সবখানে একটা ঝড়ের আভাস দেখছিলাম। হলের ছেলেরা বইপত্র নিয়ে বাড়ি চলে যাচ্ছিল। রাস্তাঘাটে লোকজন চলছে, অথচ যানবাহন নেই। এখানে-সেখানে ব্যারিকেড সাজিয়ে সকলেই কিছু একটার জন্যে অপেক্ষা করছে। আমার ভালো লাগছিল না। সকলের হাবভাব, রাজনৈতিক-পরিস্থিতি ইত্যাদি দেখে আমি বেশ শঙ্কিত হয়ে উঠেছিলাম। ছোটো ভাইবোন দুটিকে নিয়ে বাসায় চলে যেতে চাচ্ছিলাম। অথচ ওরা দু-জনেই স্বভাবে আর মানসিক গঠনে আমার উলটো। যখন রোকেয়া হলে শেফুর (হুমায়ূন আহমেদের বোন সুফিয়া হায়দার) সঙ্গে দেখা করতে যাই তখন তার উল্লসিত ভাব দেখে বিস্মিত হই। বলি,
কিরে ভয় লাগে না? আয় বাসায় চলে যাই।
সবাই হলে আছে, আমি কেন খামাখা যাব?
হেসেই উড়িয়ে দেয় সে। আমি তবু জোর করি। বলি, কিন্তু যদি কিছু হয়।
তুমি বড়ো ভীতু।
ভীতু মানুষকে ভীতু বলে গাল দেবার সুবিধা এই যে, তাতে সে রাগ করতে পারে না। মনের খবর প্রকাশ হয়ে যায় দেখে বিব্রত হয় শুধু। আমিও তাই বিব্রত মুখেই ফিরে আসি।
হলেও আমার কিছু করার নেই। অনার্স থিওরি পরীক্ষা দিয়ে দিয়েছি, প্রাকটিকেলের ফার্স্ট পেপারও হয়ে গিয়েছে। গণ্ডগোল শুরু হয় এর মধ্যেই। ইয়াহিয়ার জাতীয় পরিষদের অধিবেশন মুলতুবি, প্রতিবাদে দেশব্যাপী হরতাল এবং একে অনুসরণ করে গ্রেফতার, গুলি, কারফিউ।
আমার রাজনৈতিক নিস্পৃহতার জন্যেই আমি এ-সমস্ত থেকে দূরে ছিলাম। শুচিবাইগ্রস্তদের মতোই আমি রাজনীতি থেকে দূরে থাকতে চেষ্টা করতাম। সংসারে যে-সমস্ত লোক বিজ্ঞাপন, অবিশ্বাস্য, মর্মন্তুদ, বিশ্বাস করুন আর নাই করুন জাতীয় খবরগুলো খবরের কাগজের হেডলাইনের খবরের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে পড়ে আমি সব সময় সেই দলের। যার ফলস্বরূপ আমি সবার ওপরই বিরক্ত হয়ে উঠছিলাম। ইয়াহিয়ার ওপর বিরক্তি–কেন সে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন পিছিয়ে দিলো। মুজিবরের ওপর বিরক্তি দুই একদিন পিছিয়েছে তাতে এত হইচই এর কি আছে। আসল কারণ পরীক্ষাগুলো দিয়ে ঝামেলা মিটিয়ে ফেলতে আমি উদগ্রীব হয়ে উঠেছিলাম।
ছোটো ভাই ইকবাল (মেজো ভাই মুহম্মদ জাফর ইকবাল) তখনো হলে সিট পায়নি। আমার সঙ্গেই থাকত। রাজনীতি বিষয়ে তার কতটুকু আগ্রহ ছিল জানি না কিন্তু মিটিং, মিছিল এই সমস্তে তার উৎসাহ ছিল। শহীদ মিনারে ফুল দেয়ার জন্যে রাত তিনটায় বেরিয়ে যাওয়ার মধ্যে এর প্রমাণ মেলে। তার জন্যে উদ্বেগ ভোগ করতে হতো। সব সময় ভয় হতো এই বুঝি কোনো একটা ঝামেলায় পড়ল।
আবহাওয়া তখন খুব গরম যাচ্ছে। চারিদিকে মিটিং, মিছিল, বিক্ষোভ। শামুকের মতোই এ-সমস্ত থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিজের খোলেই নিজেকে আবদ্ধ করে রেখেছিলাম। আমি যখন টমাস হার্ডির ‘এ পেয়ার অব ব্লু আইস’ পড়ে চোখের জলে বালিশ ভিজিয়ে ফেলছি তখন শুনতাম ছেলেরা মিছিল করে যাচ্ছে। ভয় হতো এই বুঝি এসে বলবে ‘কি রে তুই গাধার মতো ঘুমুচ্ছিস আয় আমাদের সাথে।’ এর হাত থেকে বাঁচার জন্যেই রুমের সামনে লিখে রেখেছিলাম ‘Examinee, Don’t disturb, নীরবতাই কাম্য।’
দুপুরে ইকবাল এসে খবর দিল ফার্মগেটে গুলি হয়েছে। বিকেলের দিকে এল ইকবালের বন্ধু খাজা। নাটক না করে কিছুই বলতে পারে না। সে চোখ বড় বড় করে হাত নেড়ে মাথা দুলিয়ে যা বলল তা হলো হাইকোর্টের সামনে বাঙালি পুলিশ আর মিলিটারিতে সিরিয়াস ফাইট। দুই পক্ষেই গুলাগুলি, একশর উপর জখম। বলা বাহুল্য তার কথা বিশ্বাস হলো না। তবে কিছু একটা যে হয়েছে তার আঁচ পেলাম। সন্ধ্যা নাগাদ খবর পাওয়া গেল দুই পক্ষে মতান্তর হয়েছে ঠিকই। পুলিশরা রাইফেল ফেলে দিয়ে বলেছে ডিউটি করব না। দাবানলের মতোই খবর ছড়িয়ে পড়ল। মিলিটারি পুলিশ সংঘর্ষ। ছেলেরা উৎসাহে টগবগ করে ফুটতে লাগল। পুলিশ অফিসারের ছেলে হিসেবে আমি এতে যথেষ্ট গৌরববোধ করছিলাম। আমার হাবভাবে এমন প্রকাশ পাচ্ছিল যে আমি নিজেই এই গণ্ডগোলের সৃষ্টি করে মিলিটারির পিলে চমকে দিয়েছি।
অবস্থার দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছিল। মিলিটারির ট্রাক, জিপ আর পশ্চিমা ই.পি.আর-দের নড়াচড়া চোখে পড়ার মতোই। হল থেকে যখনই দৈত্যের মতো ট্রাকগুলো দেখা যেত তখনই ‘দুর!’ ‘দুর!’ ধ্বনি উঠত সমস্ত হলগুলো থেকে। অতিরিক্ত উৎসাহীরা ছড়া কাটত
‘একটা দুইটা মিলিটারি ধর
সকাল বিকাল নাস্তা কর।’
পুলিশের গাড়িগুলোও অবশ্য এ-থেকে রেহাই পেত না। তবে তারা প্রায়ই ‘জয় বাংলা’ বলে চেঁচিয়ে বাজিমাত করত। ছেলেরা তখন ‘জয় বাংলা’, ‘জয় বাংলা’ বলে ষাড়ের মতোই চেঁচাতে থাকত।
শেফুর কাছ থেকে মজার মজার খবর পেতাম। কোনো এক মেয়ে বাড়ি থেকে চিঠি পাচ্ছে না কেলে কেঁদে বুক ভাসাচ্ছে। কারা নাকি একটা মিলিটারি গাড়ির ওপর গরম পানি ঢেলে দিয়েছে উপর থেকে। আবার আরেকজন তিন তালা থেকে থুতু ফেলেছে এক পুলিশের গায়ে। অধিকাংশ গল্প গল্পই। অবিশ্বাস্য এবং হাস্যকর। বসে বসে শুনতে ভালোই লাগত। মেয়ে হলের ভিজিটার্স রুমটা যদিও সবদিক থেকেই ভিজিটারদের ডিসকারেজ করবার জন্যেই তৈরি তবু ছেলেরা সেখানে গেলে বড়ো একটা উঠতে চাইত না। মেয়েরা সেটা ভালো করেই জানত। শেফু যাতে আমাকে ঐ সব ছেলেদের দলে না ফেলে, যাতে না-ভাবে দাদাভাই (হুমায়ূন আহমেদকে তার ছোটো ভাইবোন দাদাভাই বলে ডাকত) দেখি বসে থাকতে থাকতে শিকড় গজিয়ে ফেলল সেই দিকে আমার কড়া নজর ছিল তাই তার সঙ্গে আমার কথা হতো অল্পই।
কি রে ভাল?
হ্যাঁ।
চল বাসায় চলে যাই।
না।
রাতে গুলির শব্দ শুনে ভয় লাগে?
উঁহু মজা লাগে।
আচ্ছা তা হলে যাই।
আচ্ছা।
আহসান খবর দিলো আর্ন উল্লাহ হলের তিনজন ছাত্রকে গ্রেফতার করে নিয়ে গিয়েছে লামা থাকতেন আহসান উল্লায়। দু-জন একই হোস্টেলের রুমমেট হিসেবে দু-বছর কাটানোয় সম্পর্কটা ছিল। বন্ধুসুলভ। দু-জনেই সস্তা ধরনের রসিকতা উৎসাহের সঙ্গে নিঃসংকোচেই বলাবলি করতাম। অবশ্য মাঝে মাঝে তিনি যে মামা এটি তার মনে পড়ে যেত। অভিভাবকসুলভ গাম্ভীর্যে খোঁজ-খবর নিতেন আমাদের। ছাত্র গ্রেফতারের কথা শুনেই মনে হলো তিনজনের একজন মামা রুহুল আমিন (মামা এবং সহপাঠী) নয়তো! তিনটার দিকে খোঁজ নিতে বেরুলাম। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে ভাবছি সত্যি যদি তাই হয় তবে উত্তেজনার একটা খোরাক পাওয়া যায়। ফলাও করে গল্প করতে পারি। মামার গ্রেফতার হওয়ার আশঙ্কাও উড়িয়ে দিতে পারছিলাম না। তার স্বভাব অনেকটা সেই জাতীয় বৈষ্ণবদের মতো যারা মুরগি খায় এবং নিজেদের এই বলে প্রবোধ দেয় যে গঙ্গাজলে বেঁধেছি কাজেই কোনো দোষ নেই। তিনি কোনো রাজনৈতিক মতবাদে জড়িত নন। অথচ একটি রাজনৈতিক সংস্থা থেকে ইলেকশন করে হলো সংসদের মেম্বার। মিছিল-টিছিল সমর্থন করেন না অথচ সব মিছিলের মাঝামাঝি থাকেন যাতে সামনে এবং পিছনে যে-কোনো দিক থেকেই বিপদ আসলে পগার পার হতে পারেন। অথচ দেখা গিয়েছে এই জাতীয় লোকগুলোই সবার আগে বিপদে পড়ে। সযতনে সমস্ত ঝামেলা এড়িয়ে তীরে এসে তরী ডোবায়।
গিয়ে দেখি মামা উপুড় হয়ে শুয়ে ঘরোয়া পড়ছেন। আশাভঙ্গ হলো। উঠে বসে আমার দিকে চেয়ে বলল ‘চল চা খেতে খেতে আলাপ হবে।’ চায়ে চুমুক দিতে দিতে মামা বললেন, কাল আমার ওপর দিয়ে বড় বিপদ গেছে। মিলিটারির তাড়া খেয়ে কম করে হলেও দেড় মাইল দৌড়েছি। রাস্তায় ইটের বাড়ি লেগে দেখ নখের অবস্থা।
হলে ফিরে এসে শুনি শহরে হঠাৎ করে curfew দেয়া হয়েছে। ঘণ্টাখানেক পরই নিউ মাকের্ট আর আজিমপুরের দিক থেকে গুলির শব্দ শোনা যেতে লাগল। অথচ ইকবাল এখনো ফেরেনি। হলের গেট বন্ধ করে দেওয়া হলো। ছেলেরা উত্তেজিত হয়ে হলের ভিতরই ঘোরাফেরা করতে লাগল। সন্ধ্যা হলো, রাস্তাঘাট যা নজরে পড়ে তা জনমানবহীন। হলের মেইন সুইচ অফ করে দেয়া হলো। আলোতে হলের লবিতে দাঁড়ানো ছেলেদের দূর থেকে দেখতে পেয়ে যদি গুলি ছুঁড়ে এই ভয়ে। আমি ইকবালের জন্যে উদ্বিগ্ন বোধ করছিলাম। একবার ভাবি তার বন্ধু খাজার কাছেই আছে হয়ত। আরেকবার ভাবি হয়ত মামার কাছে গিয়ে আটকা পড়েছে। রেডিওর খবর শুনতে গেলাম নিচে। গুলির শব্দ এবার খুব কাছেই শোনা গেল। দমকলের গাড়িগুলো ঢং ঢং করে ঘণ্টা পিটতে পিটতে যাচ্ছে। Ambulance এর গাড়িগুলো যাচ্ছে তারস্বরে সাইরেন বাজাতে বাজাতে। একটি ছেলে হঠাৎ বলে উঠল কার্ফিউ দিয়ে মেয়েদের হলে যদি মিলিটারি ঢুকে পড়ে তবে কিন্তু করার কিছু নেই। শেফুর কথা মনে হতেই ধুকটা ধ্বক করে উঠল। সত্যি তো গত আন্দোলনে এমনি দু-একটা ঘটনা ঘটেছিল। কার্ফিউ আওয়ারে মিলিটারি অনেক ভদ্র বাড়িতে জোর করে ঢুকে পড়েছিল। উৎকণ্ঠায় পাথর হয়ে নিজের ঘরে এসে দেখি ইকবাল দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। আছে। চাবি সঙ্গে না থাকায় ভিতরে ঢুকতে পারছে না।
‘কার্ফিউর ভিতর আসলি কী করে?’ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করি।
‘আমি কার্ফিউর আগেই এসেছি। নিচে মামুনের (মো. মামুন, পরবর্তীকালে অর্থনীতির অধ্যাপক) সঙ্গে গল্প করছিলাম।’
দুঃশ্চিন্তা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে অডহাউসের Pig have wing পড়তে লাগলাম মোমবাতি জ্বালিয়ে। পাশের রুমে বাজি রেখে কনটাক্ট ব্রিজ খেলা হচ্ছিল তার হইচই আর নিচ থেকে উত্তেজিত রাজনৈতিক আলোচনার আওয়াজেও আমার পাঠে বিঘ্ন হলো না।
রাত বারোটার দিকে নিচে প্রবল উত্তেজনার আভাস পেলাম। হইচই ভীত সন্ত্রস্ত্র দৌড়াদৌড়ি, ডাক্তার ডাক্তার চিঙ্কার। আমি ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসি। বারেন্দায় নানাজি নজরুল ইসলামের (দূর সম্পর্কের নানা, একজন মুক্তিযোদ্ধা) সঙ্গে দেখা।
‘আরে তুমি, নিচে যাও দেখ গিয়ে কাণ্ড’ দৌড়ে নিচে গিয়েতো আমি হতভম্ব। দু-জন লোককে মেঝেতে শুইয়ে রাখা হয়েছে, রক্তে মেঝে ভেসে যাচ্ছে। অ্যামবুলেন্সের জন্য ছেলেরা পাগলের মতো টেলিফোন করছে। খবরে জানতে পারলাম এরা একজন চিটাগাং রেস্টুরেন্টের বয় অন্যজন রিকশাওয়ালা। কার্ফিউ ব্রেক করতে গিয়ে একজন বুকে অন্যজন পায়ে গুলি খেয়েছে। যারা তাদের বয়ে এনেছে তারা ইউনিভার্সিটিরই ছাত্র। অ্যামবুলেন্স এলো অনেক পর, লোক দু-টিকে নিয়ে চলে গেল সাইরেন বাজাতে বাজাতে।
কার্ফিউ ভাঙল ভোর ৯টায়। দৌড়ে গেলাম রোকেয়া হলে। সেখানে গেটের কাছে খুব ভীড়। সবাই এসেছে আত্মীয় স্বজনের খোঁজে। হল থেকে পরিচিতদের সরিয়ে নিতে। মেয়েরা বিবর্ণ মুখে হল ছেড়ে চলে যাচ্ছে। দেখলাম শেফুর অবিচল সাহসেও চিড় ধরেছে। সে নিজ থেকেই বলল, চল বাসায় চলে যাই। ঠিক হলো পরদিন বিকেলে ঢাকা ছাড়ব। তার সঙ্গে আরো কয়েকজন মেয়ে যাবে। তাদের সঙ্গে কোনো অভিভাবক নেই। তারা চাঁদপুর নেমে যাবে।
সমস্ত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় বাসা থেকে টাকা নিয়ে কেউ আসে নি। নিজেদের সঞ্চিত পুঁজিও শেষ। আমি জিনিসপত্র গোছগাছ করছি বেয়ারা এসে খবর দিলো নিচে আপনার একজন গেস্ট এসেছে, মেয়ে গেস্ট। শেফু ছাড়া কে আর হবে। নিচে নেমে দেখি আমার ক্লাসমেট ‘ছাগী’ (প্রকৃত পরিচয় জানা যায়নি)। তার ‘ছাগী’ নামটির একটু ইতিহাস আছে। ছাগল যেমন যা পায় তাই চিবিয়ে দেখে। শুকনো চটিজুতা থেকে অঙ্ক বই সবই তার কাছে সমান প্রিয়। এই মেয়েটির স্বভাব তেমনি। সে যে কোনো ছুঁতোয় যে কোনো ছেলের সঙ্গে আলাপ করবেই। মেয়েদের সঙ্গে তার কোনো খাতির নেই তার যত উৎসাহ ছেলেদের নিয়ে। আমাদের ক্লাসের নিতান্ত ভ্যাবাগঙ্গারাম ছেলে সফিক যেদিন নতুন টেট্রনের শার্ট পরে এসেছিল সেদিন মেয়েটি তার শার্টে হাত দিয়ে কাপড় পরীক্ষা করতে করতে জিজ্ঞেস করেছিল কি টেট্রন পাকিস্তানি না জাপানি? আমরা ছেলেরা সবাই তাকে এড়িয়ে চলতে চেষ্টা করতাম। বিশেষ করে আমি, কারণ জনপ্রিয় ছাগী নামটি আমারই দেয়া এবং ভদ্রমহিলাও এটি ভালো করে জানেন।
‘শুনলাম আপনি পরীক্ষা না দিয়েই চলে যাচ্ছেন?’
মুখে হাসি টেনে আমি বললাম, ‘হ্যাঁ কোত্থেকে শুনলেন?’
‘আপনার বোনের কাছ থেকে। আচ্ছা আপনিও বরিশালে যাবেন?’
‘হ্যাঁ পিরোজপুরে।’
‘আমি কুষ্টিয়া যাব। এদিকে রেল আবার বন্ধ। অবশ্য যশোহর থেকে বাসে যাওয়া যায় খুলনা থেকে যশোহর পর্যন্ত বাসসার্ভিস আছে। আচ্ছা পিরোজপুর থেকে খুলনা কতদূর?’
‘বেশি দূর না, কাছেই।’
আচ্ছা আমি যদি আপনাদের সঙ্গে যাই আপনাদের অসুবিধা হবে? খুলনা পর্যন্ত যেতে পারলেই হবে, খুলনায় আমার এক খালু থাকেন।
আমি আমতা আমতা করি—
‘আমি সেইদিনই চলে যাব। শুধু একজন লোক দেবেন খুলনা পর্যন্ত।’
‘বেশত আসেন আসেন?’
‘আর মনে করেন রাস্তায় কোনো অসুবিধা হলো যাতে আমার পিরোজপুরে দুই একদিন থাকা লাগে।’
‘না অসুবিধা হবে না কিছু?’
অপরিচিত মেয়ে দেখে আম্মা হয়ত বা সন্দেহজনক দৃষ্টিতে তাকাতে পারেন কিন্তু আদর যত্ন কম হবে না বরংচ একটু বেশিই হবে। তবে বাসা ছোটো এই একমাত্র অসুবিধা আমাদের নিজেদেরই কুলোয় না। ঠিক হলো সে পরদিন ভোরে আমাদের সঙ্গেই যাবে। শেফুর রুম নাম্বার জানত না সেটি জানিয়ে দিলাম।
বাসায় রওনা হবার আগে পরীক্ষার্থী ৪/৫ জন মিলে গেলাম Head of the department (রসায়ন বিভাগীয় অধ্যাপক মোকাররম হোসেন) এর সঙ্গে দেখা করতে। স্যার বেরিয়ে এলেন। কাঁদ-কাঁদ মুখ উদ্ভ্রান্ত চেহারা। বসতে বললেন। সংকুচিত ভাবেই বসলাম। স্যার করুণ কণ্ঠে বললেন— ‘শুনেছ বোধ হয় তোমাদের Department থেকে বহু দামি chemicals কাল রাতে একদল ছেলে ডাকাতি করে নিয়ে গিয়েছে।’ ঘটনাটা জানতাম না কাজেই বিস্মিত হলাম।
‘chemicals নিয়ে ওরা কী করবে স্যার?’
যা যা নিয়েছে তা দেখে মনে হয় হাই এক্সপ্লোসিভ বোমা তৈরি করবে। তবে সঙ্গে আরো সব দামি দামি chemicals নিয়েছে যার কোনো দরকারই হবে না। আমার এত কষ্টে জোগাড় করা chemicals—স্যারের মুখ করুণ হয়ে উঠল। অস্পষ্ট ভাবে বললেন, কিছু একটা হবে। আমার মেয়ে একটা পশ্চিম পাকিস্তানে হ্যাসবেন্ডের কাছে আছে। সব সময় ভয়ে ভয়ে আছি।
আমরা পরীক্ষার কথাতে আসতেই বললেন—নিরাপদ জায়গায় যেতে চাচ্ছ, যাও। সব ঠিক না হলে পরীক্ষা হবে না। পরীক্ষার জন্যে ভেব না। কথা শুনে মনে হলো তিনি ঝুলছেন বড়ো কোনো ভাবনা ভাবো। আমরা বেরিয়ে আসলাম। স্যার হাঁটতে হাঁটতে গেট পর্যন্ত আসলেন। কী ভাবছিলেন তিনি, কে বলবে।
চারিদিকে তখন আলোচনার বিষয়বস্তু একটি–শেখ সাহেব ৭ তারিখে রেসকোর্সে ভাষণ দেবেন। না-জানি কী দেন না-জানি কী বলেন। উৎকণ্ঠায় শহর ঝিমিয়ে। খবরের কাগজগুলি আগুনের মতো তেতে আছে। এদিকে সামরিক আইন প্রশাসক হয়ে এলেন। Lt. gen. টিক্কা। ঈদগার মাঠে বোমাবর্ষণ করে যিনি ইতিমধ্যেই বিভীষিকার নায়ক হয়ে রয়েছেন। ছাত্ররা যেন উত্তেজনায় পাগল হয়ে যাবে। এদিকে বাঙালি বিহারি একটা ঝামেলা প্রায় পেকে উঠছে। শেখ সাহেব ধমক দিলেন–
‘ভাষা যাই হোক, বাংলাদেশে যে-ই বাস
করবে সেই বাঙালি। তাদের জান-মাল
আমাদের কাছে এক পবিত্র আমানত।’
ঝামেলাটা থেমে গেল বটে কিন্তু বিহারিরা ফুঁসতে লাগল।
ঢাকা থেকে বেরিয়ে পড়ার জন্যে আমি অস্থির হয়ে উঠছি। বাসা থেকে কোনো খবর নেই। শেফু মেয়ে, নতুন ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে— এদিকে ঢাকায় গণ্ডগোল। শুধু আমরা তিনজনই নই, মেজে বোন শিখু (মেজো বোন মমতাজ শহীদ) কুমিল্লায়। ফরিদা বিদ্যায়তনের হেডমিসট্রেস-এর বাসায় থেকে পড়াশুনা করছে। এসএসসি পরীক্ষার প্রস্তুতি। তার জন্যেও চিন্তা। শিখুর সঙ্গে কথা বলার জন্যে গেয়ে Telephone exchange এ। সে যেখানে আছে সেখানে Telephone নেই তবে কাছেই তার বান্ধবীর বাসা। সৌভাগ্যক্রমে প্রদির টেলিফোন নাম্বার জানা ছিল। গিয়ে দেখি ভো ভো Telephone exchange খালি। সমস্তই বন্ধ। অথচ essential service হিসেবে এটা খোলা থাকার কথা।
বেলা দুটোর দিকে হলের সামনে আমি আর ইকবাল রিকশা নিয়ে দাঁড়ালাম। ইকবাল গেল শেফুর খোঁজে। গিয়েছে তো গিয়েছেই, শেফুর দেখা নেই। পাঁচ মিনিট দশ মিনিট করে আধঘণ্টা পার হলো। অথচ লঞ্চ ছাড়বে গোটা চারেকের দিকে। যখন ধৈর্য্যের বাঁধ প্রায় ভেঙে পড়ছে তখন দেখা গেল শেফু হাসতে হাসতে আসছে, গেট পর্যন্ত এসেই বিদায়, কোনো কথা না বলেই। রাগে যখন মাথার চুল ছিড়তে ইচ্ছে হচ্ছে। তখন সে নেমে এলো সঙ্গে তিনটি মেয়ে। তারা তিনজনই চাঁদপুর যাবে। বাসা লঞ্চঘাট থেকে আধমাইল, তারা তিনজন যাবে কাজেই ভয়ের কিছু নেই। আল্লাহর দয়া, ছাগীর দেখা নেই। জিজ্ঞেস করলাম ‘কিরে শেফু আমাদের ক্লাসের কারো সঙ্গে দেখা হয়েছিল?’
‘হুঁ।’
‘কিছু বলেছিল?’
না।
টার্মিনেলে পৌঁছে দেখি লঞ্চ এই ছাড়েতো এই ছাড়ে। তাড়াহুড়া করে উঠলাম। তিল ধারণের জায়গা নেই। ছেলেরা তবু না হয় কোনোমতে গেল কিন্তু মেয়েরা? সবাই পালাচ্ছে ঢাকা থেকে। শেফু কাঁদো কাঁদো হয়ে হঠাৎ বলল, ‘আর দুটি মেয়ে কই?’ সত্যিতো ইতিউতি করে খুঁজি চারিদিক। ধু-ধু করছে কাউকেই দেখা যাচ্ছে না। ‘আমি, আমি একা কি করে বাসায় যাব’ সঙ্গী মেয়েটি কেঁদে ফেলে আর কি। সত্যিতো রাত এগারোটায় পৌঁছবে চাঁদপুর, এই মেয়ে একা একা কী করবে। সিটি বাজিয়ে লঞ্চ ছেড়ে দিলো। শেফু অভয় দিলো ‘আপা আমাদের বাসায় চলেন। সেখান থেকে লোক দিয়ে আপনাকে পাঠাব।’
কেবিনের পাশে হাঁটার রাস্তায় একটা চাদর বিছিয়ে ফেলা গেল। আমরা দুভাই কোনো মতে এঁটে বসলাম সেখানে। মেয়েদের বসার সমাধানও হয়ে গেল ভালোভাবেই। কেবিনে-বসা ভদ্রলোকেরা উৎসাহিত হয়েই মেয়েদের তাদের কেবিনে ডাকল। এরাতো আর গ্রামের জবুথবু লাজুক মেয়ে নয় যে, ছেলেদের কেবিনে ডেকেছে বলে লজ্জায় পড়ে যাবে। ইউনিভার্সিটির ঝকঝকে মেয়ে হাসতে হাসতেই কেবিনে ঢুকে পড়ল। সেখানে আরো দু-জন এই উপায়েই কেবিনে আশ্রয় নিয়েছিল। কাজে কাজেই গল্প, তর্ক, হাসাহাসি শুরু হলো। ঘন ঘন চা আর বিসকুট আসতে লাগল। বলাবাহুল্য ভদ্রলোকরা উদার হস্তে খরচ করতে লাগলেন এবং মেয়েদের অতি সামান্য রসিকতায় হেসে গড়াগড়ি খেতে লাগলেন।
আমি বাইরে বসে এদের গল্প শুনছি। আলাপের ধারা গড়াতে গড়াতে শাড়ি-গয়না সেখান থেকে সোনার দাম, সোনার দাম থেকে দেশের অবস্থা, দেশের অবস্থা থেকে বর্তমান পরিস্থিতিতে নিজ নিজ অভিজ্ঞতা। এই অভিজ্ঞতার একটি গল্প চমৎকার লাগল। গল্পটির কথক ঠিক বিশ্বাসযোগ্য নয় সে ইউনিভার্সিটির সেই ধরনের মেয়ে University-তে পড়াটা যাদের কাছে। একটা দামি-গয়না। গয়না যেমন রূপ লাবণ্য বৃদ্ধি করে বলে ধারণা, Universityর ছাত্রী এই ছাপটা তেমনি মেয়েদের মধ্যে একটা আলাদা সৌন্দর্য এনে দেয় বলে এদের ধারণা। যাদের আসল গায়ের রং বাদামি প্রলেপের আড়ালে নিজেদের কাছে পর্যন্ত আচ্ছন্ন। ছেলেদের সঙ্গে মিছিলে যোগ দিতে যারা ভীষণ উৎসাহী; উৎসাহটা অবশ্য নিজেকে বিজ্ঞাপিত করার জন্যে যে, দেখো আমরা কেমন প্রগতিবাদী, কেমন অনায়াসে ছেলেদের সঙ্গে মিশছি। গল্পটি এই রূপ:
যারা মিলিটারির গত কিছু দিনের ইতস্তত গুলি বর্ষণে আহত হয়েছে তাদের প্রত্যেকের ব্যক্তিগত অভিমত নেবার জন্যে রোকেয়া হলের কয়েকজন মেয়ে মিলে হাসপাতালে গেল। সেখানে অনেক বুলেটবিদ্ধই পড়ে আছে। মেয়েরা প্রত্যেকের কাছেই যাচ্ছে, সান্ত্বনা দিচ্ছে এবং বলছে তাদের খাতায় কিছু একটা লিখে দিতে। কেউ দিচ্ছে কেউ-বা জানাচ্ছে, আমি লিখতে জানি না। যাই হোক সহযাত্রী মেয়েটি তার খাতা নিয়ে একটি ছেলের কাছে দাঁড়াল। দেখেই মনে হচ্ছে ছেলেটি শিক্ষিত হয়ত কোনো কলেজের বা স্কুলের উঁচু ক্লাসের ছাত্র। গলা পর্যন্ত সাদা চাদরে ঢাকা।
‘দিন না আমার খাতায় কিছু লিখে। কেন আপনি মিছিলে এসেছিলেন, কি করে গুলি লাগল এই সব।’ ছেলেটি কোনো কথা বলে না। শুধু তাকিয়ে থাকে। আবার অনুরোধ করে, দিন না একটা কিছু লিখে ছেলেটি তবুও নীরব। এমন সময় নার্স আসে বৈকালিক আহার নিয়ে। টান দিয়ে চাদরটি সরাতেই দেখা। যায় ছেলেটির ডান হাত কজি পর্যন্ত কেটে বাদ দেয়া হয়েছে সেখানে। নিপুণ ব্যান্ডেজ। দুঃখ ও লজ্জায় মেয়েটি পালিয়ে আসে।
গল্পে গল্পে রাত হয়ে গেল। দূরে চাঁদপুরের আলো দেখা যাচ্ছে। চাঁদপুর যাত্রী মেয়েটির সঙ্গে সঙ্গে আমরাও উদ্বিগ্ন হলাম। সমস্যাটি মিটল হঠাৎ করেই। লঞ্চেই ইকবালের বন্ধু কবি বলাকা মুখার্জির সঙ্গে দেখা। সে যাচ্ছে কুমিল্লা ভায়া চাঁদপুর। কিন্তু যখন তাকে মেয়েটির সামনে হাজির করা হলো এবং বলা হলো কোনো ভয় নেই সে আপনাকে চাঁদপুরে বাসায় রেখে তারপর যাবে। মেয়েটির মুখ কিন্তু আনন্দে উদ্ভাসিত হওয়ার বদলে আরো যেন আমশি মেরে গেল। বারবার জিজ্ঞেস করতে লাগল, ছেলেটির বাড়ি কোথায়, কোথায় যাবে, কী পড়ে। ভালো করে তার চেহারার দিকে তাকিয়ে মেয়েটির উদ্বেগের সঙ্গে ব্যাখ্যা খুঁজে পেলাম। তার চেহারায় কবি সুলভ নির্লিপ্ততার বদলে নাট্যকার সুলভ ক্ষিপ্ততার ছাপটাই প্রবল। ছোটো চোখ, পাতলা ঠোঁট, কিঞ্চিৎ ঝুলন্ত নাক–সব মিলিয়ে এমন একটি ধারণা হয় যে, এইমাত্র কিছু একটা অন্যায় করে পুলিশের ভয়ে আত্মগোপন করে। আছে। যাই হোক বলাকা মেয়েটিকে নিয়ে নেমে গেল। আমরা হুলারহাটে পৌঁছলাম ভোর পাঁচটায়। সেখানে শুনি শেখ মুজিবের আহ্বানে যানবাহনে হরতাল চলছে।
খুশি মনেই হাঁটতে হাঁটতে বাসায় পৌঁছলাম। সদর দরজা খোলা। ঢুকে দেখি দুটি পালঙ্ক একত্রে করে মস্ত বিছানা তৈরি করে সবাই শুয়ে। আব্বা সাধারণত দেরিতে ওঠেন। সেদিন যেন আমাদের জন্যেই ঘুম ভেঙেছে সকালে। সবাইকে দেখে ছেলে মানুষের মতো। খুশি হয়ে উঠলেন
আরে দেখো কে এসেছে, এই ওঠো না। আম্মা উঠলেন। আব্বা সিগারেট ধরিয়ে খুশি সরে ঢাকার কথা জিজ্ঞেস করতে লাগলেন। একটু পরে পরেই বলতে লাগলেন ‘যাক সবাই এসে গেছে, হাজার শুকুর। আর ভয় নাই। আর ভয় নাই।’ আব্বা তার চিরাচরিত স্বভাব অনুযায়ী চড়া ভল্যুমে রেডিও ছেড়ে দিলেন। শেফু যখন আব্বা। আম্মাকে পা ছুঁয়ে সালাম করল তখন আনন্দে আব্বার চোখে পানি এসে গিয়েছে।
(প্রথম পর্ব সমাপ্ত)