।। এক ।।
হাদীসে صلو শব্দ ব্যবহৃত হইয়াছে। বলা হইয়াছে صلو -কে আমার ও বান্দার মধ্যে আধাআধি করিয়া ভাগ করিয়া দিয়াছি। উক্ত সালাত শব্দের মর্মার্থ কিরাআত (নামাযে পঠিতব্য)। নিম্নোক্ত আয়াতে কিরাআত অর্থে সালাত শব্দ ব্যবহৃত হইয়াছেঃ
ولأتجهر بصلوتك ولاتخافت بها وابِتَغ بين ذالك سبيلاً ‘তোমরা কিরাআত না জোরে পড়, না আস্তে; বরং মাঝামাঝি পথ অবলম্বন কর।’
হযরত ইব্ন আব্বাস (রাঃ) উপরোক্ত আয়াতের অনুরূপ তাফসীর করিয়াছেন।
তাহা ছাড়া আল্লাহ্ তা’আলা কর্তৃক তাঁহার ও তাঁহার বান্দার মধ্যে সালাতের আধাআধি বিভক্তিকরণের ব্যাপারেও বুঝা যায় যে, সালাত সেখানে কিরাআত অর্থে ব্যবহৃত হইয়াছে। বিভক্তি সম্পর্কিত বিশ্লেষণই দেখা যায়, আল্লাহ্ তা’আলা সূরা ফাতিহাকে তাঁহার ও বান্দার মধ্যে আধাআধি করিয়া দিয়াছেন।
উপরে বর্ণিত হাদীস দ্বারা ইহাও প্রমাণিত হয় যে, নামাযে কিরাআত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। উহা নামাযের গুরুত্ব সম্পন্ন ফরযসমূহের অন্যতম। কারণ, উক্ত হাদীসে ইবাদতের অর্থে নির্ধারিত সালাত শব্দকে উহার একটি অংশ, ‘কিরাআত’ অর্থে ব্যবহার করা হইয়াছে। এই ধরনের ব্যবহারের অন্য ক্ষেত্রেও উদাহরণ মিলে। এক জায়গায় قران শব্দ দ্বারা صلو অর্থ বুঝানো হইয়াছে। যেমন, আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ
وقزان الفجر -ان قران الفجر كان مُشهودًا ‘অনন্তর তুমি ফজরের সালাত কায়েম কর। নিশ্চয় ফজরের সালাত পর্যবেক্ষিত হয়।’
উক্ত আয়াতে দেখা যাইতেছে قران الفجر শব্দ দ্বারা ‘ফজরের সালাত’ অর্থ বুঝানো হইয়াছে। এতদসম্পর্কিত বুখারী শরীফ ও মুসলিম শরীফের হাদীসেও অনুরূপ অর্থ ব্যক্ত হইয়াছে। তাহাতে বলা হইয়াছে ‘ফজরের সালাতকে রাতের ফেরেশতাগণ ও দিনের ফেরেশতাগণ প্রত্যক্ষ করেন।
উপরোক্ত আয়াত ও হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, নামাযে কিরাআত ফরয। ফকীহ ও আলিমগণের ইহাই সর্ববাদীসম্মত অভিমত। তবে নামাযে কি কুরআনের যে কোন আয়াত তিলাওয়াত করা ফরয, না নির্দিষ্টভাবে সূরা ফাতিহা পড়া ফরয, তাহা লইয়া ফকীহদের মধ্যে মতভেদ রহিয়াছে।
ইমাম আবূ হানীফা (রঃ) ও তাঁহার শিষ্যগণ সহ একদল ফুকাহার অভিমত এই যে, নামাযে নির্দিষ্টরূপে সূরা ফাতিহা পড়া ফরয নহে; বরং কুরআন মজীদের যে কোন স্থান হইতে কিয়দংশ পাঠ করা ফরয। কারণ, নামাযে কিরাআত ফরয হওয়া সম্পর্কিত আয়াতে নির্দিষ্টভাবে সূরা ফাতিহার কথা বলা হয় নাই; বরং উহাতে সাধারণভাবে কুরআন মজীদের যে কোন অংশ পাঠের কথা বলা হইয়াছে। সংশ্লিষ্ট আয়াতটি নিম্নরূপঃ
فافرأوا ماتيسر من اُقران ‘কুরআন হইতে যতটুকু পার পড়।
অনুরূপভাবে হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ) হইতে বর্ণিত নিম্নোক্ত হাদীসেও কুরআনের যে কোন স্থান হইতে কিয়দংশ পাঠ করার নির্দেশ পাওয়া যায়।
হাদীসটি নিম্নরূপঃ
‘একদা জনৈক ব্যক্তি যথাযথভাবে নামায আদায়ে অপারগ হইয়া উহার অঙ্গহানি ঘটাইলে নবী করীম (সাঃ) তাহাকে বলিলেনঃ নামাযে দাঁড়াইয়া ‘আল্লাহু আকবার’ বল; অতঃপর কুরআন মজীদের যতটুকু পার পড়।”
উপরোক্ত আয়াত ও হাদীসে নামাযে নির্দিষ্টভাবে সূরা ফাতিহা পাঠ করিতে নির্দেশ দেওয়া হয় নাই; বরং কুরআন মজীদের যে কোন অংশ পাঠ করিতে নির্দেশ দেওয়া হইয়াছে।
পক্ষান্তরে ইমাম মালিক (রঃ), ইমাম শাফেঈ (রঃ), ইমাম আহমদ ইবন হাম্বল (রঃ) ও তাঁহাদের শিষ্যগণ সহ অধিকাংশ ফুকাহার অভিমত এই যে, নামাযে সূরা ফাতিহা পাঠ করা ফরয এবং ইহা ব্যতীত নামায শুদ্ধ হইবে না। কারণ, নবী করীম (সাঃ) বলিয়াছেন, ‘যে ব্যক্তি উম্মুল কুরআন ছাড়া নামায পড়ে তাহার নামায অপূর্ণ থাকে।’ এই ব্যাপারে হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ) কর্তৃক পূর্বে বর্ণিত হাদীসে রাসূল (সাঃ) خداج শব্দ ব্যবহার করিয়াছেন, যাহার অর্থ অপূর্ণ বা অসম্পন্ন।’
অনুরূপ আরেক হাদীস হযরত উবাদা ইব্ন সামিত (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে মাহমূদ ইব্ন রবী’ ও যুহরী প্রমুখ রাবীর সনদে বুখারী শরীফ ও মুসলিম শরীফে বর্ণিত হইয়াছে। বর্ণনাটি এইঃ
‘নবী করীম (সাঃ) বলিয়াছেন, যে ব্যক্তি (নামাযে) ফাতিহাতুল কিতাব পাঠ করে না তাহার নামায হয় না।’
হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ) হইতে ইব্ন খুযায়মা ও ইব্ন হাব্বান তাঁহাদের সংকলন গ্রন্থে বর্ণনা করেনঃ
‘নবী করীম (সাঃ) বলিয়াছেন, যে সালাতে উম্মুল কুরআন পঠিত হয় না, তাহা আদায় হয় না।’
আলোচ্য বিষয়ে বহু হাদীস বর্ণিত হইয়াছে। এতদসম্পর্কিত বিতর্ক বেশ দীর্ঘ। আমি উভয় অভিমতের প্রবক্তাদের বক্তব্য প্রমাণ সহ সংক্ষেপে তুলিয়া ধরিলাম । আল্লাহ্ তা’আলা তাঁহাদের সকলকে করুণাসিক্ত করুন।
।। দুই ।।
অতঃপর প্রশ্ন জাগে, সালাতের প্রতি রাক’আতেই কি ফাতিহা পাঠ করা ফরয, না শুধু এক বা একাধিক রাক’আতে উহা ফরয?
ইমাম শাফেঈ (রঃ) সহ একদল ফকী অভিমত হইল, প্রতি রাক’আত নামাযে ফাতিহা পাঠ করা ফরয। আরেক দল ফকীহ বলেন, সালাতের শুধু অধিকাংশ রাক’আতে ফাতিহা পাঠ করা ফরয।
হাসান বসরী সহ বসরা নগরীর অধিকাংশ ফকীর মতে মাত্র এক রাক’আতে ফাতিহা পাঠ করা ফরয। এই মতের প্রবক্তাগণ বলেন, ‘যে ব্যক্তি ফাতিহা পাঠ করে না, তাহা নামাযই হয় না’ হাদীসে কত রাক’আতে ফাতিহা পাঠ করিতে হইবে তাহা নির্দিষ্টভাবে বলা হয় নাই। তাই নামাযের রাক’আতের ন্যূনতম সংখ্যক এক রাক’আতে ফাতিহা পাঠ করিলেই ফরয আদায় হইবে।
অবশ্য হযরত আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে আবূ নুযরাহ ও আবূ সুফিয়ান সা’দী প্রমুখ বর্ণনাকারীর সূত্রে ইমাম ইবন মাজাহ্ (রঃ) বর্ণনা করেনঃ
নবী করীম (সাঃ) বলিয়াছেন, যে ব্যক্তি ফরয সহ অন্যান্য সালাতের প্রত্যেক রাক’আতে আলহামদু (সূরা) পাঠ না করে তাহার সালাত আদায় হয় না।’
তবে উক্ত হাদীসের বিশুদ্ধতা তর্কাতীত ও সংশয়মুক্ত নহে। আল্লাহ্ই সর্বজ্ঞ।
ইমাম আবূ হানীফা (রঃ) ও তাঁহার শিষ্যবৃন্দ, সুফিয়ান ছাওরী ও ইমাম আওযাঈ বলেন, সালাতে নির্দিষ্টভাবে সূরা ফাতিহা পাঠ করা আদৌ ফরয নহে; বরং কুরআন মজীদের যে কোন স্থান হইতে কিছু অংশ পাঠ করিলে কিরাআত পাঠের ফরয আদায় হইবে। কারণ, আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ
فاقراوا مائيسر من القران এ কুরআন মজীদ হইতে যতটুকু পার পড়।(১) আল্লাহ্ই সর্বজ্ঞ। এই সম্পর্কে ‘আহকামুল কবীর’ গ্রন্থে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করিব। আল্লাহ্ই শ্রেষ্ঠতম জ্ঞানী।
।। তিন ।।
প্রশ্ন জাগে যে, সালাতে সূরা ফাতিহা পাঠ করা কি মুক্তাদীর জন্যও ফরয। এ সম্পর্কে ফকীবৃন্দের তিনটি অভিমত রহিয়াছে।
প্রথম অভিমত এই যে, সালাতে ফাতিহা পাঠ করা যেরূপ ইমামের উপর ফরয, তেমনি মুক্তাদীর উপরও ফরয। কারণ, উপরোল্লেখিত হাদীসসমূহ ইমাম ও মুক্তাদী উভয়ের বেলায়ই সমান প্রযোজ্য। উহার কোন হাদীসেই সালাতে ফাতিহা পাঠের অপরিহার্যতাকে শুধু ইমামের সহিত সংশ্লিষ্ট করা হয় নাই।
দ্বিতীয় অভিমত এই যে, সশব্দ যথা, ফজর, মাগরিব, ‘ইশা কিংবা নিঃশব্দ যথা জোহর ও আসর, কোন নামাযেই মুক্তাদীর উপর সূরা ফাতিহা বা কুরআনের কিছু অংশ পাঠ করা ফরয নহে। কারণ হযরত জাবির ইবন আবদুল্লাহ (রাঃ) হইতে ইমাম আহমদ (রঃ) বর্ণনা করেনঃ নবী করীম (সাঃ) বলিয়াছেনঃ من كان له امام فقراءة الامام له قراءة অর্থাৎ ইমামের কিরাআতই মুক্তাদীর কিরাআত। অবশ্য উক্ত হাদীসের সনদ দুর্বল। ওয়াহাব ই কায়সানের বরাত দিয়া ইমাম মালিক উহাকে জাবির (রাঃ) -এর নিজস্ব উক্তি (حدييث موقوف) হিসাবে বর্ণনা করিয়াছেন।
তৃতীয় অভিমত হইল এই যে, নিঃশব্দ নামাযে কিরাআত পাঠ করা মুক্তাদীর উপর ফরয। এই অভিমতের প্রবক্তাগণ পূর্বোল্লেখিত আয়াত ও হাদীসকেই নিজেদের সমর্থনে পেশ করেন।
তাঁহারা বলেন, সশব্দ নামাযে কিরাআত পাঠ করা মুক্তাদীর উপর ফরয নহে। কারণ, হযরত আবূ মূসা আশ’আরী (রাঃ) হইতে ইমাম মুসলিম কর্তৃক বর্ণিত হইয়াছেঃ
নবী করীম (সাঃ) বলিয়াছেন, ‘মুক্তাদীর অনুসরণের জন্যই ইমামকে ইমাম বানানো হয়। অতএব যখন সে তাকবীর বলে, তখন তোমরাও তকবীর বলিবে। আর যখন সে কিরাআত পড়ে তখন তোমরা মনোযোগ সহকারে চুপ থাকিও।’ অতঃপর হাদীসের অবশিষ্টাংশ বর্ণিত হয়।
ইমাম আবূ দাউদ, ইমাম তিরমিযী, ইমাম নাসাঈ এবং ইমাম ইব্ন মাজাহও হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ) হইতে বর্ণনা করেনঃ ‘সে (ইমাম) যখন কিরাআত পড়ে, তখন তোমরা মনোযোগ সহকারে চুপ থাকিও ।’
মুসলিম ইব্ন হাজ্জাজও উপরোক্ত হাদীসকে সহীহ হাদীস বলিয়াছেন। উপরোক্ত হাদীস দুইটি দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, সশব্দ নামাযে কিরাআত পাঠ করা মুক্তাদীর জন্য ফরয নহে। ইমাম আহমদ (রঃ) হইতেও অনুরূপ একটি অভিমত বর্ণিত হইয়াছে।
সূরা ফাতিহা সংশ্লিষ্ট বিধি-বিধানগুলি স্পষ্ট করিয়া তুলিয়া ধরার উদ্দেশ্যেই উপরোক্ত মাসআলাগুলি আলোচনা করিলাম। সূরা ফাতিহা ভিন্ন অন্য কোন সূরার সহিত এতসব মাসায়েল সংশ্লিষ্ট নহে ৷
হযরত আনাস (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে আবূ ইমরান আল জুনী, গাস্সান ইব্ন উবায়দ, ইবরাহীম ইবন সাঈদ আল জাওহারী ও হাফিজ আবূ বকর আল বায্যার বর্ণনা করেনঃ ‘নবী করীম (সাঃ) বলিয়াছেন, যখন তুমি বিছানায় শায়িত হও, তখন যদি ‘আলহামদু’ ও ‘কুল হুয়াল্লাহ’ সূরা পাঠ কর, তাহা হইলে তুমি মৃত্যু ভিন্ন অন্য সব বিপদ হইতে মুক্ত থাকিবে।’