উন্মাদ পত্রিকার পক্ষ থেকে যখন হুমায়ুন আহমেদকে ‘এলেবেলে’ লেখার অনুরোধ করা হল তখন তিনি বললেন, “আমার সমস্ত লেখাই এলেবেলে। আমি আবার আলাদা করে এলেবেলে কেন লিখব?” তবু তিনি লিখলেন। সেই লেখাগুলি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হল। কারণ আমরা মনে করি বাংলা সাহিত্যের রম্য রচনায় ‘এলেবেলে’ কে স্থান দিতেই হবে। সাময়িক পত্রিকায় হারিয়ে যাবার মত লেখা এগুলি নয়।
সম্প্রতি একটি অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে পড়েছিলাম। এলেবেলে লেখা সেটা দিয়েই শুরু করা যাক।
বৈশাখী মেলায় গিয়েছি চার কন্যাকে সঙ্গে করে। তিনটি আমার নিজের, অন্যটি ধার করা। গিয়ে দেখি মেলার ভিড়। ঢাকা শহরের অর্ধেক লোক এসে উপস্থিত। মাটির হাঁড়িকুড়ি যা-ই দেখছে তা-ই তারা কিনে ফেলছে। অনেকটা কচ্ছপের মতো দেখতে কী যে বিক্রি হচ্ছে খুব সস্তায়–এক টাকা পিস। সবাই কিনছে, আমিও কিনলাম। তারপর কিনলাম দুখানা রবিঠাকুর। এবারের মেলায় রবিঠাকু খুব সস্তায় বিক্রি হচ্ছে। চার টাকা জোড়া। আমার ছোট মেয়েটি রবিঠাকুরকে নিয়ে আছাড় খেয়ে পড়ল। তার কিছু হলো না, মহাকবি দুটুকরা হয়ে গেলেন। কান্না থামাবার জন্যে আরেকটি কিনতে হয়। কিন্তু একবার কোনো দোকান ছেড়ে এসে আবার সেখানে ঢোকা অসব। অন্য একটি ঘরে উঁকি দিলাম। বিনীত ভঙ্গিতে বললাম, আপনাদের রবিঠাকুর আছে। দোকানি আমাকে বেকুব ঠাওরালো কি না জানি না, এক বুড়োর মূর্তি ধরিয়ে দিল। বুড়োটি খালি গায়ে বসে আছে, হাতে ইকো। বাতাস পেলেই সমানে মাথা নাড়ছে। সাদা চুল সাদা দাড়ি রবিঠাকুর যে এতে সন্দেহের কিছুই নেই।
আমরা তালের পাখা কিনলাম, মাটির কলস কিনলাম। শোলার কুমির কিনলাম (কিছুক্ষণের মধ্যেই টিকটিকির মতো এর লেজ খসে পড়ল)। দড়ির শিকা, বাঁকা হয়ে দাঁড়ানো (কলসি কাঁখে) বিশালফা বঙ্গললনা কিনলাম। আমার কন্যার দেখলাম দেশীয় সংকতির প্রতি গাঢ় অনুরাগ নিয়ে জন্মেছে। যা-ই দেখছে তা-ই তাদের চিত্তকে উদ্বেলিত করছে, তা-ই কিনবে। একসময় এদের পিপাসা পেয়ে গেল। চারজনের জন্যে চারটি কাঠি আইসক্রিম কেনা হলো। যে অস্বস্তিকর পরিস্থিতির কথা তে বলেছি, সেটা হলো তখন।
মেজ মেয়ে তার আইসক্রিম আমার দিকে বাড়িয়ে বলল, এক কামড় খাও বাবা। আমি খেলাম এক কামড়। একজন যা করে অন্য সবারও তাই করা চাই। কাজেই অন্য সবাইও আইসক্রিম বাড়িয়ে ধরতে লাগল আমার দিকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের ঘিরে ছোটোখাটো একটা ভিড় জমে উঠল। দৃশ্যটি অত। চারটি ছোট ছোট মেয়ে আইসক্রিম হাতে দাঁড়িয়ে আছে এবং একজন বয়স্ক লোক ক ক করে সবার আইসক্রিমে কামড় দিচ্ছে। যেন আইসক্রিম খাওয়ার কোনো একটা কমপিটিশন। এর মধ্যেই লক্ষ করলাম অচেনা একটা ছেলে তার বাবাকে বলছে, বাবা, আমিও ওই লোকটিকে আইসক্রিম খাওয়াব। ছেলের হাতে একটা আইসক্রিম। ভয়াবহ পরিস্থিতি। ছেলেটির বাবা আমাকে বিনীত ভঙ্গিতে বললেন, ভাই কিছু মনে করবেন না। এর আইসক্রিমটায় একটা কামড় দেন। ছেলেমানুষ একটা আবদার করছে।
এরকম ভয়াবহ পরিস্থিতিকেই বোধহয় বেকায়দা অবস্থা বলা হয়। এটা এমন একটা অবস্থা যাকে কিছুতেই কায়দা করা যায় না। অথচ এমন অবস্থায় আমাদের প্রায় রোজই পড়তে হয়।
একবার এক মফল শহরে আমাকে নিয়ে গিয়েছিল প্রধান অতিথি করে (খুব সবত গুরুত্বপূর্ণ কাউকে তারা রাজি করাতে পারেনি)। অনেক বক্তৃতা-টতৃতার পর শুরু হলো সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা। প্রথমেই একক নৃত্য-জলে কে চলে লো কার ঝিয়ারি। চৌদ্দ পনেরো বছরের এক বালিকা কলসি কাখে উপস্থিত হলো। বিশাল কলসি পানিতে কানায় কানায় ভরা। নাচের তালে তালে ছলকে ছলকে পানি পড়ছে। রিয়্যালিস্টিক টাচ দেওয়ার একটা মফলি প্রচেষ্টা। আমি অবাক হয়ে ভাবছি, জলভর্তি কলসি নিয়ে জল আনতে যাওয়ার প্রয়োজনটি কি ঠিক? তখন কলসি নিয়ে সে আছাড় খেল। ছোটখাটো একটা বান ডেকে গেল স্টেজে। প্রধান অতিথি এবং সম্মানিত সভাপতি যেহেতু স্টেজেই উপবিষ্ট ছিলেন, কাজেই তাদেরও সেই জল স্পর্শ করল। দর্শকমহলে তুমুল আনন্দ উত্তেজনা ওয়ান মোর, ওয়ান মোর ধ্বনি। অনুষ্ঠান শেষে আমি ভিজা প্যান্ট নিয়ে বাসে উঠলাম। বাসের সময় যাত্রী খুব সন্দেহজনক দৃষ্টিতে তাকাতে লাগল আমার দিকে। যার পাশে বসলাম সে অনেকখানি সরে বসল।
এটা হলে বড় ধরনের বেকায়দার গল্প। ছোট ধরনের বেকায়দাও প্রচুর ঘটছে। আমাদের চোখের সামনেই ঘটছে। একটা উদাহরণ দিলেই আপনারা ধরতে পারবেন। পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান কি আপনারা কখনো মন দিয়ে লক্ষ করেছেন? ঠিক আছে, দৃশ্যটি কল্পনা করুন-গুরুগম্ভীর একজন সভাপতি পুরস্কার দিচ্ছেন। পুরস্কার নিচ্ছে একটি তরুণী। সভাপতি ভাবলেন যেহেতু মেয়ে কাজেই সে নিশ্চয়ই হ্যান্ডশেক করবে না। মেয়েটি হাডশেক করতে গিয়ে লজ্জিত হয়ে লক্ষ করল সভাপতি হাত বাড়াচ্ছেন না। সে লাল হয়ে হাত নামিয়ে নিল। ততক্ষণে সভাপতি হাত বাড়িয়েছেন। মেয়েটি হাত নামিয়ে ফেলেছে দেখে তিনিও ঈষৎ লাল হয়ে হাত নামালেন। ইতোমধ্যে মেয়েটি হাত বাড়িয়েছে। সমগ্র দর্শক দারুণ টেনশনে ঘটনার পরিণতির জন্যে উপেক্ষা করছে।
বেকায়দা পরিস্থিতির ব্যাখ্যার জন্যে আবার শিশুদের কাছে ফিরে যাই। আমার ধারণা (এবং বদ্ধমূল বিশ্বাস) শিশুরা বড়দের প্রতি আক্রোশবশত কিছু কিছু পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। এর পেছনে শিশুসুলভ সারল্য ফারল্য বলে কিছু নেই। জনৈক দ্রমহিলা খুব দুঃখ করে একটা ঘটনা বললেন, তিনি এক বাসায় বেড়াতে গিয়েছেন।
দেখলেন। তিন বছর বয়সী একটি ছেলে পার্টিতে বসে বাথরুম সারছে। ছেলেটি তাকে দেখে লজ্জা পেয়েছে ভেবে তিনি বললেন, বাহ, খুব সুন্দর পার্টি তো তোমার! ভারী সুন্দর। আম এত সুন্দর পার্টি জন্মেও দেখিনি। ছেলেটি কোনো কথা বলল না। গম্ভীর হয়ে রইল। নাশতাটাসতা দেওয়া হয়েছে এমন সময় ছেলেটি এসে ঘোষণা করল, পার্টিটি সে সম্মানিত অতিথিকে দিয়ে দিয়েছে। এখন অতিথিকে সেখানে বসে বাথরুম করতে হবে। ছেলের মা বিব্রত হয়ে বললেন, ছিঃ লক্ষ্মীসোনা, এসব কী বলে? তোমার খালা হয় না?
কিন্তু ততক্ষণে ওর মাথায় ব্যাপারটা ঢুকে গেছে। কাজেই সে হাত-পা ছুড়ে বিকট চিৎকার শুরু করেছে। চায়ের কাপটাপ উল্টে ফেলছে। তাকে সামলাবার জন্যে শেষ পর্যন্ত ভদ্রমহিলাকে পার্টিতে বসার একটা ভঙ্গি করতে হলো।
অনেকেই বলেন শিশুরা সত্যবাদী হয়। আমার মনে হয় না কথাটা ঠিক। তারা সত্যি কথা বলে তখনই যখন কাউকে বিব্রত করা প্রয়োজন হয়। ঘটনাটি বলি।
একজন সংস্কৃতিবান মহিলাকে আমি চিনতাম, যিনি আমার লেখালেখি নিয়ে নানান সময় উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতেন। মাঝে মধ্যেই যেতাম তার বাসায়। সাহিত্য, তার উদ্দেশ্য–ওইসব নিয়ে উচ্চমার্গের কথাবার্তা হতো। সেদিনও তার বাসায় গিয়েছি। বাংলাদেশে কেন তুর্গেনিতের মতো বড় ঔপন্যাসিকের জন্ম হলো না এই নিয়ে কথা হচ্ছে। এমন সময় তার ছোট মেয়েটি হঠাৎ কথা বলল, চাচা, আম্মু না আপনাকে ছাগল ডাকে।
অধিক শোকে পাথর বলে যে কথাটা প্রচলিত আছে সেটা মিথ্যা নয়। ভদ্রমহিলা পাথর হয়ে গেলেন। তুর্গেনিভ প্রসঙ্গ আর জমল না।
এলেবেলে লেখা শেষ করার আগে অস্বস্তিকর পরিস্থিতি নিয়ে একটি ফরাসি রসিকতা বলি। একজন ফরাসি তরুণী (অবশ্যই রূপবতী এবং…) সন্ধ্যাবেলা তার কুকুরটিকে নিয়ে পার্কে হাঁটতে গেছেন। সেখানে দেখা হলো এক বুড়োর সঙ্গে। বুড়োটিও একটি কুকুর নিয়ে পার্কে এসেছে। না, এই রসিকতাটি বলা যাবে না। রসিকতাটা প্রাপ্তবয়স্কদের জন্যে এবং আমার ধারণা উদ-এর পাঠক-পাঠিকারা সবাই অপ্রাপ্তবয়স্ক। এই গল্প তারা হজম করতে পারবে না।
“এলেবেলে- ১ম পর্ব” গল্প সমগ্র সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ