পারভেজ আমির আলী হুডবয়
অনুবাদঃ শামসুজ্জামান খান
ভবিষ্যতের ঐতিহাসিকরা যাকে ‘সন্ত্রাসের শতাব্দী’ বলে আখ্যায়িত করতে পারেন তারা একটা রূপরেখা তৈরি করতে হলে আমাদেরকে আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদী একগুঁয়েমী ও ইসলামিক ধর্মীয় মতান্ধতার মতো বিপজ্জনক উভয় সঙ্কটের গতিপথ নির্ধারণ করতে হবে। এই জটিল ঘটনাস্রোতের মধ্যে যত্নের সঙ্গে পথ করে আমাদের এগুতে হবে একটি যুক্তিশীল, গণতান্ত্রিক, মানবতাবাদী ও সেক্যুলার ভবিষ্যতের দিকে । তা না হলে জাহাজের দুর্ঘটনা ও ধ্বংস অনিবার্য ।
প্রায় চার মাস হতে চলল* যুক্তরাষ্ট্রের মুসলিম কম্যুনিটির নেতৃবৃন্দ এবং প্রেসিডেন্ট বুশ পর্যন্ত রুটিন মাফিক জোরালো ঘোষণা দিয়ে যাচ্ছেন যে “ইসলাম একটি শান্তির ধর্ম—১১ই সেপ্টেম্বর ধর্মান্ধরা তাকে হাইজ্যাক করে নিয়ে গেছে।’ এই দুই দাবিই অসত্য ।
প্রথমত খ্রিষ্ট, ইহুদি, হিন্দু বা যে কোন ধর্মের মতোই ইসলাম শান্তি সংক্রান্ত কোন বিষয় না। যুদ্ধ সংক্রান্ত ব্যাপারও না। প্রত্যেক ধর্মের মূল কথাই হল এর নিজস্ব শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে পরিপূর্ণ বিশ্বাস এবং সত্য সম্পর্কে স্বকীয় ভাষাকে অন্যদের ওপর চাপিয়ে দেয়ার স্বর্গীয় অধিকার। মধ্যযুগে ক্রুসেড ও জিহাদ দুই-ই রক্তে ভিজে গেছে। বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যেসব খ্রিষ্টান মৌলবাদী রয়েছে তারা গর্ভপাত বিষয়ক ক্লিনিকে আক্রমণ চালাচ্ছে এবং ডাক্তারদের হত্যা করছে; মুসলিম মৌলবাদীরা তাদের ধর্মের নানা তরিকার মধ্যে পারস্পরিক যুদ্ধ ঘোষণা করেছে; ইহুদি দখলদার অভিবাসীরা একহাতে ওল্ড টেস্টামেন্ট এবং কখনও অন্য হাতে * প্রফেসর পারভেজ আমির আলী হুডবয় : পাকিস্তানের ইসলামাবাদস্থ কায়েদে আজম বিশ্ববিদ্যালয়ের পারমাণবিক ও উচ্চ শক্তি পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক। প্রবন্ধটি ২০০১ সালের শেষের দিকে ইংরেজিতে লেখা শিরোনামঃ How Islam lost its way. yesterday achievements were golden; today, reason has been eclipsed.
ইসরাইলি সাবমেশিনগান উজিস (Uzis) তুলে ধরে জলপাই বাগান পুড়িয়ে দিচ্ছে এবং প্যালেস্টাইনিদের তাদের পৈতৃকভূমি থেকে উচ্ছেদ করেছে এবং ভারতে হিন্দুরা প্রাচীন মসজিদ ধ্বংস ও গীর্জা ভস্মীভূত করছে।
দ্বিতীয় দাবিটি সত্য থেকে আরো দূরবর্তী । যদি কিছুটা প্রতীকী অর্থে ধরে নিই যে ইসলাম সত্যিই ছিনতাই হয়ে গিয়েছে তাহলে সে ঘটনাতো মাত্র তিনমাস আগে ঘটেনি। সাতশ বছরের বেশ আগে ইসলাম এক গুরুতর আঘাতের মুখে পড়ে এবং তার প্রভাব থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি ।
মুসলমানদের বর্তমান অবস্থান কোথায়? লক্ষ্য করুন, আমি ইসলাম সম্পর্কে এ প্রশ্ন করছি না; কারণ ইসলাম একটা বিমূর্ত ব্যাপার। পাকিস্তানের অগ্রগণ্য সমাজকর্মী মওলানা আবদুস সাত্তার ইদাই এবং তালিবানের মোহাম্মদ ওমর দুজনই ইসলামের অনুসারী, কিন্তু আগের জনের জন্য নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়ায় ব্যাপারটি অনেক আগেই ন্যায্য হয়ে গেছে; অন্যদিকে পরেরজন অজ্ঞ, মানসিক রোগগ্রস্ত এক নিষ্ঠুর লোক। অন্যদের মধ্যে প্যালেস্টাইনের লেখক এডওয়ার্ড সাইদ বেশ জোরালোভাবে দেখিয়েছেন যে, বিভিন্ন লোকের জন্য ইসলাম ভিন্ন ভিন্ন অর্থ বহন করে। আমার নিজের পরিবারের মধ্যেই ব্যাপক ভিন্নতাধর্মী ইসলামের অনুশীলন করা হয়। এ মর্মে বিশ্বাসী এবং এর অনুসরণকারীরা যেমন বহু বিচিত্র, এ ধর্মটিও তাই। সত্যিকারের ইসলাম বলে আলাদা করে কিছু নাই ।
বর্তমানে মুসলমানের সংখ্যা একশ কোটি। পুরো বা কাছাকাছি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্পন্ন ৪৮টি দেশের কোনটিই এখন পর্যন্ত টেকসই গণতান্ত্রিক পদ্ধতি উদ্ভাবন করেনি। প্রকৃতপক্ষে সকল মুসলিম রাষ্ট্রেই আত্মস্বার্থক সেবক দুর্নীতিবাজ আভিজাতদের আধিপত্য; এরা নিরাশা তাড়িত হয়ে ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধি এবং জনগণের সম্পদ চুরি করে। এসব দেশের কোনটিতেই সুস্থিত শিক্ষাপদ্ধতি অথবা আন্তর্জাতিক মর্যাদাসম্পন্ন একটি বিশ্ববিদ্যালয় নেই ।
যুক্তিবিচারকেও আক্রমণের শিকার হতে হয়েছে ।
আপনি কোন বিজ্ঞান-বিষয়ক জার্নালে চোখ বুলালে কদাচিৎ কোন মুসলিম নাম দেখবেন। যদি দেখেন তাহলে তার পশ্চিমের কোন দেশে বাস করারই সম্ভাবনা। এর অল্প কটি ব্যতিক্রম আছে, পাকিস্তানের আবদুস সালাম এবং আমেরিকান স্টেভেন ইউনবার্গ ও শেলডন গ্লাসহাও একত্রে ১৯৭৯-‘ নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। আমি সালামকে বেশ ভাল করেই জানতাম, আমরা এমনকি একসঙ্গে একটা বইয়ের ভূমিকাও লিখেছি। তিনি একজন অসামান্য লোক ছিলেন । নিজ দেশ ও ধর্মের প্রতি তার ভালোবাসা ছিল প্রগাঢ়। তবু তিনি প্রচণ্ড দুঃখ নিয়ে মারা গেছেন, কারণ পাকিস্তান তাকে অবজ্ঞা করেছে এবং ১৯৭৪ সালে পাকিস্তানি পার্লামেন্টের এক আইনে তাকে অমুসলিম ঘোষণা করা হয়েছে। সালাম সাহেবের আহমদি সম্প্রদায়কে খারেজি বলে গণ্য করে বর্তমানে তাদের ওপর নির্মম নির্যাতন চালানো হচ্ছে। (সাত বছর আগে আমার বাড়ির পরের বাড়ির প্রতিবেশী এক আহমদি পদার্থবিদকে ঘাড়ে ও বুকে গুলি করা হয় এবং আমার গাড়িতে করে হাসপাতালে নেয়ার সময় গাড়িতেই তিনি মারা যান। তার একমাত্র দোষ ছিল ওই ‘ভুল’ সম্প্রদায়ে জন্মগ্রহণ করা)।
যদিও খাঁটি বৈজ্ঞানিক অর্জন সমকালীন মুসলিম সমাজে বিরল তবে ছদ্ম বিজ্ঞানের সরবরাই প্রচুর। আমার বিভাগের এক সাবেক চেয়ারম্যান বেহেশতের গতির হিসেব কষে ফেলেছেন। তিনি বলেছেন : আলো যে গতিতে পৃথিবী থেকে সরে যায় তার চেয়ে প্রতি সেকেন্ডে এক সেন্টিমিটার কম গতিতে বেহেশত পৃথিবী থেকে সরে গেছে। তার উদ্ভাবনাময় পদ্ধতি ইসলামের পবিত্র গ্রন্থের একটি আয়াতের ওপর নির্ভর করে গড়ে ওঠেছে। ওই আয়াতে বলা হয়েছে যে-রাতে ওই পবিত্র গ্রন্থ নাজিল হয়েছে সে রাতের উপাসনা অন্য যেকোনো সাধারণ রাতের উপাসনার চেয়ে সহস্রগুণ বেশি মূল্য বহন করে। তিনি বলেনঃ এতে সময়কে ১ হাজার গুণ প্রসারিত করার উৎপাদক বিদ্যমান বলে ধরা যায়। একে তিনি আইনস্টাইনের বিশেষ রিলেটিভিটির ফর্মুলায় ফেলে হিসেব বের করে ফেলেছেন । আর একটি অধিকতর সর্বজনীন উদাহরণঃ তালেবানদের কাছে পারমাণবিক গোপন তথ্য সরবরাহের সন্দেহে সম্প্রতি যে দু’জন পাকিস্তানি পারমাণবিক প্রকৌশলীকে গ্রেফতার করা হয়েছে তাদের একজন আগে পাকিস্তানের এনার্জি সমস্যার সমাধানের জন্যে জ্বিনের (Genic) শক্তি ব্যবহার করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তিনি ইসলামী বিশ্বাসের ওপর নির্ভর করে বলেছিলেন যে, ঈশ্বর মানুষকে মাটি থেকে তৈরি করেছেন এবং ফেরেশতা ও জ্বিনকে আগুন থেকে; তাই ওই উচ্চপদস্থ প্রকৌশলী জ্বিনদের পাকড়াও করে তাদের শক্তি (Energy) বের করে নেবার প্রস্তাব করেন ।
আজকে দুঃখজনক পরিস্থিতির সঙ্গে তুলনায় বিগত দিনের ইসলামের একেবারেই ভিন্ন চিত্র মিলে। নবম থেকে ত্রয়োদশ শতকে ইসলামের স্বর্ণযুগে বিজ্ঞান, দর্শন এবং চিকিৎসা বিজ্ঞানে যারা চমৎকার কাজ করেছিলেন তারা ছিলেন মুসলিম। মুসলমানেরা শুধু প্রাচীন জ্ঞানের সংরক্ষণই করেনি, তারা বিপুল পরিমাণ উদ্ভাবনাও করেছে। সেই ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলা মুসলমানদের জন্য এক ট্রাজিক ঘটনা হিসেবে এখন প্রমাণিত। ‘মুতাজিলা’ নামে খ্যাত একটি মুসলিম চিন্তক গ্রুপ যুক্তিবাদী ও উদার ঐতিহ্যের এক শক্তিশালী ধারাকে বহন করে চলার কারণেই ইসলামের স্বর্ণযুগে বিজ্ঞানের অমন সমৃদ্ধি ঘটেছিল। কিন্তু দ্বাদশ শতকে আরব ধর্মগুরু ইমাম আল গাজ্জালির সৈনাপত্যে মুসলিম রক্ষণশীলতার পুনর্জাগরণ ঘটে।
আল গাজ্জালী অলৌকিকভাবে প্রকাশিত বিষয়কে যুক্তির ওপরে এবং নিয়তিবাদকে মুক্তচিন্তার ওপরে স্থান দেন। তিনি গণিত শাস্ত্রকে ইসলামবিরোধী বলে নিশ্চিত করে বলেন এ বিষয়টি মনে উন্মত্ততা জাগিয়ে বিশ্বাসকে দুর্বল করে দেয় ।
এভাবে রক্ষণশীলতার পাপচক্রে আবদ্ধ হয়ে ইসলামের কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে যায়। ফলে মুসলমান খ্রিষ্টান এবং ইহুদি জ্ঞানীগুণীরা কোনো রাজসভায় সমবেত হয়ে আর একত্রে কাজ করতে পারেননি। এভাবেই মুসলিম বিশ্বে সহিষ্ণুতা, বুদ্ধিবৃত্তি ও মেধা এবং বিজ্ঞানের পরিসমাপ্তি ঘটে। সর্বশেষ মুসলিম চিন্তাবিদ আবাদ-আল- রহমান ইবনে খলদুন প্রমুখ ছিলেন চতুর্দশ শতকের মানুষ ৷
ইতোমধ্যে পৃথিবীর বাকি অংশ এগিয়ে চলেছে। রেনেসাঁ পশ্চিমী বিশ্বে এনেছে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের এক বিস্ফোরণ । আরবদের দ্বারা গ্রিক রচনাবলীর অনুবাদ এবং মুসলমানদের অন্যান্য অবদানের কাছে এদের ঋণ আছে। তবে তা এমন কিছু নয় ।
বাণিজ্যিক পুঁজিবাদ ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতি পশ্চিমী দেশসমূহকে সামনে এগিয়ে নিয়ে গেছে এবং যাত্রাপথ ছিল নিষ্ঠুর এমনকি কখনো কখনো গণহত্যামূলক। এবং এভাবে তারা ইন্দোনেশিয়া থেকে মরক্কো পর্যন্ত মুসলিম বিশ্বকে উপনিবেশে পরিণত করে। অচিরেই অন্তত কিছু সংখ্যক মুসলিম এলিটের কাছে এটা পরিষ্কার হয়ে ওঠে যে আধুনিক বিজ্ঞানের বিশ্লেষণাত্মক উপাদান উপকরণ ও আধুনিক সংস্কৃতির সামাজিক-রাজনৈতিক মূল্যবোধকে আত্মস্থ না করার ফলেই তাদেরকে খুব বড়ো রকমের মূল্য দিতে হচ্ছে- আর এ দুটো বিষয়ই তাদেরই উপনিবেশকারীর ক্ষমতার মূল উৎস।
রক্ষণীল ও গোঁড়া মতাবলম্বীদের ব্যাপক প্রতিরোধের মুখেও ১৯ শতকের আধুনিক যুক্তিবাদ মুসলিম অনুগামী খুঁজে পায়। কেউ কেউ জাতি-রাষ্ট্রের আধুনিক ধারণাকে সাগ্রহে লুফে নেন। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে বিংশ শতকের এমন কি একজন জাতীয়তাবাবাদী মুসলিম নেতাও মৌলবাদী নন ।
যাহোক, গোটা তৃতীয় বিশ্বের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত বৃহৎ উপনিবেশবিরোধী স্রোতধারার অংশ হিসেবে মুসলিম ও আরব জাতীয়তাবাদের মধ্যে জাতীয় সম্পদের নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবহার দেশীয়ভাবে করার ইচ্ছাটাও অন্তর্ভুক্ত। পশ্চিমের লোভের সঙ্গে এখানেই সংঘর্ষ অনিবার্য। প্রথমে বৃটেন ও পরে আমেরিকার সামাজিক স্বার্থ স্বাধীন জাতীয়তাবাদকে ভয় করতে থাকে। যে কেউ সহযোগিতা করতে চায় তাকেই তারা পছন্দ করতে থাকে, এমনকি সৌদি আরবের রক্ষণশীল শাসনকেও। ১৯৫৩ সালে ইরানের মোহাম্মদ মেসাদ্দেককে সি.আই.এ এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে উৎখাত করে তার জায়গায় শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভীকে ক্ষমতায় বসায়। বৃটেন মিশরের জামাল আবদুন নাসেরকে নিশানা করে। ইন্দোনেশিয়ায় শত শত লোককে হত্যা করে এক রক্তাক্ত অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সুকর্ণের স্থানে সুহার্তকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করে ।
বাইরের চাপ আর ভেতরের দুর্নীতিপরায়ণতা ও অক্ষমতায় সেক্যুলার মুসলিম সরকারসমূহ জাতীয় স্বার্থ রক্ষা অথবা সামাজিক ন্যায়বিচার প্রদানে অসমর্থ হয়। নিজেদের ক্ষমতা ও সুযোগ-সুবিধা সংরক্ষণের জন্যে তারা গণতন্ত্রকে বানচাল করতে শুরু করে। এই ব্যর্থতায় যে শূন্যতা সৃষ্টি তার পূরণের জন্যই ইসলামী আন্দোলন দানা বাধতে থাকে- এর মাত্র সামান্য কটি উল্লেখ করি, যেমন ইরান, পাকিস্তান ও সুদান ।
সোভিয়েত ইউনিয়ন কর্তৃক ১৯৭৯-এ আফগানিস্তান অধিকৃত হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র অবিবেচনা ও ক্ষমতার উদগ্র বাসনায় মুসলিম বিশ্বের এই কালান্তক স্রোতের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করে। আমেরিকার সর্বপ্রধান মিত্র পাকিস্তানের মোহাম্মদ জিয়াউল হকের সহায়তায় সিআইএ প্রকাশ্যেই মিশর, সৌদি আরব, সুদান এবং আলজেরিয়া থেকে পবিত্র ইসলামী যোদ্ধা রিক্রুট করতে থাকে। বিজ্ঞ পরামর্শদাতা ও মিত্র পরাশক্তির সমর্থনে মুজাহিদীন বাহিনী উগ্র রূপ ধারণ করে । রোনাল্ড রেগান হোয়াইট হাউজের লনে তাদের নিয়ে আনন্দ ফূর্তি করেন ।
বাকী যা কিছু তাতো এখন সবারই জানা। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর আমেরিকা এক বিশৃঙ্খল আফগানিস্তান থেকে বেরিয়ে আসে। তালেবানদের উদ্ভব ঘটে, ওসামা বিন লাদেন ও তার আল কায়েদা আফগানিস্তানকে তাদের ঘাঁটি বানায় ।
এই পরিপূর্ণ বয়ান থেকে চিন্তাশীল মানুষ কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছবেন? মুসলমানদের এখন আত্ম-করুণায় গড়াগড়ি দেয়া বন্ধ করা উচিত। মুসলমানেরা অমিত ক্ষমতাধর ও বিদ্বেষভাবাপন্ন পশ্চিমের ষড়যন্ত্রের অসহায় শিকার নয় । সত্য এই যে বাণিজ্য পুঁজির যুগ শুরু হওয়ার বহু পূর্বে ইসলামের মহত্ত্বের পতনের সূত্রপাত। এর কারণ মূলত অভ্যন্তরীণ, তাই মুসলমানদের অবশ্যই নিজ অন্তরের কাছে জিজ্ঞাসা করা দরকার ভুলটা কোথায় হয়েছে ।
মুসলমানদের অবশ্যই এটা স্বীকার করতে হবে যে, ১৪০০ বছর আগের আরবের সমগোত্রীয় উপজাতীয় সমাজের তুলনায় এখনকার মুসলমান সমাজ · অনেক বড়ো, বহু বিচিত্র এবং জটিল । অতএব এই ধারণাটা এখন পরিত্যাগ করার সময় হয়েছে যে ইসলাম কেবলমাত্র শরিয়া বা ইসলামি আইনের দ্বারা পরিচালিত রাষ্ট্রের মাধ্যমে টিকে থাকবে বা সমৃদ্ধি লাভ করবে।
মুসলমানদের এখন একটি ইহজাগতিক ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র দরকার যে রাষ্ট্র ধর্মীয় স্বাধীনতা ও মানবিক মর্যাদাকে শ্রদ্ধা করবে। যে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে, “জনগণই ক্ষমতার উৎস’ এই নীতির ওপর ভিত্তি করে। এর অর্থ হলো রক্ষণশীল ইসলামী পণ্ডিতদের দাবির মর্ম অনুযায়ী ইসলামী রাষ্ট্রে সার্বভৌমত্ব আল্লাহ প্রতিনিধি বা ইসলামী আইনবেত্তাদের ওপরে, জনগণের ওপর নয়, এই মতবাদের সঙ্গে বিরোধ হেতু তা বাতিল করা ।
মুসলমানদের অবশ্যই বিন-লাদেন ধরনের কারো দিকে তাকানোর দরকার নেই; ওই সমস্ত লোকের কাছে কোনো প্রকৃত উত্তর নেই এবং তারা কোনো বাস্ত বসম্মত বিকল্পও দিতে পারে নাই। তাদের সন্ত্রাসবাদকে মহিমান্বিত করা এক ভয়ঙ্কর ভুল : পাকিস্তানে শিয়া, খ্রিষ্টান ও আহমদীদের তাদের ধর্মীয় উপাসনাস্থানে অবিরাম হত্যা এবং অন্যান্য মুসলিম দেশে সে দেশের সংখ্যালঘুদের একই পরিণতি প্রমাণ করে যে সকল সন্ত্রাস অধিকারচ্যুতদের বিপ্লবজাত নয়।
যুক্তরাষ্ট্রকেও তিক্ত সত্যের মুখোমুখি হতে হবে। জর্জ ডবিস্নউ বুশ ও টনি বেস্লয়ারের বাণী ধুলায় গড়াগড়ি গেলেও— লাদেন জীবিত মৃত যাই হোক না কেন, তার বাণী মুসলিম বিশ্বে প্রবলভাবে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হতে থাকে । বিন-লাদেনের ধর্মীয় চরমপন্থা বহু মুসলমানকে নিরুৎসাহিত করে, কিন্তু তারা তার রাজনৈতিক বাণীকে নিজস্ব চিন্তার সঙ্গে সম্পর্কিত করে নিতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রকে অবশ্যই প্যালেস্টাইনিদের অধিকারচ্যুত করার ব্যাপারে ইরাইলীদের সাহায্য বন্ধ করতে হবে। শুধুমাত্র নিজস্ব স্বার্থ হাসিল করে বলেই বিশ্বের দুর্নীতিপরায়ণ ও স্বৈরাচারী শাসকদের টিকিয়ে রাখার জন্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রচেষ্টা বন্ধ করতে হবে।
আমেরিকানদের অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে তাদের আত্যন্তিক বিজয় গর্ব এবং আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি অবজ্ঞা শুধু মুসলমানদের মধ্যেই নয়— সর্বত্র শত্রুর সৃষ্টি করেছে । অতএব তাদের আরো কম একগুঁয়ে এবং বিশ্বের অন্য মানুষের মতো হতে হবে।
আমাদের সমবেতভাবে টিকে থাকা এই সত্য স্বীকারের ওপর নির্ভর করে যে সন্ত্রাসবাদেকোন সমাধান নেই, জাতীয়তাবাদেও নয়। আমাদের মাত্র একটাই পছন্দ আছে : যুক্তবাদের পদ্ধতি ও যুক্তির ওপর নির্ভরশীল সেক্যুলার মানবিকতার পথ। শুধুমাত্র এই পথই এই বিশ্বের সকলকে জীবনের নিশ্চয়তা, স্বাধীনতা এবং সুখের সন্ধান দিতে পারে ।
প্রথম অধ্যায়ঃ যুক্তিবাদ মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্কতা
♦ মন্দের যুক্তি ও ঈশ্বরের অস্তিত্ব
♦ বিজ্ঞান মনস্কতা ও বিজ্ঞানমনস্ক সমাজনির্মাণ
♦ ইন্টিলিজেন্ট ডিজাইন নিয়ে কূটকচাল
♦ ব্রুনোর আত্মত্যাগ ও যুক্তিবাদ
♦ ইহজাগতিকতা ও আরজ আলী মাতুব্বর- একজন যুক্তিবাদী দার্শনিক
♦ বাংলাদেশে চেতনা-মুক্তির লড়াই
♦ ইসলাম যেভাবে নিজের পথ থেকে সরে গেছে
♦ বিজ্ঞান, বিজ্ঞানমনস্কতা বনাম কোরানিক বিজ্ঞান
দ্বিতীয় অধ্যায়ঃ ধর্ম ও নৈতিকতা
♦ জীবিত ইসলামের মৃত গৌরবের কথা
♦ রামায়ণ কাহিনীর ঐতিহাসিকতা একটি একাডেমিক আলোচনা
♦ মানবতাভিত্তিক সংবিধান এবং অমানবিক বিধান
♦ ধর্মের উপযোগিতাঃ জনৈক বিবর্তনবাদীর দৃষ্টিতে
♦ ধর্মরাষ্ট্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও রাষ্ট্রধর্ম
♦ মানুষের জন্য ধর্ম, না ধর্মের জন্য মানুষ?
♦ বিজ্ঞান কি উপাসনা-ধর্মের প্রতিদ্বন্দ্বী
তৃতীয় অধ্যায়ঃ অন্যান্য প্রসঙ্গ
♦ হাইপেশিয়াঃ এক বিস্মৃতপ্ৰায় গণিতজ্ঞ নারীর বেদনাঘন উপাখ্যান
♦ শাশ্বত এথেন্সের নারী ও তার বিপর্যস্ত ধারাবাহিকতা
“স্বতন্ত্র ভাবনাঃ মুক্তচিন্তা ও বুদ্ধির মুক্তি” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ