জাহেলী যুগে আরবদেশে লেখাপড়ার প্রচলন একেবারেই কম ছিল। হিশাম ইব্ন মুহাম্মদ ইব্ন সায়েব কালবী প্রমুখ ইতিহাসকারদের বর্ণনায় জানা যায়, জাহেলী যুগে উকায়দার দাওয়াহ নামক জনৈক ব্যক্তির ভ্রাতা বিশর ইব্ন আবদুল মালিক আম্বার শহর হইতে আরবী ভাষার লিখন পঠন শিখিয়া মক্কায় ফিরিয়া আসে। অতঃপর সে আবূ সুফিয়ান সখর ইব্ন হারব ইবন উমাইয়ার ভগ্নী ‘সহবা বিনতে হারব ইব্ন উমাইয়া’কে বিবাহ করে। এই সূত্রে সে স্বীয় শ্বশুর হাব ইব্ন উমাইয়া এবং শ্যালক সুফিয়ানকে লিখন পঠন শিক্ষা দেয়। অতঃপর উমর ইব্ন খাত্তাব হাব ইবন উমাইয়ার নিকট হইতে এবং মুআবিয়া ইব্ন আবূ সুফিয়ান স্বীয় পিতৃব্য সুফিয়ান ইব্ন হারবের নিকট হইতে উহার শিক্ষা লাভ করেন। কেহ কেহ বলেন, ‘বাক্কা’ নামক জনপদের অধিবাসী ‘তায়’ গোত্রীয় একদল লোক আম্বার শহর হইতে সৰ্বপ্ৰথম আরবী ভাষার লিখন-পঠন শিখিয়া আসে। তাহারা উহাকে অধিকতর উন্নতরূপ দান করিয়া আরব উপদ্বীপে প্রচার করে। এইরূপে আরবী লিখন-পঠন সমগ্র আরবদেশে ছড়াইয়া পড়ে ৷
শা’বী হইতে ধারাবাহিকভাবে মুজাহিদ, সুফিয়ান, আবদুল্লাহ্ ইব্ন মুহাম্মদ, যুহরী ও আবূ বকর ইব্ন আবূ দাউদ বর্ণনা করিয়াছেন যে, শা’বী বলেনঃ
‘একদা আমরা মুহাজির সাহাবীদের নিকট জিজ্ঞাসা করিলাম- আপনারা কোথা হইতে আরবী ভাষার লিখন-পঠন শিখিলেন? তাহারা বলিলেন- আম্বার নামক দেশের অধিবাসীদের নিকট হইতে।’
পুরাকালে আরবী লিখন পদ্ধতি প্রধানত কূফাকেন্দ্রিক ছিল। উযীর আবূ আলী ইব্ন মাকাল্লাহ্ উহাকে উন্নত পর্যায়ে পৌছাইয়া দেন। তিনি আরবী ভাষা লিখনের একটি উন্নত পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন । অতঃপর আলী ইব্ন হিলাল বাগদাদী ওরফে ইব্ন বাওয়াব উহার উন্নতি বিধানে আগাইয়া আসেন । জনগণ এই বিষয়ে তাহাকে অনুসরণ করিয়া চলে । তাহার প্রবর্তিত পদ্ধতি সুন্দর ও সুস্পষ্ট ।
উপরের আলোচনা দ্বারা আমি বুঝাইতে চাহিতেছি যে, ইসলামের প্রথম যুগে কুরআন মজীদ সংকলিত হইবার কালে যেহেতু আরবী ভাষার লিখন পদ্ধতি উন্নত ও সুস্পষ্ট রূপ পরিগ্রহ করে নাই, তাই উহার সংকলিত হইবার কালে উহার আয়াতসমূহের বিষয়ে নহে; বরং উহার শব্দসমূহের লিখন পদ্ধতির বিষয়ে লেখকদের মধ্যে স্বভাবতই মতভেদ দেখা দিয়াছিল । এই বিষয়ে লেখকগণ পুস্তক প্রণয়ন করিয়াছেন । ইমাম আবূ উবায়দ কাসিম ইবন সাল্লাম (রঃ) স্বীয় পুস্তক ‘ফাযায়েলুল কুরআন’-এ এই বিষয়টিকে গুরুত্ব প্রদান করিয়া আলোচনা করিয়াছেন । হাফিজ আবূ বকর ইব্ন আবূ দাউদও স্বীয় গ্রন্থে উহাকে গুরুত্ব দিয়াছেন । তাঁহারা উভয়ে স্ব-স্ব পুস্তকে একটি স্বতন্ত্র পরিচ্ছেদে এই বিষয়ে আলোচনা করিয়াছেন। কুরআন মজীদের লিখন সম্পর্কিত তাঁহাদের প্রবন্ধ দুইটি অতীব চমৎকার ।
কুরআন মজীদের লিখনশিল্প এস্থলে আমার আলোচ্য বিষয় নহে বিধায় তাঁহাদের প্রবন্ধদ্বয়ের বিস্তারিত আলোচনা হইতে বিরত রহিতেছি। এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য যে, ইমাম মালিক অভিমত প্রকাশ করিয়াছেন যে, হযরত উসমান (রাঃ) কর্তৃক প্রস্তুত কুরআন মজীদ সংকলনের লিখন-রীতি ভিন্ন অন্য কোন লিখন-রীতিতে কুরআন মজীদ লিপিবদ্ধ করা বৈধ নহে। অন্যেরা উহাকে অবৈধ বলেন না । তবে তাহারা অক্ষরের রূপ ও নোকতা পরিবর্তনের বিষয়ে একমত নহেন। কেহ কেহ উক্ত পরিবর্তনকে বৈধ এবং কেহ কেহ উহাকে অবৈধ বলেন । অবশ্য আমাদের যুগে কুরআন মজীদের একটি মাত্র সূরাকে, কয়েকটি আয়াতকে, কুরআন মজীদের এক-দশমাংশকে অথবা উহার যেকোন অংশকে পৃথক করিয়া লিখিবার রীতি বহুল প্রচলিত রহিয়াছে। তবে পূর্বযুগের নেককারবৃন্দের (سلف صالحين) অনুসরণই শ্রেয়তর।
নবী করীম (সা)-এর লেখকবৃন্দ
ইমাম বুখারী (রঃ) স্বীয় হাদীস সংকলনে “নবী করীম (সাঃ)-এর লেখকবৃন্দ(১) এই শিরোনামে একটি পরিচ্ছেদ সৃষ্টি করত উহাতে বলিয়াছেনঃ হযরত যায়দ ইব্ন ছাবিত (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে ইব্ন সাব্বাক, যুহরী, প্রমুখ রাবীর মাধ্যমে আমি ইমাম বুখারী বর্ণনা করিতেছিঃ
‘হযরত যায়দ ইব্ন ছাবিত (রাঃ) বলেন- হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রাঃ) আমাকে বলিলেন যে, ‘তুমি তো নবী করীম (সাঃ)-এর নির্দেশে ওহী লিখিতে।’ অতঃপর ইমাম বুখারী আলোচ্য হাদীসের অবশিষ্ট অংশ বর্ণনা করিয়াছেন। হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রাঃ)-এর নির্দেশে হযরত যায়দ কর্তৃক কুরআন মজীদ সংকলিত হইবার ঘটনার বর্ণনায় ইতিপূর্বে উহা বর্ণিত হইয়াছে। উক্ত পরিচ্ছেদে ইমাম বুখারী, হযরত যায়দ ইব্ন ছাবিত (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত لأيستوى القاعدون غير أؤلى الضَّرر الخ এই আয়াতটি অবতীর্ণ হইবার ঘটনা সম্পর্কিত হাদীসও বর্ণনা করিয়াছেন । আলোচ্য পরিচ্ছেদে তিনি হযরত যায়দ ইব্ন ছাবিত (রাঃ) ভিন্ন নবী করীম (সাঃ)-এর অন্য কোন লেখকের আলোচনা করেন নাই। ইহা আশ্চর্যজনক বটে। হযরত যায়দ ভিন্ন অন্য লেখক সম্পর্কিত আলোচনা রহিয়াছে, এইরূপ কোন হাদীস সম্ভবত ইমাম বুখারীর নীতিমালায় টিকে নাই। আল্লাহ্ই সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞানী। নবী করীম (সাঃ)-এর পবিত্র জীবনীতে তাঁহার লেখকগণ সম্পর্কিত পরিচ্ছেদে এইরূপ হাদীস বর্ণিত হইয়া থাকে।
কুরআন মজীদ সাতটি হরফে নাযিল হইয়াছে
‘কুরআন মজীদ সাতটি হরফে নাযিল হইয়াছে’ এই শিরোনামায় ইমাম বুখারী (রঃ) বর্ণনা করিয়াছেনঃ হযরত আবদুল্লাহ্ ইব্ন আব্বাস (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে উবায়দুল্লাহ্ ইব্ন আবদুল্লাহ্ ইব্ন শিহাব, উকায়ল, লায়ছ ও সাঈদ ইব্ন আফীর আমার (ইমাম বুখারীর) নিকট বর্ণনা করিয়াছেন যে, হযরত ইব্ন আব্বাস (রাঃ) বলেন- ‘নবী করীম (সাঃ) বলিয়াছেন যে, হযরত জিবরাঈল (আঃ) আমাকে প্রথমে একটি হরফে কুরআন মজীদ শিখাইয়াছিলেন, আমি তাঁহার সহিত আলোচনা করিয়া একটির পর একটি হরফের সংখ্যা বৃদ্ধি করিতে অনুরোধ জানাইতে থাকিলাম । আমার পর্যায়ক্রমিক অনুরোধে তিনি উহার সংখ্যা বৃদ্ধি করিতে করিতে সাতটি হরফে আমাকে কুরআন মজীদ শিখাইলেন।’ ইমাম বুখারী (রঃ) উপরোক্ত হাদীসকে প্রায় অনুরূপ অর্থে ‘সৃষ্টির প্রারম্ভ’ নামক পরিচ্ছেদেও বর্ণনা করিয়াছেন। ইমাম মুসলিমও উহা ইব্ন শিহাব যুহরী হইতে ইউনুস ও মুআম্মার প্রমুখ রাবীর মাধ্যমে প্রায় অনুরূপ অর্থে বর্ণনা করিয়াছেন। ইমাম ইবন জারীরও উহা উপরোক্ত রাবী (ইন শিহাব) যুহরী হইতে ঊর্ধ্বতন উপরোক্ত সনদাংশে এবং ভিন্নরূপ অধস্তন সনদাংশে বর্ণনা করিয়াছেন। হাদীস বর্ণনা করিবার পর সনদের অন্যতম রাবী যুহরী (রঃ) বলেনঃ
‘আমি জানিতে পারিয়াছি যে, হাদীসে উল্লেখিত সাতটি ‘হরফ’ (একই অর্থযুক্ত সাত প্রকারের উচ্চারণ রীতি)-এর বৈশিষ্ট্য এই যে, একই আয়াতকে বিভিন্ন হরফে তিলাওয়াত করিলে উহার অর্থের মধ্যে কোন তারতম্য ঘটে না। হরফ-এর পরিবর্তনে অর্থের বিকৃতি ঘটিয়া হালাল বিষয় হারামে অথবা হারাম বিষয় হালালে পরিণত হয় না ৷’
ইমাম আবূ উবায়দ কাসিম ইব্ন সাল্লাম কর্তৃক বর্ণিত নিম্নোক্ত হাদীসে ‘সাতটি হরফ’-এর উপরোক্ত ব্যাখ্যা বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হইয়াছে। হযরত উবাই ইবৃন কা’ব (রা) হইতে ধারাবাহিকভাবে হযরত আনাস ইবন মালিক, হামীদ আত্তাবীল, ইয়াযীদ, ইয়াহিয়া ইন সাঈদ ও ইমাম আবূ উবায়দ কাসিম ইব্ন সাল্লাম বর্ণনা করিয়াছেনঃ
‘হযরত উবাই ইবন কা’ব (রাঃ) বলেন- আমি ইসলাম গ্রহণ করিবার পর একটি বিষয় ভিন্ন অন্য কোন বিষয় আমার মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে নাই। উক্ত বিষয়টি এই যে, একদা আমি কুরআন মজীদের একটি আয়াতকে একরূপে তিলাওয়াত করিলাম এবং অন্য এক ব্যক্তি উহাকে অন্যরূপে তিলাওয়াত করিল। আমরা উভয়ে রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর দরবারে উপস্থিত হইলাম । আমি আরয করিলাম, হে আল্লাহ্র রাসূল ! আপনি অমুক আয়াতটি আমাকে এইরূপে শিখান নাই কি? তিনি বলিলেন- ‘হ্যাঁ ! আমি তোমাকে উহা এইরূপেই শিখাইয়াছি ।’ অতঃপর তিনি বলিলেন- ‘একদা হযরত জিবরাঈল (আঃ) ও হযরত মীকাঈল (আঃ) আমার নিকট আসিলেন। হযরত জিবরাঈল (আঃ) আমার ডান পার্শ্বে এবং হযরত মীকাঈল (আঃ) আমার বাম পার্শ্বে বসিলেন। হযরত জিবরাঈল (আঃ) বলিলেন, কুরআন মজীদকে একটি ‘হরফ’-এ তিলাওয়াত করুন। ইহাতে হযরত মীকাঈল (আঃ) বলিলেন, তাঁহার (হযরত জিবরাঈল (আঃ)-এর) নিকট ‘হরফ’ এর সংখ্যা বৃদ্ধি করিতে অনুরোধ জানান । এইরূপে তিনি ‘সাতটি হরফ’ পর্যন্ত পৌঁছিলেন । প্রত্যেকটি ‘হরফ’ই যথেষ্ট ও সঠিক।’ ইমাম নাসাঈ উপরোক্ত হাদীস হযরত উবাই ইবন কা’ব (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে হযরত আনাস (রাঃ), হামীদ আত্তাবীল ইয়াযীদ ইব্ন হারূন ও ইয়াহিয়া ইব্ন সাঈদ কাত্তান প্রমুখ রাবীর সনদে প্রায় অনুরূপ অর্থে বর্ণনা করিয়াছেন। এইরূপে ইব্ন আবূ আদী, মাহমুদ ইব্ন মাইমূন যা‘ফরানী এবং ইয়াহিয়া ইব্ন আইউব উহা উপরোক্ত রাবী হামীদ আত্তাবীল হইতে উপরোক্ত ঊর্ধ্বতন সনদাংশে এবং ভিন্নরূপ অধস্তন সনদাংশে বর্ণনা করিয়াছেন।
হযরত উবাই ইবন কা’ব (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে হযরত উবাদাহ ইব্ন সামিত (রাঃ), হযরত আনাস (রাঃ), হামীদ, হাম্মাদ ইব্ন সালমাহ, আবুল ওয়ালীদ, মুহাম্মদ ইব্ন মারযূক ও ইমাম ইব্ন জারীর (রঃ ) বর্ণনা করিয়াছেনঃ
হযরত উবাই ইবন কা’ব (রাঃ) বলেন যে, নবী করীম (সাঃ) বলিয়াছেন— ‘কুরআন মজীদ সাতটি ‘হরফ’-এ নাযিল হইয়াছে।’ উক্ত রিওয়ায়েতে দেখা যাইতেছে, হযরত উবাই ইবন কা’ব ও হযরত আনাস ইবন মালিকের মধ্যে হযরত উবাদাহ ইব্ন সামিত (রাঃ) রাবী হিসাবে অন্তর্ভুক্ত রহিয়াছেন। হযরত উবাই ইবন কা’ব (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে আবদুর রহমান ইব্ন আবূ লায়লা, আবদুল্লাহ্ ইব্ন ঈসা, ইসমাঈল ইব্ন আবূ খালিদ, ইয়াহিয়া ইবন সাঈদ ও ইমাম আহমদ ইবন হাম্বল (রঃ) বর্ণনা করিয়াছেন যে, হযরত উবাই ইবন কা’ব (রাঃ) বলেনঃ
‘একদা আমি মসজিদে অবস্থান করিতেছিলাম । এই সময়ে একটি লোক মসজিদে প্রবেশ করিল। লোকটি কুরআন মজীদের একটি অংশ বিশেষ উচ্চারণে তিলাওয়াত করিল যাহা আমার নিকট সঠিক বিবেচিত হইল না। অতঃপর আরেকটি লোক মসজিদে প্রবেশ করিল । লোকটি কুরআন মজীদের সেই অংশ অন্যরূপ উচ্চারণে তিলাওয়াত করিল । আমরা সকলে নবী করীম (সাঃ)-এর দরবারে উপস্থিত হইলাম। আমি আরয করিলাম, হে আল্লাহ্র রাসূল ! এই লোকটি কুরআন মজীদের একটি অংশ বিশেষ উচ্চারণে তিলাওয়াত করিয়াছে যাহা আমার নিকট সঠিক বিবেচিত হয় নাই। পক্ষান্তরে ওই লোকটি কুরআন মজীদের সেই অংশটি অন্যরূপ উচ্চারণে তিলাওয়াত করিয়াছে। নবী করীম (সাঃ) বলিলেন- তোমরা প্রত্যেকে নিজ নিজ উচ্চারণে উহা তিলাওয়াত করো। তাহারা নিজ নিজ উচ্চারণে উহা তিলাওয়াত করিল। নবী করীম (সাঃ) বলিলেন- ‘তোমাদের সকলের তিলাওয়াতই সঠিক হইয়াছে।’ উক্ত মন্তব্য আমার নিকট ভারী বোধ হইল। আমি অমুসলিম থাকাকালেও এইরূপ (সন্দিগ্ধ) ছিলাম না। তিনি আমার অব্যবস্থিতচিত্ততা উপলব্ধি করিয়া আমার বক্ষে মৃদু চপেটাঘাত করিলেন। আমি ঘর্মাক্ত কলেবর হইয়া গেলাম। আমি যেন ভয়ে আল্লাহর (আকাশের) দিকে তাকাইতে লাগিলাম। তিনি বলিলেন- “হে উবাই ! আল্লাহ্ তা’আলা আমার নিকট সংবাদ পাঠাইলেন – তুমি ‘একটি হরফ’-এ কুরআন মজীদ তিলাওয়াত করো। আমি আল্লাহ্ তা’আলার দরবারে আবেদন জানাইলাম-প্রভু হে ! আমার উম্মতের জন্য সহজ করুন। ইহাতে আল্লাহ্ তা’আলা আমার নিকট সংবাদ পাঠাইলেন- তুমি ‘দুইটি হরফ’-এ কুরআন মজীদ তিলাওয়াত করো। আমি আল্লাহ্ তা’আলার দরবারে আবেদন জানাইলাম- প্ৰভু হে ! আমার উম্মতকে সুযোগ প্ৰদান করুন। ইহাতে আল্লাহ্ তা’আলা আমার নিকট সংবাদ পাঠাইলেন- তুমি ‘সাতটি হরফ’-এ কুরআন মজীদ তিলাওয়াত করো। আর প্রতিবারের আবেদনের পরিবর্তে তোমার একটি করিয়া প্রার্থনা গৃহীত হইবে। আমি আরয করিলাম- প্রভু হে! আমার উম্মতকে ক্ষমা করিয়া দিন ! প্রভু হে ! আমার উম্মতকে ক্ষমা করিয়া দিন !! তৃতীয় প্রার্থনাটি আমি সেই দিনের জন্য রাখিয়া দিলাম, যেদিন সকল মানুষ, এমনকি হযরত ইবরাহীম (আঃ)-ও আমার নিকট সাহায্য প্রার্থী হইবেন।”
ইমাম মুসলিম (রঃ) উপরোক্ত হাদীস উপরোক্ত রাবী ইসমাইল ইবন খালিদের ঊর্ধ্বতন উপরোক্ত সনদাংশে এবং ভিন্নরূপ অধস্তন সনদাংশে বর্ণনা করিয়াছেন। হযরত উবাই ইবন কা’ব হইতে ধারাবাহিকভাবে আবদুর রহমান ইব্ন আবূ লায়লা, ঈসা ইবন আবদুর রহমান ইব্ন আবূ লায়লা, আবদুল্লাহ্ ইব্ন ঈসা ইব্ন আবদুর রহমান ইব্ন আবূ লায়লা, ইসমাঈল ইব্ন আবূ খালিদ, মুহাম্মদ ইব্ন ফুযায়েল, আবূ কুরায়ব ও ইমাম ইব্ন জারীর (রঃ) বর্ণনা করিয়াছেনঃ
‘নবী করীম (সাঃ) বলিয়াছেন- আল্লাহ্ তা’আলা আমাকে ‘একটি হরফে’ কুরআন মজীদ তিলাওয়াত করিতে আদেশ করিলেন । আমি আরয করিলাম- প্রভু হে ! আমার উম্মতের জন্য আসান করুন। আল্লাহ্ তা’আলা বলিলেন- তুমি উহ ‘দুইটি হরফে’ তিলাওয়াত করো । আমি আরয করিলাম- প্রভু হে ! আমার উম্মতের জন্য সহজ করুন। উহাতে আল্লাহ্ তা’আলা আমাকে জান্নাতের সাতটি দরওয়াজার সংখ্যার সহিত সঙ্গতি রাখিয়া ‘সাতটি হরফে’ উহা তিলাওয়াত করিতে আদেশ করিলেন । প্রত্যেকটি হরফই ফলদায়ক ও যথেষ্ট।’
হযরত উবাই ইবন কা’ব (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে আবদুর রহমান ইব্ন আবূ লায়লা, উবায়দুল্লাহ্ ইব্ন উমর, হিশাম ইব্ন সা’দ, ইব্ন ওয়াহাব, ইউনুস ও ইমাম ইব্ন জারীর (রঃ) বর্ণনা করিয়াছেনঃ
“হযরত উবাই ইবন কা’ব (রাঃ) বলেন- একদা আমি একটি লোককে ‘সূরা নাহল’-এর একটি অংশ বিশেষ উচ্চারণে তিলাওয়াত করিতে শুনিলাম । উহা আমার উচ্চারণ হইতে পৃথক ছিল। আরেকটি লোককে ভিন্ন উচ্চারণে উহা তিলাওয়াত করিতে শুনিলাম। আমি উভয়কে লইয়া নবী করীম (সাঃ)-এর দরবারে উপস্থিত হইলাম । তাঁহার খেদমতে আরয করিলাম— হে আল্লাহর রাসূল ! এই লোক দুইটিকে ‘সূরা নাহল’-এর একটি অংশ দুইটি পৃথক উচ্চারণে তিলাওয়াত করিতে শুনিলাম । ‘কে তোমাদিগকে ইহা শিখাইয়াছেন’- আমি তাহাদিগকে ইহা জিজ্ঞাসা করায় তাহারা বলিল, নবী করীম (সাঃ) ইহা আমাদিগকে শিখাইয়াছেন। আমি তাহাদিগকে বলিলাম- আমি নিশ্চয় তোমাদিগকে নবী করীম (সাঃ)-এর নিকট লইয়া যাইব। কারণ, নবী করীম (সাঃ) আমাকে যে কিরাআত শিখাইয়াছেন, তোমাদের কিরাআত উহা হইতে পৃথক । নবী করীম (সাঃ) তাহাদের একজনকে বলিলেন- তুমি পড়ো তো। লোকটি পড়িল। নবী করীম (সাঃ) বলিলেন- তোমার পড়া শুদ্ধ ও সঠিক হইয়াছে। অতঃপর অন্য লোকটিকে বলিলেন- তুমি পড়ো তো ! লোকটি পড়িল। তিনি বলিলেন- তোমার পড়া শুদ্ধ ও সঠিক হইয়াছে। হযরত উবাই (রাঃ) বলেন, ইহাতে আমার মনে শয়তান ওয়াসওয়াসা ( সন্দেহ ) আনিয়া দিল। আমার চেহারা লাল হইয়া গেল । নবী করীম (সাঃ) আমার চেহারায় উহা দৰ্শন করিয়া আমার বক্ষে মৃদু চপেটাঘাত করিলেন। অতঃপর বলিলেন- ‘আয় আল্লাহ্ ! তুমি তাহার নিকট হইতে শয়তানকে দূর করিয়া দাও। হে উবাই ! একদা আমার নিকট আমার প্রতিপালক প্রভুর পক্ষ হইতে জনৈক আগন্তুক আগমন করিয়া বলিলেন- আল্লাহ্ তা’আলা একটি মাত্র হরফে কুরআন মজীদ তিলাওয়াত করিতে আপনাকে আদেশ করিতেছেন। আমি আল্লাহ্ পাকের কাছে আরয করিলাম- প্রভু হে ! আমার উম্মতকে আসান দান করুন। আগন্তুক দ্বিতীয়বার আমার নিকট আগমন করিয়া বলিলেন- আল্লাহ্ তা’আলা দুইটি হরফে কুরআন মজীদ তিলাওয়াত করিতে আপনাকে আদেশ করিতেছেন। আমি প্রার্থনা করিলাম-প্রভু হে ! আমার উম্মতকে সুবিধা দান করুন। আগন্তুক তৃতীয়া আমার নিকট আগমন করিয়া তিনটি হরফে কুরআন মজীদ তিলাওয়াত করিবার আদেশ প্রদানের কথা বলিলেন। আমি পূর্বের ন্যায় আবেদন জানাইলাম । আগন্তুক চতুর্থবার আমার নিকট আগমন করিয়া বলিলেন- আল্লাহ্ তা’আলা সাতটি হরফে কুরআন মজীদ তিলাওয়াত করিতে আপনাকে আদেশ করিতেছেন। আরত প্রতিবারের আবেদনের পরিবর্তে আপনার একটি করিয়া প্রার্থনা মঞ্জুর হইবে। আমি বলিলাম- হে আমার প্রতিপালক! আমার উম্মতকে ক্ষমা করো ৷ হে আমার প্রভু ! আমার উম্মতকে ক্ষমা করো। তৃতীয়বারের প্রার্থনাটি আমি কিয়ামতের দিনে আমার উম্মতের শাফাআতের উদ্দেশ্যে রাখিয়া দিয়াছি।’ উক্ত হাদীসের সনদ সহীহ।
আমি (ইব্ন কাছীর) বলিতেছিঃ হযরত উবাই ইবন কা’ব (রাঃ)-এর হৃদয়ে উদ্রিক্ত যে সন্দেহের উল্লেখ উপরে বর্ণিত হাদীসে রহিয়াছে, উহা দূর করিবার জন্যই নবী করীম (সাঃ) (আল্লাহই সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞানী) তাহাকে কুরআন মজীদের অংশবিশেষ তিলাওয়াত করিয়া শুনাইয়াছিলেন । নবী করীম (সাঃ)-এর উক্ত তিলাওয়াতের উদ্দেশ্য ছিল- নবী করীম (সাঃ)-এর সত্যবাদিতা হযরত উবাই (রাঃ) অন্তরে বসাইয়া দেওয়া এবং উহা দ্বারা তাঁহার সন্দিহান মনের সন্দেহ রোগ বিদূরিত করা। এইরূপ সন্দেহ রোগের চিকিৎসার জন্য নবী করীম (সাঃ)-এর প্রতি আল্লাহ্ তা’আলা সূরা বায়্যিনাহ নাযিল করিয়াছেন। উহাতে নিম্নোক্ত আয়াত অন্তর্ভুক্ত রহিয়াছেঃ
رَسُولُ مِنَ اللهِ يَتْلُوا صُحُفًا مُطَهَّرَةٌ فِيهَا كُتُبُ قَيِّمَةُ
‘এইরূপ রাসূল যিনি পবিত্র সূরাসমূহ তিলাওয়াত করিয়া শুনান যাহাতে দৃঢ় যুক্তিভিত্তিক নীতিমালা ও আদেশ-নিষেধ রহিয়াছে।
নবী করীম (সাঃ) এইরূপে হযরত উমর (রাঃ)-কে ‘সূরা ফাতহ’ তিলাওয়াত করিয়া শুনাইয়াছিলেন। হুদায়বিয়াহ হইতে নবী করীম (সাঃ)-এর প্রত্যাবর্তনের পথে উপরোক্ত সূরা নাযিল হইয়াছিল। ইতিপূর্বে (হুদায়বিয়ার চুক্তি সম্পাদিত হইবার কালে) হযরত উমর (রাঃ) নবী করীম (সাঃ) ও হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রাঃ)-এর প্রতি একাধিক প্রশ্ন উত্থাপন করিয়াছিলেন। হযরত উমর (রাঃ)-এর অব্যবস্থচিত্ততা দূর করিবার উদ্দেশ্যেই নবী করীম (সাঃ) তাঁহাকে উক্ত সূরা তিলাওয়াত করিয়া শুনাইয়াছিলেন। উক্ত সূরায় সুসংবাদ পূর্ণ নিম্নোক্ত আয়াত অন্তর্ভুক্ত রহিয়াছেঃ
لَقَدْ صَدَقَ اللهُ رَسُولَ الرُّؤْيَا بِالْحَقِّ لَتَدْخُلُنَّ المَسجِد الْحَرَامَ إِنْ شَاءَ اللهُ مِنِيْنَ
‘আল্লাহ্ নিশ্চয় তাঁহার রাসূলের স্বপ্নকে সন্দেহাতীত রূপে বাস্তবায়িত করিয়া দেখাইবেন। তোমরা ইনশা আল্লাহ্ ভীতি মুক্ত হইয়া মসজিদে হারামে নিশ্চিতরূপে প্রবেশ করিবে।)
হযরত উবাই ইবন কা’ব (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে ইব্ন আবূ লায়লা, মুজাহিদ, হাকাম, শু‘বা, মুহাম্মদ ইব্ন জা’ফর, মুহাম্মদ ইব্ন মুছান্না ও ইমাম ইবন জারীর (রঃ) বর্ণনা করিয়াছেনঃ
‘একদা নবী করীম (সাঃ) বনূ গিফার গোত্রের জলাশয়ের নিকট অবস্থান করিতেছিলেন। এই সময়ে হযরত জিবরাঈল (আঃ) তাঁহার নিকট উপস্থিত হইয়া বলিলেন- আল্লাহ্ তা’আলা আপনাকে আদেশ করিতেছেন যে, আপনি স্বীয় উম্মতকে একটি হরফে কুরআন মজীদ শিখাইবেন। নবী করীম (সাঃ) বলিলেন- আমি আল্লাহ্ তা’আলার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করিতেছি। আমার উম্মত উহা করিতে সমর্থ হইবে না। হযরত জিবরাঈল (আঃ) দ্বিতীয়বার তাঁহার নিকট আসিয়া বলিলেন- আল্লাহ্ তা’আলা আপনাকে আদেশ করিতেছেন যে, আপনি স্বীয় উম্মতকে দুইটি হরফে কুরআন মজীদ শিখাইবেন। নবী করীম (সাঃ) বলিলেন- আমি আল্লাহ্ তা’আলার নিকট মুক্তি প্রার্থনা করিতেছি। আমার উম্মত উহা করিতে সমর্থ হইবে না। হযরত জিবরাঈল (আঃ) তৃতীয়বার তাঁহার নিকট আসিয়া বলিলেন- আল্লাহ্ তা’আলা আপনাকে আদেশ করিতেছেন যে, আপনি স্বীয় উম্মতকে তিনটি হরফে কুরআন মজীদ শিখাইবেন। নবী করীম (সাঃ) বলিলেন- আমি আল্লাহ্ তা’আলার নিকট নাজাত প্রার্থনা করিতেছি। আমার উম্মত উহা করিতে সমর্থ হইবে না। হযরত জিবরাঈল (আঃ) চতুর্থবার তাঁহার নিকট আসিয়া বলিলেন- আল্লাহ্ তা’আলা আপনাকে আদেশ করিতেছেন যে, আপনি স্বীয় উম্মতকে সাতটি হরফে কুরআন মজীদ শিখাইবেন। তাহারা সাতটি হরফের যে কোন হরফে কুরআন মজীদ তিলাওয়াত করিলেই তাহাদের তিলাওয়াত সহীহ হইবে।’
ইমাম মুসলিম, ইমাম আবূ দাউদ এবং ইমাম নাসায়ীও উপরোক্ত হাদীস উপরোক্ত রাবী শু’বা হইতে ঊর্ধ্বতন উপরোক্ত সনদাংশে এবং অন্যরূপ অধস্তন সনদাংশে বর্ণনা করিয়াছেন । ইমাম আবূ দাউদ কর্তৃক হযরত উবাই ইবন কা’ব হইতে বর্ণিত একটি রিওয়ায়েতে এইরূপ বর্ণিত হইয়াছেঃ
“নবী করীম (সাঃ) বলেন যে, একদা আমাকে কুরআন মজীদ শিক্ষা দেওয়া হইল । অতঃপর আমাকে প্রশ্ন করা হইল, এক হরফে অথবা দুই হরফে? আমার সহিত অবস্থানকারী ফেরেশতা আমাকে শিখাইয়া দিলেন- আপনি বলুন, দুই হরফে। অতঃপর আমাকে প্রশ্ন করা হইল, দুই হরফে অথবা তিন হরফে? আমার সহচর ফেরেশতা আমাকে শিখাইয়া দিলেন- আপনি বলুন, তিন হরফে। এইরূপে তিনি (প্রশ্নকর্তা ফেরেশতা) সাত হরফ পর্যন্ত পৌঁছিলেন। অতঃপর তিনি বলিলেন- “উহার প্রত্যেকটি হরফই আরোগ্যদাতা ও যথেষ্ট। যেমন যদি আপনি বলেনঃ سَمِيعًا عَلَيْمًا عَزِيزًا حَكِيمًا (তিনি শ্রোতা, জ্ঞাতা, পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময়) অর্থাৎ যদি আপনার তিলাওয়াতে অর্থগত ভ্রান্তি না আসে, অন্য কথায় যদি না আযাব সম্পর্কিত আয়াতকে রহমত সম্পর্কিত আয়াতের সহিত অথবা রহমত সম্পর্কিত আয়াতকে আযাব সম্পর্কিত আয়াতের সহিত মিলাইয়া তাল গোল পাকাইয়া দেন (তাহা হইলে সকল হরফই ঠিক)।’ ছাবিত ইব্ন কাসিম (রঃ) হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ) হইতে স্বয়ং নবী করীম (সাঃ)-এর উপরোক্তরূপ বাণী এবং হযরত ইবন মাসউদ (রা)-এর অনুরূপ উক্তি বর্ণনা করিয়াছেন।
হযরত উবাই ইবন কা’ব (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে আবু যর, আসিম, যায়দাহ, হুসায়ন ইব্ন আলী জা’ফী ও ইমাম আহমদ (রঃ) বর্ণনা করিয়াছেনঃ
‘আহজারুল মারআ’ নামক স্থানে হযরত জিবরাঈল (আঃ)-এর সহিত নবী করীম (সাঃ)-এর সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠিত হইল। নবী করীম (সাঃ) তাঁহাকে বলিলেন- আমি নিরক্ষর উম্মতের নিকট প্রেরিত হইয়াছি। তাহাদের মধ্যে গোলাম, কিশোর ও অতিশয় বৃদ্ধ নর-নারী রহিয়াছে। ইহাতে হযরত জিবরাঈল (আঃ) বলিলেন- ‘তাহাদিগকে সাতটি ‘হরফ’-এ কুরআন মজীদ তিলাওয়াত করিতে আদেশ দিন।’ ইমাম তিরমিযী (রঃ) উহা হযরত হুযায়ফা (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে আবূ যর, আসিম ইব্ন আবূ নাজম প্রমুখ রাবীর সনদে বর্ণনা করিয়াছেন। আল্লাহ্ই সৰ্বশ্ৰেষ্ঠ জ্ঞানী।
ইমাম আহমদ উহা প্রায় উপরোক্ত অর্থ হযরত হুযায়ফা (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে আবূ যর, আসিম, হাম্মাদ ও খালিদ হইতে বর্ণনা করিয়াছেন। এই বর্ণনায় ইহাও বলা হইয়াছে, ‘নিশ্চয়ই কুরআন সাত হরফে অবতীর্ণ হইয়াছে।’ হযরত হুযায়ফা (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে রবী ইব্ন খারাশ, ইবরাহীম ইব্ন মুহাজির, সুফিয়ান, ওয়াকী’, আবদুর রহমান ও ইমাম আহমদ (রঃ) বর্ণনা কয়িাছেনঃ
‘একদা আহজারুল মারআ নামক স্থানে হযরত জিবরাঈল (আঃ)-এর সহিত নবী করীম (সাঃ)-এর সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠিত হয়। উহাতে হযরত জিবরাঈল (আঃ) নবী করীম (সাঃ)-কে বলেন- আপনার উম্মত কুরআন মজীদকে ‘সাতটি হরফে’ তিলাওয়াত করিতে পারিবে। যে ব্যক্তি যে ‘হরফে’ উহা তিলাওয়াত করিতে পারে, সে যেন উহা সেই ‘হরফেই’ তিলাওয়াত করে। উহা যেন সে পরিত্যাগ না করে।’ উপরোক্ত সনদের আবদুর রহমান নামক রাবীর বর্ণনায় উহা এইরূপে বর্ণিত হইয়াছেঃ ‘হযরত জিবরাঈল (আঃ) বলিলেন- আপনার উম্মতের মধ্যে দুর্বল ব্যক্তি রহিয়াছে। কোন ব্যক্তি নির্দিষ্ট কোন ‘হরফে’ (কুরআন মজীদ) তিলাওয়াত করিলে সে যেন উহাতে বীতস্পৃহ হইয়া উহা পরিত্যাগ না করে।’ উক্ত সনদ সহীহ। তবে সিহাহ সিত্তাহ সংকলকগণ উপরোক্ত সনদে উহা বর্ণনা করেন নাই ৷
হযরত সুলায়মান ইব্ন সরদ হইতে ধারাবাহিকভাবে আবূ ইসহাক, শরীক, ইসমাঈল ইব্ন মূসা, সুদ্দী ও ইমাম ইবন জারীর (রঃ) বর্ণনা করিয়াছেনঃ
নবী করীম (সাঃ) বলেন- একদা আমার নিকট দুইজন ফেরেশতা আগমন করিলেন তাঁহাদের একজন আমাকে বলিলেন, আপনি পড়ুন। অন্যজন প্রশ্ন করিলেন- কয়টি হরফে? প্রথমজন বলিলেন- একটি হরফে। দ্বিতীয়জন বলিলেন- তাঁহার জন্য বৃদ্ধি করুন। এইরূপে তিনি সাতটি হরফ পর্যন্ত পৌঁছিলেন ।
সুলায়মান ইব্ন সর্দ হইতে ধারাবাহিকভাবে আবূ ইসহাক, আওয়াম ইব্ন হাওশাব, ইসহাক আযরাক, আবদুর রহমান ইব্ন মুহাম্মদ ইব্ন সালাম ও ইমাম নাসায়ী তাঁহার ‘আল-ইয়াওম-ওয়াল্লাইল’ নামক পুস্তকে বর্ণনা করিয়াছেনঃ
সুলায়মান ইব্ন সর্দ বলেন- ‘একদা হযরত উবাই ইবন কা’ব দুইজন লোককে লইয়া নবী করীম (সাঃ)-এর দরবারে উপস্থিত হইলেন। তাহাদের একজনের কিরাআত অন্যজনের কিরআত হইতে পৃথক ছিল।’ অতঃপর রাবী ইতিপূর্বে বর্ণিত হাদীসের ঘটনাটি বর্ণনা করিয়াছেন । আহমদ ইব্ন মুনী’ অনুরূপভাবে উহা সুলায়মান ইব্ন সব্দ হইতে ধারাবাহিকভাবে আবূ ইসহাক, আওয়াম ও ইয়াযীদ ইব্ন হারূনের সনদে বর্ণনা করিয়াছেন । হযরত উবাই ইবন কা’ব (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে সুলায়মান ইব্ন সর্দ, জনৈক আবদী (ইন জারীর তাহার নাম ভুলিয়া গিয়াছেন), আবূ ইসহাক, ইসরাঈল, ইয়াহিয়া ইব্ন আদম, আবূ কুরায়েব ও ইমাম ইবন জারীর বর্ণনা করিয়াছেনঃ
‘হযরত উবাই ইব্ন কা’ব (রাঃ) বলেন- একদা আমি মসজিদে গিয়া একটি লোককে কুরআন মজীদ তিলাওয়াত করিতে শুনিলাম। আমি তাহাকে প্রশ্ন করিলাম- তোমাকে কে ঐরূপ তিলাওয়াত শিখাইয়াছেন? লোকটি বলিল- নবী করীম (সাঃ)। আমি তাহাকে নবী করীম (সাঃ)-এর নিকট লইয়া গিয়া আরয করিলাম- হে আল্লাহ্র রাসূল ! এই লোকটিকে কুরআন মজীদ তিলাওয়াত করিতে বলুন। লোকটি (নবী করীম (সাঃ)-এর নির্দেশে) কুরআন মজীদ তিলাওয়াত করিল। নবী করীম (সাঃ) বলিলেন- ‘তুমি শুদ্ধ পড়া পড়িয়াছ।’ আমি আরয করিলাম- হে আল্লাহ্র রাসূল। আপনি যে উহা আমাকে এইরূপে পড়াইয়াছেন। নবী করীম (সাঃ) বলিলেন- ‘তুমিও শুদ্ধ পড়িয়াছ, শুদ্ধ পড়িয়াছ এবং শুদ্ধ পড়িয়াছ।’ অতঃপর তিনি আমার বুকে মৃদু চপেটাঘাত করিয়া বলিলেন— ‘আয় আল্লাহ্ ! তুমি উবাইর অন্তর হইতে সন্দেহ দূর করিয়া দাও।’ আমি ঘর্মাক্ত কলেবর হইয়া গেলাম । ভয়ে আমার পেট ফুলিয়া উঠিল । অতঃপর নবী করীম (সাঃ) বলিলেন- ‘একদা দুইজন ফেরেশতা আমার নিকট আসিলেন। তাঁহাদের একজন আমাকে বলিলেন, আপনি ‘এক হরফে’ কুরআন মজীদ তিলাওয়াত করুন। অন্যজন বলিলেন- তাঁহার জন্যে হরফ’ সংখ্যা বৃদ্ধি করুন। আমি বলিলাম- আমার জন্যে ‘হরফের’ সংখ্যা বৃদ্ধি করুন। প্রথমজন বলিলেন- উহা ‘দুই হরফে’ তিলাওয়াত করুন। এইরূপে তিনি ‘সাত হরফ’ পর্যন্ত পৌঁছিলেন এবং (আমাকে) বলিলেন- উহা ‘সাত হরফে’ তিলাওয়াত করুন।
নবী করীম (সাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে হযরত উবাই ইবন কা’ব, সুলায়মান ইব্ন সর্দ, সাতীর আবদী, আবূ ইসহাক, ইসরাঈল, হাজ্জাজ ও আবূ উবায়দ উহা প্রায় অনুরূপ অর্থে বর্ণনা করিয়াছেন। হযরত উবাই ইবন কা’ব হইতে ধারাবাহিকভাবে সুলায়মান ইব্ন সর্দ, ইয়াহিয়া ইবন ইয়া’মার কাতাদাহ, হুমাম, ওয়ালীদ তায়ালেসী ও ইমাম আবূ দাউদ (রঃ)-ও উক্ত হাদীস অনুরূপ অর্থে বর্ণনা করিয়াছেন। অতএব দেখা যাইতেছে, উক্ত হাদীস প্রায় ক্ষেত্রেই হযরত উবাই ইবন কা’ব হইতে বর্ণিত হইয়াছে। বর্ণনা দ্বারা মনে হয়, সুলায়মান ইব্ন সর্দ খুযাঈ উহার সাক্ষী। আল্লাহই সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞানী।
হযরত আবূ বুকরাহ (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে তদীয় পুত্র আবদুর রহমান, আলী ইব্ন যায়দ, হাম্মাদ ইব্ন সালমাহ, আবদুর রহমান ইব্ন মাহদী ও ইমাম আহমদ (রঃ) বর্ণনা করিয়াছেনঃ
‘নবী করীম (সাঃ) বলেন যে, একদা হযরত জিবরাঈল (আঃ) ও হযরত মীকাঈল (আঃ) আর্মার নিকট আসিলেন। হযরত জিবরাইল বলিলেন- আপনি একটি মাত্র হরফে কুরআন মজীদ তিলাওয়াত করিবেন। ইহাতে হযরত মীকাঈল (আমাকে) বলিলেন- তাঁহাকে (হরফের সংখ্যা) বৃদ্ধি করিতে বলুন। হযরত জিবরাঈল বলিলেন— ‘আপনি কুরআন মজীদকে ‘সাতটি হরফে’ তিলাওয়াত করিতে পারিবেন। উহার প্রত্যেকটি আরোগ্যদাতা ও যথেষ্ট। এই অনুমতি ততক্ষণ রহিয়াছে যতক্ষণ না আপনি রহমতের আয়াতকে আযাবের আয়াতের সহিত মিলাইয়া তালগোল পাকাইয়া না দেন ।’
ইমাম ইবন জারীরও উক্ত হাদীস উপরোক্ত রাবী হাম্মাদ ইব্ন সালমাহ হইতে উপরোক্ত ঊর্ধ্বতন সনদাংশে এবং হাম্মাদ ইব্ন সালমাহ হইতে ধারাবাহিকভাবে যায়দ ইব্ন খাব্বাব ও আবূ কুরায়েব এই অধস্তন সনদাংশে বর্ণনা করিয়াছেন। তবে তিনি উহার শেষাংশে নিম্নোক্ত অতিরিক্ত বর্ণনাটি সংযোজন করিয়াছেনঃ ‘হযরত জিবরাঈল (আঃ) বলিলেন- যেমন আপনি বলিয়া থাকেন هلم (তুমি আসো) কিংবা تعال (তুমি আসো) ৷’
হযরত সামুরাহ (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে হাসান, কাতাদাহ, হাম্মাদ ইব্ন সালমা, বাহায, আফ্ফান ও ইমাম আহমদ (রঃ) বর্ণনা করেনঃ
নবী করীম (সাঃ) বলিয়াছেন- কুরআন মজীদ ‘সাতটি হরফে’ নাযিল হইয়াছে। উক্ত হাদীসের সনদ সহীহ। তবে সিহাহ সিত্তার সংকলক মুহাদ্দিসগণ উহা উপরোক্ত সনদে বর্ণনা করেন নাই ৷
হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে আবূ সালমা, আবূ হাযিম, আনাস ইব্ন ইয়ায ও ইমাম আহমদ বর্ণনা করিয়ছেন যে, নবী করীম (সাঃ) বলিয়াছেন- ‘কুরআন মজীদ সাতটি হরফে নাযিল হইয়াছে, কুরআন মজীদ সম্পর্কে সন্দেহ করা কুফর। নবী করীম (সাঃ) ইহা তিনবার উচ্চারণ করিলেন । উহার যতটুকু তোমরা জানিতে পারো, ততটুকুর উপর আমল কর। আর উহার যতটুকু তোমরা জানিতে না পার, ততটুকু আলিমের নিকট লইয়া যাও (এবং তাহার নিকট হইতে উহা জানিয়া লও)।’ ইমাম নাসায়ী উপরোক্ত হাদীস উপরোক্ত রাবী আবূ যুমরাহ আনাস ইব্ন ইয়ায হইতে উপরোক্ত ঊর্ধ্বতন সনদাংশে এবং আনাস ইব্ন ইয়ায হইতে কুতাইবার অধস্তন সনদাংশে বর্ণনা করিয়াছেন। উম্মে আইউব হইতে ধারাবাহিকভাবে আবূ ইয়াযীদ, তৎপুত্র উবায়দুল্লাহ্, সুফিয়ান ও ইমাম আহমদ বর্ণনা করিয়াছেনঃ
নবী করীম (সাঃ) বলিয়াছেন- কুরআন মজীদ ‘সাতটি হরফে’ নাযিল হইয়াছে। উহার যে কোন হরফে তুমি উহা পড়িলেই চলিবে। উক্ত হাদীসের সনদ সহীহ। তবে সিহাহ সিত্তার কোন সংকলক উহা উপরোক্ত সনদে বর্ণনা করেন নাই।
হযরত আবূ জুহাম আনসারী হইতে ধারাবাহিকভাবে খাযরামীর মুক্তদাস মুসলিম ইব্ন সাঈদ (এখানে অন্যেরা ‘বিশর ইব্ন সাঈদ’ নাম উল্লেখ করিয়াছেন), ইয়াযীদ ইব্ন খাসীফাহ, ইসমাঈল ইব্ন জা’ফর ও আবূ উবায়দ বর্ণনা করিয়াছেনঃ
‘একদা দুইটি লোকের মধ্যে কুরআন মজীদের একটি আয়াতের বিষয় লইয়া মতভেদ দেখা দিল। তাহাদের প্রত্যেকেরই দাবী ছিল— নবী করীম (সাঃ) তাহাকে উহা এইরূপ শিখাইয়াছেন। তাহারা উভয়ে নবী করীম (সা)-এর নিকট আগমন করিল। নবী করীম (সাঃ) বলিলেন— ‘এই কুরআন মজীদ নিশ্চয় সাতটি হরফে নাযিল হইয়াছে। তোমরা উহা লইয়া ঝগড়া করিও না । কারণ, উহা লইয়া ঝগড়া করা কুফর।
আবূ উবায়দ উহা উপরোক্তরূপে রাবীর নামে সন্দেহের সহিত বর্ণনা করিয়াছেন। ইমাম আহমদ অবশ্য উহা রাবীর নামে কোনরূপ সন্দেহ ব্যতিরেকে বর্ণনা করিয়াছেন। তৎকর্তৃক উল্লেখিত রাবীর নামই সহীহ। ইমাম আহমদ কর্তৃক বর্ণিত হাদীসটি এইঃ হযরত আবূ যুহাম (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে বাসার ইবন সাঈদ (আবূ উবায়দ এই স্থলে সন্দেহবশত ‘মুসলিম ইব্ন সাঈদ’ নামটি উল্লেখ করিয়াছেন), ইয়াযীদ ইব্ন খাসীফাহ, সুলাইমান ইব্ন বিলাল, আবূ সালমাহ খুযাঈ ও ইমাম আহমদ বর্ণনা করিয়াছেনঃ
‘একদা দুইটি লোক কুরআন মজীদের একটি আয়াত লইয়া মতানৈক্যে পতিত হইল ৷ তাহাদের একজন বলিল- আমি এই আয়াত এইরূপে নবী করীম (সাঃ)-এর নিকট হইতে শিখিয়াছি । অন্যজন বলিল- আমি উহা এইরূপে নবী করীম (সাঃ) নিকট হইতে শিখিয়াছি । অতঃপর তাহারা তৎসম্বন্ধে নবী করীম (সাঃ)-এর নিকট জিজ্ঞাসা করিল। তিনি বলিলেন- কুরআন মজীদ ‘সাতটি হরফে’ নাযিল হইয়াছে। অতএব তোমরা কুরআন মজীদ লইয়া ঝগড়া করিও না । কুরআন মজীদ লইয়া ঝগড়া করা কুফর। উক্ত হাদীসের সনদও সহীহ। তবে সিহাহ সিত্তার সংকলকগণ উহা উপরোক্ত সনদে বর্ণনা করেন নাই ।
হযরত আমর ইব্ন ‘আসের মুক্তিপ্রাপ্ত দাস আবূ কায়স (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে বাসার ইব্ন সাঈদ, মুহাম্মদ ইব্ন ইবরাহীম ইয়াযীদ ইব্ন হাদী, লায়েছ, আবদুল্লাহ্ ইব্ন সালেহ ও আবূ উবায়দ বর্ণনা করিয়াছেনঃ
‘একদা জনৈক ব্যক্তি কুরআন মজীদের একটি আয়াত তিলাওয়াত করিলে হযরত আমর ইব্ন আস (রাঃ) বলিলেন, উহা এইরূপ হইবে। তিনি যে কিরাআতকে শুদ্ধ বলিলেন, তাহা উক্ত ব্যক্তির কিরাআত হইতে পৃথক ছিল। লোকটি বলিল, নবী করীম (সাঃ) উহা আমাকে এইরূপেই শিখাইয়াছেন । ইহাতে তাহারা উভয়ে নবী করীম (সাঃ)-এর দরবারে উপস্থিত হইয়া তাহাদের মতভেদের বিষয়টি উল্লেখ করিলেন। নবী করীম (সাঃ) বলিলেন— এই কুরআন মজীদ নিশ্চয় সাতটি হরফে নাযিল হইয়াছে। উহার যে কোন হরফেই তোমরা উহাকে পড়, তোমাদের পড়া শুদ্ধ হইবে । তোমরা কুরআন মজীদ লইয়া ঝগড়া করিও না । কারণ, কুরআন মজীদ লইয়া ঝগড়া করা কুফর।
আবূ কায়স হইতে ধারাবাহিকভাবে বাসার ইবন সাঈদ, ইয়াযীদ ইব্ন আবদুল্লাহ্ ইব্ন উসামাহ ইব্ন হাদী, আবদুল্লাহ্ ইব্ন জা’ফর ইব্ন আবদুর রহমান ইব্ন মিসওয়ার ইন মাখরামাহ, আবূ সালমা খুযাঈ এবং ইমাম আহমদও উহা প্রায় অনুরূপ অর্থে বর্ণনা করিয়াছেন। উক্ত সনদও সহীহ।
হযরত ইবন মাসউদ (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে আবূ সালমা ইব্ন আবদুর রহমান, সালমা, ইব্ন আবূ সালমা ইব্ন আবদুর রহমান, ওকায়েল ইব্ন খালিদ, হায়াত ইব্ন শুরায়হ, ইব্ন ওহাব, ইউনুস ইব্ন আবদুল আ’লা ও ইমাম ইবন জারীর বর্ণনা করিয়াছেনঃ
‘নবী করীম (সাঃ) বলিয়াছেন, পূর্ববর্তী আসমানী কিতাব মাত্র একটি বিষয়ে (واحد من باب) ও মাত্র একটি হরফে (من حرف واحد) নাযিল হইত; কিন্তু কুরআন মজীদ সাতটি বিষয়ে সাতটি হরফে নাযিল হইয়াছে। উক্ত সাতটি বিষয় (باب) হইতেছেঃ (১) সতর্ক বাণী; (২) আদেশসূচক বাণী; (৩) হালাল; (৪) হারাম; (৫) নির্দিষ্টার্থক বাণী; (৬) অনির্দিষ্টার্থক বাণী ও (৭) দৃষ্টান্তসূচক বাণী। তোমরা উহাতে বর্ণিত হালালকে হালাল এবং হারামকে হারাম বানাইবে ৷ তোমাদের প্রতি যে আদেশ প্রদান করা হইয়াছে, উহা পালন করিবে । তোমাদিগকে যাহা করিতে নিষেধ করা হইয়াছে, তাহা হইতে বিরত থাকিবে। উহাতে বর্ণিত দৃষ্টান্তসমূহ দ্বারা উপদেশ গ্রহণ করিবে। উহার নির্দিষ্টার্থক বাণী মানিয়া চলিবে এবং উহার অনির্দিষ্টার্থক বাণীর প্রতি ঈমান আনিবে। আর বলিবে- ‘আমরা উহার প্রতি ঈমান আনিলাম । উহার সমুদয় আয়াতই আমাদের প্রতিপালক প্রভুর পক্ষ হইতে আসিয়াছে।’ অতঃপর ইমাম ইবন জারীর উপরোক্ত হাদীস কাসেম ইবন আবদুর রহমান হইতে ধারাবাহিকভাবে যুমরাহ ইব্ন হাবীব, মুহারেবী ও আবূ কুরায়বের সূত্রে হযরত ইব্ন মাসউদ (রাঃ)-এর নিজস্ব উক্তি হিসাবে বর্ণনা করিয়াছেন। উহা স্বয়ং নবী করীম (সাঃ)-এর বাণী না হইয়া হযরত ইব্ন মাসউদ (রাঃ)-এর নিজস্ব উক্তি হওয়াই অধিকতর যুক্তিসঙ্গত। আল্লাহই সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞানী।
মুহাদ্দিস আবূ উবায়দ বলেন- বিপুল সংখ্যক হাদীসে বর্ণিত হইয়াছে যে, কুরআন মজীদ ‘সাতটি হরফে’ নাযিল হইয়ছে। কিন্তু নিম্নোক্ত হাদীসে সাতটি হরফের পরিবর্তে ভিন্ন সংখ্যক ‘হরফ’ও উল্লেখিত হইয়াছে। হযরত সামুরাহ ইব্ন জুনদুব হইতে ধারাবাহিকভাবে হাসান, কাতাদাহ,হাম্মাদ ইব্ন সালমা ও আফ্ফান আমার (আবূ উবায়দের) নিকট বর্ণনা করিয়াছেনঃ
‘নবী করীম (সাঃ) বলিয়াছেন- কুরআন মজীদ সাতটি হরফে নাযিল হইয়াছে। আবূ উবায়দ বলেন- সাতটি হরফই সঠিক বলিয়া আমি মনে করি। কারণ, উহাই বিপুল সংখ্যক রিওয়ায়েতে উল্লেখিত হইয়াছে। এ কথার তাৎপর্য ইহা নহে যে, কুরআন মজীদের নির্দিষ্ট একটি শব্দকে সাত প্রকারের উচ্চারণে তিলাওয়াত করা যায়। প্রকৃতপক্ষে কুরআন মজীদে সর্বসাকুল্যে মোট সাতটি গোত্রের ভাষা সন্নিবেশিত রহিয়াছে। উহার কোন শব্দের উচ্চারণ হয়তো একটি গোত্রের উচ্চারণ হইতে গৃহীত হইয়াছে। আবার অন্য কোন শব্দের উচ্চারণ হয়তো অন্য এক গোত্রের উচ্চারণ হইতে গৃহীত হইয়াছে । আবার অন্য কোন শব্দের উচ্চারণ হয়তো অন্য এক গোত্রের উচ্চারণ হইতে গৃহীত হইয়াছে। এইরূপে মোট সাতটি গোত্রের উচ্চারণ হইতে উহার শব্দ সম্ভারের উচ্চারণ গৃহীত হইয়াছে। উক্ত সৌভাগ্যে যে সকল গোত্র সৌভাগ্যমণ্ডিত হইয়াছে, তাহাদের সকলের সৌভাগ্য আবার সমান নহে; বরং এই সৌভাগ্যে এক গোত্র আরেক গোত্রকে ছাড়াইয়া গিয়াছে। অর্থাৎ এক গোত্র হইতে অন্য গোত্র অপেক্ষা অধিকতর সংখ্যক উচ্চারণ গৃহীত হইয়াছে। শীঘ্রই বর্ণিতব্য বিপুল সংখ্যক হাদীসে উহা বিশদরূপে বর্ণিত হইয়াছে।’
মুহাদ্দিস আবূ উবায়দ আরও বলেন- হযরত ইব্ন আব্বাস (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে আবূ সালেহ ও কালবী বর্ণনা করিয়াছেনঃ কুরআন মজীদ সাতটি ভাষা-রীতিতে নাযিল হইয়াছে। উহার পাঁচটি হইতেছে— হাওয়াযেন (هوازن) গোত্রের অন্তর্গত আল-আজার (العجر) শাখা গোত্রের ভাষারীতি।’ আবূ উবায়দ বলেন- আল আজার শাখা গোত্রের চারিটি উপগোত্র বা উপশাখা রহিয়াছে। উহা হইতেছেঃ (১) বনু আসআদ ইব্ন বকর (ابن بكر بثوا سعد) (২) খায়ছাম ইব্ন বকর (خيثم ابن بكر) (৩) নসর ইব্ন মুআবিয়াহ (نصر ابن معاويه) (8) ছাকীফ (ثقيف) (৫) তামীম গোত্রের অধস্তন পুরুষ বনু দারম ) ( بنوادارم) আবূ আমা ইব্ন আ’লা মন্তব্য করিয়াছেন- ‘আরবদের মধ্যে বিশুদ্ধতম ভাষায় কথা বলে হাওয়াযেন গোত্রের ঊর্ধ্বতন অংশ।’ উক্ত অংশই আল-আজার নামে অভিহিত হইয়াছে । হযরত উমর (রাঃ)-এর উক্তি এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। তিনি বলিয়াছিলেন- ‘কুরআন মজীদের সংকলনে কুরায়শ এবং ছাকীফ গোত্রের লোক ভিন্ন অন্য কেহ যেন উচ্চারণ বলিয়া না দেয়।’ ইমাম ইবন জারীর বলেন- ‘ষষ্ঠ ও সপ্তম ভাষারীতি হইতেছে (৬) কুরায়েশের ভাষারীতি এবং (৭) খুযাআহ গোত্রের ভাষারীতি । উক্ত রিওয়ায়েত হযরত ইব্ন আব্বাস (রা) হইতে কাতাদাহ বর্ণনা করিয়াছেন। তবে হযরত ইব্ন আব্বাস (রা)-এর সহিত কাতাদাহর সাক্ষাৎ লাভ ঘটে নাই ৷
উবায়দুল্লাহ্ ইব্ন আরুদল্লাহ্ ইব্ন উতবাহ হইতে ধারাবাহিকভাবে হাসীন ইব্ন আবদুর রহমান, হাশীম ও ইমাম আবূ উবায়দ বর্ণনা করিয়াছেন যে, রাবী উবায়দুল্লাহ্ বলেন- হযরত ইব্ন আব্বাস (রাঃ)-এর নিকট কুরআন মজীদের কোন আয়াতের অর্থ বা ব্যাখ্যা জিজ্ঞাসা করা হইলে তিনি উহার অর্থ বা ব্যাখ্যা প্রদানপূর্বক স্বীয় সমর্থনে আরব কবিদের কবিতা উদ্ধৃত করিতেন । সাঈদ অথবা মুজাহিদ হইতে ধারাবাহিকভাবে আবূ বিশ্ব, হাশীম ও ইমাম আবূ উবায়দ বর্ণনা করিয়াছেনঃ হযরত ইব্ন আব্বাস (রাঃ) কুরআন মজীদের والليل وما وسق আয়াতের অন্তর্গত وسق শব্দের অর্থ করিয়াছেন- جمم (সে একত্রিত করিয়াছে)। প্রমাণস্বরূপ তিনি নিম্নোক্ত কবিতা চরণটি উদ্ধৃত করিয়াছেনঃ
قد اتسقن لى يجحدن سائقا
অর্থাৎ চালক পাইলে তাহারা একত্রিত হইত। উল্লেখ্য, وسق ও اتسق এই উভয় শব্দ একই ধাতু و – س – ق হইতে উদ্ভূত হইয়াছে ।
ইকরামা হইতে ধারাবাহিকভাবে হেসীন, হাশীম ও ইমাম আবূ উবায়দ বর্ণনা করিয়াছেনঃ হযরত ইব্ন আব্বাস (রা) فاذا هم بالساهرة আয়াতের অন্তর্ভুক্ত الساهرة শব্দের অর্থ করিয়াছেন- الار ض স্থলভাগ। প্রমাণস্বরূপ তিনি কবি উমাইয়া ইব্ন আবূ সলতের নিম্নোক্ত কবিতা চরণটি উদ্ধৃত করিয়াছেনঃ
وعندهم لحم بحر ولحم ساهرة
‘তাহাদের নিকট সমুদ্রের গোশত এবং স্থলভাগের গোশত উভয়ই রহিয়াছে।(১)
ইবরাহীম ইব্ন মুহাজির হইতে ধারাবাহিকভাবে সুফিয়ান ইয়াহিয় ! ইব্ন সাঈদ ও ইমাম আবূ উবায়দ বর্ণনা করিয়াছেনঃ হযরত ইব্ন আব্বাস (রাঃ) বলেন- আমি কুরআন মজীদের فاطر السَّمرّت والآراض এই অংশের অর্থ জানিতাম না । একদা দুইজন বেদুঈন একটি কূপকে কেন্দ্র করিয়া ঝগড়া করিতেছিল। তাহাদের একজন আকেরজনকে বলিল- انافطرتها انا ابتدأتها আমিই উহাকে সর্বপ্রথম নির্মাণ করিয়াছি; আমিই উহার গোড়া পত্তন করিয়াছি। (তাহার শব্দ প্রয়োগে হযরত ইব্ন আব্বাস (রাঃ) উপরোক্ত শব্দের অর্থ জানিতে পারিলেন।) উক্ত রিওয়ায়েতের সনদও সহীহ।
উপরে বর্ণিত রিওয়ায়েতসমূহের কোন কোন রিওয়ায়েত বর্ণনা করিবার পর ইমাম আবূ জা’ফর ইব্ন জারীর তাবারী (রঃ) বলেন- ‘ইহা প্রমাণিত সত্য যে, কুরআন মজীদ আরবের সকল গোত্রের ভাষায় নাযিল হয় নাই; বরং উহা সংখ্যা সাতের অধিক । এমনকি উহার প্রকৃত সংখ্যা নির্ণয় করা অসম্ভব। পক্ষান্তরে কুরআন মজীদ মাত্র সাতটি ভাষারীতিতে নাযিল হইয়াছে। এখন প্রশ্ন দাঁড়ায়, যাহারা সংশ্লিষ্ট হাদীস نزل القران على سبعة احرف -এর এইরূপ তাৎপর্য বর্ণনা করেন যে, কুরআন মজীদে সাত শ্রেণীর বিষয় যথা আদেশ, নিষেধ, উৎসাহিতকরণ, নিরুৎসাহকরণ, কাহিনী, দৃষ্টান্ত ইত্যাদি বা অনুরূপ সাতটি বিষয় বর্ণিত হইয়াছে, তাহাদের ব্যাখ্যা যে সঠিক নহে এবং পূর্বোল্লেখিত ব্যাখ্যাই (সাতটি ভাষারীতি বা শব্দের সাতটি উচ্চারণরীতি) যে সঠিক, তাহার প্রমাণ কি? এই প্রশ্নের উত্তর এই যে, পূর্বযুগীয় কোন ইমাম অথবা কোন প্রাজ্ঞ ব্যক্তি কি উক্ত হাদীসের উপরোক্তরূপ ব্যাখ্যা প্রদান করিয়াছেন? যাহারা বলেন, কুরআন মজীদ সাত শ্রেণীর বিষয় যথা আদেশ, নিষেধ ইত্যাদি বর্ণিত হইয়াছে, তাহারা এইরূপ দাবী করেন নাই যে, উহা نزل القران على سبعة احرف হাদীসাংশের ব্যাখ্যা। তাহারা যাহা বলিয়াছেন, তাহা সঠিক ও শুদ্ধই বটে। প্রকৃতপক্ষে নবী করীম (সাঃ) এবং একদল সাহাবী হইতেই বর্ণিত হইয়াছেঃ نزل القران على سبعة ابواب الجنة ‘কুরআন মজীদ নিশ্চয় জান্নাতের সাতটি দরজায় নাযিল হইয়াছে।’ ব্যাখ্যাকারদের উপরোক্ত ব্যাখ্যা উক্ত হাদীসেরই ব্যাখ্যা। এখানে উল্লেখ করা যাইতে পারে যে, উক্ত হাদীস- نزل القران على سبعة ابواب الجنة ইতিপূর্বে হযরত উবাই ইব্ন কা’ব (রাঃ) ও হযরত ইবন মাসউদ (রাঃ) হইতে বর্ণিত হইয়াছে।
ইমাম ইব্ন জারীর বলেন- “জান্নাতের সাতটি দরজার তাৎপর্য হইতেছে কুরআন মজীদে বর্ণিত সাত শ্রেণীর বিষয়ঃ আদেশ, নিষেধ, উৎসাহিতকরণ, নিরুৎসাহকরণ, কাহিনী,দৃষ্টান্ত ইত্যাদি। উহা এই কারণে ‘জান্নাতের সাতটি দরজা’ নামে অভিহিত করা হইয়াছে যে, বান্দা সেইগুলি যথাযথভাবে পালন করিলে তাহার জন্যে জান্নাতের সাতটি দ্বারই উন্মুক্ত তথা ওয়াজিব ও প্রাপ্য হইয়া যায় ।” অতঃপর ইমাম ইব্ন জারীর দীর্ঘ এক প্রবন্ধ লিখিয়াছেন। উহার সারমর্ম এই যে, কুরআন মজীদ সাতটি কিরাআতে তিলাওয়াত করাকে শরীআত এই উম্মতের জন্যে জায়েয রাখিয়াছে।
“ইন জারীর আরও বলেন- “কুরআন মজীদ আরবী ভাষার সাতটি উচ্চারণ রীতিতে নাযিল হইলেও এবং সাতটি উচ্চারণ রীতিতে উহা তিলাওয়াত করা জায়েয হইলেও আমীরুল মু’মিনীন হযরত উসমান (রাঃ) যখন দেখিলেন যে, লোকেরা উহা বিভিন্নরূপে তিলাওয়াত করিতেছে এবং এই বিষয়ে পারস্পরিক দ্বন্দ্বে লিপ্ত হইয়াছে, তখন তাঁহার মনে আশঙ্কা জাগিল যে, ভবিষ্যতে মানুষ স্বকপোলকল্পিত উচ্চারণের শব্দ কুরআন মজীদে প্রক্ষিপ্ত করিয়া দিবে এবং উহার ফলে প্রকৃত ও বৈধ উচ্চারণসমূহ উদ্ধার করা কঠিন বা অসম্ভব হইয়া পড়িবে। কুরআন মজীদকে হিফাজত করিবার জন্যে তিনি উহার মাত্র একটি উচ্চারণরীতি বহাল রাখিলেন । অবশিষ্ট ছয়টি কিরাআত বা উচ্চারণরীতি পরিত্যক্ত হইল। সেই একটি মাত্র উচ্চারণ রীতিতে সারা বিশ্বে কুরআন মজীদ সংরক্ষিত ও পঠিত হইয়া আসিতেছে। সমগ্র সাহাবীকুল তথা সমগ্র মুসলিম উম্মাহ হযরত উসমান (রাঃ)-এর উক্ত কার্যকে রুশদ ও হিদায়েত বিবেচনা করত উহার প্রতি স্বতোৎসারিত আনুগত্য প্রদর্শন করিয়াছেন। সাতটি কিরাআতের মধ্য হইতে ছয়টিকে পরিত্যাগ করত মাত্র একটি কিরাআতে সারা বিশ্বে কুরআন মজীদ তিলাওয়াত করিবার মধ্যে তাহারা এই উম্মতের জন্যে খায়ের ও বরকত নিহিত মনে করিয়াছেন । আজ আর সে পরিত্যক্ত ছয়টি উচ্চারণরীতি বা কিরাআত উদ্ধার করা সম্ভবপর নহে। কেহ, চাহিলেও উক্ত ছয়টি কিরাআতের কোনটিতে কুরআন মজীদ তিলাওয়াত করিতে সমর্থ হইবে না।
এক্ষণে প্রশ্ন দেখা দেয়, স্বয়ং নবী করীম (সাঃ) যে সকল কিরাআত বা উচ্চারণ রীতিতে সাহাবীগণকে কুরআন মজীদ শিক্ষা দিয়াছেন, তাহা পরিত্যাগ করা হযরত উসমান (রাঃ) তথা সাহাবীকুলের জন্যে কিরূপে জায়েয হইল? এই প্রশ্নের উত্তর এই যে, শরীআত সাতটি কিরাআতের প্রত্যেকটিতে কুরআন মজীদ তিলাওয়াত করা ফরয বা ওয়াজিব করে নাই। শরীআত শুধু সাতটি কিরাআতের যে কোন কিরাআতে কুরআন মজীদ তিলাওয়াত করিবার অনুমতি প্রদান করিয়াছে। বস্তুত সাতটি কিরাআত বহাল রাখা ফরয বা ওয়াজিব নহে; বরং কুরআন মজীদের তিলাওয়াতে সাতটি কিরাআত ভিন্ন অন্য কোন কিরাআত আমদানী করা অবৈধ। হযরত উসমান (রাঃ) এবং সাহাবীগণ তাহা করেন নাই । বরং ফরয বা ওয়াজিব নহে এমন অনুমোদিত ছয়টি কিরাআতকে বাদ দিয়াছেন মাত্র। কেন তাঁহারা সেইগুলি বাদ দিলেন? তাঁহারা দেখিলেন, একটি বিশষ কিরাআত বা উচ্চারণে কুরআন মজীদ সংকলিত হইয়া যাইবার পর তদনুযায়ী উহা তিলাওয়াত করা কোন গোত্রের লোকের পক্ষেই, এমনকি বিশ্বের কোন লোকের পক্ষেই অসম্ভব বা কষ্টকর হইবে না। অধিকন্তু, কুরআন মজীদের কিরাআত লইয়া পারস্পরিক দ্বন্দ্বে লিপ্ত হইবার এবং অশুদ্ধ ও অননুমোদিত উচ্চারণ রীতি উহাতে প্রবেশ করাইয়া দিবার পথ ইহা দ্বারা চিরতরে রুদ্ধ হইয়া যাইবে। বস্তুত তাহাই হইয়াছে । কুরআন মজীদ এবং একমাত্র কুরআন মজীদই মানব জাতির নিকট বিদ্যমান নির্ভুল ও প্রক্ষেপমুক্ত আসমানী গ্রন্থ। আল্লাহ্ তা’আলা তাঁহার কিতাব সংরক্ষণ করিবার বিনিময়ে পবিত্র হৃদয় সাহাবীগণকে আখিরাতে মহা পুরস্কারে পুরস্কৃত করুন।
অতঃপর একটি বিষয়ের প্রতি আলোকপাত করা প্রয়োজন। কুরআন মজীদ মাত্র একটি কিরাআত আমাদের মধ্যে বর্তমান থাকিলেও উহার শব্দের মূলরূপ অপরিবর্তিত রাখিয়া কোন কোন শব্দের কোন কোন অক্ষরে(د فع) কর্তৃকারকে বিভক্তি (نصب) কর্মকারকের বিভক্তি এবং (جر) সম্বন্ধ পদের বিভক্তি স্থাপন, (تسكين) স্বরান্তকরণ, শব্দের অন্তর্গত বর্ণের অবস্থান পরিবর্তন ইত্যাদি ব্যাপারে মতভেদ করা হাদীসে উল্লেখিত নিষেধকে অমান্য করা নহে। সংশ্লিষ্ট হাদীসে বর্ণিত হইয়াছে যে, ‘অনুমোদিত সাতটি কিরাআতের বিষয় লইয়া ঝগড়া করা কুফর।’ বস্তুত উপরোল্লেখিত শ্রেণীর মতভেদ করা সাতটি অনুমোদিত কিরাআতের বিষয় লইয়া মতভেদ করা নহে। উম্মতের কোন বিজ্ঞ ব্যক্তিই উপরোক্ত রূপ মতভেদকে ‘কুফর’ নামে আখ্যায়িত করেন নাই।
আলোচ্য পরিচ্ছেদে ইমাম বুখারী (রঃ) কর্তৃক বর্ণিত দ্বিতীয় হাদীসে আছে যে, হযরত উমর (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে মিসওয়ার ইবন মাখরামাহ ও আবদুর রহমান ইব্ন আবদুল কারী, উরওয়াহ ইবন যুবায়ের, ইবন শিহাব, ওকায়ল, লায়ছ, সাঈদ ইবন উফায়র ও ইমাম বুখারী বর্ণনা করিয়াছেনঃ হযরত উমর (রাঃ) বলেন- একদা আমি নবী করীম (সাঃ)-এর জীবদ্দশায় হিশাম ইব্ন হাকীমকে সূরা ফুরকান তিলাওয়াত করিতে শুনিলাম ! আমি তাহার কিরাআতের প্রতি মনোযোগী হইয়া জানিতে পারিলাম, সে কতগুলি বর্ণ বৃদ্ধি করিয়া উহা তিলাওয়াত করিতেছে। নবী করীম (সাঃ) আমাকে উহা সেইরূপে তিলাওয়াত করা শিখান নাই । আমার অবস্থা এই হইল যে, তাহার নামাযের মধ্যেই তাহাকে পাকড়াও করি আর কী । তাহার নামায শেষ করা পর্যন্ত আমি ধৈর্যধারণ করিয়া রহিলাম । নামায শেষ হইবার পর আমি তাহার চাদর টানিয়া ধরিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম- আমি তোমাকে যে সূরাটি তিলাওয়াত করিতে শুনিলাম, তাহা তোমাকে কে শিক্ষা দিয়াছে? সে বলিল- আমাকে উহা নবী করীম (সাঃ) শিক্ষা দিয়াছেন। আমি বলিলাম- তুমি মিথ্যা বলিতেছ! কারণ, তুমি উহা যেরূপে তিলাওয়াত করিয়াছ, নবী করীম (সা) আমাকে উহা অন্যরূপে শিক্ষা দিয়াছেন । আমি তাহাকে নবী করীম (সাঃ)-এর নিকট টানিয়া লইয়া গেলাম । নবী করীম (সাঃ)-এর খেদমতে আরয করিলাম- হে আল্লাহ্র রাসূল ! আমি এই লোকটিকে কতগুলি অতিরিক্ত বর্ণসহ সূরা ফুরকান তিলাওয়াত করিতে শুনিয়াছি। আপনি উক্ত অতিরিক্ত বর্ণসমূহ সহ আমাকে উহা শিক্ষা দেন নাই। নবী করীম (সাঃ) বলিলেন— “হে হিশাম! তুমি পড়িয়া শুনাও তো।’ আমি উহা ইতিপূর্বে যেইরূপ তিলাওয়াত করিতে শুনিয়াছিলাম, সে উহা সেইরূপে তিলাওয়াত করিয়া নবী করীম (সাঃ)-কে শুনাইল। নবী করীম (সাঃ) বলিলেন- উহা এইরূপেই নাযিল হইয়াছে। অতঃপর আমাকে বলিলেন— ‘হে উমর ! তুমি পড়িয়া শুনাও তো।’ নবী করীম (সাঃ) উহা আমাকে যেইরূপে শিখাইয়াছেন, আমি তাহাকে উহা সেইরূপে তিলাওয়াত করিয়া শুনাইলাম। তিনি বলিলেন- ‘উহা ঐরূপেই নাযিল হইয়াছে। কুরআন মজীদ নিশ্চয় ‘সাতটি হরফে’ নাযিল হইয়াছে । উহার যে হরফে তোমরা (কুরআন মজীদ) তিলাওয়াত করিতে পারো, সেই হরফে তিলাওয়াত করিও।’ ইমাম আহমদ, ইমাম মুসলিম, ইমাম আবূ দাউদ, ইমাম তিরমিযী এবং ইমাম বুখারীও উক্ত হাদীস ইবন শিহাব যুহরীর মাধ্যমে একাধিক সনদ শাখায় বর্ণনা করিয়াছেন । ইমাম আহমদ উহা আবদুর রহমান ইব্ন আব্দুল কারী হইতে ধারাবাহিকভাবে উরওয়াহ, যুহরী ও মালিক ইব্ন মাহদীর সনদেও প্রায় অনুরূপ অর্থে বর্ণনা করিয়াছেন।
আবূ তালহা হইতে ধারাবাহিকভাবে আবদুল্লাহ্ ইব্ন আবূ তালহা, ইসহাক ইব্ন আবদুল্লাহ্, হারর্ ইব্ন সাবিত, আবদুস সামাদ ও ইমাম আহমদ বর্ণনা করিয়াছেনঃ একদা জনৈক ব্যক্তি হযরত উমর (রাঃ)-এর সম্মুখে কুরআন মজীদ তিলাওয়াত করিলে হযরত উমর (রাঃ) তাহার কিরাআতকে ভ্রান্ত ও অশুদ্ধ আখ্যায়িত করিলেন। লোকটি বলিল- ‘আমি নবী করীম (সাঃ)-এর সম্মুখে এইরূপেই তিলাওয়াত করিয়াছি। তিনি তো আমার কিরাআতকে অশুদ্ধ বলেন নাই।’ অতঃপর তাহারা উভয়ে নবী করীম (সাঃ)-এর নিকট উপস্থিত হইল ৷ লোকটি নবী করীম (সাঃ)-এর সম্মুখে সেইরূপে তিলাওয়াত করিল । নবী করীম (সাঃ) তাহাকে বলিলেন- ‘তুমি সঠিক ও শুদ্ধরূপেই পড়িয়াছ।’ ইহাতে হযরত উমর (রাঃ) আবেগাপ্লুত হইয়া পড়িলেন। নবী করীম (সাঃ) বলিলেন- ‘হে উমর! কুরআন মজীদের সকল কিরাআতই সহীহ ও শুদ্ধ, যতক্ষণ না তুমি (উহার) আযাবকে মাগফিরাতে এবং মাগফিরাতকে আযাবে রূপান্তরিত করিয়া দাও।’ উক্ত হাদীসের সনদ গ্রহণযোগ্য। উহার অন্যতম রাবী হারব ইবন সাবিত ‘আবূ সাবিত’ নামেও পরিচিত । কোন সমালোচক তাহাকে বিরূপভাবে সমালোচনা করিয়াছেন বলিয়া আমার জানা নাই।