ধর্ম গুরু, অধ্যাত্মবাদী দার্শনিক এবং ঈশ্বর-বিশ্বাসী বুদ্ধিজীবীদের কেউ কেউ যুক্তিবাদীদের বিরুদ্ধে একটা গুরুতর অভিযোগ তোলেন। অভিযোগগুলোর মূল সুর এই ধরনের :—

গরুর গাড়ির চাকা থেকে মহাকাশ বিজয়—বিজ্ঞানের প্রতিটি জয়ের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে মানুষের চিন্তা-যুক্তি-বুদ্ধি-বিবেচনা ও প্রয়োগ। প্রয়োগ মানেই সফলতা নয় ৷ প্রয়োগে ব্যর্থতা আসতে পারে। আবার ব্যর্থতা মানে অনেক সময়ই সাফল্যের ধাপও; এটাও মনে রাখতে হবে।

আদিম মানুষ গতি বাড়াতে চাকা বানিয়েছে। এই চাকা বানাবার আগে একটি কল্পিত বিশ্বাস নিয়ে চিন্তার জগতে কাজ শুরু করেছিল। একটা কাঠামোর সঙ্গে দুটো বা চারটে চাকা জুড়ে দিলে কেমন হয়? একটা গৃহপালিত পশু তার পিঠে চাপলে যতটা বোঝা বইতে পারে, চাকা লাগানো কাঠামোটা পশুর পিঠে জুতে দিলে তার চেয়ে অনেক বেশি বইবে। এই চাকার গড়নটা যে গোল করলে সুবিধে হবে, সেই ভাবনাটা, বিশ্বাসটা আগে চিন্তায় এসেছে, তার পর প্রয়োগে।

চাকা থেকে মারণ রোগের ওষুধ মহাকাশ গবেষণা—প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই আগে গবেষকদের মাথায় চিন্তা এসেছে, একটা কল্পিত বিশ্বাস এসেছে। তারপর তার প্রয়োগ এসেছে। অর্থাৎ বিজ্ঞানের কল্পিত পরীক্ষার শুরু হয় কোনও বিশ্বাসের ওপর নির্ভর করেই।

যুক্তিবাদীরা বিজ্ঞানের এই বিশ্বাস নির্ভরতাকে দোষণীয় মনে করেন না; আর আমাদের ঈশ্বর বিশ্বাসের বেলায় যত দোষ! এ’হল যুক্তিবাদীদের স্ববিরোধিতা। এ’হল যুক্তিকে বাদ দেওয়া নিজের স্বার্থে। যুক্তিবাদীরা কোনও পরীক্ষা না চালিয়েই বলে দেন—ঈশ্বর নেই। এও তো তাঁদের বিশ্বাসেরই কথা।

বিজ্ঞানের ‘বিশ্বাস’ ব্যাপারটা একেবারেই অন্যরকম। বিজ্ঞানের জগতে এই ধরনের বিশ্বাস অবিশ্বাস নিয়ে কোনও কাজই হয় না। ‘বিজ্ঞান’ বলতে ‘পরীক্ষা’ পর্যবেক্ষণ-সিদ্ধান্ত’ নামের যে অতি সরলীকৃত একটি সংজ্ঞা চালু আছে, সেটাও পুরোপুরি ঠিক নয়। বিজ্ঞানে তত্ত্ব আছে, অঙ্ক আছে, আবার পরীক্ষা, পর্যবেক্ষণও আছে। বিজ্ঞানের পরীক্ষা বলতে শুধুমাত্র গবেষণাগারে যন্ত্রপাতির সাহায্যে পরীক্ষা বোঝায় না। বিজ্ঞানের পরীক্ষার মধ্যে রয়েছে একটি কল্পিত প্রস্তাবনা বা Hypothesis, যে প্রস্তাবনা যাচাই শেষে একটা বিশেষ সিদ্ধান্তে পৌঁছবার সম্ভাবনা থাকে। এই প্রস্তাবনায় পৌঁছতে কল্পিত পরীক্ষার প্রয়োজন হয়, অঙ্কের সাহায্য নিয়ে পরীক্ষার প্রয়োজন হয়। পাশাপাশি রয়েছে যে বিষয় নিয়ে গবেষণা হবে, সেই বিষয়ের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত যে-সব গবেষণা ইতিপূর্বে হয়েছে বা হচ্ছে, সেগুলো জানা। বিজ্ঞানের বিভিন্ন তত্ত্বের সঙ্গে সেগুলোর সঙ্গতির পরীক্ষা। প্রস্তাবনার সঙ্গতির পরীক্ষা। প্রয়োজনমতো কল্পিত প্রস্তাবনার পরিবর্তন করা। এরপর আসে কল্পিত প্রস্তাবনা বা তত্ত্বটিকে বাস্তবে প্রয়োগ করে ফলাফলের পরীক্ষা।

খুব সংক্ষেপে ‘পরীক্ষা’ শব্দটিকে আমরা ব্যবহার করেছি। বাস্তবে অসংখ্য পরীক্ষার মাধ্যমে বিজ্ঞানের তত্ত্বকে যাচাই করা হয়, তারপর আসে সিদ্ধান্তে পৌঁছবার প্রশ্ন। এ’ভাবে যাচাই করার আগে বিশ্ব বিখ্যাত বিভিন্ন গৃহীত তত্ত্বও ছিল প্রস্তাবনা মাত্র।

বিজ্ঞানের কল্পিত প্রস্তাবনার সঙ্গে জড়িত বিশ্বাসগুলো এসেছে পূর্বসূরী বিজ্ঞানীদের প্রতিষ্ঠিত তত্ত্ব ও নানা গবেষণা থেকে। এই বিশ্বাসের সঙ্গে সত্যের একটা সম্পর্ক থাকে।

ঈশ্বরকে নিয়ে বা পক্ষীরাজ ঘোড়ার অস্তিত্ব নিয়ে বিজ্ঞান কেন গবেষণার প্রথম পর্যায়—কল্পিত পরীক্ষায় যাবে না, তার পিছনে অবশ্যই জোরালো কারণ আছে। ঈশ্বর বা পক্ষিরাজ ঘোড়ার অস্তিত্ব শুধু বইয়ের লেখা আর আঁকা ছবিতে পাওয়া গেছে। তেমন লেখা ও ছবি তো হাঁসজারু, বকচ্ছপ থেকে রাক্ষস অনেক বইতে-ই পাওয়া যায় । কল্পনার মিথ্যের ওপর ভিত্তি করে আর যাই হোক বিজ্ঞানের কল্পিত প্রস্তাবনা তৈরি হয় না। ঈশ্বর দেখার দাবিদার বা ভক্তদের প্রচারে বিশ্বাস করে বিজ্ঞান কল্পিত প্রস্তাবনায় নামতে পারে না। কারণ, বিজ্ঞানেরই একটি শাখা মনোবিজ্ঞানের কাছে ঈশ্বর-দর্শনের কার্য-কারণ সম্পর্ক খুবই স্পষ্ট। মস্তিষ্ক স্নায়ুকোষের অস্বাভাবিকতা থেকেই মানুষ অলীক দেখে। অলীক দর্শনে ঈশ্বর এলে মানুষটি পুজো পায়, আর অভিনেত্রী করিশমা এলে পাগল বলে গাল খায়।

যদি কোনও ঐশ্বরিক ক্ষমতার দাবিদার প্রকাশ্যে, নিরপেক্ষ ভাবে তাঁর ঐশ্বরিক ক্ষমতার প্রমাণ বিভিন্ন বিজ্ঞান সংস্থার কাছে হাজির করতে পারতেন, শুধু তবে-ই বিজ্ঞানীদের ঈশ্বর নিয়ে কল্পিত পরীক্ষায় নামার প্রশ্ন আসতো।

ঈশ্বর নিয়ে বিজ্ঞানের কল্পিত পরীক্ষায় যাওয়ার বড় বাধা হল বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থগুলো। মুসলিমরা যদি বলেন, ঈশ্বর নিরাকার ; তো হিন্দুরা কয়েক হাজার দেব-দেবীর মূর্তি পুজো করে বুঝিয়ে দেন ঈশ্বরের আকার আছে। আবার হিন্দু ধর্মে এই নিয়ে লাঠালাঠি কম নেই। অনেক হিন্দুদের কাছেই ঈশ্বর নিরাকার। আবার জৈনরা মনে করেন, মানুষই জৈন ধর্মের নিয়ম-নীতি নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে দেবতা হতে পারেন।

এতো যত ধর্ম মত, তত বিভাজন। ঈশ্বর নিয়ে উপাসনা-ধর্মগুলোর মধ্যেকার বিরোধিতা আমাদের কাছে তাদের বিশ্বাসের অসারতাই স্পষ্ট করে দেয়। ধর্মমতগুলো নিজেদের মধ্যে বসে ‘ঈশ্বর’-এর একটা সর্বধর্মমত-গ্রাহ্য সংজ্ঞা তৈরি করার প্রাথমিক কাজটুকু আগে শেষ করে ফেলুক।

তারপর ধর্মগুরুরা নামবেন পরবর্তী বাধাগুলো অতিক্রম করতে। খুঁজে হাজির করবেন এমন ধর্মগুরু, যিনি প্রতারণার আশ্রয় না নিয়ে ঐশ্বরিক ক্ষমতা দেখাবেন। তখন বিজ্ঞানীদের কেউ কেউ ঈশ্বর নিয়ে কল্পিত পারীক্ষায় নামার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতে পারেন।

এ সব প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নিয়ে বোকা বোকা চেঁচাবেন না যে—যুক্তিবাদীরা কোনও পরীক্ষা না চালিয়েই বলে দেন ঈশ্বর নেই।

এতক্ষণে নিশ্চয়ই স্পষ্ট হয়েছে যে, ‘ঈশ্বরে বিশ্বাস’ আর ‘বিজ্ঞানের বিশ্বাস – এর পার্থক্য কোথায় ।

 

‘যুক্তিবাদ’ পাবলিক খাচ্ছে ভালো

‘যুক্তিবাদ’ পাবলিক ভালই খাচ্ছে—কথাটা রাষ্ট্র হয়ে যেতেই যুক্তিবাদকে নতুন নতুন ভাবে পরিবেশনে লেগে পড়েছে অনেকে-ই। এমন-ই এক জিভে জল আনা খাবার ‘যুক্তি পেস্টো’। মধ্যমেধার বুদ্ধিজীবীদের প্রিয় খাবার।

উপকরণঃ ১০০ গ্রাম যুক্তির ঘিলু, ১৫০ গ্রাম শোধন করা তাবিজ-কবচ, ১০০ গ্রাম পুজো-আচ্চা, ১৫০ গ্রাম শ্রাদ্ধ-শান্তি, ২০০ গ্রাম অন্তরে জিইয়ে রাখা ঈশ্বর- বিশ্বাস, ১০০ গ্রাম জনগণের ধর্মীয় আবেগ, শ্রদ্ধা, ১০০ গ্রাম প্রগতিশীলতা ও ১০০ গ্রাম মার্কসবাদ।

প্রণালীঃ মার্কসবাদকে ইচ্ছে মত ফালি ফালি করে কেটে রেড টমাটো সসে ডুবিয়ে রাখুন। বাকি সব উপকরণ মিক্সিতে দিয়ে এক সঙ্গে পেস্ট করে নিন। এবার এই পেস্ট মার্কসবাদের ফালিতে মাখিয়ে আধঘণ্টা ম্যারিনেট করুন। তারপর একটা পাত্রে ভাববাদের মাখন গরম করে ফালিগুলো লাল করে ভেজে গরম গরম পরিবেশন করুন। খাদ্য-রসিকরা জিভে লালা ঝরিয়ে লুফে নেবেন ।

 

‘সমকালীন যুক্তিবাদ’-এর পালের হাওয়া কাড়তে অনেকেই

‘আগে কে বা প্রাণ করিবেক দান, তার লাগি কাড়াকাড়ি’, সমকালীন যুক্তিবাদের পালের হাওয়া কাড়তে রাষ্ট্র শক্তির গেটের কাছে বুদ্ধিজীবীদের বিশাল লাইন । লাইনে শামিল যুক্তিবাদী-বুদ্ধিবাদী-কৌশলবাদী-এ জি ও’বাদীরা। রাষ্ট্রশক্তির কাছে ওঁরা বিশেষ সুবিধাভোগী শ্রেণী। শত হলেও সমাজ কাঠামোর চারটে পায়ার একটা তো ওঁরাই।

‘রাষ্ট্র’ মানে তো আসলে শোষকদের রাজনৈতিক ক্ষমতার হাতিয়ার।

সমাজে শোষক-শাসক দু’টি শ্রেণী থাকলে রাষ্ট্র-চরিত্র এমনটাই

থাকবে। রাষ্ট্রের মূল লক্ষ হবে ধনী-শোষকদের একনায়কত্বের

প্রতিষ্ঠা। এই রাষ্ট্রকে টিকে থাকতে কিছু

সহায়ক শক্তির প্রয়োজন হয়।

যেমন, (১) শাসক হতে চাওয়া, গদিতে বসতে চাওয়া রাজনৈতিক দল। যারা শোষণকে তৈল মসৃণ করতে শোষকদের স্বার্থরক্ষাকারী নানা আইন তৈরি করবে। (২) সেনা-পুলিশ-প্রশাসন। যারা শোষিত মানুষদের উস্কে দেওয়ার চেষ্টাকে কড়া হাতে দমন করবে। (৩) প্রচার মাধ্যম। মাধ্যমগুলোর ক্রোড়পতি মালিকরা প্রয়োজনমত, কৌশল ও বুদ্ধিকে কাজ লাগিয়ে আমজনতার মগজ ধোলাই করে যাবে। (৪) বুদ্ধিজীবীরা, যাঁদের কথা শুরুতেই বলা হয়েছে। বুদ্ধিজীবীরা তাঁদের লেখায়-রেখায় প্রতিটি সৃষ্টিতে মগজ ধোলাই করবেন। বেয়াদপ মানুষদের আন্দোলনের পালের হাওয়া কাড়তে মেকি বেয়াদপ মানুষ তৈরি করবে। রাষ্ট্রের পক্ষে কোনও বিপজ্জনক তত্ত্বকে ঠেকাতে যা দরকার রাষ্ট্র সব করবে।

এক প্রাক্তন নকশালপন্থী নেতার একটা লেখা পড়ছিলাম ‘উবুদশ” পত্রিকায় ৷ যতই পড়ছিলাম, বিস্ময়ের পারদ ততই চড়চড় করে ওপরে উঠছিল। এ’যেন কোনও লালটুকটুকে মানুষের লেখা নয়, গেরুয়া কারও লেখা? তিনি লিখেছেন, “যুক্তির একটা গ্রহণযোগ্যতা থাকে। সূর্য পূর্ব দিকে ওঠে, পশ্চিমে ডোবে, এটা যুক্তিবাদ, যে কেউ মেনে নেবে, কিন্তু এটা তো সত্যি নয়। সূর্য ওঠে না, ডোবেও না, আসল সত্য হল এটাই। সুতরাং ‘যুক্তিবাদী’ আর ‘সত্যবাদী’ এক ব্যক্তি নন। যুক্তিবাদ শেষ বিচারে টুপি পরানোর প্রতিক্রিয়াশীল মতবাদ।”

পৃথিবী সূর্যের চারপাশে যেমন ঘুরছে, তেমনই নিজের মেরুদণ্ডের চারপাশে লাটুর মত ঘুরে চলেছে। এই লাট্টু গতির জন্যেই পৃথিবীর মানুষ সূর্যের উদয় ও অস্ত দেখে। এই দেখাটাকে আমরা অস্বীকার করতে পারছি না। এও সত্যি—সূর্য ওঠে না, ডোবেও না। এটা আজকালকার ফাইভ-সিক্সের ছাত্র-ছাত্রীরাও জানে। ওরা এ সব জেনেছে বিজ্ঞানের বই থেকে। আর বিজ্ঞান জেনেছে যুক্তির পথ ধরে।

বস্তুময়তা এবং বাস্তব পরিবর্তনশীলতার ধারণা

ছাড়া যুক্তি দাঁড়ায় না। যুক্তিবাদ

আসলে বস্তুবাদ-ই ।

এক সময়ের কট্টর বস্তুবাদী মানুষটির কত দ্রুত পরিবর্তন হয়েছে, দেখে চমকালাম দুঃখিত হলাম। প্রাক্তন নকশাল নেতা উচ্চশিক্ষিত, লেখাপড়ায় ভালো। ন’য়ের দশকের এক্কেবারে গোড়ায় যুক্তিবাদী সমিতির কেন্দ্রীয় অফিসে এসে যুক্তিবাদের পক্ষে স্টাডি ক্লাশও পরিচালনা করেছিলেন। যুক্তিবাদের পক্ষে কত না কথার ফুলঝুরি জ্বালিয়েছিলেন সে’দিন। আর আজ কিনা লিখছেন—সূর্য ওঠে না, ডোবে না, বিজ্ঞানের এই সত্য যুক্তিবাদীরা মানেন না! কেন তাঁকে এমন অদ্ভুত কথা লিখতে হল? যুক্তিবাদীদের সম্বন্ধে এমন বোকা-বোকা ভাবনা তাঁর মত শিক্ষিতের তো থাকা উচিত নয়! তবু কেন এলো? প্রাক্তন বিপ্লবী আরও লিখলেন—সূর্য ওঠেও না, ডোবে না। অতএব যুক্তিবাদীরা মিথ্যেবাদী, প্রতিক্রিয়াশীল।

বুদ্ধের ক্ষণিকবাদের অণুবীক্ষণের তলায় বিপ্লবীটিকে ফেললে রহস্য পরিষ্কার হয়ে যায়। তিরিশ বছর আগের বিপ্লবী আর আজকের প্রতিবিপ্লবী মানুষটি এক নন। সময়ই তাঁকে পাল্টে দিয়েছে। তিনি এখন রাষ্ট্রের বুদ্ধিজীবীদের লাইনে আছেন। রাষ্ট্র চায়, তাই তিনি যুক্তিবাদের বিরুদ্ধে সরব।

‘ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি’ যত দিন শুধু বাবাজী-মাতাজীদের ‘ভাণ্ডাফোড়’ করছিল, ততদিন এ’সব খবর বাজারে বিক্রি করতে উদ্যোগী ছিল অনেক প্রচার মাধ্যম-ই। যখন রাষ্ট্র শক্তির মনে হল, ওরা গরিব মানুষগুলোর মাথায় চেতনার আগুন জ্বালাতে চাইছে, তখনই রাষ্ট্র নামলো যুক্তিবাদী সমিতির বিরুদ্ধে যুদ্ধে। যুদ্ধে জেতাটাই নীতি। রাষ্ট্র বিভিন্ন দিক থেকে এক সঙ্গে সাঁড়াশি আক্রমণ চালালো। এক দিকে রাষ্ট্রের অর্থানুকূল্যে ও বিদেশি অর্থে গজিয়ে উঠলো অনেক যুক্তিবাদী সংগঠন ও বিজ্ঞান ক্লাব।

যুক্তিবাদী সমিতি ও তার সহযোগী সংগঠন মানবতাবাদী সমিতিকে ভাঙতে

টোপ ফেলা হল নানা ধরনের। আর এক দিকে, দেশের মানুষ

যুক্তিবাদী আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা বলে যাঁকে

গ্রহণ করেছে, তাঁকে ঠেকাতে অতীত ও বর্তমানের

অনেককে ‘যুক্তিবাদী’ বলে

প্রচার শুরু হল।

আর এক দিকে কিছু বুদ্ধিজীবীদের দিয়ে অপপ্রচার শুরু হল—যুক্তিবাদ প্রতিক্রিয়াশীলদের মতবাদ ; যুক্তিবাদ মার্কসবাদ বিরোধী ; যুক্তিবাদ খ্রিস্টপূর্বেও ছিল; যুক্তিবাদ ও চার্বাকবাদ একই মতবাদ, যার শেষ পরিণতি ভোগবাদ।

আমরা প্রচার মাধ্যমগুলোর কল্যাণে জেনেছি তিন বিশিষ্ট বিজ্ঞানী যুক্তিবাদী ব্যক্তিত্বের জন্মশতবর্ষ পালনে সরকারি নানা উদ্যোগের খবর। এ’সবই কালের বিচারে সাম্প্রতিক ঘটনা। আমরা প্রচারের কল্যাণে জানলাম প্রশান্ত মহলানবিশ, সত্যেন্দ্রনাথ বসু এবং জে বি এস হ্যালডেন নিখাদ যুক্তিবাদী মানুষ ছিলেন। রাজ্য সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন বিজ্ঞান সংগঠন ও বিজ্ঞান পত্রিকা এঁদের জন্মদিন পালন করলেন।

তিন জনই স্ব-স্ব ক্ষেত্রে বিশাল প্রতিভার অধিকারী, এ’নিয়ে দ্বিমত নেই। তাঁদের প্রতিভার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে শতবর্ষ পালন—অভিনন্দনযোগ্য প্ৰচেষ্টা ; এ বিষয়েও দ্বিমত নেই। দ্বিমতটা অন্য জায়গায় ; ওঁদের তিনজনকে আদর্শ যুক্তিবাদী হিসেবে প্রচারে নামার বিরুদ্ধে। ওঁদের বিশাল কর্মকাণ্ডের সঙ্গে পরিচয় ঘটিয়ে দিলে আমজনতা শ্রদ্ধায় আপ্লুত হতেন। এর জন্য যুক্তিবাদী সাজাবার কোনও প্রয়োজন ছিল না। বরং উদ্যোক্তাদের মিথ্যাচারিতা তিন ব্যক্তিত্বকে অসম্মান-ই করেছে।

এমন প্রচারে নামার পিছনে আরও গভীর কোনও অভিসন্ধি থাকতে-ই পারে। রাষ্ট্র শক্তি চায়, সাধারণ মানুষ ‘যুক্তিবাদী’ বলতে সেইসব চরিত্রকে আদর্শ বলে গ্রহণ করুক, যাঁরা যুক্তিতেও আছেন, আবার ঈশ্বর, নিয়তিবাদ, অলৌকিক বিশ্বাসেও আছেন। বিবেকানন্দকে যুক্তিবাদী বানাবার চেষ্টা এই ষড়যন্ত্রেরই ফল। উদ্দেশ্য, জনগণকে বোকা বানিয়ে আসল যুক্তিবাদীদের আগ্রাসন রোখা।

প্রশান্ত মহলানবিশ ‘নিষ্ঠাবান’ ব্রাহ্ম। ব্রহ্ম বা পরমপিতায় বিশ্বাসী। ব্রাহ্মধর্ম প্রেতচর্চা ও প্ল্যানচেটে বিশ্বাসী না হলেও প্রশান্ত মহালানবিশ এ’সবে বিশ্বাসী ছিলেন, জীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের লেখা রবীন্দ্র-জীবনী গ্রন্থ আগ্রহী পাঠক- পাঠিকারা নেড়ে চেড়ে দেখতে পারেন।

সত্যেন্দ্রনাথ বসু ঈশ্বরে ও অলৌকিকত্বে পরম বিশ্বাসী ছিলেন। অনেক অলৌকিকবাবাদের চরণে মাথা ঠেকাতে তিনি যেতেন। সে’সব তাঁর ছাত্র-ছাত্রী বহু বিজ্ঞানীদেরই অজানা নয়। কিছু কিছু অলৌকিকবাবারা সত্যেন্দ্রনাথ বসুর ভক্তি-গদগদ সার্টিফিকেট ও ছবি নিজেদের প্রচারমূলক বইতে ছেপে থাকেন।

জে বি এস হ্যালডেন সম্পর্কে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে যা বলা হয় তা হল—“হ্যালডেন শুধুমাত্র একজন বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী ছিলেন না, ছিলেন মার্কসীয় দর্শনে বিশ্বাসী সামাজিক দায়বদ্ধ এক মহান পুরুষ। সমাজতন্ত্রের প্রতি আমরণ তাঁর আস্থা ছিল।” …..একদিকে বিজ্ঞানের গবেষণা অন্যদিকে সাধারণ মানুষের কাছে বিজ্ঞানের শিক্ষাকে পৌঁছে দেওয়া, এই ছিল তাঁর আদর্শ।” (কথাগুলো হ্যালডেনের “The Inequality of Man and Other Essays” নামের প্রবন্ধ সংকলন থেকে নির্বাচিত প্রবন্ধের বাংলা অনুবাদ মানুষের বিভিন্নতা’য় প্রকাশিত প্রকাশকের নিবেদন’-এর অংশ বিশেষ) যে কলম থেকে উৎসারিত হ্যালডেনের সমাজতন্ত্রের প্রতি আমরণ আস্থার কথা, সেই কলমই কিন্তু হ্যালডেনের ই এস পি ও টেলিপ্যাথি বিশ্বাসে আমরণ আস্থা বিষয়ে নীরব থাকে। হ্যালডেনের নিজের কথায়, “আমি বুঝি না যে একজন দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী কেন পূর্বসিদ্ধভাবে টেলিপ্যাথি বা অলৌকিক দৃষ্টির ঘটনা বলে যা দাবি করা হয় সেগুলির সম্ভাবনা অস্বীকার করবেন।” (The Marxist Philisophy and the Sciences গ্রন্থের বাংলা অনুবাদ ‘বিজ্ঞান ও মার্কসীয়দর্শন’; জে বি এস হ্যালডেন। প্রকাশক চিরায়ত প্রকাশন, ১৯৯০; পৃষ্ঠা ১০৭)

অর্থাৎ হ্যালডেন টেলিপ্যাথিসহ বিভিন্ন অতীন্দ্রিয় ব্যাপার-স্যাপার বস্তুবাদীরা না মানায় যথেষ্টই বিস্মিত এবং কিছুটা ক্ষুব্ধও। তাঁর মতে এ’সব বেশির ভাগ ক্ষেত্রে প্রতারণা হতে পারে, কিন্তু সমস্ত ক্ষেত্রে অবশ্যই নয়। কী সর্বনাশ! হ্যালডেন একই সঙ্গে মার্কসবাদে ও অতীন্দ্রিয়বাদে বিশ্বাস রেখেছিলেন।

হ্যালডেনকে যখন বিভিন্ন মহল থেকে ‘বস্তুবাদী’ বলে প্রচার করা হচ্ছে, তখন হ্যালডেনের নিজের লেখায় আমরা পাচ্ছি, “আমি নিজে বস্তুবাদী নই, কারণ বস্তুবাদ যদি সত্য হয় তাহলে আমার ধারণা আমরা জানতে পারি না যে সেটা সত্যি। আমার মতামতগুলি যদি আমার মস্তিষ্কের মধ্যে চলতে থাকা রাসায়নিক ক্রিয়ার ফলে হয়, তাহলে সেগুলি নির্ধারিত হয় রসায়নের নিয়মে, যুক্তিশাস্ত্রের নিয়মে নয়।” (মানুষের বিভিন্নতা, হ্যালডেন, পৃষ্ঠা-৬৮) এর পরেও হ্যালডেনকে বস্তুবাদী মহান মার্কসবাদী বলে ‘প্রজেক্ট’ করা কি নীতিগর্হিত নয়? মিথ্যাচারিতা নয়? উদ্দেশ্যমূলকভাবে বস্তুবাদের সঙ্গে অধ্যাত্মবাদের মেলবন্ধনকে প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াস নয়?

 

চার্বাক থেকে দেকার্ত এবং যুক্তিবাদ

বুদ্ধ, মহাবীর, চার্বাক, স্পিনোজা, কান্ট, হেগেল, দেকার্ত, ভলতেয়ার, কভুর, ডিরোজিও, আরাজ আলী মাতুব্বর প্রমুখ যুক্তিবাদী মানুষ যুক্তিবাদী আন্দোলনকে বর্তমান অবস্থায় পৌঁছে দিতে সাহায্য করেছেন। কালের সীমাবদ্ধতা পেরিয়ে তাঁরা যা করেছেন, তাতে যুক্তিবাদী আন্দোলনের একজন কর্মী হিসেবে শ্রদ্ধায় আমার মাথা নত হয়।

পূর্বসূরিদের চিন্তা-ভাবনা অভিজ্ঞতাই আমাদের যুক্তিবোধ ও জ্ঞানকে আরও এগিয়ে যেতে সাহায্য করে। এই এগিয়ে যাওয়ায় পূর্বসূরি চিন্তাবিদ থেকে বিজ্ঞানী কেউ-ই ছোট হন না। প্রাচীনের অবদান শ্রদ্ধা বা স্বীকৃতি হারায় না। এই বইটি শুরু থেকে যাঁরা পড়ে এখানে এলেন, তাঁরা এই ভাবধারার স্পষ্ট প্রতিফলন দেখতে পেয়েছেন।

গত শতকের ন’য়ের দশকে এসে আমরা হঠাৎ-ই দেখলাম কিছু বুদ্ধিজীবীদের ‘যুক্তিবাদ’ নিয়ে লেখা। লেখাগুলোয় তাঁরা একটা ছাপ মানুষের মনে ফেলতে চাইছেন যে, চার্বাক, দেকার্ত, স্পিনোজা, হেগেল, কান্ট ইত্যাদি মানুষগুলো বর্তমান যুক্তিবাদীদের আদর্শ চরিত্র হওয়ার যোগ্য। যুক্তিবাদের এই পূর্বসূরিরা কালের সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে আজও অনুসরণীয়।

দেকার্ত ঈশ্বরের ও আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাসী ছিলেন। স্পিনোজার

দর্শনও ছিল ঈশ্বরের অস্তিত্বকে সঙ্গী করেই। লিবনিজ তাঁর

দর্শনে সমর্থন জানিয়ে ছিলেন ঈশ্বর ও আত্মা বিষয়ক

ধর্মীয় মতবাদকে। কান্ট ঈশ্বর ও আত্মার সঙ্গে

অতীন্দ্রিয় ব্যাপার-স্যাপারে বিশ্বাসী ছিলেন।

এঁদের যাঁরা ‘আধুনিক যুক্তিবাদীদের’ অনুকরণযোগ্য বলে ঘোষণা করেছেন, তাঁরা কি না জেনে-বুঝেই এসব কথা বলেছেন? নাকি অন্য পরিকল্পনা আছে মাথায় ? ঈশ্বরে ও যুক্তিতে অবস্থানকারী হাঁসজারু-মার্কা ‘যুক্তিবাদী’ গড়ার পরিকল্পনা ?

যুক্তিহীন আধ্যাত্মবাদী চিন্তাকে বাতিল করার ঝাঁঝ চার্বাকবাদে যতখানি উপস্থিত, ততখানি অনুপস্থিত ভবিষ্যৎমুখী মানবতাবাদী সমাজ সচেতনাবোধ। চার্বাক দর্শনে আর্থ-সামাজিক কাঠামোর পরিবর্তন ঘটিয়ে সাম্যের সমাজ গড়ার কোনও চিন্তা ছিল না। চার্বাকবাদীরাও ছিল সেই সময়কার রাজতন্ত্রকেন্দ্রিক শোষণ কাঠামোর সমর্থক। আমাদেরই ঠিক করতে হবে, আমরা সেই চার্বাক নিয়েই চর্বিত চর্বণ করবো, না কি আরও যুগোপযোগিতার সঙ্গে এগিয়ে নিয়ে যাবো যুক্তিবাদকে ।

ডিরোজিও যৌবনে পা দিয়েই ঝরে যাওয়া একটা জীবন। এরই মধ্যে তিনি ভারতীয় সমাজের স্থূল কুসংস্কার মুক্তির জন্য অনেক কাজ করেছেন। তাঁরই জনা কুড়ি ছাত্র ডিরোজিওর আদর্শে অনুপ্রাণীত হয়েছেন। হিন্দু ধর্মে নিষিদ্ধ খাবার খেয়েছেন, কালী ঠাকুরকে নিয়ে ছড়া কেটেছেন। ডিরোজিওর যুক্তিবাদী চিন্তা শুধুমাত্র কিছু কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সীমাবদ্ধ ছিল। ডিরোজিওর ‘যুক্তিবাদ’ কখনই বিশ্ব-নিরীক্ষণ পদ্ধতি বা জীবন দর্শন হয়ে ওঠেনি। ডিরোজিওর যুক্তিবাদ দিয়ে সৌন্দর্যবোধ থেকে নীতিবোধ ইত্যাদি বাস্তব বিষয়গুলোর ব্যাখ্যা সম্ভব ছিল না। ডিরোজিয়ানপন্থী ধনীর সন্তানদের অনেকেই ডিরোজিওর কুসংস্কার মুক্তির চিন্তাকে আত্মস্থ করতে পারেননি; তাই তাঁরা, পরবর্তীকালে খ্রিস্টান হয়েছিলেন, কেউ প্ল্যানচেটের আসর বসাতেন।

ডিরোজিওর কুসংস্কার মুক্তির চেষ্টাকে যে কারণে আমরা যুক্তিবাদী দর্শন বা বিশ্বের বিভিন্ন বিষয়কে দেখার ও বিশ্লেষণের পদ্ধতি মনে করি না, সেই একই কারণে কোভুরের যুক্তিবাদকে আমরা কোনও ভাবেই ‘যুক্তিবাদী দর্শন’ বলতে পারি না। কোভুর কুসংস্কার মুক্তির জন্য চেষ্টা করেছেন। তার জন্য তাঁকে আমরা অবশ্যই শ্রদ্ধা জানাই ।

এ’দেশের বুদ্ধিজীবীরা যাঁদের ‘যুক্তিবাদী’ দর্শনের পথিকৃৎ বলে প্রচারে নামলেন, তাঁরা কেউ-ই পথিকৃৎ নন। বরং তাঁরা যুক্তিবাদের ‘দর্শন’ চরিত্রটিকে ধরতেই পারেননি। তাঁদের লেখায় এ’কথা বেরিয়ে আসেনি যে,

‘যুক্তিবাদ’ একটি স্ববিরোধীতাহীন বিশ্ব-নিরীক্ষণ পদ্ধতি। যুক্তিবাদের সাহায্যে

আমরা ব্যাখ্যা করতে পারি সৌন্দর্যবোধ, দেশপ্রেম, জাতীয়তাবাদ,

বিচ্ছিন্নতাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, মূল্যবোধ, নারী-পুরুষের

প্রণয় সম্পর্ক ইত্যাদি বাস্তব বিভিন্ন বিষয় ।

কিছু সমাজ সচেতন, রাজনীতি সচেতন মানুষ মনে করেন, ‘সমকালীন যুক্তিবাদী দর্শন’ এবং তার স্রষ্টার উত্থান ঠেকাতেই রাষ্ট্র লড়াইতে নামিয়েছে তার সহযোগী শক্তিদের। বার বার একই মিথ্যে প্রচার করে মিথ্যেকেই ‘সত্যি’ বানাতে চাইছে। এই মিথ্যে প্রচারের বিরুদ্ধে উপযুক্ত জবাব দিতে লিফলেট, পুস্তিকা ইত্যাদি নিয়ে পাল্টা প্রচারে নেমেছে এ’দেশের ও বাংলাদেশের যুক্তিবাদীরা। ওরা মনে করে ‘আধুনিক যুক্তিবাদ দর্শন’-এর স্রষ্টা কোনও দেশের একান্ত সম্পত্তি নন। তাঁর উপর যে পরিকল্পিত লাগাতার আক্রমণ চালানো হচ্ছে তা পৃথিবীর তামাম যুক্তিবাদী দর্শনে আস্থাশীলদের ওপর আক্রমণ। যুক্তিবাদের ওপর আক্রমণ।

গত শতকের ন’য়ের দশক থেকে একটা বিষয় অনেকেরই নজরে পড়েছে। ‘সমকালীন যুক্তিবাদী’ দর্শনের স্রষ্টার ওপর সর্বাত্মক আক্রমণের পাশাপাশি দু-তিনজন ব্যক্তিকে ‘একালের বিশিষ্ট যুক্তিবাদী’ বলে তুলে ধরার চেষ্টা হচ্ছে। এঁদের একজন একটি রাজনৈতিক দলের বিজ্ঞান সংগঠনের সভাপতি ও পাড়ার দুর্গোপুজো কমিটিরও সভাপতি। আর একজন কুসংস্কারের বিরুদ্ধে বই-পত্তর লেখেন, পুজো ও শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানে অংশ নেন। ভাববাদী বই’কে প্রশংসা করে সার্টিফিকেট দেন। তৃতীয় জন গ্রহরত্নের আংটি পড়েন, পুজো করেন, কুসংস্করের বিরুদ্ধে বই লেখেন। বইয়ের উদ্বোধন করেন কালী মন্দিরে পুজো দিয়ে। ‘দামি যুক্তিবাদী’, তাই পুজো দিয়ে বই উদ্বোধনের খবরও ছাপা হয় খবরের কাগজে

এর বিষময় ফল ইতিমধ্যেই প্রকট হয়ে উঠেছে। সাচ্চা যুক্তিবাদীদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ঝুটা যুক্তিবাদীদের সংখ্যা। আজ এমন যুক্তিবাদী সংস্থা বা বিজ্ঞান ক্লাবের সংখ্যা কম নয়, যাদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাগা তাবিজধারী কুসংস্কারের আচ্ছন্ন মানুষগুলো। এঁরা ‘যুক্তিবাদ দর্শন’ বিষয়টা নিয়ে তত্ত্বগতভাবে কিছুই জানেন না। জানার প্রয়োজনও বোধ করেন না। এঁদের কাছে যুক্তিবাদ শুধুই একটা ফ্যাসান। প্রগতিশীল সাজার ফ্যাসান।

উদ্ভিদ ও প্রাণী জগতের বিবর্তনের মত বিবর্তন ঘটে চলেছে আরও অনেক ক্ষেত্রেই। যেমন উপাসনা-ধর্মের বিবর্তন, বিজ্ঞানের বিবর্তন, দর্শনের বিবর্তন।

দর্শনের বিবর্তনের একটা ইতিহাস আছে। যুক্তিবাদী দর্শনের উত্তরণ বা বিবর্তনেরও একটা ইতিহাস আছে। সেই আদিম যুগে বেঁচে থাকার তাগিদে, শিকারের তাগিদে আমরা গাছের ডালের মুখ ঘসে ছুঁচলো করে হাতিয়ার করেছি। পাথর ঘষে ধারালো অস্ত্রের চেহারা দিয়েছি। আগুনের ব্যবহার শিখেছি। চাকা তৈরি করতে শিখেছি।

সৈন্য ও সম্পদ গণনার তাগিদে সৃষ্টি হল পাটিগণিতের। জমি মাপ-জোকের প্রয়োজনে এলো জ্যামিতি। শস্য উৎপাদনের স্বার্থে ঋতু পরিবর্তনের হিসেব রাখতে গিয়ে সৃষ্টি হল জ্যোতির্বিজ্ঞানের। যুক্তি-গণিত-বিজ্ঞান সবই আমাদের বেঁচে থাকার লড়াইয়ের অঙ্গ। আমাদের যুক্তি-বুদ্ধির বিবর্তনের ইতিহাস। এমনি করেই মানুষের যুক্তি-বুদ্ধির কয়েক হাজার বছরের বিবর্তন আমাদের পৌঁছে দিয়েছে মহাকাশ ও কম্পিউটারের যুগে। এই বিবর্তন শুধু প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের বেলায় ঘটেনি। ঘটেছে খেলা, শিল্প, সাহিত্য, সংগীত, নাটক, নৃত্য, সিনেমা, চিন্তায়, দর্শনে। ‘সমকালীন যুক্তিবাদ’ দর্শনেরই এক চূড়ান্ত বিবর্তিত রূপ।

‘তর্কবিদ্যা’ ও ‘যুক্তিবাদ’ এক নয়

তর্কবিদ্যা অর্থাৎ ন্যায় দর্শনের সঙ্গে সমকালীন যুক্তিবাদী দর্শনের একটা বড় রকমের পার্থক্য রয়েছে। ভারতীয় ভাববাদীরা বেদ ও বিভিন্ন ধর্মশাস্ত্রকে অভ্রান্ত, স্বতঃপ্রমাণ ধরে নিয়ে তারপর বেদ ও ধর্মশাস্ত্রের নানা বক্তব্য নিয়ে নিজেদের মত করে টীকা বা ব্যাখ্যা হাজির করেন। বিভিন্ন ব্যাখ্যাকারদের মধ্যে মত পার্থক্য থাকে। সেই পার্থক্যের কারণে ব্যাখ্যাকারদের মধ্যে যুক্তি-তর্কের লড়াই চলে। বেদ ও ধর্মশাস্ত্রকে অভ্রান্ত ধরে নিয়ে বিভিন্ন ব্যাখ্যাকার বা টীকাকারদের এই তর্ককেই, ‘তর্কবিদ্যা’ হিসেবে ভারতীয় দর্শনের ইতিহাসে প্রধান গৌরবের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ‘তর্কবিদ্যা’ কখনই ‘যুক্তিবাদ’ হয়ে ওঠেনি। কারণ, প্রথমেই ধর্মশাস্ত্র বা বৈদিক সাহিত্যকে অভ্রান্ত ধরে নেওয়ার পিছনে কোনও যুক্তি নেই।

 

পাশ্চাত্যের (Rationalism ও New Rationalism) যুক্তিবাদ ও নব্য-যুক্তিবাদ

পাশ্চাত্যে যুক্তিবাদের চর্চার একটা ইতিহাস আছে। লক, কান্ট, হিউম প্রভুখ চিন্তাবিদরা যুক্তিবাদ বা Rationalism তত্ত্বের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

এই যুক্তিবাদের মূল বক্তব্য ছিল—জ্ঞান মাত্রেই reason বা যুক্তি-বুদ্ধি থেকে আসে। ইন্দ্রিয় অনুভূতি থেকে আমরা যা জানতে পারি, বুঝতে পারি, তাতে ভুল থাকতে পারে। কারণ ইন্দ্রিয় প্রতারিত হতে পারে। ফলে আমরা ইন্দ্রিয় থেকে যা পাই, তাকে ‘জ্ঞান’ না বলে ‘মতামত’ বলাটাই ঠিক হবে।

প্রাচীন এই যুক্তিবাদীদের মধ্যে অনেকেই বিশ্বাস করতেন, মানুষ কিছু সহজাত ধারণা নিয়ে জন্মায়। এই সহজাত ধারণাগুলো কখনই মিথ্যে হতে পারে না। সম্ভবত ঈশ্বর মানুষ সৃষ্টির সময় এই ধারণাগুলো মানুষের মনে ঢুকিয়ে দেন।

এইসব যুক্তিবাদীরা যুক্তিকে অনেকটাই এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন, এ বিষয়ে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই। কিন্তু কালবদ্ধতার কারণে, অর্থাৎ সেই সময়কার সাংস্কৃতিক পরিবেশের প্রভাবে ঈশ্বরে বিশ্বাস, আত্মায় বিশ্বাস ইত্যাদি কিছু বিশ্বাসের ঊর্ধ্বে তাঁরা উঠতে পারেননি। আমরা বলতে পারি তাঁরা হলেন ‘ঈশ্বরবাদী যুক্তিবাদী’। অর্থাৎ বেদজ্ঞ পণ্ডিতদের মতই তাঁরাও আগেই ঈশ্বর আছেন, ধরে নিতেন।

পশ্চিমি দেশগুলোতে ‘New Rationalism’ বা ‘নব্য যুক্তিবাদ’ বলে একটি মতবাদের আবির্ভাব হয়েছে। এই ‘নব্য যুক্তিবাদ’ অন্যান্য দেশেও ইতিমধ্যে প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করেছে।

নব্য যুক্তিবাদের মতে ‘মন’ হল প্রকৃতির-ই উৎপন্ন ফল (product), প্রকৃতির সঙ্গে বেড়ে ওঠে। প্রকৃতি যে’হেতু তার নিজস্ব নিয়মে চলে, তেমন-ই মানুষের মনও প্রকৃতিগত যুক্তি-বুদ্ধির দ্বারা পরিচালিত হয়। সোজা কথায়—মন যুক্তির দ্বারা পরিচালিত হয়। প্রকৃতির বিশালতার অংশ মাত্র আমাদের মন ধরতে পারে। যেটুকু ধরতে পারে, তাকে যুক্তি-বুদ্ধি দ্বারা বিচার করে গ্রহণ করলে ভুল হওয়া উচিত নয় ৷

আমাদের গাণিতিক (Mathematical) ও তর্কশাস্ত্র (logical) বিষয়ক আলোচনা থেকে যে সব সত্য উঠে আসে তা জগতের বস্তুগত নিয়মশৃঙ্খলার সঙ্গে জড়িত। এর সঙ্গে অপার্থিব কোনও কিছুর সম্পর্ক নেই ।

আমাদের জ্ঞান ইন্দ্রিয় থেকে আসে না। আসে অভিজ্ঞতা থেকে। সেই অভিজ্ঞতা নিজের হতে পারে আর পূর্বসূরিদের থেকে পাওয়া—এমনও হতে পারে।

এই বক্তব্যের সঙ্গে আমরা একমত হতে পারছি না। ইন্দ্রিয়গুলো না থাকলে আমরা নিজের বা পূর্বসূরিদের অভিজ্ঞতা গ্রহণ করতাম কী করে? আর পূর্বসূরিরা-ই বা অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে মাথায় রাখতেন কী ভাবে? মাথায় আসে না!

ইন্দ্রিয় আমাদের যেমন মাঝে-মধ্যে ভুল দেখায়, ভুল শোনায়, ভুল বোঝায়, তেমন-ই ঠিক-ঠাক জ্ঞানের ক্ষেত্রে ইন্দ্রিয়ের অবদানকে কোনও অবস্থাতেই অস্বীকার করতে পারি না। ইন্দ্রিয় যে মাঝে-মধ্যে ভুল বোঝায়, এবং এই ভুল বোঝার পিছনেও যে কার্য-কারণ সম্পর্ক আছে—তা আমরা বুঝতে পারি ইন্দ্রিয়ের সাহায্যেই।

নব্য যুক্তিবাদের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা জেমস হার্ভে রবিনসন (James Harvey Robinson)-এর মতে, ‘নব্য যুক্তিবাদ’ মনে করে জ্ঞানের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা সৃজনশীল চিন্তার (creative thought) ।

অনেকেই যুক্তির সঙ্গে পরিচিত হবার সুযোগ পাননি—তাই যুক্তিহীন।

আবার যুক্তির সঙ্গে পরিচয় ঘটিয়ে দিলেই যে সবাই যুক্তিবাদী

হয়ে উঠবেন—এমনটা নয়। কারণ যুক্তিবাদী হয়ে উঠতে গেলে

যুক্তির সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পাওয়া যেমন জরুরি,

তেমনই জরুরি সৃজনশীল চিন্তার অধিকারী

হওয়ার। দু’য়ের মেলবন্ধনে একজন

যুক্তিবাদী হয়ে ওঠে।

এত কিছুর পরও ‘নব্য যুক্তিবাদ’ শেষ পর্যন্ত একটা মতবাদ হয়ে রইলো । বিশ্বের

সমস্ত কিছুকে দেখার ও বিশ্লেষণ করার দর্শন হয়ে উঠল না।

error: Content is protected !!