‘অসম্ভব ব্যাপারগুলোকে যখন তুমি বাদ দিয়ে দেবে, তখন যা পড়ে থাকবে তা যতই
অদ্ভুত মনে হোক না কেন, সেটাই অবশ্যম্ভাবীভাবে সত্য’।
—আর্থার কোন্যান ডয়েল, ডক্টর ওয়াটসনকে শার্লক হোমস
একটি প্রশ্ন দিয়ে শুরু হয়েছিল বইটি। ‘এই যে আমাদের চারদিকের প্রকৃতি—চাঁদ, তারা, সূর্য,পৃথিবী,গাছপালা, পশুপাখি, মানুষজন—এই সবকিছু এল কোথা থেকে?’ Where did everything come from? নতুন কোনো প্ৰশ্ন নয় যদিও। আমাদের অস্তিত্বের একেবারে গোড়ার দিকের খুব পুরনো প্রশ্ন এগুলো। কুমোর, কামার, জেলে, তাঁতি, শিক্ষক, শ্রমিক, রিকশাচালক কিংবা ব্লগার, যেই হোক না কেন, আর যে কাজেই আমরা জড়িত থাকি না কেন, কোনো এক রাতে খোলা আকাশের নিচে চলতে চলতে হঠাৎ এই অন্তিম প্রশ্নের ধাক্কায় শিহরিত হয়নি, এমন মানুষ বোধ হয় কম। একটুখানি জ্ঞানবুদ্ধি হবার পরই খোকা মাকে শুধায় ‘মা, এলাম আমি কোথা থেকে?’ ইয়স্তেন গার্ডারের ‘সোফির জগৎ’-এর শিশুচরিত্র সোফির হঠাৎ একদিন মনে হয়েছিল, “এই জগৎটা কোথা থেকে এল’ – এটা একটা খুব সংগত প্রশ্ন; ‘জীবনে এই প্রথমবারের মতো সে উপলব্ধি করল যে জগৎটা কোথা থেকে এলো এই ধরনের প্রশ্ন না করে এ জগতে বেঁচে থাকাটা ঠিক নয়। হ্যাঁ, এ ধরনের প্রশ্নের আঘাতে কেবল শিশু বা সাধারণ মানুষেরা নয়, আন্দোলিত হয়েছেন, ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন বিভিন্ন যুগের প্রথিতযশা বিজ্ঞানী, দার্শনিক, গণিতবিদ, চিন্তাবিদ, কবি-সাহিত্যিক কিংবা মরমি সাধকেরা। মজার ব্যাপার হলো, এই কিছুদিন আগ পর্যন্ত এই প্রশ্নগুলো কেবল ধর্মবেত্তা আর ধর্মগুরুদেরই করায়ত্ত ছিল। তাঁরা এর উত্তর দিয়েছে প্রাচীন উপকথা আর নিজ নিজ ধর্মীয় বিশ্বাসের কাঠামোর ওপর দাঁড়িয়ে। এ নিয়ে ধর্মগ্রন্থগুলো সাজিয়েছে নানা ধরনের সৃষ্টিবাদী গল্পের পসরা। এ ছাড়া উপায় যে খুব ছিল তা নয়। আসলে
ইয়স্তেন গার্ডার, সোফির জগৎ, অনুবাদ, জি এইচ হাবীব, সন্দেশ, ২০০২
অস্তিত্বের এ অন্তিম প্রশ্নগুলো গণ্য করা হতো বিজ্ঞানের জগতের বাইরের বিষয় হিসেবে। কিন্তু বিগত কয়েক দশক ধরে আমরা দেখছি, বিজ্ঞান বোধ হয় রূপকথা আর উপকথার জগৎ থেকে ক্রমশ আমাদের টেনে নিয়ে এক রূঢ় বাস্তবতার মুখোমুখি করিয়ে দিতে চাইছে। মানবসভ্যতাকে যে রহস্য আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে, দুই হাজার বছর ধরে দার্শনিক আর চিন্তাবিদেরা যে প্রশ্নের উত্তর আঁতি- পাঁতি করে খুঁজে ফিরছিলেন, আধুনিক পদার্থবিদরা আমাদের শেষ পর্যন্ত সেই প্রশ্নের একটি সম্ভাব্য উত্তর হাজির করেছেন – ‘সবকিছুই এসেছে শূন্য থেকে’। হ্যাঁ, আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানীদের গবেষণালব্ধ ফলাফল অনুযায়ী আমাদের এই বিপুল মহাবিশ্বের উদ্ভব ঘটেছে স্রেফ ‘শূন্য’ থেকে
না, শূন্য থেকে মহাবিশ্বের উদ্ভবের ধারণাটি নতুন কিছু নয়। যাঁরা আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের গতিপ্রকৃতির খোঁজ-খবর রাখেন, তাঁরা সবাই মোটামুটি জানেন যে, বেশ অনেক দিন ধরেই এটি পদার্থবিজ্ঞানের মূলধারার গবেষণার অন্তর্ভুক্ত। সেই আশির দশকে স্ফীতি তত্ত্বের আবির্ভাবের পর থেকেই বহু বিখ্যাত বিজ্ঞানী এ নিয়ে কাজ করেছেন। তাঁদের অনেকে আবার জনপ্রিয় ধারার বইপত্রও প্রকাশ করেছেন। তবে সেসব কিছুই মূলত ইংরেজিতে। বাংলায় এ ব্যাপারে রসদ ছিল একেবারেই কম। তার পরও কিছু চেষ্টা চালিয়েছিলাম মুক্তমনায় আমার নিজস্ব ব্লগে ও অন্যত্র। মনে পড়ছে, ২০০৫ সালে লেখা আমার (অ.রা) প্রথম বইটিতেই তথাকথিত শূন্য থেকে কিভাবে জড় কণিকার উৎপত্তি হয়, তা নিয়ে পাঠকদের জন্য বিশদভাবে আলোচনা করেছিলাম একটি অধ্যায়ে। এর পর থেকে আমার নানা লেখায় বিষয়টি ঘুরেফিরে এসেছে বিভিন্ন সময়েই। সম্প্রতি স্টিফেন হকিং-এর ‘গ্র্যান্ড ডিজাইন’ ও লরেন্স ক্রাউসের ‘ইউনিভার্স ফ্রম নাথিং’ নামের বইটি রিভিউ করতে গিয়েও এ বিষয়টির কিছু পুনরাবৃত্তি করতে হয়েছিল। তার পরও লেখক হিসেবে কোথায় যেন খেদ থেকে গিয়েছিল একটা। খেদটা বোধ হয় অপূর্ণতার। ব্লগে ও ম্যাগাজিনে কিংবা এদিক-সেদিকে লেখালেখি করলেও বিষয়বস্তুর সাথে সংগতিপূর্ণ কোনো পূর্ণাঙ্গ বইয়ের জন্য সেভাবে বিষয়টি নিয়ে লেখা হয়ে ওঠেনি। আমাদের এবারকার বইয়ের বিষয়বস্তুই যেহেতু ‘শূন্য থেকে মহাবিশ্ব’, আমরা এই ধারণাটির পেছনের ইতিহাস এবং কিছু কারিগরি দিক নিয়ে আগের চেয়ে কিছুটা বিস্তৃত জায়গায় পৌঁছে যেতে পারব বলে আশা করছি।
অভিজিৎ রায়, আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী, অঙ্কুর প্রকাশনী, ২০০৫; মূল বইয়ের সপ্তম অধ্যায় দ্রষ্টব্য।
স্টিফেন হকিং-এর বইটির রিভিউ প্রকাশিত হয়েছে অভিজিৎ রায়, শহিদুল ইসলাম ও ফরিদ আহমেদ সম্পাদিত (সভাপতি অজয় রায়) ‘বিশ্বাস ও বিজ্ঞান’ (চারদিক, ২০১২) বইয়ে।
অভিজিৎ রায়, অস্তিত্বের অন্তিম প্রশ্নের মুখোমুখিঃ কেন কোনো কিছু না থাকার বদলে কিছু আছে?, মুক্তমনা, সেপ্টেম্বর ২৩, ২০১২
শূন্য থেকে কীভাবে মহাবিশ্ব উদ্ভূত হতে পারে সেটা জানতে হলে প্রথমে আমাদের কোয়ান্টাম শূন্যতার ব্যাপারটি বুঝতে হবে। আসলে খুব কম কথায় বললে, কোয়ান্টাম তত্ত্বানুযায়ী শূন্যতাকে অনেক তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করা হয়। শূন্যতা মানে আক্ষরিক অর্থে শূন্য নয়- পদার্থবিজ্ঞানীদের মতে যে শূন্য-দেশকে আপাতদৃষ্টিতে শান্ত, সমাহিত মনে হচ্ছে, তার সূক্ষ্মস্তরে সবসময়ই নানান প্ৰক্ৰিয়া ঘটে চলেছে। এর মধ্যে নিহিত শক্তি থেকে পদার্থ-কণা স্বতঃস্ফূর্তভাবে তৈরি হচ্ছে, আবার তারা নিজেকে সেই শক্তিতে বিলীন করে দিচ্ছে। যেমন, শূন্যাবস্থা থেকে সামান্য সময়ের ঝলকানির মধ্যে ইলেকট্রন ও পজিট্রন (পদার্থ-প্ৰতি পদার্থ যুগল) থেকে পদার্থ তৈরি হয়েই আবার তা শূন্যতায় মিলিয়ে যেতে পারে। এই ইলেকট্রন ও পজিট্রনের মধ্যকার ব্যবধান থাকে ১০-১০ সেন্টিমিটারেরও কম, এবং পুরো ব্যাপারটার স্থায়িত্বকাল মাত্র ১০-২১ সেকেন্ড। ব্যাপারটাকে বিজ্ঞানের পরিভাষায় বলে ‘ভ্যাকুয়াম ফ্লাকচুয়েশন’।
আমরা এই বইয়ের অষ্টম অধ্যায়ে আপেক্ষিকতা থেকে আসা আইনস্টাইনের ক্ষেত্র-সমীকরণের সাথে পরিচিত হয়েছিলাম। সেখানে আমরা দেখেছিলাম যে, আইনস্টাইন তাঁর মহাবিশ্বকে প্রথমে ‘স্থিতিশীল’ একটা রূপ দেওয়ার জন্য একটা ধ্রুবক যোগ করেছিলেন, তারপর সেটাকে ‘জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল’ বলে বাদও দিয়েছিলেন। কিন্তু ছয় দশক পর জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা কোয়ান্টাম বলবিদ্যা ও গুপ্ত শক্তি নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে দেখলেন, আইনস্টাইন আসলে ভুল ছিলেন না। আইনস্টাইনের মতো তাঁদেরও ক্ষেত্রসমীকরণে তাঁদের একটা ধ্রুবক যোগ করতেই হচ্ছে, আর সেই ধ্রুবকটা বসছে সমীকরণের ডান দিকে (Gμν = 8πG[Tμv + ρvac gμv])। প্রতীক দেখেই অনেকে অনুমান করে নিতে পারবেন, ডান পাশে বসানো 8πG[ρvac gμv] — এই কিম্ভূতকিমাকার পদটি আসলে ভ্যাকুয়াম বা শূন্যতার মধ্যে নিহিত শক্তি ছাড়া আর কিছুই নয়। তার মানে এই ক্ষেত্র-সমীকরণ সঠিক হলে শূন্যতার মধ্যেই কিন্তু একধরনের শক্তি লুকিয়ে আছে; আর সেটাই তৈরি করে ভ্যাকুয়াম ফ্লাকচুয়েশনের মাধ্যমে পদার্থ তৈরির প্রাথমিক ক্ষেত্র।
ব্যাপারটা আরেকটু বিস্তৃত করা যাক। ‘রহস্যময়’ এই শূন্য শক্তি কিংবা ভ্যাকুয়াম ফ্লাকচুয়েশনের বৈজ্ঞানিক ভিত্তিটি গড়ে উঠেছে হাইজেনবার্গের বিখ্যাত অনিশ্চয়তা তত্ত্বের কাঁধে ভর করে। ১৯২৭ সালে জার্মান পদার্থবিদ ওয়ার্নার
আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী, পূর্বোক্ত
হাইজেনবার্গ গাণিতিকভাবে প্রমাণ করে দেখান যে, কোনো বস্তুর অবস্থান এবং ভরবেগ যুগপৎ একসাথে নিশ্চিতভাবে নির্ণয় করা সম্ভব নয়। বস্তুর অবস্থান ঠিকঠাকমতো মাপতে গেলে দেখা যাবে, ভরবেগের তথ্য যাচ্ছে হারিয়ে, আবার ভরবেগ চুলচেরাভাবে পরিমাপ করতে গেলে বস্তুর অবস্থান অজানাই থেকে যাবে। কাজেই হাইজেনবার্গের এই সূত্র সত্যি হয়ে থাকলে, এমনকি ‘পরম শূন্যে’ও একটি কণার ‘ফ্লাকচুয়েশন’ বজায় থাকার কথা, কারণ কণাটি নিশ্চল হয়ে যাওয়ার অর্থই হবে এর অবস্থান ও ভরবেগ সম্বন্ধে আমাদের নিশ্চিত তথ্য জানিয়ে দেওয়া, যা প্রকারান্তরে হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা তত্ত্বের লঙ্ঘন’। ভ্যাকুয়াম ফ্লাকচুয়েশন কোনো রূপকথা নয়, নয় কেবল গাণিতিক বিমূর্ত মতবাদ; বিজ্ঞানীরা কিন্তু ব্যবহারিকভাবেই এর প্রমাণ পেয়েছেন।
Philip Yam, Exploiting Zero-Point Energy, Scientific American, 1997
একটি প্রমাণ হচ্ছে ‘ল্যাম্ব শিফট’, যা আহিত পরমাণুর মধ্যস্থিত দুটো স্তরে শক্তির তারতম্য প্রকাশ করে”। আরেকটি প্রমাণ হলো টপ কোয়ার্কের ভরের পরিমাপ। তবে কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশনের সবচেয়ে জোরদার প্রমাণ পাওয়া গেছে বিখ্যাত ‘কাসিমিরের প্রভাব’ থেকে। ১৯৪৮ সালে ডাচ পদার্থবিদ হেনরিক কাসিমির বলেছিলেন, কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশন সত্যি হয়ে থাকলে দুটো ধাতব পাত খুব কাছাকাছি আনা হলে দেখা যাবে তারা একে অন্যকে ধীরে ধীরে আকর্ষণ করছে। এর কারণ হচ্ছে, ধাতব পাতগুলোর মধ্যকার সংকীর্ণ স্থানটিতে ভ্যাকুয়াম ফ্লাকচুয়েশনের ফলে খুব উচ্চ কম্পাঙ্কের তড়িচ্চুম্বকীয় ‘মোড’-এর উদ্ভব ঘটে আর যেহেতু পাতগুলোর বাইরে সব কম্পাঙ্কের মোডেরই সৃষ্টি হতে পারে, সেহেতু বাইরের অধিকতর চাপ ধাতব পাতগুলোকে একে অপরের দিকে আকর্ষণে বাধ্য করে। এ ব্যাপারটিই পরবর্তীতে মার্ক্স স্প্যার্নে,স্টিভ লেমোরাক্স, উমর মহিদিন প্রমুখ বিজ্ঞানীদের পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়।
বিজ্ঞানীরা আজ মনে করেন, কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশনের ‘রহস্যময়’ ব্যাপারগুলো কণার ক্ষেত্রে যেমনিভাবে সত্য, ঠিক তেমনিভাবে মহাবিশ্বের জন্যও এইরকমভাবে সত্য হতে পারে। তারা মনে করেন এক সুদূর অতীতে কারণবিহীন কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশনের (Quantum Fluctuation) মধ্য দিয়ে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের উৎপত্তি হয়েছিল, যা পরবর্তীতে সৃষ্ট মহাবিশ্বকে স্ফীতির (Inflation) দিকে ঠেলে দিয়েছে, এবং আরো পরে পদার্থ আর কাঠামো তৈরির পথ সুগম করেছে। এগুলো কোনো বানানো গল্প নয়। মহাবিশ্ব যে শূন্য থেকে উৎপন্ন হতে পারে প্রথম এ ধারণাটি ব্যক্ত করেছিলেন নিউ ইয়র্ক সিটি ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক এডওয়ার্ড ট্রিয়ন ১৯৭৩ সালে ‘নেচার’ নামক বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক জার্নালে”। ট্রিয়নের এ প্রকাশনাটার পেছনে একটা ছোট্ট ইতিহাস আছে। ১৯৭০ সালে ট্রিয়ন একটি পদার্থবিজ্ঞানের সেমিনারে সামনের সারিতে বসে আলোচনা শুনছিলেন।
বিজ্ঞানী উইলস ল্যাম্ব ১৯৫৩ সালে ল্যাম্বশিফট আবিস্কারের জন্য নোবেল পুরস্কার পান।
জাপানি বিজ্ঞানী মাকাতো কোবায়াশি ও তোশিহিদে মাসকাওয়া ২০০৮ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পান ১৯৭৩ সালে টপ কোয়ার্কসংক্রান্ত ভবিষ্যদ্বানীর জন্য। টপ কোয়ার্ক ১৯৯৫ সালে ফার্মি ল্যাবে আবিষ্কৃত হয়।
Mohideen, U.; Roy, Anushree (1998). “Precision Measurement of the Casimir Force from 0.1 to 0.9 μm”. Physical Review Letters 81 (21): 4549.
E.P. Tryon, “Is the Universe a Vacuum Fluctuation?”, Nature 246 (1973): 396-97.
কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যার ওপর কোনো এক বক্তার গুরুগম্ভীর আলোচনা শুনছিলেন তিনি সেখানে। আর বসে বসে বিষয়টা নিয়ে ভাবছিলেনও। এমনি সময় হঠাৎ যেন তাঁর মাথায় বিদ্যুৎ-ঝলকের মতো খেলে গেল এক দুরন্ত অবিনাশী চিন্তা; আর তাঁর মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল স্বগতোক্তি –‘মে বি…আমাদের মহাবিশ্বটা আসলে স্রেফ ভ্যাকুয়াম ফ্লাকচুয়েশনের ফসল’ ছাড়া কিছু নয়। বক্তা বক্তৃতা থামিয়ে এক সেকেন্ডের জন্য তাঁর দিকে তাকালেন। এর মধ্যে পুরো সভাঘর অট্টহাস্যে ফেটে পড়ল। সবাই ভাবলেন, ট্রিয়ন যেন কোনো মজার কৌতুক করেছেন।
কিন্তু ট্রিয়নের জন্য বিষয়টা কোনো ‘কৌতুক’ ছিল না। তিনি সেমিনার শেষে পুরো বিষয়টা নিয়ে গভীরভাবে ভাবলেন। এক দিন দুই দিন নয়, এভাবে ভেবেই চললেন অন্তত দুই বছর ধরে। এর মধ্যে কোয়ান্টাম বলবিদ্যার সূত্র ব্যবহার করে নিজের গণনাগুলো ঝালাই করলেন, দু-একজন সহকর্মীর সাথেও হাল্কা আলাপ করলেন নিজের প্রস্তাবিত মডেলটি নিয়ে। তিনি শেষমেশ বুঝতে পারলেন, এ ধারণা সাদা চোখে যত অবাস্তবই লাগুক না কেন, এভাবে মহাবিশ্বের উৎপত্তি অসম্ভব কিছু নয়। শার্লক হোমস যেমনটি বলতেন, ‘When you have eliminated the impossible, whatever remains, however improbable, must be the truth’, ট্রিয়নেরও হয়তো সেরকমই কিছু মনে হয়ে থাকবে! ট্রিয়ন প্রথমে তাঁর যুগান্তকারী ধারণাসংলিত গবেষণাপত্রটি নেচার জার্নালে ‘লেটার টু দ্য এডিটর’ ফরম্যাটে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু জার্নালের সম্পাদকেরা বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে একে ‘ফিচার আর্টিকেল’ হিসেবে প্রকাশ করেন, ‘মহাবিশ্ব কি একটি ভ্যাকুয়াম ফ্লাকচুয়েশন? ” শিরোনামে, ১৯৭৩ সালে।
এর পর এল আশির দশক—স্ফীতি তত্ত্বের আবির্ভাবের কাল। ট্রিয়নের সেই পুরনো পেপারের গুরুত্ব নতুন করে অনুভূত হলো যেন। এই সময়ে আলেক্সেই স্তারোবিনস্কি”, ডেমোস কাজানাস”, অ্যালেন গুথ” এবং আঁদ্রে লিন্ডে” পৃথক পৃথকভাবে মহাবিশ্বের উৎপত্তির বিষয়ে নিজস্ব ফলাফল প্রকাশ করেন। তাঁদের গবেষণাগুলো বর্তমানে ‘স্ফীতিশীল মহাবিশ্ব’ (Inflationary Universe) হিসেবে প্রমিত জ্যোতির্বিজ্ঞানের (standard cosmology) অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেছে। তাঁদের কাজের সূত্র ধরে বহু বিজ্ঞানী পরবর্তীতে কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশনের ধারণাকে স্ফীতি তত্ত্বের সাথে জুড়ে দিয়ে শূন্য থেকে মহাবিশ্বের আবির্ভাবের মডেল বা প্রতিরূপ নির্মাণ করেছেন “। শূন্য থেকে মহাবিশ্ব উৎপত্তির
A.A. Starobinsky, A new type of isotropic cosmological models without singularity, Phys. Lett. B 91 (1), 99-102, 1980.
Demos Kazanas, “Dynamics of the Universe and Spontaneous Symmetry, Breaking, ” Astrophysical Journal 241 (1980): L59 L65 Alan Guth, “Infiationary universe: A possible solution to the horizon and fiatness problems”, Physical Review, D23, no. 2, 1981 Andrie Linde, “A new inflationary universe scenario: A possible solution of the horizon, flatness, homogeneity, isotropy and primordial monopole problems, ” Physics Letters B 108, 389,1982. 100
উদাহরণ হিসেবে এখানে কিছু সাম্প্রতিক পেপারের উল্লেখ করা যেতে পারেঃ
ধারণা যদি অবৈজ্ঞানিক ও ভ্রান্তই হতো, তবে সেগুলো পিয়ার-রিভিউড বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক সাময়িকী (Scientific Journal)গুলোতে কখনোই প্রকাশিত হতো না। মূলত স্ফীতি তত্ত্বকে সাম্প্রতিক কালে বেশ কিছু পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়েছে, এবং প্রায় সবগুলোতেই এই তত্ত্ব অত্যন্ত সাফল্যের সাথে এ পর্যন্ত উত্তীর্ণ হয়েছে’। স্ফীতি তত্ত্ব গ্যালাক্সির ক্লাস্টারিং, এক্স রশ্মি এবং অবলোহিত তরঙ্গের বিন্যাস, মহাবিশ্বের প্রসারণের হার এবং এর বয়স, মহাবিশ্ব গঠনে এর উপাদানগুলোর প্রাচুর্য – এগুলোর প্রায় সবগুলোই ব্যাখ্যা করতে পেরেছে অনুপম সৌন্দর্যে। আমি (অ.রা) এর কারিগরি দিকগুলো নিয়ে বিস্তৃতভাবে মুক্তমনায় একটা লেখা লিখেছিলাম বাংলায়—‘স্ফীতি তত্ত্ব এবং মহাবিশ্বের উদ্ভব’ শিরোনামে। বছর কয়েক আগে সায়েন্স ওয়ার্ল্ড ও ‘জিরো টু ইনফিনিটি’ ম্যাগাজিনের জন্য কিছু লেখা লিখেছিলাম একই শিরোনামে। লেখাগুলো পরবর্তীতে আমার (অ.রা) এবং রায়হান আবীরের লেখা ‘অবিশ্বাসের দর্শন’ (শুদ্ধস্বর, ২০১১, পুনর্মুদ্রণ, ২০১২) বইয়ে সংকলিত হয়েছিল। সে বইটিতে প্রাকৃতিকভাবে কিভাবে মহাবিশ্বের সূচনা হতে পারে তার সম্ভাব্য ব্যাখ্যা ছাড়াও এর অস্তিত্বের পেছনে একটি আদি ঐশ্বরিক কারণের খণ্ডন, স্বতঃস্ফূর্তভাবে মহাবিশ্ব উৎপত্তির পেছনে কোনো মিরাকলের খণ্ডন ছাড়াও পদার্থের উৎপত্তি,
* David Atkatz and Heinz Pagels, “Origin Of The Universe as a Quantum Tunneling Event ” Physical review D25, 2065-73, 1982
* S. W. Hawking and I. G. Moss ” Supercooled Phase Transitions in the Very Early Universe “, Physics letters B110, 35-38, 1982
* Alexander Vilenkin, “Creation of Universe from Nothing” Physics letters 117B, 25-28, 1982
* Alexander Vilenkin, “Quantum Origin of the Universe” Nuclear Physics B252, 141-152, 1985
* Andre Linde, “Quantum creation of the inflationary Universe,” Letter Al Nuovo Cimento 3, 401-405, 1984
* Victor Stenger, The Universe: The Ultimate Free Lunch,” European Journal of Physics 11, 236-243, 1990 ইত্যাদি।
বিস্তারিত তথ্যের জন্য The Inflationary Universe: The Quest for a New Theory of Cosmic Origins, Alan H. Guth, Perseus Books Group (March 1, 1998) দেখুন; কিংবা অতি সাম্প্রতিক কালের ফলাফল : Planck Collaboration et al, Planck 2013 results. XXII. Constraints on inflation, arXiv:1303.5082।
একই লেখা একটু পরিবর্তিত আকারে মাসিক সায়েন্স ওয়ার্ল্ডের ২০০৬ সালের ডিসেম্বর সংখ্যায় (বর্ষ ৫, সংখ্যা ৬০, ডিসেম্বর ২০০৬) ‘ইনফেশন থিওরি : স্ট্যান্ডার্ড বিগ ব্যাং মডেলের বিদায় কি তবে আসন্ন?” শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছিল।
শৃঙ্খলার সূচনাসহ বহু ধরনের ‘শুরুর দিককার’ সমস্যা যেগুলো নিয়ে নানাভাবে ‘জল ঘোলা করার’ চেষ্টা করা হয়, সেগুলোর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। আমাদের সেই বই থেকে কিছু প্রয়োজনীয় অংশের উল্লেখ করা যাক একটু পরিবর্তিত আকারে 03:
পদার্থের উৎপত্তি
বিংশ শতকের শুরুর দিক পর্যন্ত মহাবিশ্বের উৎপত্তিতে যে একটি বা বেশ কয়েকটি অলৌকিক ঘটনার প্রয়োজন ছিল তা বিজ্ঞানীরা পর্যন্ত মানতেন। আমরা জানি, মহাবিশ্ব বিপুল পরিমাণ পদার্থ দিয়ে গঠিত। আর পদার্থের ধর্ম হলো এর ভর। বিংশ শতাব্দীর শুরু পর্যন্ত ধারণা করা হতো, ভরের সৃষ্টি বা ধ্বংস নেই, এটি শুধু এক রূপ থেকে আরেক রূপে পরিবর্তিত হয়। শক্তির নিত্যতার সূত্রের মতো এটি ভরের নিত্যতার সূত্র। সুতরাং এই বিপুল পরিমাণ ভর দেখে সবাই ধারণা করে নিয়েছিলেন একদম শুরুতে ভর সৃষ্টি হবার মতো একটি অলৌকিক ঘটনা ঘটেছিল, যা সরাসরি ভরের নিত্যতার সূত্রের লঙ্ঘন। এবং এটি ঘটেছিল মাত্র একবারই মহাবিশ্বের সূচনাকালে।
পদার্থের অনেক সংজ্ঞা আমরা জানি। আমাদের কাছে এর সবচেয়ে দুর্দান্ত ও সহজ সংজ্ঞা হলো, পদার্থ এমন একটি জিনিস যাকে ধাক্কা মারা হলে এটি পাল্টা ধাক্কা মারে। কোনো বস্তুর মধ্যকার পদার্থের পরিমাপ করা যায় এর ভরের সাহায্যে। একটি বস্তুর ভর যত বেশি তাকে ধাক্কা মারা হলে ফিরিয়ে দেওয়া ধাক্কার শক্তি তত বেশি। বস্তু যখন চলা শুরু করে তখন সেই চলাটাকে বর্ণনা করা হয় ভরবেগ বা মোমেন্টামের মাধ্যমে, যা বস্তুর ভর ও বস্তুর যে গতিতে চলছে তার গুণফলের সমান। মোমেন্টাম বা ভরবেগ একটি ভেক্টর রাশি, এর দিক ও বস্তুর গতির দিক একই।
ভর ও মোমেন্টাম দুটি জিনিসই পদার্থের আরেকটি ধর্মকে যথাযথভাবে সমর্থন করে, যাকে আমরা বলি ইনারশিয়া বা জড়তা। একটি বস্তুর ভর যত বেশি তত এটিকে নাড়ানো কঠিন এবং এটি নড়তে থাকলে সেটাকে থামানো কঠিন। একই সাথে বস্তুর মোমেন্টাম যত বেশি তত একে থামানো কষ্ট, থেমে থাকলে চালাতে কষ্ট। অর্থাৎ বেশি পরিমাণ শক্তির প্রয়োজন।
বস্তুর গতির আরেকটি পরিমাপযোগ্য ধর্ম হলো এর শক্তি। শক্তি, ভর ও মোমেন্টাম থেকে স্বাধীন কোনো ব্যাপার নয়, এই তিনটি একই সাথে সম্পর্কিত। তিনটির মধ্যে দুটির মান জানা থাকলে অপরটি গাণিতিকভাবে বের করা সম্ভব।
অভিজিৎ রায় ও রায়হান আবীর, অবিশ্বাসের দর্শন, শুদ্ধস্বর, ২০১১; পুনর্মুদ্রণ ২০১২
ভর, মোমেন্টাম ও শক্তি এই তিনটি রাশি দিয়ে আমরা একটি সমকোণী ত্রিভুজ আঁকতে পারি। সমকোণী ত্রিভুজটির লম্ব হলো মোমেন্টাম p, ভূমি ভর m আর অতিভুজ শক্তি E। এখন পিথাগোরাসের উপপাদ্য ব্যবহার করে এই তিনটির সম্পর্ক নির্ণয় করা যায়।
স্থির অবস্থায় বস্তুর স্থিতিশক্তি ও ভরের মান সমান। এখন বস্তুটি যদি চলা শুরু করে তখন এর শক্তির মান পূর্ববর্তী স্থিতিশক্তির চেয়ে বেশি হতে শুরু করবে। অতিরিক্ত এই শক্তিকেই আমরা বলি, গতিশক্তি। রাসায়নিক ও নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ার ফলে গতিশক্তি স্থিতিশক্তিতে রূপান্তরিত হয় যা আদতে বস্তুর ভর।
আমরা জানি, আলো প্রতি সেকেন্ডে যায় 300,000 কিলোমিটার (বা ১ লক্ষ ৮৬ হাজার মাইল)। কাজেই সে হিসাবে প্রতিবছরে (অর্থাৎ ৩৬৫ x ২৪ x ৬০ x ৬০ সেকেন্ড) আলো কতটুকু দূরত্ব অতিক্রম করতে পারে তা আমরা বের করতে পারি। 9.4605284 × 105 মিটার। সেটাকেই ১ আলোকবর্ষ বা 1 light year বলে। কাজেই c=1 light-year per year.
সাধারণভাবে ধারণা করা হয়ে থাকে যে, শুধু নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ার মাধ্যমেই স্থিতিশক্তি থেকে গতিশক্তি বা গতি শক্তি থেকে স্থিতিশক্তিতে রূপান্তরের ঘটনা ঘটা সম্ভব। কিন্তু একই সাথে রাসায়নিক বিক্রিয়াতেও এমনটা ঘটে। তবে ব্যাপার হলো, রাসায়নিক বিক্রিয়ায় বিক্রিয়কের ভর খুব নগণ্য থাকে বিধায় বোঝা মুশকিল হয়।
একই সাথে উল্টো ব্যাপারও ঘটে। ভর বা স্থিতিশক্তিকে রাসায়নিক ও নিউক্লীয় বিক্রিয়ার ফলে গতিশক্তিতে রূপান্তরিত করা সম্ভব, আর সেটা করে আমরা ইঞ্জিন চালাতে পারি, কেউ কেউ আবার একই পদ্ধতি প্রয়োগে বোমা মেরে সব উড়িয়ে দিতে চায়।
সুতরাং আমরা বুঝতে পারলাম, মহাবিশ্বের ভরের উপস্থিতি কোনো ধরনের প্রাকৃতিক নিয়মের লঙ্ঘন করে না। শক্তি থেকে ভর উৎপত্তি সম্ভব একই সাথে ভরের শক্তিতে রূপান্তর হওয়াটাও একেবারে প্রাকৃতিক একটি ব্যাপার। সুতরাং মহাবিশ্ব উৎপত্তির সময় ভরের উৎপত্তি জনিত কোনো মিরাকল বা অলৌকিক ঘটনার প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু আদিতে শক্তি তবে এল কোথা থেকে?
শক্তির নিত্যতা সূত্র বা তাপগতিবিদ্যার প্রথম সূত্র অনুযায়ী আমরা জানি, শক্তিকে অন্য কোথাও থেকে আসতে হবে। আমরা ধর্মীয় অলৌকিকতার প্রমাণ পেতাম যদি কেউ দেখাত যে আজ থেকে চোদ্দ শ কোটি বছর আগে বিগ ব্যাং-এর শুরুতে শক্তির নিত্যতার সূত্রের লঙ্ঘন ঘটেছিল, আর ঈশ্বর বা কোনো অপার্থিব সত্তার হাত ছাড়া উৎপত্তির আর কোনো ব্যাখ্যা নেই।
কিন্তু পর্যবেক্ষণ থেকে শুরু করে তাত্ত্বিকভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, মোটেও ব্যাপারটি এমন নয়। তাপগতিবিদ্যার প্রথম সূত্র অনুযায়ী একটি বদ্ধ সিস্টেমে মোট শক্তির পরিমাপ স্থির থাকলেই কেবল শক্তি এক রূপ থেকে অন্য রূপে পরিবর্তিত হয়। মজার এবং আসলেই দারুণ মজার ব্যাপার হচ্ছে, মহাবিশ্বের মোট শক্তির পরিমাণ শূন্য! বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং তাঁর ১৯৮৮- এর সর্বাধিক বিক্রিত বই, ‘কালের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস’ (A Brief History of Time)-এ উল্লেখ করেছেন, যদি এমন একটা মহাবিশ্ব ধরে নেওয়া যায়, যেটা মহাশূন্যে মোটামুটি সমস্বত্ব, তাহলে দেখানো সম্ভব, যে ঋণাত্মক মহাকর্ষীয় শক্তি এবং ধনাত্মক মহাকর্ষীয় শক্তি ঠিক ঠিক কাটাকাটি যায়। তাই মহাবিশ্বের মোট শক্তি থাকে শূন্য 07। বিশেষ করে, পরিমাপের অতি সূক্ষ্ম বিচ্যুতি ধরে নিলেও,
Stephen W. Hawking, A Brief History of Time: From the Big Bang to Black Holes, New York: Bantam, 1988, পৃষ্ঠা নং. ১২৯।
ইনফ্লেশন বা স্ফীতি তত্ত্বের আবির্ভাবের পর আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান খুব পরিষ্কারভাবেই আমাদের দেখিয়েছে মহাবিশ্বে মোট শক্তির পরিমাণ শূন্য; মহাবিশ্বের মোট গতিশক্তি এবং মাধ্যাকর্ষণের ঋণাত্মক শক্তি পরস্পরকে নিষ্ক্রিয় করে দেয়। এর মানে হচ্ছে মহাবিশ্বের জন্য বাইরে থেকে আলাদা সৃষ্টি কোনো শক্তি আমদানি করার প্রয়োজন হয়নি। সহজ কথায়, ইনফ্লেশন ঘটাতে যদি শক্তির নিট ব্যয় যদি শূন্য হয়, তবে বাইরে থেকে কোনো শক্তি আমদানি করার প্রয়োজন পড়ে না। অ্যালান গুথ ও স্টেইনহার্ট নিউ ফিজিক্স জার্নালে (১৯৮৯) দেখিয়েছেন, ইনফ্লেশনের জন্য কোনো তাপগতীয় কাজের দরকার পড়ে না। স্টিফেন হকিং তাঁর অতি সাম্প্রতিক‘গ্র্যান্ড ডিজাইন’বইয়ে সুস্পষ্টভাবে মত প্রকাশ করেছেন যে,এই মহাবিশ্ব প্রাকৃতিকভাবেই শূন্য থেকে উদ্ভূত হয়েছে, কোনো অলৌকিক কিংবা অপার্থিব সত্তার হস্তক্ষেপ ছাড়াই।
ক্ষুদ্র কোয়ান্টাম অনিশ্চয়তার মধ্যে, মহাবিশ্বের গড় শক্তির ঘনত্ব ঠিক ততটাই দেখা যায়, যতটা হতো সবকিছু একটা শূন্য শক্তির আদি অবস্থা থেকে শুরু হলে।
ধনাত্মক ও ঋণাত্মক শক্তির এই ভারসাম্যের কথা নিশ্চিত করে বিগ ব্যাং তত্ত্বের বর্তমান পরিবর্ধিত রূপ ‘ইনফ্লেশনারি বিগ ব্যাং’ ধারণার সত্যতা, যেটা নিয়ে আমরা দশম অধ্যায়ে আলোচনা করেছি। আমরা এও জেনেছি, ইনফ্লেশন থিওরি প্রস্তাব করার পর একে নানাভাবে পরীক্ষা- নিরীক্ষা করা হয়েছে। যেকোনো পরীক্ষায় ব্যর্থ বা ভুল ফলাফল দানই এই তত্ত্বকে বাতিল করে দেবার জন্য যথেষ্ট ছিল। কিন্তু এটি এ পর্যন্ত সকল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে বলেই গবেষকেরা মনে করেন।
সংক্ষেপে, মহাবিশ্বে পদার্থ ও শক্তির উপস্থিতি কোনো ধরনের প্রাকৃতিক নিয়মের সাথে সাংঘর্ষিক নয়। ধর্মীয় গ্রন্থের বাণীগুলো এই মহাবিশ্বের সৃষ্টির পেছনে ঈশ্বরের হস্তক্ষেপের কাল্পনিক গালগল্প ফেঁদে বসেছে। কিন্তু বিজ্ঞানের সাম্প্রতিক তত্ত্ব ও পর্যবেক্ষণগুলো আমাদের দেখাচ্ছে কারও হস্তক্ষেপ নয়, বরং একদম প্রাকৃতিকভাবেই এই মহাবিশ্ব সৃষ্টি হওয়া সম্ভব।
এই জায়গায় এসে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোকপাত করা যাক। অনেকেই বলে থাকেন, বিজ্ঞানের ঈশ্বর সম্বন্ধে কিছু বলার সামর্থ্য বা সাধ্য নেই। যদি দেখা যেত, বিজ্ঞানীদের গণনাকৃত ভর-ঘনত্বের (mass density) মান মহাবিশ্বকে একদম শূন্য শক্তি অবস্থা (state of zero energy) থেকে উৎপত্তি হতে যা প্রয়োজন সেরকমের কিছু আসেনি, কিংবা সূচনালগ্নে মহাবিশ্ব বানাতে বাইরে থেকে শক্তি সরবরাহ অবশ্যম্ভাবী ছিল, সেক্ষেত্রে আমরা নির্দ্বিধায় ধরে নিতে পারতাম, এখনে অন্য কোনো অপ্রাকৃত সত্তার হাত ছিল। সেজন্যই ক্যালটেক বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানী লিওনার্ড স্লোডিনোর সাথে লেখা সাম্প্রতিক ‘গ্র্যান্ড ডিজাইন’ বইয়ে স্টিফেন হকিং উল্লেখ করেছেন।
V.Faraoni F. I. Cooperstock, ‘On the Total Energy of Open Friedmann- Robertson-Walker Universes’, Astrophysical Journal 587 (2003): 483-86
Alan Guth, The Inflationary Universe, New York: Addison-Wesley, 1997; আরো দেখুন – Anthony Aguirre, How did Our Universe Come to be?, Astronomy’s 60 Greatest Mysteries, Sky and Telescope, 2013
Stephen Hawking & Leonard Mlodinow, The Grand Design, Bantam, 2010
মাধ্যাকর্ষণ শক্তির সূত্রের মতো পদার্থবিজ্ঞানের বিভিন্ন সূত্র কার্যকর রয়েছে, তাই একদম শূন্যতা থেকেও মহাবিশ্বের উৎপত্তি সম্ভব এবং সেটি অবশ্যম্ভাবী। ‘স্বতঃস্ফূর্তভাবে উৎপত্তি’ হওয়ার কারণেই ‘দেয়ার ইজ সামথিং,রদার দ্যান নাথিং’,সে কারণেই মহাবিশ্বের অস্তিত্ব রয়েছে, অস্তিত্ব রয়েছে আমাদের। মহাবিশ্ব উৎপত্তির সময় বাতি জ্বালানোর জন্য ঈশ্বরের কোনো প্রয়োজন নেই।
শৃঙ্খলার সূচনা
সৃষ্টিবাদের আরেকটি অনুমানও প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্তের সাথে মেলে না। যদি মহাবিশ্বকে সৃষ্টিই করা হয়ে থাকে তাহলে সৃষ্টির আদিতে এর মধ্যে কিছুটা হলেও শৃঙ্খলা থাকবে— একটি নকশা থাকবে যেটার নকশাকার স্বয়ং স্রষ্টা। এই যে আদি শৃঙ্খলা, এটার সম্ভাব্যতাকে সাধারণত প্রকাশ করা হয় তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্রের আকারে। এই সূত্রমতে, কোনো একটা আবদ্ধ সিস্টেমের সবকিছু হয় একইরকম সাজানো-গোছানো থাকবে (এন্ট্রপি স্থির) অথবা সময়ের সাথে সাথে বিশৃঙ্খল হতে থাকবে (অর্থাৎ এন্ট্রপি বা বিশৃঙ্খলা বাড়তেই থাকবে)। একটি সিস্টেমের এই বিক্ষিপ্ততা কমানো যেতে পারে শুধু বাইরে থেকে যদি কেউ সেটাকে গুছিয়ে দেয় তখন। তবে বাইরে থেকে কোনো কিছু সিস্টেমকে প্রভাবিত করলে সেই সিস্টেম আর আবদ্ধ সিস্টেম থাকে না।
তাপগতিবিদ্যার এই দ্বিতীয় সূত্রটি প্রকৃতির অন্যতম একটি মৌলিক সূত্র, যার কখনো অন্যথা হয় না। কিন্তু আমরা চারপাশে তাকালে এলোমেলো অনেক কিছুর সাথে সাথে সাজানোগোছানো অনেক কিছুই দেখি। আমরা একধরনের শৃঙ্খলা দেখতে পাই যেটা প্রকৃতির নিয়মেই (তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্র) দিনে দিনে বিশৃঙ্খল হচ্ছে (যেমন তেজস্ক্রিয় পরমাণু ভেঙে বিক্ষিপ্ত হয়ে যায়, অথবা ক্ষয়ে যেতে থাকে পুরনো প্রাসাদ)। তার মানে সৃষ্টির আদিতে নিশ্চয়ই সবকিছুকে একরকম ‘পরম শৃঙ্খলা’ দেওয়া হয়েছিল। প্রকৃতির সকল ক্রিয়া-বিক্রিয়া তাপগতিবিদ্যা মেনে সেই শৃঙ্খলাকে প্রতিনিয়ত বিশৃঙ্খল করে চলেছে। তাহলে শুরুতে এই শৃঙ্খলার সূচনা করল কে?
কে আবার? নিশ্চয়ই সৃষ্টিকর্তা! ১৯২৯-এর আগ পর্যন্ত সৃষ্টিবাদের পেছনে এটাই ছিল অলৌকিক সৃষ্টিবাদীদের এটা একটা শক্তিশালী বৈজ্ঞানিক যুক্তি ছিল। কিন্তু সে বছর জ্যোতির্বিজ্ঞানী এডউইন হাবল পর্যবেক্ষণ করলেন যে গ্যালাক্সিসমূহ একে অপর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে নিজেদের দূরত্বের সমানুপাতিক হারে। অর্থাৎ দুইটা গ্যালাক্সির পারস্পরিক দূরত্ব যত বেশি, একে অপর থেকে দূরে সরে যাওয়ার গতিও তত বেশি। এই পর্যবেক্ষণই বিগ ব্যাং তত্ত্বের সর্বপ্রথম আলামত। আর আমরা জানি, একটা প্রসারণশীল মহাবিশ্ব চরম বিশৃঙ্খলা থেকে শুরু হলেও এর মধ্যে আঞ্চলিক শৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে পারে। অর্থাৎ সবকিছু এলোমেলোভাবে শুরু হলেও তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্রকে ভঙ্গ না করেও প্রসারণশীল কোনো সিস্টেমের কোনো কোনো অংশে শৃঙ্খলা সৃষ্টি হওয়া সম্ভব।
ব্যাপারটাকে একটা গৃহস্থালির উঠানের উদাহরণ দিয়ে বর্ণনা করা যায়। ধরুন, যখনই আপনি আপনার বাড়ি পরিষ্কার করেন তখন জোগাড় হওয়া ময়লাগুলো জানালা দিয়ে বাড়ির উঠানে ফেলে দেন। এভাবে যদিও দিনে দিনে উঠানটা ময়লা-আবর্জনায় ভরে যেতে থাকে, ঘরটা কিন্তু সাজানো-গোছানো ও পরিষ্কারই থাকে। এভাবে বছরের পর বছর চালিয়ে যেতে হলে যেটা করতে হবে উঠান সব আবর্জনায় ভরে গেলে আশপাশের নতুন জমি কিনে ফেলতে হবে। তারপর সেসব জমিকেও ময়লা ফেলার উঠান হিসেবে ব্যবহার করলেই হলো। তার মানে এভাবে আপনি আপনার ঘরের মধ্যে একটা আঞ্চলিক শৃঙ্খলা রক্ষা করতে পারছেন কিন্তু এর জন্য বাদবাকি জায়গায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হচ্ছে।
একইভাবে মহাবিশ্বের একটি অংশে শৃঙ্খলা রক্ষা করা যেতে পারে, যদি সেখানে সৃষ্ট এন্ট্রপি (বিশৃঙ্খলা) ক্রমাগতভাবে বাইরের সেই চিরবর্ধনশীল মহাশূন্যে ছুড়ে দেওয়া হয়। ওপরের চিত্রে আমরা দেখি, মহাবিশ্বের সার্বিক বিশৃঙ্খলা তাপগতিবিদ্যা মেনেই ধারাবাহিকভাবে বেড়ে চলেছে”। কিন্তু মহাবিশ্বের আয়তনও আবার বাড়ছে ক্রমাগত। সেই বর্ধিত আয়তন (স্পেস)-কে পুরোপুরি বিশৃঙ্খলায় ভরে ফেলতে যে বাড়তি এন্ট্রপি লাগত সেটাই হচ্ছে আমাদের সর্বোচ্চ-সম্ভাব্য-বিশৃঙ্খলা। কিন্তু ওপরের ছবি থেকেই আমরা দেখি বাস্তবে বিশৃঙ্খলার বৃদ্ধির হার ততটা নয়। আর বিশৃঙ্খলার অনুপস্থিতি মানেই শৃঙ্খলা। তাই এই বাড়তি স্থানে অনিবার্যভাবেই শৃঙ্খলার উদ্ভব হচ্ছে, এবং সেটা তাপগতিবিদ্যার কোনো সূত্রকে ভঙ্গ না করেই।
ব্যাপারটাকে এভাবে দেখা যায়। আমরা জানি, কোনো একটা গোলকের (আমরা এখানে মহাবিশ্বকে গোলক কল্পনা করছি) এন্ট্রপি যদি সর্বোচ্চ হয় তাহলে সেই গোলকটা কৃষ্ণগহ্বরে (Black hole) পরিণত হয়। অর্থাৎ ঐ গোলকের আয়তনের একটা ব্ল্যাক হোলই হচ্ছে একমাত্র বস্তু যার এন্ট্রপি ঐ আয়তনের জন্য সর্বোচ্চ। কিন্তু আমাদের এই ক্রমপ্রসারণশীল মহাবিশ্ব তো পুরোটাই একটা কৃষ্ণগহ্বর নয়। তার মানে মহাবিশ্বের এন্ট্রপি (বিশৃঙ্খলা) সম্ভাব্য- সর্বোচ্চের চেয়ে কিছুটা হলেও কম। অর্থাৎ সময়ের সাথে সাথে যদিও বিশৃঙ্খলা বাড়ছে ক্রমাগত, তার পরও আমাদের মহাবিশ্ব এখনো সম্পূর্ণ বিশৃঙ্খল নয়। কিন্তু একসময় ছিল। একদম শুরুতে।
ধরুন, যদি আমরা মহাবিশ্বের এই প্রসারণকে পেছনের দিকে ১৩৮০ কোটি বছর ফিরিয়ে নিয়ে যাই তাহলে আমরা পৌঁছুব সংজ্ঞাযোগ্য একদম আদিতম সময়ে অর্থাৎ প্লাঙ্ক সময় ৬.৪ x ১০ সেকেন্ডে যখন মহাবিশ্ব ছিল ততটাই ক্ষুদ্র যার চেয়ে ক্ষুদ্রতম কিছু স্পেসে থাকতে পারে না। এটাকে বলা হয় প্লাঙ্ক গোলক যার ব্যাসার্ধ হচ্ছে প্লাঙ্ক দৈর্ঘ্যের (১.৬ x ১০ -৩৫ মিটার) সমান। তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্র থেকে যেমন অনুমান করা হয় তখন মহাবিশ্বের মোট এন্ট্রপি এখনকার মোট এন্ট্রপির চেয়ে তেমনভাবেই কম ছিল। অবশ্য প্লাঙ্ক গোলকের মতো একটা ক্ষুদ্রতম গোলকের পক্ষে সর্বোচ্চ যতটা এন্ট্রপি ধারণ করা সম্ভব তখন মহাবিশ্বের এন্ট্রপি ঠিক ততটাই ছিল। কারণ একমাত্র কোনো ব্ল্যাক হোলের পক্ষেই প্লাঙ্ক গোলকের মতো এতটা ক্ষুদ্র আকার ধারণ করা সম্ভব। আর আমরা জানি, ব্ল্যাক হোলের এন্ট্রপি সব সময়ই সর্বোচ্চ।
চিত্রটির গাণিতিক ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে, Victor J. Stenger এর Has Science Found God? The Latest Results in the Search for Purpose in the Universe, Amherst, NY: Prometheus Books, 2003 বইয়ের appendix C, পৃষ্ঠা নং ৩৫৬-৫৭ তে।
অনেকে এই তত্ত্ব শুনে অনেক সময়ই যে আপত্তি জানান সেটা হলো, ‘আমাদের হাতে এখনো প্লাঙ্ক সময়ের পূর্বের ঘটনাবলির ওপর প্রয়োগ করার মতো কোনো কোয়ান্টাম মহাকর্ষের তত্ত্ব নেই’।
আমরা যদি সময়ের আইনস্টাইনীয় সংজ্ঞাটাই গ্রহণ করি, মানে ঘড়ির সাহায্যে যেটা মাপা হয়- তাহলে দেখা যায় প্লাঙ্ক সময়ের চেয়ে ক্ষুদ্রতম সময়ের ব্যাপ্তি মাপতে হলে আমাদের প্লাঙ্ক দৈর্ঘ্যের চেয়ে ক্ষুদ্রতম দৈর্ঘ্যে মাপজোখ করতে হবে। যেখানে প্লাঙ্ক দৈর্ঘ্য হচ্ছে প্লাঙ্ক সময়ের আলো যে পথ অতিক্রম করে তার দৈর্ঘ্য।
অর্থাৎ আলোর গতি ও প্লাঙ্ক সময়ের গুণফল। কিন্তু হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা নীতি থেকে আমরা জানি, কোনো বস্তুর অবস্থান যত সূক্ষ্মভাবে মাপা হয় তার শক্তির সম্ভাব্য মান ততই বাড়তে থাকে। এবং গাণিতিক হিসাব থেকে দেখানো যায় প্লাঙ্ক দৈর্ঘ্যের সমান কোনো বস্তুকে পরিমাপযোগ্যভাবে অস্তিত্বশীল হতে হলে তার শক্তি এতটাই বাড়তে হবে যে সেটা তখন একটা ব্ল্যাক হোলে পরিণত হবে। যে ব্ল্যাক হোল থেকে কোনো তথ্যই বের হতে পারে না। এখান থেকে বলা যায় প্লাঙ্ক সময়ের চেয়ে ক্ষুদ্রতম কোনো সময়ের বিস্তার সংজ্ঞায়িত করা সম্ভব নয়।
বর্তমান সময়ের কথা চিন্তা করুন। পদার্থবিজ্ঞানের কোনো প্রতিষ্ঠিত সূত্র প্রয়োগেই আমাদের দ্বিধার কিছু নেই যতক্ষণ না আমরা প্লাঙ্ক সময়ের চেয়ে ক্ষুদ্র বিস্তারের কোনো সময়ের জন্য এটার প্রয়োগ করছি। মূলত সংজ্ঞা অনুযায়ী সময়কে গণনা করা হয় প্লাঙ্ক সময়ের পূর্ণ সংখ্যার গুণিতক হিসেবে। আমরা আমাদের গাণিতিক পদার্থবিজ্ঞানে সময়কে একটা ক্রমিক চলক হিসেবে ধরে পার পেয়ে যাই, কারণ সময়ের এই ক্ষুদ্র অবিভাজ্য একক এতই ছোট যে ব্যবহারিক ক্যালকুলাসে আমাদের এর কাছাকাছি আকারের কিছুই গণনা করতে হয় না। আমাদের সূত্রগুলো প্লাঙ্ক সময়ের মধ্যেকার অংশগুলো দিয়ে এক্সট্রাপোলেটেড হয়ে যায় যদিও এই পরিসীমার মধ্যে কিছু পরিমাপ অযোগ্য এবং অসংজ্ঞায়িত হিসেবে থেকে যাবে।
এভাবে এক্সট্রাপোলেট যেহেতু আমরা ‘এখন’ করতে পারি, সেহেতু নিশ্চয় বিগ ব্যাং-এর শুরুতে প্রথম প্লাঙ্ক পরিসীমার শেষেও করতে পারব।
সেই সময়ে আমাদের এক্সট্রাপোলেশনের হিসাব থেকে আমরা জানি যে তখন এন্ট্রপি ছিল সর্বোচ্চ। এর মানে সেখানে ছিল শুধু ‘পরম বিশৃঙ্খলা’। অর্থাৎ,
কোনো ধরনের শৃঙ্খলারই অস্তিত্ব ছিল না। তাই, শুরুতে মহাবিশ্বে কোনো শৃঙ্খলাই ছিল না। এখন আমরা মহাবিশ্বে যে শৃঙ্খলা দেখি তার কারণ, এখন বর্ধিত আয়তন অনুপাতে মহাবিশ্বের এন্ট্রপি সর্বোচ্চ নয়।
সংক্ষেপে বললে, আমাদের হাতে থাকা কসমোলজিক্যাল উপাত্ত মতে মহাবিশ্বের সূচনা হয়েছে কোনো ধরনের শৃঙ্খলা, পরিকল্পনা বা নির্মাণ ছাড়াই। শুরুতে ছিল শুধুই বিশৃঙ্খলা।
বাধ্য হয়েই আমাদের বলতে হচ্ছে যে আমরা চারপাশে যে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম শৃঙ্খলা দেখি তা কোনো আদি স্রষ্টার দ্বারা সৃষ্ট নয়। বিগ ব্যাং-এর আগে কী হয়েছে তার কোনো চিহ্নই মহাবিশ্বে নেই। এবং সৃষ্টিকর্তার কোনো কাজের চিহ্নই বা তার কোনো নকশাই এখানে বলব নেই। তাই তার অস্তিত্বের ধারণাও অপ্রয়োজনীয়।
আবারও আমরা কিছু বৈজ্ঞানিক ফলাফল পেলাম যেগুলো একটু অন্যরকম হলেই সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বের প্রমাণ হয়তো হতে পারত। যেমন মহাবিশ্ব যদি ক্রমপ্রসারণশীল না হয়ে স্থির আকৃতির হতো (যেমনটা বাইবেল বা অন্যান্য ধর্মগ্রন্থগুলো বলে) তাহলেই তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্র মতে আমরা দেখতাম সৃষ্টির আদিতে এন্ট্রপির মান সর্বোচ্চ-সম্ভাব্য-এন্ট্রপির চেয়ে কম ছিল। তার মানে দাঁড়াত মহাবিশ্বের সূচনাই হয়েছে খুবই সুশৃঙ্খল একটা অবস্থায়। যে শৃঙ্খলা আনা হয়েছে বাইরে থেকে। এমনকি পেছনের দিকে অসীম অতীতেও যদি মহাবিশ্বের অস্তিত্ব থাকত তাহলে আমরা যতই পেছনে যেতাম দেখতাম সবকিছুই ততই সুশৃঙ্খল হচ্ছে এবং আমরা একটা পরম শৃঙ্খলার অবস্থায় পৌঁছে যেতাম যে শৃঙ্খলার উৎস সকল প্রাকৃতিক নিয়মকেই লঙ্ঘন করে।
Victor J. Stenger 4 Has Science Found God? The Latest Results in the Search for Purpose in the Universe, Amherst, NY: Prometheus Books, 2003, পৃষ্ঠা নং ৩৫১-৫৩।
এই লাইনটি আবারো একটু বিশদভাবে ব্যাখ্যার দাবি রাখে। সাধারণত পদার্থবিজ্ঞানের বইগুলোতে (যেমন শন ক্যারলের ‘From Eternity to Here : The Quest for the Ultimate Theory of Time’ বইটি দ্রষ্টব্য) বলা হয়ে থাকে মহাবিশ্ব শুরু হয়েছে খুব নিম্ন এনট্রপির অবস্থা থেকে। মনে হতে পারে যে উপরিউক্ত লাইনটি সেই বাস্তবতার পরিপন্থী। হ্যাঁ, নিম্ন এন্ট্রপি থেকে মহাবিশ্বের যাত্রা শুরুর ব্যপারটা যেভাবে সাধারণ বইগুলোতে বলা হয় সেটা ভুল নয়, কিন্তু একই সাথে মহাবিশ্ব যাত্রা শুরু করতে পারে সর্বোচ্চ এনট্রপি অর্থাৎ কোয়ান্টাম স্কেলের চরম বিশৃঙ্খলা থেকেও, যাকে ‘কেওস’ নামে অভিহিত করা হয়। আর তারপর যখন থেকে মহাবিশ্ব প্রসারিত হতে শুরু করল, সর্বোচ্চ এনট্রপি বাড়তে থাকল প্রকৃত এন্ট্রপি থেকে দ্রুত হারে (প্রদত্ত গ্রাফ দ্রষ্টব্য)। সেজন্যই অধ্যাপক ভিক্টর স্টেঙ্গর তার ‘ডিফেন্ডিং দ্য ফ্যালাসি অব ফাইনটিউনিং’ শিরোনামের পেপারে বলেন, ‘A volume of space can have maximal entropy and still contain very low entropy as compared to the visible universe. Assume our universe starts out at the Planck time as a sphere of Planck dimensions. Its entropy will be as low as it can be. However, at the same time, a Planck sphere is akin to a black hole whose entropy is maximal for an object of the same radius. It is not logically inconsistent to be both low and maximum at the same time. In short, the universe could have started out in complete disorder and still produced organized structures. The reason is, as the universe expands its maximum allowed entropy grows with it so that order can form without violating the second law of thermodynamics.’
সিংগুলারিটি বা অদ্বৈত বিন্দু
১৯৭০ সালে জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং এবং গণিতবিদ রজার পেনরোজ, পেনরোজের আগের একটি উপপাদ্যের আলোকে প্রমাণ করেন যে, বিগ ব্যাং-এর শুরুতে ‘সিংগুলারিটি” বা অদ্বৈত বিন্দুর অস্তিত্ব ছিল”। সাধারণ আপেক্ষিকতাকে শূন্য সময়ের আলোকে বিবেচনা করার মাধ্যমে দেখা যায় যে, বর্তমান থেকে পেছনে যেতে থাকলে মহাবিশ্বের আকার ক্রমশ ছোট এবং ঘনত্ব বৃদ্ধি পায়। পেছনে যেতে যেতে যখন মহাবিশ্বের আকার শূন্য হয় তখন সাধারণ আপেক্ষিকতার গণিত অনুযায়ী এর ঘনত্ব হয় অসীম। মহাবিশ্ব তখন অসীম ভর ও ঘনত্ববিশিষ্ট একটি বিন্দু যার নাম ‘পয়েন্ট অব সিংগুলারিটি’। ধর্মবেত্তারা যারা বিগ ব্যাংকে ঈশ্বরের কেরামতি হিসেবে ফুটিয়ে তুলতে চান তাঁরা বলেন, তখন সময় বলেও কিছু ছিল না।
তার পর থেকে এভাবেই চলছে। বিগ ব্যাং-এর আগে অসীম ভর ও ঘনত্বের বিন্দুতে সবকিছু আবদ্ধ ছিল, তখন ছিল না কোনো সময়। তারপর ঈশ্বর ফুঁ দানের মাধ্যমে এক মহাবিস্ফোরণ ঘটান, সূচনা হয় মহাবিশ্বের, সূচনা হয় সময়ের। যেমন, আমরা আমাদের ‘অবিশ্বাসের দর্শন’ বইয়ে আমেরিকার রক্ষণশীল লেখক দিনেশ ডি’সুজার উদাহরণ হাজির করেছিলাম। ডি’সুজা তাঁর একটি বইয়ে বলেছেন, ‘বুক অব জেনেসিস যে ঈশ্বরপ্রদত্ত মহাসত্য গ্রন্থ সেটা আরেকবার প্রমাণিত হলো। আধুনিক বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন যে, মহাবিশ্বের উৎপত্তি হয়েছিল শক্তি ও আলোর এক বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে। এমন না যে, স্থান ও সময়ে মহাবিশ্বের সূচনা ঘটেছে, বরং মহাবিশ্বের সূচনা ছিল সময় ও স্থানেরও সূচনা’”। ডি’সুজা আরও বলেন, ‘মহাবিশ্বের সূচনার আগে সময় বলে কিছুর অস্তিত্ব ছিল না। অগাস্টিন অনেক আগেই লিখেছিলেন, মহাবিশ্বের সূচনার ফলে সময়ের সূচনা হয়েছিল। এতদিনে আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান নিশ্চিত করল, অগাস্টিন এবং ইহুদি, খ্রিষ্টানদের মহাবিশ্বের সূচনা সম্পর্কে আদিম উপলব্ধির সত্যতা’। একই ধরনের কথা মুসলিম জগতের জনপ্রিয় ‘দার্শনিক’ হারুন ইয়াহিয়াও (আসল নাম আদনান অকতার; যার নামে বিবর্তন তত্ত্বকে বিকৃত করে সৃষ্টিবাদের রূপকথা প্রচার, নারী ধর্ষণ, মাদক চোরাচালানসহ বহু অভিযোগ আছে, এবং তাকে বিভিন্ন সময় কারাবাসেও যেতে হয়েছিল। বলেছেন একাধিকবার, প্রাচ্যের খ্রিষ্টীয় সৃষ্টিবাদীদের ধারণাগুলোর পর্যাপ্ত ‘ইসলামীকরণ’ করেঃ
Stephen W. Hawking and Roger Penrose, ‘The Singularities of Gravitational Collapse and Cosmology,’ Proceedings of the Royal Society of London, series A, 314 (1970): পৃষ্ঠা নং ৫২৯-৪৮।
Dines D’ Souza, What’s So Great About Christianity?, Washington, DC: Regnery, 2007, পৃষ্ঠা নং ১১৬।
‘বিজ্ঞানীরা এখন জানেন, মহাবিশ্বের উদ্ভব ঘটেছে সিংগুলারিটি থেকে এক অচিন্তনীয় মহাবিস্ফোরণের মাধ্যমে, যাকে আমরা বিগ ব্যাং নামে চিনি। অন্য কথায় মহাবিশ্ব সৃষ্ট হয়েছে। অর্থাৎ আল্লাহই একে বানিয়েছে।
ইসলামি পণ্ডিত জাকির নায়েকও প্রায়ই তাঁর বিভিন্ন লেকচারে কোরানের একটি বিশেষ আয়াতকে বিগ ব্যাং-এর ‘প্রমাণ’ হিসেবে হাজির করেন।৪। ডি’সুজা, হারুন ইয়াহিয়া, আর জাকির নায়েকরা সুযোগ পেলেই এভাবে বিগ ব্যাং-এর সাথে নিজ নিজ ধর্মগ্রন্থের আয়াত জুড়ে দিয়ে এর একটা অলৌকিক মহিমা প্রদান করতে চান। কিন্তু আদতে বিজ্ঞানের এই আবিষ্কার প্রাচীন এ সমস্ত ধর্মগ্রন্থের সত্যতার কোনো রকমের নিশ্চয়তা তো দেয়ই না, বরং এই ধর্মগ্রন্থ এবং আরও অনেক ধর্মগ্রন্থে থাকা সৃষ্টির যে গল্প এত দিন ধার্মিকেরা বিশ্বাস করে এসেছেন তা কতটা ভুল এবং অদ্ভুত সেটাই প্রমাণ করে।
যা-ই হোক, সিংগুলারিটির কথা বলে ধার্মিকদের মাঝে গভীর সাড়া ফেলা স্টিফেন হকিং ও পেনরোজ প্রায় বিশ বছর আগে ঐকমত্যে পৌঁছান যে, বাস্তবে সিংগুলারিটি নামের কোনো বিন্দুর অস্তিত্ব আসলে ছিল না, এবং নেই।
Dines D’ Souza, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১২৩।
অনন্ত বিজয় দাশ, হারুন ইয়াহিয়া : চকচক করলেই সোনা হয় না, যুক্তি, সংখ্যা ৪, জুলাই ২০১৩
যেমন, জাকির নায়েক তার একটি লেকচারে বলেছেন,
As far as Qur’an and modern Science is concerned, in the field of ‘Astronomy’, the Scientists, the Astronomers, a few decades earlier, they described, how the universe came into existence – They call it the ‘Big Bang’. And they said… ‘Initially there was one primary nebula, which later on it separated with a Big Bang, which gave rise to Galaxies, Stars, Sun and the Earth, we live in.’ This information is given in a nutshell in the Glorious Qur’an, in Surah Ambiya, Ch. 21, Verse No. 30, which says, “Do not the unbelievers see that the heavens and the earth were joined together, and we clove them asunder?’ Imagine this information which we came to know recently, the Qur’an mentions 14 hundred years ago.
এ প্রসঙ্গে পড়ুন, অবিশ্বাসের দর্শন (শুদ্ধস্বর, ২০১১; পুনর্মুদ্রণ ২০১২) বইটির ‘বিজ্ঞানময় কিতাব’ শিরোনামের অধ্যায়টি।
সাধারণ আপেক্ষিকতার ধারণায় হিসাব করলে অবশ্য তাদের আগের হিসেবে কোনো ভুল ছিল না। কিন্তু সেই ধারণায় সংযুক্ত হয়নি কোয়ান্টাম মেকানিকস। আর তাই সেই হিসাব আমলে নেওয়া যায় না। ১৯৮৮ সালে হকিং ‘আ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম’ বইতে বলেন, There was in fact no singularity at the beginning of universe. অর্থাৎ মহাবিশ্বের সূচনার সময়ে সিংগুলারিটির অস্তিত্ব ছিল না।
ডি’সুজা, হারুন ইয়াহিয়া কিংবা জাকির নায়েকের মতো মানুষেরা ‘আ ব্রিফ হিস্ট্রি অফ টাইম’ বইটিতে একনজর চোখ বুলিয়েছেন সেটা সত্যি। কিন্তু পড়ে বোঝার জন্য নয়। তাঁরা খুঁজেছেন তাঁদের মতাদর্শের সাথে যায় এমন একটি বাক্য এবং সেটা পেয়েই বাদবাকি কোনো দিকে নজর না দিয়ে লাফিয়ে উঠেছিলেন। তাঁরা বিভিন্ন সময় হকিংকে উদ্ধৃত করে বলেন, ‘মহাবিশ্বের সৃষ্টি হয়েছে একটা বিন্দু (সিংগুলারিটি) থেকে বিগ ব্যাং-এর মাধ্যমে’৷ তাঁরা মূলত হকিং-এর কথার আংশিক উদ্ধৃত করেন, মূল বিষয়টা চেপে গিয়ে। উদ্ধৃতির সামনের পেছনের বাকি বাক্যগুলোকে উপেক্ষা করার মাধ্যমে এমন একটি অর্থ তাঁরা দাঁড় করান, যা আসলে হকিংয়ের মতের ঠিক উল্টো। হকিং আসলে বলছিলেন তাঁদের ১৯৭০-এ করা প্রাথমিক এক হিসাবের কথা, যেখানে তাঁরা সিংগুলারিটির কথা আলোচনা করেছিলেন। সম্পূর্ণ কথাটি ছিল এমন—— ‘আমার ও পেনরোজের গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফল ১৯৭০ সালে একটি যুগ্ম প্রবন্ধের মাধ্যমে প্রথম প্রকাশিত হয়, যেখানে আমরা প্রমাণ করে দেখাই যে, বিগ ব্যাং-এর আগে অবশ্যই সিংগুলারিটির অস্তিত্ব ছিল, যতক্ষণ পর্যন্ত সাধারণ আপেক্ষিকতার তত্ত্ব সঠিক বলে ধরে নেওয়া হয়, এবং এ-ও ধরে নেওয়া হয় যে, বর্তমানে মহাবিশ্বে যেই পরিমাণ পদার্থ রয়েছে আগেও তাই ছিল’। হকিং আরও বলেন-
একসময় আমাদের (হকিং ও পেনরোজ) তত্ত্ব সবাই গ্রহণ করে নিল এবং আজকাল দেখা যায় প্রায় সবাই এটা ধরে নিচ্ছে যে মহাবিশ্বের সৃষ্টি হয়েছে একটা বিন্দু (সিংগুলারিটি) থেকে বিগ ব্যাং-এর মাধ্যমে। এটা হয়তো একটা পরিহাস যে এ বিষয়ে আমার মত পালটানোর পরে আমিই অন্য পদার্থবিজ্ঞানীদের আশ্বস্ত করতে চেষ্টা করছি, যে এমন কোনো সিংগুলারিটি আসলে ছিল না—কারণ, কোয়ান্টাম প্রভাব হিসাবে ধরলে সিংগুলারিটি বলে কিছু আর থাকে না’।
অথচ ধর্মবেত্তারা আজ অব্দি সেই সিংগুলারিটি পয়েন্টকে কেন্দ্রে করে স্রষ্টার অস্তিত্ব প্রমাণবিষয়ক অসংখ্য বই লিখে চলছেন। বছর খানেক আগে প্রকাশিত বইয়ে র্যাভি যাকারিয়াস বলেন, ‘আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতার তত্ত্বের পাশাপাশি বিগ ব্যাং তত্ত্বের মাধ্যমে আমরা এখন নিশ্চিত সবকিছুর অবশ্যই একটি সূচনা ছিল। সকল ডেটা আমাদের এই উপসংহার দেয় যে, একটি অসীম ঘনত্বের অদ্বৈত বিন্দু থেকেই মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ শুরু হয়েছিল’।
Stephen W. Hawking, A Brief History of Time: From the Big Bang to Black Holes, New York: Bantam, 1988, পৃষ্ঠা ৫০।
D’ Souza, What’s So Great About Christianity?, Washington, DC: Regnery, 2007, পৃষ্ঠা ১২১।
Stephen W. Hawking, A Brief History of Time: From the Big Bang to Black Holes, New York: Bantam, 1988, পৃষ্ঠা ৫০
Stephen W. Hawking, পূর্বোক্ত।
স্টিফেন হকিংয়ের প্রথম প্রবন্ধ এত ভালোভাবে পড়লেও পরবর্তীতে আর কিছু পড়ে দেখার ইচ্ছে হয়তো তাঁদের হয়নি। কিংবা পড়লেও, নিজেদের মতের সাথে মেলে না বলে তাঁরা সেটা এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে বের করে দিয়েছেন আরেক কান দিয়ে। তাঁরা অবিরাম ঘেঁটে চলছেন সেই পুরনো কাসুন্দি, যেই কাসুন্দি আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করেছেন কাসুন্দি প্রস্তুতকারী মানুষটি নিজেই।
সাদা চোখে মনে হতে পারে শূন্য থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে মহাবিশ্ব তৈরি হওয়াটা শক্তির নিত্যতার লঙ্ঘন। আসলে কিন্তু তা নয়। আগেই বলেছি, স্ফীতি তত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করা বিজ্ঞানীরা গণনা করে দেখেছেন যে, মহাবিশ্বের মোট শক্তির পরমাণ সব সময়ই শূন্য থাকে। শক্তির যোগফল শূন্য হলে এই পৃথিবী সূর্য, চেয়ার, টেবিলসহ হাজারো রকমের পদার্থ তাহলে এল কথা থেকে? বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, মহাবিশ্বের দৃশ্যমান জড়পদার্থগুলো তৈরি হয়েছে আসলে ধনাত্মক শক্তি থেকে, আর অন্যদিকে মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রের রয়েছে ঋণাত্মক শক্তি। এই দুটো পরস্পরকে নিষ্ক্রিয় করে দেয়। তাই, মহাবিশ্বের শক্তির বীজগণিতীয় যোগফল হিসাব করলে সব সময় শূন্যই পাওয়া যায়।
ব্যাপারটাকে আরেকটু বিস্তৃত করা যাক। গুথের দেওয়া স্ফীতি তত্ত্ব থেকে আমরা জেনেছি আলোক কণা—ফোটন কিংবা চেনাজানা পদার্থের আদি উপাদানগুলো—তৈরি হয়েছে মেকি শূন্যতা বা ফলস ভ্যাকুয়াম থেকে দশার স্থানান্তরের (Phase transition) মাধ্যমে (পূর্ববর্তী অধ্যায় দ্রষ্টব্য)। এ উপাদানগুলোর রয়েছে ধনাত্মক শক্তি। এই শক্তি কাটাকাটি হয়ে যায় মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রের ঋণাত্মক শক্তি দিয়ে’। কাজেই যে কেউ যেকোনো সময় বুক কিপিং- এর হিসাব মেলাতে বসলে দেখবেন, নিট যোগফল শূন্যই পাচ্ছেন তিনি। যত ভারী বস্তুকণা আমরা তৈরি করতে যাব, মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রের কাছে আমাদের তত ভারী ট্যাক্স দিতে হবে আগে।
অর্থাৎ, মহাবিশ্বের আকার বাড়াতে হলে বিপরীত দিকে মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রের মানও বাড়াতে হবে। স্টিফেন হকিং তাঁর বিখ্যাত ‘ইউনিভার্স ইন নাটশেল’ বইয়ে বলেন, ‘মহাবিশ্বের আকার দ্বিগুণ হবার অর্থ হলো পদার্থ ও মহাকর্ষীয় শক্তি উভয়েরই দ্বিগুণ হওয়া। শূন্যের দ্বিগুণ করলেও শূন্যই হয়। আহা, আমাদের ব্যাংকিং সিস্টেমও যদি এভাবে কাজ করত …’।
শক্তির নিত্যতাকে লঙ্ঘন না করেই স্রেফ শূন্য থেকে কিভাবে দৃশ্যমান মহাবিশ্বের উৎপত্তি ঘটতে পারে, তা পরিষ্কার করেছেন স্টিফেন হকিং তাঁর ‘কালের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস’ (দ্য ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম) গ্রন্থে এভাবে—
মহাবিশ্বে এই পরিমাণ জড়পদার্থ কেন রয়েছে তা মহাস্ফীতির ধারণা দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়। মহাবিশ্বের যেসব অঞ্চল আমরা পর্যবেক্ষণ করতে পারি সেখানে রয়েছে দশ মিলিয়ন মিলিয়ন মিলিয়ন মিলিয়ন মিলিয়ন মিলিয়ন মিলিয়ন মিলিয়ন মিলিয়ন মিলিয়ন মিলিয়ন মিলিয়ন মিলিয়ন মিলিয়ন (অর্থাৎ ১-এর পিঠে আশিটি শূন্য = ১.০ X ১০৮০) সংখ্যক জড় কণিকা। কোত্থেকে এগুলো সব এল? এর উত্তর হলো কোয়ান্টাম তত্ত্ব অনুযায়ী শক্তি থেকে কণিকা ও প্রতি কণিকা যুগল আকারে উৎপত্তি হতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন হলো এই শক্তি এল কোত্থেকে? এরও উত্তর হলো মহাবিশ্বের মোট শক্তির পরিমাণ হলো শূন্য। মহাবিশ্বে পদার্থ সৃষ্টি হয়েছে ধনাত্মক শক্তি থেকে। অবশ্য জড়পদার্থ মহাকর্ষণের দ্বারা নিজেকে পরিপূর্ণভাবে আকর্ষণ করছে। দুটি বস্তুখণ্ড যখন কাছাকাছি থাকে তখন তাদের শক্তির পরিমাণ যখন তারা অনেক দূরে থাকে তা থেকে কম। এর কারণ হলো এদের পৃথক করতে হলে যে মহাকর্ষীয় বল দ্বারা তারা পরস্পরের দিকে আকৃষ্ট হচ্ছে সেই বলের বিরুদ্ধে আপনাকে শক্তি ব্যয় করতে হবে। তাই এক অর্থে মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রের রয়েছে ঋণাত্মক শক্তি। এমন একটি মোটামুটি স্থানিক সুষম (approximately uniform in space) মহাবিশ্বের ক্ষেত্রে দেখানো যেতে পারে যে এই ঋণাত্মক মহাকর্ষীয় শক্তি পদার্থের প্রতিনিধিত্বকারী ধনাত্মক শক্তিকে নিখুঁতভাবে বিলুপ্ত করে দেয়। কাজেই মহাবিশ্বের মোট শক্তির পরিমাণ সব সময়ই শূন্য।
Ravi K. Zacharias, The End of Reason: A Response to the New Atheist, Grand Rapids, MI: Zondervan, 2008, পৃষ্ঠা নং ৩১।
Alexei V. Filippenko and Jay M. Pasachoff, A Universe from Nothing (Adapted from The Cosmos: Astronomy in the New Millennium, 1st edition, 2001).
Stephen W. Hawking, A Brief History of Time: From the Big Bang to Black Holes, New York: Bantam, 1988, পৃষ্ঠা ১৩৬
হকিং-এর ওপরের বক্তব্যের মর্মার্থ হচ্ছে, মহাবিশ্ব ‘সৃষ্টি’র জন্য বাইরে থেকে আলাদা কোনো শক্তি আমদানি করার প্রয়োজন হয়নি। সহজ কথায়,ইনফ্লেশন ঘটাতে যদি শক্তির নিট ব্যয় যদি শূন্য হয়, তবে বাইরে থেকে কোনো শক্তি আমদানি করার প্রয়োজন পড়ে না। অ্যালান গুথ ও স্টেইনহার্ট নিউ ফিজিকস জার্নালে (১৯৮৯) দেখিয়েছেন,ইনফ্লেশনের জন্য কোনো তাপগতীয় কাজের (thermodynamic work) দরকার পড়েনি।
মোটা দাগে মহাবিশ্ব ‘সৃষ্টি’র আগেকার মোট শক্তি যা ছিল অর্থাৎ শূন্য, সৃষ্টির পরও আমরা তা-ই পাচ্ছি –অর্থাৎ শূন্য। কাজেই মহাবিশ্বের উৎপত্তি ঘটতে গিয়ে শক্তির নিত্যতার লঙ্ঘন ঘটেনি। মহাবিশ্বের ব্যাপারে মূলধারার অধিকাংশ পদার্থবিদেরই এই একই অভিমত। উদাহরণ হিসেবে আমরা প্রখ্যাত পদার্থবিদ মিচিও কাকুর কথা বলতে পারি। আমাদের এই কাকাবাবু নিউ ইয়র্ক সিটি কলেজের অধ্যাপক এবং বর্তমানে বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করার পেছনে একজন শীর্ষস্থানীয় কান্ডারি। ‘ফিজিকস অব দ্য ইম্পসিবল’সহ বহু নিউ ইয়র্ক টাইমস বেস্ট সেলার বই আছে তাঁর ঝুলিতে। এমনি একটি সাম্প্রতিক গুরুত্বপূর্ণ বই হচ্ছে ‘সমান্তরাল বিশ্বগুলো’127 । বইটি ২০০৫ সালে প্রকাশের পর ব্রিটেনের স্যামুয়েল জনসন প্রাইজের জন্য শীর্ষ তালিকায় এসেছিল। এই বইয়ের স্ফীতিসংক্রান্ত অধ্যায়টিতে একটি অনুচ্ছেদ যোগ করেছেন কাকু ‘শূন্য থেকে মহাবিশ্ব’ নামে।
Michio Kaku, Parallel Worlds: A Journey Through Creation, Higher Dimensions, and the Future of the Cosmos, Anchor; Reprint edition, 2006
সেখানে তিনি ব্যাখ্যা করেছেন কেন শক্তির নিত্যতার সূত্র অক্ষুণ্ণ রেখেই শূন্য থেকে মহাবিশ্ব উদ্ভূত হওয়া সম্ভব। হকিং-এর সাম্প্রতিক ‘গ্র্যান্ড ডিজাইন’ বইটি বেরোনোর পর তিনি এ নিয়ে একটি ব্লগও লিখেছিলেন – ‘Can a Universe Create Itself Out of Nothing?’ শিরোনামে। সেখানেও ব্যাপারটি ব্যাখ্যা করেছেন আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের আলোকে। এ ছাড়া ইউটিউবেও কাকুর একটি চমৎকার ভিডিও আছে। সেখানে তিনি উল্লেখ করেছেন’।
আপনি হয়তো ভাবতে পারেন, শূন্য থেকে মহাবিশ্বের উদ্ভবের ধারনাটা পদার্থ ও শক্তির নিত্যতার সূত্রের লঙ্ঘন। কিভাবে আপনি শূন্য থেকে রাতারাতি একটা মহাবিশ্ব তৈরি করে ফেলতে পারেন? ওয়েল…যদি আপনি মহাবিশ্বের সমস্ত ভর হিসাব করেন, দেখবেন এটা ধনাত্মক। আর যদি আপনি মহাবিশ্বের মহাকর্ষ ক্ষেত্রের শক্তির হিসাব নেন, দেখবেন সেটা ঋণাত্মক। যখন আপনি এ দুটোকে যোগ করবেন, কী পাবেন? শূন্য। তার মানে মহাবিশ্ব তৈরি করতে কোনো শক্তি আসলে লাগছে না। মহাবিশ্ব ফ্রি পাচ্ছেন আপনি যেন ফ্রি লাঞ্চ হিসেবে। আপনি হয়তো মাথা নেড়ে ভাবতে পারেন – নাহ, এটা ঠিক নয়। এই যে চারদিকের ধনাত্মক চার্জ আর ঋণাত্মক চার্জ দেখি, কই তারা তো একে অপরকে নিষ্ক্রিয় করে দিচ্ছে না। তাহলে কিভাবে শূন্য থেকে মহাবিশ্ব পাওয়া যাবে? ওয়েল, আপনি যদি একইভাবে মহাবিশ্বের যাবতীয় ধনাত্মক চার্জের পরিমাণ আর ঋণাত্মক চার্জের পরিমাণ ধরে যোগ করেন, দেখবেন, যোগফল পাওয়া যাচ্ছে শূন্য! মহাবিশ্বের আসলে কোনো নেট চার্জ নেই। আচ্ছা স্পিন বা ঘূর্ণনের ব্যাপারেই বা ঘটনা কী? গ্যালাক্সির ঘূর্ণন আছে, তাই না? এবং তারা ঘুরে বিভিন্ন ডিরেকশনে। আপনি যদি গ্যালাক্সিগুলোর সমস্ত ঘূর্ণন যোগ করেন, কী পাবেন? শূন্য। সুতরাং – মহাবিশ্বের রয়েছে ‘শূন্য স্পিন’, ‘শূন্য চার্জ’, এবং ‘শূন্য এনার্জি কনটেন্ট’। অন্য কথায় পুরো মহাবিশ্বই শূন্য থেকে পাওয়া।
আদি কারণ
মহাবিশ্ব সৃষ্টির পেছনে আদি কারণ বলে কি কিছু আছে? থাকলে সেটা কী রকমের? আধুনিক জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাগুলো পাওয়ার আগ পর্যন্ত ঢালাওভাবে ঈশ্বরকেই ‘আদি কারণ’ হিসেবে অভিহিত করা হতো, অনেক মহল থেকে এখনো করা হয় তুমুল উৎসাহের সাথেই। বার্টরান্ড রাসেল তাঁর বিখ্যাত ‘Why I am not a Christian’ প্রবন্ধে প্রথম কারণ সম্বন্ধে বলেন,
Michio Kaku, Can a Universe Create Itself Out of Nothing?, November 24, 2010
Michio Kaku, Michio Kaku: Space Bubble Baths and the Free Universe (Youtube video); Transcript : A Universe is a Free
Lunch; (bigthink.com)
আমাদের আগেই বুঝে রাখা দরকার যে জগতের যা কিছু আমরা দেখতে পাই, সবকিছুর একটি কারণ আছে। এই কারণকে প্রশ্ন করতে করতে আপনি পেছনের দিকে এগিয়ে গিয়ে অবশ্যই প্রথম কারণের (First Cause) সম্মুখীন হবেন,এবং এই প্রথম কারণকেই স্বতঃসিদ্ধভাবে ‘ঈশ্বর’ হিসেবে ধরে নেওয়া হয়।… আমিও বহুদিন ধরেই এটিকে স্বতঃসিদ্ধ হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছিলাম কিন্তু একদিন, যখন আমার বয়স আঠারো, আমি জন স্টুয়ার্ট মিলের আত্মজীবনী পড়ছিলাম, আর পড়তে গিয়েই সেখানে এই বাক্যটি পেলাম: ‘আমার বাবা আমাকে প্রশ্ন করলেন, ‘কে আমাকে তৈরি করেছে?’ আমি এ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারিনি। কিন্তু এই প্রশ্নটি আমাকে আরও একটি প্রাসঙ্গিক প্রশ্নের দিকে ঠেলে দিল। যেটি হলো, ঈশ্বরই যদি আমাকে তৈরি করে থাকেন, তবে ঈশ্বরকে তৈরি করেছে কে?’ আমি এখনো মনে করি, “ঈশ্বরকে তৈরি করেছে কে?’ এই সহজ-সরল বাক্যটি প্রথম কারণসম্পর্কিত যুক্তির দোষটি প্রথম আমাকে দেখাল। যদি প্রতিটি জিনিসের পেছনে একটি কারণ থাকে, তবে ঈশ্বরেরও কারণ থাকতে হবে। আবার যদি কারণ ছাড়াই কোনো কিছু থাকতে পারে (যেমন ঈশ্বর), তবে এই যুক্তি ঈশ্বরের জগতের জন্যও সমানভাবে প্রযোজ্য।
আমরা নবম অধ্যায়ে বিগ ব্যাং বা মহাবিস্ফোরণের ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। সেখানে বলেছিলাম, একটা সময় পর্যন্ত মহাবিস্ফোরণ বা “বিগ ব্যাং’ তত্ত্বের পাশাপাশি ‘স্টেডি স্টেট’ বা ‘স্থিতিশীল তত্ত্ব’ নামে আরেকটি তত্ত্ব পাশাপাশি রাজত্ব করত। স্থিতি তত্ত্বের প্রবক্তা ছিলেন বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ ফ্রেডরিক হয়েল। তাঁর কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন কেমব্রিজ কলেজের হারমান বন্ডি, থমাস গোল্ড এবং পরবর্তীকালে একজন ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানী – জয়ন্ত নারলিকার। মহাবিশ্বের উৎপত্তির পেছনে সমাধানটা কি মহাবিস্ফোরণ নাকি স্থিতিশীল তত্ত্ব থেকে আসবে এ নিয়ে ঝানু ঝানু বিজ্ঞানীরা দ্বিধাবিভক্ত ছিলেন সে সময়। তবে পরবর্তীতে বিজ্ঞানীদের বিভিন্ন পর্যবেক্ষণের সূত্রে বেরিয়ে আসতে শুরু করল যে মহাবিশ্ব স্থিতিশীল নয়, বরং ক্রমশ প্রসারমাণ। বিশেষ করে ১৯৬৪ সালের দিকে আর্নো পেনজিয়াস ও রবার্ট উইলসন আকস্মিকভাবে ‘মহাজাগতিক পশ্চাদপট বিকিরণ’-এর খোঁজ পাওয়ার পর স্থায়ীভাবে স্থিতি তত্ত্বকে হটিয়ে বিগ ব্যাং-কে জায়গা করে দেয় সঠিক তত্ত্বের সিংহাসনে।
তবে মহাবিস্ফোরণ বা ‘বিগ ব্যাং’ তত্ত্বটি বৈজ্ঞানিক সমাজে গৃহীত হওয়ার পর থেকেই যেন বিশ্বাসীদের মধ্যে নতুন করে ‘প্রথম কারণ’টিকে প্রতিষ্ঠিত করার নব উদ্দীপনা লক্ষ করা গিয়েছে। ১৯৫১ সালে Pope Plius XII পন্টিফিকাল একাডেমির সভায় বলেই বসলেন—
‘যদি সৃষ্টির শুরু থাকে, তবে অবশ্যই এই সৃষ্টির একজন স্রষ্টাও রয়েছে, আর সেই স্রষ্টাই হলেন ঈশ্বর’।
আমরা আজ জানি, জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও ধর্মযাজক জর্জ হেনরি লেমিত্রি (যিনি ‘বিগ ব্যাং’ প্রতিভাসের একজন অন্যতম প্রবক্তা ছিলেন) পোপকে সে সময় বিনয়ের সঙ্গে এ ধরনের যুক্তিকে ‘অভ্রান্ত’ হিসেবে প্রচার করা থেকে বিরত থাকতে পরামর্শ দিয়েছিলেন। এগুলো সবই আমরা আগের অধ্যায়ে আলোচনা করেছি। এখানে বরং আমরা এই তথাকথিত ‘আদি কারণের’ দার্শনিক ভিত্তিটি নিয়ে একটু আলোচনা করব।
অনেকেই হয়তো জানেন, ‘কালাম কসমোলজিক্যাল আর্গুমেন্ট’ (Kalam Cosmological Argument) নামে একটি দার্শনিক যুক্তিমালা আছে যেটা বিশ্বাসীরা মহা উৎসাহের সাথে ‘ঈশ্বরের প্রমাণ’ হিসেবে হাজির করেন। বিতার্কিক উইলিয়াম লেন ক্রেইগ (William Lane Craig) ১৯৭৯ সালে লেখা “দ্য কালাম কসমোলজিক্যাল আর্গুমেন্ট’ নামক বইয়ের মাধ্যমে যুক্তির এই ধারাকে একসময় সাধারণ মানুষের কাছে জনপ্রিয় করে তোলেন। যদিও বহুবারই তাঁর এই যুক্তিমালা বিভিন্নভাবে খণ্ডিত হয়েছে, তার পরও ভাঙা রেকর্ডের মতো এই যুক্তিমালাকে এখনো ‘ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রমাণ’ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। কালামের যুক্তির ধারাটিকে নিচের চারটি ধাপের সাহায্যে বর্ণনা করা যায়ঃ
১। যার শুরু (উৎপত্তি) আছে, তার পেছনে একটি কারণ রয়েছে।
২। আমাদের আজকের এই মহাবিশ্বের একটি উৎপত্তি আছে।
৩। সুতরাং এই মহাবিশ্বের পেছনে একটি কারণ আছে।
৪। সেই কারণটিই হলো ‘ঈশ্বর’।
সংশয়বাদী দার্শনিকেরা কালামের যুক্তিকে তীব্রভাবে আক্রমণ করেছেন বিভিন্ন সময়েই30। আমাদের পূর্ববর্তী ‘অবিশ্বাসের দর্শন’ কিংবা ‘বিজ্ঞান ও বিশ্বাস’ প্রভৃতি বইয়ে কালামের এই ‘আদি কারণের’ বিস্তৃত খণ্ডন অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এখানে বাহুল্য বিধায় সেগুলোর পুনরুল্লেখ করা হলো না। তবে একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার উল্লেখ না করলেই নয়। সবকিছুর পেছনেই ‘কারণ’ আছে বলে পেছাতে পেছাতে বিশ্বাসীরা ঈশ্বরের কাছে গিয়ে হঠাৎ করেই থেমে যান। এ সময় আর তাঁরা যেন কোনো কারণ খুঁজে পান না। মহাবিশ্বের জটিলতাকে ব্যাখ্যা করার জন্য যদি ঈশ্বর নামক একটি সত্তার আমদানি করতেই হয়, তবে সেই ঈশ্বরকে ব্যাখ্যা করার জন্য একই যুক্তিতে আরেকটি ‘ঈশ্বর’কে কারণ হিসেবে আমদানি করা উচিত। তারপর সেই ‘ঈশ্বরের ঈশ্বর’-এর অস্তিত্ব ব্যাখ্যার জন্য লাগবে আরেকজন ঈশ্বর। এভাবে আমদানির খেলা চলতেই থাকবে একের পর এক, যা আমাদের অসীমের দিকে ঠেলে দেবে। এই ব্যাপারটি স্বাভাবিকভাবেই সকল বিশ্বাসীর কাছে আপত্তিকর। তাই ধর্মবাদীরা নিজেরাই ‘সবকিছুর পেছনেই কারণ আছে’ এই স্বতঃসিদ্ধের ব্যতিক্রম হিসেবে ঈশ্বরকে কল্পনা করে থাকেন আর সোচ্চারে ঘোষণা করেন, ‘ঈশ্বরের অস্তিত্বের পেছনে কোনো কারণের প্রয়োজন নেই।’ সমস্যা হলো যে, এই ব্যতিক্রমটি কেন শুধু ঈশ্বরের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হবে, মহাবিশ্বের ক্ষেত্রে কেন নয়, এর কোনো যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা তাঁরা দিতে পারেন না।
উৎসাহী পাঠকেরা ‘অবিশ্বাসের দর্শন’ (শুদ্ধস্বর) ‘বিশ্বাস ও বিজ্ঞান’ (চারদিক) বই দুটো পড়ে দেখতে পারেন। দেখতে পারেন মুক্তমনায় প্রকাশিত বিভিন্ন প্রবন্ধও।
আর তাছাড়া ‘যার শুরু আছে তার পেছনে কারণ থাকতেই হবে’— কালামের যুক্তিমালার প্রাথমিক ধাপটিকে বিজ্ঞানের জগতে অনেক আগেই খণ্ডন করা হয়েছে কারণবিহীন কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশনের উদাহরণ হাজির করে। পারমাণবিক পরিবৃত্তি, পারমাণবিক নিউক্লিয়াসের তেজস্ক্রিয় অবক্ষয়ের মতো কোয়ান্টাম ঘটনাসমূহ ‘কারণবিহীন ঘটনা’ হিসেবে ইতোমধ্যেই বৈজ্ঞানিক সমাজে স্বীকৃত’। হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা তত্ত্ব অনুযায়ী সামান্য সময়ের জন্য শক্তির (যা E = mc² সূত্রের মাধ্যমে শক্তি ও ভরের সমতুল্যতা প্রকাশ করে) উদ্ভব ও বিনাশ ঘটতে পারে— স্বতঃস্ফূর্তভাবে— কোনো কারণ ছাড়াই। এগুলো সব পরীক্ষিত সত্য। কাজেই সত্য। কাজেই ওপরের ওপরের উদাহরণগুলোই কালামের যুক্তিকে বৈজ্ঞানিকভাবে খণ্ডন করার জন্য যথেষ্ট।
আমরা অবশ্য ‘আদি কারণ’ নিয়ে দার্শনিক কথার ফুলঝুরি কিংবা মারপ্যাচের চেয়ে ঢের আগ্রহী আধুনিক বিজ্ঞান কী বলছে জানতে। আলোচ্য স্ফীতির প্রসঙ্গেই আসা যাক। স্ফীতি তত্ত্বের মূল ধারণাগুলো কোয়ান্টাম কসমোলজি নামক আধুনিক শাখাটির ক্রমিক উন্নয়নের প্রভাবজাত ফলাফল বললে অত্যুক্তি হবে না। কোয়ান্টাম বলবিদ্যার সূত্রগুলো একসময় কেবল আমরা খুব ক্ষুদ্র স্কেলে পারমাণবিক জগতের জন্য প্রযোজ্য বলে ভাবতাম। কিন্তু আশির দশকের পর থেকে স্টিফেন হকিংসহ অন্য বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন, আমাদের মহাবিশ্ব যেহেতু এ ধরনের কোয়ান্টাম স্তরের মতো ক্ষুদ্র অবস্থা থেকেই যাত্রা শুরু করেছিল, কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যার সূত্রগুলো মহাবিশ্বের আদি অবস্থায়ও প্রয়োগ করা যাবে। পরে এই প্রচেষ্টার সাথে যুক্ত হয় ইনফ্লেশনারি জোতির্বিদ্যা থেকে আহৃত জ্ঞান। এই দুই শাখার সুসংহত উপসংহারের মূল নির্যাসটিই হচ্ছে, কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশনের মধ্য দিয়ে এই মহাবিশ্বের উদ্ভব আর তারপর স্ফীতির মাধ্যমে এর দানবীয় প্রসার। শুরুর দিকে ছোট্ট একটা শূন্য স্থানের কথা আমরা ভাবতে পারি, যার মধ্যে ‘ভ্যাকুয়াম এনার্জি’ লুকিয়ে ছিল। এই ধরনের মেকি স্থানকে আমরা আগের অধ্যায়ে ‘ফলস ভ্যাকুয়াম’ হিসেবে জেনেছি। আমরা আরো জেনেছি এই মেকি শূন্যতা সূচকীয় হারে প্রসারিত হতে থাকবে এবং সেটাই হয়েছিল। শূন্যতার যে শক্তির কথা আমরা বলছি সেটা যদি ‘ডায়নামিক’ বা গতিময় ধরনের কিছু হয়ে থাকে, তবে এটা সময়ের সাথে সাথে বিবর্তিত হবে, আর একটা সময় এটা নিজেকে তরঙ্গশক্তিতে রূপান্তরিত করতে পারে। এই তরঙ্গশক্তির কিছু অংশ হয়তো আমাদের চেনাজানা পদার্থে পরিণত হবে, কিছুটা হয়তো থেকে যাবে গুপ্ত শক্তি হিসেবে। এভাবে উত্তপ্ত মিশ্রণ একসময় কিছুটা ঠান্ডা হবে আর শেষ পর্যন্ত তৈরি করবে এমন এক মহাবিশ্ব যেটা ১৪০০ কোটি বছর আগে আমাদের মহাবিশ্বের অনুরূপ। আমরা দশম অধ্যায়ে স্ফীতি তত্ত্বের পেছনের মূল বিজ্ঞানটি এবং এর ইতিহাস নিয়ে আমরা বিস্তৃত পরিসরে আলোচনা করেছিলাম। সে সবের পুনরুল্লেখ এখানে প্রয়োজনীয় নয়; আমরা এখানে দেখব ইনফ্লেশনের পেছনে যদি ‘আদি’ কারণ থাকে সেটি কী হতে পারে! এক্ষেত্রে তিনটি সম্ভাবনার কথা আমরা বলতে পারিঃ
এক, স্ফীতির প্রাথমিক বীজ আসতে পারে আণুবীক্ষণিক আকারের বিকর্ষণমূলক পদার্থ থেকে। অ্যালেন গুথ তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন, খুব ছোট মাত্র এক আউন্সের মতো একটা ভর থেকেই ইনফ্লেশন যাত্রা শুরু করতে পারে, যার ব্যাস হতে পারে একটি প্রোটনের চেয়েও একশত কোটি গুণ ছোট কিছু। স্ফীতির সেই ছোট্ট বীজ ট্রিয়ন বর্ণিত ভ্যাকুয়াম ফ্লাকচুয়েশনের সমান, যা কোয়ান্টাম শূন্যতা থেকে উদ্ভূত হতে পারে সময় সময়।
মহাবিশ্বের ক্ষেত্রে একটি বড় একটি সম্ভাবনা হচ্ছে একেবারে ‘শূন্য” থেকে উদ্ভূত হওয়া, যেটা টাফট্স বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আলেকজান্ডার ভিলেস্কিনের গবেষণা থেকে উঠে এসেছে। ভিলেঙ্কিনের এই শূন্যতা মানে কিন্তু কেবল শূন্যস্থান বা ‘এম্পটি স্পেস’ নয়, একেবারেই যাকে বলে ‘নাথিং’। ভিলেঙ্কিন দেখিয়েছেন যে সেই ‘নাথিং’ থেকে কোয়ান্টাম টানেলিং প্রক্রিয়ায় মহাবিশ্বের উদ্ভব ঘটতে পারে।
দ্বিতীয় আরেকটি সম্ভাবনা কিংবা প্রস্তাবনা হলো, শুরু নিয়ে এ ধরনের প্রশ্নই অর্থহীন। স্টিফেন হকিং ‘প্রান্তহীন প্রস্তাবনা” (no – boundary proposal) শীর্ষক একটি মডেলে দেখিয়েছেন, ‘স্থান’, ‘কাল’, ‘আগে’, ‘পরে’ কোনো কিছুই আসলে মহাবিশ্ব উদ্ভবের উষালগ্নে দ্ব্যর্থবোধক নয়। এগুলো অর্থহীন প্রশ্ন, অনেকটা ‘উত্তর মেরুর উত্তরে কী আছে’- প্রশ্নের মতো শোনায়। আশির দশকের শুরুতে জেমস হার্টলির সাথে তৈরি করা এই মডেলে হকিং দেখিয়েছেন, মহাবিশ্ব স্বয়ংসম্পূর্ণ (self contained) 34। তিনি তাঁর ‘ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম’ বইয়ে প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে বলেন, ‘যদি মহাবিশ্বের সূচনা থাকে, তবে হয়তো ভাবতে পারি এর পেছনে ঈশ্বর বলে কেউ হয়তো থাকতে পারেন। কিন্তু মহাবিশ্ব যদি পুরোপুরি স্বয়ংসম্পূর্ণই হয়, যদি তার কোনো সীমারেখা কিংবা প্রান্ত না থাকে, তবে তো এর কোনো শুরু নেই, শেষ নেই, it would simply be। তাহলে এখানে ঈশ্বরের স্থান কোথায়?’
Quantum phenomenon, such as atomic transitions and radioactive decay of nuclei, seem to happen without prior cause. In fact, the highly successful theory of quantum mechanics does not predict the occurence of these events, just their probabilities for taking place;… we have no current basis for assuming such cause exist. After all Quantum mechanics is almost a century old and has been utilized with immense success over the period, with no sign of such causes ever being found (Quoted from Prof. Victor Stenger’s Has Science Found God?: The Latest Results in the Search for Purpose in the Universe, Prometheus Books, pp 173)
Stephen W. Hawking, The Edge of Spacetime, in Paul C. Davies, ed., The New Physics, Cambridge University Press; 1989
Alex Vilenkin, Many Worlds in One: The Search for Other Universes, Hill and Wang, 2006
তৃতীয় আরেকটি জোরালো সম্ভাবনা আছে অবশ্য। সম্ভাবনাটি হলো ইনফ্লেশন হয়েছে বটে, কিন্তু এর সূচনা কিংবা এর পেছনে আদি কোন কারণ থাকতে হবে এমন কোনো কথা নেই। বরং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া সান্টা-ক্রুজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানী অ্যান্থনি অ্যাগুরি এবং কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানী স্টিভেন গ্র্যাটন ‘ইনফ্লেশন উইদাউট আ বিগিনিং’ শীর্ষক সাম্প্রতিক একটি গবেষণাপত্রে দেখিয়েছেন যে, যেকোনো ধরনের ‘শুরুর প্রস্তাবনা’ ছাড়াও ইনফ্লেশন বা স্ফীতি কাজ করতে পারে খুব ভালোভাবেই।
আর লিন্ডের ‘চিরন্তন’ স্ফীতি তত্ত্ব এসে আদি কারণকে খুব জোরেশোরে প্রশ্নবিদ্ধ করে দিয়েছে বলা যায়। তাঁর তত্ত্ব অনুযায়ী এ ধরনের স্ফীতি অবিরামভাবে স্ব- পুনরাবৃত্তি ঘটিয়ে প্রতি মুহূর্তেই তৈরি করছে এবং করবে নতুন নতুন মহাবিশ্ব। এই প্রক্রিয়া অনন্তকাল ধরে অতীতে যেমন চলেছে,ভবিষ্যতেও চলবে অবিরামভাবেই।
সে হিসেবে ১৪০০ কোটি বছর আগে ঘটা বিগ ব্যাং আমাদের মহাবিশ্বের শুরু হিসেবে চিহ্নিত করা হলেও অন্য সব মহাবিশ্বের জন্য সেটি ‘শুরু’ নয়। আসলে এই অনন্ত মহাবৈশ্বিক সিস্টেমের কোনো শুরু নেই,শেষও নেই। আজ থেকে ১০০ বিলিয়ন কিংবা ১০০ ট্রিলিয়ন বছর আগে কিংবা পরে যে সময়েই যাওয়া হোক না কেন, স্ফীতির মাধ্যমে ‘মাল্টিভার্স’ তৈরির চলমান প্রক্রিয়া অতীতে যেমন ছিল, ভবিষ্যতেও তেমনি থাকবে। আর এটা গাণিতিক ও বৈজ্ঞানিকভাবে খুবই সম্ভব’। লিন্ডে নিজেই বলেছেন, চিরন্তন এ স্ফীতি তত্ত্ব আজ অনেকের মাঝেই তৈরি করেছে ‘সৃষ্টি সুখের উল্লাসে কাঁপা’ এক সর্বজনীন দার্শনিক আবেদনের—এ মহাবিশ্ব যদি কোন দিন ধ্বংস হয়ে যায়ও, জীবনের মূল সত্তা হয়তো টিকে থাকবে অন্য কোনো মহাবিশ্বে, হয়তো
মহাবিশ্বের জন্য ওপরের কোনো সম্ভাবনা সত্য সেটা জানার জন্য হয়তো আমাদের ভবিষ্যতের কারিগরি দক্ষতা এবং উন্নয়নের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে, কিন্তু এটা সত্য যে, মডেলগুলোর কোনোটিই শুরু কিংবা আদি কারণের জন্য অতিপ্রাকৃত কোনো কিছুর ওপর নির্ভর করছে না। কয়েকটি মডেলে আদি কারণের একেবারেই দরকারই নেই, আর কয়েকটিতে যাও বা আছে, সেগুলোর সবগুলোই বরং প্রাকৃতিক উপায়ে মহাবিশ্বের উদ্ভবের দিকেই ইঙ্গিত করছে। প্রাকৃতিক উপায়ে কিভাবে মহাবিশ্বের সূচনা হতে পারে সেটাই আমরা দেখব পরবর্তী অনুচ্ছেদে।
প্রাকৃতিক উপায়ে শূন্য থেকে মহাবিশ্বের সূচনা
প্রাকৃতিক উপায়ে অর্থাৎ, ভ্যাকুয়াম ফ্লাকচুয়েশনের মধ্য দিয়ে শূন্য থেকে মহাবিশ্ব থেকে উৎপন্ন হতে পারে এ ধারণাটি যে এডওয়ার্ড ট্রিয়ন ১৯৭৩ সালে ব্যক্ত করেছিলেন সেটা আমরা আগেই জেনেছি।
Stephen Hawking, A Brief History of Time, Bantam; 10th anniversary edition, 1998
Anthony Aguirre and Steven Gratton,, “Inflation without a beginning: A null boundary proposal”, Phys. Rev. D67 083515, 2003
Victor J. Stenger, God and the Atom, Prometheus Books, 2013
Andrei Linde, The Self-Reproducing Inflationary Universe, Scientific American, November, 1994
কেন এভাবে, মানে কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশনের মাধ্যমে মহাবিশ্বের উদ্ভব ঘটল? এর উত্তরে ট্রিয়ন বলেছিলেন, ‘আমি এক্ষেত্রে একটা বিনয়ী প্রস্তাবনা হাজির করতে চাই যে, আমাদের মহাবিশ্ব হচ্ছে এমন একটি জিনিস যেটা কিনা সময় সময় উদ্ভূত হয়’। তবে ‘নেচার’ জার্নালে প্রকাশিত ‘ইজ দ্য ইউনিভার্স এ ভ্যাকুয়াম ফ্লাকচুয়েশন’ শিরোনামের সেই প্রবন্ধে যেভাবে মহাবিশ্ব উৎপত্তি হয়েছে বলে ট্রিয়ন ধারণা করেছিলেন, তাতে কিছু সমস্যা ছিল। প্রথমত: এই প্রক্রিয়ায় ১৪০০ কোটি বছর আগেকার মহাবিশ্বের উদ্ভবের সম্ভাবনাটি খুবই কম। কারণ ফ্লাকচুয়েশনগুলো সাধারণত হয় খুবই অস্থায়ী। সে হিসাবে একটি ফ্লাকচুয়েশন প্রায় ১৪০০ কোটি বছর টিকে থাকার সম্ভাবনা প্রায় অসম্ভব ব্যাপারই বলতে হবে। আসলে ফ্লাকচুয়েশনের স্থায়িত্ব বা জীবনকাল নির্ভর করে এর ভরের ওপর। ভর যত বড় হবে, ফ্লাকচুয়েশনের জীবনকাল তত কম হবে। দেখা গেছে একটি ফ্লাকচুয়েশনকে তের শ কোটি বছর টিকে থাকতে হলে এর ভর ১০-৬৫ গ্রামের চেয়েও ছোট হতে হবে, যা একটি ইলেকট্রনের ভরের ১০৩৮ গুণ ছোট। আর দ্বিতীয়ত এই মহাবিশ্ব যদি শূন্যাবস্থা (empty space) থেকে উৎপত্তি হয়ে থাকে, তবে প্রশ্ন থেকে যায়, আদিতে সেই শূন্যাবস্থাই বা এল কোথা থেকে (আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব অনুযায়ী, স্পেস বা শূন্যাবস্থাকে দেশকালের বক্রতার পরিমাপে প্রকাশ করা হয়)। প্রথম সমস্যাটির সমাধান ট্রিয়ন নিজেই দিয়েছিলেন। ট্রিয়ন আপেক্ষিক তত্ত্ব বিশেষজ্ঞদলের (যেমন পদার্থবিদ পিটার বার্গম্যান) সাথে সে সময়ই আলোচনা করে বুঝেছিলেন, একটি আবদ্ধ মহাবিশ্বে ঋণাত্মক মাধ্যাকর্ষণ শক্তি ধনাত্মক ভর শক্তিকে নিষ্ক্রিয় করে দেয়। অর্থাৎ মহাবিশ্বে মোট শক্তির পরিমাণ (এবং এই শক্তির সমতুল্য পদার্থের পরিমাণ) শূন্য। সে হিসেবে প্রায় ভরশূন্য অবস্থা থেকে যাত্রা শুরু করলে একটি ফ্লাকচুয়েশন প্রায় অসীম কাল টিকে থাকবে।
১৯৮২ সালে আলেকজান্ডার ভিলেঙ্কিন (Alexander Vilenkin) দ্বিতীয় সমস্যাটির একটি সমাধান দেওয়ার চেষ্টা করেন এভাবে, মহাবিশ্ব সৃষ্ট হয়েছে কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশনের মধ্য দিয়ে আক্ষরিক অর্থেই ‘শূন্য’ থেকে, তবে এই শূন্যাবস্থা শুধু ‘পদার্থবিহীন’ শূন্যাবস্থা নয়, বরং সেইসাথে সময়-শূন্যতা এবং স্থান-শূন্যতাও বটে। ভিলেঙ্কিন কোয়ান্টাম টানেলিং-এর ধারণাকে ট্রিয়নের তত্ত্বের সাথে জুড়ে দিয়ে বললেন, এ মহাবিশ্ব যাত্রা শুরু করেছে এক শূন্য জ্যামিতি (empty geometry) থেকে এবং কোয়ান্টাম টানেলিং এর মধ্য দিয়ে উত্তোরিত হয়েছে অশূন্য অবস্থায় (non-empty state) আর অবশেষে ইনফ্লেশনের মধ্য দিয়ে বেলুনের মতো আকারে বেড়ে আজকের অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে।
ভিলেঙ্কিনের দেওয়া ‘পরম শূন্যের’ ধারণাটি nothingness) আত্মস্থ করা আমাদের জন্য একটু কঠিনই বটে। কারণ আমরা শূন্যাবস্থা বা স্পেসকে সব সময়ই পেছনের পটভূমি হিসেবেই চিন্তা করে এসেছি—এ ব্যাপারটি আমাদের অস্তিত্বের সাথে এমনভাবে মিশে গেছে যে মনের আঙিনা থেকে একে তাড়ানো প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। মাছ যেমন জল ছাড়া নিজের অস্তিত্ব কল্পনা করতে পারে না, ঠিক তেমনি স্পেস ও সময় ছাড়া কোনো ঘটনাপ্রবাহের সংগঠন যেন আমাদের মানস-কল্পনার বাইরে। তবে একটি উপায়ে ‘অ্যাবসোলুট নাথিংনেস’-এর ধারণাটিকে বুঝবার চেষ্টা করা যেতে পারে। যদি পুরো মহাবিশ্বটিকে সসীম আয়তনের একটি আবদ্ধ ক্ষেত্র হিসেবে চিন্তা করা হয়, এবং এর আয়তন যদি ধীরে ধীরে কমিয়ে শূন্যে নামিয়ে আনা যায়, তবে এই প্রান্তিক ব্যাপারটাকে ‘অ্যাবসোলুট নাথিংনেস’ হিসেবে ধরে নেওয়া যেতে পারে।
আবদ্ধ মহাবিশ্বে মোট শক্তি যে শূন্য থাকে তা ট্রিয়নের সময়ই বিজ্ঞানীরা জানতেন। যেমন বিখ্যাত পদার্থবিদ এল ডি লান্ডাউ এবং ই এম লিফশিৎস ১৯৬২ সালে লেখা “The Classical Theory of Fields’ পাঠ্য বইয়ে এটি ব্যাখ্যা করেছিলেন। কিন্তু ট্রিয়ন সম্ভবত এই উৎস সম্বন্ধে অবগত ছিলেন না।
Alexander Vilenkin, “Creation of Universe from Nothing” Physics letters 117B (1982) 25-28
আমরা ছবিটিকে আমাদের মানসপটে কল্পনা করতে পারি আর না-ই পারি, ভিলেঙ্কিন কিন্তু প্রমাণ করেছেন, এই শূন্যতার ধারণা গাণিতিকভাবে সুসংজ্ঞায়িত, আর এই ধারণাটিকে মহাবিশ্বের উৎপত্তির গণিত হিসেবে প্রয়োগ করা যেতেই পারে। ভিলেঙ্কিন তাঁর ধ্যানধারণা এবং সেই সাথে জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানের সামগ্রিক অগ্রগতি নিয়ে সাধারণ পাঠকদের জন্য একটি বই লিখেছেন সম্প্রতি ‘একের ভেতর অসংখ্য—অন্য মহাবিশ্বের সন্ধান’ শিরোনামে। বইটি বৈজ্ঞানিক তত্ত্বে সমৃদ্ধ কেবল নয়, নানা হাস্যরস এবং কৌতুকসমৃদ্ধ উপাদানেও ভরপুর।
১৯৮১ সালে স্টিফেন হকিং ও জেমস হার্টলি ভিন্নভাবে সমস্যাটির সমাধান করেন। তাঁদের মডেল পদার্থবিজ্ঞানের জগতে ‘প্রান্তহীন প্রস্তাবনা’ (no- boundary proposal) হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। তাঁদের মডেলটি নোবেল পুরস্কার বিজয়ী বিজ্ঞানী রিচার্ড ফেইনম্যানের বিখ্যাত ইতিহাসের যোগ বা ‘sum over histories’-এর ওপর ভিত্তি করে তৈরি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ফেইনম্যান কোয়ান্টাম বলবিদ্যা নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে দেখিয়েছিলেন, একটি কণার কেবল একটি ইতিহাস থাকে না, থাকে বিভিন্ন সম্ভাব্য হিস্ট্রির সমাহার, অর্থাৎ গাণিতিকভাবে – অসংখ্য সম্ভাবনার অপেক্ষকের সমষ্টি। আমরা কণার দ্বিচিড় বা ডবল স্লিট এক্সপেরিমেন্টসহ বহু বিখ্যাত পরীক্ষা থেকে ব্যাপারটার সত্যতা জেনেছি। ঠিক একই পদাঙ্ক অনুসরণ করে হকিং দেখিয়েছেন যে, এই ব্যাপারটা আমাদের মহাবিশ্বের জন্যও একইভাবে প্রযোজ্য। মহাবিশ্বেরও কেবল একক ইতিহাস আছে মনে করলে ভুল হবে, কারণ মহাবিশ্বও কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশনের মাধ্যমে সেই কোয়ান্টাম স্তর থেকেই যাত্রা শুরু করেছে। হকিং তাঁর ‘ইউনিভার্স ইন আ নাটশেল’ বইয়ে এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘প্রান্তহীন প্রস্তাবনাটা ফেইনম্যানের সেই একাধিক ইতিহাসের ধারণার ওপর ভিত্তি করে তৈরি। কিন্তু ফেইনম্যানের যোগফলে কণার ইতিহাস এখন স্থলাভিষিক্ত হয়ে গিয়েছে সর্বতোভাবে স্থানকাল দিয়ে, যেটা কিনা মহাবিশ্বের ইতিহাসের সমষ্টি তুলে ধরে’। হকিং ইতিহাসের যোগসূত্র প্রয়োগ করতে গিয়ে আরো দেখলেন, স্থান ও কালের পুরো ব্যাপারটা প্রান্তবিহীন সসীম আকারের বদ্ধ গোলকীয় ক্ষেত্রে পরিণত হয়ে যায়। ব্যাপারটা যেন অনেকটা পৃথিবীর আকারের সাথে তুলনীয়। আমরা জানি, পৃথিবীর পৃষ্ঠদেশ ও আকারে সসীম, কিন্তু প্রান্তবিহীন গোলকের মতো। গোলকের কোনো প্রান্ত থাকে না। সেজন্যই দক্ষিণ মেরুর ১ মাইল দক্ষিণে কী আছে তা বলার অর্থ হয় না।
হকিং-এর দৃষ্টিতে মহাবিশ্বের আদি অবস্থাটাও তেমনি। হকিং নিজেই লিখেছেন তাঁর ‘গ্র্যান্ড ডিজাইন’ বইয়েঃ
আমরা যদি আপেক্ষিকতার তত্ত্বের সাথে কোয়ান্টাম তত্ত্বকে মেলাই তাহলে দেখা যায় প্রান্তিক ক্ষেত্রে স্থান -কালের বক্রতা এমন ব্যাপক হতে পারে যে, সময় তখন স্থানের স্রেফ আরেকটা মাত্রা হিসেবেই বিরাজ করে। একদম আদি মহাবিশ্বে, যখন মহাবিশ্ব এতটাই ক্ষুদ্র ছিল যে এর ওপর কোয়ান্টাম তত্ত্ব এবং সাধারণ আপেক্ষিকতার তত্ত্ব উভয়েই কাজ করত তখন আসলে মহাবিশ্বের চারটি মাত্রাই ছিলো স্থানিক মাত্রা এবং কোনো আলাদা সময়ের মাত্রা ছিল না। এর অর্থ, আমরা যখন মহাবিশ্বের “সূচনা” সম্পর্কে বলি তখন একটা ব্যাপার এড়িয়ে যাই। সেটা হলো, তখন সময় বলতে আমরা যা বুঝি, তারই কোনো অস্তিত্ব ছিল না। এটা জানা থাকা প্রয়োজন যে, স্থান ও কাল নিয়ে আমাদের যে প্রচলিত ধারণা, সেটা একদম আদি মহাবিশ্বের ওপর খাটে না। অর্থাৎ সেটা আমাদের অভিজ্ঞতার ঊর্ধ্বে, অবশ্য আমাদের কল্পনা এবং গণিতের ঊর্ধ্বে নয়। এখন, আদি মহাবিশ্বে চারটি মাত্রাই যদি স্থানের মাত্রা হিসেবে কাজ করে তাহলে সময়ের সূচনা হলো কিভাবে?
এই যে ধারণা যে, সময় জিনিসটাও স্থানের আরেকটি মাত্রা হিসেবে আচরণ করতে পারে, সেখান থেকে আমরা সময়ের সূচনাবিষয়ক সমস্যাটি কাটিয়ে উঠতে পারি; ঠিক যেভাবে আমরা “পৃথিবীর শেষ কোথায়” এই প্রশ্নকেও কাটিয়ে উঠি, গোলাকার পৃথিবীর ধারণা মাথায় রেখে। মনে করুন, মহাবিশ্বর সূচনা অনেকটা পৃথিবীর দক্ষিণ মেরুর মতো। কেউ যখন সেখান থেকে উত্তর দিকে যেতে থাকে, তখন একই অক্ষাংশের বৃত্তও বড় হতে থাকে, যেটা মহাবিশ্বের আকার ও স্ফীতি হিসেবে ভাবা যায়। তার মানে মহাবিশ্ব শুরু হয়েছে দক্ষিণ মেরুতে, কিন্তু এই দক্ষিণ মেরুবিন্দুর বৈশিষ্ট্য পৃথিবীপৃষ্ঠের আর যেকোনো সাধারণ বিন্দুর মতোই হবে।
এই প্রেক্ষাপটে মহাবিশ্বের সূচনার আগে কী ঘটেছিল, এই প্রশ্নটাই অর্থহীন হয়ে পড়ে। কারণ, এই প্রশ্নটা “দক্ষিণ মেরুর দক্ষিণে কী আছে”, এই প্রশ্নের সমতুল। এই চিত্রে মহাবিশ্বের কোনো সীমানা নেই— প্রকৃতির যে আইন দক্ষিণ মেরুতে কাজ করে, সেটা অন্য যেকোনো জায়গাতেও কাজ করবে। একই ভাবে, কোয়ান্টাম তত্ত্বে মহাবিশ্বের সূচনার আগে কী ঘটেছিল, এই প্রশ্ন অর্থহীন হয়ে পড়ে। মহাবিশ্বের ইতিহাসও যে সীমানাহীন একটা বদ্ধ তল হতে পারে, এই ধারণাকে বলে “নো বাউন্ডারি কন্ডিশন” বা প্রান্তহীনতার শর্ত।
Alex Vilenkin, Many Worlds in One: The Search for Other Universes, Hill and Wang, 2006
James B. Hartle and Stephen W. Hawking, “Wave Function of the Universe,” Physical Review D28, 2960-75, 1983
Stephen William Hawking, The Universe in a Nutshell, Bantam, 2001
‘দ্য গ্যান্ড ডিজাইন’ – স্টিফেন হকিং [অধ্যায় ৬] (অনুবাদ তানভীরুল ইসলাম)
এখানে মূল ব্যাপারটি হলো, হকিং-এর মডেলটিও ভিলেঙ্কিনের মডেলের মতো প্রাকৃতিক ভাবে মহাবিশ্বের উদ্ভবকে ব্যাখ্যা করতে পারে। তবে হকিং-হার্টলি মডেলের সাথে ভিলেঙ্কিনের মডেলের পার্থক্য এই যে, এই মডেলে ভিলেঙ্কিনের মতো ‘পরম শূন্য’র ধারণা গ্রহণ করার দরকার নেই।
ভিলেঙ্কিন ও হকিং-এর এই দুই মডেলের বাইরে আরেকটা মডেল আছে যেটা বাইভার্স (Biverse) নামে পরিচিত। এটা মূলত হকিং-হার্টলি মডেল এবং ভিলেঙ্কিনের প্রস্তাবিত মডেল দুটোর একধরনের সমন্বয় বলা যায়। পদার্থবিদ ভিক্টর স্টেঙ্গর এই মডেলের প্রবক্তা। ২০১১ সালে প্রকাশিত আমাদের ‘অবিশ্বাসের দর্শন’ বইয়েও এই মডেলটির উল্লেখ করেছিলাম।
এই প্রস্তাবনা অনুযায়ী আমাদের মহাবিশ্বের সূচনা হয়েছিল কোয়ান্টাম টানেলিং প্রক্রিয়ায় অপর একটি মহাবিশ্ব থেকে, যে মহাবিশ্বের অস্তিত্ব ছিল অসীম সময় পর্যন্ত, অন্তত আমাদের সময় পরিমাপের দৃষ্টিকোণ থেকে। কোয়ান্টাম টানেলিং বিজ্ঞানের জগতে একটি প্রতিষ্ঠিত বৈজ্ঞানিক ধারণা। সাধারণ ভাষায়, কোনো বস্তুর একটি নিউটনীয় বাধা বা দেয়ালের ভেতর গলে বের হয়ে যাওয়াই কোয়ান্টাম টানেলিং। বিগ ব্যাং-এর মাধ্যমে স্থানের প্রসারণের যে অভিজ্ঞতা আমাদের মহাবিশ্বের অধিবাসীরা উপলব্ধি করেছে, অপর মহাবিশ্বটি উপলব্ধি করবে ঠিক তার উল্টো অর্থাৎ সংকোচনের অভিজ্ঞতা।
আরও একটি ব্যাপার হলো, একটি মহাবিশ্বে সময়ের দিক নির্ধারণ করা হয়ে থাকে এনট্রপি বৃদ্ধি বা বিশৃঙ্খলা বৃদ্ধির দিকের সাথে সামঞ্জস্য রেখে। সেই শর্তকে সিদ্ধ করতে গেলে অপর মহাবিশ্বের সময়ের দিক আমাদের মহাবিশ্বের সময়ের দিকের ঠিক বিপরীত হতে হবে। আর তাহলেই এই বাইভার্স মডেলে আমাদের মহাবিশ্ব টানেলিং-এর মাধ্যমে অপর মহাবিশ্ব থেকে উদ্ভূত হয়েছে বলে মনে হবে; ঠিক একইভাবে অপর মহাবিশ্বের অধিবাসীদের কাছে মনে হবে তাদের মহাবিশ্ব টানেলিং-এর মাধ্যমে উদ্ভূত হয়েছে আমাদের মহাবিশ্ব থেকে। দুই মহাবিশ্বেরই আপাত উদ্ভব ঘটবে ছবিতে ‘আনফিজিকাল রিজন’ হিসেবে চিহ্নিত বিশেষ ধরনের শূন্যাবস্থা থেকে। গাণিতিক ও বৈজ্ঞানিকভাবে মডেলটি ত্রুটিপূর্ণ না হলেও প্রায়োগিক দিক থেকে মডেলটির কিছু জটিলতার কারণে মূলধারার পদার্থবিদদের কাছে এটি জনপ্রিয় নয়। আমরাও এ মডেলটি নিয়ে বেশি আলোচনাতে আগ্রহী নই। তার চেয়ে স্ফীতি থেকে উঠে আসা আধুনিক মডেলগুলোর দিকে বরং দৃষ্টি দেওয়া যাক।
আশির দশকে যখন হকিংসহ অন্য বিজ্ঞানীরা প্রান্তহীন প্রস্তাবনা নিয়ে নিবিষ্টচিত্তে কাজ করে যাচ্ছিলেন, ঠিক সে সময়টাতে গুথ-লিন্ডে-ভিলেঙ্কিন- স্টেইনহার্ট প্রমুখ বিজ্ঞানী কাজ করছিলেন তাঁদের প্রস্তাবিত ‘স্ফীতি তত্ত্ব’ নিয়ে। এই তত্ত্বের সাফল্যের ইতিহাস আমরা ইতোমধ্যেই আগের অধ্যায়গুলো থেকে জেনেছি। স্ফীতি তত্ত্বের আবির্ভাবের পর থেকেই এ তত্ত্ব সন্ধিগ্ধজনের কাছ থেকে বহু পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছে, এবং বলা যায় সাফল্যের সঙ্গেই সে নিজেকে সামাল দিতে পেরেছে। সবচেয়ে বড় সাফল্য হচ্ছে মহাবিশ্বের জ্যামিতি শেষ পর্যন্ত ‘সামতলিক’ প্রমাণিত হওয়া। মূলত গুপ্ত শক্তির খোঁজ পাওয়া এবং কোবে আর ডব্লিউম্যাপ এবং অতি সম্প্রতি প্লাঙ্ক থেকে পাওয়া সূক্ষ্ম উপাত্ত থেকে আমরা প্রায় শতভাগ নিশ্চয়তায় জানতে পেরেছি যে আমাদের মহাবিশ্বের জ্যামিতি সমতল (অর্থাৎ ওমেগার মান হবে ১-এর একদম কাছাকাছি), যেটা ছিল একসময় স্ফীতি তত্ত্বের জোরালো অনুকল্প।
ভিকটর স্টেঙ্গরের এই বাইভার্স মডেলের সাথে পরিচিত হতে হলে তাঁর The Fallacy of Fine-Tuning: Why the Universe Is Not Designed for Us (Prometheus Books, 2011) অথবা Timeless Reality : Symmetry, Simplicity, and Multiple Universes (Prometheus Books, 2000) দ্রষ্টব্য।
সমতল মহাবিশ্বের ব্যাপারটি এই অধ্যায়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, সমতল মহাবিশ্বের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে। এটি তৈরি করে দেয় শূন্য থেকে মহাবিশ্ব উদ্ভবের নান্দনিক ক্ষেত্র। এ ব্যাপারটি স্পষ্ট করেছেন খ্যাতনামা পদার্থবিজ্ঞানী লরেন্স ক্রাউস তাঁর বিভিন্ন লেকচারে এবং বইয়ে। লরেন্স ক্রাউস ২০০৯ সালের অক্টোবর মাসে লস এঞ্জেলেসে এথিস্ট কনভোকেশনে ‘ইউনিভার্স ফ্রম নাথিং’ নামে একটি বক্তৃতা দিয়েছিলেন। সেই এক ঘণ্টা চার মিনিটের সেই লেকচারটি রিচার্ড ডকিন্স ফাউন্ডেশন থেকে ইউটিউবে প্রকাশিত হলে পাঠক ও দর্শকদের মধ্যে তীব্র চাঞ্চল্য তৈরি করে। কিছুদিনের মধ্যেই ভিডিওটির দর্শকের সংখ্যা মিলিয়নের ওপর ছাড়িয়ে যায় লেকচারটিকে উপজীব্য করে তিনি পরবর্তীতে (২০১২) একই শিরোনামে একটি জনপ্রিয় ধারার বিজ্ঞানের বই প্রকাশ করেন, যা নিউ ইয়র্ক টাইমসে বেস্ট সেলার হয়েছিল। সেই মূল লেকচারের একটি অংশে সমতল মহাবিশ্ব এবং এর প্রভাব নিয়ে বলতে গিয়ে অধ্যাপক ক্রাউস উল্লেখ করেন।
মহাবিশ্বের জ্যামিতি অবশ্যই সমতল হতে হবে। কেন? দুটি কারণ। প্রথমত যেটা আমি সাধারণত বলি—সমতল মহাবিশ্বই একমাত্র মহাবিশ্ব যেটা কিনা পদার্থবিদদের চোখে ‘ম্যাথেম্যাটিকালি বিউটিফুল’। এটা হয়তো ঠিক; কিন্তু এটা মূল কারণ নয়। আরেকটা বড় কারণ আছে। সমতল মহাবিশ্ব এবং একমাত্র সমতল মহাবিশ্বই একমাত্র মহাবিশ্ব যেখানে মোট শক্তির পরিমাণ একেবারে নিখুঁতভাবে শূন্য হয়ে যায়। কারণ মহাকর্ষের রয়েছে ঋণাত্মক শক্তি। আর এই ঋণাত্মক শক্তি নিখুঁতভাবে নিষ্ক্রিয় হয়ে যায় মহাবিশ্বের ধনাত্মক ভর শক্তি দিয়ে। অর্থাৎ মহাবিশ্বের মোট শক্তি থাকে শূন্য। এখন, মহাবিশ্বের মোট শক্তি শূন্য হবার মাজেজাটা কী? মাজেজাটা হলো কেবল এ ধরনের মহাবিশ্বই শূন্য থেকে উদ্ভূত হতে পারে। এ ব্যাপারটা সত্যই অনন্যসাধারণ। কারণ, পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রগুলো একেবারে শূন্য থেকে মহাবিশ্বকে উদ্ভূত হবার অনুমতি দেয়। আপনার আর অন্য কিছুর দরকার নেই শূন্যতা ছাড়া, যার মোট শক্তি হবে শূন্য। সেখানে কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশন থেকে মহাবিশ্বের উদ্ভব ঘটবে।
আরও মজার ব্যাপার হলো, স্ফীতি তত্ত্বের সর্বাধুনিক ধারণা (যাকে লিন্ডে ‘কেওটিক ইনফ্লেশন’ বলে অভিহিত করেছেন) অনুযায়ী, শুধু যে একবারই বিগ ব্যাং বা মহাবিস্ফোরণ ঘটেছে তা কিন্তু নয়, এরকম বিগ ব্যাং কিন্তু হাজার হাজার, কোটি কোটি এমনকি অসীম-সংখ্যকবার ঘটতে পারে; তৈরি হতে পারে অসংখ্য ‘পকেট মহাবিশ্ব’। আমরা সম্ভবত এমনই একটি পকেট মহাবিশ্বে অবস্থান করছি বাকিগুলোর অস্তিত্ব সম্বন্ধে জ্ঞাত না হয়ে। এটাই সেই বিখ্যাত ‘মাল্টিভার্স’ বা ‘অনন্ত মহাবিশ্বের’ ধারণা।
বিজ্ঞানীরা আজ মনে করছেন, আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান যখন কেবল একটি নয়, অসংখ্য মহাবিশ্বের উদ্ভবের একটি প্রাকৃতিক এবং যৌক্তিক সমাধান দিতে পারছে, তখন ঈশ্বর সম্ভবত একটি ‘বাড়তি হাইপোথিসিস’ ছাড়া আর কিছু নয়। বিজ্ঞানী ভিক্টর স্টেঙ্গর, লরেন্স ক্রাউস, অ্যালেন গুথ, আঁদ্রে লিন্ডেরা সেটা অনেক আগে থেকেই বলে আসছিলেন। হকিংও তাঁর ‘গ্র্যান্ড ডিজাইন’ বইয়ে বলেছেন, ‘গড হাইপোথিসিস’ বা ‘ঈশ্বর অনুকল্প’ মোটা দাগে ‘অক্কামের ক্ষুরের’ লঙ্ঘন । অবশ্য তাতে বিতর্ক থেমেছে এমন বলা যাবে না; বরং জাল ফেলে রাসেলের ‘শেষ কচ্ছপ’ ধরার প্রচেষ্টা চলছেই বিভিন্ন মহল থেকে।
রাসেলের শেষ কচ্ছপ?
নোবেল পুরস্কার বিজয়ী বিজ্ঞানী ও দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেলকে নিয়ে একটি চমৎকার গল্প প্রচলিত আছে। তিনি একবার সাধারণ জনগণের জন্য উন্মুক্ত এক সেমিনারে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। সূর্যকে কেন্দ্র করে কিভাবে পৃথিবী এবং অন্য গ্রহমণ্ডল ঘুরছে, এবং সূর্য আবার কিভাবে আমাদের ছায়াপথে ঘুরছে এগুলোই ছিল বক্তৃতার বিষয়। বক্তৃতা শেষ হলে এক বৃদ্ধা উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “এতক্ষণ তুমি যা যা বলেছ তা সব বাজে কথা। পৃথিবী আসলে সমতল, আর সেটা রয়েছে একটা বিরাট কচ্ছপের ওপর। রাসেল মৃদু হেসে বৃদ্ধাকে জিজ্ঞেস করলেন,
ইউটিউব ভিডিও: ‘A Universe From Nothing’ by Lawrence Krauss, AAI 2009; Richard Dawkins Foundation for Reason and Science, Uploaded on Oct 21, 2009
Lawrence M. Krauss, A Universe from Nothing: Why There Is Something Rather than Nothing, Atria Books;, 2012
এ প্রসঙ্গে পড়া যেতে পারে অ্যালেন গুথের ‘The Inflationary Universe’ (Basic Books, 1998 ) কিংবা ভিক্টর স্টেঙ্গরের ‘God: The Failed Hypothesis (Prometheus Books, 2008)’, কিংবা ইউটিউব থেকে দেখা যেতে পারে লরেন্স ক্রাউসের বিখ্যাত ‘A Universe From Nothing’ ভিডিওটি (Lawrence Krauss, AAI 2009) ইত্যাদি।
অক্কামের ক্ষুর প্রসঙ্গে জানতে হলে ‘অবিশ্বাসের দর্শন’ (শুদ্ধস্বর, ২০১১; পুনর্মুদ্রণ ২০১২) দ্রষ্টব্য। এ ছাড়া অনলাইনে, অভিজিৎ রায়, অক্কামের ক্ষুর (occam’s razor) এবং বাহুল্যময় ঈশ্বর, মুক্তমনা, জানুয়ারি ১৯, ২০১০ দ্রষ্টব্য।
ইউটিউব ভিডিও: A “Flat” Universe; Uploaded on May 20, 2010.
‘কচ্ছপটা তাহলে কার ওপর দাঁড়িয়ে আছে?’ বৃদ্ধা খানিকক্ষণ ভেবে জবাব দিলেন, ‘ছোকরা, তুমি খুব চালাক। তবে জেনে রাখো, কচ্ছপটার তলায় আরেকটা কচ্ছপ, আর ওটার তলায় আরেকটা—এভাবে পরপর সবই কচ্ছপ রয়েছে’।
তো প্রাকৃতিকভাবে শূন্য থেকে মহাবিশ্বের উদ্ভবের ব্যাখ্যা পাওয়ার পর কি রাসেলের গল্পের সেই শেষ কচ্ছপের খোঁজ পাওয়া গেল? কচ্ছপের খোঁজ পাওয়া গেছে কি না জানি না, তবে অনেকেই মনে করছেন, মহাবিশ্ব ‘সৃষ্টি’র পেছনে কচ্ছপচালক ঈশ্বরের ভূমিকা অনেকটাই গৌণ হয়ে গেছে। পদার্থবিজ্ঞানের সূত্র মেনে অনিবার্যভাবে শূন্য থেকে মহাবিশ্ব উদ্ভূত হতে পারলে মহাবিশ্বের অস্তিত্বকে ব্যাখ্যার জন্য ঈশ্বরের আদৌ কোনো আর ভূমিকা থাকে কিনা সেটা একটা প্রশ্ন বটে। স্টিফেন হকিং-এর ‘গ্র্যান্ড ডিজাইন’ বইটি বের হবার প্রাক্কালে লন্ডন টাইমসে শিরোনাম করা হয়েছিল—‘ঈশ্বর মহাবিশ্ব তৈরি করেননি:হকিং-এর অনুধাবন’। হ্যানা ডেভলিনের রিপোর্টে প্রকাশিত টাইমসের সেই নিবন্ধে সে সময় লেখা হয়েছিল।
আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান ঈশ্বরের জন্য কোনো জায়গা আর খালি রাখেনি, স্টিফেন হকিং-এর উপসংহার এটাই। যে ভাবে ডারউইনবাদ জীববিজ্ঞানের চৌহদ্দি থেকে ঈশ্বরকে সরিয়ে দিয়েছে, ব্রিটেনের সবচেয়ে বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ঠিক সেরকমভাবেই মনে করেন, পদার্থবিজ্ঞানের নতুন তত্ত্বগুলো ঈশ্বরের ভূমিকাকে অপাঙ্ক্তেয় করে তুলেছে।
বলা বাহুল্য, ২০১০ সালে প্রকাশিত স্টিফেন হকিং-এর বইটিকে নিয়ে তুমুল বিতর্ক হয়েছিল মিডিয়ায়। বিতর্ক হয়েছে গ্র্যাণ্ড ডিজাইনের পরে বাজারে আসা লরেন্স ক্রাউসের ‘ইউনিভার্স ফ্রম নাথিং’ (২০১২) বইটি নিয়েও। বিরূপতা এসেছে মূলত ধার্মিক এবং ধর্মপন্থী দার্শনিকদের দিক থেকেই বেশি। তাঁরা সোরগোল তুলেছেন শূন্যতার অভিব্যক্তি নিয়ে। তাঁরা দাবি করেছেন যে শূন্যতার কথা ক্রাউস তাঁর বইয়ে বলেছেন সেটা নাকি ‘প্রকৃত শূন্যতা’ নয়। কিন্তু প্রকৃত শূন্যতাটা ঠিক কী সেটা তাঁরাও যে খুব পরিষ্কারভাবে বলতে পারেন তা নয়। এটা অবশ্য স্বাভাবিকই। শূন্যতাকে সংজ্ঞায়িত করতে গেলে প্রথমেই শূন্যের কিছু বৈশিষ্ট্য আরোপিত করতে হবে, যার নিরিখে শূন্যকে সংজ্ঞায়িত করা যায়। কিন্তু কোনো বৈশিষ্ট্য আরোপ করা মানেই সেটা আর ‘প্রকৃত শূন্যতা’ হবে না। এ ধরণের শূন্যতা নিয়ে দার্শনিক ত্যানা প্যাঁচানোর নানা খেলা খেলা যায়, কিন্তু পদার্থবিজ্ঞানীদের চোখে সেগুলো অর্থহীন। ক্রাউস এ ধরনের ‘দার্শনিক ত্যানা প্যাচানো শূন্যতা’কে অস্বচ্ছ (vague), অসম্যকবিবৃত (ill-defined) এবং অক্ষম (impotent) হিসেবে অভিহিত করেছেন”। কেউ কেউ সামঞ্জস্যহীন (inconsistent) কিংবা পরস্পরবিরোধীও (self-contradictory) হয়তো ভাববেন। পদার্থবিজ্ঞানীরা এই ধরনের পরস্পরবিরোধী দার্শনিক শূন্যতা নিয়ে কাজ করেন না, তাঁরা যে শূন্যতার কথা বলেন, সেটাকে বলে ‘ভয়েড” বা স্থান- শূন্যতা। এটি বৈজ্ঞানিকভাবে খুব ভালোভাবেই সংজ্ঞায়িত। চাইলে গাণিতিকভাবেও একে প্রকাশ করা যায়। এর প্রকাশমান তরঙ্গ অপেক্ষক (explicit wave function) আছে। এই ভয়েডজনিত শূন্যতা আসলে কোয়ান্টাম মহাকর্ষের শূন্যতা যা কোয়ান্টাম ক্ষেত্রতত্ত্বের কোয়ান্টাম ভ্যাকুয়ামের সমতুল”। এই ধরনের শূন্যতা থেকে আমাদের চেনা মহাবিশ্বের মতো কিছুর উৎপত্তিতে কোনো বাধা নেই। ক্রাউস সঠিকভাবেই বলেছেন, ‘কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটি কেবল শূন্যতা থেকে মহাবিশ্বর সৃষ্টির অনুমতি দিয়েই ক্ষান্ত হয় না; এক্ষেত্রে আমি জোরালোভাবে বলব, এটা অনেক ক্ষেত্রে আবশ্যকও’। এ জন্যই শূন্য থেকে মহাবিশ্বের উৎপত্তি সম্ভবপর।
অবশ্য তাতে যে বিতর্ক থেমেছে তা নয়। ধর্মপন্থী দার্শনিকেরা প্রশ্ন করেছেন, ‘শূন্যতার মধ্যে যদি কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশন ঘটে তবে কোয়ান্টাম বলবিদ্যার সূত্রগুলোই বা এল কোত্থেকে?”। ‘কে নাজিল করল এই সব নিয়ম?’ মুশকিল হলো, এ ধরনের প্রশ্ন ধারাবাহিকভাবে ক্রমাগত চলতে থাকে, কচ্ছপের গল্পের মতোই। বিজ্ঞানের জ্ঞানের সাহায্যে যে সমাধানই দেওয়া হোক না কেন, সেটারই বা কারণ কী বলে সে সমাধানকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হবে। সেটারও কোনো ব্যাখ্যা বা উত্তর হাজির করলে ‘সেই উত্তরেরও বা কারণ কী’ বলে আবার প্রশ্ন ছুড়ে দেওয়া হবে।
Hannah Devlin, Hawking: God Did Not Create Universe The Times (London) 2 September, 2010;
Modern physics leaves no place for God in the creation of the Universe, Stephen Hawking has concluded. Just as Darwinism removed the need for a creator in the sphere of biology, Britain’s most eminent scientist argues that a new series of theories have rendered redundant the role of a creator for the Universe”; The Times newspaper on 2 September, 2010;
Hannah Devlin, Hawking: God Did Not Create Universe The Times (London) 2 September, 2010;
Modern physics leaves no place for God in the creation of the Universe, Stephen Hawking has concluded. Just as Darwinism removed the need for a creator in the sphere of biology, Britain’s most eminent scientist argues that a new series of theories have rendered redundant the role of a creator for the Universe”; The Times newspaper on 2 September, 2010;
Victor J. Stenger, God and the Atom, Prometheus Books, 2013
Lawrence M. Krauss, The Consolation of Philosophy, Scientific American, April 27, 2013
তবে অন্ততঃ একটি ক্ষেত্রে স্থানশূন্যতার বাইরে গিয়েও অর্থাৎ পরমশূন্যতা গোনায় ধরেও মহাবিশ্বের উদ্ভব ব্যাখ্যা করা গেছে, তার হদিস আছে ভিলেঙ্কিনের মডেলে। এ প্রসঙ্গে দ্রষ্টব্য: Alexander Vilenkin, “Creation of Universe from Nothing” Physics letters 117B, 25-28, 1982
Victor J. Stenger, God and the Atom, Prometheus Books, 2013
এভাবে ঠেলে ঠেলে শেষ পর্যন্ত উত্তরটাকে সকল রহস্যের একমাত্র সমাধান আরাধ্য ‘ঈশ্বর’-এর কাছে নিয়ে যাওয়া হবে। এবং তার পরই লম্বা একটা দাঁড়ি – কমপ্লিট ফুলস্টপ যাকে বলে। তখন ‘ঈশ্বরই বা এল কোথা থেকে’ কিংবা ‘ঈশ্বরের পেছনেই বা কারণ কী?’ – এই ধরনের প্রশ্ন আর আমরা করতে পারব না। হাত- পা বেঁধে দেওয়া হবে। টেপ মেরে দেওয়া হবে তাঁদের মুখে যাঁরা এগুলো প্রশ্ন করবেন।
সৌভাগ্যবশত বিজ্ঞান এভাবে কাজ করে না। পদার্থবিজ্ঞানের নিয়ম নীতিগুলো আসলে কী, এবং এর উদ্ভব কীভাবে ঘটতে পারে, এটা এখনো বিজ্ঞানীদের গবেষণার সজীব একটি বিষয়, কিন্তু বিজ্ঞানীরা এটা অন্তত জানেন যে, বিজ্ঞানের এই নিয়মনীতিগুলো শরিয়া আইনের মতো কিছু নয়, যে কারো দ্বারা ‘নাজিল’ হতে হবে। বরং কিভাবে পদার্থবিজ্ঞানের নিয়মগুলো প্রাকৃতিকভাবেই তৈরি হতে পারে তা অনেক বিজ্ঞানী বৈজ্ঞানিক কাঠামোর মধ্যে থেকেই ব্যাখ্যা করতে পারেন। যেমন বিজ্ঞানী ভিক্টর স্টেঙ্গর তাঁর “The Comprehensible Cosmos: Where Do the Laws of Physics Come From?” বইয়ে দেখিয়েছেন যে, শূন্যতার প্রতিসাম্যতা এবং সেই প্রতিসাম্যের ভাঙনের মাধ্যমে প্রাকৃতিকভাবেই পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রের উদ্ভব ঘটতে পারে । সে সমস্ত গাণিতিক মডেলের উল্লেখ পাওয়া যায় তাঁর অনলাইনে রাখা পেপারেও। তিনি মূলত গণিতবিদ এমি নোদারের (Emmy Noether, ১৮৮২-১৯৩৫) সহজ-সরল কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজের ওপর ভিত্তি করে মূল গণনাগুলো করেন; তার সাথে ‘গেজ সিমেট্রি’র ধারণার গাণিতিক সমন্বয় ঘটান (যাকে তিনি তাঁর বইয়ে অভিহিত করেছেন ‘পয়েন্ট অব ভিউ’ নীতি নামে), এবং সেখান থেকেই বেরিয়ে আসে এই উপসংহার।
এমি নোদারের তত্ত্বটি গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সেটা নিয়ে বলার আগে এমি নোদার সম্বন্ধেই দু-চার কথা বলে নেওয়া যাক। নোদার জন্মেছিলেন ১৮৮২ সালে জার্মানির বাভারিয়ায়। গণিতজ্ঞ বাবার অনুপ্রেরণায় আর মূলত নিজের চেষ্টায় নিজেও একসময় গণিতজ্ঞ হয়ে ওঠেন তিনি। কিন্তু হলে কী হবে, নোদার যে সময়টায় জন্মেছিলেন, সে সময় গণিতবিদ হিসেবে নারীদের তেমন কোন স্বীকৃতি ছিল না। তাঁর নিজের শহরের আর্লেংগেন বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতের ক্লাসে অডিট করা ছাড়া আর কোনো কিছু করতে দেওয়া হয়নি। তারপরেও ১৯০৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জার্মান ব্যাচেলর ডিগ্রির সমতুল্য ডিগ্রি নিয়ে বেরোতে পারলেন। পরের এগারো বছর তিনি বিখ্যাত গণিতজ্ঞ ডেভিড হিলবার্টের অধীনে কাজ করার সুযোগ পান, সুযোগ পান আর্লেংগেন ও গোটিংগেন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোরও, যদিও এর জন্য কোনো পারিশ্রমিক তাকে দেওয়া হয়নি। ১৯১৮ সালের দিকে তাঁকে ‘আনটেনিউরড প্রফেসর’ হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়, এবং ১৯২৩ সাল থেকে তিনি সামান্য কিছু পারিশ্রমিক পেতে শুরু করেন। এভাবেই তাঁকে থাকতে হয়েছিল। গণিতে তাঁর উল্লেখযোগ্য পারদর্শিতা থাকলেও কখনোই তাঁর চাকরি স্থায়ী করা হয়নি, তাঁকে দেওয়া হয়নি গোটিংগেন একাডেমি অব সায়েন্সের কোনো পদও।
এর মধ্যে ত্রিশের দশক থেকে জার্মানিতে নাৎসি বাহিনীর ক্ষমতা বৃদ্ধি পেতে শুরু করলে, শুরু হয় ইহুদিদের ওপর লাগাতার অত্যাচার। এমি নোদার জার্মানির ইহুদি পরিবারে জন্মেছিলেন। বিপদ ঘনিয়ে আসছে বুঝে তাঁকে জার্মানি ত্যাগ করতে হয়। ১৯৩৩ সালে তিনি আমেরিকা এসে পেনসেলভেনিয়ার ব্রায়ান মেওর কলেজে যোগ দেন। কিন্তু দুই বছরের মাথায় তাঁকে দুর্ভাগ্যজনকভাবে জরায়ুর ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হতে হয়। তিনি মারা যাবার সময় খুব কম লোকই তাঁর নাম জানত। কিন্তু এখন দিন বদলাচ্ছে। তাঁর কাজ খুব গুরুত্ব সহকারে বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় উঠে আসছে।
Victor J. Stenger, The Comprehensible Cosmos: Where Do the Laws of Physics Come From?, Prometheus Books, 2006
Victor J. Stenger, Where Do the Laws of Physics Come From?, colorado.edu; October 18, 2007
Victor J. Stenger, Where Do the Laws of Physics Come From?, http://arxiv.org/vc/physics/papers/0207/0207047v2.pdf
তার পরও প্রতিভাধর বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের চোখকে নোদার ফাঁকি দিতে পারেননি। নোদার মারা যাবার পরপরই আইনস্টাইন নিউইয়র্ক টাইমসের একটি নিবন্ধে নোদারকে একজন ‘গুরুত্বপূর্ণ সৃষ্টিশীল গণিত-প্রতিভা’ (significant creative mathematical genius) হিসেবে অভিহিত করেছিলেন।
বিশেষ করে এমি নোদার ১৯১৫ সালে একটি যুগান্তকারী তত্ত্ব দিয়েছিলেন, যেটা এখন ‘নোদারের তত্ত্ব’ (Noether’s theorem) নামে অভিহিত হয়। এ তত্ত্ব এখন ব্যবহৃত হচ্ছে আধুনিক পদার্থবিদ্যার বহু শাখায়”। গুরুত্ব, প্রয়োগ ও ব্যবহারের নিরিখে তাঁর তত্ত্বটি বর্তমানে হয়ে উঠেছে গণিতের ইতিহাসের অন্যতম সার্থক তত্ত্ব। এর সার কথা হলো, প্রতিটি লাগাতার স্থান-কাল সাম্যতার জন্য একটি করে নিত্যতার নীতি রয়েছে। পদার্থবিজ্ঞানে তিনটি নিত্যতার নীতি মৌলিক বলে বিবেচিত: শক্তির নিত্যতা, রৈখিক ভরবেগের নিত্যতা, কৌণিক ভরবেগের নিত্যতা।
নোদারের তত্ত্ব থেকে দেখা গেল, শক্তির নিত্যতার সূত্র (conservation of energy) আসলে সেরকম মৌলিক কিছু নয়, সময় অবস্থান্তর সাম্যতা (time translation symmetry) থেকেই বেরিয়ে আসে এটা । রৈখিক ভরবেগের নিত্যতা (conservation of linear momentum) বেরিয়ে আসে স্থান অবস্থান্তর সাম্যতা (space translation symmetry) থেকে। কৌণিক ভরবেগের নিত্যতা আসে স্থানিক ঘূর্ণন সাম্যতা (space rotation symmetry) থেকে।
এর মানে কী দাঁড়াল? দাঁড়াল এই যে, পদার্থবিজ্ঞানীরা যখন গাণিতিক মডেল বা প্রতিরূপ নির্মাণ করেন, তখন যদি তাঁদের সময় নিয়ে চিন্তা করতে না হয়, তাহলে তাঁদের শক্তির সংরক্ষণ নিয়েও আলাদা করে চিন্তার কিছু নেই। এটা এমনিতেই সিস্টেমে চলে আসবে। অর্থাৎ, একই মডেল যদি আজকে কাজ করে, কালকে কাজ করে কিংবা পরশু, কিংবা এক হাজার বছর আগে, কিংবা এক হাজার বছর পরে, তাহলে মডেলে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই শক্তির নিত্যতা বলবৎ থাকবে। পদার্থবিজ্ঞানীদের এখানে আলাদা করে কিছুই করণীয় নেই।
একইভাবে, যদি আরেকজন পদার্থবিদ আরেকটি মডেল নির্মাণ করেন যেটা কিনা স্থানের ওপর নির্ভরশীল থাকবে না, অর্থাৎ মডেলটি বাংলাদেশের বান্দরবান যেভাবে কাজ করবে, সেভাবেই কাজ করবে বিলেতের অক্সফোর্ডে, আমেরিকার টেক্সাসে, টিম্বুকটুতে কিংবা প্লুটোতে, তাহলে আমরা বলতে পারি, সেই মডেল স্বয়ংক্রিয়ভাবে রৈখিক ভরবেগের নিত্যতাও ধারণ করবে। এক্ষেত্রেও পদার্থবিজ্ঞানীদের আলাদা করে কিছু করার নেই।
ঠিক একইভাবে কোন মডেল যদি তার ওরিয়েন্টেশন বা দিকস্থিতির ওপর নির্ভরশীল না হয়, তবে কৌণিক ভরবেগের নিত্যতার ব্যাপারটিও এমনিতেই বেরিয়ে আসবে।
নোদারের তত্ত্বের পাশাপাশি গেজ প্রতিসাম্যের বিষয়টিও এখানে প্রাসঙ্গিক। গবেষকেরা দেখিয়েছেন, নাম আলাদা হলেও এদের মধ্যে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ; গেজ সিমেট্রির অনেক কিছুই আসলে নোদারের তত্ত্ব থেকেই বেরিয়ে আসে গেজ প্রতিসাম্যের ব্যবহার পদার্থবিজ্ঞানে অনেক। বৈদ্যুতিক চার্জের সংরক্ষণের কথা যে আমরা শুনি, সেটা এই গেজ প্রতিসাম্যতা থেকেই চলে আসে। যখন আহিত কণার গতির সূত্রকে গেজ সিমেট্রিক হিসেবে তৈরি করা হয়, ম্যাক্সওয়েলের সূত্র সেখান থেকেই চলে আসে। গেজ প্রতিসাম্যতা কেবল চিরায়ত পদার্থবিজ্ঞানেই নয়, আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের বহু শাখাতেই সাফল্যের সাথে ব্যবহৃত হচ্ছে। সেই ১৯৪০ সাল থেকেই কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞানে আর ১৯৭০-এর পর কণা পদার্থবিজ্ঞানের প্রমিত মডেলে অত্যন্ত সাফল্যের সাথে ব্যবহৃত হচ্ছে এই তত্ত্ব। প্রমিত মডেলের চারটি মৌলিক বলের তিনটিই—তাড়িতচুম্বক, দুর্বল এবং সবল নিউক্লিয় বল ‘লোকাল গেজ সিমেট্রি’ থেকেই বেরিয়ে আসে।
‘নোদারের তত্ত্ব’এবং গেজ প্রতিসাম্যের মোদ্দা কথা হলো সিস্টেমে সিমেট্রি বজায় থাকলে পদার্থবিজ্ঞানের সংরক্ষণতার নিয়মগুলো সেখান থেকে এমনিতেই বেরিয়ে আসে। কেন আর কীভাবে আসে এ প্রশ্নগুলো গুরুত্বপূর্ণ। পদার্থবিজ্ঞানীরা বলেন, তাঁরা যে শূন্যতা নিয়ে কাজ করেন, তাকে বলা হয় ‘সিমেট্রিক ভয়েড’। নোবেল পুরস্কার বিজয়ী বিজ্ঞানী ফ্র্যাঙ্ক উইলজেক তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন, এ ধরনের প্রতিসাম্যতা আসলে অস্থিতিশীল। কাজেই এ ধরনের সিস্টেম থেকে প্রতিসমতার ভাঙনের মাধ্যমে পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রের উন্মেষ ঘটাবে। অস্থিত অবস্থা থেকে স্থিতাবস্থায় আসার জন্যই এটা ঘটবে। সাম্প্রতিক সময়ে আলেকজান্ডার ভিলেঙ্কিনসহ বহু বিজ্ঞানীই তাঁদের মডেলের সাহায্যে দেখিয়েছেন যে, কণাবিহীন, শক্তিবিহীন, স্থানবিহীন, সময়বিহীন এই আদি শূন্যাবস্থা (‘হাইলি সিমেট্রিক ভয়েড’) থেকে কোয়ান্টাম টানেলিং-এর মাধ্যমে এমন মহাবিশ্বের উৎপত্তি ঘটতে পারে, যেখানে থাকবে পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রের ক্রিয়াশীলতা। অধ্যাপক ভিক্টর স্টেঙ্গর দেখিয়েছেন, কেবল চিরয়াত বলবিজ্ঞানের আলোচ্য তিনটি নিত্যতার সূত্রই নয়, নিউটনীয় বলবিদ্যা, কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যা, আপেক্ষিকতার বিশেষ এবং সার্বিক তত্ত্ব থেকে আসা সূত্রগুলো ‘পয়েন্ট অব ভিউ ইনভ্যারিয়েন্স’ এবং গেজ প্রতিসাম্যতা থেকেই বের করা সম্ভব।
Dwight E. Neuenschwander, Emmy Noether’s Wonderful Theorem, Johns Hopkins University Press; 2010
Katherine Brading and Harvey R. Brown, Noether’s Theorems and Gauge Symmetries, August 2000
Frank Wilczek, “The Cosmic Asymmetry Between Matter and Antimatter,” Scientific American 243, no. 6, 82-90, 1980
আর পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রগুলোই বা আসলে কী? এগুলো কি আদপেই মৌলিক কিছু, নাকি মহাবিশ্বকে ব্যাখ্যার প্রয়োজনে গণিতবিদ ও পদার্থবিদদের সৃষ্ট একধরনের বর্ণনা—সেটাও একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন এ মুহূর্তে। অনেক সূত্রের কথাই আমরা জানি যেগুলো আপাতদৃষ্টিতে সূত্র মনে হলেও আসলে সেরকমভাবে মৌলিক কিছু নয়। আমাদের চেনাজানা বলগুলোর অনেকগুলোই ‘কল্পিত বল’ (Fictitious force)। ‘কল্পিত’ বলা হচ্ছে, কারণ এগুলো কোনো সত্যিকারের বল নয়, এগুলো মূলত উঠে আসে বস্তুর সাথে ক্রিয়াশীলতার প্রেক্ষাপটে। বস্তু এবং মিথস্ক্রিয়া অনুপস্থিত থাকলে বলগুলোও অনুপস্থিত থাকে। যেমন ছোটবেলায় স্কুলের পদার্থবিজ্ঞানের পাঠ্যবইগুলোতে আমরা সেন্ট্রিফিউগাল ফোর্স বা কেন্দ্রাতিগ বলের কথা পড়েছি। কোনো বস্তু বৃত্তাকার পথে ঘুরতে গেলে বাইরের দিকে একধরনের বল অনুভব করে, সেটাই কেন্দ্রাতিগ বল। কিন্তু অনেকেই জানেন না যে, এটা আসলে একটা কল্পিত বল, এর কোনো প্রকৃত উৎস নেই। এই বলের ধাক্কা অনুভূত হয় বৃত্তাকার পথে ঘোরার সময় বৃত্তের অক্ষ থেকে বাইরের দিকে। বৃত্তাকার পথে না ঘুরলে এই বলের অস্তিত্বও থাকবে না। এরকম আরো অনেক বল আছে যেগুলো কল্পিত। যেমন কোরিলয়িস বল। এমনকি মাধ্যাকর্ষণ বলও।
মাধ্যাকর্ষণ বলকে সত্যিকারের বল বলেই আমরা সাধারণত জানি। কিন্তু আইনস্টাইন তাঁর আপেক্ষিক তত্ত্ব নিয়ে ভাবনার সময় বুঝতে পেরেছিলেন, মহাকর্ষ ক্ষেত্রের মধ্যে মুক্তপতনশীলতার অভিজ্ঞতা আর মহাকর্ষবিহীন শূন্যাবস্থায় ভেসে থাকার মধ্যে আসলে কোনো পার্থক্য নেই। সেখান থেকেই তিনি বের করে আনলেন ‘ইকুইভ্যালেন্ট প্রিন্সিপাল’—–যা ছিল সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্বের মূল ভিত্তি। সে হিসেবে মহাকর্ষও একটি কল্পিত বল, নিদেন পক্ষে এমন একটি বল যা কল্পিত বল থেকে অনেক সময়ই আলাদা করা যায় না।
আরো একটি বড় সমস্যা হলো, পদার্থবিজ্ঞানের যে সূত্রগুলোকে আমরা নিত্য বা ধ্রুব বলে জানি, সেগুলোর অনেকগুলোই সর্বজনীন নয়। যেমন,আমরা জানি নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ সূত্র মাটিতে আপেলের পতনকে ব্যাখ্যা করতে পারলেও অন্তিম কিছু পরিস্থিতিতে ঠিকমতো কাজ করে না,যেমন কৃষ্ণগহ্বরের কাছাকাছি, কিংবা আলোর বেগের প্রায় সমান বা তুলনীয় কোনো বেগের ক্ষেত্রে। আমরা তখন শরণাপন্ন হই আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্বের। কিন্তু আবার দেখা গেছে, আইনস্টাইনের তত্ত্বও প্লাঙ্ক স্কেলের চেয়ে ছোট জায়গায় কাজ করে না, আমরা শরণাপন্ন হই, কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যার কিছু সূত্রের। তাই পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রগুলো হয়তো ‘ধ্রুব’ কিছু নয়, এরা আসলে আমাদের মডেলের সীমাবদ্ধতা তৈরি করছে, পদার্থের নয়। এরকম আরো উদাহরণ দেওয়া যায়। যেমন, ‘কনজারভেশন অব লিনিয়ার মোমেন্টাম’ বা রৈখিক ভরবেগের নিত্যতা নামের সূত্রের কথা যে আমরা আগে জেনেছি,তা আর সংরক্ষিত থাকে না যখন সময় অবস্থান্তর বা ‘স্পেস ট্রান্সলেশন’ প্রতিসাম্যতা ভেঙে যায়। ঠিক একইভাবে কৌণিক ভরবেগও কিছু বিশেষ ক্ষেত্রে লঙ্ঘিত হয়। আর কোয়ান্টাম জগতে আমাদের চেনাজানা জগতের অনেক সূত্রই কাজ করে না। যেমন, কোয়ান্টাম টানেলিং-এর সময় নিউটনীয় বাধা কাজ করে না; কোয়ান্টাম এন্টাংগেলমেন্টের মতো ব্যাপার-স্যাপার ঘটে, কিংবা কণা-প্রতিকণার উদ্ভব ঘটে শূন্য থেকে, যেগুলো আমাদের সজ্ঞাত ধারণা কিংবা প্রচলিত নিয়মের বিরোধী। কাজেই এ উদাহরণগুলো গোনায় ধরলে পদার্থবিজ্ঞানের সূত্র বা নিয়মগুলোকে যেভাবে চিরায়ত বা ‘প্লেটোনিক’ বলে উল্লেখ করা হয়, সেগুলো কি সেরকমই নাকি আসলে মডেল তৈরির প্রয়োজনে পদার্থবিদদের বর্ণন,তা সত্যই প্রশ্নসাপেক্ষ; যদিও অধিকাংশ মানুষ এবং এমনকি পদার্থবিদদেরও একটি বড় অংশ মনে করেন এই সূত্রগুলো ‘প্লেটোনিক”।
কিন্তু এই ‘প্লেটোনিক’ ব্যাপারটা আসলে কী? এ নিয়ে কিছু বলা প্রয়োজন। এর উৎস পাওয়া যায় গ্রিক দার্শনিক প্লেটোর রিপাবলিকে বর্ণিত ধারণায়। প্লেটো কল্পনা করতেন, আমাদের জগতের বাইরেও একটা স্বর্গীয় জগৎ আছে, সেখানে সব নিখুঁত গাণিতিক বিমূর্ত ধারণাগুলো বাস করে। আমরা আমাদের জগতে শতভাগ নিখুঁত রেখা, বৃত্ত, ত্রিভুজ, অসীমসংখ্যক সমান্তরাল রেখা দেখতে পাই না।
What is a “fictitious force”?, Scientific American, July 9, 2007
আমাদের জগতে না পাওয়া গেলেও প্লেটো ভাবতেন, সেগুলো পাওয়া যাবে সেই স্বর্গীয় জগতে। শুধু জ্যামিতিক অবয়ব নয়, আমাদের সংখ্যাপদ্ধতি, গাণিতিক, অনুপাত, ধ্রুবক সবকিছুরই বাস্তব অস্তিত্ব রয়েছে সেই স্বর্গীয় জগতে। গণিতবিদদের মধ্যে যাঁরা এখনো, প্লেটোর রিপাবলিকের অর্ধশতাব্দী পরও এই স্বর্গীয় ফ্যান্টাসিতে আচ্ছন্ন হয়ে আছেন, তাঁদের বলা হয় ‘প্লেটোনিস্ট’। তাঁরা সত্যই মনে করেন, এমন এক জগৎ আছে যেখানে গণিতের ‘পাই’, ‘সুবর্ণ অনুপাত’, ‘ফিবোনাচি রাশিমালা’ এরা সবাই হাত-ধরাধরি করে বাস করে। যেমন, কলেজ ডি ফ্রান্সের বিশ্লেষণ এবং জ্যামিতি বিভাগের চেয়ারপারসন অ্যালেইন কোনস বলেন, ‘মানবমনের বাইরেও আদি এবং ইমিউটেবল গাণিতিক বাস্তবতার অস্তিত্ব রয়েছে’। প্লেটোনিস্ট গণিতবিদেরা মনে করেন, গণিতবিদের কাজ হচ্ছে সেই গাণিতিক বাস্তবতাগুলো ‘ডিসকোভার’ করা, ‘ইনভেন্ট’ নয়। অর্থাৎ গণিতের নিয়মগুলো তৈরি করা যায় না, কেবল খুঁজে বের করা যায়। পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রগুলোও ঠিক তেমনি, এরা বাস করে বিমূর্ত এক কল্পলোকে, আর এরা বাস্তব জগৎকে স্পর্শ করে তখনই যখন তারা এর ওপর ‘ক্রিয়া’ করে।
কিন্তু ব্যাপারটা কি আসলেই ঠিক সেরকম? আমরা এই বইয়ের প্রথমদিকে সুবর্ণ অনুপাতের সাথে পরিচিত হয়েছি। আমরা দেখেছি ভিঞ্চির আঁকা মোনালিসা কিংবা গ্রীসের পার্থেনন প্রাসাদ থেকে শুরু করে আনারস,শামুক,গাছের পাতা, ফুলের পাপড়ি, পাইনকোন, গাছের শাখা, গ্যালাক্সিসহ প্রকৃতির বিভিন্ন নকশায় রয়েছে সুবর্ণ অনুপাতের সরব উপস্থিতি। একই কথা ফিবোনাচি রাশিমালার ক্ষেত্রেও খাটে। প্লেটোনিস্ট গণিতবিদেরা এই রহস্য দেখে উদ্বেলিত হন, তাঁরা যেন অনুভব করেন গাণিতিক বিমূর্ততার সত্যিকার অস্তিত্ব: ‘Mathematics feels real, and the world feels mathematical’. কেউ কেউ জেমস জিনসের মতো জিজ্ঞেসা করেই বসেন, ‘ইজ গড আ ম্যাথেম্যাটেশিয়ান?”।
তবে, প্লেটোনিক ব্যাপারটায় ‘রোমান্টিকতা’ থাকলেও এটা সর্বজনগ্রাহ্য কোনো কিছু নয়। বরং এর ‘আঁশটে’ গন্ধের জন্য বহুদিক থেকেই এর বহু সমালোচনা আছে। এ প্রসঙ্গে জর্জ লেকফ ও রাফায়েল নুনেজের ‘Where Mathematics Come From: How The Embodied Mind Brings Mathematics Into Being’ বইটি পড়া যেতে পারে। বইটিতে লেখকদ্বয় প্লেটোনিক ধারণার সমালোচনা করে বলেছেন, ‘প্লেটোনিক গণিত বিশ্বাসের ব্যাপার, অনেকটা ঈশ্বরে বিশ্বাসের মতোই। এটার অস্তিত্বের পক্ষে বা বিপক্ষে কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই’। জ্যোতিঃপদার্থবিদ মারিও লিভিও তাঁর ‘Is God a Mathematician?” বইয়ে দেখিয়েছেন, সুবর্ণ অনুপাতসহ গণিতের বেশ কিছু ধারণা, যেগুলো মানুষকে মোহাচ্ছন্ন করে রেখেছে যুগের পর যুগ ধরে, তার অনেকগুলোই আসলে প্লেটোনিক নয়, বরং অনেক ক্ষেত্রে মানুষেরই আবিষ্কার, কিংবা কোনো কোনো ক্ষেত্রে এ দুই বৈশিষ্ট্যের মিশ্রণ “। মারিও লিভিও তাঁর আরেকটি বই ‘গোল্ডেন রেশিও’তে জোরালোভাবে অভিমত দিয়েছেন যে, স্থাপত্য, শিল্পকলাসহ বহুক্ষেত্রে আমরা গোল্ডেন রেশিও বা সুবর্ণ অনুপাতের যেরকম মাহাত্ম্যের কথা শুনি, তার বেশিরভাগই আসলে ‘মিথ’ বা অতিকথন।
তবে আমরা সেসব দার্শনিক জটিলতায় যেতে চাই না। আমরা খুব সহজ কিছু উদাহরণের সাহায্যে সোজাসাপ্টাভাবে ব্যাপারগুলো বুঝতে চাই। এ প্রসঙ্গে চলুন আমরা বেছে নিই সবার চেনাজানা গাণিতিক ধ্রুবক ‘পাই’ (π) বাবাজিকে। ছোটবেলায় স্কুলের শিক্ষকেরা শিখিয়েছিলেন-এর মান ৩.১৪-এর মতন। যত বড় হতে লাগলাম তত দেখলাম পাইয়ের হরেক রকমের ব্যবহার। বৃত্তের ক্ষেত্রফল (A = πr²) বের করতে ‘পাই’ লাগে, গোলকের আয়তন (V = 4/3πr³) বের করে ‘পাই’ দরকার, ‘পাই’ লাগে গোলকের পৃষ্ঠক্ষেত্র (A = 4πr²) বের করতে গেলেও। নবম-দশম শ্রেণীতে উঠে বৈদ্যুতিক চার্জের সাথে আর কুলম্বের সূত্রের সাথে যখন পরিচিত হলাম, দেখলাম ‘পাই’ বাবাজি খুঁটি গেড়েছে সেখানেও–
F = q1q2 / ε04πr²
F = চার্জ q1 এবং চার্জ q2-এর মধ্যকার বল
4πr² = গোলকের পৃষ্ঠক্ষেত্র
q1 = প্রথম বস্তুকণার আধান
q1 = দ্বিতীয় বস্তুকণার আধান
r = আহিত বস্তুকণাদ্বয়ের কেন্দ্রের মধ্যবর্তী দূরত্ব
ε0 = বৈদ্যুতিক প্রবেশ্যতা বা পার্মিবিলিটি কনস্ট্যান্ট
আইনস্টাইনের বিভিন্ন তত্ত্বের সাথে পরিচিত হবার পর দেখলাম, তাঁর বিভিন্ন সূত্রেই ‘পাই’য়ের নানা ধরনের ব্যবহার আছে। যেমন তাঁর ভর আর শক্তির মধ্যে সম্পর্কসূচক বিখ্যাত সমীকরণটাকে সহজেই ‘পাই’-এর মাধ্যমে লেখা যায় –
E = mc² = m/ ε0µ0 যেখানে µ0 = 4π10-7 henry/meter
আর আমরা অষ্টম অধ্যায়ে আপেক্ষিকতত্ত্বের যে ক্ষেত্র-সমীকরণের সাথে পরিচিত হয়েছি, সেখানেও রয়েছে ‘পাই’ –
Gπν = 8πGTµν
দেখে মনে হতে পারে পুরো মহাবিশ্বই যেন ‘পাই’ময়। মহাবিশ্বের ডিজাইনের মূলেই যেন ‘পাই’। বহু লেখকের বইয়েই দেখা যায়, মিসরের প্রাচীন পিরামিড থেক শুরু করে বহু প্রসিদ্ধ স্থাপত্যকর্মের নকশায় নাকি ‘পাই’ লুকিয়ে আছে”। ভাবখানা এমন, এই ‘পাই” ব্যাপারটা ধ্রুবক হিসেবে না থাকলে বোধ হয় মহাবিশ্ব কাজই করত না। নিশ্চয় এটা স্বৰ্গীয় কিছু। কোনো বিশেষ উদ্দেশ্যে নিশ্চয় ‘পাই’- এর মান এমনতর করে তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু মুশকিল হল – ভাবনাটা যে ঠিক তার কোনো প্রমাণ নেই। সবকিছুর পেছনে একধরনের ‘উদ্দেশ্যের বিভ্রম’ তৈরি করা মানুষের মজ্জাগত; হয়তো এটা অতীতে কোনো বিবর্তনীয় উপযোগিতা দিয়েছিল মানুষকে, তাই অধিকাংশ মানুষ এভাবেই চিন্তা করে; কিন্তু মহাবিশ্ব তো আর মানুষের চিন্তা অনুযায়ী কিংবা তার আরোপিত বিভ্রম অনুযায়ী কাজ করার জন্য দিব্যি দিয়ে বসে নেই। পদার্থবিদ শন ক্যারল সেটা স্পষ্ট করেছেন নিচের এই উদ্ধৃতিতে –
‘মানুষের একটা সাধারণ প্রবণতা হলো মহাবিশ্বের সব কিছুর পেছনে একটা উদ্দেশ্য ও অর্থ খুঁজে ফেরা। কিন্তু সেই প্রবণতাকে মহাজাগতিক নিয়মনীতির দিকে আমাদের নিয়ে যাওয়া উচিত নয়। ‘অর্থ’ ও ‘উদ্দেশ্য’—এগুলো আমরা নিজেরাই তৈরি করেছি; এগুলো বাস্তবতার পরম নির্মাতার কোথাও ওত পেতে থাকার ইঙ্গিত নিয়ে আমাদের কাছে আসেনি। তাতে অবশ্য কোন সমস্যা নেই। আমাদের মহাবিশ্বটা যেরকম, সেরকমভাবে খুঁজে পেয়েই আমি খুশি’।
শন কারলের মতো পদার্থবিদ মহাবিশ্বের প্রকৃতি যেরকম সে রকমভাবে পেয়েই খুশি হতে পারেন, কিন্তু আমাদের অনেকেই হই না। নানা রকম অর্থ খুঁজে ফিরি, নানা পদের উদ্দেশ্য তৈরি করি এর পেছনে। সামান্য একটা ‘পাই’-এর মান
Mario Livio, Is God a Mathematician?, Simon & Schuster, 2010
Mario Livio, The Golden Ratio: The Story of PHI, the World’s Most Astonishing Number, Broadway Books, 2003
মজার ব্যাপার হচ্ছে, পিরামিডের নকশায় সুবর্ণ অনুপাত এবং পাই-এর ব্যবহার থাকার দাবি করা হলেও প্রাচীন মিসরীয় ও ব্যাবিলনীয়রা যে সুবর্ণ অনুপাতের ব্যবহার জানতেন, তার কোনো লিখিত প্রমাণ পাওয়া যায় না। তারা ‘পাই’-এর ব্যবহার জানলেও সাম্প্রতিক sekedতত্ত্ব অনুযায়ী পিরামিড নির্মাণে এর কোনো ভূমিকাই ছিল না (Mario Livio, Golden Ratio, 2003)।
কেন ৩.১৪ হল তা নিয়ে ভাবাপ্লুত হয়ে যাই, বিস্মিত হই প্রকৃতিতে ‘বুদ্ধিদীপ্ত নকশা’ কিংবা ‘সূক্ষ্ম সমন্বয়’ খুঁজে পেয়ে।
‘পাই’-এর প্রসঙ্গে আসা যাক। এর সংজ্ঞা খুবই সোজা। ইউক্লিডীয় জ্যামিতিতে যেকোনো বৃত্তের পরিধি ও ব্যাসের অনুপাতকে এই পাই নামের ধ্রুবক দিয়ে প্রকাশ করা হয়।
ছবি থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, পাই ব্যাপারটা আমরাই সংজ্ঞায়িত করেছি বৃত্তের পরিধি ও ব্যাসের অনুপাত দিয়ে। এই সংজ্ঞা স্বর্গ থেকে আসেনি। মানুষই বানিয়েছে। মানুষ আরো দেখেছে, এই অনুপাতের একটা মান আছে এবং সেটা একটা অমূলদ সংখ্যা, যাকে পিথাগোরাস এবং তাঁর অনুসারীরা যমের মতো ভয় করতেন। গণিতবিদেরা পাই-এর মান দশমিকের পর এমন সূক্ষ্মতায় নির্ণয় করেছেন যে এই বইয়ের সমস্ত পাতাকে সংখ্যা দিয়ে ভরে ফেলা যাবে। কেউ কেউ আবার নিজেদের স্মৃতিশক্তির পরীক্ষা দিতে পাই-এর সেই মান গড়গড় করে মুখস্থ বলতে পারেন, আর নানা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে অন্যদের তাক লাগিয়ে দিতে পারেন। এগুলো সবই মানুষ করে ঐশ্বরিক কোনো ক্ষমতার দাবি ছাড়াই, যেকোনো ভাবালুতা এড়িয়ে।
কিন্তু চাইলে কেউ ভাবালু হয়ে আলুথালু বেশ নিতে পারেন অবশ্য। ছোটবেলায় আমরাও নিতাম। একটা ধাঁধা ছিল ছোটবেলায় — পঁচিশ পয়সার একটা কয়েনকে মাঝখানে রেখে এর চারদিকে সর্বোচ্চ কয়টা সিকি বসানো যাবে, যাতে তাদের মধ্যে কোনো ফাঁক না থাকে?
ছোটবেলায় ধাঁধাটির সমাধান বের করতে মাথা চুলকালেও এখন জানি এর সমাধান আসলে খুবই সোজা। যাঁরা পিথাগোরাসের জ্যামিতি জানেন, তাঁরা টেবিলে পয়সা না বসিয়েই উত্তর বলে দিতে পারবেন। যাঁরা পারবেন না তাঁরা ওপরের ছবিটা দেখুন। দেখবেন, মাঝখানের কয়েনের চারদিকে মোট ৬টা কয়েন বসানো যাবে। কিভাবে পাওয়া গেল এই উত্তর? মাঝখানের কয়েন আর তার চারপাশের দুটো কয়েনের কেন্দ্র মিলে তৈরি করবে এক সমবাহু ত্রিভুজ। আমরা জানি, ত্রিভুজের তিন কোণের সমষ্টি ১৮০ ডিগ্রি। সে হিসেবে সমবাহু ত্রিভুজের প্রতিটি কোণ হবে ৬০ ডিগ্রি। এখন সমগ্র বৃত্তকে যেহেতু ৩৬০ ডিগ্রি দিয়ে প্রকাশ করা হয়, সেক্ষেত্রে চারপাশের বৃত্তের সংখ্যা হবেঃ ৩৬০/৬০=৬টি।
দেখাই যাচ্ছে খুব সোজাসাপ্টা হিসাব। কোনো রহস্য নেই। একটা সিকির চারদিকে সাতটা বা আটটা সিকি বসানো যাবে না। ৬টিই হতে হবে। এটা কি কোনো সূক্ষ্ম গায়েবি সমন্বয়? না, তা নয়। আগেই দেখানো হয়েছে, ত্রিভুজের তিন কোণের সমষ্টি ১৮০ ডিগ্রি হিসেবে সমবাহু ত্রিভুজের প্রতিটি কোণকে হতে হবে ৬০ ডিগ্রি। কাজেই ৬টির বেশি কয়েন এতে আটবে না। কিন্তু যাঁরা ঐশী ভাবালুতা খোঁজেন তাঁরা সব সময়ই নানা পদের রহস্য আমদানি করবেন, হয়তো বলবেন তিন কোণের সমষ্টি ১৮০ ডিগ্রিই বা হলো কেন, কেন ১৭০.৭৫ ডিগ্রি নয়?
এর কারণ হলো, বিজ্ঞানীরা প্রমাণ পেয়েছেন যে আমাদের মহাবিশ্বের জ্যামিতি সামতলিক বা ফ্ল্যাট। সামতলিক জ্যামিতির মহাবিশ্বে দুটি সমান্তরাল রেখা সব সময় সমান্তরালভাবেই চলতে থাকে। আর সেখানে ত্রিভুজের তিন কোণের সমষ্টি হয় ঠিক ১৮০ ডিগ্রি। ভিন্ন টপোলজির মহাবিশ্বে সেটা ভিন্ন রকম হতে পারে যদিও। যেমন কোনো বদ্ধ মহাবিশ্বে ত্রিভুজের তিন কোণের সমষ্টি ১৮০ ডিগ্রিকে ছাড়িয়ে যায়, আর সমান্তরাল আলোর রেখা পরস্পরকে ছেদ করে। আবার উন্মুক্ত কিংবা পরাবৃত্তাকার (hyperbolic) মহাবিশ্বে ত্রিভুজের তিন কোণের সমষ্টি হয় ১৮০ ডিগ্রির চেয়ে কম। সেখানে সমান্তরাল আলোর রেখাগুলো পরস্পর থেকে দূরে সরে যায়। কাজেই যে ভাবালুরা ত্রিভুজের তিন কোণের সমষ্টি ১৭০.৭৫ ডিগ্রি হিসেবে দেখতে চান, তাঁদেরকে কষ্ট করে আমাদের মহাবিশ্বের বাইরে গিয়ে কোনো হাইপারবলিক উন্মুক্ত মহাবিশ্ব খুঁজে নিয়ে সেখানে আবাস গড়তে হবে।
ব্যাপারটা কেবল ‘পাই’-এর মান নির্ণয়ে কিংবা তিন কোণের সমষ্টি পরিমাপের ক্ষেত্রেই নয়, যেকোনো পদার্থবিজ্ঞান বা গণিতের সূত্রের ক্ষেত্রেই একইভাবে প্রযোজ্য। মারিও লিভিও তাঁর ‘গোল্ডেন রেশিও’ বইয়ে বলেন, “কোনো কারণে পৃথিবীতে মাধ্যাকর্ষণ বলের টান যদি একটু বেশি অনুভূত হতো, তাহলে ব্যাবলনীয়রা কিংবা ইউক্লিডিয়ানরা হয়তো ভিন্ন কোনো জ্যামিতি প্রস্তাব করত। মাধ্যাকর্ষণ বেশি হলে আমরা জানি যে, আমাদের চারদিকের স্থান সমতল না হয়ে বাঁকা হতো। আলোকেও সোজা পথে না চলে বাঁকা পথেই চলতে হতো। সেই বাস্তবতার সাথে তাল মিলিয়ে ইউক্লিডের জ্যামিতির যে স্বীকার্যগুলো উঠে আসত তা আজকে থেকে ভিন্নরকম’। সে ধরনের বাস্তবতা হয়তো থাকতেই পারে, তবে আমাদের মহাবিশ্বে নয়, অন্য কোনো মহাবিশ্বে।
লিন্ডের কেওটিক ইনফ্লেশনারি মডেলকে গোনায় ধরলে সেটা কোনো অসম্ভব বিষয় নয়। স্ফীতির এই সর্বশেষ এবং সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য ভাষ্য অনুযায়ী আমাদের এই মহাবিশ্বের বাইরেও অসংখ্য মহাবিশ্বের অস্তিত্ব আছে। ‘স্ট্রিং ল্যান্ডস্কেপ’ থেকে পাওয়া সমাধান থেকে জানা গেছে যে আমাদের মহাবিশ্বের বাইরেও অন্তত ১০৫০ টির মতো ‘ভ্যালি’ আছে,এবং তা থেকে জন্ম নিতে পারে আলাদা আলাদা মহাবিশ্ব। সে সমস্ত মহাবিশ্বে একেক রকম পদার্থবিজ্ঞানের সূত্র কাজ করতে পারে। সম্ভাব্য মহাবিশ্বের যে বিশাল সমাধান পাওয়া গেছে তার বিন্যাস এবং সমাবেশ করলেই বোঝা যায় কত ধরণের বহুমুখী মহাবিশ্ব বাস্তবে তৈরি হতে পারে। কোনো মহাবিশ্বে হয়তো গ্রহ বা নক্ষত্র তৈরিই হতে পারবে না কখনো, কোনোটায় তৈরি হলেও প্রাণের বিকাশের জন্য খুবই বৈরি পরিবেশ থাকবে, কোনো মহাবিশ্বে হয়তো আমাদের মতোই কোনো এক সুনীল গ্রহে বুদ্ধিমান সত্তার উদ্ভব ঘটার মতো পরিবেশ তৈরি হয়েছে, কোনোটায় হয়তো দেখা যাবে মানুষের বদলে ডাইনোসরেরা ছাতা মাথায় দিয়ে ঘুরছে, আর কোনোটায় পিথাগোরাসের জ্যামিতি সমাধান করতে গিয়ে ত্রিভুজের তিন কোণের সমষ্টি পাওয়া যাচ্ছে ১৭০.৭৫ ডিগ্রি। অর্থাৎ,আমাদের মহাবিশ্বের নিয়মগুলোকে যেভাবে ‘চিরায়ত’ কিংবা ‘পাথরে খোদাই করা’ বলে ভাবা হচ্ছে, মাল্টিভার্স সত্য হলে সেই ছবিটা আর সেরকম থাকবে না। তা না হওয়াটাই বরং অধিকতর সম্ভাব্য। পদার্থবিজ্ঞানী লরেন্স ক্রাউস তাঁর ‘ইউনিভার্স ফ্রম নাথিং’ বইয়ে অভিমত ব্যক্ত করেন, পদার্থবিজ্ঞানের বিধিগুলো কোনো ঐশী স্পর্শে নয়, বরং র্যাণ্ডমলি বা বিক্ষিপ্তভাবে বিভিন্ন মহাবিশ্বে বিভিন্ন রকমভাবে সন্নিবেশিত হয়েছে। তিনি বলেন,
‘সামগ্রিকভাবে মহাবিশ্বের বিধিগুলো যদি এলোপাতাড়ি এবং বিক্ষিপ্ত হয়, তবে আমাদের মহাবিশ্বের জন্য এর কোনো কোনোটি প্রযুক্ত হবার জন্য কোনো নির্ধারিত ‘cause’-এর দরকার নেই। কোনো কিছুর উপরে যদি নিষেধাজ্ঞা আরোপ না করা হয়, তবে, সাধারণ নিয়মেই কোনো একটা মহাবিশ্বে পদার্থবিজ্ঞানের কিছু জুতসই নিয়ম প্রযুক্ত হবে, যেগুলো আমরা সেখানে খুঁজে পেয়ে ধন্য হয়ে যাব।’
একই কথা বলেছেন ব্রিটিশ পদার্থবিজ্ঞানী মার্টিন রিসও। তিনি এই মাল্টিভার্স বা অনন্ত মহাবিশ্বের পুরো সিস্টেমকে তুলনা করেছেন বঙ্গবাজারের কিংবা গাউছিয়ার মতো কোনো একটা পুরনো সেকেন্ড হ্যান্ড কাপড়ের দোকানের সঙ্গে। কাপড়ের জোগান যদি বিশাল হয়, তার মধ্যে কোনো একটা পুরনো জামা আমাদের দেহে মাপমতো লেগে গেলে, আমরা যেমন অবাক হই না, ঠিক তেমনি আমাদের মহাবিশ্বের বিধিগুলোর তথাকথিত সূক্ষ্ম সমন্বয় দেখেও এত হতবিহবল হবার কিছু নেই।
কিন্তু কিভাবে ভিন্ন ভিন্ন পদার্থবিজ্ঞানের সূত্র ভিন্ন ভিন্ন মহাবিশ্বে কাজ করছে? আর কেনই বা এই অনন্ত মহাবিশ্বের ধারণাকে মূলধারার বিজ্ঞানীরা এত জোরালোভাবে গ্রহণ করতে শুরু করেছেন ইদানীং? ‘মাল্টিভার্স’-এর ধারণা, যা কিছুদিন আগেও কেবল বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি এবং ফ্যান্টাসির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, ক্রমশ এখন পদার্থবিজ্ঞানের মূলধারার গবেষণার অংশ হয়ে উঠছে কিভাবে? এ নিয়ে আমরা জানব পরবর্তী একটি অধ্যায়ে।
কিন্তু তার আগে আমাদের হিগস সম্বন্ধে জেনে নেওয়া দরকার। কারণ, আমাদের এই শূন্যতার সাথে হিগসের একটা গভীর সম্পর্ক আছে।
Martin Rees, Why does the Universe Appear to be Fine-Tuned for life?, Astronomy’s 60 Greatest Mysteries, Sky and Telescope, 2013
♦ দ্বিতীয় অধ্যায়ঃ শূণ্যের ভীতি
♦ তৃতীয় অধ্যায়ঃ পশ্চিমে নয়, পুবের দিকে
♦ চতুর্থ অধ্যায়ঃ শূন্য এল ইউরোপে
♦ পঞ্চম অধ্যায়ঃ প্রকৃতির শূন্যবিদ্বেষ ?
♦ ষষ্ঠ অধ্যায়ঃ বিজ্ঞানে শূন্যের আভাস
♦ সপ্তম অধ্যায়ঃ আইনস্টাইনের বিশ্ব
♦ অষ্টম অধ্যায়ঃ শূন্যতার শক্তি
♦ নবম অধ্যায়ঃ মহাবিস্ফোরণের কথা
♦ দশম অধ্যায়ঃ বিগ ব্যাং-এর আগে কী ছিল?
♦ একাদশ অধ্যায়ঃ কোয়ান্টাম শূন্যতা ও মহাবিশ্বের উৎপত্তি
♦ দ্বাদশ অধ্যায়ঃ হিগস কণার খোঁজে
♦ ত্রয়োদশ অধ্যায়ঃ মহাবিশ্বের অন্তিম পরিণতি
♦ চতুর্দশ অধ্যায়ঃ অনন্ত মহাবিশ্বের সন্ধান শূন্য ও অসীমের মেলবন্ধন
♦ পঞ্চদশ অধ্যায়ঃ অন্তিম প্রশ্নের মুখোমুখি: কেন কোনো কিছু না থাকার বদলে কিছু আছে?
“শূন্য থেকে মহাবিশ্ব” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ