الاستعانه শব্দের অর্থ হইতেছে কোন ব্যক্তি বা বস্তুর ক্ষতি হইতে বাঁচার জন্য সর্বশক্তিমান আল্লাহ্র নিকট আশ্রয় চাওয়া। العيأذه শব্দটি ক্ষতি প্রতিরোধক অর্থে ব্যবহৃত হয়। পক্ষান্তরে العيأذ শব্দ ব্যবহৃত হয় কল্যাণ ও মঙ্গলের জন্য সাহায্য প্রার্থনা অৰ্থে। কবি মুতানাব্বীর নিম্নোক্ত পংক্তিতে উক্ত শব্দদ্বয় পরস্পর পৃথক অর্থে ব্যবহৃত হইয়াছে। যেমনঃ

ومناعوذبيهقمناحالذره * يامن الوذ يه قفقيمااؤمله

لايجير الناس عظماانت كاسره * ولايهيضون عظماانت جايره

‘ওহে সেই সত্তা, কাঙ্ক্ষিত বস্তু লাভ করার জন্য আমি যাহার সাহায্য প্রার্থী এবং অবাঞ্ছিত বস্তু হইতে বাঁচার জন্য যাহার আশ্রয় প্রার্থী; তুমি হে হাড্ডি গুড়া কর, তাহা কেহ জোড়া দিতে পারে না এবং যে হাড্ডি তুমি জুড়িয়া রাখ, তাহা কেহই ভাঙ্গিতে পারে না।’

সংসা করা أعوذ باللّه من الشّيطان الرجيم -এর তাৎপর্য হইতেছে এই যে, যে কার্য সম্পাদনের জন্য আমি আদিষ্ট হইয়াছি তাহা সম্পাদনের ও যাহা হইতে বিরত থাকার জন্য আমি আদিষ্ট হইয়াছি তাহা পরিহারের পথে বিতাড়িত শয়তান যাহাতে বাধা সৃষ্টি করিয়া বিপরীত কিছু না ঘটাইতে পারে তাহার জন্য সর্বশক্তিমান আল্লাহ্ তা’আলার নিকট আমি আশ্রয় প্রার্থনা করিতেছি। কারণ, আল্লাহ্ ছাড়া কেহই শয়তানের প্ররোচনা ও কুমন্ত্রণা হইতে বাঁচাইতে পারে না। এই কারণেই মানুষের শত্রুতা প্রতিহত করার জন্য আল্লাহ তা’আলা উদারতা ও ক্ষমাশীলতার উপদেশ দিলেও শয়তানের শত্রুতার হাত হইতে বাঁচার জন্য তিনি তাঁহার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করিতে আদেশ দিয়াছেন। শয়তানের প্রকৃতি এতই জঘন্য ও অপবিত্র যে, উদারতা বা মহানুভবতাকে সে কোন মূল্যই দেয় না। মানুষ যত বড় শত্রুই হউক, উদারতা ও মহানুভবতা অনেক সময় তাহাকে অভিভূত করে এবং শত্রুতা ভুলিয়া সে বন্ধু হইয়া যায়। কিন্তু শয়তানকে কখনও উদারতা ও মহানুভবতা অভিভূত করিতে পারে না, পারে না শত্রুতা হইতে বিন্দুমাত্র নিরস্ত করিতে। তাই আল্লাহ্ তা’আলা এই দুই শ্রেণীর শত্রুর মোকাবিলার জন্য দুই রূপ ব্যবস্থা দিয়াছেন। ইস্তিআযা সম্পর্কিত আলোচনার শুরুতে উর্ধ্বত তিনটি আয়াতে উক্ত দুইরূপ ব্যবস্থা প্রদত্ত হইয়াছে। সূরা আ’রাফে আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ

خُذِ الْعَفْوَ وَأمرُ بِالْعُرْفِ وَأَعْرِضْ عَنِ الْجَاهِلِينَ .

এই অংশে মানুষের শত্রুতার প্রতিষেধক নির্দেশ করা হইয়াছে। অতঃপর তিনি বলেনঃ

وَإِمَّا يَنْزَغَنَّكَ مِنَ الشَّيْطَانِ نَزْغٌ فَاسْتَعِذْ بِاللَّهِ إِنَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ –

এই অংশে শয়তানের শত্রুতার দাওয়াই বাতলানো হইয়াছে।

সূরা মু’মিনে আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ

اِدْفَعْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ السَّيِّئَةَ نَحْنُ أَعْلَمُ بِمَا يَصِفُونَ .

এখানেও মানুষের শত্রুতার প্রতিকার ব্যবস্থা বর্ণিত হইয়াছে। অতঃপর তিনি বলিতেছেনঃ

وَقُلْ رَبِّ أَعُوذُبِكَ مِنْ هَمَزَاتِ الشَّيَاطِينِ وَأَعُوذُبِكَ رَبِّ أَنْ يَحْضُرُونَ –

এখানে আবার শয়তানের আক্রমণ প্রতিহত করার ব্যবস্থা বর্ণিত হইয়াছে।

সূরা ‘হা-মীম আস্ সাজদায়’ তিনি বলেনঃ

وَلَا تَسْتَوِي الْحَسَنَةُ وَلَا السَّيِّئَةُ ادْفَعْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ فَإِذَا الَّذِي بَيْنَكَ

وبينه عداوة كائه ولى حميم ‏- وما يلقاها الا الذين صيروا وما يلقاها الا ذو

حَظِّ عَظِيمٍ

এই অংশে মানুষের শত্রুতা ও হামলা প্রতিহত করার ব্যবস্থা বর্ণিত হইয়াছে। অতঃপর তিনি বলেনঃ

وَإِمَّا يَنْزَغَنَّكَ مِنَ الشَّيْطَانِ نَزْغٌ فَاسْتَعِذْ بِالله – اِنَّهُ هُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ

এই অংশে শয়তানের শত্রুতা ও হামলা প্রতিহত করার ব্যবস্থা বর্ণিত হইয়াছে।

 

الشيطان শব্দের বিশ্লেষণ

الشيطان শব্দের ধাতু হইতেছে ش – ا – ط উহার অর্থ বিদূরিত বস্তু বা ব্যক্তি। শয়তান যেহেতু স্বভাব প্রকৃতিতে মানুষ হইতে দূরে অবস্থান করে, তাই তাহাকে শয়তান বলা হয়। তাহা ছাড়া স্বীয় অবাধ্য স্বভাবের দরুণ সে যাবতীয় কল্যাণ হইতে বিদূরিত বিধায় তাহাকে শয়তান বলা হয়।

কেহ কেহ বলেন, الشيطان  শব্দের ধাতু হইল ش – ا – ط উহার অর্থ হইতেছে ‘উত্তপ্ত বস্তু’। আগুন হইতে সৃষ্ট বলিয়া শয়তানকে শয়তান বলা হয়।

একদল বলেন, শয়তানকে উপরোক্ত উভয় অর্থেই শয়তান বলা হয়। তাই উহার ধাতু ও নামকরণ সম্পর্কিত উভয় ব্যাখ্যাই সঠিক।

আরবী সাহিত্যে ব্যবহৃত শব্দ দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, প্রথমোক্ত ব্যাখ্যাই যথার্থ। কবি উমাইয়া ইব্‌ন আবুস্ সালত হযরত সুলায়মান (আঃ)-কে প্রদত্ত ঐশ্বর্য ও পরাক্রম বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেনঃ

ايما شاطن عصاه عكاه ‏ ثم يلقى فى السجن والاغلال ‘যদি শয়তানও তাহার অবাধ্য হইত, তাহা হইলে তিনি তাহাকেও গ্রেফতার করিয়া জেলখানায় জিঞ্জীরাবদ্ধ করিতেন।’

কবি এখানে শয়তানকে বুঝাইবার জন্য شاطن শব্দ ব্যবহার করিয়াছেন। ‘শাতেন’ শব্দের শব্দমূল ش – ا – ط -এ যদি উহার শব্দমূল ش – ا – ط হইত, তাহা হইলে:তিনি شاطن শব্দের পরিবর্তে شائط শব্দ ব্যবহার করিতেন।

অনুরূপ কবি নাবিগা যুবয়ানী (যিয়াদ ইব্‌ন আমর ইব্‌ন মুআবিয়া ইবন জাবির ইব্‌ন যুব্বাব য়্যারবূ ইব্‌ন মুরা ইব্‌ন সা’দ ইব্‌ন যুরয়ান) বলেনঃ

نأت بسعاد عنك نوى شطون – فباتت ولك له ادبها رهين

‘দূরবর্তী পথ সুআদকে তোমার নিকট হইতে দূরে লইয়া গিয়াছে। সেখানেই সে নিশিযাপন করিয়াছে। অথচ হৃদয় তাহার নিকট বন্ধক রহিয়াছে।’

এখানে কবি দূরবর্তী شطون শব্দ প্রয়োগ করিয়াছেন। উহার ধাতু হইতেছে ش ‏- ط – ن যদি ش – ا – ط শব্দমূল হইত, তাহা হইলে তিনি شاطن শব্দের বদলে شائط শব্দ ব্যবহার করিতেন।

খ্যাতনামা ব্যাকরণবিদ সিবওয়াই বলেন, আরবগণ বলিয়া থাকে অমুক ব্যক্তি শয়তানের ন্যায় কার্য করিয়াছে ! تشيطن শব্দের ধাতু ش ‏- ط – ن হইলে উক্ত অর্থে তাহারা تشيطن না বলিয়া تشيط বলিত। ইহা দ্বারা প্রমাণিত হয় شيطان শব্দটির অর্থ হইতেছে বিদূরিত বস্তু বা ব্যক্তি এবং উহার ধাতু হইতেছে ش ‏- ط – ن

উপরোক্ত অর্থই সঠিক বিধায় দূরে অবস্থানকারী জ্বিন, ইনসান বা অন্য কোন প্রাণীকে تشيطن নামে আখ্যায়িত করা হয়। স্বয়ং আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ

وَكَذَالِكَ جَعَلْنَا لِكُلِّ نَبِي عَدُوا شَيَاطِينَ الإِنْسِ وَالْجِنَ يُوحِي بَعْضُهُمْ إِلَى بَعْضٍ زُخْرُفَ الْقَوْلِ غُرُورًا –

“অনন্তর এইরূপে আমি প্রত্যেক নবীর জন্য শত্রু সৃষ্টি করিয়াছি। তাহারা সত্য হইতে দূরে অবস্থানকারী জ্বিন ও ইনসান। তাহারা একে অপরের নিকট প্রতারণামূলক চটকদার কথা পৌঁছায়।”

উক্ত আয়াতে সত্য হইতে দূরে অবস্থানকারী জ্বিন ও ইনসান উভয়কেই شيطان বলা হইয়াছে।

অনুরূপভাবে হযরত আবূ যর (রাঃ) হইতে ইমাম আহমদ কর্তৃক বর্ণিত এক হাদীসে বলা হইয়াছে যে, নবী করীম (সাঃ) বলেনঃ

تَعَوَّذْ بِاللَّهِ مِنْ شَيَاطِينِ الإِنْسِ وَالْجِنِّ –

(মানুষ শয়তান ও জ্বিন শয়তান হইতে আল্লাহ্ তা’আলার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা কর।) আমি (আবূ যর) আরয করিলাম, ‘মানুষের মধ্যেও কি শয়তান রহিয়াছে?’ তিনি বলিলেন, হ্যাঁ।

মুসলিম শরীফে বর্ণিত এক হাদীসে হযরত আবূ যর (রাঃ) বলেনঃ ‘একদা নবী করীম (সাঃ) বলিলেন- নারী, গাধা ও কালো কুকুর নামায ভঙ্গ করে। আমি আরয করিলাম, হে আল্লাহর রাসূল ! লাল ও হলুদ কুকুর হইতে কালো কুকুরের বিধান ভিন্ন কেন? তিনি বলিলেনঃ الكلب الاسود شيطان (কালো কুকুর শয়তান) ।

আযলাম হইতে ধারাবাহিকভাবে যায়দ ইব্‌ন আলাম, হিশাম ইব্‌ন সা’দ ও ইব্‌ন ওহাব বর্ণনা করিয়াছেনঃ একদা হযরত উমর (রাঃ) একটি তুর্কী অশ্বে আরোহণ করিলেন। অশ্বটি দাম্ভিকের ন্যায় হেলিয়া-দুলিয়া চলিতেছিল। তিনি উহাকে চাবুক মারিতে লাগিলেন। উহাতে তাহার অহংকারী ভাব আরও বাড়িয়া গেল। তখন তিনি উহা হইতে অবতরণ করিলেন। তারপর খাদেমগণকে বলিলেন, তোমরা আমাকে একটি শয়তানের পিঠে চড়াইয়াছ? উহার অহংকারী চলার ভঙ্গী আমার মনেও অহংকার জাগাইতেছিল বলিয়া আমি নামিয়া পড়িয়াছি।’ উক্ত রিওয়ায়েতের সনদ সহীহ।

 

الرجيم শব্দের বিশ্লেষণ

الرجيم শব্দটি المفعول ওযনে সৃষ্ট ও المفعول ওযনের অর্থবোধক المفعول -এর মতই কর্মবাচ্যের অর্থ প্রকাশ করে। তাই উহার অর্থ দাঁড়ায় বিতাড়িত ও বিদূরিত। আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ

وَلَقَدْ ريثا الْسَّمَاءَ الدّنْيًا بِمَصابِيْحَ وَجَعَلْنَاهَا رجوما للشَيَاطين

আমি পৃথিবী সন্নিহিত আকাশকে আলোকমণ্ডলী দ্বারা সুসজ্জিত করিয়াছি এবং সেইগুলিকে শয়তানের জন্য ক্ষেপণাস্ত্র বানাইয়াছি।’

তিনি আরও বলেনঃ

إِنَّا زَيَّنَا السَّمَاءِ الدُّنْيَا بِزِينَة نِ الْكَوَاكِب وحفظا منْ كُلِّ شَيْطَان مارد مَّارِدٍ

 لا يَسْمَعُونَ إِلَى الْمَلاء الأعلى وَيُقْذَفُونَ مِنْ كُلِّ جَانب – دُحُورًا وَلَهُمْ عَذَابٌ وَاصِبٌ

– الأ مَنْ خَطِفَ الْخَطْفَةَ فَأَتْبَعَهُ شِهَابٌ ثَاقِبُ –

‘নিশ্চয় আমি পৃথিবী দৃষ্ট আকশকে নক্ষত্ররাজী দ্বারা সুসজ্জিত করিয়াছি এবং উহাকে সকল অবাধ্য শয়তান হইতে হিফাজতের ব্যবস্থা করিয়াছি। উহারা সর্বোচ্চ মর্যাদার ফেরেশতাদের সংলাপ শুনিতে পারে না, চতুর্দিক হইতে তাহাদের উপর ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষিপ্ত হয়। অনন্তর তাহাদের জন্য রহিয়াছে অনিবার্য আযাব। তথাপি কেহ যদি ছোঁ মারিয়া কোন কথা লইয়া পালায়, তাহা হইলে উজ্জ্বল আলোকপিণ্ড তাহার পশ্চাদ্ধাবন করে।’

তিনি অন্যত্র বলেনঃ

وَلَقَدْ جَعَلْنَا فِي السَّمَاءِ بُرُوجًا وَزَيَّنَّاهَا لِلنَّاظِرِينَ – وَحَفِظْنَاهَا مِنْ كُلِّ –

شَيْطَانِ رَّحِيْمِ – الا مَنِ اسْتَرَقَ السَّمَعَ فَأَتْبَعَهُ شَهَابٌ مُّبِين –

‘নিশ্চয় আমি আকাশে কক্ষপথ সৃষ্টি করিয়াছি এবং উহাকে দর্শকদের জন্য সুসজ্জিত করিয়াছি। আর উহাকে সকল বিতাড়িত শয়তান হইতে হিফাজতের ব্যবস্থা করিয়াছি। তবে যদি কেহ আড়ি পাতে, তাহা হইলে উজ্জ্বল নক্ষত্র তাহাকে ধাওয়া করে।’

এতদ্ভিন্ন অনুরূপ আরও আয়াত রহিয়াছে। কেহ কেহ বলেনঃ الرجيم শব্দের অর্থ الرجم (নিক্ষেপক)। শয়তান যেহেতু মানুষের অন্তরে কুমন্ত্রণা ও প্ররোচনার তীর নিক্ষেপ করে, তাই তাহাকে الرجيم নামে অভিহিত করা হয়। অবশ্য পূর্বোক্ত তাৎপর্যই বিশুদ্ধ ও প্রসিদ্ধ।

error: Content is protected !!