হিন্দুরাই আমার বল-ভরসা
বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা যেদিন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ঘোষণা করলেন, সেদিন তিনি নিজে মোট ৪টি আসন থেকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঘোষণা দেন। গোপালগঞ্জের ১টি, বাগেরহাটের ২টি এবং ঢাকার ডেমরা থেকে ১টি। এই মোট ৪টি আসন থেকে শেখ হাসিনা নিজে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ঘোষণা দেওয়ার পরের দিনই বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ঢাকার ডেমরা আসন থেকে তার প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নিলে, ঢাকার মেয়র মোহাম্মদ হানিফের নেতৃত্বে কয়েকজন নেতা জননেত্রী শেখ হাসিনাকে অনুরোধ করে বলেন, আপনি গোপালগঞ্জ আর বাগেরহাটের (টুঙ্গিপাড়া মধুমতি নদীর অপরপার) ৩টি আসন থেকে দাঁড়ালেন অথচ ঢাকার একটি আসন থেকেও নির্বাচনে দাঁড়ালেন না। ৫টি আসন থেকে তো আপনি দাঁড়ালে পারেনই। খালেদা জিয়া ৫টি আসন থেকে দাঁড়িয়েছে; আপনিও ৫টি আসন থেকে দাঁড়ান। আপনি আমাদের নেত্রী, আপনি অন্তত ঢাকার দু’টি আসন থেকে নির্বাচনে দাঁড়ান।
জবাবে বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা বললেন, গোপালগঞ্জে আর বাগেরহাটে তো ৭০% (সত্তর শতাংশ) হিন্দু আছে; ঢাকায় কত পার্সেন্ট হিন্দু আছে? হিন্দুরা ছাড়া মুসলমানরা আমাকে ভোট দেয় না। মুসলমানরা বেঈমান ও অকৃতজ্ঞ। হিন্দুরা ঈমানদার এবং কৃতজ্ঞ। আমি হিন্দুদের উপর ভরসা করতে পারি, বিশ্বাস রাখতে পারি। কিন্তু মুসলমানদের বিশ্বাস করা যায় না। ভরসা করা যায় না। এই জন্যই তো আমি সত্তর শতাংশ হিন্দুদের অঞ্চল গোপালগঞ্জ আর বাগেরহাট থেকে ৩টি (তিন) আসনে দাঁড়িয়েছি। কিন্তু ঢাকা থেকে ১টি (এক) আসনেও দাঁড়াইনি । যাও ডেমরা থেকে দাঁড়িয়েছিলাম খোঁজ খবর নিয়ে দেখলাম, ডেমরায় তেমন হিন্দু নে, তাই প্রত্যাহার করে নিয়েছি। ঢাকার মেয়র হানিফ বললেন, এটা আপনার ভুল ধারণা। মুসলমানরা ভোট না দিলে আপনার অন্যান্য প্রার্থীরা জিতে কিভাবে?
বঙ্গবন্ধু কন্যা বললেন, মূলতঃ হিন্দুদের ব্যাংক ভোটটা পুরাটা পায়, বাকী আত্মীয়-স্বজন, নিজস্ব লোকলস্কর দিয়ে গুতিয়ে গাতিয়ে কোন রকমে বেরিয়ে আসে। হিন্দুরা না থাকলে আমি, আমার দল ১টি (এক) আসনেও জিততে পারতাম না। হিন্দুরা যাতে নিরাপদে-নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারে এই জন্যই তো আমি এত আন্দোলন-সংগ্রাম করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আদায় করেছি। হিন্দুরাই আমার বল। হিন্দুরাই আমার ভরসা।
নির্বাচনী প্রচারের কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে। সারা দেশ পোস্টার, প্লে-কার্ড ফেস্টুন, ব্যানার এবং দেয়াল লিখনে ছেয়ে গেছে। কোথাও এতটুকু খালি জায়গা নেই। প্রতিদিন রাতে চলছে মিটিং আর মিছিল।
সৈন্য নামানোর নির্দেশ দিয়ে চম্পট
১৯৯৬ সালের এপ্রিল মাসের শেষ সপ্তাহে নাট্যশিল্পী লুৎফুর নাহার লতার মাধ্যমে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল নাসিম বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার কাছে সংবাদ পাঠালেন যে, ২৫ মার্চ ’৯৫ সপ্তম পার্লামেন্টে ২৪ ঘন্টারও বেশি বিরতিহীন অধিবেশনে সংবিধানে, যে সংশোধনী আনা হয়েছে তাতে রাষ্ট্রপতির হাতে সেনাবাহিনীর সকল কর্তৃত্ব দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ সংশোধিত সংবিধান অনুযায়ী সেনাবাহিনীর সকল কর্তৃত্ব বিএনপির বর্তমান রাষ্ট্রপতি আব্দুর রহমান বিশ্বাসকে দেওয়া হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান বিচারপতি মোহাম্মদ হাবিবুর রহমানের কাছে এবং সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল নাসিমের কাছে সেনাবাহিনীর কোন কর্তৃত্বই নেই। এই সংবাদ শোনার পর শেখ হাসিনা বলেন, ও এই জন্যই খালেদা জিয়া দিন-রাত পার্লামেন্টে বসে ছিল। খালেদা জিয়া ২৪ ঘন্টারও বেশি সময় ধরে সংসদ অধিবেশনে বসে থেকেই এই কুকীর্তিই করেছে। আমি তো বুঝিনি, আগে চিন্তা করিনি।
এরপর বঙ্গবন্ধু কন্যা হাসিনা উত্তেজিত হয়ে বলেন, কিসের সংবিধান? কিসের সংশোধনী? আমি যা বলব জেনারেল নাসিমকে তাই করতে হবে। জেনারেল নাসিম আমাকে কথা দিয়েছে, আমি যা বলবো, আমি যে নির্দেশ দেব নাসিম সে ভাবেই সেনাবাহিনী চালাবে। লতা (লুৎফুর নাহার লতা) তুমি যাও, সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল নাসিমকে বলো আমি যেভাবে বলবো, যা বলবো সে যেন সেভাবেই তা করে। বাকি সব দায়দায়িত্ব আমার, আমিই বুঝবো। সংবিধান অনুযায়ী সেনাবাহিনীর পুরো কর্তৃত্ব ও দায়দায়িত্ব রাষ্ট্রপতি আব্দুর রহমান বিশ্বাসের। কিন্তু সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল নাসিম বীর বিক্রম প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নির্দেশে সেনাবাহিনী পরিচালনা করতে লাগলেন। দ্বৈত নির্দেশনার কারণে ভেতরে ভেতরে সেনাবাহিনীতে সংকট সৃষ্টি হলো। রাষ্ট্রপতি রহমান বিশ্বাস সেনা কর্মকর্তাদের কোন নির্দেশ দিলে, সেনাপ্রধান জেনারেল নাসিম শেখ হাসিনার নির্দেশে তার বিপরীত নির্দেশ দিতে লাগলেন এমন কি রাষ্ট্রপতি আঃ রহমান বিশ্বাস কোন সেনা কর্মকর্তাকে বদলি নির্দেশ দিলে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নির্দেশে তার বিপরীত নির্দেশ দিতে লাগলেন। এমনকি রাষ্ট্রপতি আঃ রহমান বিশ্বাস কোন সেনা কর্মকর্তাকে বদলীর নির্দেশ দিলে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নির্দেশে জেনারেল নাসিম পাল্টা বদলীর নির্দেশ দিতে শুরু করলেন।
সেনাবাহিনীর ভেতরকার সংকট আরো ঘনীভূত হয়ে সংঘাতের দিকে যেতে লাগলো। এই পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রপতি আব্দুর রহমান বিশ্বাস ১৮ই মে ‘৯৬ বগুড়া সেনানিবাসে (ক্যান্টনমেন্টের) জি ও সি মেজর জেনারেল গোলাম হেলাল মোরশেদ খান বিবিপিএসসি এবং বি,ডিআর-এর উপ-মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার মিরণ হামিদুর রহমানকে অকালীন (বাধ্যতামূলক) অবসর দান করেন। (এই অবসর দেওয়া উর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে একজন শেখ হাসিনার চাচাতো ভাই শেখ হেলাল-এর আত্মীয়) পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ৪ জন ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তাকে অবসর দেওয়ার নির্দেশ দিলে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল নাসিম (শেখ হাসিনার নির্দেশমত) মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আব্দুল মতিন, মেজর জেনারেল সুবিদ আলী ভূঁইয়া, ব্রিগেডিয়ার আব্দুর রহিম ও কর্নেল আব্দুস সালাম এই ৪ জন ঊর্ধ্বতন সেনাকর্মকর্তাকে অবসরের নির্দেশ দেন। ফলে সংঘাত চরম আকার ধারণ করে সশস্ত্র বাহিনী চ্যালেঞ্জ-পাল্টা-চ্যালেঞ্জে চলে গেলো। সাংবিধানিকভাবে সেনাবাহিনীর পূর্ণ কর্তৃত্বের অধিকারী রাষ্ট্রপতি আব্দুর রহমান বিশ্বাস, সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল নাসিমকে অবসর দানের সিদ্ধান্ত নিলে ১৯শে মে ‘৯৬ শেখ হাসিনা জেনারেল নাসিমকে তার (নাসিমের) সমর্থনে সারা দেশ থেকে ঢাকায় সেনাবাহিনী মার্চ করানোর (নিয়ে আসার) নির্দেশ দেওয়ার জন্য তাকে জানান। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার এই নির্দেশ পাওয়ার পর সেনাবাহিনী প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল আবু সালেহ মোহাম্মদ নাসিম ১৯শে মে দিবাগত রাত ২টার পর (ঘড়ির কাঁটা অনুযায়ী ২০শে মে রাত ২টা) ঢাকার বাইরের সমস্ত সেনা ইউনিটকে তার সমর্থনে ঢাকায় মার্চ (চলে আসার) করার নির্দেশ দেন।
এর কয়েক ঘন্টা পরে ২০শে মে সকাল ৮টায় বেসরকারী বিমান এরো বেঙ্গলে করে শেখ হাসিনা সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল নাসিমকে অবহিত না করে চুপিসারে কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করেন। এদিকে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল নাসিমের নির্দেশ পেয়ে বগুড়া, রংপুর, যশোর, ময়সনসিংহ প্রভৃতি ক্যান্টনমেন্ট থেকে সেনাবাহিনী ঢাকার দিকে রওয়ানা হয়। সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল নাসিম এর নির্দেশে এবং সমর্থনে ঢাকার বাইরে থেকে আসা সৈনিকদের মূল নেতৃত্ব দেন ময়মনসিংহ ব্রিগেড কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জিল্লুর রহমান এবং বগুড়া বিগ্রেড কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার শফি মেহবুব। এই পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রপতি আব্দুর রহমান বিশ্বাস সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল নাসিমকে বরখাস্ত করে সিজিএস (চীফ অব জেনারেল স্টাফ) মেজর জেনারেল মাহবুবুর রহমানকে লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদোন্নতি দিয়ে নতুন সেনাবাহিনী প্রধান পদে নিয়োগ দেন।
কিন্তু লেফটেন্যান্ট জেনারেল আবু সালেহ মোহাম্মদ নাসিম তার বরখাস্তের আদেশ এবং নতুন সেনাবাহিনী প্রধান পদে জেনারেল মাহবুবুর রহমান-এর নিয়োগ প্রত্যাখ্যান করে নিজেকেই সেনাবাহিনী প্রধান দাবি করতে থাকেন এবং পরবর্তী নির্দেশের জন্য বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার সাথে বার বার যোগাযোগের ব্যর্থ চেষ্টা করতে থাকেন।
ওদিকে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের বর্তমান এমপি ও শেখ পরিবারের ব্যবসায়িক পার্টনার ডাঃ ইকবালের এরোবেঙ্গলে করে কক্সবাজার পৌঁছে কক্সবাজারের আপার সার্কিট (পাহাড়ের উপরে সে সার্কিট হাউস) হাউসে বসে সাগরের পানে তাকিয়ে সাগরের ঢেউ দেখছেন। আর চা খাওয়ার সাথে মাঝে মাঝে একটু করে ফেনসিডিল খাচ্ছেন।
ফেনসিডিল কাহিনী
বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা অবশ্য আগে কখনো ফেনসিডিল খেতেন না। ‘৯১ সালে নির্বাচনে হেরে যেয়ে বিরোধী নেত্রী হিসেবে ২৯ নং মিন্টু রোডের সরকারী বাসায় ওঠার পর থেকেই সর্দি-কাশি লেগেই থাকতো, ঘুম হতো না। নাক দিয়ে সব সময় পানি ঝরতো। মাথা ব্যথা করতো, টেনশনে ঘুম হতো না। বিশেষ করে বক্তৃতা দেওয়ার সময় গলা ভেঙ্গে যেতো। বক্তৃতা দেওয়ার সময় গলা বসে যাওয়া ছিল সবচেয়ে বড় অসুবিধা। ডাঃ এস এ মালেক (বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক উপদেষ্টা) অনেক হোমিওপ্যাথি ঔষধ খাইয়েছেন। ডাঃ এস এ মালেকের কাছ থেকে শত শত শিশি হোমিওপ্যাথি ঔষধ খেয়েও কোন ফল হচ্ছিল না। জননেত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ভাল হচ্ছিলেন না। ডাঃ মালেক এই সকল ঔষধের জন্য কোন পয়সা নিতেন না, যদি পয়সা নিতেন তাহলে নিশ্চিত বলা হতো পয়সা নেওয়ার জন্যই ডাঃ মালেক অযথা নেত্রীকে ঐ সব ঔষধ খাওয়াচ্ছেন। ডাঃ মালেকের হোমিওপ্যাথি ঔষধের সাথে চলতো তুলসি পাতার রস, জ্যৈষ্ঠমধু। কিন্তু কোন কিছুতেই কিছু হচ্ছিল না। অবশেষে একদিন ডাঃ এস এ মালেক এক বোতল ভারতীয় ফেনসিডিল নিয়ে এলেন এবং বঙ্গবন্ধু কন্যাকে বললেন, নেত্রী ২ চামচ করে দিনে ৩ বার এই ওষুধ খান; দেখবেন সর্দি চলে যাবে, খুশখুশি কাশ চলে যাবে, গলা ভাঙ্গবে না, মাথা ধরা চলে যাবে। রাতে ভাল ঘুম হবে। একজন বলল, হায় হায় এটা তো ফেনসিডিল, আপা, এটা খেয়ে মানুষ নেশা করে।
মালেক ভাই, এটা আপনি কি আনলেন?
ডাঃ এস এ মালেক বললেন, রাখ তোমাদের কথাবার্তা। নেত্রী, এই ঔষধ আমাদের দেশেই ছিল। আমরা কত প্রেসক্রাইব করেছি। এটা খুবই কার্যকরি এবং ভাল ওষুধ। এরশাদ আমলে শুধু শুধু এই ঔষধটা ব্যান্ড (নিষিদ্ধ) করেছে। নেত্রী আপনি খেয়ে দেখেন, যদি আপনার অসুবিধা দূর না হয়েছে, তবে আমাকে বলবেন।
এটা ‘৯২ সালের প্রথম দিকের কথা। এরপর থেকেই ২ চামচ করে দিনে ৩ বার আর যেদিন মিটিং থাকে, জনসভা থাকে, বক্তৃতা থাকে সেদিন ৫/৬ চামচ করে দিনে ৩/৪ বার এমন কি চায়ের লিকারের সাথে মিশিয়ে জনসভার মঞ্চে নিয়ে গলা ঠিক রাখার জন্য বক্তৃতার আগমুহূর্ত পর্যন্ত । লম্বা বক্তৃতা হলে বক্তৃতার মাঝেও শেখ হাসিনা ফেনসিডিল খেতে লাগলেন।
এভাবে বছর দুই/তিন নেত্রী নিয়মিত প্রতিদিন ফেনসিডিল খেলেন। পরবর্তী পর্যায়ে তিনি আর ফেনসিডিল ছাড়তে পারলেন না। যখনই তিনি ফেনসিডিল ছেড়েছেন তখনই পুরানো সেই রোগ ব্যাধি সর্দি, গলা খুশখুশি বক্তৃতার সময় গলা ভেঙ্গে যাওয়া, ঘুম না হওয়া ইত্যাদি আবার পেয়ে বসে।
তাই ডাঃ এস এ মালেক বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে নিয়মিত ফেনসিডিল দিতে থাকলেন আর নেত্রীও খেতে থাকলেন।
বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার মনোযোগ আকর্ষণ করার জন্য জিজ্ঞেস করা হলো, আপা ঢাকার খবর কি?
নেত্রী কাব্যিক সুরে বললেন, কেউ কারো নাহি ছাড়ে সমানে সমান।
তারপর বললেন, দিয়ে এসেছি লাগিয়ে যা হয় হোক। আজ নেত্রীর অনেকগুলে পথসভা আছে। পথসভা মানে রাস্তার ধারে জনসভা। নেত্রীর আজ অনেক বক্তৃতা করতে হবে। গলা গরম রাখতে হবে। গলা বসে গেলে বা ভেঙ্গে গেলে বক্তৃতা চলবে না। আবার ওদিকে ঢাকার পরিস্থিতি গরম । তাই আজ একটু বেশি ফেনসিডিল খেতে হচ্ছে। বেলা ১১টায় কক্সবাজার- এর জনসভা শুরু হলো। এর মধ্যে ঢাকার পরিস্থিতির গুরুতর অবনতি ঘটার সংবাদ এলো। রাষ্ট্রপতি আঃ রহমান বিশ্বাস এবং জেনারেল নাসিমের এই সংঘাতে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট কার নিয়ন্ত্রণে এটা বোঝা যাচ্ছে না। তবে সাভার ও গাজীপুর ক্যান্টনমেন্ট যে রাষ্ট্রপতি আঃ রহমান বিশ্বাসের পক্ষে এটা বোঝা গেল এই কারণে যে, জেনারেল নাসিমের নির্দেশে ঢাকা অভিমুখে আসা যশোর, রংপুর, বগুড়া এবং ময়নসিংহ ক্যান্টনমেন্টের সৈনিকদের প্রতিরোধ করার জন্য নবম পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল ইমামুজ্জামান-এর নির্দেশে সাভার ক্যান্টনমেন্টের সৈনিকেরা আরিচা ঘাটে অবস্থান নেয় এবং ফেরী চলাচল বন্ধ করে দেয় ও নদী পার হওয়ার অপেক্ষায় থাকা দৌলতদিয়া এবং নগরবাড়ি ঘাটের সৈনিকদের নদী পার হওয়ার চেষ্টা করলে ডুবিয়ে দেওয়া হবে বলে ওয়ারলেসের মাধ্যমে হুঁশিয়ার করে দেয়। এদিকে ময়মনসিংহ থেকে আসা সৈনিকদের রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে গাজীপুরের সৈনকরা আটকিয়ে দেয়। কুমিল্লার ময়নামতি, চিটাগাং, বান্দরবন প্রভৃতি ক্যান্টনমেন্টের অবস্থা বোঝা যায় না। শেখ হাসিনা ইতোমধ্যে ৭টি পথসভায় বক্তৃতা করেছেন। ঢাকা থেকে খবর এলো, ঢাকার রাস্তায় ট্যাঙ্ক নেমেছে। কিন্তু কার পক্ষে নেমেছে অর্থাৎ লড়াইয়ে কে জিতেছে?
জেনারেল নাসিম না রাষ্ট্রপতি আঃ রহমান বিশ্বাস? এটা কিছুতেই নিশ্চিত হওয়া গেল না। এই পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা পথসভার কর্মসূচী বাতিল করে দেন এবং কোথায় পালাবেন সেই চিন্তায় ও চেষ্টায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কেউ বলেন টেকনাফে, কেউ বলেন বান্দরবানে, কেউ বলেন চিটাগাং-এ।
আওয়ামী লীগের বান্দরবানের বর্তমান এমপি বীর বাহাদুর বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে বান্দরবানে নিয়ে যেতে থাকলে পথিমধ্যে চিটাগাং সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মহিউদ্দিন, বর্তমানে শেখ হাসিনার শ্রম মন্ত্রী মান্নান, বিমান মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন শেখ হাসিনাসহ সকলকে চিটাগাং সার্কিট হাউসে নিয়ে তোলেন। চিটাগাং সার্কিট হাউসের ভি ভি আই রুমে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা, মেয়র মহিউদ্দিন, চিটাগাং আওয়ামী লীগ সভাপতি বর্তমান শ্রম মন্ত্রী মান্নান, কেন্দ্রীয় নেত্রী এডভোকেট সাহারা খাতুন, কেন্দ্রীয় নেতা ডাঃ মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিনসহ কয়েকজন বসে টেলিভিশন দেখছেন। দেশের এই সংকট মুহূর্তে করণীয় কি সে বিষয়ে জননেত্রী শেখ হাসিনা বেমালুম নিশ্চুপ। টেলিভিশন দেখা ছাড়া এই সংকটময় মুহূর্তে আর যেন কোন কাজ নেই। শুধু ঢাকায় একটা ফোন করে শেখ হাসিনা রেহানাকে বাসা ছেড়ে অন্য জায়গায় থাকার কথা বলেই নিশ্চুপ, নির্বিকার । এডভোকেট সাহারা খাতুন জিজ্ঞেস করলো, নেত্রী আমাদের করণীয় কি?
নেত্রী উত্তরে আমতা আমতা করলেন। ঢাকা থেকে আসা নেত্রীর সফরসঙ্গী মটর সাইকেল আরোহী বললো, আমাদের এখন উচিত জেনারেল নাসিমের পক্ষে মিছিল বের করা।
এডভোকেট সাহারা খাতুন জানতে চাইলেন, কি জন্য জেনারেল নাসিমের পক্ষে মিছিল বের করা উচিত?
এ জন্য মিছিল বের করা উচিত, জেনারেল নাসিম বিএনপি রাষ্ট্রপতি আঃ রহমান বিশ্বাসের প্রতিপক্ষ মানে বিএনপির প্রতিপক্ষ।
জেনারেল নাসিমকে সেনাবাহিনী প্রধান করে রাখতে পারলে সেনাবাহিনীতে চেক এন্ড ব্যালেন্স থাকবে। আর জেনারেল নাসিমের পতন ঘটলে বিএনপির রাষ্ট্রপতি রহমান বিশ্বাসের সেনাবাহিনীর উপর একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে। ফলে আগামী ১২ জুনের নির্বাচনে এর প্রভাব পড়বে। ঠিক আছে, নাসিমের পক্ষে মিছিল বের করেন বলেই বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা বেডরুমে ঢুকে পড়লেন। চিটাগাংয়ের মেয়র মহিউদ্দিন, সভাপতি মান্নান মিছিল বের করতে অস্বীকৃতি প্রকাশ করলে তাদের মিছিল বের করার জন্য চাপাচাপি করলে তারা বলেন, এখন কোথায় লোকজন পাব, মিছিলের শ্লোগান কি হবে?
ঢাকা থেকে আগত নেত্রীর সফরসঙ্গী মটর সাইকেল আরোহী বললো, যে, কোন কিছুর বিনিময়েই মিছিল করতে হবে। নইলে ১২ই জুনের নির্বাচনে আবার ক্ষমতায় যেতে চান? জেনারেল নাসিম যদি নাও টেকে, নাসিমের যদি পতনও হয় তথাপি মিছিল বের করে প্রোটেস্ট “(প্রতিবাদ) বজায় রাখতে হবে। আপনারা মিছিল বের করেন। মিছিলে শ্লোগান দেবেন, জেনারেল নাসিম জিন্দাবাদ, আঃ রহমান বিশ্বাস নিপাত যাক। এই পর্যায়ে মহিউদ্দিন আর মান্নান বাইরে যেয়ে কয়েকজন লোকের একটা মিছিল বের করে সার্কিট হাউসের চারপাশে ঘুরলো। টেলিভিশনে রাষ্ট্রপতি আব্দুর রহমান বিশ্বাসের ভাষণ শুরু হলো। শেখ হাসিনা ভাষণ শুনে বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার কোথায়? হাবিবুর রহমান কোথায়? খালেদা জিয়া ২৪ ঘন্টা সংসদে বসে থেকে এমনভাবে সংবিধান সংশোধন করেছে যে, ক্ষমতা আসলে ওদের হাতেই রয়ে গেছে। আমরা তার কিছুই বুঝিনি।
শেখ হাসিনা আবার বেডরুমে চলে গেলেন। ঢাকা থেকে আগত সফরসঙ্গী মটর সাইকেল আরোহী ঢাকায় ফোন করে তার স্ত্রীকে বললো, তুমি যাও আওয়ামী লীগ অফিসে এবং আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীদের বাসায়। যেয়ে বল বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা নির্দেশ দিয়েছে, মিছিল বের করতে এবং মিছিলে শ্লোগান দেবে, জেনারেল নাসিম জিন্দাবাদ ! রহমান বিশ্বাস নিপাত যাক।
হঠাৎ বেডরুমের রিসিভার থেকে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা বলে উঠলেন, এ-ই-এ-ই-এই। তারপর চুপ, আর কিছুই বললেন না। অর্থাৎ নেত্রী বেডরুমের রিসিভার তুলে এতক্ষণ কথাগুলো আড়ি পেতে শুনেছিলেন। টেলিভিশনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান বিচারপতি হাবিবুর রহমানের বক্তৃতা নেত্রী শুনলেন এবং আবার বেডরুমে চলে গেলেন। বেডরুমে গিয়ে নজিব ও বাহাউদ্দিন নাসিম বঙ্গবন্ধু কন্যাকে সার্কিট হাউস ছেড়ে অন্যত্র পালিয়ে যেতে পরামর্শ দিলে তিনি বলেন, আমি কোথায় যাব? তার চেয়ে দেখ কি হয়। বলেই শেখ হাসিনা পুরো আধা বোতল ফেনসিডিল খেয়ে শুয়ে পড়লেন।
মাঝরাতে মোটামুটি নিশ্চিত হওয়া যায় যে, জেনারেল নাসিম এ লড়াইয়ে পরাজিত। সকাল বেলা জননেত্রী শেখ হাসিনা বলেন, নাসিম পরাজিত হয়েছে ভাল হয়েছে। ওকে (নাসিমকে) আমি ফেব্রুয়ারী মাসে ক্ষমতা নিতে বলেছিলাম ও তখন ডাট দেখিয়েছে। পরাজিত হয়েছে ঠিক হয়েছে।
সকাল ৯টার ফ্লাইটে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় ফিরলেন। সেনাবাহিনী প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল আবু সালেহ মোহাম্মদ নাসিম বীর বিক্রম বরখাস্ত ও গ্রেপ্তার হলেন। এরপর থেকে আর কোনদিন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা জেনারেল নাসিমের নাম বিন্দু বিসর্গও উচ্চারণ করলেন না।
আবু হেনার আগমন
১২ই জুন ১৯৯৬। নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। নর- নারী নির্বিশেষে জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে হাসতে হাসতে ভোটকেন্দ্রে গেল, হাসতে হাসতে নিজেদের ভোট দিল। আবার হাসতে হাসতেই ঘরে ফিরে এলো। সন্ধ্যার পর বাংলাদেশ টেলিভিশনে নির্বাচনী ফলাফল ঘোষণা শুরু হলো। প্রথম দিকে দেখা যায় আওয়ামী লীগ বেশ এগিয়ে রয়েছে। রাত ১০টার পর আবার দেখা যায় বিএনপি বেশ এগিয়ে রয়েছে।
প্রথম দিকের ঘোষিত নির্বাচনী ফলাফলে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাসহ উপস্থিত সকলেই বেশ পুলকিত হতে থাকেন। কিন্তু রাত দশটার পরের ঘোষিত ফলাফলে সকলেই চিন্তিত হয়ে পড়েন।
রাত প্রায় বারোটার দিকে শেখ হাসিনা তার উপর হামলা হতে পারে এই কথা বলে তার বাসায় উপস্থিত সকলকে চলে যেতে বলেন। বাইরের সকলে চলে যাওয়ার ফলে শেখ হাসিনার ধানমণ্ডি ৫৪ নম্বর বাসাটি নীরব হয়ে যায়। রাত ১টায় দিকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ আবু হেনা অন্য একজনকে সঙ্গে নিয়ে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার বাসায় আসেন এবং প্রায় এক ঘন্টা একান্ত গোপন বৈঠক শেষে চলে যান।
ঐকমত্যের সরকার
নির্বাচনের চূড়ান্ত ফলাফলে দেখা গেল অন্যান্য দলের চেয়ে আওয়ামী লীগ সবচেয়ে বেশি সিট পেয়েছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু কন্যা হিসেব করে দেখলেন বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামাত এবং জাসদ (রবের) আ স ম রব যদি একত্রিত হয়ে যায় তাহলে আওয়ামী লীগের চাইতে ১টি সিট বেশি হয়ে যায়। অর্থাৎ আওয়ামী লীগের ১টি সিট কম হয়। সে ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের পরিবর্তে বিএনপি, জাতীয় পার্টি, আর জাসদের আ স ম রব এই জোট বা সম্মিলিত দলগুলো সরকার গঠন করতে পারে এবং সংসদের সংক্ষিপ্ত ৩০টি মহিলা সিট অনায়াসে নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিতে পারে। বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা এই হিসেব-নিকেশের পর শুধু বলতে থাকেন, আবু হেনা (প্রধান নির্বাচন কমিশনার) আমার সাথে ছলনা করলো, প্রতারণা করলো । কথা রাখলো না, কথামতো কাজ করলো না।
এরপর ১৫ই জুন সন্ধ্যা বেলায় শেখ হাসিনা জাসদ নেতা এবং জাসদের একমাত্র নির্বাচিত সংসদ সদস্য আ স ম রবকে নিয়ে যে কোন প্রকারে ছলে বলে কৌশলে তার (শেখ হাসিনার) বাসায় নিয়ে আসার নির্দেশ দেন।
স্বৈরাচারী এরশাদের ‘৮৮ সালের পার্লামেন্টের গৃহপালিত বিরোধী দলীয় নেতা সম্মিলিত ওয়াচ ডক আ স ম রবকে এই সংবাদ দিলে মনে হলো তিনি এমন একটি সংবাদের জন্য চাতক পাখির ন্যায় অপেক্ষা করছিলেন। শেখ হাসিনা আমন্ত্রণ জানিয়েছেন বলার সঙ্গে সঙ্গে আ স ম রব এমপি বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার ধানমন্ডি ৫ নম্বর রোডের ৫৪ নম্বর বাড়িতে ছুটে চলে আসেন। ২য় তলার ভি ভি আই পি রুমে আ স ম রব এমপিকে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা বসতে দিলেন, মিষ্টি খাওয়ালেন। তারপর বললেন, রব ভাই, আপনারাই দেশ স্বাধীন করেছেন। বাংলাদেশ বানিয়েছেন। আপনারাই তো আমার পিতাকে শেখ মুজিবর থেকে বঙ্গবন্ধু বানিয়েছেন। সারা বিশ্বে পরিচিতি দিয়েছেন, এসবের মূলে ব্যক্তিগতভাবে আপনার অবদানই রয়েছে সব চাইতে বেশি।
আ স ম রব বলেন, আপনি তো তখন রাজনীতিতে ছিলেন না কাজেই আপনি জানেন না, আমরা কখনই বঙ্গবন্ধুর বিরোধিতা করতে চাইনি। আর আমি ব্যক্তিগতভাবে তো কখনই বঙ্গবন্ধুর বিরোধিতা করিনি। বঙ্গবন্ধুর চার পাশে যারা ছিল এবং আমার সাথের গুটিকয়েক, এরাই আমাদের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করে দিয়েছিল। আসলে বঙ্গবন্ধুই আমাদের প্রকৃত নেতা ছিলেন। আমরাই বঙ্গবন্ধুর প্রকৃত লোক ছিলাম।
বঙ্গবন্ধু কন্যা বললেন, হ্যাঁ রর ভাই, আপনারাই বঙ্গবন্ধুর প্রকৃত লোক। তাই তো আমি আপনাদের নিয়ে মন্ত্রীসভা গঠন করতে চাই। আমরা সকলে মিলে সরকার গঠন করে দেশ চালাতে চাই।
আ স ম রব বললেন, মনের দিক থেকে তো অনেক আগেই আমি আপনার (শেখ হাসিনার ) নেতৃত্বে দেশ পরিচালনার প্রস্তুতি নিয়ে আছি এবং এতোদিন তো কেবল আপনার ডাকের অপেক্ষাই ছিলাম।
বঙ্গবন্ধু কন্যা বললেন, আমাকে বিশ্বাস করুন, আমি আপনার বিশ্বাসের অমর্যাদা করবো না। আ স ম রব বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ আপনাকে বিশ্বাস করার ব্যাপারে আমার কোন ঘাটতি নেই । আপনি বঙ্গবন্ধু কন্যা; আপনাকে কি অবিশ্বাস করা যায়?
উপস্থিত নজিব আহাম্মেদ, বাহাউদ্দিন নাসিম, নকিব আহমেদ মানু, কানিজ আহাম্মেদ (এরা সবাই হাসিনার বাবার ফুফাতো ভাইদের ছেলে) রাম মোহন দাস, মৃনাল কান্তি দাস, আনাম, সেন্টুদের দিকে তাকিয়ে আ স ম রব বললেন, আমি নেত্রীর সঙ্গে একটু একা কথা বলতে চাই। বঙ্গবন্ধু কন্যা উপস্থিত সকলকে বললেন, তোমরা এখন বাইরে যাও।
সবাই বাইরে চলে আসলো। শেখ হাসিনা আর জাসদ নেতা আ স ম রব ভিতরে একান্তে কথা বলছেন। মিনিট পাঁচেক পরে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা কলম এবং ২টি কাগজ চাইলেন। ১টি কলম এবং ২টি কাগজ ভেতরে দেওয়া হলো। বাইরে থেকে বোঝা গেল বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা এবং জাসদ নেতা আ স ম রব নিজেদের মধ্যে একটি লিখিত চুক্তিনামা করলেন। মিনিট পনেরো পরে আ স ম রব চলে গেলেন। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ঘোষণা করলেন, আ স ম রবকে ম্যানেজ করা গেছে, এবার হয়তো সরকার গঠন করতে পারবো। পরের দিন সকালে রাম মোহন দাস একটি হিসেব নিয়ে এসে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে বোঝালেন যে, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামাতে ইসলামী, জাসদ রব এবং একমাত্র স্বতন্ত্র এমপি কুষ্টিয়ার মকবুল হোসেনও যদি একজোটভুক্ত হয় তাহলেও আওয়ামী লীগ-এর সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকে এবং আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করতে পারে। কারণ একাধিক আসন থেকে বিজয়ী সংসদ সদস্যদের সংবিধান অনুযায়ী শপথ নেওয়ার পূর্বে ১টি (এক) মাত্র আসন বা সিট রেখে বাকি আসন বা সিট ছেড়ে দিতে হবে এবং ছেড়ে দেওয়া সেই আসন বা সিট শূন্য ঘোষিত হবে। অর্থাৎ এক ব্যক্তি যতগুলো আসন বা সিট থেকেই বিজয়ী হোক না কেন, এক ব্যক্তিকে একজন এমপিই হতে হবে এবং একজন এমপি হিসেবেই ধরা হবে। সে দিক থেকে বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জাসদ, জামাত এবং স্বতন্ত্র জোটের আসন বা সিট ছাড়তে হবে ১১টি (এগারো), আওয়ামী লীগের ৪টি (চার)। শপথ নেওয়ার পূর্বে ছেড়ে দেওয়া আসন বাদ দিয়ে হিসেব করলে দেখা যায় আওয়ামী লীগের একারই উল্লেখিত জোটের চাইতে ১টি (এক) আসন বেশি থাকে। জননেত্রী শেখ হাসিনা এই হিসেব বোঝার পর বলে ওঠেন, ওরে হারামজাদা আগে কই ছিলি? আগে কই ছিলি? এখন সব শেষ। এখন সব শেষ। রব ভাঁওতাবাজি দিয়ে আমার কাছ থেকে লিখিত নিয়ে গেছে। এখন আর তা পাল্টানো যাবে না ৷ হারামজাদারা আগে কি করলি? এখন কি করি? রবের কাছে আমার লিখিত আছে। এই হলো বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার ঐকমত্যের সরকারের প্রকৃত উৎপত্তি এবং জাসদ নেতা আ স ম রব মন্ত্রী।
রওশন এরশাদের পা ধরা
১৯শে জুন ১৯৯৬। সন্ধ্যা ৭টায় সাবেক রাষ্ট্রপতি হোসেন মোহাম্মদ এরশাদের স্ত্রী রওশন এরশাদ বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার সাথে তার ধানমণ্ডিস্থ ৫ নম্বর বাড়িতে দেখা করলেন। ২য় তলায় ভি ভি আই পি রুমে মুখোমুখি সোফায় বসেছেন শেখ হাসিনা আর সাবেক ফার্স্টলেডি রওশন এরশাদ। দু’জনের মাঝে ৫ ফিটের মত দূরত্ব। রওশন এরশাদ বললেন, আপা (শেখ হাসিনা) আপনার কাছে আমার একটা অনুরোধ, আপনি জাতীয় পার্টি থেকে জিনাত মুশারফকে মহিলা এমপি বানাবেন না।
শেখ হাসিনা বললেন, এটা আপনাদের ব্যাপার, আপনারা যাকে দেবেন আমি তাকেই মহিলা এমপি বানাব।
রওশন এরশাদ বললেন, আপা, আপনি আমার বোন, আপনিও মহিলা, আপনারও স্বামী আছে। আপনি বোন হিসেবে আমার প্রতি দয়া করেন। সবই আপনার হাতে। আপনি দয়া করে আমার স্বামীকে আমার কাছে ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করুন। ঐ চরিত্র ভ্রষ্টা-নষ্টা জিনাত মুশাররফকে দয়া করে আপনি মহিলা এমপি বানাবেন না। প্রয়োজনে আপনি জাতীয় পার্টি থেকে একটাও মহিলা এমপি বানাবেন না।
বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা বললেন, না না আমি জাতীয় পার্টিকে দু’টি এবং জামাতকে ১টি মহিলা এমপি দেব।
রওশন এরশাদ বললেন, তাহলে আর যাই হোক, জিনাতকে এমপি করবেন না।
শেখ হাসিনা বললেন, বললাম তো এটা আপনাদের ব্যাপার।
রওশন এরশাদ সোফা থেকে উঠে সোজা শেখ হাসিনার পা জড়িয়ে বললেন, আপা, আপনি আমার বোন, আপনি দয়া করে আমাকে এই মসিবতে ফেলবেন না। আপনি দয়া করে আমার স্বামীকে উদ্ধার করুন।
শেখ হাসিনা বললেন, আরে কি করছেন, কি করছেন। ঠিক আছে, পা ছাড়ুন, পা ছাড়ুন আমি দেখব।
রওশন এরশাদ বললেন, আপা আপনি কথা দেন ৷
বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা বললেন, ঠিক আছে জিনাতকে এমপি বানাব না।
অতঃপর রওশন এরশাদ ভি ভি আই পি রুমের পশ্চিম পার্শ্বের দরজা দিয়ে বেরিয়ে সিঁড়ির ধারে যেতে না যেতেই ভি ভি আই পি রুমের উত্তর দিকের দরজা দিয়ে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা বেরিয়ে ডাইনিং রুমে এসে নাচতে লাগলেন, আর বলতে লাগলেন, কাউরে ছাড়ুম না। লাগাইয়া দিমু। কাউরে ছাড়ম না। জিনাত মুশাররফকে এমপি বানাবই।
হানিফ এল জি আর ডি মন্ত্রী
আগামী ২৩শে জুন ১৯৯৬। সন্ধ্যা ৭টায় বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি আব্দুর রহমান বিশ্বাসের কাছে বঙ্গবন্ধু কন্যা হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেবেন। সবাই খুব ব্যস্ত। যারা মন্ত্রী হবেন বলে আশা করছেন তারা সকলেই প্রচণ্ড টেনশনে আছেন। ঘনঘন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার বাসায় আসা-যাওয়া করছেন। মনে মনে ভাবছেন আমি তো মন্ত্রী হবো। আমাকে মন্ত্রী সভা থেকে বাদ দেয় কিভাবে? তবুও বলা তো যায় না, যে এক-আধজন মন্ত্রী সভা থেকে বাদ পড়বে আমার নাম আবার ঐ বাদ যাওয়া তালিকায় নেই তো? না, না এ কি করে হয় ! আমাকে মন্ত্রী না বানিয়ে পারেন না। আমি মন্ত্রীত্ব পাব। তবে কোন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাব এটা ভাববার বিষয়। ভাবী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছের লোক, বাসার লোক বিশেষ করে আত্মীয়- স্বজনদের কাছে ধর্না দেওয়া, জোর তদবির চলছে। এদের মধ্যে একজনই শুধু তদবীর করছেন না ধর্না দিচ্ছেন না। কারণ তিনিতো একেবারেই নিশ্চিত তিনি মন্ত্রী হচ্ছেনই। শুধু মন্ত্রীত্বই নিশ্চিত নয়, মন্ত্রণালয়ও নিশ্চিত এবং সেই মন্ত্রণালয়টা হলো এল জি আর ডি মন্ত্রণালয়। এই সৌভাগ্যবান ব্যক্তিটি আর কেউ নন, তিনি হচ্ছেন ঢাকার মেয়র মোহাম্মদ হানিফ। মেয়র মোহাম্মদ হানিফ এল জি আর ডি মন্ত্রী তো হয়েই আছেন, এটা তিনি একেবারেই নিশ্চিত। তার শুধু শপথ নেওয়াটা বাকি। আগামী ২৩শে জুন শপথ অনুষ্ঠানটাও হয়ে যাবে। ঢাকার মেয়র মোহাম্মদ হানিফের এল জি আর ডি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীত্বের এই নিশ্চয়তার কারণ গত ১৭ই ফেব্রুয়ারী ‘৯৬ ধানমণ্ডি ৩২ নং বঙ্গবন্ধু ভবনে বঙ্গবন্ধু কন্যা আজকের ভাবী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তো মেয়র হানিফকে এল জি আর ডি মন্ত্রী বানিয়েই রেখেছেন এবং মেয়র হানিফকে এল জি আর ডি মন্ত্রী হিসেবে অনানুষ্ঠানিক ঘোষণাও ১৭ই ফেব্রুয়ারী ‘৯৬ দিয়েছেন। কাজেই মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ‘নো চিন্তা ডু ফুর্তিতেই’ আছেন।
সবার মুখ কালো
আজ ২৩শে জুন ১৯৯৬ সাল। সন্ধ্যা ৭টায় বঙ্গভবনের দরবার কক্ষে রাষ্ট্রপতি আব্দুর রহমান বিশ্বাসের কাছে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা শপথ নেবেন।
ধানমণ্ডিস্থ ৫৪নং বাড়িতে শুধুমাত্র শেখ হাসিনার ছাড়া বাকি সবার মুখ কালো। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার পিতার ফুফাতো ভাইদের ছেলেরা নজিব আহম্মেদ নজিব, নকিব আহাম্মেদ মানু, কানিজ আহাম্মেদ এদের সবার মুখ কালো। এমন কালো যেন কালবৈশাখীর কালো মেঘ এদের মুখে ভর করেছে। এদের আরেক চাচাতো ভাই বাহাউদ্দিন নাসিম সে তো ভোর হওয়ার আগেই শেখ হাসিনার বাসা ছেড়ে চলে গেছে। বাড়ির চাকর-বাকর, পিয়ন, গাড়ির ড্রাইভার, বাবুর্চি, এমন কি যারা দীর্ঘ ১৬/১৭ বৎসর শেখ হাসিনার সাথে থাকতে থাকতে শেখ হাসিনার আত্মীয়ের মতো হয়ে গেছে, শেখ হাসিনার পরিবারের সদস্য হয়ে গেছে, তাদের চোখেও জল, তাদের মুখও ভীষণ মলিন। ভীষণ কালো। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা কিছুক্ষণ পর পর শুধু বলছেন, সবাই এমন শুরু করেছে, যেন আমি মরে যাচ্ছি! আর ঘন্টাখানেক পরেই বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেবেন। অথচ তার বাড়িতেই নেমে এসেছে ভীষণ গাঢ় শোকের ছায়া। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা বলেই যাচ্ছেন হ্যাঁ, আমি কি মরে যাচ্ছি যে, সবাই শোক শুরু করেছে?
শেখ হাসিনার আত্মীয়সহ দুই-তিনজনকে এই শোকের কারণ কি জিজ্ঞেস করলে তারা বলেন, বোঝেন না, উনি তো (শেখ হাসিনা) প্রধানমন্ত্রী হয়ে গেলেন, উনার আখের তো গুছিয়েই নিলেন। আমাদের কি হবে? এখন তো উনি আমাদের খোঁজও নেবেন না। আমরা যে এতো বৎসর এতো কষ্ট করলাম, তা মনেও রাখবে না । বলা হলো, না না প্রধানমন্ত্রী হয়ে ভুলে যাবেন কেন! মনে রাখবেন না কেন? নিশ্চয়ই মনে রাখবেন।
ওরা জবাবে বললো, এখনও বোঝেন তো, কি রকম বেঈমান, বুঝবেন।
সন্ধ্যা সাতটায় বঙ্গভবনের দরবার কক্ষে প্রবেশ করা হলো। আওয়ামী লীগের সমস্ত এমপিরা এসেছেন। বিচারপতিগণ এসেছেন। তিন বাহিনী প্রধান এসেছেন। প্রশাসনের কর্মকর্তাগণ ও গণ্যমান্য ব্যক্তিগণ সবাই এসেছেন।
নতুন পায়জামা-পাঞ্জাবি আর মুজিব কোট পরে এসেছেন ঢাকার মেয়র মোহাম্মদ হানিফ। তিনি সাধারণত মুজিব কোট পড়েন না। কিন্তু তিনি তো নিশ্চিত তিনি আজ মন্ত্রীত্বের শপথ নিচ্ছেন। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা গত ১৭ই ফেব্রুয়ারী তাঁকে (হানিফকে) মন্ত্রী বলে ঘোষণা দিয়েছেন। কাজেই তিনি আজ মুজিব কোট পরে এসেছেন। তিনি জনতার মঞ্চ তৈরী করেছেন। খালেদা জিয়া সরকারের পতন ঘটিয়েছেন। জনতার মঞ্চের নায়ক তো তিনিই। এই সমস্ত দিক দিয়ে ঢাকার মেয়র হানিফ আজকের অনুষ্ঠানের মধ্যমণি না হলেও কম গুরুত্বের না।
আমার সাথে বেঈমানী !
অনুষ্ঠানের শুরুতেই প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা শপথ নিলেন এবং বাংলাদেশের নতুন প্রধানমন্ত্রী হলেন। এবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর মন্ত্রী সভার নাম ঘোষণা করবেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্যাগ থেকে তার মন্ত্রী পরিষদের লিস্ট বের করেছেন। ঢাকার মেয়র মোহাম্মদ হানিফ আস্তে আস্তে চেয়ার থেকে উঠছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মন্ত্রী পরিষদের নাম পড়তে একটু সময় লাগছে। ঢাকার মেয়র হানিফ এমনভাবে আছেন যে, তিনি না চেয়ারে বসে আছেন, না দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি মনে করছেন, চেয়ারে বসে কি লাভ এখনই তো উঠতে হবে, মন্ত্রী পরিষদের প্রথম নামটাই তার। চেয়ার ছেড়ে দাঁড়াচ্ছেন না এ জন্য যে, দৃষ্টিকটু মনে হতে পারে। তাই তিনি আধা বসা, আধা দাঁড়ানো অবস্থায় আছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মন্ত্রী পরিষদের নাম পড়তে লাগলেন। প্রথম নামটি মেয়র হানিফের না, দ্বিতীয়টি না, তৃতীয়টি না, চতুর্থ না, পঞ্চম না, ষষ্ঠ না, সপ্তম না, অষ্টম না ….. না, না, না, না। এরপর মেয়র মোহাম্মদ হানিফ কানায় কানায় শ্রোতা-দর্শকে ভরা দরবার কক্ষের চেয়ারের দু’সারির মাঝখান দিয়ে দ্রুত বঙ্গভবন ত্যাগ করে বেরিয়ে যেতে থাকলে একজন তাকে পিছন থেকে হানিফ ভাই বলে জড়িয়ে ধরলে তিনি তাকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিয়ে, আমার সাথে বেঈমানী ! আমার সাথে বেঈমানী ! বলতে বলতে বঙ্গভবন ত্যাগ করে চলে যান।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বাসায় ফিরে রাতের খাবার খেতে খেতে বলেন, আজ আমার দু’টি আনন্দ। প্রধানমন্ত্রী হতে পারার আনন্দ আর হানিফের বেঈমানীর প্রতিশোধ নিতে পারার আনন্দ।
পরবর্তী পর্যায়ে মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ডায়াবেটিক (বারডেম-এ) হাসপাতালে ভর্তি হয়ে সাংবাদিক ডেকে বলেন, কাউকে সম্মান না করেন অপমান করতে পারেন না। তারপর দাবী করলেন মিনি গভর্নমেন্টের। এরপর মেট্রোপলিটন অথরিটির। কিন্তু না, মেয়র হানিফের কিছুই পাওয়া হলো না। মন্ত্রীত্ব না। মিনি গভর্নমেন্ট না। মেট্রোপলিটন অথরিটিও না।
বেসামাল
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার ধানমণ্ডিস্থ বাসায় ফিরে এসে তার জন্য নতুন সরকারী বাসা পছন্দ করার জন্য আত্মীয়-স্বজনদের বললেন। শুরু হলো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্য বাসা পছন্দ করা। প্রথমেই দেখা হলো রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন সুগন্ধা। তারপর দেখা হলো এরশাদ আমলে শুরু হয়ে খালেদা জিয়ার আমলে শেষ হওয়া, জাতীয় সংসদসহ বহুল আলোচিত ২০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ৩০ নম্বর হেয়ার রোডের বাসাটি। এরপর রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মা, মেঘনা এবং অবশেষে করতোয়া।
বহু চিন্তা-ভাবনা, আত্মীয়-স্বজনের সাথে অনেক আলাপ-আলোচনার পর শেরে বাংলা নগর সংসদ ভবনের পশ্চিম উত্তরে ক্রিসেন্ট লেকের পশ্চিমে বিশাল আকারের দুর্গের ন্যায় করতোয়াকে পছন্দ করা হলো। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পিতা শেখ মুজিবের আমলে তাঁর (শেখ মুজিবের) অফিস ছিল এখানে। তখন এই ভবনকে বলা হতো গণভবন। পুনরায় এই ভবনের নাম গণভবন দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাসভবন করা হলো।
৩রা জুলাই, ১৯৯৬। রাত ৯টার দিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই গণভবনে এসে উঠলেন। গণভবনে এসে তিনি সোজা ২য় তলায় চলে গেলেন। ২য় তলার শোবার রুম দেখলেন, খাবার রুম দেখলেন, বসার রুম দেখলেন, আরো ৮/১০টা রুম দেখলেন। প্রতিটি রুমেই ২৬ ইঞ্চি রঙ্গিন টেলিভিশন এবং অত্যাধুনিক আসবাবপত্রে সুচারুরূপে সাজানো। রাত বেশি হওয়ায় বিশাল প্রাসাদের বিশাল আয়তনের নীচতলার অংশটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেখতে পারলেন না। ঘুমিয়ে পড়লেন।
পরদিন ৪ঠা জুলাই, ঈদের দিনে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা যেমন খুব ভোরে উঠে গোসল টোসল সেরে নতুন জামাকাপড় পরে খুশির ঠেলায় বেড়াতে বের হয়ে যায়, ঠিক ঐ রকম ভাবেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খুব ভোরে উঠে সারসার করে গোসল টোসল সেরে নতুন শাড়ী পরে সাতটা বাজার আগেই তার (প্রধানমন্ত্রী) কার্যালয়ে চলে গেলেন। ফিরলেন দুপুর প্রায় ১টায়। গণভবনের নীচতলায় ঢুকতেই হাতের ডান দিকে অর্থাৎ নীচতলার পশ্চিম পার্শ্বের ৩ নম্বর রুমে ঢুকলেন, সঙ্গে ছিলেন চাচী, মানে শেখ হেলালের মা । এই ৩ নম্বর রুমটিতে ঢুকেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেসামাল হয়ে যেয়ে এক চিৎকার দেন, ও …রে চা…চি রে এ….ত ব…ড় টে… বি…ল বলে লাফ দিয়ে শেখ হেলাল এমপির মাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ভইরা গুষ্ঠী (সকল আত্মীয়) কে খবর দেন, এই টেবিলে খাইতে হবে।
চাচী বললেন, ভইরা গুষ্ঠী আসলেও টেবিল ভরবি নেনে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বললেন, তাইলে টুঙ্গিপাড়ার মাইনসেরে (মানুষ) খবর দেন। এই টেবিলে খাইতে হবে।
প্রধানমন্ত্রীর চিৎকারে তার নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত সেনাবাহিনীর বিশেষ দল এস এস এফ এবং পি জি আর-এর সদস্যরা এগিয়ে এলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চুপ করে যান এবং চার্চকে সঙ্গে নিয়ে উপরে চলে যান।
গণভবনের ৩নং রুমটি একটি বিশাল রুম। এই রুমে ডিম্ব আকৃতির একটি বিশাল টেবিল রয়েছে এবং এই টেবিলের চার দিকে প্রায় শ’দুই রিভলবিং চেয়ার রয়েছে। এই রুমটি খাওয়ার বা ডাইনিং রুম নয়। এটি আসলে একটি কনফারেন্স রুম।
দুই বোনের ভাগাভাগি
বর্তমানে বাংলাদেশের যিনি সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী, যার অঙ্গুলী হেলনে এদেশের বড় বড় ব্যবসা-বাণিজ্য, উচ্চ পর্যায়ের চাকরী-বাকরী নিয়ন্ত্রিত হয়, সরকারের সামরিক-বেসামরিক আমলা, মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর আত্মীয়স্বজন যে যেখানেই আছেন তাদের মধ্যে সবচাইতে শক্তিশালী ক্ষমতাধর, সামরিক সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে যে কোন পর্যায় পর্যন্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীর পদোন্নতি পদাবনতি এবং বদলী যার মনোবাসনা বা ইচ্ছানুযায়ী হয়, সরকারী পর্যায়ে ব্যবসা-বাণিজ্য না পাওয়া যার উপর নির্ভর করে, এদেশের বৈধ-অবৈধ সমস্ত টাকা-পয়সা যার হাতে জমা হয়, বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরিবারের ক্যাশিয়ার যিনি, একমাত্র রাজনীতি ছাড়া গোটা দেশের অর্থনীতি একক হস্তে পরিচালনা করেন যিনি, এদেশের মানুষের জন্য বিন্দুমাত্র ভালবাসা মায়া-মমতার লেশমাত্র নেই যার, এদেশের মানুষকে শিয়াল (শৃগাল) কুত্তার (কুকুরের) জাতি, নিমকহারামের জাত ছাড়া অন্য কিছু ভাবেন না, অন্য কিছু বলেন না যিনি, মাঝ রাতে ঘুম ভেঙ্গে গেলে অথবা রাত পোহালে যদি শুনতে পেতেন, এদেশের বারো কোটি মানুষ সকলেই মহাপ্রলয়ে নিহত হয়ে গেছে তাহলে খুশিতে আত্মহারা হয়ে যাবেন যিনি, সদাসর্বদত্র, এদেশের মানুষের অনিষ্ট-অমঙ্গল ছাড়া অন্য কিছু চিন্তা এবং কামনা করেন না যিনি, তিনি আর কেউ নন, তিনি হলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান-এর ২য় কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আদরের ছোট বোন শেখ রেহানা। ৭ই জুলাই ১৯৯৬-এর অপরাহ্নে তিনি এলেন গণভবনে। তারই বড় বোন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে। এসেই সরাসরি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে চিৎকার করে বললেন, এই, শেখ মুজিব কি একা তোমার বাপ? শেখ মুজিব কি আমার বাপ না? আমার ভাগ কই? আমি কি ভাগ পাই না? আমার ৫টা মন্ত্রী নিতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, মন্ত্রী পাবি না। চালাইতেছি, চালাইতে দে। যত টাকা দরকার, পাবি। সব তুই নে।
দুই বোনের চিৎকারের চোটে প্রধানমন্ত্রীর ২৪ ঘন্টা সার্বক্ষণিক নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত সেনাবাহিনী, বিমান বাহিনী ও নৌ-বাহিনীর ৬৪ (চৌষট্টি) জন অফিসার সমন্বয়ে ১৬শ (ষোলশ) সদস্যের একটি বিশেষ দল পিজি আর (প্রাইম মিনিস্টার গার্ড রেজিমেন্ট)-এর ঐ দিন ডিউটিরত সদস্যরা তাদের দায়িত্ব পালনে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চোখের ইশারায় তাদেরকে সরিয়ে এনে, এটা প্রধানমন্ত্রীর একান্তই নিজস্ব এবং পারিবারিক ব্যাপার বলে ওভারলুক (দৃষ্টি এড়িয়ে যাওয়া) করার পরামর্শ দেওয়া হয় । আজই যদি আমার পাঁচজনকে মন্ত্রী না করো, তবে আমি আমেরিকায় চলে যাব। যখন আসবো তখন সমান ভাগ নিয়ে আসবো। মনে রেখ। এ কথা বলে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ রেহানা চলে গেলেন।
পরবর্তী পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমেরিকায় যেয়ে চূড়ান্ত পর্যায়ে ভাগাভাগি এবং আপোষ রফা করে তার ছোট বোন শেখ রেহানাকে দেশে নিয়ে আসেন এই শর্তে যে, শেখ রেহানাই হবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্যাশিয়ার। সমস্ত টাকা-পয়সা শেখ রেহানার হাত দিয়ে আসতে হবে এবং শেখ হাসিনার পর শেখ রেহানাই হবেন শেখ মুজিবের উত্তরসূরী।
শেয়ার বাজার কেলেঙ্কারী
১৯৯৬ সালের জুলাইয়ের মাঝামাঝি সময়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছোট বোন রেহানার স্বামী শফিক সিদ্দিকী, শেখ হাসিনার লাল রঙের নিশান পেট্রোল জীপ গাড়িতে এবং হলুদ নম্বর প্লেট লাগানো দু’টি টয়োটা গাড়িতে করে ২জন শিখ, ৩জন মাড়োয়ারী ও ২জন ভারতীয় বাঙালিকে সঙ্গে নিয়ে এসে প্রতি সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারী বাসভবন গণভবনের ৫ নম্বর বৈঠকখানায় গুরুত্বপূর্ণ মিটিং করতেন। মিটিং-এ বসার আগে শফিক সিদ্দিকী মটর সাইকেল আরোহীর কাছ থেকে ঢাকার মতিঝিলের শেয়ার মার্কেটের বিষয়ে খোঁজখবর নিতেন । শফিক সিদ্দিকী প্রথমেই জানতে চাইতেন আজকে শেয়ার মার্কেটে কেমন ভীড় হয়েছিলো? মটর সাইকেল আরোহী বলতো মধুমিতা সিনেমা হলের বিপরীতে স্টক একচেঞ্জের সামনে বেশ ভীড় দেখলাম।
তখন শফিক সিদ্দিকী বলতেন শেয়ার ব্যবসা খুব ভাল ব্যবসা, শেয়ার ব্যবসা করবেন, শেয়ার কিনবেন, আত্মীয়-স্বজনদের বলবেন, বন্ধু-বান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশী সবাইকে বলবেন শেয়ার কিনতে। শেয়ার কিনলেই লাভ।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পৃষ্ঠপোষকতায় গণভবনে ৫ নং বৈঠকখানায় প্রতি সন্ধ্যায় উক্ত ব্যক্তিদের সাথে মিটিং-এর আগে মটর সাইকেল আরোহীকে শফিক সিদ্দিকীর একই প্রশ্ন, শেয়ার মার্কেটে আজকে কত লোক হয়েছে?
মটর সাইকেল আরোহীর উত্তর, অনেক লোক হয়েছে, মতিঝিলের রাস্তা ভরে গেছে। শফিক সিদ্দিকীর একই কথা, সবাইকে শেয়ার কিনতে বলবেন। শেয়ার কেনা খুবই লাভজনক ব্যবসা। কিনলেই লাভ। এভাবে দিন যেতে লাগলো, এক পর্যায়ে প্রতিদিন সরেজমিনে শেয়ার মার্কেটের প্রকৃত অবস্থা দেখে সন্ধ্যায় গণভবনে এসে তা জানানোর জন্য মটর সাইকেল আরোহীকে শফিক সিদ্দিকী দায়িত্ব দিয়ে দিলেন। মটর সাইকেল আরোহী প্রতি সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারী বাসভবন গণভবনে গিয়ে শফিক সিদ্দিকীকে শেয়ার মার্কেটের বাস্তব অবস্থা জানাতে লাগলো। আর শফিক সিদ্দিকী তা জানার পর ভারতীয় শিখ, মাড়োয়ারী এবং বাঙালি ব্যবসায়ীদের সাথে গুরুত্বপূর্ণ মিটিং করতে থাকলেন। সত্যিই, শেয়ার কিনলেই লাভ। শেয়ার বিক্রী করাটা কোন ব্যাপার না। কেনাটাই আসল ব্যাপার। আজ কোনমতে শেয়ার কিনতে পারলে আগামী কাল আসতে না আসতেই তা চড়া দামে বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। শেয়ার কেনা নিয়ে প্রায় সারা দেশেই হই হই রই রই পড়ে গেছে। বাজারে প্রচুর ক্রেতা আছে। কিন্তু শেয়ার বিক্রেতা নেই। ক্রেতারা শেয়ার কেনার জন্য রাত- দিন ঘুরে বেড়াচ্ছে । একদিন মটর সাইকেল আরোহী শফিক সিদ্দিকীর জানালো, শেয়ার মার্কেটে আজ সবচাইতে বেশি ক্রেতা এসেছে। ইত্তেফাকের মোড়, হাটখোলা, অভিসার সিনেমা হল থেকে শুরু করে পুরো মতিঝিল, শাপলা চত্বর পার হয়ে নটরডেম কলেজ ছাড়িয়ে গেছে। এই সকল এলাকায় যানবাহন বন্ধ হয়েছে। শুধু ক্রেতা আর ক্রেতা। বিক্রেতা নেই। শফিক সিদ্দিকী তার ভারতীয় ব্যবসায়ীদের নিয়ে গণভবনের ৫ নং বৈঠকখানায় নির্ধারিত মিটিং-এ বসলেন। অন্যান্য দিনের তুলনায় আজকের মিটিং অনেক বেশি সময় নিয়ে চললো। অন্যান্য দিন যেখানে মিটিং হয় দেড়-দুই ঘন্টা সেখানে আজকের মিটিং হলো প্রায় সাড়ে পাঁচ ঘন্টা। পরের দিন শেয়ার বাজারে আরো বেশি লোক হলো এবং শফিক সিদ্দিকী তার ভারতীয় ব্যবসায়ী বন্ধুদের নিয়ে দুপুর তিনটা থেকেই গণভবনে মিটিং-এ বসেছেন। রাত দশটা পর্যন্ত একটানা মিটিং চললো। মিটিংশেষে ভারতীয়রা শফিক সিদ্দিকীর সাথে এমন করে করমর্দন ও বুকে বুক মিলিয়ে বিদায় নিল, তাতে মনে হলো এ বিদায় অন্যান্য দিনের মতো বিদায় নেওয়া নয়। তার পরদিন মতিঝিলের শেয়ার বাজারে শুধু বিক্রেতাদের ধাক্কাধাক্কি আর চিৎকার শোনা গেল। কিন্তু শেয়ার ক্রেতা খুঁজে পাওয়া গেল না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারী বাসভবন গণভবনে শফিক সিদ্দিকী ও তার ভারতীয় ব্যবসায়ীদেরও দেখা গেল না।
ওরা ছয় জন মুক্তিযোদ্ধা
‘৭৫-এর ১৫ই আগস্ট শেখ মুজিবর রহমান নিহত হওয়ার পর ঐ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে মিলে যে সকল মুক্তিযোদ্ধা ২য় বার যুদ্ধ করেছিল, সেই সকল মুক্তিযোদ্ধা ১২ আগস্ট ১৯৯৬ ঢাকার পুরানা পল্টনে এক বৈঠকে বসে। সারাদিন বৈঠক চলে। বৈঠকে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসায় তাকে এবং তাঁর সরকারকে কিভাবে সহযোগিতা করা যায় এই নিয়ে দিনভর আলোচনা চলে। হালুয়াঘাট এবং নালিতবাড়ী থানার প্রখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা বৈদ্যনাথ কর তাঁর বক্তৃতায় কেন জানি খুবই আবেগ প্রবণ হয়ে বলতে লাগলো, ‘৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে যুদ্ধ করেছি। দেশ স্বাধীন করেছি। কিন্তু মরি নি। ‘৭৫-এ বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে যুদ্ধ করেছি। যুদ্ধে পরাজিত হয়েছি। কিন্তু মরি নি। অবশেষে এক বিধবা যুবতীকে বিয়ে করেছি। আমাদের ঘরে একটি পুত্র সন্তান হয়েছে। আমি এখন এক বিধবা যুবতীর স্বামী এবং এক ছেলের পিতা। আমি আর ভাল-মন্দ কোন কিছুতেই জড়িত হতে চাই না। আপনারা এমন কিছু করবেন যাতে আমার বিধাব স্ত্রী আবার ২য় বার বিধবা না হয়। আমার ছেলে পিতৃহারা এতিম না হয়।
সন্ধ্যা সাতটায় বৈঠক শেষ হলে যে যার বাড়ির দিকে রওয়ানা হয়। নালিতা বাড়ি থানা থেকে আসা বৈদ্যনাথ কর, জসিমউদ্দিন, এরা একটি মাইক্রোবাস ভাড়া করে খোদা হাফেজ বলে নালিতাবাড়ির দিকে রওয়ানা হয়ে যায়। পরদিন সকাল ৭টার (সাত) সময় আমার কাছে মুক্তিযোদ্ধা হাসেমি মাসুদ জামিল যুগোল-এর একটি ফোন আসে। ফোনে আমাকে বলা হয় বৈদ্যনাথ কর, জসিম সহ ওরা ছয় (৬) জন মুক্তিযোদ্ধা মারা গেছে।
কথাটা শুনে হার্ট এটাকের মতো হয়ে গেল। কিছুক্ষণ কোন কথা বের হলো না। গত রাতে মানে এখন থেকে ১০/১২ ঘন্টা আগে যাদের সাথে দেখা হলো, কথা হলো তারা মারা গেছে। এটা কি অসম্ভব কথা। নিজেকে একটুখানি সামলে নিয়ে বললাম, কি বলছেন? কিভাবে মারা গেল?
মুক্তিযোদ্ধা হাসেমী মাসুদ জামিল যুগোল জানালেন, গত রাতে ঢাকা পুরানো পল্টনে উলফাত ভাইয়ের অফিস থেকে মিটিং শেষে নালিতাবাড়ি যাওয়ার সময় সড়ক দুর্ঘটনায় এই ছয় জন মুক্তিযোদ্ধা নিহত হয়। অর্থাৎ আমাদের কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই এরা পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়ে নিল।
শোকে-দুঃখে মনটা বিষণ্ন ভারাক্রান্ত হলো। বাসা থেকে বেরিয়ে কাঁদতে কাঁদতে সোজা গণভবনে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে শোক সংবাদটা জানালাম। তিনি ভাবলেশহীন ভাবে শুনলেন। পরে তার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে চলে গেলেন।
মনে মনে একটা ভাবনা ছিল; প্রধানমন্ত্রী যদি তাঁর পক্ষ থেকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য কাউকে নিহত ছয়জন মুক্তিযোদ্ধার পরিবারের কাছে পাঠান। তাই দুপুরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবনে ফিরে এলে পুণরায় তাঁকে ছয়জন মুক্তিযোদ্ধা নিহত হওয়ার কথা বললাম। জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বললেন, তাতে কি হয়েছে? প্রতিদিনই তো কত লোক মারা যাচ্ছে। এর ঘন্টাখানেক পর বিকেল ৩টায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর বাবার মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু পরিষদ-এর আলোচনা সভায় যোগদানের জন্য ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে চলে গেলেন এবং সেখানে তিনি আমার পিতা, আমার মা, আমার ভাই বলে কাঁদতে লাগলেন। অন্যের পিতাকে যদি নিজের পিতার মতো মনে না হয়, অন্যের মাতাকে যদি নিজের মাতার মতো মনে না হয়, অন্যের সন্তানকে যদি নিজের সন্তানের মনে না হয়, অন্যের শোক-দুঃখকে যদি নিজের শোক-দুঃখ মনে না হয়, তাহলে, এমন রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, নেতা দিয়ে দেশের কোন লাভ হবে? মানুষের কোন লাভ হবে? নিজের বাবা-মা, ভাইদের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কান্না দেখে শুধু মনে হল, হে আল্লাহ, তুমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে কি এতোই দীনহীন করলে? এতোই কাঙ্গাল করলে? যার কেবলই নিজের ছাড়া অন্যের দুঃখে বিন্দুমাত্র অনুভূতি হবে না? হে আল্লাহ, তুমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে মানুষের জন্য মমত্ববোধের সামর্থ্য দাও। মানুষকে ভালবাসার সামর্থ্য দাও। মানুষের প্রতি অনুভূতি দাও। অপরের সুখ- দুঃখকে নিজের করে ভাববার তৌফিক দাও। আমিন।
ডঃ ডিগ্রী পাওয়া
৬ই ফেব্রুয়ারী ১৯৯৭। যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ডক্টর অফ ল ডিগ্রী প্রদান করে। এই ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদানের আগে, ’৯৬ সালের শেষ প্রান্তে, অর্থাৎ ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট জন ওয়েসলিং বাংলাদেশে এসেছিলেন। জন ওয়েসলিং ৪/৫ (চার/পাঁচ) দিন বাংলাদেশে ছিলেন। বাংলাদেশে অবস্থানকালে জন ওয়েসলিং ৩ দিন ছিলেন ঢাকায় এবং ১দিন ছিলেন গোপালগঞ্জে। ঢাকায় অবস্থানকালে জন ওয়েসলিং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারী বাসভবন গণভবনেই থাকতেন। গণভবন থেকেই জন ওয়েসলিংকে ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখান হতো। ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু যাদুঘর, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, সংসদ ভবন স্মৃতিসৌধ ইত্যাদি জায়গাসমূহ দেখান হলো এবং ঐতিহাসিক গুরুত্ব ব্যাখ্যা করে জন ওয়েসলিংকে বোঝানো হলো। একদিনের সফরে টুঙ্গিপাড়ায়ও নেওয়া হলো। টুঙ্গিপাড়ায় শেখ মুজিবর রহমান-এর মাজার দেখান হলো। গোপালগঞ্জ সার্কিট হাউসে রাত্রি যাপন করার পরদিন আবার ঢাকায় নিয়ে এসে বঙ্গবন্ধু যাদুঘরের সমস্ত ছবি এবং নিদর্শনগুলো খুবই ভালভাবে ব্যাখ্যা করে জন ওয়েসলিংকে বুঝিয়ে দেওয়া হলো। শুধু বুঝিয়েই দেওয়া হলো না একেবারে তোতা পাখির ন্যায় মুখস্ত করিয়ে দেওয়া হলো। জন ওয়েসলিংকে সমস্ত কিছু বুঝিয়ে মুখস্ত করিয়ে দেওয়ার দায়িত্বে ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত। সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত জন ওয়েসলিংকে সব কিছু বুঝিয়ে মুখস্ত করে দেওয়ার সাথে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে “ডক্টর অফ ল” প্রদানের বিষয়টিও ভাল ভাবে বুঝিয়ে দিলেন।
বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট জন ওয়েসলিং নগদ ও বাকি মিলিয়ে অনেক উপঢৌকন নিয়ে বাংলাদেশ থেকে চলে গেলেন। কিন্তু গণভবন যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারী বাসভবন এটা সেন বাবু জন ওয়েসলিংকে বলেন নি। ফলে জন ওয়েসলিং ধরে নিলেন ধানমণ্ডি ৩২শের ঐটা বঙ্গবন্ধু মিউজিয়াম (যাদুঘর)। টুঙ্গিপাড়াটা বঙ্গবন্ধুর গ্রামের বাড়ি আর বিশাল দুর্গের ন্যায় গণভবনটা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পিতা শেখ মুজিবের বাড়ি। তাই ৬ই ফেব্রুয়ারী ১৯৯৭ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে “ডক্টর অফ ল” ডিগ্রি প্রদান কালে যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট জন ওয়েসলিং যে মানপত্র পাঠ করেন, তার এক জায়গায় লিখেছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আপনাকে আপনার পিতার বিশাল দুর্গের মতো পৈত্রিক বাসভবনে বন্দী করে রাখলেও আপনার উদ্যমকে, আপনার চেতনাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। বিশাল দুর্গের মতো পৈত্রিক বাড়ি ও তার উত্তরাধিকারের মধ্যে আটকে থাকলেও ইত্যাদি ইত্যাদি।
জন ওয়েসলিং তার মানপত্রে যে বিশাল দুর্গের মতো পৈত্রিক বাড়ির উল্লেখ করেছেন সেটা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পিতার বাড়ি নয়, সেটা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারী বাসভবন গণভবন। একমাত্র গণভবনই বিশাল দুর্গের মতো। তাছাড়া শেখ মুজিবর রহমানের বিশাল দুর্গের মতো কোন বাড়ি কোথাও নেই।
প্রথম আমেরিকা সফর
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই প্রথম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সফরে যাচ্ছেন। আত্মীয়স্বজনের এক বিশাল বহর নিয়ে সন্ধ্যার আগেই গণভবন থেকে জিয়া আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রওয়ানা হয়ে গেলেন। তিনি নির্দিষ্ট সময়ে জিয়া আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের ভি ভি আই পি লাউঞ্জে পৌঁছলেন এবং আত্মীয়-স্বজনের কোলাহলপূর্ণ পরিবেশে দীর্ঘক্ষণ চা ও নানান পদের নাস্তা খেতে লাগলেন, হাসি-ঠাট্টায় মেতে থাকলেন। মন্ত্রী সভার সদস্যগণ, তিন বাহিনী প্রধানগণসহ উচ্চপদস্থ সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা এবং বিশিষ্ট নাগরিকগণ বিমান বন্দরের ভি ভি আই পি টারমাকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বিদায় দেওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন। এদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাবার ফুফাতো ভাইয়ের ছেলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এ পি এস বাহাউদ্দিন নাসিম নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করার জন্য, বিমান বন্দর কর্তৃপক্ষকে প্রধানমন্ত্রীকে বহন করার চাটার্ড বিমানটিকে প্যাসেঞ্জার টারমাকের লাউঞ্জে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিল। বাহাউদ্দিন নাসিম বললো, আমাদের প্রধানমন্ত্রী এতই অতি সাধারণ যে, তিনি ভি ভি আই পি টারমাকের পরিবর্তে সাধারণ যাত্রীদের (প্যাসেঞ্জার টারমাক (লাউঞ্জ) দিয়ে বিমানে উঠে এক নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করবেন।
কাজেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাবার ফুফাতো ভাইয়ের এ পি এস নাসিম বিমানকে প্যাসেঞ্জার টারমাকে নিয়ে যাওয়ার হুকুম দিল। যথারীতি বিমান কর্তৃপক্ষ বিমানের পাইলটকে ঐ নির্দেশ দিলে পাইলট প্যাসেঞ্জার টারমাকে বিমান নিয়ে এলো। একটু পরে এলো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাবার আরেক ফুফাতো ভাইয়ের ছেলে এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীফ সিকিউরিটি নজিব আহাম্মেদ নজিব। নাসিমের নির্দেশে প্রধানমন্ত্রীর বিমান প্যাসেঞ্জার টারমাকে নেওয়া হয়েছে এই কথা শোনামাত্র নজিব বললো, প্রধানমন্ত্রী ভি ভি আই পি টারমাক দিয়ে বিমানে উঠবে, বিমান ভি ভি আই পি টারমাকে ফেরত আনা হোক।
যথারীতি বিমানকে ভি ভি আই পি টারমাকে ফেরত আনা হলো। কিছুক্ষণ পরে প্রধানমন্ত্রীর এ পি এস বাহাউদ্দিন নাসিম এসে শুনল, তার চাচাতো ভাই নজিব বিমান ভি ভি আই পি টারমাকে ফেরত এনেছে। তখন নাসিম বিমান কর্তৃপক্ষকে বললো, আমি প্রধানমন্ত্রীর এ পি এস, আমি প্রধানমন্ত্রীর ভাবমূর্তি গড়ে তুলি, আমি প্রধানমন্ত্রীর প্রোগ্রাম তৈরী করি। আপনারা কি আমার চাইতে বেশি বোঝেন?
সমস্ত সাংবাদিকদের আমি প্যাসেঞ্জার লাউঞ্জে পাঠিয়েছি। আমি যা বলি সেভাবে কাজ করেন। প্রধানমন্ত্রীর বিমান প্যাসেঞ্জার টারমাকে পাঠান। বিমান কর্তৃপক্ষের মৌখিক নির্দেশে পাইলট আবার বিমান প্যাসেঞ্জার টারমাকে নিয়ে এলো। প্রধানমন্ত্রীর এ পি এস বাহাউদ্দিন নাসিমের চাচাতো ভাই প্রধানমন্ত্রীর চীফ সিকিউরিটি নজিব আহাম্মেদ নজিব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বিমান রেডি বলে এসে, বিমান আবার প্যাসেঞ্জার টারমাকে লাগানো হয়েছে শুনেই হারামজাদা কুত্তার বাচ্চা বলে গালাগালি দিতে দিতে কার নির্দেশে বিমান সরানো হয়েছে জিজ্ঞেস করলে নাসিম বললো, আমার নির্দেশে বিমান সরানো হয়েছে। আমি বিমান প্যাসেঞ্জার টারমাকে নিয়েছি।
নজিব বললো, তুই বিমান সরানোর কে?
আমি চীফ সিকিউরিটি, আমার নির্দেশে বিমান চলবে।
নাসিম বললো, আমার নির্দেশে বিমান চলবে।
নজিব বললো, দেখ বেশি কথা বলবি না খারাপ হইয়া যাইব।
নাসিম বললো, আমি কি তোমার মাহা তামুক খাই যে, আমাকে ডর দেহাও। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাবার দুই ফুফাতো ভাইয়ের দুই ছেলে এ পি এস বাহাউদ্দিন নাসিম এবং চীফ সিকিউরিটি নজিব আহাম্মেদ নজিবের মধ্যেকার ঝগড়ার মুখে বিমান কর্তৃপক্ষ অসহায়ের ন্যায় দাঁড়িয়ে রইল। এমনিভাবে মিনিট বিশ পঁচিশেক চলে গেল। ওদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিমানে ওঠার জন্য ভি ভি আই পি রেস্ট রুম থেকে বাইরে এসে দাঁড়িয়ে রইলেন এবং বললেন কি ব্যাপার আমাকে এখনো বিমানে তুলছে না কেন?
দুই চাচাতো ভাই নজিব-নাসিমের ঝগড়া থামানোর জন দুই চাচাতো ভাইয়ের চাইতেও অনেক অনেক বেশি ক্ষমতাধর ব্যক্তি, বলতে গেলে ক্ষমতার শীর্ষের তিন/চার (৩/৪) নম্বর ব্যক্তি, যিনি সচরাচর নজিব-নাসিমদের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করে না, কিন্তু যাকে দেখলে নজিব-নাসিম ভয়ে এবং কৌশলগত কারণে নেতিয়ে পড়ে, পাগলের মতো টাকা-পয়সার দিকে ছোটা ছাড়া আর অন্য কোন কাজ নেই যার, তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চাচাতো ভাই (শেখ নাসেরের বড় ছেলে) শেখ হেলাল এমপি এসে উপস্থিত হলো। নজিব, নাসিম ভয়ে এবং কৌশলগত কারণে নেতিয়ে গেল। শেখ হেলাল এমপি বললো, প্রধানমন্ত্রী দাঁড়িয়ে রয়েছে আর এখনো বিমানের ব্যবস্থা হয় নি? যা ভি ভি আই পিতে বিমান লাগান।
কর্তৃপক্ষ ভি ভি আই পি টারমাকে বিমান নেওয়ার মৌখিক নির্দেশ দিলে ভি ভি আই পি আর প্যাসেঞ্জার টারমাকে বার বার বিমান নেওয়া এবং আনার পরিপ্রেক্ষিতে এবার বিমানের পাইলট ভি ভি আই পি এবং প্যাসেঞ্জার টারমাকের মাঝখানে বিমান রেখে দিয়ে কর্তৃপক্ষকে বললো, আমাকে লিখিত দিতে হবে। লিখিত ছাড়া বিমানের চাকা একবারও ঘুরাবো না।
এবার বিমান কর্তৃপক্ষ আরো বিপাকে পড়লো। কর্তৃপক্ষ লিখিত দেওয়ার পর পাইলট ভি ভি আই পি টারমাকে বিমান নিয়ে গেল। প্রধানমন্ত্রী আমেরিকার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলেন। যদিও এই সমস্ত কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যাত্রা শুরু করতে ঘন্টাদেড়েক দেরী হলো এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অসন্তোষ প্রকাশ করলেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কার উপর অসন্তোষ প্রকাশ করলেন তা বোঝা গেল না।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বিদায় জানাতে আসা সকল মন্ত্রী, তিন বাহিনী প্রধান, উচ্চপদস্থ সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা ও বিশিষ্ট নাগরিকগণ যাত্রা শুরুর এই বিলম্বের সময় ভেবলার মতো দাঁড়িয়ে ছিল। পরের দিন দেশের সমস্ত পত্র-পত্রিকায় নানান ভাষায় প্রধানমন্ত্রীর যাত্রা শুরু করতে বিলম্বের সংবাদ পরিবেশন করলো। কিন্তু কেন যাত্রা বিলম্ব হলো, তা কোন পত্রিকাতেই জানা গেল না। প্রকাশ করা হলো না। শুধু বিলম্ব হলো এটাই প্রকাশ করা হলো। শুধু তাই নয়, প্রকাশিত এই সংবাদের পরিপ্রেক্ষিতে সাংবাদিক, কলাম লেখক, আবেদ খান ভোরের কাগজে “প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা কি বিঘ্নিত” শিরোনামে ধারাবাহিকভাবে সরেজমিন তদন্ত লিখলেন। আবেদ খান তার প্রতিবেদনে বিমানের অভ্যন্তরে রাজাকারের সন্ধান পাওয়াসহ আরো কত কিছু পেলেন ! কত কিছু লিখলেন ! বিমান প্রশাসনের অনেক রদবদল হলো। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যাত্রা বিলম্বের প্রকৃত কারণ আবেদ খানের কলামে এলো না।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমেরিকা সফর করে যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টর অফ ল ডিগ্রির সাথে তাঁর একমাত্র বোন শেখ রেহানাকে সকল কিছুতে (পৌত্রিক সূত্রে) অর্ধেক ভাগ দেওয়ার পাকাপাকি ব্যবস্থার শর্তে সঙ্গে নিয়ে এলেন। ভাগ-বাঁটোয়ারা নিয়ে দুই বোনের দ্বন্দ্বের অবসান ঘটিয়ে শেখ রেহানা ক্যাশিয়ারের দায়িত্ব নিয়ে বাংলাদেশে আবার ফিরে এলেন। অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত তহবিলে যা কিছু জমা হবে তার সব কিছুই শেখ রেহানা হাত দিয়ে হতে হবে। এই শর্তে শেখ রেহানা দেশে ফিরে এলেন।
যুদ্ধ বিমান ক্রয়
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্যাশিয়ার বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ রেহানা তার স্বামী শফিক সিদ্দিকীকে সঙ্গে নিয়ে এক বিকেলে প্রধানমন্ত্রীর সরকারী বাসভবন গণভবনে এসে প্রধানমন্ত্রীকে রাশিয়ার মিগ-২৯ বোমারু বিমান (যুদ্ধ বিমান) ক্রয় করার পরামর্শ দিয়ে বললেন, এই যুদ্ধ বিমান ক্রয় করলে উত্তর পাড়ার লোকেরাও (ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের সৈনিকেরা) খুশি থাকবে এবং আমরা ভারতের দালাল না এটাও জনগণ মনে করবে। উপস্থিত মটর সাইকেল আরোহী বললো, খবরদার নেত্রী (প্রধানমন্ত্রী) এই কাজও করবেন না। দেশের কোটি কোটি মানুষ বেকার, যুদ্ধ বিমান ক্রয় না করে, যে টাকা দিয়ে যুদ্ধ বিমান ক্রয় করবেন, সেই টাকা বেকারদের কর্মসংস্থান বরাদ্দ করেন।
শেখ রেহানা ও তার স্বামী শফিক সিদ্দিকী চেহারায় ভেতরে ভেতরে প্রচণ্ড রাগ হওয়ার ছাপ ফুটে উঠলো এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বললেন, বিমান তো বাকিতে কিনবো।
মটর সাইকেল আরোহী বললো, যতই বাকিতে কেনেন, এই টাকা তো এদেশকেই শোধ করতে হবে। নেত্রী (প্রধানমন্ত্রী) একটা কথা খেয়াল রাখবেন, যদি বেকারদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারেন, দেশের উন্নতি করতে পারেন, তাহলে এদেশের মানুষ শুধু আপনাকে-ই না, আপনার নাতি পুতিকেও মাথায় করে রাখবে।
বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ রেহানা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্দেশ্যে বললেন, তোমার সাথে কি একটু একাকী কথা বলা যাবে? না, তোমার লোকজন কথার মধ্যে বাঁ-হাত দিতেই থাকবে? মটর সাইকেল আরোহী বাইরে চলে এলো।
কথা হলো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার ছোট বোন শেখ রেহানা ও তার স্বামী শফিক সিদ্দিকী বাংলাদেশের মতো একটি দীনহীন দরিদ্র দেশের কর্ণধার হয়ে কেন যুদ্ধ বিমান ক্রয় করেন? ভারতের সাথে যুদ্ধ করার জন্য? মনস্তাত্ত্বিক (সাইকোলজিক্যালি) ভাবে শেখ হাসিনা- শেখ রেহানা গংয়েরা কি কখনই ভারতের সাথে যুদ্ধের কথা চিন্তা করতে পারে? নিশ্চয়ই না। শেখ পরিবার কখনই ভারতের সঙ্গে যুদ্ধের কথা চিন্তা করতে পারে না। বরং শেখ হাসিনা, শেখ রেহানারা সদা সর্বদা ভারতকে তাদের ব্যক্তিগত ও পরিবারগত অভিভাবকই মনে করেন। তারা সব সময়ই ভারতের রাজনীতিবিদদের বিশেষ করে পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতিবসুকে পিতৃতুল্যই মনে করেন। ভারতের সাথে যুদ্ধ করবেন না। তারপরও যুদ্ধ বিমান ক্রয় করেন, রহস্যটা কি?
তাহলে কি হাসিনা-রেহানা গংয়েরা জানেন না যে, বাংলাদেশ পৃথিবীর মধ্যে প্রায় সবচাইতে গরীব দেশ? এদেশের মানুষেরা দিনে আধপেট আহার জোটে না? বস্ত্র নেই, শিক্ষা নেই, বাসস্থান নেই, এসব কি তারা জানেন না? নিশ্চয়ই জানেন। তারা সবাই জানেন। আবার এটাও নিশ্চিত যে, আর যাই হোক শেখ হাসিনা-রেহানারা তাদের অভিভাবক ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য কখনই যুদ্ধ বিমান ক্রয় করবেন না। তাহলে তারা যুদ্ধ বিমান ক্রয় করেন কেন? একটা কথা মনে রাখতে হবে, দেশের প্রতিরক্ষা খাত হচ্ছে এমন একটা খাত, যে খাতের ব্যয় (ক্রয়-বিক্রয় সম্পর্কে) সম্পর্কে মহান জাতীয় সংসদেও কোন প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে না। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাজনিত কারণেই প্রতিরক্ষা ব্যয় সম্পর্কে কোথাও কোন প্রশ্ন তোলা যাবে না। শুধু আমাদের দেশেই নয়, অন্যান্য দেশেও একই নিয়ম । সেই জন্যই ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী রাজিব গান্ধীর বোফোর্স কেলেঙ্কারিতে স্পষ্ট জড়িত থাকা সত্ত্বেও ভারতের পার্লামেন্টে এই নিয়ে তেমন হৈ-হুল্লোড় হয়নি। এই প্রতিরক্ষা খাত থেকেই বর্তমান বিশ্বে সবচাইতে বেশি দুর্নীতি হচ্ছে। প্রতিরক্ষা ব্যয়ের যেহেতু কোন জবাবদিহিতা নেই, সেহেতু এই খাতেই দুর্নীতি করা বা কমিশন নেওয়া অতীব সহজ। প্রশ্ন হচ্ছে, ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হবে না, তথাপি শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা গং বর্তমানে যুদ্ধে অকার্যকর পুরনো সেকেলে রাশিয়ান মিগ-২৯ যুদ্ধ বিমান কেন ক্রয় করেন? এর উত্তর শুধু কমিশন। শুধু কমিশন পাওয়ার জন্যই এই অত্যাধুনিক যুগে অত্যাধুনিক কার্যকর জঙ্গী বিমানের পরিবর্তে, অকার্যকর সেকেলে পুরোনো ধ্বজা ভাঙ্গা বোমারু বিমান ক্রয় করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার ক্যাশিয়ার শেখ রেহানা এই রকম এক একটি ডিল-এ কম করে হলেও শত শত কোটি টাকা পেয়ে থাকেন।
কাদের সিদ্দিকী বনাম শেখ হাসিনা
দেশের মাটিতে থেকে একমাত্র যিনি কাদেরিয়া বাহিনী নামে বিশাল এক মুক্তিবাহিনী গড়ে তুলেছিলন, বৃহত্তর টাঙ্গাইল জেলা, বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলা এবং বৃহত্তর পাবনা জেলার অধিকাংশ অঞ্চল তিনি নিজের দখলে ও নিয়ন্ত্রণে রেখে সৃষ্টি করেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের মুক্ত অঞ্চল। দেশ ত্যাগ করে ভারতে না যেয়ে বৃহত্তর টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, পাবনা ইত্যাদি অঞ্চল জুড়ে গড়ে তোলা হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশ। এই স্বাধীন বাংলাদেশের হানাদার মুক্ত অঞ্চলে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী কখনোই ঢুকতে পারেনি। পাকিস্তানী খান সেনারা যখনই মুক্তাঞ্চলে প্রবেশের চেষ্টা করেছে, এখনই প্রচণ্ড মার খেয়ে ফেরত এসেছে। এই মুক্তাঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর পাশাপাশি গড়ে তোলা হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশের বেসামরিক প্রশাসন। এখানে যুদ্ধের সাথে চলতো রাজস্ব (খাজনা ট্যাক্স) আদায়। নিয়োগ দেওয়া হতো রাজকর্মচারী (চৌকিদার, দফাদার তহশিলদার, এসডিও) ও কর্মকর্তাদের। গড়ে তোলা হয়েছিল বিচার বিভাগ, সাংস্কৃতিক বিভাগ। শুধু বাংলাদেশেরই নয়, সারা বিশ্বের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এমন নজির খুঁজে পাওয়া যাবে না। মুক্তিযুদ্ধের বিশ্ব ইতিহাসে নজিরবিহীন ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন যিনি, তিনি হলেন মুক্তিযুদ্ধের কিংবদন্তির নায়ক বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম। মুক্তিযুদ্ধের সময় লোকে যাকে বাঘা সিদ্দিকী বলে জানতো। যাঁর নাম শুনলে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর জেনারেলদের পর্যন্ত আত্মারাম খাঁচা হয়ে যেতো।
১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট শেখ হাসিনার পিতা শেখ মুজিবর রহমানকে সপরিবারের হত্যা করলে একমাত্র বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকীই ঐ হত্যার প্রতিবাদ করে। শেখ মুজিব হত্যার পর কাদের সিদ্দিকী নিজেকে শেখ মুজিবের চতুর্থ পুত্র দাবী করে, ‘৭১-এর ন্যায় পুনরায় যুদ্ধ শুরু করেন। এই যুদ্ধ ছিল কাদের সিদ্দিকীর জীবনে এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে সবচাইতে বড় রাজনৈতিক ভুল। এই যুদ্ধে কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে জনগণের অংশ গ্রহণ তো দূরের কথা, সামান্যতম সমর্থনও ছিল না। ‘৭৫-এর ১৫ই আগস্ট শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডকে জনগণ সমর্থন করেছিল কিনা যদিও এটা গবেষণার বিষয়, তথাপি এটা নিশ্চিত বলা যায় ঐ হত্যাকাণ্ড জনগণ নিরবে গ্রহণ করেছিল। সে জন্যই শেখ মুজিব হত্যার প্রতিবাদে কাদের সিদ্দিকীর ২য় বার যুদ্ধ জনগণ প্রত্যাখ্যান করেছে।
শেখ মুজিব হত্যার প্রতিবাদ যুদ্ধে জনগণ শামিল তো হয়ইনি, বরং যে হাজার তিনেক যোদ্ধা কাদের সিদ্দিকীর সাথে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল, জনগণ তাদের বাংলাদেশ সরকার ও সেনাবাহিনীর কাছে ধরিয়ে দিতে চেয়েছিল । ঐ যুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছিল শেখ মুজিব হত্যা পরবর্তী বাংলাদেশ সরকার এবং বাংলাদেশের আপামর জনগণের বিরুদ্ধে।
ফলে ‘৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকী বিজয়ী হলেও, ‘৭৫-এর শেখ মুজিব হত্যার প্রতিবাদ যুদ্ধে কাদের সিদ্দিকী এবং তার বাহিনী শোচনীয়ভাবে পরাজয় বরণ করে। যুদ্ধে পরাজিত হয়ে কাদের সিদ্দিকী নির্বাসনে ভারতে চলে গেলে শেখ মুজিব কন্যা শেখ হাসিনা তাকে ধর্মের ভাই ডাকে। সেই থেকেই তাদের ধর্মের ভাই-বোনের সম্পর্ক এতোই গভীর ছিল যে, কাদের সিদ্দিকী মাংস খেতেন না বিধায় শেখ হাসিনা ইলেকট্রিক হিটার এবং মাছ কিনে কাদের সিদ্দিকী যে হোটেলে থাকতেন সেখানে গিয়ে নিজে রান্না করে কাদের সিদ্দিকীকে খাওয়াতেন। শেখ হাসিনা প্রকাশ্যেই বলতেন, একমাত্র কাদের সিদ্দিকী ছাড়া পৃথিবীতে তার আর কেউ নেই এবং কাদের সিদ্দিকীই তার পিতা শেখ মুজিবের একমাত্র উত্তরসূরী। শেখ হাসিনা বলতেন সারা জীবন কাদের সিদ্দিকীর ঝি-চাকরাণীর কাজ করেও কাদের সিদ্দিকীর ঋণ তিনি শোধ করতে পারেন না।
১৯৮১ সালের ১৭ই মে শেখ হাসিনা ভারত থেকে বাংলাদেশে ফিরে আসার প্রাক্কালে কলকাতা দমদম বিমান বন্দরে বলেন, দেশে ফিরে তাঁর একমাত্র কাজ হবে বঙ্গবন্ধুর উত্তরসূরী তাঁর ধর্মের ভাই কাদের সিদ্দিকী ও তাঁর লোকজনকে দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করা। কিন্তু দেশে ফিরে এসে শেখ হাসিনা তাঁর ধর্মের ভাই শেখ মুজিবের উত্তরসূরী কাদের সিদ্দিকীকে ফিরিয়ে আনার কার্যকর কোন ব্যবস্থা না নিলে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর সহধর্মিনী নাসরিন সিদ্দিকী “বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম স্বদেশ প্রত্যাবর্তন সংগ্রাম পরিষদ” নামে একটি নতুন সংগঠন করে অত্যন্ত যোগ্যতা ও দক্ষতার সাথে বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে ঝটিকা সফর করে কাদের সিদ্দিকীকে দেশে ফিরিয়ে আনার পক্ষে ব্যাপক জনমত সৃষ্টি করলে, শেখ হাসিনা এটাকে ভাল দৃষ্টিতে না দেখে চ্যালেঞ্জ হিসেবে মনে করেন এবং নাসরিন সিদ্দিকী ও ঐ সংগঠনকে কুদৃষ্টিতে দেখতে থাকেন। শেখ হাসিনা প্রকাশ্যে কিছু না বললেও ভেতরে ভেতরে তার সংগঠন আওয়ামী লীগকে কাদের সিদ্দিকীর ঐ সংগঠনের সাথে সম্পর্ক না রাখার এবং বিরোধিতা করার নির্দেশ দেন।
১৯৯০ সালে তীব্র গণআন্দোলনে সামরিক স্বৈরাচার জেনারেল হোসেইন মোহাম্মদ এরশাদ- এর পতন হলে, ১৬ই ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবসে শেখ মুজিবের চতুর্থ পুত্রের দাবীদার শেখ হাসিনার ধর্মের ভাই, বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম বাংলাদেশে ফিরে আসার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ও প্রস্তুতি নেন এবং যথারীতি শেখ হাসিনার সাথে টেলিফোনে কাদের সিদ্দিকী তাঁর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে আলোচনা করলে শেখ হাসিনা সরাসরি কাদের সিদ্দিকীর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের বিরোধিতা করেন । এরপরও কাদের সিদ্দিকী স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে দৃঢ় থাকলে শেখ হাসিনা তাঁর দল আওয়ামী লীগকে কাদের সিদ্দিকীর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন কর্মসূচী ভন্ডুল (সাবোটাস) করার নির্দেশ দেন।
১৬ই ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবসে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করলে জিয়া আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে লক্ষ লক্ষ মানুষ তাকে সংবর্ধনা দিলেও শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের কোন নেতা-কর্মী ঐ সংবর্ধনায় যোগদান করেননি এবং এখান থেকেই শেখ মুজিবের চতুর্থ পুত্রের দাবীদার, শেখ হাসিনার ধর্মের ভাই, কাদের সিদ্দিকীর সাথে শেখ হাসিনার প্রকাশ্য বিরোধ শুরু হয়। এরপর থেকে শেখ হাসিনা তার ধর্মের ভাই কাদের সিদ্দিকীকে এক মুহূর্তও সহ্য করতে পারতেন না। শেখ হাসিনা প্রকাশ্যেই বলতেন আমি আছি বলেই কাদের সিদ্দিকী আছে । আমি না থাকলে কাদের সিদ্দিকীও থাকবে না। কাদের সিদ্দিকীর অবস্থা হবে ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর পুত্র সঞ্জয় গান্ধীর স্ত্রী মেনকা গান্ধীর মতো। যতক্ষণ ইন্দিরা গান্ধী ছিল, মেনকা গান্ধীও ততক্ষণ ছিল। এখন ইন্দিরা গান্ধীও নাই, আর মেনকা গান্ধীও খবর নাই। আমি না থাকলে কাদের সিদ্দিকীরও ঐ অবস্থা হবে। কোন খবর থাকবে না।
আর কাদের সিদ্দিকীও মাশাআল্লাহ কখনই শেখ হাসিনাকে নেত্রী বলে মানলেন না, স্বীকার করলেন না। কাদের সিদ্দিকীর ঐ একই কথা, শেখ হাসিনা আমার বোন, আমি শেখ হাসিনার ধর্মের ভাই, আমিই শেখ মুজিবের রাজনৈতিক উত্তরসূরী। নানাবিধ কারণে বিশেষত কৌশলগত কারণেই শেখ হাসিনা কাদের সিদ্দিকীকে আওয়ামী লীগে রাখেন, আওয়ামী লীগের এমপি বানান। কাদের সিদ্দিকীও একই কারণে আওয়ামী লীগে থাকেন, আওয়ামী লীগের এমপি হন। শেখ হাসিনার ভাবনা হলো কাদের সিদ্দিকীকে আওয়ামী লীগ থেকে বের করে দিলে আওয়ামী লীগের কিছু ক্ষতি হতে পারে। তাছাড়া কাদের সিদ্দিকীও প্রকাশ্যে সরাসরি উঠে পড়ে তাঁর (শেখ হাসিনার) নেতৃত্বের বিরোধিতায় লিপ্ত হয়ে পড়বে। তার চেয়ে নিজের পৈত্রিক দল আওয়ামী লীগে রেখেই কাদের সিদ্দিকীকে পচিয়ে দিতে হবে। কাদের সিদ্দিকীকে পচিয়ে দেওয়ার লক্ষ্য নিয়েই শেখ হাসিনা কাদের সিদ্দিকীকে আওয়ামী লীগে রেখেছেন। কাদের সিদ্দিকীও আপাতত নিরবে আওয়ামী লীগে অবস্থান করার কৌশলগত অবস্থান নিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হেয় করা ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য কাদের সিদ্দিকীর বাড়ীতে পুলিশ পাঠানোর পরিকল্পনা করলে মটর সাইকেল আরোহী এর বিরোধিতা করে বলেন, সামান্যতম কৃতজ্ঞতাবোধ থাকলে আপনি এটা করতে পারেন না। ভুলে যাবেন না, আপনার পিতা-মাতা-ভাইদের মেরে যখন সিঁড়িতে লাশ ফেলে রেখেছিল, তখন সারা পৃথিবীতে একমাত্র কাদের সিদ্দিকী ছাড়া অন্য আর কেউ এর প্রতিবাদ করেনি। আর আজ আপনি প্রধানমন্ত্রী হয়ে তার বাড়িতে পুলিশ পাঠালে তা হবে চরম অকৃতজ্ঞতার কাজ। আপনি এত বড় অকৃতজ্ঞের কাজ করতে পারেন না।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বললেন, ওর (কাদের সিদ্দিকীর) ভাইরা সন্ত্রাসী। ওর ভাইদের ধরার জন্য ওর বাড়ীতে পুলিশ যাবে।
মটর সাইকেল আরোহী বললো, কাদের সিদ্দিকীর ভাই মুরাদ সিদ্দিকী ও আজাদ সিদ্দিকী সন্ত্রাসীই হোক আর যাই হোক, তারা আপনার আমলে কোন সন্ত্রাস করেনি, কোন অপরাধ করেনি।
অত্যন্ত দুর্দিনে আপনার পিতা-মাতা নিহত হয়েছিলেন, কাদের সিদ্দিকী, লতিফ সিদ্দিকী দেশের বাইরে নির্বাসনে ছিলেন, শেখ মুজিব এবং আওয়ামী লীগের নাম নেওয়ার কোন লোক ছিল না তখন নিদারুণ বৈরী পরিবেশে মুরাদ সিদ্দিকী ও আজাদ সিদ্দিকী এই দুই ভাই টাঙ্গাইলের মাটিতে শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগের নাম নেওয়ার জন্য যুবকদের সংগঠিত করতে করতে এবং শেখ মুজিব আওয়ামী লীগ বিরোধী প্রশাসনের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হতে হতে এক পর্যায়ে সন্ত্রাসীদের খাতায় নাম চলে যায় এবং বহু মামলা তাদের বিরুদ্ধে হয়। যেহেতু প্রশাসন দুর্নীতিপরায়ণ তাই কঠোর ব্যবস্থা না নিয়ে প্রশাসন এদের সাথে ভাগাভাগিতে চলে যায়। তাছাড়া আজাদ-মুরাদ এখন আর কোন ধরনের অপবাদের সাথে যুক্ত নয়। এসব কোন কিছুই আপনার অজানা নয়। আপনি সবই ভালভাবে জানেন। আপনার শাসনামলে ওরা কোন ধরনের বেআইনী কাজের সাথে জড়িত থাকলে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠিয়ে দেওয়ার কঠোর হুঁশিয়ারী দিয়ে তাদের সতর্ক করে দেন।
প্রধানমন্ত্রী বললেন, না, কাদের সিদ্দিকীর বাড়িতেই পুলিশ পাঠিয়ে ওদের ধরতে হবে। মটর সাইকেল আরোহী বললো, শুধুমাত্র হেয় করার জন্য যদি কাদের সিদ্দিকীর বাড়ীতে পুলিশ পাঠান, তাহলে পৃথিবীতে কৃতজ্ঞতা বলে কিছু থাকবে না।
রাষ্ট্রীয় কাজে তুমি বাধা দিতে পার না, ক্রুদ্ধস্বরে এই কথা বলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেডরুমে চলে গেলেন এবং ঠিকই কাদের সিদ্দিকীর বাড়ীতে পুলিশ পাঠালেন।
বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের রাষ্ট্রপতি হওয়া
২৩শে জুন ‘৯৬ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার আগে থেকেই বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা তার দলের একজনকে নতুন রাষ্ট্রপতি করা নিয়ে বেশ বিপাকে পড়ে গেলেন। দলের যে নেতাকেই তিনি রাষ্ট্রপতি হওয়ার প্রস্তাব করেন সেই নেতাই কেঁদে ফেলেন। কোন কোন নেতা আবার সভানেত্রী শেখ হাসিনার পা জড়িয়ে ধরে দেশের নতুন রাষ্ট্রপতি হওয়ার থেকে মুক্তি চান। এই অবস্থায় মতিয়ুর রহমান রেন্টু ও মিসেস মতিয়ুর রহমান রেন্টু (ময়না) সুপ্রীমকোর্টের সাবেক প্রধান বিচারপতি ১৯৯০ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে নতুন রাষ্ট্রপতি করার জন্য বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে এই বলে পরামর্শ দেয় যে, কেউ-ই যখন রাষ্ট্রপতি হতে ইচ্ছুক নন, তখন বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহম্মদকেই নতুন রাষ্ট্রপতি করেন। সাধারণ মানুষের কাছে সাহাবুদ্দীন আহমদ-এর একটা জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা আছে। তাকে রাষ্ট্রপতি করলে আপনার (শেখ হাসিনার) জনপ্রিয়তা আরো বৃদ্ধি পাবে।
বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা বলেন, না, সাহাবুদ্দীনকে রাষ্ট্রপতি করা যাবে না। কারণ আমি (শেখ হাসিনা) যখন ‘৯১ সালের নির্বাচনের পর বলেছিলাম নির্বাচনে সূক্ষ্ম কারচুপি হয়েছে, তখন সাহাবুদ্দীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রাষ্ট্রপতি হিসেবে খালেদা জিয়ার সাথে সুর মিলিয়ে বলেছিল নির্বাচন সম্পূর্ণ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছে। এটা কোন বিচারপতি হলো? এটাকে রাষ্ট্রপতি করবো না।
বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা প্রথমে জিল্লুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি হওয়ার প্রস্তাব করলেন। জিল্লুর রহমান বললেন, নেত্রী আপনি আমাকে দয়া করে আওয়ামী লীগের জেনারেল সেক্রেটারী বানিয়েছেন। এখন যদি দয়া করে আমাকে রাষ্ট্রীয় কোন এক্সিকিউটিভ (নির্বাহী) পদে না দেন তাহলে দলের সেক্রেটারী হিসেবে আমার কোন গুরুত্বই থাকে না। কোন মূল্যই থাকে না। আমাকে দয়া করে রাষ্ট্রপতি না বানিয়ে আপনার কাছাকাছি একটা মন্ত্রণালয় দেন, যাতে আমি সব সময় আপনার কাছে থাকতে পারি।
বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা এরপর প্রেসিডিয়াম সদস্য সালাউদ্দিন ইউসুফকে রাষ্ট্রপতি হওয়ার প্রস্তাব করলে সালাউদ্দিন ইউসুফ বলেন, নেত্রী আমার স্বাস্থ্য ভাল না।
বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা বলেন, বেশ তো রাষ্ট্রপতি হন। রাষ্ট্রপতির কোন কামকাজ নেই, শুধু বসে বসে সরকারী খরচে আরাম-আয়েশ করবেন।
এই কথা শুনে সালাউদ্দিন ইউসুফ সোজা বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার পা জড়িয়ে ধরে বলেন, নেত্রী আমার এলাকার জনগণের জন্য কিছু কাজ করার সুযোগ দেন।
এই সুযোগে মতিয়ুর রহমান রেন্টু ও মিসেস মতিয়ুর রহমান রেন্টু (ময়না) সাবেক রাষ্ট্রপতি ও বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে নতুন রাষ্ট্রপতি করার জন্য বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে পুনরায় চাপ দিতে থাকে। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা এরপর প্রেসিডিয়াম সদস্য বর্তমান পররাষ্ট্র মন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদকে রাষ্ট্রপতি হওয়ার প্রস্তাব করলে আব্দুস সামাদ আজাদ বলেন, নেত্রী আমাকে রহম করেন, দয়া করে আমাকে শেষ বয়সে বাতিল করবেন না। আমি বঙ্গবন্ধুর ফরেন মিনিস্টার (পররাষ্ট্রমন্ত্রী) ছিলাম। আমাকে কাজ করার সুযোগ দেন। আমি দেখিয়ে দেব বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রীদের কত যোগ্যতা ছিল।
বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা রাষ্ট্রপতি করার জন্য কাউকেই খুঁজে পাচ্ছেন না। অর্থাৎ যাকেই রাষ্ট্রপতি করতে চান তিনিই মাফ চেয়ে পালিয়ে যান। এমনি সময়ে এসে উপস্থিত হলেন ‘৯১ সালের আওয়ামী লীগের রাষ্ট্রপতি প্রার্থী বর্তমান ধানমন্ডি-মোহাম্মদপুর-এর আওয়ামী লীগ এমপি হাজী মকবুল হোসেন। হাজী মকবুল হোসেন এমপির বক্তব্য হলো, আমি ‘৯১ সালে আওয়ামী লীগের রাষ্ট্রপতি প্রার্থী ছিলাম। আপনিই (শেখ হাসিনা) আমাকে রাষ্ট্রপতি প্রার্থী করেছিলেন। এখন কেউ রাষ্ট্রপতি হতে চাচ্ছেন না, তখন আমাকেই রাষ্ট্রপতি করেন। নইলে মন্ত্রী করেন। কিছু একটা করেন।
বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিন বললেন, না, আপনাকে কিছুই করা হবে না। মনে নেই, ‘৯১-এ আমার বিরুদ্ধাচরণ করেছিলেন। আমার সম্পর্কে নানা কথা প্রকাশ করেছিলেন। আপনাকে কিছুই করা হবে না। এমপি করেছি এটাই যথেষ্ট।
এই পরিস্থিতিতে ২১শে জুন ১৯৯৬ মতিয়ুর রহমান রেন্টু ও মিসেস মতিয়ুর রহমান রেন্টু বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে বোঝালেন রাষ্ট্রপতির তো বসে বসে আরাম-আয়েশ করা আর চাঁদ দেখা ছাড়া অন্য কোন কাজ নেই। রাষ্ট্রপতির হাতে কোন নির্বাহী ক্ষমতা নেই। মন্ত্ৰী শাসিত সরকারে রাষ্ট্রপতি হলো নাচের পুতুল। যেভাবে আপনি নাচাবেন সেইভাবেই রাষ্ট্রপতিকে নাচতে হবে। এই সুযোগ আপনি হাতছাড়া করেন কেন? সাবেক রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে নতুন রাষ্ট্রপতি বানিয়ে আরেকটা বাবা কেন নেবেন না? বাবা নেওয়ার সুযোগ চলে গেলে কিন্তু আর বাবা নিতে পারবেন না।
বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা তখন বলেন, ঠিক আছে তাহলে সাহাবুদ্দিনকেই রাষ্ট্রপতি করি। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ২৩শে জুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়ে বঙ্গভবন থেকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সাবেক রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ-এর বাসায় গিয়ে তাকে নতুন রাষ্ট্রপতি হওয়ার প্রস্তাব করেন এবং রাষ্ট্রপতি আব্দুর রহমান বিশ্বাসের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর সাবেক রাষ্ট্রপতি ও বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করেন।
বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলা
‘৯৬ সালের নভেম্বর মাসের ১ম সপ্তাহের এক বিকেলে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারী বাসভবন গণভবনের নীচতলার পূর্ব দিকের ২নং ড্রয়িং রুমে প্রধানমন্ত্রী এবং তার আত্মীয়-স্বজন মিলে গল্প-গুজব করছেন। শেখ রেহানা এবং তার স্বামী শফিক সিদ্দিকী, চাচাতো বোন লুনা, মিনা এরা সবাই পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর পদে চাকরী দেওয়ার অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলা দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে শলাপরামর্শ দেয়।
অর্থাৎ ১৯৯১ সালে ক্ষমতায় এসে বেগম খালেদা জিয়া এবং তাঁর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মতিন চৌধুরী নাকি তাদের পছন্দমতো ৪৫ জনকে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীতে সাব-ইন্সপেক্টর পদে চাকরী দিয়েছে। আর এই অভিযোগে বেগম জিয়া ও মতিন চৌধুরীর বিরুদ্ধে স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতির মামলা দায়ের করতে দুর্নীতি দমন ব্যুরোকে নির্দেশ দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উল্লেখিত আত্মীয়-স্বজনেরা পীড়াপীড়ি করতে থাকলে, মতিয়ুর রহমান রেন্টু ও মিসেস মতিয়ুর রহমান রেন্টু (ময়না) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তার আত্মীয়দের বুঝিয়ে বলেন যে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াদের না খুঁচিয়ে বরং তাঁদের মাথায় হাত বুলিয়ে চেষ্টা করে দেখেন, দেশের উন্নতি করতে পারেন কিনা। যদি একবার কোন মতে দেশ গঠন করতে পারেন, তাহলে দেখবেন শুধু আপনাকেই না, আপনার নাতি পুতিকেই এদেশের মানুষ মাথায় করে রাখবে।
বিএনপি ও বেগম খালেদা জিয়াকে হোস্টাইল করে আপনি দেশ গড়তে পারবেন না। আবার আপনাকে এবং আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে কেউ দেশ গড়তে পারবে না। আপনি ও খালেদা জিয়া এই দুই শক্তির ঐক্য ছাড়া কিছুতেই দেশের মঙ্গল করা যাবে না, দেশের উন্নয়ন করা যাবে না। বিভেদ, অনৈক্য, শত্রুতা পরিত্যাগ করে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেন। বেগম জিয়া আপনার আগের প্রধানমন্ত্রী, তাকে (বেগম জিয়াকে) বড় বোন ডেকে বুকে টেনে নিয়ে দেশের উন্নয়নের চেষ্টা করুন। তাতে আপনারই লাভ হবে অনেক বেশি। মামলা করলে আপনার (প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার) ক্ষতি হবে, দেশের ক্ষতি হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বললেন, তুমি জান না, খালেদা জিয়া ছাত্রদল আর যুবদলের লোকদের পুলিশে চাকরি দিয়েছে। মতিয়ুর রহমান রেন্টু বললো, এটা আংশিক সত্য। আসল সত্য হলো টাকা দিয়ে এরা চাকরী নিয়েছে। তারপর যদি ধরে নেই চাকরী পাওয়া সকলেই ছাত্রদল, যুবদলের লোক, তবুও তো তারা এদেশেরই মানুষ। বেগম জিয়া ৪৫ জনকে চাকরী দিয়েছে, সেই পথ ধরে আপনি (শেখ হাসিনা) ছাত্রলীগ, যুবলীগের ৭,০০০ (সাত হাজার) জনকে চাকরী দেন। কিন্তু মামলা করবেন না। মামলায় কোন ফল হবে না। মামলা করলে বরং আপনি ছোট হয়ে যাবেন।
সব কাজেই তোমাদের বাধা, তোমাদের আপত্তি। এই কথা বলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উপরে তার শয়ন কক্ষে চলে গেলেন এবং প্রধানমন্ত্রীর ছোট বোন শেখ রেহানা, তাঁর স্বামী শফিক সিদ্দিকী এবং তাদের চাচী ও চাচাতো বোনেরা মতিয়ুর রহমান রেন্টু, মিসেস মতিয়ুর রহমান রেন্টুকে ভীষণ তিরস্কার করলো।
পরে ঠিকই পুলিশের এই চাকরী দেওয়াকে স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতি আখ্যায়িত করে দুর্নীতি দমন ব্যুরো ১৯৯৬ সালের ২১শে ডিসেম্বর প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ও প্রাক্তন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী আব্দুল মতিন চৌধুরী বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করে।
গঙ্গা ও পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং ট্রানজিট চুক্তি
ভারতের পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু ‘৯৬ সালের শেষের দিকে বাংলাদেশ সফরে এলেন। মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু বাংলাদেশে এসেই সরাসরি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারী বাসভবন গণভবনে চলে এলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যে কয়জন ভারতীয় অভিভাবক আছেন, পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু তাদের মধ্যে অন্যতম । শুধু অন্যতমই নয়, শেখ হাসিনা পরিবারের ভারতীয় অভিভাবকদের মধ্যে জ্যোতি বসু সবার শীর্ষে । প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা সপরিবারে যখন ভারতে ছিলেন তখন ভারতীয় মুরব্বী বা অভিভাবকদের মধ্যে জ্যোতি বসুর সান্নিধ্য ও স্নেহ পেয়েছেন সবচাইতে বেশী। জ্যোতি বসু পিতৃতুল্য স্নেহ-মমতা ও সান্নিধ্য দিয়ে গড়ে তুলেছেন শেখ হাসিনা ও রেহানাকে। ১৯৮১ সালের ১৭ই মে বাংলাদেশে ফিরে আসার পর শেখ হাসিনা যত বার ভারতে গিয়েছেন (প্রতি বছর ৩/৪ বার তো যেতেনই), মূলত মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর সাথে শলাপরামর্শের জন্যই গিয়েছেন। জ্যোতি বসুদের বহু সাধনার ফসল আজ শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। ভারতের পশ্চিম বাংলা রাজ্যের সেই মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু আজ এসেছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাসভবন গণভবনে। গণভবনে ঢুকতেই আগে থেকে প্রস্তুত হয়ে থাকা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দৌড়ে এসে জ্যোতি বসুর পায়ে পড়ে পদধূলী নিলেন। দীর্ঘদিন পর পিতা ঘরে এলে নাবালিকা কন্যা যে ভাবে ছুটে এসে পিতার পায়ে পড়ে, ঠিক সেভাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জ্যোতি বাবুর পায়ে পড়লেন। অতঃপর দোতলার খাস কামরায় নিয়ে বসালেন এবং আগে থেকে তৈরী করে রাখা নানা ধরনের খাবার, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই পরিবেশন করে জ্যোতি কাকাকে খাওয়াতে লাগলেন। জ্যোতি কাকা খেতে খেতে পারিবারিক, রাজনৈতিক এবং ভারত-বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক বিষয়ে কথা বলতে থাকলেন।
এক পর্যায়ে জ্যোতি বসু বললেন, দেখ মা, গঙ্গার জলটল কিছু পাবে ‘না। আমিই পাই না, আর তুমি কিভাবে পাবে? আমি প্রধানমন্ত্রী দেবগৌড়-এর সাথে আলোচনা করে রেখেছি, তুমি গঙ্গা চুক্তি করে ফেল। তাতে করে তুমি জল না পেলেও, তোমার বিরোধীরা গঙ্গার জল, গঙ্গার জল বলে রাজনৈতিক ইস্যু আর তৈরী করতে পারবে না। এই সুবিধাটা তুমি পেয়ে যাবে। ২০/৩০ (বিশ ত্রিশ) বৎসরের একটা চুক্তি করে দেব। তুমি আবার প্রথমেই ২০/৩০ বছর-এর কথা বলতে যেয়ো না। তুমি বলবে ৫ (পাঁচ) বছর মেয়াদের গঙ্গাচুক্তি করতে যাচ্ছ। তোমার বিরোধীরা এই ৫ (পাঁচ) বছর মেয়াদ নিয়ে চিল্লা ফিল্লা করতে থাকবে, পরে আমি ২০/৩০ (বিশ/ত্রিশ) বছর মেয়াদ-এর চুক্তি করে দেব। কেন্দ্রীয় প্রধানমন্ত্রী ও জলমন্ত্রীর সাথে আমার এই রকমই কথা হয়েছে। তুমি এভাবেই কাজ চালিয়ে যাও। আর একটা কথা মা, পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয়দের সাথে তুমি সহসা একটা চুক্তি করে ফেলবে। ওদের রেভিনিউ (খাজনা-টেক্স) ওদের থাকবে, ওদের কর্মচারী ওদের থাকবে। ওখানে কখনো কিছু তুমি (সরকার) করতে চাইলে উপজাতীয়দের অনুমতি নিয়ে করবে। এটা আমি কেন্দ্রীয় প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রতিরক্ষামন্ত্রী এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় নেতাদের কথা দিয়েছি। যথাশীঘ্র সম্ভব তুমি পার্বত্য উপজাতীয়দের সাথে এই চুক্তি সম্পাদন করবে। এই চুক্তির নাম দেবে শান্তি চুক্তি। এতে তোমারও লাভ হবে। তুমি প্রচার করবে দীর্ঘদিনের যুদ্ধ লড়াই আর অশান্তি দূর করে শান্তি চুক্তি করেছ। সারা দুনিয়ায় তোমার পক্ষে শান্তি শান্তি রব উঠবে। তোমার বাবা চলবে। বলা যায় না তুমি নোবেল পুরষ্কারও পেয়ে যেতে পার।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সুবোধ বালিকার মতো শুধু জ্বি কাকা, জ্বি কাকা, বলতে লাগলো। জ্যোতি কাকা বললেন, আর একটা লাভ তোমার হবে। বলতো কি লাভ? ওরা খুশি হবে।
ওরা খুশি হলে কি হবে? পার্বত্য চট্টগ্রামের পার্লামেন্টের তিন (৩) টি আসনই স্থায়ীভাবে তুমি পাবে। যেমন গোপালগঞ্জের তিন (৩) আসন পাও।
আর ভারতকে করিডোর দেওয়া ট্রানজিট দেওয়া নৌবন্দর (পোর্ট) দেওয়া এসব তো তোমার পিতার সাথেই আমাদের পাকা কথা হয়েছিল। তুমি এখন তোমার সুবিধাজনক সময়ে আমাদের (ভারতকে) এগুলো দিয়ে দাও। বেশি দেরি কর না কিন্তু। বেশি দেরি করলে আবার দিল্লির দিকে ভুল বোঝাবুঝি হতে পারে বুঝলে?
পশ্চিম বাংলা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বাবু কাজ শেষে চলে গেলেন। তারপর ভারতের প্রধানমন্ত্রী দেব গৌড় বাংলাদেশ সফর করে গেলেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিল্লি সফরে গেলেন এবং পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি কাকার সাজানো ৩০ বছর মেয়াদের পানিবিহীন গঙ্গাচুক্তি করে এলেন। এরপরই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার ফুফাতো ভাই মহান জাতীয় সংসদের বকলম চীফ হুইপ মাতাল আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহকে প্রধান করে, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক কমিটি করলেন এবং জ্যোতিবাবুর নীল নক্সা অনুযায়ী রাজস্ববিহীন, রাজকর্মচারী বিহীন এবং রাজকর্তৃত্ব বিহীন পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি করলেন। এই শান্তি চুক্তি অনুযায়ী।
(১) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের কোন খাজনা-ট্যাক্স পাবে না এবং অঞ্চলের যাবতীয় খাজনা ট্যাক্স উপজাতীয়রাই সংগ্রহ করবে ও খরচ করবে।
(২) পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থানীয় কোন কর্মচারী গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের কর্মচারী হবে না। উপজাতীয়রাই উপজাতীয়দের মধ্যে থেকে ঐ সকল কর্মচারীদের নিয়োগ দেবে, পদোন্নতি দেবে এবং বরখাস্ত করবে।
(৩) পার্বত্য চট্টগ্রামের জলাশয়, ভূমি, বন ইত্যাদি যা কিছু আছে উপজাতীয়রা যদি অনুমতি না দেয় তাহলে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার অধিগ্রহণ বা কোয়ার করতে পারবে না।
ডঃ মহিউদ্দিন মন্ত্রী
১৯৯৬ সালের রমজান মাস। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারী বাসভবন গণভবনে দেশের মান্যবর ব্যক্তি, সরকারী কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদ, বিদেশী দূতাবাসের লোকজনের ইফতার পার্টি। গণভবনের ভেতরের বিশাল মাঠে বিশাল প্যান্ডেল, বিশাল আয়োজন। অধিকাংশ অতিথি এসে গেছেন। এমন সময় ডঃ কামাল হোসেন তার দুই-তিনজন সাথী নিয়ে পশ্চিম দিক থেকে প্যান্ডেলের দিকে এগিয়ে আসছেন। প্যান্ডেলের পূর্ব দিকের শেষ প্রান্তে বসে থাকা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এটা দেখামাত্র চিৎকার করে ডঃ কামাল হোসেনের দিকে হাত উঠিয়ে বলে উঠলেন, ঐ যে, ঐ যে, ঘর ভাঙ্গা আসছে, ঘর ভাঙ্গা আসছে। এই, এই ঘর ভাঙ্গাকে দূরে বসা। ঘর ভাঙ্গা যেন আমার কাছে না আসতে পারে। ঘর ভাঙ্গাকে দূরে বসা।
এপিএস বাহাউদ্দিন নাসিম ডঃ কামাল হোসেনকে প্যান্ডেলের পশ্চিম পার্শ্বের এক কোণে একটা টেবিলে নিয়ে বসালেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘুরে ঘুরে ইফতার পার্টিতে আগত অতিথিদের খোঁজ খবর নিচ্ছেন, সৌজন্য বিনিময় করছেন। কিন্তু ডঃ কামাল হোসেনের দিকে গেলেন না। প্যান্ডেলের এক টেবিলে অন্যান্য স্টাফদের সাথে মাথা নিচু করে বসে আছেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ডঃ মহিউদ্দিন খান আলমগীর। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন এ দিকে এলেন ডঃ মহিউদ্দিন খান আলমগীর খাওয়া ছেড়ে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লেন এবং এমনভাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সালাম দিলেন যে, এটা সালাম না পায়ে হাত দিয়ে কদমবুচি একেবারে ধারে কাছের লোকজন ছাড়া অন্য কেউ তা বুঝতেই পারলো না।
ইফতার পার্টির অনুষ্ঠানের শেষে গণভবনের নীচ তলার ৫ (পাঁচ) নম্বর ড্রইংরুমে বসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইফতার পার্টিতে আসা তার কয়েকজন আত্মীয়ের সাথে আলাপ করতে যেয়ে বললেন, ডঃ মহিউদ্দিন খান আলমগীরকে মন্ত্রী বানাতে হবে। মটর সাইকেল আরোহী বললো, মহিউদ্দিন খান আলমগীরকে মন্ত্রী বানাবেন কিজন্য?
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বললেন, আমার ক্ষমতায় আসার পেছনে মহিউদ্দিন খান আলমগীরের অনেক অবদান রয়েছে।
মটর সাইকেল আরোহী বললো, ডঃ মহিউদ্দিন খান আলমগীর রাজদ্রোহী। মাত্র কিছুদিন আগে সরকারের একজন কর্মকর্তা হয়েও মহিউদ্দিন খান আলমগীর সরকারের সাথে বিদ্রোহ করেছে। তাঁকে মন্ত্রী করলে তা সরকারের সাথে বিদ্রোহের পুরস্কার হিসেবে পরিগণিত হবে এবং এটা সরকারের সাথে বিদ্রোহের পুরস্কারের উদাহরণ হয়ে থাকবে। আপনার সরকারের অনেক সরকারী কর্মকর্তা আছে যারা আপনাকে পছন্দ করে না। সরকারের সাথে বিদ্রোহের পুরস্কারের এই উদাহরণ হয়ে থাকলে, সুযোগ পেলে তারাও আপনার সরকারের সাথে বিদ্রোহ করবে। মহিউদ্দিন খান আলমগীরকে মন্ত্রী করার আগে এই বিষয়টা খেয়ালে রাখতে হবে। আপনি যদি সত্যিই মনে করেন আপনার ক্ষমতায় আসার পিছনে মহিউদ্দিন খান আলমগীরের অবদান আছে এবং আপনি তাঁকে পুরস্কৃত করবেন, তাহলে আগে তাকে চাকরী থেকে অবসর দিয়ে আপনার উপদেষ্টা করেন। সরাসরি মন্ত্রী না করে মন্ত্রীর মর্যাদা দেন। আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম মেম্বার করেন। পরের টার্মে মন্ত্রী করেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বললেন, আচ্ছা রেন্টু, তুমি কি আমার সরকারী কাজে-কর্মে বাধা দিতেই থাকবা? না আমাকে কাজ করতে দিবা?
না, নেত্রী আমি আপনাকে বাধা দিতে যাবো কেন?
তাহলে তুমি এতো কথা বলছো কেন?
আপনি বললেন তাই বললাম।
এখানে তো আরো অনেকেই আছে, কই কেউ তো তোমার মতো বাধা দিচ্ছে না? তুমি এত কথা বলছ কেন?
অগে থেকেই বলে এসেছি, পুরানো অভ্যাস তাই বলি।
আগে বলছো, তখন আমি শেখ হাসিনা ছিলাম। এখন আমি প্রধানমন্ত্রী।
যতদিন আমি আপনার সাথে আছি, ভালো-মন্দ বলে যাব, শোনা না শোনা, করা না করা আপনার ব্যাপার।
এখনো প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতা তো দেখ নাই। দেখবা। এই কথা বলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দোতলায় চলে গেলেন। সরকারদ্রোহী ডঃ মহিউদ্দিন খান আলমগীর মন্ত্রী হলেন।
অবাঞ্ছিত ঘোষণা
মতিয়ুর রহমান রেন্টু ও মিসেস মতিয়ুর রহমান রেন্টু (ময়না) অবাঞ্ছিত হলো । প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মতিয়ুর রহমান রেন্টু ও মিসেস মতিয়ুর রহমান রেন্টু (ময়না) কে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে পুলিশ, এসবি, এনএসআই, ডিএফআই, সিআইডি, ডিবিসহ রাষ্ট্রের যত আইন প্রয়োগকারী সংস্থা আছে সকল সংস্থার কাছে নির্দেশ পাঠালেন। নির্দেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বললেন, এই অবাঞ্ছিতরা প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এবং প্রধানমন্ত্রী সকল অনুষ্ঠানে যোগদান করবেন সেই সকল অনুষ্ঠানে যোগদান করতে পারবে না। এরা যাতে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন, কার্যালয় এবং
অনুষ্ঠানে যোগদান করতে না পারে সে দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখার নির্দেশ দেওয়া হলো এবং এই অবাঞ্ছিত ঘোষণাপত্র পত্রিকায়ও প্রকাশ করা হলো।
“আমার ফাঁসি চাই” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ