ওপরের শিরোনামে প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়েছিল ‘আজকাল’ পত্রিকায় ৮ ডিসেম্বর ’৯৩-তে।
এমন ওঝার খবর পেয়ে ‘আজকাল’ পত্রিকার তরফ থেকে ছুটে গিয়েছিলাম। সঙ্গী ছিলেন চিত্রসাংবাদিক শিখর কর্মকার।
সত্যচরণ তরফদার। বয়স ৫৫। রানাঘাটের পালপাড়া গ্রামের বাসিন্দা। পেশায় ওঝা। ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে দস্তুরমত এফিডেভিট করেই ওঝাগিরি করেন। ৩০ বছর ধরে চুটিয়ে ব্যবসা করছেন। হাবিবপুর স্টেশন থেকে মিনিট দশ হাঁটলেই তাঁর বিশাল একতলা বাড়ি। বাড়িতে ঢোকার মুখে, ডানদিকে মনসা মন্দির। দোরগোড়ায় দুধসাদা অ্যাম্বাসাডার মার্ক ফোর। সম্প্রতি কিনেছেন। কিনেছেন রাঘব বাজারের কাছে ১০ কাঠা জমিও। চার ছেলে। তিন মেয়ে। ওঝাগিরির আয়ে চকচক করছে তাঁর সংসার। দুই মেয়েকে ধুমধাম করে বিয়ে দিয়েছেন। বাবার পিঠে হেলান দিয়ে তিন ছেলেও দাঁড়িয়ে গেছে। ছোট মেয়ে এবার উচ্চমাধ্যমিক দেবে। ছোট ছেলেও নাইনের ছাত্র। বাড়িতে উপচে পড়ছে নানাজনের প্রশংসাপত্র। তাঁদের কেউ ডাক্তার, কেউ মোক্তার, কেউ বা পার্টির নেতা। সত্যচরণের উচ্চতা মাঝারি। চেহারাও সাধারণ। কিন্তু এলাকায় কেউকেটা। গত পাঁচ বছর রামনগর গ্রাম পঞ্চায়েতের সদস্য ছিলেন। বরাবর সি পি এম করেন। তন্ত্রসাধনায় হাতে খড়ি ৩০ বছর আগে। গুরুর নাম কাফরি দাস। সত্যচরণ মন্দিরেই তন্ত্রসাধনা করেন। তাঁর মানুষ-প্রমাণ মনসামূর্তির পায়ের কাছে সাজানো আছে খুলি, শুয়োরের চোয়াল ও পাঁচটি শকুনের হাড়। মন্দির চত্বরে বসেই সত্যচরণ জানালেন, ‘গত তিরিশ বছরে সাপে-কাটা মানুষ বাঁচানোর হিসেব পাচ্ছি ৫ হাজার ৬-শোর মত। বাকিদের হিসেব নেই। ঠিকমতো রাখতে পারিনি। আমার হাতে একটাও সাপে কাটা রোগী মরেনি।
তাঁর দাবি উড়িয়ে দিলেন এক পড়শি। বললেন, ‘বিষাক্ত সাপে কাটা রোগেী এলেই সত্য চরণ হাসপাতালে পাঠাতে বলেন।’ একই অভিযোগ সত্যচরণের বহু পড়শির, কিন্তু কিছুতেই তাঁরা নাম প্রকাশে রাজি হলেন না, সত্যচরণের রাজনৈতিক প্রভাবের কথা ভেবে। পড়শিদের অভিযোগটি সত্যচরণের কাছে হাজির করতেই বললেন, ‘হ্যাঁ, ওরা ঠিকই বলেছে। সেই সব রোগীদের হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলি, যাদের ঢোঁকটুকুও গেলার অবস্থা নেই। আমি মন্ত্রের সঙ্গে সঙ্গে নাগদময়ন্তী গাছের শিকড় বেটেও খাওয়াই। দুয়ে মিলে রোগী সারে।’
আমার অনুরোধে মন্ত্রটা পাঠ করলেন। মন্ত্র টেপবন্দি করলাম। সত্যচরণ জানালেন, সাপে কাটা রোগীকে নাগদময়ন্তী গাছের শিকড় বেটে খাওয়াবার পাশাপাশি মন্ত্রের টেপটা একবার বাজালেও, রোগী বাঁচবে। উর্দু, হিন্দি ও বাংলা মেশানো চল্লিশ সেকেন্ডের মন্ত্র। শুধু মানুষ নয়, একইভাবে পশুকেও বাঁচানো যায়। সম্প্রতি একটি গরুকেও নাকি এভাবে বাঁচিয়েছেন। বললাম, ‘এ বাংলার শতকরা ৮৫ ভাগ সাপই তো নির্বিষ। সুতরাং নির্বিষে সাপে-কাটা রোগীই তো আপনার কাছে বেশি আসতে বাধ্য। আর তাঁরা বাঁচবেনই, আপনি, কিছু করুন বা না করুন। বিষাক্ত সাপে কাটলেই রোগীকে আপনি হাসপাতালে পাঠান। বাঁচানোর ক্ষমতা আপনার নেই, এটা জানেন বলে—এই অভিযোগ যদি আপনার বিরুদ্ধে আনি, কী বলবেন ? ”
‘আপনার কথার উত্তর দেবে দু’জন রেজিস্টার্ড ডাক্তারের সার্টিফিকেট।’ দুটি বাঁধানো প্রশংসাপত্র তুলে দিলেন আমার হাতে। একটি দিয়েছেন ডাঃ আশিসকুমার মজুমদার, এম বি বি এস, ডি টি এম অ্যান্ড এইচ (ক্যাল), এফ আর এস টি এম অ্যান্ড এইচ (লন্ডন) রেজিস্ট্রেশন নম্বর ২৭৮৬৪। ডাঃ মজুমদারের ইংরেজি প্রশংসাপত্রের বাংলা তর্জমা করলে দাঁড়ায়, সত্যচরণ তরফদার ‘সাপে-কাটা রোগীর ক্ষেত্রে একজন বিখ্যাত ওঝা। …’ কিছু বিষাক্ত সাপে কাটা রোগী তাঁর হতে আরোগ্যলাভ করেছেন। তাঁর সঙ্গে, সকলকে সহযোগিতা করতে আহ্বান জানাচ্ছি।’ দ্বিতীয় প্রশংসাপত্রটি ডাঃ সলিল মুখার্জি, এম বি বি এস, ডি পি এইচ (ক্যাল) দিয়েছেন। রেজিস্ট্রেশন নম্বর ২৩৮২২। তিনি শুধু লিখেছেন, ওঝা সত্যচরণ বাতব্যাধি ও সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসা করেন।
রামনগর ২ নম্বর গ্রাম পঞ্চায়েত অফিসে নিয়ে গেলেন সত্যচরণবাবু। পঞ্চায়েত প্রধান দীনেশচন্দ্র ঘোষ সত্যবাবুর ওঝাগিরির প্রচুর প্রশংসা করলেন। দীনেশবাবু পঞ্চায়েত প্রধানের রাইটিং প্যাডে সত্যচরণ সম্পর্কে লিখেছিলেন, ‘… দূর-দূরান্ত হইতে সাপের কাটা রুগীগণ সুচিকিৎসার জন্য এখানে আসিয়া থাকেন এবং প্রতিটি রুগীই সম্পূর্ণ সুস্থ ও স্বাভাবিক হইয়া বাড়িতে ফিরিয়া যান।’
হাবিবপুরের প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের চিকিৎসক ডাঃ পরমার্থ চ্যাটার্জি জানালেন, স্বাস্থ্যকেন্দ্রে বিষাক্ত সাপে-কাটা রোগীর একমাত্র জীবনদায়ী ওষুধ অ্যান্টি ভেনম সিরাম নেই। দীর্ঘ দিন ধরেই নেই। তাই বোধহয় সাধারণের শেষ ভরসা ওঝাই।
ডাঃ সলিল মুখার্জির সঙ্গে তাঁর রানাঘাটের বাড়িতে দেখা করি। স্মার্ট মানুষ। সরাসরি অস্বীকার করলেন, ‘ওঝাকে আমি কোনও সার্টিফিকেট দিইনি।’ সার্টিফিকেট দেখাতে বয়ান বদলে বললেন, হ্যাঁ সত্যচরণ বলেছিল, তাই এ সব লিখে দিয়েছি।
এবার ওয়েস্ট বেঙ্গল মেডিকেল কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট ডাঃ জ্যোতির্ময় মজুমদারের দ্বারস্থ হলাম। বললাম, ওঝাকে সার্টিফিকেট দিয়েছেন দুই ডাক্তার। এটা সম্পূর্ণ বে-আইনি কাজ। তাঁদের এই সার্টিফিকেটে বিশ্বাস করে কোনও বিষাক্ত সাপে কাটা রোগী গেলে মৃত্যু অনিবার্য। এই মৃত্যুর দায় অবশ্যই এই দায়িত্বজ্ঞানহীন চিকিৎসকের।
জ্যোতির্ময়বাবু জানালেন, খোঁজ-খবর না করে এ রকম সার্টিফিকেট দেওয়া ঠিক নয়। কেউ দিয়ে থাকলে তাঁদের শাস্তি হবে। রেজিস্ট্রেশনও বাতিল হতে পারে। সত্যি কি দুই ডাক্তারের শাস্তি হবে? দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি? আমাদের সমিতির তরফ থেকে দুই ডাক্তারের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দায়ের করলাম।
৭ জানুয়ারি ১৯৯৪ আজকাল পত্রিকায় একটি খবর প্রকাশিত হয়েছিল। খবরটি এই : পশ্চিমবঙ্গ মেডিকেল কাউন্সিলের অস্থায়ী রেজিস্ট্রার ডি কে ঘোষ শোকজ করেছেন ডাঃ আশিস মজুমদার এবং ডাঃ সলিল মুখার্জিকে। নদীয়ার হবিবপুরের এক ওঝা সাপে কাটা রোগীদের বাঁচিয়ে দিয়েছে—এই সার্টিফিকেট দেওয়ার জন্যই শোকজ। যুক্তিবাদী সমিতির প্রবীর ঘোষ জানিয়েছেন, শোকজের খবর ডি কে ঘোষ চিঠি মারপত তাঁকে জানিয়েছেন। এই ওঝার সম্পর্কে প্রতিবেদন তিনিই পেশ করেছিলেন আজকালে ।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত ডাক্তার দু’জন অন্যায় স্বীকার করে ক্ষমা চেয়ে পার পেয়েছেন। এটা একটা ঘটনা। একটা ইতিহাস।
প্রথম খন্ড
অধ্যায়ঃ এক
♦ মার্কিন গডম্যান মরিস সেরুলোঃ একটি ইতিহাস
অধ্যায়ঃ দুই
♦ যোগী-জ্যোতিষী হরেকৃষ্ণবাবা !
অধ্যায়ঃ তিন
♦ পঞ্চাশ বছর আগের বালক ব্রহ্মচারী এবং…
অধ্যায়ঃ চার
অধ্যায়ঃ পাঁচ
অধ্যায়ঃ ছয়
অধ্যায়ঃ সাত
অধ্যায়ঃ আট
♦ প্রদীপ আগরওয়ালের সম্মোহনে ‘পূর্বজন্মে’ যাত্রা
অধ্যায়ঃ নয়
অধ্যায়ঃ দশ
♦ বরানগরের হানাবাড়িঃ গ্রেপ্তার মানুষ- ভূত
অধ্যায়ঃ এগারো
♦ এফিডেভিট করে ডাক্তারের প্রশংসাপত্র নিয়ে ওঝাগিরি !
অধ্যায়ঃ বারো
♦ ‘গ্যারান্টি চিকিৎসা’র নামে হত্যাকারীর ভূমিকায় সর্পবিদ হীরেন রায়
অধ্যায়ঃ তেরো
অধ্যায়ঃ চোদ্দ
♦ সাঁইবাবার চ্যালেঞ্জঃ পেটে হবে মোহর !
অধ্যায়ঃ পনেরো
♦ হুজুর সাইদাবাদীঃ মন্তরে সন্তান লাভ !
অধ্যায়ঃ ষোলো
অধ্যায়ঃ সতেরো
♦ বিশ্বাসের ব্যবসায়ীরা ও নপুংসক আইন
দ্বিতীয় খন্ড
অধ্যায়ঃ এক
♦ খেজুর তলার মাটি সারায় সব রোগ
অধ্যায়ঃ দুই
অধ্যায়ঃ তিন
♦ স্বামী রামদেবঃ সন্ন্যাসী, সর্বযোগসিদ্ধ যোগী, যোগচিকিৎসক !
অধ্যায়ঃ চার
♦ নাকালের দৈব-পুকুরঃ হুজুগের সুনামী
অধ্যায়ঃ পাঁচ
♦ সায়েব যখন রেইকি করে রাঘব বোয়াল চামচা ঘোরে
অধ্যায়ঃ ছয়
♦ লক্ষ্মীমূর্তি কালি হলেন আপন খেয়ালে
অধ্যায়ঃ সাত
অধ্যায়ঃ আট
অধ্যায়ঃ নয়
♦ বিশ্বের বিস্ময় অলৌকিক মাতা জয়া গাংগুলী’র বিস্ময়কর পরাজয় এবং…
অধ্যায়ঃ দশ
♦ আই আই টিতে টেলিপ্যাথি দেখালেন দীপক রাও
অধ্যায়ঃ এগারো
♦ জন্ডিস সারাবার পীঠস্থান ইছাপুর
অধ্যায়ঃ বারো
♦ মালপাড়ার পেশা দাঁতের পোকা বের করা
অধ্যায়ঃ তেরো
তৃতীয় খন্ড
অধ্যায়ঃ এক
♦ ওঝার ঝাড়ফুঁক আর টেরিজার লকেটে মণিহার রোগমুক্তিঃ কুসংস্কারের দু’পিঠ
অধ্যায়ঃ দুই
♦ ‘মেমারিম্যান’ বিশ্বরূপ-এর একটি বিশুদ্ধ প্রতারণা
অধ্যায়ঃ তিন
♦ কোটিপতি জ্যোতিষী গ্রেপ্তার হলেন
চতুর্থ খন্ড
অধ্যায়ঃ এক
♦ কিস্যা অক্টোপাস পল বিশ্বকাপ ফুটবলের ভবিষ্যৎ বক্তা
অধ্যায়ঃ দুই
♦ কিস্যা জ্যোতিষী বেজান দারওয়ালা
অধ্যায়ঃ তিন
♦ সাধারণ নির্বাচন ২০০৯ নিয়ে সব জ্যোতিষী ফেল
অধ্যায়ঃ চার
♦ মা শীতলার পায়ের ছাপ পুকুরঘাটেঃ রহস্যভেদ
অধ্যায়ঃ পাঁচ
অধ্যায়ঃ ছয়
অধ্যায়ঃ সাত
♦ অলৌকিক উপায়ে সন্তান দেন ডা. বারসি
অধ্যায়ঃ আট
♦ জ্যোতিষীর বাড়িতে অলৌকিক আগুন
অধ্যায়ঃ নয়
♦ সম্মিলিত দুর্নীতির ফসল ‘মোবাইলবাবা’
অধ্যায়ঃ দশ
“যুক্তিবাদীর চ্যালেঞ্জাররা” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ