আইনস্টাইনের সময় বিজ্ঞানীরা দুর্বল ও সবল নিউক্লিয় বলের কোন হদিস পাননি । আইনস্টাইনের মূল ভাবনা ছিল তাই মহাকর্ষ এবং তড়িচ্চুম্বক বলকে ঘিরে। তিনি এই দুটি বলকে একটিমত্র সূত্রের মাধ্যমে প্রকাশ করবার লক্ষ্যে জীবনের শেষ ত্রিশ বছর ধরে প্রাণান্তকর চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। এই সেই তথাকথিত একীভূত ক্ষেত্র তত্ত্ব বা ‘Unified field theory’ যার মাধ্যমে আইনস্টাইন স্বপ্ন দেখেছিলেন প্রকৃতিজগতের বলগুলোকে একটিমাত্র সূতায় গাঁথতে। কিন্তু আইনস্টাইন আজীবন চেষ্টা করেও এই ‘বিনি সুতার মালাখানি’ গাঁথতে পারলেন না, বরং তার স্বপ্ন পূরণের উচ্চাভিলাসী পরিকল্পনা তাঁকে জীবনের শেষ বছরগুলোতে এক ‘নিঃসঙ্গ গ্রহচারী’তে পরিনত করে। শধু এই একটি বিষয়ে নিজের সমস্ত মেধা ও শক্তি নিয়োগ করায় পদার্থবিজ্ঞানের তৎকালীন মূলধারার গবেষণা থেকে তিনি ক্রমশঃ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছিলেন। আইনস্টাইন যে ব্যাপারটি বুঝতে পারেন নি তা নয়। ১৯৪২ সালে তার এক বন্ধুকে লেখা চিঠিতে আইনস্টাইন বললেন,
‘আমি একজন বৃদ্ধ কিশোরে পরিণত হয়েছি, যিনি এখন মোজা পরেন না বলে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছেন এবং বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠানে একধরনের ‘কৌতুহলী দ্রষ্টব্য’ হিসেবে প্রদর্শিত হন।’ (সূত্রঃ Albert Einstein, 1942 letter to a friend, as quoted in Tony Hey and Patrik Walters, Einstein’s Mirror, Cambridge, Eng.: New York: Pantheon, 1992 )
আসলে আইনস্টাইন তার সময়ের চেয়ে আনেক আগ্রগামী ছিলেন। আইনস্টাইনের সময় যে ব্যাপারটিকে স্রেফ ‘উচ্চাভিলাসী স্বপ্ন’ বলে মনে হয়েছিল, আজ অর্ধশতাব্দীরও বেশী সময় পর সেই স্বপ্নটিকেই পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণার সবচাইতে শক্তিশালী স্রোতধারা হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে।
কয়েক দশক আগে গ্লাসো, সালাম আর ভাইনবার্গ মিলে তড়িচ্চুম্বক আর দুর্বল পারমানবিক বলকে একসূত্রে গাঁথলেন -আইনস্টাইনের লালিত স্বপ্নের প্রাথমিক একটি ধাপ সম্পন্ন হল । স্বপ্নের পরবর্তী ধাপ অর্থাৎ, ‘দুর্বল তড়িৎ’, ‘সবল নিউক্লিয়’ এবং মহাকর্ষ এই বল তিনটিকে এক করবার মত উপযুক্ত তত্ত্ব যদিও এখনো পাওয়া যায়নি, কিন্তু, ‘নন-গ্র্যাভিটেশনাল বল’ তিনটিকে (দুর্বল, সবল এবং তড়িচ্চুম্বক) কোয়ান্টাম বলবিদ্যার সাহায্যে একটিমাত্র বোধগম্য ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব হয়েছে অনেক আগেই। চতুর্থ বল অর্থাৎ মহাকর্ষকে ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে সবচাইতে যে আলোচিত তত্ত্ব – আপেক্ষিকতার ব্যাপক (সাধারণ) তত্ত্ব – তাকে কিন্তু আলোচনার বাইরেই রাখতে হচ্ছে এই মুহূর্তে। কারণ আপেক্ষিকতার ব্যাপক তত্ত্বটি একটি চিরায়ত তত্ত্ব (Classical theory), কোনমতেই কোয়ান্টাম বলবিদ্যার সম্ভাবনার জগতের সাথে খাপ খায় না; আর খাপ খায়না বলেই যত উটকো ঝামেলা আর বিরোধের উৎপত্তি। আধুনিক পদার্থবিদ্যার একটি প্রাথমিক লক্ষ্য এই মুহূর্তে আপেক্ষিকতার ব্যাপক তত্ত্ব (General Theory of Relativity) এবং কোয়ান্টাম তত্ত্বের (Quantum theory) ভিতরকার অনাকাঙ্ক্ষিত বিরোধ মিটিয়ে ফেলা। তাত্ত্বিক পদার্থবিদরা চেষ্টা করেছেন ঢের, কিন্তু ব্যাপারটি তাদের জন্য মোটেও সহজ হয়নি। আসলে আপেক্ষিকতার ব্যাপক তত্ত্ব আর কোয়ান্টাম বলবিদ্যা বস্তু জগতের উপর সম্পূর্ণ আলাদাভাবে কাজ করে। বিজ্ঞানীরা সম্মিলিত সমীকরণের (Combined Equation) সাহায্যে আপেক্ষিক তত্ত্ব এবং কোয়ান্টাম বলবিদ্যাকে এক সূত্রে গাঁথার উদ্যোগ নিয়েছিলেন, কিন্তু এ ধরনের প্রচেষ্টায় প্রায় ক্ষেত্রেই একটিমাত্র উত্তর বেরিয়ে আসে – Infinity। সমস্যা এটাই। পদার্থবিদদের কাছে এই উত্তর একটি অবোধ্য কবিতা ননসেনস রাইম। কারণ ব্যবহারিক পদার্থবিদরা অসীমতা বা ইনফিনিটিকে কোনভাবেই মাপতে পারেন না। আমাদের চিরচেনা বস্তুজগৎ কাজ করে সসীম মাত্রায় – তা সে মোটরগাড়ীর গতিই হোক আর ইলেকট্রনের ঘূর্ণনই হোক । তাই সমীকরণ থেকে প্রাপ্ত উত্তর – ‘ইনফিনিটি’ পদার্থবিদদের হতাশ করে, স্তিমিত করে। আইনস্টাইনের স্বপ্নের ‘সোনার কাঠি’ বুঝি অধরাই থেকে যায়।
অনেক পাঠক হয়ত ভাবতে পারেন, আপেক্ষিক তত্ত্ব আর কোয়ান্টাম তত্ত্বের মধ্যে যখন এতই বিরোধ, তা না মিটালেই বা এমন কি ক্ষতি? সব বিরোধ যে সব সময় মিটাতে হবে তারও তো কোন কথা নেই; বিরোধ থাকলে কীই বা এমন যায় আসে? হ্যা, ব্যাপারটা সত্যিই; হতে পারে সম্মিলিত সমীকরণগুলো ‘অর্থহীন’ ফলাফল হাজির করছে, কিন্তু সমীকরণগুলো তো একসাথে কখনই ব্যবহৃত হয় না। বহুবছর ধরে জ্যোতির্পদার্থবিদরা দেখেছেন – স্থুল জগতের (macro world) বর্ণনায় অর্থাৎ, গ্রহ তারকামন্ডল, নিহারীকার বিচলন, এমনকি সমস্ত মহাবিশ্বের প্রসারণে আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব অত্যন্ত সাফল্যের সাথে বিগত সময়গুলোতে ব্যবহৃত হয়েছে, ঠিক একইভাবে আনুবীক্ষনিক জগতের (micro world) বর্ণনায়, মানে অণু পরমাণু ও কণিকার জগতে কোয়ান্টাম বলবিদ্যার সূত্রাবলী ব্যবহৃত হয়েছে নিখুঁত সৌন্দর্যে। যেহেতু আপেক্ষিক তত্ত্ব আর কোয়ান্টাম তত্ত্ব দুইই তাদের নিজস্ব পরিমন্ডলে অত্যন্ত সফল, কেন অযথা তাদের একীভূত করার প্রচেষ্টা? তাদের আলাদা রাখলেই তো হয়। আপেক্ষিক তত্ত্বকে বৃহৎ বস্তুরাজির জগতে আর কোয়ান্টাম বলবিদ্যাকে অতিক্ষুদ্র বস্তুকণার জগতে আলাদাভাবেই বরং প্রয়োগ করি না কেন! সমস্যাটা কি?
না সমস্যা নেই। সত্যি বলতে কি, বিজ্ঞানীরা এতদিন ধরে এভাবেই কাজ করেছেন, মানে সূত্রদুটিকে আলাদা ভাবে প্রয়োগ করেছেন। আর অস্বীকার করার জো নেই, এভাবে আলাদা আলাদাভাবে প্রয়োগ ‘অত্যন্ত সফল’ বলে প্রমাণিতও হয়েছে; আর মানবজাতিও উপকৃত হয়েছে স্বীয় পরিমন্ডলের নান্দনিক সৌন্দর্যে। কিন্তু এত কিছুর পরও তাত্ত্বিক পদার্থবিদরা মনে করেন, আপেক্ষিক তত্ত্ব আর কোয়ান্টাম তত্ত্বের বিরোধ মেটানো জরুরী। এর কারণ মূলতঃ দুটি।
প্রথমতঃ GUT লেভেলে পদার্থবিজ্ঞানের দুটি শক্তিশালী বিচরণক্ষেত্রকে আলাদা করা যাচ্ছে না – এই ব্যাপারটি বিজ্ঞানীদের জন্য একই সাথে অবিশ্বাস্য এবং অস্বস্তিকর। ওই স্তরে নেমে আসলে ব্যাপারটা আর এমন থাকে যে, কিছু ঘটনাকে আপেক্ষিকতার সাহায্যে আর কিছু ঘটনাকে কোয়ান্টাম সূত্রের সাহায্যে ব্যাখ্যা করে দায়িত্ব শেষ করা যায়। আর তাছাড়া বিজ্ঞানীরা মনে করেন, সামগ্রিকভাবে বিশ্বজগতকে দুটি আলাদা পরিমন্ডলে ভাগ করে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা কৃত্রিম এবং অনভিপ্রেত। কোয়ান্টাম আর আপেক্ষিক তত্ত্বের বিরোধ থেকে যাওয়া মানে আসলে বস্তুজগৎ সম্বন্ধে আমাদের অর্জিত জ্ঞান এখনো অপর্যাপ্তই রয়ে গেছে বলে বুঝতে হবে। তারা মনে করেন যে, দীর্ঘদিনের এই বিরোধ মিটলে আমাদের এই চিরচেনা প্রকৃতিজগতকে স্রেফ একটিমাত্র সূত্রের সাহায্যে (সেই যে তথাকথিত Theory of Everything সংক্ষেপে T.O.E) ব্যাখ্যা করা সম্ভব।
দ্বিতীয়তঃ বড় বড় বস্তুর ক্ষেত্রে আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্ব, আর ছোট বস্তুকণার ক্ষেত্রে কোয়ান্টাম বলবিদ্যার আলাদা প্রয়োগের ব্যাপারটি সবসময় সমানভাবে কার্যকরী নয়। কৃষ্ণ গহবর (Black Hole) এক্ষেত্রে খুব ভাল উদাহরণ। আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্ব থেকে আমরা জানছি, কৃষ্ণ গহবরের আভ্যন্তরীণ পদার্থসমূহ ঘন সন্নিবদ্ধ হয়ে গহবরের কেন্দ্রে একটি ক্ষুদ্র বিন্দুতে বিলীন হয়। এই আকর্ষনীয় ব্যাপারটা কৃষ্ণ গহবরের কেন্দ্রকে একই সাথে বৃহদাকার (ভর বিশিষ্ট) এবং ক্ষুদ্রাকার (আয়তন বিশিষ্ট) সত্ত্বায় পরিণত করেছে। আপেক্ষিকতার ব্যাপক তত্ত্ব প্রয়োগের ব্যাপারটা আসছে বৃহৎ ভরের কারণে সৃষ্ট মহাকর্ষ ক্ষেত্রকে সামলাতে, আর কোয়ান্টাম বলবিদ্যার ব্যাপারটা গোনায় ধরতে হচ্ছে কৃষ্ণ গহবরের অত্যন্ত ঘন সন্নিবেশিত ক্ষুদ্রায়তনের জন্য। কিন্তু সম্মিলিত সমীকরণগুলো এই বিশেষ অবস্থায় প্রয়োগ করতে গিয়ে দেখা গেছে যে, এই বিশেষ অবস্থায় তারা ভেঙে পড়ে, ফলে কৃষ্ণ গহবরের কেন্দ্রে ঠিক কি হচ্ছে আমরা আজো তা পরিস্কারভাবে বুঝে উঠতে পারি নি।
বোঝা যাচ্ছে যে, আপেক্ষিক তত্ত্ব আর কোয়ান্টাম বলবিদ্যার মিলনের ব্যাপারটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তবে গুরুত্বের মাত্রাটা আরও বেশী অন্য জায়গায়। তত্ত্ব দুটির মধ্যে বিরোধ থাকার অর্থ হল আমাদের মহাবিশ্বের শুরুর দিকের ঘটনাবলী বুঝার ক্ষেত্রে সবসময়ই এটি একটি বিশাল অন্তরায় হয়ে রইবে। কারণটা বোঝা মোটেও কষ্টকর নয়।
আমরা ইতিমধ্যেই জেনেছি যে, প্রায় ১৫০০ কোটি বছর পূর্বে এক ঘন সন্নিবেশিত অদ্বৈত বিন্দু (Singularity point) থেকে এক মহাবিস্ফোরণের (Big Bang) মাধ্যমে আমাদের এই মহাবিশ্বের উৎপত্তি। বিশ্বব্রহ্মান্ডের প্রাথমিক অবস্থাটা তা হলে অনেকটা কৃষ্ণগহবরের কেন্দ্রের মতই দাঁড়াচ্ছে। প্রাথমিক মহাবিশ্বের বিশাল ঘন অবস্থাটিকে সঠিকভাবে ব্যাখ্যার জন্য দরকার আপেক্ষিকতার ব্যাপক তত্ত্বের আবার মহাবিশ্বের সে সময়কার অতি ক্ষুদ্র আয়তন দাবী করে বসে কোয়ান্টাম বলবিদ্যা প্রয়োগের। কিন্তু আগের মতই আমরা দেখছি যে একীভূত সমীকরণকে এই বিশেষ অবস্থায় এসে ভেঙে পড়তে। কোয়ান্টাম বলবিদ্যা আর আপেক্ষিক তত্ত্বের বিরোধের কারণে মহাবিশ্বের প্রাথমিক নিয়ামক সম্বন্ধে আমরা এখনো অজ্ঞই থেকে যাচ্ছি। বিজ্ঞানীরা তাই মনে করেন, মহাবিশ্বের শুরুর দিককার ঘটনাবলী সঠিকভাবে বুঝতে হলে আপেক্ষিক তত্ত্ব আর কোয়ান্টাম তত্ত্বের বিদ্যমান বিরোধ মেটাতেই হবে। বড় কণিকা আর ছোট কণিকার মধ্যকার ‘শ্রেনীগত’ বিরোধ মিটিয়ে ‘সাম্য’ প্রতিষ্ঠিত করতে পারলেই কেবলমাত্র প্রকৃতিজগৎকে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করা সম্ভব বলে অনেক বিজ্ঞানীই মনে করছেন।
আর এজন্যই স্ট্রিং তত্ত্ব বিজ্ঞানীদের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। স্ট্রিং তত্ত্ব এই মুহূর্তে শুধু কোয়ান্টাম বলবিদ্যা আর আপেক্ষিক তত্ত্বের দীর্ঘদিনের বিরোধ মেটাবার প্রত্যাশা দিচ্ছেই না, বরং সেই সাথে মহাবিশ্বের উৎপত্তির এক অজানা অধ্যায় আমাদের সামনে উন্মোচিত করতে চলেছে। সত্যি কথা বলতে কি, স্ট্রিং তত্ত্বের আবির্ভাব বিজ্ঞানের জগতে অন্য সব আবিস্কারের মত বিজ্ঞানীদের নিরলস প্রচেষ্টায় ধীরে ধীরে গড়ে ওঠেনি বরং ‘আবির্ভূত’ হয়েছে হঠাৎ করেই, বলা যায় একদম আকস্মিকভাবে। স্ট্রিং তত্ত্বের অন্যতম প্রবক্তা এবং স্ট্রিং বিষয়ে বিশেষজ্ঞ এডওয়ার্ড উইটেন উদ্বেলিত হয়ে তাই বলে উঠেছেন
‘String theory is a part of twenty-first century physics that fell by chance into the twentieth century’ (Interview with Edward Witten, May 11, 1992)
উইটেনের উক্তি হতে বোঝা যায়, আলাদীনের চেরাগের মত হঠাৎ পাওয়া এ তত্ত্বকে পুরোপুরি বুঝতে, আত্মস্থ করে সম্পূর্ণভাবে গড়ে তুলতে কয়েক দশক এমনকি শতকও লেগে যেতে পারে। ব্যাপারটা অতিরঞ্জিত নয়। আসলে এই মুহূর্তে স্ট্রিং তত্ত্বের গাণিতিক অভিব্যক্তিগুলো এতটাই জটিল যে, এর প্রকৃত সমীকরণ কি হবে এ সম্বন্ধে কেউই খুব বেশী নিঃসন্দেহ নন। পদার্থবিজ্ঞানীরা এই মুহূর্তে পুরো সমীকরণ খোঁজা বা সমাধানের চেয়ে বরং ‘আসন্ন মনের (Approximation) উপর গুরুত্ব দিচ্ছেন। আর বলা বাহুল্য, সে সমস্ত আসন্ন সমীকরণগুলোর প্রকৃতিই এতটা জটিল যে, এখন পর্যন্ত কেবল সেগুলোর আংশিক সমাধান মিলেছে। আরেক জনপ্রিয় স্ট্রিং তাত্ত্বিক ব্রায়ান গ্রীন তাঁর ‘The Fabric of Cosmos’ বইয়ে স্ট্রিং তাত্ত্বিকদের এখনকার পরিস্থিতিকে এক আদিম উপজাতি কর্তৃক মাটি খুঁড়ে হঠাৎ করে একটি মহাকাশযান (space craft) পেয়ে যাওয়ার সাথে তুলনা করেছেন। সেরকম একজন মানুষ মহাকাশযানটি দেখে কি করবে? প্রথমে হাত দিয়ে ধরে ছুঁয়ে বুঝতে চাইবে চাইবে ব্যাপারটা কি। তারপর আস্তে আস্তে অনেকটা সময় পেরুলে হয়ত এক সময় উপলব্ধি করবে যে, পুরো মহাকাশযানটি কাজ করে আসলে ভিতরের কিছু বোতাম আর হাতলের সমন্বিত চালনায় ৷ স্ট্রিং তাত্ত্বিকদের এখনকার অবস্থাটা অনেকটা সেই আদিম উপজাতির প্রথমবারের মত মহাকাশযান দেখে হতবিহবল অবস্থার মতই করুণ! প্রতিদিনই তারা জ্ঞানের সোপান বেয়ে উপরের দিকে উঠছেন, অজানাকে জানছেন আর তত্ত্বকে সাধ্যমত সমৃদ্ধ করতে চাইছেন। কিন্তু তাঁদের এই তত্ত্বের ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী হতে এবং সার্বিকভাবে ঐক্যমতে পৌঁছুতে এখনো অনেকটা সময় লাগবে ৷
স্ট্রিং তত্ত্বের মূল ব্যাপারটি নিয়ে এবারে একটু আলোচনা করা যাক; একদম শুরু থেকে। আমরা সকলেই জানি, একটা বস্তুখন্ড তা সে একটা বরফের চাঁই ই হোক আর একটা পাথর খন্ডই হোক, ভেঙে টুকরো করা সম্ভব। আবার সেই টুকরোগুলোকেও ভেঙে আরো ছোট টুকরোয় পরিণত করা যায়। এখন থেকে প্রায় ২৫০০ বছর আগে গ্রীক পন্ডিতেরা এই ব্যাপারটি লক্ষ্য করে একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন যে, টুকরো করতে করতে এমন একটা সময় নিশ্চয়ই আসবে যখন পদার্থকে ভেঙে আরো ছোট টুকরায় পরিনত করা আর সম্ভব হচ্ছে না । তারা পদার্থের এই ক্ষুদ্রত্তম অংশের নাম দিলেন পরমানু বা Atom। তবে এই পরমাণু কিন্তু পদার্থের ক্ষুদ্রত্তম অংশ বা প্রাথমিক কণিকা নয় । আমরা ছেলেবেলায় পদার্থবিদ্যার পাঠ্যপুস্তকে পড়েছি যে, পরমাণুকেও ভাঙা সম্ভব। পরমাণুকে ভাঙলে পাওয়া যায় একটি নিউক্লিয়াসের চারিদিকে পরিভ্রমণত ইলেকট্রনকে। আর নিউক্লিয়াস গঠিত হয় প্রোটন আর নিউট্রনের সমন্বয়ে । বহুদিন পর্যন্ত ইলেকট্রন, প্রোটন আর নিউট্রনকে প্রাথমিক কণিকা মনে করা হত । কিন্তু ১৯৬৪ সালে ক্যালিফোর্ণিয়া ইনসটিটিউট অব টেকনোলজির তাত্ত্বিক পদার্থবিদ মারে গেলম্যান এবং ১৯৬৮ সালে স্ট্যানফোর্ড লিনিয়ার একসিলেটর সেন্টারের বিজ্ঞানীদের পর্যবেক্ষণে প্রমাণিত হল যে, প্রোটিন ও নিউট্রনগুলো আসলে আরো ক্ষুদ্র কণার সমন্বয়ে গঠিত – যার নাম কোয়ার্ক। তা হলে কোয়ার্ক এবং ইলেকট্রনই হল পদার্থের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সত্ত্বা, যাদেরকে আমরা বলছি প্ৰাথমিক কণিকা । স্ট্রিং তত্ত্ব কণিকা জগতের পরিচিত এই পরিচিত ছবিকে চ্যালেঞ্জ করে ঘোষনা করছে এই ইলেকট্রন আর কোয়ার্কগুলো আর কিছুই নয় বরং অতি ক্ষুদ্র এক ধরনের কম্পণশীল তন্তুর (String) কম্পনসৃষ্ট শক্তির এক একটি রূপ।
আসলে এই মুহূর্তে প্রাথমিক কণিকা কেবল কোয়ার্ক এবং ইলেকট্রনই নয়, তালিকায় রয়েছে মিউয়োন(muon) এবং টাউস (taus) নামক দুটি কণিকা যারা মহাবিস্ফোরণ পরবর্তীকালীন মহাবিশ্বেপ্রচু পরিমাণে ছিল বলে ধারণা করা হয়। এ ছাড়াও প্রাথমিক কণিকা হিসেবে পাওয়া গিয়েছে নিউট্রিনো (neutrino) – যা ট্রিলিয়ন মাইল পুরু সীসার আস্তরণকে অবলীলায় ভেদ করার ক্ষমতা রাখে।
এই তন্তু গুলোর আকার কিন্তু খুবই ছোট (১০৩ সেঃমিঃ) – একটি পরমাণু-কেন্দ্রীন বা নিউক্লিয়াসেরও লক্ষ লক্ষ গুন ছোট; এবং এরাই আসলে পদার্থের ক্ষুদ্রত্তম গঠন একক। তাহলে আমরা বুঝতে পারছি যে, উপরে যে সমস্ত প্রাথমিক কনিকার উল্লেখ করা হয়েছে তারা সবই আসলে ১০ সেঃমিঃ দৈর্ঘ্যের সুতোর বিভিন্ন মাত্রায় কম্পনের ফল ছাড়া আর কিছু নয়। গীটারের একটি তারকে বিভিন্নভাবে আঘাত করলে আমরা যেমন বিভিন্ন মাত্রার শব্দ শুনতে পাই, প্রায় একই রকম ব্যাপার ঘটে স্ট্রিং তত্ত্বের বেলাতেও। তবে স্ট্রিং তত্ত্বের স্ট্রিং গুলো কাঁপলে বিভিন্ন মাত্রার সুরধ্বনি পাওয়া যায় না, বরং পাওয়া যায় বিভিন্ন ধরণের কণিকা। কণিকাগুলোর ভর, চার্জ, ঘূর্ণন সবকিছুই আসলে নির্ধারিত হয় স্ট্রিং এর কম্পণের বিভিন্ন রকমফেরে। ইলেকট্রনের ক্ষেত্রে স্ট্রিং এক রকমভাবে কাঁপে, আর কোয়ার্কের ক্ষেত্রে কাঁপে অন্যভাবে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, একটিমত্র স্ট্রিং ই বিভিন্ন ভাবে স্পন্দিত হয়ে বস্তুকণার নির্দিষ্ট ভর, নির্দিষ্ট তড়িৎ আধান, নির্দিষ্ট ঘূর্ণন….. এধরনের নানা বৈশিষ্ট্যের প্রকাশ ঘটাচ্ছে। আর এই বৈশিষ্ট্যগুলোই কিন্তু এক ধরনের কণা থেকে আরেক ধরনের কণাকে আলাদা করছে।
ছবিটা বোধ হয় পাঠকদের কাছে আরেকটু স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন। সোজা কথায়, ব্যাপারটা এমন নয় যে, ‘ইলেকট্রন স্ট্রিং’ কম্পিত হয়ে তৈরী করল ইলেকট্রনের কিংবা ‘আপ-কোয়ার্ক’ স্ট্রিং কম্পিত হয়ে তৈরী করল ‘আপ কোয়ার্কের’ – বরং একটিমাত্র স্ট্রিং বিভিন্নভাবে কম্পিত হয়ে বিভিন্ন ধরনের কণা তৈরী করছে। এডওয়ার্ড উইটেনের ভাষায়, আপনার কাছে যদি বেহালা বা পিয়ানো থাকে, তাহলে লক্ষ্য করে থাকবেন যে, এটির তার বিভিন্ন আকৃতিতে কাঁপতে পারে। আমরা স্ট্রিং তত্ত্বে যে ধরনের তারের কথা বলছি, তাদের সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হল যে, এসব তারও নানা সম্ভাব্য আকার নিতে পারে। কাজেই ‘ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রিনো এবং এ জাতীয় কণিকাগুলি যে একই মৌলিক তন্তু সমূহের (basic strings) বিভিন্ন মোডের কম্পনের প্রকাশ’ এই ব্যাখ্যা থেকে প্রাথমিক কণিকাসমূহের একত্রীকরণের ধারণাটি উদ্ভুত হয়।
এই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটাই জন শোয়ার্জ (John Schwarz) এবং জোয়েল শ্যার্ক (Joel Scherk) মিলে ১৯৭৪ সালে গ্র্যাভিটন কণার ক্ষেত্রে সাফল্যজনকভাবে প্রয়োগ করলেন এবং মহাকর্ষ বলকে শেষ পর্যন্ত কোয়ান্টাম বলবিদ্যার অবকাঠমোর সাথে জুড়ে দিতে সমর্থ হলেন।
গ্র্যাভিটন কণার কথা অগেও বলা হয়েছে। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, প্রকৃতিজগতের বলগুলো কোয়ান্টাম লেভেলে বিশেষ বিশেষ কণার মাধ্যমে স্থানান্তরিত হয়। এই কণিকাগুলোকে বলা হয় ‘বার্তাবহ কণিকা” (messanger particle)। তড়িচ্চুম্বক বলের ক্ষেত্রে যেমন ‘ফোটন কণিকা’, তেমনি মহাকর্ষ বলের ক্ষেত্রে কল্পণা করা হয়েছে ‘গ্র্যাভিটন কণিকা’। এছাড়াও সবল নিউক্লিয় বলের ক্ষেত্রে আছে ‘গুয়োন’ (Gluon) আর দুর্বল নিউক্লিয় বলের জন্য রয়েছে W এবং Z কণা। স্ট্রিং তত্ত্ব আমাদের বলছে যে, প্রতিটি গ্র্যাভিটন আসলে প্ল্যাঙ্কের দৈর্ঘ্যের সেঃমিঃ) সমান দৈর্ঘ্য বিশিষ্ট এক কম্পণশীল তন্তু। আর যেহেতু এই গ্র্যাভিটন কণাই মহাকর্ষক্ষেত্রের ক্ষুদ্রত্তম প্রাথমিক উপাদান হিসেবে চিহ্নিত, তাই প্লাঙ্ক স্কেলের নীচে কোন কিছু নিয়ে আসলে কথা বলার কোন অর্থই হয় না। টিভি স্ক্রিন বা কম্পিউটরের মনিটরের ক্ষেত্রে ঔজ্জ্বল্যের ক্ষুদ্রত্তম একক হচ্ছে ‘পিক্সেল’, ঠিক তেমনি স্ট্রিং তত্ত্ব আমাদের গ্র্যাভিটনের ক্ষেত্রে ক্ষুদ্রত্তম সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে – ‘প্ল্যাঙ্ক স্কেল’। আর স্ট্রিং তত্ত্ব অনুযায়ী যেহেতু এই স্ট্রিংগুলোই বস্তুজগতের ক্ষুদ্রত্তম একক, কাজেই আমাদের আন্তঃ আনুবীক্ষণিক ভ্রমণ স্ট্রিং এ এসে শেষ হতে বাধ্য। যে দৈর্ঘ্যকে আমরা প্ল্যাঙ্কের দৈর্ঘ্য বলছি তা আসলে প্রকারান্তরে স্ট্রিংগুলোর নিজস্ব দৈর্ঘ্যের সমান।
স্ট্রিং তত্ত্ব কিন্তু আমাদের আরেকটি বিষয়ে বেশ ভাবাচ্ছে। এতদিন ধরে আমরা আমাদের চিরচেনা বিশ্বজগতকে জানতাম তিনটি নির্দিষ্ট মাত্রায় (দৈর্ঘ্য, প্রস্থ এবং উচ্চতা)। সময়কে আরেকটি মাত্রা ধরলে মাত্রার সংখ্যা দাঁড়ায় চারে। এই তিন মাত্রার (সময় সহ চার) ব্যাপারটা আমাদের কাছে অনেকটা যেন ‘ধ্রুব সত্য’ হিসেবেই বিবেচিত হয়েছে। নিউটন থেকে ম্যাক্সওয়েল, আর ম্যাক্সওয়েল থেকে আইনস্টাইন, সবাই তাঁদের পরিচিত বিশ্বকে ‘ত্রিমাত্রিক’ বিশ্ব হিসেবেই দেখেছেন – এ যেন ছিল অনেকটা আগামীকাল সূর্য উঠার মতই নিশ্চিত! স্ট্রিং তত্ত্ব আমাদের এতদিনকার বদ্ধমূল ধারণায় কুঠারাঘাত করে বলছে- আমাদের বিশ্বজগৎ তিনমাত্রার নয়, প্রকৃতপক্ষে নয় মাত্রার (সময় সহ দশ)। এই দশ মাত্রার ব্যাপারটি কোন কল্পণা নয়, নয় কোন হাইপোথিসিস। স্ট্রিং তত্ত্বের সমীকরণগুলো সমাধান করেই এই সংখ্যাটি পাওয়া গিয়েছে। কাজেই স্ট্রিং তত্ত্ব দৈর্ঘ্য, প্রস্থ আর উচ্চতার বাইরেও আরও ছয়টি অতিরিক্ত মাত্রা নিয়ে আমাদের ভাবতে বাধ্য করছে। সম্প্রতি এম তত্ত্ব নামে আরেকটি তত্ত্ব বিজ্ঞানীরা হাজির করেছেন যেখানে মাত্রার সংখ্যা আরো একটি বেশী অর্থাৎ দশ (সময়কে ধরে ১১)। সে যাই হোক, স্ট্রিং তত্ত্ব বা এম তত্ত্ব যে কোনটা সত্যি হয়ে থাকলে আমাদের বিশ্ব যে তিনটি দৃশ্যমান মাত্রায় সীমাবদ্ধ নয়, তা নিশ্চিত হয়ে যাবে।
এম থিওরী’ আসলে স্ট্রিং সংক্রান্ত প্রচলিত ৫ টি তত্ত্বকে একটি তত্ত্বের মাধ্যমে সমন্বিত করার প্রয়াস। এডয়ার্ড উইটেনের ১৯৯৫ সালে সাউদার্ণ ক্যালিফোর্ণিয়া ইউনিভার্সিটিতে এ সংক্রান্তপ্রদত্ত বক্তৃতাটিকে ‘স্ট্রিং তত্ত্বের দ্বিতীয় বিপ্লব’ নামে অভিহিত করা হয়। আর প্রথম বিপ্লবের সময়কাল ছিল ১৯৮৪-১৯৮৬ যখন সোয়ার্জ এবং ব্রায়ান গ্রীন মিলে স্ট্রিং তত্ত্বের বিভিন্ন গানিতিক অসঙ্গতি দূর করেন।
তাই যদি হয়, তবে অতিরিক্ত এই মাত্রাগুলোকে আমরা দেখতে পাই না কেন? ব্যাপারটা বোঝা একটু জটিল। ব্যাপারটাকে অবশ্য একটা উদাহরণের সাহায্যে সাধারণ পাঠকদের কাছে পরিস্কার করা যেতে পারে। ছোটবেলায় আমি যখন সার্কাস দেখতে যেতাম, তখন বেশ মনে আছে – দড়ির কিছু খেলা দেখে খুব অবাক হতাম। এর মধ্যে একটি খেলা ছিল এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত চিকন একটা দড়ি বেঁধে এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত হেটে যাওয়ার খেলা। সার্কাসের এক ক্লাউন বিচিত্র অঙ্গভঙ্গি করে নাচতে নাচতে দড়ির ওপর দিয়ে হেটে চলে যেত। প্রতিবারই ভাবতাম এই বুঝি দড়ি ছিঁড়ে ব্যাটা পড়ে বুঝি মাটিতে। দড়ি কিন্তু কখনই ছিঁড়ত না । কারণটা পরে বুঝেছিলাম। দড়িটা দূর থেকে চিকন দেখালেও আসলে কিন্তু অতটা চিকন নয় ৷ দড়িটা আসলে অনেকগুলো দড়ি একসাথে পেঁচিয়ে খুব শক্ত করে তৈরী করা হয়েছে, যা দূর থেকে দেখা বা বোঝা সম্ভব নয়। ঠিক এ ধরনেরই একটি ব্যাপার ঘটে স্ট্রিং তত্ত্বের বেলায় । স্ট্রিং এর অতিরিক্তমাত্রাগুলো আসলে কোকড়ানো বা প্যাচানো অবস্থায় এমন একটি সূক্ষ স্তরে রয়ে গিয়েছে যে, দৃষ্টিগ্রাহ্যভাবে কোনভাবেই তা বোঝা সম্ভব নয়। অনেক বিজ্ঞানীরই ধারণা, মহাবিশ্ব সৃষ্টির সময় বিগব্যাং পরবর্তী মুহূর্তগুলোতে যখন মহাজাগতিক প্রসারণ (Cosmic inflation) ঘটেছিল, তখন কেবল তিনটি দৃষ্টিগ্রাহ্য মাত্রা দেশ কালের বিস্তারে স্বাভাবিকভাবে প্রসারিত হতে পেরেছে, বাকীগুলো কোঁকরানো অবস্থায় আমাদের দৃষ্টিসীমার বাইরে আনুবীক্ষণিক আকারে রয়ে গেছে।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, উপরের কথাগুলো যে সত্যি, তার প্রমাণ কি? আমদের মানতেই হবে যে, এর পরীক্ষালব্ধ কোন প্রমাণ এখন পর্যন্ত পাওয়া যায় নি। এর কারণ হচ্ছে, আমাদের বাস্তব দৃশ্যমান যে জগৎকে আমরা চিনি তা তিন মাত্রার। বিজ্ঞানীরাও বাস করেন এই বাস্তব জগতেই। এগারো মাত্রার জগৎ টা ঠিক কিরকম তা আমাদের কল্পনায় আসে না। আমরা তো ছা-পোষা মানুষ, ১৭ বছর ধরে স্ট্রিং নিয়ে গবেষনাররত বিজ্ঞানী ব্রায়ান গ্রীন পর্যন্ত বলেন, ‘আমি এই দশ-এগারো মাত্রার জগৎকে কল্পনায় চোখের সামনে ভাসাতে পারি না, আর আমি এমন কারো দেখা পাইনি যিনি পারেন’ ( সূত্রঃ The Fabric of the Cosmos : Space, Time and the Texture of Reality, Brian Greene )। এই সমস্যার কারণে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই মাত্রা কল্পনা করার ব্যাপারটিতে গুরুত্ব দিতে নিষেধ করা হয়, বরং বলা হয় আতিরিক্ত মাত্রাগুলোকে সমীকরণে ‘অতিরিক্ত সংখ্যা’ হিসেবে চিন্তা করতে। কিন্তু তারপরও কথা থেকে যায়, এই অতিরিক্ত সংখ্যাগুলোকে পরীক্ষা করে যাচাই করবার কোন উপায় আছে কি? এখন পর্যন্ত তা জানা নেই । আর মাত্রার ব্যাপারটা তো অনেক পরের কথা, স্ট্রিং তত্ত্বের ভিত্তি যে গড়ে উঠেছে স্ট্রিং কে নিয়ে তা তো কেউ চোখের সামনে দেখেননি। তাই স্ট্রিং তত্ত্বের অধিকাংশ ব্যাপার স্যাপারগুলো এখনো তত্ত্বকথার মধেই সীমাবদ্ধ। স্ট্রিং তত্ত্ব যদি কখনও সত্যি বলে প্রমাণিতও হয়, তারপরও স্ট্রিংকে কেউ দেখতে পাবে বলে মনে হয় না। স্ট্রিং এর আকার এতটাই ছোট যে, প্ৰত্যক্ষ পর্যবেক্ষণ এক্ষেত্রে দূরাশা মাত্র। কতাটা দুরাশা তা একটু বোঝার চেষ্টা করা যাক। স্ট্রিং কে দেখবার আশা করা অনেকটা আমার এই পৃষ্ঠার লেখা প্রায় ১০০ আলোকবর্ষ দূর থেকে পড়তে পারার আশা করার মত। আসলে স্ট্রিং কে দেখতে হলে আজকের দিনের প্রচলিত প্রযুক্তির চেয়ে কোটি কোটি গুন শক্তিশালী বিশ্লেষনী ক্ষমতা বিশিষ্ট যন্ত্রপাতি লাগবে। প্রত্যক্ষ প্রমাণজনিত এত অসুবিধার কারণেই অনেক বিজ্ঞানী আছেন যারা স্ট্রিং তত্ত্বকে এখনো পদার্থবিজ্ঞানের আওতাভুক্ত করতে রাজী নন, বরং স্ট্রিং তত্ত্বকে রাখতে চান দর্শন ও ধর্মতত্ত্বের রাজ্যে। যেমন ১৯৭৯ সালে সালাম এবং স্টিভেন ভাইনবার্গের সাথে যুগপৎ নোবেল পুরষ্কারে ভূষিত পদার্থবিজ্ঞানী সেলডন গ্লাশো (Sheldon Glashow ) একটি সাক্ষাৎকারে বলেন-
স্ট্রিং তাত্ত্বিকদের একটি সুস্থিত, মনোহর একটি জটিল তত্ত্ব আছে এবং আমি আসলেই এটি বুঝি না। মহাকর্ষের ক্ষেত্রে এটি একটি সুস্থিত কোয়ান্টাম তত্ত্বকে এটি প্রকাশ করছে, কিন্তু বাড়তি কোন ভবিষ্যদ্বানী তো করছে না। তার মানে দাড়াচ্ছে, পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে এটি যাচাই করার যেমন ব্যবস্থা নেই, তেমনি পর্যবেক্ষণ করে বলার উপায় নেই যে, ‘তোমাদের তত্ত্ব ভুল’। কাজেই এই তত্ত্ব নিরাপদ, স্থায়ীভাবেই নিরাপদ। এখন আমার জিজ্ঞাসা এটি কি সত্যই ফিসিক্স, নাকি ফিলোসফি? (সূত্রঃ Viewpoints on String Theory by Sheldon Glashow
http://www.pbs.org/wgbh/nova/elegant/view-glashow.html )
কিন্তু স্ট্রিং তাত্ত্বিকরা এই যুক্তির বিপক্ষে জোড়ালো যুক্তি হাজির করে বলছেন, প্রত্যক্ষ প্রমাণ ছাড়াও শুধু পরোক্ষ পরীক্ষণের ভিত্তিতে বহু তত্ত্বকে বিজ্ঞান গ্রহন করে নিয়েছে; বিজ্ঞানের ইতিহাস অন্ততঃ তাই বলে। আসলে পরমানুর অস্তিত্বও প্রাথমিকভাবে বিজ্ঞান গ্রহণ করেছিল পরোক্ষ প্রমাণের ভিত্তিতেই (কিছু রাসায়িনিক পদার্থের সংমিশ্রনের অনুপাত থেকে, আর পরবর্তীতে ব্রাউনীয় সঞ্চরণ থেকে); আবার প্রাথমিকভাবে ব্ল্যাক হোলের অস্তিত্বও বিজ্ঞান স্বীকার করে নিয়েছিল পরোক্ষ পর্যবেক্ষণে, ‘চোখে দেখে’ নয়। এরকম উদাহরণ আছে বহু সেলডন গ্লাশোর সহপাঠী এবং সহকর্মী নোবেল বিজয়ী স্টিভেন ভাইনবার্গ ব্যাপারটি পরিস্কার করেছেন এভাবে-
লোকে আনেক সময় বলে থাকে যে, তন্তু তত্ত্ব আর কোন বিজ্ঞান নয় – এটি হল এক ধরণের মরমীবাদ (mysticism), কারণ এর সাথে পরীক্ষা-নিরীক্ষার কোন সম্পর্ক নেই । আমি মনে করি না এ অভিযোগ সঠিক। আমি মনে করি তন্তু তত্ত্ববাদীরা এমন একটা কিছু সম্পন্ন করার চেষ্টায় আছেন যা একদিন অবশ্যই স্বীকৃতি পাবে। যদি তাঁদের এই প্রচেষ্টা সকল শ্রেনীর প্রাকৃতিক বলগুলোকে একত্রিত করতে পারে, তবে একদিন তা পরীক্ষণ দ্বারাও প্রতিষ্ঠিত হবে। এর অস্তিত্ব অবশ্য এমন কোন পরীক্ষা দিয়ে যাচাই করা যবে না যা দিয়ে আমরা সয়ং তারগুলোর দেখা পেতে পারি – অর্থাৎ, এই দেখাটা স্থানের কোন অংশকে চিকন করে কাটা ‘ছিন্ন ক্ষুদ্র একমাত্র ফালি’ – যাকে আমরা ‘তার’ বলি, এরকম দেখা নয়। এই তত্ত্ব পরীক্ষার সাহায্যে যাচাই করার অর্থ হবে, পদার্থবিদ্যার যে ব্যাপারগুলো এখনও রহস্যময়, সে সব বিষয়ের ব্যাখ্যা দিতে এ তত্ত্ব সক্ষম হবে। এটি সাধারণ বিজ্ঞানেরই অংশ। তবে দুর্ভাগ্য এই যে, বিজ্ঞানের অন্যান্য অংশের তুলনায় পর্যবেক্ষণ আওতা থেকে এর অবস্থান অনেকটা দূরে, তবে একেবারেই আশাহীন দূরত্বে নয়। (সূত্রঃ Viewpoints on String Theory by Steven Weinberg http://www.pbs.org/wgbh/nova/elegant/view-weinberg.html )
স্টিভেন ভাইনবার্গ স্ট্রিং তাত্ত্বিকদের প্রতি আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, ‘স্ট্রিং তাত্ত্বিকরা গানিতিক বিমূর্ততার রহস্য উদঘাটন করে ধীরে ধীরে পরবর্তী বড় পদক্ষেপের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন । আর সেটা সত্যই খুব কঠিন একটা কাজ। আমি আশা করব তারা যেন সফল হয়। আমার মনে হয় এপথে অগ্রসর হয়ে তারা সঠিক কাজটাই করছেন, কারণ এই মুহূর্তে স্ট্রিং তত্ত্বই প্রকৃতির ঐক্য রচনায় একমাত্র আশার আলো দেখাচ্ছে।
স্ট্রিং তত্ত্ব সত্য বলে প্রমাণিত হলে বস্তু জগৎ নিয়ে আমাদের সনাতন চিন্তা ভাবনা আমূল পালটাতে হবে। এতে অবশ্য অসুবিধার তেমন কোন কারণ নেই। অনেক ধারণাই আমরা এভাবে বিভিন্ন সময়ে পালটেছি। একটা সময় আমরা ভাবতাম যে কোন বস্তুর তাপমাত্ৰা বুঝি যত ইচ্ছা কমানো যায়। কিন্তু তাপগতিবিদ্যা (Thermodynamics) আমাদের শিখিয়েছে যে, বরফ গলার তাপমাত্রার ২৭৩ ডিগ্রী নীচে নামলে আমরা পরমশূন্য তাপমাত্রায় পৌঁছে যাই। এর নীচে তাপমাত্রা আর কমানো সম্ভব নয়। এই ধারণার প্রমাণ আমরা পেয়েছি পদার্থের আভ্যন্তরীণ কণাসমূহের নিজেদের মধ্যে ছুটোছুটির পরিমাপ থেকে।
সময় সম্বন্ধে আমাদের প্রচলিত ধারণাও আমরা পালটিয়েছি একটা সময়। নিউটন সময়কে পরম বলে ভাবতেন। আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব আমাদের সেই ধারণা বদলে দেয়।
তেমনিভাবে স্ট্রিং তত্ত্ব সত্য প্রমাণিত হলে আমাদের চিরচেনা ত্রিমাত্রিক জগতকে আমাদের মনের আয়না থেকে সরিয়ে স্থান করে দিতে হবে বহুমাত্রিক জগতের জন্য, শুধু তাই না, বস্তু জগৎকে শেষ পর্যন্ত কতকগুলো সুতোর কম্পনে পরিমাপ করতে হবে। মেনে নিতে হবে যে, আমাদের এই সুন্দর পৃথিবী, আমদের সকলের সুখ, দুঃখ, আনন্দ, কান্না, আবেগ, ভালবাসা কিংবা আমার লেখা পড়ে পাঠকের হতাশা গুলো আসলে কিছুই নয় – মগজের ভিতরকার রাসায়নিক ক্রিয়া-বিক্রিয়ার ফল; আর এই রাসায়িনিক বিক্রিয়া ঘটছে আসলে মগজের আভ্যন্তরীন অনু-পরমানু গুলোর মধ্যে যা আরেকটু ক্ষুদ্র স্কেলে গেলে ওই ইলেকট্রন আর কোয়ার্কে, শেষ পর্যন্ত যা কিনা স্রেফ কতগুলো সুতোর কাঁপুনি ছাড়া আর কিছু নয়!
“আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ