আশালতা বৈদ্য (কোটালিপাড়া)

মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে বাঙালিদের ওপর নেমে আসে সীমাহীন নির্যাতন। পাকবাহিনীর হিংস্র থাবা থেকে মুক্তি পাবার জন্য এদেশের প্রায় এক কোটি লোক শরণার্থী হিসেবে ভারতে আশ্রয় নেয়। একই সময় মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের লক্ষ্যে ভারতে সশস্ত্র প্রশিক্ষণও নেয় হাজার হাজার তরুণ-তরুণী। একইভাবে দেশের অভ্যন্তরেও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সৈনিকদের তত্ত্বাবধানে গড়ে ওঠে প্রশিক্ষণ শিবির। স্বদেশে প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজের জীবনের মায়া ত্যাগ করে দেশ মাতৃকার মুক্তির জন্য এদেশের দামাল ছেলেরা ঝাঁপিয়ে পড়ে মুক্তি সংগ্রামে । এই মহান মুক্তিযুদ্ধে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও রেখেছে প্রশংসনীয় অবদান। বিভিন্ন জায়গায় পাকবাহিনীর ওপর প্রচণ্ড আঘাত হেনেছে নারীরা। স্থানীয়ভাবে প্রশিক্ষণ পেয়ে নিজেদেরকে প্রকাশ করেছেন একজন সফল যোদ্ধা হিসেবে। এমন একজন নারী আশালতা বৈদ্য।

১৯৫৬ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি গোপালগঞ্জ জেলার কোটালিপাড়া থানার সাদুল্লাহপুর ইউনিয়নের লাটেংগা গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত হিন্দু পরিবারে আশালতা বৈদ্যের জন্ম। তাঁর বাবা হরিপদ বৈদ্য ছিলেন একজন স্কুল শিক্ষক এবং মা সরলাময়ী বৈদ্য গৃহিণী।

একাত্তর সালের মে মাসে পাকসেনারা ঘিরে ফেলে পূর্ববাংলার প্রায় সকল গ্রামগঞ্জ। নির্বিচারে হত্যা করে নিরীহ গ্রামবাসীকে। ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। সমগ্র বাঙালি জাতির ওপর নেমে আসে সীমাহীন নির্যাতন। বাধ্য হয়ে শরণার্থী হিসেবে ভারতে আশ্রয় নেয় লাখ লাখ নিরীহ মানুষ। পাকবাহিনীর এই সীমাহীন নির্যাতনে ক্ষিপ্ত ও প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন আশালতা বৈদ্য।

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আশালতারা দু’বোন পূর্ণ যুবতী। রাজাকারদের লোলুপ দৃষ্টি পড়ে তাদের দু’বোনের ওপর। আশালতার বাবা হরিপদ বাবু ছিলেন এলাকার স্থানীয় এবং মোটামুটি অর্থশালী ব্যক্তি। রাজাকারেরা আশালতাদের বাড়িঘর দখলের হীন পাঁয়তারা করেছিল। তারা আশার বাবার নিকট ছয় লক্ষ টাকা দাবি করে। টাকা না দিতে পারলে আশালতাকে আর তাঁর বোনকে রাজাকারদের হাতে তুলে দিতে বলে। হুঙ্কার দিনে এক’দুবার তারা আশালতার বাবাকে শোনায় । অবশেষে রাজাকারেরা আশালতার বাবাকে এক সপ্তাহ সময় দেয়। এক সপ্তাহের মধ্যে টাকা দিতে না পারলে তারা আশালতাদের দুই বোনকে তুলে নিয়ে যাবে।

মেয়েদের রক্ষার চিন্তায় আশালতার বাবা বিমূঢ়। আশালতাদের নিয়ে ভারত যাবে না দেশে থাকবে, এটা নিয়েই চিন্তিত আশালতার বাবা। এ ঘটনা হেমায়েত বাহিনীর প্রধান হেমায়েত উদ্দিন জানতে পেরে এক রাতে আশালতাদের বাড়িতে আসেন এবং তাঁর বাবাকে ভারত যাওয়া থেকে নিবৃত্ত করেন। তিনি আশালতাকে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের জন্য প্রস্তাব দেন। নিজেদের রক্ষার জন্য আশালতা হেমায়েত উদ্দিনের প্রস্তাবে সম্মত হন এবং মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেন।

আশালতার প্রথম প্রশিক্ষণ হয় কোটালিপাড়া থানার লেবুবাড়ি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে। এটা ছিল মহিলাদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। এখানে ৪৫জন নারী মুক্তিযোদ্ধার প্রথম ব্যাচের প্রশিক্ষণ হয়। এরপর তিনি প্রশিক্ষণ নেন কোটালিপাড়া থানার নারিকেল বাড়ি হাইস্কুল মাঠে। এই নারিকেল বাড়ি ছিল হেমায়েত বাহিনীর আর একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র । এখানে তাঁরা নারী পুরুষ সম্মিলিতভাবে প্রশিক্ষণ নেন । তিনি গেরিলা প্রশিক্ষণ নেন ভাংগারহাট হাইস্কুল মাঠে। নারিকেল বাড়ি ও লেবুবাড়ির মতো আরো একটা প্রশিক্ষণকেন্দ্র ছিল জহুরকান্দি স্কুলে। এখানে সুইসাইড স্কড পরিচালনা বিষয়ক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন তিনি। বিভিন্ন পর্যায়ে তিনি সর্বমোট তিন মাসের সমরবিদ্যা বিষয়ক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। তিনি যে-সমস্ত আগ্নেয়াস্ত্রের প্রশিক্ষণ নেন সেগুলো হলো— ৩০৩ রাইফেল, পিস্তল, গ্রেনেড ও বিভিন্ন ধরনের বিস্ফোরক ব্যবহার। হেমায়েত উদ্দিন, কমলেশ বাবু ও বাবুল আক্তার তাঁদের এই প্রশিক্ষণ দেন । মহিলাদের প্রশিক্ষণের দায়িত্বে ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা শেখ জবেদ আলী। সমরাস্ত্রের পাশাপাশি তিনি চিকিৎসার জন্য ফার্স্ট এইড এবং গোয়েন্দাবৃত্তির কৌশল বিষয়ক প্রশিক্ষণও গ্রহণ করেন।

আশালতা সরাসরি বেশ কয়েকটি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। এরমধ্যে ঘাগর বাজার যুদ্ধ, কলাবাড়ির যুদ্ধ, রামশীল পায়শারহাট যুদ্ধ বিশেষভাবে উল্লেখ্যযোগ্য। এই যুদ্ধক্ষেত্রগুলো ছিল গোপালগঞ্জ জেলার কোটালিপাড়া থানার অন্তর্গত। এ সকল যুদ্ধ, হেমায়েত উদ্দিন ও কমলেশ বাবুর সরাসরি কমান্ডিং-এ পরিচালিত হয়। উল্লিখিত যুদ্ধে আশালতা সরাসরি অংশগ্রহণ করেন এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। এছাড়া হেমায়েত উদ্দিনের নির্দেশ ও সহযোগিতায় ২৪জন সশস্ত্র নারী গেরিলাদের গঠিত একটা দলের কমান্ডার নিযুক্ত হন তিনি। শত্রুর অবস্থান জানার জন্য রেকি করা, বিভিন্ন ছদ্মবেশী রূপে সশস্ত্র আক্রমণ করা সুইসাইড স্কড হিসেবে কাজ করা ছিল এই গ্রুপের অন্যতম দায়িত্ব। সশস্ত্র যুদ্ধে আত্মাহুতি বাহিনীর মতো কাজ করতে তাঁরা থাকতেন সর্বদা প্রস্তুত। হেমায়েত উদ্দিনের নির্দেশে দেশ স্বাধীনের পূর্ব পর্যন্ত তিনি তাঁর ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করেন।

মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের জন্য তিনি এ সমাজের নিকট থেকে পেয়েছেন সীমাহীন গঞ্জনা। গোচরে-অগোচরে এ সমাজ নানাভাবে কটূক্তি করেছে তাঁকে নিয়ে। নীরবে তিনি এসব অপবাদ সহ্য করেছেন। মাঝে মাঝে তাঁর নিজের ওপর ভীষণ ঘৃণা হয়েছে। তিনি আফসোস করে বলেন, আমরা যখন পুরুষের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছি তখন মানসম্মান যায় নি। যখন মা-বোনদের রক্ষা করেছি তখন সম্মান যায় নি। তখন আমরা তাদের কাছে ছিলাম সম্মানীয়। দেশ স্বাধীনের পরে সমাজের নিকট নারী যোদ্ধাদের প্রয়োজন শেষ হয়ে যায়। নারীযোদ্ধাদের সইতে হয় নানান রকম সামাজিক ধিক্কার।

দেশ স্বাধীনের পরে এসএসসি, এইচএসসি এবং বাংলায় অনার্সসহ মাস্টার্স পাশ করেন আশালতা বৈদ্য। ছাত্র-জীবন থেকে এ পর্যন্ত তিনি বিভিন্নমুখী সমাজকল্যাণমূলক সংস্থার সাথে জড়িত আছেন। বর্তমানে সূর্যমুখী সমাজকল্যাণ সংস্থার নির্বাহী পরিচালক হিসেবে কাজ করছেন আশালতা।

আশালতা সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পেরে গর্বিত। মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের জন্য এখন অবশ্য আত্মীয়স্বজনসহ পরিবারের সকলে তাকে শ্রদ্ধা করে।

error: Content is protected !!