পরম দাতা ও দয়ালু আল্লাহ্ তা’আলার নামে (আরম্ভ করিতেছি)।
(অগাধ জ্ঞানদীপ্ত অনন্য ব্যক্তিত্ব প্রাজ্ঞ ইমাম পরম আল্লাহভীরু ও আল্লাহ্প্রেমিক মনীষী শায়খ হাফিজ ইমাদুদ্দীন আবুল ফিদা ইসমাঈল ইব্ন খতীব আবূ হাফ্স উমর ইব্ন কাছীর আশ্শাফেঈ (রঃ) বলেন
সকল প্রশংসা আল্লাহ্ তা’আলার প্রাপ্য যিনি স্বীয় কিতাব (আল-কুরআন) ‘প্রশংসা’ দিয়া আরম্ভ করিয়াছেন। যেমন তিনি বলিয়াছেনঃ
الحمد لله رب الْعَالمِيْنَ الرحمن الرّحيم مالك يوم الْدِيْن (সকল প্রশংসা নিখিল সৃষ্টির প্রতিপালক, পরম দাতা ও দয়ালু, বিচার দিবসের বাদশাহ আল্লাহ্ তা’আলার প্ৰাপ্য।)
তেমনি আরও বলিয়াছেনঃ
الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي أَنْزَلَ عَلَى عَبْدِهِ الْكِتَابَ وَلَمْ يَجْعَل لَّهُ عِوَجًا – قَيِّمًا لِيُنْذِرَ أسًا شَدِيدًا مِنْ لَدُنْهُ وَيُبَشِّرَ الْمُؤْمِنِينَ الَّذِينَ يَعْمَلُونَ الصَّالِحَاتِ أَنَّ لَهُمْ أَجْرًا حَسَنًا مَّاكِثِينَ فِيهِ أَبَدًا – وَيُنْذِرَ الَّذِينَ قَالُوا اتَّخَذَ اللَّهُ وَلَدًا – مَالَهُمْ بِهِ مِنْ عِلْمٍ
ولاً لا بَائِهِمْ – كَبُرَتْ كَلِمَةً تَخْرُجُ مِنْ أَفْوَاهِهِمْ – اِنْ يُقُولُونَ الأكَذباً
(সকল প্রশংসা আল্লাহ্ পাকের প্রাপ্য যিনি স্বীয় বান্দার উপর কিতাব নাযিল করিয়াছেন এবং উহাতে কোনরূপ বক্রতা রাখেন নাই। উহা মজবুত গ্রন্থ। উহা তাহার উপর এই উদ্দেশ্যে নাযিল করিয়াছেন যে, সে আল্লাহ্র তরফ হইতে আসন্ন কঠিন শাস্তি সম্পর্কে সতর্ক করিবে এবং যে সব মু’মিন নেক কাজ করিবে তাহাদিগকে এমন উত্তম প্রতিদানের (জান্নাতের সুসংবাদ দিবে যেখানে তাহারা চিরকাল অবস্থান করিবে। আর যাহারা পুরুষানুক্রমে অজ্ঞতাবশত বলিয়া বেড়ায়, আল্লাহ্ তা’আলার সন্তান আছে, তাহাদিগকেও সাবধান করিয়া দিবে। তাহাদের মুখ নিসৃত উক্ত উক্তি বড়ই ঘৃণ্য। তাহারা মিথ্যা ছাড়া কিছুই বলিতেছে না।) আল্লাহ্ তা’আলা স্বীয় সৃষ্টিকার্যের বর্ণনাও ‘প্রশংসা’ দিয়া আরম্ভ করিয়াছেন। যেমন বলিয়াছেনঃ
الْحَمْدُ لله الذي خَلَقَ السَّمَوَاتِ وَالْأَرْضِ وَجَعَلَ الظُّلُمَاتِ والنُّور – ثُمَّ الَّذِينَ الَّذِي كَفَرُوا بِرَبِّهِمْ يَعْدِلُون-
(সকল প্রশংসা আল্লাহ্র প্রাপ্য যিনি নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডল সৃষ্টি করিয়াছেন এবং আঁধার ও আলোর জন্ম দিয়াছেন। এতদসত্ত্বেও কাফিররা স্বীয় প্রতিপালক প্রভুর সমকক্ষ সত্তা গড়িয়া লয়।)
তারপর তিনি উহার পরিসমাপ্তির বর্ণনাও প্রশংসা’ দিয়া শেষ করিয়াছেন। বেহেশত-দোযখ বিতরণোত্তর পরিস্থিতি প্রসঙ্গে তিনি বলেনঃ
وَتَرَى الْمَلَائِكَةُ حَافِينَ مِنْ حَوْلِ الْعَرْشِ يُسَبِّحُونَ بِحَمْدِ رَبِّهِمْ وَقُضي بينهم بَيْنَهُمْ بالْحَقِّ وقيل الحَمْدُ للهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ
(আর তুমি ফেরেশতাদিগকে আরশের পরিবেষ্টকরূপে দেখিবে; তাহারা তদবস্থায় স্বীয় প্রতিপালক প্রভুর প্রশংসা বর্ণনায় রত থাকিবে । অনন্তর তাহাদের (জ্বিন ও মানবের) ব্যাপারে ইনসাফভিত্তিক ফয়সালা প্রদান করা হইবে । তখন উচ্চারিত হইবে, সকল প্রশংসা নিখিল সৃষ্টির প্রতিপালক প্রভুর প্রাপ্য।)
অন্যত্র আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ
وَهُوَ الله لا لا هُوَ لَهُ الْحَمْدُ فِي الأولى وَالْآخِرَةِ وَلَهُ الْحُكْمُ وَاِلَيْهِ ة الأ ترجعون
(আর আল্লাহ্ তো তিনিই, যিনি ছাড়া অন্য কোন প্রভু নাই। পূর্বাপর সর্বকালের সকল প্রশংসার অধিকারী তিনিই। অনন্তর বিধি-বিধান তাঁহারই চলিবে এবং তোমরা তাঁহারই নিকট ফিরিয়া যাইবে।)
অনুরূপ অপর একস্থানে বলিয়াছেনঃ
الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي لَهُ مَا فِي السَّمَوتِ وَمَا فِي الأَرْضِ وَلَهُ الْحَمْدُ فِي الْآخِرَةِ وَهُوَ الْحَكِيمُ الْخَبِيرُ
(সকল প্রশংসা সেই আল্লাহ্ পাকের প্রাপ্য যাঁহার মালিকানায় নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের সমুদয় বস্তু রহিয়াছে। আখিরাতের সমস্ত প্রশংসাও তাঁহারই প্রাপ্য। তিনি সূক্ষ্মজ্ঞানী ও সূক্ষাদর্শী।)
আদি ও অন্তে সর্বকালে ইতিপূর্বে সৃষ্ট ও ভবিষ্যতে সৃষ্টব্য সকল বস্তুর ব্যাপারেই সকল প্রশংসা আল্লাহ্ তা’আলার প্রাপ্য। তিনি সকল সৃষ্টির জন্যই প্রশংসার পাত্র। আল্লাহ্ নেক বান্দা তাই মুনাজাতে বলিয়া থাকে, ‘হে আমাদের প্রতিপালক প্রভু আল্লাহ্ ! আকাশসমূহে ও পৃথিবীতে যে পরিমাণ প্রশংসা ধরে এবং ভবিষ্যতেও তোমার নিত্য নতুন সৃষ্টির ভিতর যে পরিমাণ প্রশংসা ধরিবে, তত প্রশংসাই তোমার উদ্দেশ্যে নিবেদিত।’ আর এই কারণেই জান্নাতবাসীগণ তাহাদের জন্য আল্লাহ্ পাকের প্রদত্ত স্থায়ী নিয়ামত ও অনুগ্রহরাশি সন্দর্শন করিয়া এবং তাঁহার বিশাল পরাক্রম ও কুদরত উপলব্ধি করিয়া নিজেদের শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণ-বর্জনের সমসংখ্যক বার আল্লাহ্ গুণাবলী ও প্রশংসা বর্ণনা করিবে। এই প্রসঙ্গে আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ
إنَّ الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ يَهْدِيهِمْ رَبُّهُمْ بِإِيمَانِهِمْ تَجْرِي مِنْ تَحتِهِمُ الأَنْهَارُ فِي جَنَّاتِ النَّعِيم – دَعْوَاهُمْ فِيهَا سُبْحَانَكَ اللَّهُم وَتَحيَّتُهُمْ فِيهَا سلام – وَاخِرُ دَعْوَاهُمْ اَنِ الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ .
(যাহারা ঈমান আনিয়াছে ও নেক কাজসমূহ সম্পাদন করিয়াছে, তাহাদের প্রতিপালক প্রভু এই ঈমান ও আমলের বদৌলতে তাহাদিগকে নিশ্চয়ই নিয়ামতে পরিপূর্ণ জান্নাতে লইয়া যাইবেন। সেইসব জান্নাতের নিম্নভাগে ঝর্ণাধারা প্রবহমান থাকিবে। সেখানে তাহাদের স্বতোৎসারিত স্লোগান হইবে- ‘হে আল্লাহ্, তুমি মহান, তুমি পবিত্র, তুমি সর্বগুণাধার।’ আর সেখানে তাহাদের পারস্পরিক সম্বোধন হইবে ‘শান্তি’ (সবার উপর শান্তি বর্ষিত হউক)। তাহাদের সকল কথার শেষ কথা হইবে ‘সকল প্রশংসা নিখিল সৃষ্টির প্রতিপালক প্রভু আল্লাহ্ তা’আলার উদ্দেশ্যে নিবেদিত।’)
মোটকথা সকল প্রশংসা সেই আল্লাহ্ পাকের উদ্দেশ্যে নিবেদিত যিনি একাধারে সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী হিসাবে রাসূলগণকে পাঠাইয়াছেন যেন (বিচার দিবসে) তাঁহার বিরুদ্ধে মানুষের পক্ষে কোন যুক্তি না থাকে। তিনি সর্বশেষে নিরক্ষর, আরবী ভাষাভাষী, মক্কা নিবাসী নবী মুহাম্মদ মুস্তফা (সাঃ)-কে পাঠাইয়াছেন। সেই সর্বশেষ নবী ছিলেন সর্বাধিক দীপ্ত ও অধিকতম আলোকময় পথের দিশারী। আল্লাহ্ তাঁহার নবৃওতের ধারার প্রথম সময় হইতে কিয়ামত পর্যন্ত বিস্তৃত সময়ের যে কোন অংশে পৃথিবীতে অবস্থানকারী প্রতিটি মানুষ ও জ্বিনের কাছে তাঁহাকে পাঠাইয়াছেন। এই প্রসঙ্গে আল্লাহ্ তা’আলা বলিয়াছেনঃ
قُلْ يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنِّي رَسُولُ اللهِ إِلَيْكُمْ جَمِيعًا – الَّذِي لَهُ مُلْكُ السَّمُوتِ وَ الْأَرْضِ لا اله الا هوَ يُحْيِ وَيُمِيتُ – فَامِنُوا بِاللهِ وَرَسُولِهِ النَّبِي الأمي الذي الَّذِي يؤمن بالله وكلماته واتبعوه لعلكم تهتدون
(তুমি বল, হে মানব সম্প্রদায় ! নিশ্চয়, আমি তোমাদের সকলের প্রতি প্রেরিত আল্লাহর রাসূল আর আল্লাহ্ই আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর একচ্ছত্র মালিক। তিনি ভিন্ন অন্য কোন প্রভু নাই। তিনিই জীবন ও মৃত্যু দান করেন। অতএব তোমরা আল্লাহর উপর ঈমান আন ও তাঁহার সেই নিরক্ষর নবীর প্রতি আস্থাবান হও যে রাসূল নিজেও আল্লাহ্ ও তাঁহার বাণীর উপর ঈমান রাখে। অনন্তর তোমরা তাঁহাকে অনুসরণ কর; হয়ত ইহার ফলে তোমরা সঠিক ও সত্যপথ লাভ করিবে।)
অনুরূপ অন্যত্র তিনি বলিয়াছেনঃ
لِأَنْدْرَكُمْ به ومن بَلَمْ ظ (আমি এই উদ্দেশ্যে প্রেরিত হইয়াছি যে, তোমাদিগকে এবং অন্যান্য যাহাদের নিকট ইহা পৌঁছিবে, তাহাদের সকলকেই ইহা দ্বারা সতর্ক করিব।)
অতএব আরবী হউক কিংবা আজমী, কৃষ্ণাঙ্গ হউক কিংবা শ্বেতাঙ্গ, এমনকি মানুষ হউক কিংবা জ্বিন, যাহারই নিকট আল-কুরআন পৌঁছিবে, তিনি তাহারই সতর্ককারীরূপে প্রেরিত হইয়াছেন।
ومن يَكْفْر به من الآحزاب فالثار موعدمه
(যে কোন শ্রেণীর যে কোন ব্যক্তিই উহা প্রত্যাখ্যান করিবে, দোযখ তাহারই জন্য নির্ধারিত রহিয়াছে।
মোটকথা আল্লাহ্ পাকের বাণী দ্বারা স্পষ্টত প্রমাণিত হইতেছে যে, উপরোল্লিখিত দলসমূহের যে ব্যক্তিই আল-কুরআন প্রত্যাখ্যান করিবে, তাহারই ঠিকানা হইবে জাহান্নাম। তদ্রূপ অন্যত্র বলিয়াছেনঃ
فَدَرْنِئْوَ مَنْ يدب بهذا الْحَدِيْ سسَتسْتدْرِجُهُمْ من حَيْتُ ليَخلمُون
(যে ব্যক্তি এই বাণীকে মিথ্যা বলিয়া আখ্যায়িত করে, দেখো, আমি তাহার সহিত কিরূপ আচরণ করি। শীঘ্রই আমি তাহাদিগকে (না ফরমানী কাজে) এইরূপ অবকাশ দিব, যাহাতে তাহারা (মহাক্ষতির ব্যাপারটা) বুঝিতেও না পারে।)
নবী করীম (সাঃ) বলিয়াছেন, আমি শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গ সকলের প্রতি প্রেরিত হইয়াছি। মুজাহিদ উহার ব্যাখ্যায় বলিয়াছেন, নবী করীম (সাঃ) মানুষ ও জ্বিন সকলের প্রতি প্রেরিত হইয়াছেন। মোটকথা নবী করীম (সাঃ) মানুষ ও জ্বিন উভয় জাতির প্রতিই রাসূল হিসাবে প্রেরিত হইয়াছেন। আল্লাহ্ তা’আলা তাঁহার প্রতি যে মহাগ্রন্থ আল-কুরআন নাযিল করিয়াছেন, তিনি উহা তাহাদের নিকট পৌছাইয়া দিবার দায়িত্বপ্রাপ্ত হইয়াছেন। উক্ত মহাগ্রন্থে সরাসরি কিংবা পরোক্ষভাবে কোন বাতিল বা অসত্য প্রবেশ করিতে পারে না। উহা প্রজ্ঞাময় প্রশংসিত সত্তার পক্ষ হইতে অবতীর্ণ কিতাব। উক্ত মহাগ্রন্থ সম্বন্ধে চিন্তা ও গবেষণা করিতে আল্লাহ্ তা’আলা মানুষকে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করিয়াছেন। তিনি বলিয়াছেনঃ
أَفَلَا يَتَدَبَّرُونَ الْقُرْآنَ – وَمَا كَانَ مِنْ عِنْدِ غَيْرِ الله لَوَجَدُوا فِيهِ اخْتِلَافًا كثيرا
(তাহার কি আল-কুরআন সম্বন্ধে চিন্তা করিয়া দেখে না? যদি উহা আল্লাহ্ ভিন্ন অন্য কাহারো নিকট হইতে অবতীর্ণ হইত, তাহা হইলে তাহারা উহার ভিতর অনেক স্ববিরোধীতা দেখিতে পাইত।)
তিনি আরও বলিয়াছেনঃ
كِتَابُ أَنْزَلْنَاهُ إِلَيْكَ مُبَارَكَ لَيُدَبِّرُوا آيَاتِهِ وَلِيَتَذَكَّرُوا أُولُوا الْأَلْبَابِ –
(উহা সেই মুবারক কিতাব যাহা তোমার প্রতি এই উদ্দেশ্যে নাযিল করিয়াছি যে, লোকজন উহার আয়াতসমূহ সম্বন্ধে চিন্তা ও গবেষণা করিবে এবং জ্ঞানীগণ উহা হইতে উপদেশ গ্রহণ করিবে।
তিনি অন্যত্র বলিয়াছেনঃ
أفَلاً يَتَدَبَّرُوْنَْ الْقّرَانَ آمْ على قُلُوْب أَقْفَالُهًا
(তাহারা কি আল-কুরআন সম্বন্ধে চিন্তা ও গবেষণা করে না? অথবা তাহাদের অন্তরসমূহ কি তালাবদ্ধ হইয়া রহিয়াছে?)
অতএব আল্লাহ্ পাকের কালামের অর্থ সঠিকরূপে জ্ঞাত হওয়া ও অপরকে উহা জ্ঞাত করা এবং উহার তাৎপর্য ও রহস্যাবলী মানুষের নিকট তুলিয়া ধরা আলেমগণের দায়িত্ব ও কর্তব্য।
এই প্রসঙ্গে আল্লাহ্ তা’আলা বলিতেছেনঃ
وَإِذْ أَخَذَ اللَّهُ مِيثَاقَ الَّذِينَ أوتُوا الْكِتَابَ لِتُبَيِّنَنَّهُ لِلنَّاسِ وَلَا تَكْتُمُوْنَهُ
فَنَبَذُوهُ وَرَاءَ ظُهُورهمْ وَاشْتَرُوا بِهِ ثَمَنًا قَلِيلاً – فَبِئْسَ مَا يَشْتَرُونَ
(অনন্তর আল্লাহ্ কিতাব প্রাপ্ত জাতির নিকট হইতে এই দৃঢ় প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করিলেন যে, তোমরা অবশ্যই উহা সর্বসাধারণের নিকট সুস্পষ্টরূপে প্রকাশ করিবে এবং উহার কিছুই গোপন করিবে না। তাহা সত্ত্বেও তাহারা উক্ত প্রতিশ্রুতি অবলীলাক্রমে ভঙ্গ করিল আর উহার পরিবর্তে তুচ্ছ স্বার্থ ক্রয় করিল। তাহারা যাহা ক্রয় করিতেছে তাহা বড়ই ঘৃণ্য ও জঘন্য।)
তিনি আরও বলিয়াছেনঃ
إِنَّ الَّذِينَ يَشْتَرُونَ بِعَهْدِ اللَّهِ وَأَيْمَانِهِمْ ثَمَنًا قَلِيلاً أُولئِكَ لَاخَلاقَ لَهُمْ فِي الْآخِرَةِ وَلَا يُكَلِّمُهُمُ اللَّهُ وَلَا يَنْظُرُ إِلَيْهِمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَلا يُزَكِّيهِمْ – وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ
(যাহারা আল্লাহ্র নিকট প্রদত্ত স্বীয় প্রতিজ্ঞা ও প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে তুচ্ছ স্বার্থ ক্রয় করে, আখিরাতে তাহাদের ভাগ্যে (নিয়ামতের) কোন হিস্সা নাই। কিয়ামতের দিন আল্লাহ্ তা’আলা না তাহাদের সহিত কথা বলিবেন, না তাহাদের প্রতি তাকাইবেন, না তাহাদিগকে পবিত্র করিবেন। তাহাদের জন্য নির্ধারিত রহিয়াছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।)
উপরোক্ত আয়াতসমূহে আল্লাহ্ তা’আলা আহলে কিতাবদের নিন্দা করিয়াছেন। কারণ তাহারা তাহাদের প্রতি অবতীর্ণ কিতাব উপেক্ষা করিয়া পার্থিব সম্পদ পুঞ্জীভূত করিয়াছে এবং আল্লাহর কিতাব অনুসরণ না করিয়া উহার বিরোধী পক্ষ অবলম্বন করিয়াছে। ‘অতএব হে মুসলিম জাতি ! যে পাপের কারণে আল্লাহ্ পাক পূর্ব গ্রন্থধারীদের নিন্দা করিয়াছেন, উহা হইতে বিরত থাকা আমাদের জন্য অপরিহার্য কর্তব্য। তেমনি আমাদের প্রতি অবতীর্ণ তাঁহার কিতাব শিক্ষা করার ও অপরকে শিক্ষা দিবার এবং উহার অর্থ, তাৎপর্য ও রহস্যাবলী নিজেদের জ্ঞাত হইবার ও অপরকে জ্ঞাত করার যে আদেশ তিনি আমাদিগকে প্রদান করিয়াছেন, উহা পালন করা আমাদের জন্য ফরয।’ এই প্রসংগে আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ
ألَمْ يَأْنِ لِلَّذِينَ آمَنُوا أَنْ تَخْشَعَ قُلُوبُهُمْ لِذِكْرِ اللهِ وَمَا نَزَّلَ مِنَ الْحَق
وَلَا يَكُونُ كَالَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ مِنْ قَبْلُ فَطَالَ عَلَيْهِمُ الْأَمَدُ فَقَسَتْ قُلُوبُهُمْ . وَكَثِيرُ مِنْهُمْ فَاسِقُونَ –
اعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ يُحْيِ الْأَرْضَ بَعْدَ مَوْتِهَا – قَدْ بَيَّنَّا لَكُمُ – الْآيَاتِ لَعَلَّكُمْ تَعْقِلُونَ
(মু’মিনদের জন্য কি এখনও সময় আসে নাই যে, আল্লাহ্র উপদেশ ও তাঁহার অবতীর্ণ সত্যের জন্য তাহাদের অন্তর সন্ত্রস্ত হইবে? আর তাহাদের জন্য কি সেই সময়ও নাই যখন তাহারা পূর্ববর্তী গ্রন্থধারীদের ন্যায় আর বিভ্রান্ত হইবে না? তাহাদের পূর্ব গ্রন্থধারীদের অন্তরসমূহ (প্রত্যাদেশ বিহীন অবস্থায়) বহুকাল থাকার পর কঠিন (সত্য গ্রহণে পরান্মুখ) হইয়া গেল। ফলে তাহাদের বিপুল সংখ্যক লোক অবাধ্যতাপরায়ণ হইল। তোমরা জানিয়া রাখ যে, পৃথিবীর মৃত্যুর পর (মানব জাতির আধ্যাত্মিক অধঃপতনের পর) আল্লাহ্ পাক উহাকে পুনর্জীবন দান করিবেন। নিশ্চয় আমি তোমাদের জন্য (স্বীয়) নিদর্শনাবলী সুস্পষ্ট করিয়া দিয়াছি । ফলে হয়ত তোমরা বিবেক বুদ্ধি প্রয়োগ করিবে।)
উপরের আয়াত দুইটির প্রথমটিতে আল্লাহ্ তা’আলা পূর্ব গ্রন্থধারীদের আত্মিক অধঃপতনের উল্লেখ করিয়াছেন। আর দ্বিতীয়টিতে তিনি উল্লেখ করিলেন মৃত পৃথিবীকে পুনর্জীবন দানের ব্যাপারটি। ইহাতে এই ইঙ্গিত রহিয়াছে যে, পৃথিবী বিশুষ্ক হইলে (বৃষ্টি দ্বারা) যেভাবে তিনি উহাকে পুনর্জীবিত ও ফুলে-ফলে সুসজ্জিত করেন, তেমনি পাপাচার ও অনাচারে বিশুষ্ক মানুষের কঠিন অন্তরসমূহ ঈমান ও হিদায়েতের বৃষ্টি দ্বারা পুনর্জীবিত তথা আলোকপ্রাপ্ত করেন। আল্লাহ্ পাকের কাছে আমাদের ঐকান্তিক প্রার্থনা, তিনি যেন আমাদিগকেও অনুরূপ পবিত্র ও আলোকপ্রাপ্ত করেন। অবশ্যই তিনি উদারপ্রাণ মহান দাতা।
কুরআন পাকের ব্যাখ্যার সর্বোত্তম পন্থা কোনটি? এ প্রশ্নের জবাব এই কুরআন মজীদের ব্যাখ্যা কুরআন মজীদ দ্বারা করাই সর্বোত্তম পন্থা। কারণ দেখা যায় যে, কুরআনের এক জায়গায় কোন বিষয় সংক্ষেপে বলা হইয়াছে অন্য জায়গায় উহা সবিস্তারে বর্ণিত হইয়াছে। তবে আয়াত বিশেষের বেলায় যদি সেরূপ না হয়, তখন রাসূলের সুন্নাহ্ সাহায্যে উহার ব্যাখ্যা দান করিতে হইবে। কারণ, সুন্নাহ্ কুরআনেরই ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ। ইমাম শাফেঈ (রঃ) বলেন, মহানবী (সাঃ) যেসব আহকাম ও ফয়সালা প্রদান করিয়াছেন, তাহা কুরআনের আলোকেই করিয়াছেন ৷ এই প্রসঙ্গে স্বয়ং আল্লাহ্ বলেনঃ
إِنَّ أَنْزَلْنَا إِلَيْكَ الْكِتَابَ بِالْحَقِّ لِتَحْكُم بَيْنَ النَّاسِ بِمَا أَرَاكَ اللَّهُ – وَلَا تَكُنْ لِلْخَائِنِينَ خَصِيمًا.
(নিশ্চয় আমি তোমার কাছে সত্যবাহী মহাগ্রন্থটি এই উদ্দেশ্যে নাযিল করিয়াছি যে, ইহার আলোকে তুমি মানুষের বিবাদ-বিসম্বাদের মীমাংসা প্রদান করিবে। অনন্তর তুমি আত্মসাৎকারীদের পক্ষাবলম্বন করিও না।)
অনুরূপ তিনি অন্যত্র বলেনঃ
وَمَا أَنْزَلْنَا عَلَيْكَ الْكِتَابَ إِلا لِتُبَيِّنَ لَهُمُ الَّذِي اخْتَلَفُوا فِيْهِ وَهُدًى وَرَحْمَةً لِقَوْمٍ يُؤْمِنُونَ –
(তোমার কাছে আমি এই জন্য কিতাব পাঠাইয়াছি যে, তাহাদের বিরোধ-বিসম্বাদের মূল সত্যটি তাহাদের নিকট পরিষ্কার করিয়া দিবে এবং ঈমানদারের জন্য উহা আলোকবর্তিকা ও কল্যাণ ভাণ্ডার হইয়া দেখা দিবে।)
তিনি আরও বলেনঃ
وآأَتْرَلْنَا الَيْكَ الذّكْرَ لتُبَيَنَ للثّاس مَا نَزْلَ الَيْهِم ولَعْلّهُمْ يُتَفكّرونَ
(এবং আমি তোমার কাছে এই জন্য উপদেশগ্রন্থ পাঠাইয়াছি যে, মানব সম্প্রদায়ের উদ্দেশ্যে যাহা কিছু বলা হইল তাহা সবই তুমি তাহাদিগকে বুঝাইয়া বলিবে; তাহা হইলে হয়ত তাহারা চিন্তা-ভাবনা করিবে। )
এসব কারণে নবী করীম (সাঃ) বলিয়াছেন, ‘তোমরা শোন, আমাকে আল-কুরআন ও তৎসহ অনুরূপ অন্য এক বস্তু প্রদান করা হইয়াছে।’ বলাবাহুল্য আল-কুরআনের সহিত প্রদত্ত অনুরূপ অন্য বস্তুটি হইল আস্ সুন্নাহ্ (কথা ও কাজের মাধ্যমে মহানবী (সা) কর্তৃক বর্ণিত আল-কুরআনের ব্যাখ্যা) মহানবী (সাঃ)-এর প্রতি কুরআনের মত সুন্নাহও অবতীর্ণ হইয়াছে। তবে পার্থক্য এই, আল-কুরআন তাঁহাকে পড়িয়া শুনানো হইত। পক্ষান্তরে আসুন্নাহ্ তাঁহাকে পড়িয়া শুনানো হইত না (বরং ভাব ও বিষয়বস্তু তাঁহাকে জানানো হইত এবং তিনি নিজ ভাষায় উহা প্রকাশ করিতেন)। আল-কুরআনের ন্যায় আস্ সুন্নাহও যে মহানবীর উপর অবতীর্ণ হইত, ইমাম শাফেঈ প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তিবৃন্দ বহু সংখ্যক দলীল দ্বারা তাহা প্রমাণ করিয়াছেন। এই স্থানে উহা আলোচনার উপযোগী ক্ষেত্র নহে।
উপরের আলোচনার প্রতিপাদ্য বিষয় এই যে, আল-কুরআনের ব্যাখ্যা আমাদিগকে সর্বপ্রথম উহাতেই খুঁজিতে হইবে। উহাতে না পাইলে সুন্নাহ্ খুঁজিতে হইবে। প্রসঙ্গত নিম্নোক্ত হাদীস উল্লেখ্যঃ
বিখ্যাত সাহাবী মু’আয ইবন জাবালকে ইয়ামান প্রদেশের প্রশাসক করিয়া পাঠাইবার কালে নবী করীম (সাঃ) তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘তুমি কিসের সাহায্যে শাসনকার্য চালাইবে?’ তিনি বলিলেনঃ আল্লাহর কিতাবের সাহায্যে। নবী করীম (সা) বলিলেন, উহাতে যদি (বিশেষ কোন সম্যসার সমাধান) না পাও? তিনি জবাব দিলেন, রাসূলের সুন্নাহর সাহায্যে। নবী করীম (সাঃ) জিজ্ঞাসা করিলেন, উহাতেও যদি না পাও? তিনি জবাব দিলেন (কুরআন-সুন্নাহর আলোকে) নিজের জ্ঞান-বুদ্ধি প্রয়োগ করিয়া সমাধান বাহির করিতে চেষ্টা করিব। নবী করীম (সাঃ) হৃষ্টচিত্তে তাঁহার বক্ষে করাঘাত করিয়া বলিলেন, সেই আল্লাহ্ প্রশংসা করি যিনি স্বীয় রাসূলের প্রতিনিধিকে তাঁহার মনোপূত পথ প্রদর্শন করিয়াছেন।
হাদীসটি ‘মুসনাদ’ এবং ‘সুনান’ সংকলনে বিশুদ্ধ সনদে বর্ণিত রহিয়াছে। (এই গ্রন্থে) যথাস্থানে উহা উল্লেখ করা হইয়াছে।
আল-কুরআনের বিশেষ কোন আয়াতের ব্যাখ্যা যদি আমরা কুরআন বা সুন্নাহ্র কোনটিতে না পাই তাহা হইলে আমাদিগকে এতদসম্পর্কিত ‘আছার’ বা সাহাবাদের বাণী অনুসন্ধান করিতে হইবে। কারণ, তাঁহারা এই বিষয়ে অধিকতর জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। কেননা তাঁহারা এইরূপ কতগুলি প্রমাণ, চিহ্ন, নিদর্শন, অবস্থা ও প্রেক্ষিত প্রত্যক্ষ করিবার সুযোগ লাভ করিয়াছিলেন, যাহা প্রত্যক্ষ করিবার সুযোগ অন্যরা লাভ করেন নাই। তদুপরি তাঁহারা ছিলেন পূর্ণ ও সঠিক জ্ঞান এবং নেক আমলের অধিকারী। ইল্ম ও আমলের দিক দিয়া প্রথম শ্রেণীর সাহাবীগণ তথা খোলাফায়ে রাশেদীন, আবদুল্লাহ্ ইব্ন মাসউদ (রা) এবং অন্যান্য শীর্ষস্থানীয় সাহাবাবৃন্দ এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে অনুসরণযোগ্য।
মাসরূক হইতে ধারাবাহিকভাবে আবুযযোহা, আ’মাশ, জাবির ইব্ নূহ, আবূ কুরাইব এবং ইমাম আবূ জাফর ইব্ন জারীর বর্ণনা করিয়াছেন যে, হযরত আবদুল্লাহ্ ইব্ন মাসউদ (রাঃ) বলেন- ‘আল্লাহর কসম ! আমি আল-কুরআনের প্রতিটি আয়াতের শানে নুযূল এবং অবতরণ স্থান সম্বন্ধে সর্বাধিক জ্ঞাত রহিয়াছি। যদি আমি জানিতাম, আল্লাহ্র কিতাবে কেহ আমা অপেক্ষা অধিকতর জ্ঞানী ও ব্যুৎপন্ন, তবে সম্ভবপর হইলে আমি (উক্ত জ্ঞান আহরণের জন্য) তাহার নিকট গমন করিতাম।’ আবূ ওয়ায়েল হইতে আ’মাশ আরও বর্ণনা করেন যে, ইব্ন মাসউদ (রাঃ) বলেন, ‘আমাদের মধ্যে যদি কেহ দশটি আয়াত শিখিত তবে সে সেগুলির অর্থ না বুঝিয়া এবং সেগুলির উপর আমল না করিয়া পরবর্তী কোন আয়াত শিখিত না।
আবূ আবদুর রহমান সালফী তাহার কুরআন শিক্ষক সাহাবাবৃন্দ হইতে বর্ণনা করেন যে, তাঁহার শিক্ষক সাহাবীরা বলিয়াছেন- ‘আমরা মহানবী (সাঃ)-এর নিকট হইতে এই নিয়মে আল-কুরআন শিখিতাম যে, দশটি আয়াত শিখিবার পর আমরা উহা পুরোপুরি আমল করিতাম এবং উহার পর পরবর্তী আয়াত শিখিতাম। অর্থাৎ পূর্বায়ত্ত দশটি আয়াত কার্যকরী না করিয়া পরবর্তী কোন আয়াত শিখিতাম না। এভাবে আমরা কুরআনের ইলম ও আমল একই সঙ্গে আয়ত্ত করিয়াছি।’
শীর্ষস্থানীয় সাহাবাবৃন্দের অন্যতম হইলেন মহানবী (সাঃ)-এর খুল্লতাত ভাই আবদুল্লাহ্ ইব্ন আব্বাস (রাঃ)। জ্ঞান সমুদ্ররূপ এই মহাপণ্ডিত ব্যক্তিটি মহানবী (সাঃ)-এর দোয়ার বরকতে আল-কুরআনের তাফসীকার ও প্রভাষক হইবার বিরাট সৌভাগ্য লাভ করিয়াছিলেন। নবী করীম (সাঃ) তাঁহার জন্য আল্লাহ্ পাকের কাছে প্রার্থনা করিলেনঃ ‘হে আল্লাহ্ ! তুমি তাহাকে দীনী ইমে ব্যুৎপত্তি দান কর এবং আল-কুরআনের রহস্যাবলী শিক্ষা দাও।’
মুসলিম হইতে ধারাবাহিকভাবে আ’মাশ, সুফিয়ান, মুহাম্মদ ইব্ন বিশর, ওয়াকী’ এবং ইমাম ইবন জারীর বর্ণনা করেন যে, আবদুল্লাহ্ ইব্ন মাসউদ (রাঃ) বলিয়াছেন- হ্যাঁ, আল্ কুরআনের তাফসীরকার ও প্রভাষক হইতেছেন আবদুল্লাহ্ ইব্ন আব্বাস (রাঃ)। অনুরূপভাবে মাসরূক হইতে ধারাবাহিকভাবে আবু যোহা, মুসলিম ইব্ন সাবীহ, আ’মাশ, সুফিয়ান, ইসহাক আল আযরাক, ইয়াহিয়া ইব্ন দাউদ এবং ইব্ন জারীর বর্ণনা করেন যে, হযরত ইব্ন মাসউদ (রাঃ) বলিয়াছেন- হ্যাঁ, আল-কুরআনের ব্যাখ্যাকার ও শিক্ষক হইলেন ইব্ন আব্বাস (রাঃ)।
ইবন জারীর অন্যত্র উপরোক্ত রিওয়ায়েতকে অন্যতম রাবী আ’মাশ হইতে জা’ফর ইব্ন আওন ও বিনদারের মাধ্যমেও বর্ণনা করিয়াছেন। সেই রিওয়ায়েতেও ইব্ন আব্বাস (রাঃ) সম্পর্কে ইব্ন মাসঊদ (রাঃ) উপরোক্ত মন্তব্য করেন। উপরোক্ত বর্ণনার সূত্র যেহেতু বিশুদ্ধ, তাই সহীহ্ সনদে উক্ত মন্তব্যের সত্যতা প্রমাণিত হইল।
সঠিক ঐতিহাসিক বর্ণনামতে হযরত ইব্ন মাসউদ (রাঃ) হিজরী বত্রিশ সনে ইন্তেকাল করেন। তাঁহার ইন্তেকালের পর হযরত ইব্ন আব্বাস (রাঃ) ছত্রিশ বৎসর জীবিত ছিলেন সুতরাং তাঁহার সম্বন্ধে ইব্ন মাসউদ (রাঃ)-এর উপরোক্ত মন্তব্যের পরও তিনি স্বীয় জ্ঞানের পরিধি সম্প্রসারিত করার জন্য অন্তত ছত্রিশ বৎসর সময় পাইয়াছিলেন। এখন ভাবিয়া দেখুন, হযরত ইব্ন মাসউদ (রাঃ)-এর মন্তব্যের পরবর্তী এই সুদীর্ঘ সময়ে তিনি কি বিপুল জ্ঞানরাশি আহরণ করিয়াছিলেন।
আবূ ওয়ায়েল হইতে আ’মাশ বর্ণনা করিয়াছেন যে, হযরত আলী (রাঃ) স্বীয় খিলাফতের সময় একবার হযরত ইব্ন আব্বাস (রাঃ)-কে হজ্জে নিজের প্রতিনিধি নিযুক্ত করিলেন। তখন তিনি হাজীদের সামনে খুৎবা পাঠ করিলেন। সেখানে তিনি এক বর্ণনা মতে সূরা বাকারা ও অন্য বর্ণনামতে সূরা নূর পাঠ করত উহার তাফসীর বর্ণনা করিলেন। উক্ত তাফসীর এইরূপ অনুপম হইয়াছিল যে, রোমক, তুর্কী কিংবা কুর্দী সম্প্রদায়ের কাফিররা উহা শ্রবণ করিলেও সঙ্গে সঙ্গে-ইসলাম গ্রহণ করিত।
হযরত ইব্ন মাসউদ (রাঃ) ও হযরত ইব্ন আব্বাস (রাঃ)-এর উপরোক্ত পাণ্ডিত্যের কারণেই দেখা যায়, তাফসীকার ইসমাঈল ইব্ন আবদুর রহমান আস্ সুদ্দী আল কবীর স্বীয় তাফসীর গ্রন্থে উক্ত সাহাবীদ্বয় হইতে অধিকাংশ রিওয়ায়েত বর্ণনা করিয়াছেন। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে তিনি ‘আহলে কিতাব’ কর্তৃক তাঁহাদের নিকট বর্ণিত গল্প-কাহিনীও তাঁহাদের বরাত দিয়া উদ্ধৃত করিয়াছেন। নবী করীম (সাঃ) অবশ্য আহলে কিতাব হইতে কোন কথা বর্ণনা করিতে অনুমতি দিয়াছেন। তিনি বলিয়াছেনঃ ‘আমার নিকট হইতে একটি বাণী পাইলেও উহা মানুষের কাছে পৌছাইয়া দাও। আর বনী ইসরাঈল হইতে কোন কিছু বর্ণনা করিতে পার। উহাতে কোন দোষ নাই। অতঃপর যে ব্যক্তি আমার নামে জ্ঞাতসারে মিথ্যা কথা চালাইবে, তাহার আবাস হইবে জাহান্নাম।’ এই হাদীসটি ইমাম বুখারী হযরত আবদুল্লাহ্ ইব্ন আমর (রাঃ) হইতে বর্ণনা করিয়াছেন। হযরত আবদুল্লাহ্ ইব্ন আমর (রাঃ) ইয়ারমুকের যুদ্ধে আহলে কিতাবের গ্রন্থরাজী হইতে দুইখানা কিতাব সংগ্রহ করিয়াছিলেন। উপরোক্ত হাদীসের ভিত্তিতে তিনি উহা হইতে বিভিন্ন কাহিনী বর্ণনা করিতেন।
অবশ্য আহলে কিতাব হইতে প্রাপ্ত কথা ও কাহিনী দ্বারা কোন বিষয় প্রমাণিত করা যায় না। তবে (কুরআন-সুন্নাহ দ্বারা) প্রমাণিত কোন বিষয় যখন আহলে কিতাবের নিকট প্রচার করা হয়, তখন দলীল হিসাবে তাহাদের কাছে উল্লেখ করা যায়। আহলে কিতাব হইতে প্রাপ্ত কথা ও কাহিনী তিন শ্রেণীর হইতে পারে। এক, কুরআন ও সুন্নাহ্ কর্তৃক সমর্থিত কথা ও কাহিনী। এই শ্রেণীটি বিশুদ্ধ তাই গ্রহণযোগ্য। দুই, কুরআন ও সুন্নাহ্ কর্তৃক মিথ্যা বলিয়া প্রমাণিত কথা ও কাহিনী। ইহা সুস্পষ্টত প্রত্যাখ্যেয়। তিন, কুরআন-সুন্নাহ দ্বারা যেসব কথা ও কাহিনী সমর্থিত কিংবা অসমর্থিত কোনটাই হয় নাই। এই শ্রেণীর ক্ষেত্রে আমাদের ভূমিকা নিরপেক্ষ হইবে। আমরা উহাকে সত্য বলিয়া যেমন গ্রহণ করিব না, তেমনি মিথ্যা বলিয়া প্রত্যাখ্যানও করিব না। তবে উপরের হাদীসের ভিত্তিতে আমরা উহা অপরের কাছে বর্ণনা করিতে পারি, তাহাতে কোন দোষ নাই। অবশ্য অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায়, এসব কথা ও কাহিনী দ্বারা দীন ইসলামের কোন উপকার সাধিত হয় না। যেহেতু স্বয়ং আহলে কিতাবের মধ্যে উহা লইয়া মতভেদ রহিয়াছে।
উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, আসহাবে কাহাফের নাম, তাহাদের কুকুরের রং, তাহাদের সংখ্যা, হযরত মূসা (আঃ)-এর লাঠির মূল বৃক্ষের নাম, হযরত ইবরাহীম (আঃ)-এর হাতে আল্লাহ্ তা’আলা যেসব পাখী মারিয়া আবার জীবিত করিলেন সেইগুলির নাম, বনী ইসরাঈলদের নিহত ব্যক্তির হন্তা নির্ধারণার্থে জবাই করা গাভীর কোন অঙ্গ কাটিয়া উহার গাত্রে আঘাত করা হইল, উহার পরিচয়, কোন বৃক্ষ হইতে আল্লাহ্ তা’আলা মূসা (আঃ)-এর সহিত বাক্যালাপ করিলেন তাহার নাম ইত্যাদি লইয়া তাফসীকারদের ভিতর মতানৈক্য পরিলক্ষিত হয়। অথচ এইগুলি নির্ণয়ের মধ্যে মানুষের ইহত্রিক বা পারত্রিক কোন লাভ নিহিত নাই। আর এই কারণেই আল্লাহ্ পাক উহা নির্ণয় করিয়া দেন নাই। তবে এই সব মতভেদ উল্লেখ করায় কোন দোষ নাই। যেমন স্বয়ং আল্লাহ্ তা’আলাও অনুরূপ মতভেদ উল্লেখ করিয়াছেনঃ ‘তাহাদের একদল বলে, আসহাবে কাহাফ তিনজন ছিলেন, আর চতুর্থটি ছিল তাহাদের কুকুর। অন্য দল বলে, তাহারা পাঁচজন ছিলেন, ষষ্ঠটি ছিল তাহাদের কুকুর। উভয় দলই অন্ধকারে ঢিল ছুঁড়িয়া থাকে। আবার একদল বলে, তাহারা সাতজন ছিলেন, অষ্টমটি ছিল কুকুর। তুমি বলিয়া দাও, তাহাদের সঠিক সংখ্যা আমার প্রতিপালক প্রভুই ভাল জানেন। স্বল্প সংখ্যক লোকই তাহাদের সঠিক সংখ্যা জ্ঞাত রহিয়াছে। তুমি তাহাদের সংখ্যা সম্পর্কে ভাসাভাসা আলোচনা করিতে পার। এই সম্পর্কে গভীর আলোচনায় প্রবৃত্ত হইও না। এমনকি তাহাদের নিকট ইহা লইয়া প্রশ্ন করিও না।’
উক্ত আয়াতে তৃতীয় শ্রেণীর কথা ও কাহিনীর ক্ষেত্রে আমাদের করণীয় কিংবা অকরণীয় বিষয়ের উল্লেখ রহিয়াছে। আয়াতটিতে আল্লাহ্ তা’আলা আসহাবে কাহাফের সংখ্যা সম্বন্ধীয় তিনটি অভিমত উল্লেখ করিয়াছেন। উহাদের প্রথম দুই অভিমতকে দুর্বল বলিয়া ইঙ্গিত প্ৰদান করিয়াছেন। তৃতীয় অভিমত সম্পর্কে প্রতিকূল বা অনুকূল কোন ফয়সালা প্রদান করেন নাই। ইহাতে বুঝা যায়, তৃতীয় অভিমত সত্য ও সঠিক। কারণ, উহা মিথ্যা ও বাতিল হইলে পূর্ববর্তী দুই অভিমতের ন্যায় উহাকেও দুর্বল বলিয়া ইঙ্গিত প্রদান করা হইত। অতঃপর বলা হইল, তাহাদের সংখ্যা জানার মধ্যে কোন কল্যাণ নিহিত নাই। তাই বলা হইল, ‘তুমি বল, আমার রবই তাহাদের সঠিক সংখ্যা সম্পর্কে অধিকতর অবহিত রহিয়াছেন। স্বল্প সংখ্যক লোকই তাহাদের সঠিক সংখ্যা জানে। তুমি তাহাদের সংখ্যা সম্বন্ধে শুধু হালকা আলোচনা করিতে পার। এ ব্যাপারে গভীর আলোচনায় প্রবৃত্ত হইও না। আর এই সম্বন্ধে তাহাদের কাহাকেও প্রশ্ন করিও না।’ অর্থাৎ আল্লাহ্ তা’আলা যে স্বল্প সংখ্যক বান্দাকে তাহাদের সঠিক সংখ্যা জানাইয়াছেন তাহারা ভিন্ন অন্য কেহ তাহাদের সঠিক সংখ্যা জানে না। তাই তিনি অভিমত ব্যক্ত করিলেন, যে কাজে কোন লাভ নাই তাহাতে শক্তি ব্যয় করিয়া নিজকে কষ্ট দিও না আর এই সম্বন্ধে তাহাদিগকে প্রশ্ন করিতে যাইও না। কারণ, তাহারা এই সম্বন্ধে আনুমানিক কথা ছাড়া কিছুই জানে না।
এই প্রেক্ষিতে জানা গেল, কোন ব্যাপারে মতভেদ উল্লেখ করার সর্বোত্তম পন্থা এই যে, সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কিত যাবতীয় অভিমত উল্লেখপূর্বক উহাদের মধ্যকার বাতিল ও ভ্রান্ত অভিমতকে চিহ্নিত করিয়া সঠিক ও নির্ভুল অভিমতকে প্রতিষ্ঠিত করা। সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন অভিমতের পরিণতি বর্ণনা করিয়া মতভেদ জনিত তর্ক-বিতর্কের অবসান ঘটাইতে হইবে এবং অপ্রয়োজনীয় প্রসঙ্গ ত্যাগ করিয়া প্রয়োজনীয় কাজে মনোনিবেশ পূর্বক সময়ের অপচয় রোধের পন্থা অনুসরণ করিতে হইবে। তাই যে ব্যক্তি কোন বিরোধমূলক ব্যাপারের যাবতীয় অভিমত উল্লেখ না করিয়া প্রতিকূল অভিমতগুলি বর্জন করে সে ব্যক্তি অপরাধী। কারণ, হয়ত তাহা বর্জিত অভিমতই সঠিক ও নির্ভুল অভিমত ছিল। এমতাবস্থায় তাহার পাঠক বা শ্রোতা তাহারই কারণে সত্য ও সঠিক বিষয়টি জানিবার ও উহা গ্রহণের সুযোগ হইতে বঞ্চিত রহিল। তেমনি যে ব্যক্তি বিরোধীয় বিষয়ের সহিত সম্পর্কিত যাবতীয় অভিমত উল্লেখপূর্বক উহাদের সঠিক ও ভ্রান্ত অভিমতকে চিহ্নিত করে না, সে ব্যক্তিও অপরাধী। কারণ, সে তাহার পাঠক বা শ্রোতাকে সঠিক ও ভ্রান্ত বিষয়টি জানিতে সাহায্য করে না। অনুরূপ যে ব্যক্তি অজ্ঞাতসারে ভ্রান্ত অভিমতকে সত্য বলিয়া থাকে, সে ভ্রান্ত ধারণার পোষক ও প্রচারক। আবার যে ব্যক্তি অপ্রয়োজনীয় বিষয়ের মতভেদের উপর গুরুত্ব আরোপ করে, সে ভ্রান্ত। তেমনি যে ব্যক্তি মূলত একই বস্তুকে বাহ্যত বিভিন্নরূপে দেখাইয়া বিভিন্নমতের উল্লেখ করে সেও ভ্রান্ত। শেষোক্ত দুই শ্রেণীর লোক অপ্রয়োজনীয় কার্যে মূল্যবান সময়ের অপচয় ঘটায়। ইহারা অকার্যকর ও উদ্দেশ্য পূরণে ব্যর্থ পোষাক পরিধানকারী ব্যক্তি সমতুল্য। আল্লাহ্ই ন্যায় পথ অনুসরণের তওফীক দিয়া থাকেন।
কুরআনের কোন বিশেষ আয়াতের তাফসীর যদি কুরআন বা সুন্নাহ্র কোনটিতে না মিলে তখন কি করিতে হইবে? এ ব্যাপারে বিপুল সংখ্যক ইমামের অভিমত এই যে, এমতাবস্থায় তাবেঈদের (সাহাবায়ে কিরামদের দর্শন লাভকারী মু’মিনদের) তাফসীর গ্রহণ করিতে হইবে। প্রসঙ্গত বিখ্যাত তাবেঈ মুজাহিদ ইবন জাবিরের নাম উল্লেখ করা যায়। তাফসীর শাস্ত্রে তাঁহার বিশেষ বুৎপত্তি ও পারদর্শীতা ছিল। উক্ত মুজাহিদ হইতে ইব্ন সালেহ এবং তাঁহার নিকট হইতে মুহাম্মদ ইব্ন ইসহাক বর্ণনা করেন যে, মুজাহিদ বলেন, আমি তিনবার সম্পূর্ণ কুরআনের তিলাওয়াত ও তাৎপর্য হযরত ইব্ন আব্বাস (রাঃ)-এর নিকট হইতে শিক্ষা করিয়াছি। প্রতিটি আয়াত তিলাওয়াতের পর তাঁহাকে থামাইয়া উহার অর্থ ও তাৎপর্য তাঁহার নিকট হইতে জানিয়া লইয়াছি।
ইব্ন আবূ মালিকা হইতে ধারাবাহিকভাবে উসমান মক্কী, তালিক ইব্ন গানাম, আবূ কুরাইব ও ইমাম ইবন জারীর বর্ণনা করিয়াছেন যে, ইমাম ইব্ন মালিকা বলেন, আমি মুজাহিদকে ইব্ন আব্বাস (রাঃ)-এর নিকট কুরআন মজীদের তাফসীর জিজ্ঞাসা করিতে দেখিয়াছি । তখন তাঁহার কাছে লিখিত কুরআন মজীদ মওজুদ থাকিত। হযরত ইব্ন আব্বাস (রাঃ) তাঁহাকে বলিতেন, ‘লিখিয়া লও’। -এভাবেই তিনি তাঁহার নিকট হইতে, সম্পূর্ণ কুরআনের তাফসীর অবহিত হইয়াছিলেন। এই কারণেই হযরত সুফিয়ান আছ ছওরী বলিতেন, ‘মুজাহিদ হইতে তোমার কাছে তাফসীর পৌঁছিলে উহা তোমার জন্যে যথেষ্ট।”
প্রসঙ্গত সাঈদ ইব্ন জুবায়র, ইকরামা (ইব্ন আব্বাসের (রাঃ) ভৃত্য), আতা ইব্ন আবূ রাবাহ, হাসান বসরী, মাকরূক ইব্ন আজদা’, সাঈদ ইবনুল মুসাইয়্যেব, আবুল আলীয়া, রবী’ ইব্ন আনাস, কাতাদাহ, যিহাক ইব্ন মুজাহিদ প্রমুখ তাবেঈ, তাবে তাবেঈ ও তৎপরবর্তী ব্যক্তিবৃন্দের নাম উল্লেখ্য। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, বিশেষ কোন আয়াতের ব্যাখ্যায় তাহাদের বক্তব্যসমূহ উদ্ধৃত হইয়াছে ৷ এই বক্তব্যসমূহের ভিতর শাব্দিক বিভিন্নতার দরুণ অজ্ঞ ব্যক্তিরা সেগুলিকে পরস্পর বিরোধী বক্তব্য ভাবিয়া বসিয়াছে। তাই তাহারা সেইগুলিকে পরস্পর বিরোধীরূপেই অপরের কাছে উপস্থাপন করিয়াছে। মূলত সেইগুলি আদৌ পরস্পর বিরোধী নহে। বরং কেহ হয়ত কোন আয়াতের ব্যাখ্যায় সংশ্লিষ্ট বিষয়ের সহিত অবিচ্ছেদ্য অনুরূপ কোন বিষয়ের উল্লেখ করিয়াছেন, আবার কেহ হয়তো সরাসরি বিষয়টিই উল্লেখ করিয়াছেন মাত্র। এমতাবস্থায় উভয়ের ভিতরে কোন তাৎপর্যগত বিরোধ থাকিতে পারে না। এই কথাটুকু উপলব্ধি করা যে কোন সূক্ষ্মদর্শী ব্যক্তিরই কর্তব্য। আল্লাহই সঠিক পথের সন্ধানদাতা।
তাবেঈদের অভিমত গ্রহণের প্রশ্নে শু’বা ইব্ন হাজ্জাজ প্রমুখ বিশেষজ্ঞগণ বলেন, ‘যে ক্ষেত্রে শরীআতের কম গুরুত্ব সম্পন্ন বিষয়েই তাবেঈদের অভিমত গ্রহণ করা অপরিহার্য নহে, সেক্ষেত্রে তাফসীরের ন্যায় গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক বিষয়ে তাহাদের অভিমত গ্রহণ কিরূপে অপরিহার্য হইতে পারে? তাই তাবেঈদের তাফসীর গ্রহণ করা অপরের জন্য অপরিহার্য নহে।’ বস্তুত ইহাই সঠিক ও যুক্তিসঙ্গত অভিমত। তবে কোন বিষয়ে তাঁহারা যদি অভিন্ন মত পোষণ করেন, উহা গ্রহণ করা নিঃসন্দেহে অপরিহার্য। পক্ষান্তরে তাহারা যদি বিভিন্ন মত পোষণ করেন, তখন এক তাবেঈর মত যেরূপ অন্য তাবেঈর গ্রহণ করা অপরিহার্য নহে, তেমনি অন্য কাহারও জন্যেও উহা গ্রহণ করা অপরিহার্য হয় না। এইরূপ পরিস্থিতিতে আমাদিগকে কুরআন, সুন্নাহ, আছার কিংবা আরবী অভিধানের শরণাপন্ন হইতে হইবে।
প্রসঙ্গত আল-কুরআনের শুধুমাত্র বুদ্ধিনির্ভর ব্যাখ্যা প্রদানের বিষয়টি বিবেচ্য। শুধু বুদ্ধির সাহায্যে তাফসীর করা হারাম। ইব্ন আব্বাস (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে সাঈদ ইব্ন জুবায়র, আব্দুল আ’লা ইব্ন আমের ছা’লাবী, সুফিয়ান, ইয়াহিয়া ইবন সাঈদ, মুহাম্মদ ইব্ন বিশর ও ইমাম ইব্ন জারীর বর্ণনা করেন যে, নবী করীম (সাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি স্বীয় বুদ্ধি কিংবা অনুমানের সাহায্যে কুরআনের ব্যাখ্যা করিবে দোযখ তাহার ঠিকানা হইবে।’ ইমাম তিরমিযী এবং ইমাম নাসাঈও উক্ত হাদীস সুফিয়ান পর্যন্ত অভিন্ন রাবী এবং তাঁহার পর হইতে ভিন্ন রাবীর বরাত দিয়া বর্ণনা করিয়াছেন। ইমাম আবূ দাঊদও হাদীসটি আবদুল আ’লা পর্যন্ত অভিন্ন রাবী এবং তাঁহার পর হইতে ভিন্ন রাবীর বরাত দিয়া বর্ণনা করিয়াছেন। পরবর্তী রাবী হইলেন আবূ আওয়ানা ও মুসাদ্দাদ। এই সনদে হাদীসটি মারফু’ হিসাবে বর্ণিত হইয়াছে। ইমাম তিরমিযী হাদীসটিকে ‘হাসান সহীহ’ বলিয়াছেন। ইব্ন জরীর উহাকে আবদুল আ’লা পর্যন্ত অভিন্ন রাবী এবং তাঁহার পর হইতে ভিন্ন রাবীর বরাত দিয়া বর্ণনা করিয়াছেন। পরবর্তী আবার অন্যত্র হানীফের বরাত দিয়া উহাকে ‘মাওকুফ হাদীস’ অর্থাৎ ইব্ন আব্বাসের উক্তি হিসাবে বর্ণনা করিয়াছেন। অনুরূপ তিনি সাঈদ ইব্ন জুবায়র পর্যন্ত অভিন্ন রাবী এবং তাঁহার পর হইতে ধারাবাহিকভাবে বকর, লায়ছ ও মুহাম্মদ ইব্ন হামীদের বরাত দিয়া উহাকে ইব্ন আব্বাস (রাঃ)-এর নিজস্ব উক্তি হিসাবে বর্ণনা করিয়াছেন। আল্লাহ্ই সর্বাধিক জ্ঞাত।
হযরত জুনদুব (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে আবূ ইমরান আল জওনী, সাল, হাইয়ান ইব্ন হিলাল, আব্বাস ইব্ন আবদুল আযীম, আম্বারী ও ইব্ন জরীর বর্ণনা করেন যে, নবী করীম (সাঃ) বলিয়াছেন, ‘যে ব্যক্তি স্বীয় বুদ্ধির সাহায্যে কুরআনের তাফসীর বর্ণনা করে, সে ভ্রান্তির শিকার হয়।’ আবূ দাঊদ, তিরমিযী ও নাসাঈ উক্ত হাদীসটি সুহায়ল ইব্ন আবূ হামের মাধ্যমে বর্ণনা করিয়াছেন। ইমাম তিরমিযী উহাকে অসমর্থিত হাদীস বলিয়া অভিহিত করিয়াছেন। তিনি আরও বলিয়াছেন, উক্ত হাদীসের অন্যতম রাবী ‘সুহায়ল’ কোন কোন বিশেষজ্ঞ কর্তৃক বিরূপভাবে সমালোচিত হইয়াছে। কোন কোন রিওয়ায়েতে রহিয়াছে, ‘যে ব্যক্তি নিজ বুদ্ধিতে আল্লাহ্র কিতাবের তাফসীর বর্ণনা করে, সে সঠিক তাফসীর করিলে ও ভ্রান্তিতে পতিত।’ নিজ বুদ্ধিতে সঠিক তাফসীর করিলেও সে এই কারণে ভ্রান্ত যে, অনুমানের ভিত্তিতে সে কোন বিষয়কে সত্য ও সঠিক বলিয়া দাবী করে। বর্ণিত তাফসীর সঠিক হইলে ও তাহার অনুসৃত পন্থাটি ভ্রান্ত । যেহেতু কুরআনের তাফসীর কুরআন-সুন্নাহ দ্বারা করিবার জন্য সে আদিষ্ট হইয়াছে। সুতরাং উহা লঙ্ঘন করিয়া সে সঠিক তাফসীর করা সত্ত্বেও ভ্রান্ত ও বিপথগামী হইয়াছে। যেমন, কোন বিচারক অনুমানের ভিত্তিতে বিবদমান বিষয়ে রায় প্ৰদান করিলে সে জাহান্নামী হইবে। অবশ্য যে ব্যক্তির অনুমানভিত্তিক ব্যাখ্যা সঠিক হইবে, তাহার অপরাধ অনুমানভিত্তিক ভুল ব্যাখ্যাদানকারীর চাইতে কম। আল্লাহই ভাল জানেন।
কোন ব্যক্তি কাহারও বিরুদ্ধে ব্যাভিচারের অভিযোগ উত্থাপন করিয়া উহার সপক্ষে সাক্ষ্য-প্রমাণ উপস্থিত করিতে না পারিলে আল্লাহ্ পাকের ঘোষণা অনুযায়ী সে মিথ্যুক সাব্যস্ত হইবে। যেমন আল্লাহ্ তা’আলা বলেন, ‘সাক্ষ্য-প্রমাণ হাজির করিতে না পারিলে তাহারা (ব্যভিচারের অভিযোগ উত্থাপকরা) আল্লাহ্ তা’আলার কাছে মিথ্যাবাদী হইবে।’ এখানে দেখা যাইতেছে যে, অভিযোগকারী সত্য অভিযোগ উত্থাপন করিলেও সাক্ষ্য-প্রমাণ পেশ করিতে ব্যর্থ হওয়ায় মিথ্যাবাদী ঘোষিত হইয়াছে। কারণ, যেভাবে অভিযোগটি উত্থাপন তাহার জন্য বৈধ নহে, সে তাহাই করিয়াছে। যদিও ব্যাপারটি সত্য। আল্লাহ্ই অধিক পরিজ্ঞাত।
উপরোক্ত কারণে পূর্বসূরী একদল বিশেষজ্ঞ অজ্ঞাত বিষয়ের তাফসীর করা হইতে সর্বদা বিরত থাকিতেন। আবূ মুআম্মার হইতে ধারাবাহিকভাবে আবদুল্লাহ্ ইব্ন মুবারাহ, সুলায়মান ও শু’বা বর্ণনা করেন যে, হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রাঃ) বলিয়াছেন, যদি আমি না জানিয়া অনুমানের ভিত্তিতে আল্লাহর কিতাব সম্বন্ধে কিছু বলি, তাহা হইলে কোন্ মাটি আমাকে বুকে নিবে আর কোন্ আকাশই বা আমাকে ছায়া দিবে?
ইবরাহীম তায়মী হইতে ধারাবাহিকভাবে আওয়াম ইব্ন হাওশাব, মুহাম্মদ ইব্ন ইয়াযীদ ও আবূ উবায়দ কাসিম সালাম বর্ণনা করিয়াছেন, একবার হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রাঃ)-এর নিকট وفاكهة وآأيًا আয়াতখণ্ডের তাৎপর্য জিজ্ঞাসা করা হইলে তিনি বলেন, না জানিয়া অনুমানের ভিত্তিতে আল্লাহ্ কিতাব সম্বন্ধে আমি যদি কিছু বলি, তাহা হইলে কোন্ যমীন আমাকে বুকে ধারণ করিবে আর কোন্ আসমান আমাকে ছায়া দিবে?
উপরোক্ত রিওয়ায়েতসমূহ বিচ্ছিন্ন সনদে হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রাঃ) হইতে বর্ণিত হইয়াছে। হযরত আনাস (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে হামীদ, ইয়াযীদ ও আবূ উবায়দ বৰ্ণনা করিয়াছেন, একদিন হযরত উমর (রাঃ) মিম্বরে দাঁড়াইয়া وفاكهة وآأيًا আয়াতাংশ পাঠ করিয়া বলিলেন, الفاكبة (ফল) আমাদের নিকট জ্ঞাত; কিন্তু الاب শব্দের তাৎপর্য কি? অতঃপর নিজেই নিজেকে বলিলেন, ‘ওহে উমর ! ইহা অহেতুক প্রচেষ্টা।’ হযরত আনাস (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে ছাবিত, হাম্মাদ ইব্ন যায়দ, সুলায়মান ইব্ন হারব ও মুহাম্মদ ইব্ন সা’দ বর্ণনা করিয়াছেন যে, হযরত আনাস (রাঃ) বলেনঃ একদিন আমরা হযরত উমর (রাঃ)-এর নিকট উপস্থিত ছিলাম। তাঁহার জামার পৃষ্ঠভাগে চারিটি তালি ছিল। তিনি وفاكهة وآأيًا আয়াতাংশ তিলাওয়াত করিয়া বলিলেন, الاب শব্দের তাৎপর্য কি? অতঃপর নিজেকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন, ‘ওহে উমর! ইহা অহেতুক প্রচেষ্টা, উহা না জানিলে তোমার কি ক্ষতি হইবে?”
উপরোক্ত রিওয়ায়েতসমূহে বর্ণিত الاب শব্দের তাৎপর্য সম্বন্ধে হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রাঃ) ও হযরত উমর (রাঃ)-এর অজ্ঞতার তাৎপর্য এই যে, তাঁহারা উহার ধরণ ও শ্রেণী সম্পর্কে অনবহিত ছিলেন এবং উহাই জানিতে আগ্রহী হইয়াছিলেন । নতুবা الاب শব্দের অর্থ যে এক শ্রেণীর তৃণ তাহা সর্বজনবিদিত ব্যাপার। অনুরূপ فَأنْيَمْنًا فيها حبًا وعنْبًا আয়াতাংশে উল্লেখিত حب শব্দটির অর্থ শস্য হইলেও উহা কোন্ শ্রেণীর শস্য তাহা অজ্ঞাত রহিয়াছে ।
ইব্ন আবূ মালিকাহ হইতে ক্রমাগত আইয়ুব ইব্ন আলীয়াহ্, ইয়াকুব ইব্ন ইবরাহীম ও ইমাম ইবন জারীর বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন, একদা হযরত ইব্ন আব্বাস (রাঃ)-এর নিকট এমন একটি আয়াত সম্পর্কে প্রশ্ন করা হইল যাহা সম্পর্কে অন্য কাহারো নিকট প্রশ্ন করা হইলে তিনি তৎক্ষণাৎ উহার উত্তর প্রদান করিতেন। কিন্তু হযরত ইব্ন আব্বাস (রাঃ) উক্ত আয়াত সম্বন্ধে কিছু বলিতে অসম্মতি জানাইলেন। উপরোক্ত রিওয়ায়েতের সনদ সহীহ।
ইব্ন আবূ মালিকাহ হইতে ক্রমাগত আইয়ুব, ইসমাঈল ইব্ন ইবরাহীম ও আবূ উবায়দ বর্ণনা করেন যে, একদা জনৈক ব্যক্তি কুরআনে বর্ণিত এক হাজার বৎসরের সমান দিন সম্পর্কে হযরত ইব্ন আব্বাস (রাঃ)-এর নিকট প্রশ্ন করিলে তিনি তাহাকে পাল্টা প্রশ্ন করিলেন, কুরআনে বর্ণিত পঞ্চাশ হাজার বৎসরের সমান দিনটি কি? লোকটি বলিল, আমি তো উহা আপনার নিকট জানিতে চাহিতেছি। তিনি তখন বলিলেন, উপরোক্ত দিন দুইটি হইল কুরআন পাকে আল্লাহ্ তা’আলার উল্লেখিত দিন। আল্লাহ্ই উহাদের সম্পর্কে সমধিক জ্ঞাত।
উপরোক্ত বর্ণনা দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, হযরত ইব্ন আব্বাস (রাঃ) আল্লাহর কিতাব সম্বন্ধে যাহা জানিতেন না, তাহা অনুমান করিয়া বলা পছন্দ করিতেন না।
ওয়ালীদ ইব্ন মুসলিম হইতে ধারাবাহিকভাবে মাহদী ইব্ন মায়মূন, ইব্ন আলীয়াহ্, ইয়াকূব ইব্ন ইবরাহীম ও ইব্ন জারীর বর্ণনা করেনঃ একদা তালিক ইব্ন হাবীব হযরত জুনদুব ইব্ন আবদুল্লাহ্ (রাঃ)-এর নিকট আগমন করিয়া একটি আয়াতের তাফসীর জিজ্ঞাসা করিলেন। হযরত জুনদুব (রাঃ) তাহাকে বলিলেন- ‘তুমি মুসলিম হইয়া থাকিলে তোমাকে কসম দিয়া বলিতেছি, (এই ব্যাপারে আমার অজ্ঞতার কারণে রাগ করিয়া) তুমি আমার নিকট হইতে উঠিয়া যাইও না।(১)
ইয়াহিয়া ইবন সাঈদ হইতে লায়ছ বর্ণনা করেন, হযরত সাঈদ ইব্ন মুসাইয়্যেব (রাঃ) কুরআন মজীদ সম্বন্ধে যতটুকু জানিতেন শুধু ততটুকুই বলিতেন, তিনি না জানিয়া অনুমানের ভিত্তিতে কিছুই বলিতেন না।
আমর ইব্ন মুর্রা হইতে শু’বা বর্ণনা করেনঃ একদিন এক ব্যক্তি হযরত সাঈদ ইব্ন মুসাইয়্যেব (রাঃ)-এর নিকট কুরআন পাকের একটি আয়াত সম্বন্ধে প্রশ্ন করিলে তিনি বলেন, ‘আমার নিকট কুরআন মজীদের ব্যাখ্যা জিজ্ঞাসা করিও না; বরং সেই বিজ্ঞ ব্যক্তির কাছে জিজ্ঞাসা কর যাহার সম্পর্কে’ মানুষের বিশ্বাস রহিয়াছে যে, তিনি কুরআন মজীদের সকল রহস্যই সুপরিজ্ঞাত (অর্থাৎ ইকরামার নিকট জিজ্ঞাসা কর)।
ইয়াযীদ ইব্ন আবূ ইয়াযীদ হইতে ইব্ন শাওয়াব বর্ণনা করেন যে, ইয়াযীদ ইব্ন আবূ ইয়াযীদ বলেনঃ ‘আমরা সাঈদ ইব্ন মুসাইয়্যেবের নিকট হালাল-হারাম সম্পর্কিত প্রশ্ন করিতাম। তিনি তাঁহার যুগের বিজ্ঞতম ব্যক্তি ছিলেন। (তাই এতদসম্পর্কিত প্রশ্নের উত্তর দিতে তিনি অসম্মত হইতেন না।) কিন্তু আমরা তাঁহার নিকট কুরআন পাকের কোন আয়াতের তাফসীর জিজ্ঞাসা করিলে তিনি চুপ করিয়া থাকিতেন- যেন উহা শুনিতে পান নাই ৷’
উবায়দুল্লাহ্ ইব্ন উমর ধারাবাহিকভাবে হাম্মাদ ইব্ন যায়দ, আহমদ ইব্ন উবাদা আয্যাদী ও ইব্ন জারীর বর্ণনা করেন যে, উবায়দুল্লাহ্ ইব্ন উমর বলেনঃ ‘আমি মদীনা শরীফের ফকীহ্ ও বিজ্ঞ ব্যক্তিগণকে দেখিয়াছি, তাহারা নিজদিগকে কুরআন মজীদের তাফসীর বর্ণনা করিবার অযোগ্য মনে করিয়া উহা এড়াইয়া চলিতেন। তাঁহাদের মধ্যে সালিম ইব্ন আবদুল্লাহ্, কাসিম ইব্ন মুহাম্মদ, সাঈদ ইব্ন মুসাইয়্যেব এবং নাফে’র নাম সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।
হিশাম ইব্ন উরওয়া হইতে ধারাবাহিকভাবে লায়ছ, আবদুল্লাহ্ ইব্ন সালেহ ও আবূ উবায়দ বর্ণনা করেন, ‘আমি (হিশাম) আমার পিতাকে (উরওয়া) কখনও কুরআন মজীদের কোন আয়াতের ব্যাখ্যা প্রদান করিতে শুনি নাই।’
মুহাম্মদ ইব্ন সীরীন হইতে আইয়ূব ইব্ন ‘আওন ও হিশাম আলুস্তোয়াঈ বর্ণনা করেন- ‘আমি একদিন উবায়দা সালমানীর নিকট কুরআনের একটি আয়াতের ব্যাখ্যা জিজ্ঞাসা করায় তিনি বলিলেন, কুরআনের কোন্ আয়াত কোন্ উপলক্ষে নাযিল হইয়াছে তাহা যাঁহারা জানিতেন তাঁহারা দুনিয়া হইতে বিদায় লইয়াছেন। এখন আল্লাহকে ভয় করিয়া চল এবং দৃঢ়তার সহিত যথাবিহিত আমল ও আচরণ করিতে থাক।
আবদুল্লাহ্ ইব্ন মুসলিম ইন ইয়াসার হইতে ক্রমাগত ইব্ন ‘আওন, মুআয ও আবূ উবায়দ বর্ণনা করেনঃ ‘ইবন মুসলিম বলেন, আল্লাহর কালামের কোন আয়াতের আলোচনার পূর্বে উহার আগে পরের আয়াত সম্বন্ধে গভীরভাবে গবেষণা করিও।’
মুগীরা হইতে ধারাবাহিকভাবে হাশিম ও আবূ উবায়দ বর্ণনা করেন, ইবরাহীম বলিয়াছেন, আমাদের যুগের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ কুরআন মজীদের ব্যাখ্যা বর্ণনা করা হইতে বিরত থাকিতেন। তাঁহারা উহাকে ভীতির দৃষ্টিতে দেখিতেন।
আবদুল্লাহ্ ইব্ন আবূ আস সাফ্ফাহ হইতে শু’বা বর্ণনা করিয়াছেন যে, শা’বী বলিয়াছেন, ‘আল্লাহর কসম ! আমার কাছে কুরআনের প্রতিটি আয়াত সম্পর্কেই প্রশ্ন করা হইয়াছে। কিন্তু ইহা হইতেছে আল্লাহর নিকট হইতে জানিয়া বর্ণনা করার কাজ।’ (তাই তিনি উহার উত্তর দানে বিরত ছিলেন)।
শা’বী হইতে ধারাবাহিকভাবে আমর ইব্ন আবূ যায়দাহ্, হাশিম ও আবূ উবায়দ বর্ণনা করেন, মাসরূক বলিয়াছেন, ‘তোমরা কুরআন মজীদের তাফসীর বর্ণনা করিবার ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করিও। কারণ, উহা হইল আল্লাহর নিকট হইতে জ্ঞাত হইয়া বর্ণনা করার কাজ। উপরে প্রাথমিক যুগের ফকীহ ও ইমামবৃন্দ কর্তৃক অনুসৃত আল-কুরআনের তাফসীর সম্পর্কিত যে নেতিবাচক ভূমিকা বর্ণিত হইল, উহার ব্যাখ্যা হইল এই যে, কুরআন মজীদ সম্বন্ধে তাঁহারা যাহা জানিতেন না, অনুমানের ভিত্তিতে তাহা বলিতেন না। পক্ষান্তরে শরী’আত ও অভিধানের সাহায্যে জ্ঞাত বিষয়কে মানুষের নিকট প্রকাশ করায় কোন দোষ নাই। তাই দেখা যায়, উল্লিখিত ফকীহ ও ইমামগণসহ অনেক বিজ্ঞ ব্যক্তিই কুরআনের বিভিন্ন আয়াতের ব্যাখ্যা প্রদান করিয়াছেন। তাঁহাদের কথা ও কাজে বিরোধ নাই। কারণ, তাঁহারা যাহা বলিতেন তাহাই বলিতেন এবং যাহা জানিতেন না তাহা অনুমান করিয়া বলিতেন না। মূলত ইহাই মানুষের জন্য অবশ্য কর্তব্য। অজ্ঞাত বিষয় অনুমান করিয়া বলা যেমন নিষিদ্ধ, তেমনি জ্ঞাত বিষয় প্রকাশ করা কর্তব্য। আল্লাহ্ পাক বলেনঃ
لسَبَِيْنْنَة للناس ولا تكتمونه তোমরা উহাকে (শরী’আতকে) মানুষের নিকট সুস্পষ্টরূপে প্রকাশ করিবে এবং উহার্কে গোপন করিবে না।
নবী করীম (সাঃ) বলিয়াছেন, ‘যে ব্যক্তি কোন ইলম বা জ্ঞান সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হইবার পর উহা গোপন রাখে, কিয়ামতের দিন তাহাকে আগুনের লাগাম পরানো হইবে।’
উক্ত হাদীস একাধিক সনদে বর্ণিত হইয়াছে। প্রসঙ্গত নিম্নোক্ত হাদীসটি পর্যালোচনা করা সমীচীন হইবে।
হযরত আয়েশা (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে উরওয়াহ্, হিশাম ইব্ন উরওয়াহ্, আবূ জা’ফর ইব্ন মুহাম্মদ যুবায়রী, মুহাম্মদ ইব্ন খালিদ ইব্ন উসামা, আব্বাস ইব্ন আবদুল আযীয ও ইমাম আবূ জা’ফর ইব্ন জারীর বর্ণনা করেনঃ ‘হযরত জিবরাঈল (আঃ) নবী করীম (সাঃ)-কে যে সকল আয়াতের ব্যাখ্যা শিখাইতেন, উহা ভিন্ন অন্য কোন আয়াতের ব্যাখ্যা নবী করীম (সাঃ) বর্ণনা করিতেন না।’
হযরত আয়েশা (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে উরওয়াহ, হিশাম ইবন উরওয়াহ, জা’ফর ইব্ন খালিদ, মাআন ইব্ন ঈসা ও আবূ বকর, মুহাম্মদ ইব্ন ইয়াযীদ তারসূমী ও ইমাম জা’ফর ইব্ন জারীর বর্ণিত উপরোক্ত হাদীসটি বর্ণনা করিয়াছেন।
মূলত উপরোক্ত হাদীসটি ‘দুর্বল’ ও উহা সহীহ হাদীসের পরিপন্থী বিধায় ‘মুনকার’ এবং অন্য কোন সনদে বর্ণিত না হওয়ায় ‘গরীব’। শেষোক্ত সনদের অন্যতম ‘রাবী’ জা’ফর হইতেছে ইবন মুহাম্মদ ইব্ন খালিদ ইবন যুবায়ের ইবন আওয়ান আল কুরায়শী আর যুবায়রী। তাহার ব্যাপারে ইমাম বুখারীর মন্তব্য, হইল, ‘তাহার বর্ণিত হাদীসের সমর্থনে অন্য কোন হাদীস পাওয়া যায় না।’ হাফিজ আবুল ফাতাহ ইযদী তাহার সম্পর্কে মন্তব্য করিয়াছেন, ‘তাহার বর্ণিত, হাদীস দুর্বল ও সহীহ হাদীসের বিরোধী হইয়া থাকে।’
ইমাম আবূ জা’ফর নিম্ন মর্মে উপরোক্ত হাদীসের ব্যাখ্যা প্রদান করিয়াছেনঃ
‘যে সকল আয়াতের ব্যাখ্যা আল্লাহর তরফ হইতে না আসা পর্যন্ত নবী করীম (সাঃ)-এর পক্ষে বর্ণনা করা সম্ভবপর ছিল না, উল্লেখিত হাদীসটি কেবল সেই সকল আয়াতের বেলায় প্রযোজ্য। তিনি শুধু সেই আয়াতসমূহের ব্যাখ্যা প্রদানের ব্যাপারে হযরত জিবরাঈল (আঃ)-এর উপর নির্ভর করিতেন।
আলোচ্য হাদীসটি বিশুদ্ধ হইলে উপরোক্ত ব্যাখ্যাটি সঠিক। কারণ; কুরআন পাকের কিছু কিছু আয়াতের ব্যাখ্যা আল্লাহ্ তা’আলা ভিন্ন অন্য কেহ জানে না। তেমনি কতকগুলি আয়াতের ব্যাখ্যা শুধু বিশেষজ্ঞ আলেমগণই জানিতে পারেন। কতগুলি আয়াতের ব্যাখ্যা আরবী ভাষাভাষী আরবগণ জানিতে পারে এবং কতিপয় আয়াতের ব্যাখ্যা আরবী ভাষার সাহায্যে সকলেই জানিতে পারে। শেষোক্ত শ্রেণীর আয়াতের ব্যাখ্যা না বুঝার কাহারও কোন অজুহাত থাকিতে পারে না।
আবুয্ যানাদ হইতে ক্রমাগত সুফিয়ান, মুআম্মাল, মুহাম্মদ ইব্ন বিশর ও ইমাম ইব্ন জারীর বর্ণনা করেনঃ ‘হযরত ইব্ন আব্বাস (রাঃ) বলেন- তাফসীরের চারিটি প্রকার রহিয়াছে। এক প্রকারের তাফসীর হইতেছে যাহা আরবী ভাষাবিদগণ ভাষাজ্ঞানের সাহায্যে বুঝিতে পারে। আরেক প্রকারের তাফসীর যে কোন আরবী ভাষা জ্ঞাত ব্যক্তিই বুঝিতে পারে। তাই তাহা না বুঝিবার পক্ষে কোন অজুহাত থাকিতে পারে না। অন্য প্রকার তাফসীর শুধু বিশেষজ্ঞ আলেমগণই বুঝিতে পারে। আরেক প্রকার তাফসীর আল্লাহ্ তা’আলা ভিন্ন কেহই জানে না।’
হযরত ইব্ন আব্বাস (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে হযরত উম্মে হানীর গোলাম আবূ সালেহ, মুহাম্মদ ইব্ন সায়েব কালবী, আমর ইব্ন হারছা, ইব্ন ওহাব, ইউনুস ইব্ন আবদুল আলা সাদাফী ও ইমাম ইবন জারীর বর্ণনা করেনঃ নবী করীম (সাঃ) বলিয়াছেন, কুরআন মজীদের বিষয়বস্তুকে চারিটি স্তরে বিভক্ত করিয়া নাযিল করা হইয়াছে। এক স্তর হইতেছে হালাল-হারাম সম্পর্কিত সুস্পষ্ট আয়াতসমূহ যাহা না বুঝিবার পক্ষে কাহারও কোন অজুহাত গ্রহণযোগ্য হইতে পারে না। আরেক স্তর হইতেছে যাহা আরবী ভাষাবিদগণ ভাষাজ্ঞানের সাহায্যে ব্যাখ্যা করিতে পারেন। আরেক স্তর হইতেছে যাহা শুধু বিশেষজ্ঞ আলেমগণ ব্যাখ্যা করিতে পারেন। অন্য স্তর হইতেছে ‘মুতাশাবিহা আয়াত’ যাহার অর্থ তাৎপর্য আল্লাহ্ ছাড়া কেহই জানে না। যে ব্যক্তি উহার অর্থ ও তাৎপর্য জানে বলিয়া দাবী করে, সে মিথ্যাবাদী।
ইমাম ইব্ন জারীর বলেন, উপরোক্ত হাদীসটির সূত্র দুর্বল ও অগ্রহণযোগ্য। কারণ, উহার অন্যতম বর্ণনাকারী মুহাম্মদ ইব্ন সায়েব জ্বালবীর বর্ণিত হাদীস গ্রহণযোগ্য হয় না। তবে ইহা হইতে পারে যে, উক্ত বর্ণনাকারী ভুলক্রমে হযরত ইব্ন আব্বাস (রাঃ)-এর উক্তিকে স্বয়ং নবী করীম (সাঃ)-এর বাণী (হাদীসে মারফু’) বলিয়া ফেলিয়াছেন। আল্লাহ্ই সর্বজ্ঞ।