উপাসনা-ধর্ম নিয়ে বিজ্ঞানসম্মত গবেষণার শুরু মাত্র ২৩০ বছর আগে । আধুনিক নৃতত্ত্ববিদ ও সমাজতত্ত্ববিদরা নানা আদিম মানব গোষ্ঠীদের মধ্যে উপাসনা-ধর্মের উৎপত্তি নিয়ে গভীর গবেষণা করেছেন। তাঁদের গবেষণার মধ্য দিয়ে বিভিন্ন মতামতের সঙ্গে আমরা পরিচিত হবার সুযোগ পেয়েছি। উপাসনা-ধর্মের আদি ও প্রাথমিক রূপ কী ছিল? বর্তমান অবস্থায় পৌঁছতে কী কী স্তর অতিক্রম করতে হয়েছে? এ’সবই আমরা জেনেছি বিভিন্ন গবেষকদের গবেষণাকর্ম থেকে। উপাসনা ধর্মের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ নিয়ে প্রথম বিজ্ঞানসম্মত গ্রন্থটির নাম ‘Primitive culture’ বাংলা করে বলতে পারি ‘আদিম সংস্কৃতি’। গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ১৮৭১ সালে। লেখক টাইলর (Tyler)। টাইলরকে দিয়ে যাত্রা শুরু। তারপর বহু বিবর্তনবাদী নৃতত্ত্ববিদ ও সমাজতত্ত্ববিদ উপাসনা ধর্মের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ নিয়ে গবেষণা করেছেন ও গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন। ‘ধর্ম’ (religion)-এর প্রাথমিক রূপ খুঁজে পেতে গবেষকদের প্রায়ই মনোবিজ্ঞানের সাহায্য নেওয়ার প্রয়োজন হয়েছে। আদিম মানব সমাজের মানসিক অবস্থার নানা পর্যায় সম্বন্ধে যথেষ্ট ধারণা না থাকলে উপাসনা- ধর্মের উৎপত্তি ও বিবর্তনের নৃতাত্ত্বিক গবেষণায় অনেক ভুলের সম্ভাবনা থেকে যাবে।
আদিম মানব জীবন সম্বন্ধে অনেক তথ্য নৃতাত্ত্বিক গবেষণায় পাওয়া গেলেও তা থেকে আমরা কিছু কিছু অনুমানে পৌঁছতে পারি মাত্র। সমাজবিজ্ঞান ও মনোবিজ্ঞান আমাদের সেই অনুমানকে আরও কিছুটা সঠিক দিকে পরিচালিত করতে পারে। সেই অনুমানকে আমরা কোনওভাবেই নির্ভুল সিদ্ধান্ত বলতে পারি না । আদিম মানুষের জীবনযাত্রার ইতিহাসের প্রায় পুরোটাই অজানা। কারণ তখন ইতিহাস লিখে যাবার প্রশ্ন-ই নেই। এখনও পর্যন্ত পৃথিবী জুড়ে যে’সব পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া গেছে, তার সঙ্গে আদিম মানব গোষ্ঠীর অতি সহজ-সরল মানসিক অবস্থা জুড়ে আমরা সেই সময়কার সমাজ জীবনের একটা ছবি পেতে পারি। আদিম সমাজ জীবনের খুঁটিনাটি বিষয়ে জানতে না পারলেও, তখনকার মানুষদের বিশ্বাস ও সংস্কৃতির একটা মোটামুটি ধারণায় অবশ্যই পৌঁছতে পারি।
এমনই কিছু মোটামুটি ধারণার উপর ভিত্তি করে কিছু নৃতত্ত্ববিদ ও সমাজতত্ত্ববিদরা আদিম মানব-সমাজে ঈশ্বর বিশ্বাস ও উপাসনা-ধর্মের উৎপত্তি নিয়ে গবেষণা করেছেন ও কিছু সুস্পষ্ট মতামত দিয়েছেন। আমরা এমনই কিছু উল্লেখযোগ্য মতামত এবার আলোচনায় নিয়ে আসব।
টাইলরের ‘সবেরই প্রাণ আছে তত্ত্ব’ (Animiam)
টাইলর তাঁর ‘আদিম সংস্কৃতি গ্রন্থে লিখলেন—আদিম মানুষ বিবর্তনের একটা পর্যায়ে এসে বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল, সবের-ই প্রাণ আছে। নদী, সমুদ্র, মেঘ, বিদ্যুৎ, বর্ষা, বন্যা, পাহাড়, আগুন, গাছ-পালা, জঙ্গল, ঝড়, চাঁদ, সূর্য ইত্যাদি সবের-ই। আরও বিশ্বাস করতো— মানুষের প্রাণ আছে বলে মানুষ যেমন নিজের ইচ্ছে মতো কাজ করতে পারে, তেমনই নদী থেকে সূর্য প্রত্যেকেই নিজেদের খেয়াল-খুশি মতো কাজ করে।
নদীর পানীয় জলের যোগান ও বন্যা, সমুদ্রের বিশালতা ও জলোচ্ছ্বাস, মেঘের আকাশ চেরা বিদ্যুতের ঝলকানি, বজ্রপাত ও বৃষ্টি, আগুনের দহন ক্ষমতা, সবুজে ঢাকা পাহাড়-পর্বতের বিশালতা ও রহস্যময়তা, শিকার ও ফলমূলের জন্য অরণ্য নির্ভরতা, বৃক্ষ থেকে ফল-মূল-জ্বালানি সংগ্রহ ও ছায়া প্রাপ্তি, সূর্যের অন্ধকার কাটিয়ে আলোয় ভরিয়ে দেওয়া, উদয় ও অস্তের পরিক্রমা, চাঁদের স্নিগ্ধ আলো ও আকাশ পরিক্রমা, হ্রাস-বৃদ্ধি—এ’সবই আদিম মানুষদের মনে বিস্ময়, ভক্তি, ভয় ইত্যাদি সৃষ্টি করেছিল। উপকারী প্রাকৃতিক সম্পদ ও প্রাকৃতিক শক্তিকে তারা যেমন শ্রদ্ধা- ভক্তি থেকে তুষ্ট করতে চাইতো, তেমনই ঝড়, বন্যা, বজ্রপাতের মত ধ্বংসকারী শক্তিকে ভয় করতো, এবং ভয়াবহ এইসব শক্তি থেকে বাঁচতে তাদেরও তুষ্ট করতে চাইতো।
এই তুষ্ট করার চেষ্টা থেকেই উপাসনার উৎপত্তি। সব কিছুরই প্রাণ আছে, এবং তাদের ভালো বা খারাপ করার ক্ষমতা আছে—এমন চিন্তা থেকেই সূর্য, চন্দ্ৰ, নদী, সমুদ্র, বায়ু, ঝড়, বজ্র ইত্যাদিকে ঈশ্বর বলে মনে করার শুরু। পৃথিবীর প্রায় সব অঞ্চলেই এইসব প্রাকৃতিক শক্তিকে ঈশ্বর হিসেবে পুজো করা হত বা এখনও হয় ৷
এই হল মোটামুটি ভাবে টাইলরের ‘Animism’ বা ‘সবেরই প্রাণ আছে’ তত্ত্ব।
টাইলরের এই তত্ত্বকে সমাজ বিজ্ঞানীদের বড় অংশই মেনে নিয়েছেন। তাঁরা মনে করেন,
পৃথিবীর প্রায় সর্বত্র একটা সময় আদিম মানবগোষ্ঠীর মধ্যে এই
বিশ্বাস ছিল যে, গাছ থেকে সূর্য—সবেরই প্রাণ আছে।
এই বিশ্বাসই সেই সব আদিম মানবগোষ্ঠীর ঈশ্বর
বিশ্বাস ও উপাসনা-ধর্মের ভিত।
‘সবেরই প্রাণ আছে’ এই বিশ্বাস কোন্ সময়ে দেখা দিয়েছিল? প্রশ্ন আসে ৷ কোনও কোনও সমাজ বিজ্ঞানী এই বিশ্বাসের আবির্ভাবের কাল বা সময় নির্ধারণ করেছেন। বাস্তবে এ’ভাবে সময় ঠিক করাটা ভুল হবে। কারণ, আদিম মানুষের বিবর্তনের পর্যায়গুলো পৃথিবী জুড়ে, একই সঙ্গে আসেনি। ভারতীয়দের ক্রমবিকাশের ইতিহাসের দিকে তাকালেই এই বক্তব্যের সত্যতা বুঝতে পারবেন। আমরা স্যাটেলাইট, কম্পিউটার জমানায় আছি—এটা আংশিক সত্য। কারণ আমরা যখন জাড়োয়া তখনই আদিম মানুষের খোলস ছেড়ে পুরোপুরি বেরিয়ে আসতে পারিনি।
হার্বাট স্পেনসর-এর (Harbert Spencer) ‘প্রেতপুজো তত্ত্ব’
স্পেনসর হাজির করলেন এক নতুন তত্ত্ব। তিনি বললেন, উপাসনা-ধর্মের উৎপত্তি হয়েছে প্রেতপুজোর মধ্য দিয়ে, যা আসলে মৃত পূর্বপুরুষদের উপাসনা। আদিম মানুষরা মনে করতো, পূর্বপুরুষদের আত্মাকে তুষ্ট রাখলে আত্মারা বিপদে-আপদে তাদের রক্ষা করবে। স্পেনসরের মতে, ‘সবেরই প্রাণ আছে’ ধারণারও আগে প্রেতপুজোর শুরু।
ভারতের পিছিয়ে থাকা আদিবাসী জনগোষ্ঠীর দিকে তাকালে দেখতে পাবো পূর্বপুরুষদের আত্মাকে পুজো করা এখনও টিকে আছে। সাঁওতাল সমাজ বিশ্বাস করে, পরিবারের কেউ মারা যাওয়ার পর ‘বোঙ্গা’ অর্থাৎ ঈশ্বর হয়ে যান । পারলৌকিক আচার-আচরণ পালনের পর ওই বোঙ্গা তার নিজের পরিবারের কুঁড়েঘরে স্থায়ীভাবে বাস করতে থাকে। আত্মার এই বোঙ্গাকে বলে ‘হপ্রামপো বোঙ্গা’। প্রতি পরবে পরিবারের লোক হগ্রামপো বোঙ্গাকে নৈবেদ্য দেয়। বিনিময়ে এই বোঙ্গা পরিবারকে বিপদ-আপদে রক্ষা করে।
আদিম আদিবাসী কিছু কিছু সমাজে প্রেতপুজো ছিল। যে’সব আদিবাসী জনগোষ্ঠী এখন সংস্কৃতিগত ভাবে পিছিয়ে আছে, সে’সব জনগোষ্ঠীর কেউ কেউ এখনও প্রেতপুজো করে। তার সরল অর্থ এই নয় যে—প্রেতপুজোই উপাসনা-ধর্মের উৎস।
আদিম সমাজে মৃত ব্যক্তির আত্মার কল্পনা আগে এসেছিল, তার-ও
পরে এসেছে প্রাকৃতিক বস্তুর প্রাণের কল্পনা—এমন তত্ত্ব
মনোবিদরা স্বীকার করেন না। তাঁরা মনে করেন, আগে
প্রাণের কল্পনা এলে, তারপরই শুধু
আত্মার কল্পনা করা সম্ভব।
আত্মার মতো একটা জটিল কল্পনা মানসিক বিবর্তনের অনেক উঁচু স্তরে এসেছে। আর নৃতত্ত্ববিদদের আধুনিক গবেষণা থেকে আমরা যা জানতে পেরেছি, তাতে এটুকু নিশ্চিন্তে বলা যায় যে, উপাসনা-ধর্মের উৎপত্তি প্রেতপুজোর মধ্য দিয়ে নয়।
রবার্টসন স্মিথ (Robertson Smith)-এর ‘টোটেম তত্ত্ব’ (Totem-Theory)
স্মিথ-এর ‘Religion of Semites’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৮৫ সালে। উপাসনা- ধর্ম নিয়ে তাঁর ‘টোটেম তত্ত্ব’ সে সময় দারুণ সাড়া জাগিয়েছিল। টোটেম হল সাধারণভাবে সেই প্রাণী গোষ্ঠী, যারা একটি মানব গোষ্ঠীর প্রতীক বা কুলপ্রতীক বলে পরিচিত। এই টোটেম প্রাণীদের মধ্যে গাছ, ফুল, ফল ইত্যাদিকেও গণ্য করা হয়। স্মিথ তাঁর ‘সেমিটিসদের ধর্ম’ গ্রন্থটিতে সেমেটিক জাতিগোষ্ঠীর উপাসনা-ধর্ম নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন। ‘সেমিটিক জাতি’ মানে বাইবেলে কথিত ‘Shem’ (শেম) থেকে উৎপন্ন জাতিগোষ্ঠী। এই জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে পড়ে ব্যাবিলনিয়ন, আসিরিয়ন, ফিনিসিয়ন, মৌটিস, ওল্ড হিব্রু, পূর্ব অ্যারামিনিয়ন, পশ্চিম অ্যারমিনিয়ন, উত্তর আরবিক, দক্ষিণ আরবিক, আবিশাইনিয়ন। এই উপজাতিগুলোর মধ্যে টোটেম প্রথার প্রচলন শুরু। পৃথিবীর অন্যান্য আদিবাসীদের মধ্যেও টোটেম প্রথার উদ্ভব দেখা গেছে। টোটেম প্রথা অর্থাৎ টোটেম পুজোর মধ্য দিয়েই শুরু হয়েছিল আদিম মানবগোষ্ঠীর উপাসনা ধর্মের জয়যাত্রা।
‘টোটেম’ মানে সাধারণভাবে বিশেষ প্রজাতির প্রাণী। বিশেষ প্রজাতির উদ্ভিদ এবং জড়বস্তুকেও টোটেম হিসেবে পুজো করা হত, তবে জড় টোটেমের উদাহরণ অবশ্য খুবই বিরল।
উত্তর আমেরিকার আদিবাসী রেড ইন্ডিয়ান থেকে ভারতীয় আদিবাসীদের মধ্যে টোটেম পুজোর প্রচলন ছিল, এখনও আছে। সাপ, বাঘ, ষাঁড়, ভেড়া, হনুমান, শুয়োর, কুমির, মাছ, কাছিম, পেঁচা, বাজপাখি ইত্যাদি কত না পশু-পাখি পুজিত হয় এখনও।
এখনও বট, অশ্বত্থ, তুলসী, আকন্দ, কলা, হলুদ, ধান ইত্যাদি গাছকে পুজো করা হয়। পুজো করা হয় পাথর, শাল গাছের খুঁটি। শুধু আদিবাসী সমাজ নয়, হিন্দু উপাসনা- ধর্মে মীন, কূর্ম, বরাহ ইত্যাদি পশুকে দেবত্ব আরোপ করা হয়েছে। সাপের পুজো এখনও আমাদের দেশে খুবই জনপ্রিয়। আদিম অস্ট্রিকভাষী উপজাতিদের থেকে এই পশু পুজোর অনুপ্রবেশ ঘটেছিল বৈদিক উপাসনা-ধর্মে ও বেদ-পরবর্তী উপাসনা-ধর্মে, এ বিষয়ে নৃতত্ত্ববিদরা নিশ্চিত।
১৮৯৬-তে প্রকাশিত হল আরও একটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ ‘Introduction To The History of Religion’। বাংলায় বলতে গেলে বলতে পারি, ‘উপাসনা- ধর্মের ইতিহাসের ভূমিকা’। লেখক এফ বি জেভন্স। প্রায় রবার্টসন স্মিথ-এর প্রতিধ্বনি পেলাম তাঁর লেখায়।
স্মিথ ও জেভন্স আর একটা বিষয়ে একমত ছিলেন—টোটেমের প্রাণী, উদ্ভিদ বা জড়বস্তু হল পূর্বপুরুষদের প্রতীকীভূত কুলদেবতা।
‘টোটেম’ শব্দের সঙ্গে আরও একটি শব্দ জড়িয়ে আছে—‘টাবু’ (Taboo)। ‘টাবু’ মানে নৈতিক বাধা-নিষেধ। শুচিতা-অশুচিতা, পবিত্র-অপবিত্র ইত্যাদি বিষয়ে টোটেম উপাসনা-ধর্মের বিধি-নিষেধকে বলা হয় ‘টাবু’। টাবু’ শব্দটি এখন অবশ্য ধর্মীয় লক্ষ্মণ-রেখা অতিক্রম করে ব্যাপ্তি পেয়েছে। আধুনিক সমাজ দেহশূচিতাকে ‘টাবু’ বা সামাজিক বাধা-নিষেধ বলে মনে করে।
দুৰ্খাইম (Durkhiem)-এর ‘টোটেম তত্ত্ব’
দুর্খাইম বিশিষ্ট ফরাসি সমাজতত্ত্ববিদ। তাঁর মতে যে কোনও উপাসনা-ধর্ম বিশ্বাসের মূলে রয়েছে এক রহস্যময় শক্তির কাছে আবেগের আত্মসমর্পণ। এই রহস্যময় শক্তিকে মানবজীবনের নিয়ন্ত্রণকারী মনে করে বলেই মানুষ আবেগ ও ভক্তির দ্বারা পরিচালিত হয়। টোটেম হল সামাজিক কর্তৃত্বের প্রতীক। টোটেমকে মানলে টাবুকেও মানতে হয়। এসে পড়ে সমাজকে বেঁধে ফেলার নৈতিক রীতি-নীতি।
দুর্খাইম অবশ্য তাঁর মতামতে আরও কিছু প্রকাশ করেছিলেন। তিনি মনে করতেন, উপাসনা-ধর্ম ও জাদু বিশ্বাসের মধ্যে পার্থক্য টানা মুশকিল। উপাসনা ধর্ম ও জাদু বিশ্বাসের আকারগত পার্থক্য থাকলেও দুইয়ের-ই উৎস এক। টোটেমের রহস্যময় শক্তিকে নিজের মধ্যে পেতেই আদিম জাতিগোষ্ঠী টোটেম হত্যা করে খেতো বিশেষ অনুষ্ঠানে।
টোটেম প্রথা সারা পৃথিবী জুড়ে উপাসনা-ধর্মের গোড়ার কথা—এমন
মতামত বর্তমানের নৃতত্ত্ববিদরা মানতে নারাজ। টোটেম প্রথা প্রায়
সারা পৃথিবী জুড়ে ধর্মের বিবর্তনের একটা
পর্যায়ে দেখা গিয়েছিল—এটা ঠিক।
টোটেম পুজোর পর টোটেমকে হত্যা করে খাওয়া হত—এটাও ঠিক। কিন্তু সব আদিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে টোটেম পুজোর প্রচলন ছিল না।
যাযাবর জীবন ও টোটেম প্রথা
অনেক আদিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে টোটেম প্রথা এসেছে যাযাবর জীবন পশুনির্ভর হয়ে পড়ায়। আদিম জনগোষ্ঠী ছিল যাযাবর। জলের অভাব হলে আজও যেমন পশুরা তাদের ডেরা তুলে জলের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ে। তেমনই আদিম মানবগোষ্ঠীও জলের অভাব দেখা দিলে দলবদ্ধভাবে পাড়ি দিত জলাশয়ের সন্ধানে। প্রধান খাদ্য ছিল পশু মাংস। সঙ্গে ছিল মৎস্য শিকার ও বনের ফল-মূল আহরণ। পশু-মাংস নির্ভরতা থেকেই এলো পশু পালন। বনের কিছু পশুকে ধরে পালন। এইসব পশুরা ছিল তৃণভোজী। বুনো কুকুরদেরও পোষ মানিয়েছিল শিকারে সাহায্য পেতে। গৃহপালিত তৃণভোজীদের জন্য ঘাস-পাতার প্রয়োজন হত। সবুজের অভাব দেখা দিলে সবুজের সন্ধানে বেরিয়ে পড়তে হত। মাংস সরবরাহ বজায় রাখতে গৃহপালিত পশুদের বংশবৃদ্ধির প্রয়োজন ছিল। তার জন্য প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল পালিত পশুদের পরিচর্যার।
মানুষ যখন চাষ করতে শিখল, তখন যাযাবর জীবনে এলো স্থায়িত্ব। চাষের কাজে ষাঁড়, বলদ, চামরি, মোষ ইত্যাদির ব্যবহার এলো এক সময়। দুধ অন্যতম খাদ্য হয়ে উঠলো। ‘গো-ধন’ সম্পদের মাপকাঠি হয়ে উঠলো। মাংস ও দুধের জন্য ভেড়া, ছাগল, চামরি গাই, মোষ এ’সব গৃহপালিতদেরও কদর ছিল বিভিন্ন গোষ্ঠীদের মধ্যে। চামরি এ ভেড়ার লোম থেকে পোশাক তৈরি করতে শিখলো। পোশাকে এলো পশু-চামড়ার ব্যবহার। এ ভাবেই বেড়েছে পশু নির্ভরতা ও পশু পালনের প্রয়োজনীয়তা। মানবগোষ্ঠী পশুসম্পদ রক্ষা ও বৃদ্ধিতে যেমন একদিকে নজর দিয়েছে, পাশাপাশি অন্য গোষ্ঠীর পশু সম্পদ লুঠ করতে বুদ্ধি ও শক্তি প্রয়োগ করেছে। পশুরা এক দিকে পেতে লাগলো সেবা, পরিচর্যা ও পুজো। আর এক দিকে খাদ্যবস্তু হিসেবে নিহত হতে লাগলো। শুরুতে টোটেম পশু-পাখি ছিল অন্তর্গত গোষ্ঠীর খাদ্য। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে টোটেম গোষ্ঠী নানা উপগোষ্ঠীতে ভাগ হল। অনেক উপগোষ্ঠী টোটেম খাওয়া নিষিদ্ধ করলো।
উৎপাদন ব্যবস্থার উন্নতি, নতুন নতুন খাদ্যের যোগান বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে টোটেম বিশ্বাস তার তাৎপর্য হারালো। অনেক জায়গায় ব্যাপারটা হয়ে দাঁড়ালো নিছকই প্রথা।
হিন্দু উপাসনা-ধর্মে টোটেমের প্রভাব
টোটেমগোষ্ঠীর মানুষরা কিছু বিধি-নিষেধ মেনে চলে। এই বিধি-নিষেধকে বলে ‘টাবু’। বিয়ের ব্যাপারে প্রত্যেকেই প্রায় ‘টাবু’ বা নিময়-কানুন মেনে চলে। এক টোটেম গোষ্ঠীর পুরুষ বা নারী সেই টোটেম গোষ্ঠীর নারী বা পুরুষকে বিয়ে করে না। হিন্দুদের গোত্র ব্যবস্থা টোটেম প্রথা থেকেই এসেছে। গোত্রের নাম দেখলেই হিন্দু ধর্মীয় চেতনায় টোটেমের প্রভাবের পরিচয় পাওয়া যায়। শাণ্ডিল্য মনে ষাঁড়, গৌতম অর্থে গরু, ভরদ্বাজ মানে ভরত পাখি, মৌদ্গল্য হলো মাগুর মাছ, কাশ্যপ মানে কচ্ছপ। কোনও গোত্রের মানুষ তার টোটেম খাবে না, তার গোত্রের কাউকে বিয়ে করবে না, এটাই ছিল ‘টাবু’।
হিন্দু উপাসনা-ধর্মে আমরা অবতার হিসেবে মীন, কূর্ম, বরাহ ইত্যাদি প্রাণীর উল্লেখ পাই। শ্রীকৃষ্ণ ছিলেন শুনক গোত্রধারী, যার টোটেম হল কুকুর।
হিন্দুদের কিছু ধর্মশাস্ত্রের নামও পশুদের নামে। যেমনঃ শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ । শ্বেতাশ্বতর অর্থাৎ সাদা অশ্বতর। ঘোড়া ও গাধার মিলনজাত সাদা রঙের পশু। তৈত্তিরীয় উপনিষদ। তৈত্তিরীয় শব্দটি এসেছে তিত্তির পাখি থেকে। এমন উদাহরণ প্রচুর রয়েছে।
আদিবাসীদের মধ্যে হাঁসদার টোটেম হল হাঁস, হেমব্রেম-সুপারি, সরেন-আমলকি গাছ, মারাণ্ডি-ঘাস, মাণ্ডি-পিয়াল গাছ। লোধাদের গোত্র শুশুক।
ডবলিউ বরার্টসন স্মিথ তাঁর ‘রিলিজিয়ন অফ দি সেমিটিজ’ (Religion Of The Semites by W.Robertion Smith) গ্রন্থে লিখেছেন, বলিদান প্রথার মূলে রয়েছে টোটেম প্রথা। বিশেষ অনুষ্ঠান বা উৎসবে টোটেম প্রাণীকে হত্যা করে তাকে খাবার হিসেবে গ্রহণ করা হয়।
আদিম সংস্কৃতির কিছু কিছু অবশেষ এখনও টিকে রয়েছে সংস্কৃতিগতভাবে পিছিয়ে থাকা অঞ্চলগুলোতে। সেখানে এখনও নিষ্ঠুর বলিপ্রথা টিকে রয়েছে। টিকে রয়েছে ‘প্রগতিশীল’ পশ্চিমবঙ্গেও। বিহার ও ঝাড়খন্ডে বলির বিরুদ্ধে আইনের প্রয়োগ করার আদেশ দেওয়া হয়েছে—যে দুটি প্রদেশকে পিছিয়ে পড়া’ বলে আমরা বাঙালিরা নাক সিঁটকোই ।
প্রাক-সর্বপ্রাণ তত্ত্ব ও জাদু (Pre-animism and Magic)
কিছু নৃতত্ত্ববিদ জানালেন, ‘সবেরই প্রাণ আছে, এই ধারণারও আগে উপাসনা- ধর্মের উৎপত্তি হয়েছিল। আদিম মানবগোষ্ঠী এই সময় মনে করতো—যা দেখছে, সবের মধ্যেই রয়েছে একটা রহস্যময় শক্তির খেলা। এই শক্তি নিয়ে কোনও স্পষ্ট ধারণা ছিল না। আর এই অস্পষ্ট রহস্যময় ধারণা থেকেই গড়ে উঠেছিল রহস্যময়ের প্রতি ভয় ও ভক্তি। প্রকৃতির অনেক বিষয়, অনেক ঘটনা দেখে কার্য-কারণ সম্পর্ক খুঁজে না পেয়ে রহস্যময় মনে হয়েছে। জোয়ার-ভাটা, সূর্যের উদয়-অস্ত, চাঁদের হ্রাস- বৃদ্ধি, গ্রহণ, ঝড়, বজ্রপাত, বন্যা, ভূমিকম্প—এমন অনেক কিছুকেই রহস্যময় শক্তির লীলা মনে হয়েছে।
বিশিষ্ট নৃতত্ত্ববিদ বিশপ কর্ডিনটন (Bishop Cordinton) এই সর্বব্যাপী রহস্যময় শক্তির নাম দিলেন ‘মানা’ (Mana)। বিশপ তাঁর ‘দ্য মিলানেসিয়ানস’ (The Melanesians) গ্রন্থে ‘মানা’ শব্দটি ব্যবহার করলেন। নৃতত্ত্ববিদের কোনও গ্রন্থে মানা’র সর্বব্যাপী শক্তিতে বিশ্বাস করতো। এবং এই শক্তিকে বলতো ‘মানা’। বিশপ এও মনে করতেন, আদিম মানবগোষ্ঠী এই ‘মানা’ ধরনের কোনও অতিপ্রাকৃত শক্তিতে বিশ্বাস করতো, ভক্তি ও ভয় করতো। এর থেকেই উপাসনা-ধর্মের উৎপত্তি। ‘সব কিছুরই প্রাণ আছে’—এমন ধারণার আগে-ই এসেছিল এই অতীন্দ্রিয় শক্তির ধারণা।
বিশপ-এর ‘দ্য মিলানেসিয়ানস’ গ্রন্থ প্রকাশের পরেই আর একটি গ্রন্থ নৃতত্ত্ববিদদের নজর কাড়লো। বইটির নাম “Threshold of Religions’, বাংলা করে বলতে পারি ‘ধর্মের সূত্রপাত’। লেখক, ম্যারেট (Marret)। তিনি বললেন, রহস্যময় সর্বব্যাপী অতিপ্রাকৃত শক্তিতে বিশ্বাস থেকেই জাদু বিশ্বাসের জন্ম, উপাসনা-ধর্মের জন্ম। ম্যারেটও বিশপ-এর ‘মানা’ তত্ত্বকে স্বীকৃতি দিলেন।
এফ বি জেভন্স রবার্টসনের টোটেম প্রথার পক্ষে মত প্রকাশ করলেও ‘উপাসনা- ধর্মের ইতিহাসের ভূমিকা’ গ্রন্থে বললেন, মানা’র মতো অপ্রাকৃতিক রহস্যময় শক্তির প্রতি বিশ্বাস, আসলে জাদু বিশ্বাস। এই জাদু বিশ্বাসই হলো উপাসনা-ধর্মের উৎপত্তির প্রথম ধাপ। মানা’র ধারণা বা জাদু বিশ্বাস সর্ব-প্রাণ ধারণারও আগে আদিম মানুষের চিন্তায় এসেছিল।
জেমস ফ্রেজার (James Frazer) ও তাঁর ‘Golden Bough’ বা ‘সোনার শাখা’ গ্রন্থে জানালেন, আদিম মানুষের চিন্তার ক্রমবিবর্তনের ইতিহাসের দিকে চোখ ফেরালে দেখতে পাবো জাদু বিশ্বাস থেকেই উপাসনা-ধর্মের উৎপত্তি। আদিম মানুষ প্রকৃতির কিছু কার্য-কারণ সম্পর্ক ধরতে পারে নি। কল্পনা করেছিল রহস্যময় অতিপ্রাকৃত শক্তি রয়েছে প্রকৃতির মধ্যেই। সেই শক্তিকে নিয়মে বাঁধা যায় না। কার্য- কারণ সম্পর্ক খোঁজার চেষ্টা বৃথা। এই রহস্যময় অতিপ্রাকৃত শক্তিকেই আদিম মানুষ ‘জাদুশক্তি’ বা ‘magic’ বলে ধরে নিল। অতিপ্রাকৃত শক্তিকে তুষ্ট করতে নানা রহস্যময় উপাসনা, আচার-পদ্ধতি গড়ে তুললো বিভিন্ন আদিম গোষ্ঠী। গড়ে উঠলো নানা সাংকেতিক জাদু আচার পদ্ধতি।
ফ্রেজার আরও বললেন, মানব বিবর্তনের নিয়ম অনুসারে আদিম গোষ্ঠীর কিছু মানুষ অপেক্ষাকৃতভাবে অন্যদের তুলনায় চিন্তায় বুদ্ধিতে এগিয়েছে। জাদুশক্তির নানা নিয়ম-কানুন ও রহস্যময় চিহ্ন ব্যবহার ইত্যাদির সাহায্যে অতীন্দ্রিয় শক্তিকে কাজে লাগানো যায়—এমন বিশ্বাসকে ভুল বলে মনে করলো চিন্তায় এগিয়ে থাকা মানুষ। অতীন্দ্রিয় শক্তিমান এক সত্তা যাকে আমরা ‘ঈশ্বর’ বলতে পারি, সেই ঈশ্বর উপাসনায় মন দেওয়াটাই তারা ঠিক পথ বলে মনে করলো। এ’ভাবে গড়ে উঠলো উপাসনা- ধর্ম। অর্থাৎ জাদু বিশ্বাসের বিরোধীতার মধ্য দিয়েই উপাসনা ধর্মের উৎপত্তি।
‘উপাসনা ধর্ম’ ও ‘জাদু বিশ্বাস’ তেল ও জলের মতো। কখনই মিলতে পারে না ।
ফ্রেজারের এই মতের পুরোপুরি বিরোধিতা করলেন হার্টল্যান্ড (Hartland) । তিনি তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘Ritual and Belief’ (বাংলায় বলতে পারি, ‘আচার ও বিশ্বাস’)-এ জানালেন, ফ্রেজার আদিম গোষ্ঠীর কিছু মানুষকে যতটা চিন্তাশীল ও বুদ্ধিমান বলে ধরে নিয়েছেন –বাস্তবে তা অসম্ভব। জাদু ও অতীন্দ্রিয় শক্তির মধ্যে পার্থক্য করার মত মানসিকতা আদিম বর্বর মানুষদের মধ্যে গড়ে ওঠা সম্ভব নয়। আদিম মানুষের বুদ্ধির ক্রমবিকাশ হয়েছে অত্যন্ত ধীরগতিতে। এই আদিম অবস্থায় জাদু-বিশ্বাস ও উপাসনা-ধর্মবিশ্বাসকে সরাসরি তেল-জলের মত মনে করলে, মানুষের বুদ্ধি ও চিন্তার ক্রমবিকাশের তত্ত্বকেই অস্বীকার করতে হয়। আর এই অস্বীকারের অর্থ বিজ্ঞানকেই অস্বীকার।
আমরা কী পেলাম
উপাসনা-ধর্মের উদ্ভব নিয়ে আমরা বেশ কিছু বিশিষ্ট গবেষক পণ্ডিতদের মতামতের সঙ্গে ইতিমধ্যে পরিচিত হয়েছি। হয়তো এই অংশটা অনেকের কাছে কিছুটা অ্যাকাডেমিক বা ক্লাস-পাঠ্য বইয়ের মত তত্ত্ব ও তথ্যের কচকচানি-কণ্টকিত মনে হয়েছে। বইটিকে প্রামাণ্য করার এবং তত্ত্ব ও তথ্যগুলোর সঙ্গে পাঠক- পাঠিকাদের পরিচয় ঘটাবার একটা আন্তরিক তাগিদ অনুভব করেছি বলে-ই এই অংশের অবতারণা ।
আমাদের মনে রাখতে হবে—পৃথিবী জুড়ে অসম বিকাশ একটা সমস্যা কিন্তু বাস্তব সত্য। ভারতের মত একটা দেশ যা পৃথিবীর অংশ মাত্র, সেখানেও অসম বিকাশের সমস্যা আজও প্রকটভাবে রয়েছে। আমরা একই সঙ্গে নিউক্লিয়ার বোম তৈরির প্রযুক্তিকে কাজে লাগাচ্ছি, আবার জমিকে উর্বর করতে ভারতের কিছু আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ হিসেবে আমরা আজও নানা অশ্লীল আচার-অনুষ্ঠান করছি। বৃষ্টি নামতে প্রকাশ্যে নগ্ন হয়ে বৃষ্টি দেবতাকে লোভ দেখিয়ে মাটিতে নামাতে চাইছি।
‘ভারতের সংস্কৃতি’ বলে শিল্প-সাহিত্য-সঙ্গীত-বিজ্ঞান ইত্যাদি নিয়ে যে প্রচার
চালানো হয়, সেই সংস্কৃতি উচ্চবর্ণের ভারতীয়দের সংস্কৃতি,
সর্বস্তরের ভারতীয়দের সংস্কৃতি নয়। শতকরা ৮০ ভাগ
ভারতীয়-ই তপসিলভূক্ত জাতি ও উপজাতিগোষ্ঠীর
অথবা হতদরিদ্র মানুষ। এই সংস্কৃতি সেই
শতকরা ৮০ ভাগ মানুষের সংস্কৃতি নয়।
কয়েক হাজার বছরে অনেক কিছুই পাল্টেছে। পাল্টায়নি শুধু ভারতীয় ট্রাইব বা উপজাতি গোষ্ঠীর সংস্কৃতি, জীবনযাত্রা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বহিরঙ্গের কিছুটা পরিবর্তন হলেও এখনও তারা স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সুযোগ না পেয়ে রোগ সারাতে জাদুচিকিৎসা ও জাদুবিশ্বাসের সাহায্য নেয়। এখনও পানীয় জল বলতে ডোবার দুর্গন্ধময় পচা জল। এখনও প্রাথমিক শিক্ষা নেবার ভাবনা করার মত কোনও অবস্থা- ই নেই। এখনও এ’দের পরিবারের মহিলারা বারবার গণধর্ষণের শিকার হয় উচ্চবর্ণের ‘বীরপুরুষ’দের হাতে। এখনও এক বেলা খাবার জুটলে বর্তে যায় ওরা। এখনও শোষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে সামান্য গলা উঁচু করলে, সে’সব গলা কেটে গ্রাম জ্বালিয়ে দিতে একটুও দেরি করে না উচ্চবর্ণেরা। এই বর্বরতা উচ্চবর্ণের সংস্কৃতি।
এমন অসম বিকাশ যে দেশে, যে পৃথিবীতে, সেখানে একই সঙ্গে সংস্কৃতির বিবর্তন ঘটেনি। কয়েক হাজার বছর আগের হরপ্পার নগর সভ্যতা যেমন আমাদের সংস্কৃতি, তেমন-ই আন্দামানের আদিবাসীদের আদিম জীবনযাত্রাও আমাদের সংস্কৃতি ।
গোটা পৃথিবীর মানব-প্রজাতির বিবর্তন বা অগ্রগমন একই সঙ্গে পরিচালিত হয়নি। মিশরে, ব্যাবিলনে, গ্রিসে হাজার হাজার বছর আগে যে সভ্যতার নিদর্শন আমরা পেয়েছি, হাজার হাজার বছর পরে, বর্তমানেও সেই সভ্যতার ধারে-কাছে পৌঁছবার অবস্থা নেই পৃথিবীর বিভিন্ন উপজাতি গোষ্ঠীর ।
বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠী ও উপজাতি গোষ্ঠীর মধ্যে উপাসনা-ধর্মের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ ঘটেছে বিভিন্নভাবে।
উপাসনা-ধর্মের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশের একটা চিত্র আঁকতে কেউ কেউ পাথুরে যুগের একটা ক্যালেন্ডার তৈরি করেছেন। যেমন—
১. আদি প্রত্নপ্রস্তর যুগের ১ম পর্ব–১ লক্ষ বছর ও তার বেশি প্রাচীন। ২. আদি প্রত্নপ্রস্তর যুগের ২য় পর্ব—কম-বেশি ৪০ হাজার বছর থেকে ১ লক্ষ বছর প্রাচীন।
৩. মধ্য-প্রত্নপ্রস্তর যুগ—কম-বেশি ২০ হাজার থেকে ৪০ হাজার বছর আগে। ৪. প্রত্ন-প্রস্তর যুগের শেষ পর্যায়—কম-বেশি ১২ হাজার থেকে ২০ হাজার বছর প্রাচীন।
৫. মধ্য-প্রস্তর যুগ—কম-বেশি ৬ হাজার বছর থেকে ১২ হাজার বছর প্রাচীন। ৬. নব্য-প্রস্তর যুগ—কম-বেশি ৪,৫০০- থেকে ৬,০০০ বছর প্রাচীন।
এই পর্ব ধরে উপাসনা-ধর্মের বিকাশ বা সংস্কৃতির বিকাশ নিয়ে কোনও আলোচনা করলে তা হবে ভুল। সমস্ত দেশে তো দূরের কথা একই দেশের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সংস্কৃতির বিকাশ একই সঙ্গে ঘটেনি, ঘটা সম্ভব নয়।
এক একটি সামাজিক বলয়ে অর্থাৎ এক একটি জাতি বা উপজাতি গোষ্ঠীর সামাজিক পরিবেশে এক এক ধরনের উপাসনা-ধর্ম-চিন্তা পালিত হয়েছে, হচ্ছে।
“অলৌকিক নয়,লৌকিক- ৫ম খন্ড ” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ
অধ্যায়ঃ এক
ধর্মঃ সংজ্ঞায় গোলমাল
অধ্যায়ঃ দুই
উপাসনা ধর্মঃ প্রাচীন মত
♦ উপাসনা- ধর্মের (religion) উৎপত্তি
♦ একঃ দৈব-প্রত্যাদেশ বা অপৌরুষেয় প্রত্যাদেশ
♦ দুইঃ ঈশ্বরে বিশ্বাস; সহজাত প্রবৃত্তি
♦ তিনঃ ধর্মীয় আচরণ বাদে ঈশ্বর বিশ্বাস
♦ আধুনিক নাস্তিক্যবাদ ‘মার্কসবাদ’
অধ্যায়ঃ তিন
‘সমকালীন যুক্তিবাদ’ নাস্তিক্যবাদের সঙ্গে বাড়তি কিছু
♦ ‘সমকালীন যুক্তিবাদ’ চির নতুন
♦ তোমার আমার দুই চেতনার ভালো-খারাপ
♦ মারাদোনার পায়ের জাদু ও যুক্তিবাদ
♦ প্রেমের রহস্যময়তা ও যুক্তিবাদ
♦ ‘ঈশ্বরে বিশ্বাস’, ‘বিজ্ঞানের বিশ্বাস’ : আকাশ-পাতাল
অধ্যায়ঃ চার
উপাসনা ধর্মঃ আধুনিক মত
♦ উপাসনা-ধর্ম : নৃতত্ত্ব ও সমাজতত্ত্বের দৃষ্টিতে
অধ্যায়ঃ পাঁচ
ভারতবর্ষের জাদু সংস্কৃতি
♦ আদিম উপজাতি, আধুনিক উপজাতিঃ একই কথা
♦ ধর্মীয় জাদু বিশ্বাস ও ম্যাজিক শোঃ দুই পৃথিবী
অধ্যায়ঃ ছয়
তন্ত্রের প্রথম ধাপ যোগ, তারপর…
অধ্যায়ঃ সাত
বৈদিক সাহিত্য, জাদু-বিশ্বাস, যজ্ঞে যৌনাচার
♦ সত্য খোঁজে মুক্তমন, হিসেব কষে ভন্ড
♦ বৈদিক সাহিত্যের গপ্পো ও দুই ডাক্তার
♦ বৈদিক সাহিত্যে জাদু-বিশ্বাস, যজ্ঞের নামে যৌনাচার
অধ্যায়ঃ আট
হিন্দু উপাসনা-ধর্মে তন্ত্র
অধ্যায়ঃ নয়
শক্তিধর্মে তন্ত্র
অধ্যায়ঃ দশ
রেইকি গ্রাণ্ডমাষ্টার, ফেং শুই ক্ষমতার দাবিদার, জ্যোতিষী ও অলৌকিক ক্ষমতার দাবিদারদের প্রতি