১ লক্ষ বছর আগেও পৃথিবীতে মানুষ ছিল। প্রত্নতাত্ত্বিকরা এই সময়টাকে বলছেন, আদি প্রত্নপ্রস্তর যুগ। ভূপালের কাছে ভীমভেটকা পাহাড়ে, প্রত্নবিজ্ঞানীরা ১৯৭১ থেকে টানা অনুসন্ধান চালিয়ে কিছু পাথরের হাতিয়ার পেয়েছেন। এ’গুলো কম- বেশি ১ লক্ষ বছরের পুরোন। ৪০ হাজার বছর আগে আঁকা গুহাচিত্রের বহু ছবি রয়েছে ‘ফোর হানড্রেড সেঞ্চুরিজ অব কেভ আর্ট’ বইতে। বইটির লেখক পৃথিবী বিখ্যাত গুহাচিত্র বিশেষজ্ঞ ও ঐতিহাসিক ল্য অ্যাবে আঁরি ব্রুইল। ৪০ হাজার থেকে ১ লক্ষ বছরের পুরনো প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন থেকে মনে হয়, আদিম মানুষের মধ্যে তখনও উপাসনা-ধর্মের প্রাথমিক বিকাশ শুরু হয়নি।

মিশর, মেসোপোটেমিয়া, ব্যাবিলন, গ্রিস, চিন, ইরান, ভারত ইত্যাদি দেশে ধর্মের শুরুর যে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া গেছে, সে সব নিদর্শনগুলোর তৈরির কাল নির্ধারণ করা হয়েছে আধুনিক বিজ্ঞানের সাহায্য নিয়ে পাশাপাশি অঙ্কনশৈলী, বর্ণবিন্যাসের পদ্ধতিও পরীক্ষা করা হয়েছে। এখনও পর্যন্ত পাওয়া নানা নিদর্শনের ভিত্তিতে অনুমান করা যায় যে, পৃথিবীতে উপাসনা-ধর্মের উৎপত্তি কম-বেশি হাজার দশেক বছরের প্রাচীন। এই উৎপত্তি কোনও এক বা একাধিক অঞ্চলে দেখা গিয়েছিল, পৃথিবী জুড়ে নয়।

পৃথিবীর উপাসনা-ধর্মের (religion) ইতিহাস নিয়ে এর আগে অনেক গবেষণা হয়েছে। কিন্তু গবেষণা শুরুর ইতিহাস মাত্র ১৩০ বছরের পুরনো। তখনকার পৃথিবী আজকের মত ছোট্ট হয়ে যাওয়া অবস্থায় ছিল না। গবেষকরা তাঁদের গবেষণা চালিয়ে ছিলেন এক বা কয়েকটা অঞ্চল বেছে নিয়ে। সেখানকার অধিবাসীদের ঈশ্বর বিশ্বাসের সম্ভাব্য উৎপত্তি ও উপাসনা-ধর্মের ক্রমবিকাশ নিয়ে তাঁদের কাজ সীমাবদ্ধ ছিল। আজ বিভিন্ন অঞ্চলের গবেষণা কর্ম থেকে আমরা অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের সুযোগ পাচ্ছি, পরবর্তী ধাপের কাজগুলো করতে পাচ্ছি। প্রাথমিক গবেষকদের সে সুযোগ ছিল না। বিভিন্ন গবেষকদের তথ্যকে গেঁথে আমরা উপাসনা-ধর্মের উৎপত্তি ও তার ক্রমবিকাশের রূপরেখা তৈরি করতে পারছি। এই পূর্বসূরি গবেষকদের অভিজ্ঞতার সঙ্গে বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিভাগের নানা তথ্য ও তত্ত্বকে মিলিয়ে আমরা বেশ কিছু অনুমানে পৌঁছতে পারছি।

পূর্বসূরি গবেষকদের অনেকেই এমন মত প্রকাশ করেছেন যে, উপাসনা-ধর্মের উৎপত্তি নিয়ে তিনি যে মত প্রকাশ করেছেন, সেটা গোটা বিশ্বের জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, আঞ্চলিকতায় আবদ্ধ নয়।

কোনও উপাসনা-ধর্মের উৎপত্তি ও তার ক্রমবিকাশ তত্ত্ব বিশ্বজনীন হওয়ার পক্ষে একটি বড় সমস্যা বা বাধা রয়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে, বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে অসম বিকাশের সমস্যা ছিল এবং আছে। সুতরাং উপাসনা ধর্মের উৎপত্তি ও বিকাশ পৃথিবী জুড়ে একই ধাঁচে হওয়া অসম্ভব।

আদিম মানুষের উপাসনা ধর্মের উৎপত্তি ও বিকাশের ইতিহাস জানার ক্ষেত্রে আরও একটা বড় ধরনের সমস্যা রয়েছে। আদিম মানুষ থেকে আধুনিক মানুষ পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে উপাসনা-ধর্মের উৎপত্তি ও তার ক্রমবিকাশের ইতিহাস তো কেউ লিখে যায়নি, সুতরাং গোটা বিষয়টাই অনুমান-নির্ভর। অনুমানকে যতটা সম্ভব ঠিক-ঠাক ভাবে পরিচালিত করলে আমরা আদিম মানুষের ইতিহাসের একটা রূপরেখা গড়ে তুলতে পারি। এজন্য বিজ্ঞানের কিছু বিভাগের সাহায্য নেওয়া একান্তই জরুরি। সেগুলো হল, নৃবিদ্যা বা নৃতত্ত্ববিদ্যা (Anthropoligy ), পুরাতত্ত্ব (Archaecology), মনোবিজ্ঞান (Psychology), সমাজবিজ্ঞান (Sociology) এবং কিছুটা ভাষাতত্ত্ব (Philology or Linguistics)।

উপাসনা-ধর্মের উৎপত্তি আদিম মানবগোষ্ঠীর মধ্যে হঠাৎ করে প্রবেশ করেনি। বিভিন্ন মানবগোষ্ঠীর মধ্যে একটু একটু করে গড়ে উঠেছে। উপাসনা-ধর্মের উৎপত্তি ও তার বিবর্তন নিয়ে গবেষণা বা গভীর চিন্তাভাবনার শুরু ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে, সে কথা আমরা আগেই বলেছি। তার আগে উপাসনা-ধর্মের উৎপত্তি নিয়ে যে সব ধারণা প্রচলিত ছিল, সে সব ধারণা এসেছিল বিভিন্ন উপাসনা-ধর্মীয় গোষ্ঠীর অন্ধ-বিশ্বাস থেকে। এইসব আবেগ-সর্বস্ব ধর্মীয় বিশ্বাসের যুক্তিহীনতাকে মাথায় রেখেই বেশ কিছু বিশিষ্ট নৃতত্ত্ববিদ বিজ্ঞানের প্রয়োজনীয় শাখাগুলোর সাহায্য নিয়ে নতুন ভাবে ধর্মের উৎপত্তি ও বিবর্তনের ইতিহাস খোঁজার প্রয়োজন অনুভব করেছিলেন।

পৃথিবীর বিভিন্ন ধর্ম গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ইতিহাস, বিভিন্ন ধরনের ধর্ম-গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক চেতনা সমান ভাবে এগোয়নি। যেমন ইউরোপ, আমেরিকায় খ্রিস্টান ধর্ম- গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক চেতনা যতটা এগিয়েছে, আরব ভূখণ্ডের মুসলিম সাংস্কৃতিক চেতনা ততটা এগোয়নি। সাংস্কৃতিক চেতনা বলতে আমাদের বুঝতে হবে শিক্ষা, শিল্প, সাহিত্য, সংগীত, নাটক, সিনেমা, খেলাধূলা, জ্ঞান-বিজ্ঞানের সঙ্গে সাধারণ মানুষের পরিচয়, এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থান। সংস্কৃতি বলতে বোঝায় চলমান জীবনের ভালো-খারাপ প্রগতি, দুর্নীতি, অন্ধ-বিশ্বাস, যুক্তিমনস্কতা ইত্যাদি সব কিছু। আবার স্থান ভেদে একই ধর্মীয় গোষ্ঠীর মানুষদের চেতনার বিকাশে আমরা অসমতা দেখতে পাই। ইউরো-আমেরিকানরা অর্থের জোরে পৃথিবী জুড়ে খ্রিস্টান ব্রাদার- হুডের পরিধি বাড়াতে চাইছে। পাদ্রিরা আজ সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। তারা পিছিয়ে পড়া বিভিন্ন জনগোষ্ঠীকে ধর্মান্তরের বিনিময়ে শিক্ষা-চিকিৎসা-চাষ-হাতের কাজ শেখানো ইত্যাদি সেবা দিচ্ছে। বাড়ছে খ্রিস্টধর্মীয়দের সংখ্যা। কিন্তু তারপরেও ইউরো- আমেরিকান খ্রিস্টানদের সঙ্গে ঝাড়খণ্ডের খ্রিস্টান বা নাইজিরিয়ার খ্রিস্টানদের সাংস্কৃতিক চেতনার কোনও তুলনাই হয় না। কারণ চেতনা নির্দেশিত হয় বহু শর্তের দ্বারা।

আমাদের দেশের দিয়ে তাকান। দেখতে পাবেন এ’দেশে হিন্দু ধর্মের বিকাশ সর্বত্র সমানভাবে হয়নি। রাজস্থান, গুজরাট, মহারাষ্ট্র এবং উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, বিহার-সহ গো-বলয়ে হিন্দু ধর্মীয় আবেগ যতটা প্রবল, পশ্চিমবঙ্গসহ উত্তর-পূর্ব ভারতে ততটাই দুর্বল।

সাংস্কৃতিক চেতনা যে সব অঞ্চলে এগিয়েছে, সেখানেই ধর্মীয়

বিশ্বাসগুলো দুর্বল হয়েছে। যুক্তিবাদের অগ্রগমনের

সঙ্গে সঙ্গে যুক্তিহীন ধর্মীয় বিশ্বাসের

অস্তিত্ব ভেঙে পড়ছে।

ধর্মীয় বিশ্বাসের অস্তিত্ব টিকে আছে উৎসবের প্রতীক হিসেবে। ঐতিহ্যের প্রতীক হিসেবে।

আজ আধুনিক শিক্ষা ও মননের অধিকারী মানুষদের কাছে প্রাচীন উপাসনা- ধর্মগুলো গুরুত্বহীন, বোকাবোকা ব্যাপার মনে হতেই পারে, হওয়াটাই স্বাভাবিক। তাঁরা ভারতীয় হলেও বিশ্বাস করে না, তন্ত্র-মন্ত্রে অসুখ সারে, ঈশ্বর কৃপায় মৃত প্রাণ পায়। তাঁরা অসুখ হলে ডাক্তার দেখান। ধর্ম আজ অগ্রণী চেতনার মানুষদের কাছে গুরুত্বহীন—এই সত্য স্বীকার করেও বলি, কেউ যদি বিভিন্ন উপাসনা-ধর্মের উৎপত্তি খুঁজতে গবেষণা করেন, সেটাকে আমরা গুরুত্বহীন মনে করি না। কারণ, এইসব উপাসনা ধর্মের ঐতিহাসিক মূল্যকে আমরা অস্বীকার করতে পারি না। আসুন, এবার আমরা উপাসনা-ধর্মের উৎপত্তি বিষয়ে কিছু প্রধান ধর্মীয় মতবাদ নিয়ে আলোচনায় যাবো।

error: Content is protected !!