ধর্ম নামক বিষয়টির ব্যাপকতা আজকের দিনে বহুমাত্রিক এবং বিশাল। একেক ভাষায় এর ভাবার্থ একেক রকম। ইংরেজিতে প্রোপার্টি অর্থে যে ভাবে এটিকে ব্যবহার করি, বাংলায়ও অনুরূপ ‘বস্তুর গুণ’ বোঝাতে আমরা ধর্মকে ব্যবহৃত হতে দেখেছি বহুক্ষেত্রেই। যেমন আমরা বলি, আলোর ধর্ম ‘ঔজ্বল্য’, আগুনের ধর্ম ‘দহন’ ইত্যাদি।ধর্ম শব্দটির বুৎপত্তি ঘটেছে সংস্কৃত ‘ধৃ’ ধাতু থেকে। ধৃ ধাতুর সাথে ‘মন্’ প্রত্যয় যোগ করে ধর্ম শব্দের উৎপত্তি হয়েছে। কাজেই আক্ষরিক অর্থে সংজ্ঞায়িত করতে গেলে ‘যা ধারণ করে থাকে তাই ধর্ম’। তবে এই ‘ধারণ করার’ সংজ্ঞাতেই ধর্মের ব্যপ্তি আটকে থাকেনি। ইংরেজি ‘রিলিজিয়ন’ শব্দটির বাংলাও আমরা করেছি –ধর্ম, যার অর্থ প্রোপার্টি হতে ভিন্ন। কাজেই বাংলাভাষায় প্রোপার্টি এবং রিলিজিয়নের জন্য আলাদা আলাদা শব্দ ব্যবহৃত হয়নি। দুটোকেই ‘ধর্ম’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে অধুনা এ দুটি শব্দের পার্থক্য বোঝাতে অনেকে রিলিজিয়নের শব্দার্থ করেছেন ‘উপাসনা ধর্ম’। অর্থাৎ ঈশ্বর উপাসনা, ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের সাথে জড়িয়ে থাকা মানুষের যে আধ্যাত্মিক ক্রিয়াকাণ্ড তাকেই বলা হয়েছে মানুষের উপাসনা ধর্ম বা রিলিজিয়ন। এই অর্থে ইসলাম, খ্রীস্টিয়, হিন্দু এমন কি বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মকেও উপাসনা ধর্ম বা রিলিজিয়ন হিসেবে গণ্য করতে পারি। তবে ‘রিলিজিয়ন’ তথা ধর্মের মূল ভিত্তি হলো ব্যক্তি ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস, যদিও বৌদ্ধ এবং জৈন ধর্মের মত ‘নিরীশ্বরবাদী’ দর্শনগুলো এই সংজ্ঞার বাইরেই পড়বে।
ধর্মের উৎপত্তির একটা ইতিহাস আছে। প্রাগৈতিহাসিক যুগে আদিম মানুষ ছিল অসহায়। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, হিংস্র পশুর দাপাদাপি সব কিছু মিলিয়ে সে ছিল সত্যিকার অর্থেই নিরাশ্রয়। সেই সাথে খাদ্যের অপর্যাপ্ততা, রোগ ব্যাধি ও মহামারী ছিল নিত্যসঙ্গি। জীবন রক্ষার প্রয়োজনেই একটা সময় সূর্য, ঝড়, ঝঞ্চা, আগুন, বিদ্যুৎ, পর্বত, পশু ইত্যাদিকে বশ করার উপায়ের কথা মানুষ চিন্তা করে। হয়ত কখনো দাবানলে জঙ্গলে গাছের পর গাছ ধংস হতে থাকলো, আগুনের এই শক্তি দেখে হতবিহবল হয়ে মানুষ আগুনের উপাসনা শুরু করল, যাতে অগ্নিদেব সন্তুষ্ট থাকলে ভবিষ্যতে এ ধরনের বিপর্যয় এড়ানো যায়। এভাবেই মানুষের অসহায়ত্ব এবং প্রয়োজনের তাগিদে ধর্মের প্রাথমিক রূপ হিসেবে প্রকৃতি এবং প্রতীকের উপর অলৌকিক শক্তি আরোপ করে তাদের পূজা অর্চনা শুরু হয়। মায়াবী কৌশল বা ইন্দ্রজালের মাধ্যমে অশরীরী শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ বা বশ করার চেষ্টা চলে। ক্রমশ চলে আসে স্তব, স্তুতি, পুজা ও প্রার্থনা। এইভাবেই ঐন্দ্রজালিক কাজকর্মকে আশ্রয় করে গড়ে উঠতে থাকে মানুষের ধর্মবিশ্বাস। নিশ্চিন্ত ও নিরুপদ্রপ জীবনের আকুতিকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হতে থাকে নানা ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান। এইসব অনুষ্ঠান ও পুজো-পার্বনকে সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করারা জন্য আবার গড়ে উঠলো পুরোহিত শ্রেণি। পুরোহিত শ্রেণি আবার নিজেদের কায়েমী স্বার্থ সুকৌশলে রক্ষা করতে আশ্রয় নিলো ধর্মের।
সমাজবিবর্তনের এক বিশেষ পর্যায়ে এলো রাষ্ট্র। ধর্মও ক্রমশ প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিলো। যে অন্যায় ও অবিচার শোষিত মানুষ অসহায় ভাবে ভোগ করে, তার পরিপূরক হিসেবে স্বর্গ, নরক, পারলৌকিক বিচার প্রভৃতির মাধ্যমে মানুষের আশা এবং আকাংখাকে শাসক শ্রেণি কাজে লাগালো স্বীয় স্বার্থে। সাধারণ মানুষের আধ্যাত্মিকতা এবং কল্পণাকে রাষ্ট্রযন্ত্র বিভিন্নভাবে বিশ্বাসযোগ্য এবং স্থায়ী করে রাখার প্রয়াস পায় । এক সময় মানুষের আধ্যাত্মিক চাহিদা এবং অজানাকে ব্যাখ্যা করার উদগ্র আগ্রহ থেকে যে ধর্মের জন্ম হয়েছিল, সেই ধর্মই ধীরে ধীরে প্রচলিত সামাজিক অনুশাসন ও পশ্চাৎপদ রীতিনীতিকে নীতি নৈতিকতার মোড়কে পুড়ে পরিবেশন শুরু করে। ধর্ম পরিণত হয় পুরুষতন্ত্র এবং শোষকশ্রেণির এক ধরনের প্রতিক্রিয়াশীল হাতিয়ারে। রক্ষণশীল মানুষেরা ধর্ম রক্ষার নামে তৈরি করে নানা রকমের টাবু। নারী অধিকার অবদমন, সমকামীদের প্রতিবিদ্বেষ, জাতিভেদ, বর্ণবাদ, সতীদাহ, জিহাদ ইত্যাদি নানা ধরনের ধর্মীয় সংস্কার এসে প্রগতিশীলতার চাকাকে পেছনের দিকে চালিত করে।
এক বছর আগে ভারতের তাজ হোটেল যখন সন্ত্রাসবাদী হামলায় আক্রান্ত হলো, তখন ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’ নামে একটি লেখা মুক্তমনায় লিখেছিলাম”। লেখাটিতে বিবর্তনবাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ধর্মের প্রায়োগিকতাকে ব্যাখা করার একটি প্রয়াস নেয়া হয়েছিল। লেখাটিতে আমি ব্যাখ্যা করে বলেছিলাম যে, ‘বিশ্বাসের একটা প্রভাব সবসময়ই সমাজে বিদ্যমান ছিল। না হলে এই বিংশ শতাব্দীতে এসেও প্রাচীণ ধর্মগুলো স্রেফ মানুষের বিশ্বাসকে পুঁজি করে এভাবে কখনোই টিকে থাকে থাকতে পারতো না। এটা মনে করা ভুল হবে না যে, ‘বিশ্বাস’ ব্যাপারটা মানব জাতির বেঁচে থাকার পেছনে হয়ত কোনো বাড়তি উপাদান যোগ করেছিল একটা সময়। মানুষ আদিমকাল থেকে বহু সংঘাত, মারামারি এবং রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে গিয়ে আজ এই পর্যায়ে এসে পৌছেছে। একটা সময় সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করাটা ছিল মানব জাতির টিকে থাকার ক্ষেত্রে অনেক বড় নিয়ামক। যে গোত্রে বিশ্বাস ঢুকিয়ে দিতে পারা গিয়েছিল যে যোদ্ধারা সাহসের সাথে যুদ্ধ করে মারা গেলে পরলোকে গিয়ে পাবে অফুরন্ত সুখ, সাচ্ছ্বন্দ্য, হুর পরী উদ্ভিন্নযৌবনা চিরকুমারী অপ্সরা, (আর বেঁচে থাকলে তো আছেই সাহসী যোদ্ধার বিশাল সম্মান আর পুরস্কার) – তারা হয়ত অনেক সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করেছে এবং অধিক হারে উত্তরাধিকার তৈরি করতে পেরেছে। বিবর্তনের নিয়মেই হয়ত বিশ্বাসনির্ভরতার বিভিন্ন বিষয়গুলো আমাদের মধ্যে এমনিভাবে ঢুকে গেছে যে পুরো প্রক্রিয়াটি আমাদের কাছে খুব স্বাভাবিক একটি ব্যাপার বলে মনে হয়। মুক্তমনায় প্রকাশিত ইবুক ‘বিজ্ঞান ও ধর্মঃ সঙ্ঘাত নাকি সম্বনয়’ এ রিচার্ড ডকিন্সের একটি চমৎকার প্রবন্ধ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে ‘ধর্মের উপযোগিতা নামে । প্রবন্ধটিতে অধ্যাপক ডকিন্স একজন বিবর্তনবাদী বিজ্ঞানীর দৃষ্টিভঙ্গী থেকে বিশ্বসের বিভিন্ন দিক নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন।
অধ্যাপক ডকিন্সের লেখাটি থেকে একটা গুরুত্বপুর্ণ বিষয় উল্লেখ করা যেতে পারে। মানব সভ্যতাকে অনেকে শিশুদের মানসজগতের সাথে তুলনা করেন। শিশুদের বেঁচে থাকার প্রয়োজনেই একটা সময় পর্যন্ত অভিভাবকদের সমস্ত কথা নির্দ্বিধায় মেনে চলতে হয় –এ আমরা জানি। ধরা যাক একটা শিশু চুলায় হাত দিতে গেল, ওমনি তার মা বলে উঠল – চুলায় হাত দেয় না – ওটা গরম! শিশুটা সেটা শুনে আর হাত দিল না, বরং সাথে সাথে হাত সরিয়ে নিলো। মার কথা শুনতে হবে – এই বিশ্বাস পরম্পরায় আমরা বহন করি – নইলে যে আমরা টিকে থাকতে পারবো না, পারতাম না। এখন কথা হচ্ছে – সেই ভালো মা-ই যখন অসংখ্য ভালো উপদেশের পাশাপাশি আবার কিছু মন্দ বা কুসংস্কারাচ্ছন্ন উপদেশও দেয় – ‘শনিবার ছাগল বলি না দিলে অমঙ্গল হবে’, কিংবা ‘রসগোল্লা খেয়ে অংক পরীক্ষা দিতে যেও না – গেলে গোল্লা পাবে’ জাতীয় – তখন শিশুর পক্ষে সম্ভব হয় না সেই মন্দ বিশ্বাসকে অন্য দশটা বিশ্বাস কিংবা ভালো উপদেশ থেকে আলাদা করার। সেই মন্দবিশ্বাসও বংশপরম্পরায় সে বহন করতে থাকে অবলীলায়। সব বিশ্বাস খারাপ নয়, কিন্তু অসংখ্য মন্দ বিশ্বাস হয়ত অনেক সময় জন্ম দেয় ‘বিশ্বাসের ভাইরাসের’। এগুলো একটা সময় প্রগতিকে থামাতে চায়, সভ্যতাকে ধ্বংস করে। যেমন, ডাইনি পোড়ানো, সতীদাহ, বিধর্মী এবং কাফেরদের প্রতি ঘৃণা, মুরতাদদের হত্যা এগুলোর কথা বলা যায়। ডেনিয়েল ডেনেটের সাম্প্রতিক ‘ব্রেকিং দ্য স্পেল’ বইয়ে এর ধরনের পিঁপড়ের মাথায় ল্যান্সফ্লুক প্যারাসাইটের উদাহরণ হাজির করেছেন। ল্যাংসেট ফ্লুক নামের প্যারাসাইটের কারণে পিঁপড়ের মস্তিষ্ক যখন আক্রান্ত হয়ে পড়ে, তখন পিঁপড়ে কেবল চোখ বন্ধ করে কলুর বলদের মতো কেবল পাথরের গা বেয়ে উঠা নামা করে।
অভিজিৎ রায়, বিশ্বাসের ভাইরাস, মুক্তমনা,http://mukto-mona.com/banga_blog/?p=290
বিজ্ঞান ও ধর্মঃ সংঘাত নাকি সমন্বয় ? (২০০৮) : মুক্তমনা ইবুক, http://www.mukto- mona.com/project /Biggan_dhormo 2008/
বিজ্ঞান ও ধর্মঃ সংঘাত নাকি সমন্বয়’ বইয়ের ষষ্ঠ অধ্যায় দ্রঃ
Breaking the Spell: Religion as a Natural Phenomenon, Daniel C. Dennett, Viking Adult, 2006
ধর্মীয় বিশ্বাসগুলোকেও অধ্যাপক ডেনেট মানুষের জন্য একেকটি প্যারাসাইট বলে মনে করেন। মানুষের এই প্যারাসাইট আক্রান্ত মনন স্বীয় বিশ্বাস রক্ষার জন্য চোখ বুজে প্রাণ দেয়, বিধর্মীদের হত্যা করে, টুইন টাওয়ারের উপর হামলে পড়ে, সতী নারীদের পুড়িয়ে আত্মতৃপ্তি পায় ইত্যাদি…। মনোবিজ্ঞানী ডেরেল রে তার ‘The God Virus: How religion infects our lives and culture’ বইয়ে বলেন, জলাতঙ্কের জীবাণু দেহের ভিতরে ঢুকলে যেমন মানুষের কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র বিকল হয়ে যায়, ঠিক তেমনি ধর্মীয় বিশ্বাসগুলোও মানুষের চিন্তা চেতনাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে, তৈরি হয় ভাইরাস আক্রান্ত মননের। ডেরেল রে তার বইয়ে বলেন –
Virtually all religion rely upon early childhood indoctrination as the prime infection strategy… Biological virus strategies bear a remarkable resemblance to method of religious propagation. Religious conversion seems to affect personally. In the viral paradigm, the God virus infects and takes over critical thinking capacity of individual with respect to his or her own religion, much as rabies affects specific parts of the central nervous system
কিছু প্রাচীন সভ্যতার ইতিহাস থেকে জানা যায়, যখন কোনো নতুন প্রাসাদ কিংবা ইমারত তৈরি করা হত, তার আগে সেই জায়গায় শিশুদের জীবন্ত কবর দেওয়া হতো -এই ধারণা থেকে যে, এটি প্রাসদের ভিত্তি মজবুত করবে। অনেক আদিম সমাজেই বন্যা কিংবা অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য কুমারী উৎসর্গ করার বিধান ছিল; কেউ কেউ সদ্যজন্মলাভ করা শিশুদের হত্যা করত, এমনকি খেয়ে ও ফেলত। কোনো কোনো সংস্কৃতিতে কোনো বিখ্যাত মানুষ মারা গেলে অন্য মহিলা এবং পুরুষদেরও তার সাথে জীবন্ত কবর দেওয়া হত, যাতে তারা পরকালে গিয়ে পুরুষটির কাজে আসতে পারে। ফিজিতে ‘ভাকাতোকা” নামে এক ধরনের বিভৎস রীতি প্রচলিত ছিল যেখানে একজনের হাত-পা কেটে ফেলে তাকে দেখিয়ে দেখিয়ে সেই কর্তিত অংগগুলো খাওয়া হত। আফ্রিকার বহু জাতিতে হত্যার রীতি চালু আছে মৃত-পূর্বপুরুষের সাথে যোগাযোগ স্থাপনের উদ্দেশ্য। ভারতে সতীদাহের নামে হাজার হাজার মহিলাদের হত্যা করার কথা তো সবারই জানা। এগুলো সবই মানুষ করেছে ধর্মীয় রীতি-নীতিকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে, অদৃশ্য ঈশ্বরকে তুষ্ট করতে গিয়ে। এধরনের ‘ধর্মীয় হত্যা’ সম্বন্ধে আরো বিস্তৃতভাবে জানবার জন্য ডেভিড নিগেলের ‘Human Sacrifice: In History And Today’ বইটি পড়া যেতে পারে?”। এগুলো সবই সমাজে ‘বিশ্বাসের ভাইরাস” নামক আগাছার চাষ ছাড়া আর কিছু নয়। সমকামের প্রতি অহেতুক ঘৃণা-বিদ্বেষ তৈরিতেও ধর্মের বিশাল ভুমিকা আছে। প্রথম দিকের প্রাচীন জনগোষ্ঠীর মধ্যকার ধর্মগুলো এত প্রাতিষ্ঠানিক রূপে ছিল না বলে সমকামের প্রতি বিদ্বেষ এতো তীব্রভাবে অনুভূত হয়নি। ধর্ম প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাওয়ার পর থেকেই পাদ্রী, পুরোহিত মোল্লারা ঢালাওভাবে সমকামিতাকে ‘ধর্মবিরুদ্ধ যৌনাচার’, ‘মহাপাপ’, ‘ প্রকৃতিবিরুদ্ধ বিকৃতি’ প্রভৃতি হিসেবে আখ্যা দিতে শুরু করে এবং এর ধারাবাহিকতায় শুরু হয় পৃথিবী জুড়ে সমকামীদের উপর লাগাতার নিগ্রহ এবং অত্যাচার। এই অধ্যায়ে পৃথিবীর প্রধান প্রধান ধর্মমত গুলোর দৃষ্টিতে সমকামিতা ব্যাপারটি কিরকম তা বিস্তৃতভাবে ব্যাখ্যা করার প্রয়াস নেয়া হয়েছে।
প্রাচীন জনগোষ্ঠীর ধর্ম
প্রাচীন কালের অনেক ধর্ম এবং সংস্কৃতিতে প্রথম থেকেই সমকামিতার স্বাভাবিক প্রকাশ ঘটেছিল। প্রচলিত ছিল সমকামিতাকে ঘিরে নানা ধরনের আচার অনুষ্ঠান। প্রাচীন গ্রীসের ধর্মশাস্ত্র ও পুরাণ এবং সংস্কৃতিতে সমকাম-স্পৃহার কথা জানা যায় (এই বইয়ের অষ্টম অধ্যায়ে গ্রীক সভ্যতায় সমকামিতা অংশ দ্রষ্টব্য)। ধর্মীয়ভাবে সমপ্রেম এখানে স্বীকৃত ছিল। ‘ভেনাস’ ছিলেন তাদের কামনার দেবী। এই দেবীই আবার সমকামীদের উপাস্য ছিলেন। এছাড়া ‘প্রিয়াপ্রাস” নামেও আরেক দেবীকেও সমকামীরা আরাধনা করত বলে শোনা যায়। তাহিতির বিভিন্ন জায়গায় সমকামে আসক্ত ব্যক্তিদের আরাধ্য দেবতার মূর্তির সন্ধান পাওয়া গেছে। আনাতেলিয়া, গ্রীস এবং রোমার বিভিন্ন মন্দিরে ‘সিবিলি’ এবং ‘ডাইওনীসস’ এর পুজো ব্যাপকভাবে শুরু হয়েছিল। সিবিলির পুরোহিতেরা গাল্লি নামে পরিচিত ছিলেন। এরা নারীবেশ ধারণ করতেন। মাথায় নারীর মতো দীর্ঘ কেশ রাখতে পছন্দ করতেন। এরা সমকামী ছিলেন বলেও অনুমিত হয়। খ্রিষ্টপূর্ব ১৫০০ থেকে ১২০০ সালের মধ্যে সিবিলি পুজো ছড়িয়ে পড়ে এশিয়া মাইনরের হিটটাইট নামের ইন্দো ইউরোপীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে। এর পর এশিয়া মাইনর থেকে সিবিলি পুজো পারস্য দেশেও ছড়িয়ে পড়ে। পারস্য সাম্রাজ্য বিস্তারের ফলে এ সমস্ত প্রথা পৃথিবীর বিভিন্ন দিকে প্রসারিত হয়। প্রত্নতাত্ত্বিকেরা আফগানিস্তানে খননকার্য চালিয়ে একটি রৌপ্য ফলকের উপর সিবিলির মূর্তি আবিস্কার করেন।
অনুমান করা যেতে পারে যে, আফগানিস্তান হয়ে এই দেবীর পুজো কোনো এক সময়ে ভারতে ছড়িয়ে পড়েছিল। বর্তমানে গুজরাটের সঙ্ঙ্খলপুরে বহুচোরা মাতার যে মূর্তি আছে তা অনেকটা ‘সিবিলির’ আদলে রচিত। খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতকের মাঝামাঝি সময়ে পারস্যে ‘মনিকিজম’ (manichaeism) নামে এক বিশেষ ধর্মমতের উন্মেষ ঘটে। প্রফেট মানি ছিলেন এই ধর্মমতের প্রবক্তা। মানির অনুগামীরা তাদের পুরুষাঙ্গ ছেদন করে নপুংসকে রূপান্তরিত হতেন। এরপর ভ্যালেরিয়াস এর নেতৃত্বে ভ্যালেসি নামে এক খ্রিষ্টান ধর্মীয় সম্প্রদায়ের আবির্ভাব ঘটে। এরাও ছিলেন নপুংসক। আঠারো শতকের মধ্যভাগে রাশিয়ার স্কোপ্টসি (Skoptsy) নামে আরো এক নপুংসক খ্রিষ্টান ধর্মীয় সম্প্রদায়ের আবির্ভাব ঘটে। পরে এই সম্প্রদায়ের আদর্শ রোমানিয়াতেও ছড়িয়ে পড়েছিল। এই সব খ্রিষ্টান যাজকদের যৌনজীবন সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা না গেলেও তাদের জীবনের সাথে সমপ্রেমের একটা সূক্ষ সম্পর্ক অনুমিত হয়।
আমেরিকার মায়া এবং এজটেক সভ্যতার ধর্মীয় সংস্কৃতিতে সমপ্রেমের সন্ধান পাওয়া যায়। এখানে ধর্মীয় প্রথা অনুযায়ী বিভিন্ন মন্দিরের পুরোহিতেরা অবিবাহিত অবস্থায় জীবন কাটাতেন। তারা অবিবাহিত জীবনে বালক সম্ভোগে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। সমকামিতার এই বিশেষ রূপ ধর্মীয়ভাবে সেখানকার সমাজে স্বীকৃত ছিল। প্রখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী গ্রীনবার্গের গবেষণা থেকে জানা যায় যে, জ্যোচিপিল্লি (Xochipilli) নামক এক দেবতাকে তুষ্ট করার জন্য পুরোহিতেরা সমকামে প্রবৃত্ত হতেন। তবে ধর্মীয়ভাবে সমকামিতার চর্চা বিচ্ছিন্নভাবে করা হলেও সার্বিকভাবে মায়া এবং এজটেক সভ্যতা সমকামিতার প্রতি অসহিষ্ণু ছিল বলেই মনে করা হয়। মায়া সভ্যতায় সমকামের কিছুটা গ্রহণযোগ্যতা থাকলেও এজটেক সভ্যতার আইনকানুন সমকামিতার প্রতি ছিল অত্যন্ত কঠোর। সমকামিতার অপরাধে সমকামীদের জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপ করা হতো, নয়তো পুজার বেদীতে উৎসর্গ করা হতো ।
আমেরিকার উত্তর-পশ্চিম উপকূলে ‘তালিংগিৎ’ (Tlingit) নামে এক উপজাতি বাস করতো। তাদের মধ্যে উপকথা প্রচলিত ছিল যে, উপজাতির এক নারীকে সূর্যদেব বিয়ে করেন। এই নারীর গর্ভে সূর্যদেবের ঔরসে আট সন্তানের জন্ম হয়। অষ্টম সন্তান ছিল এক অর্ধনারীশ্বর। তারা বিশ্বাস করে এর পর থেকে মানব মানবীর মিলনেও অর্ধনারীশ্বরের জন্ম হতে থাকে। এই উপজাতির সকলে বিশ্বাস করতো যে, এই বিশেষ ধরনের মানুষেরা ঐশ্বরিক ক্ষমতা সম্পন্ন ছিল। এছাড়া উত্তর আমেরিকার আলাস্কাসের অ্যালিয়ুট, ক্যালিফোর্ণিয়ার লেচি এবং কানাডার কাসকা জনগোষ্ঠীর মধ্যেও পুরুষ রূপান্তরকামীদের এবং সমকামীদের সন্ধান পাওয়া যায়। এরা বয়স্ক বিবাহিত পুরুষের এ সমস্ত সামাজিক সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হত, এবং উপপত্নীর মর্যাদা পেত। রীতিনীতির পেছনে ছিল প্রচলিত ধর্মীয় অনুশাসনের সমর্থন।
Nigel Davies, Human Sacrifice–In History and Today, William Morrow & Co, 1981
অজয় মজুমদার, নিলয় বসু, সমপ্রেম, পূর্বোক্ত।
বার্দাশদের কথা
আঠারো শতকের গোঁড়ার দিকে ফরাসী পরিব্রাজকের দল উত্তর আমেরিকায় পদার্পন করে নেটিভ ইন্ডিয়ান জনগোষ্টিদের মধ্যে এক অদ্ভুত জিনিস লক্ষ্য করলেন। এই গোত্রের অনেক পুরুষ নারীবেশ ধারণ করে এবং সঙ্গি হিসেবে পুরুষদের চয়ন করে। তারা এদেরকে বার্দাশ (Berdache) নামে অভিহিত করেন।
ফরাসী পরিব্রাজকেরা হতবিহবল হয়ে লক্ষ্য করেন, এই রূপান্তরকামী এবং সমকামী প্রবৃত্তিকে শুধু সহনশীল দৃষ্টি থেকেই দেখা হয় না, সেই সাথে শ্রদ্ধা এবং সম্মানও করা হয়।
পুরুষ বার্দাশেরা সাধারণত রান্না বান্না, কাপড় চোপড় গোছানো এবং গৃহস্থালির মতো ‘মেয়েলী’ কাজে নিয়োজিত থাকে, অন্যদিকে মেয়ে বার্দাশেরা অস্ত্র সস্ত্র বানানো এবং শিকারের সরঞ্জাম তৈরিতে নিজেদের নিয়োজিত করে। তারা এমনকি যুদ্ধেও অংশ নিয়ে থাকে। নেটিভ ইন্ডিয়ানদের অনেক গোত্রে পুরুষ বার্দাশদের ‘নারী” হিসেবে দেখা হলেও(এবং তাদেরকে নারী হিসেবে গন্য করে বিভিন্ন ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করা হয়), তবে অধিকাংশ গোত্রেই এদেরকে নারী কিংবা পুরুষের বাইরে ‘তৃতীয় প্রকৃতি’ হিসবেই বিবেচনা করা হয়।
বার্দাশদের সমকামী হিসেবে চিহ্নিত করার কারণ আছে। প্রধাণ কারণ হলো বার্দাশেরা বিপরীত লিঙ্গের পোষাক পরিধান করলেও এরা শয্যাসঙ্গী হিসেবে বেছে নেয় সমলিঙ্গের সদস্যদের। পুরুষ বার্দাশরা সাধারণত ছেলেদের সাথেই সম্পর্ক স্থাপন করে। অন্যদিকে মেয়ে বার্দাশদের মধ্যে ‘স্ত্রী রাখার’ কিংবা দীর্ঘদিন ‘নারী সঙ্গী’ রাখার রেওয়াজ আছে। তবে এই রেওয়াজের বাইরেও বয়স্ক পুরুষেরা অল্প বয়সী মেয়েলী স্বভাবের ছেলেদের সঙ্গে যৌনসম্পর্ক স্থাপন করে। এই সম্পর্ক গড়ে উঠে সামাজিক অনুমদনের ভিত্তিতে। তবে এক বার্দাশ কখনোই আরেক বার্দাশের সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করে না, ব্যাপারটিকে সামাজিকভাবে অগম্য ব্যভিচার (incest) হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের অনুষঙ্গ হিসবে অস্ট্রেলিয়ার উত্তরে পাপুয়া নিউগিনিতে সমকামিতা এবং উভকামিতার ব্যাপক প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়। নৃতত্ত্ববিদ গিলবার্ট হার্ড ১৯৭০ সাল থেকে শুরু করে প্রায় বিশ বছর ধরে এই অঞ্চলে আদিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে যৌন্তা সংক্রান্ত গবেষণা চালান। তার গবেষণা থেকে বেরিয়ে আসে অভিনব কিছু তথ্য। এই অঞ্চলে সাম্বিয়া নামে এক আদিম জনগোষ্ঠীর বাস করে। এই জনগোষ্ঠীর মধ্যে ‘পুরুষত্ব নির্মাণের’ জন্য এদের মধ্যে এক ধরনের সামাজিক প্রথা প্রচলিত আছে। বীর্যকে এরা পুরুষত্বের আধার বলে মনে করে। অতিমাত্রায় বীর্যস্খলনের ফলে পুরুষত্ব হ্রাস পেতে পারে কিংবা মৃত্যুও হতে পারে বলে তারা বিশ্বাস করে। তাই বিবাহিত জীবনে পুরুষেরা এক বিশেষ ধরনের গাছের রস সেবন করে। সাম্বিয়ারা মনে করে নারী এবং পুরুষ প্রাপ্ত বয়স্ক হয় ভিন্ন ভিন্ন যাত্রাপথের মধ্য দিয়ে। মেয়েদেরকে প্রকৃতিকভাবেই ‘নারী” বলে মনে করা হয়, কিন্তু ছেলেরা স্বাভাবিকভাবে ‘পুরুষ” হয়ে উঠে না, তাদেরকে পুরুষ হয়ে উঠবার জন্য ধর্মীয় এবং সামাজিক আচারের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। কৈশোর পেরুলেই ছেলে সন্তানদের মায়ের কাছ থেকে আলাদা করে ফেলা হয়। এই সময় প্রাপ্তবয়স্ক যুবকদের সাথে মৈথুনে লিপ্ত হতে হয়। সাম্বিয়া গোষ্ঠীর মানুষেরা বিশ্বাস করে ছেলেদের দেহে বাইরে থেকে বীর্য প্রবেশ না করলে তারা সত্যিকার পুরুষ হয়ে উঠবে না। তারা মনে করে সাহস, শক্তি, শিকারের দক্ষতা প্রভৃতি এভাবেই দেহে সঞ্চালিত হয়। বীর্যকে তারা মাতৃদুগ্ধের সমান উপকারী বলে মনে করে। বীর্য এভাবে প্রবেশ না করালে কিশোরদের দেহ ক্ষুদ্রকায় থেকে যাবে বলে তারা আশংকা করে। এ সমস্ত বীর্যদানকারী যুবকেরা পরবর্তীকালে বিবাহিত জীবনে প্রবেশ করে। শিশু কিশোরেরাও বড় হয়। একই পদ্ধতিতে তারা তখন অন্য কিশোরের দেহেও বীর্য প্রবেশ করায়। তারপর এরাও পরে বিয়ে করে নারী সংসর্গ উপভোগ করে। কাজেই দেখা যাচ্ছে, তারা বিষমকামী হলেও জীবনের একটি সময়ে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সমকামের চর্চা করে। এদেরকে তাই বিশেষ ধরনের উভকামীও বলা যেতে পারে।
পাশাপাশি, আফ্রিকার বেনিনের ফন এবং তানজানিয়ার নিয়াকুসা জনগোষ্ঠীর মধ্যে সমপ্রেমের সন্ধান পাওয়া গেছে। ঘানার পশ্চিমাঞ্চলে ধর্মীয় অনুমোদন সাপেক্ষে সমলিঙ্গের বিয়ে প্রচলিত ছিল। নারী-পুরুষ উভয়েই সমলিঙ্গের বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারতো। সুদানের আজান্দি সমাজে কিশোর বয়সী বালকদের বয়স্ক পুরুষের সাথে বিয়ে দেয়া হত। এ ছাড়া দক্ষিণ আফ্রিকার জুলু এবং জোসা আদিবাসীদের মধ্যেও এই একই ধরনের প্রথা প্রচলিত ছিল। দক্ষিণ আফ্রিকার ছোট দেশ লোসাথো এবং বান্টু ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর মধ্যেও সমকামিতার ধর্মীয় অনুমোদনের সন্ধান পাওয়া যায়। জাম্বিয়ার ইলা নামক আদিবাসীদের মধ্যে ‘মাওয়ামী’ নামের এক পুরোহিত শ্রেণির মধ্যে রূপান্তরকামিতা এবং সমকামিতা দৃশ্যমান। অ্যাঙ্গোলার অ্যাম্বো, উগান্ডার লুগবারা প্রভৃতি আদিবাসী সমাজেও রূপান্তরকামী পুরোহিত সমাজের অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়। গবেষকেরা রূপান্তরকামিতা আর সমকামিতার উপস্থিতি লক্ষ্য করেছেন নাইজেরিয়ার হাউসা, সেনেসাল ও গাম্বিয়ার উলোফ ও লেবউ আদিবাসী সমাজেও।
Gilbert Herdt, Sambia Sexual Culture: Essays from the Field, University Of Chicago Press 1999
বিখ্যাত যৌনবিশেষজ্ঞ জন মানি এই উভকামিতাকে sequential bisexuality( হিসেবে অভিহিত করেছেন (Ref. John Money Gay, Straight, and In Between : The Sexology of Erotic Orientation, Oxford University Press, USA, 1988)।
হিন্দু ধর্ম
হিন্দু ধর্ম আদপে কোনো ধর্ম নয়। এটিকে এক ধরনের সংস্কৃতি বলাই ভালো। হিন্দু ধর্ম আসলে নানা মুনির নানা মতের সমন্বয়ে গড়ে উঠা জগাখিচুড়ি ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। এতে একেশ্বরবাদ আছে, বহুঈশ্বরবাদ আছে, আছে এমনকি নিরীশ্বরবাদও (যদি চার্বাক দর্শনকে এর অন্তর্ভুক্ত ধরি)। এতে বহুদেব দেবীর অস্তিত্ব যেমন আছে, তেমনি পাশাপাশি আবার আছে ‘অদ্বৈত ব্রহ্মের’ ধরাণা। এতে মূর্তিপুজারী ভক্ত যেমন আছে, তেমনি আবার আছে মূর্তিহীন শাক্ত এবং ব্রাহ্মরা। এ ধরনের নানা ধরনের পরষ্পরবিরোধী বিচিত্র ধ্যান ধারণার সমন্বয়েই গড়ে উঠেছে হিন্ধু ধর্ম। এই বৈচিত্রের কারণ ধর্মটিতে সমন্বয় ঘটেছে আর্য, অনার্য, প্রাগার্য, বাহ্লীক, গ্রীকসহ নানা প্রাচীণ সংস্কৃতির মিশ্রণ। জহরলাল নেহেরু ‘The Discovery India’ বইয়ে হিন্দু ধর্মের যে সংজ্ঞা দিয়েছেন, তা আমার কাছে সবসময়ই অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক মনে হয়-
“HINDUISM as a faith is vague, amorphous, many sided, all things to all men. It is hardly possible to define it, or indeed to say definitely whether it is a religion or not, in the usual sense of the word. In its present form, and even in the past, it embraces many beliefs and practices, from the highest to the lowest, often opposed to or contradicting each other.”
হিন্দু শব্দটি পারস্যদেশীয় ‘সিন্ধু’ থেকে এসেছে বলে অনুমিত হয়। বলা হয়ে থাকে, পারস্যভাষায় ‘স’ শব্দটিকে ‘হ’ এর মতো উচ্চারণ করা হয়। তারা সিন্ধু অববাহিকার লোকদের ‘হিন্ধু” বলে অভিহিত করতো। কালের পরিক্রমায় এই ‘হিন্ধু’ শব্দটিই ‘হিন্দু’তে রূপান্তরিত হয়। আরবীয় ‘আল হিন্দ’ শব্দটির মাধ্যমেও ‘হিন্দু’ শব্দটি জনপ্রিয় হয় বলে ধারণা করা হয়। এই শব্দটির মাধ্যমে ‘সিন্ধু নদের তীরে বসবাসকারী জনগণ’কে বোঝানো হত। একসময় হিন্দুস্থান বলতে শুধু উত্তরভারতকে বোঝানো হলেও পরবর্তীতে হিন্দুস্থানের মাধ্যমে সারা ভারতবর্ষকেই চিহ্নিত করা হয়।
হিন্দুধর্মে সমকামের ব্যাপারে আলোচনা করা একটু কঠিনই, কারণ সমকামিতা কিংবা সমপ্রেমের সুনির্দিষ্ট সমার্থক শব্দ সংস্কৃত শব্দভান্ডারে ছিল না। বিভিন্ন ধর্মশাস্ত্র অনুযায়ী সমকামী যৌনক্রিয়াকে চারটি ভাগে ভাগ করা যায় – (ক) পুরুষে পুরুষে যৌন সম্পর্ক (খ) নারীর সঙ্গে নারীর যৌনক্রিয়া (গ) পায়ু সঙ্গম (ঘ) মুখমৈথুন। প্রথম দুটি ভাগকে সমলিঙ্গের যৌনসম্পর্কিত হিসেবে গন্য করা গেলেও পরের দুটো সমকামিতার সাথে সম্পর্কযুক্ত নাও হতে পারে। বিষমকামী সম্পর্কেও পায়ু এবং মুখমৈথুনের যোগ থাকতে পারে। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার হলো প্রাচীন হিন্দুধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এমনকি বিষম যৌনসম্পর্কের মুখ ও পায়ু সঙ্গমকেও সমকামিতার পর্যায়ভুক্ত ধরা হতো। বস্তুত প্রাচীন হিন্দু ধর্মের সমকামিতা আর আজকের সমকামিতার মধ্যে বিস্তর ফারাক। এমনকি প্রাচীন গ্রীসে যে ধরনের সমকাম প্রচলিত ছিল সেটার সাথেও হিন্দু ধর্মে বর্ণিত সমকামে পার্থক্য রয়েছে।
হিন্দুধর্মের প্রাচীনতম গ্রন্থগুলোর মধ্যে মনুসংহিতা অন্যতম। কথিত আছে এটা প্রথম মানব সায়ম্ভব মনু কর্তৃক লিখিত হয়। মনু ব্রহ্মার কাছ থেকে স্মৃতিশাস্ত্র পাঠ করে এটি মরীচি প্রমুখকে পাঠ করান। ভৃগু মনুর আদেশে এই ধর্মশাস্ত্র ঋষিদের নিকট ব্যাখ্যা করেন। এটিই মনুসংহিতা। মনুসংহিতাকে হিন্দু আইনের ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অত্যন্ত পুরুষতান্ত্রিক এবং নারীদের জন্য প্রচন্ড অবমাননাকর গ্রন্থের নাম মনুসংহিতা। এই গ্রন্থের ছত্রে ছত্রে বর্ণবাদ, শুদ্র সহ নিম্নবর্ণিয় হিন্দুদের মানুষ হিসবেই গন্য করেনি গ্রন্থটি। সমকামীদের প্রতিও গ্রন্থটি অনুদার, যদিও এদের নিয়ে খুব বেশি আলোচনা গ্রন্থটিতে স্থান পায়নি। যে দু’চারটি ক্ষেত্রে সমকামিতার প্রসংগ এসেছে, তার মধ্যে অধিকাংশই নারী সমকামিতাকেন্দ্রিক। মনুসংহিতায় উল্লিখিত আইনে, ‘যদি কোনো বয়স্কা নারী অপেক্ষাকৃত কম বয়সী নারীর (কুমারীর) সঙ্গে দৈহিক সম্পর্ক স্থাপন করে, তাহলে বয়স্কা নারীর মস্তক মুণ্ডন করে দুটি আঙ্গুল কেটে গাধার পিঠে চড়িয়ে ঘোরানো হবে। যদি দুই কুমারীর মধ্যে সমকামিতার সম্পর্ক স্থাপিত হয়, তাহলে
মনুসংহিতার দৃষ্টিতে হিন্দু নারীর অবস্থান সম্পর্ক বিস্তারিত জানতে ক) সুকুমারী ভট্টাচার্য, প্রাচীন ভারতে নারী ও সমাজ, ন্যাশনাল বুক এজেন্সি প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, ২০০৬ খ) সুকুমারী ভট্টাচার্য, প্রাচীন ভারত : সমাজ ও সাহিত্য, আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা, ২০০১; (গ) কঙ্কর সিংহ, মনুসংহিতা এবং নারী, র্যাডিক্যাল ইম্প্রেশন, কলকাতা, ২০০৫; (ঘ) কঙ্কর সিংহ, আমি শূদ্র, আমি মন্ত্রহীন, র্যাডিক্যাল ইম্প্রেশন, কলকাতা প্রভৃতি গ্রন্থ দ্রষ্টব্য। এ ছাড়া মুক্তমনা ওয়েব সাইটে রাখা ই- সংকলন ‘বিজ্ঞান ও ধর্ম – সংঘাত নাকি সমন্বয়?” এ রাখা অনন্ত বিজয় দাশের ‘সনাতন ধর্মে’র দৃষ্টিতে নারী’ প্রবন্ধটি দ্রষ্টব্য।
তাদের শাস্তি ছিল দুইশত মূদ্রা জরিমানা এবং দশটি বেত্রাঘাত”। সেতুলনায় পুরুষদের মধ্যে সম্পর্কের শাস্তি তুলনামূলকভাবে অনেক কম। বলা হয়েছে দু’জন পুরুষ অপ্রকৃতিক কার্যে প্রবৃত্ত হলে তাদেরকে জাতিচ্যুত করা হবে এবং জামা পরে তাকে জলে ডুব দিতে হবে। ‘শুশ্ৰুত’ নামক প্রাচীন ভারতীয় চিকিৎসাশাস্ত্রে স্ত্রী-সমকামিতার কথা বর্ণিত হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে যে, দুই নারী যদি যৌনসম্পর্কে লিপ্ত হয় তাহলে অস্থিহীন সন্তানের জন্ম হবে। মহাভরতে ভগীরথের জন্মকাহিনীতে (এই বইয়ের অষ্টম অধ্যায় দ্রঃ) এই ধরনের সংস্কারের সমর্থন মেলে।
উপরের দু-চারটি ক্ষেত্রে ছাড়া হিন্দুদের অন্যান্য ধর্মগ্রন্থগুলোতে পরিষ্কারভাবে কিছু না থাকলেও উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা ধর্মের দোহাই দিয়ে সমকামিতাকে ভারতবর্ষে অচ্ছুৎ বানিয়ে রেখেছে। হিন্দু ধর্ম সমকামীদের ব্যাপারে অন্য ধর্ম থেকে তুলনামূলক বিচারে ‘উদার’ হিসেবে দেখা হলেও ধর্মবাদীদের আচরণে তার প্রকাশ পাওয়া যায় না। অন্য সব ধর্মান্ধদের মতই তারা সমকামিতাকে বিকৃতি এবং নিন্দনীয় হিসেবে দেখে। তাদের চাপে সমকামী এবং রূপান্তরকামী ব্যক্তিদের সামাজিকভাবে হেয় করে রাখা হয়। তাদের ধর্মোন্মাদিতার প্রকাশ ঘটে বিভিন্ন বিচ্ছিন্ন ঘটনায়। প্রসঙ্গত ১৯৯৭ সালে দীপা মেহেতার ‘ফায়ার” ছবিটি মুক্তি পেলে ধর্মম্মাদিতার ঘৃতে যেন আগুন জ্বালা হয়। নারী সমকামিতাকে উপজীব্য করে বানানো এই ছবিটি সিনেমা হলগুলোতে মুক্তি পাওয়া মাত্রই হিন্দুত্ববাদী দলগুলোর তোপের মুখে পড়ে। তারা দাবি করে এই সিনেমা ‘ভারতীয় কৃষ্টি এবং সংস্কৃতি পরিপন্থি”। শিবসেনা নেতা বাল থ্যাকারে নারী সমকামিতাকে ‘সামাজিক এইডস’ হিসেবে বর্ননা করে একে ‘মহামারী’ চিহ্নিত করেন।
Manu Smriti chapter 8, verse 370.
Manu Smriti chapter 8, verse 369. 264 Manu Smriti Chapter 11, Verse 68.
Manu Smriti Chapter 11, Verse 175.
Kidwai, Saleem. “Sena fury on Fire, ” The Independent”, 5 February 1999. Accessed 12 March 2008.
Bearak, Barry (1998-12-24), “A Lesbian Idyll, and the Movie Theaters Surrender”, New York Times,
শুধু তাই নয়, শিব সেনারা দাবি করে যে, হিন্দু ধর্মকে ব্যঙ্গ করার জন্য ইচ্ছে করেই ছবির নায়িকাদের নাম সীতা এবং রাধা রাখা হয়েছিল। সমকামী অধিকার কর্মীরা অবশ্য হিন্দুত্ববাদীদের দাবি প্রত্যাখ্যান করে জানিয়েছিল যে খোদ হিন্দু ধর্মের বহু পুরাণ আর মহাকাব্যগুলোতে সমকামিতার অজস্র উপাদান আছে, আর সমকামিতাকে অপরাধের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছে ভারতে বলবৎ ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আইন, যা খ্রীষ্টিয় মতাদর্শ দিয়ে বেশি অনুপ্রাণিত। তারা দাবি করেন সমকামিতা হিন্দু ধর্মের এবং সর্বোপরি ভারতীয় সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।
তবে সাম্প্রতিককালে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে বলে অনুমিত হয়। ফায়ারের পরবর্তীকালে নির্মিত ‘দোস্তানা’ কিংবা ‘মেন নট এলাউড’ ছবিগুলোর ব্যাপারে ভারতে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যায়নি। ২০০৮ সালে ভারতের চারটি রাজ্যে (দিল্লী, ব্যাঙ্গালোর, কলকাতা এবং পন্ডিচেরী) প্রথমবারের মতো গে প্রাইড প্যারেড অনুষ্ঠিত হয়। দু হাজারেরও বেশি লোক এই প্যারেডে অংশ নেয়। এর পরের বছর ২০০৯ সালের ২৭ শে জুন ওরিষ্যা রাজ্য প্রথমবারের মতো দেখলো গে প্রাইড প্যারেডের দৃশ্য। ২৮ শে জুন দিল্লী এবং ব্যাঙ্গালোরে অনুষ্ঠিত হয় গে প্যারেড। চেন্নাইয়ে হয় এর পরের দিন। ২০০৯ সালের জুলাই মাসের ২ তারিখে নয়াদিল্লির হাইকোর্ট সমকামিতা অপরাধ নয় বলে রায় দিয়ে ১৪৮ বছরের পুরোনো ঔপনিবেশিক আইনের অবসান ঘটায়, শুরু হয় এক নতুন দিগন্তের সূচনা।
বৌদ্ধ ধর্ম
৫৬৬ খ্রীস্টপূর্বাব্দে গৌতম বুদ্ধের জন্ম। তিনি বৌদ্ধ ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা। এই ধর্ম (কিংবা দর্শন) ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে তেমন মাথা ঘামায়নি, বরং বুদ্ধের মতে অতৃপ্ত বাসনাই জাগতিক দুঃখের অন্যতম কারণ। এই অতৃপ্ত বাসনার জন্যই মানুষকে পুনর্জন্মের মাধ্যমে পুনরায় ধরাধামে জন্ম নিতে হয়। তাই বাসনা নিবৃত্তির মধ্যেই রয়েছে দুঃখ দূরীকরণের উপায়। তিনি এই অবস্থাকে বলেছেন ‘নির্বাণ লাভ’ । তবে নির্বাণ লাভের জন্য সব কিছু বাদ দিয়ে কেবল কৃচ্ছসাধনাকে বৌদ্ধ ধর্মে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। প্রচুর ভোগবিলাস যেমন কামনা বাসনার নিবৃত্তি ঘটাতে পারে না, তেমনি কঠোর কৃচ্ছতাসাধনের মধ্য দিয়েও তা সম্ভব হয় না। যৌনতার সাথে কামনা বাসনার সম্পর্ক গভীরভাবে যুক্ত। অতিরিক্ত যৌনসম্ভোগকে তাই বৌদ্ধধর্মের অনুসারীদের অনেকেই নির্বান লাভের পথে অন্যতম বাধা বলে মনে করে। সমকামিতা যৌনতারই একটি বিশেষ দিক। তা সত্ত্বেও বৌদ্ধ ধর্ম সমকামিতা সম্বন্ধে আশ্চর্যজনক ভাবে নীরব। বিমলাকৃতিনির্দেশে বর্ণিত কিছু কাহিনী ছাড়া (অষ্টম অধ্যায় দ্রঃ) বৌদ্ধ সাহিত্যে সমকামিতার তেমন কোনো উল্লেখ আমরা পাইনা। কিন্তু ধর্ম বা সাহিত্যে খুব বেশি কিছু না থাকলেও প্রায় সব দেশেই বৌদ্ধ ধর্মীয়দের মধ্যে সমকামিতার অস্তিত্ব দেখা যায়। এমনকি আছে মঠবাসী সন্ন্যাসীদের মধ্যেও।
ধর্মীয় অনুশাসন অনুযায়ী মঠবাসী সন্ন্যাসী এবং সন্ন্যাসিনীদের চিরকৌমার্যের ব্রত পালন করতে হয়। জীবিকার প্রয়োজনেই তারা সমলিঙ্গের সদস্যদের সাথে একসাথে বসবাস করে। একসাথে বাস করতে গিয়ে অনেকের মধ্যে সমকামী মানসিকতার পরিস্ফুটন ঘটে। ফলে চিরকৌমার্যের ব্রত পালনের কথা প্রকাশ্যে থাকলেও, সন্ন্যাসী এবং সন্ন্যাসীনিরা গোপনে ভিন্নপথে যৌনজীবনের স্বাদ পেয়ে থাকে। বস্তুত মঠজীবনের ওপর সমীক্ষাভিত্তিক বেশ কিছু গবেষণার মধ্য দিয়ে বৌদ্ধ ধর্মবলাম্বীদের যৌনজীবনের বিভিন্ন রূপ উদ্ভাসিত হয়েছে।
জাপানের বৌদ্ধ সংস্কৃতিতে সমপ্রেমের সুস্পষ্ট উপস্থিতি পরিলক্ষিত হয়। সমলিঙ্গের প্রেম-ভালোবাসা এখানে অনেক ক্ষেত্রে শুধু সমর্থিত হয়নি, প্রশংসিতও হয়েছে। চোদ্দ শতক থেকে জাপানী বৌদ্ধশাস্ত্রে সমপ্রেম বিষয়টি আলোচনায় উঠে আসে। মঠের বয়স্ক সন্ন্যাসীরা অনেকক্ষেত্রেই কম বয়সী সন্ন্যাসীদের সাথে দৈহিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়তেন। এই সব কমবয়সী সন্ন্যাসীরা ‘ছিগো’ (chigo) বলে পরিচিত ছিল। সমপ্রেমের এই সম্পর্ক অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দীর্ঘস্থায়ী হতো। অনেক সময় আমৃত্যু এই ভালোবাসা অটুট থাকতো। দুজনের কোনো একজনের মৃত্যু হলে বেশ কয়েকদিন ধরে ‘বৈধব্য’ পালন করে। জাপানের বীর যোদ্ধা সামুরাইদের মধ্যেও সমপ্রেমের নানা দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া যায়। সতেরো শতকে কিতামুরা কিগিমের (Kitamura Kigim) লেখা ‘Iwatsusji’ এবং ইহারা সাইকাকুর Nashoku Okagami নামক কাব্যগ্রন্থে পুরুষ সমকামী যৌনসম্পর্কের নানা কাহিনী বিধৃত হয়েছে। জাপানের মতো চীন এবং তিব্বতের বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের মধ্যেও সমকামিতার উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। ১৯০০ থেকে ১৯৫০ সালের মধ্যে চীনে বৌদ্ধ ধর্মের অবস্থা নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে হোমস ওয়েলস তার “The practice of Chinese Buddhism’ গ্রন্থে চীনের বিভিন্ন মঠে বয়স্ক এবং কম বয়সী সন্ন্যাসীদের মধ্যে বিদ্যমান যৌনসম্পর্কের উল্লেখ করেছেন। অন্যদিকে মার্কিন সমাজবিজ্ঞানী মেলভিন গোল্ডস্টেইনের গবেষণা থেকে লাডাব এল ডব নামে পরিচিত তিব্বতী সন্ন্যাসীদের সমকামের বিস্তৃত বর্ণনা দিয়েছেন। এ সব কিছুই বৌদ্ধ ধর্মে সমকামিতার প্রামাণ্য দলিল।
ইহুদি ধর্ম
ইহুদিরা খুবই প্রাচীন জাতি। আর ইহুদি ধর্ম হলো পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীণ ধর্ম। হিব্রু বাইবেল বা ওল্ড টেস্টামেন্ট হলো এদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ। যিহোভা এদের একমাত্র উপাস্য দেবতা। হিব্রু বাইবেল থেকে সডোম নামক নগরীর কথা জানা যায়। এখানকার পুরুষেরা নারীদের পরিত্যাগ করে পুরুষে উপগত হলো বলে বর্ণিত আছে। এই ‘ঘৃণ্য যৌনাচরণের’ কারণে ঈশ্বর তাদের উপর রুষ্ট হন, এবং তিনি এই নগরীকে ধ্বংস করেন।
এ ব্যাপারে ধর্মগ্রন্থে বর্ণিত কাহিনীটি এরকম (আদিপুস্তক ১৯ থেকে বর্ণিত):
১) সন্ধ্যায় সডোম নগরে দুজন দূত (angel) এসেছিলেন (সাধারণ মানুষের ছদ্মবেশে)। লুত তখন নগরের প্রবেশপথে বসেছিলেন।
২) লুত উঠে গিয়ে অভিবাদন জানিয়ে বললেন, ‘মহাশয়গন একবার অনুগ্রহ করে আমার বাড়িতে আসুন এবং সেবা করার সুযোগ করে দিন’।
৩) দূত দুজন সেখানেই রাত্রিবাস করতে চাইলে লুত নিজের বারীতে নিয়ে যাওয়ার জন্য বিশেষ পীড়াপীড়ি করতে লাগলেন। দূতেরা শেষ পর্যন্ত লুতের বাড়ি পর্যন্ত গেলেন, লুত তাদের পানীয় এবং রুটি দিলেন।
৪) সন্ধ্যায় ঘুমাতে যাবার ঠিক আগে শহরের নানা প্রান্ত থেকে লোকজন এসে লুতের বাড়ি ঘিরে ফেললো, এবং লুতকে চিৎকার করে ডাকতে লাগলো।
৫) তারা বললো, ‘আজ সন্ধ্যায় যারা এসেছে, কোথায় তারা? তাদের বাইরে নিয়ে এস। আমরা তাদের সাথে যৌন সহবাস করতে চাই।
Activists slam attacks on lesbian film, Hindus vow to widen protest,” Agence France-Presse, 3 December 1998.
অজয় মজুমদার ও নিলয় বসু, সমপ্রেম, দীপ প্রকাশন, কলকাতা, ২০০৫।
Bengali New Testament Downloads, World Bible Translation Center, http://www.wbtc.com/downloads/bible_downloads/Bengali/Bengali_Bible_01)_Genesis.pdf
৬) লুত বাইরে বেরিয়ে এসে দরজা বন্ধ করে দাঁড়ালো।
৭) আর জনতার উদ্দেশ্যে বলল, ‘না বন্ধুরা আমি মিনতি করছি, এমন খারাপ কাজ করো না’।
৮) লুত আরো বললো, ‘দেখো আমার দুটি মেয়ে আছে,কোনো পুরুষ তাদের স্পর্শ করেনি। তাদের বরং তমরা নিয়ে যাও। কিন্তু দয়া করে এই অতিথি দুজনের প্রতি তোমরা কিছু করো না। এই দুজন আমার ঘরে এসেছে, এবং আমার অবশ্যই এদের রক্ষা করা উচিৎ।
৯) যে সব লোকেরা লুতের বাড়ি ঘিরে রেখেছিল তারা উত্তর দিলো, ‘আমাদের পথ থেকে সরে যাও’।… জনতা লুতের দিকে এদিয়ে যেতে থাকল, ক্রমে দরজা ভেঙ্গে ফেলার উপক্রম হলো।
১০) কিন্তু যে দুজন লোক (দূত) লুতের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল, তারা হঠাৎ দরজা খুলে লুতকে টেনে ভিতরে নিয়ে গিয়ে দরজা আটকে দিলো।
১১) তারপর তারা বাইরের মারমুখো জনতার উদ্দেশ্যে এমন কিছু করলো যে তারা অন্ধ হয়ে গেল। ফলে যারা বাড়ির ভেতরে জোর করে ঢুকার চেষ্টা করছিল, তারা দরজাই খুঁজে পেলো না ।
১২) অতিথি দুজন রাতে লুতকে বলল, তার পরিবার পরিজন নিয়ে যেন শহর থেকে চলে যায়।
১৩) আমরা ঈশ্বরের আদেশে এই শহর ধ্বংস করে দেব। এই নগর যে কত খারাপ তা প্রভু শুনেছেন। তাই এই নগর ধ্বংস করার জন্য তিনি আমাদের পাঠিয়েছেন …
ইহুদিদের ধর্মীয় আইন ও উপদেশ গ্রন্থের সংক্ষিপ্তসার হলো Talmud । এই গ্রন্থে সমকামী পুরুষদের গর্হিত আচরণের জন্য কিছু সুস্পষ্ট শাস্তির বিধানের কথা বলা হয়েছে। সাধারণত দুই ধরনের শাস্তির কথা জানা যায় – এক, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে সমগ্র ইহুদি জাতি থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়। চরম শাস্তি হিসেবে এই বিচ্ছিন্নতা আসবে মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। তবে ‘মৃত্যুর মধ্য দিয়ে শাস্তি’ মানে কাউকে ধরে মেরে ফেলার কথা বোঝানো হয়নি, মনে করা হয়েছে শাস্তি আসবে সয়ং ঈশ্বরের কাছ থেকে। দ্বিতীয় ধরনের শাস্তি হিসেবে অবশ্য মৃত্যুদন্ডের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু তারপরেও কাউকে সমকামের জন্য শারীরিককভাবে মেরে ফেলাকে উৎসাহিত করা হয় না। এর কারণ হলো, ইহুদিদের জন্য মোসেস (মূসা) যে দশটি উপদেশাবলী রেখে গিয়েছেন, তার মধ্যে সপ্তমটিতে ব্যক্তি হত্যা নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
তবে মূসার অনুশাসনাবলীতে সমপ্রেম সম্পর্কিত কিছু কথা স্পষ্টভাবেই বিধৃত আছে। বলা হয়েছে সমকামিতার অভিযোগে যদি কোনো বয়স্ক পুরুষ ধৃত হয়, তবে তার উপর মৃত্যুদণ্ড বর্ষিত হবে। যদি দুজনের মধ্যে একজন বয়স্ক পুরুষ ধৃত হয়, তবে তার উপর মৃত্যুদণ্ড বর্ষিত হবে। যদি দুজনের মধ্যে একজন বয়স্ক এবং অপর জনের বয়স নয় বছর থেকে তের বছরের মধ্যে হয়ে থাকে, তবে বয়স্ক ব্যক্তিটির জন্য মৃত্যুদণ্ড এবং অপরজনকে বেত্রাঘাতের বিধান দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সমকামী ব্যক্তির বয়স যদি নয় বছরের কম হয়ে থাকে, তবে নাবালক হিসেবে সে কোনো শাস্তির আওতায় পড়ে না। কিন্তু বয়স্ক ব্যক্তির জন্য বেত্রাঘাতের বিধান বলবৎ থাকে।
ইহুদি ধর্মে নারী সমকামিতার বিষয়েও কিছু কথা উল্লেখ করা হয়েছে। যেহেতু স্ত্রী সমকামিতায় লিঙ্গ-প্রবিষ্টকরণের (Penile penetration) ব্যাপার থাকে না, তাই স্ত্রী সমকামিতাকে এতটা নিন্দনীয় ব্যাপার হিসেবে অনেকেই গণ্য করেন না। ইহুদি ধর্মীয় আইন কানুনেও এর প্রতিফলন ঘটেছে। এখানে স্ত্রী সঙ্গমকে আদৌ প্রকৃত সঙ্গম বলে মনে করা হয় না। ফলে বিবাহ বহির্ভুত যৌন মিলনের তুলনায় তাদের কাছে এই জাতীয় সম্পর্ক অনেক মম দোষাবহ।
ধর্মগ্রন্থ ছাড়াও ইহুদি ধর্মগুরুদের কথা এক সময় ইহুদিরা যথেষ্টই প্রাধান্য দিতো। লিভাই নামে এক প্রাচীন ধর্মগুরু ছিলেন। তাঁর বংশধরদের বলা হতো Levite । এরা বিভিন্ন সময়ে ইহুদিদের যৌনজীবন নিয়ে নানা মতামত প্রদান করতেন। এই মতামতের মধ্যে সমপ্রেমকে অত্যন্ত নিন্দনীয় কাজ হিসেবে গণ্য করা হতো। তাদের শাস্তি ছিল সোজাসুজি মৃত্যুদণ্ড। তারা মনে করতো, যেহেতু সমকামী সম্পর্কের মধ্য দিয়ে কোনো সন্তানের জন্ম দেয়া যায় না, সেহেতু এই সম্পর্কের মধ্য দিয়ে কোনো চরম পরিতৃপ্তির পর্যায়ে পৌঁছানো যায় না। আবার Rabbai Acha নামে আরেক ধর্মগুরু ফতোয়া দেন সমকামিতার কারনেই ঈশ্বর নাকি পৃথিবীতে ভূমিকম্প সৃষ্টি করেন। তবে সাম্প্রতিক সময়গুলোতে এই ধর্মগুরুদের প্রভাব ইহুদি সমাজে অনেক কমে এসেছে। ইহুদিরা যেহেতু জ্ঞান বিজ্ঞানে অগ্রসর একটি জাতি, তারা ধর্মগুরুদের চেয়ে বিজ্ঞানীদের কথাকেই গুরুত্ব দিতে শুরু করেছেন বেশি।
সেজন্যই ধর্মীয় আইন কানুনে যাই থাকুক না কেন, কিংবা ধর্মগুরুরা একটা সময় যাই প্রচারণা চালাক না কেন, বর্তমানকালে ইহুদিদের জীবনচর্চায় অনেক পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে। বিভিন্ন ইহুদি সংগঠনেও লেগেছে ‘নতুন দিনের হাওয়া’। ১৯৮৪ সালে Reconstructionist Rabbinical College এর কর্তৃপক্ষ সমপ্রেমী কোনো ব্যক্তিকে তার বিশেষ যৌনপ্রবৃত্তির কারণে এই সংস্থায় ভর্তি থেকে বিরত রাখা যাবে না বলে নির্দেশ জারি করে। এর পর Hebrew Union College এ ধর্মতত্ত্ব বিষয়ে পড়তে ইচ্ছুক ছাত্রদের যৌনপরিচয়কে ভর্তির মানদণ্ড হিসেবে দেখা হবে না বলে ঘোষণা করা হয়। এদিকে ১৯৮৮ সালের মার্চ মাসে ইসরায়েলী পার্লামেন্ট নতুন আইন প্রণয়নের মধ্য দিয়ে দুই পুরুষের সমকামী সম্পর্ককে আইনসিদ্ধ বলে ঘোষণা করে। ফলে ইসরায়েলে সুলামিত এলনি সহ অন্যান্য মানবাধিকার কর্মীরা যে সংসদে দশ বছর ধরে সমকামের স্বপক্ষে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন তা অবশেষে পূর্ণতা পেল।
খ্রিষ্ট ধর্ম
একটা সময় ইহুদি ধর্মের মধ্য থেকেই খ্রিষ্টধর্মের জন্ম হয়। যদিও ইহুদি এবং খ্রীস্টানদের সম্পর্ক কোনো সময়ই মধুর ছিল না, তা সত্ত্বেও খ্রিষ্টানরা ইহুদিদের ধর্মগ্রন্থগুলোকে বাইবেলের অংশ হিসেবে মেনে নেয়। ফলে ওল্ড টেস্টামেনন্টে (Genesis 19:4-8) সমকামিতার জন্য সডোম নামক ধ্বংসের ব্যাখ্যা খ্রিষ্টধর্মাবলম্বীরাও গ্রহণ করে নেয়, এবং সমকামিতাকে ‘বিকৃত পাপাচার’ হিসেবে প্রচার করে। এ প্রসঙ্গে বার্ন ফোন তার হোমোফোবিয়া গ্রন্থে বলেন-
The Sodom story is popularly believed to demonstrate God’s abhorrence of homosexual acts and to embody his most profound prohibition against them. It is also generally accepted as a dire warning to mankind, detailing what calamities will befall a society that allows homosexual behavior to flourish, and as scriptural justification for the belief that the extreme punishment is just recompense for the sin. The authority of the Church has supported this reading and has considered it sufficient justification for condemning those whose sin is believed to be like that of the men of Sodom.
এ ছাড়াও সমকামিতার উপর নিষেধাজ্ঞা এবং বিশেদগার আছে লেভিটিকাসের ‘হোলিনেস কোড’ অধ্যায়ে। বলা হয়েছে –
‘যেভাবে মেয়েদের সাথে শয়ন কর, সেভাবে কোনো পুরুষের সাথে শয়ন কোর না। এটা নিষিদ্ধ’ (Leviticus 18:22)।
কিংবা,
‘যদি কোনো পুরুষ অন্য পুরুষের সাথে শয়ন করে, যেরূপ অন্য স্ত্রীর সাথে
করে থাকে, তবে তাদেরকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে’। (Leviticus 20:13)।
সমকামিতা নিয়ে বিষেদগার আছে সেন্ট পলের অনেক সূত্রেও (Romans 1:26-2:1, I Corinthians 6:9-11, I Timothy 1:10)। তবে আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে, যীশু সমকামিতা সম্বন্ধে তেমন কিছুই কোথাও বলেননি। ইতিহাস থেকে দেখা যায় সমপ্রেম বিষয়ে খ্রিষ্টধর্ম সবসময়ই খড়গহস্ত। সমপ্রেমকে খ্রিষ্টধর্ম প্রথম থেকেই সমর্থন করতে পারেনি। খ্রিষ্টান ধর্মবাদীদের হাতে প্রতিটি যুগে নির্মম নির্যাতন এবং নিপীড়নের শিকার হয়েছে সমপ্রেমীরা। বস্তুত প্রজননহীন যৌনসম্পর্ককে ক্যাথলিক খ্রিষ্টধর্ম সম্পূর্ণ বর্জন করেছে। যেহেতু সমকামী সম্পর্কের মধ্য দিয়ে সন্তান উৎপাদনের কোনো সম্ভাবনা নেই, তাই এই জাতীয় সম্পর্ক ধর্মীয় নীতি বিরুদ্ধ। পোপ জন পল ২ (অধুনা মৃত) প্রায়শঃই বলতেন, প্রেম ভালোবাসা সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত, তাই এই ব্যাপারে চার্চের খবরদারী করাটা আদৌ সঙ্গত নয়। কিন্তু এই পোপ জন পলই সমকামিতাকে মেনে নিতে পারনিনি, সেটাও তিনি বহুভাবেই ব্যক্ত করেছেন। তিনি একে ‘ধর্মবিরুদ্ধ কাজ’ বলে বর্ণনা করেছেন। ১৯৭৫ সালের ২৯ এ ডিসেম্বর রোমের প্রধান ক্যাথলিক চার্চ থেকে ‘পারসোনা হিউম্যানা’ নামে একটি ধর্মবার্তা প্রকাশিত হয়। প্রাকৃতিক আইন এবং নৈতিকতার নানা দিক নিয়ে এখানে আলোচনা হয়। আলোচ্য বিষয়ে সমপ্রেমও ছিল। তবে সমপ্রেম (Homosexual love or romance) বিষয়ে খুব একটা উচ্চবাচ্য না করা হলেও সমকামিতাকে (Homosexuality) স্বীকার করা হয়নি, যদিও দেহজ এবং প্রেমজ সম্পর্কের পার্থক্যও ধর্মবার্তায় সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়নি। আর এই অস্বচ্ছতার সুযোগ নিয়ে অনেকে সমপ্রেমের পেছনে বাইবেলের সমর্থন আছে বলে প্রচার করতে শুরু করে। এই ধরনের ঘোলাটে পরিস্থিতিতে চার্চ তার ‘সঠিক’ ভূমিকা প্রকাশ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৮৬ সালের ১লা অক্টোবর খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের উদ্দেশ্যে চার্চ থেকে ‘অন পেস্টোরাল কেয়ার অব হোমোসেক্সুয়াল পারসন’ শীর্ষক একটি পত্র প্রকাশ করে। এখানে সমপ্রেমকে সোজাসুজি এক ধরনের ‘কাম বিকৃতি’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। আরো বলা হয়, নারী-পুরুষের যৌন সম্পর্ক ছাড়া অন্য সমস্ত ধরনের সম্পর্ক অত্যন্ত গর্হিত যৌন আচরণ। অবশ্য ‘সঠিক’ ভূমিকা নেয়ার পরেও বেশ কিছু জায়গার ঘোলাটে অবস্থা চার্চ দূর করতে পারেনি। নৈতিক দিক দিয়ে সমপ্রেমের অধিকারের বিষয়টি প্রতিক্রিয়াশীল চার্চও এড়িয়ে যেতে পারেনি। তারা সেই পত্রে উল্লেখ করে যে, সমপ্রেমী ব্যক্তি যদি নিগ্রহের স্বীকার হয়, তবে তাকে সাহায্য করা প্রয়োজন।
প্রাচীন গ্রীক ও রোমান সভ্যতায় সমকামের গ্রহনযোগ্যতা থকলেও খ্রিষ্ট ধর্মের উত্থানের সাথে সাথে সেখানে এই গ্রহণযোগ্যতা কমে আসতে শুরু করে। দ্বাদশ শতকের শেষ দিকে সমপ্রেমকে সমপ্রেমকে খ্রীষ্টিয় সংস্কৃতি বিরুদ্ধ আচরণ হিসেবে গন্য করা শুরু করে। এ সময় থেকেই ক্যাথলিক চার্চ প্রজননহীন যৌনতাকে ‘অপরাধ’ হিসেবে প্রচার করতে শুরু করে।
Byrne Fone, Homophobia: A History, Picador, 2001
“For homosexuals the Judeo-Christian tradition has meant nothing but ostracism and punishment, exile and death….” ( Encyclopedia of Homosexuality)
মধ্যযুগের শেষ দিকে খ্রিষ্টান ধর্মযাজকেরা নানারকম দুর্নীতি ও অন্যায়ের সাথে যুক্ত হয়ে পড়েছিলেন। আর্তের সেবা করা তাদের কাছে গৌণ হয়ে গিয়েছিল। ত্যাগ তিতিক্ষার পরিবর্তে তারা অব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন আমোদ প্রমোদ ও অসৎ জীবনধারায়। চতুর্দশ শতকে জন ওয়াই ক্লিফ, জন হাস ও মার্টিন লুথারের নেতৃত্বে শুরু হলো ধর্ম সংস্কার আন্দোলন। বস্তুত রেনেসাঁ বা নবজাগরণের সূত্র ধরে জ্ঞান- বিজ্ঞানের বিকাশ মানুষের মনে যে পরিবর্তন আনে, ধর্ম সংস্কারের পথ সুগম করে। পোপের অনাচারের প্রতিবাদে তৈরি হয়েছিল বলে এই নতুন ধারার খ্রিষ্টধর্মকে ‘প্রটেস্ট্যান্ট নামে অভিহিত করা হয়। প্রতিক্রিয়াশীল ধর্মীয় শক্তির বিপরীতে প্রটেস্ট্যান্ট শক্তি মাথা তুলে দাঁড়ায়। প্রগতিশীল নানা ভাবনার কথা উঠে আসতে থাকে। কিন্তু তারপরেও অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে, সমপ্রেম সম্বন্ধে সে সময়কার ধর্মসংস্কার আন্দোলনের নেতৃবর্গের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল খুবই রক্ষণশীল। সমপ্রেম বা সমলিঙ্গের ভালোবাসাকে মার্টিন লুথার শয়তানের সৃষ্ট বিকৃত মনমানসিকতা বলে অভিহিত করেছিলেন। সে সময়কার অন্যতম সংস্কারক জন কেলভিন মনে করতেন সমপ্রেম ব্যক্তিজীবনকে কলুসিত করে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়। তাই তিনি সমপ্রেমকে সমর্থন করতে পারেননি। আসলে ক্যাথলিক খ্রিষ্টানদের মতো প্রটেস্ট্যান্টরাও পায়ুকামকে সমপ্রেমের সমার্থক মনে করতেন। তারাও পূর্বসূরী খ্রিষ্টানদের মতো মনে করতেন পায়ুকামের মতো ঘৃণ্য যৌনপ্রবৃত্তির কারণে ঈশ্বর সডোম এবং গোমরাহ নগরী দুটিকে ধ্বংস করেন। ১৯৫৫ সাল থেকে ১৬৮০ সালের মধ্যে শুধু জন কেল্ভিনের অনুগামীদের নেতৃত্বে ত্রিশ জন সমকামীকে হত্যা করা হয়। সমপ্রেমীদের উপর পাথর নিক্ষেপের ঘটনা ঘটতে থাকে অহরহ। বলপূর্বক তাদের হাসপাতালে ‘চিকিৎসার জন্য’ পাঠানো শুরু হয়। অনেককে কারাবন্দীও করে রাখা হয়।
কিন্তু এত কিছুর পরেও সমকামীদের অধিকার বঞ্চিত করে রাখা যায়নি। আসলে সমকামিতার ব্যাপারটা যে প্রাকৃতিক, তা খ্রিষ্টধর্মের মধ্য থেকেই বেরিয়ে আসলে শুরু করে। ধীরে ধীরে প্রকাশিত হতে থাকে চার্চের যাজকদের মধ্যে অনেকেই সমকামী আছেন। সামাজিক মান সম্মানের ভয়ে এই যাজকেরা নিজেদের যৌনপ্রবৃত্তি প্রকাশ্যে জানাতে পারতেন না। এমনই একজন যাজক হলেন ক্রিস গ্লেসার (Chris Glaser)। চার্চ এন্ড সোসাইটি’ (জুন ১৯৯৭) নামের এওটি পত্রিকায় ‘এ নিউলি রিভিল্ড খ্রিষ্টান এক্সপেরিয়েন্স’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধে সরাসরি বলেন, চার্চের অভ্যন্তরে সমকামী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করা মানে চার্চ থেকে বিতারিত হওয়া। তিনি প্রশ্ন করেন, মানুষের বঞ্চনার হাত থেকে মুক্তি দেয়াই যদি চার্চের একমাত্র উদ্দেশ্য হয়, তবে সমকামীদের প্রতি চার্চ এত বিরূপ কেন। তিনি চার্চকে ‘কবরখানা’ বলে আখ্যায়িত করেন। তিনি সে সময় বলেন, সমকামী আন্দোলনকে ত্বরান্বিত করতে হলে সমকামী যাজকদের চার্চ পরিত্যাগ করেই এগুতে হবে।
সত্তুরের দশকের পর থেকেই ইউরোপের বিভিন্ন প্রটেস্ট্যান্ট চার্চের যাজকেরা বিক্ষিপ্তভাবে হলেও নিজেদের যৌনপরিচয়কে প্রকাশ করার চেষ্টা করেন। এই চেষ্টা ধীরে ধীরে আন্দোলনের আকার ধারণ করে। তাঁরা একথাই বলতে চান যে, খ্রীষ্টিয় ধর্মতত্ত্বের সাথে সমপ্রেমের কোনো বিরোধ নেই। এদের অনেকেই মত দেন যে, প্রটেস্ট্যান্টরা সব সময়ই অন্যায়ের বিরুদ্ধাচরণ করে এসেছে, তাই সমকামিতার অধিকার আন্দোলন তাদের জন্য ব্যতিক্রম হতে পারে না। তারা দাবি, করেন বিংশ এবং একবিংশ শতকে মানুষের চাহিদা আর মূল্যবোধকে সামনে রেখে খ্রিষ্টধর্মকে নতুন দিকে পরিচালিত করতে হবে। তবে সবাই যে এই দাবি সমর্থন করলেন তা নয়। বস্তুত সমকামকে সামনে রেখে প্রটেস্ট্যান্টরা দুটি পরস্পরবিরোধী ধারায় বিভক্ত হয়ে যায়। একটি ধারা সমপ্রেমকে সম্পূর্ণ উৎখাত করতে চায়। অন্যধারা সমপ্রেমের পেছনে ধর্মীয় সমর্থন খুঁজতে থাকে। ফলে চার্চের অভ্যন্তরে যাজকদের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে তর্ক বিতর্ক শুরু হয়। চার্চের উপর সামাজিক চাপ বাড়তে থাকে। এর ফলে বিভন্ন দেশে দাবি মেনে নেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়। ১৯৮৮ সালে কানাদার ‘ইউনাইটেড চার্চ কর্তৃপক্ষ সমকামী পরিচয়যুক্ত ব্যক্তিদের যাজক হিসেবে মনোনীত করতে রাজি হয়। এরপর ‘ইউনাটেড চার্চ অব ক্রাইস্ট’, ‘ইউনিটেরিয়ান ইউনিভার্সালিস্ট এসোসিয়েসন’ সহ বহু চার্চ এবং খ্রিষ্টধর্মীয় সংগঠণ সমকামী যাজকদের অধিকার এবং পদমর্যাদা মেনে নেয়। তারপরেও সামগ্রিকভাবে প্রটেস্ট্যান্টরা সমপ্রেমকে স্বাভাবিক যৌনপ্রবৃত্তি হিসেবে স্বীকার করে নেয়নি।
এসময় চার্চের রক্ষণশীল ভূমিকাকে সমালোচনা করতে এগিয়ে আসেন উদারপন্থি খ্রিষ্টান বুদ্ধিজীবীরাও। তারা দাবি করেন সমকামিতা সম্বন্ধে বাইবেলের বক্তব্য সুস্পষ্ট নয়। একে তো যীশু খ্রিষ্ট কোথাও সমকামিতা সম্বন্ধে টু শব্দ করেননি, অন্যদিকে বাইবেলের যে অংশগুলোকে সমকামিতার প্রতি নিবর্তন মূলক বলে অভিহিত করা হয়েছে, সেগুলোকে ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করা সম্ভব। যেমন, তারা ব্যাখ্যা করেন – সডোম এবং গোমরা নামক শহর দুটো সমকামের জন্য ধ্বংস হয়নি, হয়েছে অতিথিবৎসল না হবার কারণে। অনেকেই ব্যাখ্যা করেছেন যে, সডোম নগরবাসীর লুতের বাড়ি ঘেরাও করে দুজন অতিথিকে জোর করে বের করে যৌনসঙ্গম করার আর্তির মধ্যে ‘ধর্ষকামী মনোবৃত্তি’ প্রকাশ পেয়ছে। সমকামিতা এখানে গৌন। ঈশ্বর সডোম নগরী ধ্বংস করেছেন এই ধর্ষকামী মনোবৃত্তির জন্য, সমকামিতার জন্য নয়। প্রসঙ্গতঃ বাইবেলে বর্ণিত যিবৃষ (Gibeah)নগরীতেও একইভাবে অথিতিবৎসল না হওয়া এবং ধর্ষণের শাস্তি হিসেবে ঈশ্বর এক সময় পুরো নগর ধ্বংস করে দিয়েছিলেন (Judges 19:22-30)। সেখানে গৃহকর্তার দাসী এবং উপপত্নীকে সারা রাত ধরে ধর্ষণ করা হয়েছিল।সমকামিতাকে সেক্ষেত্রে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছিল, কিন্তু তারপরেও নগর রক্ষা পায়নি। কাজেই উদারপন্থি ধর্মতাত্ত্বিকেরা দাবি করেন, সডোমের ক্ষেত্রেও ঈশ্বরের কাছ থেকে শাস্তি এসেছে ধর্ষকামিতার কারণে, সমকামিতার কারণে নয়। আর তাছাড়া বাইবেলের যে সমস্ত জায়গায় সমকামিতাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে, সে সমস্ত জায়গাতে কাঁচা মাংস খাওয়া, একই জমিতে ভিন্ন ভিন্ন ধরনের বীজ বপণ করা থেকে শুরু করে গাইয়ে ট্যাটু আঁকা, মাসিক অবস্থায় স্ত্রীর সাথে সঙ্গম করা সহ অনেক কিছুই ‘নিষিদ্ধ’ করা হয়েছে। এগুলোর বেশিরভাগই আজকের জ্ঞানের সাপেক্ষে হাস্যকর শুনাবে। কাজেই সেগুলো যদি কারো জীবনে সমস্যা না করে থাকে, সমকামিতাই বা করবে কেন সেটাও একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন বলে তারা মনে করেন। সেজন্যই জন বসওয়েল তার ‘ Christianity, Social Tolerance, and Homosexuality ‘ গ্রন্থে বলেন,
The New Testament takes no demonstrable position on homosexuality. To suggest that Paul’s references to excesses of sexual indulgence involving homosexual behavior are indicative of a general position in opposition to same-sex erorticism is as unfounded as arguing that his condemnation of drunkenness implies opposition to the drinking of wine.
১৯৯৮ সালে ‘ইউনাটিং চার্চ অব অস্ট্রেলিয়া’ একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে জানায় যে, বাইবেলের যুগে সমকামিতা নিয়ে কোনো স্পষ্ট ধারণা ছিল না, তাই একে বিকৃতির পর্যায়ভুক্ত করে রাখা হয়েছিল। বস্তুত আচরণগত সমকাম এবং প্রবৃত্তিগত সমকামের মধ্যে এই সময় পার্থক্য করা দূরূহই ছিল। ফলে বাইবেলে বর্ণিত সেসময়কার শাস্তিগুলোকে আক্ষরিক অর্থে নিলে চলবে না। ১৯৭৩ সালে আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক এসোসিয়েশন সমপ্রেম এবং সমকামিতাকে স্বাভাবিক প্রবৃত্তি হিসেবে রায় দেয়ার পর এর প্রভাব পড়তে শুরু করে চার্চের উপরে।চার্চ কর্তৃপক্ষ সমকামের ব্যাপারে অনেক নমনীয়তা প্রদর্শন করতে শুরু করে। বর্তমানে বিভিন্ন ক্যাথলিক এবং প্রোটেস্ট্যান্ট চার্চ সমকামী নারী এবং পুরুষদের অধিকারের কথা বলতে শুরু করেছে।
ইসলাম ধর্ম
ইসলামে সমকামিতার বিষয়ে জানতে হলে প্রথমে আমাদের পবিত্র কোরান শরিফের দিকে তাকাতে হবে। মুসলিমরা বিশ্বাস করে কোরান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর বাণী। কোরান আল্লাহর কাছ থেকে নবী মুহম্মদ (দঃ) এর নিকট নাজিল হয়েছিল জিবরাইল ফেরেস্তার মাধ্যমে। কোরানে সমকামিতাকে ‘জেনা’র সমতুল্য হিসেবে গন্য করা হয়েছে, এবং কোরান, হাদিস এবং শরিয়া অনুযায়ী কঠোর শাস্তির বিধান দেয়া হয়েছে”। কোরানের সমকাম-বিরুদ্ধ আইনের ভিত্তি হচ্ছে পূর্বতন ইহুদি-খ্রিষ্ট ধর্মগ্রন্থে বর্ণিত লুতের কাহিনী । কোরানও ইহুদি এবং খ্রীস্ট ধর্মের অনুকরণে লুতের ব্যাভিচারের কাহিনীকে নিজেদের ধর্মগ্রন্থে আত্মীকরণ করেছে”। কাজেই কোরান অনুসারে সডোমী হচ্ছে হযরত লুতের (আঃ) সম্প্রদায় কতৃক আচরিত একটি প্রথা। লুত ছিলেন ইসলামের আদি পুরুষ হযরত ইবরাহীমের (আঃ) ভ্রাতঃষ্পুত্র। লুতের সম্প্রদায়ের বাসস্থান কোথায় ছিল কোরানে তার সুস্পষ্ট উল্লেখ নাই। তবে ইতিহাসের বিভিন্ন রেফারেন্স থেকে যা বুঝা যায় তাতে মনে হয় যে প্রাচীন সডোম বা গোমরাহ নগরীতে ছিল তাদের বাস । বাইবেল বর্ণিত প্রাচীন এই শহর দুটি যৌনবিচ্যুতির জন্য কুখ্যাত ছিল। কোরানের বিভিন্ন আয়াত থেকে জানা যায়, এই শহর দুটির সমকামী অধিবাসীগণ আল্লাহর গজবে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। আসমান হতে নিক্ষিপ্ত ব্রাইমষ্টোনের (গন্ধক বা সালফারনির্মিত প্রস্তরখণ্ড) আঘাতে মৃত্যুবরণ
Bailey, Derrick Sherwin. Encyclopedia of Homosexuality. Dynes, Wayne R. (ed.), Garland Publishing, 1990.
John Boswell, Christianity, Social Tolerance, and Homosexuality : Gay People in Western Europe from the Beginning of the Christian Era to the Fourteenth Century, University of Chicago Press; 8th Edition. edition (November 1, 2005 )
Abul Kasem, Sex and Sexuality in Islam, Part 6
লুতের কাহিনী বর্ণনায় কোরানের এবং বাইবেলীয় ব্যাখ্যা প্রায় একই রকম। কেবল একটি জায়গায় বড় পার্থক্য আছে। লুত বাইবেলীয় দৃষ্টিকোনো থেকে কোনো পয়গম্বর না হলেও কোরানের দৃষ্টিতে তিনি একজন পয়গম্বর। বাইবেল অনুযায়ী লুতের সাথে তার দুই কন্যার অবৈধ সম্পর্ক ছিলো, এবং মদ্যপানরত অবস্থায় লুত তার কন্যাদের সাথে মিলিত হন এবং কন্যাদ্র গর্ভবতী করে ফেলেন (Genesis, 19:30-36)। কোরানে লুতের সম্বন্ধে এরকম কোনো কিছু পাওয়া যায় না, তাকে ধার্মিক হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।
করে সডোমবাসীরা। নিহতদের মধ্যে লুতের স্ত্রীও ছিলেন”। লুত-সম্প্রদায়ের ধ্বংসবিষয়ক বর্ণনা কোরানে বহু সুরায় আছে (৭:৮০-৮৪, ২১:৭৪-৭৫, ২৬:১৬০- ১৬৫, ২৭:৫৪-৫৮, ২৯:২৮-৩৫ ইত্যাদি দ্রঃ)।
আমরা এই বইয়ে কেবল সূরা আ’রাফ এর প্রাসঙ্গিক আয়াতগুলো (৭:৮০- ৮৪)উল্লেখ করব –
৭:৮০- আর আমি লুতকে নবুয়ত দান করে পাঠিয়েছিলাম, যখন সে তার সম্প্রদায়কে বলেছিলঃ তোমরা এমন অশ্লীল কুকর্ম করেছো যা তোমাদের পূর্বে বিশ্বে কেউ আর করেনি।
৭:৮১- তোমরা স্ত্রীলোকদের বাদ দিয়ে পুরুষদের দ্বারা তোমাদের যৌন ইচ্ছা নিবারণ করে নিচ্ছ।প্রকৃতপক্ষে তোমরা হচ্ছো সীমালঙ্ঘনকারী সম্প্রদায়।
৭:৮২- উত্তরে তার সম্প্রদায় শুধু বললো, এদের (লুত এবং তার সঙ্গীদের) জনপদ হতে বহিষ্কৃত কর, এরা নিজেদেরকে বড় পবিত্র লোক বলে প্রকাশ করছে।
৭:৮৩- পরিশেষে আমি লুতকে এবং তার পরিবারের লোকদেরকে শাস্তি হতে রক্ষা করেছিলাম তার স্ত্রী ছাড়া, তার স্ত্রী ছিল ধ্বংসপ্রাপ্ত লোকদের অন্তর্ভুক্ত।
৭:৮৪- অতঃপর আমি তাদের উপর মুষলধারায় বৃষ্টি বর্ষণ করেছিলাম, সুতরাং অপরাধী লোকদের পরিনাম কি হয়েছিল তা লক্ষ্য কর।
আল-তিবরানি এবং আল-বায়হাকির বর্ণনায় দেখা যায়, হযরত মুহম্মদ (দঃ) বলেছেন-
চার ধরনের লোক আছে যারা আল্লাহর তীব্র ক্রোধ মাথায় নিয়ে সকালে ঘুম হতে জাগে এবং আল্লাহর অসন্তুষ্টি মাথায় নিয়েই রাতে ঘুমাতে যায়। তাকে জিজ্ঞেস করা হলো- ‘তারা কে, হে আল্লাহর রাসুল’? নবী বলেন- ‘সেই সমস্ত পুরুষ যারা মেয়ে সাজতে চেষ্টা করে এবং সেই সমস্ত মেয়ে যারা পুরুষ সাজতে চেষ্টা করে (পোষাক-পরিচ্ছেদ এবং আচার আচরণ দ্বারা) এবং সেই সমস্ত লোক যারা পশুর সাথে সঙ্গম করে এবং সেই সমস্ত পুরুষ যারা পুরুষের সাথে সঙ্গম করে’।
বিভিন্ন ইসলামী সোর্সের উল্লেখ করে আব্দুর রহমান ডইয়ের শারিয়া দ্য ইসলামিক ল (১৯৯৮) নামক গ্রন্থটিতে সিদ্ধান্ত টানা হয়েছে যে সমকামীতা কবিরা গুনাহ্ বা মহাপাপ। উক্ত গ্রন্থে বলা হয়েছে –
“কোনো ব্যক্তি যদি লালসাভরে কোনো বালককে চুমা দেয়, মহান আল্লাহ তাকে এক হাজার বছর দোজখের আগুনে পুড়িয়ে শাস্তি দেবেন।”
আব্দুর রহমান ডইয়ের গ্রন্থে আরও দাবি করা হয়েছে যে নবী বলেছেন-
“কোনো ব্যক্তি যদি লালসাভরে কোনো বালককে স্পর্শ করে, তার উপর আল্লাহ তার ফেরেশতাবর্গ ও সমস্ত মানব জাতির অভিশাপ বর্ষিত হয়”।
তবে আব্দুর রহমান ডইয়ের এই ব্যাখ্যার সাথে সবাই যে একমত হয়েছেন তা নয়। বহু ইসলামী বিশেষজ্ঞ শারিয়া আইনকে ইসলামের অংশ বলেই মনে করেন না, তারা মনে করেন শারিয়া আইন কোরান বিরোধী”। শারিয়া আইনের বিরোধিতা করে উদারপন্থি মুসলিম সংগঠন যেমন আল ফাতিহা ফাউন্ডেশন, ক্যানাডিয়ান মুসলিম কংগ্রেসসহ অনেক সংগঠনই সমকামিতাকে স্বাভাবিক প্রবৃত্তি বলে রায় দিয়েছে। তারা মনে করে সডোমবাসীরা মারা গিয়েছিল দুর্নীতি এবং লালসার কারণে, সমপ্রেমের কারণে নয়। লালসামূলক প্রবৃত্তিকে কোরান মূখ্যত সমপ্রেম সম্বন্ধে কোরান নিরবতা পালন করেছে বলে তারা মনে করেন। উদারপন্থি লেখিকা ইরাশাদ মানজী, যিনি নিজেও একজন সমকামী, তিনি মনে করেন ইসলামে সমকামিতা গ্রহণীয়। সেজন্যই প্রতিটি যুগে মুহম্মদ ইবনে আব্বাদ আল মুতাদিদ, অয়াবু নুহাস, ইফতি নাসিমের মতো কবি সাহিত্যিক মুসলিম বিশ্বে সব সময়ই খুঁজে পাওয়া যারা সমকামিতাকে উদযাপন করেছেন।
কোরানে সমকামিতার ব্যাপারে কিছু ক্ষেত্রে পরষ্পর-বিরোধিতা আছে। কোরান থেকে একদিকে আমরা যেমন দেখতে পাই আল্লাহ সমকামিতার কারণে গোটা একটা শহরকে ধ্বংস করে ফেলছেন, অন্যদিকে তিনি আবার তার পবিত্র গ্রন্থটির কয়েকটি সূরার বেশ কিছু আয়াতে (যেমন, ৫২:২৪, ৫৬:১৭, ৭৬:১৯) ধার্মিকদের জন্য বেহেস্তে উদ্ভিন্নযৌবনা হুরীর পাশাপাশি ‘মুক্তা-সদৃশ কিশোর বালকের সেবা পাওয়ারও আশ্বাস দিয়েছেন। কোরানের বর্ননা মতে, এই মুক্তা সদৃশ কিশোর বালকেরা হবে চিরতরুণ (৭৬:১৯), তাদের আভরণ হবে স্বচ্ছ রেশমের কাপড় (৭৬:২১), এবং তারা অলঙ্কৃত থাকবে রৌপ্য নির্মিত কঙ্কণে (৭৬:২২)। এদেরকে সাধারণভাবে অভিহিত হয় গিলমান হিসেবে। বেহেস্তে গিলমানদের সত্যিকার দায়িত্ব নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মতপার্থক্য থাকলেও এদের কাজ যে কেবল পানীয় বিতরণে সীমাবদ্ধ থাকবে না,তা অনেক স্কলারই মনে করেন। আসলে গ্রীক সভ্যতার মতোকিশোর বালকদের সাথে প্রেম করার রীতি পারস্য এবং আরব দেশগুলোতে সে সময় প্রচলিত ছিল। সে সময়কার সাহিত্য-সংস্কৃতির অনেক উপকরণেই এর উল্লেখ পাওয়া যায়। আর সেজন্যেই বেহেস্তের বর্ণনায় আয়তলোচনা হুরদের পাশাপাশি মুক্তাসদৃশ্য চিরকিশোরদের আশ্বাস দেয়া হয়েছে বলে অনেকেই মনে করেন।
বাইবেল অনুযায়ী অবশ্য লুতের স্ত্রী লুতের সাথে পালানোর সময় পেছনে তাকাতে গিয়ে লবনের স্তম্ভে পরিনত হন।
নূর নূরানী কোরান শরীফ, হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (রঃ),সোলেমানিয়া বুক হাউজ
Sharia the Islamic Law, 1998 by Abdur Rahman I. Doi; Publisher A.S. Noordeen, G.P.O. Box No. 10066, Kuala Lumpur, Malaysia.
Also see, “Narated By Abdullah ibn Abbas : The Prophet (pbuh) said: If you find anyone doing as Lot’s people did, kill the one who does it, and the one to whom it is done.” – Abu Dawud 38:4447
এ প্রসঙ্গে পড়ুন হাসান মাহমুদ, ইসলাম ও শারিয়া (৩য় সংস্করণ), শব্দশৈলী
এই ধরনের পরষ্পরবিরোধিতা থাকার কারনেই সমকামিতার ব্যাপারে শাস্তিপ্রদানের ক্ষেত্রে ইসলামী পন্ডিতগণ একমত হতে পারেননি, বিভিন্ন বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন শাস্তি নির্ধারণ করেছেন। কোনো কোনো আইনবিদের মতে ইসলামি আইনানুযায়ী এই অপরাধের জন্যে কোনোপ্রকার নির্ধারিত শাস্তি (হুদুদ) নেই, বরং ঘটনার তা’জির বা গুরুত্ব বিবেচনা করে শাস্তি নির্ধারণ করতে হবে। যেমন, ইমাম আবু হানিফার মতে সডোমি ব্যভিচারের সমতুল্য নয়, সুতরাং সডোমির জন্যে কারও উপর হুদুদ শাস্তি প্রয়োগযোগ্য নয়, এক্ষেত্রে অপরাধীদের উপর তা’জিরের মাধ্যমে শাস্তি প্রদান করতে হবে। কিন্তু আবার ইমাম মালিকের মতে সডোমির জন্যে অপরাধীকে হুদুদ আইনানুযায়ী শাস্তি প্রদান করতে হবে, অপরাধী বিবাহিত না অবিবাহিত তা বিচার করা চলবে না। যে হাদিসের সুত্র ধরে ইমাম মালিক মৃত্যুদণ্ড প্রদানের পক্ষপাতি, সে হাদিসটি নিম্নরূপ
আবু হুরাইরা হতে বর্ণিত যে রাসুলুল্লাহ (দঃ) বলেছেনঃ ‘যদি তোমরা এমন কাউকে পাও যারা লুতের গোত্রের কাজ করেছে (অর্থাৎ সমকামিতা), তাদের উপরের জন এবং নীচের জন উভয়কেই হত্যা করো’। আরেক বর্ণনায় তিনি বলেছেন যে ‘যে করছে এবং যার সাথে করছে- উভয়কে হত্যা কর।
আবু ইউসুফ, ইমাম শাফেয়ি এবং মহম্মদের মতানুযায়ী অপরাধী যদি বিবাহিত হয়, তার শাস্তি হবে পাথর নিক্ষেপে মৃত্যু, তবে অবিবাহিত হলে তা’জির প্রয়োগযোগ্য।
Anwar Shaikh, Islam : Sex and Violence,
http://iranpoliticsclub.net/library/english-library/islam-sex01/index.htm; Also see, Syed Kamran Mirza, Islamic Heaven, http://mukto-mona.com/wordpress/?p=396 etc.
Sharia the Islamic Law, 1998 by Abdur Rahman I. Doi; Publisher A.S. Noordeen, G.P.O. Box No. 10066, Kuala Lumpur, Malaysia.
Narrated by al-Tirmidhi, 1456; Abu Dawud 38:4447; Ibn Maajah, 2561:; Classed as saheeh by Shaykh al-Albaani in Saheeh al-Jaami’, no. 6589
তবে বিশেষজ্ঞদের শাস্তি নিয়ে যতই মতান্তর থাকুক না কেন, অধিকাংশ ইসলামী রাষ্ট্রে সমকামিতার শাস্তি এখনো নির্মম। উদাহরণ স্বরূপ, ইরানে বছর কয়েক আগে (২০০৫ সালে) দুজন কিশোরকে সমকামিতার অপরাধে ফাঁসি দেয়া হয় তারপর সেই লাশ শহরের সাড়া রাস্তায় ট্রাকে করে ঘোরানো হয়। সেই ছবি ইন্টারনেটে প্রকাশিত হলে সারা বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। তালিবান নিয়ন্ত্রিত সময়কার আফগানিস্তানে ১৯৯৮ সালে কান্দাহারে তিনজন পুরুষকে জীবন্ত মাটিতে পুঁতে হত্যা করা হয়। তাদের অপরাধ ছিল সমকামিতা। ২০০৯ সালে ইরাকে গুপ্ত হত্যায় সাত মাসে বিরাশিজন সমকামী প্রাণ হারায়। সমকামিতাকেন্দ্রিক বিভিন্ন নৃশংসতার ঘটনা মরোক্কো, ইন্দোনেশিয়া, তুরস্ক, সুদান, বাংলাদেশ সহ প্রায় প্রতিটি মুসলিম প্রধান দেশে অহরহই ঘটছে গবেষক খালেদ দুরানের সাম্প্রতিক কিছু গবেষণায় ইসলামী বিশ্বে সমকামিতার নানা দিক উদভাসিত হয়েছে। তার মতে, পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্রের অধিকাংশ মুসলিম সমাজে ছেলে ও মেয়ে স্বতন্ত্রভাবে লালিত হয়, এবং এদের পরবর্তী জীবনচর্চায় এই স্বাতন্ত্র্য নানাভাবে প্রতিফলিত হয়। কট্টর মুসলিম রাষ্ট্রে এমনকি নারী-পুরুষ একত্রে পড়ারও সুযোগ নেই। সৌদী আরব, তালিবানী আমলের আফগানিস্তান, ইরাণ প্রভৃতি দেশগুলোর কথা এক্ষেত্রে উল্লেখ করা যায়। এই লিঙ্গ বিভক্তিকরণ (gender segragation) সমাজের উপর অনেক সময় স্থায়ী প্রভাব তৈরি করে বলে তিনি মত দিয়েছেন। তিনি মনে করেন কর্মক্ষেত্রে নারী-পুরুষের লিঙ্গভিত্তিক বিভেদের প্রাচীর তুলে রাখায় এর প্রভাবে সমকামিতা সাময়িক সময়ের জন্য হলেও বাড়তে সহায়তা করে। মরক্কোর ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা একটা সময় একারণেই গভীরভাবে সমপ্রেমে আসক্ত হয়ে পড়ে বলে তার গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে। দুরানের ক্ষেত্র সমীক্ষা থেকে জানা যায় যে, তের থেকে বিশ বছর বয়সী ছেলেরাই ইসলামী বিশ্বে বেশি সমকামী হয়ে উঠে। তবে বিবাহিত জীবনে প্রবেশের পর এই অভ্যাস অনেকেরই ধীরে ধীরে কেটে যায়।
তবে যে কারণেই সমকামিতার উন্মেষ ঘটুক না কেন, সামাজিকভাবে সমকামিতাকে ইসলামী বিশ্বে হেয় করেই দেখা হয়। হোমসেক্সুয়ালিটি বিষয়ে ইসলামী আইন এখন পর্যন্ত মানবিক এবং যুগোপযুগী নয় বলেই বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। অন্য সবার মতোগে এবং লেসবিয়ানদেরও যে একান্তভাবেই নিজস্ব জীবন থাকতে পারে, তাদের অধিকার থাকতে পারে নিজেদের পছন্দানুযায়ী জীবন পরিচালনা করার, সেই ব্যাপারটাই ইসলামী বিশ্বে এখনো অস্বীকৃত। সমকামীদের জীবনধারা যতক্ষণ পর্যন্ত সমাজের অপর অংশের প্রতি ক্ষতিকর না হচ্ছে, ততক্ষণ পর্য্যন্ত তাদের অধিকারকে পদদলিত করা কিংবা কিছু ধর্মীয় অনুশাসনের নামে তাদের উপর অত্যাচার করার কিংবা তাদেরকে হত্যা করার অধিকার কারও নেই বলেই আজকের বিশ্বের সচেতন নাগরিকেরা এবং মানবাধিকার কর্মীরা মনে করে। আশার কথা এই যে, বিচ্ছিন্নভাবে হলেও মুসলিমমদের মধ্যে থেকেই কিছু সংগঠন মানবিক দিকটি সামনে রেখে এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিয়েছে, ইন্টারনেটেও গড়ে উঠেছে বেশ কিছু ‘গে মুসলিম কমিউনিটি’। আশা করা যায় অন্যান্য ধর্মের মতোইসলামেও ধীরে ধীরে উদারনৈতিক হাওয়া লাগবে এবং সমকামীদের প্রতি অহেতুক বিদ্বেষ পোষণ না করে বরং সমাজের বিবেকবোধকে তারা মানবতার পথে পরিচালিত করবে।
Execution of two gay teens in Iran spurs controvers; Saturday, July 23, 2005; http://en.wikinews.org/wiki/Execution_of_two_gay_teens_in_Iran_spurs_controversy ‘Three Men Buried Alive Under a Pile of Stones & a Wall Pushed on Top of Them, For Sodomy in The Town of Kandahar; http://www.rawa.org/handcut.htm
Militias target some Iraqis for being gay, USA TODAY, http://www.usatoday.com/news/world/ iraq / 2009-07-28-gays-in-iraq_N.htm?csp=34
Khalid Duran, Homosexuality in Islam. Homosexuality and World Religions. Valley Forge, Pennsylvania: Trinity P _International, 1993. 181-197
♦ রূপান্তরকামীতা আর উভকামিতার জগৎ
♦ গবেষণার রুদ্ধ দুয়ার খুললেন যারা
♦ গে মস্তিষ্ক এবং গে জিনের খোঁজে
♦ সমকামিতা কি কোনো জেনেটিক রোগ?
“সমকামিতা” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ