আলাওল, কবি; বড়ো কবি। তিনি লিখেছেন অনেকগুলো কাব্য, আর প্রত্যেক কাব্যে লিখেছেন অসংখ্য ভালো কবিতার পংক্তি। তিনি সপ্তদশ শতকের কবি। তাঁর কবিতা পড়ার সময় আগে মনে দাগ কাটে তাঁর ভাষা। সে-সময় কবিরা ভাষার দিকে বিশেষ নজর দিতেন না। কিন্তু আলাওল কবিতা লেখার সময় ভাষাকে ভাবতেন দেবতা, তাকে সুন্দর করে সাজিয়ে দিতেন। সেকালের অনেক বড়োবড়ো কবি ছিলেন ভাষার ব্যবহারে গ্রাম্য। তাঁরা যে-কোনো শব্দকে কবিতার চরণে ঠাই দিতেন। কবি আলাওল ছিলেন অন্যরকম। ভাষাকে সাজাতেন নানা অলঙ্কারে, অনেক অপ্রচলিত মনোহর শব্দকে তিনি ডেকে আনতেন এবং কবিতাকে করে তুলতেন সুনির্মিত প্রাসাদের মতো চমৎকার। আলাওলের “পদ্মাবতী” কাব্যটি পড়ার সময় বারবার মনে হয় যেনো ক্রমশ একটি সযত্নে নির্মিত প্রাসাদের ভেতর প্রবেশ করছি। তার কক্ষেকক্ষে ছড়িয়ে আছে সৌন্দর্য।
আলাওল সপ্তদশ শতকের কবি। তাঁর জন্ম, জন্মস্থান ইত্যাদি নিয়ে বিতর্ক আছে। কেউ বলেন, তিনি ফরিদপুরের লোক; কেউ বলেন, আলাওল চট্টগ্রামের মানুষ। তবে একথা ঠিক তার জীবনের অধিকাংশ সময় কেটেছে চট্টগ্রামে, বিশেষ করে আরাকানে। আলাওল বিভিন্ন কাব্যে নিজের কথা বলেছেন। তা থেকে জানা যায় কবি আলাওলের জীবন শাদামাটা ছিলো না, তাতে আছে অনেক ওঠানামা, আছে রোমাঞ্চ, আছে জীবনের সুখ ও দুঃখের টানাপোড়েন। কবির পিতা ছিলেন ফতেহাবাদ অঞ্চলের অধিপতি মজলিশ কুতুবের প্রধান কর্মচারী। একসময়ে আলাওল তাঁর পিতার সাথে নৌকো করে কোথাও যাচ্ছিলেন। সে-সময় বাঙলার নদীতেনদীতে দস্যুতা করে ফিরতে পর্তুগিজরা। আলাওলের পিতার নৌকো আক্রমণ করে পর্তুগিজ জলদস্যুরা। অনেকক্ষণ লড়াই হয় তাদের মধ্যে। সে-লড়াইয়ে আলাওলের পিতা নিহত হন। কবির জীবনে নেমে আসে অন্ধকার। অনেক কষ্টের মুখে আলাওল আসেন আরাকানে। আলাওলের বয়স তখন কম; যোললা থেকে কুড়ির মধ্যে। আলাওল ভর্তি হন আরাকানের রাজার অশ্বারোহী সেনাবাহিনীতে। সে-সময় আরাকানের রাজদরবারে অনেক নামকরা মুসলমান কর্মচারী ছিলেন। তাঁরা কবি আলাওলের প্রকৃত পরিচয় পেয়ে তাঁকে উৎসাহ দেন কবিতা রচনা করতে। তাঁদের উৎসাহ পেয়ে সৈনিক আলাওল কবি হয়ে ওঠেন। কবি আলাওল তাঁর জীবনের যে-সব কথা বলেছেন, তা শোনার মতো। তিনি পদ্মাবতী কাব্যে নিজের সম্বন্ধে যা বলেছেন, তার খানিকটা :
মুলুক ফতেহাবাদ গৌড়েত প্রধান।
তথাত জালালপুর পুণ্যবন্ত স্থান।।
বহু গুণবন্ত বৈসে খলিফা ওলামা।
কথেক কহিমু সেই দেশের মহিমা।।
মজলিশ কুতুব তাহাতে অধিপতি।
মুই হীন দীন তান অমাত্য সন্ততি।।
কার্যগতি যাইতে পথে বিধির গঠন।
হার্মাদের নৌকা সঙ্গে হৈল দরশন।।…
কহিতে বহুল কথা দুঃখ আপনার।
রোসাঙ্গ আসিয়া হৈলুং রাজ আসোয়ার।।
আলাওল কবি হয়ে উঠলেন। খ্যাতি লাভ করলেন। কিন্তু তখন ঘনিয়ে আসে আরেক বিপদ। শাহ সুজা তখন পালিয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছে আরাকানে। কিছুদিন পরে সুজাকে হত্যা করা হয় রাজদ্রোহিতার অপরাধে। আলাওলকেও জড়ানো হয় এ-দ্রোহিতার সাথে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয় যে তিনি শাহ সুজার লোক। এ-অভিযোগে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়, এবং পঞ্চাশ দিন বিনা বিচারে আটক রাখা হয় কারাগারে। আলাওলের শেষ জীবনও সুখে কাটে নি, রাজা তার ওপর সুনজর রাখে নি বলে। কবি তাঁর এ-দুঃসময় সম্বন্ধে বলেছেন, ‘আয়ুবশ আমারে রাখিল বিধাতায়। সবে ভিক্ষা প্রাণ রক্ষা ক্লেশে দিন যায়। কবি তাঁর বিভিন্ন কাব্যে এ-সময়ের বেদনার কথা উল্লেখ করেছেন সাশ্রু নয়নে। কবি আরো বলেছেন, মন্দকৃতি ভিক্ষাবৃত্তি জীবন কর্কশ।
কবি আলাওল সম্ভবত জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৫৯৭ অব্দে এবং তার মৃত্যু হয় ১৬৭৩ অব্দে। আলাওল যখন আরাকানে আসেন তখন আরাকানের রাজা ছিলেন থদোমিস্তার। থদোমিন্যারের একজন প্রধান কর্মচারী ছিলেন মাগণ ঠাকুর। আলাওল মাগণ ঠাকুরের প্রীতি লাভ করেন, এবং তারই উৎসাহে মনোযোগ দেন কাব্যরচনায়। আলাওলের শ্রেষ্ঠ কাব্যের নাম পদ্মাবতী। এ-কাব্য আলাওল রচনা করেন মাগণ ঠাকুরের অনুরোধে। পদ্মাবতী রচিত হয় ১৬৪৮ সালে। এটি বিখ্যাত হিন্দি কবি মালিক মুহম্মদ জায়সির পদুমাবত-এর কাব্যানুবাদ। আলাওলের জীবনে মাগণ ঠাকুরের প্রভাব অসীম; তিনি কবিকে কয়েকটি কাব্যরচনায় উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। মাগণ ঠাকুরের অনুরোধে তিনি অনুবাদ করেন ফারসি কাব্য, সয়ফলমূলক-বদিউজ্জামাল। কাব্যটি তিনি শেষ করতে পারেন নি। বইটি যখন অনেকখানি লেখা হয়ে গেছে, তখন অকস্মাৎ লোকান্তরিত হন কবির উৎসাহদাতা মাগণ ঠাকুর। তাই কবি এটাকে অসমাপ্ত রেখে দেন। আলাওলের আর একটি কাব্যের নাম হপ্তপয়কর; এটিও একটি অনুবাদ কাব্য। এটির মূল রচয়িতা ফারসি কবি নিজামী। ১৬৫৯ সালে কবির যখন বেশ বয়স তখন তিনি আরাকানের আরো একজন বড়ো কবির একটি অসমাপ্ত কাব্য সমাপ্ত করেন। সে-কবির নাম কাজী দৌলত; তাঁর কাব্যের নাম সতীময়না। এ-কাব্যটি তিনি রচনা করেন সুলায়মান নামক এক দ্রলোকের অনুপ্রেরণায়। আলাওলের আরো কয়েকটি উল্লেখযোগ্য কাব্য আছে। সেগুলো হলো তোহফা, দারাসেকেন্দারনামা। সেকেন্দারনামা কাব্যটির মূল লেখক কবি নিজামী। এ-কাব্য তিনি যখন রচনা করেন তখন কবি আলাওল ছিলেন মজলিশ নবরাজ নামক এক ভদ্রলোকের আশ্রিত। আলাওল কেবল বড়ো বড়ো কাহিনীকাব্য রচনা করেন নি, তিনি লিখেছিলেন পদাবলিও। এগুলোও আলাওলের প্রতিভার স্বাক্ষর।
আলাওলের প্রধান কাব্য কোনটি? পদ্মাবতী। বাঙলা কবিতা আলাওলকে এ-কাব্যের জন্যে এতোদিন স্মরণে রেখেছে, এবং রাখবে আরো বহুদিন। আলাওলের পদ্মবতী যদিও অনুবাদ কাব্য, তবু এটি নতুন সৃষ্টি। প্রাচীন হিন্দি ভাষার মহাকবি ছিলেন মালিক মুহম্মদ জায়সি। তিনি পদ্মাবতী-রত্নসেন-নাগমতী-আলাউদ্দিন খিলজির মনোহর কাহিনী রচনা করেছিলেন পদ্মাবত নামে। এ-গল্পের কাহিনীকে ঐতিহাসিক কাহিনী মনে হলেও এ কিন্তু সত্যিকারের ইতিহাস নয়। পদ্মাবতী নামক এক অপরূপ রূপসী রাজকন্যার কাহিনী অনেক দিন ধরে এদেশে প্রচলিত। সেই কাহিনীকে কাব্যরূপ দিয়েছিলেন কবি জায়সি। জায়সির এ-কাব্য নিজের মতো করে অনুবাদ করেন কবি আলাওল।
পদ্মাবতীর কাহিনীটি সুন্দর। পদ্মাবতী ছিলো সিংহলরাজকন্যা। অপরূপ রূপসী। তার সৌন্দর্যের খ্যাতি এক পাখির মুখে শোনে চিতোর-রাজ রত্নসেন। সে সিংহলে যায়, এবং লাভ করে পদ্মাবতীকে। ফিরে আসে দেশে। তখন দিল্লির সম্রাট আলাউদ্দিন খিলজি। সে একদিন শোনে পদ্মাবতীর অপরূপ রূপের কথা। সে রত্নসেনের কাছে দাবি করে পদ্মাবতীকে। এতে রত্নসেন রেগে যায়, এবং তাদের মধ্যে যুদ্ধ বাধে। আলাউদ্দিন যুদ্ধে না পেরে কৌশলে বন্দী করে রত্নসেনকে। কিন্তু পরে মুক্ত হয় রত্নসেন। ওদিকে আরেক রাজা, যার নাম দেবপাল, সেও পদ্মাবতীকে লাভ করতে চায়। দেবপাল ও রত্নসেনের মধ্যে এ নিয়ে যুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধে লাভ হয় না কারো, সবাই প্রাণ হারায়। যুদ্ধে প্রাণ হারায় দেবপাল এবং আহত হন রত্নসেন। আহত রত্নসেন পরে মারা যায়। সতী নারী অপরূপ রূপসী পদ্মাবতী স্বামীর চিতায় উঠে সহমরণ বরণ করে। মালিক মুহম্মদ জায়সির কাহিনীটি রূপক, অর্থাৎ তিনি এ-পৃথিবীর কাহিনী অবলম্বন করে শোনাতে চেয়েছিলেন মানবজীবনের গূঢ় কথা। তবে আমাদের সে-কথায় কোনো লোভ নেই, আমরা চাই চমৎকার গল্প আর কবিতা। মালিক মুহম্মদ দুটিই দিয়ে গেছেন। আলাওল সে-কাব্য অনুবাদ করেন বাঙলা ভাষায়।
আলাওলের পদ্মাবতী কাব্য থেকে তাঁর রচনার কিছু উদাহরণ তুলে আনছি। এ-অংশে কবি পদ্মাবতীর রূপ বর্ণনা করেছেন। মধ্যযুগের কবিতার একটি রীতি ছিলো নায়িকার রূপের পরিপূর্ণ বর্ণনা দেয়া। আজকাল আর তেমন হয় না। আজকাল লেখকেরা নায়কনায়িকার সৌন্দর্যকে ফুটিয়ে তুলতে চান ইঙ্গিতে। মধ্যযুগে ছিলো অন্যরকম। তখন কবিরা নায়িকার রূপ আপাদমস্তক বর্ণনা করতেন। বলতেন তার চুল কেমন, চোখ কেমন, ঠোট কেমন ইত্যাদি। শরীরের কোনো অংশ বাদ দেয়া হতো না। রূপ বর্ণনায় কবিরা ব্যবহার করতেন একটির পর একটি উপমা। এর ফলে নায়িকার বিশেষ বিশেষ অঙ্গের রূপ সত্যিই ফুটে উঠতো। কিন্তু মুশকিল হতো সারা শরীর নিয়ে। দেখা যেতো সুন্দর সুন্দর অঙ্গের অদ্ভুত সংস্থানে নায়িকারা অদ্ভুত হয়ে পড়েছে। আলাওলের বর্ণনা শোনা যাক :
পদ্মাবতী রূপ কি কহিমু মহারাজ।
তুলনা দিবারে নাহি ত্রিভুবন মাঝ।।
আপাদলম্বিত কেশ কস্তুরী সৌরভ।
মহাঅন্ধকারময় দৃষ্টি পরাভব।।
তার মধ্যে সীমন্ত খড়গের ধার জিনি।
বলাহক মধ্যে যেন স্থির সৌদামিনী।।
স্বর্গ হন্তে আসিতে যাইতে মনোরথ।
সৃজিল অরণ্যমাঝে মহাসূক্ষ্ম পথ।।
পদ্মাবতীর রূপ অপূর্ব, তবে কবির ভাষা বুঝতে কিছুটা অসুবিধা হতে পারে। কবি কী বলছেন এখানে? আসলে কবি নন, এক হীরামণ পাখি রত্নসেনকে বলছে, মহারাজ পদ্মাবতীর রূপের কথা আমি আর কী বলবো! তার সাথে তুলনা দিতে পারি এমন জিনিশ তো ত্রিভুবনে নেই। তার মাথার কেশরাশি পা পর্যন্ত লম্বা, আর তাতে ভরপুর সর্বদা মৃগনাভির সৌরভ। সে-কেশরাশি এতো কালো যে চোখের দৃষ্টি সেখানে পরাজিত হয়, তা রাত্রির মতো। তোমরা যখন বড়ো হবে চুল সম্বন্ধে একজন আধুনিক কবির এরকম এক অসাধারণ পংক্তির সাক্ষাৎ পাবে। সে-কবির নাম জীবনানন্দ দাশ। তাঁর একটি বিখ্যাত কবিতা হচ্ছে বনলতা সেন’। জীবনানন্দ দাশ বনলতা সেনের চুলের কথা বলতে গিয়ে বলেছেন, চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা।’ চমৎকার না? যাক, আমরা আলাওলে ফিরে আসি। কবি এরপরে সিঁথির কথা বলছেন। পদ্মাবতীর সিথি কেমন? তা খুব সরু, সুন্দর, তীক্ষ, এমনকি তরবারির তীক্ষ্ণতার চেয়েও অধিকতর তীক্ষ পদ্মাবতীর সিথি। তারপর কবি একটি উপমা দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন সে-সিঁথির সৌন্দর্য। বলছেন, ওই সিঁথির রেখাকে মনে হয় যেনো কালো মেঘের মধ্যে স্থির হয়ে আছে বিদ্যুৎরেখা। এতেও কবির মন ভরে নি। তাই তিনি দেন আরো একটি উপমা। বলেন, স্বর্গ থেকে আসা-যাওয়ার জন্যে সৌন্দর্যের দেবতা অরণ্যের মধ্যে এক সূক্ষ্ম পথ নির্মাণ করেছিলেন, পদ্মাবতীর সিথি তেমনি সুন্দর, নয়নাভিরাম। আলাওল কিন্তু খুব সহজ কবি নন। তিনি কথা বলেন উপমায়, অলঙ্কারে এবং অনেক সময় বেশ শক্ত শব্দে। তিনি মনোযোগ দিয়ে পড়ার মতো কবি।
“লাল নীল দীপাবলী বা বাঙলা সাহিত্যের জীবনী” উপন্যাস বা প্রবন্ধ সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ
♦ প্রদীপ জ্বললো আবারঃ মঙ্গলকাব্য
♦ কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তী
♦ উজ্জ্বলতম আলোঃ বৈষ্ণব পদাবলি
♦ দেবতার মতো দুজন এবং কয়েকজন অনুবাদক
♦ গদ্যের জনক ও প্রধান পুরুষেরা