সন্তানদের নাম সাধারণত বাবা-মা কিংবা অন্য গুরুজনরা রাখেন। আমার সর্বকনিষ্ঠ ভাই আহসান হাবীবের নাম আমার রাখা। বাবা তার কনিষ্ঠ পুত্রের জন্যে নাম খুঁজছিলেন। আমার এক বন্ধুর নাম আহসান হাবীব। দুর্দান্ত ভালো ছেলে (এখন আমেরিকার এক বিশ্ববিদ্যালয়ে ইকনমিক্সের অধ্যাপক এবং বিশিষ্ট তবলাবাদক। বাঙালিদের গানের অনুষ্ঠান তার তবলা বাদন না হলে জমে না।) আমি বাবাকে বললাম, আহসান হাবীব নামটা কি রাখবেন? আমার বন্ধু এবং খুব ভালো ছেলে।
বাবা আঁর নিউমারোলজির বইপত্র খুললেন। হিসাবনিকাশ করে বললেন, নিউমরোলজিতে ভালো আসছে। আহসান হাবীব নামের জাতকের জীবন শুভ হবে। এই নামই রাখা হলো। খাসি জবেহ করে আকিকা করা হলো না। বাবার সেই সামর্থ্য ছিল না। অনেক বছর পর যখন আমার সামান্য টাকাপয়সা হলো তখন আমি যেসব ভাইবোনের আকিকা করা হয় নি তাদের নামে আকিকার ব্যবস্থা করলাম। এই ঘটনায় আমার মা পরম সন্তোষ লাভ করলেন।
ছোট ভাইয়ের প্রসঙ্গে ফিরে যাই। সে ছিল অতি রূপবান এক বালক। গায়ের রঙ দুধে আলতা টাইপ। শৈশবে তার হজকিনস ডিজিজ হয়েছিল। তাকে কঠিন চিকিৎসার ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছিল বলেই হয়তো রঙের এমন পরিবর্তন।
প্রিয় পাঠক, শৈশবে আমার গায়ের রঙও না-কি দুধে আলতা টাইপ ছিল। (আমার মায়ের ভাষ্য।) একবার কঠিন রক্ত আমাশা হলো। আমার গায়ের রঙ হয়ে গেল শ্রীলংকানদের মতো। ছোটবেলায় আমার গায়ের রঙ কী ছিল আমার মনে নেই, তবে আমার মা যে কালো ছিলেন সেটা মনে আছে। মার কাছে শুনেছি, বাবা একটা কালো মেয়ে বিয়ে করে এনেছেন এই নিয়ে দাদার বাড়িতে অনেক মন্তব্য করা হয়েছে। মাকে আড়ালে চোখের পানি ফেলতে হয়েছে। সেই কালো মহিলাকে এখন দেখলে চমকাতে হয়। ধবধবে সাদা রঙ। এই মহিলা নিজের দুই পুত্রকে কালো বানিয়ে নিজে কীভাবে গৌরবর্ণ ধারণ করলেন কে জানে? জগৎ রহস্যময়।
রঙ প্রসঙ্গ আপাতত থাকুক। আহসান হাবীব প্রসঙ্গে আসি। সে ছিল বাবার অতি প্রিয়পুত্র। দুটি কারণে প্রিয়।
১. মজার মজার গল্প বলত। তার গল্প শুনে বাবা হো হো করে হাসতেন। বেচারাকে একই গল্প প্রতিদিন তিন-চারবার করে শোনাতে হতো।
২. তার গলায় সুর ছিল। যে-কোনো গান একবার শুনলেই নির্ভুল সুরে গাইতে পারত।
আহসান হাবীব প্রথম গুণটি নিয়ে এখন জীবন চালিয়ে যাচ্ছে। উন্মাদ পত্রিকা, রম্য লেখা, জোকসের বই। প্রতি বইমেলাতে তার জোকস-এর বই বের করা রেয়াজে দাঁড়িয়ে গেছে।
তার দ্বিতীয় গুণটি বিকশিত হয় নি। সে কাউকে গান গেয়ে শুনিয়েছে এমন শোনা যায় নি। গান গাওয়ার প্রতিভা বিকশিত হলে এখন হয়তো তার কয়েকটি গানের ক্যাসেট থাকতো। উন্মাদের বিশেষ সংখ্যার সঙ্গে একটা শ্যাম্পুর মিনি প্যাক, কফির মিনি প্যাক এবং আহসান হাবীবের গানের CD ফ্রি দেওয়া হতো।
সে মোটামুটি রেজাল্ট করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জিওগ্রাফিতে M.Sc করল এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই গ্রামীণ ব্যাংকে ভালো চাকরি পেল। চাকরি ঢাকার বাইরে। সাতদিনের মাথায় চাকরি ছেড়ে দিয়ে ঢাকায় উপস্থিত। মাকে বলল, সকালবেলায় নাশতার সমস্যা এই জন্যে চাকরিতে রিজাইন দিয়ে চলে এসেছি।
মার কাছে মনে হলো চাকরি ছাড়ার কারণ ঠিকই আছে। যেখানে খাওয়াদাওয়ার সমস্যা, সেই চাকরি করার দরকার কী? তিনি ছেলেকে কাছে পেয়ে বরং খুশি হলেন।
নাশতা সমস্যায় এমন একটা ভালো চাকরি ছাড়ার যুক্তি আমার কাছে কখনোই গ্রহণযোগ্য মনে হয় নি। আমার ধারণা ঢাকায় সে বন্ধুবান্ধব ফেলে গেছে। তাদের টানেই চাকরি ছেড়ে চলে এসেছে। তার কাছে বন্ধুবান্ধব অতি গুরুত্বপূর্ণ। আমি যে তাকে ডেকে কিছু উপদেশ দেব, তাও সম্ভব না। কারণ উপদেশ দেবার বিষয়টা আমাদের পরিবারে নাই। আমরা উপদেশ দেই না, কারো উপদেশ শুনিও না।
অবশ্য তাকে উপদেশ দেওয়ার যোগ্যতাও আমার ছিল না। সে বড় হয়েছে একা একা। আমি তখন সংসার নামক ঠেলাগাড়ি ঠেলতে ব্যস্ত। বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারারের সামান্য কিছু টাকা সম্বল। বিরাট সংসার। আমরা ছয় ভাইবোন, মা। আমার ছোটমামাও আমাদের সঙ্গে থেকে পড়াশোনা করেন। কোনোদিকে তাকানোর অবস্থা নেই। আহসান হাবীব স্কুলে ভর্তি হবে। কে তাকে নিয়ে যাবে?
বেচারা নিজেই খুঁজে খুঁজে একটা স্কুল বের করল। মার কাছ থেকে টাকা নিয়ে ভর্তি হয়ে গেল। স্কুলের হেডমাস্টার সাহেব বললেন, বাবা তোমার গার্জিয়ান কোথায়? সে হাসিমুখে বলল, স্যার আমিই আমার গার্জিয়ান। কখন সে পাস করল, কখন কলেজে গেল, কলেজ শেষ করে ইউনিভার্সিটিতে– কিছুই তো জানি না। তাকে কী করে আমি বলি, তোমার ভালো চাকরি মন দিয়ে করা দরকার।
সে তার উন্মাদ পত্রিকা নিয়ে আছে। ভালো আছে বলেই আমার ধারণা। আর ভালো না থাকলেই বা কী!
আহসান হাবীবকে নিয়ে কাঠপেন্সিল লেখার একটা আলাদা কারণ আছে। কারণটা শুনলে পাঠক বিস্মিত হবেন বলেই এই লেখা।
আহসান হাবীব শব্দের রঙ দেখতে পায়। সে বলে যখনই কোনো শব্দ হয় তখনই সে সেই শব্দের রঙ দেখে। কখনো নীল, কখনো লাল, সবুজ, কমলা। মাঝে মাঝে এমন সব রঙ দেখে যার অস্তিত্ব বাস্তব পৃথিবীতে নেই।
তরুণ গবেষক হিসেবে আমি তাকে নিয়ে কিছু গবেষণাও করি। হারমোনিয়ামের একেক রিড একেক ফ্রিকোয়েন্সিতে বাজে। আমি তাকে আলাদা আলাদা করে প্রতিটি ফ্রিকোয়েন্সি বাজিয়ে শোনালাম। সে রঙ বলল। আমি লিখে রাখলাম। পনেরো দিন পর আবারো সেই পরীক্ষা। রংগুলো যদি বানিয়ে বানিয়ে বলে তাহলে দ্বিতীয়বার পরীক্ষায় এলোমেলো ফল আসবে। আরেকটু পরিষ্কার করে বলি। গানের সাতটা স্বর হলো–সা রে গা মা পা ধা নি। প্রথমবারের পরীক্ষায় সে বলেছে
সা : নীল।
রেঃ সবুজ
গা : গাঢ় সবুজ
মা : কমলা
ইত্যাদি–
পনেরো দিন পর একই পরীক্ষা যদি করা হয়, তাহলে একই উত্তর তাকে দিতে হবে। ভিন্ন উত্তর দিলে বুঝতে হবে রঙের ব্যাপারটা সে বানিয়ে বানিয়ে বলছে।
ঘটনা সেরকম ঘটল না। সে একই উত্তর দিল। আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। এ ধরনের রঙ দেখার কারো ক্ষমতা আছে তা আমার চিন্তাতেও ছিল না।
তার মতো ক্ষমতা যে আরো কিছু মানুষের আছে জানলাম রাশিয়ান একটা পত্রিকা পড়ে। পত্রিকার নাম Sputnik। রিডার্স ডাইজেস্ট এর মতো পত্রিকা। সেখানে বিশাল এক প্রবন্ধ ছাপা হয়েছে যার বিষয় কিছু কিছু মানুষের শব্দের রঙ দেখার অস্বাভাবিক ক্ষমতা।
উন্মাদ অফিসে বসে আহসান হাবীব এখনো রঙ দেখে কি না জানি না। আমরা ভাইবোনরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছি। কেউ কারো খবর রাখি না। বাবা-মা ভাইবোনদের নিয়ে একসময় ভালোবাসার বৃত্তের মধ্যে একটা সংসার ছিল। সেই বৃত্ত ভেঙে গেছে। নতুন বৃত্ত তৈরি করে প্রত্যেকেই আলাদা সংসার করছি। আমাদের সবার ভুবনই আলাদা। এই ভুবনও একদিন ভাঙবে। আমরা অচেনা এক বৃত্তের দিকে যাত্রা শুরু করব। সেই বৃত্ত কেমন কে জানে! পৃথিবীতেই এত রহস্য। না জানি কত রহস্য অপেক্ষা করছে অদেখা ভুবনে।
“কাঠপেন্সিল” গল্প সমগ্র সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ