আমি কি আড়াল করিয়া রেখেছি তব বন্ধু’র মুখ?

না জানিয়া আমি না জানি কতই দিয়াছি তোমায় দুখ।

তোমার কাননে দখিনা পবন

এনেছিল ফুল পূজা-আয়োজন,

আমি এনু ঝড় বিধাতার ভুল –ভণ্ডুল করি’ সব,

আমার অশ্রু-মেঘে ভেসে গেল তব ফুল-উৎসব।

 

মম উৎপাতে ছিঁড়েছে কি প্রিয়, বক্ষের মণিহার?

আমি কি এসেছি তব মন্দিরে দস্যু ভাঙিয়া দ্বার?

আমি কি তোমার দেবতা –পূজার

ছড়ায়ে ফেলেছি ফুল-সম্ভার?

আমি কি তোমার স্বর্গে এসেছি মর্ত্যের অভিশাপ?

আমি কি তোমার চন্দ্রের বুকে কালো কলঙ্ক-ছাপ?

 

ভুল ক’রে যদি এসে থাকি ঝড়, ছিঁড়িয়া থাকি মুকুল,

আমার বরষা ফুটায়েছে তার অনেক অধিক ফুল !

পরায়ে কাজল ঘন বেদনার

ডাগর করেছি নয়ন তোমার,

কূলের আশায় ভাঙিয়া করেছি সাত সাগরের রানী,

সে দিয়াছে মালা, আমি সাজায়েছি নিখিল সুষমা ছানি’ ।

 

দস্যুর মত হয়ত খুলেছি লাজ-অবগুণ্ঠন,

তব তরে আমি ‘দস্যু, করেছি ত্রিভুবন লুণ্ঠন!

তুমি ত জান না, নিখিল বিশ্ব

কার প্রিয়া লাগি’ আজিকে নিঃস্ব?

কার বনে ফুল ফোটাবার লাগি’ ঢালিয়াছি এত নীর,

কার রাঙা পায়ে সাগর বাঁধিয়া করিয়াছি মঞ্জীর।

তুমি না চাহিতে আসিয়াছি আমি —সত্য কি এইটুক?

ফুল ফোটা-শেষে ঝরিবার লাগি’ ছিলে না কি উৎসুক?

নির্মম-প্রিয়-নিষ্ঠুর হাতে

মরিতে চাহ নি আঘাতে আঘাতে?

তুমি কি চাহ নি মিলনের মাঝে নিবিড় পীড়ন-জ্বালা?

তুমি কি চাহ নি কেহ এসে তব ছিঁড়ে দেয় গাঁথা-মালা?

 

পাষাণের মত চাপিয়া থাকি নি তোমার উৎস-মুখে,

আমি শুধু এসে মুক্তি দিয়াছি আঘাত হানিয়া বুকে

তোমার স্রোতেরে মুক্তি দানিয়া

স্রোতমুখে আমি গেলাম ভাসিয়া ।

রহিবার যে –সে রয়ে গেল কূলে, সে রচুক সেথা নীড় !

মম অপরাধে তব স্রোত হ’ল পুণ্য তীর্থ-নীর !

 

রূপের দেশের স্বপন-কুমার স্বপনে আসিয়াছিনু,

বন্দিনী ! মম সোনার ছোঁয়ায় তব ঘুম ভাঙাইনু।

দেখ মোরে পাছে ঘুম ভাঙিয়াই,

ঘুম না টুটিতে তাই চ’লে যাই,

যে আসিল তব জাগরণ-শেষে মালা দাও তারি গলে,

সে থাকুক তব বক্ষে —রহিব আমি অন্তর-তলে ।

 

সন্ধ্যা-প্রদীপ জ্বালায়ে যখন দাঁড়াবে আঙিনা-মাঝে,

শুনিও কোথায় কোন্ তারা-লোকে কার ক্রন্দন বাজে !

আমার তারার মলিন আলোকে

ম্লান হয়ে যাবে দীপশিখা চোখে,

হয়ত অদূরে গাহিবে পথিক আমারি রচিত গীতি—

যে গান গাহিয়া অভিমান তব ভাঙাতাম সাঁঝে নিতি ।

 

গোধূলি-বেলায় ফুটিবে উঠানে সন্ধ্যা-মণির ফুল,

তুলসী-তলায় করিতে প্রণাম খুলে যাবে বাঁধা চুল।

 

কুন্তল-মেঘ-ফাঁকে অবিরল

অকারণে চোখে ঝরিবে গো জল,

সারা শর্বরী বাতায়নে বসি নয়ন-প্রদীপ জ্বালি’

খুঁজিবে আকাশে কোন্ তারা কাঁপে তোমারে চাহিয়া খালি ।

নিষ্ঠুর আমি –আমি অভিশাপ, ভুলিতে দিব না, তাই

নিঃশ্বাস মম তোমারে ঘিরিয়া শ্বসিবে সর্বদাই।

তোমারে চাহিয়া রচিনু যে গান

কণ্ঠে কণ্ঠে লভিবে তা প্ৰাণ,

আমার কণ্ঠ হইবে নীরব, নিখিল-কণ্ঠ-মাঝে

শুনিবে আমারি সেই ক্রন্দন সে গান প্রভাতে সাঁঝে !

error: Content is protected !!