স্যার আইজ্যাক নিউটন

‘বলি আমরাও পারতাম’ !

‘কি পারতাম?” আমি অবাক আমার বন্ধুর ‘ইউরেকা’ মার্কা চাহনিতে।

‘কি আবার? এই মাধ্যাকর্ষণ সূত্র আবিস্কার করে জগৎবাসীকে তাক লাগিয়ে দিতে।’

‘তো সমস্যাটা কে করল? তাক লাগাতে মানা করেছিল কে?’

‘সমস্যা তো গোড়াতেই। নিউটন সাহেবের (স্যার আইজ্যাক নিউটন) কপাল ভাল। উনি বসেছিলেন তার বাগানে আপেল গাছের নীচে। গাছ থেকে আপেল খসে মাথায় পড়তেই তিনি বুঝেছিলেন মহাকর্ষের কথা। কিন্তু উনি বিলেতে না জন্মে এই বাংলাদেশে জন্মালে তাঁকে বসতে হত আপেল নয় কাঁঠাল গাছের নীচে। মাথায় আপেল পড়া আর কাঁঠাল পড়া তো আর এক কথা নয় রে ভাই! বাঙালী বিজ্ঞানীদের কপালটাই তাই মন্দ!

মাধ্যাকর্ষনের ধারণা মাথায় এলেও বলে যেতে পারেননি কাউকে। দুই মন ওজনের বেমাককা কাঁঠালের আঘাতে অকস্মাৎ মৃত্যু হওয়ায়….

‘থাক ! থাম এবার ! তুই কি জানিস, নিউটনের এই আপেল মাথায় পড়ার কাহিনীটা একেবারেই বানানো?”

‘বানানো মানে?” এবার অবাক হওয়ার পালা আমার বন্ধুটির !

‘বানানো মানে, বানানো। স্রেফ বানোয়াট! তোর কি সত্যই মনে হয় নাকি যে তিনি বাগানে বসলেন, মাথায় আপেল পড়ল আর তারপরই মহামতি নিউটনের বোধদয় হল মার হাবা! নিশ্চয়ই এমন কোন নিয়ম প্রকৃতিতে আছে যার কারণে বস্তু মাটিতে পড়ে! আমার আর তোর মত আহাম্মক তো সবাই!

আসলে আপেল কাঁঠাল কিছু নয়। নিউটন তখন ছিলেন কেমব্রীজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ১৬৬৫ সালের দিকে প্লেগ মহামারী হিসেবে দেখা দিলে বিশ্ববিদ্যালয় ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়। নিউটনও চলে গিয়েছিলেন তাঁর গাঁয়ে (Woolsthrope) অবসর সময় কাটাতে। সেখানেই মহাকর্ষের ধারণাটি প্রথম তাঁর মাথায় আসে। শুধু মহাকর্ষ নয় এ সময়ই নিউটন প্রিজমের মধ্য দিয়ে আলোর বিচ্ছুরণ সংক্রান্ত নানা পরীক্ষা নিরিক্ষাও করেন। এই সময়টা এতটাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে, অনেকেই মনে করেন যে প্লেগের কারণে বিশ্ববিদ্যালয় ছুটি না হয়ে গেলে নিউটন এত কিছু নিয়ে নিবিষ্ট মনে ভাবনা-চিন্তার সময় পেতেন না আর পৃথবীবাসী বঞ্চিত হত তার জাদুকরী কেরামতি থেকে। একেই বোধ হয় বলে কারও সর্বনাশ আর কারও পৌষ মাস !

(নিউটনের নিজের হাতে আঁকা স্কেচ। বিভিন্ন গতিতে বস্তুকে পৃথিবী থেকে উপরের দিকে ছুঁড়ে দিলে কি হয় তা বোঝাতে ব্যবহৃত।)

যা হোক, প্লেগ পর্ব মিটে যাওয়ার পর, নিউটন আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিলেন; আর ১৬৮৭ সালে ‘প্রিন্সিপিয়া’ গ্রন্থের মাধ্যমে তিনি প্রথম বারের মত মহাকর্ষ তত্ত্ব জনসমক্ষে প্রকাশ করলেন। খুবই অবাক ব্যাপার যে, নিউটন প্রায় বিশ বছর ধরে তার এই আবিস্কারের কাহিনী জনসমাজ থেকে গোপন রেখেছিলেন। কেন যে রাখলেন তা আজও একটি রহস্য বটে। শেষ পর্যন্তও বোধ হয় গোপনই রাখতেন, যদি না ১৬৮৪ সালে তার বন্ধু হ্যালির সাথে (যার নামে হ্যালির ধুমকেতু) গ্রহ নক্ষত্রের চালচলন নিয়ে একটি আলোচনায় লিপ্ত না হতেন। সে সময় জ্যোতির্বিদদের জন্য একটি বড় সমস্যা ছিল যে – কেন কেপলারের সূত্রানুযায়ী গ্রহরা চলাফেরা করছে – এর ব্যখা খুঁজে বের করা! নিউটন হ্যালিকে বললেন যে, তিনি এখন থেকে দু’দশক আগেই এই রহস্যের সমাধান করেছেন। তখনই হ্যালি প্রথমবারের মত নিউটনের কাছ থেকে ‘মহাকর্ষের’ কথা শোনেন। পরবর্তীতে হ্যালির চাপাচাপিতেই নিউটন সম্ভবত পদার্থবিজ্ঞানের ইতিহাসে লিখিত সবচাইতে influential বইটিতে ( ‘The Mathematical Principles of Natural Philosophy’ সংক্ষেপে, ‘নিউটনের প্রিন্সিপিয়া’) তাঁর ধ্যান-ধারণা তুলে ধরেন। নিউটন বললেন, এই মহাবিশ্বে প্রতিটি বস্তুকণাই একে অপরকে আকর্ষণ করছে। যে কোন দুটি বস্তুকণার কথা যদি ধরা যায়, তা হলে তাদের মধ্যে আকর্ষণের পরিমাণ নির্ভর করবে তাদের ভরের গুনফলের উপর। দুই ভরের গুনফল যত বেশী হবে আকর্ষণ ও সেই অনুপাতে বেশী হবে। আর বস্তু দুটির মধ্যে দুরত্ব যত বাড়বে, আকর্ষণ কমে যাবে তার বর্গের হিসেবে। অর্থাৎ দুরত্ব দুগুন বাড়লে আকর্ষণ হয়ে যাবে চার ভাগের এক ভাগ। দুরত্ব তিন গুন বাড়লে আকর্ষণ হবে ন’ ভাগের এক ভাগ। সহজ কথায় এটাই হচ্ছে নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র।

এ এক আশ্চর্য তত্ত্ব। একদিকে এ দিয়ে আকাশের চন্দ্র-সূর্য-গ্রহ তারার গতি-প্রকৃতিকে বোঝা যাচ্ছে – জানা যাচ্ছে তাদের অবস্থান, এমন কি পূর্বাভাস দেওয়া যাচ্ছে সূর্যের বা চন্দ্রের গ্রহণের। আবার এই তত্ত্বের সাহায্যেই বোঝা যাচ্ছে পৃথিবীর উপর বিভিন্ন বস্তুর চাল-চলনও – কেনই বা আপেল মাটিতে পড়ে, আর কেনই বা নদীতে জোয়ার ভাটা হয় । আকাশ আর পৃথিবী যে এক নিয়মে বাঁধা নিউটনের আগে এমনি ভাবে আর কেউই বলে যেতে পারেন নি।

নিউটন জন্মেছিলেন সে বছরই যে বছর গ্যালেলিও র মহাপ্রয়াণ ঘটে। আলো হাতে আঁধারের যাত্রীদের কথা বলতে শুরু করলে এ দু মনীষীর কথা অনিবার্য ভাবেই এসে পড়বে।

error: Content is protected !!