নাই বা পেলাম আমার গলায় তোমায় গলার হার,
তোমায় আমি করব সৃজন –এ মোর অহঙ্কার !
এমন-চোখের দৃষ্টি দিয়া
তোমায় যারা দেখ্ল প্ৰিয়া,
তাদের কাছে তুমি তুমিই । আমার স্বপনে
তুমি নিখিল-রূপের রাণী —মানস-আসনে !—
সবাই যখন তোমায় ঘিরে করবে কলরব,
আমি দূরে ধেয়ান-লোকে রব তোমার স্তব !
রচ্ব সুরধুনী-তীরে
আমার সুরের উর্বশীরে,
নিখিল-কণ্ঠে দুলবে তুমি গানের কণ্ঠ-হার—
কবির প্রিয়া অশ্রুমতী গভীর বেদনার !
যেদিন আমি থাকব না ক’ থাকবে আমার গান,
বলবে সবাই, “কে সে কবির কাঁদিয়েছিল প্রাণ?”
আকাশ-ভরা হাজার তারা
রইবে চেয়ে তন্দ্রাহারা,
সখার সাথে জাগবে রাতে, চাইবে আকাশে,
আমার গানে পড়বে মনে আমায় আভাসে !
বুকের তলা করবে ব্যথা, বলবে কাঁদিয়া,
“বন্ধু ! সে কে তোমার গানের মানসী প্রিয়া?”
হাসবে সবাই, গাইবে গীতি, —
তুমি নয়ন-জলে তিতি’
নতুন ক’রে আমার গানে আমার কবিতায়
গহীন নিরালাতে ব’সে খুঁজবে আপনায় !
রাখতে যেদিন নারবে ধরা তোমায় ধরিয়া,
ওরা সবাই ভুলবে তোমায় দুদিন স্মরিয়া,
আমার গানের অশ্রুজলে
আমার বাণীর পদ্মদলে
দুবে তুমি চিরন্তনী চির-নবীনা !
রইবে শুধু বাণী, সেদিন রইবে না বাণী !
নাই বা পেলাম কণ্ঠ আমার তোমার কণ্ঠহার,
তোমায় আমি করব সৃজন এ মোর অহঙ্কার !
এই ত আমার চোখের জলে,
আমার গানে সুরের ছলে,
কাব্যে আমার, আমার ভাষায়, আমার বেদনায়,
নিত্যকালের প্রিয়া আমায় ডাক্ছ ইশারায় !…
চাইনা তোমায় স্বর্গে নিতে, চাই এ ধূলাতে
তোমার পায়ে স্বর্গ এনে ভুবন ভুলাতে !
ঊর্ধ্বে তোমার –তুমি দেবী,
কি হবে মোর সে রূপ সেবি ?
চাই না দেবীর দয়া, যাচি প্রিয়ার আঁখিজল,
একটু দুখে অভিমানে নয়ন টলমল !
যেমন ক’রে খেলতে তুমি কিশোর রয়সে—
মাটির মেয়ের দিতে বিয়ে মনের হরষে।
বালু দিয়ে গড়ুতে গেহ,
জাগতে বুকে মাটির স্নেহ,
ছিল না ত স্বর্গ তখন সূর্য তারা চাঁদ,
তেমনি ক’রে খেলবে আবার পাবে মায়া-ফাঁদ !
মাটির প্রদীপ জ্বালবে তুমি মাটির কুটিরে,
খুশির রঙে করবে সোনা ধূলি-মুঠিরে।
আধখানা চাঁদ আকাশ ‘পরে
উঠবে যবে গরব-ভরে
তুমি বাকি-আধখানা চাঁদ হাসবে ধরাতে,
তড়িৎ ছিড়ে পড়বে তোমার খোঁপায় জড়াতে।
তুমি আমার বকুল যূথি –মাটির তারা-ফুল,
ঈদের প্রথম চাঁদ গো তোমার কানের পার্সি-দল।
কুমী-রাঙা শাড়িখানি
চৈতী সাঁঝে পরবে রানী,
আকাশ গাঙে জাগ্বে জোয়ার রঙের রাঙা বান,
তোরণ-দ্বারে বাবে করুণ বারোয়া মূলতান ।
আমার-রচা গানে তোমায় সেই বেলা-শেষে
এমুনি সুরে চাইবে কেহ পরদেশী এসে !
রঙিন সাঁজে ঐ আঙিনায়
চাইবে যারা, তাদের চাওয়ায়
আমার চাওয়া রইবে গোপন ! –এ মোর অভিমান
যাবে যারা তোমায় –রচি তাদের তরে গান !
নাই বা দিলে ধরা আমার ধরার আঙিনায়,
তোমায় জিনে গেলাম সুরের স্বয়ম্বর-সভায় !
তোমার রূপে আমার ভুবন
আলোয় আলোয় হ’ল মগন !
কাজ কি জেনে—কাহার আশায় গাঁছ ফুল-হার,
আমি তোমার গাঁথছি মালা এ মোর অহঙ্কার !
“চক্রবাক” কাব্যগ্রন্থ সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ