‘যোগ’ ব্যাপারটা নিয়ে আমি ধন্ধে ছিলাম দীর্ঘকাল। যোগ কি আসলে যন্ত্রপাতি ছাড়া আসনের সাহায্যে কিছু ব্যায়াম পদ্ধতি? শরীরকে সুস্থ রাখার কিছু আসন ও মুদ্রার পদ্ধতি মাত্র? নাকি এর বাড়তি কিছু? যোগী হলে কি জলের উপর দিয়ে সত্যিই হেঁটে যাওয়া যায়? কয়েক’শো বছর নীরোগ অবস্থায় বেঁচে থাকা যায়? যৌবনকে ধরে রাখা যায় আমরণ?

“হ্যাঁ, যায়।” কথাটা জোরের সঙ্গে আমাকে বলেছিলেন ‘সিদ্ধ-যোগী’ বালক ব্রহ্মচারী। আরও বলেছিলেন, “তোরা যে’সব ঘটনাকে অলৌকিক বলে মনে করিস, সে’সবই করতে পারেন একজন সিদ্ধ-যোগী। জলে হাঁটা কীরে স্বর্গ-মর্ত-পাতাল ত্রিভুবন ঘুরে আসতে পারেন তাঁরা।”

“এখনকার যোগ-ব্যায়াম আর ঋষিদের নির্দেশিত ‘যোগ’ কি একই ব্যাপার?” জিজ্ঞেস করেছিলাম যোগ-ব্যায়ামের জাতীয় বিচারক ডাঃ শান্তিরঞ্জন চট্টোপাধ্যায়কে। ডাঃ চট্টোপাধ্যায় সোজা-সাপটা জানালেন, “এ’যুগের যোগ আর ঋষিদের আমলের যোগ একই ব্যাপার। যোগ হল সেই প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে জীবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার যোগ সাধন করা যায়। এখন সবারই সময়ের অভাব। তাই শরীরকে সুস্থ রাখার মত কয়েকটা সোজা যোগ আমরা শেখাই। আমার ‘যোগ-বিজ্ঞান ও রোগ মুক্তি বইতে লিখেছি, পতঞ্জলির আমলের যোগ হল এ’যুগের যোগেরই একটা বিস্তৃত রূপ। যোগ মৃত্যু ও জরাকে জয় করতে পারে। এই যে আমার কোনও অসুখ হয় না, তার কারণ যোগ।”

ডাঃ শান্তিরঞ্জন একবার খুবই অসুস্থ হলেন। ডাক্তার-হাসপাতাল করলেন । শান্তির কথাগুলো আমার কাছে জোলো হয়ে গেল। কথার কথা’ হয়ে গেল । কমল ভাণ্ডারী এক সময়ের ভারতের সেরা ‘বডি বিল্ডার’ ছিলেন। যোগে আকৃষ্ট হলেন। ‘যোগ ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়া’র সম্পাদক হলেন। তাঁর কথায়, “সব শাস্ত্রের সার যোগ শাস্ত্র।”

যোগ নিয়ে কথা বলেছিলাম চিত্ত গড়াই-এর সঙ্গে। তিনি তখন যোগ ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ার নির্বাচিত জাতীয় বিচারক। কথা বলেছি যোগ সাধক ও বঙ্গীয় ব্যায়াম সমিতির সহ-সভাপতি ডাঃ সৌমেন্দ্রনাথ দাসের সঙ্গে। দেখলাম যোগের কয়েকটা বিষয়ে ডাঃ চট্টোপাধ্যায়, কমল ভাণ্ডারী, চিত্ত গড়াই ও ডাঃ দাস একমত। ওঁরা মনে করেন (১) ভারতীয় মুনি-ঋষিরাই যোগের আসন, মুদ্রা ও প্রাণায়মের প্রবর্তক। (২) মহাদেব, পশুপতিনাথ বা শিব-ই যোগের আদি দেবতা ও স্রষ্টা। (৩) প্রাচীন মুনি-ঋষিরা মানুষের শরীর বিজ্ঞানের খুঁটি-নাটি সব কিছু জানতেন। বিভিন্ন স্নায়ুতন্ত্র, শিরা-উপশিরার কার্যকারিতা জানতেন। (৪) যোগশাস্ত্র ও তন্ত্রশাস্ত্র দুই-ই বুঝেছিল, মস্তিষ্ক থেকে সুষুম্মার মধ্যে (মেরুদণ্ডের মধ্যে) অবস্থিত স্নায়ুতন্ত্রের সব কেন্দ্র ও মর্মস্থানে একটি শক্তিনাড়ী বা ব্রহ্মনাড়ীর আশ্রয়ে আত্মা থাকে। (৫) মানুষের দেহের ভিতর ছটি চক্র থাকে, যাকে বলে ‘ষটচক্র’। এই ছটি চক্র ভেদ করে চিত্তকে মস্তিষ্কে নিয়ে যেতে পারলে মহাশক্তি অর্জন করা যায়, যোগ সিদ্ধ হওয়া যায়।

এইসব শুনে বেশ শঙ্কিত হয়েছিলাম। এই চার বিশিষ্ট যোগবিদদের দু’জন ডাক্তার। তারপরও তাঁরা বুঝতে চাইছেন না—যোগ দর্শনটাই দাঁড়িয়ে আছে ভুল ‘অ্যানাটমি’ জ্ঞানের ওপর ভিত্তি করে। ডাক্তারী বিদ্যার ‘অ্যানাটমি’ জ্ঞান যোগীদের ভুলের পায়ে বিসর্জন দিলেন? এই ভুল শারীর বিদ্যে দিয়ে রোগ সারাবার চেষ্টা করলে তার পরিণতি কী হবে ভেবে শঙ্কিত হয়েছিলাম।

‘অবমানব’ পত্রিকার সম্পাদক সোমনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। হিজড়েদের নানা অধিকার নিয়ে কথা-টথা বলেন। একটি কলেজে অধ্যাপনা করেন। একদিন আমাদের যুক্তিবাদী সমিতির বেলেঘাটার অফিসে এলেন এক ‘অবমানব’কে নিয়ে। কথায় কথায় জানালেন, হিজড়েদের শতকরা প্রায় ১০০ ভাগ-ই পুরুষ। কিন্তু কেউ পরীক্ষা করতে গেলে ধরতে পারবে না। আমরা একটা গুহ্য যোগাসনের সাহায্যে লিঙ্গকে শরীরের ভিতর ঢুকিয়ে নিতে পারি ।

হটযোগে এমন একটা আসনের কথা পড়েছি, কিন্তু বিশ্বাস করিনি। হটযোগের ক্ষমতার পরীক্ষা নেওয়ার সুযোগ পেয়ে বললাম, “করে দেখাও।” দেখাতে পারেননি সোমনাথ।

আসলে যোগের নানা ফল লাভের যে সব কথা প্রাচীন মুনি-ঋষি অৰ্থাৎ জাদু- পুরোহিতরা বলে গিয়েছিলেন, তা ঠিক নয়। কিছু কিছু আসন শরীরকে সুস্থ রাখার পক্ষে যথেষ্ট কার্যকর হতেই পারে। কিন্তু আসন করে অদৃশ্য হওয়া যায়, জরা ও মৃত্যুকে ঠেকিয়ে রাখা যায়, এমন আজগুবিতে বিশ্বাস করার মত কিছু বাল্যখিলা মানুষ এখনও আছেন, দুঃখ ও শঙ্কার কথা এটাই।

আমাকে পাকিয়েছিলেন স্কুলের ভৌমিক স্যার। ফর্সা গোলগাল রসগোল্লা-মার্কা চেহারা। একেবারে রসে টইটম্বুর। তিনিই শুনিয়েছিলেন রামী চণ্ডীদাসের গল্প। বুঝিয়েছিলেন, চণ্ডীদাস ও রামী রজকিনীর মধ্যে কোনও প্রেমের সম্পর্ক ছিল না। ছিল বিশুদ্ধ কামের সম্পর্ক। চণ্ডীদাস শৈব মতে রামীকে বিয়ে করেছিলেন।

অনেক যোগী-তান্ত্রিক রমণের জন্য রমণী রাখতেন। তাকেই শোভন

আকার দিতে বলা হত ‘শৈব-বিবাহ’। একসময় অনেক বাঙালি

জমিদার ও বাবুরা যোগ ও তন্ত্র নিয়ে মেতেছিলেন।

তাঁদের সাধনার ভৈরবী ছিল

নিচুজাতের মেয়েরা।

এইসব সাধন-সঙ্গিনীদের যোগাড় করে দিত এক শ্রেণীর দূত বা দূতি। যোগ ও তন্ত্র মতে এমন পবিত্র কাজে সাহায্য করার জন্য পুণ্য লাভের কথা বলা হয়েছে। এইসব সাধন সঙ্গিনী নারীদের যোগাড় করা হত সাধারণভাবে ধোপা, গোয়ালা, নাপিত, চণ্ডাল, বেশ্যা—এইসব সম্প্রদায় থেকে।

সাংখ্য যোগ থেকে তন্ত্র, যেখানেই গভীরে ঢুকবেন, দেখবেন ওদের মূল কথা এক-ই—মানুষের দেহ-ই বিশ্বপ্রকৃতির সব রহস্যের আধার। সৃষ্টির মূলে রয়েছে পুরুষ ও প্রকৃতির মিলন। প্রকৃতিই হল নারী-শক্তি। নারী-পুরুষের মিলন-ই সাধনা ৷ মিলনের চরম আনন্দ-ই পরম-ব্রহ্ম। মিলনেই সৃষ্টি। যোগ ও তন্ত্রে কামজ আরাধনা ছাড়া সিদ্ধির কোনও উপায় নেই। দেহের আত্মাই ঈশ্বর। নিজের আত্মাকে সুখী করাই ঈশ্বরকে সুখী করা। মিলনে যে সুখ, তার তুল্য সুখ আর কিছুতে নেই।

যোগ আর তন্ত্র হল ‘গুহ্য তত্ত্ব’। মানে, গোপন তত্ত্ব। এ’সব নিয়ে আলোচনা গোপনে করতে হয়। এর সাধনাও গোপনে করতে হয়। এ’নির্দেশ যোগ ও তন্ত্রের।

আমার কলেজে-সহপাঠী ছিল বিমল। পদবি—মনে নেই। একদিন আমাকে ও আর এক সহপাঠী তপনকে শোনালো পরিবারের এক গভীর সমস্যার কথা । পরিবার বলতে— বিমল, মা-বাবা আর এক বোন। বোন ক্লাশ টেনের ছাত্রী। বাবা তান্ত্রিক। সমস্যাটা বাবা আর বোনকে নিয়ে। বাবা ভৈরবতন্ত্র মতে বোনকে ভৈরবী করে সাধনা করেন।

তপন অবাক? বাবা-মেয়েতে তন্ত্র-সাধনা করে, এতে সমস্যা কোথায় ?

ভৌমিক স্যারের কল্যাণে আমি আগেই পেকেছি। তাই ব্যাপারটা বুঝতে পেরে গা গুলিয়ে উঠলো। ইতিমধ্যে তপনও সমস্যার কদর্যতা ও গভীরতা বুঝতে পেরেছে। শুনলাম, বিমল আর ওর মা বাধা দেওয়ার সমস্ত রকম চেষ্টা করে ব্যর্থ। শেষ ভরসা হিসেবে লজ্জার মাথা খেয়ে পড়শিদের সাহায্য চেয়েছেন। তারপরও পড়শিরা কেউ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেননি। কেচ্ছা শুনতে ওঁদের যতটা উৎসাহ দেখা গেছে, সাহায্য চাইতেই ততটাই কুঁচকে গেছেন। বিমলের কথায়—আসলে বাবার তন্ত্রক্ষমতার ভয়ে ওঁরা কেউ বাবার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে সাহস করেন না। ওঁরা বাবাকে ঘৃণা করেন, আবার ভয়ও করেন।

তন্ত্রের নামে অজাচার চলছে প্রায় প্রকাশ্যে।

কিছু বছর আগেও তান্ত্রিকদের সম্বন্ধে সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা বিশেষ ধারণা কাজ করতো। তান্ত্রিক মানে শ্মশানে-মশানে ঘুরে বেড়ায়। মড়ার উপর বসে সাধনা করে। মদ-মড়ার আধ পোড়া মাংস ইত্যাদি অখাদ্য-কুখাদ্য খায়। ভৈরবী রাখে। কী সব গোপন সাধনা করে। মারণ উচ্চাটন-হঠযোগ ইত্যাদি করে। পিশাচ-সিদ্ধ এ’সব লোকদের দৃষ্টি থেকে যত দূরে থাকা যায়, ততই মঙ্গল। এখন তান্ত্রিকদের সম্বন্ধে ধারণাটা পাল্টে দিয়েছে কলকাতার কিছু দৈনিক পত্রিকা। যে পত্রিকা যত বড়, তান্ত্রিকদের বিজ্ঞাপনের মিছিলও সে পত্রিকায় তত বড়। এঁদের কত না উপাধির বহর? যেমন—তন্ত্রভৈরব, তন্ত্র-অ্যাস্ট্রোপামিস্ট, তান্ত্রিকাচার্য, তন্ত্রসম্রাট, তন্ত্রবিদ, তন্ত্রবিশারদ, তন্ত্রজ্ঞানী, তন্ত্ররত্ন, তন্ত্রসিদ্ধ তান্ত্রিক, পিশাচসিদ্ধ তান্ত্রিক, হঠযোগী তান্ত্রিক ইত্যাদি। এঁদের ছবি সহ বিজ্ঞাপন থাকে। ছবি দেখলে আদৌ ভয় করে না। সাজু- গুজু চেহারা। অনেকেই যেন যাত্রার আসর থেকে উঠে আসা চরিত্র। একটু বেশি রকম নাটুকে। মহিলা তান্ত্রিকের সংখ্যা কম নয়। এইসব পুরুষ নারী তান্ত্রিকদের অনেকেই এসেছেন বিভিন্ন জগৎ থেকে। কেউ ছিলেন যাত্রা দলের ফালতু, কেউ সিনেমার এক্সট্রা, কেউবা এক সময়ের গেঞ্জির মডেল, আবার কেউবা নাকি ছিলেন কলগার্ল, এখন বিগতা যৌবনা। কেউ ঢপের ‘ডাক্তার’, কেউ স্কুলের গণ্ডি পেরুতে না পারা ‘ডক্টরেট’। উপাধিগুলো হয় স্বঘোষিত, নতুবা মোটা টাকায় কেনা ।

এইসব তান্ত্রিক-জ্যোতিষীরা বশীকরণ মন্ত্রে সব্বাইকে বশ করতে পারেন।

আবার বেয়াড়া যুক্তিবাদী বা পোষ না মানা মিডিয়া-ম্যানকে

সামলাতে বশীকরণ মন্ত্রের বদলে পোষা মস্তানদের উপর

ভরসা করেন। ৯০ দিনে গ্যারান্টি দিয়ে রোগ

সারাবার বিজ্ঞাপন দেন এবং নিজে

অসুস্থ হলে দামী নাসিংহোমে

ভর্তি হন।

এইসব তান্ত্রিকদের সঙ্গে কম টিভি অনুষ্ঠানে তো মুখোমুখি হলাম না। ঝামা ঘষা মুখ নিয়ে এঁরা নির্লজ্জের মত যে সব কথা আমাকে বলেছেন, তার মোদ্দা অর্থ হলো—আপনারা যুক্তিবাদ নিয়ে যতই চেঁচান, আমাদের হাঁড়িকাঠে গলা বাড়িয়ে দেওয়ার মত পাঁঠার অভাব কোনও দিনই হবে না। ওরা যদি গলা বাড়িয়ে দেয়, আমাদের খাঁড়া চালাতে দোষটা কোথায় ?

এইসব তান্ত্রিকদের অনেকেই আবার টিভি ক্যামেরার সামনে ও বিজ্ঞাপনে এ কথা বলেন যে, নকল তান্ত্রিকদের থেকে সাবধান, আমি ছাড়া সব তান্ত্রিক-জ্যোতিষীই প্রতারক, ইত্যাদি জাতীয় কথা।

‘তারা’ টিভি চ্যানেলে ডঃ সন্দীপন চৌধুরীর এমন-ই একটা বক্তব্য ছিল—তিনি ছাড়া আর সবাই প্রতারক।

উত্তরে ওই অনুষ্ঠানেই বলেছিলাম— আমরা বলি, যে যত বড় তান্ত্রিক বা জ্যোতিষী, সে তত বড় প্রতারক।

বীরভূম আমাকে টানে। এই টানের অনেকটাই বাউল গান আর বাউলদের জীবনচর্যার কারণে। বীরভূমের মাটির গন্ধ যে সাহিত্যিকের কলমে পেয়েছি, তিনি তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়। একদিন তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়, তাঁর জামাতা ডাঃ বিশ্বনাথ রায় ও আমি গল্প করছিলাম তারাশংকরবাবুর পাকপাড়ার বাড়িতে। কথায় কথায় এক সময় এলো আউল-বাউল ও সহজিয়াদের প্রসঙ্গ। তারাশংকরবাবুর কাছেই সেদিন প্রথম জানলাম, আউল-বাউল-সহজিয়া-বৈষ্ণবরা দেহতত্ত্ববাদী। তারা মনে করে—যাহা আছে ব্রহ্মাণ্ডে, তাহা আছে দেহভাণ্ডে। পরম ব্রহ্মকে, পরম সত্যকে জানার জন্য ধর্মীয় নানা আচার-অনুষ্ঠান তাদের কাছে মূল্যহীন। দেহকে জানা, সৃষ্টি তত্ত্বকে জানার জন্যে নারী-পুরুষের মিলন হল স্বাভাবিক উপায়। মিলন থেকেই সৃষ্টি। মিলনেই আনন্দ। মিলনেই পূর্ণ জ্ঞান। আউল-বাউল-সহজিয়াদের উৎপত্তি সহজযানী বৌদ্ধ ধর্ম থেকে। সহজযানী বৌদ্ধরা বজ্রযান বৌদ্ধদের নিয়ম-কানুন- আচার-অনুষ্ঠান বর্জন করে দেহকেই সব সাধনার উৎস, লক্ষ ও মাধ্যম বলে গ্রহণ করেছিল।

বঙ্গদেশে পাল রাজাদের আমলে সহজযান বৌদ্ধদের প্রভাব প্রতিষ্ঠিত হয়। পাল রাজাদের আমলেই অতীশ দীপঙ্কর ‘বজ্রযান সাধন’ গ্রন্থ লিখেছিলেন। তান্ত্রিক গ্রন্থের টীকাকার প্রজ্ঞাবর্মনের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন পাল রাজারা। রাজা ধর্মপাল পঞ্চাশটা বৌদ্ধ মঠ তৈরি করে দিয়েছিলেন। রাজা দেবপালও কিছু বৌদ্ধবিহার তৈরি করেছিলেন। পাল রাজারাই বৌদ্ধ ধর্মের একটা সহজ-সরল চেহারা দিতে চেয়েছিলেন। তাঁরা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী হলেও হিন্দুদের মূর্তি পুজোর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন এবং বুদ্ধদেবের মূর্তি পুজোর প্রচলন করেছিলেন। সহজযান ও দেহতত্ত্ববাদ বঙ্গদেশে জনপ্রিয় হওয়ার পিছনে পাল রাজাদের অবদান সবচেয়ে বেশি। দেহতত্ত্ববাদীরা শেষ পর্যন্ত তান্ত্রিক।

আউল-বাউল-সহজিয়া-বৈষ্ণবদের দেখলে আমার কিশোর মনেও কোনও ভয় বা বীভৎস রসের উদয় হত না। বরং বাউলরা সে’দিন থেকে আজও আমার মন টানে সমান ভাবে। আমার মনের মতো অনেক মানুষই আজও বাউল গানের টানে, বাউল মনের টানে কেন্দুলি মেলায় ভিড় জমান।

পরে জেনেছি, রামকৃষ্ণও তন্ত্রসাধক ছিলেন। তন্ত্র-সাধনার মাধ্যমেই

তাঁর ‘সিদ্ধি’ লাভ বা ‘ব্রহ্ম’ লাভ। তন্ত্র-সাধকের ভৈরবী চাই ।

তন্ত্র-সাধিকার চাই তান্ত্রিক। তন্ত্রে দীক্ষাগুরুর কোনও

জাত-বিচার নেই, নারী-পুরুষ ভেদ নেই।

রামকৃষ্ণের দীক্ষাগুরুর যোগ সঙ্গী ও

ভৈরবী ছিলেন যোগেশ্বরী।

এ’সবই লেখা আছে রামকৃষ্ণ মিশনের নিজস্ব প্রকাশন বিভাগ ‘শ্রীরামকৃষ্ণ বেদান্ত মঠ’ থেকে প্রকাশিত স্বামী প্রজ্ঞানন্দর লেখা ‘তন্ত্রে তত্ত্ব ও সাধনা’ বইটিতে।

যোগ ও তন্ত্রের একই অঙ্গে এত রূপ! যতই জেনেছি ও দেখেছি ততই অবাক হয়েছি। হরপ্পা যুগ, বৈদিক যুগ ঘুরে আধুনিক যুগ পর্যন্ত তন্ত্রের নানা রূপ ছিল ও বহাল তবিয়তে আছে। এখনও যোগ ও তন্ত্রের বই-পত্তর প্রচুর বিক্রি হয়। যাঁরা কেনন, তাঁদের প্রায় সকলেই ওসব বইয়ের ধোঁয়াশায় ভরা কথা পড়তে পড়তে, হোঁচোট খেতে খেতে বুকসেল্ফে সাজিয়ে রেখে বাঁচেন। যাদের কিছু করে খাওয়ার ক্ষমতা নেই, তাঁরা তান্ত্রিক জ্যোতিষী সেজে বসেন। বিজ্ঞাপন দেন। মাস গেলে চার লাখ থেকে চল্লিশ লাখ যা খুশি রোজগার করেন লাইন দেওয়া ‘শিক্ষিতদের’ পকেট কেটে।

মানব সমাজের ক্রমবিবর্তনের ইতিহাস শেষ পর্যন্ত এগিয়ে যাওয়ার-ই ইতিহাস । সাময়িকভাবে বার বার পিছু হাঁটার কুচেষ্টাকে নিষ্ফল করে দিয়ে সমাজ শেষ পর্যন্ত এগিয়েই চলেছে—এটাই ইতিহাস। যোগ ও তন্ত্রের অর্বাচিন ও বিকৃত ধারণা একদিন মানুষ বর্জন করবেই। এটাই মানব সমাজের ক্রমবিবর্তনের পরিণতি ।

error: Content is protected !!