ভূমিকা

ওমরকে তাঁর কাব্য পড়ে যারা Epicurean বলে অভিহিত করেন, তাঁরা পূর্ণ সত্য বলেন না। ওমরের জাব্য সাধারণত ছয় ভাগে বিভক্তঃ

১। ‘শিকায়াত-ই-রোজগার’, অর্থাৎ গ্রহের ফের বা অদৃষ্টের প্রতি অনুযোগ।

২। ‘হজও’, অর্থাৎ ভন্ডদের, বকধার্মিকদের প্রতি শ্লেষ-বিদ্রুপ ও তথাকথিত আলেম বা জ্ঞানীদের দাম্ভিকতা ও মূর্খদের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ।

৩। ‘ফিরাফিয়া’ ও ‘ওসালিয়া’, বা প্রিয়ার বিরহে ও মিলনে লিখিত কবিতা।

৪। ‘বাহরিয়া’ – বসন্ত, ফুল, বাগান, ফল, পাখি ইত্যাদির প্রশংসায় লিখিত কবিতা।

৫। ‘কুফরিয়া’ – ধর্মশাস্ত্র-বিরুদ্ধ কবিতাসমূহ। এইগুলি ওমরের শ্রেষ্ঠ কবিতারূপে কবি-সমাজে আদৃত। স্বর্গ-নরকের অলীক কল্পনা, বাহ্যিক উপাসনার অসারতা, পাপ-পুণ্যের মিথ্যা ভয় ও লাভ ইত্যাদি নিয়ে লিখিত কবিতাগুলি এর অন্তর্গত।

৬। ‘মুনাজাত’ বা খোদার কাছে প্রার্থনা। এ প্রার্থনা অবশ্য সাধারণের মতো প্রার্থনা নয়, সূফীর প্রার্থনার মতো এ হাস্য-জড়িত।

ওমরকে Epicurean কতকটা বলা যায় শুধু তাঁর ‘কুফরিয়া’- শ্রেণীর কবিতার জন্য। এছাড়া ওমর যা, তা ওমর ছাড়া আর কারুর সঙ্গেই তুলনা হয় না।

ওমরের কাব্যে শারাব-সাকির ছড়াছড়ি থাকলেও তিনি জীবনে ছিলেন আশ্চর্য রকমের সংযমী। তাঁর কবিতায় যেমন ভাবের প্রগাঢ়তা, অথচ সংযমের আঁটসাঁট বাঁধুনি, তাঁর জীবনও ছিল তেমনি।

ফিটজেরাল্ডের মুখে ঝাল খেয়ে অনেকেই বলে থাকেন, ওমর যে শারাবের কথা বলছেন তা দ্রাক্ষারস, তাঁর সাকিও রক্ত-মাংসের। ফিটজেরাল্ড তাঁর মতের পরিপোষকতার জন্য কোন প্রমাণ দেননি। তাঁর মতে মত দিয়েছেন যারা, তাঁরাও কোন প্রমাণ দিতে পারেন নি। ওমর তাঁর ‘রুবাই’-তে অবশ্য শারাব বলতে আঙ্গুরের ক্বাথ-এর উল্লেখ করেছেন; কিন্তু ওটা পারস্যের সকল কবিরই অন্তত ‘বলার জন্য বলা’র বিলাস। শারাব, সাকি, গোলাপ, বুলবুলকে বাদ দিয়ে যে কবিতা লেখা যায়, তা ইরানের কবিরা যেন ভাবতেই পারেন না।

ওমর হয়তো শারাব পান করতেন কিংবা করতেনও না। এর কোনোটাই প্রমাণ না পাওয়া পর্যন্ত সত্য বলে মেনে নেওয়া যায় না। ওমরের রুবাইয়াতের মতবাদের জন্য তাঁর দেশের তৎকালীন ধর্মগোঁড়াদের অত্যন্ত আক্রোশ ছিল, তবু তাঁকে দেশের শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী বলে সম্রাট থেকে জনসাধারণ পর্যন্ত ভক্তির চোখে দেখত। সে-যুগের শ্রেষ্ঠ মনীষীরা ওমরের ছাত্র ছিলেন; কাজেই, মনে হয়, তিনি মদ্দপ লম্পটের জীবন (ইচ্ছা থাকলেও) যাপন করতে পারেন নি। তাছাড়া, ও-ভাবে জীবন যাপন করলে গোঁড়ার দল তা লিখে রাখতেও ভুলে যেতেন না। অথচ, তাঁর সবচেয়ে বড় শত্রুও তা লিখে যাননি। সাধারণের শ্রদ্ধাভাজন হওয়ার শাস্তি তাঁকে পেতে হয়েছিল হয়তো এই ভাবেই যে, তিনি নিজের স্বাধীন ইচ্ছামতো জীবন যাপন করতে পারেননি। শারাব-সাকির স্বপ্নই দেখেছেন- তাদের ভোগ করে যেতে পারেননি। ভোগ-তৃপ্ত মনে এমন আগুন জ্বলে না। এ যে মরুভূমি-নিম্নে হয়তো বহু নিম্নে কান্নার ফল্গুধারা, ঊর্ধ্বে রৌদ্র-দগ্ধ বালুকার জ্বালা, তীব্র দাহন। ওমর যেন ম্রুভূমির বুকের খর্জূর-তরু, মরুভূমির খেজুর গাছকে দেখলে যেমন অবাক হতে হয়- ওমরকে দেখেও তেমন বিস্মিত হই। সারাদেহে কন্টকের জ্বালা, ঊর্ধ্বে রৌদ্রতপ্ত আকাশ, নিম্নে আতপ-তপ্ত বালুকা- তারি মাঝে এর রস যে পায় কেমন করে?

খেজুর গাছের মতোই ওমর এ-রস দান করেছেন নিজের হৃৎপিণ্ডকে বিদারণ করে। এ রস মিষ্ট হলেও এ তো অশ্রুজলের লবণ মেশা। খেজুর-গাছের রস যেমন তার মাথা চেঁছে বের করতে হয়, ওমর খৈয়ামের রুবাইয়াতও তেমনি বেরিয়েছে তাঁর মস্তিষ্ক থেকে। প্রায় হাজার বছর আগে এত বড় জ্ঞানমার্গী কবি কি করে জন্মাল, বিশেষ করে ইরানের মতো অনুভুতিপ্রবণ দেশে- তা ভেবে অবাক হতে হয়। ওমরকে দেখে মনে হয়, কোন বিংশ শতাব্দীর কবিও বুঝি তাঁর ঐ হাজার বছর আগে জন্মাবার জন্যই। আজকাল পৃথিবীর কোন মডার্ন কবিই তাঁর মতো মডার্ন নন, তরুণও নন। বিংশ শতাব্দীর জ্ঞান-প্রবুদ্ধ লোকও তাঁর সব মত বুঝি হজম করতে পারেন না। ওমর আজ জগতে অপরিমাণ শ্রদ্ধা পাচ্ছেন- তবু মনে হয়, আরো চার-পাঁচ শতাব্দী পরে তিনি আরো বেশি শ্রদ্ধা পাবেন- যা পেয়েছেন  তার বহু সহস্র গুণ।

ওমর তাঁর অসময়ে আসা সম্বন্ধে যে অত বেশি সচেতন ছিলেন, তা তাঁর লেখার দুঃসাহসিকতা, পৌরুষ ও গভীর আত্মবিশ্বাস দেখেই বুঝা যায়। তিনি যেন তাঁর কাছে আর সব মানুষকে অতি ক্ষুদ্র pigmy করে দেখতেন।

তিনি নিজেকে এইসব ক্ষুদ্র-জ্ঞান মানুষের, এমনকি সে-যুগের তথাকথিত শ্রেষ্ঠ জ্ঞানীগণেরও- বহু বহু ঊর্ধ্বে মনে করতেন। তিনি যেন জানতেন- তাঁর জীবনে তাঁর লেখা বুঝবার মতো লোক কেউ জন্মায়নি, ,তিনি যা লিখেছেন তা অনাগত দিনের নূতন পৃথিবীর জন্য।

ওমর সূফী ছিলেন কিনা জানিনা। কিন্তু ঐ পথের পথিক যারা, তাঁরা ওমরকে সূফী এবং খুব উঁচুদরের তাপস বলে মনে করেন। তাঁরা বলেন, সূফী জনপ্রিয়তার বা লোকের শ্রদ্ধার যুলুম এড়াবার জন্যই ঘোরতর পাপ পরিহার করেন। তাঁরা নিজেদের মদ্যপ লম্পট বলে স্বেচ্ছানির্বাসন বরণ করে নিজেরা গুপ্ত সাধনায় মগ্ন থাকেন। তাছাড়া, ইরানে কবিরা শারাবকে সকলে সত্যিকার মদ বলে ধরে নেন না। তাঁরা শারাব বলতে- ভূমানন্দকে বোঝেন- যে আনন্দ- রূপিণী সুরার নেশায় তাপস-ঋষি সংসারের সব ভুলে গিয়ে আপনাতে আপনি বিভোর হয়ে থাকেন। সাকি বলতে বোঝেন মুর্শিদকে, গুরুকে, যিনি সেই আনন্দ-শারাব পরিবেশন করেন। যাক, ও-সব তত্ত্বকথা দিয়ে আমাদের প্রয়োজন নেই, কেননা আমরা তত্ত্বজিজ্ঞাসু নই, আমরা রস-পিপাসু। ওমর কবিতা লিখেছেন, এবং তা চমৎকার কবিতা হয়েছে, আমাদের পক্ষে এই যথেষ্ট। আমরা তা পড়ে অত্যন্ত আনন্দ পাই, আমাদের এতেই আনন্দ।

আমাদের কাছে বিংশ শতাব্দীর জ্ঞান-বিজ্ঞান-পুষ্ট কারণ-জিজ্ঞাসু মনের কাছে, ওমরের কবিতা যেন আমাদেরই প্রশ্ন, আমাদেরই প্রাণের কথা। আমরা জিজ্ঞাসা করি করি করেও যেন সাহস ও প্রকাশ-ক্ষমতার দৈন্যবশত বা জিজ্ঞাসা করতে পারছিলাম না। বিগত মহাযুদ্ধের মতোই আমাদের আজকের জীবন-মহাযুদ্ধ-ক্লান্ত অবিশ্বাসী-মন জিজ্ঞাসা করে ওঠে- কেন এই জীবন, মৃত্যুই বা কেন? স্বর্গ, নরক, ভগবান বলে সত্যই কি কিছু আছে? আমরা মরে কোথায় যাই? কেন এই হানাহানি? এই অভাব, দুঃখ, শোক? –এমনিতর অগুনতি প্রশ্ন, যার উত্তর কেউ দিতে পারেনি। যে উত্তর দিয়েছে, সে তার উত্তরের প্রমাণে কিছুই দেখাতে পারেনি; শুধু বলেছে; বিশ্বাস করো! তবু আমাদের মন বিশ্বাস করতে চায় না, সে তর্ক করতে শিখেছে। এই চিরন্তন প্রশ্ন ওমরের জ্ঞান-প্রশান্ত মনে প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে ঝড়ের মতোই দোল দিয়েছিল। সেই তরঙ্গ-সংঘাতের সঙ্গীত, বিলাপ, গর্জন শুনতে পাই তাঁর রুবাইয়াতে। ওমরকে বিংশ শতাব্দীর মানুষের ভালো-লাগার কারণ এই।

ওমর বলতে চান, এই প্রশ্নের হাত এড়াবার জন্য কত অবতার পয়গম্বর এলেন, তবু যে প্রশ্ন সে প্রশ্নই র‍য়ে গেল। মানুষের দুঃখ এক তীলও কমল না। ওমর তাই বললেন, এ-সব মিথ্যা, পৃথিবী মিথ্যা, পাপ-পুণ্য মিথ্যা, তুমি মিথ্যা, আমি মিথ্যা, সত্য মিথ্যা, মিথ্যা মিথ্যা। একমাত্র সত্য- যে মুহূর্ত তোমার হাতের মুঠোয় এলো তাকে চুটিয়ে ভোগ করে নাও। স্রষ্টা যদি কেউ থাকেনও, তিনি আমাদের দুঃখে-সুখে নির্বিকার- আমরা তাঁর হাতের খেলা-পুতুল। সৃষ্টি করছেন ভাঙছেন তাঁর খেয়াল-মতো, তুমি কাঁদলেও যা হবে, না কাঁদলেও তাই হবে, যা হবার তা হবেই। যে মরে গেল, সে একেবারেই মরে গেল; সে আর আসবেও না বাঁচবেও না। তাঁর পাপ-পুণ্য স্রষ্টারই আদেশ- তাঁর খেলা জমাবার জন্য। মোট কথা, স্রষ্টা একটা বিরাট খেয়ালি শিশু বা ঐন্দ্রজালিক।

আমি ওমরের রুবাইয়াৎ বলে প্রচলিত প্রায় এক হাজার রুবাই থেকেই কিঞ্চিদধিক দুশো রুবাই বেছে নিয়েছি; এবং তা ফারসি ভাষার রুবাইয়াৎ থেকে। কারণ, আমার বিবেচনায় এইগুলি ছাড়া বাঁকি রুবাই ওমরের প্রকাশভঙ্গি বা স্টাইলের সঙ্গে একেবারে মিশ খায় না। রবীন্দ্রনাথের কবিতার পাশে আমার মতো কবির কবিতার মতো তা একেবারে বাজে। বাকিগুলিতে ওমর খৈয়ামের ভাব নেই, ভাষা নেই, গতি ঋজুতা- এ কথায় স্টাইলের কোনো কিছু নেই। খুব সম্ভব ওগুলি অন্য-কোনো পদ্য-লিখিয়ের লেখা। আর, তা যদি ওমরেরই হয়, তবে তা অনুবাদ করে পণ্ডশ্রম করার দরকার নেই। বাগানের গোলাপ তুলব; তাই বলে বাগানের আগাছাও তুলে আনতে হবে এর কোনো মানে নেই।

আমি আমার ওস্তাদি দেখাবার জন্য ওমর খৈয়ামের ভাব ভাষা বা স্টাইলকে বিকৃত করিনি- অবশ্য আমার সাধ্যমতো। এর জন্য আমার অজস্র পরিশ্রম করতে হয়েছে, বেগ পেতে হয়েছে। কাগজ-পেন্সিলের, যাকে বলে আদ্যশ্রাদ্ধ, তা-ই করে ছেড়েছি। ওমরের রুবাইয়াতের সবচেয়ে বড় জিনিস ওঁর প্রকাশের ভঙ্গি বা ঢং। ওমর আগাগোড়া মাতালের ‘পোজ’ নিয়ে তাঁর রুবাইয়াৎ লিখে গেছেন- মাতালের মতোই ভাষা, ভাব, ভঙ্গি, শ্লেষ, রসিকতা, হাঁসি, কান্না- সব। কত বৎসর ধরে কত বিভিন্ন সময়ে তিনি এই কবিতাগুলি লিখেছেন, অথচ এর স্টাইল সম্বন্ধে কখনো এতটুকু চেতনা হারাননি। মনে হয় একদিনে বসে লেখা। আমি আমার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি- ওমরের সেই ঢংটির মর্যাদা রাখতে, তাঁর প্রকাশভঙ্গিকে যতটা পারি কায়দায় আনতে। কতদূর সফল হয়েছি, তা ফারসি-নবিশরাই বলবেন।

ওমর খৈয়ামের ভাবে অনুপ্রাণিত ফিটজেরাল্ডের কবিতায় যারা অনুবাদ করেছেন, তাঁরা সকলেই আমার চেয়ে শক্তিশালী ও বড় কবি। কাজেই তাঁদের মতো মিষ্টি শোনাবে না হয়তো আমার এ অনুবাদ। যদি না শোনায়, সে আমার শক্তির অভাব- সাধনার অভাব, কেননা কাব্য-লোকের গুলিস্থান থেকে সঙ্গীতলোকের রাগিণী-দ্বীপে আমার দ্বীপান্তর হয়ে গেছে। সঙ্গীত-লহ্মী দুই বোন বলেই বুঝি ওদের মধ্যেই এত রেষারেষি। একজনকে পেয়ে গেলে আরেকজন বাপের বাড়ি চলে যান। দুইজনকে খুশি করে রাখার মতো শক্তি রবীন্দ্রনাথের মতো লোকেরই আছে। আমার সে সম্বলও  নেই, শক্তিও নেই। কাজেই, আমার অক্ষমতার দরুন কেউ যেন পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি ওমরের উপর চটে না যান।

ওমরের রুবাইয়াৎ বা চতুষ্পদী কবিতা চতুষ্পদী হলেও তার চারটি পদই ছুটেছে আরবি ঘোড়ার মতো দৃপ্ত তেজে সম-তালে-ভন্ডামি, মিথ্যা বিশ্বাস, কুসংস্কার, বিধি-নিষেধের পথে ধূলি উড়িয়ে তাদের বুক চূর্ণ করে। সেই উচ্চৈঃশ্রবা আমার হাতে পড়ে হয়তো বা বজদ্দি মোড়লের ঘোড়াই হয়ে উঠেছে- আমাদের গ্রামের কাছে এক জমিদার ছিলেন, তাঁর নাম বজদ্দি মোড়ল। তাঁর এক বাগ-না-মানা ঘোড়া ছিল, সে জাতে অশ্ব হলেও গুণে অশ্বতর ছিল। তিনি যদি মনে করতেন পশ্চিম দিকে যাবেন, ঘোড়া যেত পূর্ব দিকে। ঘোড়াকে কিছুতেই বাগ মানাতে না পেরে শেষে বলতেন- ‘আচ্ছা চল, এদিকেও আমার জমিদারি আছে।‘

ওমরের বোররাক বা উচ্চৈঃশ্রবাকে আমার মতো আনাড়ি সওয়ার যে বাগ মানাতে পারবে, সে ধৃষ্টতা আমার নেই। তবে উক্ত বজদ্দি মোড়লের মতো সে ঘোড়াকে তার ইচ্ছামতো পথেও যেতে দিইনি। লাগাম ক্ষে প্রাণপণ বাধা দিয়েছি, যাতে সে অন্য পথে না যায়। অবশ্য মাঝে মাঝে পড়ব-পড়ব অবস্থাও যে হয়েছে, তা স্বীকার করতে আমার লজ্জা নেই। তবে এটুকু জোড় করে বলতে পারি, তাঁর ঘোড়া আমার হাতে পড়ে চতুষ্পদী ভেড়াও হয়ে যায়নি- প্রাণহীন চার-পায়াও হয়নি। আমি ন্যাজ মলে মলে ওর অন্তত তেজটুকু নষ্ট করিনি। ওর মতো ‘ছার্তক’ (সার্থক?) না হতে পারলেও অন্তত ‘কদমে’ চালাবার কিছু চেষ্টা করেছি।

যাক, অনেক বকা গেল; এর জন্য যারা আমাকে দোষ দেবেন- তাঁরা যেন আমার দোষ দেবার আগে খৈয়ামের শারাবকে দোষ দেন। এর নামেই এতো নেশা, পান করলে না জানি কি হয়, হয়তো-বা ওমর খৈয়ামই হয়। অবশ্য আমরা খেলে এই রকম বখামি করি, ওমর খেলে রুবাইয়াৎ লেখেন।

এইবার কৃতজ্ঞতা নিবেদনের পালা। খাওয়ানোর শেষে, বিনয় প্রকাশের মতো। না করলেও হয়, তবু দেশের রেওয়াজ মেনে চলতেই হবে।

আমার বহুকালের পুরোনো বন্ধু মৌলবি মঈনউদ্দীন হোসায়ন সাহেব এর সমস্ত কিছু সরবরাহ না করলে হয়তো আমি কোনদিনই এ শেষ করতে পারতাম না। তাঁর কাছে আমি এজন্য চির-ঋণী। শ্রীমান আব্দুল মজিদ সাহিত্য-রত্নও যথেষ্ট সাহায্য করেছেন আমার প্রয়োজনীয় বই সংগ্রহ করে দেওয়ার জন্য। এঁদের দু’জনারই নাম আছে সাহিত্যে, কাজেই কেবল আমার বই-এ নাম থাকার জন্য এঁরা পরিচিত হবেন না। আমার সাহায্য করার মতি এঁদের অটল থাক, এই-ই প্রার্থনা।

(১)

রাতের আঁচল দীর্ণ করে আসল শুভ ঐ প্রভাত,

জাগো সাকি! সকাল বেলার খোঁয়ারি ভাঙ্গো আমার সাথ।

ভোলো ভোলো বিষাদ-স্মৃতি! এমনি প্রভাত আসবে ঢের,

খুঁজতে মোদের এইখানে ফের, করবে করুণ নয়নপাত।

(২)

আঁধার অন্তরীক্ষ বুনে যখন রুপার পাড় প্রভাত,

পাখির বিলাপ-ধ্বনি কেন শুনি তখন অকস্মাৎ।

তারা যেন দেখতে বলে উজল প্রাতের আরশিতে-

ছন্নছাড়া তোর জীবন কাটল কেমন একটি রাত।

(৩)

ঘুমিয়ে কেন জীবন কাটাস? কইল ঋষি স্বপ্নে মোর,

আনন্দ-গুল প্রস্ফুটিত করতে পারে কি ঘুম তোর।

ঘুম মৃত্যুর জমজ ভ্রাতা, তার সাথে ভাব করিসনে,

ঘুম দিতে ঢের পাবি সময় করবে তোর জনম ভোর।

(৪)

আমার আজের রাতের খোরাক তোর টুকটুক শিরিন ঠোঁট,

গজল শোনাও, শিরাজি দাও, তন্বী সাকি জেগে ওঠ।

লাজ-রাঙ্গা তোর গালের মতো দে গোলাপি রং শারাব,

মনে ব্যথার বিনুনি মোর খোঁপায় যেমন তোর চুনোট।

(৫)

প্রভাত হলো। শারাব দিয়ে করব সতেজ হৃদয়-পুর,

যশোখ্যাতির ঠুনকো এ কাচ করব ভেঙ্গে চাখনাচুর।

অনেক দিনের সাধ ও আশা এক নিমিষে করব ত্যাগ,

পরব প্রিয়ার বেণী বাঁধন, ধরব বেণুর বিধুর সুর।

(৬)

ওঠো, নাচো! আমরা প্রচুর করবো তারিফ মদ-অলস

ঐ নার্গিস-আঁখির তোমার, ঢালবে তুমি আঙ্গুর-রস!

এমন কি আর- যদিই তাহা পান করি দশ বিশ গেলাশ,

ছয় দশে ষাট পাত্র পড়লে খানিকটা হয় দিল সরস।

(৭)

তোমার রাঙ্গা ঠোঁটে আছে অমৃত-কূপ প্রাণ-সুধার,

ঐ পিয়ালার ঠোঁট যেন গো ছোঁয় না, প্রিয়া, ঠোঁট তোমার।

ঐ পিয়ালার রক্ত যদি পান না করি, শাপ দিও;

তোমার অধর স্পর্শ করে এত বড় স্পর্ধা তার।

(৮)

আজকে তোমার গোলাপ-বাগে ফুটল যখন রঙ্গিন গুল

রেখো না পান-পাত্র বেকার, উপচে পড়ুক সুখ ফজুল।

পান করে নে, সময় ভীষণ অবিশ্বাসী, শত্রু ঘোর,

হয়তো এমন ফুল-মাখানো দিন পাবি ন আজের তুল!

(৯)

শারাব আনো! বক্ষে আমার খুশির তুফান দেয় যে দোল।

স্বপ্ন চপল ভাগ্যলহ্মী জাগল, জাগো ঘুম-বিভোল।

মোদের শুভদিন চলে যায় পারদ সম ব্যস্ত পায়

যৌবনের এই বহ্নি নিভে খোঁজে নদীর শীতল কোল!

(১০)

আমরা পথিক ধূলির পথের, ভ্রামি শুধু একটি দিন,

লাভের অঙ্ক হিসাব করে পাই শুধু দুখ, মুখ মলিন।

খুঁজতে গিয়ে এই জীবনের রহস্যের কূল বৃথাই

অপূর্ণ সাধ আশা লয়ে হবোই মৃত্যুর অঙ্কলীন।

(১১)

ধরায় প্রথম এলাম নিয়ে বিস্ময় আর কৌতূহল,

তারপর- এ জীবন দেখি কল্পনা, আঁধার অতল।

ইচ্ছা থাক কি না থাক, শেষে যেতেই হবে, তাই বলি-

এই যে জীবন আসা-যাওয়া আঁধার ধাঁধার জট কেবল।

(১২)

রহস্য শোন সেই সে লোকের আত্মা যথায় বিরাজে,

ওরে মানব! নিখিল সৃষ্টি লুকিয়ে আছে তোর মাঝে।

তুই-ই মানুষ, ,তুই-ই পশু, দেবতা দানব স্বর্গদূত,

যখন হতে চাইবি রে যা হতে পারিস তুই তা যে।

(১৩)

স্রষ্টা যদি মত নিত মোর-আসতাম না প্রাণান্তেও

এই ধরাতে এসে আবার যাবার ইচ্ছা নেই মোটেও।

সংক্ষেপে কই, চিরতরে নাশ করতাম সমূলে

যাওয়া-আসা জন্ম আমার, সেও শূন্য শুন্য এও!

(১৪)

আত্মা আমার! খুলতে যদি পারতিস এই অস্থিমাস

মুক্ত পাখার দেবতা সম পালিয়ে যেতিস দূর আকাশ।

লজ্জা কি তোর হলো না রে, ছেড়ে তোর ঐ জ্যোতির্লোক

ভিন-দেশি প্রায় বাস করতে এলি ধরার এই আবাস?

(১৫)

সকল গোপন তত্ত্ব জেনেও পার্থিব এই আবহাওয়ার

মিথ্যা ভয়ের ভয় গেল না? নিত্য ভয়ের হও শিকার?

জানি স্বাধীন ইচ্ছামতো যায় না চলা এই ধরায়,

যতটুকু সময় তবু পাও হাতে, লও সুযোগ তায়।

(১৬)

ব্যথায় শাস্তি লাভের তরে থাকত যদি কোথাও স্থান

শ্রান্ত পথের পথিক মোরা সেথায় জুড়াতাম এ প্রাণ।

শীত-জর্জর হাজার বছর পরে নবীন বসন্তে

ফুলের মতো উঠত ফুটে মোদের জীবন-মুকুল ম্লান।

(১৭)

বুলবুলি এক হালকা পাখায় উঠে যেতে গুলিস্থান,

দেখল হাসিখুশি ভরা গোলাপ লিলির ফুল-বাথান।

আনন্দে সে উঠল গাহি, ‘মিটিয়ে নে সাধ এই বেলা,

ভোগ করতে এমন দিন আর পবিনে তুই ফিরিয়ে প্রাণ।‘

(১৮)

রূপ-মাধুরীর মায়ায় তোমার যেদিন পারো, লো প্রিয়া,

তোমার প্রেমিক বধূর ব্যথা হরণ করো প্রেম দিয়া।

রূপ-লাবনীর সম্ভার এই রইবে না সে চিরকাল,

ফিরবে না আর তোমার কাছে যায় যদি বিদায় নিয়া।

(১৯)

সাকি! আনো আমার হাতে মদ-পেয়ালা, ধরতে দাও!

প্রিয়ার মতন ও মদ-মদির সুরত-ওয়ালি বরতে দাও!

জ্ঞানী ও অজ্ঞানীরে বেঁধে যা দেয় গাঁটছড়ায়,

সেই শারাবের শিকল, সাকি, আমায় খালি পরতে দাও!

(২০)

নীল আকাশের নয়ন ছেপে বাদল-অশ্রুজল ঝড়ে,

না পেলে আজ এই পানীয় ফুটত না ফুল বন ভরে।

চোখ জুড়াল আমার যেমন আজ এ ফোটা ফুলগুলি,

মোর কবরে ফুটবে যে ফুল- কে জানে হায় কার তরে!

(২১)

করব এতই শিরাজি পান পাত্র এবং পরান ভোর

তীব্র মিঠে খোশবো তাহার উঠবে আমার ছাপিয়ে গোর।

থমকে যাবে চলতে পথিক আমার গোরের পাশ দিয়ে,

ঝিমিয়ে শেষে পড়বে নেশায় মাতাল-করা গন্ধে ওর।

(২২)

দেখতে পাবে যেথায় তুমি গোলাপ লালা ফুলের ভিড়,

জেনো, সেথায় ঝরেছিল কোনো শাহানশার রুধির।

নার্গিস আর গুল-বনোসার দেখবে যেথায় সুনীল দল,

ঘুমিয়ে আছে সেথায়- গালে তিল ছিল সে সুন্দরীর।

(২৩)

নিদ্রা যেতে হবে গোরে অনন্তকাল, মদ পিও।

থাকবে নাকো সাথী সেথায় বন্ধু প্রিয় আত্মীয়।

আবার বলতে আসব না ভাই, বলছি যা তা রেখো শুনে-

ঝরেছে যে ফুলের মুকুল্‌ ফুটতে পারে আর কি ও?

(২৪)

বিদায় নিয়ে আগে যারা গেছে চলে, হে সাকি!

চির-ঘুমে ঘুমায় তারা মাটির তলে, হে সাক!

শারাব আনো, আসল সত্য আমার কাছে যাও শুনে,

তাঁদের যত তথ্য গেল হাওয়ায় গলে, হে সাকি!

(২৫)

তুমি আমি জন্মিনিকো- যখন শুধু বিরামহীন

নিশীথিনীর গলা ধরে ফিরত হেথায় উজল দিন,-

বন্ধু, ধীরে চরণ ফেলো! কাজল-আঁখি সুন্দরীর

আঁখির তারা আছে হেথায় হয়তো ধূলির অঙ্কলীন!

(২৬)

প্রথম থেকেই লেখা আছে অদৃষ্টে তোর যা হবার,

তাঁর সে কলম দিয়ে- যিনি দুঃখে সুখে নির্বিকার।

স্রেফ বোকামি কান্নাকাটি, লড়তে যাওয়া তার সাথে,

বিধির লিখন ললাট-লিপি টলবে না যা জন্মে আর!

(২৭)

ভালো করেই জানি আমি, আছে এক রহস্য-লোক,

যায় না বলা সকলকে তা ভালোই হোক কি মন্দ হোক।

আমার কথা ধোঁয়ায় ভরা, ভাঙতে তবু পারব না –

থাকিস সে কোন গোপন-লোকে, দেখতে যাহা পায় না চোখ।

(২৮)

চলবে নাকো মেকি টাকার কারবার আর, মোল্লাজি!

মোদের আবাস সাফ করে নেয় শেয়ান-ঝাড়ুর কারসাজি।

বেরিয়ে ভাঁটিখানার থেকে বলল হেঁকে বৃদ্ধ পীর –

‘অনন্ত ঘুম ঘুমাবি কাল, পান করে নে মদ আজি!’

(২৯)

সবকে পারি ফাঁকি দিতে মনকে পারি ঠারতে চোখ,

খোদার উপর খোদকারিতে ব্যর্থ হয় এ মিছে স্তোক।

তীক্ষ্ম বুদ্ধি দিয়ে জাল বুনিলাম চাতুর্যের,

মুহূর্তে তা দিল ছিঁড়ে হিংস্র নিয়তির সে নোখ!

(৩০)

মৃত্তিকা লীন হবার আগে নিয়তির নিঠুর করে

বেঁচে নে তুই, মৃত্যু-পাত্র আসছে রে ঐ তোর তরে!

হেথায় কিছু যোগার করে নে রে, হোথায় কেউ সে নাই

তাঁদের তরে- শূন্য হাতে যার যাহারা সেই ঘরে।

(৩১)

বলতে পারে, অসার শূন্য ভবের হাটের এই ঘরে

জ্ঞান-বিলাসী সুধীজনের হৃদয় কেন রয় পড়ে?

যেই তাহারা শ্রান্ত হয়ে এই সে ঘরের শান্তি চায়,

‘সময় হলো, চল ওরে’, কয় অমনি মরণ হাত ধরে!

(৩২)

খাজা! তোমার দরবারে মোর একটি শুধু আর্জি এই-

থামাও উপদেশের ঘটা, মুক্তি আমার এই পথেই।

দৃষ্টি-দোষে দেখছ বাঁকা আমার সোজা সরল পথ,

আমায় ছেড়ে ভালো করো ঝাপসা তোমার চক্ষুকেই।

(৩৩)

কাল কি হবে কেউ জানে না, দেখছ তো, হায়, বন্ধু মর।

নগদ মধু লুট করে লও, মোছো মোছো অশ্রুলোর।

চাঁদনি-তরল শারাব পিও, হায়, সুন্দর এই সে চাঁদ

দীপ জ্বালিয়ে খুঁজবে বৃথাই কাল এ শূন্য ধরার ক্রোড়।

(৩৪)

প্রেমিকরা সব আমার মতো মাতুক প্রেমের মত্ততায়,

দ্রাক্ষা-রসের দীক্ষা নিয়ে আচার-নীতি দলুক পায়।

থাকি যখন শাদা চোখেদ, সব কথাতেই রুষ্ট হই;

শারাব পিয়ে দিল-দরিয়া উড়িয়া দি ভয়-ভাবনামূ।

(৩৫)

মানব-দেহ-রঙ্গে-রূপে এই অপরূপ ঘরখানি-

স্বর্গের সে শিল্পী কেন করল সৃজন কি জানি,

এই ‘লালা-রুখ’ বল্লী-তনু ফুল্ল-কপোল তন্বীদের

সাজাতে হায় ভঙ্গুর এই মাটির ধরায় ফুলদানি।

(৩৬)

তিন ভাগ জল এক ভাগ থল, এই পৃথিবীর এও মায়া,

এই ধরাতে দেখছ যা তার সকল-কিছু সব মায়া,

এই যে তুমি বলছ যা সব, শুনছ কলরব মায়া।

গোপন প্রকাশ সত্য মিথ্যা এ সব অবাস্তব মায়া।

(৩৭)

দোষ দেয় আর ভৎসে সবাই আমার পাপের নাম নিয়া,

আমার দেবী প্রতিমারে পূজি তবু প্রাণ দিয়া।

মরতে যদি হয় গো আমার শারাব পানের মজলিশে-

স্বর্গ-নরক সমান, পাশে থাকবে শারাব আর প্রিয়া।

(৩৮)

মুসাফিরের এক রাত্রি পান্থ-বাস এ পৃথ্বীতল-

রাত্রি-দিবার চিত্রলেখা চন্দ্রাতপ আঁধার-উজল।

বসল হাজার জামশেদ ঐ উৎসবেরই আঙ্গিনায়

লাখ বাহরাম এই আসনে বসে হলো বেদখল।

(৩৯)

কারুর প্রাণে দুখ দিও না, করো বরং হাজার পাপ,

পরের মনের শান্তি নাশি বাড়িও না তার মনস্তাপ।

অমর আশিস লাভের আশা রয় যদি, হে বন্ধু মোর,

আপনি সয়ে ব্যথা, মুছো পরের বুকের ব্যথার ছাপ।

(৪০)

ছেড়ে দে তুই নীরস বাজে দর্শন শাস্ত্রপাঠ,

তার চেয়ে তুই দর্শন কর প্রিয়ার বিনোদ বেণীর ঠাট;

ঐ সোরাহির হৃদয়-রুধির নিষ্কাশিয়া পাত্রে ঢাল,

কে জানে তোর রুধির পিয়ে কখন মৃত্যু হয় লোপাট।

(৪১)

অজ্ঞানেরই তিমির তলের মানুষ ওরে বে-খবর!

শূন্য তোরা, বুনিয়াদ তোর গাঁথা শূন্য হাওয়ার পর।

ঘুরিস তরল অগাধ খাদে, শূন্য মায়ার শূন্যতায়,

পশ্চাতে তোর অতল শূন্য, অগ্রে শূন্য অসীম চর।

(৪২)

লয়ে শারাব-পাত্র হাতে পিই যবে তা মস্ত হয়ে

জ্ঞানহারা হই সেই পুলকের তীব্র ঘোর বেদন সয়ে,

কি যেন এক মন্ত্র-বলে যায় ঘটে কি অলৌকিক,

প্রোজ্জ্বল মোর জ্ঞান গলে যায় ঝর্নাসম গান বয়ে।

(৪৩)

‘শারাব ভীষণ খারাপ জিনিস, মদ্যপায়ীর নেইকো ত্রাণ।‘

ডাইনে বাঁয়ে দোষদর্শী সমালোচক ভয় দেখান-

সত্য কথাই! যে আঙ্গুরে, নষ্ট করে ধর্মমত,

সবার উচিৎ- নিঙরে ওরে করে উহার রক্তপান।

(৪৪)

আমার কাছে শোন উপদেশ- কাউকে কভু বলিসনে-

মিথ্যা ধরায় কাউকে প্রাণের বন্ধু মেনে চলিসনে।

দুঃখ ব্যথায় টলিসনে তুই, খুঁজিসনে তার প্রতিষেধ,

চাসনে ব্যথার সমব্যথী, শির উঁচু রাখ ঢলিসনে।

(৪৫)

মউজ চলুক। লেখার যা তা লিখল ভাগ্য কালকে তোর,

ভুলেও কেহ পুঁছল না কি থাকতে পারে তোর ওজর।

ভদ্রতারও অনুমতি কেউ নিল না অমনি ব্যস

ঠিকঠাক সব হয়ে গেল ভুগবি কেমন জীবন-ভোর।

(৪৬)

আমি চাহি, স্রষ্টা আমার সৃজন করুণ শ্রেষ্ঠতর

আকাশ ভুবন, এই এখনি এই সে আমার আঁখির পর;

সেই সাথে চাই-সৃষ্টি-খাতায় দিক কেটে সে আমার নাম,

কিংবা আমার যা প্রয়োজন তা মিটাবার দিক সে বর।

(৪৭)

নাস্তিক আর কাফের বলো তোমার লয়ে আমার নাম,

কুৎসা গ্লানির পঙ্কিল স্রোত বহাও হেথা অবিশ্রাম।

অস্বীকার তা করব না যা ভুল করে যাই, কিন্তু ভাই,

কুৎসিত এই গালি দিয়েই তোমরা যাবে স্বর্গধাম?

(৪৮)

বদখশানি রক্ত চুনির মতন সুরা ছুঁইয়ে আন

তপ্ত হিয়ার আনন্দ যা, শাস্ত্র যাহে দগ্ধ প্রাণ।

মুসলমানের তরে শারাব হারাম না কি, সবাই কয়,

বলতে পার তাদের কেহ-আছে কি আর মুসলমান?

(৪৯)

মসজিদ মন্দির গির্জায় ইহুদ-খানায় মাদ্রাসায়

রাত্রি-দিবস নরক-ভীতি স্বর্গ-সুখের লোভ দেখায়।

ভেদ জানে আর খোঁজ রাখে ভাই খোদার যারা রহস্যের

ভোলে না এই খোশ গল্পের ঘুম-পাড়ানো কল্পনায়।

(৫০)

এক হাতে মোর তসবি খোদার, আর হাতে মোর লাল গেলাস,

অর্ধেক মোর পুণ্য-স্নাত, অর্ধেক পাপে করল গ্রাস।

পুরোপুরি কাফের নহি, নহি খাঁটি মুসলিমও-

করুণ চোখে হেরে আমায় তাই ফিরোজা নীল আকাশ।

(৫১)

একমণি ঐ মদের জালা গিলব, ,যদি পাই তাকে,

যে জালাতে প্রাণের জ্বালা নেভাবার ওষুধ থাকে!

পুরানো ঐ যুক্তি-তর্কে দিয়ে আমি তিন তালাক,

নতুন করে করব নিকাহ আঙ্গুর-লতার কন্যাকে।

(৫২)

বিষাদের ঐ সওদা নিয়ে বেড়িয়ো না ভাই শিরোপরি,

আঙ্গুর-কন্যা সুরার সাথে প্রেম করে যাও প্রাণ ভরি।

নিষিদ্ধা ঐ কন্যা, তবু হোক সে যতই অ-সতী,

তাহার সতী মায়ের চেয়ে ঢের বেশি সে সুন্দরী।

(৫৩)

স্বর্গে পাব শারাব সুধা, এ যে কড়ার খোদ খোদার,

ধরায় তাহা পান করলে পাপ হয় এ কোন বিচার?

হামজা সাথে বেয়াদবি করল মাতাল এক আরব,-

তুচ্ছ কারণ- শারাব হারাম তাই হুকুমে মোস্তফার।

(৫৪)

রজব শাবান পবিত্র মাস বলে গোঁড়া মুসলমান,

সাবধান, এই দু’মাস ভাই কেউ কোরো না শারাব পান।

খোদা এবং তাঁর রসূলের রজব শাবান এই দু’মাস

পান পিয়াসার তরে তবে সৃষ্ট বুঝি এ রমজান।

(৫৫)

শুক্রবার আজ, বলে সবাই পবিত্র নাম জুম্মা যার,

হাত যেন ভাই খালি না যায়, শারাব চলুক আজ দেদার।

এক পেয়ালি শারাব যদি পান করো ভাই অন্য দিন,

দু পেয়ালি পান করো আজ বারের বাদশা জুম্মাবার।

(৫৬)

মসজিদের অযোগ্য আমি, গির্জার আমি শত্রু-প্রায়;

ওগো প্রভু, কোন মাটিতে করলে সৃজন এই আমায়?

সংশয়াত্মা সাধু কিংবা ঘৃণ্য নগর-নারীর তুল

নাই স্বর্গের আশা আমার, শান্তি নাহি এই ধরায়।

(৫৭)

মুগ্ধ করো নিখিল হৃদয় প্রেম নিবেদন কৌশলে,

হৃদয় জয়ী হে বীর, উড়াও নিশান প্রিয়ার অঞ্চলে।

এক হৃদয়ের সমান নহে লক্ষ মসজিদ আর ‘কাবা’;

কি হবে তোর তীর্থে ‘কাবা’র, শান্তি খোঁজ হৃদয়-তলে।

(৫৮)

বিধর্মীদের ধর্মপথে আসতে লাগে এক নিমেষ,

সন্দেহেরই বিপথ-ফেরত বিবেক জাগে এক নিমেষ।

দুর্লভ এই নিমেষটুকু ভোগ করে নাও প্রাণ ভরে,

এই ক্ষণিকের আয়েশ দিয়ে জীবন ভাসে এক নিমেষ।

(৫৯)

হৃদয় যাদের অমর প্রেমের জ্যোতির্ধারায় দীপ্তিমান,

মসজিদ মন্দির গির্জা, যথাই করুক অর্ঘ্য দান-

প্রেমের খাতায় থাকে লেখা অমর হয়ে তাঁদের নাম,

স্বর্গের লোভ ও নরক-ভীতির ঊর্ধ্বে তারা মুক্ত-প্রাণ।

(৬০)

মদ পিও আর ফুর্তি করো- আমার সত্য আইন এই!

পাপ পুণ্যের খোঁজ রাখি না- স্বতন্ত্র মোর ধর্ম সেই।

ভাগ্য সাথে বিয়ের দিনে কইনু, ‘দিব কি যৌতুক?’

কইল বধূ, ‘খুশি থাকো, তার বড় যৌতুক সে নেই।‘

(৬১)

এক সোরাহি সূরা দিও, একটু রুটির ছিলকে আর,

প্রিয় সাকি, তাহার সাথে একখানি বই কবিতার,

জীর্ণ আমার জীবন জুড়ে রইবে প্রিয়া আমার সাথ,

এই যদি পাই চাইবো নাকো তখত আমি শাহানশার।

(৬২)

হুরি বলে থাকলে কিছু- একটি হুরি মদ খানিক

ঘাস-বিছানো ঝর্নাতীরে, অল্প-বয়েস বৈতালিক-

এই যদি পাস, স্বর্গ নামক পুরনো সেই নরকটায়

চাসনে যেতে, স্বর্গ ইহাই, স্বর্গ যদি থাকেই ঠিক।

(৬৩)

যতক্ষণ এ হাতের কাছে আছে অঢেল লাল শারাব

গেহুঁর রুটি, গরম কোর্মা, কালিয়া আর শিক-কাবাব,

আর লালা-রুখ, প্রিয়া আমার কুটির-শয়ন-সঙ্গিনী,-

কোথায় লাগে শাহানশাহের দৌলৎ ঐ বে-হিসাব।

(৬৪)

দোষ দিও না মদ্যপায়ীর তোমরা, যারা খাও না মদ;

ভালো করার থাকলে কিছু, মদ খাওয়া মোর হতো রদ।

মদ না পিয়েও, হে নীতিবিদ, তোমরা যে-সব  করো পাপ,

তাহার কাছে আমরাও শিশু, হই না যতই মতাল-বদ!

(৬৫)

খুশি-মাখা পেয়ালাতে ঐ গোলাপ-রক্ত-মধুর!

মধুরতর পাখির গীতি, বেণুর ধ্বনি, বীণার সুর।

কিন্তু ঐ যে ধর্মগোঁড়া- বুঝল না যে মদের স্বাদ,

মধুরতম- রয় সে যখন অন্তত পাঁচ-যোজন দূর!

(৬৬)

চৈতী-রাতে খুঁজে নিলাম তৃণাস্ত্রিত ঝর্না-তীর,

সুন্দরী এক হুরি নিলাম, পেয়ালা নিলাম লাল পানির।

আমার নামে বইল হাজার কুৎসা গ্লানির ঝড়-তুফান,

ভুলেও মনে হলো না মোর স্বর্গ নরকের নজির।

(৬৭)

সাকি-হীন ও শারাব-হীনের জীবনে, হায়, সুখ কি বল?

নাই ইরাকি বেণুর ধ্বনির জমজমাটি সুর-উছল

সুখ নাই ভাই সেথায় থেকে; এই জগতের তত্ত্ব শোন,

আনন্দহীন জীবন-বাগে ফলে শুধু তিক্ত ফল।

(৬৮)

মরুর বুকে বসাও মেলা, উপনিবেশ আনন্দের,

একটি হৃদয় খুশি করা তাহার চেয়ে মহৎ ঢের।

প্রেমের শিকল পড়িয়ে যদি বাঁধতে পারো একটি প্রাণ-

হাজার বন্দি মুক্ত করার চেয়েও অধিক পুণ্য এর।

(৬৯)

শারাব এবং প্রিয়ার নিয়ে, সাকি, হেথায় এলাম ফের!

তৌবা করেও পাইনে রেহাই হাত হতে ভাই এই পাপের।

‘নূহ’ আর তাঁর প্লাবন-কথা শুনিয়ো নাকো আর, সাকি,

তার চেয়ে মদ-প্লাবন এনে ডুবাও ব্যথা মোর বুকের!

(৭০)

নৃত্য-পাগল ঝর্নাতীরে সবুজ ঘাসের ঐ ঝালর

উন্মুখ কার চুমো যেন দেব-কুমারের ঠোঁটের পর-

হেলায় পায়ে দলো না কেউ- এই যে সবুজ তৃণের ভিড়

হয়তো কোনো গুল-বদনীর কবর-ঢাকা নীল চাদর।

(৭১)

আমার ক্ষণিক জীবন হেথায় যায় চলে ঐ ত্রস্ত পায়

খরস্রোতা স্রোতাস্বতী কিংবা মরু-ঝঞ্জা প্রায়।

তারি মাঝে এই দু’দিনের খোঁজ রাখি না- ভাবনা নাই,

যে গত-কাল গত, আর যে আগামী-কাল আসতে চায়।

(৭২)

আর কতদিন সাগর-বেলায় খামকা বসে তুলব ইট!

গড় করি পায়, ধিক লেগেছে গড়ে গড়ে মূর্তি পীঠ।

ভেবো নাকো-খৈয়াম ঐ জাহান্নামের বাসিন্দা,

ভিতরে সে স্বর্গ-চারী, বাহিরে সে নরক-কীট।

(৭৩)

মধুর, গোলাপ-বালার গালে দখিন হাওয়ার মদির শ্বাস,

মধুর, তোমার রূপের কুহক মাতায় যা এই পুষ্পবাস।

যে গেছে কাল গেছে চলে, এলোনা তার ম্লান স্মৃতি,

মধুর আজের কথা বলো, ভোগ করে নাও এই বিলাস।

(৭৪)

শীত ঋতু ঐ হলো গত, বইছে বায় বসন্তেরি,

জীবন-পুঁথির পাতাগুলি পড়বে ঝরে, নাই দেরি।

ঠিক বলেছেন দরবেশ এক, ‘দূষিত বিষ এই জীবন,

দ্রাক্ষার রস বিনা ইহার প্রতিষেধক নাই, হেরি।‘

(৭৫)

‘সরো’র মতন সরল তনু টাটকা-তোলা গোলাপ-তুল,

কুমারীদের সঙ্গে নিয়ে আনন্দে তুই হ মশগুল।

মৃত্যুর ঝড় উঠবে কখন, আয়ুর পিরান ছিঁড়বে তোর-

পড়ে আছে ধুলায় যেমন ঐ বিদীর্ণ-দল মুকুল!

(৭৬)

পল্লবিত তরুলতা কতই আছে কাননময়,

দেওদার আর থলকমলে, জানো কেন মুক্ত কয়?

দেবদারু তরুর শত কর, তবু কিছু চায় না সে;

থলকমলীর দশ রসনা, তবু সদা নীরব রয়।

(৭৭)

আমার সাথী সাকি জানে মানুষ আমি কোন জাতের;

চাবি আছে তার আঁচলে আমার বুকের সুখ-দুখের।

যেমনি মেজাজ মিইয়ে আসে গেলাশ ভরে দেয় সে মদ,

এক লহমায় বদলে গিয়ে দূত হয়ে যাই দেব-লোকের।

(৭৮)

আরাম করে ছিলাম শুয়ে নদীর তীরে কাল রাতে,

পার্শ্বে ছিল কুমারী এক, শারাব ছিল পিয়ালাতে;

স্বচ্ছ তাহার দীপ্তি হেরি শুক্তি-বুকে মুক্তা-প্রায়

উঠল হেঁকে প্রাসাদ-রক্ষী, ‘ভোর হলো কি আধ-রাতে?’

(৭৯)

মন কহে, আজ ফুটল যখন এন্তার ঐ গোলাপ গুল

শরিয়তের আজ খেলাফ করে বেদম আমি করব ভুল।

গুল-লালা-রুখ কুমারীদের প্রস্ফুটিত যৌবনে

উঠল রেঙ্গে কানন-ভূমি লালা ফুলের কেয়ারি-তুল।

(৮০)

হায় রে, আজি জীর্ণ আমার কাব্য পুঁথি যৌবনের!

ধুলায় লুটায় ছিন্ন ফুলের পাপড়িগুলি বসন্তের।

কখন এসে গেলি উড়ে, রে যৌবনের বিহঙ্গম!

জানতে পেরে কাঁদছি যখন হয়ে গেছে দেরি ঢের!

(৮১)

আজ আছে তোর হাতের কাছে, আগামীকাল হাতের বার,

কালের কথা হিসাব করে বাড়াসনে তুই দুঃখ আর।

স্বর্গ-ক্ষরা ক্ষণিক জীবন- করিসনে আর অপব্যয়,

বিশ্বাস কি- নিশ্বাস-ভর জীবন যে কাল পাবি ধার!

(৮২)

হায় রে হৃদয়, ব্যথায় যে তোর ঝরছে নিতুই রক্তধার,

অন্ত যে নেই তোর এ ভাগ্য-বিপর্যয়ের, যন্ত্রণার!

মায়ায় ভুলে এই সে কায়ায় আসলি কেন, রে অবোধ!

আখেরে যে ছেড়ে যেতে হবেই এ আশ্রয় আবার!

(৮৩)

অর্থ বিভব যায় উড়ে সব রিক্ত করে মোদের কর,

হৃৎপিণ্ড ছিঁড়ে মোদের মৃত্যুর নিষ্ঠুর নখর;-

মৃত্যু-লোকের চোখ এড়িয়ে ফেরত কেহ আসল না,

যে-সব পথিক গেল সেথায় নিয়ে তাদের খোশখবর।

(৮৪)

পান করে যাই মদিরা তাই, শুনছি প্রাণে বেণুর রব,

শুনছি আমার তনুর তীরে যৌবনেরই মদির স্তব,

তিক্ত স্বাদের তরে সুরার করো না কেউ তিরস্কার,

ত্যক্ত মানব-জীবন সাথে মানায় ভালো তিক্তাসব।

(৮৫)

ব্যথার দারুণ, শারাব পিও, ইহাই জীবন চিরন্তন;

জরায় স্বর্গ-অমৃত এ, যৌবনের এ সুখ-স্বপন।

গোলাপ, শারাব, বন্ধু লাভের মরসুম এই আনন্দের-

য’দিন বাঁচো শারাব পিও, সত্যিকারের এই জীবন।

(৮৬)

সুরা দ্রবীভূত চুনি, সোরাহি সে খনি তার,

এই পিয়ালা কায়া যেন, প্রাণ তার এই দ্রাক্ষাসার।

বেলোয়ারির এই পিয়ালা-ভরা তরল হাঁসির রক্তিমা,

কিংবা ওরা ব্যথায়-ক্ষত হিয়ার যেন রক্তাধার।

(৮৭)

সুরার সোরাহি এই মানুষ, আত্মা শারাব তার ভিতর;

দেহ তাহার বাঁশরি আর তেজ যেন সেই বাঁশির স্বর।

খৈয়াম! তুই জানিস কি এই মাটির মানুষ কোন জিনিস?

খেয়াল-খুশির ফানুস এ ভাই, ভিতরে তার প্রদীপ-কর।

(৮৮)

ব্যর্থ মোদের জীবন ঘেরা কুগ্রহ সব মেঘলা প্রায়,

‘জিহুন’ সম স্রোত বয়ে যায় অশ্রু-সিক্ত চক্ষে, হায়!

বুকের কুন্ঠে দুখের দাহ- তারেই আমি নরক কই,

মুহূর্তের যে মনের শান্তি- আমি বলি স্বর্গ তায়।

(৮৯)

মদের নেশার গোলাম আমি সদাই থাকি নুইয়ে শির,

জীবন আমি পথ রাখি ভাই, প্রাসাদ পেতে তারু হাসির।

শারাব-ভরা কুঁজোর টুটি জাপটে সাকি হস্তে তার

পাত্রে ঢালে, নিঠুর হাতে নিঙরে তাহার লাল রুধির।

(৯০)

 পেতে যে চায় সুন্দরীদের ফুল্ল-কপোল গোলাপ ফুল

কাঁটার সাথে সইতে হবে তায় নিয়তির তীক্ষ্ম হুল।

নিঠুর করাত চিরুনিরে কেটে কেটে তুলল দাঁত

তাই সে ছুঁয়ে ধন্য হলো আমার প্রিয়ার কেশ আকুল।

(৯১)

শারাব নিয়ে বসো, ইহাই মহমুদেরই সুলতানৎ,

‘দাউদ’ নবীর শিরিন- স্বর ঐ বেণু-বীণার মধুর গৎ।

লুট করে নে আজের মধু, পূর্ণ হবে মনস্কাম।

আজকে পেয়ে ভুলে যা তুই অতীত আর ভবিষ্যৎ।

(৯২)

ওগো সাকি! তত্ত্বকথা চার ও পাঁচের তর্ক থাক,

উত্তর ঐ সমস্যার গো এক হোক কি একশো লাখ!

আমরা মাটির্‌ সত্য ইহাই, বেণু আনো, শোনাও সুর!

আমরা হাওয়া, শারাব আনো! বাকি যা সব চুলোয় যাক।

(৯৩)

এক নিশ্বাস প্রশ্বাসের এই দুনিয়া, রে ভাই, মদ চালাও!

কালকে তুমি দেখবে না আর আজ যে জীবন দেখতে পাও।

খামখেয়ালির সৃষ্টি এ ভাই, কালের হাতে লুঠের মাল,

তুমিও তোমার আপনাকে এই মদের নামে লুটিয়ে দাও!

(৯৪)

কায়কোবাদের সিংহাসন আর কায়কাউসের রাজমুকুট,

তুষের রাজ্য একছহিতে এই মদের কাছে সব যে ঝুট!

ধর্ম-গোঁড়ার উপাসনার কর্কশ যে প্রভাত-স্তব

তাহার চেয়ে অনেক মধুর প্রেমিক-জনের শ্বাস অফুট।

(৯৫)

এই সে প্রমোদ-ভবন যেথায় জলসা ছিল বাহরামের,

হরিণ সেথায় বিহার করে, আরাম করে ঘুমায় শের!

চির-জীবন করল শিকার রাজশিকারি যে বাহরাম,

মৃত্যু-শিকারির হাতে সে শিকার হলো হায় আখের।

(৯৬)

ঘরে যদি বসিস গিয়ে ‘জমহুর’ আর ‘আরাস্তু’র,

কিংবা রুমের সিংহাসনে কায়সর হোস শক্তি-শূর-

জামশেদিয়া জামবাটি ঐ নে শুষে রে, সময় নাই,

বাহরামও তুই হোস যদি, তোর শেষ তো গোর আঁধারপুর!

(৯৭)

প্রেমের চোখে সুন্দর সেই হোক কালো কি গৌর-বরণ,

পরুক ওড়না রেশমি কিংবা পরুক জীর্ণ দীন বসন।

থাকুক শুয়ে ধুলোয় সে কি থাকুক সোনার পালঙ্কে,

নরকে সে গেলেও প্রেমিক করবে সেথায় অন্বেষণ।

(৯৮)

খৈয়াম- যে জ্ঞানের তাঁবু করল সেলাই আজীবন,

অগ্নিকুন্ডে পড়ে সে আজ সইছে দহন অসহন।

তার জীবনের সূত্রগুলি মৃত্যু-কাঁচি কাটল, হায়!

ঘৃণার সাথে বিকায় তারে তাই নিয়তির দালালগণ।

(৯৯)

সাত-ভাঁজ ঐ আকাশ এবং চার উপাদান-সৃষ্ট জীবন!

ঐ এগারোর মারপ্যাঁচে সব ধোঁওয়াস, গলিস বদ-নসিব।

যে যায় সে যায় চিরতরে, ফেরত সে আর আসবে না,

পান করে নে বলব কত, বলে বলে ক্লান্ত জিভ।

(১০০)

খারাব হওয়ার শারাব-খানায় ছুটছি আমি আবার আজ,

রোজ পাঁচবার আজান শুনি, পড়তে নাহি যাই নামাজ!

যেমনি দেখি উদগীব ঐ মদের কুঁজো, অমনি ভাই-

কুঁজোর মতোই উদগ্রীব হই, কন্ঠ সটান হয় দরাজ।

(১০১)

এক কুঁজো- যা আমার মতো ভোগ করেছে প্রেম-দাহন,

সুন্দরীদের মাথায় থাকি পেল খোঁপার পরশন।

এই সোরাহির পার্শ্বদেশে এই যে হাতল দেখতে পাও,

পেল কতই তন্বঙ্গীর ক্ষীণ কাঁকালের আলিঙ্গন।

(১০২)

দ্রাক্ষা সাথে ঢলাঢলির এই তো কাঁচা বয়স তোর,

বৎস, শারাব-পাত্র নিয়ে ঠায় বসে দাও আড্ডা জোর।

একবার তো নূহের বন্যা ভাসিয়েছিল জগৎখান,

তুইও না হয় ভাসিয়ে দিলি মদের স্রোতে জীবনভোর!

(১০৩)

সাবধান! তুই বসবি যখন শারাব পানের জলসাতে,

মদ খাসনে বদমেজাজি নীচ কুৎসিত লোক সাথে।

রাত্তির ভর করবে সে নীচ চিৎকার আর গণ্ডগোল,

ইতর সম চেঁচিয়ে কারণ দর্শাবে ফের সে প্রাতে।

(১০৪)

যদিও মদ নিষিদ্ধ ভাই, যত পারো মদ চালাও,

তিনটি কথা স্মরণ রেখেঃ কাহার সাথে মদ্য খাও?

মদ-পানের কি যোগ্য তুমি? কি মদই বা করছ পান?-

জ্ঞান পেকে না ঝুনো হলে মদ খেয়ো না একফোঁটাও!

(১০৫)

তোমরা-যারা পান করো মদ আর সব দিন, কিন্তু যা

পান করো না শুক্রবারে, ছুঁয়ো না শারাবের কুঁজা-

তাদের বলি- আমার মতো সব বারকে সমান জানো,

খোদার তোরা পূজারী হ, করিস নাকো বার পূজা।

(১০৬)

করছে ওরা প্রচার- পাবি স্বর্গে গিয়ে হুরপরি,

আমার স্বর্গ এই মদিরা, হাতের কাছের সুন্দরী।

নগদা যা পাস তাই ধরে থাক, ধারের পণ্য করিসনে,

দূরের বাদ্য মধুর শোনায় শূন্য হাওয়ায় সঞ্চরি।

(১০৭)

এই সে আঁধার প্রহেলিকা পারবিনে তুই পড়তে মন!

তুই কি সফল হবি যেথায় হার মেনেছে বিজ্ঞজন?

শারাব এবং পেয়ালা নিয়ে খুশির স্বর্গ রচ্যে হেথাই-

পাবি কি না বেহেশত, বলতে পারে কেউ কখন?

(১০৮)

দোহাই! ঘৃণায় ফিরিয়ো না মুখ দেখে শারাব-খোর গোঁয়ার,

যদিও সাধু সজ্জনেরই সঙ্গে কাটে কাল তোমার।

শারাব পিও, কারণ শারাব পান করো আর না-ই করো,

ভাগ্যে ধার্য থাকলে নরক যায় না পাওয়া স্বর্গ আর।

(১০৯)

জীবন যখন কন্ঠাগত- সমান বলখ নিশাপুর,

পেয়ালা যখন পূর্ণ হলো- তিক্ত হোক কি হোক মধুর।

ফুর্তি চালাও, নিভে যাবে হাজার তপন লক্ষ চাঁদ,

আমরা ফিরে আসব না আর এই ধরণীর পথ সুদুর!

(১১০)

আয় ব্যয় তোর পরীক্ষা করে ঠিক সে হিসাব করতে পেশ,

আসার বেলায় আনলি কি আর নিয়েই বা কি যাস সে দেশ।

‘আনব নাকো বিপদ ডেকে শারাব পিয়ে’- কস যে তুই,

মদ খাও আর না খাও তবু মরতে তোমায় হবেই শেষ।

(১১১)

হঠাৎ সেদিন দেখলাম, এক কর্মরত কুম্ভকার,

করছে চূর্ণ মাটির ঢেলা, ঘট তৈরির মাল দেদার।

দিব্য সৃষ্টি দিয়ে এ-সব যেই দেখলাম, কইল মন,

নূতন ঘাট এ করছে সৃজন মাটিতে মোর বাপ দাদার।

(১১২)

একই আজব করছ সৃষ্টি, কুম্ভকার হে, হাত থামাও!

চূর্ণ নরের মাটি নিয়ে করছ কি তা দেখতে পাও?

কায়খসরুর হৃদয় এবং ফরিদুনের অঙ্গুলি

বে-পরোয়া হয়ে তোমার নিঠুর চাকায় মিশিয়ে যাও!

(১১৩)

চূর্ণ করে তোমায় আমায় গড়বে কুঁজো কুম্ভকার,

ওগো প্রিয়া! পার হবার সে আগেই মৃত্যু-খিড়কি-দ্বার-

পাত্রে ব্যথার শান্তি ঢালো- এই সোরাহির লাল সুরা,

এক পেয়ালা তুমি পিও, আমায় দিও পেয়ালা আর।

(১১৪)

এই যে রঙ্গিন পেয়ালাগুলি নিজ হাতে যে গড়ল সে

ফেলবে ভেঙ্গে খেয়ালখুশির লীলায় এদের বিন দোষে?

এতগুলি সুষ্ঠু শোভন চটুল আঁখি চন্দ্রমুখ

প্রীতির ভরে সৃষ্টি করে করবে ধ্বংস ক্রোধবশে।

(১১৫)

পেয়ালাগুলি তুলে ধরো চৈতী লালা ফুলের প্রায়

ফুরসুত তোর থাকলে, নিয়ে বস লালা-রুখদিল প্রিয়ায়।

মউজ করে শারাব পিও, গ্রহের ফেরে হয়তো ভাই

উল্টে দেবে পেয়ালা সুখের হঠাৎ-আসা ঝঞ্ছাবায়।

(১১৬)

মসজিদ আর নামাজ রোজার থামাও থামাও গুণ গাওয়া,

যাও গিয়ে খুব শারাব পিও, যেমন করেই যাক পাওয়া!

খৈয়াম, তুই পান করে যা, তোর ধূলিতে কোন একদিন

তৈরি হবে পেয়ালা, কুঁজো, গাগরি গেলাস মদ-খাওয়া!

(১১৭)

মৃত্যু যেদিন নিঠুর পায়ে দলবে আমার এই পরান,

আয়ুর পালক ছিন্ন করি করবে হৃদয়-রক্ত পান,

আমায় মাটির ছাঁচে ঢেলে পেয়ালা করে ঢালবে মদ,

হয়তো গন্ধে সেই শারাবের আবার হব আয়ুষ্মান!

(১১৮)

রে নির্বোধ! চ ছাঁচে-ঢালা মাটির ধরা শূন্য সব,

রঙ-বেরঙ-এর খিলান-করা এই যে আকাশ-অবাস্তব।

এই যে মোদের আসা-যাওয়া জীবন-মৃত্যু-পথ দিয়ে,

একটি নিশ্বাস ইহার আয়ু, আকাশ-কুসুমের এ টব।

(১১৯)

তিরস্কার আর করবে কত জ্ঞান-দাম্ভিক অর্বাচীন?

লম্পট নই, পান যদিও করি শারাব রাত্রিদিন!

তোমার কাছে তসবি দাড়ি, তাপস সাজার নানান মাল,

আমার পুঁজি দিল-প্রিয়া আর লাল পেয়ালি মদ-রঙ্গিন!

(১২০)

মসজিদের এও পথে ছুটি প্রায়ই আমি ব্যাকুল প্রাণ,

নামাজ পড়তে নয় তা বলে, খোদার কসম! সত্যি মান।

নামাজ পড়ার ভান করে যাই করতে চুরি জায়নামাজ,

যেই ছিঁড়ে যায় সেখানা, যাই করতে চুরি আরেকখান।

 (১২১)

নিত্য দিনে শপথ করি- করব তৌবা আজ রাতে,

যাব না আর পানশালাতে, ছোঁব না আর মদ হাতে।

অমনি আঁখির আগে দাঁড়ায় গোলাপ ব্যাকুল বসন্ত

সকল শপথ ভুল হয়ে যায়, কুলোয় না আর তৌবাতে।

(১২২)

আগে যেসব সুখ ছিল, আজ শুনি তাদের নাম কেবল,

মদ ছাড়া সব গেছে ছেড়ে আগের ইয়ার বন্ধুদল।

কেমন করে ছাড়ব- যে মদ আমায় কভু ছাড়ল না,

এক পেয়ালা আনন্দ, তাও ছাড়লে কিসে বাঁচব বল!

(১২৩)

আমরা শারাব পান করি তাই শ্রীবৃদ্ধি ঐ পানশালার,

এই পাপীদের পিঠ আছে তাই স্থান হয়েছে পাপ রাখার।

আমরা যদি পাপ না করি ব্যর্থ হবে তাঁর দয়া,

পাপ করি তাই ক্ষমা করে করুণাময় নাম খোদার।

(১২৪)

তোমার দয়ার পেয়ালা প্রভু উপচে পড়ুক আমার পর,

নিত্য ক্ষুধার অন্ন পেতে না যেন হয় পাততে কর।

তোমার মদে মস্ত করো আমার ‘আমি’র পাই সীমা,

দুঃখে যেন শির না দুখায় অতঃপর, হে দুঃখহর!

(১২৫)

আময় সৃজন করার দিনে জানত খোদা বেশ করেই

ভাবীকালের কর্ম আমার, বলতে পারত মুহূর্তেই।

আমি যে সব পাপ করি- তা ললাট-লেখা, তাঁর নির্দেশ,

সেই সে পাপের শাস্তি নরক- কে বলবে ন্যায় বিচার এই!

(১২৬)

দুঃখে আমি মগ্ন প্রভু, দুয়ার খোল করুণার!

আমায় করো তোমার জ্যোতি, অন্তর মোর অন্ধকার।

স্বর্গ যদি অর্জিতে হয় এতই পরিশ্রম করে-

সে তো আমার পারিশ্রমিক, নয় সে দয়ার দান তোমার।

(১২৭)

দয়ার তরেই দয়া যদি, করুণাময় স্রষ্টা হন,

আদমের স্বর্গ হতে দিলেন কেন নির্বাসন?

পাপীর তবে করুণা যে- করুণা সে-ই সত্যিকার,

তাদের আবার প্রসাদ কে কয় পুণ্য করে যা অর্জন।

(১২৮)

আডাডা আমার এই সে গুহা, মদ চোলাই-এর এই দোকান,

বাঁধা রেখে আত্মা হৃদয় করি হেথায় শারাব পান।

আরাম-সুখের কাঙ্গাল নহি, ভয় করি না দুর্দশায়,

এই ক্ষিতি-অপ-তেজ-মরুতের ঊর্ধবে ফিরি মুক্ত-প্রাণ।

(১২৯)

দেখে দেখে ভন্ডামী সব হৃদয় বড় ক্লান্ত, ভাই!

তুরন্ত, শারাব আনো সাকি, ভন্ডের মুয়খ ভুলতে চাই।

শারাব আনো বাঁধা রেখে এই টুপি এই জায়নামাজ,

হব বক-ধার্মিক কাল, আজ তো এখন মদ চালাই।

(১৩০)

স্যাঙ্গাৎ ওগো, আজ যে হঠাৎ মোল্লা হয়ে সাজলে সং!

ছাড়ো কপট তপের এ ভান, সাধুর মুখোশ এই ভড়ং।

দেবেন ‘আলি-মুর্তজা’ যা সাকি হয়ে বেহেশতে

পান করো সে শারাব হেথাও হুরি নিয়ে রঙ-বেরঙ।

(১৩১)

পানোন্মত্ত বারাঙ্গনায় দেখে সে এক শেখজী কন-

‘দুরাচার আর সুরার করো দাসীপনা সর্বক্ষণ!’

‘আমায় দেখে যা মনে হয়, তাই আমি’- কয় বারনারী,

‘কিন্তু শেখজী, তুমি কি তাই, তোমায় দেখে কয় যা মন?’

(১৩২)

হাতে নিয়ে পান-পিয়ালা নামাজ পড়ার মাদুরখান-

দেখতে পেলাম ভাঁটি-খানার পথ ধরে শেখ সাহেব যান!

কইনু দেখে, ‘ব্যাপার কি এ, এ পথে যে শেখ সাহেব !’

কইলেন পীর, ‘ফক্কিকার এ-দুনিয়া, করো শারাব পান!’

(১৩৩)

কালকে রাতে ফিরছি যখন ভাঁটি-খানার পাঁড় মাতাল,

পীর সাহেবে দেখতে পেলাম, হাতে বোতল-ভরা মাল।

কইনু, ‘হে পীর, শরম তোমার নেই কি?’ হেঁসে কইল পীর,

‘খোদার দয়ার ভান্ডার সে অফুরন্ত রে বাচাল!’

(১৩৪)

হে শহরের মুফতি! তুমি বিপথ-গামী কম তো নও,

পানোন্মত্ত আমার চেয়ে তুমিই বেশি বেহুঁশ হও।

মানব-রক্ত শোষো তুমি,  আমি শুষি আঙ্গুর-খুন,

রক্ত-পিপাসু কে বেশি এই দু’জনের, তুমিই কও!

(১৩৫)

ভন্ড যত ভড়ং করে দেখিয়ে বেড়ায় জায়নামাজ,

চায় না খোদায়- লোকের তারা প্রশংসা চায় ধাপ্পাবাজ।

দিব্যি আছে মুখোশ পরে সাধু ফকির ধার্মিকের,

ভিতরে সব কাফের ওরা, বাইরে মুসলমানের সাজ!

(১৩৬)

ধূলি-ম্লান এ উপত্যকায় এলি, এসেই হলি গুম,

করল তোরে জরদগব এই সে যাওয়া আসার ধূম।

নখগুলো তোর পুরু হয়ে হয়েছে আজ ঘোড়ার খুর,

দাড়ির বোঝা জড়িয়ে গিয়ে হলো যেন গাধার দুম।

(১৩৭)

সুন্দরীদের তনুর তীর্থে এই যে ভ্রমণ, শারাব পান,

ভন্ডদের ঐ বুজরুকি কি হয় কখনো তার সমান?

প্রেমিক এবং পান-পিয়াসী এরাই যদি যায় নরক,

স্বর্গ হবে মোল্লা পাদরি আচার্যদের ‘দাড়ি-স্থান’!

(১৩৮)

এই মূঢ়দল-স্থুল তাহাদের অজ্ঞানতার ঘোর মায়ায়,

ভাবে- মানবজাতির নেতা তারাই জ্ঞান ও গরিমায়।

ফতোয়া দিয়ে কাফের করে তাদের তারা এক কথায়

শুভ্র-মুক্তবুদ্ধি যারা, নয় গর্দভ তাদের ন্যায়।

(১৩৯)

মার্কা-মারা রাইস যত-ঈসৎ দুখের বোঝার ভার

বইতে যারা পড়েন ভেঙ্গে, বিস্ময়ের নাই অন্ত আর,

তাঁরাই যখন দীন দরিদ্রে দেখেন দ্বারে পাততে হাত

তাদের তখন চিনতে নারেন মানুষ বলে এই ধরার।

(১৪০)

দরিদ্রেরে যদি তুমি প্রাপ্য তাহার অংশ দাও,

প্রাণে কারুর না দাও ব্যথা, মন্দ কারুর নাহি চাও,

তখন তুমি শাস্ত্র মেনে না-ই চললে তায় বা কি!

আমি তোমায় স্বর্গ দিব, আপাতত শারাব নাও!

(১৪১)

জ্ঞান যদি তোর থাকে কিছু- জ্ঞানহারা হ সত্যিকার,

পান করে নে শাশ্বতী সে সাকির পাত্রে সুরার সার!

সেয়ান-জ্ঞানী! তোর তরে নয় গভীর আত্মবিস্মৃতি,

সব বোকারা জ্ঞান লভে না সত্যিকারের জ্ঞানহারার।

(১৪২)

যার পরে তোর আস্থা গভীর, এই যে বুকের বন্ধু তোর

মার্জিত জ্ঞান-চক্ষু নিয়ে দেখো এই তোর শত্রু ঘোর।

বন্ধু বেছে নিসনে রে তোর অমার্জিতের ভিড় থেকে,

ভেজিয়ে দে ভাই অন্তর-হীন অন্তরঙ্গতার এ দোর।

(১৪৩)

দাস হয়ো না মাৎসর্যের, হয়ো নাকো অর্থ-যখ,

ঘাড়ে যেন ভর করে না ঠুনকো যশোখ্যাতির শখ,

অগ্নি-সম প্রদীপ্ত হও, বন্যা-সম প্রাণোদ্বেল,

হয়ো নাকো পথের ধূলি, হাওয়ার হাতের ক্রীড়নক।

(১৪৪)

যোগ্য হাতে জ্ঞানীর কাছে ন্যস্ত করো এই জীবন,

নির্বোধদের কাছ থেকে ভাই থাকবে তফাত দশ যোজন!

জ্ঞানী হাকিম বিষ যদি দেয় বরং তাহাই করবে পান,

সুধাও যদি দেও আনাড়ি- করবে তাহা বিসর্জন!

(১৪৫)

সেরেফ খেয়াল-খুশির বশে আপনজনের বক্ষে তুই

এই যে তীব্র যন্ত্রণারই ক্ষত এঁকে দিস নিতুই-

শোক কর, কাঁদ, অশান্ত তোর মনও মৃত বীর তরে,

আপন হাতে বধ করেছিস, রে অবোধ, এ শক্তি দুই।

(১৪৬)

ধীর চিত্তে সহ্য কর, দুঃখ-সুখের এই দাওয়াই

দুঃখ পেয়ে রুক্ষ-মেজাজ হসনে, দেখবি দুঃখ নাই!

অভাবে ক্ষয় হয় না যেন তোর স্বভাবের প্রশান্তি,

ষড়ৈশ্বর্য লাভের উপায়, আমার মতে এই সে ভাই।

(১৪৭)

আকাশ পানে হতাশ আঁখি চেয়ে থাকি নির্নিমিখ

‘লওহ’ কলম বেহেশত-দোজখ কোথায় থাকে কোন সে দিক;

অন্ধকারে পেলাম আলো, দরবেশ একই কইল শেষ-

‘লওহ’ কলম বেহেশত-দোজখ তোরি মাঝে-নয় অলীক।

(১৪৮)

দশ বিদ্যা, আট স্বর্গ, সাত গ্রহ আর নয় গগন

করল স্রষ্টা সৃষ্টি রে ভাই, দেখছে যাহা জ্ঞান-নয়ন!

চার উপাদান, ইন্দ্রিয় পাঁচ, আত্মা তিন ও দুই জগৎ-

পারল না সে সৃষ্টি করতে আরেকটি লোক মোর মতন।

(১৪৯)

কি হই আর কি নই আমি- মোর চেয়ে তা কে জানে?

ঊর্ধ্বে নিম্নে যাহা কিছু ভেদ আছে তার মোর প্রাণে।

একদিনে মোর এসব বিদ্যা করব জলে বিসর্জন,

শারাব পানের অধিক মহত-কেউ যদি তার খোঁজ আনে।

(১৫০)

একদা মোর ছিল যখন যৌবনেরই অহংকার

ভেবেছিলাম- গিঠ খুলেছি জীবনের সব সমস্যার।

আজকে হয়ে বৃদ্ধ বুঝেছি ঢের বিলম্বে

শূন্য হাতড়ে শূন্য পেলাম-যে আঁধারকে সে আঁধার!

(১৫১)

আসিনি তো হেথায় আমি আপন স্বাধীন ইচ্ছাতে,

যাবও না নিজ ইচ্ছামতো, খেলার পুতুল তাঁর হাতে।

ক্ষীণ কাঁকালে জড়িয়ে আঁচল, ঢালো সাকি বিলাও মদ,

পিয়ালাভর সেই পানিতে-ধরার কালি ধোয় যাতে।

(১৫২)

ঘেরা-টোপের পর্দা-ঘেরা দৃষ্টি-সীমা মোদের ভাই,

বাইরে ইহার দেখতে গেলে শূন্য শুধু দেখতে পাই।

এই পৃথিবীর আঁধার বুকে মোদের সবার শেষ আবাস-

বলতে গেলে ফুরোয় না আর বিষাদ-করুণ সেই কথাই।

(১৫৩)

আমার রোগের এলাজ কর পিইয়ে দাওয়াই লাল সুরা,

পাংশু মুখে ফুটবে আমার চুনির লালি, বন্ধুরা!

মরব যেদিন- লাল পানিতে ধুয়ো সেদিন লাশ আমার,

আঙ্গুর-কাঠের ‘তাবুত’ করো, কবর দ্রাক্ষাদল-ঝুরা।

(১৫৪)

পেয়ালার প্রেম যাচঞ্ছা করো, থেমো না এক মুহূর্তও,

থাকবে হৃদয় মগজ তাজা মদ দিয়ে তায় ভিজিয়ে থোও!

আদমেরে করত প্রণাম শয়তান দু’হাজার বার-

হায় যদি সে গিলতে পেত বিন্দু-প্রনাম আঙ্গুর-মট্ট।

(১৫৫)

অঙ্গে রক্তমাংশের এই পোশাক আছে যতক্ষণ

তকদিরের এই সীমার বাইরে করিসনে তুই পদার্পণ।

নোয়াসনে শির, ‘রুস্তম’ ‘জাল’ শত্রু যদি হয় রে তোর,

দোস্ত যদি হয় ‘হাতেম-তাই’ তাহারও দান নিসনে শোন।

(১৫৬)

কইল গোলাপ, ,’মুখে আমার ‘ইয়াকুত’ মণি, রঙ সোনার,

গুলবাগিচার মিশর দেশে য়ুসোফ আমি রূপকুমার।‘

কইনু, ‘প্রমাণ আর কিছু কি দিতে পারো?’ কইল সে,

‘রক্ত-মাখা এই যে পিরান পরে আছি প্রমাণ তার!’

(১৫৭)

হৃদয় ছিল পূর্ণ প্রেমে, পেয়েছিলাম তায় একাও,

বক্ষে ছিল কথার সাগর, একটি কথা কইনি তাও।

দাঁড়িয়ে ভরা নদীর তীরে মরলাম আমি তৃষ্ণাতুর,

বিস্ময়কর এমন শহীদ দেখেছ আর কেউ কোথাপ?

(১৫৮)

‘ইয়াছিন’, আর ‘বয়াত’ নিয়ে, সাকি রে, রাখ, তর্ক তোর!

আমায় সুরার হাত-চিঠে দাও, সেই সে সুরা ‘বরাত’ মোর।

যে রাতে মোর শ্রান্তি ব্যথা ডুবিয়ে দেবে মদের স্রোত,-

সেই সে’শবে-বরাত’ আমার, সেই তো আমার বরাত জোর।

(১৫৯)

ভূলোক আর দ্যুলোকেরই মন্দ-ভালোর ভাবনাতে,

বে-পরোয়া ঘুরে বেড়াই ভাটি-খানার আড্ডাতে।

গোলোক হয়ে পড়ত যদি মোর ঘরে ঐ যুগল লোক,

মদের নেশায় বিকিয়ে দিতাম ওদের একটা আধলাতে।

(১৬০)

এই নেহারি-নিবিড় মেঘে মগ্ন আছে মুখ তোমার,

একটু পরেই ঠিকরে পড়ে ভুবন-মোহন দীপ্তি তার।

মহলা দাও নিজ মহিমার নিজের কাছেই, হে বিরাট,

দ্রষ্টা তুমি, দৃশ্য তুমি তোমার অভিনয়-লীলার!

(১৬১)

আমরা দাবা খেলার  ঘুঁটি, নাই রে এতে সন্দ নাই।

আসমানি সেই রাজ-দাবাড়ে চালায় যেমন চলছি তাই।

এই জীবনের দাবার ছকে সামনে পিছে ছুটছি সব,

খেলার শেষে তুলে মোদের রাখবে মৃত্যু-বাক্সে ভাই!

(১৬২)

আসমানি হাত হতে যেমন পড়বে ঘুঁটি ভাগ্যে তোর

পণ্ডশ্রম করিসনে তুই হাতড়ে ফিরে সকল দোর!

এই জীবনের জুয়াখেলায় হবেই হবে খেলতে ভাই

সৌভাগ্যের সাথে বরণ করে নে দুর্ভাগ্য তর।

(১৬৩)

চাল ভুলিয়ে দেয় রানি মোর, খঞ্জন ঐ চোখ খর,

বোড়ে দিয়ে বন্দি করে আমায় ঘোড়া গজ হর!

তোমার সকল বল আগিয়ে কিস্তির পর কিস্তি দাও,

শেষে লালা-রুখ দেখিয়ে ‘রুখ’ নিয়ে মোর, মাত করো!

(১৬৪)

আসমানে এক বলিবর্দ রয় ‘পর্বিন’ নাম তাহার

আছে আরেক বৃষভ নিচে বইতে মোদের ধরার ভার।

কাজেই, এই যে মানবজাতি-জ্ঞানীর চক্ষে হয় মালুম-

ঐ সে ভীষণ ষাঁড় যুগলের মধ্যে যেন ঝাঁক গাধার।

(১৬৫)

শ্রেষ্ঠ শারাব পান করে নেয় বদরসিকে, হায় রে হায়!

স্থুল-আত্মা মূর্খ ধনিক শ্রেষ্ঠ বিলাস বিভব পায়।

হায় রে যত চিত্তহারী রূপকুমারী জর্জিয়ার

শুকায় কিনা গুম্ফ-বিহীন বালক-সাথে মাদ্রাসায়!

(১৬৬)

রূপ লোপ এর হয় অরূপে, অস্থি ইহার হয় না নাশ।

এই মদিরা-হাজার রূপে অরূপে এর হয় প্রকাশ,

ভেবো না কেউ সুরার সাথে সুরার সারও যায় উবে,

কভু এ হয় প্রাণী কভু তরু-লতা, ফুল-সুবাস।

(১৬৭)

লাল গোলাপে কিস্তি দিয়ে তোমার ও গাল করে মাত,

খেলতে গিয়ে চীন-কুমারী হারে প্রিয়া তোমার সাথ।

খেলতে বাবিল-রাজার সাথে হানলে চাউনি একটিবার

মন্ত্রী ঘোড়া গজ নিলে তার হেনে ঐ এক নয়ন-পাত?

(১৬৮)

তোমার-আমার কি হবে ভাই ভেবে মোর ব্যাকুল মন!

মীন-কুমারী হংসীরে কয়, ‘শুকাবে এই বইল যখন!’

মরালী কয়, ‘কাবাব যদি হই দু’জনাই তুইও আমি,

ভাসলে এ বিল মদের স্রোতে মোদের কি তায় লাভ তখন।‘

(১৬৯)

ঘূর্ণায়মান ঐ কুগ্রহ-দল-সদাই যারা ভয় দেখায়-

ঘুরছে ওরা ভোজবাজির ঐ লন্ঠনেরই ছায়ার প্রায়।

সূর্য যেন মোমবাতি আর ছায়া যেন পৃথ্বী এই,

কাঁপছি মোরা মানুষ যেন প্রতিকৃতি আঁকা তায়!

(১৭০)

ফিরনু পথিক সাগর মরু ঘোর বনে পর্বত-শিরে

এই পৃথিবীর সকল দেশে গুহায় ঘরে মন্দিরে,

শুনলাম না- ফিরছে কেউ তীর্থ-পথিক এই পথের,

আজ এ পথে যাত্রা যাহার, আসল না সে কাল ফিরে!

(১৭১)

দুই জানতেই সইছি সাকি নিয়তির ভ্রুভঙ্গি ঢের,

এই ধরাতে তোমার আমার নাই অবসর আনন্দের।

তবুও মোদের মাঝে আছে মদ-পিয়ালা যতক্ষণ

সেই তো ধ্রুব সত্য, সখি, পথ দেখাবে সেই মোদের!

(১৭২)

স্রষ্টা মোরে করল সৃজন জাহান্নানে জ্বলতে সে,

কিংবা স্বর্গে করবে চালান- তাই বা পারে বলতে কে!

করব না ত্যাগ সেই লোভে এই শারাব সাকি দিলরুবা,

নগদার এ ব্যবসা খুইয়ে ধারে স্বর্গ কিনবে কে?

(১৭৩)

দুর্ভাগ্যের বিরক্তি পান করতে যেন না হয় আর,

পানই যদি করি, পানি পান করব পান-শালার।

এই সংসারে হত্যাকারী, রক্ত তাহার লালা শারাব,

আমাদের যে খুন করে, কি? করব না পান খুন তাহার?

(১৭৪)

ওমর রে, তোর জ্বলছে হৃদয় হয়তো নরকেই জ্বলি,

তাহার বহ্নি-মহোৎসবে হয়তো হবি অঞ্জলি।

খোদায় দয়া শিখাতে যাস সেই সে তুই, কি দুঃসাহস।

তুই শিখাবার কে, তাঁহারে শিখাতে যাস কি বলি?

(১৭৫)

কুগ্রহ মোর! বলতে পারিস, করেছি তোর ক্ষতি কোন

সত্যি বলিস, মোর পরে তুই বিরূপ এত কি কারণ।

একটু মদের তরে এত উষ্ণবৃত্তি তোষামোদ

এক টুকরো রুটির তরে, ভিক্ষা করাস অনুক্ষণ।

(১৭৬)

জল্লাদিনী ভাগ্যলক্ষ্মী, ওরফে ওগো গ্রহের ফের!

স্বভাব-দোষে চিরটা কাল নিষ্ঠুরতার টানছ জের।

বক্ষ তোমার বিদারিয়া দেখতে যদি এই ধরা

খুঁজে পেত ঐ বুকে তার হারা-মণি-মানিক ঢের।

(১৭৭)

ভাগ্যদেবী! তোমার যত লীলাখেলায় সুপ্রকাশ

অত্যাচারী উৎপীড়কের দাসী তুমি বারো মাস।

মন্দকে দাও লাখ নিয়ামত ভালোকে দাও দঃখ-শোক,

বাহাত্তুরে ধরল শেষে? না এ বুদ্ধিভ্রম বিলাস?

(১৭৮)

সইতে যুলুম খল নিয়তির চাও বা না চাও শির নোওয়াও!

বাঁচতে হলে হাত হতে তার প্রচুরভাবে মদ্য খাও।

তোমার আদি অন্ত উভয় এই সে ধুলা-মাটির কোল,

নিম্নে নয় আর এখন তুমি ধরার ধুলির ঊর্ধ্বে ধাও।

(১৭৯)

মোক্ষম বাঁধ বেঁধেছে যে মোদের স্বভাব শৃঙ্খলে,

স্বভাব-জয়ী হতে আবার আমাদেরে সেই বলে!

দাঁড়িয়ে আছি বুদ্ধি-হত তাই এ দু’য়ের মাঝখানে-

উল্টে ধরবে কুঁজো কিন্তু জল যেন তার না টলে!

(১৮০)

মানুষ খেলার গোলক প্রায় ফিরছে ছুটে ডাইনে বাঁয়,

যেদিক পানে চলতে বলে ক্রূর নিয়তির হাতা তায়।

কেন হলি ভাগ্যদেবীর নিঠুর খেলার পুতুল তুই,

সেই জানে- এক সেই জানে রে, আমরা পুতুল অসহায়।

 (১৮১)

খামকা ব্যথার বিষ খাসনে, মুষড়ে যাসনে নিরাশায়,

ফেরেব-বাজির এই দুনিয়ায় তুই ধরে থাক সত্য ন্যায়

আখেরে তো দেখলি শূন্য ফাঁস ফক্কিকার,

তুইও মায়ার পুতুল যখন- ভয় ভাবনা যাক চুলায়!

(১৮২)

সিন্ধু হতে বিচ্ছেদেরই দুঃখে কাঁদে বিন্দুজল,

‘পূর্ণ আমি’, কইল হেঁসে বিন্দুরে সিন্ধু অতল।

সত্য শুধু পূর্ণ, বাকি অন্য যা তা নাস্তি সব,

ঘূর্ণমান ঐ এক সে বিন্দু বহুর রূপে করছে ছল।

(১৮৩)

আমার রানি (দীর্ঘায়ু হন দগ্ধে মারতে দাসকে তাঁর!)

হঠাৎ খেয়াল হলো, দিলেন সস্নেহ এক উপহার।

গেলেন চলে অনুগ্রহের চাউনি হেনে! তার মানে-

‘তার চেয়ে ঐ নালার জলে দাও ভাসিয়ে প্রেম তোমার।‘

(১৮৪)

তোমার আদরিণী বধূ ছিল, প্রভু আত্মা মোর,

কাজ হতে তায় তাড়িয়ে দিলে কোন দোষে, হায় মনোচোর

পূর্বে কভু ছিলে না তো এমন কঠোর, হে স্বামী!

বিরহিনী বাস করিব প্রবাসে কি জীবনভর?

(১৮৫)

যেমনি পাবি মণ দুই মদ- যেখানে হোক যদিই পাস-

অমনি পনোন্মত্ত ওরে, সে মদ-স্রোতে ডুবে যাস।

যেমনি খাওয়া অমনি হবি আমার মতো মুক্ত-প্রাণ

ভেসে যাবে রাশ-ভারি তোর ঋষির মতো দাড়ির রাশ!

(১৮৬)

মানব-স্বভাব জড়িয়ে বহে মন্দ-ভালোর দুই ধারা,

শুভাশুভ দুঃখ ও সুখ দান নিয়তির-কয় যারা,

তাদের বলি- অপরাধী করছে খামকা কুগ্রহে,

তোমার চেয়ে হাজার গুণ যে অসহায় সে বেচারা!

(১৮৭)

তোমার নিন্দা করতে সাহস করবে না আর কেউ কোথাও!

এক সে উপায় আছে যদি বিশ্বে খুশি করতে চাও

এন্তার সব শ্রদ্ধা পাবে বড় ছোট সকলকার

মুসলিম খৃষ্টান ইহুদি সবার যশো-গাথা গাও।

(১৮৮)

বলতে পারো! টক সে কেন আঙ্গুর যখন কাঁচা রয়?

পাকলে তার মিষ্টি রসে, তারই শারাব তিক্ত হয়।

কাঠকে কুঁদে কুঁদে যখন শিল্পী গড়ে রবাব বীণ

সে কাঠে সেই শিল্পী বেণু গড়তে পারে? নয় গো নয়!

(১৮৯)

খ্যাতির মুকুট পড়লে হেথায় নিন্দা-গ্লানির পাঁক হানে,

বলবে ষড়যন্ত্রকারী বোস যদি গোরস্থানে।

‘খিজির’ হও আর ‘ইলিয়াস’ হও; সব সে-আচ্ছা এই ধারায়

জানতে চাসনে কারেও আর তোরেও কেহ না জানে।

(১৯০)

খৈয়াম! তুই কাঁদিস কেন পাপের ভয়ে অযথা?

দুঃখ করে কেঁদে কি তোর ভরবে প্রাণের শূন্যতা?

জীবনে যে করল না পাপ নাই দাবি তাঁর দয়ায়

পাপীর তরেই দয়ার সৃষ্টি, আনন্দ কর ভোল ব্যথা।

(১৯১)

আবার যখন মিলবে হেথায় শারাব সাকির আঞ্জামে,

হে বন্ধুদল, একটি ফোঁটা অশ্রু ফেলো মোর নামে!

চক্রাকারে পাত্র ঘুরে আসবে যখন সাকির পাশ,

পেয়ালা একটি উল্টে দিয়ো স্মরণ করে খৈয়ামে!

(১৯২)

বিশ্ব-দেখা জামশেদিয়া পেয়ালা খুঁজি জীবন-ভর

ফিরনু বৃথাই সাগর গিরি কান্তার বন আকাশ-ক্রোড়।

জানলাম শেষ জিজ্ঞাসিয়া দরবেশ এক মুর্শিদে-

জামশেদের সে জাম-বাটি এই আমার দেহ আত্মা মোর!

(১৯৩)

আকাশ যেদিন দীর্ণ হবে, আসবে যেদিন ভীম প্রলয়,

অন্ধকারে বিলীন হবে গ্রহ তারা জ্যোতির্ময়,

প্রভু আমার দামন ধরে বলব কেঁদে, ‘হে নিঠুর,

নিরপরাধ মোদের কেন জন্মে আবার মরতে হয়?’

(১৯৪)

হৃদয় যদি জীবনে হয় জীবনের রহস্যজয়ী,

খোদা কি, তা জানতে পারে মৃত্যুতে সে অবশ্যই।

কিন্তু তুমি থেকেই যদি শূন্য ঠেকে সব কিছুই,

তুমি যখন রইবে না কাল জানবে কি আর শূন্য বই?

(১৯৫)

খৈয়াম! তোর দিন দুয়েকের এক যে দেহের শামিয়ানা-

আত্মা নামক শাহানশাহের হেথায় ক্ষণিক আস্তানা।

তাম্বুওয়ালা মৃত্যু আসে আত্মা যখন লন বিদায়,

উঠিয়ে তাঁবু অগ্রে চলে; কোথায় সে যায় অ-জানা।

(১৯৬)

পৌঁছে দিও হজরতেরে খৈয়ামের হাজার সালাম,

শ্রদ্ধাভরে জিজ্ঞাসিও তাঁরে লয়ে আমার নাম-

‘বাদশা নবী। কাঁজি খেতে নাই তো নিষেধ শরিয়তে,

কি দোষ করল আঙ্গুর-পানি? করলে কেন তায় হারাম?’

(১৯৭)

তত্ত্ব-গুরু খৈয়ামেরে পৌঁছে দিও মোর আশিস

ওর মতো লোক বুঝল কিনা উল্টো করে মোর হদিস!

কোথায় আমি বলেছি, যে, সবার তরেই মদ হারাম?

জ্ঞানীর তরে অমৃত এ, বোকার তরে উহাই বিষ!

error: Content is protected !!
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x