‘অপৌরুষেয়’ শব্দের অর্থে ‘মানুষের দ্বারা নয়’। দৈব-প্রত্যাদেশ মতবাদে বিশ্বাসীরা মনে করতো, তাদের ঈশ্বর কোনও একজন মানুষকে যাবতীয় উপদেশ দিয়ে গেছেন। সেই সঙ্গে তাকে দায়িত্ব দিয়েছেন, এইসব উপদেশ প্রচারের। যেহেতু ঈশ্বরের দেওয়া উপদেশ, তাই ভক্তদের কাছে এসব উপদেশ ছিল অপরিবর্তনীয়, শাশ্বত ও অভ্রান্ত । ঈশ্বরের উপদেশ শোনা ঈশ্বরের নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই ইহুদি, খ্রিস্টান, মুসলিম ইত্যাদি ধর্মের প্রবর্তন করেছিলেন। এই ধর্মপ্রবর্তক বা Prophet-রাই মানুষের উপাসনা- ধর্ম চেতনার জনক। আর উপাসনা-ধর্মের জনকদের মধ্যে এই চেতনার উন্মেষ ঘটিয়েছে দৈব-প্রত্যাদেশ ।

এই ধর্মীয় মতবাদকে গ্রহণ করতে কিছু বাস্তব অসুবিধে রয়েছে। দৈববাণী শোনা ধর্মপ্রবর্তকদের আবির্ভাবের আগে কি তবে কোনও ঈশ্বর চিন্তা মানুষের মধ্যে ছিল না? অবশ্যই ছিল। সে আলোচনায় আমরা পরে যাব। তার আগে দৈববাণী প্রসঙ্গে আরও দু-একটি জরুরি প্রশ্ন উঠে আসে। যেমন—

ঈশ্বরই যদি ধর্মপ্রবর্তকদের দৈববাণীর মাধ্যমে তাঁর উপদেশ প্রচারে

উদ্যোগী হয়ে থাকেন, তবে পৃথিবীতে একটি মাত্র উপাসনা-ধর্ম

বা religion থাকার কথা। কারণ ঈশ্বর-ই বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের

স্রষ্টা এবং ঈশ্বর এক। তবে কেন এত

উপাসনা-ধর্ম? তবে কেন ঈশ্বর

ধারণায় এত পার্থক্য ?

কেন হিন্দুদের ঈশ্বর সাকার, মুসলিমদের নিরাকার? একজন হিন্দু ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলিম হলে কি সেই মানুষটির ঈশ্বর সাকার থেকে নিরাকার হয়ে যাবেন? কেন হিন্দু ধর্মের শুয়োর খাওয়া নিষিদ্ধ নয়, মুসলিম ধর্মে নিষিদ্ধ। মুসলিম ধর্মে ‘রোজা’ আবশ্যিক পূণ্য কর্ম হলে, হিন্দু ধর্মে রোজার বিধান নেই কেন? হিন্দু ধর্মের মানুষ মৃত্যুর পর আবার জন্ম নেবে, মুসলিম ধর্ম নিয়ে মারা গেলে কেন আবার জন্ম নেবার প্রশ্নই নেই! এমন হাজারো প্রশ্নে বিভিন্ন ধর্মের মধ্যেকার বিরোধ উঠে আসতে বাধ্য। আবার ভাবুন তো, আমি যদি হীনযানপন্থী বৌদ্ধ ধর্মে বিশ্বাসী হই, তবে বুদ্ধদেবের উপদেশ মেনে আমাকে বিশ্বাস করতে হবে—ঈশ্বর নেই, ধর্মপ্রবর্তকদের প্রচারিত বাণী আদৌ ঈশ্বরের দেওয়া নয়। এত পার্থক্যের মধ্যে সমতা কোথায়? এত কিছুর পর কী করে মানি— দৈববাণী তত্ত্বকে?

এরপর আরও একটি জরুরি প্রশ্ন উঠে আসে। ঈশ্বর বা আল্লা এত নারী বিদ্বেষী, নিষ্ঠুর কেন? পৃথিবীর মানুষদের অর্ধেক পুরুষ, তো অর্ধেক নারী। ঈশ্বর বা আল্লা কেন পৃথিবীর অর্ধেক মানুষের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন? কেন তিনি নিরপেক্ষ নেন? এরপর তাঁকে ন্যায়-বিচারক বলে মানি কেমন করে?

অপৌরুষেয়, বেদ ও মনুসংহিতা শুধু নারীদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণে থেমে থাকেনি, মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করেছে। শ্রমজীবী শূদ্রদের প্রতি যে সব ভয়ংকর বিধান দেওয়া হয়েছে, তা অত্যন্ত নিষ্ঠুর ও চূড়ান্ত অমানবিক ।

এরপর প্রশ্ন উঠে আসা স্বাভাবিক যে, এইসব অমানবিক উপদেশাবলী কি সত্যিই ঈশ্বরের মহান-বাণী হতে পারে? হতে পারে অমোঘ বাণী? ঈশ্বর কি তবে একজন স্বার্থপর, উগ্র-পুরুষতান্ত্রিক, উচ্চবর্ণের নিষ্ঠুর পুরুষ? নাকি এসবই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে চাওয়া উচ্চবর্ণের স্বার্থপর কিছু মানুষের বিধান? প্রশ্নাতীত আনুগত্যে দৈববাণী তত্ত্ব মেনে না নিয়ে প্রশ্ন করুন। উত্তর মিলবেই।

একটা সময় চিন্তায় এগিয়ে থাকা কিছু মানুষ সমাজকে শৃঙ্খলায় আনতে কিছু কিছু আচরণ-বিধি ঈশ্বরের নামে সমাজের উপর চাপিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। বিভিন্ন উপাসনা-ধর্মে কিছু কিছু উপদেশ আছে, যাতে বলা হয়েছে ঈর্ষা, লোভ, চুরি, লুণ্ঠন, খুন ইত্যাদি খারাপ। গরীবকে দয়া করার কথাও আছে। তারপরেও উপাসনা-ধর্মের পৃষ্ঠপোষক রাজা-রাজড়াদের হাতে লুণ্ঠন, খুন হতো ব্যাপক আকারে। লোভ আর ঈর্ষা থেকেই অন্য রাজ্য জয়ের আকাঙ্ক্ষা, অন্য দেশের সম্পদ ও মানুষ লুণ্ঠনের ঘটনাগুলো ঘটতো। এইসব রাজা-সম্রাটেরা ধর্মের বাণীকে কোনও দিনই একটুও তোয়াক্কা করেনি। ঋষি, ব্ল্যাক ম্যাজিশিয়ান বা জাদুপরোহিত, পুরোহিত-পাদ্রি, যে নামেই এই ধর্মগুরুদের ডাকি না কেন, এই ধর্মগুরু শ্রেণীর সঙ্গে শাসক শ্রেণীর একটা সুসম্পর্ক, নির্ভরতা, ‘দিবে ও নিবে’ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। ফলে রাজার গুয়ে গন্ধ পেতেন না ধর্মগুরুরা। তারপরেও স্বীকর না করে উপায় নেই, ধর্ম প্রবর্তকদের ধর্মীয় বিধানে সমাজকে কিছুটা হলেও সুশৃঙ্খল করার একটা প্রয়াস যে যুগে ছিল। ধর্ম প্রবর্তকরা সেই সময়কার সমাজ-সাংস্কৃতিক প্রভাব থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হতে পারেননি, ফলে পুরুষতান্ত্রিকতা ও জাত-পাতের বিভেদ সৃষ্টিকে সমাজের উপর চাপিয়ে দিয়েছিলেন।

একটা সময়ে এইসব ধর্মীয় বিধানের কিছু ইতিবাচক ভূমিকা ছিল

সমাজের উপর। এইসব ধর্মীয় বিধান-ই ছিল আইন,

ছিল কিছু সুনীতিবোধ গড়ে তোলার ভিত্তি-ভূমি ।

বর্তমান সময়ের প্রেক্ষিতে আজ এইসব

ধর্মীয় বিধান তার উপযোগিতা

হারিয়েছে।

ধর্মীয় বিধানের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়েছে। ফুরিয়েছে ধর্মপ্রবর্তকদের ভূমিকা। সমাজে শৃঙ্খলা রাখতে এমন দৈববাণীর ‘মহান মিথ্যে’র চেয়ে আইনের শাসন, সাংস্কৃতিক অগ্রগতি অনেক বেশি কার্যকর ভূমিকা নিতে সক্ষম।

এখানে ‘আইনের শাসন’ বলতে অবশ্যই আইন প্রণয়ন ও প্রনীত আইনের প্রয়োগ বোঝাতে চাইছি। ভারতীয় আইন অনুসারে বেশ্যালয় চালানোর বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির কথা লেখা আছে। সহমরণে প্ররোচনা দেওয়া আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেওয়ার শামিল হিসেবে গণ্য করে শাস্তি দানের কথা রয়েছে। পশু বলি শাস্তি যোগ্য অপরাধ । গ্রহরত্ন বা তাবিজ-কবজ দিয়ে রোগ সারানোর দাবি করলে এবং সেই দাবির কথা কেউ প্রচার করলে উভয়েরই কঠোর শাস্তির কথা আইনের বইতে আছে। কিন্তু এ’দেশে সে’সব আইনের বইতেই শুধু আছে, প্রয়োগ নেই। জনতার আবেগে আঘাত পেতে পারে ভেবে সব রাজনৈতিক দল-ই আইন প্রয়োগে ভয় পায়। ভয়টা ভোট হারাবার। তাই তো এই রাজ্যেও প্রতি বছর ডাইনি হত্যার নামে নরহত্যা হয়। যে’সব ওঝা, জানগুরু, গুনিন ‘ডাইনি’ বলে কোনও মানুষকে ঘোষণা করে, তারা জনগণের আবেগের ঝড়ে দিব্বি শাস্তি এড়িয়ে যায়। আইনের শক্ত হাতের প্রয়োগ প্রত্যেকটি বে-আইনি কাজকে বন্ধ করতে পারে। এইসব বে-আইনি কাজ চলার পিছনে আরও অনেক উপাদান কাজ করে। তার মধ্যে অন্যতম প্রধান হল ব্যক্তিস্বার্থ ও দুর্নীতি।

ঈশ্বর-বিশ্বাস ও উপাসনা ধর্মের উপদেশ কখনই আইনের

বিকল্প নয়। তাই তো ধর্মের দেশ ভারত

দুর্নীতিতে পৃথিবীর প্রথম

সারির দেশ।

এই অবস্থায় সমাজের সুনীতি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ‘মহান মিথ্যা’ ঈশ্বরের প্রয়োজন ফুরিয়েছে। ঈশ্বরের উপযোগিতা আছে তাদের কাছে, যারা শোষিত মানুষদের মগজে ঢোকাতে চায়—তোমায় বঞ্চনার কারণ আমরা নই। বঞ্চনার জন্য দায়ী ঈশ্বরের কৃপা না পাওয়া, পূর্বজন্মের কর্মফল, নিয়তি ইত্যাদি ইত্যাদি।

ঈশ্বর বিশ্বাস, উপাসনা-ধর্মে বিশ্বাস একসময় রাজশক্তির আনুকূল্য পেত, এখন রাষ্ট্র শক্তির আনুকূল্য পায়। ‘ঈশ্বর’ নামের পণ্যের উপযোগিতা উপলব্ধি করে পত্রিকায় ঢাউস ঢাউস বিজ্ঞাপন দেয় তান্ত্রিক-জ্যোতিষীরা। এরা ঈশ্বর ও উপাসনা- ধর্ম ভাঙিয়ে অনায়াসে পরের মাথায় হাত বুলিয়ে খাচ্ছে। ঈশ্বর আছে বলেই খাচ্ছে, না থাকলে খাবে কী? মন্দির-মসজিদ-গীর্জা উপাসনা-ধর্ম ভাঙিয়েই ধনী। মানুষের অজ্ঞানতা ও বিশ্বাসকে কাজে লাগিয়েই তাদের মস্তানি।

error: Content is protected !!