আরজ মঞ্জিল পাবলিক লাইব্রেরীতে জেলা প্রশাসনের পুস্তক প্রদান অনুষ্ঠানে প্রদত্ত বক্তৃতা
মাননীয় বাকেরগঞ্জ জেলা প্রশাসক বনাম সভাপতি সাহেব ও সুধী অতিথিবৃন্দ! লামচরির মতো গণ্ডগ্রামে অবস্থিত আমার প্রতিষ্ঠিত এ ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানটির নোংড়া প্রাঙ্গণে মাননীয় জেলা প্রশাসক সাহেব অনাহূত হয়েও যেভাবে পদধূলি দিয়েছেন, সেজন্য আমি নিজেকে ধন্য ও গৌরবান্বিত মনে করছি। কিন্তু আজকের এই গৌরবজ্জল দিনটিতে আমার মানসগগন ছেয়ে রয়েছে বিষাদের একটি কালো মেঘ। সে বিষাদের কারণ হচ্ছে এই যে, সময়ের স্বল্পতা ও আমার নিজের অযোগ্যতা, এ উভয় কারণেই আপনাদের মর্যাদা মাফিক যথাযোগ্য অভ্যর্থনার ব্যবস্থা করতে না পারা। আমার অনিচ্ছাকৃত ত্রুটির জন্য আপনাদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি।
জন্ম আমার ৩রা পৌষ ১৩০৭ সালে। ১৩৬৭ সালে যখন বয়স ৬০ বছর পূর্ণ হয়, তখন যে পর্যন্ত যে বিত্ত-সম্পদ উপার্জন করতে পেরেছিলাম, তার স্থাবর-অস্থাবর সমস্ত সম্পদ আমার ওয়ারিশগণের মধ্যে দান ও বন্টন করে দিয়েছি এবং রিক্তহস্তে আমি আমার পুত্রগণের পোষ্য হয়ে জীবন যাপন করছি। কিন্তু পুত্রদের কাছে আমি একথা বলে রেখেছি যে, অবশিষ্ট জীবনে আমি আমার দেহ খাটিয়ে যদি কোন অর্থ উপার্জন করতে পারি, তবে তা সমস্তই দেশের জনগণের কল্যাণে ব্যয় করবো। তাতে তাদের কোন দাবি-দাওয়া থাকবে না। আমার ওয়ারিশগণ তাতে সম্মত ছিলো ও আছে। অতঃপর ১৩৮৭ সাল পর্যন্ত অর্থাৎ আমার ৮০ বছর বয়স পর্যন্ত শুধু কায়িক শ্রমের দ্বারা যে অর্থ উপার্জন করতে পেরেছি, তা সমস্তই আমি এ ক্ষুদ্র লাইব্রেরীটির মাধ্যমে জনকল্যাণ দান করেছি। আজ পর্যন্ত যার পরিমাণ হচ্ছে প্রায় ৮০ হাজার টাকা। এর মধ্যে ১২ হাজার টাকা স্থায়ী আমানত রেখেছি জনতা ব্যাংক চকবাজার শাখা, বরিশালে। যার লভ্যাংশের দ্বারা লাইব্রেরীর চলতি খরচ মেটানো হচ্ছে এবং স্থানীয় ৫টি প্রাথমিক ও ২টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে মোট ৮০০.০০ টাকা করে বার্ষিক বৃত্তি প্রদান করা হচ্ছে।
বর্তমানে আমি কপর্দকশূন্য ও পরবাসী। পরবাসী কথাটি সঙ্গতিহীন বলে আপনাদের মনে হলেও একাধিকরূপে সত্য। এ কথাটি কারো অজানা নয় যে, দান করা বস্তুর উপর দাতার কোন স্বত্ব বা অধিকার থাকে না, দাতার কাছে তখন তা হয় পরের সম্পদ। বর্তমানে আমি যে বাড়িতে বাস করি, সে বাড়িটি আমার নয়। কেননা তা আমি দান করে দিয়েছি। সুতরাং এখন আমি নিজ বাড়িতে পরবাসী। বর্তমানে যে লাইব্রেরীটিতে বাস করি, সেটিও আমার নয়। কেননা তা আমি দান করে দিয়েছি। সুতরাং আমি আমাই নিজ লাইব্রেরীতে পরবাসী। সর্বোপরি আমার মন ও প্রাণটিকে নিয়ে যে দেহটিতে বাস করছি, সে দেহটিও আমার নয়, কেননা তা বরিশাল শেরে বাংলা মেডিক্যাল কলেজে দান করে দিয়েছি। সুতরাং দেহগত ভাবেও আমি এখন পরের দেহেই বাস করি। এত রকম পরবাসী হওয়া স্বত্বেও আমি নিজেকে মনে করি যেন স্বর্গবাসী। কিন্তু সে স্বর্গীয় সুখের মধ্যে একটিমাত্র দুঃখ এই যে, আমার প্রতিষ্ঠিত ক্ষুদ্র লাইব্রেরীটির পূর্ণাঙ্গ রূপ দান করা আমার সামর্থে কুলোয়নি। কেননা আমার পরিকল্পিত কতিপয় কাজ এখনো বাঁকি।
নিরক্ষর বয়স্কদের শিক্ষার জন্য একটি নৈশ বিদ্যালয় স্থাপনের উদ্দেশ্যে লাইব্রেরী সংলগ্ন একটি বারান্দা নির্মাণ, গরু-ছাগলের কবল থেকে ফুলবাগান রক্ষার উদ্দেশ্যে লাইব্রেরীর সরহদ্দ বরাবর একটি দেয়াল নির্মাণ, আসবাবপত্র ও কিছু পুস্তকাদি খরিদ ইত্যাদি বাবদ এখনো প্রায় ৩০ হাজার টাকার দরকার। কিন্তু এ অর্থ সংকুলানের তহবিল আমার নেই। তা সে বিষয়ে সদাশয় বাংলাদেশ সরকার বিশেষত মহান জেলা প্রশাসক সাহেবের শুভদৃষ্টি প্রার্থনা করছি।
মাননীয় জেলা প্রশাসক সাহেব ও উপস্থিত সুধীবৃন্দ! আমার মামুলি আলোচনা দ্বারা আপনাদের মূল্যবান সময় আর নষ্ট করতে চাই না। এ নিঃস্ব পল্লীর ধূলিময় মাটিতে পদার্পণ করে আপনারা যে উদারতার পরিচয় দিয়েছেন, সেজন্য পল্লীবাসীদের ও নিজের পক্ষ থেকে আপনাদের সকৃতজ্ঞ ধন্যবাদ জানিয়ে আমার বক্তব্য শেষ করছি।
ধন্যবাদ, শুভ হোক।
২১.১.১৯৮৫
অপ্রকাশিত
৮.১ মুসলিম সাহিত্য সমাজের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে ভাষণ
৮.২ বাংলাদেশ সোসিও-ফিলসফিক হিউম্যানিস্ট গিল্ড সেমিনারে ভাষণ
৮.৩ আরজ মঞ্জিল লাইব্রেরীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ভাষণ
৮.৪ নজরুল জয়ন্তী অনুষ্ঠানে ভাষণ
৮.৫ গুণী সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে ভাষণ
৮.৬ বাংলাদেশ উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীর অনুষ্ঠানে ভাষণ
৮.৭ আরজ মঞ্জিল লাইব্রেরীর বার্ষিক বিবরণী ভাষণ
৮.৮ মানবিক উন্নয়নে যুব সমাজের ভূমিকা সেমিনারে ভাষণ
৮.৯ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সভায় ভাষণ
৮.১০ আরজ মঞ্জিল লাইব্রেরীর বার্ষিক অধিবেশনে ভাষণ
৮.১১ বার্ষিক বৃত্তিপ্রদান উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ভাষণ
৮.১২ বাংলাদেশ কুটির শিল্প সংস্থায় ভাষণ
৮.১৩ আরজ মঞ্জিল লাইব্রেরীর বার্ষিক বিবরণী ভাষণ
৮.১৪ বাংলাদেশ দর্শন সমিতিতে ভাষণ
৮.১৫ বার্ষিক বৃত্তি প্রদান অনুষ্ঠানে ভাষণ
৮.১৬ আরজ মঞ্জিল লাইব্রেরীতে ভাষণ
৮.১৭ বাংলা একাডেমীর সংবর্ধনা ভাষণ