ভদ্রলোক কঠিন গলায় বললেন, আপনি কি সেই লেখক?

আমি হ্যাঁ বলব না না বলব বুঝতে পারলাম না। সেই লেখক বলতে ভদ্রলোক কি বোঝাতে চাচ্ছেন কে জানে? তিনি যে আমার সঙ্গে রসালাপ করতে আসেননি তা বুঝতে পারছি। সাপের চোখের মত কঠিন চোখে তাকাচ্ছেন। চোখে পলক পড়ছে না।

ভদ্রলোক চেয়ারে বসতে বসতে বললেন, ঘরে কি বাংলা অভিধান আছে? আমি বিনীত ভঙ্গিতে বললাম, জ্বি আছে।

: নিয়ে আসুন।

পাগল টাইপ মানুষদের বেশী ঘাটাতে নেই–আমি অভিধান নিয়ে এলাম! ভদ্রলোক বললেন, আপনার একটি উপন্যাসে গণ্ডগ্রাম শব্দটা পেয়েছি। গণ্ডগ্রাম শব্দের মানে কি বলুন।

: গণ্ডগ্রাম হচ্ছে অজ পাড়া গাঁ।

: অভিধান খুলে দেখুন।

অভিধান খুললাম। অভিধানে লেখা–গণ্ডগ্রাম হচ্ছে বড় গ্রাম, প্রধান গ্রাম, বর্ধিষ্ণুগ্রাম। কি সর্বনাশের কথা।

ভদ্রলোক চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, বাংলা না জেনে বাংলা লিখতে যান কেন? আগে তো ভাষাটা শিখবেন, তারপর গল্প উপন্যাস লিখবেন।

ভদ্রলোক আরো একগাদা কথা শুনিয়ে বিদেয় হলেন। আমি সঙ্গে সঙ্গে আমার এক অধ্যাপক বন্ধুকে টেলিফোন করলাম। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক। আমি বললাম, অভিধান না দেখে বলুনতো গণ্ডগ্রাম মানে কি? অধ্যাপক বন্ধু বললেন, গণ্ডগ্রাম মানে অজ পাড়া গা। ছোট্র ক্ষুদ্র গ্রাম।

দয়া করে অভিধান দেখে বলুন।

: অভিধান দেখার দরকার নেই।

: দরকার না থাকলেও দেখুন।

অধ্যাপক বন্ধু অভিধান দেখলেন। বেশ কয়েকটাই বোধ হয় দেখলেন। কারণ টেলিফোনে কথা বলতে তার অনেক সময় লাগল।

: অভিধান দেখেছেন?

: হুঁ।

: ব্যাপারটা কি বলুনতো? আপনি ভুল না অভিধান ভুল?

: অভিধানও ঠিক আছে। আমিও ঠিক আছি।

: তার মানে?

: গণ্ডগ্রাম শব্দটির আসল মানে বড় গ্রাম, প্রধান গ্রাম কিন্তু সবাই ভুল করে অজ পাড়া গাঁ অর্থে গণ্ডগ্রাম ব্যবহার করতে থাকল। আজ তাই অজ পাড়া গাঁ হচ্ছে স্বীকৃত অর্থ। এটাই শুদ্ধ।

: অভিধান তা হলে বদলাতে হবে?

: তাতো হবেই। ভাষা কোন স্থির কিছু নয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটা বদলাতে পারে। শব্দের অর্থ পাল্টে যেতে পারে।

অধ্যাপক বন্ধুর কথা আমাকে খানিকটা ধাঁধায় ফেলে দিলেও ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করে দেখলাম তিনি খুব ভুল বলেননি। কিছু কিছু শব্দের অর্থ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সত্যি পাল্টে যাচ্ছে। যতই দিন যাচ্ছে ততই উল্টো অর্থ হচ্ছে। যেমন ধরুন–বুদ্ধিজীবী। অভিধানিক অর্থ হচ্ছে–বুদ্ধি বলে বা বুদ্ধির কাজ দ্বারা জীবিকা অর্জনকারী।

আজ বুদ্ধিজীবী শব্দের অর্থ কি দাঁড়িয়েছে? আজ বুদ্ধিজীবী শব্দটি গালাগালি অর্থে ব্যবহৃত হচ্ছে। বুদ্ধিজীবী বলতে আমরা বুঝি নাকউঁচু সুবিধাবাদী একদল মানুষ যাদের প্রধান কাজ হচ্ছে বিবৃতি দেয়া।

আমার এক বন্ধু কিছুদিন আগে বলছিলেন–দেশে কত রকম আন্দোলন হয়। আন্দোলনে ছাত্র মরে, শ্রমিক মরে, টোকাই মরে কিন্তু কখনো কোন বুদ্ধিজীবী মরে না। ছলে বলে কৌশলে তারা বেঁচে থাকে। কারণ তারা মরে গেলে বিবৃতি দেবে কে? শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির দেখভাল করবে কে? সভা-সমিতিতে প্রধান অতিথি, বিশেষ অতিথি হবে কে?

আমার লেখার ভঙ্গি দেখে কেউ কেউ মনে করে বসতে পারেন আমি বিবৃতি দেয়াটাকে খুব সহজ কাজ ধরে নিয়ে ব্যাপারটাকে ছোট করতে চাচ্ছি। মোটেই তা না। আমি এ দেশের একজন বুদ্ধিজীবীর বিবৃতিতে সই করার সময়ের কি অন্তরঙ্গ মুহূর্ত দেখেছি–আমি জানি কাজটা কত কঠিন।

বিবৃতিতে সই করার সময় একজন বুদ্ধিজীবীকে কত দিকেই না খেয়াল করতে হয়। প্রথমেই দেখতে হয় তার আগে কারা কারা সই করেছে। যারা সই করেছে তাদের ব্যাকগ্রাউণ্ড কি? প্রো চায়না, প্রো রাশিয়া না কি আমেরিকা পন্থী? তারপর চিন্তা করতে হয় বিবৃতিতে সই করলে সরকারী লোকজন ক্ষেপে যাবে কি-না, সই না করলে পাবলিক ক্ষেপবে কি না।

এ ছাড়াও সমস্যা আছে–খবরের কাগজে তার নাম ঠিকমত ছাপা হবে তো? সিনিয়ারিটি মেইনটেইন করা হবে তো। তাঁর আগে কোন চেংড়ার নাম চলে যাবে না তো?

আমি লক্ষ্য করে দেখেছি বুদ্ধিজীবীরা বড়ই সাবধানী। তারা কাউকেই রাগাতে চান না। নিজেরাও রাগেন না। তাদের মুখের হাসি হাসি ভাবটা থেকেই যায়। তারা এই অসম্ভব কি করে সম্ভব করেন কে জানে।

মূল বিষয় থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। শুরু করেছিলাম শব্দের অর্থ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কি ভাবে বদলায় তার উপর গুরু গম্ভীর আলোচনা দিয়ে। সেখানেই ফিরে মাই। অর্থ বদলে যাচ্ছে এমন কিছু শব্দ আমি বের করেছি–ঠিক আছে কিনা দেখুনতো—

          প্রাচীন অর্থ — বর্তমান অর্থ —  ভবিষ্যৎ অর্থ

ছাত্রঃ  শিক্ষার্থী–  যে শিক্ষা দেয় —      ?

           (যে শিক্ষা গ্রহণ করে)

নেতাঃ  পথ প্রদর্শক —     পথ দেখানোর দায়িত্ব

         (অগ্রে চলেন যিনি) — এড়াবার জন্যে

                                       পশ্চাতে চলেন যিনি।

না, এ লেখাটা বড় শুকনো ধরণের হয়ে যাচ্ছে। বুঝতে পারছি পাঠকরা ইতিমধ্যেই যথেষ্ট বিরক্ত হয়েছেন। কি করব বলুন, মাঝে মাঝে ঠাট্রা মশকরা কিছুতেই আসতে চায় না। নিজের উপর, নিজের চারপাশের জগতের উপর প্রচণ্ড রাগ হয়। সেই রাগ গুছিয়ে প্রকাশ করতে পারি না তখন ইচ্ছা করে ……

থাক ইচ্ছার কথা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা গল্প বলে শেষ করি। শোনা গল্প। সত্য মিথ্যার দায়-দায়িত্ব নিচ্ছি না।

হার্টজগ তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বাংলার অধ্যাপক। তিনি রিডার (সহযোগী অধ্যাপক) পদে একজন শিক্ষকের নিয়োগ দিতে চাইলেন। হার্টজগ বললেন, একজন রিডরি না নিয়ে দুজন লেকচারার নিন।

হরপ্রসাদ বললেন, তা হলে একটা গল্প শুনুন। এক লম্পট সাহেবের অভ্যাস ছিল প্রতিরাতে ষোলবছর বয়েসী তরুণীর সঙ্গে নিশিযাপন। নিত্য নতুন ষোল বছর বয়েসী তরুণী জোগাড় করার দায়িত্ব ছিল বাড়ির খানসামার। এক রাতে সে মুখ কাচুমাচু করে বলল, ষোল বছর তো পাওয়া গেল না স্যার। আটবছর বয়সের দুজন নিয়ে এসেছি। আটে আটে ষোল হয়ে গেল।

হরপ্রসাদ শাস্ত্রী গল্পের এই পর্যায়ে হঠাৎ নীচুগলায় বললেন, মিঃ হর্টিজ আশা করি বুঝতে পারছেন, একজন ষোল বছরের কাছ থেকে যা পাওয়া যাবে দুজন আট বছরের কাছ থেকে তা পাওয়া যাবে না।

হার্টজগ কোন কথা না বলে তৎক্ষণাৎ লিখিত হুকুম দিলেন টাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে একজন রিডার (সহযোগী অধ্যাপক) নিয়োগ করা হোক।

আজকের এলেবেলে এই পর্যন্ত থাক। আজ কেন জানি কোন কিছুই জমছে না।

error: Content is protected !!
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x