হার মানলেন পোপ

পোপ চেয়েছিলেন মাদার টেরিজাকে ১৯ অক্টোবর ২০০৩-এ সরাসরি ‘সেন্ট টেরিজা’ হিসেবে ঘোষণা করতে। কিন্তু পারলেন না। বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিমান ধর্মগুরুর সর্বাত্মক চেষ্টা ও একান্ত ইচ্ছে-আগুনে জল ঢেলে দিল ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি ।

ক্যাথলিকদের কাছে জীবিত অবস্থায় কেউই সাধু, সন্ত বা সেন্ট নন। মৃত্যুর পরে কতকগুলো

পদক্ষেপের শেষে পোপ অনেক কিছু দেখে-শুনে কাউকে ‘সেন্ট’ উপাধি দিলে তবেই তিনি ‘সেন্ট’ বলে পরিচিত হবেন ।

সেন্ট হওয়ার পূর্ব পদক্ষেপগুলো এইরকম

* ‘ক্যানান ল’ বা ক্যাথলিক ধর্মযাজকদের অনুশাসন অনুযায়ী ‘রেসেড’ বা ‘ঈশ্বরের আশীর্বাদধন্যা’ ঘোষণার প্রস্তুতিপর্ব শুরু হবে প্রার্থীর মৃত্যুর পাঁচ বছর পরে।

* স্থানীয় বিশপরা প্রার্থীর জীবনচর্চা বিষয়ে অনুসন্ধান করে তাঁদের মতামত পোপের কাছে পাঠাবেন।

* ‘ভ্যাটিকান’ বা পোপের শাসনকর্তৃত্বের পরিকাঠামো এই মতামত পাঠাবে প্যানেলভুক্ত ক্যার্ডিনালদের (রোমান ক্যাথলিকদের সর্বোচ্চ পদাধিকারীধর্মযাজক-গোষ্ঠী) কাছে। তারা এই মতামত গ্রহণ করলে মৃত প্রার্থীরা নামের আগে ‘ভেনারেবল’ বা ‘সার্ভেন্ট অফ গড’ উপাধি ব্যবহারের জন্য প্রদান করবেন পোপ ।

* পরবর্তী পদক্ষেপ ‘বিয়েটিফিকেশন’ বা স্বর্গীয় মহিমা প্রদান অনুষ্ঠান। এই পর্যায়ে পৌঁছাতে গেলে লাগবে প্রার্থীর অলৌকিক ক্ষমতার অকাট্য প্রমাণ। এখানেও আবার বিশেষত্ব আছে। প্রার্থীর মৃত্যুর পর তাঁর অমর আত্মাকে ঘটাতে হবে কোনও একটি অলৌকিক ঘটনা।

এরপর আসে ‘সেন্ট’ উপাধি দানের সর্বশেষ পর্যায়। এর জন্য দরকার হয় আত্মার আরও একটি অলৌকিক ক্ষমতার খাঁটি প্রমাণ ।

(CNN. com-mother Teresa on road to santhood – Oct 1.2000 থেকে ‘Steps to sainthood’ অংশ অনুবাদ করা হল।)

‘সেন্ট’ হওয়ার এই যে রীতি, এ’হল ‘ক্যানান ল’-এর অংশ। মাদার টেরিজার বেলায় ‘ক্যানান ল’ ভাঙলেন স্বয়ং পোপ দ্বিতীয় জন পল। টেরিজার মৃত্যুর (১৯৯৭) দু’বছরের মধ্যেই শুরু হয়ে গেল তাঁকে ‘সেন্ট’ টেরিজা করার প্রস্তুতি। অথচ ‘ক্যানান ল’ অনুসারে এই প্রস্তুতিটুকু শুরু করার জন্যেই অপেক্ষা করা উচিত ছিল আরও তিন তিনটি বছর। কেন এই তাড়াহুড়ো? কেন এই আইন ভাঙার খেলা? পোপের সময় কী ফুরিয়ে যাচ্ছে? জীবনদীপ নিভুনিভু, তাই ‘ওঠ ছুঁড়ি তোর বিয়ে’ বলে হুড়মুড়িয়ে নেমে পড়া ?

মিশনারিজ অফ চ্যারিটি’র সুপিরিয়র জেনারেল নির্মলাও মাদারকে পণ্য করে নেমে পড়লেন আখের গোছাতে। মাদারকে সেন্ট বানাতে দরকার একটা মিরাকেলের, একজন রোগীর। রোগীটি শুধু বলবে, আমার কঠিন অসুখ সেরেছে মাদারের অলৌকিক কৃপায়। খুঁজে-পেতে পাওয়া গেল একজন অজ পাড়া-গাঁ’র সাঁওতাল গৃহবধূ। কঠিন অসুখে ভুগছিলেন। সোনার দামে তাকে কিনে নিয়ে শিখিয়ে পড়িয়ে হাজির করা হল। নাম—মণিকা বেসরা। একজন ডাক্তারের নামও শোনা গেল। ডাঃ আর এন ভট্টাচার্য। তিনি দরাজ সার্টিফিকেট দিয়েছেন, মণিকার পেটে টিউমার হয়েছিল। যে টিউমারটা আসলে ক্যানসার। আধুনিক চিকিৎসায় এ ক্যানসার সারানো অসম্ভব ব্যাপার। আর এই অসম্ভবই সম্ভব হয়েছে মাদারের মিরাকেলে। ১৯৯৮-এর ৫ সেপ্টেম্বর মাদারের জন্ম-তিথিতে মাদারের ছবি থেকে একটা জ্যোতি এসে মণিকার টিউমারে পড়তেই মুহূর্তে টিউমার ভ্যানিস।

এবার দরকার স্থানীয় বিশপের তদন্ত রিপোর্ট। দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার ‘ক্যাথলিক ডায়োসেস অফ বারুইপুর’-এর বিশপ সালভাদোর লোবো’র নেতৃত্বে তদন্ত কমিটি তৈরি হল। তদন্ত কমিটি রিপোর্ট পেশ করল, চিকিৎসা ব্যর্থ হওয়ার পর মণিকা মাদারের মিরাকেলে রোগ মুক্ত হয়েছেন। মণিকার চিকিৎসকদের মতামতকে একটুও পাত্তা না দিয়ে, কী সত্য প্রতিষ্ঠা করলো তদন্ত কমিটি? ধর্মব্যবসায়ীরা অসাধু হয়—এই সত্য?

বিশপের মিথ্যে ইনভেস্টিগেশন রিপোর্ট নিয়ে মিশনারিজ অফ চ্যারিটি আবেদন জানাল ভ্যাটিকানের কাছে, বিয়েটিফিকেশনের ব্যাপারটা বাদ দিয়ে মাদার টেরিজাকে সরাসরি ‘সেন্ট’ ঘোষণা করা হোক ।

ব্যাপারটা আবেদন অনুসারে হওয়ার সব আয়োজনই ছিল। কিন্তু বিষম রকমের বাধা হয়ে দাঁড়াল যুক্তিবাদী সমিতি। পরে সে বিষয়ে বিস্তৃত আলোচনার অবকাশ আছে। এখন আসুন লাইনচ্যুত না হয়ে আলোচনা চালিয়ে যাই ।

তোমার কর্ম তুমি কর….লোকে বলে করি আমি

পোপের ইচ্ছে-সুতোয় মিশনারিজ অফ চ্যারিটি নেচে ছিল কি না, এ বিষয়ে নিশ্চিভাবে বলার মতো প্রমাণ আমাদের হাতে নেই। তবে পারিপার্শ্বিক তথ্য-প্রমাণ থেকে যে সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায়, এ’কথা জজও মানেন। আমরা প্রাসঙ্গিক পারিপার্শ্বিক তথ্য-প্রমাণ থেকে কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারি কি না আসুন দেখি ।

(১) ১৯ অক্টোবর, ২০০৩, ছিল পোপ দ্বিতীয় জন পলের অভিষেকের ২৫ বছর পূর্তির দিন। পোপ দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে টেরিজাকে ‘সেন্ট’ উপাধি দিতে চেয়েছিলেন এই দিনটিতেই। তাঁর এই ইচ্ছা-পূরণে এতটাই আগ্রহী ছিলেন যে, লক্ষ্যে পৌঁছতে ‘ক্যানান ল’ অগ্রাহ্য করা, ছল গ্রহণ করা— কোনও কিছুতেই পিছ-পা ছিলেন না। আরও কিছু তথ্য এ লেখায় আসবে, যা পড়ার পর আশা রাখি আপনিও এ’ বিষয়ে সহমত পোষণ করবেন ।

(২) মণিকা বেসরার টিউমার যে দুরারোগ্য ক্যানসার ছিল না, এটা পোপ জানতেন। ক্যানসারের বায়পসি রিপোর্ট পোপের কাছে ছিল না। থাকলে প্রবল সমালোচনার মুখে পড়ে কখনই চুপ করে কিল হজম করতেন না। রিপোর্ট হাজির করতেন-ই

(৩) ডাঃ আর এন ভট্টাচার্য-ই একমাত্র ডাক্তার, যিনি দাবি করেছিলেন, মণিকার ক্যানসার মাদারের অলৌকিক ক্ষমতায় রাতারাতি সেরে গেছে। এরপর প্রত্যাশিত ছিল যে, ভ্যাটিকান ও মিশনারিজরা ডাক্তার ভট্টাচার্যকে বারবার প্রচার মাধ্যমের সামনে হাজির করবে। বাস্তবে হল উল্টোটা। ডাঃ ভট্টাচার্য কোনও এক রহস্যময় কারণে ভ্যানিস হয়ে গেলেন। কোনও প্রচার- মাধ্যমই তাঁর খোঁজ পেল না। কেন তাঁকে লুকিয়ে ফেলা হল? মিথ্যে ফাঁস হওয়ার ভয়ে ? বিয়েটিফিকেশনে বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানে মণিকা ছিলেন, কিন্তু ছিলেন না ডাঃ ভট্টাচার্য। অবাক করার মতো ব্যাপার। যাঁর সার্টিফিকেটের জোরে আজকের এই অনুষ্ঠান তিনি-ই নেই !

(৪) ভ্যাটিকান একটি দলকে পাঠিয়েছিল মণিকার আরোগ্য নিয়ে সত্যানুসন্ধানের জন্য। অসুস্থ মণিকার চিকিৎসকদের মতামত তাঁরা কেন গ্রহণ করলেন না? চিকিৎসকদের বক্তব্য, মণিকার কোনও ক্যানসার ছিলই না। হয়েছিল যক্ষ্মা। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে পেটে টিউমার হয়েছিল। ওষুধ খেয়েছে। ন’মাসে পাঁচ রকম ওষুধের কোর্স নিয়েছে। ধীরে ধীরে সুস্থ হয়েছে। যক্ষ্মা সারাতে, টিউমারও সেরেছে। এরমধ্যে অলৌকিক গল্পের কোনও স্থান নেই।

মণিকার চিকিৎসকদের এমন মতামত গ্রহণ করলে মাদারকে ‘সেন্ট’ বানাবার প্রক্রিয়াই যে থমকে যায়। আবার নতুন করে খোঁজা-খুঁজি শুরু করলে বোধহয় বড় বেশি দেরি হয়ে যাবে। পোপের অভিষেকের রজতজয়ন্তীতে তো ‘সেন্ট’ দেওয়া হবেই না। পোপের জীবিতকালে হবে এমন সম্ভাবনাও কম।

মণিকার চিকিৎসা হয়েছিল দক্ষিণ দিনাজপুরের বালুরঘাট জেলা হাসপাতালে। হাসপাতালের সুপার ডাঃ মঞ্জুল মুর্শেদ আমাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছিলেন, মিশনারিজ অফ চ্যারিটির তরফ থেকে তাঁর উপর চাপ সৃষ্টি করা হয়েছিল। চাপ দিয়ে বলাবার চেষ্টা হয়েছিল—চিকিৎসায় মণিকার অসুখ সারেনি। অসুখ সেরেছে মাদারের ছবির মিরাকেলে। ডাঃ মুর্শেদের এই বিস্ফোরক সাক্ষাৎকার ইতিমধ্যে ‘খোঁজ-খবর’ নামের অনুসন্ধান-মূলক জনপ্রিয় টিভি অনুষ্ঠানে দেখানো হয়েছে।

ডাঃ মুর্শেদ আমাকে এও জানিয়েছেন, ভ্যাটিকানের প্রতিনিধিকে নিয়ে কলকাতার একটি দৈনিক পত্রিকার এক সাংবাদিক এসেছিলেন। তাঁদের তরফ থেকেও নানাভাবে চাপ সৃষ্টি করা হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল মণিকার চিকিৎসকদের দিয়ে বলিয়ে নেওয়া, মণিকা সুস্থ হয়েছেন মাদার টেরিজার ছবির অলৌকিক ক্ষমতায় ।

একজনকে ‘সাধু’ বানাবার এমন অসাধু প্রচেষ্টা বিশ্বের কাছে বেফাঁস হলে বিতর্কের ঝড় উঠতে বাধ্য। প্রত্যাশামতোই সেই ভয়ংকর ঝড় উঠেছিল। তাইতেই হাইটেক সাজানো পরিকল্পনা তছনছ। এ’কথা তো ভুললে চলবে না, “সত্য ততটাই প্রকাশিত হয়, যতটা আমরা এগিয়ে নিয়ে যাই।” আমাদের আমজনতার সক্রিয় উদ্যোগ, আমাদের নির্লোভ সাহস এবং মেধাও বহুক্ষেত্রে হার মানে বলেই অনেক সত্য চাপা পড়ে যায় মিথ্যের ভারী অন্ধকারে।

(৫) ভ্যাটিকানের প্রতিনিধি কেন মণিকার প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা বললেন না? বললে জানতে পারতেন, মণিকার পেটের টিউমার রাতারাতি ভ্যানিস হওয়ার গপ্পোটা নেহাতই গপ্পো।

নাকি কথা বলেছিলেন, কিন্তু মনপসন্দ না হওয়ায় চেপে গেছেন? ভ্যাটিকানের স্বার্থ বিরোধী কথা বলেই চেপে গেছেন ?

পশ্চিমবঙ্গ থেকে ‘মিরাকেল’ হাজির করার সময় বাংলার যুক্তিবাদীদের আন্ডার এস্টিমেট করেছিলেন ওঁরা। লন্ডনের ‘চ্যানেল ফোর’ থেকে ‘নিউইয়র্ক টাইমস’-এর দীর্ঘ পরিক্রমায় আমাদের কিন্তু গ্যালিভার হিসেবেই হাজির করা হয়েছে। তারপরও আমাদের বিরুদ্ধে ওদের অতি আত্মতুষ্টির কারণ নিশ্চয়ই আছে। পশ্চিমী শক্তির মনে হতেই পারে, সাম্যের স্বপ্ন দেখা দেশগুলোকেই স্রেফ মগজ খাটিয়ে ধসিয়ে দিলাম, যুক্তিবাদী সমিতি সেই তুলনায় নেহাতই ‘হরিদাস পাল’।

ভ্যাটিকানের সত্যানুসন্ধানীরা যাঁদের এড়িয়ে গেছেন, আমরা তাঁদের কথাই ক্যামেরা বন্দি করেছি। মণিকার প্রতিবেশীদের সেসব কথা দেখেছেন-শুনেছেন লক্ষ লক্ষ মানুষ। দেখানো হয়েছে ‘খোঁজ-খবর’ অনুষ্ঠানে।

ভ্যাটিকানের প্রতিনিধি সম্ভবত শুধু এই সত্যটুকু জেনে উৎসাহিত হয়ে এসেছিলেন যে, ভারত দুর্নীতিতে প্রথম সারির দেশ। এটা জেনে আসেননি, সংখ্যায় অতি নগণ্য হলেও রুখে দাঁড়াবার মতো সোজা-মেরুদণ্ডী ও জয় ছিনিয়ে আনার মতো উচ্চ-মেধার মানুষ এ’দেশে এখনও আছেন ।

(৬) পোপ যখন মাদার টেরিজার ছবির অলৌকিক বিকিরণে মুগ্ধ ও প্রত্যয়ী, তখন পোপ কেন মাদারের ছবি লকেট করে গলায় ঝুলিয়ে নিজেকে সুস্থ করে তুলছেন না? তাহলে তো যারা তাঁর ও মিশনারিজ-এর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এনেছে, তাদের মুখের মতো জবাব দেওয়া যেত! পাশাপাশি আরও একটা কাজ হয়ে যেত—দ্বিতীয় অলৌকিক ঘটনা খোঁজার আর দরকারই হত না। দুনিয়ার নিরীশ্বরবাদীদের মুখে ঝামা ঘষে দিয়ে খ্রিস্টধর্মের জয়ধ্বজা ওড়াবার এমন সুযোগ কেন হারালেন? একে কী বলব—ভ্যাটিকনের বোকামি? নাকি ভ্যাটিকানের ধূর্ততা?

আমরা টিভিতে দেখলাম অসুস্থ পোপকে। হাঁটতে পারেন না। কথা বলতে পারেন না। জবুথবু অসহায় মানুষটিকে দেখে অনেকেরই খুব কষ্ট হচ্ছিল। অনেকেরই মাথায় একটা প্রশ্ন এসেছে— মাদারের ছবিওয়ালা লকেট পরে পোপ কেন তাঁর দুরারোগ্য ব্যাধি সারিয়ে নিচ্ছেন না? পোপ কী তবে জানেন, এ’ভাবে রোগ মুক্তি অসম্ভব? নামের মোহে, ক্ষমতার লোভে জেনে বুঝেই কী পোপ মানুষদের প্রতারিত করলেন ?

(৭) “প্রথম সহস্রাব্দে ইউরোপ জয় করেছি। দ্বিতীয় সহস্রাব্দে আমেরিকা। তৃতীয় সহস্রাব্দে জয় করব এশিয়া।”–এ পোপের-ই কথা। এশিয়া জয়ের প্রথম ধাপ হিসেবেই কী ভারতীয় মাদার টেরিজাকে ‘সেন্ট’ বানানোটা জরুরি ছিল? ১১০ কোটি জনসংখ্যার দেশ ভারতের বিশাল বাজার ধরতে ভারতীয় নারীদের বিশ্বসুন্দরী বানাবার খেলায় নেমেছে বহুজাতিক প্রসাধনী সংস্থাগুলো। পানীয় থেকে গাড়ি উৎপাদনকারী বহুজাতিক সংস্থাগুলো তাদের পণ্যের ভারতীয় বাজার ধরতে ভারতীয় ক্রিকেটারদের মডেল বেছেছে। ফলে ক্রিকেট র‍্যাংকিং-এ সাত নম্বর দেশ ভারতের ক্রিকেটাররা রোজগারে এক নম্বর। প্রচারের দৌলতে ভারতীয়রা ক্রিকেট খাচ্ছে ভালো। কোক-পেপসি থেকে ফোর্ড সব্বাই বাজার পাচ্ছে ভালো। ভারতের বাজারে খ্রিস্টধর্ম বিক্রি করতে মাদার টেরিজাকে আদর্শ মডেল জেনে তাঁকে সেন্ট বানাবার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হতেই পারে। টেরিজার চেয়ে আদর্শ ভারতীয় খ্রিস্টান মডেল আর একজনও নেই।

অতএব, টেরিজার সঙ্গে অলৌকিক রোগ আরোগ্যের আষাঢ়ে গল্প ফাঁদা হয়েছে।

দুঃখের কথা, টেরিজা কোনও দিন এসব হিজিবিজি অলৌকিক

চিকিৎসায় বিশ্বাস করতেন না। নিজের অসুখ হলে

বারবারই আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের সাহায্য

নিয়েছেন। জীবিতকালে কাউকে ঝাড়-ফুঁক

করে, অলৌকিক উপায়ে রোগ

সারাবার দাবি করেননি।

সেই মাদার টেরিজাকে অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারিণী বলে চালাবার নোংরা চেষ্টায় নামলেন পোপ, নামলো ভ্যাটিকান ও মিশনারিজ অফ চ্যারিটি।

পৃথিবীতে খ্রিস্টধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা মুসলিমদের প্রায় দু’গুণ, হিন্দুদের আড়াই গুণ, (তথ্য সূত্রঃ ওয়ার্ল্ড অ্যালমানাক, ২০০২ এবং মনোরমা ইয়ারবুক, ২০০৩)। খ্রিস্টধর্মাবলম্বী দেশগুলোই অর্থে ও অস্ত্রে আর সবার চেয়ে বড় বেশি রকম এগিয়ে। ওরা চায় পৃথিবীর সব্বাইকে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করে ছাড়তে। তেমনটা হলে খ্রিস্টান ভ্রাতৃত্ববোধে সুড়সুড়ি দিয়ে সব বেয়াদপদের পায়ের তলায় রাখা যাবে। এখনও কিছু বেয়াদপ সাম্যের স্বপ্ন দেখে। এই স্বপ্নকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে ভ্রাতৃত্ববোধের আহ্বানই যথেষ্ট। এরচেয়ে বড় অহিংস প্রতিবিপ্লবী অস্ত্র আর নেই। এই চিন্তা থেকেই পৃথিবী জুড়ে খ্রিস্টানধর্মীয়দের সংখ্যা বৃদ্ধির পরিকল্পনা। এই পরিকল্পনা আমেরিকার মস্তিষ্কপ্রসূত অসাধারণ কার্যকর অহিংস অস্ত্র ‘ব্রেনওয়ার’ বা ‘মস্তিষ্কযুদ্ধ’-এর অঙ্গ।

‘ব্রেনওয়ার’ বা মস্তিষ্কযুদ্ধেরই পরিকল্পনা অনুসারে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে অঢেল অর্থসাহায্য দিয়ে দিকে দিকে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা গড়ে তোলা হয়েছে। এটা জেনেই গড়ে তোলা হয়েছে যে, সংস্থাগুলোর পালের গোদারা সাহায্যের বড় অংশটাই চুরি করে নিজেদের পেট ভরাবে। “তা ভরাক, তবু আমাদের উদ্দেশ্য তো সফল হবে’—এই ভেবেই সাহায্যকারীরা চুপ। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলো ধনী দেশগুলোর ‘দালাল’ হিসাবে নানা তথ্য জোগাবে, গোয়েন্দাগিরি করবে, প্রয়োজনে নির্দেশ পালন করবে।

মস্তিষ্কযুদ্ধের পরিকল্পনারই অঙ্গ পৃথিবী জুড়ে খ্রিস্টধর্মীদের সংখ্যা বাড়াতে মিশনারিজদের পাঠানো, তাদের পালন ও বৃদ্ধি ঘটানো। এ জন্য প্রতি বছর কোটি কোটি ডলার, স্টার্লিং পাউন্ড ও ইউরো আসছে মিশনারিজদের হাতে। তবে এসব সাহায্য সাধারণত সোজাসুজি আসে না। আসে একটু ঘুর পথে

ভারতে কী ভাবে সাহায্য আসছে, একটু ফিরে দেখি আসুন। এ’থেকেই বিশ্বের চিত্রটা অনুমান করে নিতে অসুবিধে হবে না। খ্রিস্টধর্মাবলম্বীদের দেশ থেকে ভারতের বিভিন্ন মিশনারি প্রতিষ্ঠানে দান হিসেবে আসছে গুঁড়ো দুধ, ভোজ্য তেল, গম ইত্যাদি নানা ভোজ্যসামগ্রী। এইসব সামগ্ৰী খোলা বাজারে পাইকারদের কাছে বিক্রি করে দেয় মিশনারি প্রতিষ্ঠানগুলো। বিনিময়ে পায় ভারতীয় টাকা। বাঁশের খুঁটির ওপর টিনের চাল দিয়ে এরা শুরু করে। দু-চার বছর ঘুরতে না ঘুরতেই বিশ পঞ্চাশ বিঘা জমি নিয়ে গড়ে তোলে ফার্ম হাউস, স্কুল, হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্র, চার্চ অফিস ঘর ইত্যাদি।

ভারতে শিকড় গাড়া চার্চ ও মিশনগুলো কাউকে জোর করে

ধর্মান্তরিত করে না। তবে খ্রিস্টধর্ম নিলে বিনে

পয়সায় রেশন মেলে, চিকিৎসা মেলে,

শিক্ষা মেলে, হাতের কাজ শেখা

যায়, এমন কী কাজও মেলে।

ফলে ধর্মান্তরের রাজনীতি চার্চ ও মিশনগুলো দিব্যি চালিয়ে যাচ্ছে। ওরা নিঃস্বার্থ সেবার ব্রত নিয়ে আসেনি। ওদের নীতি, ‘এক হাতে নাও, এক হাতে দাও’। সেবা বিলোবার মতোই যিশুর মাহাত্ম্য প্রচারের ব্যাপারটাও গৌণ। মুখ্য হল –বিশ্ব জুড়ে খ্রিস্টধর্মীয়দের সংখ্যা বৃদ্ধি । খ্রিস্টধর্মীয়দের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ জাগিয়ে তোলা। ধর্মীয় শ্রেণি চেতনা জাগিয়ে তোলা। এই শ্রেণি চেতনাই ধর্ম-ভাইদের স্বার্থ দেখবে।

একটি উদাহরণ আনলেই বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে। ১৯৮৪ সালে ভুপালের ইউনিয়ন কার্বাইড কারখানায় গ্যাস দুর্ঘটনা ঘটে গেল। ভারতের সর্বকালের ভয়ংকরতম দুর্ঘটনা। মারা গেলেন ১৬ হাজারের বেশি মানুষ। শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ও সারাজীবনের মতো পঙ্গু হয়ে গেলেন ৫ লক্ষের বেশি মানুষ। এই বিপর্যয়ে মানবতার পূজারী চার্চ ও মিশনারিজরা ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে, ইউনিয়ন কার্বাইডের বিরুদ্ধে এসে দাঁড়াননি। তাঁদের এই নীরবতাই প্রমাণ করে দিল, খ্রিস্টধর্মীয় মালিকদের বিরুদ্ধে দাঁড়াবার মতো হাঁটুর জোর নেই। পরিকল্পনার রূপকারদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো সম্ভব নয়।

এসবের পরে মনে হতেই পারে ভারতের মতো বিশাল জনসমষ্টির দেশে ধর্মান্তরের জোয়ার আনতেই মাদার টেরিজাকে পণ্য করা হয়েছে। খ্রিস্টধর্মের পক্ষে হুজুগের ঝড় তুলতেই মাদারকে ‘সেন্ট’ বানাবার ষড়যন্ত্র। আর এই মনে হওয়ার পিছনে যথেষ্ট জোরালো যুক্তি আছে।

(৮) ভ্যাটিকানের ইচ্ছেয় প্রায় দু-হাজার সাল পর্যন্ত সূর্য চক্কর কেটেছে পৃথিবীকে। ভ্যাটিকানের সুতোর টানে নাচে অনেক নট-নটী। ভ্যাটিকানরূপী খ্রিস্টধর্মকে নিজেদের স্বার্থে বাঁচিয়ে রেখেছে পশ্চিমী ধনকুবের গোষ্ঠী। পৃথিবী জুড়ে শোষণ প্রক্রিয়াকে মসৃণ রাখতেই খ্রিস্ট ভ্রাতৃত্ববোধের প্রয়োজনে ভ্যাটিকানের রমরমা বেড়েই চলেছে। তবে কতদিন চলবে, কবে ভাঙবে, সময় বলে দেবে। পশ্চিমী ধনকুবেররা শুধু চার্চ, মিশনারি ও স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের উপর ভরসা করে নেই। তারা বিপুল অর্থের জাল ছড়িয়ে ‘বন্ধু’ গড়ে তোলে। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক জগতের প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব, প্রচার মাধ্যমের নামীদামি সাংবাদিক, রাজনীতিকদের সঙ্গে প্রথমে সম্পর্ক স্থাপন এবং পরবর্তীতে ‘দিবে ও নিবে’ মার্কা একটা পেশাদারী সুসম্পর্ক গড়ে তোলে। তারই ফলে যখন কোক-পেপসির বিরুদ্ধে জেহাদের দাউদাউ আগুন জ্বলে উঠেছিল ভারতে, তখন সে আগুনে জল ঢালার কাজে ওরা নামাতে পেরেছিল ‘বন্ধু’ সাংবাদিক ও রাজনীতিকদের। এই বন্ধুদেরই কেউ কেউ ‘সাপ হয়ে কাটে, ওঝা হয়ে ঝাড়ে’।

ছাপা-চাপার আলো আঁধার

২০০২-এর অক্টোবরে প্রাথমিক আঘাতের তীব্রতায় কেঁপে উঠেছিল ভ্যাটিকান। ভ্যাটিকান যেই মণিকার গপ্পো বাজারে ছাড়ল, সঙ্গে সঙ্গে যুক্তিবাদী সমিতি ভ্যাটিকানের বুজরুকি ফাঁস করল তথ্য-প্রমাণ হাজির করে। বিশ্বের তামাম বিখ্যাত মিডিয়া যুক্তিবাদী সমিতির তুলে পরা তথ্য-প্রমাণ এতটাই গুরুত্বের সঙ্গে প্রচার করলো, যা কল্পনার অতীত। রয়টার, এ এফ পি, অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস, পি টি আই, ইউ এন আই-এর মতো সংবাদ বিক্রিকারী সংস্থাগুলো মারফত পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের পত্র-পত্রিকা ও রেডিও আমাদের সত্য উন্মোচনের খবর জানল ও প্রচার করল। প্রচারিত পত্র-পত্রিকার সংখ্যাই কয়েক লক্ষ। ভ্যাটিকানের কাছে, পশ্চিমীদের কাছে এ যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত। মস্তিষ্কযুদ্ধের শুরুর কাল থেকে জয়ের পর জয়-ই শুধু এসেছে। এ পরাজয় কখনই মানা যায় না। এ’তো সমুদ্র পাড়ি দিয়ে খালে এসে ডোবা?

ফলে অবশ্যই তৈরি হল একটা ‘মাস্টার প্ল্যান’। আমাদের বিরুদ্ধে পালটা বৌদ্ধিক আক্রমণ শুরু হল। আক্রমণ বিশ্লেষণ করে বুঝতে অসুবিধা হল না পরিকল্পনার চরিত্র। যুক্তিবাদী সমিতির কাজকর্ম যতই প্রভাব সৃষ্টিকারী হোক না কেন, শিকড় কলকাতায়। অতএব কলকাতার পত্র- পত্রিকাগুলো যদি যুক্তিবাদী সমিতিকে টেরিজা ইস্যুতে ‘ব্ল্যাক আউট’ করে, তবে মানুষ ওদের কথা জানতেই পারবে না। ওরা যে খাতে মানুষের ভাবনাকে নিয়ে যেতে চাইছে, তা পারবে না। ‘দিবে আর নিবে’ মার্কা বন্ধুদের কাজে লাগাও। প্রতিটি মিডিয়ার সহযোগিতা পেতে যে কোনও মূল্যে রাজি হয়ে যাও ।

সায়েবদের মাথা থেকে বেরিয়ে আসা পরিকল্পনা যে এমনটাই ছিল, পারিপার্শ্বিক ঘটনা তেমনই ইঙ্গিত করে। সারা বিশ্ব যখন ভ্যাটিকানের বুজরুকি ফাঁস নিয়ে তুমুল ভাবে আলোড়িত, যুক্তিবাদী সমিতির ক্রেজ তুঙ্গে, তখন কলকাতার পত্র-পত্রিকা বদ্ধ জলাশয়ের মতই নিস্তরঙ্গ। ব্যতিক্রমী দু-একটি পত্রিকা ছাড়া সবাই তখন ‘ছাপা ও চাপা’র খেলায় ব্যস্ত।

৮ অক্টোবর ২০০৩। এক নম্বর বাংলা দৈনিকের এগারো নম্বর পৃষ্ঠায় একটি খবর প্রকাশিত হল। প্রায় এক চতুর্থাংশ পৃষ্ঠাজোড়া খবর, ‘সন্তের সরণীতে টেরিজা : ব্রিটিশ ক্যামেরায়’। বড়- সড় একটা ফোটোগ্রাফও ছাপা হয়েছে সঙ্গে। ছবির তলায় শিরোনাম, ‘কলকাতায় ‘মেকিং অফ এ মডার্ন সেন্ট’-এর শ্যুটিং। ক্যামেরার লুক-থ্রু করছেন পরিচালক ডেভিড মেলোন।’ শ্যুটিং চলছিল আমাদের যুক্তিবাদী সমিতির একটি পথ সভায়। পূর্ব কলকাতার রাসমণি বাজারে পথসভা করেছিলাম, মাদারকে যেভাবে সেন্ট বানাবার নামে প্রহসন করা হচ্ছে, তার বিরুদ্ধে। সেই পথসভার ছবি ছাপা হয়েছে।

সেদিন শ্যুটিং চলাকালীন প্রচুর ছবি তুলেছিলেন পত্রিকার আলোকচিত্রী। গোটা খবরে কোথাও উল্লেখ নেই—কাদের নিয়ে শ্যুটিং হচ্ছিল। কেন নেই? ভুল? নাকি ব্ল্যাক আউট?

পরিচালক ডেভিড মেলোন পথসভার আগে আমারই ফ্ল্যাটে এক দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নেন। ডকুমেন্টারিতে তার অত্যন্ত গুরুত্ব থাকলেও পত্রিকাটির প্রকাশিত খবরে তার কোনও উল্লেখ ছিল না। এখানেও কী সেই ব্ল্যাক আউট ?

বিষয়টা আমার বা যুক্তিবাদী সমিতির স্বার্থের সঙ্গে শুধু জড়িয়ে নেই। বিষয়টা নীতির। জানি, একটা পত্রিকায় কী ছাপা হবে, কী চাপা হবে তা ঠিক করার আইনি অধিকার পত্রিকা মালিকের বা মালিকের ঠিক করে দেওয়া কর্মচারীর। পত্রিকার পাঠক হিসেবে আমরা ততটুকুই জানতে পারি, যতটা পত্রিকা আমাদের জানায়। কিছু কিছু পত্র-পত্রিকা তাদের ছাপা ও চাপা ক্ষমতাকে জায়গা মতো বিক্রি করে। আমাদের ব্ল্যাক আউট করার আইনি অধিকার এক নম্বর পত্রিকাটির আছে। কিন্তু প্রশ্ন এই—বিষয়টা নৈতিক ছিল কী? নাকি এ হল বিজ্ঞাপনদাতা জ্যোতিষী-তান্ত্রিক রেইকি বিশারদ ও ফেংশ্যুই বিশেষজ্ঞদের বিরুদ্ধে আমাদের পিছনে লাগার বদলা? নাকি এ সেই বাঙালি কাকড়ার পুরনো গল্প- যে উঠছে, তাকে টেনে নামাও। অথবা পত্রিকাগোষ্ঠীর সুরে সুর না মেলানো, কালো কে ‘কালো, সাদাকে ‘সাদা’ বলা মানুষটির ‘ঔদ্ধত্য’ আহত করেছে কোনও পত্রিকার ইগোকে এ তারই প্রতিফলন ?

ব্ল্যাক আউট করার কারণ এক বা একাধিক হতে পারে, তবে কারণ ছিল।

আমাদের ব্ল্যাকআউট করার ঠিক কারণটা কী? জানি না। তবে এটা জানি— এইসব পত্রিকা পড়ে অনেক কিছুই শেখা যায়। শেখা যায়— লজ্জার মাথা খেয়ে কীভাবে খবর চাপতে হয়। ছাপা ও চাপার রাজনীতি শিখতে এ’সব পত্রিকা পড়তেই হয়, নতুবা পিছিয়ে পড়তে হয়।

উদাহরণ একটা টেনেছি। কলকাতা থেকে প্রকাশিত পত্রিকাগুলোর প্রায় সকলেই আমাদের অনন্য এই লড়াইয়ের খবর চাপার ব্যাপারে একই রকমের ভূমিকা পালন করেছে। এ’দেশের এবং পৃথিবীর অন্যান্য মিডিয়া যখন আমাদের আন্দোলনের খবর প্রচার করে ভ্যাটিকানের গলার গাস হয়ে দাঁড়িয়েছে, তখন কলকাত্তাইয়া পত্র-পত্রিকার ভূমিকা বিস্ময়জনক। এই বিস্ময় চেপে রাখেননি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মিডিয়া-ব্যক্তিত্ব। তাঁদের মনেও নানা প্রশ্ন— খেলাটা কী? কে খেলাচ্ছে? গন্ধটা সন্দেহজনক? ইত্যাদি ।

সত্য ততটাই এগোয়, যতটা এগিয়ে নিয়ে যাই

‘যো জিতা ওহি সিকন্দর।’ এত কিছুর পরেও আমরা জিতেছি। যুক্তিবাদী সমিতি জিতেছে। যুক্তিবাদী মানুষরা জিতেছে। এদেশের ও বিদেশের সৎ সাংবাদিকদের সংগ্রাম শেষপর্যন্ত জয়যুক্ত হয়েছে। কলকাতা যখন ব্ল্যাক আউটের জ্বরে কাঁপছে, তখন ভ্যাটিকানে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছে বিশ্বের তাবড় সংবাদ সংস্থা, পত্র-পত্রিকা, বৈদ্যুতিন প্রচারমাধ্যমগুলো। এই অনন্য জয়ে তাদের যে অকুণ্ঠ সহযোগিতা পেয়েছি, তার জন্য হাজারো কুর্নিশ জানাই। কুর্নিশ জানাই এইসব সংস্থার সঙ্গে যুক্ত সাংবাদিকদের যাঁদের বন্ধুত্ব, উপদেশ ও সহযোগিতা ছাড়া এ’জয় সম্ভব ছিল না। এঁদের সম্মিলিত সহযোগিতার ফলেই কলকাতার আট-দশটা পত্রিকা যখন আমাদের বয়কট করে চলেছে, তখন পৃথিবী জুড়ে কয়েক লক্ষ পত্রিকায় আমরা জ্বল-জ্বল করছি। ওয়েবসাইট খুলে ‘মাদার টেরিজা’ বা ‘র‍্যাশনালিস্ট প্রবীর’ টিপলেই হুড়মুড় করে বেরিয়ে আসছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রচারিত বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের দেওয়া খবর। যুক্তিবাদীদের উদ্দীপ্ত করার মতো খবর।

১৯ অক্টোবর ২০০৩। এই দিন টেরিজাকে সরাসরি ‘সেন্ট’ ঘোষণা করা হবে, সব ঠিকঠাক। ‘বিয়েটিফিকেশন’ বা ‘স্বর্গীয় মহিমা প্রদান’ অনুষ্ঠান বাদ দিয়ে সরাসরি ‘সেন্ট’ বা ‘সন্ত’ ঘোষণা করা হবে এমনই সিদ্ধান্ত নিয়ে সেই মতো ব্যাপক বর্ণময় পরিকল্পনা গ্রহণ করল ভ্যাটিকান। টেরিজার ছবি সহ বৈচিত্রময় নানা স্মারকের আয়োজন ছিল। ছিল দুনিয়া জুড়ে বিশাল প্রচার। এই প্রত্যয়ী প্রচারকে যে দ্রুততার সঙ্গে তুঙ্গে নিয়ে গেল, তা শুধু ভ্যাটিকানকেই মানায়। পৃথিবীর সমস্ত ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা খ্রিস্টধর্মীয়দের একমাত্র ধর্মগুরু পোপ। জনসংখ্যা বিচারে পৃথিবীর প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষই খ্রিস্টধর্মাবলম্বী। এই অবস্থায় বর্তমান পোপের ক্ষমতা পূর্বসূরিদের তুলনায় অনেক বেশি। তাই তো তিনিই পারেন ইচ্ছে মতো খ্রিস্টধর্মের অচলায়তন ‘ক্যানান ল’কে খেয়াল খুশিতে ভাঙতে। মাদার টেরিজার জীবিতকালের সব ভালো কাজকে তুচ্ছ করে উড়িয়ে দিলেন পোপ। টেরিজা যখন ছবি হয়ে গেলেন, তখন ছবি নিয়ে অসত্য অলৌকিকের গল্প চালাতে চাইছেন পোপ। প্রতিবাদ প্রত্যাশিত ছিল প্রোটেস্টান্টদের কাছ থেকে। ওদের কাছ থেকে তেমন প্রতিবাদ এল না বলে হয়তো অনেকেই অবাক। কিন্তু সবাই নন, যাঁরা জানেন, খ্রিস্টসমাজে ব্রাত্য প্রোটেস্টান্টরা যখন কোঠাসা, তখন এই পোপই তাদের ত্রাণকর্তা হিসেবে হাজির হয়েছেন। ফলে অতিমাত্রায় সংখ্যালঘু প্রোটেস্টান্ট ক্যাথলিকদের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক গড়ার সুযোগ পেয়ে কৃতজ্ঞতায় গলে-মলে একশা। কৃতজ্ঞ মানুষগুলো এখন প্রতিবাদী হবে? পাগল ?

পোপের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে খ্রিস্টধর্মীদের স্পর্শকাতরতা, জাত্যভিমান জন্মগতভাবে খ্রিস্টধর্মাবলম্বী, কিন্তু বর্তমানে নিরীশ্বরবাদী, এমন মানুষদেরও অনেকে জাত্যাভিমানের প্রতীক হিসেবে পোপকে দেখেন। এমনই এক কঠিন পরিস্থিতিতে পোপকে তাঁর লক্ষ্য থেকে পিছু হটতে বাধ্য করা ছিল অসম্ভবেরও কিছু বেশি।

অলৌকিক ক্ষমতার জন্য টেরিজাকে ‘সেন্ট’ ঘোষণা করতে চেয়েও শেষ পর্যন্ত পোপ পারেননি। কিন্তু এই জয় তুচ্ছ হয়ে যায়, যখন দেখি ‘সেন্ট’ ঘোষণার সঙ্গে আলৌকিকতাকে জুড়ে দেবার বিরুদ্ধে বিশ্বজনমত গড়ে উঠেছে। আর সেই জনমত গড়ার ক্ষেত্রে আমাদের ভূমিকাকে দ্বিধাহীনভাবে স্বীকৃতি দিয়েছে BBC News (বিবিসি নিউজ) ১৮.১০.২০০৩ এর বিবিসি নিউজ/ওয়ার্ল্ড/সাউথ এশিয়ার দু’পৃষ্ঠা ব্যাপী ওয়েবসাইট থেকে দ্বিতীয় পৃষ্ঠার সামান্য একটু অংশ তুলে দিচ্ছি।

” Prabir Ghosh, secretary of the Calcutta – based Indian Rationalists Association, . openly questions the miracle.

“Mother Teresa was a great soul and I think it is an insult to her legacy to make her sainthood dependent on bogus miracles. It should be linked to her great work among the poor,” says Mr. Ghosh.

He says Mother Teresa herself went to the best hospitals- and the best doctors in the city when she fell ill.

Most agree with him that Mother Teresa does not need miracles to be declared a saint. “

এই একই মূল সুর যুক্তিবাদী সমিতি রেখেছে বিভিন্ন সংবাদ বিক্রিকারী সংস্থা থেকে শুরু করে আমেরিকান ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন, অস্ট্রেলিয়ান ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন, জার্মান ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন, ডেইলি টেলিগ্রাফ, দ্যা ইন্ডিপেন্ডেন্ট, টাইম, নিউইয়র্ক টাইমস, লেমন ইত্যাদি বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমের কাছে। মাদার গরিবদের জন্য অনেক কিছুই করেছেন। তিনি পথশিশুকে যেমন বুকে টেনেছেন, তেমনই কুষ্ঠ রোগীর শুশ্রূষা করেছেন। হিন্দু-মুসলিম রায়টে অগ্নিগর্ভ কলকাতার বস্তি এলাকায় তিনিই ছুটে গেছেন সবার আগে। তাঁর এই মমতাময়ী রূপের জন্যে ‘নোবেল শান্তি পুরস্কার’ পেয়েছেন। সেই একই কারণে তাঁকে ‘সেন্ট’ উপাধি দিতে অসুবিধে কোথায়? তিনি যখন ছবি হয়ে গেলেন তখন তাঁর ছবি অলৌকিক ক্ষমতা পেল, তাই তিনি ‘সেন্ট’ হবার উপযুক্ত হয়ে উঠলেন—এমন যাঁরা বলেন, তাঁরা মাদারকে অপমান করেন, সত্যকে অপমান করেন। ভারতীয় ও কলকাতাবাসী হিসেবে আমরাও অপমানিত বোধ করি।

আমাদের দেশে আর যারই অভাব থাক, অলৌকিক বাবাজি-মাতাজিদের কোনও অভাব নেই। পত্রিকাগুলোর দু’য়ের পাতার বিজ্ঞাপন সে কথাই বলে। তারপরও গ্রাম-গঞ্জে ছড়িয়ে রয়েছে কত লক্ষ ওঝা-গুনিন। এদের অলৌকিক শক্তির কথা পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে জানাতে হয় না। গাঁয়ের মানুষরা মফস্সলের মানুষরা এমনিই জানেন। এরপরও রয়েছেন সাঁই, রবিশংকর, নির্মলা, আত্মার মতো কয়েক হাজার হাইটেক অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী। অর্থাৎ মোদ্দা কথা হিন্দুদের মধ্যে অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারীর সংখ্যা লক্ষ লক্ষ ।

এরা কেউই খ্রিস্টজগতের পোপের মতো সুসংগঠিত ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করে না। সব্বাই অসংগঠিত। এদের কারও পিছনেই সমস্ত হিন্দুত্ববাদীরা নেই। চার শঙ্করাচার্যের মধ্যে ক্ষমতার আঁকচা-আঁকচি, কামড়া-কামড়ি দেখার পর বুঝতে অসুবিধে হয় না লক্ষ গুরুর লক্ষ হাঁড়ি।

এইসব অসংগঠিত ‘অলৌকিক ক্ষমতাধরদের বুজরুকি ফাঁস করা অনেক সহজ। অসম্ভব রকমের কঠিন হল জাত্যভিমানী, সব কিছুতে শক্তির তুঙ্গে অবস্থানকারী একটি সুসংগঠিত রিলিজিয়ন গোষ্ঠীর প্রতীক পোপের বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত জয় হাসিল করা। সুসংগঠিত গোষ্ঠীর মধ্যে সরাসরি বিভাজন সৃষ্টি করা। পোপ ও ভ্যাটিকানের ওই ‘ক্যানান ল’র বিরুদ্ধে জনমত তৈরি করা।

এরপরও পোপ আজ বাদে কাল আরও একটি সাজানো

অলৌকিক ঘটনা হাজির করে টেরিজাকে ‘সেন্ট’

উপাধি দিতেই পারেন। কিন্তু তাঁর এই

প্রতারণার বিরুদ্ধে ভবিষ্যতে আঙুল

তুলবে খ্রিস্টধর্মীয়রাই। এই

অবস্থা তৈরি করা গেছে।

এই যে একটা গুণগত অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে খ্রিস্টান সমাজে— এটাই যুক্তিবাদীদের সবচেয়ে বড় জয়, পোপ, আপনি বিয়েটিফিকেশনের পরও হেরে গেলেন। আপনার ভক্তরাই আপনার ফাঁকি ধরে ফেলেছেন।

এমন এক অভাবনীয় জয়ের পর বলতেই হচ্ছে, এটাই আমার জীবনের ও সমিতিকালের সবচেয়ে কঠিন ও বড় জয়।

* বি.দ্র. বিষয়টা আরও একটু পরিষ্কার হয়, যদি বলি— কোনও ধর্মগুরু ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ওটাই সবচেয়ে বড় জয়। এভাবে বলার কারণ, যুক্তিবাদী সমিতি ও তার সিস্টার কনসার্ন ‘হিউম্যানিস্ট অ্যাসোসিয়েশন অফ ইন্ডিয়া’র কাজ শুধু তো অলৌকিক রহস্য উন্মোচন করা নয়, তারচেয়ে অনেক ব্যাপক। সুন্দর সমাজ গড়ার লক্ষ্যে, মুক্তমনের লক্ষ্যে, যুক্তিমনস্ক মানুষ গড়ার লক্ষ্যে, শোষণের বিরুদ্ধে, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আমাদের প্রতিদিনের প্রতি মুহূর্তের লড়াই। আমরা এদেশে বেশ্যাবৃত্তিকে আইনি করার চেষ্টাকে রুখেছি, রিলিজিয়ান কলমে ‘মানবতা’ লেখার আইনি লড়াই জিতেছি, ‘ধর্মনিরপেক্ষ ভারতে রাষ্ট্র থাকবে ধর্ম বর্জিত’–আমাদের এই সংজ্ঞা ভারতের বেশির ভাগ রাজনৈতিক দলই গ্রহণ করেছে। এমন জয় অনেক আছে। তার পরও নিঃসন্দেহে বলা যায়, আমাদের সর্বকালীন সেরা জয়—কাশ্মীর প্রসঙ্গে ভারত ও পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলোর মত পরিবর্তনে সক্ষম হওয়া। কাশ্মীর নিয়ে ভারত-পাকিস্তানের কট্টর অবস্থানকে পালটে আমরাই প্রথম বললাম—কাশ্মীর কাশ্মীরিদের। ভারত-পাকিস্তান যখন ব্রিটিশ শক্তির অধীন, তখনও কাশ্মীর স্বাধীন ছিল। ভারত ও পাকিস্তান ছলে-বলে-কৌশলে কাশ্মীরের উপর দখলদারি কায়েম রেখেছে। কাশ্মীর সমস্যা কখনই ভারত ও পাকিস্তানের দ্বিপাক্ষিক আলোচনার বিষয় হতে পারে না। কাশ্মীর সমস্যা নিয়ে আলোচনায় কাশ্মীরিদের রাখতেই হবে। তাদের মতামতকেই সহানুভূতির সঙ্গে মর্যাদা দিতে হবে। নতুবা ‘স্বাধীনতা সংগ্রাম’ বা ‘সন্ত্রাসবাদ’ যাই বলুন না কেন, তা কখনই বন্ধ হবে না।

এই মতের পক্ষে জনমত গড়ে তোলা ও রাজনৈতিক দলগুলোর গ্রহণযোগ্যতা পাওয়া ছিল অত্যন্ত কঠিন কাজ। ঝুটা জাতীয়তাবাদের আবেগে ভারত-পাক জনগণ যখন গা ভাসিয়েছে, কার্গিল নিয়ে দু’দেশ যখন উত্তপ্ত, তখন এই ধরনের পালটা স্রোতে সাঁতার কাটা যে কত কঠিন তা আমরা অনুভব করেছি অনেক মূল্যে। ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ বলে চিহ্নিত করে রাষ্ট্র আমাকে শেষ করতে চাইবেই—জানতাম। রাষ্ট্র যন্ত্রের দুর্নীতি ও হিংস্রতা সাধারণের চিন্তারও বাইরে। রাষ্ট্র যেমনটি চাইবে তেমনটিই প্রচার করবে প্রচারমাধ্যমগুলো। কারণ প্রচারমাধ্যমের মালিকরা শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রযন্ত্রেরই সহায়ক। অতএব আমাকে গুলিতে ঝাঁজরা করে অনেক গোলাবারুদ পাওয়ার গল্প ফাঁদলে মানুষ তাও খাবে চেটে-পুটে।

এমনই এক কঠিন সময়ে এই লড়াইয়ে সর্বাত্মকভাবে ঝাঁপিয়ে পড়তে ব্যাংকের বাঁধা আয়ের চাকরি ছেড়ে অনিশ্চিত জীবনে পা রেখেছি। টাডায় গ্রেপ্তারের সমস্ত রকম ঝুঁকি নিয়ে লিখলাম একটি পুস্তিকা, ‘কাশ্মীর সমস্যাঃ একটি ঐতিহাসিক দলিল’।

বইটি ভারতে প্রকাশিত হলে আমার এ সমিতির উপর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস নেমে আসবে ধরেই নিয়েছিলাম। আমার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকেই এমনটা ধরে নিয়েছিলাম। ফলে বইটির প্রথম প্রকাশ ঘটল লন্ডন থেকে। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে অভাবনীয় সাড়া পাই। ইংলন্ড, ইউরোপ, আমেরিকার সাংবাদিকদের মধ্যে একটা বিরাট আলোড়ন তুলেছিল পুস্তিকাটি। ‘ডেইলি টেলিগ্রাফ’ ও ‘টাইম’- এর মতো বিশ্বখ্যাত দৈনিক ও ম্যাগাজিনের সাংবাদিক সশরীরে হাজির হয়েছেন আমাদের কথা শুনতে।

ভারত থেকে বইটির প্রকাশক পাওয়া তখন অসম্ভব ব্যাপার। হিউম্যানিস্টস অ্যাসোসিয়েশনকে প্রকাশক হিসেবে খাড়া করলাম। বইটি পড়েই গ্রেপ্তার হওয়ার শঙ্কায় অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট ডাকাবুকো ডাক্তার পদত্যাগ করলেন। এদেশ থেকে বইটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে একটা অভাবনীয় ঘটনা ঘটে চলল। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ও ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে প্রকাশিত পত্র-পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হল লেখাটি। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মুখপাত্র অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে ছাপা হল গোটা পুস্তিকাটি। ফলে সমাজনীতি ও রাজনীতি সচেতন মানুষ এবং আমজনতার একাংশ আমাদের মতামতের সঙ্গে পরিচিত হলেন, কাশ্মীরের ইতিহাসের সঙ্গে পরিচিত হলেন। গড়ে উঠল আমাদের মতামতের পক্ষে রাজনৈতিক মত ও জনমত। আমাদের সমিতি ছাড়াও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সাংস্কৃতিক সংগঠন কাশ্মীর প্রসঙ্গ নিয়ে সেমিনারের আয়োজন করতে লাগলেন। খোলা ময়দানের সেমিনারগুলোয় অবাক করা ভিড়। ফল হিসেবে ভারত-পাক রাজনৈতিক দলগুলোর দৃষ্টিভঙ্গিই গেল আমূল পালটে। কাশ্মীর কাশ্মীরিদের—এই মত এখন যে পৃথিবী জুড়েই স্বীকৃতি পেয়েছে, এ’খবর সচেতন মানুষদের সবারই জানা। কেন্দ্রে ক্ষমতার গদিতে কট্টর হিন্দুত্ববাদী বিজেপি। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তারাও বুঝে গেছে কাশ্মীর আর ভারত- পাক দ্বিপাক্ষিক বিষয় নেই। কাশ্মীরিদের সঙ্গে আলোচনায় বসাটা যে অনিবার্য, তা বুঝে নিয়েছে। পরিস্থিতি বিচার করে পুস্তিকাটি আরও বিস্তৃত ও গভীর ভাবে লেখায় হাত দিই। ২০০০- এর জানুয়ারিতে ‘স্বাধীনতার পরে, ভারতের জ্বলন্ত সমস্যা’ গ্রন্থে লেখাটি গ্রথিত হল। প্ৰকাশ করার হিম্মত দেখালো দে’জ পাবলিশিং। ‘কাশ্মীরে আজাদির লড়াই’ প্রকাশিত হল ২০১০ সালে সর্বশেষ পরিস্থিতি এখানে আছে।

মানবতার পক্ষে, গভীর অন্যায়ের বিপক্ষে অবস্থা পালটে দেবার এই লড়াই আমার জীবনের ও সমিতিকালের কঠিনতম লড়াই, কঠিনতম চ্যালেঞ্জ জেতা ।

‘সেন্ট’ করা হোক কাজের জন্যে

মাদার টেরিজাকে ‘সেন্ট’ করার আমরা বিরোধী নই। আমরা মানে যুক্তিবাদীরা। বিরোধী তাঁকে ‘সেন্ট’ বানাবার পদ্ধতি নিয়ে। টেরিজা কী এমন কোনও কাজ করেননি, যার জন্য তাঁকে সম্মানিত করা যেত? যেমনটা করেছিল নোবেল পুরস্কার কমিটি। ‘নোবেল শান্তি পুরস্কার’ দেওয়ার জন্য টেরিজার সঙ্গে কোনও অলীক কাহিনি জুড়তে হয়নি সেদিন। নোবেল পাওয়ার দু’যুগ পরে মানুষ এগোল, না পিছোল? প্রশ্ন জাগে, যখন দেখি টেরিজাকে সম্মান জানাতে হাতড়ে, মিথ্যের পাঁক খুঁজে বের করে আনতে হয় মণিকা-কাহিনিকে। এতে ক্যাথলিক খ্রিস্ট সম্প্রদায় মাদারকে সম্মানের বদলে অসম্মানের পাঁকেই পুঁতে দিলেন। শিক্ষায় সংস্কৃতিতে এগিয়ে থাকা পশ্চিমী খ্রিস্টানরা

ডাঃ রঞ্জন মুস্তাফি, মণিকার চিকিৎসক

‘সেন্ট হুড’-এর নামে এ কোন্ সমষ্টিগত অন্ধকারের দিকে এগিয়ে চলেছেন? বিশুদ্ধ খ্রিস্টধর্ম কায়েম করতে তাঁরা কি কঠোর ইসলামপন্থীদের ও হিন্দুত্ববাদীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নেমেছেন? আলজিরিয়া থেকে ইরান, উগান্ডা থেকে আফগানিস্তান পর্যন্ত বিশুদ্ধ ইসলাম চিন্তায় যে অন্ধকারাচ্ছন্ন মধ্যযুগের স্পষ্ট ছায়া, ভারতকে ওঝা-গুণিন-পুরোহিততন্ত্র ও পুরুষতন্ত্রতে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার যে কট্টর হিন্দুত্ববাদী প্রয়াস, তাদের সঙ্গে চিন্তা-পার্থক্যের রেখা মুছে ফেলার খেলায় নামাটা কী পশ্চিমী খ্রিস্টানদের কাছে গর্বের? আমাদের কাছে কিন্তু শঙ্কার।

পশ্চিমী খ্রিস্টানদের কাছে কিছু প্রত্যাশা আছে বলেই শঙ্কার। ভ্যাটিকানের প্রতি প্রশ্নাতীত আনুগত্য ও প্রেম যদি বিশ্ব জুড়ে সম্প্রসারণবাদী নীতিকে আড়াল করার কৌশল হয়, তবে সম্প্রসারণবাদের শিকার হিসেবে আমরা দেশবাসীদের সচেতন করতে পারি মাত্র। কিন্তু তারপরও একটা প্রশ্ন উঠে আসে—তৃতীয় সহস্রাব্দে পা দিয়েও ধর্মীয় মৌলবাদকে ভাঙিয়ে সম্প্রসারণকে কেন টিকিয়ে রাখতে হবে ‘মস্তিষ্ক যোদ্ধাদের’? একই সঙ্গে বিশ্বায়ন ও মধ্যযুগীয় অবস্থায় অবস্থানের মধ্যে স্ববিরোধিতা কী স্পষ্ট নয়? পশ্চিমীদের বেশিরভাগই নিরীশ্বরবাদী। তারপরও পোপকে নিয়ে এত হই-চই করছেন কারা? মেকি জাত্যাভিমান উস্কে দিয়ে পোপকে পশ্চিমী ঐতিহ্যের প্রতীক হিসেবে তুলে ধরার এত দিনকার ধারাবাহিকতা বড়ো রকমের ধাক্কা খেয়েছে। ধাক্কা দিলেন কারা ? এই প্রজন্মে পশ্চিমী দেশগুলোতে এমন মানুষই সংখ্যায় বেশি, যাঁরা জন্মগতভাবে খ্রিস্টান, তাই খ্রিস্টান পদবি বয়ে চলেছেন মাত্র। বিশ্বাসে নিরীশ্বরবাদী। এঁদের সঙ্গে খ্রিস্টধর্মে অন্ধ-বিশ্বাসীদের একটা চিন্তার দ্বন্দ্ব আছে। মাদার’কে ‘সেন্ট’ বানাবার ইস্যুতে এই দ্বন্দ্ব প্রকট হয়ে উঠেছে। তারই ফলস্বরূপ আমার ও আমাদের সমিতির বক্তব্য পশ্চিমী তা’বড় প্রচার মাধ্যমগুলো অসামান্য গুরুত্বের সঙ্গে প্রচার করেছে। এদের অনেক সাংবাদিকই প্রায় প্রতিদিন আমার সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছেন। ভ্যাটিকানের খুঁটিনাটি নানা জরুরি খবর পৌঁছে দিয়েছেন। ভ্যাটিকান শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চেষ্টা চালিয়েছে ১৯ অক্টোবর-ই মাদারকে ‘সেন্ট’ ঘোষণা করতে। কিন্তু সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বদের আন্তরিক সহযোগিতায়। সহযোগীদের বেশির ভাগই কিন্তু জন্মগতভাবে খ্রিস্টান। তাঁরা স্পষ্টতই চাইছিলেন, মাদার ইস্যুকে কেন্দ্র করে ‘ক্যানান ল’ নামের কুসংস্কারের অন্তিম-যাত্রার সূচনা হোক। তাঁরা কেউই মাদার টেরিজাকে ‘সেন্ট’ উপাধি দেওয়ার বিরোধী ছিলেন না। চেয়েছিলেন, তাঁকে ‘সেন্ট’ দেওয়া হোক সারা জীবন গরিবদের জন্য যা করেছেন, তারই ভিত্তিতে। ‘সেন্ট’ বলে সম্মানিত করার জন্য মিথ্যে অলৌকিক কাহিনি গুঁজে দেবার কুপ্রথা বন্ধ হোক।

মজার কথা হল, এই প্রতিবাদীরা কেউই জন্মগতভাবে প্রোটেস্টান্ট নন, সবাই ক্যাথলিক। এঁদের কাছ থেকে পাওয়া সাহায্যের একটা ছোট্ট নমুনা হাজির করছি। ২ অক্টোবর ২০০৩। ভোরে আমার ঘুম ভাঙালেন বিবিসি’র এক সাংবাদিক। জানালেন, তাঁদের রোমের প্রতিনিধি ঘণ্টা কয়েক আগে ফোনে একটা ভয়ংকর খবর দিয়েছেন। যে দু’জন ডাক্তার জানিয়েছিলেন মণিকা বেসরা তাঁদের চিকিৎসায় ভালো হয়েছে, তাঁদের নামে রোমে অ্যাকমডেশন বুক করা হয়েছে। মিশনারিজ অফ চ্যারিটি আজ অ্যাকমডেশনের যে লিস্ট দিয়েছে তাতে ওঁদের নাম আছে। ওঁদের তো আর এই বলতে আনা হচ্ছে না যে, মণিকা চিকিৎসায় সেরেছে; তবে কেন আনছে? ডাক্তার কি তবে ডিগবাজি খাবেন? বিষয়টা এখুনি দেখুন।

এক ঘণ্টা পরে একই বক্তব্য রাখলেন আমেরিকান ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশনের সাংবাদিক অনুরোধ একই। তারই ভিত্তিতে আমার পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে সুবিধে হয়েছে।

এমনই বহু সহযোগিতা আমাদের কঠিনতম লড়াইকে জয়যুক্ত করতে সাহায্য করছে। সত্যি বলতে কী, আমরা যুক্তিবাদীরা শিখতে শিখতে পালটাই। পালটাতে পালটাতে শিখি। ‘মস্তিষ্ক যুদ্ধ’ আমেরিকার কাছ থেকে শিখেছি। ভ্যাটিক্যানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ জয় আমেরিকাকে আমাদের গুরুদক্ষিণা।

মাদার টেরিজা ছিলেন ক্যাথলিক ধর্ম প্রচারক ও প্রসারক। রাস্তার মরণাপন্ন রোগীকে তুলে এনেছেন, এটি সত্যি, এও সত্যি চ্যারিটির বিনিময়ে তাদের খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করেছেন। খ্রিস্টধর্ম প্রচার ও প্রসারের জন্য মাদার যা করেছেন, সে জন্যই ক্যাথলিক ধর্মের তরফ থেকে পোপ তাঁকে সম্মানিত করতেই পারতেন। মিথ্যে কাহিনিকে টেনে আনার মতো দুর্নীতির গন্ধ যুক্ত না হয়েই পারতেন। সেন্ট ঘোষণা করার জন্য প্রার্থীর অলৌকিক ক্ষমতার আষাঢ়ে গল্প হাজির করতেই হবে—এমন বোকা বোকা বিশ্বাসকে ঝেড়ে ফেললেই পারতেন। তাঁকে স্বাগত জানিয়ে, যদি বলতেন—আমাদের ভুল ছিল।

সেই পোপই কয়েক বছর আগে ঘোষণা করেছিলেন—আমাদের ভুল ছিল। সূর্য পৃথিবীকে নয়, পৃথিবী সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে চলেছে। এই ভুল স্বীকারের মধ্য দিয়ে মুক্তমনের ভ্যাটিকানই উদ্ভাসিত হয়েছে। তাদের উদারতাই প্রকাশ পেয়েছে।

পোপ যদি ‘ক্যানান ল’র মধ্যযুগীয় অলৌকিক বিশ্বাসকে ছেঁটে ফেলে মাদারকে তাঁর কাজের জন্যে ‘সেন্ট’ ঘোষণা করতেন, তাতে পোপের সম্মান বৃদ্ধি পেত। কুসংস্কারের অন্ধকার থেকে ভ্যাটিকানকে কিছুটা এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য পোপের নাম ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে থাকত । মধ্যযুগীয় এই ‘ক্যানান ল’-কে রমরমার সঙ্গে বাঁচিয়ে রাখার মধ্যে কোনও গৌরব নেই। আছে লজ্জা। যারা এ ধরনের খ্রিস্টান মৌলবাদী চিন্তার মধ্যে গৌরব খুঁজে পায়, তাদের সঙ্গে মুসলিম ও হিন্দু মৌলবাদীদের পার্থক্য কোথায়? এরা প্রত্যেকেই শেষ পর্যন্ত বিশুদ্ধ খ্রিস্টধর্ম, ইসলাম ধর্ম ও হিন্দুধর্ম প্রতিষ্ঠা করতে চায়। হাজার হাজার বছরের প্রাচীন, বোকা-বোকা কিছু ধারণা, অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারকে ধর্মের নামে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে, জ্ঞানের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ধর্মকে যুগোপযোগী করে তুলতে এরা অক্ষম ।

অ্যাগনেস থেকে মাদার টেরিজা

প্রতিটি মানুষেরই গুণের সঙ্গে কিছু দোষ থাকে। আবার দোষের সঙ্গে কিছু গুণও। আমরা শুধুমাত্র গুণ অথবা দোষ নিয়ে বিচারে বসলে সে বিচার হবে একটি সম্পূর্ণ মানুষের বদলে খণ্ডিত মানুষের বিচার। অর্থাৎ, ভুল বিচার। মাদারের মতো কিংবদন্তি চরিত্রের বিশ্লেষণের জন্য প্রয়োজন আবেগে আপ্লুত না হয়ে মুক্তমনে বিচার করা। বিচার-বিশ্লেষণের আগে মাদার টেরিজার জীবনচর্যাকে জেনে নেওয়া খুবই জরুরি। আসুন সেই প্রাথমিক কাজটা সেরে নিই।

◊ আগেকার নাম অ্যাগনেস। পুরো নাম অ্যাগনেস গোনঝা বোজাঝিউ। জন্মগতভাবে ক্যাথলিক খ্রিস্টান ।

◊ জন্ম ২৬ আগস্ট ১৯১০ সালে, যুগোস্লাভিয়ার আলবেনিয়া রাজ্যের স্কোপিয়ে শহরে। ছোট্ট শহর। এক দিদি, এক দাদা, অ্যাগনেস সবার ছোট।

◊ বাবা নিকোলাস ছিলেন বাড়ি তৈরির ঠিকাদার। অনিশ্চিত আয়। তীব্র দারিদ্র ছিল নিত্যসঙ্গী। দিদি ও মা রোজগারের চেষ্টা করতেন।

◊১৯১৭-তে বাবা খুন হলেন।

◊ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ দারিদ্র আরও তীব্র আকার ধারণ করে। আলবেনিয়ার মুসলিম সম্প্রদায় খ্রিস্টান বিরোধী। খ্রিস্টান যেন তাদের জাতশত্রু। ফলে সংখ্যালঘু খ্রিস্টান ক্যাথলিকদের সব সময় নানা অত্যাচারের মুখোমুখি হতে হত। চার্চই ছিল খ্রিস্টানদের একমাত্র ভরসাস্থল। অ্যাগনেস তাঁর বারো বছর বয়সেই জানিয়ে দেন, তাঁরা লক্ষ্য ‘নান’ বা খ্রিস্টান সন্ন্যাসিনী হওয়া। ক্যাথলিক চার্চে যাওয়ার সুবাদে তিনি ব্রিটিশ শাসিত ভারত ও কলকাতার কথা অনেক শুনেছিলেন। তাঁর স্বপ্ন হয়ে ওঠে, এই অঞ্চল থেকে বেরিয়ে ভারতে পা দেওয়া ।

◊ ২৯ নভেম্বর, ১৯২৮ ভারতে আসতে ডাবলিন থেকে জাহাজে ওঠেন। কলকাতায় নামেন ৬ জানুয়ারি, ১৯২৯।

◊ উঠলেন লরেটো কনভেন্টে। মিশনারিদের পরিচালিত এই স্কুল ছিল কলকাতার অভিজাত স্কুল। স্কোপিয়ে শহরের সেক্রেড হার্ট চার্চ-এর পরিচয়পত্রের সুবাদে তিনি এই স্কুলে একই সঙ্গে শিক্ষাজীবন ও শিক্ষিকা জীবন শুরু করেন।

◊ ১৯৩১ থেকে ১৯৪৮ পর্যন্ত কলকাতার সেন্ট মেরিজ স্কুলে পড়িয়েছেন। সানডে স্কুলেও পড়াতেন। প্রাইমারি পর্যন্ত পড়াতেন। ১৯৩৭-এ অধ্যক্ষা হন। তখন তিনি সিস্টার টেরিজা থেকে মাদার টেরিজা নামে পরিচিত হন।

◊ ১৯৪৬-এ টেরিজা ঠিক করলেন, তিনি গরিব, অনাথদের চ্যারিটি ও ক্যাথলিক ধর্মান্তরের কাজকে জীবনের লক্ষ্য করবেন।

◊ ১৯৫০-এর এপ্রিলে ভ্যাটিকানের ‘কার্ডিনাল’-এর ক্যাথলিক ধর্মের প্রচার বিভাগ টেরিজার আবেদনপত্র পেলেন। সঙ্গে কলকাতার আর্চবিশপের প্রশংসাপত্র।

◊ ১৯৫০-এর ৭ অক্টোবর পোপ ‘মিশনারিজ অফ চ্যারিটি’কে ক্যাথলিক ধর্ম প্রচারক সংস্থা হিসেবে স্বীকৃতি দেন। ভ্যাটিকানের নিয়ম অনুসারে সঙ্গে নানা ধরনের সেবামূলক কাজ করার বিধান দেন ।

◊ ১৯৬৫-তে ভ্যাটিকান সিটি এই সংস্থাটিকে পুরোপুরি নিজেদের আইন ও অনুশাসনের অঙ্গ করে নেয়।

◊ ১৯৫০ তে ৫৪এ লোয়ার সারকুলার রোডে একটা বাড়ি কিনে নিলেন আর্চবিশপ। এই বাড়ির নাম দেওয়া হল ‘মাদার হাউস’। এটাই মিশনারিজ অফ চ্যারিটির মূলকেন্দ্র। এখানেই থাকেন সিস্টাররা ও শিক্ষার্থীরা।

◊ শিক্ষার্থীনীদের বেশির ভাগই আসেন আদিবাসী পরিবার থেকে। পরিবারের অভাব এবং এই সংস্থায় এলে খাওয়া পরা থাকার নিশ্চিত আশ্বাস—এটাই আদিবাসী মহিলাদের এখানে ভিড় জমানোর প্রধান কারণ। শিক্ষাপর্ব পাঁচ বছরের।

◊ প্রথম বছরে শেখানো হয় ক্যাথলিক ধর্মের অ-আ-ক-খ। বাকি বছরগুলো শেখানো হয় প্রাথমিক চিকিৎসা পদ্ধতি, প্রাথমিক শিক্ষাদান ও হাতের কাজ শেখানোর পদ্ধতি, রোগী, গরিব ও পথশিশুদের সেবা পদ্ধতি এবং ধর্ম প্রচার ও ধর্ম প্রসার পদ্ধতি। পাঁচ বছর পর শিক্ষার্থীরা খ্রিস্ট ধর্মের আদর্শ প্রচার, প্রসার ও সেবা ধর্ম পালনের শপথ নেন । ২৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫৩। এদিন টেরিজা ১৪ ক্রিক লেনের একটি বাড়িতে থেকে প্রথম জয়যাত্রা শুরু করেন।

◊ ১৯৪৮, বাঙালিদের মন জয় করতে স্কার্ট ছেড়ে শাড়ি পরলেন ।

◊ ১৯৫২, ২২ আগস্ট। কলকাতা পুরসভ; কালীঘাট মন্দিরের লাগোয়া বাড়ি দিলেন টেরিজাকে। এখানে গড়ে উঠল ‘নির্মল হৃদয়’। বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, মরণাপন্ন নিরাশ্রয়দের আশ্রয়স্থল এটি।

◊ ১৯৬০ সালে আর্চবিশপের অনুমতি নিয়ে টেরিজা তাঁর চ্যারিটি, ধর্মপ্রচার ও ধর্মান্তরের কর্মসূচিকে কলকাতার বাইরে ছড়িয়ে দেবার অনুমতি দিলেন।

◊ ১৯৬১-তে মিশনারিজ অফ চ্যারিটির নতুন বাড়ি হল আগ্রা, ঝাঁসি, মুম্বাই, গোয়া, পাটনা, আম্বালা, দার্জিলিং, ভাগলপুর অমরাবতীতে।

◊ ১৯৬১-তে আসানসোলের কাছে শান্তিনগরে চৌত্রিশ একর জমি এক টাকা ভাড়ায় মাদারকে লিজ দিল পশ্চিমবঙ্গ সরকার। সেখানে মাদার গড়ে তুললেন কুষ্ঠরোগীদের জন্য হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্র।

◊ মিশনারিজ অব চ্যারিটি ভারতে পঞ্চান্নটি কুষ্ঠ হাসপাতাল চালায়। পৃথিবীর বিভিন্ন গরিব দেশে আরও গোটা তিরিশেক কুষ্ঠাশ্রম চালায় ।

◊ ১৯৬৫-তে প্রথম বিদেশে ক্যাথলিক ধর্ম প্রচার ও সেবার জন্য কেন্দ্র স্থাপিত হল ভেনেজুয়েলায়। পরে ভেনেজুয়েলায় আরও দুটি বাড়ি গড়ে উঠেছে, গড়ে উঠেছে আরও দুটি কেন্দ্র। এ ছাড়াও এক বা একাধিক মিশনারিজ অফ চ্যারিটি, ক্যাথলিক ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান কেন্দ্র গড়ে তুলেছে অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, উত্তর আয়ারল্যান্ড, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, আলবেনিয়া, ব্রাজিল, পানামা, গাজা, ইথিওপিয়া, সিসিলি, ফিলিপিনস, পাপুয়া, নিউগিনি, বুরুন্ডি, বাংলাদেশ প্রভৃতি ১৩৩টি দেশে। কেন্দ্রের সংখ্যা প্রায় ৬০০।

◊ মিশনারিজ অফ চ্যারিটির কেন্দ্র আছে ভ্যাটিকান সিটিতে। কারণ মিশনারিজ অফ চ্যারিটি ভ্যাটিকান অনুমোদিত এবং সরাসরি ভ্যাটিকানের নির্দেশ মতো চলা একটি সংস্থা। পোপের হুকুম-ই শেষ কথা। মাদার টেরিজা পোপের প্রতিনিধি মাত্র।

◊ ১৯৭৩-এ শিয়ালদহ এলাকার এন্টালিতে গড়ে তোলা হল ‘নির্মলা শিশুভবন’। এটি হল পথশিশুদের নৈশাবাস। এখান থেকে কাজের বিনিময়ে খাবার দেওয়া হয়। ১০০টি ডাবের খোলা কুড়িয়ে এনে নৈশাবাসে জমা দিলে ১৬টা বিস্কুট অথবা এক পাউণ্ড রুটি মেলে। আট থেকে দশ বছরের প্রায় আটশো শিশু রাতে এখানে থাকে।

◊ ১৯৭৩-এ তিলজলায় গড়ে তোলা হয় ‘প্রেমদান’ কেন্দ্র। নির্মলা শিশুভবনে সংগৃহীত ডাবের খোলা লরিতে তুলে আনা হয় এই কেন্দ্রে। এখানে ডাব শুকিয়ে ছোবড়া তৈরি করা হয়। ছোবড়া দিয়ে তৈরি করা হয় দড়ি, মাদুর, জাজিম, গদি ইত্যাদি। বিকলাঙ্গ প্রায় শ’তিনেক মানুষ এখানে কাজ করে। বাড়িটি আই. সি. আই-এর দান।

◊ ১৯৯১-এর মধ্যে ভারতে তৈরি হল ১৬৮টি বাড়ি। সেগুলোতে প্রতিষ্ঠিত কেন্দ্র।

◊ মিশনারিজ অফ চ্যারিটি কারও কাছ থেকেই কোনও চাঁদা গ্রহণ করে না। দান গ্রহণ করে মাত্র। এই দাতাদের তালিকায় কুখ্যাত একনায়কতন্ত্রী অনেক শাসকই আছে। আছে আন্তর্জাতিক কুখ্যাতির অধিকারী অনেক মাফিয়া ও প্রতারক। মাদার এইসব একনায়কদের দরাজ হাতে ‘সার্টিফিকেট দিয়েছেন। হাজার হাজার কোটি টাকা প্রতারণার দায়ে অভিযুক্ত কিটিং টেরিজাকে দান করায় টেরিজা কিটিং-এর পক্ষে মার্কিন বিচারব্যবস্থার কাছে আবেদন রেখেছিলেন।

◊ ১৯৬২-তে পেলেন ম্যাগসাইসাই পুরস্কার।

◊ ১৯৭১-এ পেলেন ‘পোপ জন ত্রয়োবিংশ শান্তি পুরস্কার’।

◊ ১৯৭২-এ পেলেন ‘জওহরলাল নেহেরু অ্যাওয়ার্ড ফর ইন্টারন্যাশনাল আন্ডারস্ট্যান্ডিং

◊ ১৯৭৫-এ পান ‘অ্যালবার্ট শোয়াইৎজার আন্তর্জাতিক পুরস্কার।

◊ ১৯৭৯-তে পেলেন শান্তির জন্য ‘নোবেল পুরস্কার’।

◊ ১৯৮০-তে পেলেন ‘ভারতরত্ন’।

◊ ১৯৮৩-তে ইংলন্ড দিল ‘অর্ডার অফ মেরিট ।

◊ ২০০৩-এ পেলেন ‘রেসেড। দিলেন পোপ দ্বিতীয় জন পল।

◊ বিখ্যাত আটটি সম্মানের মধ্যে ছটিই পেয়েছেন খ্রিস্টান ধর্মীয় গোষ্টির কাছ থেকে।

◊ মৃত্যু, ৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৯৭।

‘মিশনারিজ অফ চ্যারিটি ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান ভ্যাটিকানের-ই সিস্টার কনসার্ন পোপের প্রতিনিধি হিসেবে মাদার এই সংস্থার দেখভালের দায়িত্বে ছিলেন। স্বাভাবিক কারণেই মাদার বিশুদ্ধ, কঠোর ক্যাথলিক ধর্মের পক্ষেই প্রচার চালাতে চেয়েছেন। খ্রিস্টানদের মধ্যে ক্যাথলিক ধর্মের আদর্শ কায়েম করতে চেয়েছেন। খ্রিস্টধর্ম প্রচারক যিনি, ধর্মান্তরকরণ যাঁর লক্ষ্য, তাঁর চিন্তার সঙ্গে সমাজ সচেতন মানুষদের চিন্তার বিরোধ থাকতে বাধ্য। সমাজ সচেতন মানুষের চোখে যা মাদারের সীমাবদ্ধতা, তাই মাদারের চোখে লক্ষ্যপূরণ। মাদারের ‘সীমাবদ্ধতাগুলো’ এই ধরনেরঃ

♦ মাদার ছিলেন গর্ভপাতের কট্টর বিরোধী গর্ভপাতের পিছনে মা বা বাবার ইচ্ছের কোনও দাম-ই নেই মাদারের কাছে। এমন কী গর্ভপাতের পিছনে শারীরিক, আর্থিক বা সামাজিক যে প্রতিবন্ধকতাই থাক না কেন, মাদার তাকে একটুও পাত্তা দিতে রাজি ছিলেন না ৷

মাদারের এমন মধ্যযুগীয় দৃষ্টিভঙ্গির কারণ, তিনি স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকারী ছিলেন না। ১৯৬৫ সালে মাদার নিজেই এই পরাধীনতার শিকল পরেছিলেন। মিশনারিজ অফ চ্যারিটিকে ভ্যাটিকান যখন তাদের আইন ও অনুশাসনের অঙ্গ করে নেয়, তখন থেকে সংগঠনটি সরাসরি চলে যায় পোপের হুকুমের আওতায়। ফলে গর্ভপাত বিষয় পোপের মতামতের সুরে সুর না মিলিয়ে কোনও উপায়-ই ছিল না মাদারের।

♦ অনেকেই অভিযোগ করেন মৃত্যুপথযাত্রীদের নিয়েও মাদার ধর্মের রাজনীতি করেছিলেন। তিনি মুমূর্ষ মানুষদের সেবার বিনিময়ে, চ্যারিটির বিনিময়ে ধর্মান্তরিত করে-ই গেছেন। লাগাতার ভাবে করে গেছেন ।

কিছু পত্রিকায়, কিছু ম্যাগাজিনে (যার মধ্যে ‘আমরা যুক্তিবাদী’ও আছে), কিছু বইতে এইসব অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগ কী জন্যে? নীতিহীনতার? ক্যাথালিক উপাসনা ধর্মের প্রচার ও প্রসার পোপ ও ভ্যাটিকানের আদর্শ। ভ্যাটিকানের প্রতিনিধি মাদার এই আদর্শের পরিপন্থী কাজ করবেন—এমনটা যাঁরা প্রত্যাশা করেন, তাঁদের দলে আমরা যুক্তিবাদীরা নেই। আমরা যদি ভাবতে থাকি, বাঘ নিরামিষ খাবার খাবে, শোষকরা সাম্য চাইবে—সেটা আমাদের বোকামি। আমাদের বুঝতে হবে, ধর্ম প্রচারক ও প্রসারকামী মাদার তাঁর ধর্ম বা বৈশিষ্ট্য-ই পালন করে চলেছেন। এটা ভালো, কী খারাপ? আপনার আমার গড়ে ওঠা বোধ-ই তা তা বলে দেবে। সে বোধ ভ্যাটিকানের সঙ্গে না মিলতেই পারে।

♦ মিশনারিজ অফ চ্যারিটি নিঃস্বার্থ ভাবে চ্যারিটি করে না—এই অভিযোগ অনেকেরই। সাম্যের স্বপ্ন দেখিয়ে বাঁদর নাচন নাচিয়ে যাওয়া ক’টা দল নিঃস্বার্থভাবে গরিবের কথা ভাবে? নেতারা পার্টির ভোট বাক্স আর নিজের তহবিল বাড়াতেই ব্যস্ত। এবং এটাই বাস্তব চিত্র।

এইসব রাজনৈতিক দল ও রাজনীতিকদের তুলনায় ওরা অনেক সৎ। সাম্যের স্বপ্ন দেখায় না। সোজা-সাপটা বলে, আমাদের সাহায্যের দোকান খুলেছি। রেশন, চিকিৎসা, শিক্ষা, কাজ সব-ই মিলবে। টাকাও দিতে হবে না। খ্রিস্টধর্ম নিলে সব বিনামূল্যে। নিলে নাও। পছন্দ না হয়, নিও না। কোনও জোর-জবরদস্তি নেই।

ওরা গরিবদের বন্ধু সেজে বিরোধী ধর্মের মানুষদের ধর্ষণ করে না, বাড়ি জ্বালায় না, মুন্ডু কাটে না। অনেক রাজনৈতিক দলের তুলনায় ওরা অনেক ভালো। দলের ছত্রছায়ায় সমাজবিরোধী পোষে না। সমাজসেবী পোষে। হ্যাঁ পোষে। তবে এই সমাজসেবীরা অনেক গরিবেরই বন্ধু, অনেক অনাথের-ই নাথ। এইসব অনাথ, মুমূর্ষরা জানে-ই না ধর্ম খায়, না মাথায় মাখে। যে ধর্ম ওদের বাঁচায়, সে ধর্ম ওরা নেবে, বেশ করবে।

ভ্যাটিকানের ধর্মের রাজনীতি থেকে ভারতের যে রাজনৈতিক দল শিক্ষা নিয়েছে, তাদের নাম সংঘ পরিবার। সংঘ পরিবার মানে, ভারতীয় জনতা পার্টি ও রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের যৌথ পরিবার। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ ভারতের হাজার হাজার গ্রামে অবৈতনিক শিক্ষা, হাতের কাজ শিখিয়ে স্বনির্ভর করে তোলার কর্মসূচি নিয়েছে। ওরাও মিশনারিজ অফ চ্যারিটি এবং চার্চগুলোর মতোই সেবার ভিতর দিয়ে হিন্দুধর্ম প্রচারের রাজনীতি করছে।

সংঘ পরিবারের এই হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন বামপন্থী, কংগ্রেসের মতো দক্ষিণপন্থী রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবীরা। ‘গেল গেল’ রব তুলেছেন। উপসনা ধর্ম নিয়ে রাজনীতির বিরুদ্ধে সরবতা নিশ্চয়ই ভালো। কিন্তু এই প্রতিবাদ যদি স্রেফ ভন্ডামি হয়, তাহালে দুঃখের, ক্ষোভের। দেশে শুধু খ্রিস্টান ধর্মান্তরের কাজ চলছে, তা কিন্তু নয়। ইসলাম ধর্মান্তকরণের জন্য ভারতে বিপুল পরিমাণে পেট্রো-ডলার ঢুকছে। খ্রিস্টধর্ম এবং মুসলিম ধর্ম নিয়ে যে সেবার রাজনীতি চলছে সে বিষয়ে সব জেনে-শুনে হিন্দুত্ববাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবীরা নীরব কেন? এই নীরবতাও তো ঘৃণ্য রাজনীতি।

খ্রিস্টান ও মুসলিমদের সেবার রাজনীতি করতে দেখে বিজেপি একই ভাবে সেবার রাজনীতিতে নেমেছে। মানলাম। তেমন সেবার রাজনীতি করতে ক্যাডারদের হতদরিদ্র গ্রামগুলোতে পাঠাতে অসুবিধে কোথায়? ওরাও গ্রামে গ্রামে পড়ে থেকে শিক্ষা, চিকিৎসা, হাতের কাজ শিখিয়ে গ্রামবাসীদের স্বনির্ভর করে তুলুন। অসুবিধে কোথায়? ওরা গ্রামবাসীদের মন জয় করে নিলে সাম্যের শিক্ষা নিশ্চয়ই নেবে।

গ্রামে সেবার ব্রত নিয়ে যাবার মতো ক্যাডার মিলবে না ভেবেই কী এ’ধরনের প্রোগ্রাম নিতে বেজায় অসুবিধে আছে? হতে পারে, এমনটা হতে পারে। যেদিন দেখব তোলাবাজ-মস্তান- প্রোমোটার-ক্যাডার-হাফলিডাররা তাদের এমন সাজানো ‘ব্যবসা’ ছেড়ে গ্রামে-গঞ্জে সেবার মধ্য দিয়ে মার্কসবাদের নীতি শেখাচ্ছে, সেদিন তো বেড়ালরাও মাছ খাওয়া ছেড়ে দেবে। মার্কসবাদী নেতারা এই সত্যিটা ভালো রকম জানেন বলেই সংঘ পরিবারকে গালাগাল দিয়েই দায়িত্ব সেরেছেন? ওঁরা কী জেনে গেছেন ক্যাডার—হাফলিডারদের মনের কথা—“আরে বাবা সেবার রাজনীতির মতো ছুতোরের টুক্‌টাকের দরকার কী? কামারের এক ঘা’য়ে ইলেকশন তো আমরাই উতরে দিই। তারপর আবার আমাদের গ্রামে পাঠাবার ন্যাকামো কেন? আমাদের দিয়ে ইলেকশন জিতবেন, গদিতে বসবেন, মূল্য দেবেন না?”

গ্রামে যে সব ক্যাডার ও হাফলিডার স্থায়ী বাসিন্দা, তারা মাদার টেরিজার চেয়ে দুর্যোধনের ভূমিকায় নামতে বেশি আগ্রহী। নিরুত্তেজক সেবার চেয়ে ‘বস্ত্রহরণ’ ও ‘জতুগৃহ’ পালায় উত্তেজনার মজাই আলাদা। বিরোধী রাজনৈতিক দলের কাজ-কর্মকে টাইট দিতে আমরা ক্যাডাররা এ’সব দুষ্টুমি একটু-আধটু করব। কখনও-সখনও বাড়াবাড়ি হলে দেখ-ভালের দায়িত্ব পার্টিকে তো নিতেই হবে। কাজ করাবে মূল্য হিসেবে প্রোটেকশনটুকু দেবে না, এ হয় নাকি! গ্রাম থেকে চা বাগান, সর্বত্র সাধারণ মানুষকে বেঁচে থাকতে হলে নেতাদের মূল্য দিতেই হবে। মূল্য—প্রোটেকশন মিশনারিজ অফ চ্যারিটি এই মূল্যই নিচ্ছে, তবে মস্তানি করে নয়।

♦ মিশনারিজ অফ চ্যারিটির বিরুদ্ধে কেউ কেউ এমন অভিযোগ করেন, ওরা গরিবি হটাতে চায় না। এই যে বিপুল অর্থ ওরা সাহায্য হিসেবে পাচ্ছে, তা দিয়ে গোটা দেশে লক্ষ লক্ষ কুটির শিল্প গড়ে তুলতে পারত, পারত কোটি কোটি মানুষকে চরম দারিদ্র থেকে মুক্তি দিতে। কিন্তু তা ওরা করে না।

এইসব দুর্মুখেরা বোঝে না যে—দরিদ্র নারায়ণের সেবা করতে দরিদ্র মানুষের জোগান জরুরি। তার-ই জন্যে জরুরি দারিদ্রকে টিকিয়ে রাখা। গরিব মানুষগুলো গরিবি থেকে মুক্তি পেলে, বাঁচার শর্তে খ্রিস্টান হবে কে? ভ্যাটিকান কোনও দেশের গরিবি হটাবার ঠিকে নেয়নি। ঠিকে নিয়েছ খ্রিস্টধর্ম প্রসারের।

দুর্মুর্খদের মুখ বন্ধ করা সোজা। ব্ল্যাক আউট কর। সঙ্গে কর মাদারের গুণকীর্তন প্রচার। ‘ফেল কড়ি, মাখ তেল’ মার্কা বন্ধুরাই সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছে, দেবে।

♦ মিশনারিজ অফ চ্যারিটির বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ অনেক আছে যে, তাদের কেন্দ্রগুলোতে ডিসপেনসারি আছে ঠিকই, কিন্তু ডাক্তার নেই। নান বা সন্ন্যাসীরাই রোগীর কাছ থেকে শুনে বড়ি- টড়ি দিয়ে দেন। সর্বাধুনিক চিকিৎসার সুযোগ দেবার মতো কোনও হাসপাতাল-ই মাদার তৈরি করার চেষ্টা করেননি, প্রতুল অর্থ থাকার পরও। মাদার নিজের চিকিৎসা করাতে ভর্তি হয়েছেন অত্যন্ত নামী-দামি বে-সরকারি হাসপাতালে। নিজের গড়ে তোলা হাসপাতালকে চিকিৎসার দায়িত্ব দেননি। জানতেন, সামান্য ভরসা করার মতো পরিকাঠামো তাঁর হাসপাতালগুলোতে নেই।

গরিব, আঙুর, মৃত্যুপথযাত্রীরা চিকিৎসা পেয়েছেন মাদারের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে বা হাসপাতালে। মাদার নিজের চিকিৎসার জন্যে কিন্তু ভুলেও পা রাখেননি নিজের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে বা হাসপাতালে। আপন-পর জ্ঞানটুকু প্রয়োজনের সময় টল্টনে ছিল—অন্তত চিকিৎসার ব্যাপারে। নীল পাড় সাদা খোলের সুতির শাড়ি পরে আর ভাঙা বাংলা বলেই বাজার মাত করে গেছেন মাদার। মাদার রাজনীতিকদের ভরসা জোগান। শিখিয়েছেন, কীভাবে কথায় ও কাজে দুই পৃথিবীতে থেকেও কোটি কোটি কোটি মানুষের শ্রদ্ধা আদায় করা যায়।

কিন্তু, চিরকালের জন্য যায় কি? সময় উত্তর দেবে। অথবা উত্তর দেওয়া শুরু হয়ে গেছে। মাদারকে নিয়ে এতটা আলোচনার পর মনে হতে পারে এ সব-ই মাদারের সীমাবদ্ধতা । আবার কেউ যদি বলেন, না এসব কোনও সীমাবদ্ধতার প্রকাশ নয়। এ’সবই ভ্যাটিকানের প্রতি মাদারের দায়বদ্ধতার বিভিন্ন রূপ। আমরা কি এক কথায় এই বক্তব্যকে উড়িয়ে দিতে পারব?

কেউ কেউ মনে করতেই পারেন, একজন সেন্ট এর এমন আচরণ সাজে না। কিন্তু ধর্মের প্রচার ও প্রসার যাঁর লক্ষ্য, তাঁর খুব সাজে।

ভ্যাটিকান মাদার টেরিজাকে ‘সেন্ট’ করুক তাঁর কাজের জন্যে।

খ্রিস্টধর্মের প্রচার ও প্রসারে তাঁর অনন্য অবদানের

জন্যে। এতে আমাদের প্রতিবাদ জানাবার

কোনও অবকাশই থাকে না। প্লিজ,

‘সেন্ট’ বানাতে অলৌকিক

গপ্পো ফাঁদবেন না ।

মাননীয় পোপ, দরিদ্র ভারতবাসীদের প্রতি করুণার তলানি আপনার মনের তলায় পড়ে থাকলে এমন ভয়ংকর খেলা খেলবেন না। আপনার এই খেলায় ধর্মান্তরে জোয়ার আসতেই পারে। কিন্তু শিক্ষার সুযোগ না পাওয়া, কুসংস্কারে আচ্ছন্ন মানুষগুলোকে আধুনিক চিকিৎসা থেকে অলৌকিক চিকিৎসার দিকে মুখ ঘুরিয়ে দেওয়া অত্যন্ত অমানবিক, অপরাধ। মাননীয় পোপ, আপনার এ’খেলার পরিণতিতে অলৌকিক-চিকিৎসার দিকে ধাবিত প্রতিটি মৃত্যুর জন্য আপনিই দায়ী থাকবেন ।

ভারতকে মধ্যযুগীয় কুসংস্কারের যুগে ঠেলে নিয়ে যাওয়ার জন্য, লক্ষ-কোটি মানুষের মৃত্যুর জন্য ইতিহাস একদিন আপনাকে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করাবেই। এই সত্যটুকুও বোঝার ক্ষমতা কি কেড়ে নিয়েছে আপনার অসুস্থতা ?

মিরাকেলের রোজ নামচা

২৫ সেপ্টেম্বর বুধবার ২০০২। গাজোল থেকে সুবোধ সূত্রধর ফোন করলেন। সুবোধ আমাদের সমিতির সদস্য। গাজোল মালদা জেলার ছোট শহর। সুবোধ জানালেন, “মাদার টেরিজাকে ‘সেন্ট’ বানাবার জন্য আমাদেরই কাছের গ্রাম নাকোড়ের একটি গরিব আদিবাসী বউকে হাজির করা হচ্ছে। নাম মণিকা বেসরা। দীর্ঘ বছর ধরেই ওদের পরিবারকে চিনি। নাকোড় মেহেন্দিপাড়া চার্চ এলাকার অন্তর্গত। মেহেন্দিপাড়া চার্চ থেকে নাকি গুজব ছড়ানো হচ্ছে, মণিকা বেসরার পেটে টিউমার হয়েছিল। বায়পসি করে নাকি দেখা গেছে ক্যানসার। এই ক্যানসার নাকি, রাতারাতি সেরে গেছে। সারিয়ে দিয়েছে মাদারের ছবি। এ’ ব্যাপারে আমরা কিছু করতে পারি না?”

২৯ সেপ্টেম্বর, রবিবার, ২০০২। দারুণ অগ্রগতির খবর দিলেন সুবোধ। একটা টিম গড়ে কাজে নেমেছিলেন। টিমে সুবোধের সঙ্গী ছিলেন ডাঃ নিরঞ্জন মণ্ডল ও ডাঃ মদনমোহন বিশ্বাস । ১৯৯৮-এ মণিকা বেসরা বালুরঘাট জেলা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল চিকিৎসার জন্য। অসুখটা টিবি। পেটে একটা মাংসপিণ্ড ধরা পরেছিল আলট্রাসোনোগ্রাফিতে। টিবি’র পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে এই মাংসের দলা বা মাংসপিণ্ডের উৎপত্তি। চিকিৎসা করেছিলেন প্রাথমিক পর্যায়ে ডাঃ আশিস বিশ্বাস। তিনি ডাঃ রঞ্জন মুস্তাফির কাছে মণিকাকে পাঠান। রঞ্জন মুস্তাফি চিকিৎসা করেন। পরবর্তী সময়ে মণিকা শিলিগুড়ির উত্তরবঙ্গ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যান। সেখানেও একই কথা বলা হয়—রোগটা টিবি। মণিকার স্বামী সেলকু মুর্মুর কথা অনুসারে, হাসপাতাল থেকে ৯ মাস খাওয়ার জন্য অনেক রকম ওষুধ দিয়েছিল। মণিকা ওষুধ খেত। মণিকা ওষুধেই সেরেছে। এক দিনে টিউমার সেরেছে, এমন কিছু দেখিনি ।

বালুরঘাট হাসপাতাল থেকে ফিরে আসার ১১ মাস পরে মণিকা আবার বালুরঘাট হাসপাতালে যান। সেখানে দ্বিতীয়বার মণিকার আলট্রাসোনোগ্রাফি হয়। টিউমারের অস্তিত্ব ধরা পড়েনি। মণিকার ডাক্তারদের মত, টিবি আজকাল অতি সাধারণ রোগ। ওষুধ খেয়েছেন, সেরেছেন। টিবি’র উপসর্গ টিউমারও সেরে গেছে। এর মধ্যে অলৌকিক কিছু নেই ।

২০০০ সালে সে সময়কার রাজ্যের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ছিলেন পার্থ দে। তিনি বালুরঘাট জেলা হাসপাতালের সুপার ডাঃ মুর্শেদের কাছে মণিকার চিকিৎসা বিষয়ে বিস্তৃত রিপোর্ট পাঠাতে অনুরোধ করেন। ডাঃ মুর্শেদ মণিকার চিকিৎসা সংক্রান্ত সমস্ত ডকুমেন্টের কপি পার্থ দে’র কাছে পাঠিয়েছেন।

সুবোধ আরও জানালেন, মণিকা এখন বলছেন, ৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৯৮-এর রাতে হঠাৎ করে তাঁর বিশাল সাইজের টিউমারটা ভ্যানিস হয়ে যায়। ঘটনাটা ঘটে মিশনারিজ অফ চ্যারিটির পতিরাম কেন্দ্রে। সে রাতে পেটে অসহ্য ব্যথা হচ্ছিল। মণিকা যখন ব্যথায় ছটফট করছেন, তখন মাদারের ছবি থেকে একটা আলো বেরিয়ে এসে মণিকার পেটে পড়ল। ওমনি ব্যথা চলে গেল। অবাক মণিকা পেটে হাত বুলিয়ে দেখেন, বিশাল টিউমারের কোনও চিহ্নই নেই। সে’রাতেই মণিকা নাকি ঘটনাটি জানান সিস্টার বার্থলোমিয়াকে। সিস্টার জানান কলকাতার মিশনারিজ অফ চ্যারিটির সুপিরিয়র জেনারেল সিস্টার নির্মলাকে।

রাজ্যের এত রোগী থাকতে স্বাস্থ্যমন্ত্রী কেন মণিকার রিপোর্ট তলব করলেন? এটা কোটি টাকার প্রশ্ন। মণিকা তো মারা যাননি। চিকিৎসা বিভ্রাট নিয়ে কোনও বিতর্কও ওঠেনি। তবে? সিস্টার নির্মলা কি স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কাছ থেকে একটা সার্টিফিকেট আদায় করতে চাইছিলেন, যাতে লেখা থাকবে—মণিকা দুরারোগ্য অসুখে ভুগছিলেন, তারপর ঠিক কী করে যে সেরে উঠলেন? সত্যিই আশ্চর্য !

সিস্টার নির্মলা শেষ পর্যন্ত একজন ধর্ম প্রচারক। ধর্মের প্রচার ও প্রসারের জন্য প্রয়োজনে ‘কালো’ কে ‘সাদা’ বলবেন—এটাই স্বাভাবিক। ধর্মের রাজনীতিতে এটা স্বাভাবিক ।

সুবোধ এও জানালেন, এখন হঠাৎ করে মিশনের সেন্টারগুলো থেকে জোর প্রচার চালানো হচ্ছে মণিকার টিউমারটি আসলে ছিল ক্যান্সারের প্রতিক্রিয়া। ডাঃ আর এন ভট্টাচার্য নাকি খুব নামী ডাক্তার। তিনিই নাকি জানিয়েছিলেন, মণিকার এই ক্যানসার আধুনিক চিকিৎসায় সারানো সম্ভব নয়। সেলকু জানিয়েছেন, ডাঃ ভট্টাচার্যের নাম-ই শোনেননি।

৩০ সেপ্টেম্বর, সোমবার, ২০০২। ফোনে ধরলাম প্রাক্তন স্বাস্থ্যমন্ত্রী পার্থ দে’কে। জানতে চাইলাম, মণিকার মেডিকেল রিপোর্ট চাওয়ার ইনসাইড স্টোরি। জানলাম, সিস্টার নির্মলা পার্থ- দে’র সঙ্গে যোগাযোগ করেন। মণিকা বেসরা নামের এক মহিলার টিউমার না ক্যানসার হয়েছিল। বালুরঘাট জেলা হাসপাতালের ডাক্তাররা নাকি জানিয়েছিলেন—এ’ অসুখ সারার নয়। তারপর মাদার টেরিজার একটা লকেট নিয়ে প্রার্থনা করায় রাতারাতি নাকি অসুখটা সেরে যায়। স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে পার্থ দে কথাগুলো লিখে দিলে পোপের কাছে সেই সার্টিফিকেট পাঠিয়ে দেওয়া হবে। মাদার সেন্টহুড পাবেন কি না, সেটা নাকি তার সার্টিফিকেটের উপর নির্ভর করছে।

বালুরঘাট জেলা হাসপাতালের সুপারের কাছে তিনি বিষয়টি জানতে চান। সুপার তাঁকে সব ডকুমেন্টের কপি পাঠিয়ে দেন। সঙ্গে এ বিষয়ে নিজের মন্তব্য লিখে পাঠান। সব পড়ে তিনি সিস্টার নির্মলাকে জানিয়ে দেন যে-মণিকার সুস্থ হওয়ার মধ্যে মিরাকেল কিছুই নেই । আধুনিক চিকিৎসাতেই তিনি সুস্থ হয়েছেন ।

রাতে ‘ইন্ডিয়া টুডে’ পত্রিকা গোষ্ঠীর সাংবাদিক সুমন চক্রবর্তীর ফোন পেলাম। জানালেন, আগামী ৪ অক্টোবর ভ্যাটিকান মাদারকে সেন্টহুড দেওয়া নিয়ে একটা ঘোষণা রাখবে।

৪ অক্টোবর, শুক্রবার, ২০০২। বিবিসি’র ভারতের প্রতিনিধি সুবীর ভৌমিক ফোন করলেন। আজ ভ্যাটিকান ঘোষণা করেছে, মাদারের অলৌকিক মহিমার প্রমাণ মিলেছে। পশ্চিমবঙ্গের এক আদিবাসী মহিলার জরায়ুতে টিউমার হয়েছিল যা আসলে ক্যানসারের ফলে কোষের অনিয়ন্ত্রিত বৃদ্ধি। বহু চিকিৎসার পর ডাক্তাররা জানিয়ে ছিলেন, আধুনিক চিকিৎসায় এ রোগ সারিয়ে তোলা অসম্ভব। এমন অসম্ভবই সম্ভব করেছে মাদার টেরিজার একটি লকেট। ১৯৯৮-এর ৫ সেপ্টেম্বর রাতে মাদারের মিরাকেলে মুহূর্তে সুস্থ হয়ে ওঠেন মহিলা।

মিশনারিজ অফ চ্যারিটি ভ্যাটিকানের কাছে এই দাবি জানাবার পর কলকাতার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল বারুইপুরের বিশপ সালভাদোর লোবোর নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিটি সত্যানুসন্ধান করেন। ডাঃ আর এন ভট্টাচার্য তদন্ত কমিটির কাছে দেওয়া সাক্ষ্যে জানান, মণিকা বেসরা একজন ক্যানসার রোগী ছিলেন, তাঁর জরায়ুর ক্যানসার আধুনিক চিকিৎসার দ্বারা সারিয়ে তোলা ছিল অসম্ভব। বিশপ লোবোর তদন্ত রিপোর্ট পাওয়ার পর ভ্যাটিকান ঘটনাটিকে নির্ভেজাল মিরাকেল বলে ধরে নিয়ে সেন্ট ঘোষণার প্রক্রিয়া শুরু করেছে।

শ্রীভৌমিক জানালেন, এ বিষয়ে আমার বক্তব্য রেকর্ড করতে চান, বিবিসি-তে প্রচারের জন্যে।

বি বি সি’র স্টুডিওতে পৌঁছলাম ঘণ্টাখানেকের মধ্যে। ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির সাধারণ সম্পাদক হিসেবেই বক্তব্য রাখলাম। বলা ভালো—প্রশ্নের প্রেক্ষিতে জবাব। প্রশ্ন ছিল, মাদার টেরিজার মিরাকেল পাওয়ারের পরিচয় পেয়েছে বলে আজ ভ্যাটিকান ঘোষণা করেছে। ঘোষণার বলা হয়েছে, পশ্চিম দিনাজপুরের এক আদিবাসী মহিলার পেটে ক্যানসার হয়েছিল।

মাদার টেরিজার ছবি থেকে জ্যোতি এসে পড়ে মহিলার পেটে। সঙ্গে সঙ্গে ক্যানসার সেরে যায়। মাদারের এই মিরাকেলকে ভ্যাটিকান স্বীকৃতি দিয়েছে। এই স্বীকৃতি মাদারের ‘সেন্টহুড’ পাওয়ার ব্যাপারটা শক্ত করল। এ বিষয়ে আপনি ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে কী বলছেন, কী ভাবছেন।

উত্তরে মণিকা বেসরাকে নিয়ে আমাদের সমিতির গাজোল ও মশালদিঘি শাখার তিন সদস্য সুবোধ সূত্রধরের নেতৃত্বে যে তদন্ত চালিয়েছিল, বলেছিল তাঁরা কী পেয়েছেন, কী দেখেছেন, তাও বলেছি। জানিয়েছি আমাদের সমিতির স্ট্যান্ড। মাদারকে গরিবদের সেবা এবং ধর্ম প্রচার ও প্রসারের কাজকর্মের জন্য ভ্যাটিকান তাঁকে সম্মান জানিয়ে ‘সেন্ট’ উপাধি দিতেই পারত। কিন্তু ভ্যাটিকান এটা কী করল? ‘সেন্ট’ বানাতে ‘মিরাকেল’-এর মিথ্যে দাবি হাজির করে কিংবদন্তি মাদারকে তো অপমান-ই করল। আমরা মণিকার ডাক্তার ও স্বামী সেলকুর সঙ্গে কথা বলেছি। ওঁরা কিন্তু জানিয়েছেন, মণিকা ওষুধ খেয়েই সুস্থ হয়েছে। সেলকু কিন্তু নিজেই বিশ্বাস করেন না যে, মণিকা মিরাকেলে রাতারাতি সুস্থ হয়েছেন। এরপরও মিথ্যেকে ‘সত্যি’ বলে চালাবার এই অপচেষ্টা অবশ্যই নিন্দনীয়।

এমন মিথ্যে প্রচারে আমাদের মতন গরিব দেশের বিশাল ক্ষতি হবে। শিক্ষার সুযোগ লাভে বঞ্চিত, গরিব, কুসংস্কারে আচ্ছন্ন গ্রামের মানুষ এই ধরনের প্রচারে বিভ্রান্ত হবে। মেডিকেল ট্রিটমেন্টের বদলে ‘মিরাকেল’ চিকিৎসার দিকে ঝুঁকবে। ফলে মিথ্যে চিকিৎসায় মৃত্যু বাড়বে। এমন এক সর্বনাশ মিথ্যাচারিতার জন্য মিশনারিজ অফ চ্যারিটির বিরুদ্ধে সমস্ত রকম আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছে দাবি রাখছি। মিশনারিজ অফ চ্যারিটিকে এবং তাদের প্রধান সিস্টার নির্মলাকে প্রতারণা করার জন্য ইন্ডিয়ান পিনাল কোডের ৪২০ ধারায় অভিযুক্ত করা উচিত। এছাড়া ওদের ড্রাগস অ্যান্ড ম্যাজিক রেমিডিজ’ (অবজেকশনেবল অ্যাডভার্টাইসমেন্ট) অ্যাক্ট ১৯৫৪ ধারা লঙ্ঘনের জন্য অভিযুক্ত করা উচিত। এই ধারা মতে কেউ যদি অলৌকিক উপায়ে রোগ সারাবার পক্ষে কোনও ধরনের বক্তব্য রাখেন বা প্রচার করেন, তবে তিনি শাস্তিযোগ্য অপরাধী, মাদারের অলৌকিক ক্ষমতা বিশ শতকের ‘সেরা বুজরুকি ।

বক্তব্য শেষ করি একটা সোজাসাপটা চ্যালেঞ্জ জানিয়ে। আমাদের হাজির করা একজন অন্ধকে ভ্যাটিকান বা মিশনারিজ অফ চ্যারিটি কি দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিতে পারবে? পারলে আমাদের সমিতি অলৌকিক বিরোধী সমস্ত রকম প্রচার চিরতরে বন্ধ করে দেবে। প্রণামী হিসেবে তুলে দেবে কুড়ি লক্ষ টাকা ।

বিবিসি এই চ্যালেঞ্জের বিষয়ে মিশনারিজ অফ চ্যারিটির মতামত চায়। ওরা বলে, এ’বিষয়ে কোনও মন্তব্য করতে নারাজ। ভ্যাটিকানও চ্যালেঞ্জের বিরুদ্ধে নীরবতা পালন করে।

এই সাক্ষাৎকার বিবিসি সারা দিন ধরে প্রচার করেছে বাংলা, ইংরেজি, হিন্দি সহ বিভিন্ন ভাষায় ৷ খরবটা গোটা গোটা পৃথিবীকে তোলপাড় করে দেয় ৷ সংবাদসার বিসিসি-র ওয়েবসাইটে টপ টেন’-এ জায়গা দখল করে রেখেছিল বেশ কয়েক দিন।

ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির ইংরেজি করা হয়েছে Indian Rationals and Scientific Thinking Association’। আবার অনেকে আমাদের সমিতি ইংরেজিতে নাম দিয়েছেন, ‘Science and Rationalists’ Association of India’। পৃথিবীর অন্যান্য ভাষায় বাংলা অর্থ বজায় রেখে অন্য নাম দেওয়া হচ্ছে। তা হোক। ‘গোলাপ’-কে যে নামেই ডাকুক, সে ‘গোলাপই।

৫ অক্টোবর, শনিবার, ২০০২। কলকাতা থেকে প্রকাশিত মিঠুন চক্রবর্তীর দৈনিক পত্রিকা ‘খবরের কাগজ’-এর প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত হল একটি বড়ো লেখা। শিরোনোমঃ-

মাদার টেরিজার কোনও অলৌকিক শক্তি ছিল না। সুতরাং সেই ‘অলৌকিক’ শক্তি দিয়ে রোগ সারানোর কোনও প্রশ্নই নেই। এখন সেন্টহুড দেবার জন্য মাদারের নামে যেসব প্রচার চলছে তা সম্পূর্ণ পরিকল্পিত, অবৈজ্ঞানিক এবং ভিত্তিহীন। আমরা বিজ্ঞান এবং যুক্তি দিয়ে কড়াভাবে এর মোকাবিলা করেছি। যে মহিলার টিউমার মাদার সারিয়ে দিয়েছেন বলে খবর হয়েছিল সেটি সম্পূর্ণ মিথ্যে। এরকম কোনও ঘটনাই বাস্তবে ঘটেনি। বালুরঘাট হাসপাতালে এখনও ভর্তি রয়েছেন মণিকা বেসরা। মণিকার শারীরিক অবস্থার কোনও উন্নতি হয়নি।

আগেও যেমন ছিলেন এখনও তেমনই রয়েছেন। আর সবচেয়ে অবাক লাগছে কাউকে সেন্ট করার জন্য অলৌকিক ক্ষমতায় পরিচয় দিতে হবে কেন? ব্যাপারটা একেবারে বোকা বোকা। কারণ অলৌকিক বলে কিছু নেই। তাই সেন্টহুড দেবার ক্ষেত্রে অলৌকিক মানদণ্ড একেবারেই ভিত্তিহীন। আমরা ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির পক্ষ থেকে শুক্রবার বি বি সি-র মাধ্যমে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছি পোপকে। মণিকা বেসরার ঘটনাটি জানাজানি হবার পর বিবিসি আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে। আমরা পোপের উদ্দেশে বলেছি, আপনি কী একজন অন্ধকে দৃষ্টি ফিরিয়ে দিতে পারবেন? বা মাদারের ছবি কোনও অন্ধ মানুষের চোখে বসিয়ে দৃষ্টি ফেরাতে পারবেন ? যদি তা পারেন তবে সমিতির তরফ থেকে নগদ ২০ লক্ষ টাকা আপনার কাছে পাঠিয়ে দেব।

ইতিমধ্যেই বালুরঘাট হাসপাতাল থেকে সমস্ত বর্ণনা সবিস্তারে জানানো হয়েছে রাজ্যের স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে। আমাদের প্রশ্ন স্বাস্থ্যদপ্তরকে, যারা এই ষড়যন্ত্র করেছে তাদের বিরুদ্ধে আপনারা কী ব্যবস্থা নিচ্ছেন। ড্রাগ অ্যান্ড ম্যাজিক রেমিডিজ (অবজেকশনেবল অ্যাটভার্টাইসমেন্ট) অ্যাক্ট ১৯৫৪-তে বলা হয়েছে, কেউ যদি অলৌকিক ভাবে রোগ সারানোর কথা ঘোষণা করেন সঙ্গে সঙ্গে তাঁর তিন মাসের জেল হবে। আমাদের ইতিমধ্যেই আইনি বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে এ বিষয়ে বিশদ কথা চলছে। নির্দেশ দেওয়া হয়েছে আমাদের শিলিগুড়ি শাখাকেও তথ্যাবলী দেবার জন্যে। তাই মিশনারিজ অব চ্যারিটি-র বিরুদ্ধে আমরা কড়া শাস্তির দাবি তুলেছি। কারণ এইরকম উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, ভিত্তিহীন খবর বারবার প্রকাশ পেলে সাধারণ মানুষ ডাক্তারদের কাছে যাওয়া বন্ধ করে দেবে।

মাদার টেরিজাকে, কেউ যদি সেন্টহুড দিতে চায় আমাদের আপত্তি নেই। কিন্তু অযথা তাঁর অলৌকিক ক্ষমতা ছিল বলে খবর চালাবার চেষ্টা করলে আমরা ছেড়ে দেব না। যেখানে বিজ্ঞানের কোনও অস্তিত্ব নেই তা আমরা মানি না। সবচেয়ে বড় কথা, মানবতার কারণে আমাদের প্রতিবাদ করতেই হবে। মিথ্যে, আজগুবি, কল্পকাহিনি রটিয়ে কাউকে মহান বানানোর চেষ্টা করলে যুক্তিবাদী সমিতি ছেড়ে কথা বলবে না। এই প্রতিবেদন পড়ে অনেকেই হয়তো ভাববেন আমরা মাদারের সম্মানহানি করতে চাইছি। কিন্তু আদৌ ব্যাপারটা তা নয়। মাদার টেরিজা আমাদের শত্রু নন। কিন্তু তাঁর অলৌকিক কাহিনির কথা বলে যখন কোটি কোটি মানুষকে ধাপ্পা দেবার চেষ্টা চলছে তখন আমরা হাত গুটিয়ে বসে থাকব না। আবারও বলেছি, গোটা বিশ্বে অলৌকিক বলে কিছু ছিল না, নেই এবং আগামী দিনেও থাকবে না। মুমুর্ষু রোগীদের প্রতি তাই আমাদের আবেদন, এখনও সময় আছে। ডাক্তার দেখান। সুচিকিৎসা করান, রোগ সেরে যাবে। মাদারের ‘অলৌকিক হাতের ছোঁয়ার অপেক্ষায় বসে থেকে নিজের অকালমৃত্যু ডেকে আনবেন না।

৬ অক্টোবর, রবিবার, ২০০২। ‘খবরের কাগজ’-এর প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত হলোঃ

কথায়, বিশ্বাসে কী না হয়। মাদারের মধ্যে যে অলৌকিকত্ব ছিল তা তাঁরা বিশ্বাস করেন। সেই বিশ্বাসকে নষ্ট করার যাবতীয় চেষ্টাকে প্রতিরোধ করা হবে বলে ওই সিস্টার জানান ।

৭ অক্টোবর, সোমবার, ২০০২। দিল্লির দৈনিক পত্রিকা ‘Today’-র প্রথম পৃষ্ঠা জুড়ে শুধু একটাই খবর, ‘Mothers Miracle Challenged’ লাল বক্স করে লেখা ‘Exclusive India Today গোষ্ঠীর দৈনিক ‘Today’। রাজধানী দিল্লিতে বোম ফাটল। Today-ওয়েব সাইটেও খবরটা বিরাট গুরুত্বের সঙ্গে ছাপা হল।

৮ অক্টোবর, মঙ্গলবার, ২০০২। স্টার নিউজ চ্যানেলে সারাদিন আমরা। কাশ্মীরে ভোট আর তা নিয়ে ব্যাপক হিংসা ও গন্ডগোল যখন প্রায় পুরো সময় খেয়ে নিচ্ছে, তখন দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ খবর হয়ে উঠেছে, মাদার টেরিজাকে সেন্ট বানাবার জন্য ভ্যাটিকানের মিথ্যচারিতার বিরুদ্ধে যুক্তিবাদী সমিতির তীব্র প্রতিবাদ।

একই দিনে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় দুটি সংবাদ সরবরাহকারী সংস্থা এ এফ পি এবং রয়টার খবরটা ছাড়ল। ভ্যাটিকান ও মিশনারিজ অফ চ্যারিটির মিথ্যাচারিতা বে-আব্রু করার খবর। তাদের বিরুদ্ধে ছুড়ে দেওয়া চ্যালেঞ্জ, আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সরকারের কাছে দাবি—সবই ওদের সরবরাহ করা খবরে স্থান পেল। এ এফ পি এবং রয়টার আরও জানাল, মাদারের মিরাকেল বিষয়ে যুক্তিবাদী সমিতির তদন্ত রিপোর্ট এবং চ্যালেঞ্জের খবর পৌঁছে দেওয়া হয়েছে ভ্যাটিকান ও মিশনারিজ অফ চ্যারিটির কাছে। ওরা সব শোনার পর এ বিষয় কোনও মন্তব্য করতে বা বক্তব্য রাখতে রাজি হয়নি।

রাতে সুবোধ সূত্রধরের সঙ্গে কথা হল। সুবোধ জানালেন মণিকা বেসরার দিদি কাঞ্চনের সঙ্গে আজই কথা হল, কাঞ্চন মিশনারিজ অফ চ্যারিটির গঙ্গারামপুর হোলি ক্রস হাসপাতালের নার্স ছিলেন। কাঞ্চন-ই মণিকাকে বালুরঘাট হাসপাতালে ও শিলিগুড়ির উত্তরবঙ্গ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলেন। হঠাৎ করে কাঞ্চনের হোলি ক্রসের নার্সের চাকরিটা গেছে। আপাতত কাঞ্চন থাকেন বুনিয়াদপুরের কামারডাঙায়। একটা প্রাইমারি স্কুলে পড়াচ্ছেন। কাজটা মিশনারিজদের-ই দেওয়া। মিশনারিজ অফ চ্যারিটি থেকে কয়েকজন এসেছিলেন দিন কয়েক আগে। কাঞ্চনকে পই-পই করে পাখি পড়াবার মতো পড়িয়ে গেছেন, হঠাৎ কোনও সাংবাদিক ওঁর বাড়িতে এসে পড়লে কী বলতে হবে। বলতে হবে — মাদারের লকেট পেটে রেখে মণিকা প্রার্থনা করছিল একটা রাতে। সেই রাতে হঠাৎই টিউমারটা অদৃশ্য হয়ে যায় ৷ কাঞ্চন একথাও বলেছেন, যাঁরা মণিকার চিকিৎসা করেছিলেন, সেই ডাক্তাররা কেউই বলতে রাজি হচ্ছেন না যে মাদারের আশীর্বাদে রোগ সেরেছে। তাই মিশনারিজের সিস্টার ও নানরা ডাক্তারদের ওপর রেগে আছেন। কাঞ্চন যদি উলটোপালটা কিছু বলে ফেলেন, তাই তাঁকে নার্সের চাকরি থেকে সরিয়ে সাংবাদিকের কাছ থেকে আড়াল করতে চাইছেন, বলে মণিকাও মনে করেন। মণিকা এ’সবই সুবোধকে বলেছেন দীর্ঘ-বছরের পরিচয়ের সুবাদে।

৯ অক্টোবর, বুধবার ২০০২। পত্রিকার নাম আনন্দবাজার। প্রথম পৃষ্ঠার খবর

‘টেরিজার মহিমা, নাকি ওষুধ, মণিকা নিরাময় কীসে’।

খবরটির একাংশে বলা হয়েছে, “মণিকার দিদি আপাতত থাকেন বুনিয়াদপুরের কামারডাঙার বাড়িতে। প্রাথমিক স্কুলশিক্ষিকা কাঞ্চন জানিয়েছেন, চিকিৎসার পরে অনেকটাই সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন। পাতিরাম মিশনারিজ অফ চ্যারিটি থেকে তাঁকে জানানো হয়েছিল, মাদারের লকেট ছুইয়ে প্রার্থনার সময় অলৌকিক ভাবে মণিকার পেটের টিউমার অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে। এবং মাদারের আশীর্বাদেই এটা সম্ভব হয়েছে বলে যেন তাঁরা মনে রাখেন।”

এ’দিনের সর্বভারতীয় ইংরেজি দৈনিক ‘দ্য এশিয়ান এজ’ পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত হল একটি খবর ‘যুক্তিবাদীদের বিদ্রুপের লক্ষ্য মাদারের মিরাকেল’। খবরটি : এক জায়গায় বলা হয়েছে স্বাস্থ্যমন্ত্রী পার্থ-দে মিশনারিজ অফ চ্যারিটিকে ২০০০ সালেই জানিয়ে দিয়েছিলেন, শ্রীমতী বেসরা সুস্থ হয়েছেন মেডিকেল ট্রিটমেন্টে।

খবরটির আর এক জায়গায় বলা হয়েছে, : মিস্টার ঘোষ প্রশ্ন তুলেছেন, যে ডাঃ ভট্টাচার্য সার্টিফাই করেছেন মণিকা বেসরা এমন অসুখে ভুগছিলেন যা সারা সম্ভব নয় এবং তিনি সুস্থ হয়েছিলেন অলৌকিক ক্ষমতার দ্বারা—সেই ডাঃ ভট্টাচার্যের খোঁজ এখন মিডিয়াগুলো পাচ্ছে না কেন ?

অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। কিন্তু খ্রিস্টানব্রাদারহুডের বিশ্বায়নের পরিকল্পনার কারিগররা তো আর ভারতীয় আঁতেল মার্কা জোকার নন, সত্যিই মেধা-বুদ্ধির মিশ্রণ। ওরা কেন ডাঃ ভট্টাচার্যকে নিউজ মিডিয়ার সামনে হাজির করবে? এতো সূর্য-চন্দ্রের অস্তিত্বের মতোই সত্যি যে, তোতাপাখি ডাক্তারবাবুটিকে নিউজ মিডিয়া হাতের সামনে পেলে ছিঁড়ে-খুঁড়ে খাবে। ঝাঁকে ঝাঁকে প্রশ্ন এসে আছড়ে পড়তে থাকবে—কবে প্রথম মণিকা আপনার কাছে ট্রিটমেন্টের জন্য গিয়েছিলেন? কোথায় মণিকা আপনাকে দেখান? শিলিগুড়ির উত্তরবঙ্গ হাসপাতালে ? না, কোনও চেম্বারে? আপনি কী করে নিশ্চিত হলেন মণিকার জরায়ুতে যে টিউমার হয়েছে, তা ক্যানসার, অর্থাৎ কোষের অনিয়ন্ত্রিত বৃদ্ধি? নিশ্চয়ই বায়পসি টেস্ট করাবার পর এই সিদ্ধান্তে এসেছিলেন? কোন্ প্যাথলজিকাল ল্যাব থেকে বায়পসি টেস্ট করা হয়েছিল? একটাই ল্যাব থেকে টেস্ট করা হয়েছিল? নাকি একাধিক ল্যাব থেকে? সেই বায়সি রিপোর্ট কোথায়? প্যাথলজিকাল ল্যাবের রিপোর্টগুলো সঙ্গে সঙ্গে ল্যাবের রেজিস্টারেও তোলা হয়েছিল তো? তোলা না হয়ে থাকলে রিপোর্টের সত্যতা নিয়ে সংশয় থাকবেই। এইসব তথ্য-প্রমাণ দেখাতে পারবেন তো? তথ্য-প্রমাণের সত্যতা পরীক্ষা করতে চাইলে পরীক্ষা করা যাবে তো? ক্যানসার তো এখন বহু ক্ষেত্রেই সারে, এ সত্য ওয়ার্ল্ড হেলথ্ অরগানাইজেশন থেকে ক্যানসারের চিকিৎসকরা মানেন। আপনার কেন মনে হল, মণিকার ক্যানসার আধুনিক চিকিৎসায় সেরে ওঠা সম্ভব নয়? এই মত কী কোনও ক্যানসার বিশেষজ্ঞের? সেই বিশেষজ্ঞের নাম ঠিকানা কী? মণিকার কি কেমোথেরাপি চলছিল? কোন্ হসপিটালে কেমো চলছিল? আপনি কি কেমো নিতে কোনও ডাক্তারের কাছে মণিকাকে রেফার করেছিলেন? না করে থাকলে কেন করেননি? আপনি কী জানতেন যে, কেমোর প্রয়োজন নেই, মাদারের মিরাকেলেই মণিকা সেরে উঠবেন? যে ডাক্তাররা মণিকার চিকিৎসা করেছেন, আপনি কি তাঁদের সঙ্গে কথা বলেছিলেন? মণিকার কি

টিবি হয়েছিল? টিবি-র পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে জরায়ুতে এমন একটা দলা হওয়া কি সম্ভব ? টিবি সারলে কি দলাও সেরে যেতে পারে? কী কী কারণে আপনার মনে হল, মণিকা ক্যানসারে ভুগছেন ?

এমনই হাজারো জরুরি প্রশ্নের ঝড়ে ডাঃ ভট্টাচার্যথেক মুখ থুবড়ে পড়বেন-ই—এটা বুঝেই কী ভ্যাটিকানের এই লুকোচুরি?

আবারও একটা কথা মনে করিয়ে দিই—শুরুতে ভ্যাটিকান জানিয়ে ছিল মণিকা ক্যানসার রোগী। ২০ অক্টোবর ২০০২-এর রোজনামচায় সেই প্রসঙ্গে আসব।

‘অল ইন্ডিয়া রেডিও’-র খবরে এবার আমরা। সর্বভারতীয় খবরে দিনভর আমরা। অনেকটা সময় ধরে। আমাদের প্রতিবাদ, আমাদের চ্যালেঞ্জ ভাষা পেল। ছাপার অক্ষর ছেড়ে এবার শব্দ হয়ে। পানের দোকান থেকে রান্নাঘর, খেত থেকে বস্তি সর্বত্র ভাসছে আমাদের কথা। মণিকার বেসরার অসুখ যে মাদারের মিরাকেলে সারেনি সে কথা। খবরের কাগজ থেকে দূরে থাকা কোটি কোটি মানুষ জানলেন, ভ্যাটিকানের শতাব্দীসেরা প্রতারণার কথা, আমাদের চ্যালেঞ্জের কথা ৷

১৫ অক্টোবর, মঙ্গলবার, ২০০২। বিশ্বের অন্যতম নামী ও সম্ভ্রান্ত সাপ্তাহিক ‘টাইম’ (TIME)। আজ ‘টাইম’ প্রকাশিত হয়েছে। প্রচ্ছদ কাহিনি – মাদার টেরিজার মিরাকেল বিতর্ক। একই সঙ্গে ‘টাইম’–এর ওয়েবসাইটে জ্বলজ্বল করছে ‘সেন্ট’ বিতর্ক। উপ-শিরোনামে লেখা আছে “Monica says she is proof of a miracle by the late nun; her husband begs to differ” | বাংলা করলে দাঁড়ায়, “মণিকা বলেছেন তিনি মৃত নানের (মাদারের) অলৌকিক ক্ষমতার প্রমাণ; ওঁর স্বামীর ভিন্ন মত” ।

ভিতরে রয়েছে মণিকার স্বামী সেলকুর কথা, “My wife was cured by the doctors and not by any miracle”; অর্থাৎ “আমার স্ত্রীকে সুস্থ করে তুলেছেন ডাক্তাররা, অলৌকিক নয়।” সেলকুর বক্তব্য হিসেবে আরও লেখা আছে, “This miracle is a hoax.” অর্থাৎ এই মিরাকেল একটা ধোঁকা।

গত ২৯ সেপ্টেম্বর এই কথাই জানিয়েছিলেন যুক্তিবাদী সমিতির সদস্য সুবোধ। কিন্তু তারপর দ্রুত পালটে গেছে গোটা পরিস্থিতিটা। এখন ভ্যাটিকান, মিশনারিজ অফ চ্যারিটি, খ্রিস্টান ব্রাদারহুডের পৃষ্ঠপোষকরা নিশ্চয়ই মণিকা, সেলকুর কথা বলার অধিকার কেড়ে নিয়েছে। ৪ অক্টোবর বিবিসি যে বোমা ফাটিয়েছে; তারপর সেলকুর মুখে এমন কথা! সেলকুর এই সাক্ষাৎকার নিশ্চয়ই আমার সাক্ষাৎকার প্রচারের দু-এক দিনের মধ্যেই নেওয়া। মিশনারিজদের ব্যবস্থা গ্রহণের আগেই নেওয়া।

বিবিসি, এ এফ পি, রয়টার, টাইম এবং আরও সব নিউজ মিডিয়াগুলো এ কী আরম্ভ করেছে? সব্বাই মিলে যুক্তিবাদী সমিতির অনুসন্ধান রিপোর্ট, প্রশ্ন, চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছে ভ্যাটিকানকে লক্ষ্য করে। ভ্যাটিকানের অবস্থা এখন বোমা-বিধ্বস্ত পার্ল হারবার-এর মতো

TIME-এর খবরের অনেকটা জুড়েই আমরা আছি। হ্যাঁ খবরের অনেকটা জুড়েই আমরা আছি। টাইম-এর ওয়েব সাইট থেকে একটু অংশ তুলে দিচ্ছি। “The vacuum created by that silence is being filled by conspiracy theorists

who see the Missionaries of Charity overeagerly producing proof that their founder is within the gates of heaven. That chorus is amplified by vociferous debunkers, among them Prabir Ghosh, head of the Science and Rationalist Association of India. Ghosh, who is based in Calcutta, has deflated the claims of many of India’s self-proclaimed Hindu holy men and holds that no miracle should be exempt from scrutiny. He says he has no complaint “if she is declared a saint for all the great work she had done among poor people, But, adds, “she is not capable of any miracle. It is indeed an insult to Mother Teresa to make her sainthood dependent on some stupid miracles. “Ghosh tells Time that he will shut down his association and turn over its 2 million rupees ($40,000) to the Catholic order if the sisters will put the medallion to test and have it cure another tumor.”

এরপর একটা মজার ছত্রিশ-ভাজা মার্কা গপ্পো শোনাই। ‘টাইম’ ম্যাগাজিনের এই লেখাটির রেফারেন্স টেনেছে অনেক ভারতীয় পত্রিকা-ই। স্বভাবতই তারা আমাদের সমিতির বক্তব্যের উল্লেখ করেছে। টাইম ম্যাগাজিনকে ‘কোর্ট করেও যুক্তিবাদী সমিতির নামটা বেমালুম ভুলে থেকেছে শহর কলকাতা থেকে প্রকাশিত দৈনিক পত্রিকাগুলো।

বিবিসি, এ এফ পি, রয়টার, টাইম ইত্যাদি মহাশক্তিধর নিউজ মিডিয়াগুলো যখন মাদারের মিরাকেল নিয়ে যুক্তিবাদী সমিতিকে হাতিয়ার করে প্রশ্নের মেরুঝড় তুলেছে, তখন শহর কলকাতার পত্রিকাগুলো আশ্চর্য রকম নিস্তরঙ্গ। এমন অদ্ভুত আচরণে দেশ-বিদেশের সাংবাদিকদের কেউ অবাক কেউ বা মজার খোরাক পেলেন, কেউ বা বললেন—’গন্ধটা খুব সন্দেহজনক ।

১৮ অক্টোবর, শুক্রবার, ২০০২। কলকাতা থেকে প্রকাশিত বাংলা দৈনিক ‘আজকাল’-এর এডিটরিয়ল পেজে ছাপা হল আমার একটি লেখা—‘সফেদ ঝুট এবং কিছু কথা’। সেখানে গোড়া থেকেই ‘গত শতকের সেরা বুজরুকি’ চিহ্নিত করেই মাদার-মিরাকেলের নেপথ্য কাহিনি হাজির করেছি।

২০ অক্টোবর, রবিবার, ২০০২। পত্রিকার নাম-আনন্দবাজার। চার কলাম জুড়ে খবর, ‘এখনই টেরিজা-মহিমায় আচ্ছন্ন ভ্যাটিকান’। ভ্যাটিকান থেকে খবর পাঠিয়েছেন শ্রাবণী বসু। তাঁর কথায়, “ভ্যাটিকান সরকারি ভাবে তাঁকে সন্তু ঘোষণা করবে আগামী বছরের মাঝামাঝি সময়। তার আগে সন্তু হিসেবে ঘোষণা করার পূর্ববর্তী পর্যায়ের শেষ ধাপ (বিয়েটিফিকেশন) সম্পন্ন হবে আগামী বসন্তে, ভ্যাটিকানের তরফে জানানো হয়েছে। অর্থাৎ এখনও পাঁচ-ছ’মাস দেরি।” আনন্দবাজার ভ্যাটিকানকে কোট করে জানাচ্ছে, ২০০৩-এর মার্চ-এপ্রিলে বিয়েটিফিকেশন অনুষ্ঠিত হবে। সেন্টহুড দেওয়া হবে ২০০৩-এর মাঝামাঝি নাগাদ

তাহলে ঝুলি থেকে শেষ পর্যন্ত বেড়াল বেরুল ২০০৩-এর অক্টোবরে। সেন্টহুড দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে আঁট-ঘাট বেঁধেই নেমেছিলেন পোপ। ২০ অক্টোবর ২০০২-এর আনন্দবাজার বলছে, “…..এখনও পাঁচ-ছ’মাস দেরি। কিন্তু ভ্যাটিকান জুড়ে এখন থেকেই টেরিজাকে সন্ত হিসেবে ঘোষণা করার অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি চলছে পুরোদমে।” এত কিছুর পর কেন পিছোলেন পোপ?

আনন্দবাজার ২০ অক্টোবর ২০০৩। ঠিক একটি বছর পরের আনন্দবাজার প্রথম পৃষ্ঠায় বলছে, “পোপ নিজে চেয়েছিলেন টেরিজাকে সরাসরি সন্ত পদে আসীন করতে। কিন্তু তাঁর কার্ডিনালদের পরামর্শে বিয়েটিফিকেশনের জরুরি পর্বটি পালন করাই সাব্যস্ত হয়।” আনন্দবাজার ২০০২ এবং ২০০৩ সালের ২০ অক্টোবর সংখ্যা দুটি থেকে পাঠক-পাঠিকাদের বুঝতে কোনও অসুবিধেই হয় না যে, ২০০২-এর শেষ দিকে মাদার টেরিজাকে সেন্ট বানাবার প্রত্যয়ী ও নিশ্চিত প্রচেষ্টা ছিল। কিন্তু সে পরিকল্পনা বিসর্জন দিয়ে ‘বিয়েটিফিকেশন’-এর মধ্যেই নিজেদের আটকে রাখতে হয়েছে।

আটকে গেছে বিশ্ব মিডিয়ার প্রচণ্ড চাপে। আর এই চাপ সৃষ্টিতে মিডিয়াদের একমাত্র হাতিয়ার ‘ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি’। না, আর কোনও সংগঠনের নাম বিশ্বের কোনও নিউজ মিডিয়াই উল্লেখ করেনি।

আরও একটি লক্ষণীয় বিষয় হলো—আজ চাপে পড়ে মণিকাকে টিউমার রোগী বলা হচ্ছে। এক বছর আগে ভ্যাটিকান প্রচার রেখেছিল, মণিকা ছিল ক্যানসার রোগী। এখন প্ৰচণ্ড চাপে পড়ে, ব্যাক ফুটে খেলছেন।

২০ অক্টোবর, রবিবার ২০০২। আনন্দবাজার পত্রিকার প্রতিনিধি শ্রাবণী বসু ভ্যাটিকান সিটি থেকে রিপোর্ট দিচ্ছেন “পেটে টেরিজার মাদুলি ঝুলিয়ে রেখে যাঁর পাকস্থলীর ক্যানসার সেরে গিয়েছে বলে মেনে নিয়েছে ভ্যাটিকান, ‘যুক্তিবাদীদের’ সন্দেহ ও অবিশ্বাস সত্ত্বেও।”

২০০২-এর ৪ অক্টোবর ভ্যাটিকানের বুজরুকির বিরুদ্ধে যুক্তিবাদীরা প্রচার-প্রতিবাদ চ্যালেঞ্জ জানানো সত্ত্বেও কয়েকটা দিন ব্যাপারটাকে পাত্তাই দেয়নি ভ্যাটিকান। তারপর চাপ বাড়তেই ডিগবাজি। ক্যানসার হল টিউমার।

তাহলে টিউমারের কোনও বায়পসি রিপোর্ট না দেখেই বালখিল্যের মতো “ক্যানসার সেরেছে, ক্যানসার সেরেছে” বলে শোরগোল তুলেছিলেন কেন পোপ? এ তো দেখছি, ‘ছিল বিড়াল, হলো রুমাল’-এর গল্প।’

এই ভ্যাটিকানি ডিগবাজি শুধু ডিগবাজি নয়। যুক্তিবাদী সমিতির জয়। যুক্তিবাদীদের জয়। ২৩ অক্টোবর বুধবার ২০০২। ভোরে ট্রেনে মালদায় পৌঁছলাম ‘খোঁজখবর’- এর প্রতিনিধি হিসেবে। সঙ্গী খোঁজখবর-এর ফোটোগ্রাফার নন্দন। খোঁজখবর বাংলা ভাষার জনপ্রিয় অনুসন্ধানমূলক টিভি অনুষ্ঠান। এখানে আসার উদ্দেশ্য মণিকাকে নিয়ে সত্যানুসন্ধান চালানো এবং বিষয়টি ক্যামেরা বন্দি করা ।

একটা ইন্টারেসটিং তথ্য পেশ করছি। গতকাল পর্যন্ত কোনও দেশি-বিদেশি টিভি কোম্পানি- ই দেখাতে পারেনি মণিকা, সেলকু এবং মণিকার ডাক্তারদের সাক্ষাৎকার। দেখাতে পারেনি এমন কোনও’ এক্সক্লুসিভ ইনসাইড স্টোরি’ যাতে একটা ঋজু সত্য উঠে আসে। কথাটা অদ্ভুত হলেও সত্যি। বিভিন্ন টিভি নিউজের সাংবাদিকরাই আমাকে বলেছেন, একাধিক দিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা চেষ্টা করেও তাঁরা ব্যর্থ হয়েছেন। এ বিষয়ে ভ্যাটিকান ও মিশনারিজ অফ চ্যারিটির যথাক্রমে সূক্ষ্ম ও স্থূল হাত ছিল, এমন ভাবনা আসাটা অস্বাভাবিক নয় ।

এমনই এক বিশ্রি পরিস্থিতিতে ছবি তুলে দেবার আমন্ত্রণ এল। তাও আমন্ত্রণ এল এতই দেরিতে, যখন মণিকা চলে গেছেন লৌহ যবনিকার অন্তরালে। মিশনারিজ অফ চ্যারিটি মণিকাকে কোথায় যে লুকিয়ে ফেলেছে, হাজার মাথা খুঁড়েও নিউজ মিডিয়াগুলো তার হদিশ পাচ্ছে না । ভ্যাটিকান কোথায় বুক চিতিয়ে মণিকা-সেলকু-ডাক্তার ভট্টাচার্যকে নিয়ে প্রেস কনফারেন্স করে বিতর্কের আগুনে জল ঢেলে দেবে, তা নয়, গোড়া থেকেই লুকোচুরি। ভ্যাটিকানের এই ‘চুপ-গুপ’ ব্যবহারই চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছে— ‘ডালমে কুছ কালা হ্যায়।’

মালদা স্টেশনে আমাদের জন্য অপেক্ষায় ছিলেন যুক্তিবাদী সমিতির মশালদিঘি শাখার দুই তরুণ চিকিৎসক নিরঞ্জন মণ্ডল ও মদনমোহন বিশ্বাস এবং গাজোল শাখার সুবোধ সূত্রধর। গাড়ি নিয়ে প্রথমেই গেলাম ফুলের বাজারে। কয়েকটা সেরা ফুলের তোড়া কিনলাম। দৌড়লাম আলমপুর চার্চে। খবর আছে, এখানেই মণিকাকে গত ৪ অক্টোবর থেকে গোপনে রাখা হয়েছে।

বিশাল এলাকা নিয়ে আলমপুর চার্চ। বিশাল বাগানে আনাজপাতির চাষ। ছোট্ট একটা ডিসপেনশরি। গ্রামের মানুষরা লাইন দিয়ে ওষুধ নিচ্ছেন। ডাক্তার নেই চার্চের সিস্টাররাই রোগী দেখছেন, ওষুধ দিচ্ছেন।

ইনচার্জ সিস্টারের দেখা মিলল। রোগী দেখছিলেন। একটি ফুলের তোড়া হাতে আমি ওঁর দিকে এগোলাম। আমার পোশাক ও শরীরী ভাষা বুঝিয়ে দিচ্ছে আমি ধর্মে খ্রিস্টান। গলায় ক্রস। মাথায় একটা টুপি মাথা ঝুঁকিয়ে হাসি ঝুলিয়ে একটা ফুলের তোড়া তুলে দিলাম সিস্টারের হাতে। অনেক কথা হল। অনেক ছবি তোলা হল। জানালাম, এসবই ক্যাসেট বন্দি করে রাখছি মাদারকে সেন্টহুড দেবার সময় দেখাবার পরিকল্পনা মাথায় রেখে।

সিস্টারের চোখে ও কথায় যে সতর্কতা শুরুতে দেখেছিলাম, তা কিছুক্ষণের মধ্যেই মিলিয়ে গেছে আমার ব্যবহারে। দ্বিতীয় একটি ফুলের তোড়া আমার হাতেই ছিল। সেটা সিস্টারের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললাম, একটা অনুগ্রহ করে মণিকা বেসরা-র কাছে পৌঁছে দেবেন। বলবেন, পুলক গোমস দিয়েছেন।

শেষ পর্যন্ত সিস্টারের কাছ থেকে খবরটা পাওয়া গেল। গত পরশু মণিকা তাঁর গ্রামের বাড়ি নাকোড়-এ গেছেন। এ খবরও মিলল, এতটা গোপনীয়তার কারণ ‘র‍্যাশনালিস্ট প্রবীর ঘোষ’।

বাসস্টপ দানগ্রাম। বাস আর ম্যাক্সি ট্যাক্সি দাঁড়ায়। দোকান, বাজার, ব্যাঙ্ক, সব-ই এখানে আছে। ছোট্ট আধা-শহর। দশ-বিশটা গ্রামের মানুষ দানগ্রামেই বাজার করতে আসেন। নাকোড়বাসীদের দোকান-বাজার করতে এখানেই আসতে হয়। দীর্ঘ বছর ধরে মণিকা পরিবারের জন্য দোকান-বাজার করতে এখানেই আসেন। তবে গত মাসখানেক হল দানগ্রামে মণিকাকে কেউ দেখেননি। রাতারাতি ভ্যানিস।

দানগ্রামের প্রচুর মানুষের সাক্ষাৎকার নিয়েছি। ওঁদের অনেকে নাকোড় গ্রামের মানুষ। নাকোড় এখান থেকে দু’কিলোমিটারের পথ। ওঁদের সাক্ষাৎকার থেকে যে কয়েকটি কথা বা ‘পয়েন্ট’ উঠে এসেছে, সেগুলো হলো : (১) মণিকার বর সেলকু ‘জন’ খাটত। (২) যেটুকু চাষযোগ্য জমি ছিল, তা-ও মণিকার চিকিৎসার খরচ জোগাতে বন্ধক দিতে হয়েছে। (৩) মণিকার দিদি কাঞ্চন মিশনারিজ অফ চ্যারিটির স্বাস্থ্যকর্মী ছিলেন। (৪) মণিকার রোগের দায়িত্ব কাঞ্চনের উপরই ছেড়ে দিয়েছিলেন মণিকা ও সেলকু। (৫) কাঞ্চন-ই মণিকাকে নিয়ে যান বালুরঘাট হাসপাতাল ও শিলিগুড়ি হাসপাতালে। (৬) এর বছর খানেক পর কাঞ্চনের সঙ্গ ধরে মিশনারিজ অফ চ্যারিটির গাড়ি নাকোড়ে ঢুকল। (৭) গরীব মণিকাদের বাড়ি ঘন ঘন মিশনারিজদের গাড়ি আসতে লাগলো ৷ সে এক রহস্যময় আনাগোনা। গাড়ি থেকে সিস্টাররা নেমে সোজা ঢুকে যেতেন মণিকাদের ঘরে। ঘন্টাখানেক থেকে বেরিয়ে আসতেন। (৮) ওদের আনাগোনার সঙ্গে সঙ্গে মণিকাদের অবস্থা ফিরে গেল। (৯) তারপর মণিকা, সেলকু খ্রিস্ট ধর্ম নিলেন। (১০) মণিকারা এখন আর হতদরিদ্র নন। যথেষ্ট অবস্থা ফিরেছে।

দানগ্রাম বাসস্টপে একটি জামা কাপড়ের দোকান ‘আজকাল’। আজকালের মালিক নাকোড়ের বাসিন্দা। মণিকার আত্মীয়ও। তাঁর কথায়—মণিকারা ভূমিহীন কৃষক। খুব গরিব। বর সেলকু ‘জন’ খাটত। এখন তাড়ি গিলে পড়ে থাকেন। কাজ করেন না। কাজ করার দরকার হয় না । সংসারে এখন কোনও অভাব নেই মিশনারিজের কৃপায়। প্রতি মাসেই আলমপুর চার্চ থেকে গাড়ি আসে মণিকার বাড়িতে। মণিকাদের পরিবার ‘আজকাল’ থেকে ইচ্ছেমতো শাড়ি, ধুতি, জামা, কাপড় নিয়ে যায় ধারে। এই ধার মিটিয়ে দেয় আলমপুর চার্চ। মণিকার পরনের শাড়ি অবশ্য আলমপুর চার্চের সিস্টার নিজে পছন্দ করে কিনে দেন। কিনে দেন ব্লাউজের কাপড় বা ব্লাউজ। ও কী ব্যাগ নেবে তা পর্যন্ত ঠিক করে দেন সিস্টার। বছর দুয়েক আগেও মণিকা দু-পাঁচ ক্রোশ পথ হেঁটেই পাড়ি দিতেন। এখন ম্যাক্সি-ট্যাক্সিতে যাতায়াত করেন। মণিকার ছেলে- মেয়েরা আগে ঘরে বসে থাকত। এখন চারজনই মিশনারিজদের স্কুলে পড়ে, ওদের হোস্টেলে থাকে। সবই বিনে পয়সায় ৷

  • দানগ্রাম বাসস্ট্যান্ডের মানুষগুলো একটি বিষয়ে একমত, টেরিজার মিরাকেলে মণিকার রোগ সারাটা ডাহা মিথ্যে, টাকার বিনিময়ে মণিকাদের দিয়ে মিথ্যে বলানো হয়েছে।

নাকোড়েও দেখা মিলল না মণিকার। দেখা পেলাম সেলকুর। সেলকুর অতি পরিচিত সুবোধ আমাদের সঙ্গী হওয়া সত্ত্বেও সেলকু ক্যামেরার সামনে মুখ খুলতে বিলকুল নারাজ। ক্যামেরায় ছবি হচ্ছে না, এ বিষয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে সেলকু সতর্কতার সঙ্গে কিছু কিছু করে মুখ খুলতে লাগলেন । সেলকু স্বীকার করলেন কয়েকটি কথা। (১) মণিকার টিবি হয়েছিল। (২) পাঁচ রকমের ওষুধ দিয়েছিলেন হাসপাতালের ডাক্তারবাবুরা। (৩) ৯-১০ মাস ওষুধ খেয়েছিলেন মণিকা। (৪) পেটে এত বড় একটা টিউমার হয়েছিল যে, কুঁজো হয়ে হাটতেন মণিকা। (৫) দেখলে মনে হত ১০ মাসের পোয়াতি। (৬) মাদারের চার্চ-ই সংসার চালাচ্ছে। (৭) মাদারের কৃপাতেই মণিকার রোগ সেরেছে। মাদারের ছবি থেকে হঠাৎ একটা আলো এসে পেটে পড়তেই টিউমার ভ্যানিস। (৮) সেলকুর বন্ধক রাখা জমি ছাড়াতে আমার (এই লেখকের) আর্থিক দান গ্রহণ করতে এখনই অসুবিধে আছে। মাদারের চার্চের অনুমতি নিতে হবে। চার্চের এমনই নির্দেশ। (৯) মণিকা এখন আছেন পতিরাম চার্চে। (১০) সেলকু, তাঁর ইচ্ছেমতো মণিকার সঙ্গে দেখা করতে পারেন না। ফোনে চার্চের অনুমতি নিতে হয়। (১১) এখন গোলমাল চলছে, মাদারের অলৌকিক ক্ষমতার একমাত্র প্রমাণ মণিকা। কলকাতার যুক্তিবাদীরা পিছনে লেগেছে, তাই চাৰ্চ মণিকাকে সরিয়ে নিয়ে গেছে।

নাকোড় গ্রামের প্রচুর মানুষ কথা বলেছেন ক্যামেরার সামনে। মণিকার পেটে বিশাল টিউমার থাকায় গর্ভবতী মনে হত—একথা কেউ-ই মানলেন না।

নাকোড় থেকে সোজা বালুরঘাট জেলা হাসপাতালে গেলাম। দেখা পেলাম হাসপাতালের সুপার ডাঃ মঞ্জুর মুর্শেল ও ডাঃ রঞ্জন মুস্তাফির। ডাঃ মুস্তাফি মণিকার চিকিৎসা করেছিলেন। সুপার ডাঃ মুর্শেদ স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন, টি ভি ক্যামেরার সামনে মুখ খুলবেন না তাঁরা। যুক্তিবাদী সমিতির প্রবীর ঘোষের সামনেই শুধু মুখ খুলবেন। কারণ—সময়টা খুব খারাপ। এই সময় যুক্তিবাদী প্রবীর ঘোষ একমাত্র নির্ভরযোগ্য, বিশ্বাসযোগ্য মানুষ। শুনে একই সঙ্গে লজ্জিত ও গর্বিত হচ্ছিলাম। আমার পরিচয় পেয়ে, খুশি দু’জনেই জানালেন, (১) মণিকার হয়েছিল টিবি। এতে অনেক সময় শরীরে ‘একস্ট্রা গ্রোথ’ হয়, যাকে বলতে পারি টিউমার সঙ্গে ছিল যক্ষ্মা সংক্রামণজনিত মস্তিষ্কের প্রদাহ। সব মিলিয়ে রোগটাকে বলতে পারি, টিউবার কুলার মেনিনজাইটিস। (২) টিবি সারতে থাকলে টিবি রোগের উপসর্গ টিউমার সারতে থাকে। (৩) মণিকা ৫ রকম ওষুধের ৯ মাসের একটা কোর্স নিয়েছিলেন। টিবি সারাবার ওষুধ। (৪) এতে সেরেছে। টিউমার বা মাংসের দলা সেরেছে। টিবি এখন খুবই সাধারণ অসুখ। (৫) টিউমারটা বা দলাটা ছিল একটা লেবুর আকারের। (৬) ভ্যাটিকান, মিশনারিজ অফ চ্যারিটি এবং আমেরিকার টিভি সি এন এন প্রচার করছে— কোনও এক ডাঃ ভট্টাচার্য নাকি জানিয়েছেন, মণিকার পেটে ক্যানসার হয়েছিল। এমন ক্যানসার যা আধুনিক চিকিৎসায় সারানো সম্ভব নয়। এটা ডাহা মিথ্যা, কুরুচিকর মিথ্যা। (৭) সরকারের উচিত এইসব প্রতারকদের বিরুদ্ধে ৪২০ ধারায় মামলা করা। (৮) সরকারের উচিত সিস্টার নির্মলার বিরুদ্ধে ‘ড্রাগ অ্যান্ড ম্যাজিক রেমেডিস অ্যাক্ট’ অনুসারে মামলা করা। (৯) ভ্যাটিকান সিটি থেকে একজন প্রতিনিধি এসেছিলেন। তাঁকে এনেছিলেন কলকাতার এক বিখ্যাত পত্রিকার সাংবাদিক। উদ্দেশ্য ছিল মণিকা ক্যানসারে ভুগছিল—এটা আমাদের দিয়ে বলিয়ে নেওয়া।

সুপার ডাঃ মঞ্জুল মুর্শেদ আরও জানালেন, (ক) মিশনারিজ অফ চ্যারিটির তরফ থেকে সুপারকে অনুরোধ করা হয়েছিল, মণিকার চিকিৎসা সংক্রান্ত সমস্ত নথি যেন তাদের দিয়ে দেওয়া হয়। (খ) ডাঃ মুর্শেদ তা দেননি। কারণ ইতিপূর্বেই মিশনারিজরা নানাভাবে চাপ সৃষ্টি করছিল, যেন মণিকার রোগটাকে ক্যানসার বলে ডাক্তাররা মত প্রকাশ করেন। এরপর আসল নথি ওদের হাতে তুলে দিলে ভবিষ্যতে কেউ প্রমাণই করতে পারবে না—মণিকা আসলে কী রোগে ভুগছিলেন। তখন মিশনারিজদের মিথ্যে প্রচারটাই সত্যি হয়ে যাবে। (গ) সেই সময় স্বাস্থ্যমন্ত্রী ছিলেন পার্থ দে। মিশনারিজ অব চ্যারিটি তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী বিষয়টি ডাঃ মুর্শেদের কাছে বিস্তৃতভাবে জানতে চান। (ঘ) শ্রীদে’র কাছে সব নথি পাঠিয়ে দিই। সেইসঙ্গে জুড়ে দিয়েছিলাম মণিকার রোগ বিষয়ে বিশ্লেষণ ও আমার মন্তব্য। (ঙ) মিশনারিজ অফ চ্যারিটি রায়গঞ্জে একটি আলোচনা সভার আয়োজন করে। মণিকার যাঁরা চিকিৎসা করেছিলেন, তাঁদের আমন্ত্রণ জানায়। আলোচ্য বিষয় ছিল—গ্রামীণ স্বাস্থ্য, সঙ্গে মণিকার রোগ ও আরোগ্য’। অদ্ভুত বিষয়। উদ্দেশ্য পরিষ্কার। মণিকার রোগ ও আরোগ্য নিয়ে একটা বিভ্রান্তি তৈরি করা। ডাঃ রঞ্জন মুস্তাফি ও ডাঃ তরুণ বিশ্বাসকে ওই সেমিনারে যোগদানের অনুমতি দেয়নি। ডাঃ বিশ্বাসের কাছেই মণিকা প্রথমে গিয়েছিলেন। তিনিই ডাঃ মুস্তাফির কাছে কেসটা রেফার করেছিলেন। আমি নিজেও ওই আলোচনা সভায় যাইনি। (ছ) অতিরিক্ত জেলাশাসক গৌতম ঘোষের নির্দেশে মণিকার রোগমুক্তি নিয়ে তদন্ত করেছেন হরিরামপুরের যুগ্ম সমষ্টি উন্নয়ন আধিকারিক অরুণ সরকার। শুনেছি অরুণবাবুর কাছে মিশনারিজদের তরফ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে, আমরা মণিকার অরিজিনাল প্রেসক্রিপশন ও অন্যান্য নথি মণিকাকে ফেরত দিইনি। (ছ) মিশনারিজ অফ চ্যারিটি কোন ডকুমেন্টের ভিত্তিতে জানল যে মণিকার টিউমার ছিল ফুটবল সাইজের; টিউমারটা আসলে ক্যানসার? এইসব উলটোপালটা মিথ্যে কথা যারা বলে তারা তো অরিজিনাল ডকুমেন্ট পেলেই হাওয়া করে দেবে। হাওয়ায় আরও জোরালো গুজব ছুড়ে দেবে। (জ) ডকুমেন্ট দেখতে হলে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করুন। আমরা কোনও ডকুমেন্ট হাওয়া করে দিইনি। বরং রক্ষা করে চলেছি।

এবার গেলাম পতিরাম চার্চে। বালুরঘাট থেকে ফেরার পথে রাস্তার ডাইনে-বাঁয়ে দু’দিকেই মিশনারি অফ চ্যারিটির বিশাল সাম্রাজ্য। ডান দিকের চার্চে আমাদের গাড়ি ঢুকল। কিছু বালক ও কিশোর মাঠে খেলছিল। একজনই যুবক। জানলাম, ওই আদিবাসী যুবকটি এই চার্চের কেয়ারটেকার। ‘প্রেস’ স্টিকার মারা গাড়ি দেখে সতর্ক। নাম জানতে চাওয়ায় এড়িয়ে গেল। মণিকা বেসরার সঙ্গে দেখা করতে চাই—শুনে বলল, কে মণিকা বেসরা? ভাবটা এমন, যেন নামটা এই প্রথম শুনল।

মণিকার নাম শুনে ইতিমধ্যে ছোটদের খেলা গেছে থেমে। ওরাও শুনতে চাইছে কথা। মণিকা কে? তাও বোঝাতে হল। এও বললাম, মণিকার স্বামী সেলকুই জানিয়েছেন— মণিকা এখানে আছেন ৷

এত কিছু শোনার পরও যুবকটির মুখে একই কথা—না, মণিকা নামের কেউ তো এখানে থাকে না। থাকলে আমি তো জানতে পারতাম।

খেলা থামানো ছেলেদের মধ্যে একজন জানাল, মণিকা বেসরা এখানেই থাকে। এই হল মণিকার ছেলে।

একটি ছেলেকে দেখিয়ে দিল। মণিকার ছোট ছেলে। নাম—আনারস। আনারস জানাল, মা এই চার্চেরই রাস্তার ওপাশে থাকেন। যুবকটি যত ধামাচাপা দিতে চায়, ততই ধামা খুলে দেয় আনারস।

ওপারে গিয়েও একপ্রস্থ নাটক। সিস্টার ভ্রু কুঁচকে বললেন, মণিকা এখানে থাকে কে বলল? বললাম, সেলকুই বলল। সিস্টার জোরালভাবে জানিয়ে দিলেন মণিকা এখানে থাকেন না নাটকটা এখান থেকেই শুরু করেছিলাম। দশ-পনের মিনিটের নাটক। নাটক শেষে সিস্টার আমার একান্ত বন্ধু হয়ে গেলেন। ফুলের তোড়া নিলেন খুশি মনে। জানালেন, এত গোপনীয়তার কারণ প্রবীর ঘোষ ও যুক্তিবাদী সমিতি। আমাকে ফিসফিস করে জানালেন, মণিকা গেছেন গঙ্গারামপুরের ‘হোলিক্রস মিশন হসপিটাল’-এ। ওখানে একটা এক্সরে হবে ওর। এখনও মণিকা পুরোপুরি সুস্থ নন।

আমাদের তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে। পতিরামে ঘাঁটি গেড়ে অপেক্ষা করার মতো সময় নেই । গঙ্গারামপুরে পৌঁছবার আগে মণিকার গাড়ি যদি ওখান থেকে বেরিয়ে পড়ে? গাড়ির মডেল, রং, রেজিস্ট্রেশন নম্বর—অত্যন্ত গোপন খবরগুলো প্রায় কানে কানে বলে দিলেন সিস্টার।

ছুটলাম গঙ্গারামপুরের হোলিক্রস হসপিটালে। দেওয়াল ঘেরা বিশাল কম্পাউন্ড। গেটের বাইরেই দাঁড়িয়ে রয়েছে মণিকার গাড়ি। এখানেও একই সমস্যা। মণিকাকে নিয়ে মিথ্যের সাতকাহন। ডাক্তার, নার্স যাঁদেরই মণিকার কথা জিজ্ঞেস করি, তাঁরাই যেন আকাশ থেকে পড়েন । মণিকার নাম-ই শোনেননি। আমার হাতে ফুলের তোড়া। নন্দনের হাতে পুঁচকে ক্যামেরা। আমরা চক্কর কাটলাম অনেকক্ষণ। শেষ পর্যন্ত এই খোঁজটুকু পেলাম, ভি আই পি রোগী কোন কেবিনে থাকেন। ভি আই পি কেবিন থেকে একজন নার্সকে বের হতে দেখে তাঁর কাছে মণিকার খোঁজ করলাম। নার্সের মুখে একই ক্যাসেট বাজল, কে মণিকা? না, মণিকা তো এখানে আসেনি। এখানে ঢুকেছেন পারমিশান আছে? আপনারা এখান থেকে চলে যান।

নার্সকে দেখিয়ে আমাদের বাইরের দিকে হাঁটা শুরু হল। নার্স চোখের আড়াল হতেই আমরা দ্রুত পায়ে ভি আই পি কেবিনে হানা দিলাম। পর্দা সরাতেই মণিকা। আরোগ্য কামনা করে একটা ফুলের তোড়া এগিয়ে দিলাম। ফুলের তোড়া নিতেও মণিকা সাহস পেলেন না। তাঁর অনেক প্রশ্ন—কোথা থেকে আসছেন? এখানে আছি, কে খবর দিল? ফুলের তোড়া দেবার অনুমতি হোলিক্রসের সিস্টারের কাছ থেকে নিয়েছি কি না? আমি অসুস্থ, এ খবর কে দিল? আমার সঙ্গে দেখা করতে সিস্টার নির্মলার অনুমতি নিয়েছি কি না?

প্রশ্নের হার্ডল রেস একের পর এক অতিক্রম করার পর মণিকা ফুলের তোড়া নিলেন । ছবি তুলতে দিলেন।

এই মণিকা বছর দুয়েক আগের গরিব, অপুষ্টিতে শীর্ণ, শতছিন্ন পোশাকের মণিকা নন । পরনে দামি সিল্কের শাড়ি, শিল্কের ব্লাউজ, কাঁধে দামি চামড়ার ব্যাগ। মণিকা এখন আর আর খালি পায়ে কিলোমিটারের পর কিলোমিটার পথ হাঁটেন না। এখন তাঁর যাতায়াতের জন্য গাড়ি থাকে। মণিকা এখন খুব দামি মানুষ। মিশনারিজ অফ চ্যারিটির কৃপায় দামি মানুষ। অথবা এও হতে পারে—মণিকা-ই ‘মিশনারিজ অফ চ্যারিটি’কে খ্রিস্টজগতের কাছে দামি করে তোলার তুরুপের তাস।

২৫ অক্টোবর, শুক্রবার ২০০২। রাত ১০টা। ‘আকাশবার্তা’ চ্যানেল ‘খোঁজখবর’ অনুষ্ঠানে বে-আব্রু করা হল ভ্যাটিকানের বুজরুকি। অনুষ্ঠানটি আবারও দেখানো হল ২৬ অক্টোবর সকাল ৮-৫৫ মিনিটে, ২৭ অক্টোবর রাত ১০টায়, ২৮ অক্টোবর সকাল ৮-৫৫ মিনিটে। পরপর টানা চারদিন একই অনুষ্ঠান—খুবই ব্যতিক্রমী ব্যাপার। অবশ্য এর পরও অনেকবার অনুষ্ঠানটি দেখানো হয়েছে।

হ্যাঁ, একটা জরুরি খবর — ২০০২-এ ‘খোঁজ খবর’ ছাড়া পৃথিবীর আর কোনও চ্যানেল মণিকার ডাক্তারদের, সেলকুর ও মণিকার সাক্ষাৎকার দেখাতে সক্ষম হয়নি। এটা আমাদের গর্ব, খোঁজখবর ও যুক্তিবাদী সমিতির গর্ব।

অনেকেই মনে করতে পারেন—সব্বাই যখন ব্যর্থ, তখন কী করে সব কিছুরই ক্যাসেট বন্দি করতে পারলাম? কেন-ই বা সিস্টাররা সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলেন? উত্তর—কাজ উদ্ধার করেছি নতুন নতুন পরিস্থিতিতে নতুন নতুন দুষ্টুবুদ্ধি কাজে লাগিয়ে। এর চেয়ে বেশি—না, মুখ খুলছি না।

 

রোজনামচা দুইঃ একটি বছর পরে

২ অক্টোবর, বৃহস্পতিবার, ২০০৩। মাত্র দিন কয়েক আগে ভ্যাটিকান ঘোষণা করেছে ১৯ অক্টোবর ২০০৩ মাদার টেরিজাকে ‘রেসেড’ উপাধি দেওয়া হবে ‘বিয়েটিফিকেশন’ অনুষ্ঠানে। গত কয়েক দিন পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের নিউজ মিডিয়াগুলো থেকে ফোনে অভিনন্দন পেয়েছি। ১৯ অক্টোবর ‘সেন্টহুড’ দেবার পরিকল্পনা ভ্যাটিকান বাতিল করে ‘রেসেড’ দিচ্ছে—তাই অভিনন্দন। এইসব অভিনন্দন গ্রহণ করার পাশাপাশি নতুন করে সাক্ষাৎকার দিতে হয়েছে। আমেরিকান ব্রডকাসটিং কর্পোরেশন আগামী ১৯ অক্টোবরের ‘গুডমর্নিং আমেরিকা’ অনুষ্ঠানের জন্য দীর্ঘ সাক্ষাৎকার ক্যামেরা-বন্দি করেছে দিন চারেক আগে ।

কিন্তু আজ সকাল থেকে যেসব খবর পেয়েছি, তাতে মনে হয়েছে, সেন্ট প্রক্রিয়া বিরোধীদের বিভ্রান্ত করে ১৯ অক্টোবরই ‘সেন্ট’ দেওয়ার চক্রান্ত চলছে।

সকাল ছ’টা তিরিশ। ফোনের ও প্রান্তে সুবীর ভৌমিক। বিবিসি’র প্রতিনিধি। জানালেন, একটু আগে বিবিসি’র রোম প্রতিনিধি একটা বিস্ফোরক খবর দিয়েছেন। ভ্যাটিকানের অতিথি হিসেবে কয়েকজন বিশিষ্ট ভারতীয় আসবেন। অতিথিরা কে, কোথায় থাকবেন, তার একটা লিস্ট আজ প্রকাশ করা হয়েছে। তালিকায় দুটি আশ্চর্য নাম রয়েছে। একজন ডাঃ রঞ্জন মুস্তাফি। অন্যজন ডাঃ তরুণ বিশ্বাস। দু’জনই বালুরঘাট হাসপাতালের ডাক্তার। ডাক্তার বিশ্বাসের কাছেই মণিকা প্রথম যান। তিনি-ই মণিকাকে ডাক্তার মুস্তাফির কাছে রেফার করেন। দুই ডাক্তার-ই ইতিমধ্যে জানিয়েছেন—মণিকা চিকিৎসাতেই ভালো হয়েছে। কোনও অলৌকিক ক্ষমতায় নয়। এরপরও তাঁদের কেন অতিথি হিসেবে রোমে নিয়ে যাচ্ছে ভ্যাটিকান? তবে কি ডাক্তার দুজন ডিগবাজি খাবেন? শেষ মুহূর্তে এমন অকাট্য প্রমাণ পেয়ে যাওয়ায় উৎসবের রং-ই যাবে পাল্টে। বিয়েটিফিকেশনের উৎসব হঠাৎ করে পাল্টে যাবে সেন্টহুডের উৎসবে। রোমে ডাক্তারদের নামের তালিকা বিশেষ অতিথি হিসেবে প্রকাশিত হওয়াটা এমন সংকেত-ই বহন করে।

সুবীর ভৌমিক বললেন, এত লড়লেন, কিন্তু শেষ হাসিটা কি পোপ-ই হাসবেন? ব্যাপারটা ভালো করে দেখুন। ডাক্তার দু’জনের যাওয়াটা আটকাবার চেষ্টা করুন।

এক ধর্মগুরু তাঁর শিষ্যাকে ‘রেসেড’ করলেন কি ‘সেন্ট’, তাতে আমাদের যুক্তিবাদীদের কিছুই এসে যায় না। কিন্তু লাগাতার প্রচারে আমরা অবশ্যই একটা বিশ্বজনমত গড়ে তুলতে পেরেছি, এই ধরনের মিথ্যের আশ্রয় নিয়ে একজনকে সেন্ট বানাবার প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে।

সকাল সাতটা কুড়ি। আমেরিকান ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন থেকে ফোন করলেন। সুবীর ভৌমিকের কথাই যেন শোনালেন। ফোন করার উদ্দেশ্যটাও একই। সকাল সাতটা পঁয়তিরিশ। ‘অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস’ থেকে ফোন। বক্তব্য ও উদ্দেশ্য একই। সকাল সাতটা পঁয়তাল্লিশ। ফোনে ইন্দো-এশিয়ান নিউস সার্ভিস-এর করোপডেনন্ট কৃত্তিবাস মুখার্জি। একই বক্তব্য। একই প্রত্যাশা।

সকাল আটটা দশ। ফোনে ধরলাম পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ্যমন্ত্রী শ্রীসূর্যকান্ত মিশ্রকে। চুম্বকে বললাম, মাদার টেরিজা-সেন্টহুড-মণিকা-ডাঃ মুস্তাফি-ডাঃ বিশ্বাস-ডাঃ মুর্শেদ সেলকু-নাকোড় গ্রামের মানুষদের কথা। জানালাম, একটু আগেই ফোন পেয়েছি বিবিসি, আমেরিকান ব্রডকাসটিং কর্পোরেশন ও কয়েকটা নিউজ এজেন্সি থেকে। তাঁরা খবর দিলেন—ডাঃ বিশ্বাস ও ডাঃ মুস্তাফির নামে রোমে থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। এই লিস্ট প্রকাশ করেছেন সিস্টার নির্মলা। দুই ডাক্তারের থাকার ব্যবস্থা মিশনারিজ অফ চ্যারিটি করায় মনে হচ্ছে ডাক্তার দু’জন রোমে যাচ্ছেন। ওঁরা রোমে গেলে নিশ্চিন্তে ধরে নেওয়া যায় যে, ওঁরা ডিগবাজি খাবেন।

জানতে চাইলাম, ডাক্তার দু’জন কি রোমে যাওয়ার অনুমতি নিয়েছেন আপনার কাছে? আমার মনে হয়, ওঁরা সরাসরি রোম যাওয়ার অনুমতি চাননি। কারণ, ১৯ অক্টোবরের কাছাকাছি একটা দিনে ওঁরা রোমে যাচ্ছেন, এটার প্রচার ভ্যাটিকান ও মিশনারিজ অফ চ্যারিটি (এম. ও. সি) নিশ্চয় চাইবে না। গোটা ব্যাপারটা যথাসম্ভব গোপনীয়তার সঙ্গেই সারবে। সুতরাং ডাক্তার দু- জন বিদেশের অন্য কোনও শহরে যাবার অনুমতি চেয়েছেন, এমনটা ঘটা সম্ভব।

আপনার অনুমতি না নিয়েও পোপের বিশাল ক্ষমতার উপর আস্থা রেখে বিদেশে যেতেই পারেন। ভাবতেই পারেন, পশ্চিমী দুনিয়া শেষ পর্যন্ত বিষয়টা ম্যানেজ করে দেবে। আমরা চাই, এবিষয়ে আপনার কিন ইমেজের মর্যাদা রেখে আপনি বিষয়টি দেখবেন। আপনার অনুমতি ছাড়া বিদেশে গেলে আইনমাফিক ব্যবস্থা নেবেন। রোমে গিয়ে ডাক্তাররা যদি ঘোষণা রাখেন যে মণিকার রোগ সেরেছে মাদারের মিরাকেলে, তাহলে ওঁদের বিরুদ্ধে ‘ড্রাগস অ্যান্ড ম্যাজিক রেমিডিস (অবজেকশনেবল অ্যাডভারটাইজমেন্ট) অ্যাক্ট ১৯৫৪’ অনুসারে আপনি যাতে ব্যবস্থা নেন, তার আনুষ্ঠানিক অনুরোধ রাখব আপনার কাছে। যে ডাক্তার অলৌকিক উপায়ে রোগ মুক্তির পক্ষে প্রচার রাখেন, সেই ডাক্তারের চিকিৎসা করার নৈতিক অধিকার থাকতে পারে না। ডাক্তারের রেজিস্ট্রেশন বাতিল করা উচিত বলে আমরা মনে করি।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী শ্রী সূর্যকান্ত মিশ্র অত্যন্ত মনোযোগের সঙ্গে গোটা বিষয়টি শুনলেন। জানালেন, এখন পুজোর ছুটি চলছে। সাত তারিখ রাইটার্স খুলবে। সেদিন একবার আমাকে রাইটার্সে ফোন করুন। দুই ডাক্তার বিদেশ যাওয়ার অনুমতি চেয়েছেন কি না, সেক্রেটারির কাছ থেকে জেনে আপনাকে জানিয়ে দেব। বিনা অনুমতিতে গেলে, বিভাগীয় শাস্তি ওঁদের নিশ্চয়ই পেতে হবে।

পশ্চিমবঙ্গের অ্যাডভোকেট জেনারেল শ্রীবলাই রায়। তিনি আরও একটি নতুন তথ্য জানিয়েছেন। লকেট, মাদুলি, তাবিজ, কবচ দিয়ে অসুখ সারাবার দাবি কেউ কেউ করে। এইসব লকেট বা কবচের অসুখ সারানোর যে ক্ষমতা আছে সেটা ড্রাগ কন্ট্রোল ডিপার্টমেন্টের সামনে প্রমাণ করে ড্রাগ লাইসেন্স নিতে হয়। ড্রাগ লাইসেন্স না নিয়ে লকেট, কবচ এইসব পরে রোগ সেরেছে প্রচার করলে লোকে এইসব কিনবে। এমন মিরাকেল লকেট, কবচ বিক্রি বে-আইনি। এদের বিরুদ্ধে একটা আইন আছে ‘ড্রাগস অ্যাণ্ড কসমেটিকস অ্যাক্ট’। এই আইন ভাঙলে পাঁচ বছর পর্যন্ত জেলের বিধান রয়েছে।

দুপুর দেড়টা নাগাদ নিউদিল্লি থেকে ফোন করলেন চন্দন নন্দী। ইংরেজি দৈনিক পত্রিকা ‘হিন্দুস্থান টাইমস’-এর সাংবাদিক। জানালেন, যেসব ভি আই পি ভারতীয় ১৯ অক্টোবরের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ভ্যাটিকানে আসছেন, তাঁদের থাকার ব্যবস্থার তালিকা আজ প্রকাশ করা হয়েছে। তালিকায় ডাঃ রঞ্জন মুস্তাফি ও ডাঃ তরুণ বিশ্বাসের নাম আছে। আপনারা এ বিষয়ে কিছু করছেন?

বললাম, খবরটা সাত সকালেই পেয়েছি। কথা বলেছি স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সঙ্গে। মন্ত্রীর সঙ্গে কথোপকথন ও অ্যাডভোকেট জেনারেলের মতামত জানালাম ।

বিবিসি, আমেরিকান ব্রডকাসটিং কর্পোরেশন ও হিন্দুস্থান টাইমস প্রতিনিধিদের প্রত্যেকেই একটি বিষয়ে সমমত। ১৯ অক্টোবর ‘বিয়েটিফিকেশন’-এর দিনটি ‘সেন্টহুড’ উৎসবের দিন হয়ে উঠতে পারে।

৩ অক্টোবর, শুক্রবার, ২০০৩। ‘দ্য হিন্দুস্থান টাইমস’-এ খবরটা প্রকাশিত হল। গতকাল আমার সঙ্গে চন্দন নন্দীর কথোপকথন গুরুত্বের সঙ্গেই প্রকাশিত হল।

এদিনের “হিন্দুস্থান টাইমস’-এর ওয়েবসাইটেও খবরটা এল।

Row over Mother’s sainthood continues [ 03/10/2003] Hindustan Times.com

30, for ovarian tumour and tubercular meningitis. She received nine months of anti-tubercular treatment under them. After being discharged from the Balurghat hospital. Besra’s treatment at the North Bengal Medical College and Hospital was successful with a last ultra-sound investigation showing that her tumour had disappeared.

According to the Vatican’s “proof”, on October 5, 1998 Besra prayed to Mother Teresa at MoC, Kolkata. Her pain vanished the same night.

(‘হিন্দুস্থান টাইমস’-এর ওয়েবসাইট)

দপ্তরের এক সচিবের বিনা অনুমতিতে বিদেশ ভ্রমণ।

শুনলাম, ডাক্তার রঞ্জন মুস্তাফি একথাও বলেছেন, তাঁর পাসপোর্ট-ই নেই। অতএব বিদেশ যাবেন কী করে?

আমার অভিজ্ঞতা বলে, এক বা দু-দিনে পাসপোর্ট বের করা সম্ভব। খুব সম্ভব। আমাদের সমিতির এক সদস্যের খুব তাড়াতাড়ি পাসপোর্ট বের করা জরুরি ছিল। ২৪ ঘন্টায় বেরিয়ে ছিল। আর এখানে তো ভ্যাটিকান খুঁটি। বিশাল ব্যাপার।

ডাঃ রঞ্জন মুস্তাফিকে ফোনে ধরলাম। জানতে চাইলাম ঘটনাটা। ডাঃ মুস্তাফি জানালেন, রোমে যাওয়ার কোনও আমন্ত্রণ-ই পাননি। নিজের পাসপোর্ট নেই। গোটা ঘটনাই ভিত্তিহীন। সঙ্গে এও জানালেন, গতকাল ও আজ ইনটেলিজেন্স ব্রাঞ্চ না স্পেশাল ব্রাঞ্চ থেকে কয়েকজন এসেছিলেন। অনেকক্ষণ ধরে জেরা করেছেন। তাঁরা জানতে চাইছিলেন, রোমে কবে যাচ্ছি। যাওয়ার ডিপার্টমেন্টাল অনুমতি আছে কি না? ভ্যাটিকান কেন দুই ডাক্তারের নামে অ্যাকমডেশন অ্যালট করেছে? ইত্যাদি হাজারো প্রশ্ন। সঙ্গে প্রচ্ছন্ন হুমকি, স্বাস্থ্য দপ্তরের অনুমতি ছাড়া যেন বিদেশে পাড়ি না দিই। মিশনারিজ অফ চ্যারিটির হয়ে যেন ডিগবাজি না খাই—ইত্যাদি।

ডাঃ মুস্তাফি শেষ কথা জানালেন, আগামী ১৯ অক্টোবর পর্যন্ত বালুরঘাটের বাইরে পা রাখবেন না, ঠিক করেছেন।

ডাঃ মুস্তাফিকে এক বছর আগের বক্তব্যে অটল থাকায় অভিনন্দন জানালাম।

৫ অক্টোবর, রবিবার, ২০০৩। আজ দুর্গাপুজোর দশমী। ‘চ্যানেল ভিশন’-এর লাইভ টক শো ‘ভিশন টাইম’ জনপ্রিয় অনুষ্ঠান। রাত ৯টা ১৫ থেকে ১০টা পর্যন্ত। ফোনে প্রশ্ন করা যায় । এই অনুষ্ঠানে আমি আজ অতিথি বা আলোচক। সঞ্চালক— সাংবাদিক কুনাল ঘোষ ।

কুণাল আমার সঙ্গে দর্শকদের পরিচয় করিয়ে দিলেন। শ্রোতা-দর্শকদের তারপরই খবরটা দিলেন, আগামী ১৯ অক্টোবর মাদারকে ‘সেন্ট’ বানাবার ভ্যাটিকানি চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। সেদিন মাদারকে সেন্টহুডের পরিবর্তে ‘রেসেড’ দেওয়া হবে।

টি ভি ক্যামেরার সামনে কুণাল আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন, এই যে মাদারকে সেন্টহুড দেওয়াটা আটকে দিলেন, আপনার কেমন লাগছে ?

উত্তরে যা বলেছিলাম, তাকে ছোট্ট করে বললে ব্যাপারটা এমন দাঁড়াতে পারে— (১) ১৯ অক্টোবর সেন্টহুড দেওয়া বন্ধ করে দিতে পেরেছি। এখনই দৃঢ়তার সঙ্গে এমনটা বলতে পারলে ভালো হত। কিন্তু বলতে পারছি না। (২) এখনও পর্যন্ত সংগ্রহ করা তথ্যের ভিত্তিতে বলতে পারি, ভ্যাটিকান বিষয়টিকে যেভাবে একটা ভয়ংকর ‘মস্তিষ্ক যুদ্ধ’ হিসেবে নিয়েছে, তাতে ছলে- বলে-কৌশলে আবার যুদ্ধ জেতার চেষ্টা করবেই। (৩) গত এক বছরে ভ্যাটিকান অনেক খেলা খেলেছে। প্রথমে বলেছে ২০০৩-এ মাদার টেরিজাকে ‘সেন্ট’ দেওয়া হবে। ২০০৩-এ জানলাম মিডিয়ার চাপের কাছে পিছু হটেছে। সেন্ডহুডের বদলে রেসেড দেওয়া হবে। তিন দিন আগে জানলাম মণিকার দুই চিকিৎসককে রোমে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বিশেষ অতিথি করে। অনেক বিশ্বখ্যাত নিউজ মিডিয়ার স্পষ্ট ধারণা, ১৯ অক্টোবর শেষ মুহূর্তে মাদারকে ‘সেন্ট’ উপাধি দিয়ে বাজিমাত করার ছক নিয়েই ডাক্তার দু’জনকে শেষ মুহূর্তে রোমে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার একটা পরিকল্পনা ছিল। পরিকল্পনাটা ভেস্তে গেছে। শেষ পর্যন্ত বালুরঘাটের ডাক্তাররা রোমে যাচ্ছেন না। (৪) এর পরও আবার কবে নতুন কোনও রোগী ও মাদারের মিরাকেলের পক্ষে সার্টিফাই করার মতো ডাক্তারকে রোমে উড়িয়ে নিয়ে যাবার চেষ্টা করতেই পারে ভ্যাটিকান।

‘ভিশন টাইম’-এ একথাও বলেছি, পৃথিবী সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে এই সত্যটা ভ্যাটিকান মানল মাত্র বছর কয়েক আগে।

আধুনিক বিজ্ঞান বুঝে গেছে ‘অলৌকিক’ বলে কোনও কিছুর অস্তিত্ব বাস্তবে সম্ভব নয় ভ্যাটিকান বোঝেনি। এ বিষয়ে তাদের অবস্থান তৃতীয় বিশ্বের কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষগুলোর সঙ্গে একই পংক্তিতে। এই মধ্যযুগীয় কুসংস্কার ছেড়ে বেরিয়ে আসতে ভ্যাটিকানের আর কত বছর লাগবে কে জানে ?

তবে পোপের দিকে পশ্চিমি খ্রিস্টান সমাজের আঙুল তোলার কাউন্টডাউন শুরু হয়ে গেছে। তারই স্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে পশ্চিমি নিউজ মিডিয়াগুলোর কর্মধারায়।

পশ্চিমী মিডিয়াগুলো ‘ক্যানান ল’ ও পোপের মিথ্যাচারিতার

বিরুদ্ধে আমাদের লড়াইকে যে লাগাতারভাবে

তুলে ধরেছে, তাতে বুঝতে অসুবিধে হয়

না, ওরাও চায় খ্রিস্টধর্মের নামে

এই মিথ্যাচারিতা বন্ধ হোক।

নিউজ মিডিয়াগুলোর লাগাতার প্রচারের প্রভাব পশ্চিমি খ্রিস্টান জগতে পড়তে বাধ্য। পশ্চিমি খ্রিস্টান জগতের জাত্যভিমান পোপের দিকেই আঙুল তুলবে। পোপের মৃত্যুর পর তাঁর অন্যায়ের বিরুদ্ধে মুখ খুলবেন অনেক আর্চবিশপ-ই, আমার সাংবাদিক বন্ধুদের কাছ থেকে এ খবরও পেয়েছি। ইতিমধ্যেই পোপের মিথ্যাচারিতার বিরুদ্ধে, বোকা-বোকা ক্যানান ল’র বিরুদ্ধে এবং যুক্তিবাদী সমিতির পক্ষে তাঁদের অনেকেই মুখ খুলতে শুরু করেছেন।

তৃতীয় সহস্রাব্দে পশ্চিমি জগতে ধর্মীয় দীক্ষাগুরু হিসেবে পোপের অস্তিত্ব রক্ষা করা অসম্ভব। খ্রিস্টান ব্রাদারহুডের লক্ষ্য পূরণের জন্যে হলেও অসম্ভব। উপাসনা ধর্মকে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সংস্কার না করলে তা এগিয়ে থাকা চেতনার মানুষরা বর্জন করবেই। তাই তো পশ্চিমি জগতে ঈশ্বর বিশ্বাসীর তুলনায় নিরীশ্বরবাদীরা সংখ্যাগুরু।

৬ অক্টোবর, সোমবার, ২০০৩। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত অনেকগুলো রাষ্ট্রীয় ও বিদেশি মিডিয়াকে সাক্ষাৎকার দিয়েছি। কিছুটা একই কথা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বলা।

নতুন একটা ঘটনা ঘটল। ফ্রান্সের নামী পত্রিকা ‘ল্য মড্’ (Le Monde)-এর দক্ষিণ এশিয়ার করেস্পন্ডেন্ট ফ্রাঁসোয়া শিপো (Francoise Chipaux) এলেন সাক্ষাৎকার নিতে। ফ্রাঁসোয়া উত্তর পঞ্চাশের মহিলা। সভ্রান্ত চেহারা। মনে হল অহংবোধ একটু বেশিই।

কথা এগোচ্ছিল। সঙ্গে সঙ্গে কিছু কিছু বিষয় পরিষ্কার হচ্ছিল। ফ্রাঁসোয়া দৃঢ় প্রত্যয়ী- বালুরঘাটের দুই ডাক্তার রোম যাচ্ছেন-ই। ওদের যাওয়া ঠেকাতে পারব না। যদি শেষ পর্যন্ত অসম্ভব সম্ভবও করতে পারি, তবুও আগামি ১৯ অক্টোবর মাদারকে সেন্টহুড দেওয়া হবেই। কলকাতারই এক বিখ্যাত ডাক্তার রোমে হাজির থাকবেন। তিনিই দেবেন মাদারের আরও এক অলৌকিক ঘটনার প্রমাণ ।

ফ্রাঁসোয়ার ইগোই শেষ পর্যন্ত আমাকে জানিয়ে দিল ডাক্তারের নাম। ডাঃ সুনীল ঠাকুর। ভারতের নামী অস্থি বিশেষজ্ঞ কলকাতার প্রাক্তন শেরিফ।

ডাঃ সুনীল ঠাকুরকে মোবাইলে পেলাম। শেষ পর্যন্ত শোনালেন, মিশনারিজ অফ চ্যারিটির কলকাতার এক সিস্টারের মাদারের মিরাকেলে ভালো হয়ে ওঠার গল্প। সিস্টারের কলার বোনে একটা প্রবলেম ছিল। ডাঃ ঠাকুর রোগিণীকে দেখেছিলেন। জানিয়ে ছিলেন অপারেশন করা ছাড়া গতি নেই। মাদার টেরিজা তখন বেঁচে। তিনি কাঁধে হাত বুলিয়ে দিয়েছিলেন। অবাক কাণ্ড ! মাসখানেকের মধ্যে রোগিণী একদম সুস্থ। এই ঘটনাকে মিরাকেল ছাড়া আর কী বলব?

ল্য মন্ত্ পত্রিকার ফ্রাঁসোয়া শিপো’র কথায় এলাম। উনি প্রথমে প্রসঙ্গ এড়াবার চেষ্টা করলেন। শেষে স্বীকার করলেন ফ্রাঁসোয়া এসেছিলেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আজই।

ফ্রাঁসোয়ার কাছেই শুনলাম, আপনি রোমে যাচ্ছেন। ১৯শে অক্টোবরের উৎসবে হাজির থাকবেন। আপনাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে মিশনারিজ অফ চ্যারিটি।

আমার এসব কথা শুনে ডাঃ ঠাকুর কিছুটা গুটিয়ে গেলেন বলে মনে হলো। বললেন, হ্যাঁ যাব তো ভাবছি। আসলে মিশনারিজ অফ চ্যারিটি আমন্ত্রণ করেছে। মাদারও আমাকে খুব ভালোবাসতেন। জানো তো মাদারকে নিয়ে আমি বই লিখেছি। ওই বইতে সিস্টারের ওই কলার বোন ঠিক হয়ে যাওয়ার কথাও লেখা আছে।

বললাম, বইটা তো পড়িনি। এখন শুনলাম মাদার হাত বুলিয়ে একজনের কাঁধের হাড়ের অসুখ সারিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু মাদারকে সেন্ট বানাতে এই ঘটনাটা কোনও কাজেই লাগবে না। মাদারের মৃত্যুর পর তাঁর আত্মা অলৌকিক উপায়ে কাউকে সুস্থ করছেন, এমন প্রমাণ চাই ।

আপনি নামী ডাক্তার। আপনার তো জানা, এমন অনেক অসুখ আছে যা আমাদের শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতার জন্য নিজে থেকেই সেরে যায়। মানসিক কারণে অনেক শারীরিক অসুখ হয়। আবার এসব মানসিক কারণে সেরেও যায়। কিন্তু ক্যানসার বা টিউমার মাদারের লকেটে ছুইয়ে রাতারাতি সেরে গেছে, এমন গুল-গপ্পো কে বিশ্বাস করবে বলুন? কোনও এক ডাক্তার ভট্টাচার্য নাকি জানিয়েছেন, মণিকা ক্যানসারের রোগী ছিলেন। মাদারের লকেটের কল্যাণে রাতারাতি মণিকা ভালো হয়ে গেছেন। কে এই ডাক্তার ভট্টাচার্য? মিশনারিজ অফ চ্যারিটিই মণিকার চিকিৎসক হিসেবে হাজির করেছিল ডাক্তার ভট্টাচার্যের নাম। কিন্তু এখন মিডিয়ার সামনে ডাঃ ভট্টাচার্যকে হাজির করছে না। জানি না, সত্যিই ডাঃ আর. এন. ভট্টাচার্য নামে কেউ আছেন কিনা? নাকি, জেরার মুখে প্রতারণা ধরা পড়ে যাওয়ার প্রবল সম্ভাবনা থাকায় ডাঃ ভট্টাচার্যকে লুকিয়ে ফেলা হয়েছে? মণিকা ক্যানসার রোগী ছিলেন বলে যে নথির কথা ভ্যাটিকান প্রথম দিকে বলে আসছিল সে নথি পাল্টে এখন টিউমার রোগী বানান হয়ে থাকলে একটুও অবাক হব না ।

শেষে একটু অনুরোধ রাখলাম, মিশনারিজদের ফাঁদে পড়ে রোমে পা বাড়াতে যাবেন না। ওদের মিথ্যের সঙ্গে নিজেকে জড়াতে যাবেন না।

না। ডাঃ সুনীল ঠাকুর শেষ পর্যন্ত ওদের মিথ্যের সঙ্গে নিজেকে জড়াননি। রোমে যাননি । ফ্রাঁসোয়া-র প্রত্যয়ের আগুনে জল ঢেলে দিয়েছেন। ডাঃ ঠাকুরের এই সহযোগিতা আমাদের লড়াইয়ের পাথেয়। তাঁকে আমাদের অভিনন্দন।

৭ অক্টোবর, মঙ্গলবার, ২০০৩। ভোর ৪টে ৩০ মিনিট। দেবীনিবাসের ফ্ল্যাট থেকে আমাকে তুললেন সঞ্জীব শ্রীবাস্তব ও রবি লেখি। সঞ্জীব বিবিসি নিউজ-এর ইন্ডিয়া করেসপন্ডেন্ট। লেখি ফোটোগ্রাফার।

বিবিসি নিউজ টিমের সঙ্গে আমি ওদের গাইড। লক্ষ্য বালুরঘাট ও নাকোড় গ্রাম।

দুপুর ১টা নাগাদ পৌঁছলাম গাজোল-এ। গাড়ি থামল। যুক্তিবাদী সমিতির পথসভা হচ্ছে। গাজোল শাখা ও মশালদিঘি শাখার প্রচুর সদস্য হাজির। তাদের হাতে হাতে পোস্টার। মাদারের নামে বুজরুকি বন্ধ করার আহ্বান জানিয়ে মূলত পোস্টার। পথসভায় প্রচুর মানুষের ভিড়। এখানে আমরা মিনিট কুড়ির জন্য দাঁড়ালাম। তারই মধ্যে সুবোধ সূত্রধরের একটা সাক্ষাৎকার ক্যামেরা- বন্দি করলেন রবি লেখি।

আবার দৌড়। দৌড় থামল বালুরঘাট জেলা হাসপাতালে। তখন বেলা ৩টে। ডাঃ রঞ্জন মুস্তাফি রোগিণী দেখছিলেন। ভালো ভিড়। চেম্বারের দেয়াল ঢেকে গেছে ‘অবতার’ ও ঠাকুরের নানা ছবিতে।

ডাঃ মুস্তাফি বিবিসি নিউজকে সাক্ষাৎকার দিলেন। এক বছর আগে আমাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারেরই পুনরাবৃত্তি। ভ্যাটিকান ও মিশনারিজ অফ চ্যারিটির মিথ্যাচারিতার বিরুদ্ধে সেই চ্যালেঞ্জ ঠোকা তীক্ষ্ণ কথা।

সাক্ষাৎকার শেষে ডাঃ মুস্তাফি আমাকে আন্তরিকতার সঙ্গে জড়িয়ে ধরলেন। জানালেন, ৩ অক্টোবর হিন্দুস্থান টাইমস-এ ওঁর রোম যাওয়া নিয়ে যে খবর বেরিয়েছে, তা ভুল। আজ পর্যন্ত রোমে যাওয়ার জন্য কোনও আমন্ত্রণ পাননি। পাসপোর্ট নেই। কেন বালুরঘাটের দুই ডাক্তারের নাম অতিথি হিসেবে মিশনারিজরা প্রকাশ করলেন, বুঝতে পারছি না। তার ওপর যেদিন হিন্দুস্থান টাইমস-এ খবরটা বের হল, সেদিন থেকে গোয়েন্দারা এসে জেরা করতে লাগল। যাচ্ছি না, তবু না যাওয়ার জন্য অদ্ভুত চাপ সৃষ্টি।

অদ্ভুত দিয়ে যে ঘটনার শুরু, তার বিস্তৃতিতে আরও অনেক অদ্ভুত ঘটনা ঘটবে—এটাই স্বাভাবিক।

৮ অক্টোবর, বুধবার, ২০০৩। কাল রাত ভোর বৃষ্টি হয়েছে। আজও বৃষ্টি চলছেই। কাল ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ সব-ই বিস্কুট চিবিয়ে সারতে হয়েছে। রাতে মালদার ‘কলিঙ্গ’ হোটেলে উঠেছি। স্নান করে, ডিনার সেরে রিসেপশনে ভোর পাঁচটায় ডেকে দিতে বলে টিভিতে খবর দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়েছি।

আজ রিসেপশনের ফোন বাজার আগেই ঘুম ভেঙেছে। সাড়ে পাঁচটায় আমরা বেরিয়ে পড়লাম। গাজোলে সুবোধ অপেক্ষা করছিলেন। ওঁকে তুলে বৃষ্টি পিছল পথে দানগ্রাম। নাকোড়ের রাস্তায় ঢুকতেই এক বছর আগের পথের সঙ্গে আজকের পথের পার্থক্য চোখে পড়ল। পথ আর কাঁচা নেই। দু’কিলোমিটার পথ-ই ইট পেতে তৈরি হয়েছে।

মণিকার স্বামী সেলকুর সাক্ষাৎকার নেওয়া হল। এক বছর আগের সাক্ষাৎকারের উল্টো কথা বাজিয়ে গেলেন সেলকু। এবারের কথাগুলো এরকম—(১) মণিকার টিউমার দেখে মনে হত ন’মাসের পোয়াতি। (২) ডাক্তাররা বলে দিয়েছিলেন, এ অসুখ সারবে না। মণিকা মরবে। (৩) ১৯৯৮-এ রাতারাতি মণিকার টিউমার ভ্যানিস হয়ে যায়। (৪) কেউ অর্থ সাহায্য দিলে সেলকু নিতে রাজি। এক বছর আগে সেলকুকে জমি ছাড়াতে টাকা সাহায্য করতে চেয়েছিলাম। তিনি জানিয়েছিলেন, সিস্টার নির্মলার অনুমতি ছাড়া কোনও অর্থ সাহায্য নেওয়ার উপায় নেই তাঁর। (৫) অনেকটা জমি নিয়ে যে বড় একতলা বাড়িতে মণিকা-সেলকু পরিবার থাকেন, তাতে বিভিন্ন ভাইদেরও ভাগ আছে। গত বছর সেলকু কিন্তু বলেছিলেন, বাড়িটা তাঁর।

বুঝলাম, এক বছরে সেলকুকে ভালোই শিখিয়ে পড়িয়ে নেওয়া হয়েছে।

১২ অক্টোবর, রবিবার, ২০০৩। জার্মান ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন থেকে মাদার টেরিজার সেন্টহুড দেওয়া নিয়ে আমার বক্তব্য রেকর্ড করে নিয়ে গেলেন। বক্তব্য না বলে সাক্ষাৎকার বললে ঠিক বলা হয়। প্রচার করা হবে ১৯ অক্টোবর।

১৫ অক্টোবর, বুধবার, ২০০৩। বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ সংবাদ সরবরাহকারী সংস্থা এ এফ পি বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও নিউজ মিডিয়াকে খবর পাঠাল, “ভারতের যুক্তিবাদী দল মাদার টেরিজার অলৌকিক ক্ষমতার প্রতিবাদ করেছে।” বড় খবর। ভিতরে আছে— মাদারের নামে মিথ্যাচারিতা করার বিরুদ্ধে আমরা যে বিক্ষোভ সমাবেশ করতে চলেছি, সে খবর।

খবরে আরও বলা হয়েছে, বুধবার সাইন্স অ্যান্ড র‍্যাশানালিস্টস অ্যাসোসিয়েশান অফ ইন্ডিয়ার সাধারণ সম্পাদক প্রবীর ঘোষ জানান, “আমরা মিশনারিজ অফ চ্যারিটির সুপিরিয়র জেনারেল সিস্টার নির্মলা যোশীকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছি, তিনি প্রমাণ করুন মণিকা বেসরা সুস্থ হয়েছে ওষুধে নয়, মাদারের আশীর্বাদে। তিনি এখন পর্যন্ত এই চ্যালেঞ্জ-এ সাড়া দেননি।”

“আগামী শুক্রবার আমরা বিক্ষোভ প্রদর্শনের পরিকল্পনা নিয়েছি, মিথ্যে প্রমাণ হাজির করে মাদারকে সেন্টহুড দেওয়ার বিরুদ্ধে।” তিনি (প্রবীর ঘোষ) বলেছেন।

“আমি মিশনারিজ অফ চ্যারিটির বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করতে চলেছি খ্রিস্টান সমাজকে প্রতারিত করার জন্য।” তিনি বলেছেন

ঘোষ বলেছেন, বেসরা পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাঞ্চলের দু’টি সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করিয়েছেন।

“তিনি (মণিকা) দীর্ঘ চিকিৎসার ফলেই সুস্থ হয়েছেন।” ঘোষ বলেছেন।

“মাদার টেরিজাকে গরিবের প্রতি তাঁর কাজের নিরিখেই সেন্টহুড দেওয়া যেত। এর জন্য মিথ্যে প্রচারের কোনও প্রয়োজন ছিল না।” তিনি বলেছেন—

মিশনারিজ অফ চ্যারিটির কলকাতার কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সিস্টার যুক্তিবাদীদের এই দাবিগুলো শুনে উদাসীনতার সঙ্গে কাঁধ ঝাঁকিয়েছেন। বলেছেন, “আমাদের সম্বন্ধে আনা অভিযোগ ও প্রতিবাদ প্রদর্শনের বিরুদ্ধে, আমাদের কিছু বলার নেই । ”

“ঘোষ জানিয়েছেন, তাঁর সংগঠন ১৯৮৫-তে প্রতিষ্ঠিত। বিজ্ঞানসম্মত ও যুক্তিবাদী চিন্তার পক্ষে ভারতে প্রচার অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে।”

“আমরা অতীতে ৭০০ হিন্দু তথাকথিত অলৌকিক ক্ষমতাধরদের ভাণ্ডাফোড় করেছি……….. তিনি বলেছেন।

১৬ অক্টোবর, বৃহস্পতিবার, ২০০৩। যুক্তিবাদী সমিতির কলকাতা অফিসে (৩৩ এ, ক্রীক রো, কলকাতা-৭০০ ০১৪) যুদ্ধকালীন তৎপরতা। আগামী কাল মধ্য কলকাতার বেলেঘাটা জোড়া মন্দিরের সামনে প্রতিবাদী পথসভা। বিকেল ৪টেতে শুরু হবে। পথসভা আয়োজনের দায়িত্ব পূর্ব কলকাতা শাখার উপর। বর্ণময় শ’খানেক পোস্টার তৈরির দায়িত্ব পূর্ব কলকাতা ও উত্তর কলকাতা শাখার ওপর। পোস্টারে কী লেখা হবে, কী আঁকা হবে, কী প্রচারপত্র ছাড়া হবে, কে কী দায়িত্ব পালন করবে—এসব নিয়েই কেটে গেল দিনটা ।

রাত ন’টায় ‘অস্ট্রেলিয়া ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন’ অস্ট্রেলিয়ার সিডনি থেকে ফোনে ধরলেন আমাকে। ফোনেই একটা ইন্টারভিউ নেবেন। ঠিক রাত দশটায় ফোন করবেন।

প্রশ্নোত্তরে সাক্ষাৎকার ভালোই উতরোল বলে মনে হল। জানালেন ১৯ অক্টোবর প্রচার করবেন। সেদিনের ওয়েবসাইটেও পাওয়া যাবে।

১৭ অক্টোবর, শুক্রবার, ২০০৩। আজ ইংরেজি দৈনিক ‘দ্য এশিয়ান এজ’ এর প্রথম পৃষ্ঠায় একটা খবর প্রকাশিত হয়েছে— Rationalist forum on protest path’।

সকাল ৯টা। আমি, সুমিত্রা ও অরিন্দম হাজির হলাম দিলীপ গুপ্তের সল্টলেকের বাড়িতে। দিলীপ গুপ্ত গণতান্ত্রিক আইনজীবী সংঘের সাধারণ সম্পাদক

মিশনারিজ অফ চ্যারিটির কর্ণধার সিস্টার নির্মলার বিরুদ্ধে কী কী অভিযোগ দায়ের করব? কার কাছে অভিযোগ দায়ের করব? অভিযোগের ভাষা কী হবে? এসব বিষয়ে পরামর্শ নিতেই আমাদের সমিতির শুভানুধ্যায়ী দিলীপ গুপ্তের কাছে আসা।

আলোচনা ও মুসাবিদা শেষে ফিরলাম আমার ফ্ল্যাটে। কম্পিউটারে কমপ্লেন ড্রাফ্ট করা হল। ফ্যাক্সে অভিযোগ দায়ের করলাম কলকাতার পুলিশ কমিশনার সুজয় কুমার চক্রবর্তী ও পশ্চিমবঙ্গের ডাইরেক্টর জেনারেল অফ পুলিশ ডি সি বাজপেয়ীর কাছে।

আজ এক অসাধারণ ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটল। খ্রিস্টান সমাজে এক সুদূরপ্রসারী প্রতিক্রিয়ার বীজ পোঁতা হল। ভ্যাটিকানের সিস্টার কনসার্ন মিশনারিজ অফ চ্যারিটির কর্ণধারের বিরুদ্ধে প্রতারণাসহ আরও দুটি আইন ভঙ্গ করার অভিযোগ দায়ের করা হল পুলিশের কাছে। তৃতীয় বিশ্বের পিছিয়ে থাকা শোষিত মানুষগুলো পশ্চিমি খ্রিস্টানদের প্রতীক ভ্যাটিকানের বুজরুকিফিকেশনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনল ৷

দুপুর ১টা ৩০ মিনিটে শুরু হল নিউজ মিডিয়াগুলোকে খবর দেবার পালা। দুটো ফোনে আমি ও অরিন্দম খবর পৌঁছে দিতে লাগলাম ।

বিকেল তিনটে দশ। বেলেঘাটা জোড়া মন্দিরে পৌঁছে চোখ ট্যারা। আমরা বলেছি, বিকেল চারটেতে প্রতিবাদী পথসভা। কিন্তু এর মধ্যেই পৌঁছে গেছে অনেক নিউজ মিডিয়া। ঢাউস ঢাউস টিভি ক্যামেরা হাজির।

সাড়ে তিনটের আগেই টি ভি ক্যামেরার সামনে সাক্ষাৎকার দেওয়া শুরু করতেই হল । বিক্ষোভ সভায় সাংবাদিকদের অনেক প্রশ্ন ছিল। আমাদের উত্তর ছিল। উত্তর দেবার দায়িত্ব

ছিল আমার ও সুমিত্রার উপর। সুমিত্রা ‘হিউম্যানিস্টস অ্যাসোসিয়েশান অফ ইন্ডিয়া’র জেনারেল সেক্রেটারি। হিউম্যানিস্টস অ্যাসোসিয়েশন যুক্তিবাদী সমিতির উইং ।

ইংরেজিভাষী বিদেশি মিডিয়ার সাংবাদিকদের সঙ্গে ইংরেজি-চোস্ত এদেশী মিডিয়ার বাঙালি সাংবাদিকদের মধ্যে সাধারণভাবে একটা আসমান-জমিন ফারাক আছে। বিদেশি মিডিয়ার সাংবাদিকরা রিপোর্ট তৈরির ক্ষেত্রে তুলনামূলক ভাবে বেশিমাত্রায় নিরপেক্ষ জিজ্ঞাসু ও নির্লিপ্ত। কোনও পক্ষ অবলম্বন করে বা কোনও ঘটনার সঙ্গে নিজেকে লিপ্ত করে সংবাদের বিকৃতি ঘটাতে সচেষ্ট হয় না। লন্ডনের দৈনিক ‘দ্য ইন্ডিপেনডেন্ট’-এর সাংবাদিক ফিলিপ রীভ থেকে ইন্টারন্যাশনাল নিউজ এজেন্সি এ এফ পি’র শৈলেন্দ্র এন শীল—সবাই এই ছাঁচে গড়া। মিডিয়াগুলো তাদের সাংবাদিকদের এই ছাঁচে গড়ে। ফলে পাশ্চাত্যের নিউজ মিডিয়াগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতা অনেক বেশি।

ইংরেজি ভাষার ভারতীয় নিউজ চ্যানেলগুলোর বাঙালি সাংবাদিকরা সাধারণভাবে তুলনায় অনেক বেশি ঝক্‌ঝকে, বাচতুর, তারুণ্যের ঝাঁঝে ভরপুর। পার্থক্য গড়ে দিয়েছে এঁদের মানসিকতা। এঁদের মধ্যে আকাদেমিক নিরপেক্ষতা ও নির্লিপ্ত মানসিকতার বড়-ই অভাব। জানার আগ্রহের চেয়ে আক্রমণ চালাবার প্রবণতা বেশি। নিরপেক্ষভাবে একটি খবর পরিবেশন করার নিরপে চেয়ে, ঘটনার মধ্যে ইনভলভড হয়ে নিজের মতের পক্ষে খবরটাকে তুলে ধরার চেষ্টা করেন। এটাই এই বঙ্গের ইংরেজি-চোস্ত সাংবাদিকদের মূলস্রোত। মনে হয় তাঁরা আগে থেকে ঠিক করেই আসেন কোন দিকে টেনে লিখবেন বা দেখাবেন।

আজ দেশি-বিদেশি নিউজ মিডিয়াগুলোর সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে এই সত্যটাই বার বার প্রকট হয়ে উঠছিল। বিদেশি মাধ্যমের প্রতিনিধিরা যখন অত্যন্ত ধৈর্যের সঙ্গে দীর্ঘ সময় ধরে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানতে চাইছেন—আমাদের বক্তব্য কী? বক্তব্যের পিছনে কী যুক্তি আমরা হাজির করছি? তখনই এদেশি নিউজ মিডিয়ার ঝক্‌ঝকে বাঙালি তরুণীরা চোস্ত ইংরেজিতে মাছের বাজার বসিয়ে ফেলেছেন। এঁরা সব্বাই একসঙ্গে আঙুল তুলে চেঁচাচ্ছেন—আপনারা সিস্টার নির্মলার বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে কমপ্লেন লজ করলেন কোন যুক্তিতে? মণিকার সঙ্গে মিশনারিজ অব চ্যারিটি বা সিস্টার নির্মলা কোনওভাবেই জড়িত নন। মণিকার ব্যাপারে এনকোয়ারি করেছে ভ্যাটিকানের টিম। এরপরও আপনারা কেন সিস্টারের বিরুদ্ধে অযৌক্তিক ভাবে কমপ্লেন করলেন। না। উত্তর শোনার মতো ধৈর্য ও দায় তাঁদের ছিল না।

এরই মাঝে অনেক মুখ থেকে একই প্রশ্ন ছুটে এল—আপনারা ‘ক্যানান ল’কে অস্বীকার করছেন? ক্যানান ল’ পাল্টাতে চাইছেন? আপনারা জানেন ‘ক্যানান ল’ কী ?

বুঝুন প্রশ্নের ধরন ?

ক্যানান ল’র অস্তিত্ব যে আছে, তার জবরদস্ত প্রমাণ পোপের সাম্রাজ্য ভ্যাটিকানের উপস্থিতি । এরপর কেন বলতে যাব যে—’ক্যানান ল নেই।’ আমরা ক্যানান ল পাল্টাতে চাইছি। কারণ, একজনের ভুল ধারণা, ভুল বিশ্বাস সমাজকে প্রভাবিত করে। সামাজিক পরিবেশ যেমন মানুষকে প্রভাবিত করে, তেমনই মানুষও সমাজকে প্রভাবিত করে। ব্যক্তি মানুষের চেয়ে সংগঠনের প্রভাব আরও বেশি। সংগঠন শক্তিশালী হলে তার ভুল চিন্তাধারার প্রচারে আরও বেশি সংখ্যক মানুষ প্রভাবিত হয়। সমাজবিজ্ঞানের এই সত্যকে মাথায় রেখেই আমরা ক্যানান ল পাল্টাতে চাইছি।

আমরা জানি ক্যানান ল’র সুরের সঙ্গে মৌলবী ও টিকিধারীদের সুর প্রায়শই মেলে। জন্মনিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে এরা একই সুরে চেঁচায়। কন্ডোমের বিরুদ্ধে এরা উচ্চকণ্ঠ। ভ্যাটিকানের পরিবার সংক্রান্তমন্ত্রী লোপেজ টুজিল্লো বি বি সি’র অনুষ্ঠানে ক্যানান ল স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, সন্তান কামনা ছাড়া পতি-পত্নীর দেহমিলন অনৈতিক। কন্ডোম কাম-সুখের রাস্তা দেখায়, ব্যভিচারের পথ প্রশস্ত করে।

ভ্যাটিকানের শেষ আবিষ্কার–কন্ডোম কখনই এড্‌স প্রতিরোধ করে না। বরং কন্ডোম ব্যবহারের জন্যই এড্‌স বাড়ছে।

দেহ-মিলন মানুষের একটা স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। স্বাভাবিক প্রবৃত্তিকে ধর্মীয় অনুশাসন দিয়ে চেপে রাখতে গেলে অস্বাভাবিক মানসিকতা বাড়বে। মানসিক রোগ বাড়বে। মানসিক কারণে শারীরিক অসুখ বাড়বে। জানি না শারীর-বিজ্ঞানের এই সত্যকে ভ্যাটিকান কবে বুঝবে? জানি না দেশি সাহেব সাংবাদিকরা ক্যানন ল বিষয়ে কতটা জানেন, ক্যানান ল’কে কতটা স্বীকার করেন। সন্তান কামনা ছাড়া দেহ-মিলন উচিত নয়—এমন নীতিকথায় বিশ্বাস করার মতো কোনও সাংবাদিক বিক্ষোভ সভায় ছিলেন কিনা জানি না। কন্ডোম ব্যবহার উচিত নয় অথবা পৃথিবী জুড়ে এড্‌স ছড়াবার কারণ কন্ডোম ব্যবহার—এমন বিজ্ঞানবিরোধী সর্বনাশা বিশ্বাসে সহমত কোনও সাংবাদিক ওখানে হাজির ছিলেন, ভাবলেই আতঙ্কে শিউরে উঠছি। তবে আশার কথা এই যে, বাঙালি মধ্যবিত্ত মানসিকতা এখনও কথায় ও কাজে এক নয় ।

এঁরা ‘ক্যানান ল’কে চিরন্তণ ও অভ্রান্ত মনে করতে চান, করুন। এঁদের অনেকে গ্রহরত্ন ধারণ করেন, আমাদের বলার কিছুই থাকতে পারে না। এঁদের অনেকে জ্যোতিষী ও তান্ত্রিকদের কাছে যান। এঁরা জ্যোতিষী-তান্ত্রিকদের ‘বখ্া’ হলে আপনার আমার কী? এইসব ইংরেজি বলিয়ে- কইয়ে কুসংস্কারে আচ্ছন্ন মানুষদের সঙ্গে শিক্ষার সুযোগ না পাওয়া আনপড় কুসংস্কারে ডুব দেওয়া মানুষগুলোর কোনও পার্থক্য আছে কি?

তা আছে। শিক্ষার সুযোগ না পাওয়া গ্রামের মানুষগুলোর মধ্যে জিজ্ঞাসার আগুন আছে। উসকে দিলেই জ্বলে ওঠে। ওদের নিয়েই যুক্তিবাদী আন্দোলন গড়ে তুলি। কুসংস্কারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলি। ইংরেজি বলতে কইতে পারে মধ্য-মেধার, মধ্যবিত্তসুলভ মানসিকতার মানুষদের মধ্যে অহং ও ভণ্ডামি বড়-ই বেশি। এঁরা শিখতে চান না। স-ব জানেন। শিখে বড় হওয়ার চেয়ে, অন্যকে ছোট করে বড় সাজার প্রবণতা বড়-ই বেশি।

আমরা ‘ক্যানান ল’র বিরোধিতা করছি। খ্রিস্টান সমাজকে বিরোধিতা করার আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। সেন্ট-এর সংজ্ঞা পালটাতে চাইছি। মাদার’কে পণ্য বানিয়ে, তাঁর নাম করে মানুষকে প্রতারিত করে ভ্যাটিকান ও মিশনারিজরা মাদারকেই অপমান করছেন। এই প্রতারণা বন্ধ না করলে প্রচারের দৌলতে আমজনতা অলৌকিক চিকিৎসার দিকে দৌড়বে। অলৌকিক চিকিৎসার ভয়াবহ পরিণতির জন্য কে দায়ী হবে? পোপ? ভ্যাটিকান? মিশনারিজ অফ চ্যারিটি? সিস্টার নির্মলা? ভ্যাটিকানের সুরে সুর মেলান নিউজ মিডিয়া? নাকি এরা প্রত্যেকেই দায়ী? আপনারা নিজেদের যুক্তি দিয়ে বিচার করুন। উত্তর পাবেন-ই। এই ছিল আমাদের বিক্ষোভ সমাবেশের ‘থিম’ ।

যে দেশি সাহেব সাংবাদিকরা আমাদের ‘ক্যানান ল’ পান্টাবার চেষ্টাকে দুঃসাহসিক বা বোকামো মনে করেন, তাঁদের প্রত্যেকে প্রতিদিন ‘ওয়েবসাইট সার্চ’ করেন কিনা জানি না। যাঁরা করেন, তাঁরা পরের দিনের ‘বিবিসি নিউজ’ ওয়েবসাইট দেখে নিশ্চয়ই লজ্জায় মাটিতে মিশেছেন। ওখানে বলা হয়েছে—“মাদার টেরিজাকে ‘সেন্ট’ দেওয়ার প্রশ্নে বেশির ভাগ মানুষই প্রবীর ঘোষের পক্ষে একমত। তাঁরাও মনে করেন, সেন্টহুড দেওয়ার জন্য মিরাকেল’কে যুক্ত করার কোনও প্রয়োজন নেই ।”

খাঁটি ব্রিটিশ নিউজ মিডিয়ার এমন জোরালো বক্তব্যকে মেনে নেবার মতো মুক্ত মনের পরিচয় কি এঁরা দিতে পারবেন? নাকি ইংরেজি শেখা বাঙালি কাঁকড়া হয়ে থাকবেন ?

আজ সারা ভারতের টিভি চ্যানেলগুলো অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে প্রচার করেছে সিস্টার নির্মলার বিরুদ্ধে আমাদের অভিযোগ দায়ের করার খবর। দেখানো হয়েছে আমাদের বিক্ষোভ পথসভা। শোনানো হয়েছে আমাদের বক্তব্য ।

১৮ অক্টোবর, শনিবার, ২০০৩। বিবিসি রেডিও আজ সকাল ৬টা ৩০ মিনিটে আমার একটা সাক্ষাৎকার প্রচার করেছে বাংলায় ৷

সেই পুরোন কাসুন্দি ঘাঁটা। নতুনত্ব অবশ্য একটু আছে। ক্যাথলিক খ্রিস্টান সমাজের কাছে আবেদন রেখেছি—ক্যানান ল’র অবৈজ্ঞানিক দিকগুলো পাল্টে দিতে সোচ্চার হোন।

আজ শুধুমাত্র আসমুদ্র হিমাচল নয়, বিশ্ব জুড়ে পত্র-পত্রিকায় নানা ওয়েবসাইটে বিশাল সাড়া ফেলে আমরা, যুক্তিবাদী সমিতি। সমিতির রাণা হাজরা দিন-ভোর ওয়েবসাইট সার্চ করে শ’খানেক কপি তুলেছে।

এ এফ পি তাদের ওয়েবসাইটে জানাচ্ছে –

facts to claim a miracle to secure sainthood for the Roman Catholic nun. “Sainthood Means Falsehood,” said a poster carried by one of the approximately 100 protesters in the Indian city of Calcuta, where Mother Teresa’s Missionaries of Charity (MoC) order is headquartered.

The Nobel lauteate’s sainthood stems from the claims of 35-year-old Indian tribal woman, Monica Basra, who insists that she was cured of stomach cancer by Mother Teresa.

Friday’s protesters said it was a fraud perpetrated by the MOC and Mother Teresa’s successor, sister Nirmala.

Prabir Ghosh, Chief of Science and Rationalists’ Association of India, said the forum registered fraud cases with the police against Sister Nirmala.

Hot breath: An Indian activist of the Science and Rationalists’ Associaton of India performs a fire-breathing act as she demonstrates against claims that Mother Teresa performed a miracle in Calcutta.

(AFP/Deshakalyan Chowdhury).

Zinos.Com-ই শুধু এই ‘ধামাকা নিউজ’ দিয়ে বিস্ফোরণ ঘটায়নি। কালকে যুক্তিবাদী সমিতির ভূমিকা বিশ্ব জুড়েই ‘বিগ ধামাকা’ বা ‘ধামাকা নিউজ’। এবং কলকাতার প্রায় পত্র- পত্রিকাতেই ‘বিগ ব্ল্যাক আউট’।

‘খ্রিস্ট ভ্রাতৃত্ববোধ’ বিশ্বব্যাপী গড়ে তোলার পরিকল্পনা যাদের মস্তিষ্কপ্রসূত, সেই বহুজাতিক সংস্থাগুলো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর অর্থনীতি থেকে সংস্কৃতি সব-ই নিয়ন্ত্রণ করে। এমত অবস্থায় আমাদের সমিতির কর্মস্থলের কেন্দ্রবিন্দু কলকাতা শহরে আমাদের ব্ল্যাক আউট করার পরিকল্পনা ভ্রাতৃত্ববোধের পালকরা গ্রহণ করলে তা কার্যকর হবেই। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু অবাক হই, যখন দেখি এত কিছুর পরও খ্রিস্টান-জনমত আমাদের-ই পাশে এসে দাঁড়ায়।

সবের ই ব্যতিক্রম আছে। শহর কলকাতা থেকে প্রকাশিত আঙুলে গোনা ব্যাতিক্রমী দৈনিক ছিল। তার মধ্যে প্রথমেই যে নামটি করতে হয়, সে নামটি হলো “The Asian Age |

‘এক নজর’ হিন্দি টিভি নিউজ বুলেটিন। প্রচারিত হয় ‘এ টি এন কলকাতা’ চ্যানেলে রাত সাড়ে ৯টা থেকে ১০টা। মাদারকে মিরাকেলের সঙ্গে যুক্ত করে সেন্টহুড দেওয়ার প্রক্রিয়া নিয়ে আমার সাক্ষাৎকার প্রচারিত হল। নতুন কথা যা বলেছি তা হল, বিশ্ব জুড়ে হাসপাতালগুলো বন্ধ করে দেওয়া হোক। গড়ে তোলা হোক মাদার টেরিজার লকেট তৈরির ফ্যাক্টরি। সিস্টার নির্মলা, আপনাদের প্রতিষ্ঠান পরিচালিত প্রতিটি চিকিৎসা কেন্দ্র বন্ধ করে দিন। পরিবর্তে রোগীদের সারিয়ে তুলতে মাদারের লকেট বিতরণ করুন। সিস্টাররা এরপর থেকে তাঁদের অসুখের জন্য ডাক্তারদের সাহায্য নেওয়া বন্ধ করুন। লকেট ঝুলিয়ে রোগ সারান।

এমন আচরণ না করলে মানুষ আপনাদের দিকে আঙুল তুলে বলবে — ‘স্ববিরোধী’, ‘ভণ্ড’ বলে।

সঙ্গে একটি আবেদন ছিল পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে। আগামী ৯ নভেম্বর কলকাতায় মাদারের ‘রেসেড’ হওয়া নিয়ে উৎসব হবে। সেই উৎসবের আমন্ত্রণ আপনি গ্রহণ করেছেন শুনেছি। একজন মার্কসবাদী হিসেবে অলৌকিক ব্যাপারে বিশ্বাস রাখলে জনমানসে তার প্রভাব হবে ভয়াবহ। আমাদের সমিতি একই সঙ্গে অনুরোধ ও দাবি রাখছে—আপনি ওই অনুষ্ঠানে যাবেন না।

এন ডি টিভির লাইভ প্রোগাম বরখা দত্তের ‘বিগ স্টোরি’। সময় রাত ১০টা থেকে সাড়ে ১০টা। ইংরেজি এই অনুষ্ঠানে বরখা সঞ্চালক। আলোচক যুক্তিবাদী সমিতির সৌরভ দাশগুপ্ত ও নিউ দিল্লির এক বিশপ ।

বরখা দাপুটে সঞ্চালক। তাঁর মধ্যে বাঙালি মধ্যবিত্ত মানসিকতার লেশ মাত্র নেই। আকাদেমিক নিরপেক্ষতা আছে। আছে নির্লিপ্ত থাকার গুণ। সুতরাং, অনুষ্ঠান জমজমাট।

বরখার প্রতিটি প্রশ্নের উত্তরে সৌরভ আমাদের সমিতির বক্তব্যকে নিখুঁতভাবে তুলে ধরেছেন। হ্যাঁ, উল্লেখ করেছেন, হাসপাতালের ঝাঁপ বন্ধ করে মাদারের লকেট তৈরির ফ্যাক্টরির কথা।

‘খোঁজখবর’ আজও দেখিয়েছে গত বছর আমার তুলে আনা মণিকা-সেলকু-ডাক্তারদের নিয়ে ভ্যাটিকানকে ভয়ংকর রকম বে-আব্রু করা অনুষ্ঠান। ‘আকাশ বার্তা’ চ্যানেলে অনুষ্ঠানটি দেখানো হল রাত ১০টা থেকে সাড়ে ১০টা।

‘মাদার টেরিজা’ নামের বেলুনটি সবচেয়ে বেশি ফুলিয়েছে পশ্চিমবঙ্গের প্রায় সব মিডিয়া । যুক্তিবাদী সমিতির ভূমিকা ছিল বিবেকের। আজ নিজেকে হালকা লাগছে। বুঝতে পারছি, চূড়ান্ত জয়ের দোরগোড়ায় এসে পড়েছি। এ জয় প্রতিটি যুক্তিবাদী মানুষের জয়। পরিণতিতে পশ্চিমবঙ্গে র অপরিণামদর্শী মিডিয়াগুলো ১৮০ ডিগ্রি ঘুরবে। অন্যস্বরে কথা বলবে।

১৯ অক্টোবর, রবিবার, ২০০৩। ভ্যাটিকান সিটি থেকে বিভিন্ন মিডিয়া খবর পাঠাল—পোপ দ্বিতীয় জন পল মাদার টেরেজাকে ‘রেসেড’ অর্থাৎ ঈশ্বরের আশীর্বাদধন্যা’ বলে ঘোষণা করলেন।

না। মাদানকে শেষ পর্যন্ত ‘সেন্ট’ ঘোষণা করা হয়নি। কার্ডিনালদের পরামর্শে সরাসরি ‘সেন্ট’ ঘোষণা থেকে পিছিয়ে যান পোপ। এটাই খবর।

সকাল থেকেই পৃথিবীর টিভি চ্যানেল, রেডিও এবং দৈনিক পত্রিকায় মাদারের মিরাকেলের পাশাপাশি অনিবার্যভাবেই যুক্তিবাদী সমিতিও উঠে এসেছে। মাদার টেরিজা নিয়ে যে কোনও ওয়েবসাইট ক্লিক করলেই হুড়মুড়িয়ে বেরিয়ে আসছে যুক্তিবাদী সমিতির তোলা মণিকা বিতর্ক।

বিবিসি রেডিও’র লন্ডন থেকে ফোন করলেন সাকিল আনোয়ার। আজই ভারতীয় সময় রাত দশটায় আমার সাক্ষাৎকার প্রচারিত হবে।

সাক্ষাৎকারে বলেছিলাম, সমস্ত মানুষেরই কিছু সীমাবদ্ধতা থাকে। মাদার টেরিজারও ছিল। তিনি জন্মনিয়ন্ত্রণ প্রথার, কন্ডোমের ও গর্ভপাতের বিরোধী ছিলেন। এসব বিষয়ে তাঁর চিন্তা ছিল মধ্যযুগীয় কুসংস্কারে আচ্ছন্ন।

তিনি মিশনারিজ অফ চ্যারিটির তহবিল বাড়াতে অর্থ সাহায্য নিয়েছেন একনায়ক শাসক থেকে কুখ্যাত মাফিয়ার কাছ থেকেও ।

মাদার টেরিজা আতুরজনের সেবায় নিবেদিত-প্রাণ ছিলেন। এ যেমন সত্য, তার চেয়েও বড় সত্য মাদার ছিলেন ধর্ম প্রচারক। ধর্মান্তরিত করার ক্ষেত্রে সেবাধর্মের চেয়ে শক্তিশালী কোনও অস্ত্র নেই—এটা ভ্যাটিকান জানে। মাদারও জেনেছিলেন। তাইতেই আমরা দেখেছি, সেবার আড়ালে তিনি ধর্মান্তকরণের কাজ চালিয়ে গেছেন।

এইসব সীমাবদ্ধতার পরও তাঁকে শুধুমাত্র সেবাকর্মের জন্য ‘সেন্ট’ দিতে পারতেন পোপ এমন সেবাধর্মের জন্য মাদার টেরিজা নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছেন। আমরা কলকাতাবাসী হিসেবে গর্বিত হয়েছি।

কিন্তু মাদার টেরিজাকে ‘সেন্ট’ বানাতে যে নগ্ন মিথ্যাচারিতার পথে ভ্যাটিকান নেমেছে তা শুধু দুঃখজনক নয়, ভয়ংকরও।

আমাদের মতো কুসংস্কারে ডুবে থাকা দেশের মানুষ প্রচারের দৌলতে অলৌকিক- চিকিৎসার দিকে দৌড়লে তার পরিণতি ভয়াবহ হতে বাধ্য। এই প্রতিটি মৃত্যুর দায় আমরা আগাম চাপিয়ে দিচ্ছি পোপ-ভ্যাটিকান-সিস্টার নির্মলা-মিশনারিজ অফ চ্যারিটির উপর।

মিশনারিজ অফ চ্যারিটির সঙ্গে যুক্ত লোকজন অসুস্থ হলে তাদের চিকিৎসা না করিয়ে মাদারের লকেট ঝুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে—এটা আমরা দেখতে চাই। আমরা চাই কথায় ও কাজে ভ্যাটিকান ও মিশনারিজরা এক হোন। নতুবা ইতিহাস এদের ভণ্ড বলেই চিহ্নিত করবে।

মিশনাজির অফ চ্যারিটির তরফ থেকে জানানো হয়েছে রোম থেকে ফিরে আগামী ৯ নভেম্বর কলকাতায় উৎসব উদ্যাপন করা হবে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী শ্রীবুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ওই উৎসবে যোগ দিয়ে একটা অন্য মাত্রা যুক্ত করবেন। ১৯ অক্টোবর সময়াভাবে বুদ্ধদেববাবু নাকি রোমে হাজির থাকতে পারছেন না। তাই এই ব্যবস্থা। মার্কসবাদী বুদ্ধদেববাবু মিশনারিজ অফ চ্যারিটির ওই উৎসবে যোগাদান করলে তা হবে স্পষ্টতই স্ববিরোধিতা। মার্কসবাদ ও ধর্মে থাকার স্ববিরোধিতা।

বড় গাছ পড়লে জমি তো কাঁপবেই

♦ মাদার টেরিজাকে ‘রেসেড’ দেওয়ার পরও মিডিয়ায় এ’নিয়ে বিতর্কের ঝড় কমেনি ।

♦ কলকাতার আঙুলে গোনা ব্যতিক্রমী পত্রিকা যারা আমাদের এই লড়াইয়ের খবর তুলে ধরেছিল তাদের মধ্যে অন্যতম সান্ধ্য দৈনিক ‘সত্যযুগ’। ২১ অক্টোবর ২০০৩ তারিখে এক পৃষ্ঠা জুড়ে প্রকাশিত হল একটা প্রতিবেদন। শিরোনাম ‘বুজরুকিফিকেশন?’ প্রতিবেদনে মাদারের মিরাকেল-মণিকা বিতর্ক উস্কে দেওয়া হয়েছে। স্বভাবতই উঠে এল আমাদের কথা। লেখা হল,

“ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির সাধারণ সম্পাদক প্রবীর ঘোষ বলেন, ‘মাদার ছিলেন দরিদ্রের বন্ধু এবং তাকে সেন্টহুড প্রদান করার মাপকাঠি তো এটাই হওয়া উচিত। কিন্তু এই যে অলৌকিকতার দাবি করা হচ্ছে, এটা তো সবটাই একটা ধাপ্পা। কোনো প্রমাণ নেই। কোনোভাবেই চিকিৎসাশাস্ত্রের পরীক্ষিত নয়। পুরোটাই বুজরুকি।’ সেই সঙ্গে যুক্তি দিয়ে তাঁর বক্তব্য, পশ্চিমবঙ্গের কমিউনিস্ট সরকারের উচিত তথাকথিত অলৌকিক’ এই ঘটনাটিকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে যাচাই করা। প্রবীরবাবু প্রশ্ন তুলেছেন মণিকার ঘটনাটি প্রকাশ্যে আসার সঙ্গে সঙ্গেই ডাঃ আর এন ভট্টাচার্যের উধাও হয়ে যাওয়া নিয়েও। প্রবীরবাবু ওই ঘটনার পর বিষয়টি নিয়ে খোঁজখবর করতে বালুরঘাট জেনারেল হাসপাতালে ছুটে যান। সেখানকার দুই ডাক্তার রঞ্জন মুস্তাফি ও মঞ্জুল মুর্শেদের সঙ্গে দেখা করতে। বস্তুত এঁরা দুজনই মণিকার টিউবারকিউলার মেনিনজাইটিসের চিকিৎসা করেছিলেন ওই হাসপাতালে। ‘ওঁরা বললেন, মণিকার শরীরে ৯ মাস ধরে অ্যান্টি-টিউবারকিউলোসিস চিকিৎসা চালানো হয়েছিল।’ মণিকার গ্রামেরও প্রায় পঞ্চাশেক প্রতিরেশীর বক্তব্য নেওয়া হয়েছিল। তাঁরাও সবাই বলেছিলেন, ‘একটা কমলালেবু আকারের টিউমার ধীরে ধীরে মণিকার শরীর থেকে সেই সময়েই ছোট হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছিল’—প্রবীরবাবু জানিয়েছেন। তিনি আরো জানান, মণিকার স্বামীও একথা স্বীকার করেন।

কিন্তু বিবিসি এ মাসের প্রথম দিকে যেই না গ্রামে গিয়ে তাঁর স্বামীকে জিজ্ঞাসাবাদ করে, সঙ্গে সঙ্গে উল্টো সুর। প্রবীরবাবু ক্ষোভের সঙ্গে জানান, ‘বিবিসি-র সাংবাদিকের কাছে মণিকার স্বামী বলেন, কলকাতায় গিয়ে একরাতেই নাকি তাঁর স্ত্রী অলৌকিকভাবে সেরে গিয়েছেন। অবাক কাণ্ড, গ্রামের লোকজনের মুখেও তখন কুলুপ !”

টানটান সতেজ যুক্তিতে দৃঢ় প্রবীরবাবু ও তাঁর সমিতির সহকর্মীরা। তাঁরা এখন মনে করেন, মিশনারিজ অব চ্যারিটির সিস্টার নির্মলার বিরুদ্ধে জনগণকে বিভ্রান্ত করার দায়ে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৪২০ নম্বর ধারায় মামলা করা উচিত। প্রবীরবাবুর বক্তব্য, ‘ড্রাগ্‌স অ্যান্ড ম্যাজিক রেমিডিজ (অবজেকশনেল অ্যাডভার্টাইজমেন্ট অ্যাক্ট) ১৯৫৪ এবং ‘ড্রাগ্‌স অ্যান্ড কসমেটিক্‌স অ্যাক্ট ১৯৪০’—এই দুই আইন লঙ্ঘন করে সিস্টার নির্মলা মিথ্যে প্রচারের আশ্রয় নিয়ে মাদারের মহত্ত্বকে অবমাননা করেছেন। এই বিজ্ঞান ও যুক্তির যুগে মধ্যযুগীয় কুসংস্কারের চর্চা কখনওই এভাবে চলতে দেখা যায় না।”

‘সত্যযুগ’ এ’কথাও লিখল,

…..মাদারকে মহিমা প্রদানে যে অলৌকিকতার শক্তি স্বীকার করা হল, তা আসলে মাদারকেই অসম্মান করা নয় কি? তিনিই যখন ছবি হয়ে গিয়ে কল্পিত বিভূতি ছড়ানোর উপাদান হয়ে গেলেন, তখনই তিনি আরও বড় হলেন ?…

যুক্তিবাদী সমিতির সুরে সুর মিলে যাওয়া কথা।

‘তথ্যকেন্দ্র’ বাংলা ভাষার সাহিত্য মাসিক। নভেম্বর ২০০৩ সংখ্যার সম্পাদকীয়তে লেখা হলঃ-

“মাদারকে সন্ত বানানোর চেষ্টা তো তাঁর সেবাধর্মকেই আঘাত করা। তাঁর

নোবেল শান্তি পুরস্কারের প্রতি অবমাননা। রক্তমাংসের মানবীকে

অবৈজ্ঞানিক রজ্জুতে, অলৌকিক ও অসত্যের মোড়কে

মুড়ে ফেলা। প্রতিবাদে কজন বুদ্ধিজীবী ও

সাধারণ মানুষ কণ্ঠ মেলাবেন,

সেটাই এখন দেখার।”

“ঘটনার সত্যাসত্য যাচাই করতে কলকাতার ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির সাধারণ সম্পাদক প্রবীর ঘোষ হাজির হয়েছিলেন বালুরঘাট জোনারেল হাসপাতালে। চিকিৎসক রঞ্জন মুস্তাফি ও মঞ্জুল মুর্শেদের সঙ্গে কথা বলতে, যাঁরা ওই হাসপাতালে মণিকার টিউবারকুলার মেনিনজাইটিসের চিকিৎসা করেছিলেন। ডাক্তারদের বক্তব্য, মণিকার শরীরে প্রায় ৯ মাস অ্যান্টি টিউবারকুলোসিস চিকিৎসা চালানো হয়েছিল। এই চিকিৎসার ফলেই মণিকার টিউমারটি নষ্ট হয়েছে। মণিকার নাকোড় গ্রামের জনা পঞ্চাশেক প্রতিবেশী প্রবীরবাবুকে একবাক্যে জানিয়েছিলেন, একটা কমলালেবু আকারের টিউমার ধীরে ধীরে মণিকার শরীর থেকে ক্রমশ ছোটো হয়ে মিলিয়ে গেছে। মণিকার স্বামীও তখন এ কথা স্বীকার করেছিলেন। মোটামুটি এ পর্যন্ত ঠিক ছিল। জলে দুধ মিশল, মণিকার গ্রামে বি বি সি চ্যানেলের খোঁজখবর করতে যাওয়ার ঘটনায় গিরগিটিকেও লজ্জা দিয়ে মণিকার স্বামী বি বি সি-র সাংবাদিকদের জানালেন, মাত্র একটি রাতের মধ্যেই তাঁর স্ত্রী অলৌকিকভাবে সেরে গিয়েছেন। বিন্দুমাত্র প্রতিবাদ করেননি তাঁর প্রতিবেশীরাও। তারা যেন মুখে কুলুপ ঝুলিয়ে ছিলেন।”

“ধর্ম যাজকের সর্বোচ্চ আসনে থেকে গত ২৫ বছর ধরে পোপ এই নিয়ে কিন্তু হাজারেরও বেশি ‘রেসেড’ বানিয়েছেন। আর তাঁর ‘সন্ত’ তৈরির কারখানা থেকে বেরিয়েছেন ৪৭৭ জন। প্রাচ্যের দেশ বিশেষ করে ভারতবর্ষ না হয় জাদুমন্ত্র ভূত-পেত্নি-রাক্ষস-খোক্ষসদের দেশ, কিন্তু বেয়াড়া যুক্তিবাদী পাশ্চাত্যের এই হাল কেন? প্রথম বিশ্বের প্রতি তৃতীয় বিশ্বের কি এমন প্রশ্ন করা উচিত?”

“মাদারকে সন্ত বানানোর চেষ্টা তো তাঁর সেবাধর্মকেই আঘাত করা। তাঁর নোবেল শান্তি পুরস্কারের প্রতি অবমাননা। রক্তমাংসের মানবীকে অবৈজ্ঞানিক রজ্জুতে, অলৌকিক ও অসত্যের মোড়কে মুড়ে ফেলা। প্রতিবাদে যুক্তিবাদী সংস্থাগুলি যদি পথে নামেন তাহলে বাংলার ক- জন বুদ্ধিজীবী ও সাধারণ মানুষ কণ্ঠ মেলাবেন, সেটাই এখন দেখার।”

কলকাতার যে’সব মিডিয়া এতদিন ভ্যাটিকানের পক্ষে নির্লজ্জ দালালি করেছে, জয় বন্দনা করেছে, মাদারের মিরাকলের পক্ষে উদ্বাহু উল্লাস প্রকাশ করেছে, তারাই এখন নির্মমভাবে মাদার ও ভ্যাটিকানের কেচ্ছাকাহিনি তুলে ধরে এক নম্বরেই থাকতে চাইছে। ২৩ অক্টোবর ২০০৩ থেকে এমন-ই ‘ডিগবাজি’ লেখা ছাপা শুরু করল কলকাতার ‘সিকান্দার’ দৈনিক পত্রিকা। ১৯ অক্টোবর বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারের কথাই যেন উঠে এসেছে।

‘আজকাল’ কলকাতা থেকে প্রকাশিত বাংলা দৈনিক পত্রিকা। ৮ নভেম্বর, ২০০৩, প্রিয় সম্পাদক’ বিভাগে একটি চিঠি প্রকাশিত হল। চিঠিটি ইঙ্গিতবহ ও উদ্দীপ্ত করার মতো।

সিস্টার নির্মলা প্রতারণার দায়ে ?

আমি আজকালের পাঠক। বয়সে প্রবীণ। আপনাদের কাছে প্রত্যাশা অনেক ।

গত ১৭ অক্টোবর বাংলা ও ইংরেজি-সহ বহু চ্যানেলে দেখলাম, মাদার টেরিজাকে নিয়ে সিস্টার নির্মলা মানুষকে প্রতারিত করছেন। কারণ মণিকা বেসরা ৯ মাস চিকিৎসার দ্বারা সুস্থ হয়েছে। এক রাতে মাদার-মিরাকলে নয়। নির্মলার এই মিথ্যাচারিতার বিরুদ্ধে ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি ডিরেক্টর জেনারেল অফ পুলিশ, কলকাতার পুলিশ কমিশনারের কাছে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছে।

যুক্তিবাদী সমিতির এই সৎ লড়াইয়ে আপনাদের সামিল দেখতে চাই।

সাধন মজুমদার। রামকৃষ্ণ পল্লী।

বেলঘরিয়া। কলকাতা-৮৩

 

সব প্রগতিশীল প্রগতিশীল নয়

মাদার টেরিজার নামে, ভ্যাটিকানের নামে, ভয়ংকর রকমের বুজরুকি হল, যার উৎপত্তিস্থল কলকাতা। অবাক বিস্ময়ে বিশ্বের মিডিয়াগুলোর সঙ্গে আমরাও দেখলাম, কলকাতার প্রতিবাদী বুদ্ধিজীবীরা, প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীরা একদম চুপ।

কেন চুপ? তাঁদের কি তবে টিকি বাঁধা আছে সেই সব মিডিয়া বা প্রতিষ্ঠানের কাছে, যারা অন্য সুরে গাইছে? অথবা নীরব?

রম্যাঁ রলাঁ ১৯৩৩ সালে তাঁর এক বন্ধুকে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন, বুদ্ধিজীবীরা হল ‘সরকারের চেনে বাঁধা কুকুর’, যাঁরা আসলে ‘ক্ষমতার দাস’।

‘তথ্যকেন্দ্র’ নভেম্বরের সম্পাদকীয়তে এই একটা আশঙ্কা প্রকাশ করেছিল শেষ পংক্তিতে। অনেক বিজ্ঞান সংগঠন ও যুক্তিবাদী সংগঠন পশ্চিমবঙ্গে আছে। কারও কারও বার্ষিক বাজেট এতই বড় অঙ্কের যে বিস্মিত হতে হয়। কিন্তু এরা কেন অদ্ভুত রকম নীরবতা পালন করল ?

নির্বাচন নির্ভর রাজনৈতিক দলের শাখা হিসেবে গড়ে ওঠা বিজ্ঞান সংগঠন বা যুক্তিবাদী সংগঠনের পক্ষে খ্রিস্টান ভোটারদের তুষ্ট রাখার বিষয়টি মাথায় রাখতেই হয়। তাইতেই ভ্যাটিকানের বিরোধিতা করা ‘হঠকারী’ কাজ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।

মাদারকে ‘সেন্ট ’ করা নিয়ে কলকাতার বড় মিডিয়াগুলো বড় বেশি নাচানাচি করেছে। ফলে মধ্যবিত্ত বাঙালি ভোটাররা মাদার-আবেগে গা ভাসিয়েছে। এই অবস্থায় পোপের মিথ্যাচারিতার বিরোধিতা করতে গেলে বিপদ আছে। মধ্যবিত্ত বাঙালি সেন্টিমেন্ট ধরে নিতেই পারে, এটা মাদারকেই অপমান। অতএব এ নিয়ে মুখ না খোলাই নিরাপদ। রাজনৈতিক দলের বিজ্ঞান সংগঠনগুলো এমন ভাবনা থেকেই চুপ ছিলেন, এমন সম্ভাবনা প্রবল ।

‘খ্রিস্টান ভ্রাতৃত্ববোধ’-এর পুষ্টি চাওয়া মাথাগুলো আবার একই সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গে বিজ্ঞান আন্দোলন ও যুক্তিবাদী আন্দোলনকারী কিছু সংগঠনেরও ‘গডফাদার’। গডফাদারদের রাগালে রমরমা বন্ধ। অতএব ভ্যাটিকানের বিরুদ্ধে তারা স্পিকটি নট’।

কলকাতার মিডিয়াগুলো এদের কারও কারও উপর আলো ফেলার চেষ্টা করেছে। একটা আলোয় কি ক্রিকেট মাঠ আলোকিত করা যায়?

মিডিয়ার আলোয় আলোকিত সব প্রগতিশীল যে প্রগতিশীল নন, কেউ কেউ প্রগতিশীল— ভ্যাটিকানের বুজরুকি তা আবার প্রমাণ করল।

সুপার ফ্লপ শো

প্রচার ছিল ৯ নভেম্বর, ২০০৩, কলকাতার সব রাস্তা যাবে মাদারের ‘রেসেড’ পাওয়ার উৎসবে। উৎসবের মধ্যমণি হবেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী শ্রীবুদ্ধদেব ভট্টাচার্য।

সব-ই তো ঠিক-ঠাকই ছিল। সেন্ট পিটার্স গির্জায় ‘বিয়েটিফিকেশন’ অনুষ্ঠানের পর থেকে মাদার হলেন ‘রেসেড’ অফ কলকাতা’। কিন্তু তারপর যতই দিন গড়াতে লাগল, ততই ‘রেসেড’ বিতর্ক ভ্যাটিকান ও মিশনারিজ অফ চ্যারিটিকে কোণঠাসা করে চলল। বন্ধু মিডিয়াগুলোর ভূমিকাও বিস্ময়করভাবে পালটে গেল। যারা এতদিন বাহবা দিয়েছে, একবারও মনে করিয়ে দেয়নি যে, এত মিথ্যে ভালো নয়, তারাই আজ নানা অভিযোগ খুঁচিয়ে তুলে বিশ্বাসযোগ্যতার হারানো জমি ফিরে পেতে চাইছে।

যে হাত এতদিন সেলাম ঠুকেছে, সে হাত-ই এখন পিছন থেকে ছোরা মারতে তৈরি। পশ্চিমবঙ্গের আর্চবিশপদের হাবভাবও তেমন সুবিধের মনে হচ্ছে না। ওঁরাও পোপের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে শুরু করেছেন বলে গোপন সূত্রে খবর মিলেছে।

সব মিলিয়ে বড় রকমের ছন্দপতন ।

৯ নভেম্বরে অনুষ্ঠান ‘নমো নমো’ করে-ই সারা ছাড়া উপায় ছিল না। একমাত্র ভরসা, মুখ্যমন্ত্রী এসে যদি মুখ-রক্ষা করেন।

শেষ পর্যন্ত মুখ্যমন্ত্রীও এলেন না।

একে কী বলব, ‘সুপার ফ্লপ শো’ ছাড়া?

 

পোপের বিরুদ্ধে ‘ক্যানান ল’র বিচারক

পোপের উপর একটা ডকুমেন্টারি রিপোর্ট তৈরি হয়ে আছে। পোপের স্বাস্থ্যের অবনতি দেখে জরুরি ভিত্তিতে তৈরি। তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে বিবিসি রেডিও ওটা বাজাবে। শুনবে পৃথিবীর ১০০ কোটির উপর মানুষ। ডকুমেন্টারি রিপোর্ট তৈরির দায়িত্ব ছিল বিবিসি’র রেডিও করেসপন্ডেন্ট কল্পনা প্রধানের উপর। ডকুমেন্টারি তৈরির সময়টা খুব-ই তাৎপর্যপূর্ণ।

২০০৩-এর অক্টোবর দ্বিতীয় পর্যায়ে পোপ-মাদার-মণিকা-যুক্তিবাদী সমিতি বিতর্ক তীব্র আকার নিয়েছে। মিডিয়া ও খ্রিস্টান সমাজ তোলপাড় হচ্ছে। এমন-ই একটা সময়ে ক্যাথলিক ধর্মগুরুরা পোপের বিরুদ্ধে আঙুল তুলেছেন। পোপের বিরুদ্ধে এনেছেন ভয়ংকর সব অভিযোগ, যার আর এক নাম ‘দুর্নীতি’। মণিকা বেসরার এ’সবই ধরা আছে ওই ডকুমেন্টারি রিপোর্টে।

৫ ডিসেম্বর, ২০০৩। পোপ নিয়ে ডকুমেন্টারি রিপোর্ট যাঁর তৈরি, সেই কল্পনা প্রধানের এক সাক্ষাৎকার নিই। তাতে কী বলেছিলেন কল্পনা?

কল্পনা : মাদারকে ‘সেন্টহুড’ বা ‘রেসেড’ অর্থাৎ ‘সাধ্বী’ বা ‘ধন্যা’ ঘোষণার আগে আমাকে কিছু কাজ করতে হয়েছিল বিবিসি’র জন্য। বিবিসি’র সাংবাদিক হিসেবে কয়েকজনের সঙ্গে মিট করি, যাঁরা ‘ক্যাথলিক মণ্ডলী’র উচ্চপদে আছেন। যেমন ধরুন, ‘আইন মণ্ডলী’ বা ‘ক্যানান ল’র বিচারক এ সি জোসেফ।

তো মিস্টার জোসেফ আমাকে বলেছিলেন যে, মাদারকে যে ভাবে ‘রেসেড’ বা ‘সেন্টহুড’ ঘোষণা করার চেষ্টা হচ্ছে, সেটা ঠিক নয়। অনেক কিছু নিয়েই বড় বেশি তাড়াহুড়ো করা হচ্ছে, সেটা ঠিক নয়। যেমন ‘ক্যানান ল’ অনুসারে ক্যান্ডিডেটের মৃত্যুর পাঁচ বছর পর থেকে ‘সেন্ট’ প্রদানের প্রক্রিয়া শুরু হয়। এই পদ্ধতি, এই ঐতিহ্য না মেনে মাদারের বেলায় যে ভাবে তাড়াতাড়ি করে সব কিছু করার চেষ্টা হচ্ছে, তাতে কুড়ি-পঁচিশ বছর পরে প্রশ্ন উঠতে পারে। যাঁরা ক্যাথলিক ধর্ম নিয়ে গবেষণা করছেন, ঈশ্বরতত্ত্ব নিয়ে পড়াশুনো করেন, তাঁরা এই প্রশ্ন করতে পারেন যে, মাদার টেরিজার ‘সাধ্বী’ ঘোষণার প্রক্রিয়া এত তাড়াতাড়ি হল কেন?

তিনি আরও বলেছেন, মাদারের কাজের প্রতি তাঁর অসীম শ্রদ্ধা রয়েছে। তাই চান না যে, এ’রকম কোনও বিতর্কের সঙ্গে মাদারের নামটা জড়িত হোক।

তারপরও আবার উনি বলেন, এটা তো কোনও ক্রিমিনাল প্রসেস নয় বা কোনও জুডিসিয়াল প্রসেস নয়। তা হলে কেন এতো তাড়াহুড়ো করার প্রয়োজন হল ?

তিনি বলেছেন, প্রথমে ‘সার্ভেন্ট অফ গড’, তারপর ‘রেসেড এবং শেষে ‘সেন্টহুড’ দেওয়ার প্রতিটি ধাপে যথেষ্ট সময় দিতে হয় ।

মণিকা বেসরার অলৌকিক ঘটনা সম্বন্ধে বলতে গিয়ে বলেছেন, হয় তো ভবিষ্যতে লোকে বলবে যে, এই অলৌকিক ঘটনা নিয়ে যথেষ্ট তদন্ত হয়নি। এই প্রশ্ন যে ভবিষ্যতে উঠতে পারে, এ নিয়ে তিনি বারবার উল্লেখ করেছেন।

তারপরও মিস্টার জোসেফ বলেছেন যে, আমার ব্যক্তিগত ধারণা, আরও বেশি সময় ধরে আরও গভীরভাবে ইনভেস্টিগেশনের প্রয়োজন ছিল। এবং সেই ইনভেস্টিগেশন রিপোর্ট সাধারণ মানুষের সামনে তুলে ধরার দরকার ছিল। সাধারণ মানুষের এ বিষয়ে কী বক্তব্য, কী প্রতিক্রিয়া, সেটা তাঁদের জানার দরকার ছিল। ‘তাঁদের’, মানে ‘ক্যাথলিক মণ্ডলী’ ও ‘ক্যাথলিক আইন সভা’র লোকজনদের। সাধারণ মানুষের কাছে ঘটনাটি বিশ্বাসযোগ্য না হলে অর্থাৎ মিথ্যে মনে হলে, সেটাকে ‘সত্যি অলৌকিক ঘটনা’ বলে জোর করে চালাবার চেষ্টা করা ঠিক পদ্ধতি নয়। সাধারণের কাছে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনের পরে মাদারের অলৌকিক ক্ষমতা বিষয়ে ঘোষণা করতে পারতেন। অস্বস্তিকর বিতর্ক এড়াতে পারতেন।

আমি মিট করেছিলাম ক্যাথিলিক ফাদার রবিন গোমসের সঙ্গে। তিনিও প্রায় একই কথা বলেছেন। মৃত্যুর অল্প সময়ের মধ্যে মাদারকে ‘ধন্যা’ শ্রেণিভুক্তির কাজ হয়েছে, যা নিয়ে গোটা পৃথিবী আলোড়িত হয়েছে। তার একটা বড় কারণ, মাদারকে তাড়াহুড়ো করে ‘সেন্ট বানাবার চেষ্টা হয়েছে। ব্যাপারটা ‘ক্যানান ল’ মেনে হয়নি, ভ্যাটিকানের ঐতিহ্য মেনে হয়নি।

ক্যাথলিক মণ্ডলীর যে ইতিহাস, তাতে পোপ যাঁকে ‘রেসেড’ বা ‘সেন্টহুড’ শ্রেণিভুক্তিকরণ করতে চেয়েছেন, সেখানে দেখা গেছে কুড়ি থেকে পঞ্চাশ বছর পর্যন্ত সময় নেওয়া হয়েছে । কিন্তু মাদারের ক্ষেত্রে তাঁর মৃত্যুর মাত্র চোদ্দ মাস পর থেকেই ভ্যাটিকান সেন্টহুড ঘোষণার প্রক্রিয়া শুরু করে দিয়েছে নিজেদের উদ্যোগে। এটা একটা ব্যতিক্রম।

আরও একটা উল্লেখযোগ্য কথা তিনি বলেছেন যে, যাঁরা খ্রিস্টধর্মীয় ঈশ্বরতত্ত্ববিদ, তাঁদের কাছে ঘটনাটা অবশ্যই ব্যতিক্রম বলে মনে হয়েছে। কেন পোপ গোটা প্রক্রিয়ার জন্য প্রয়োজনমতো সময় দিলেন না? কেন পোপ ইনভেস্টিগেশন থেকে শুরু করে প্রতিটি পর্যায়ে তাড়াহুড়ো করলেন ? এগুলোও ঈশ্বরতত্ত্ববিদদের থেকে উঠে আসা প্রশ্ন। তো ফাদার রবিন গোমস্ নিজেই একজন বিশিষ্ট ঈশ্বরতত্ত্ববিদ।

গোলমাল হ্যায় ভাই সব গোলমাল হ্যায়

কল্পনা : মণিকা বেসরার অলৌকিক ঘটনা নিয়ে যখন ইন্টারভিউ নিচ্ছিলাম তখন যেটা হচ্ছিল, প্রথমে বিবিসি টেলিভিশনের জন্য নেওয়া হচ্ছিল; তারপরে আমি বিবিসি রেডিওর জন্য নিচ্ছিলাম। টেলিভিশন নিউজের জন্য খুব কম সময় বরাদ্দ। রেডিওর ডকুমেন্টারি রিপোর্টের জন্য অনেক লম্বা ইন্টারভিউ নিয়েছি। টেলিভিশন ও রেডিওর জন্য মণিকা বাংলাতেই কথা বলেছে। টেলিভিশনের জন্য ওকে সংক্ষেপে বলতে বলেছে। ওকে আমি বারবার বলছি, তুমি ছোটো করে বল। কিন্তু দেখছিলাম, ওকে কোনও প্রশ্ন করলে তার উত্তর না দিয়ে ও ডাক্তার থেকে শুরু করে, হসপিটাল থেকে শুরু করে পুরো ঘটনাটাই বারংবার বলে যাচ্ছিল। সব প্রশ্নের উত্তরেই শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পুরো ঘটনাটা মুখস্তের মতো বলে যাচ্ছিল। ঠিক যেন টেপ চালিয়ে আর রিওয়াইন্ড করে একই কথা শুনে যাচ্ছি। আমার অবাক লাগছিল। মনে হচ্ছিল, ওকে এমনভাবে মুখস্ত করানো হয়েছে যে, মাঝখান থেকে কোনও প্রশ্ন করলে উত্তর দিতে পারে না।

আমি এও দেখেছি, বিভিন্ন মিডিয়াকে আলাদা আলাদা করে দেওয়া মণিকার ইন্টারভিউতে একটি শব্দ বা বাক্য একটুও এদিক-ওদিক হচ্ছিল না। অথচ প্রত্যেকটি মানুষের বেলায় একই প্রশ্নের উত্তরে শব্দ বা বাক্য গঠনের কিছু এদিক-ওদিক হয়। মণিকার বেলায় কিন্তু তেমনটা হচ্ছিল না। প্রত্যেকটি প্রশ্নের উত্তরে সেই শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যেন একই টেপ শুনছি। আমার খট্‌কা লেগেছে।

মণিকাকে এতদিন প্রেসের সঙ্গে কথা বলতে দেওয়া হয়নি। রোমে যাওয়ার আগের দিন, এই একটা দিন-ই প্রেসের সামনে মণিকাকে হাজির করা হয়েছিল। এক একটা প্রেস আলাদা আলাদাভাবে মণিকার সঙ্গে মিট করেছিল। প্রথমে এপি নিয়েছে। তারপর আমরা বিবিসি। বিদেশি টেলিভিশনগুলোকে এক এক করে মণিকার সঙ্গে কথা বলতে দেওয়া হয়েছিল। আমি কিছুটা খট্‌কা মেটাতে অনেক মিডিয়াকে মণিকার দেওয়া ইন্টারভিউ শুনছিলাম। ওকে প্রশ্নগুলো বাংলা করে দেওয়া হচ্ছিল। বাংলাতেই উত্তর দিচ্ছিল। কিন্তু প্রতিটি প্রশ্নের উত্তরেই সেই গোড়া থেকে মুখস্ত বলে যাওয়া। আমার মনে হচ্ছিল ওকে সব মুখস্ত করানো হয়েছিল হয়তো বা। প্রবীর আপনার কী মনে হচ্ছে?

প্রবীরঃ আমারও মনে হয়েছে মণিকা ও সেলকু শেখানো কথা মুখস্ত বলে যাচ্ছেন। আমি এক বছর আগে সেলকুর সঙ্গে কথা বলেছি। সেলকু যা বলেছিলেন আমরা তা টিভি’তে দেখিয়েছি। সেলকু বলেছিলেন, মণিকা হাসপাতালের দেওয়া ওষুধ খেয়েছে, ভালো হয়েছে। রাতারাতি সেরে ওঠাটা মিছে কথা। এক বছর পরে বিবিসি নিউজ টিমের সঙ্গে যখন গেলাম, তখন সেলকু জানালেন, মণিকা মাদারের দয়ায় রাতারাতি সেরে গেছেন ।

মণিকার চিকিৎসা করাতে সেলকু জমি বন্ধক দিয়ে ধার নিয়েছিলেন। জমি ছাড়াতে পারেননি শুনে এক বছর আগে আমি ওকে টাকাটা দিতে চেয়েছিলাম। সেলকু জানিয়েছিলেন, নির্মলার অনুমতি ছাড়া তিনি টাকা নিতে পারবেন না। কারণ সিস্টার নির্মলাই তাঁর পরিবারের সব খরচ জোগাচ্ছেন, ছেলে-মেয়েদের হোস্টেলে রেখে লেখা-পড়া শেখাচ্ছেন।

অথচ গত মাসে যখন বিবিসি টিমের সঙ্গে গেলাম, তখন ক্যামেরার সামনে সঞ্জীব শ্রীবাস্তবের প্রশ্নের উত্তরে সেলকু জানালেন, কেউ অর্থ সাহায্য করতে চাইলে নিশ্চয়ই নেব।

গত বছর দেয়াল ঘেরা বাড়ির চৌহদ্দি দেখিয়ে সেলকু বলেছিলেন, এটা তাঁর একার। এ’বছর সে বাড়ি হয়ে গেছে অনেকের।

গোটা পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি থেকে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছনই স্বাভাবিক যে, মিশনারিজ অফ চ্যারিটি ওঁদের যে ভাবে বলাচ্ছে, ওঁরা সেভাবেই বলছেন।

কল্পনাঃ আমি মণিকা বেসরার ইন্টারভিউ নিয়েছি। ওকে জিজ্ঞেস করেছি, মাদারের কৃপায় তোমার রোগ সেরেছে, এমন ঘটনা প্রচার পাওয়ার পর তোমার পরিবারের লোকজন বিষয়টা কেমনভাবে নিয়েছে? তারা খুশি?

উত্তরে ও খুব হেসে বলেছিল, হ্যাঁ খুব খুশি। আগে আমাদের খুব অভাব ছিল, খুব অশান্তি ছিল। এখন আমরা খুব ভালো আছি।

প্রবীরঃ সেই ডাঃ ভট্টাচার্যের কোনও খোঁজ আপনারা কলকাতার পেয়েছিলেন ? কল্পনা : না, না, না।

প্রবীরঃ সুবীর ভৌমিক আন্তরিকভাবে চেষ্টা করেছিলেন ডাঃ ভট্টাচার্যকে ধরতে। খোঁজ পাননি। কোনও মিডিয়াই খোঁজ পায়নি। অথচ সি এন এন টিভির সামনে নাকি ডাঃ ভট্টাচার্যকে হাজির করেছিলেন নির্মলা। কিন্তু তার পরই ডাঃ ভট্টাচার্য ভ্যানিস। অথচ তিনিই সার্টিফাই করেছিলেন, মণিকা ক্যানসার রোগী।

কল্পনাঃ আপনি জানিয়েছিলেন যে, বালুরঘাট হসপিটালের সুপার ডাঃ মঞ্জুল মুর্শেদ এখন বর্ধমান হসপিটালে আছেন। এই খোঁজ পাওয়ার পর এইডসের ওপর একটা কাজ নিয়ে বর্ধমান হসপিটালে গিয়েছিলাম। এই কাজের পরিচয়ের সূত্র ধরে মণিকার চিকিৎসা বিষয়ে ডাঃ মুর্শেদের একটা ইন্টারভিউ নিতে ফোন করি। দেখলাম, উনি ফোন ধরছেন না। মোবাইল বন্ধ করে রেখেছেন। ডাঃ মুর্শেদের এক অ্যাসিস্ট্যান্টকে ধরলাম। এইডসের কাজের সময় পরিচয় হয়েছিল। অ্যাসিস্ট্যান্ট বললেন, ডাঃ মুর্শেদের কিছু বলার নেই। উনি তিনজন ডাক্তারের নাম দিয়ে বললেন, ওরা মণিকার ট্রিটমেন্ট করেছিলেন। এখন ওঁরা বালুরঘাটে নেই। অমুক অমুক জায়গায় পোস্টিং আছেন। একজন হাওড়ায় আছেন। একজন কলকাতার আই ডি হসপিটালে আছেন। তিনটে জায়গাতেই চেজ করলাম। সেই ডাক্তারকে হসপিটাল কর্তৃপক্ষ চিনলেন-ই না। ওঁদের কোনও ট্রেস পাইনি ।

প্রবীরঃ দুজন ডাক্তার মণিকাকে দেখেন। একজন ডাঃ তরুণ বিশ্বাস। যিনি মণিকাকে পরীক্ষা করে ডাঃ রঞ্জন মুস্তাফির কাছে রেফার করেন। আমরা গত মাসে বালুরঘাটে গিয়ে রঞ্জন মুস্তাফিকে সেখানেই পেলাম। কোথাও ট্রান্সফার হননি।

কল্পনাঃ হ্যাঁ সেটাই অবাক কাণ্ড। ফোর্থ ডিসেম্বর আপনার কাছেই শুনলাম ডাঃ মুস্তাফি কোথাও ট্রান্সফার হননি। ফোন নম্বরও দিলেন। অথচ ডাঃ মুস্তাফি সঞ্জীবকে (বিবিসি নিউজ- এর করেসপন্ডেন্ট) বলেছিলেন, দেখা করব না। সঞ্জীব তো ভয় পেয়ে গিয়েছিল। ডাঃ মুস্তাফি তো বলছিলেন, হেলথ সেক্রেটারি বা হেলথ মিনিস্টারের একটা চিঠি নিয়ে এসো, হ্যান-ত্যান, অনেক কিছু বলছিলেন।

প্রবীরঃ আমি ৬ তারিখ রাতে ডাঃ মুস্তাফির সঙ্গে ফোনে কথা বলি। জানাই বিবিসি নিউজ টিম নিয়ে কালই ওর কাছে যাচ্ছি।

আমরা পৌঁছতেই সঞ্জীব ও লেখির (ফোটোগ্রাফার) সামনে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন ডাঃ মুস্তাফি। সঞ্জীবকে বললেন, প্রবীরদা’ই প্রথম এসেছিলেন আমার ইন্টারভিউ নিতে। আমি কিন্তু আমার মতো চেঞ্জ করিনি। ডিগবাজি খাচ্ছি না। হ্যাঁ, মিডিয়াগুলোকে এড়িয়ে চলছি। স্বীকার করছি। কারণ, মিডিয়াগুলো কে যে কেমন মতিগতি নিয়ে চলে, বোঝা মুশকিল। সব মিডিয়াকে এড়ালেও প্রবীরদা’কে কিন্তু এড়াইনি।

একটা কথা বড় সত্যি যে, আমার নেওয়া বা আমার সামনে দেওয়া ডাক্তারদের ইন্টারভিউই বিশ্বের তাবড় নিউজ মিডিয়া, নিউজ এজেন্সি প্রচার করেছে। আর সেখান থেকে লাখখানেক মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে। উৎস একটাই। বিস্ময়কর হলেও এটাই সত্যি।

শেষ কথা

পোপ-ভ্যাটিকান-মাদার-মণিকা-খ্রিস্টভাতৃত্ববোধ ইত্যাদি মিলিয়ে যে ছবিটা ফুটে ওঠে, তা এ’দেশের ওঝা-ঝাড়ফুঁক-তন্ত্রমন্ত্র- জ্যোতিষীর আর-এক পিঠ।

এর-ই পাশাপাশি আরও এক সত্য হল—মাদারের লকেটে ক্যানসার সেরে ওঠার প্রচারে সাদা চামড়ার গোলামি করা মানসিকতার ভারতবাসী আরও বেশি করে মধ্যযুগীয় কুসংস্কারের দিকে ধাবিত হবে।

এমন-ই এক সংকটের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে, সুসংগঠিত ষড়যন্ত্রকে ছিন্ন করতে এক অসম্ভব জয়ের প্রয়োজন ছিল। মানুষের অগ্রগতির স্বার্থেই প্রয়োজন ছিল।

এমন-ই এক অসম্ভব ও অনন্য স্বপ্নজয়ের কাহিনি এটি।

♦ কিছু কথা

প্রথম খন্ড

♦ কিছু কথা

অধ্যায়ঃ এক

♦ মার্কিন গডম্যান মরিস সেরুলোঃ একটি ইতিহাস

অধ্যায়ঃ দুই

♦ যোগী-জ্যোতিষী হরেকৃষ্ণবাবা !

অধ্যায়ঃ তিন

♦ পঞ্চাশ বছর আগের বালক ব্রহ্মচারী এবং…

অধ্যায়ঃ চার

♦ মেঠাইবাবার রহস্যভেদ

অধ্যায়ঃ পাঁচ

♦ হাড় ভাঙ্গার দৈব-চিকিৎসা

অধ্যায়ঃ ছয়

♦ কাকদ্বীপের দৈব-পুকুর

অধ্যায়ঃ সাত

♦ আগরপাড়ায় ‘ভূতুরে’ আগুন

অধ্যায়ঃ আট

♦ প্রদীপ আগরওয়ালের সম্মোহনে ‘পূর্বজন্মে’ যাত্রা

অধ্যায়ঃ নয়

♦ কামধেনু নিয়ে ধর্মব্যবসা

অধ্যায়ঃ দশ

♦ বরানগরের হানাবাড়িঃ গ্রেপ্তার মানুষ- ভূত

অধ্যায়ঃ এগারো

♦ এফিডেভিট করে ডাক্তারের প্রশংসাপত্র নিয়ে ওঝাগিরি !

অধ্যায়ঃ বারো

♦ ‘গ্যারান্টি চিকিৎসা’র নামে হত্যাকারীর ভূমিকায় সর্পবিদ হীরেন রায়

অধ্যায়ঃ তেরো

♦ চলো যাই ফকিরবাড়ি

অধ্যায়ঃ চোদ্দ

♦ সাঁইবাবার চ্যালেঞ্জঃ পেটে হবে মোহর !

অধ্যায়ঃ পনেরো

♦ হুজুর সাইদাবাদীঃ মন্তরে সন্তান লাভ !

অধ্যায়ঃ ষোলো

♦ জলাতঙ্ক ও দৈব-চিকিৎসা

অধ্যায়ঃ সতেরো

♦ বিশ্বাসের ব্যবসায়ীরা ও নপুংসক আইন

দ্বিতীয় খন্ড

♦ কিছু কথা

অধ্যায়ঃ এক

♦ খেজুর তলার মাটি সারায় সব রোগ

অধ্যায়ঃ দুই

♦ পক্ষিতীর্থমের অমর পাখি

অধ্যায়ঃ তিন

♦ স্বামী রামদেবঃ সন্ন্যাসী, সর্বযোগসিদ্ধ যোগী, যোগচিকিৎসক !

অধ্যায়ঃ চার

♦ নাকালের দৈব-পুকুরঃ হুজুগের সুনামী

অধ্যায়ঃ পাঁচ

♦ সায়েব যখন রেইকি করে রাঘব বোয়াল চামচা ঘোরে

অধ্যায়ঃ ছয়

♦ লক্ষ্মীমূর্তি কালি হলেন আপন খেয়ালে

অধ্যায়ঃ সাত

♦ পাথর যখন কথা বলে

অধ্যায়ঃ আট

♦ ফাঁদে পড়ে জ্যোতিষী শ্রীঘরে

অধ্যায়ঃ নয়

♦ বিশ্বের বিস্ময় অলৌকিক মাতা জয়া গাংগুলী’র বিস্ময়কর পরাজয় এবং…

অধ্যায়ঃ দশ

♦ আই আই টিতে টেলিপ্যাথি দেখালেন দীপক রাও

অধ্যায়ঃ এগারো

♦ জন্ডিস সারাবার পীঠস্থান ইছাপুর

অধ্যায়ঃ বারো

♦ মালপাড়ার পেশা দাঁতের পোকা বের করা

অধ্যায়ঃ তেরো

♦ নিমপীঠের গুগি মা

তৃতীয় খন্ড

♦ কিছু কথা

অধ্যায়ঃ এক

♦ ওঝার ঝাড়ফুঁক আর টেরিজার লকেটে মণিহার রোগমুক্তিঃ কুসংস্কারের দু’পিঠ

অধ্যায়ঃ দুই

♦ ‘মেমারিম্যান’ বিশ্বরূপ-এর একটি বিশুদ্ধ প্রতারণা

অধ্যায়ঃ তিন

♦ কোটিপতি জ্যোতিষী গ্রেপ্তার হলেন

চতুর্থ খন্ড

অধ্যায়ঃ এক

♦ কিস্যা অক্টোপাস পল বিশ্বকাপ ফুটবলের ভবিষ্যৎ বক্তা

অধ্যায়ঃ দুই

♦ কিস্যা জ্যোতিষী বেজান দারওয়ালা

অধ্যায়ঃ তিন

♦ সাধারণ নির্বাচন ২০০৯ নিয়ে সব জ্যোতিষী ফেল

অধ্যায়ঃ চার

♦ মা শীতলার পায়ের ছাপ পুকুরঘাটেঃ রহস্যভেদ

অধ্যায়ঃ পাঁচ

♦ যিশুর মূর্তি থেকে রক্তপাত

অধ্যায়ঃ ছয়

♦ সত্য সাঁই-এর সত্যি-মিথ্যে

অধ্যায়ঃ সাত

♦ অলৌকিক উপায়ে সন্তান দেন ডা. বারসি

অধ্যায়ঃ আট

♦ জ্যোতিষীর বাড়িতে অলৌকিক আগুন

অধ্যায়ঃ নয়

♦ সম্মিলিত দুর্নীতির ফসল ‘মোবাইলবাবা’

অধ্যায়ঃ দশ

♦ জাতিস্মরঃ রাজেশ কুমার

♦ অলৌকিক শক্তিধরদের প্রতি চ্যালেঞ্জ

“যুক্তিবাদীর চ্যালেঞ্জাররা” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ

⇒ মন্তব্য করুন⇐

error: Content is protected !!