অজয় রায়
ইহজাগতিকতা কি?

বাংলা ভাষায় ইহজাগতিকতা একটি চমৎকার শব্দ । আমরা সেক্যুলারিজম শব্দটির বাংলা নিয়ে বিস্তর মাথা ঘামাই। আমার মনে হয় ইহজাগতিকতা শুধু সেক্যুলারিজমকে ধারণ করে না, এর ব্যাপ্তি অনেক ব্যাপক । যে দার্শনিক মতবাদ বস্তুবাদী দৃশ্যমান জগৎ ছাড়া অন্য কোন আধিভৌতিক জগতের (metaphysical world) অস্তিত্বে বিশ্বাস করে না ভারতীয় দর্শনে এই মতবাদকে বলা হয়ে থাকে ইহজাগতিকতা । ইহজাগতিকতার মূল ভিত্তি হল বস্তুতন্ত্রবাদ বা ম্যাটিরিয়ালিজম (materialism) । ইহজগতের অর্থ হল এই জগৎ অর্থাৎ যে দৃশ্যমান জগতে অর্থাৎ পৃথিবী ও চতুষ্পার্শ্ব নিয়ে যে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে আমরা বসবাস করছি । ইংরেজিতে যাকে বলা হয় ‘mortal world’ অর্থাৎ মরজগৎ বা মতজগৎ । ইহজাগতিকতা মতবাদ গড়ে উঠেছিল দার্শনিক কপিলের ‘সাংখ্য দর্শন’, চার্বাকের ‘লোকায়াত দর্শন’ ধীষণের ‘নাস্তিকতাবাদ’, সঞ্জয় বেলথিপুত্তের ‘অজ্ঞেয়বাদ’ (agnosticism) ও ন্যায় শাস্ত্রের ‘হেতুবাদ’কে (rationalism) আশ্রয় করে । আমরা এসব প্রসঙ্গে পরে ফিরে আসব ।

অন্যদিকে ভাববাদী দার্শনিকেরা মনে করেন ‘লোক’ (world) দুই ধরনের । যে মর্তলোকে আমরা বসবাস করছি নির্দিষ্ট সময়ে তা হল ‘ইহলোক’, এবং ইহকাল শেষে আমরা ফিরে যাব অন্য এক জগতে যার নাম ‘পরলোক’ । হিন্দু পুরাণকারেরা একে নানা শব্দে অভিহিত করেছেন যেমন ব্রহ্মলোক, অমরলোক, অমর্তলোক বা স্বর্গ-নরক; বাইবেলে একে বলা হয়েছে ‘হেভেন ও হেল’ আর কোরান শরীফে ‘বেহেস্ত ও দোজখ’ । জীবিত অবস্থায় সেখানে যাওয়া যায় না, যদিও মহাভারতে বলা হয়েছে যে ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির সশরীরে স্বর্গে গিয়েছিলেন— স্বয়ং ধর্মরাজ তাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন কুকুরের ছদ্মবেশে। কিন্তু এসবই মিথোলজি বা রূপকথা । বাস্তব জীবনে এটি ঘটে না। মৃত্যুতেই আমাদের ইহজীবনের সমাপ্তি । ওপার থেকে এসে কেউ আমাদের বলেনি পরলোক কোথায় এবং সেখানে তিনি শরীর ছাড়া কি ভাবে রয়েছেন এবং কতটা সুখে শান্তিতে ।

শুধু দার্শনিক মতবাদ হিসেবে নয় ইহজাগতিকার ধারণা অনেক বেশি ব্যাপ্ত । ইহজাগতিকতার সাথে জড়িয়ে রয়েছে ধর্মবিরুদ্ধ হলেও ‘ধর্মঅনপেক্ষ বা ধর্মপ্রভাবহীন’ সমাজের কথা, লোকায়ত রাষ্ট্র ব্যবস্থা, মানবিকতা, বহুমাত্রিকতা ও বৈচিত্রময়তার ধারণার কথা । এক কথায় আধুনিকতা বলতে যা বুঝি তার সামষ্টিক ধারণা বহমান এই ইহজাগতিকতার শব্দটির মধ্য দিয়ে ।

কিন্তু আধুনিকতা বলতে আমরা কি বুঝব? আধুনিকতা শব্দ দিয়ে আমরা অনেক কিছু বোঝাতে চাইলেও এক ধরনের অস্পষ্টতা থেকে যায় । আমরা একজন আধুনিক মানুষ বলতে কাকে বোঝাব? বিজ্ঞানের চিন্তা চেতনা ও আবিষ্কারের সাথে যিনি পরিচিত, যুক্তি-তথ্য ও প্রমাণের ভিত্তিতে যিনি বৈজ্ঞানিক পন্থায় সমস্যা সমাধানে অগ্রসর হন, অর্থাৎ যিনি বিজ্ঞানমনস্ক, মুক্তবুদ্ধি চর্চায় নিবেদিত প্রাণ মুক্তমনের অধিকারী এবং যুক্তিবাদী, তাকেই তো আমরা বলতে পারি ‘আধুনিক মানুষ’ । এই প্রবন্ধের নিরিখে আধুনিকতা বলতে আমরা বুঝব কোন বিশ্বাস নয়, প্রতিটি ঘটনার পশ্চাতে রয়েছে বিশে-ষণধর্মী ব্যাখ্যা, যা যুক্তি ও তথ্য দ্বারা প্রতিষ্ঠিত, কোন আধিভৌতিক সত্তা বা আলৌকিক কোন বিষয় নয়; আধুনিকতার মূলে রয়েছে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ভিত্তিক তথ্য ও প্রমাণ যার ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে অনুসন্ধিৎসু মুক্ত মন ও স্বাধীন চিন্তা; তথ্য-প্রমাণ-যুক্তির পথ ধরে বৈজ্ঞানিক, সামাজিক, সামষ্টিক বা ব্যষ্টিক সমস্যার সমাধান খুঁজে পাওয়ার বিশে-ষণী পথকেই বলা হয় বৈজ্ঞানিক বা আধুনিক পথ । আধুনিকতার আর একটি লক্ষণ হল সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া, তবে ইতিহাস-ঐতিহ্য-কৃষ্টিকে অস্বীকার করে নয়, পেছনের দিকে অতিতাশ্রয়ী হওয়া নয় । ইতিহাসের ভুল থেকে আমরা শিক্ষা নেব, ঐতিহ্য থেকে অনুপ্রেরণা পাব এবং কৃষ্টি আর সংস্কৃতিকে নতুন থেকে নতুনতর করে নির্মাণ করার সতত প্রয়াস পাব, কারণ জীবন চলমান- আর জীবন চর্চারই অপর নাম সংস্কৃতি । একেই আমরা বলব আধুনিকতা । মানবতাবাদ অর্থাৎ ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’ এই নীতিবোধই হল আধুনিকতা, এবং মানুষের অনন্ত সম্ভাবনাকে পরিপূর্ণভাবে এই জগতেই বিকাশ করার লক্ষ্যই হল ইহজাগতিকতা, অন্য কোন জগতের জন্য উপযোগী করে তোলা নয়। মানুষের স্বাধীনতা ও সার্বজনীন অধিকার চেতনায় বিশ্বাসী মানুষকেই আমরা বলব আধুনিক মানুষ ৷

প্রশ্ন হল একজন ধর্মভীরু মানুষ কি ইহজাগতিক বা আধুনিক হতে পারেন?

আমাদের বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে প্রশ্নটির প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে, কারণ আপ্তবাক্যের মত আমাদের বলা হয় বাংলাদেশের মানুষ ধর্মভীরু ধর্মাচারী ও ধর্মনিষ্ঠ । এ প্রশ্নের উত্তর অনেকাংশে নির্ভর করবে এই শব্দগুলো দিয়ে ঠিক আমরা কি বুঝাতে চাই । সাধারণভাবে যে ব্যক্তি পরলোকে বিশ্বাসী ও ধর্মচর্চা ও ধর্মকর্মে এবং ধর্মীয় আচার আচরণে নিষ্ঠাবান আমরা তাকেই সাধারণত বলে থাকি ‘ধর্মাচারী ও ধর্মনিষ্ঠ’ । ধর্মভীরু শব্দটির সাথে জড়িয়ে রয়েছে একধরনের ভয় ও ভীরুতা ধর্ম সম্পর্কে । ধর্মাচার থেকে স্খলনজনিত পাপ বোধ থেকেই এই ভয়ের জন্ম, আর এ ধরনের মানুষকেই আমরা বলে থাকি ধর্মভীরু । বস্তুত আমরা সাধারণ মানুষেরা ধর্মকে ভালবাসার চাইতে একে ভয় পাই- কারণ ধর্মচ্যুতি ঘটলে আমরা পতিত হব নরকে বা দোজখে । আমাদের ধর্মাচরণের পশ্চাতে যতটা না রয়েছে ঈশ্বর প্রীতি তার চাইতে অনেক বেশি রয়েছে ঈশ্বর ভীতি, কারণ তিনি রুষ্ট হলে নরকে পতন ও দোজখের আগুনে দহন অবধারিত । সে অর্থে সাধারণ মানুষ যতটা ধর্মাচারী ও ধর্মনিষ্ঠ তার চাইতে অনেক বেশি ধর্মভীরু । আমাদের আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ধর্মভীরু মানুষ ইহজাগতিক হতে পারে না। হওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু আমাদের জনগণ কি সত্যিই ধর্মভীরু যে অর্থে তাদের বলা হয়? আমার তো মনে হয় জনগণকে ধর্মবাদীরা তাদের প্রচারের মাধ্যমে ধর্মভীরু বানিয়েছেন ।

আমাদের জনগণের একটি বৈশিষ্ট্য হল তারা বাহ্যিকভাবে যত ধর্মাচারই করুক না কেন, তাদের দর্শনের মূল ভিত্তিটা কিন্তু মানবতাবোধ বা মানুষের প্রতি ভালবাসা । আর একটি বৈশিষ্ট্য হল বাঙালি যে ধর্মের অনুসারীই হোক না কেন, সে তার লোকজ ঐতিহ্য ও বিশ্বাসকে পরিত্যাগ করেনি, বা করতে চায়নি । আর আমাদের সংস্কৃতির উৎস ও অনুপ্রেরণা কিন্তু সেখানেই প্রোথিত । তাই সাঁওতালী নৃত্য, বেদে নৃত্য, মণিপুরী নৃত্য ও গীত আমাদের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, বিয়েতে গায়ে হলুদ, পান চিনি অনুষ্ঠান, বিয়ে ও অন্যান্য সামাজিক অনুষ্ঠানে মেয়েলী গীত, নবান্ন, পৌষমাষে পীঠে পার্বণ, নববর্ষপালন, এমনকি নানা অনুষ্ঠানে নানা রঙে আলপনার ঢঙে মেঝেতে চিত্রাঙ্কন প্রভৃতি অনুষ্ঠান- তাত্ত্বিক ইসলাম ধর্ম অনুমোদিত না হলেও, বাঙালি মুসলমান তা পালন করে আনন্দের সাথে । এবং সমাজ জীবনের সাথে ওতোপ্রোতোভাবে সংশি-ষ্ট। এসব আচার আচরণে হিন্দু বাঙালি ও মুসমান বাঙালি জীবনে তেমন পার্থক্য নেই, কারণ এসব অনুষ্ঠান একই উৎস থেকে ক্ষরিত— আমাদের ফেলে আসা লোকজ জীবন, সংস্কৃতি ও আচার আচরণ। ওহাবী ইসলামে ‘মিলাদ’ উৎসবের কোন সুযোগ নেই, কিন্তু বাংলার মুসলমান হিন্দুদের শ্রীকৃষ্ণের জন্মাষ্টমীর অনুকরণে ‘মিলাদ’কে আত্মীকরণ করেছে। ইংরেজ আমলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে সম্প্রদায় নির্বিশেষে ছাত্ররা একদিকে যেমন বীণাপাণির আরাধনা করেছে, ঠিক তেমনি মুহম্মদকে স্মরণ করেছে ও শ্রদ্ধা নিবেদন করেছে মিলাদ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে ।

আমাদের জনগণের ধর্মচেতনার আর একটি বৈশিষ্ট্য এদের চেতনায় নম্যতা (flexibility)।

তাই দেখা যায় রাজা বা শাসকের ধর্মবিশ্বাসের সাথে জনগণের ধর্ম পরিবর্তন ও নতুন ধর্মগ্রহণ । পাল রাজাদের আমলে জনগণ মূলত ছিল তথাগতের অনুসারী, যদিও হিন্দুর সংখ্যা ছিল তাৎপর্যময়, আবার সনাতনপন্থী সেন রাজারা ক্ষমতায় এলে, সারাদেশ হিন্দুধর্মে প্রত্যাবর্তন করতে সময় নেয়নি । যখন ১২০২-৩ সালে বখতিয়ার খিলজি’র আক্রমণের মধ্য দিয়ে মুসলিম শাসনকর্তারা বাংলার ক্ষমতায় এল, কিছুদিনের মধ্যে বাঙালি জনসংখ্যার সিংহভাগ ইসলাম ধর্মগ্রহণে দ্বিধা করে নি । কিন্তু এই ধর্মান্তরে, বাঙালি তার অতীত ঐতিহ্য, বিশ্বাস ও সংস্কৃতিকে নিয়ে এসেছে, কোন দূরাগত সংস্কৃতিকে নিজের সংস্কৃতি বলে মনে করে নি, কিন্তু নিজের প্রয়োজনে মুসলমান বাঙালি অনেক তুর্কী, পারসিক, আরবী শব্দকে বাংলা ভাষায় গ্রহণ করেছে। আর এখানেই বাঙালি মুসলমানকে অনন্যতা প্রদান করেছে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলমানদের তুলনায় । বাংলাদেশে ইসলামের একটি নিজস্ব লোকজ স্থানিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে । কিন্তু ওহাবী, আহলে হাদিস প্রমুখ উগ্র ও কট্টর ইসলামী আন্দোলন চেয়েছে এই বৈশিষ্ট্যকে নির্মূল করে তাত্ত্বিক ইসলামী মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করতে । এদের উত্তরসুরীরাই নবান্ন, পহেলা বৈশাখ ও বাঙালির ঐতিহ্যিক সংস্কৃতি ও আচার আচরণকে অ-ইসলামী নাম দিয়েছে, এমন কি শহীদ মিনারের অনুষ্ঠানকে ‘পৌত্তলিকতা’ নাম দিয়ে হারাম ঘোষণার ধৃষ্টতা দেখিয়েছে। আবার ইংরেজ শাসনকালে অনেক বাঙালি, বিশেষ করে সামাজিকভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষ খ্রিষ্টীয় মিশনারীদের কল্যাণে ও অন্যবিধ কারণে খ্রিষ্ট ধর্ম গ্রহণ করেছে । শুধু তাই নয়, ইংরেজদের শাসনের স্পর্শে আসার ফলে পশ্চিমী সংস্কৃতির দুয়ার বাঙালির কাছে খুলে গেল, পশ্চিমের উদারনৈতিক চিন্তা চেতনা দর্শন ও সংস্কৃতি বাঙালি জীবনকে প্রভাবিত করল বিপুলভাবে । জন্ম নিল একটি নতুন ও আধুনিক বাঙালি সমাজের, চিন্তা চেতনায় বলা যেতে পারে আধুনিক, প্রগতিবাদী এবং ইহজাগতিক । বাঙালি মননের এই যে পরিবর্তনশীলতা ও নম্যতা প্রমাণ করে যে ধর্ম বিশ্বাসে বাঙালি চিত্ত কখনও সংরক্ষণশীল ও অনড় ছিল না। নতুন ও পরিবর্তনকে গ্রহণ করতে সে পেছপা হত না । তাই সিপাহী বিদ্রোহকালে, সারা ভারত একে সমর্থন জোগালেও বাঙালি অগ্রবর্তী সমাজ একে পশ্চাদমুখী আখ্যায়িত করেছে; কেবলমাত্র সঙ্কীর্ণ দেশপ্রেমের কাঠামোতে বিচার করে ক্ষয়িষ্ণু মোগল সামন্তবাদের পশ্চাতে দাঁড়াবার বুদ্ধিবৃত্তিক কোন যুক্তি সে কালের আধুনিকমনা বাঙালি সমাজ খুঁজে পায়নি । আর ধর্মবিশ্বাসের নমন্য স্বভাব ও মানুষের প্রতি ভালবাসা বোধ থেকেই এখানে জন্ম হয়েছে চৈতন্য, কবীর আর লালন প্রমুখ মানবতাবাদী সমন্বয়বাদীদের ।

তবে ঈশ্বরের প্রতি ভালবাসা ও আত্মসমর্পণ থেকেও অবশ্য জন্ম নিয়েছে এক ধরনের ধর্মচেতনা যাকে এক কথায় বলা যায় ভক্তিবাদ। ‘সর্বধর্মং পরিত্যজ্যয়া মামেকং শরণং ব্রজ, অহং ত্বাং মোক্ষয়িষ্যামি’ গীতার এই বাণী, অথবা পরমাত্মার মধ্যে ব্যক্তি আত্মার বিলীন— বৈদান্তিক দর্শনের এই সার কথা, কিংবা কলিকালে হরিনামই সর্বস্ব ও মুক্তির একমাত্র উপায়— চৈতন্য ধর্মের এই মর্মবাণী, অথবা আল্লাহতালার সাথে ব্যক্তি রুহের অন্তর্মিলন- সুফিবাদের এই উপলব্ধি, অথবা রামকৃষ্ণের আত্মসমর্পিত হয়ে কালী মাতাকে ভক্তির মধ্য দিয়ে সাধনা ভক্তিবাদেরই নানা প্রকাশ— এর মূলে রয়েছে ঈশ্বরের কাছে আত্মনিবেদন ও আত্মসমর্পণ । প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে গীতায় বলা হয়েছে যে তিন ধরনের সাধনার পথ বা মার্গ অনুসরণ করে ঈশ্বরোপলব্ধি বা নির্বাণ লাভ সম্ভব— এই তিনটি মার্গ হল কর্ম, জ্ঞান ও ভক্তি

বাংলার সাধারণ মানুষের ঐতিহাসিক মানবতাবোধ ও উদার সাংস্কৃতিক পটভূমিতেই আমরা গ্রাম বাংলার ইহজাগতিক দার্শনিক আরজ আলী মাতুব্বরকে উপস্থাপন করতে চাই । আমরা দেখেছি যে ইহজাগতিকতা হল আরজ আলী দর্শনের মূল ভিত্তি । আর ইহজাগতিকতার মূলে রয়েছে অনুসন্ধিৎসা বা মুক্ত মনের জিজ্ঞাসা এবং যুক্তিবাদ বা র‍্যাশনালিজম (rationalism)।

বিদগ্ধ পাঠককে অবশ্য র‍্যাশনালিজমের ধারণা নিয়ে বলবার প্রয়োজন নেই । তবে যুক্তিবাদিতা বা র‍্যাশনালিজম বলতে আমার ধারণা হল এটি কোন বিশ্বাস বা ডকট্রিন নয় । এটি হল কারণ, যুক্তি ও বৈজ্ঞানিক তথ্যের ভিত্তিতে সত্যে উপনীত হওয়ার বিশে-ষণমূলক পদ্ধতি (system) । চিরায়ত র‍্যাশনালিজমের সংজ্ঞার জন্য আমরা নীচের যেকোন একটি বক্তব্যকে বিবেচনা করতে পারিঃ

  1. ‘the principle or practice of accepting reason as the only authority in determining one’s opinon or course of action.’
  2. In philosophy, the theory that the reason or intellect, is the true source of knowledge, rather than senses.
  3. In theology, the doctrine that rejects that revelation and the

supernatural, and makes reason the sole source of knowledge. তাহলে দেখা যাচ্ছে যুক্তিবাদিতার মূলগত কথা হল কারণ বা যুক্তি (reason) ও বুদ্ধিমত্তা (intellect)। সংশয়াবাদ বা স্কেপটিসিজম (skepticism) হল যুক্তিবাদিতার পশ্চাতে চালক শক্তিরূপ । সংশয় ব্যতিরেকে কোন কিছু, যা আপাত দৃষ্টিতে যতই দুর্বোধ্য মনে হোক না কেন, গ্রহণ করা জন্ম দেয় বিশ্বাসের । আর প্রশ্নাতীত বিশ্বাস ঠেলে দেয় অন্ধত্বের দিকে। কাজেই কোন ঘটনা সম্পর্কে ‘জিজ্ঞাসাবোধ ও প্রশ্নকরা’, সে ঘটনা প্রাকৃতিকই হোক আর সামাজিকই হোক, রচনা করে বিশে-ষণী পন্থার ভিত্তি যা থেকে জন্ম নেয় যুক্তিবাদিতা ।

একজন যুক্তিবাদী মানুষ অবরোহী (deductive) ও আরোহী (inductive) উভয় পদ্ধতিতেই সিদ্ধান্ত বা সত্যে উপনীত হওয়ার চেষ্টা করে । আমরা বিজ্ঞানের জগতে দুটি পদ্ধতিই অণুসরণ করে থাকি । দু’একটি উদাহরণ দেয়া যাক । ১৯২৪ সালে (১) আলো কণিকাগুলো কেবল অবিকল (identical) এক নয়, এরা পার্থক্য অযোগ্যও (indistinguishable) (২) এসব ফোটন যে দশা-স্থানে বিচরণ করে এর ন্যূনতম আয়তন h এবং একটি ফোটন তার মেরুবর্তিতার প্রসঙ্গে মাত্র দুটি অবস্থানে থাকতে পারে— এই দুটি অনুমিতির ওপর ভিত্তি করে সত্যেন বোস ফোটন কণিকারা মেনে চলে এমন একটি নতুন কোয়ান্টাম সংখ্যায়নের জন্ম দেন যা থেকে সহজেই প্যাঙ্কের বিকিরণ সূত্র পাওয়া যায় । বোস কর্তৃক এই সংখ্যায়নকে বর্তমানে বলা হয় বোস সংখ্যায়ন (Bose statistics)। আবার ১৯০৫ সালে আইনস্টাইন (১) সকল জাড্য কাঠামোতে আলোর দ্রুতি সব সময় অপরিবর্তিত থাকে, ও (২) সকল জাড্য কাঠামোতে পদার্থবিদ্যার সূত্রসমূহের রূপ একই থাকবে— এই দুটি অনুমিতির ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘বিশেষ আপেক্ষিক তত্ত্ব’, যা চিরায়ত পদার্থবিজ্ঞানের ভিত্তিটাকেই প্রবল নাড়া দিয়েছিল। উপরে উদ্ধৃত বোস ও আইনস্টাইন কর্তৃক অনুসৃত পদ্ধতি দুটি হল অবরোহী (deductive) পদ্ধতির চমৎকার উদাহরণ । অন্যদিকে ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল তার সময়ে বিদ্যুৎ, চুম্বকত্ব ও আলো সম্পর্কিত ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নানা নিয়ম, তথ্য ও পরীক্ষালব্ধ ফলাফল অনুপুঙ্খ বিশে-ষণ করে তার নামে পরিচিত চারটি ক্ষেত্র সমীকরণে উপনীত হলেন যা প্রয়োগ করে আলো, বিদ্যুৎ ও চুম্বকত্ব সম্পর্কে চিরায়ত সকল ঘটনার ব্যাখ্যা দেয়া সম্ভব। এটি হল বিজ্ঞানে অনুসৃত আরোহী পদ্ধতির একটি সুন্দরতম উদাহরণ ।

যেহেতু যুক্তিবাদীরা সত্যে উপনীত হওয়ার লক্ষ্যে তাদের যুক্তিনির্ভর বিশেষণ পদ্ধতি গড়ে তোলার জন্য সব কিছু সম্পর্কেই প্রশ্ন ও সন্দেহ প্রকাশ করে থাকে— এ কারণে তারা বর্তমানে অর্জিত জ্ঞানের স্তর ও লভ্য তথ্যের পরিপ্রেক্ষিতে কি জানা সম্ভব আর কী জানা সম্ভব নয়, এ নিয়েও তাদের চিন্তাভাবনা রয়েছে । এ কারণে যুক্তিবাদ ও সংশয়বাদ (agnosticism) পরস্পর কাছাকাছি । সনাতনী ধারণা অনুযায়ী যিনি মনে করেন যে, ‘আমরা বস্তুজাগতিক ঘটনার বাইরে কোন কিছু জানতে পারি না,– অর্থাৎ প্রথম কারণ এবং অদৃশ্য জগৎ আমাদের কাছে অজানা (unknown), এবং আপাতদৃষ্টিতে অজ্ঞেয় (unknowable)’- তিনি হলেন অজ্ঞেয়বাদী (agnostic)। এবং এই মতবাদকে বলা হয় অজ্ঞেয়বাদ (agnosticism) । ধর্মীয় দৃষ্টিতে বলতে গেলে যারা বিশ্বাস করেন যে ঈশ্বর এবং ইহজগতের বাইরে কোন কিছুর অস্তিত্ব সম্পর্কে কোন কিছুই জানা অসম্ভব— এই মতবাদকে বলা যায় অজ্ঞেয়বাদ । ঈশ্বর আছেন কি না, বা স্বর্গ ও নরক আছে কি না— এ ধরনের প্রশ্ন তোলা অবান্তর । সুতরাং আধিভৌতিক জগৎ সম্পর্কে কোন আলোচনা করা অবান্তর । এই নীতিকে চমৎকারভাবে উত্থাপন করেছেন জি. জে. রামানেস (G. J. Ramanes) : “By agnosticism, I understand a theory of things which abstains from either affirming or denouncing the existence of God; all it undertake to affirm is that, upon existing evidence, the being God is unknownable.”) এ বক্তব্যটি পুরোপুরিই ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হয়েছে । শুধু ঈশ্বরের ক্ষেত্রে বা পারলৌকিক বিষয়ে নয়, পার্থিব অনেক ঘটনা আমাদের সামনে ঘটে যা আমাদের এখন পর্যন্ত জানা তথ্য ও তত্ত্ব দিয়ে বিশে-ষণ করা যায় না । যতক্ষণ না পর্যাপ্ত জ্ঞান আহরিত হচ্ছে ততক্ষণ ঐ ঘটনাটির স্বরূপ বা প্রকৃতি অজ্ঞেয় । এই অজ্ঞেয় বস্তুকে জানার অহরহ চেষ্টাই হল মুক্তচিন্তা ও মুক্তমনের বৈশিষ্ট্য— পরীক্ষা নিরীক্ষা ও বিশে-ষণের মধ্য দিয়ে প্রস্ফুটিত হবে ঐ দুয়ে বস্তুর স্বরূপ । বিজ্ঞান এই পথ ধরেই অগ্রসর হয় সত্যের সন্ধানে ।

আমরা পদার্থবিদরা অজ্ঞেয়বাদের কাছাকাছি এক ধরনের মৌল নীতিতে বিশ্বাস করি- এটিকে বলা যেতে পারে অসম্ভব্যতার নীতি (principle of impossibility) দু’একটি উদাহরণ দেই। তাপবলবিদ্যায় দুটি নীতি রয়েছে— একটি হল আমাদের পক্ষে এমন কোন যন্ত্র নির্মাণ করা অসম্ভব যা সৃষ্টি করতে পারে চিরস্থায়ী গতি (perpetual motion), আর অন্যটি হল পরম শূন্য ডিগ্রির তাপমাত্রায় পৌঁছানো অসম্ভব। আবার আপেক্ষিক তত্ত্ব অনুযায়ী শূন্য স্থানে বস্তুকণার বেগ আলোর বেগের সমান বা এর বেশি হতে পারে না । হাইসেনবার্গের অনিশ্চয়তা নীতি অনুসারে ক্যানোনিকভাবে সম্পর্কযুক্ত (canonically related) কোন দুটি ভৌতরাশি ১০০% নিশ্চয়তা নিয়ে পরিমাপ করা যায় না । যেমন কোন জড় কণিকার অবস্থান ও বেগ একই সাথে ১০০% নিশ্চয়তায় মাপা যায় না, অর্থাৎ কণিকাটির বেগ যদি ১০০% নিশ্চয়তা নিয়ে পরিমাপ করি, এর অবস্থান সম্পূর্ণ অনিশ্চিত হয় পড়বে। এমন কিছু সত্তা রয়েছে যার অস্তিত্ব জাড্য কাঠামোতে সম্পাদিত পরীক্ষণ দ্বারা নির্ধারণ করা সম্ভব নয়, যেমন স্থানকালের ‘পরমতা’ (absoluteness) । তথাকথিত শাশ্বত ঈথারের কথা ধরা যাক, যার অস্তিত্ব কল্পনা করেছিলেন ঊনবিংশ শতাব্দীর পদার্থবিজ্ঞানীরা আলো পরিচালনার মাধ্যম হিসেবে, কিন্তু পদার্থবিদ্যার কোন পরীক্ষণেই এর অস্তিত্ব ধরা পড়েনি । ধর্মবাদী ও ভাববাদী দার্শনিকের কল্পিত ঈশ্বরও এমন একটি সত্তা বলে বিবেচনা করা যায় যার অস্তিত্ব ভৌত কাঠামোয় সম্পাদিত কোন পরীক্ষায় ধরা পড়ে না । অজ্ঞেয়বাদ এ ধরনেরই একটি নীতি ।

 

অজ্ঞেয়বাদ, যুক্তিবাদ বা র‍্যাশনালিজম এবং নিরীশ্বরবাদ কি কেবলই পাশ্চাত্য ধারণা?

সাধারণভাবে মনে করা হয় যে, এসব ধারণা পাশ্চাত্যে উদ্ভুত । কিন্তু সার্বিকভাবে একথা সত্য নয় । এথিইজম এর প্রাতিষঙ্গিক ভারতীয় দর্শনের ধারণাকে প্রকাশ করা হয় দুটি শব্দ দিয়ে- নাস্তিকতা বা নাস্তিবাদ এবং নিরীশ্বরবাদ । ন অস্তি তাই নাস্তি অর্থাৎ যার কোন অস্তিত্ব নেই । ঈশ্বর, স্রষ্টা বা পরলোকের অস্তিত্ব নেই এই মতবাদকে বলা হয় নাস্তিকতা বা নাস্তিবাদ এবং নিরীশ্বরবাদ ।

গৌতম বুদ্ধেরও আগে ভারতীয় দার্শনিক ধীষাণ নাস্তিবাদ অর্থাৎ নিরীশ্বরবাদ (atheism) দর্শনের উন্মেষ ও বিকাশ ঘটিয়েছিলেন। তার এই বাদ অনুসারে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অস্তিত্ব রয়েছে, কিন্তু ঈশ্বর বা সৃষ্টিকর্তার কোন অস্তিত্ব নেই । যে চির শাশ্বত সত্তার অস্তিত্ব রয়েছে তা হল জড় (matter) আর জড় পদার্থ, তার মতে, চারটি মৌল উপাদান নিয়ে গঠিত : মৃত্তিকা, জল, তেজ (আলো), বা শক্তি এবং বাতাস । জীবন সৃষ্টি হল একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া— এবং কথিত চারটি মৌলের সংযুক্ত সংমিশ্রণ (composite composition) থেকে উদ্ভুত হয়েছে । পরলোক বলে কিছু নেই মৃত্যুর সাথেই জীবের সম্পূর্ণ সমাপ্তি । ধীষাণের মতে প্ৰত্যক্ষণই (perception) হল ‘অস্তিত্বের’ প্রত্যক্ষ প্রমাণ

ভারতীয় দর্শনে র‍্যাশনালিজমকে নাম দেয়া হয়েছে হেতুবাদ (যুক্তির তত্ত্ব)। বাংলায় আমরা যুক্তিবাদ কথাটি চালু করেছি । এই দার্শিনক মতবাদ মনে করে যে মহাবিশ্বে ঘটমান প্রতিটি ঘটনার পশ্চাতে রয়েছে কোন না কোন হেতু (cause) বা কারণ একেই বলা হয় ‘কার্যকারণবাদ’ ।

 

বস্তুবাদ থেকেই যুক্তিবাদিতার উদ্ভব

অজ্ঞেয়বাদ, নিরীশ্বরবাদ বা যুক্তিবাদ যাই বলি না কেন- সব ধারণার মূল ভিত্তিটি কিন্তু বস্তুবাদ । বর্তমান কালে বস্তুবাদের নানা ধরনের সংজ্ঞা বা ব্যাখ্যা রয়েছে । মার্কসবাদীরা এক ধরনের ব্যাখ্যা দিয়ে থাকেন, আবার বিজ্ঞানীরাও এক ধরনের বস্তুবাদী । কিন্তু দুয়ের মধ্যে ভেদ আছে । বার্ট্রান্ড রাসেল বা হোয়াইটহেড যেভাবে বস্তুতান্ত্রিকতাকে দেখেন তার সাথে মার্কসীয় বস্তুবাদের ভেদ আছে। আমরা অনেকেই এইসব পশ্চিমী বস্তুবাদের মূল ধারণাগুলোর সাথে কমবেশি পরিচিত । কিন্তু অতি দূর অতীতে প্রাচ্যে বিশেষ করে ভারতবর্ষের নিজস্ব দার্শনিক চিন্তা ধারণাতেও বস্তুবাদ তখনকার জ্ঞাত তথ্যের ভিত্তিতে বিকশিত হয়েছিল— সে খবর আমরা অনেকেই হয়তো রাখি না । এ কথা দিয়ে আমি জোর দিয়ে বলতে চাই যে, বস্তুতান্ত্রিকতা কোন এলিয়েন অর্থাৎ আমাদের সংস্কৃতি বা ঐতিহ্য বিরোধী ধারণা নয়, আমাদের নিজেদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ । আমরা ভারতীয় চিন্তাধারার এই মূল স্রোতগুলো নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করতে চাই ।

যতদূর জানা যায়, কপিল প্রবর্তিত ‘সাংখ্য দর্শনই’ হল ভারতীয় দর্শনে বস্তুবাদের প্রথম সার্থক প্রকাশ । কপিল ছিলেন খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের মানুষ, গৌতম বুদ্ধের প্রায় একশ বছর আগের। এই দর্শনের মূল বক্তব্য ছিল প্রকৃতিই হচ্ছে একমাত্র শাশ্বত সত্তা যা থেকে বিশ্বজগৎ বিকশিত হয়েছে । তিনি বলেছিলেন ‘মূলে মূলাভাবাদমূলং মূলম ।’ এর অর্থ হল প্রকৃতিই সকলের মূলে, তার মূলে কেউ নেই । প্রকৃতিই হল জগতের কারণ, প্রকৃতির পরিণাম হচ্ছে বিশ্ব । জগৎ সৃষ্ট হয়নি, এ জগতের স্রষ্টা বলে কেউ নেই । জগতের ক্রম বিকাশ হয়েছে । যান্ত্রিক বস্তুবাদীদের মত কপিল তার চারপাশের পরিদৃশ্যমান তথ্য, উপাত্ত ও ইতোমধ্যে প্রাপ্ত জ্ঞান বিশে-ষণ করে আরোহী পদ্ধতিতে তার সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার চেষ্টা করতেন । এই দর্শন বলে ‘নাবস্তুনো বস্তুসিদ্ধি’ অর্থাৎ অবস্তু থেকে বস্তুর যেমন উৎপত্তি হতে পারে না, তেমনি নিরাকার ব্রহ্ম থেকে জগতের বিকাশ ঘটতে পারে না । পঞ্চভূত থেকেই স্থূল জড় বা বস্তু সৃষ্টি হয়। প্রাকৃতিক ঘটনার পশ্চাতে রয়েছে হেতু বা কারণ- আর কার্যকারণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বস্তুর রূপান্তর, ক্রমবিকাশ আর বিবর্তন ঘটে থাকে । প্রত্যেক কার্য কারণে সুপ্ত থাকে । অনস্তিত্ব বা অভাব কোন ক্রিয়ার বিষয় হতে পারে না । ‘আকাশ কুসুম’ কবির কল্পনায় থাকতে পারে, কিন্তু বাস্তবে এর কোন অস্তিত্ব নেই । তবে প্রকৃতির এই বিবর্তন বা রূপান্তর প্রক্রিয়ার সাথে অন্তর্নিহিতভাবে যুক্ত রয়েছে প্রকৃতি ছাড়াও প্রকৃতিরই আর একটি সত্তা- সাংখ্য দর্শনে একে বলা হয়েছে নিষ্ক্রিয় ‘পুরুষ’ সত্তা। যিশুর জন্মের ছ’শ বছর আগে কপিল কল্পনা করেছিলেন যে এই বিশ্ব জগতের কোন স্রষ্টা নেই— পঞ্চভূত থেকেই অজৈব জড়ের সৃষ্টি, আর অজৈব জড় থেকে উদ্ভুত হয়েছে চৈতন্যময় জীব । এ কেমন করে হয়— এ প্রশ্নের জবাবে কপিল তখনকার জ্ঞান ও তথ্যের ভিত্তিতে বলেছিলেন : ‘মাদকশক্তিবচ্চেৎ প্রত্যেক পরিদৃষ্টে সাংহত্যে তদুদ্ভবঃ’, যার সারমর্ম হল যে যে দ্রব্য দিয়ে মদ তৈরি হয় তার কোনটিতেই মাদক শক্তি থাকে না, কিন্তু সেসব দ্রব্য মিশিয়ে সৃষ্ট মদে থাকে ‘মাদকতা’ । অনেকটা সেরকমই স্থূল ভূতগুলির আলাদাভাবে চৈতন্য না থাকলেও মিলিত ভূতগুলির পরিণামস্বরূপ নতুন সৃষ্ট ভূতে চৈতন্য সৃষ্টি হতে পারে । আর এই চৈতন্যময় ভূতেরই নাম জীব। কপিলের এই অনুকল্পকেই আমরা আধুনিক পরিভাষায় বলতে পারি ‘জীবনের রসায়নিক উৎপত্তি তত্ত্ব’ (Theory of chemical origin of life)। সুতরাং মহাব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টিতে যেমন ঈশ্বর নামক কোন বহিপ্রতিভূর প্রয়োজন নেই, জীব সৃষ্টিতেও তেমন এর কোন ভূমিকা নেই । কপিল বলেছেন জড়, উদ্ভিদ ও প্রাণীজগতের মধ্যে যে পার্থক্য দেখা দেয় তা তাদের স্ব স্ব গুণের ভিন্নতার কারণে । সুতরাং আমরা বলতে পারি, কপিলের দৃষ্টিতে, চৈতন্য-গুণযুক্ত জড়ই হল জীব । ‘দেশ ও কালও’ প্রকৃতির প্রকাশ যা নিরবিচ্ছিন্ন ও অনন্ত । কপিল অনুসৃত আরোহী পদ্ধতির মূল তিনটি প্রকরণ হচ্ছে ‘প্রত্যক্ষ, অনুমান ও আগম’ । আগম হল শ্রবণ বা শব্দ, শ্রবণের মাধ্যমে যে জ্ঞান তাকে বলা হয় আগম । আর যেহেতু শ্রবণ বা শব্দের মাধ্যমে বেদ প্রকাশিত হয়েছে তাই বেদাদি গ্রন্থকে আগম শাস্ত্র বলা হয় । তিনি তার মত করে এই তিনটি প্রকরণ করে ঈশ্বরের অনস্তিত্ব প্রমাণ করার প্রয়াস পেয়েছেন । তাই কপিলের মতে ঈশ্বর বা ব্রহ্ম বলে কোন কিছুর অস্তিত্ব নেই: ‘ঈশ্বরাসিদ্ধে’ । যুক্তির দ্বারা যে সত্তার হদিস মেলে না, তার অস্তিত্ব নেই, আর সেজন্য ঈশ্বর অসিদ্ধ । একথা বলে আমরা এ প্রসঙ্গ শেষ করব যে সাংখ্যদর্শনের মূলে রয়েছে কঠোর অভিজ্ঞতা, আর এর ভিত্তি হল ভুয়োদর্শন । ভাববাদী দার্শনিকেরা কপিলের বস্তুবাদী দর্শনকে ভুয়োদর্শন অর্থাৎ মিথ্যে বা ভ্রান্ত নামে অভিহিত করত ।

আমাদের কালে এসব কথা স্থূল ও অপক্ক মনে হতে পারে, কিন্তু কপিলের কালের কথা আমাদের মনে রাখতে হবে। তখন কেবল মানুষ চাকার ব্যবহার শিখেছে কাঠের যন্ত্রপাতি আবিষ্কার করে ব্যবহার করতে শিখেছে । তাম্র- লৌহের ব্যবহার্য কারিগরী ও শিল্পীগোষ্ঠী কেবল সৃষ্টি হচ্ছে ।

আধুনিক পরিভাষায় এই দর্শনকে বলা যেতে পারে ‘prime ordial matter’ । কপিল দর্শনের বিশেষ দিকগুলো বিশে-ষণ করলে দেখা যায় যে, তার দার্শনিক মতটিকে আধুনিক দর্শনের দৃষ্টিতে অনেকটা যান্ত্রিক বস্তুবাদের (mechanical materialsm) সামিল।

বৌদ্ধ ও জৈনদর্শন দুটিকেও এক ধরনের বস্তুবাদের প্রকাশ বলে ধরা যায় । জৈনদর্শনে বস্তু বা জড় হল সগুণ, অর্থাৎ গুণ বা ধর্ম ছাড়া বস্তুর কোন অস্তিত্ব অসম্ভব, তেমনি বস্তু নিরপেক্ষ কোন গুণের অস্তিত্ব কল্পনাহীন । জৈনদর্শন পদ্ধতি হল বিশে-ষাত্মক । জড়ের বাইরেও জৈনরা কল্পনা করে এক ধরনের প্রহেলিকাময় সত্তার যার নাম কর্ম, আর এই কর্মের মধ্য দিয়ে সমন্বয় ঘটে জড় ও মনের এবং দেহ ও চৈতন্যের । এই রহস্যবাদী জৈন বস্তুতান্ত্রিকতা বোঝা বেশ কষ্টকর । স্থান কাল সম্পর্কে তাদের ধারণা আরও অস্পষ্ট; তারা বলে কাল পুরোপুরি জড় নয়, বলা যেতে পারে অর্ধজড় । একথা দিয়ে তারা ঠিক কী বোঝাতে চায় অনুধাবন করা বেশ কষ্টকর । এই দর্শনে বলা হয় কাল বিশ্বব্যাপী এবং বস্তুর গতিই হল কালের প্রকাশ । অর্থাৎ বোধগম্য ভাষায় বলা যেতে পারে বিশ্ব ঘটনাবলী কালের কোলে গ্রোথিত । কালের অস্তিত্ব আছে কিন্তু নেই পরিণাম ।

মহাত্মা বুদ্ধের বাণী, উপদেশ ও চিন্তাভাবনাকে কেন্দ্র করে যে দার্শনিক পদ্ধতি গড়ে উঠেছে পরবর্তীকালে তাকেই বলা হয়েছে বৌদ্ধ দর্শন । নাগসেন, বসুমিত্র, বুদ্ধঘোষ প্রমুখ বৌদ্ধাচার্যদের মনীষার লালনে এই পদ্ধতি একটি যৌক্তিক স্তরে উন্নীত হয়েছিল, তারা একে পরিণত করেছিলেন এক দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদে। এই বস্তুতান্ত্রিকতা একদিকে যেমন যান্ত্রিক নয়, অন্য দিকে জৈনদর্শনের মত কুহেলিকাময় নয় । আধুনিক পরিভাষা ব্যবহার করলে বলা যায় এই দর্শন পদ্ধতির মূলে রয়েছে দ্বান্দ্বিকতা (dialectical)। বুদ্ধের মতে জড়জগৎ সতত পরিবর্তনশীল, স্থান নয় । আর এই পরিবর্তন সাধিত হয় দ্বান্দ্বিকতার পথ ধরে । উদাহরণ টেনে বলেছেন- এই মুহূর্তে যে লাল কুসুমটি দৃশ্যমান, তা কিন্তু পরক্ষণেই একই কুসুম নয়, পরিবর্তিত হয়ে একটি নতুন কুসুম জন্ম নিচ্ছে । বিশ্বব্যাপী চলছে এক সীমাহীন বিরামহীন পরিবর্তনের প্রবাহ, বস্তুর রূপান্তর আর বিবর্তন । জীবনের সৃষ্টি, বেড়ে ওঠা আর তিরোধান একটানা প্রবহমান এক ছন্দ যেন । এই পরিবর্তন ঘটার পেছনে রয়েছে একটি চালিকা শক্তি অস্তি ও নাস্তির দ্বন্দ্ব; আস্তিক-নাস্তিক, হ্যাঁ ও না’ এর যুগপৎ মিছিল । এই অস্তি-নাস্তির মাঝে নেই কোন ছেদ- তা সতত চলমান এক বিরামহীন প্রক্রিয়া। বুদ্ধের মতে ‘সত্তা’ বলে কিছু নেই, যা আছে তা হল উৎপাদমান অর্থাৎ ‘ভব’ (being)- ‘সবই আছে যেমন একটি অতিশয়োক্তি, তেমনি কোন কিছুরই অস্তিত্ব নেই আর একটি অতিশয়োক্তি, মাঝামাঝিই সত্য । একটি ভব থেকে আর একটি ভবের যে সতত ধারা অর্থাৎ উৎপাদমানের যে অনন্ত স্রোতধারা তার পশ্চাতে রয়েছে হেতু, অর্থাৎ পরিবর্তনের এই ধারা কার্যকারণ দ্বারা অন্বিষ্ট। বুদ্ধের এই দ্বান্দ্বিক তত্তকে বলা হয় ‘প্রত্যুৎ সমুদপাদ’ বা জগতের ক্রমবিকাশ তত্ত্ব । আর এ কারণেই বৌদ্ধদর্শনের দৃষ্টিতে পরম সত্য বলে কিছু নেই, সকল সত্যই আপেক্ষিক । তাদের মতে পঞ্চভূত নিয়েই জড়, এবং জড় ও মন দুটি পৃথক সত্ত্বা হলেও পরস্পরকে আশ্রয় করে থাকে । জৈনদের মতই তারা মনে করে জড়বস্তু সগুণ, আর বস্তুর এই গুণ তার বৈশিষ্ট্যজ্ঞাপক, আমাদের মনোলোকের সৃষ্ট কোন প্রতিতী নয় । তারা আরও বলেন যে, অনেক সত্য আমাদের জানা, এবং অনেক সত্য হয়তো আমাদের অজানা থাকবে । গৌতম বুদ্ধ, একগুচ্ছ জীর্ণ পত্র হস্তে ধারণ করে শিষ্যদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ‘আমি এই মুষ্টিমেয় কয়েকটি পত্রের মত তোমাদের মুষ্টিমেয় সত্যের কথা বলেছি, এছাড়া জগতে অসংখ্য সত্য আছে।’

ভারতীয় দর্শনে আরও একজন বস্তুবাদীর সাক্ষাৎ মেলে— তিনি খ্রিষ্টপূর্ব ৩য় শতকের দার্শনিক ‘কণাদ’ । তিনি বলেছিলেন যে, জড় কেবল মাটি, জল, তেজ আর বায়ু দিয়ে তৈরি নয়, প্রতিটি বস্তুর রয়েছে এক একটি ক্ষুদ্রতম কণা— এই কণা সমষ্টি নিয়েই গঠিত হয়েছে স্থূল বস্তু: বস্তুটির এই কণা কিন্তু নির্গুণ নয়, বরং বস্তুটির স্থূল ধর্ম এই কণিকাটি বহন করে, যা দিয়ে এটিকে অন্য বস্তুকণা থেকে আলাদা চিহ্নিত করা যায় । কণাদের ‘কণা’ অনেকটা বর্তমানের ‘অণুর’ (mdecute) মত । সুতরাং দেখা যাচ্ছে বস্তু গঠন আর সন্তত নয়, এর প্রকৃতি রেণুধর্মী (discrete)। কনাদের এই ‘কণিকাবাদ’ কতকটা গ্ৰীক কণিকাবাদীদের দ্বারা প্রভাবিত আর কতটা কণাদের নিজস্ব সে বিতর্কে যাওয়ার অবকাশ আমাদের নেই । কণাদের প্রবর্তিত এই দর্শন পদ্ধতিকে বলা হয় বৈশেষিক শাস্ত্ৰ ।

আমরা এবার ভারতীয় দর্শনচর্চার একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের কথা উল্লেখ করতে চাই—যা নানা নামে অভিহিত হয়ে থাকে, যেমন চার্বাক দর্শন, লোকায়ত দর্শন ইত্যাদি । নাম যাই হোক এই দর্শনের প্রবক্তারা কেবল ইহলোকের কথা বলেছেন, ইহজাগতিকতার কথা বলেছেন, কারণ তারা দৃশ্যমান ইহলোক ছাড়া পরলোক, স্বর্গ, নরক, পরমাত্মা, ঈশ্বর এসবের কোনটিতেই বিশ্বাস করতেন না । এ কারণেই এই দর্শনের আসল নাম ছিল ‘লোকায়ত’ অর্থাৎ ইহলোক সম্পর্কে যে জ্ঞান । ‘লোকেষু আয়ত’ সাধারণ মানুষের বোদ্ধ যে মতবাদ অর্থাৎ ইহলোক নিয়ে যে কথাবার্তা তাকেই নাম দেওয়া হয়েছিল লোকায়ত । অন্যদিকে এই দর্শনের বিরুদ্ধবাদীরা বলতেন যে লোকয়তিকরা ভাল ভাল মন ভোলানো কথা বলে অর্থাৎ চারু বাক্যের দ্বারা সাধারণ মানুষের মনোহরণ করতেন সেজন্য তারা বিদ্রূপ করে এর নাম দিয়েছিলেন ‘চার্বাক দর্শন । চারু বাক থেকেই চার্বাক নামের উৎপত্তি । এ নামের সত্যিই কোন দার্শনিক ছিলেন কিনা এ নিয়ে মতভেদ রয়েছে । লোকায়ত দর্শন পদ্ধতির প্রবক্তা কে এ নিয়ে মতভেদ রয়েছে পণ্ডিতদের মধ্যে । বৃহস্পতি, চার্বাক, ধীষাণ, অজিতকেশকম্বলী, কাশ্যপ, পুরন্দর, ভাণ্ডারী, সঞ্জয় প্রমুখদের নাম এই দর্শনের সাথে জড়িয়ে রয়েছে। এ থেকে মনে হয় এই দর্শন নানা জনের অবদানে পুষ্ট হয়েছে এবং হয়তো বা প্রচারিত হয়েছে । তবে গবেষণা থেকে দেখা যায় যে ধীষণই এই মতবাদের প্রথম প্রণেতা । তিনি কোন সময়ের তা সঠিকভাবে এখনও জানা যায়নি, তবে অনুমান করা হয় যে, তিনি কপিল ও বুদ্ধের পূর্ববর্তী, সম্ভবত কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের আগের লোক। এর কারণ হিসেবে বলা হয় যে, মহাভারতের শান্তি পর্ব ও শল্য পর্বে ধীষণ দর্শনের উল্লেখ রয়েছে । পদ্মপুরাণ থেকে জানা যায় যে ধীষণই ছিলেন লোকায়ত দর্শনের আদি প্রবক্তাঃ ‘কণাদ নামে কোনও ব্যক্তি বৈশেষিক নামে মহৎ শাস্ত্র আবিষ্কার করেছেন । গৌতম ন্যায়শাস্ত্র প্রণয়ন করেছেন, কপিল সাংখ্য শাস্ত্র রচনা করেছেন, জৈমিনী নামে কোনও ব্রাহ্মণ নিরীশ্বরবাদের এক মহত্তম শাস্ত্র এবং ধীষণ নামে কোনও ব্যক্তি অতি গর্হিত চার্বাক শাস্ত্র এবং স্বয়ং বিষ্ণু দৈত্য বিনাশের নিমিত্ত বুদ্ধরূপী হয়ে সর্বোতভাবে অসৎ বৌদ্ধশাস্ত্র বলেছেন । লোকায়তবাদীরা সবচাইতে গুরুত্ব আরোপ করেছেন প্রত্যক্ষ জ্ঞানের ওপর যা আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে লব্ধ এবং বাস্তবধর্মী । এই দর্শনের মতে প্রমাণ একটিই, তিনটি নয়, প্রত্যক্ষ, অনুমান ও আগম (যেমন সাংখ্য দর্শন মনে করে) । ধীষণ বলেছেন যে শোনা কথা (আগম) কোন প্রমাণ হতে পারে নাঃ ‘ত্রয়োবেদস্য কর্তারো ভণ্ড ধূর্ত নিশাচরঃ’। আর অনুমান সম্পর্কে ধীষণের মন্তব্য হলো এটি নির্ভর করে ব্যাপ্তিজ্ঞানের ওপর । যেমন ‘ধূমাৎ বহ্নি’ অর্থাৎ যেখানেই ধূম সেখানেই অগ্নির অস্তিত্ব এই অনুমান নির্ভর জ্ঞানকেই বলা হয় ব্যাপ্তিজ্ঞান, যা সব সময় সত্য নাও হতে পারে। কাজেই ধীষণের মতে অনুমান কখনোই প্ৰমাণ হিসেবে গ্রহণ করা যায় না । সুতরাং প্রত্যক্ষই হল একমাত্র প্রমাণ, প্রত্যক্ষ ছাড়া সত্যে উপনীত হওয়ার অন্য কোন রাস্তা নেই । তবে এ নিয়ে কিছু মতান্তর রয়েছে লোকায়িতকরা অনুমানকে প্রমাণ হিসেবে একেবারেই গ্রাহ্য করে না এটি মাধবাচার্যের কথা, তবে পুরন্দর নামের এক লোকায়তিক অনুমানগ্রাহ্য প্রমাণকে একেবারে অস্বীকার করেননি, অবশ্য এ ধারণার পশ্চাতে থাকতে হবে যথেষ্ট হেতু ।

লোকায়িতিকরা মনে করেন না যে, ঈশ্বর নামে কোন কিছুর অস্তিত্ব আছে । তবে জগৎ ছিল, জগৎ আছে ও থাকবে; আর জগৎ বৈচিত্রময় । জড় জগৎ গড়ে উঠেছে ক্ষিতি, অপ, তেজ ও মরুৎ এই চারটি মৌলিক উপাদান নিয়ে । অকাশকে তারা ভুতের মধ্যে গণ্য করেননি । এই চারটি ভুতের সংমিশ্রণে দেহ গঠিত হয় । আর চৈতন্যময় দেহই হল আত্মা, আত্মার কোন পৃথক অস্তিত্ব থাকতে পারে না । চারি ভুতের বিশেষ সংমিশ্রণেই চৈতন্যের উৎপত্তি । জড়বস্তুতে কীভাবে চেতনা বা প্রাণের উন্মেষ ঘটে এর ব্যাখ্যা সাংখ্য জড়বাদের ব্যাখ্যারই অনুরূপ । ধীষণ ব্যাখ্যায় বলেছেন গুড় ও চাল থেকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় মদ তৈরি হয়— যা খেলে মানুষ মাতাল হয় । কিন্তু আলাদাভাবে চালের বা গুঁড়ের মাদতাগুণ থাকে না । আলাদাভাবে চাল বা গুড় খেলে কেউ মাতাল হয় না । জড়ে চৈতন্য বা প্রাণের সৃজনও অনুরূপভাবে ঘটে থাকে ।

এ কারণেই লোকায়ত দর্শন হল দেহাত্মবাদ ও বস্তুবাদ । মৃত্যুতেই সব শেষ, তাই ‘ন ধর্মাংশ্চরেৎ’ অর্থাৎ মৃত্যুতেই যখন সব শেষ তখন ধর্মাচারণ- যাগযজ্ঞ, স্বৰ্গ, মোক্ষ, পরলোক সবই অর্থহীন । অধ্যাপক তুচির মতে ‘আয়ত’ শব্দের একটি অর্থ হল ভিত্তি বা ভূমি বা মাটি অর্থাৎ ইহলোক । সুতরাং বলা যায়, যে দর্শনের ভিত্তি হল ইহলোক বা মাটির পৃথিবী, তাকেই বলা যেতে পারে লোকায়ত । অন্যদিকে হরিভদ্র তার ষড়দর্শন সমুচ্চয় গ্রন্থে লোকায়ত মত ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন, লোক অর্থ সেটুকুই বোঝায় যা আমাদের ইন্দ্রিয়গোচর অর্থাৎ দৃশ্যমান জগৎ : ‘এতাবানেবলোকোহয়ং যাবানিন্দ্রিয়গোচর:’ । একেই বলা হয়েছে ‘লোক’ । অর্থাৎ প্রত্যক্ষে যেটুকু ধরা পড়ে লোকায়তবাদীরা শুধুমাত্র সেটুকুকেই সত্য বলে স্বীকার করেন এর বাইরে সবকিছুকেই তারা অস্বীকার করে থাকেন । কিন্তু দুঃখের বিষয় এই দর্শনের কোন লেখ্য সাহিত্য আজও আবিষ্কৃত হয়নি, ধরা হয় যে ভাববাদীদের আক্রমণে ও আক্রোশে এই দর্শনের সকল পুথি ও গ্রন্থ বিনষ্ট করা হয়েছে । মহাভারতে শান্তিপর্বে চার্বাক দর্শনকে কিভাবে লুপ্ত করা হল তার একটি প্রতীকী গল্প রয়েছে । পণ্ডিত নেহেরু এ প্রসঙ্গে বলেছেন যে খুব সম্ভব উত্তরযুগে পুরোহিত দল এবং সনাতন ধর্মে বিশ্বাসীরা ভারতবর্ষে বস্তুবাদীদের অনেক পুঁথিপত্র ইচ্ছে করে নষ্ট করেছিল । সুতরাং লোকায়ত সম্পর্কে বিরুদ্ধবাদীদের গ্রন্থে রক্ষিত মাল মশলাই লোকায়ত দর্শনের পুনর্গঠনের একমাত্র আকর, আর সে আকর কতটা বিশ্বস্ততার সাথে লোকায়ত মতকে আশ্রয় দিয়েছে সে প্রশ্ন মনে রেখেই একথা বলতে হচ্ছে। এ ধরনের আকর উৎসগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হল : মাধাবাচার্যের সর্বদর্শন সংগ্রহ, শঙ্করাচার্য প্রণীত সর্বসিদ্ধান্ত সংগ্রহ, এবং হরিভদ্রসূরীর ষড়দর্শনসমুচ্চয়… ।

আমরা লোকায়ত দর্শন সম্পর্কে যে ধারণা দেবার চেষ্টা করেছি তা মূলত সর্বদর্শন সংগ্রহ থেকে উৎকলিত । আর একটি উৎস হল বৃহস্পতির নামে প্রচলিত ‘বৃহস্পতি সূত্র’, যদিও এখানে লোকায়ত মত সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্য রয়েছে, তথাপি এর মূল সুরটি হল লোকায়ত দর্শনবিরোধী । ঐতিহ্য অনুযায়ী দেবগুরু বৃহস্পতি লোকায়ত দর্শনের আদি প্রবর্তক। গল্পটি হচ্ছে যে দেবাসুর যুদ্ধে দেবতারা সুবিধা না করতে পেরে, বৃহস্পতি অসুরলোকে গিয়ে অসুরকুলের গুরু শুক্রাচার্যের ছদ্মবেশে অসুরদের মধ্যে এই বস্তুবাদী ও দেহাত্মবাদী দর্শন প্রচার করে অসুরকুলকে মোহান্ধ করে তোলে । এতে অসুরদের মধ্যে নৈতিক অধঃপতন ঘটায় দেবতাদের হাতে তাদের পরাজয় ঘটে । লোকায়ত দর্শনের ওপর যে তাদের নিজস্ব রচনা ছিল তার অপ্রত্যক্ষ প্রমাণ পাওয়া যায়— যেমন বৌদ্ধ পুঁথি দিব্যদানে ‘ভাগুরি ’ নামের লোকায়ত শাস্ত্রের একটি ভাষ্যের কথা উল্লিখিত হয়েছে। কিন্তু ঐ নামটুকুরই হদিশ মিলেছে— ভাষ্যটির সন্ধান আজও মেলেনি ।

উপর্যুক্ত ‘বার্হস্পত্যসূত্রম’ ও অন্যান্য সূত্রে বলা হয়েছে যে লোকায়ত মতে ‘বার্তাই’ হল একমাত্র বিদ্যা । বর্তমানে আমরা জানি বার্তা মানে সংবাদ, সন্দেশ ইত্যাদি । কিন্তু প্রাচীন ভারতে এর অর্থ ভিন্ন ছিল যেমন কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের মতে বার্তার মানে হল ‘কৃষি, পশুপালন ও বাণিজ্য’। তাহলে দেখা যাচ্ছে লোকায়িতকদের কাছে ইহজাগতিক অর্থকরী কার্যাদিই হল আসল বিদ্যা যা জীবনের প্রয়োজন ও বাঁচা মরার সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত- যেসব বিদ্যাকে ব্রহ্মবাদীরা ব্যঙ্গ করে বলতেন অবিদ্যা। তাদের মতে ব্রহ্মজ্ঞান অর্জন যে বিদ্যায় লাভ করা যায় তাই হল বিদ্যা । সুতরাং দেখা যাচ্ছে ইহজাগতিক বিদ্যাঅর্জন, মাটির সাথে সম্পর্ক, বস্তুর সাথে সংযোগ ইত্যাকার বিষয় নিয়েই গড়ে উঠেছে চার্বাক বা লোকায়ত দর্শন অর্থাৎ প্রাচীন ভারতীয় বস্তুবাদ। আমরা বস্তুবাদ ও জড়বাদ শব্দদুটিকে সমার্থক বিবেচনা করব। প্রাচীন ভারতীয় দর্শনে আমাদের আজকের ধারণায় ‘materialism’ এর ধারণার কাছাকাছি যে পরিভাষাটি ব্যবহৃত হত তা হল ‘ভূতচৈতন্যবাদ’ অর্থাৎ যে মতবাদ বিশ্বাস করে চতুর্ভূত বা পঞ্চভূতের সমন্বয়েই চৈতন্যময় প্রাণের উন্মেষ ঘটে । ভূত অর্থ ম্যাটার বা জড় ।

এখন প্রশ্ন হল বেদ- বেদান্ত- গীতা- মনুসংহিতার ও ব্রাহ্মণ-পুরোহিত ও রাজন্যশ্রেণীর দোর্দণ্ড প্রতাপ ও প্রভাবকে তুচ্ছ জ্ঞান করে এই দর্শন-চিন্তার উদ্ভব ঘটল কি করে । মনু চার্বাকপন্থীদের প্রচণ্ড আক্রমণ করে বলেছেন এই মতবাদ নাস্তিক ও পাষণ্ডদের মতবাদ । আমরা দুটি পরস্পরবিরোধী মতের উলে-খ করতে চাইঃ প্রথমটি হল দার্শনিক অধ্যাপক রাধাকৃষ্ণের অভিমত, তার মতে মহাভারত ও রামায়ণের যুগে, অর্থাৎ খ্রিষ্টের জন্মের ৬০০-২০০ বছর আগে ‘ভারতবর্ষে শ্রুতি- শাসনের কঠোরতা ভেঙে চিন্তার মুক্তি ঘোষিত হয়েছিল’, আর তারই ফলে এক ধরনের বিদ্রোহী চিন্তার ফসল হিসেবে এই চূড়ান্ত নাস্তিকতা ও জড়বাদী মতের স্ফূরণ ঘটে, পরে তা নানা জনের রচনায় একটি দার্শনিক রূপ লাভ করে । অন্যপক্ষে মুয়ারের মতে ‘অতি সুপ্রাচীনকাল থেকেই ভারতীয় ধ্যানজগতে চিন্তার স্বাধীনতা স্বীকৃত ছিল । উত্তরকালে লোকায়তিক ও বৌদ্ধদের নাস্তিক্য-বাহুল্যের কালে আস্তিকেরা শঙ্কিত বোধ করেন এবং কঠোর শ্রুতি শাসন প্রবর্তন করেছিলেন। আবার প্রাচ্যবিদ অধ্যাপক তুচি বলেছেন যে লোকায়ত বলতে প্রাচীন ভারতে রাজন্যসভার উপদেষ্টা পুরোহিতকুলের প্রজ্ঞাকে বোঝাত । সেই প্রাচীনকালে কখনও ধর্ম ও অর্থের মধ্যে বিরোধ প্রকট হয়ে দেখা দেয়নি । কিন্তু কাল ক্রমে সে বিরোধ প্রবল দ্বন্দ্বে রূপ নেয়, তখন অর্থ যেন ধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে এবং এরই পরিণামে আবির্ভূত হয় নিরীশ্বরবাদী ‘ভোগসর্বস্ব’ লোকায়ত দৰ্শন । এই আলোচনা থেকে আমরা এ সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে চার্বাক ও লোকায়ত দর্শন এক ও অভিন্ন এর বৈশিষ্ট্য হল: ১। লোকায়ত মানে সাধারণ মানুষের কাছে জনপ্রিয় ও সহজাত মতবাদ বা দর্শন; ২ । লোকায়ত মানে ইহলোকসর্বস্ব বস্তুবাদী দর্শন । চার্বাক দর্শন যে কিভাবে জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল তার প্রমাণ তার নামে প্রচলিত অসংখ্য লোকগাঁথা; আমরা এখানে দু’চারটি উলে-খ করে এই পর্বের সমাপ্তি টানতে চাই ।

০ স্বর্গ বলে কিছু নেইঃ অপবর্গ বা মুক্তি বলেও নয়, পরলোকগামী আত্মা বলেও নয় । বর্ণাশ্রম-বিহিত ক্রিয়াকর্মও নেহাতই নিষ্ফল ।

০ যাদের না আছে বুদ্ধি, না খেটে খাবার মুরোদ তাদের জীবিকা হিসেবেই বিধাতা যেন সৃষ্টি করেছেন অগ্নিহোত্র যজ্ঞ, তিন বেদ, সন্নাসীদের ত্রিদণ্ড, গায়ে ভস্মলেপন প্রভৃতি ব্যবস্থা ।

০ জ্যোতিষ্টোম যজ্ঞে নিহত পশু যদি সরাসরি স্বর্গেই যায়, তাহলে যজমান কেন নিজের পিতাকে হত্যা করে না?

০ কেউ মারা যাবার পর শ্রাদ্ধকর্ম যদি তার তৃপ্তির কারণ হয়, তাহলে তো প্ৰদীপ নিভে যাবার পরেও তেল ঢেলে তার শিখা প্রদীপ্ত করা যেত ।

০ যে পৃথিবী ছেড়ে গেছে তার পাথেয় (পিত্ত) কল্পনা করা বৃথা, কেননা তাহলে ঘর ছেড়ে কেউ গ্রামান্তর গমন করলে ঘরে বসে তার উদ্দেশ্যে পিণ্ড দিলেই তো তার ‘পাথেয় ব্যবস্থা সম্পন্ন হত ।

০ যতদিন বেঁচে আছ সুখে বাঁচার চেষ্টা কর, ধার করেও ঘি খাবার ব্যবস্থা কর । লাশ পুড়ে যাবার পর আবার কেমন করে ফিরে আসবে?

০ জীব যদি এই দেহ ছেড়ে পরলোকে যায়, তাহলে বন্ধুবান্ধবের টানে সে আবার ফিরে আসে না কেন?

০ যারা তিন বেদ রচনা করেছেন তারা নেহাতই ভণ্ড, ধূর্ত ও চোর । জফরীতুরী (প্রভৃতি অর্থহীন বেদমন্ত্র) ধূর্ত পণ্ডিতদের বাক্য মাত্র । আর তারাই বিধান দিয়েছেন, অশ্বমেধ যজ্ঞে যজমান পত্নী অশ্বের শিশ্ম গ্রহণ করবে ।

ইত্যাদি অসংখ্য লোকগাথা ও লোকবাক্য ।

আমরা আধুনিককালে কালে ‘agnosticism’ বলতে যা বুঝি সে ধরনের এক সংশয়বাদ প্রাচীন ভারতীয় দর্শনে বিকশিত হয়েছিল । এই দর্শনের প্রবক্তা ছিলেন সঞ্জয় এবং তা ‘অজ্ঞেয়বাদ’ নামে পরিচিত । তিনি ছিলেন মোটামুটি গৌতম বুদ্ধের সমসাময়িক। তার দর্শন মূলত ইহলোকসর্বস্ব এক ধরনের জড়বাদী হলেও, পরমাত্রা, ইশ্বর, আত্মা, পরলোক, স্বর্গ-নরক ইত্যাদি সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হলে তিনি মৌন থাকাই পছন্দ করেন । তবে বলেন, এসব আছে যেমন বলি না তেমনি এরা নেই তাও বলি না । তিনি বলেন, ওসব ভারি ভারি কথা ছেড়ে মানুষের মঙ্গলের কথা, মানুষের শোক দুঃখের কথা পার্থিব জগতের কথা ভাব; ইহলোকে মানুষ কিভাবে শান্তিতে বাস করতে পারে তার নিরলস চেষ্টা করাই তার দর্শনের মূল কথা । মরণের পর অস্তিত্ব থাকে কি না বা আত্মা কোথায় যায় এসব প্রশ্ন অবান্তর কারণ আত্মা সম্বন্ধে আমাদের জানা সম্ভব নয়, কাজেই তার কোন স্বতন্ত্র অস্তিত্ব আছে কিনা আমাদের জ্ঞানে তা বলা সম্ভব নয়। ব্রহ্ম, পরব্রহ্ম, মোক্ষ এসব সম্পর্কেও একই কথা প্রযোজ্য- না আমরা জানি তা হল প্রত্যক্ষমান বিশ্ব জগৎ যা পঞ্চভূত দিয়ে তৈরি, মৃত্যুর পর দেহ পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে যায় ।

 

যুক্তিবাদিতা ও মানবতা

ভারতে, বিশেষ করে বাংলায় যুক্তিবাদ কিন্তু মানবতাবাদ থেকে বিচ্ছিন্ন নয় । বরং আমাদের যুক্তিবাদের ধারণা গড়ে উঠেছে মানবতাবোধ ও মানবতাবাদকে ভিত্তি করেই, বিশেষ করে গ্রাম বাংলায়। প্রকৃতিগতভাবে যদিও সাধারণ মানুষ ধর্মবিশ্বাসী, কিন্তু তারা কোন সময় ধর্মান্ধ ও মৌলবাদী ছিলেন না, এবং আজও নেই । এমনকি বাংলার ইসলামের একটি নিজস্ব বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা মৌলবাদী কট্টর ইসলাম থেকে নানা দিক থেকেই স্বতন্ত্র । আর আমাদের আলোচ্য ব্যক্তি আরজ আলী মাতুব্বরের যুক্তিবাদী দর্শনের ভিত্তি এই মানবতাবাদ থেকেই উৎক্ষরিত, মানুষের প্রতি প্রেম ও ভালবাসাই এর ভিত্তি। বাংলার লোক সংস্কৃতিতে মানবতাবোধ, যাকে ইংরেজিতে বলা হচ্ছে ‘Humanism’-এর ভিত্তির গভীরে রয়েছে সাধারণ মানুষের প্রতি ভালবাসা এবং সকল মানুষ সমান— এই বোধ ।

ষোড়ষ শতকের বাংলার বৈষ্ণব কবি চণ্ডীদাস খুব সাধারণ ভাষায় গানের মধ্যে দিয়ে মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের কথা বলেছেনঃ

“শুনহ মানুষ ভাই

সবার উপরে মানুষ সত্য

তাহার উপরে নাই”

বহুকাল আগে বাংলার অজ্ঞাত কবি এই মানবতার জয়গান করে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন মানুষে মানুষে ভেদাভেদ নেই, বিশ্বের সকল মানুষ সমান :

“নানান বরন গাভীরে ভাই,

একই বরন দুধ

জগৎ ভরমিয়া দেখি, সবই

একই মায়ের পুত”

স্থানিক বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত ইসলাম ধর্ম ছাড়াও, বাংলাদেশে সনাতন হিন্দু ধর্মের অনুসারী রয়েছে । সাতচলি-শ বিভাগপূর্ব বাংলার যে অঞ্চলগুলো নিয়ে বর্তমান বাংলাদেশ সে এলাকায় সে সময় হিন্দু ধর্মের অনুসারীর সংখ্যা ছিল মোট জনসংখ্যার ৪৬% । আজকের বাংলাদেশে এদের সংখ্যা ১২% বা তারও কম । যে কোন ভারততত্ত্ববিদ লক্ষ্য করবেন যে হিন্দুধর্মে রয়েছে তিনটি অন্তপ্রবাহ : (১). ব্রাহ্মণ্যবাদ যার মূলে রয়েছে বেদ ও পুরাণ; (২). বৈষ্ণববাদ ভক্তি ও মানুষের প্রতি ভালবাসাই যার মূল প্রেরণা; এবং (৩). শক্তিবাদ বা তন্ত্র। সাংস্কৃতিক নৃতত্ত্ববিদদের মতে বৈষ্ণব মাৰ্গ ও শাক্ত মার্গ ভারতের পূর্বাঞ্চলে বিকশিত হয়েছিল। পূর্বভারতের অন্তর্ভুক্ত জনপদগুলোর নাম মগধ, অঙ্গ, বঙ্গ, পুণ্ড্র এবং কামরূপ-প্রাগজ্যোতিষপুর (আসাম উপত্যকা) । অন্যপক্ষে ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুধর্ম রূপ পেয়েছে উত্তর ভারতে, যার প্রাচীন নাম ছিল আর্যাবর্ত বা আর্যদের দেশ । বেদোত্তর পুঁথি ও সাহিত্যে, বিশেষ করে পুরাণাদিতে পূর্বাঞ্চলের মানুষকে ‘অসুর’ নামে অভিহিত করা হয়েছে । যেমন পূর্ব জনপদসমূহের বিভিন্ন রাজন্যদের বলা হচ্ছে উত্তর বঙ্গের পুণ্ড্র দেশের রাজা বাসুদেবকে ‘পুণ্ড্রকাসুর’, শোণিতপুরের রাজাকে ‘বাণাসুর’, আর কামরূপ- প্রাগজ্যোতিষিপুরের রাজাকে ‘নরকাসুর’… ইত্যাদি। পুরাণে যদিও দেবতাদের প্রতিপক্ষ হিসেবে অসুরদের চিত্রিত করা হয়েছে, তবুও তাদেরকে অসভ্য ও অসংস্কৃতিবান বর্বর জাতি হিসেবে দেখান হয়নি। অসুরেরা অর্থাৎ পূর্বভারতের অধিবাসীরা যে সাংস্কৃতিক ও সম্ভবত নৃজাতিক দিক থেকে উত্তর ভারতীয়দের থেকে স্বতন্ত্র এটি চিহ্নিত করতে খুব বেশি কষ্ট করতে হয় না । পুরাণের বর্ণনাতেই দেখা যায় পূর্ব জনপদবাসীদের চিত্রিত করা হয়েছে বীর ও সংস্কৃত জাতি হিসেবে, যারা একটি বেশ উঁচু মানের সভ্যতার অধিকারী । মনে হয় ভাষার দিক থেকে এই দুই জনগণের মধ্যে আপাত তারতম্য দৃষ্ট হলেও ভাষাদুটির উৎস একটি অভিন্ন ভাষা থেকে ।

কিন্তু পুরাণোক্ত এই অসুর ছিলেন কারা? তাদের ধর্ম ও সংস্কৃতির শেকড়ই বা কোথায়? এ বিষয়ে বিদ্বজনেরা একমত নন । অথর্ববেদে মগধের অধিবাসীদের (পূর্ব বিহার) বলা হয়েছে ‘ব্রাত্য’ এবং অথর্ববেদ ব্রাত্য বন্দনায় মুখর । কিন্তু ব্রাত্য বলতে কি বোঝায়? আজকের ধারণায় যারা ব্রত ভ্রষ্ট তারাই ব্রাত্য অর্থাৎ যারা প্রচলিত ধর্মীয় আচার আচরণ ও অনুশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠি দেখায় তারাই ব্রাত্য। যেমন কোন ব্রাহ্মণ বা ক্ষত্রিয় যদি উপনয়ন সংস্কার মেনে না চলে তিনি ব্রাত্যত্বে অধঃপতিত হবেন । কিন্তু অথর্ববেদের কালে আর আজকের দিনে ‘ব্রাত্য’ শব্দের মানে এক নয় । অথর্ববেদেই বলা হয়েছে যে মগধবাসীরা বেদ শ্রুতি অনুশাসন মানে না, যাগ যজ্ঞে বিশ্বাসী নয়, তাদের ধর্মযাজকরা উপবীত ধারণ করে না । এক কথায় ব্রাত্যরা এক স্বতন্ত্র সংস্কৃতির ধারক যারা বেদের অনুসারী নয় এবং বৈদিক আচার আচরণও মেনে চলে না । মহাভারত থেকে জানা যায় যে ভগবান শ্ৰীকৃষ্ণ মধ্যম পাণ্ডবের মগধ ও উত্তর বঙ্গ অভিযানে, রাজ্য জয় ছাড়াও যার উদ্দেশ্য ছিল পূর্বভারতে বৈদিক ও শ্রুতি অনুশাসনের প্রাধান্য বিস্তার, প্রবল বাধার সম্মুখীন হয়েছিল । মগধরাজ পরাজিত হলেও পুণ্ড্ররাজ বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণকে তাড়িয়ে আরব সাগরের দ্বীপে আশ্রয় নিতে বাধ্য করেছিলেন । পূর্বাঞ্চলের তৎকালীন রাজন্যবৃন্দের মধ্যে মগধরাজ জরাসন্ধ ছিলেন ব্রাত্য, আর রাজা বাসুদেব এবং কামরূপরাজ ভগদত্ত ছিলেন অসুরকুলজাত । অর্থাৎ এরা কেউ শ্রুতি শাসনের অনুসারী ছিলেন না । গীতায় বলা হয়েছে জগতে দুই জাতের মানুষ সৃষ্টি করা হয়েছে দেবতা ও মানুষ । গীতার উক্তি থেকে বোঝা যায় যে, অসুর ও দেবতারা ছিলেন জাতিতাত্ত্বিক ও ধর্ম সংস্কৃতির দিক থেকে স্বতন্ত্র দুটি জন। তবে গীতায় অসুরদের সম্পর্কে দুর্বাক্য উচ্চারিত হলেও পুরাণের যুগের আগে বৈদিক যুগে অসুরদের খারাপ বলা হয়নি, বরং বেদের বহুস্থানে অসুরদের প্রশংসা করা হয়েছে । দেবরাজ ইন্দ্রকে অসুর বলে প্রশংসা করা হয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ ঋকবেদের এক স্থানে বলা হয়েছে, ‘যিনি শত্রুকে জয় করেছেন, যিনি নিজ শক্তিতে অটল সেই ইন্দ্রের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ নত হও, এবং বিনম্রভাবে তার প্রতি প্রশংসাবাণী উচ্চারণ কর কারণ তিনি প্রজ্জ্বল, মহান এবং অসুর ।’ এসব আলোচনা থেকে মনে হয় অসুর নামের কথিত মানুষেরা অবশেষে পূর্বভারতে স্থিতিলাভ করে, আর বেদের অনুসারীরা উত্তর ভারতে বিকশিত হয় । অবশ্য পরবর্তী বেদ রচনায় অসুরদের প্রতি নিন্দা প্ৰকাশ করা হয় এই বলে যে তারা বেদ বর্ণিত অনুষ্ঠানাদি পালন করে না, এমন কি বেদই যে জ্ঞানের একমাত্র উৎস তা তারা স্বীকার করে না । ‘অসুরেরা বেদ-রহিত এবং বেদ বিদ্বেষী’ একথা বেদোত্তর সাহিত্য ও পুরাণেও বলা হয়েছে । আমাদের অবশ্যই বুঝতে হবে বৈদিক সংস্কৃতির বিপরীতে অসুর সংস্কৃতির উৎস সম্পর্কে ।

আমরা আগেই বলেছি যে তন্ত্রবাদ ও শক্তিবাদ পূর্বভারতে বিশেষ করে বাংলায় বিকাশ লাভ করেছিল । অধুনা গবেষণায় দেখা গেছে যে, তন্ত্রবাদ ও শক্তিবাদের গোড়ায় রয়েছে ‘লোকায়ত দর্শন’ । মাধবাচার্য লিখিত ‘সর্বদর্শন সংগ্রহ’ চার্বাক নামে যে দর্শন সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করা হয়েছে তা মূলতঃ ‘লোকায়ত দর্শন’ । আমরা ইতোপূর্বেই এই দর্শনের সারাৎসার উলে-খ করেছি, যার চৌম্বক কথা হল প্রত্যক্ষ থেকে উদ্ভুত জ্ঞান ছাড়া জ্ঞানের অন্য কোন উৎস থাকতে পারে না । এরই সূত্র ধরে বলা যায় যে এই দর্শনের মতে চরম আনন্দলাভ এ জগতেই পাওয়া সম্ভব অন্য কোন জগতে নয় । এ কথা বিভিন্ন শ্রেণীর তন্ত্রশাস্ত্রেরও অন্ত নিহিত মূল নীতি । ছান্দ্যোগ্য উপনিষদে বলা হয়েছে যে ‘অসুরের উপনিষদ’ মতে প্রকৃত জ্ঞান হল ‘দেহাত্মবাদ’ অর্থাৎ চৈতন্যময় দেহকে আশ্রয় করে মতবাদকেই বলা হয় ‘দেহতত্ত্ব’ । ছান্দোগ্য উপনিষদে অসুর উপনিষদ সম্পর্কে বলা হয়েছেঃ ‘এ জগতে দেহেরই পুজা কর, এবং দেহের পরিচর্যা কর। তুমি যদি দেহকে গৌরবে ভূষিত কর, দেহকে যত্ন কর- তাহলে ইহলোক ও পরলোক দু’জগতেরই চরম আনন্দ লাভ করবে। এ কারণে যেসব লোক শাস্ত্র মানে না, বেদকে অশ্রদ্ধেয় মনে করে এবং যাগযজ্ঞ সম্পাদন করে না, তাদেরকেই অসুর হিসেবে জ্ঞান করা হয় । এই হল অসুরদের উপনিষদ ।’ আমরা এর আগেই বলেছি যে, লোকায়ত দর্শন গড়ে উঠেছে দুটি ধারণাকে আশ্রয় করে— ‘দেহাত্মবাদ ও বস্তুবাদ’ ।

শঙ্করাচার্যের মতে ‘দেহমাত্রং চৈতন্যবিশিষ্টমত্মে তি প্রাকৃতিজনালোকায়িতকশা প্রতিপন্ন ।’

গীতায় বলা হয়েছেঃ

‘অসত্যমপ্রতিশ্যাং তে জগদাহুরনীশ্বরম ।

অপরস্পরসম্ভুতাং কিম্যন্যৎ কামহৈতুকম৷’

এই শোকটির তাৎপর্য হল এই জগৎ ঈশ্বর কর্তৃক সৃষ্ট এবং স্থিত- এই অর্থে এই জগৎ সত্য নয়, কারণ স্বয়ং ঈশ্বরেরই তো কোন অস্তিত্বই নেই । পুরুষ ও নারীর মিলনেই এই সৃষ্টি, আর সৃষ্টি মুখরিত হয় ‘মিলনের উদগ্র বাসনা’ অর্থাৎ ‘কাম’ থেকে । এছাড়া সৃষ্টির পশ্চাতে আর কোন কারণ নেই ।

তাহলে আমরা দেখতে পাচ্ছি অসুর দর্শনের দুটি দিক রয়েছে : দেহতত্ত্ব বা আত্মতত্ত্ব এবং সৃষ্টিতত্ত্ব । আমরা এ প্রসঙ্গে পাঁচকড়ি বন্দোপাধ্যায়ের একটি উক্তি মনে করতে পারিঃ ‘নর নারীর মিলনের প্রক্রিয়ায় ‘পুরুষ ও প্রকৃতি’র মিলনে জগৎ সৃষ্টি হয় ।’ উক্তির পরের অংশটি সাংখ্য দর্শনেরই কথা । পরবর্তীকালে তন্ত্রবাদ ও শক্তিবাদ আসল বৈশিষ্ট্য ও পূর্বেকার শক্তি হারিয়ে ফেলে । এর মধ্যে বিকৃতরূপের প্রকাশ ঘটে, এবং ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুধর্মের প্রভাবে জ্ঞানের চরম উৎস হিসেবে বেদকে গ্রহণ করে; তন্ত্রশাস্ত্র অবশেষে হিন্দুধর্মের অঙ্গীভূত হয়ে অন্যতম ‘মার্গ’ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে । একইভাবে হিন্দুধর্মের সর্বগ্রাসী আত্মিকরণ প্রক্রিয়ায় বৈষ্ণববাদ, জৈন মতবাদ প্রভৃতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ধর্মমতগুলো, এমনকি বৌদ্ধ ধর্মও বিকৃতরূপে হিন্দুধর্মের কোলে স্থান লাভ করে ।

আরজ আলী, যাকে নিয়ে আমাদের আলোচনা তিনি হলেন গ্রাম বাংলা থেকে উঠে আসা মানুষ- দরিদ্র কৃষকের সন্তান এবং গ্রামীণ পরিবেশেই লালিত হয়েছেন । এই পশ্চাদপটেই তার যুক্তিবাদ বিকশিত হয়েছিল । ক্ষুধা, দারিদ্র ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে আপোষহীন যুদ্ধই হল তার অত্যাশ্চর্য সংগ্রামী জীবন । তার যুক্তিবাদী মতাদর্শের আলোচনায় যাওয়ার আগে, গ্রাম বাংলায় যুক্তিবাদের ঐতিহ্য সম্পর্কে সামান্য কিছু কথা বলা যাক যা আমরা আমাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যে কীভাবে লালন করে আসছি ।

 

যুক্তিবাদ ও বাঙালির লোক ঐতিহ্য

একথা অবশ্য স্বীকার করতে হবে, আমরা যে অর্থে যুক্তিবাদকে আধুনিককালে বুঝে থাকি, আমাদের গ্রামীণ মানুষেরা সুদূর অতীতে যুক্তিবাদকে সেভাবে বোঝেননি । একথা বলা বোধহয় সত্যের অপলাপ হবে না যে জানা ইতিহাসের কাল থেকে বাংলার জনগণ রাষ্ট্রযন্ত্রের মাধ্যমে যুগ যুগ ধরে শাসিত হয়ে এলেও গ্রাম বাংলা শাসকদের ধর্মের প্রভাব থেকে মুক্ত ছিল । আমাদের ইতিহাসে, সাম্প্ৰতিক কাল ছাড়া, কখনও কোন ধর্মকে ‘রাষ্ট্র ধর্ম’ নামে জনগণের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয় নি, এমন কি পাঠান যুগেও নয় । আমাদের অতীতের গ্রামীণ সমাজ মূলত কৃষিভিত্তিক ও গ্রামকেন্দ্রিক । বস্তুত দূরবর্তী গ্রামে বাস করা সাধারণ জনের সাথে রাষ্ট্র শক্তির কোন সরাসরি সম্পর্ক ছিল না, যে ধর্মই শাসকবৃন্দ অনুসরণ করে থাকুক না কেন । রাষ্ট্রের শাসকরা হিন্দু বা বৌদ্ধ ও মুসলমান যাই ছিলেন না কেন, কিছু কিছু ব্যতিক্রমী ঘটনা বাতিরেকে, সাধারণভাবে জনগণের ধর্মবিশ্বাসে কোন প্রভাব বিস্তার করতে পারেননি । একথা অবশ্য অস্বীকার করা যায় না যে বাংলার জনগণ ইসলাম, হিন্দু, বৌদ্ধ বা জৈন ধর্মমতের মত প্রথাগত ধর্ম গ্রহণ করেছিল, কিন্তু এসব প্রথাগত ধর্মের কোনটিই বাংলার মাটিতে তাদের বিশুদ্ধতা রক্ষা করতে পারেনি । লোক সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের জারকে আত্মীকৃত হয়ে একটি স্থানীয় লোকজ রূপ পরিগ্রহ করেছিল প্রতিটি ধর্ম, যা আসলে বিশুদ্ধ রূপ থেকে তাৎপর্যময়ভাবে স্বতন্ত্র একটি নতুন রূপ । অতীতকালে বাংলার লোক ধর্ম বিশুদ্ধ শাস্ত্রীয় গ্রন্থ নির্ভর ধর্মগুলোকে প্রত্যাখ্যান করেছে । জনগণের এই প্রত্যাখ্যানের, যে জনগণকে সংস্কৃত সাহিত্য বলা হয়েছে ‘প্রাকৃতজন’, ভিত্তি ছিল তাদের বোদ্ধ যুক্তিবাদ ।’ প্রাকৃতজনের ভাষায় পুরাণের কথা, রামায়ণ ও মহাভারত প্রভৃতি মহাকাব্যগুলো অনুবাদ করার ওপর সংস্কৃত পণ্ডিতেরা নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন এবং এই মর্মে ঘোষণা দিয়েছিলেন যে যারা এই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করবে তারা এই পাপকর্মের ফলে নরকে নিক্ষিপ্ত হবে । কিন্তু বাংলার লোক কবি ও লেখকরা রক্ষণশীল এই শাস্ত্রীয় পণ্ডিতদের অনুশাসন তুচ্ছ করে রামায়ণ-মহাভারতসহ হিন্দু ধর্মের পুরাণীয় গল্প ও শাস্ত্রবাণী আঞ্চলিক ভাষায় প্রকাশ করেছিলেন । মৌলবাদী ইসলামী পণ্ডিতেরাও একই ধরনের একই ফতোয়া জারী করেছিলেন মুসলিম শাসকদের আমলে । ইসলামের ধর্মের কথা, রসুলের কথা এই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে যেসব পুঁথিকার বাংলা ভাষায় কাব্য লিখেছিলেন ও বাংলায় ইসলামী শাস্ত্রীয় বই প্রকাশ করেছিলেন তাদের ‘কাফের’ নামে অভিহিত করা হয়েছিল। একটি উদাহরণ দেওয়া যাক । ১৮ শতকের একজন মুসলিম লোক যুক্তিবাদী সৈয়দ সুলতান বাংলা ভাষায় ‘নবী বংশ’ পুঁথি কাব্য লিখে লোকায়ত আদর্শের ও মানবিক মূল্যবোধের কথা তুলে ধরেছিলেন । যুক্তিবাদী ও মানবতাবাদী না হলে এসব কথা লিখতে সাহসী হতেন না ৷

হিন্দুধর্মের ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব ও কৃষ্ণকে তিনি পয়গম্বর হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন । ‘জ্ঞান প্রদীপ’ এবং ‘জ্ঞান চৌতিসা’ শিরোনামে যোগ ও তন্ত্রশাস্ত্র নিয়ে দুটি পৃথক পুস্তক লিখেছিলেন । এই দুটি শাস্ত্র হল পূর্ব ভারতের প্রাচীন ঐতিহ্যিক বস্তুবাদের ধারক । এই দুটি দর্শনই ইসলামের চিন্তাধারার বিরুদ্ধবাদী ।

আমরা গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যে দুই শ্রেণীর মানবতাবাদীকে দেখতে পাই- একটি দল ধর্মীয় সর্বোচ্চ কতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করে বস্তুবাদী ঐতিহ্যকে তুলে ধরে, অর্থাৎ এরা হলেন বিভিন্ন শাখার লোকায়ত ও তন্ত্রবাদের অনুসারী । অন্যপক্ষে দ্বিতীয় দলটি ধর্মের আঞ্চলিক লোকজ রূপটিকে আশ্রয় করে তাদের মানবতাবাদ প্রচার করে থাকেন— মানব মূল্যবোধের স্থান সবার ওপরে, তবে ঈশ্বরকে সরাসরি অস্বীকার করে নয় । প্রথম চিন্তাধারার উদাহরণ, যা আজও বিদ্যমান তা হল ‘বৌদ্ধ সহজিয়া’ মত। দ্বিতীয় পথের অনুসারীদের প্রবক্তা ছিলেন চৈতন্যদেবের বৈষ্ণববাদ । এই পথের অনুসারীরা ‘আধ্যাত্মিক সমতা ও মরমী প্রেমময় ভক্তিবাদের’ বাণী প্রচারের মধ্য দিয়ে মানুষের মধ্যে শ্রেণীভেদ ও বৈষম্য দূর করতে চেয়েছিল । শেষোক্ত পন্থীরা প্রথাগত ধর্মের আঞ্চলিক লোকজ রূপটি ব্যবহার করে মানবতাবাদ প্রচার করেছিলেন । কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যাক ।

‘লালন মত’ নামে পরিচিত লোক ধর্মের ছদ্মবেশে এ ধরনের একজন যুক্তিবাদী ছিলেন দুদু শাহ । তিনি ছিলেন ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকের মানবধর্মী লালন শাহের একজন অনুগত শিষ্য । তার লেখা থেকে একটি নমুনা উদ্ধৃতি দেওয়া যাক, ‘বস্তু বা জড়কে আত্মা বলা যেতে পারে, আর তথাকথিত আত্মা রহস্যময় কোন কিছু নয় ।’ তিনি আরও বলেছেনঃ

বস্তু ছাড়া নাই আলা কিংবা হরি । এহি মত দেখে সবে নর-বস্তু ধারী॥ রজঃ বীর্য্য এই দুই বস্তু যেবা চিনে । লালন সাঁইজীকে সেই জন চিনে।

আমাদের লোক ধর্মের প্রবক্তারা যেভাবে বস্তুবাদকে বুঝেছিলেন উপরের কথাগুলো তারই সরলতম প্রকাশ । এই সরল মতের বস্তুবাদী দার্শনিকেরা দেহকেই সবার ওপরে স্থান দিয়েছিলেন একথা বলে, ‘যাহা নাই দেহ মন্দিরে, তাহা কোথাও খুঁজে পাবে না কো বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে ।’ এই মতের অনুসারীরা প্রায়শঃ গেয়ে থাকেন

অনন্তরূপ সৃষ্টি করলেন সাঁই

শুনি মানবের উত্তম কিছু নাই ।

দেব- দেবতাগণ করে আরাধন

জন্ম নিতে মানবে।

এই সরল চিন্তাশীলদের ধারণায় সরল বস্তুবাদের মতে সৃষ্টি হল নারীর রজঃ আর পুরুষের বীর্যের মিলনের ফসল, এবং দেহের বাইরে কোন কিছুর অস্তিত্ব নেই । সৃষ্টির পেছনে রয়েছে ঈশ্বর বা আল্লাহতায়ালার অস্তিত্ব— এই ধারণাকে এখানে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে । লালন শাহ এক সময় বলেছিলেনঃ

আল্লাহ হরি ভজন পূজন ।

সকলই মানুষের সৃজন।

অনামক অচিনয় কাকহন ।

বগিন্দ্ৰীয় না সম্ভবে।

লালনের একটি গানে কোরানের বাণীর ধাপ্পাবাজী নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছেঃ

ধর্মের উদ্দেশ্য যদি হয়

আল্লাহ  নির্ণয় ।

তা হলে সকল ধর্মেই

তারে পাওয়া যায় ৷

পয়গম্বরের হলো খবর ।

ঊনিশটি নাম কোরান-ভিতর

আর সকল কোথায় ৷

সাধারণভাবে দেখা যায় যে আমাদের লোক সমাজে মুক্তচিন্তা ও মনের উদারতা লোকধর্ম ও লোক সঙ্গীতকে কেন্দ্র করে বিকাশ লাভ করেছে । আমরা জানি বাংলায় অনেক ধরেনর লোক ধর্মমত (folk cults)-এর মধ্যে কয়েকটি সুপরিচিত নাম হলঃ সহজিয়া (বৌদ্ধধর্ম জাত, বৈষ্ণবীয়, এবং বাউল), এবং সাহেবধনী, খুশি বিশ্বাসী, বল হরি ইত্যাদি । প্রতিটি কাল্টই তাদের মত করে মুক্ত ও উদার চিন্তার চর্চা করে এসেছে । লুপ্তপ্রায় বল হরি ধর্মমত, যা বাংলার পশ্চিমাঞ্চলে উদ্ভুত হয়েছিল, হিন্দু ও ইসলাম উভয় ধর্মের আচার আচরণকে প্রত্যাখ্যান করেছে । নারী- পুরুষের মধ্যে পার্থক্য ছাড়া মানুষের মধ্যে জাতিভেদ, সামাজিক বিভাজন ও ধর্মীয় ভেদাভেদসহ কোন বিভেদই এরা মানতে নারাজ । এই মতের প্রতিষ্ঠাতা বলরাম, যিনি নিজেই জন্মেছিলেন নিচু জাতে, একদিন ব্রাহ্মণের অনুকরণে নদীতে নেমে কৃষিখেতের উদ্দেশ্যে জল ছিটাচ্ছিলেন। সে সময় ব্রাহ্মণটি তার পিতৃপুরুষদের উদ্দেশ্যে জল দিয়ে স্মৃতি তর্পণ করছিলেন । বলরামকে জল ছিটানো দেখে ব্ৰাহ্মণ তাকে কি উদ্দেশ্যে এটি করছেন জিজ্ঞাসা করলে বললাম জবাবে বলেছিলেন তিনি কৃষিখেতে জল সিজ্ঞন করছেন । অতদূরের কৃষিখেতে কি করে পৌঁছাবে জিজ্ঞাসিত হলে বললাম উত্তরে বলেছিলেন ব্রাহ্মণের স্বর্গবাসী পিতৃপুরুষগণ যদি অন্যলোকে থেকে জল পান, তাহলে পার্শ্ববর্তী কৃষি জমিতে জল পৌঁছাবে না কেন? এই লোকবাদী তার একটি গানে বলেছিলেনঃ

মানুষ থুইয়া খোদা ভজ, এ মন্ত্র কে দিয়েছে?

মানুষ ভজ, কোরান খোঁজ পাতায় পাতায় সাক্ষী আছে ।

আমাদের লোক— ইহজাগতিক ও যুক্তিবাদীরা, তাদের বুদ্ধি ও ধারণা মতে ‘অজ্ঞেয়বাদের’ কথাও প্রচার করেছিলেন । ১৯ শতকের ঢাকার কাছে এ ধরনের একজন চিন্তাবিদ ছিলেন কবি বৈকুণ্ঠ চক্রবর্তী । তিনি ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন, জনপ্রিয় গানের মধ্যদিয়ে— ‘কেহ বলে তুমি আছ, কেহ বলে নাই; আমি বলি ‘তিনি যদি থেকেই থাকেন, থাকতে দাও, আর যদি নাই থাকেন— তাহলে আর ভাবা কেন’? আর এক কবি পাগলা দ্বিজদাস বস্তুবাদী ধারণা প্রচার করতে গিয়ে বলেছেনঃ

বেদ পুরাণ বাইবেল আদি যত ইতি পুঁথি ।

মানি বোলেই মোদের এতই দুর্গতি।।

মানতে মানতে শাস্ত্র না পাই অন্ন বস্ত্ৰ ।

ঘটি বাটি লাঠি বেঁচে কর্মে দিচ্ছি দান।। 

প্রাচীন ভারতে যুক্তিবিজ্ঞানের নাম ছিল ‘ন্যায়’; বলা হয়ে থাকে যে এই শাস্ত্র মতে সাধারণ তত্ত্বে উত্তীর্ণ হওয়ার পদ্ধতি হল যুক্তি ও প্রতিযুক্তির মধ্য দিয়ে অগ্রসর হওয়া । সেখানে বলা হয়েছে: ‘বাদে বাদে জয়তে তত্ত্ববোধ।’ অর্থাৎ সার কথা হল চরম সত্যে উপনীত হতে হলে আমাদের অনুসরণ করতে হবে প্রশ্ন, যুক্তি ও প্রতিযুক্তির পথ । এছাড়া অন্য কোন পথ নেই যদি আমরা মুক্তবুদ্ধি ও মুক্তচিন্তার চর্চা করতে চাই । আধুনিক পরিভাষায় বা পশ্চিমী ধারণায় এইভাবে সত্যে পৌঁছানোর প্রক্রিয়ার নাম হল ‘থিসিস-এন্টিথিসিস-সিনথেসিস’ বাংলায় বলতে পারি ‘প্রতিপাদ্য-বিপরীত প্রতিপাদ্য- সংশে-ষণ’ । বাংলার লোক সংস্কৃতিতে ‘কবির লড়াই’ এর একটি চমৎকার উদাহরণ— দুই কবির যুক্তি ও প্রতিযুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে একটি মীমাংসায় উত্তীর্ণ হওয়া । বিতর্কের বিষয় নানা বৈচিত্র্যময় হতে পারে- সামাজিক সমস্যা থেকে রাজনীতি ও ধর্ম । কিন্তু সমাজের কর্ণধারেরা, পুরোহিতেরা, মৌলভীরা, অর্থাৎ এক কথায় মৌলবাদী ও সংরক্ষণবাদীরা গ্রামীণ এই লোকায়ত ও মুক্তচিন্তার লোক ঐতিহ্য ও সাহিত্যকে বিকৃত করে স্ব স্ব ধর্মের জারকে পরিশুদ্ধ করার প্রয়াস পেয়েছেন এবং জনপ্রিয় এসব লোক ধর্মমতকে প্রথাগত ধর্মীয় লেবাস পরানোর চেষ্টা করে আসছেন যুগযুগ ধরে । আধুনিক যুগেও এ প্রয়াস অব্যাহত তথাকথিত গবেষকদের হাতে। একটি উদাহরণ দেওয়া যাক । সংরক্ষণশীল এই গবেষকদের অনেকে আদাজল খেয়ে লেগেছেন অজ্ঞেয়বাদী লালনকে ইসলামপন্থী প্রমাণ করতে । কেউ তাকে মুসলমান, আবার কেউ তাকে অন্তজ্য শ্রেণীর হিন্দু সন্তান বানাতে প্রাণপাত করছেন । এই গবেষকরা কী আশ্চর্যভাবে ভুলে গেছেন যে মানুষের মধ্যে জাতি ও শ্রেণীভিত্তিক যেকোন বৈষম্যকে চরমভাবে ঘৃণা করে এসেছেন লালন । তার একটি বিখ্যাত গানে তিনি বলেছেনঃ

এমন সমাজ কবে গো সৃজন হবে,

যেদিন হিন্দু মুসলমান

বুদ্ধ ক্রিস্তান

জাতিগোত্রে নাহি রবে ।

শোনায়ে লোভের বুলি

নেবে না কাঁধের ঝুলি

ইতর আশরাফ বলী

দূরে ঠেলে না দেবে ।

এভাবেই স্মরণাতীতকাল থেকে আমাদের লোক চিন্তাবিদরা সমাজের এইসব সংরক্ষণশীলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে এসেছিলেন, আর আধুনিক যুগে তাদেরই আলোক বর্তিকা হাতে নিয়ে আমরা তাদের উত্তরসুরী সেক্যুলারিস্টরা, মানবতাবাদীরা এবং যুক্তিবাদীরা এইসব দুর্বৃত্ত শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছি । লোক বাংলার এই পটভূমিতেই দার্শনিক চিন্তাবিদ আরজ আলী মাতুব্বর

আমাদের সমাজে আবির্ভূত হয়েছিলেন । ইহজাগতিকতা প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে তিনি কিন্তু আমাদের লোক দার্শনিকদের চিরায়ত পথ হুবহু অনুসরণ করেননি, যদিও তাদের চিন্তাধারায় অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন । চিরায়ত লোকবাদীদের মত ধর্মকে ব্যবহার করতে চাননি মানবতাবাদ প্রতিষ্ঠায় । ধর্মের বিরুদ্ধে সরাসরি না দাঁড়িয়ে অন্ধ বিশ্বাস ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে ধর্মেরই অস্ত্র ব্যবহারে হয়তো খানিকটা সুবিধা পাওয়া যায়, যেমনটি বিদ্যাসাগর ব্যবহার করেছিলেন । তবে এই প্রাচীন পথের সীমাবদ্ধতা আছে, বিশেষ করে বিজ্ঞানের অগ্রগতির যুগে। এই সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে আরজ আলী মাতুব্বর সম্যক অবগত ছিলেন । তাই তিনি আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞানের পথকেই বেছে নিয়েছিলেন ইহজাগতিক মুক্ত চিন্তার দর্শন প্রতিষ্ঠায় । ধর্মীয় সংরক্ষণশীলতা, ধর্মান্ধতা ও ধর্মীয় সংকীর্ণতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেমেছিলেন বিজ্ঞান সিদ্ধ যুক্তিবাদিতার পথ ধরে। প্রশ্ন রেখেছেন, অনুসরণ করেছেন যুক্তির পথ, বিচার বিশে-ষণ করে বৈজ্ঞানিক পন্থায় উপনীত হতে চেয়েছেন সিদ্ধান্তে । অনেক সময় পাঠকদের বিচার বিবেচনার ওপর ছেড়ে দিয়েছেন সিদ্ধান্তে পৌছাতে- কতকগুলো মৌলিক প্রশ্ন উত্থাপন করে । এই অর্থে তাকে একজন আধুনিক লোক দার্শনিক হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে যিনি আমাদের ঐতিহ্যিক লোক যুক্তিবাদকে আধুনিক বৈজ্ঞানিক উপাদানে, আধুনিক চিন্তা ও ভাবধারায় পরিপুষ্ট করেছেন। মৌলবাদের বিরুদ্ধে তিনি নিজেকে একজন আপোসহীণ যোদ্ধায় পরিণত করেছিলেন । গ্রামীণ জীবনের পরিবেশে এই যুদ্ধ চালাতে গিয়ে শারীরিকভাবে তিনি নির্যাতিত হয়েছিলেন, আর সারা জীবন হয়েছিলেন মানসিকভাবে ক্ষতবিক্ষত। নগর ভিত্তিক একজন যুক্তিবাদীর যুদ্ধের সাথে আরজ আলীর- যিনি মানবতাবাদ ও যুক্তিবাদের সংগ্রামে অনুপ্রেরণা পেয়েছেন আমাদের ঐতিহ্যিক লোকজ যুক্তিবাদ থেকে, যুদ্ধের রয়েছে বিশাল পার্থক্য— দুটিকে এক নিক্তিতে মাপা চলে না । অন্যদিকে নগর ভিত্তিক আধুনিক মুক্তচিন্তাবিদদের কাছে এই সংগ্রাম অনেকটাই বুদ্ধিবৃত্তিক অনুশীলন । আরজ আলী মুক্তবুদ্ধির লড়াইয়ে নেমেছিলেন তার সামাজিক সচেতনতা ও গ্রামীণ সমাজের প্রতি তার দায়বদ্ধতা থেকে । এ কথা আমাদের স্মরণ রাখতে হবে ।

এ কারণে আমরা বলতে পারি আরজ আলী হলেন চিন্তার স্বাধীনতার আমাদের লোক ঐতিহ্যের মহান উত্তরসুরি ।

 

কে এই আরজ আলী মাতুব্বর?

আরজ আলী ছিলেন প্রকৃত অর্থেই নিজ থেকে উত্থিত দার্শনিক যার কোন প্রাতিষ্ঠানিক একাডেমিক শিক্ষা ছিল না । তিনি অন্যান্য অনেক প্রতিভাবান ব্যক্তির মত শিক্ষা লাভের জন্য কোন স্কুলে যাননি । তিনি জন্মেছিলেন বাংলা ১৩০৭ (১৯০০ খ্রিঃ) সালের ৩রা পৌষ তারিখে, বরিশাল সদর থেকে ১১ কি. মি. দূরে অবস্থিত চরবারিয়া ইউনিয়নের ভেতর লামছরি গ্রামে। তার বাবা ছিলেন জমিজমাহীন এক দরিদ্র কৃষক ।

বাল্যের কথা তিনি এভাবে স্মরণ রেখেছেন ‘চার বৎসর বয়সের সময় বিত্তহীন অবস্থায় রাখিয়া পিতা ‘এন্তাজ আলী মাতুব্বর’ সাহেব পরলোক গমন করেন (১৯০৪) । বিত্তহীনা বিধবা মাতা রবেজান আমাকে অতিকষ্টে প্রতিপালন করেন ।’ পিতার মৃত্যুর পর চার বছর বয়সী আরজ ও তার ছোট বোন নিয়ে গড়া সংসারের দায়ভার মাকেই বহন করতে হয়েছিল । গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মত ১৯১০ সালে স্থানীয় জমিদারের গোমস্তা খাজনা দিতে না পারায় সামান্য যে জমি পরিবারটির ছিল তা আত্মসাৎ করে, ফলে পরিবারটি ভিখিরিতে পরিণত হয় । কিন্তু এতেও নিস্তার নেই, স্থানীয় এক কুসীদজীবীর কাছ থেকে নেওয়া ঋণের টাকা শোধ করতে না পারায় বাস্তভিটাটিও পরিবারের হাতছাড়া হয়ে যায়, তবে দয়া করে পরিবারটিকে ঘরে বাস করতে দেওয়া হয় ৷

গ্রামে কোন স্কুল না থাকায় এবং দূরের কোন স্কুলে পড়ানোর সঙ্গতি না থাকায় ছোটবেলায় আরজ আলী কোন শিক্ষা লাভ করতে পারেনি। উপরন্তু ছোটবেলা থেকে মার সাথে থেকে তাকে পরিবারের অনেক দায়িত্ব পালন করতে হয়েছিল । বাল্যকালের শিক্ষাগ্রহণ সম্পর্কে মাতুব্বর সাহেব পরবর্তীকালে বলেছেন, ‘দূর সম্পৰ্কীয় এক চাচা দুই আনা মূল্যে একখানা ‘আদর্শলিপি’ বই কিনিয়া দিয়া আমাকে স্থানীয় পাঠশালায় ভর্তি করাইয়া দেন।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘আদর্শলিপি পাঠ শেষ করিয়া রামসুন্দর বসাকের ‘বাল্যশিক্ষা’ পাঠ আরম্ভ করিয়াছি, এমত সময় ছাত্রবেতন অনাদায়হেতু পাঠশালাটি বন্ধ হইয়া যায় এবং আমার পাঠশালার শিক্ষা সেখানেই চিরতরে বন্ধ হয় । অতঃপর স্থানীয় এক মুন্সি সাহেবের কাছে কোরান শরীফ, রাহে নাজাত ও পাঞ্জেনামা কেতাবের কিছু পড়ার সুযোগ লাভ করি ।’

এরপর থেকেই জীবন যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়া এই মানুষটি গ্রহণ করেন এক দীর্ঘমেয়াদী স্বচেষ্টায় শিক্ষা লাভের কর্মসূচি । গ্রন্থাগার থেকে, ব্যক্তির কাছ থেকে বই ধার নিয়ে চলে শিক্ষা ও জ্ঞানের সাধনা । এর পেছনে ছিল কিশোর আরজ আলীর অদম্য জ্ঞানতৃষ্ণা । এ প্রসঙ্গে তার নিজস্ব বক্তব্য,

‘আশৈশব প্রবল ছিল আমার অজানাকে জানার স্পৃহা। বিশেষত প্ৰকৃতি সম্পর্কে । মুন্সি সাহেবকে সময় সময় প্রশ্ন করিতাম— দিন-রাত, জোয়ার-ভাটা, শীত-গ্রীষ্ম হয় কেন ইত্যাদি । উত্তর যাহা পাইতাম মনোপুত হইত না । অথচ নিজেও সমাধান করিতে পারিতাম না বলিয়া অশান্তি বোধ করিতাম ।’

অনেক কষ্টে পিতার তিনবিঘা দায়বদ্ধ জমি মুক্ত করে সংসার ব্যয় পরিচালনার জন্য নিজ হাতে কৃষিকাজ শুরু করেন এবং অচিরেই একজন দক্ষ কৃষকে পরিণত হন । পাশাপাশি কঠোর শ্রম করে মাতুব্বর ধীরে ধীরে কিছু কিছু জমি ক্রয় করে পরিবারের স্বচ্ছলতা আনেন- আর সামান্য বাড়তি টাকা দিয়ে বই কিনতেন । সংসারের ব্যয়ভার লাঘবের উদ্দেশ্যে তিনি পুঁথি ও সারি গানের দল গঠন করে গান গাওয়া শুরু করেন । এ বিষয়ে জ্ঞানার্জনের নিমিত্ত মৌলভি-মুন্সিদের কাছে কোরান, হাদিস, কেয়াস, ফেকাহ ইত্যাদি সম্পর্কে শিক্ষাগ্রহণ এবং পুরুত ব্রাহ্মণদের নিকট থেকে বেদ পুরাণ গীতা রামায়ণ মহাভারতের কাহিনী ইত্যাদি বিষয়ে জ্ঞান লাভ করেছিলেন । কিন্তু মোল-াদের তিরস্কার ও বিরোধীতায় গানের দলের অবলুপ্তি ঘটাতে হয় । অতঃপর তিনি ‘ভূমি সংক্রান্ত মাপ জোকে’ দক্ষতা অর্জনের লক্ষ্যে জমি ‘সার্ভে’ অর্থাৎ আমিনি শিক্ষা গ্রহণ করেন (১৩৩৩ সন), এছাড়া তার নিজের ভাষায় ‘… পরিবারের বস্ত্রাভাব মিটাইবার জন্য শিক্ষা করি বস্ত্রবয়ন (১৩৩৬)।’ অচিরেই জমির দক্ষ আমিন হিসেবে মাতুব্বরের খ্যাতি সমগ্র বরিশাল জেলায় ছড়িয়ে পড়ে এবং এই পেশা তাকে এন দেয় অনেকখানি আর্থিক সচ্ছলতা ।

এভাবেই জীবন যুদ্ধে জয়ী এই মানুষটি শুধু ক্ষুধা ও দারিদ্রকেই প্রাস্ত করেননি হয়ে উঠলেন একজন আলোকময় মানুষ, আর নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করলেন একজন যুক্তিবাদী ইহজাগহতিক দার্শনিক হিসেবে । ১৯৮৫ সালে মৃত্যুকালে সারা বাংলাদেশে তিনি পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন এমন একজন সাহসী মানুষ হিসেবে যিনি আজন্ম গ্রোথিত অন্ধ বিশ্বাস ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে— যা থেকে সহজেই মৌলবাদের উত্থান ঘটে, কথা বলতে ভয় পেতেন না । সব ধরনের কুসংস্কার ও ধর্মান্ধতা, অন্ধবিশ্বাস ইত্যাদির শেকড় উপড়ে ফেলতে সর্বাত্মক আঘাত করাকে আরজ আলী তার জীবনের ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন- যার মধ্যে দিয়ে তিনি চেয়েছিলেন সাধারণ মানুষের মধ্যে বিজ্ঞান চেতনা ও ধর্মানুভূতির চমৎকার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা । তার বক্তব্যের মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষের ধর্মানুভূতিতে আঘাত দিতে চাননি, চেয়েছিলেন তাদের মন থেকে ধর্মান্ধতা ও কুসংস্কারকে মুছে দিতে, অন্ধ বিশ্বাসের অন্ধকার থেকে যুক্তিবাদের আলোতে নিয়ে আসতে। কাজটি নিঃসন্দেহে অতিমানবিক বিশেষ করে যে সমাজে নেই শিক্ষার আলো । তার ভাষা ছিল সরল সোজা, অলঙ্কার বিবর্জিত, যা কিনা সাধারণ মানুষের কাছে সহজবোধ্য ।

জ্ঞানচর্চার সাধনা অব্যাহত রেখেছিলেন আজীবন এই মাটির কাছাকাছি থাকা স্বশিক্ষিত মানুষটি। এ কারণেই বরিশাল শহরে বহু জ্ঞানবান মানুষের সান্নিধ্যে এসেছিলেন ও তাদের সাথে গড়ে উঠেছিল অটুট বন্ধতত্ত্ব । তাদেরই উৎসাহে আরজ আলী শুরু করেন তার উপলব্ধ জ্ঞানের ওপর বই লেখা । লেখা শেষ করেন প্ৰথম ও তার শ্রেষ্ঠতম দার্শনিক পুস্তক ‘সত্যের সন্ধান’ বাংলা ১৩৫৯ সালে (১৯৫২)। কিন্তু অচিরেই এ ধরনের পুস্তক লেখার অপরাধে তাকে কারাবন্দি করা হয়, পুস্তকটি প্রকাশনা থেকে তাকে বিরত রাখা হয় । বাংলাদেশ স্বাধীন হলে মুক্ত বাতাসে তিনি মুক্তির নিঃশ্বাস নিতে সমর্থ হন, এবং দীর্ঘকাল পর ১৯৭৩ সালে ‘সত্যের সন্ধান’ প্রকাশিত হয়। ধর্মীয় সংরক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী লেখার কারণে সারা জীবন তাকে হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে । তার আর দুটি গুরুত্বপূর্ণ রচনা হল ‘সৃষ্টি রহস্য’, রচনা কাল ১৯.৪.১৩৭২-২৫.৪ ১৩৭৭. প্ৰকাশকাল ১৩৭৮ (১৯৭১) এবং ‘অনুমান’, রচনা কাল ১৩.৪.১৩৮৮-৮.৩.১৩৮৯ ও প্রকাশকাল ১৩৯০ (১৯৮৩)।

মৃত্যুর আগে তিনি তার চোখ দুটি ও নশ্বর দেহকে ঢাকা মেডিকেল কলেজকে দান করে গিয়েছিলেন একাডেমিক গবেষণার উদ্দেশ্যে । বাংলা ১৩৯২ (১৯৮৫) সালের ১লা চৈত্র তারিখে এই ক্ষণজন্মা মানুষটি মৃত্যুবরণ করেন ।

 

যে ঘটনা আরজ আলীকে যুক্তিবাদের পথে ঠেলে দেয়

কৌতূহলী পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে সাধারণ মানুষ আরজ আলীর জীবনে এমন কি ঘটেছিল যা তাকে আর পাঁচজন সাধারণ মানুষের চলার পথ থেকে তাকে সেকুলার যুক্তিবাদী দর্শনের পথে চালিত করল । সব বড় মানুষের জীবনেই হয়তো এ ধরনের কিছু ঘটনা ঘটে যেখান থেকে তারা এক ব্যক্তিক্রমী পথে চলতে শুরু করেন । গৌতম বুদ্ধ নির্বাচনের খোঁজে পথে নামার আগে দেখেছিলেন অসহায় জরাগ্রস্ত মানুষের যন্ত্রণা, মৃত মানুষের শোকে মানুষের অসহায় ক্রন্দন রোগে যন্ত্রণাবিদ্ধ মানুষের অসহায়ত্ব…। আরজ আলীর জীবনেও ঘটেছিল এমনই এক মর্মন্তুদ ঘটনা । আপাত দৃষ্টিতে ঘটনাটি অনেকের কাছে সামান্য মনে হলেও তরুণ আরজ আলীর জীবনে তা অসামান্য হয়ে দেখা দেয় ।

বাংলা ১৩৩৯ সালে (১৯৩২) আরজ আলীর মা মৃত্যুবরণ করলে ভালবাসার মানুষটির স্মৃতি ধরে রাখতে মৃত মায়ের কয়েকটি ছবি তুলিয়েছিলেন শহর থেকে আনা ফটোগ্রাফার দিয়ে। এতে বিক্ষুব্ধ গ্রাম্য টাউট-মাতব্বরেরা ও মৌলভীরা ফতোয়া দেন যে, মৃত ব্যক্তির বিশেষ করে জেনানার ছবি তোলা হারাম, এবং এ কারণে মৃতের জানাজায় শরীক হতে ও ইসলামী রীতি মোতাবেক শেষকৃত্যদাফন- কাফন করায় তারা আপত্তি জানায় । হতবুদ্ধি তরুণ আরজ আলী মাতব্বরদের কাছে মিনতির সুরে আবেদন জানায়- অন্যায় যদি হয়ে থাকে তিনি করেছেন, তার ধর্মনিষ্ঠ মৃত মা তো কোন পাপ করেন নি- ছেলের অপরাধে মৃত মাকে শাস্তি দেওয়া কেন । কিন্তু মোল-া পুরুতেরা কবে কখন যুক্তির কথা শুনেছেন? দলপতিরা ফতোয়া ঘোষণা করে স্থান ত্য্যাগ করেছিলেন । অনেক দুঃখ ও কষ্ট মনে ধারণ করে দু’একজন বন্ধুর সহায়তায় ইসলামী রীতি নীতি ও শেষকৃত্য ছাড়াই বাস্তুভিটার অঙ্গনেই মাকে সমাধিস্থ করা হয় । এই মর্মান্তিক ঘটনাই তাকে ধর্ম সম্পর্কে নতুন করে ভাবতে অনুপ্রাণিত করে, কালক্রমে তিনি হয়ে ওঠেন আমাদের কালের একজন শ্রেষ্ঠ যুক্তিবাদী ইহজাগতিক দার্শনিক । এই মর্মান্তিক ঘটনার কথা তিনি পরবর্তীকালে এভাবে স্মৃতিতে ধারণ করেছিলেন : “১৩৩৯ সালে মার মৃত্যু হলে তার ছবি তুলেছিলাম । সেখানে মার দাফনের জন্য সমবেত মুন্সি, মৌলানা ও মুসল-ীবৃন্দ ফতোয়া জারী করলেন যে, ছবি তোলা হারাম । এ কথা বলে তারা চলে গেলেন, জানাজা ও দাফন শেষ না করেই । হতবুদ্ধি আমি মায়ের নামে শপথ নিয়ে মাকে উদ্দেশ্য করে মনে মনে বলেছিলাম, ‘মা! আজীবন তুমি ছিলে ইসলাম ধর্মের একনিষ্ঠ সাধিকা । তুমি কখনো নামাজ কাজা করনি, কখনো তছবিহ তেলাওয়াত ও তাহাজ্জুদ নামাজে গাফিলতি কর নি । আর আজ সেই ধর্মের দোহাই দিয়ে একদল মুসলি- তোমাকে করতে চাইল শেয়াল কুকুরের ভক্ষ্য, তাদের কাছে হলে তুমি তুচ্ছ, অবহেলিতা ও বিবর্জিতা, হলে নিন্দা ও ঘৃণার পাত্রী । সমাজে আজ সর্বত্র বিরাজ করছে ধর্মের নামে ‘কুসংস্কার’ । তুমি আমায় আশীর্বাদ কর— আমার জীবনের ব্রত হয় যেন ‘কুসংস্কার দূরীকরণ অভিযান’ । আর সে অভিযান সাৰ্থক করে আমি যেন তোমার কাছে আসিতে পারি”:

“তুমি আশীর্বাদ কর, মোরে মা,

আমি যেন বাজাতে পারি

সেই ‘অভিযানের দামামা ৷’

মাতার প্রতি অন্ধ সমাজের আবমাননাই এই সরল কৃষক বালককে জ্ঞান সাধনায় অদম্য করে তোলে, তাকে পরিণত করে একজন লোকায়ত দার্শনিকে ও বিজ্ঞানমনস্ক আধুনিক মানুষে । মার এ অবদানের কথা তিনি আজীবন মনে রেখেছেন, “… আমার লিখিত যাবতীয় পুস্তক পুস্তিকাই হচ্ছে আমার মায়ের মৃত্যুদিনে আকাঙ্ক্ষিত ‘দামামা’র অঙ্গবিশেষ ।

 

প্রকাশনা

তার প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থের বিষয় ছিল ইসলাম সম্পর্কে সাধারণ একজন বিশ্বাসী মুসলমান বিনা প্রশ্নে মেনে নিয়ে থাকে সে সব বিষয় সম্পর্কে তার চিন্তাধারা ও গভীর অনুধ্যান-অনুশীলন । গ্রন্থটির নাম :

সত্যের সন্ধান (লৌকিক দর্শন)

রচনাকাল : ১৩৫৯ সন (১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দ)

প্রথম প্রকাশ কাল : ১৩৮০ সন (১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দ)

দীর্ঘ বিশ বছরেরও বেশি সময় লেগেছিল প্রকাশ করতে। তার অপ্রথাগত ও খোলামেলা লেখার জন্য তিনি তার সামাজিক পরিমণ্ডলে খ্যাত হয়েছিলেন মুক্তচিন্ত াবিদ হিসেবে, গ্রামের সমাজে তিনি পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন ‘সত্য সন্ধানী’ নামে । সমাজে তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল মুক্তমনের অধিকারী একজন জ্ঞান সাধক হিসেবে । কিন্তু এই খ্যাতি বয়ে আনল তার জন্য বিড়ম্বনা, তার প্রতি কোপ দৃষ্টি নিপতিত হল পাকিস্তানি শাসক আর গোয়েন্দা বিভাগের । পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসন নানাভাবে তাকে হয়রানি ও উত্যক্ত করে তুলল তার সরল জীবন । এক সময় তাকে কারারুদ্ধ করাও হল । পাকিস্তানিদের দৃষ্টিতে তিনি অভিহিত হলেন ‘অধার্মিক ও কম্যুনিস্ট’ ।

অবশেষে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে তিনি ভাবলেন যে এখন সময় এসেছ তার পুস্তকটি প্রকাশের, যা এতদিন অনেক কষ্টে রক্ষা করে আসছিলেন । নিজে অঙ্কন করলেন প্রচ্ছদ, কোন পেশাজীবী চিত্রশিল্পীর কাছে যেতে সাহস করেননি, আর নিজ অর্থব্যয়ে প্রকাশ করলেন গ্রন্থটি । মুখবন্ধে লিখলেন,

‘এলোমেলোভাবে মনে যখন যে প্রশ্ন উদয় হইতেছিল, তখন তাহা লিখিয়া রাখিতেছিলাম, পুস্তক প্রণয়নের জন্য নহে, স্মরণার্থে। ওগুলি আমাকে ভাসাইতেছিল অকুল চিন্তা-সাগরে এবং আমি ভাসিয়া যাইতেছিলাম ধর্মজগতের বাহিরে ।’

বইটি লেখার পেছনে ছোট্ট একটি ঘটনা রয়েছে । ১৩৫৮ সালের জ্যৈষ্ঠ মাসের পহেলা তারিখে (১৯৫১) বরিশাল থেকে জনৈক ল’ইয়ার মেজিস্ট্রেট আরজ আলীর গ্রামে গিয়েছিলেন এবং তাকে তার তবলীগের দলে যোগ দিতে আমন্ত্রণ করেছিলেন । আরজ আলী তার হাতে একপ্রস্থ প্রশ্নাবলী গছিয়ে দিয়ে বলেছিলেন যে তিনি তার দলে যোগ দেবেন যদি মেজিস্ট্রেট সাহেব তার প্রশ্নগুলির সন্তোষজনক জবাব দিতে পারেন । মেজিস্ট্রেট প্রশ্নতালিকা নিয়ে শহরে প্রত্যাবর্তন করে আরজ আলীর নামে ধর্মদ্রোহিতার মোকদ্দমা দায়ের করে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন । মোকদ্দমা চলাকালে আত্মরক্ষার স্বার্থে তিনি যেসব প্রশ্ন মেজিস্ট্রেটের কাছে উত্থাপন করেছিলেন সেগুলোর উত্তর ও ব্যাখ্যা লিখতে শুরু করেছিলেন ।

‘ফৌজদারী মামলার জবাবদিহি করিবার উদ্দেশ্যে আমাকে প্রশ্নগুলির কিছু বাক্য লিখিতে হয় ।’ বলেছেন আরজ আলী মাতুব্বর, –সেই ব্যাখ্যা লিখাই হইল এই পুস্তক রচনার মূল উৎস । নির্দোষ প্রমাণে মামলা চূড়ান্ত হইলে ঐগুলিকে আমি পুস্তক আকারে গ্রন্থিত করিলাম ।’

তিনি কেন কতগুলি ‘তথাকথিত সত্য’ বা ধর্মীয় নীতি সম্পর্কে প্রশ্ন তুলেছিলেন সে সম্পর্কে আরজ আলী ব্যাখ্যা দিয়েছেন । পুস্তকটির ‘মূলকথা’ শিরোনামের প্রথম অধ্যায়ে প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন,

‘অজানাকে জানার স্পৃহা মানুষের চিরন্তন । বাক্যস্ফূরণ আরম্ভ হইলেই শিশু প্রশ্ন করিতে থাকে, এটি কি? ওটি কি? বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে স্কুলে কলেজে ও কাজে-কর্মে অনুরূপ প্রশ্ন চলিতে থাকে, এটি কি? ওটি কি? এরূপ কেন হইল, ওরূপ কেন হইল না ইত্যাদি। এই রকম ‘কি’ ও ‘কেন’র অনুসন্ধান করিতে করিতেই মানুষ আজ গড়িয়া তুলিয়াছে বিজ্ঞানের অটল সৌধ।

প্রশ্নকর্তা সকল সময়ই জানিতে চায়— সত্য কি? তাই সত্যকে জানিতে পারিলে তাহার আর কোন প্রশ্ন থাকে না ।’ তিনি আরও বলেছেন,

জগতে এমন বিষয় আছে, যেসব বিষয়ে দর্শন, বিজ্ঞান ও ধর্ম এক কথা বলে না । আবার ধর্মজগতেও মতানৈক্যের অন্ত নাই । … … , অর্থাৎ সত্যতা বিচারের মাপকাঠি (Criterion of truth) কি? সত্যতা প্রমাণের উপায় (Test of truth) কি এবং সত্যের রূপ (Nature of truth) কি?

আমরা ঐ সকল দুরূহ দার্শনিক তত্ত্বের অনুসন্ধানে প্রবিষ্ট হইব না, শুধু ধর্মজগতের মতানৈক্যের বিষয় সামান্য কিছু আলোচনা করিব ।’

আরজ আলী বলেছেন যে, বিশ্বমানবের একটি সহজাত বৃত্তি রয়েছে যাকে তার ‘স্বভাবধর্ম’ বলা যেতে পারে । তবে এটিই সব নয় । তার মতে সাধারণভাবে মানুষ যাকে ধর্ম নামে ভাবে, অভিহিত করে থাকে তা হল মানুষের ‘কল্পিত ধর্ম’ । এ প্রসঙ্গে তার বক্তব্য হল,

. যুগে যুগে মহাজ্ঞানীগণ এই বিশ্বসংসারের স্রষ্টা ঈশ্বরের প্রতি মানুষের কর্তব্য কি তাহা নির্ধারণ করিবার প্রয়াস পাইয়াছেন । … তাহারা তাহা নির্ধারণ করিয়া দিলেন । অধিকন্তু মানুষের সমাজ ও কর্মজীবনের গতিপথও দেখাইয়া দিলেন সেই মহাবিজ্ঞানীগণ । এইরূপে হইল কল্পিত ধর্মের আবির্ভাব । কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন মনীষী বা ধর্মগুরুদের মতবাদ হইল ভিন্ন ভিন্ন ।’

তিনি আমাদের অঙ্গুলি নির্দেশ করে বরং দেখিয়ে দিয়েছেন যে সকল ধর্মের যাজক ও পুরোহিতেরা তাদের নিজ নিজ ধর্মই একমাত্র সত্যধর্ম বলে প্রচার করে থাকেন । তিনি আরও বলেছেন যে এত মতবিরোধ থাকা সত্ত্বেও কোন ধর্মই কিন্তু বিলুপ্ত হচ্ছে না । এর কারণ হিসেবে তিনি বলতে চান,

‘রাষ্ট্রের ন্যায় ধর্মসমূহের আয়ত্তে তোপ-কামান-ডিনামাইট বা এ্যটম বোম নাই, যারা দ্বারা একে অন্যের ধ্বংস সাধন করিতে পারে । ধর্মের হাতে আছে মাত্র দুটি অস্ত্র- আশীর্বাদ ও অভিশাপ । এহেন অস্ত্রসমূহ ব্যক্তিবিশেষের উপর ক্রিয়াশীল কিনা, জানি না, কিন্তু কোন সম্প্রদায় বা জাতির উপর একেবারেই অকেজো ।’

আরজ আলী মনে করেন যে ‘প্রত্যক্ষ ও অনুমানের’ উপর ভিত্তি করেই জ্ঞানের পথে অগ্রসর হওয়া সম্ভব। এ প্রসঙ্গে তার স্পষ্ট বক্তব্য হল, ‘বিজ্ঞান প্রত্যক্ষ ও অনুমানের উপর প্রতিষ্ঠিত । তাই কোন বৈজ্ঞানিক তত্ত্বে আমাদের সন্দেহ নাই । বিজ্ঞান যাহা বলে, তাহা আমরা অকুণ্ঠিত চিত্তে বিশ্বাস করি । কিন্তু অধিকাংশ ধর্ম এবং ধর্মের তথ্য অন্ধবিশ্বাসের উপর প্রতিষ্ঠিত ।’

ইহজাগতিকতার ধারণা তার অন্তরে গভীরভাবে প্রোথিত । অলৌকিক কোন বিষয়ে তার আস্থা নেই । আল-ার উদ্দেশ্যে মহাশূন্য ভ্রমণের নবীদের অলীক কাহিনীতে বিশ্বাস রাখা তার পক্ষে শক্ত। এ প্রসঙ্গে তিনি যৌক্তিক প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন যে, যেহেতু আল্লাহতালা সর্বশক্তিমান এবং সব অসম্ভবের বাস্তবায়নক্ষম, তাহলে তিনি তো হযরত সোলায়মান নবীর মত নিজ আসনে বসিয়ে যে কোন পরমভক্ত ও বিশ্বাসী অভিলাষকারীকে শূন্যের ভেতর দিয়ে যাতায়াত করাতে পারেন, যান জটের যুগে পীর সাহেবদের জন্য এতো চমৎকার নিখরচায় পরিবহণ ব্যবস্থা । এই সব ভক্তদের উদ্দেশ্যেই আরজ আলী প্রশ্ন রেখেছেন, আল্লাহতালা ইচ্ছা করিলে জায়নামাজশুদ্ধ আমাকেও নিমেষের মধ্যে মক্কায় পৌছাইতে পারেন- এইরূপ বিশ্বাস কোন কোন পীর ছাহেবের আছে কি? থাকিলে একবারও তাহা পরীক্ষা করিয়া দেখিয়াছেন কি? না দেখিয়াই বা উড়োজাহাজ চড়িবার কারণ কি? উড়োজাহাজে চড়িবার বিপদ আছে, ভাড়া আছে, আর সময়ও লাগে যথেষ্ট । তবুও উহার উপর জন্মিয়াছে বিশ্বাস ।’

তিনি এক জায়গায় বলছেন, ‘ধর্মজগতে এমন কতকগুলি বিধি-নিষেধ, আচার-অনুষ্ঠান ও ঘটনাবলীর বিবরণ পাওয়া যায়, যাহার যুক্তিযুক্ত কোন ব্যাখ্যা সাধারণের বোধগম্য নহে । তাই সংতই মনে কতগুলি প্রশ্ন উদয় হয় এবং সেই প্রশ্নগুলির সমাধানের অভাবে ধর্মের বিধি-বিধানের উপর লোকের সন্দেহ ও অবিশ্বাস জন্মে ।’

এভাবেই আরজ আলীর মনে ধর্মের অনেক সাধারণ ঘটনা যা আমরা সাধারণেরা বিনা প্রশ্নে মেনে নিতে অভ্যস্ত হয়েছি তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন আর অনুসন্ধিৎসার পাহাড় সৃষ্টি করেছেন আমাদের জিজ্ঞাসায় ও মননে । এভাবেই তিনি সাধারণের মন থেকে অন্ধ বিশ্বাসের ও কুসংস্কারের স্থানে আনতে চেয়েছেন যুক্তি ও বিজ্ঞানকে । এর পরেই তিনি ধর্মজগৎ নিয়ে সাধারণের মনে সতত জাগ্রত প্রশ্নগুলি উত্থাপন করেছেন চমৎকার ভঙ্গিতে সাধারণ মানুষের পক্ষ থেকেই । তার প্রথম পুস্তক ‘সত্যের সন্ধানে’র মধ্য দিয়ে, আমার ধারণায়, আরজ আলী মাতুব্বরের মৌলিক যুক্তিবাদী দর্শনের সম্যক প্রকাশ ঘটেছে । এই দর্শন একজন জিজ্ঞাসু মানুষের কতিপয় মৌলিক এবং প্রাসঙ্গিক অনুসন্ধিৎসার সাথে সংশি-ষ্ট যা এই জিজ্ঞাসু মানুষটিকে তার জীবন সম্পর্কে, তার ধর্ম সম্পর্কে, এবং সর্বোপরি তার সৃষ্টিকর্তা ও সৃষ্টি সম্পর্কে প্রবলভাবে আলোড়িত করে । তার বইটি ছয়টি প্রস্তাবে বিভক্তঃ ১মটি আত্মাকে নিয়ে ৮টি প্রশ্ন, ২য়টির আলোচ্য ১১টি প্রশ্নের সমষ্টি মূলত ঈশ্বর ও আল-াহকে নিয়ে, ৩য়টি হল পরলোক সম্পর্কীয় ৭টি প্রশ্ন নিয়ে, ৪র্থ প্রস্তাবের ২২টি প্রশ্ন সমষ্টি ধর্মের নানা বিষয়কে কেন্দ্র করে আবর্তিত, ৫ম প্রস্তাবের বিষয় হল প্রকৃতি, মানুষ, জীব, আকাশ, পৃথিবী, সূর্য, ভূমিকম্প, দিন রাত্রি… ইত্যাদি বিষয়কে ঘিরে ১১টি প্রশ্নসমষ্টি, ৬ষ্ঠ বা শেষ প্রস্তাবে রয়েছে বিবিধ জিজ্ঞাসা ৯টি প্রশ্নের আকারে । বলাই বাহুল্য, আমাদের দার্শনিকের এই চিত্তাকর্ষক প্রশ্নগুলি নিয়ে বিশদ আলোচনার অবকাশ এই প্রবন্ধে নেই । তবুও দু’একটি প্রশ্নের উপর, যেমন প্রথম প্রস্তাবে উলি-খিত, দৃকপাত করা যেতে পারে : আমি কে, প্ৰাণ কি অরূপ না স্বরূপ, মন ও প্রাণ কি এক, প্রাণের সহিত দেহ ও মনের সম্পর্ক কি, প্রাণ চেনা যায় কি, আমি কি স্বাধীন, অশরীরী আত্মার কি জ্ঞান থাকবে, প্রাণ কিভাবে দেহে আসা-যাওয়া করে?

বস্তুগত দৃষ্টি থেকে প্রতিটি প্রশ্ন বেশ গুরুত্বপূর্ণ । প্রথম প্রশ্নটি শুধু কেবল অনুসন্ধিৎসু দার্শনিকদের আলোড়িত করে না, বিজ্ঞানীদেরও করে, বিশেষ করে জীব বিজ্ঞানীদের । প্রাণের রহস্য নিয়ে আমাদের পরিপূর্ণ উত্তর আজও জানা নেই, কিন্তু সকল গুরুত্বপূর্ণ ধর্ম মনে করে এই ‘উত্তর’ তাদের জানা । ধর্মবাদীদের এই আত্মশাঘাকেই মাতুব্বর সরাসরি চ্যালেঞ্জ করেছেন। তাঁর এই প্রশ্নটির বিশদ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেছেন যে আমাদের শরীরে রয়েছে রক্ত, মাংস, চর্বি ইত্যাদি বস্তু উপাদান এবং মৃত্যুর পর এসব জড় উপাদানগুলি যখন রাসায়নিক রূপান্তরের মাধ্যমে জড় উপাদানে পরিণত হয় তখন, “কি আমার আমিত্ব থাকিবে না? যদি নাই থাকে, স্বর্গ-নরকের সুখ-দুঃখ ভোগ করিবে কে? নতুবা ‘আমি’ কি আত্মা? যদি তাহাই হয়, তবে আত্মাকে ‘আমি’ না বলিয়া ‘আমার’– ইহা বলা হয় কেন?’ মাতুব্বর প্রশ্ন তুলেছেন, ‘যখন কেহ দাবি করে যে, দেহ আমার, প্রাণ আমার এবং মন আমার, তখন দাবিদারটি কে?’ সত্যি বলতে কি ধর্মবাদীদের কাছে এর কোন সন্তোষজনক জবাব পাওয়া অতীতেও যায়নি, ভবিষ্যতেও যাবে না ।

‘আত্মার’ স্বরূপ নিয়েও আমাদের দার্শনিক কৌতূহলি প্রশ্ন রেখেছেন । সব ধর্মেই আত্মাকে একটি ‘অবিনশ্বর সত্তা’ রূপে, যাকে ভৌত জগতের উপাদানে সৃষ্টি করা যায় না, কল্পনা করা হয়েছে, এমনকি দর্শনেও । ধারণা করা হয় যে, যখন মহান সৃষ্টিকর্তা বস্তুময় দেহে এই আত্মা স্থাপন করেন তখন শরীরে প্রানের সঞ্চার হয়। কিন্তু মূল প্রশ্ন হল তাহলে, আত্মা কি একটি চৈতন্যময় সত্তা, না কি চেতনাহীন? আরও প্রশ্ন রয়েছে আত্মার কি নিজস্ব জ্ঞান আছে, নাকি দেহের পাঁচটি ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে জ্ঞান আহরণ করে থাকে? সুতরাং মৃত্যুর পর, পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের ধ্বংস সাধনের পরও “শরীর ও ইন্দ্রিয়বিহীন আত্মার জ্ঞান থাকিবে কি? থাকিলে কিরূপে থাকিবে?” –আমাদের দার্শনিক প্রশ্ন রেখেছেন । এ ধরনের বিব্রতকর প্রশ্নে আমাদের বড় বড় ধর্মগুলি নিশ্চুপ ।

আমরা যদি সজ্ঞানী ও চৈতন্যময় আত্মায় প্রত্যয় রাখি তাহলে আমাদের বিশ্বাস করতে হবে যে, গড়, ঈশ্বর বা আল্লাহর মত আত্মাও সর্বজ্ঞ । অন্যদিকে আমরা যদি ধরে নিই যে, আত্মার কোন চেতনা নেই শরীরে অবস্থান কালে বা অশরীরী অবস্থায়, তাহলে এ ধরনের ব্যবহারহীন একটি নিরাসক্ত সত্তার প্রয়োজনীয়তা কোথায়? এ প্রসঙ্গে আমার একটি গল্পের কথা মনে পড়ে গেল । একদিন এক ষাটোর্ধ্ব অনুসন্ধিৎসু ভদ্রলোক প্রখ্যাত বেদান্ত দার্শনিক শহীদ অধ্যাপক পণ্ডিত গোবিন্দ চন্দ্র দেবকে বিনয়ের সাথে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “স্যার আপনি কি মনে করেন আত্মা চৈতন্যময়?’ বিজ্ঞ দার্শনিক ইতিবাচক উত্তর দিলে উক্ত ভদ্রলোকের পুনরায় জিজ্ঞাসা, ‘তাহলে স্যার, আত্মা কি যৌন মিলনে অংশগ্রহণ করে, এবং মিলনে সুখ ও চরম পুলকানন্দ অনুভব করে থাকে?’ বলাই বাহুল্য পণ্ডিত দেব যতপরোনাস্তি বিরক্ত হয়েছিলেন এবং প্রশ্নকারীকে ‘দেহাত্মবাদী’ বলে তীব্র ভর্ৎসনা করেছিলেন ।

আমি মাতুব্বরের আর দু’একটি প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা করব মাত্র এবং এর মাধ্যমে দেখাবার চেষ্টা করব আমাদের আলোচ্য দার্শনিকের বিশে-ষণী মন কীভাবে ক্রিয়া করে । আমরা সত্যিই বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে যাই যখন তার সামাজিক পটভূমি ও পারিপার্শ্বিকতা বিবেচনায় রাখি । তার পুস্তকটির ২য় প্রস্তাবে তিনি আল্লাহতালার প্রকৃতি ও রূপ নিয়ে আলোচনা তুলেছেন। এটি একটি ভয়ঙ্কর বিপদজ্জনক ও স্পর্শকাতর বিষয় যখন আমরা আমাদের সমাজে বিরাজমান ধর্মীয় উন্মাদনার কথা মনে আনি । প্রশ্নটি হলঃ আল্লাহর রূপ কি ?

আরজ আলী প্রশ্নটির আরও বিশদ ব্যাখ্যায় গিয়ে বলেন, সর্বধর্মমতানুসারে যদি সৃষ্টিকর্তা ‘অদ্বিতীয়, নিরাকার এবং সর্বব্যাপী’ হয়ে থাকেন তাহলে তো বিষয়টি বেশ সহজ ও সরল । ‘কিন্তু যখন হিন্দুদের মুখে শোনা যায় যে, সৃষ্টি পালনের উদ্দেশ্যে ভগবান মাঝে মাঝে সাকারও হইয়া থাকেন ও যুগে যুগে অবতারূপে পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করিয়া লীলা প্রকাশ করেন’, বলেন মাতুব্বর, “এবং যখন খৃষ্টানদের নিকটে শোনা যায় যে, পরম সত্তা— ‘ভগবান’ মশীহ্, পরমাত্মা— এই ত্রিত্বে প্রকাশ পাইতেছে; আবার যখন মুসলিম ধর্মযাজকদের নিকট শোনা যায় যে, আল্লাহতালা আরশে কুরছির উপর বসিয়া রেজওয়ান নামক ফেরেস্তার সাহায্যে দোজখ, জেব্রাইলের সাহায্যে সংবাদ ও মেকাইলকে দিয়া খাদ্য বন্টন ও আবহাওয়া পরিচালনা করেন— মনে প্রশ্ন জাগিতে থাকে- নিরাকার সর্বশক্তিমান ভগবানের সৃষ্টি পালনে সাকার হইতে হইবে কেন? অদ্বিতীয় ঈশ্বরের মহত্ত্ব প্রকাশে ত্রিত্বের আবশ্যক কি?’ ধর্মবেত্তাদের অবশ্যই এসব বেমক্কা প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর দিতে হবে।

৯ম প্রশ্নটিতে স্থান কাল এবং শক্তির অবতারণা করা হয়েছে । তিনি জানতে চেয়েছেন বিজ্ঞান যাদেরকে স্থান, কাল এবং শক্তি নামে অভিহিত করেছে এ সকল সত্তার অস্তিত্ব কি সবসময় ছিল, নাকি এরা ঈশ্বর সৃষ্ট? যদি এরা ঈশ্বর সৃষ্ট হয়ে থাকে, তাহলে এর আগে ঈশ্বর কোথায় অবস্থান করতেন ‘স্থান’ সৃষ্টির আগে, তিনি কোথায় ছিলেন সময়ের সৃষ্টির পূর্বে? আমাদের দার্শনিক তিনটি সরল প্রশ্নের অবতারণা করেছেনঃ (১) ঈশ্বর কোন স্থানে অবস্থান করে ‘স্থান’ সৃষ্টি করলেন? (২) তিনি কোন মুহূর্তে ‘কাল’ সৃষ্টি করলেন, এবং (৩). তিনি কোন শক্তি বলে ‘শক্তি’ সৃষ্টি করলেন?

সন্দেহ নেই আমাদের ধর্মচর্চাকারী পণ্ডিতদের কাছে এসব বিষয় উত্থাপন বেমক্কা ও ব্রিতকর প্রশ্ন । কিন্তু আমরা জানি তারা ক্রমাগত বলতে থাকবেন যে, সব সমস্যার সমাধান ও এসব প্রশ্নের উত্তর ঐ পবিত্র গ্রন্থগুলিতেই রয়েছে, কেবল কতিপয় ধর্মব্যবসায়ী মেকী বিজ্ঞানীর পুনরাবিষ্কারের অপেক্ষা । ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত ‘সত্যের সন্ধান’ বইটিতে উত্থাপিত প্রশ্নাবলী ছাড়াও তিনি বেশ কিছু সম্পূরক প্রশ্ন পরবর্তীকালে প্রস্তাব করেছিলেন যেগুলি তার অসমাপ্ত পাণ্ডুলিপি থেকে উদ্ধার করা গেছে ৷

 

বিজ্ঞানমনস্ক আরজ আলী মাতুব্বর

তাঁর আর একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ হল ‘সৃষ্টি রহস্য’ যেটির আলোচ্য বিষয় হল সৃষ্টির বিজ্ঞান অর্থাৎ মহাবিশ্ব সৃষ্টির এবং প্রাণ সৃষ্টির কাহিনী । এটি প্রকাশিত হয় ১৯৭৮ সালে । বিজ্ঞান বিষয়ক প্রাচীন সাহিত্য ও আধুনিক বিজ্ঞানের উন্নয় নিয়ে গভীর অনুধ্যায়নের ফসল হল এই জ্ঞানগর্ভ পুস্তকটি— লিখেছেন সরল সুললিত ভাষায় সাধারণ পাঠকের জন্য ।

আরজ আলী কেবল সাধারণ একজন দার্শনিক নন যিনি কেবল জ্ঞানচর্চা করেছিলেন তত্ত্বীয় বিশে-ষণ আর মননশীলতাকে ভিত্তি করে, যা সাধারণ একজন দার্শনিক করে থাকেন ব্যবহারিক বা পরীক্ষণ অভিজ্ঞতা সম্পর্কে সম্পূর্ণ নিরাসক্ত থেকে । কিন্তু মাতুব্বরের ছিল বিস্ময়কর বিজ্ঞান মন এবং তিনি ছিলেন বাস্তববাদী মানুষ (Pragmatic man ) ।

‘সৃষ্টি রহস্যে’ অন্তর্ভুক্ত লেখাগুলি একজন স্বশিক্ষিত বিজ্ঞানীর মননশীলতার ও তার উৎকৃষ্ট বিজ্ঞান মনস্কতার পরিচয় সুন্দর করে তুলে ধরেছে। আমি বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে পড়ি তার পড়ার গভীরতা দেখে- পদার্থবিদ্যা থেকে জীব বিজ্ঞানের আধুনিকতম উন্নতির পর্যায় পর্যন্ত আধুনিক বিজ্ঞানের জটিল তত্ত্ব অবধি পরিব্যাপ্ত । তিনি কেমন করে এসব জটিল বিষয়ের মূল সুরটিকে আত্মস্থ করতে পারলেন, যা কিনা অনেক সময় অনেক গবেষকের কাছেও বোধগম্য হয় না কারণ আমরা বিজ্ঞানীরা এমন এক ভাষায় কথা বলি যা কিনা সহকর্মী বা সহযোগী বিজ্ঞানীরাই বুঝতে পারেন । মাতুব্বর কেবল জটিল বিষয়গুলোকে আত্মস্থ করেননি, তার পাঠকদের ধর্মীয় সামাজিক পটভূমির কথা মনে রেখেই তিনি গ্রন্থটি রচনা করেছেন সুললিত ভাষায় সূক্ষ্মতর বিশদাদি পরিহার করে । তিনি তার গোঁড়া উগ্রপন্থীদের কথা ভুলে যাননি যারা সতত উদ্যত রয়েছে তার উপর ঝাপিয়ে পড়তে । তাই তিনি বিজ্ঞানের তত্ত্বের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য ধর্মপুস্তক উলি-খিত বিবরণের তুলনামূলক কোন বক্তব্য বা প্রস্তাবনা পাঠকের সামনে উপস্থাপন করে সিদ্ধান্ত* টানেনি । সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার সুধী পাঠকের বিবেচনার উপর ছেড়ে দিয়েছেন । এটিই ছিল গ্যালিলিও অনুসৃত শৈলী- সরাসরি মুখোমুখি হওয়া পরিহার করার কৌশল । পুস্তকটির ভূমিকায় তিনি বিনীতভাবে লিখেছেনঃ

‘মানব সমাজে কুসংস্কারের বীজ উত্তপ্ত হইয়াছিল হাজার হাজার বছর পূর্বে । এখন উহা প্রকাণ্ড মহীরূহের আকার ধারণপূর্বক অসংখ্য শাখা প্রশাখা বিস্তার করিয়া এবং ফুলে ফলে সুশোভিত হইয়া বিস্তীর্ণ জনপদ আচ্ছাদিত করিয়া রাখিয়াছে । আর তাহারই কালাতিপাত করিতেছে লক্ষ লক্ষ মানুষ । অতীতে বহু মনীষী কুসংস্কাররূপী মহীরূহের মূলে যুক্তিবাদের কুঠারাঘাত করিয়া গিয়াছেন, যাহার ফলে বহু মানুষ উহার ছায়াতল হইতে বাহির হইয়া দাঁড়াইয়াছে মুক্তমনের খোলা মাঠে আর তরুণ-তরুণীরা ভিড় জমাইতেছে দর্শন-বিজ্ঞানের পুষ্পোদ্যানে ।

এই পুস্তকখানির আদ্যন্ত অভিনিবেশ সহকারে পাঠ করিলে সুধী পাঠকবৃন্দ বিশ্বসৃষ্টি সম্পর্কে মানবমনের ধারাবাহিক চিন্তা গবেষণা ও সর্বশেষ যুক্তিসম্মত মতবাদের বিষয় জানিতে পারিবেন ।

এই পুস্তকখানি প্রণয়নে প্রণেতা হিসেবে তত্ত্বমূলক অবদান আমার কিছু নাই । তত্ত্ব যাহা পরিবেশিত হইয়াছে তাহা সমস্তই সংকলন, আমি সংগ্রাহক মাত্ৰ । ইহা প্রণয়নে আমি যে সমস্ত গ্রন্থের সাহায্য গ্রহণ করিয়াছি, তাহার গ্রন্থাকারগণের নিকট আমি চিরঋণে আবদ্ধ ৷’

তার বৈজ্ঞানিক মনের এবং বৈজ্ঞানিক তথ্য উপস্থাপনের তার চিত্তাকর্ষক পদ্ধতির সাথে পাঠকের কাছে তুলে ধরার জন্য দৃষ্টান্ত হিসেবে বইটিতে দেয়া সূর্য সম্পর্কে কিছু কথা’র উদ্ধৃতি দিতে চাই । বিভিন্ন ধর্ম থেকে কৌতুকাবহ গল্পকথা শুনিয়ে তিনি

* এসব প্রশ্নাবলী ‘ভাবি প্রশ্ন’ (সত্যের সন্ধান : ‘১লা কার্তিক, ১৩৭৯) ও ‘না বুঝের প্রশ্ন’ (সত্যের সন্ধানঃ ১৬ই বৈশাখ ১৩৫৮— ২৯শে ভাদ্র, ১৩৫৯) শিরোনামে পাঠক সমাবেশ প্রকাশিত আরজ আলী মাতুব্বর রচনা সমগ্র-১ সঙ্কলনটি স্থান পেয়েছে।

সূর্য সম্পর্কে আধুনিক তত্ত্বের বর্ণনা দিয়েছেন । সূর্যের গতি সম্পর্কে মুসলিম ধারণার কথা নিয়ে লিখেছেনঃ

‘মুসলমানগণ বলিয়া থাকেন যে, সূর্যের বাহন নৌকা (বোধ হয় যে, ইহা প্ৰাচীন মিশরীয়দের অনুকরণ)। মুসলমানগণ আরও বলিয়া থাকেন যে, চতুর্থ আসমানে একখানা সোনার নৌকায় সূর্যকে রাখিয়া ৭০ হাজার ফেরেশতা সূর্যসহ নৌকাখানা টানিয়া পূর্ব হইতে পশ্চিমে লইয়া যায়। সারারাত সূর্য আরশের নিচে বসিয়া আল্লাহর এবাদত করে এবং প্রাতে পুনরায় পূর্বদিকে উদিত হয় ।’

এ ধরনের বর্ণনার পর তিনি অগ্রসর হয়েছেন সূর্য সম্বন্ধে আধুনিকতম বৈজ্ঞানিক তথ্য পাঠকের উপহার দিতে। আর একটি উদাহরণ টানা যাক— মহাবিশ্ব সৃষ্টি নিয়ে । তিনি বলেছেনঃ

‘সনাতন ধর্মীয় মতে— পৃথিবী বিশ্বের কেন্দ্রে অবস্থিত, যাবতীয় সৃষ্টির মধ্যে বৃহত্তম বস্তুপিণ্ড এবং মানুষ জীবকুলের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ, ঈশ্বরের শখের সৃষ্টি এক বিশেষ জীব । মানুষ ঈশ্বরের শখের সৃষ্টি এক বিশেস জীব কি না, সেই আলোচনা পরে হইবে; এখন দেখা যাক- পৃথিবী বিশ্বের কেন্দ্রে অবস্থিত ও বৃহত্তম পদার্থ কি না ৷’ তার পরে বলে চলেছেন,

‘কোন স্থানের কেন্দ্রবিন্দু ঠিক করিতে হইলে উহার পরিধি জানা দরকার । · পরিধি নির্ধারণ না করিয়া কেন্দ্র নির্ধারণ অসম্ভব। কিন্তু ধর্মীয় মতবাদে বিশ্বের পরিধি নির্ধারণ না করিয়াই পৃথিবীকে বিশ্বের কেন্দ্র বলিয়া সাব্যস্ত করা হইয়াছে ।’

আমরা যদি ধরে নিই যে, আমাদের মহাবিশ্ব সীমীত এবং বর্তুলাকার, তাহলে এর আয়তন আমাদের জানতে হবে এর কেন্দ্রের অবস্থান চিহ্নিত করতে হলে আর যদি মহাবিশ্ব অসীম হয়, তাহলে মহাবিশ্বের প্রতিটি বিন্দুই হবে এর কেন্দ্র, ফলে পৃথিবীর আর কোন বিশেষত্ব থাকে না । ধর্মীয় বিশ্বাস মতে মহাবিশ্ব হল অনন্ত । এই দৃষ্টিতে বিচার করলে ‘পৃথিবী মহাবিশ্বের কেন্দ্র’- এই বাক্যটি হয়ে পড়ে অর্থহীন ।

তিনি পুস্তকটিতে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির মূল কথাগুলির পর বিশ্ব সৃষ্টির বিবর্তন, সূর্য, গ্রহ ও নক্ষত্রমণ্ডলী, উল্কা, ধূমকেতু ইত্যাদি জ্যোতিষ্ক, … প্রাণের বিকাশ, প্রাণ এবং জীবজগতের বিবর্তন, বংশগতি, মানুষের অভ্যুদয় প্রভৃতি নানা চমকপ্রদ বিষয়ের অবতারণা করেছেন বিজ্ঞানের নির্মোহ দৃষ্টি থেকে- আলোচিত হয়েছে সভ্যতার ইহজাগতিকতা ও আরজ আলী মাতুব্বর- একজন যুক্তিবাদী দার্শনিক বিকাশ, সংস্কার কুসংস্কার, ধর্ম, প্রলয় ও পুনঃসৃষ্টি ইত্যাদি বিচিত্র প্রসঙ্গ । এটি অতি অবশ্য একটি সুখপাঠ্য গ্রন্থ, যা পাঠে উপকৃত হবেন ধর্মবাদীরা— যুক্তিবাদীরাও ।

 

আরজ আলী মাতুব্বরের অন্যান্য রচনাবলী

তার অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ রচনাবলীর মধ্যে রয়েছেঃ

১। অনুমান, প্রকাশ কাল, বাংলা ১৩৯০ (১৯৮৩)

২। স্মরণিকা, প্রকাশ কাল, বাংলা ১৩৯০ (১৯৮৩)

 

অপ্রকাশিত রচনাবলী

১. বেদের অবদান, রচনাকাল ২১শে আশ্বিন, ১৩৮৩ ২ . ম্যাকগে-সান চুলা, রচনাকাল ২৭শে কার্তিক, ১৩৭৫

৩. কৃষকের ভাগ্য ‘গ্রহ’, রচনাকাল ৫ই শ্রাবণ ১৩৫৯- ১১ই ভাদ্র ১৩৬৩ ৪. সীজের ফুল, রচনাকাল ১৬ই আশ্বিন, ১৩৩২-২৭শে চৈত্র ১৩৪০ ৫. সংক্ষিপ্ত জীবন বাণী, রচনাকাল ২৪শে আষাঢ়- ৭ই শ্রাবণ ১৩৭২ ৬. ভাষণ সংকলন, ১লা মাঘ ১৩৮৪- ৩রা পৌষ ১৩৯২

(জানুয়ারি ১৯৭৮- ডিসেম্বর ১৯৮৫)

৭. ভাবি প্রশ্ন (সত্যের সন্ধান), রচনাকাল ১লা কার্তিক ১৩৭৯ ৮. নাবুঝের প্রশ্ন রচনাকাল ১৬ই বৈশাখ ১৩৫৮- ২৯শে ভাদ্র ১৩৫৯

অসমাপ্ত পাণ্ডুলিপিঃ টুকিটাকি ১৩৮১-১৩৯১

১. স্মরণিকা, রচনাকাল ১৮ই জ্যৈষ্ঠ ১৩৮১

২ . আমার জীবন দর্শন, রচনাকাল ১২ই কার্তিক ১৩৯১

এছাড়া তার পাওয়া পাণ্ডুলিপি থেকে উদ্ধার করা গেছে পাঁচ খণ্ডে লেখা অসমাপ্ত ‘ভিখারীর আত্মকাহিনী’ শিরোনামে আত্মচরিত । এটি শুরু করেছিলেন ৮ই শ্রাবণ ১৩৮১ থেকে আর লেখাটি শেষ হয়েছে ১৯শে ভাদ্র ১৩৮২ । আরজ আলীর আর একটি বৈশিষ্ট্য যে, মনে প্রাণে দার্শনিক হলেও বিজ্ঞানের প্রয়োগিক বৈশিষ্ট্য কখনও বিসর্জন দেন নি, লভ্য মাল মশলার মধ্য দিয়ে তার মত করে পরীক্ষামূলক বিজ্ঞান চর্চার চেষ্টা করেছেন অল্প বয়স থেকেই । আমরা এখানে একটি পরীক্ষার কথা উলে-খ করব দৃষ্টান্ত হিসেবে । তিনি বাংলা ১৩৫৭ সালে ম্যাকগে-সান চুলা নিৰ্মাণ করে দেখিয়েছিলেন কৃষকদের প্রয়োজনে, কৃষকদের কল্যাণে । আখের রস থেকে গুড় তৈরিতে কৃষকরা দেশীয় চুলা বা আখা ব্যবহার করে থাকে— এ ধরনের চুলার ত্রুটি হল জ্বালানি অপচয়, তাপশক্তির উৎপাদন কম এবং সময় ক্ষেপণ বেশি হয় । তাছাড়া এই চুলায় অঙ্গার থেকে তাপ উৎপাদন সম্ভব হয় না । এসব অসুবিধা থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য ম্যাকগে-সান নামের জনৈক ইংরেজ এক নতুন ধরনের চুলা উদ্ভাবন করেছিলেন, যা পরবর্তীকালে ‘ম্যাকগে-সান চুলা’ নামে পরিচিতি লাভ করে । মাতুব্বর সাহেব জীবনে এই অভিনব চুলা না দেখেও কেবলমাত্র নকসা অনুকরণে এ ধরনের চুলা নির্মাণ করে দেখান যা থেকে কৃষককুল প্রভূত উপকৃত হয়েছিল (১৩-১১-১৩৫০)।

এসব প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত রচনাবলীর মাধ্যমে আমাদের যুক্তিবাদী লোকায়ত দার্শনিক মানুষের মনের অতীব তাৎপর্যময় ও মৌলিক প্রশ্নাবলীই উত্থাপন করেননি, তিনি দেখাবার চেষ্টা করেছেন কী ভাবে কোন সমস্যা সমাধানে যুক্তির সাথে বৈজ্ঞানিক পন্থায় অগ্রসর হওয়া উচিত। স্বাভাবিকভাবেই আমাদের সকল সমস্যার উত্তর পাওয়া বর্তমান বৈজ্ঞানিক তথ্য ও তত্ত্ব এবং যুক্তিবাদী চিন্তার দ্বারা হয়তো সম্ভব নয় । কিন্তু এটিই হল বৈজ্ঞানিক পথ যার মাধ্যমে নতুন জ্ঞান সৃষ্ট হবে, অথবা পুরাতন জ্ঞানের নবায়ন ঘটবে, নতুন সত্যের উদঘাটন হবে। আর সভ্যতা সংস্কৃতি সামনের দিকে এগিয়ে যাবে। আমরা পেছনের দিকে হাটব না, ফিরে যাব না কোরানের কালে বা বৈদিক যুগে, প্রত্যাবর্তন করতে চাই না মুহম্মদ, ঈশা অথবা মুসার কালে ।

ঈশ্বরাদিষ্ট ধর্ম ও ধর্ম প্রবর্তকদের প্রতি ছিল তার সম্মানবোধ, কখনও কোন অশ্রদ্ধেয় মনোভাব প্রকাশ করেননি, কিন্তু অন্ধ বিশ্বাসও তার ছিল না । এ প্রসঙ্গে তার মন্তব্য স্মরণ করা যেতে পারে যুক্তিবাদী মনোভাব পোষণের কারণে তার বিরুদ্ধে ফৌজদারী মামলা দায়েরকারী জনৈক সরকারি কর্মচারীর ‘আপনি মুসলমান কি না; এবং আপনি কোরান মানেন কি না’- এ জাতীয় প্রশ্নের জবাবে মাতুব্বর অসম সাহসিকতার সাথে বলেছিলেন,

‘জাতি বা সম্প্রদায় হিসেবে আমি মুসলমান, যেহেতু আমার মা ও বাবা মুসলমান ।’ আর কোরান মানা না মানা প্রসঙ্গে তার উত্তর ছিল,

‘কোরান আমি মানি কি না, তাহা জানি না, যেহেতু আমি কোরান বুঝি না । তবে ইহা সত্য যে, আমি যাহা বুঝি না, তাহা মানি না ।’

আর এক স্থানে ধর্মবেত্তাদের সম্পর্কে তার বিনয়ী পর্যবেক্ষণ ছিল “মানব সমাজে ধর্মের আবির্ভাব হয়েছিল মানুষের সার্বিক কল্যাণের জন্যই । কিন্তু বর্তমানে প্রচলিত ধর্মগুলো মানুষের কল্যাণের চেয়ে অকল্যাণই করছে বেশি, অবশ্য জাগতিক ব্যাপারে। ধর্মবেত্তারা সকলেই ছিলেন মানবকল্যাণে আত্মনিবেদিত মহাপুরুষ । কিন্তু তারা তাদের দেশ ও কালের বন্ধনমুক্ত ছিলেন না ৷’

আমরা বলেছি মাতুব্বর ছিলেন মানবতাবাদী ও লোকায়তবাদী দার্শনিক যার আদি উৎস হল মানবতাবাদ ও মানবকল্যাণ । তার মতে বিজ্ঞান সাধনাই হোক আর দর্শন চর্চাই হোক সবই হতে হবে মানব হিতে। সারাটি জীবন তিনি এরই সাধনা করেছেন মানব হিতৈষণা । তিনি স্পষ্ট করে বলেছিলেনঃ

‘আমি দার্শনিক নই, এমন কি কোন পুঁথিগত দর্শন আমার আয়ত্ত্বে নেই, কতকটা লালন শাহের মতোই। তবে দর্শনকে ভালবাসি, দার্শনিকদের শ্রদ্ধা করি এবং তাদের সংসর্গ লাভে আনন্দিত হই। কিন্তু আমি ভাববাদী দর্শনে অনুরক্ত নই ।’ তিনি পুনরায় বলেছেনঃ

‘… যদিও দার্শনশাস্ত্রটি সর্বজনীন, তথাপি হিন্দু দর্শন, বৌদ্ধ দর্শন, মুসলিম দর্শন, ভারতীয় দর্শন, গ্রীক দর্শন ইত্যাদি দর্শন যেমন স্বতন্ত্র, বর্তমান বাঙালির জাতীয় দর্শনেও তেমনটি বাঞ্ছনীয় । আর আমার ব্যক্তিগত অভিমত থেকে বলছি, তা হওয়া উচিত মানবতাবাদী দর্শন । কেননা সর্বদেশে এবং সর্বকালে মেহনতী মানবতার প্রত্যাশী, পুঁজিপতিরা নয়। আর দুনিয়ার দরিদ্রতম দেশ হচ্ছে বাংলাদেশ, যেখানে মেহনতী মানুষের সংখ্যা শতকরা প্রায় ৯০ । তাই এই বিপুল সংখ্যক মানুষের জীবনদর্শনই হওয়া উচিত বাঙালির জাতীয় দৰ্শন তথা মানবতাবাদী দর্শন ।

তিনি চাইতেন সমাজে যেন বৈষম্য না থাকে, ভাবতেন বৈষম্যহীন সমাজের কথা, কোন পথে তা আসতে পারে? ভেবেছেন সমাজতন্ত্রের কথাঃ

আর এই বৈষম্যরোধ ও সমতা আনয়নের কাজে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে ‘সমাজতন্ত্র’ । তাই ‘সমাজতন্ত্র’ তথা সাম্যবাদ হচ্ছে বিশ্ব মানবের মঙ্গল বিধানের একমাত্র মাধ্যম । এছাড়া শুধুমাত্র রকেট- রোবট ও স্বর্গ-নরকের স্বপ্ন দর্শনের দ্বারা সমাজ উন্নয়নের যে প্রচেষ্টা, তা ভেল্কি বই আর কিছু নয় ৷

দেশসেবা নিয়ে তার কোন অহমিকা ছিল না, নিজের মত করেই তিনি তার মাতৃভূমির ও জনগণের সেবা করেছেন মানব হিতৈষণার চেতনা নিয়ে ৷ তিনি বলতেনঃ

“ভেকের কাছে ডোবাই তার ‘দেশ’, কৃষকের কাছে দেশ তার পলী এবং রাষ্ট্র নেতার কাছে ‘দেশ’ তার গোটা রাষ্ট্র । আমার ‘ দেশসেবা মানে ‘রাষ্ট্র সেবা নয়’, পল্লীসেবা ।

‘জীবন বাণী’ শিরোনাম আর একটি গ্রন্থ রচনার পরিকল্পনা তিনি করেছিলেন কিন্তু বাংলাদেশ দর্শন সমিতির ৬ষ্ঠ অধিবেশনে প্রদত্ত বক্তৃতা, ১৯৮৪

১ । আরজ আলী মাতুব্বর সংগ্রহ-৩, পাঠক সমাবেশ, ১৯৯৭, ঢাকা ।

আর হাত দিতে পারেননি, ১৩৯২ সালের ১লা চৈত্রে তার প্রয়াণ এই সম্ভাবনার দ্বার চিরতরে রুদ্ধ করে দেয় ।

আরজ আলী মাতুব্বর দুজন মানুষের কাছে অসীম ঋণে আবদ্ধ একজন তার পরম স্নেহাস্পদ বরিশাল বিএম কলেজের বাংলার অধ্যাপক মুহম্মদ শামসুল হক, বর্তমানে জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে, আর অন্যজন তার শ্রদ্ধেয় সুহৃদ ও শুভানুধ্যায়ী বরিশাল বিএম কলেজের দর্শনশাস্ত্রের কৃতি অধ্যাপক কাজী গোলাম কাদির ৷

আমি আমার অকিঞ্চিৎকর প্রবন্ধটির সমাপ্তি টানতে চাই এই মহান দার্শনিকের পাদপদ্মে শ্রদ্ধার্ঘ অর্পণ করে ।

 

তথ্যপঞ্জী

১. Ajoy Roy, Aroj Ali Matubbar, A rationalist philosopher of rural Bangladesh, a paper presented at the Intenational Conference on Secularism, Rationalism and Human Rights, Organised by Rationalist International 2002, New Delhi, (also see http://www.muktomona.com / Articles / ajoy /

২। আরজ আলী মাতুব্বরের স্মারকগ্রন্থ, সম্পাদক মোজাফফর হোসেন, বিজ্ঞান চেতনা পরিষদ, ২০০১, ঢাকা ।

৩। আরজ আলী মাতুব্বর রচনা সমগ্র, ১ম-৩য় খণ্ড, পাঠক সমাবেশ, ১৯৯৪-৯৭, ঢাকা

৪ । আইয়ুব হোসেন, আরজ আলী মাতুব্বর, বাংলা একাডেমি, ১৯৯৯, ঢাকা ।

error: Content is protected !!