পদত্যাগ নাটক

হঠাৎ জননেত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা সাংবাদিকদের কাছে ঘোষণা করলেন তিনি (শেখ হাসিনা) আওয়ামী লীগের সভানেত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন । সংশ্লিষ্ট সকল মহলে এই পদত্যাগের ঘটনা আলোড়ন সৃষ্টি করলো। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতারা তো হতবাক ! হতবাক কেন্দ্রীয় অফিস নির্বাহীরা। বলা নেই, কওয়া নেই, দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা করলেন, তিনি পদত্যাগ করেছেন। কিন্তু তিনি (শেখ হাসিনা) পদত্যাগ করলেন কার কাছে? কোথায় তার (শেখ হাসিনা) পদত্যাগপত্র? দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে কোন কেন্দ্রীয় নির্বাহীর কাছে সভানেত্রীর পদত্যাগপত্র নেই। কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির মিটিং-এ ও তিনি পদত্যাগ করলেন না। তাহলে তিনি পদত্যাগ করলেন কোথায় এবং কার কাছে? তিনি পদত্যাগ করেছেন বলে সাংবাদিকদের কাছে ঘোষণাই বা করলেন কিভাবে? সভানেত্রী শেখ হাসিনার এই পদত্যাগের বিষয় নিয়ে দলের ভেতরে ও বাইরে চলছে জল্পনা-কল্পনা। কেউ বলছেন না তিনি (শেখ হাসিনা) পদত্যাগ করেননি। কেউ বলছেন, না তিনি (শেখ হাসিনা) স্বয়ং পদত্যাগ করেছেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন।

এদিকে বঙ্গবন্ধু কন্যা সভানেত্রী শেখ হাসিনা তার পদত্যাগ প্রত্যাহার করার দাবীতে ছাত্রলীগ ও যুবলীগ কর্মীদের ব্যাপক মিছিল-মিটিং এবং আমরণ অনশন করার নির্দেশ দেন। কিন্তু জননেত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা সভানেত্রী শেখ হাসিনার এই নির্দেশে যুবলীগ-ছাত্রলীগের কর্মীরা তেমন সাড়া না দিলে এবং পত্র-পত্রিকা পদত্যাগ নাটক নিয়ে হই চই শুরু করলে, দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনা দলের সাধারণ সম্পাদিকা সাজেদা চৌধুরীকে (বর্তমানে শেখ হাসিনার মন্ত্রীসভার বন ও পরিবেশ মন্ত্রী) সভানেত্রীর পদত্যাগপত্র ছিঁড়ে ফেলেছেন বলে ঘোষণা দেওয়ার জন্য যারপরানই অনুরোধ করেন। এই অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে সাজেদা চৌধুরী সভানেত্রী শেখ হাসিনা তার (সাজেদা চৌধুরী) কাছে পদত্যাগপত্র দিলে তিনি তা ছিঁড়ে ফেলেছেন বলে ঘোষণা দেন এবং পদত্যাগ নাটকের অবসান ঘটান।

মটর সাইকেল আরোহী পুনরায় ফিরে এলে জননেত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা বিরোধী দলীয় নেত্রী সাদর সম্ভাষণ জানিয়ে তার (শেখ হাসিনার) ব্যক্তিগত পরামর্শকের দায়িত্ব ও মর্যাদা পুনরায় ফিরিয়ে দেন। মটর সাইকেল আরোহী জননেত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাকে সদ্য সমাপ্ত নির্বাচন সম্পর্কে এবং নতুন সরকার সম্পর্কে আর কোন কঠোর উক্তি না করে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করার পরামর্শ দেন।

 

টাকার বিনিময়ে রাষ্ট্রপতি প্রার্থী

রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের স্থলে নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সময় বিরোধী দলীয় নেত্রী জননেত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা হাজী মকবুল হোসেন (বর্তমানে আওয়ামী লীগের ধানমণ্ডি-মোহাম্মদপুর থানার এম পি এবং মোহাম্মদপুর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি) কে তিরিশ (৩০) লক্ষ টাকার বিনিময়ে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রপ্রতি পদপ্রার্থী করেন। অন্যদিকে এরশাদ এবং তার দল জাতীয় পার্টি সমর্থন নিয়ে সুপ্রীমকোর্টের সাবেক প্রধান বিচারপতি বদরুল হায়দার চৌধুরী রাষ্ট্রপতি প্রার্থী হন। বিরোধী দলীয় নেত্রী জননেত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা হাজী মকবুলকে রাষ্ট্রপতি প্রার্থী করে রাখলে তার (শেখ হাসিনার) এবং তার দল আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে; ঐতিহ্য নষ্ট হবে ইত্যাদি বুঝিয়ে সাবেক প্রধান বিচারপতি বদরুল হায়দার চৌধুরীকে সম্মিলিত বিরোধী দলীয় প্রার্থী করার পরামর্শ দিলে এক পর্যায়ে তিনি (শেখ হাসিনা) রাজি হন এবং বিচারপতি বদরুল হায়দার চৌধুরীকে ধানমণ্ডি বত্রিশ নম্বর বঙ্গবন্ধু ভবনে ডেকে এনে আলাপ-আলোচনা শেষে, জননেত্রী বিরোধী দলীয় নেত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা বিচারপতি বদরুল হায়দার চৌধুরীকে জামাতে ইসলামী বাংলাদেশ আমীর যুদ্ধাপরাধী ‘৭১-এর ঘাতক অধ্যাপক গোলাম আযমের সঙ্গে দেখা করে দোয়া নিয়ে আসার জন্য বলেন।

এদিকে হাজী মকবুল হোসেনকে রাষ্ট্রপতি প্রার্থিতা প্রত্যাহার করার জন্য বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা নির্দেশ দিলেও হাজী মকবুল প্রার্থিতা প্রত্যাহার করতে গড়িমসি শুরু করে। এক পর্যায়ে হাজী মকবুল হোসেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে দেওয়া তার তিরিশ লক্ষ টাকা ফেরত না পেলে রাষ্ট্রপতি প্রার্থিতা প্রত্যাহার করতে অস্বীকৃতি জানায়।

তখন জননেত্রী বিরোধী দলীয় নেত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ধানমণ্ডি বত্রিশ নম্বরে বঙ্গবন্ধু ভবনে লোক দিয়ে হাজী মকবুল হোসেনকে ডেকে (প্রায় ধরে এনে) এনে প্রথমে ধমকে জিজ্ঞেস করেন তার (মকবুল) মতো লোকের পক্ষে আওয়ামী লীগের রাষ্ট্রপতি প্রার্থী হওয়া সাজে কি না? তারপর বলেন, আমি (শেখ হাসিনা) আপনার মতো লোককে আওয়ামী লীগের রাষ্ট্রপতি প্রার্থী করে বিরল সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী করেছি। এটা কি আপনার জন্য যথেষ্ট নয়? তাছাড়া নির্বাচনে তো জিতবেন না। রাষ্ট্রপতি তো হতেই পারবেন না। এখন সম্মানের সাথে চুপচাপে বসে পড়েন।

হাজী মকবুল আমতা আমতা করতে থাকলো বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা বলেন, আপনি যা করেছেন, যা দিয়েছেন ভবিষ্যতে আমি তা মনে রাখবো এবং পুষিয়ে দেব। এই নিয়ে আর উচ্চবাচ্য করে ভবিষ্যত খোয়াবেন না। নিঃশব্দে পদত্যাগ করে আমার প্রতি আনুগত্য দেখান । অতঃপর আওয়ামী লীগের রাষ্ট্রপতি প্রার্থী মকবুল হোসেন ভবিষ্যতে আশায় প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে জননেত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে।

 

জাহানারা ইমাম ও শেখ হাসিনা

বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এবং শেখ হাসিনা বিরোধী দলীয় নেত্রী। প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া এবং বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার মাঝে সহযোগিতা সম্প্রীতি দূরের কথা বরং বৈরিতা এবং হিংসা আগের চেয়ে আরো তীব্র হলো।

এই সুযোগে স্বাধীনতা বিরোধী মৌলবাদী রাজনৈতিক দল জামাতে ইসলামী তাদের নেপথ্যের মূল নেতা যুদ্ধাপরাধী ঘাতক গোলাম আযমকে জামাতে ইসলামীর আমীর (প্রধান) বানায়।

এর প্রতিবাদে এবং যুদ্ধাপরাধী ঘাতক গোলাম আযমসহ সকল যুদ্ধাপরাধীর বিচারে দাবীতে ১৯৯২ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারী শহীদ জননী জাহানারা ইমাম মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও ‘৭১-এর ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটির নামে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী একটি নতুন সংগঠন গড়ে তোলেন এবং আন্দোলন শুরু করেন।

শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা এই নতুন সংগঠনের আন্দোলন কর্মসূচীতে জনগণ ব্যাপক সাড়া দিলো। নতুন প্রজন্ম শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্ব ও কর্মসূচীতে দারুণ উৎসাহ ও আস্থা নিয়ে অংশগ্রহণ করতে থাকলে বঙ্গবন্ধু কন্যা বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা অস্থির ও উত্তেজিত হয়ে ওঠেন। তিনি (শেখ হাসিনা) কেবলই বলতে থাকেন জাহানারা ইমাম নতুন দোকান খুলেছে। নতুন ব্যবসা ধরেছে, নেত্রী হতে চায়, জননেত্রী হতে চায়। ব্যবসার জায়গা পায় না, মুক্তিযুদ্ধের নাম নিয়ে ব্যবসা শুরু করেছে। মটর সাইকেল আরোহী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে বলে, নেত্রী একি বলেছেন আপনি? সমগ্র জাতি জানে জাহানারা ইমাম শহীদ জননী। ‘৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে তাঁর (জাহানারা ইমাম) ছেলে রুমি শহীদ হয়েছে। তিনি শহীদ জননী। আর আপনি একি বলছেন?

বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা উত্তেজিত হয়ে বলেন, রাখো তোমার শহীদ জননী ! ও কিসের শহীদ জননী ! ওর ছেলে রুমি লুটপাট করতে যেয়ে নিজেদের গুলিতেই মারা গেছে। ওর স্বামী ‘৭১ সালে যুদ্ধের সময় আর্মিদের সাপ্লাই করতো।

মটর সাইকেল আরোহী বলে, একি বলছেন নেত্রী ! এসব কথা জনসমক্ষে বললে হিতে বিপরীত হবে। বঙ্গবন্ধু কন্যা বলেন, এই জন্যই তো দমবন্ধ করে চুপ করে আছি এবং তোমাদের বলে রাখছি, তোমরা এগুলো বাইরে বলবে। ওরা (জাহানারা ইমাম) ধানমণ্ডি বত্রিশের রাস্তায় ঢুকতেই ডান দিকের কোণায় প্রথম ২য় তলা বাড়িতে থাকতো। আমাদের বাড়ির (ধানমণ্ডি বত্রিশের বঙ্গবন্ধু ভবনের) পূর্ব দিকে প্রথম বাড়িটায় থাকতো। জাহানারা ইমামদেরও পাকিস্তানী আর্মিরা পাহারা দিয়ে রাখতো। জাহানারা ইমামের জামাই (স্বামী) পাকিস্তানী আর্মিদের সাপ্লাই করতো। ঐ সময় প্রচুর টাকা-পয়সা কামিয়েছে এরা। আর এখন এসেছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন করতে। আসলে এ (জাহানারা ইমাম) এসেছে আমার নেতৃত্ব দখল করতে। আমি নির্বাচনে হেরেছি এই সুযোগে তলে তলে খালেদা জিয়ার সাথে লাইন করে জননেত্রী হওয়ার পরিকল্পনায় আছে জাহানারা ইমাম। আর তাই গোলাম আযমের বিচার, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ইত্যাদি নানা কথার আড়ালে নেত্রী হওয়ার খায়েশে আছে। তোমরা এর থেকে সাবধান থাকবে এবং আমাদের সকল কর্মীদের সাবধান রাখবে। কেউ যেন জাহানারা ইমামের খপ্পরে না পড়ে।

মটর সাইকেল আরোহীর প্রশ্ন, নেত্রী (শেখ হাসিনা) আপনি কি জাহানারা ইমামের ঘাতক, দালাল নির্মূল কমিটির কর্মসূচীতে যাবেন না?

বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা জবাব দেন, সে আমি যাই বা না যাই তোমরা যাবে না। আর আওয়ামী লীগের কোন কর্মীকে যেতে দেবে না। বোঝা না, আমার তো ইচ্ছে না থাকলেও অনেক জায়গায় যেতে হয়। জাহানারা ইমামের মুক্তিযুদ্ধের নামে দেওয়া কর্মসূচীতে হয়তো আমি (শেখ হাসিনা) কৌশলগত কারণে যাব। কিন্তু তোমরা যাবে না।

 

গোলাম আযম ও শেখ হাসিনা বৈঠক

শহীদ জননী জাহানারা ইমাম মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও ‘৭১-এর ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটির আহ্বায়িকা হিসেবে ঘাতক গোলাম আযমসহ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য গণআদালত গঠন করেন।

১৯৯২ সালের ২৬শে মার্চ স্বাধীনতা দিবসে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের সভাপতিত্বে গণ- আদালত ঘাতক যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমকে ১০টি অভিযোগে ফাঁসির রায় দেয়। গণ- আদালতের দেওয়া গোলাম আযমের ফাঁসির এই রায় কার্যকরী করার জন্য শহীদ জননী জাহানারা ইমাম সরকারের কাছে আহ্বান জানালে এবং গণ-আদালতে এই রায় কার্যকর করার দাবীতে আন্দোলনের কর্মসূচী দিলে যুদ্ধাপরাধী ঘাতক গোলাম আযম শেখ হেলাল উদ্দিন (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের একমাত্র আপন ভাই শেখ নাসেরের বড় ছেলে, শেখ হাসিনার আপন চাচাতো ভাই। বর্তমানে বাগের হাটের মোল্লার হাট ও ফকিরের হাট নির্বাচনী এলাকায় আওয়ামী লীগের এমপি) এর ইন্দিরা রোডের বাসায় বিরোধী দলীয় নেত্রী জননেত্রী কন্যা শেখ হাসিনার সাথে গোপন বৈঠকে বসে।

এই বৈঠকের সিদ্ধান্ত হয় ঘাতক গোলাম আযম ও তার দল জামাতে ইসলামী (জামাত) আর বিএনপি লেজুরবৃত্তি না করে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগকে সর্বতোভাবে সমর্থন ও সাহায্য সহযোগিতা করবে এবং শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের সাথে মিলে খালেদা জিয়া ও বিএনপি সরকার পতনের আন্দোলন করবে। বিনিময়ে জননেত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা যুদ্ধাপরাধী ঘাতক গোলাম আযমের ফাঁসি কার্যকর করার দাবীতে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা গণ-আন্দোলন এবং গণ আদালত নস্যাৎ ও বানচাল করার দায়িত্ব নেন। সেই থেকে ঘাতক গোলাম আযম আর বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার মাঝে গড়ে ওঠে গোপন নিবিড় ঐক্য ও সম্পর্ক।

 

১৯৯২-এর হিন্দু-মুসলিম রায়ট

১৯৯২ সালের ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহ। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া সার্কের চেয়ারম্যান। সার্কভুক্ত সাতটি রাষ্ট্রের শীর্ষ সম্মেলন ঢাকায়। সাত জাতির শীর্ষ সম্মেলনের দিন-ক্ষণ-স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে। সার্কের চেয়ারপার্সন হিসেবে বেগম খালেদা জিয়া শীর্ষ সম্মেলন উদ্বোধন করবেন। শীর্ষ সম্মেলন উপলক্ষে কোন কোন রাষ্ট্রের সরকার প্রধানগণ আসতেও শুরু করেছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরসীমা রাও এখনও ঢাকায় পৌঁছাননি। এরই মধ্যে ভারতে বাবরী মসজিদকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বা হিন্দু-মুসলিম রায়ট শুরু হলো। সঙ্গে সঙ্গে বিরোধী দলীয় নেত্রী আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা জরুরী ভিত্তিতে মটর সাইকেল আরোহীকে ডাকলেন। মটর সাইকেল আরোহী ২৯নং মিন্টু রোডে বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার বাসায় উপস্থিত হলে বাবুর্চি বিরেস দৌড়ে এসে খবর দেয় যে, আম্মা (শেখ হাসিনা) আপনাকে এখনই ধানমণ্ডি বত্রিশে বঙ্গবন্ধু ভবনে যেতে বলেছেন।

মটর সাইকেল আরোহী বত্রিশে পৌঁছলে সঙ্গে সঙ্গে জননেত্রী শেখ হাসিনা তাকে বঙ্গবন্ধু ভবনের লাইব্রেরী রুমে ডেকে বলেন, সারা দেশে হিন্দু-মুসলিম রায়ট (সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা) লাগিয়ে দাও।

মটর সাইকেল আরোহী বলে, এটা ঠিক হবে না।

নেত্রী বলেন, ঠিক-বেঠিক তোমার ভাবতে হবে না, রায়ট লাগাতে বলেছি, তুমি লাগাও।

মটর সাইকেল আরোহী বলে, আপনি এটা বলেন কি? আমি আরো রাত-দিন পরিশ্রম করে পাড়ায়-মহল্লায় যুবকদের সতর্ক করে রেখেছি যাতে করে হিন্দুদের উপর কোন প্রকার আক্রমণ না হয়। আর আপনি বলছেন রায়ট লাগিয়ে দিতে।

নেত্রী বলেন, হ্যাঁ আমি বলছি, তুমি রায়ট লাগাও।

মটর সাইকেল আরোহী বলেন, না নেত্রী, এটা নীতিবিরুদ্ধ কাজ।

নেত্রী রাগান্বিত হয়ে বলেন, রাখ তোমার নীতি-ফিতি। আমি যা বলছি তাই করো। আমি তোমার নেত্রী না তুমি আমার নেতা? আমাকে যদি নেত্রী মানো তাহলে আমি যা বলবো তাই করতে হবে।

মটর সাইকেল আরোহী বলেন, আপনিই তো আমাদের নেত্রী, আপনি যা বলবেন তাই তো শিরোধার্য। তবে হিন্দুদের উপর আক্রমণ করলে হিন্দুরা আর এদেশে থাকবে না। সবাই চলে যাবে। আর এই হিন্দুরা তো আমাদেরই লোক। আমাদেরই রিজার্ভ ভোটার।

নেত্রী বলেন, রাখ, যাবে কোথায়? যাবার জায়গা নেই। তুমি রায়ট লাগাও।

‘মটর সাইকেল আরোহী বলে, হিন্দুরা ভারতে চলে গেলে ভারত থেকে যে মুসলমান আসবে সে মুসলমানের সবাই হবে ধানের শীষ, মানে বিএনপি। এটা কি ভেবে দেখেছেন নেত্রী? নেত্রী বলেন, আরে বোকা, সার্ক সম্মেলন পণ্ড করতে হবে না! কয়েক দিন পরেই সার্ক সম্মেলন। খালেদা জিয়া সার্ক সম্মেলন উদ্বোধন করবে। ইন্ডিয়ার প্রাইম মিনিস্টার নরসীমা রাও এখনও আসে নি। এই-ই সুযোগে, এখনই রয়ট লাগিয়ে দিলে সার্ক সম্মেলন পণ্ড হয়ে যাবে। তাছাড়া জাহানারা ইমাম যেভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে তাকেও তো সাইজ করতে হবে। জাহানারা ইমাম আমার নেতৃত্বের প্রতি হুমকি। যেভাবে সে দিনকে দিন মুক্তিযুদ্ধের ধারক- বাহক হয়ে যাচ্ছে তা ভয়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাঁকে (জাহানারা ইমাম) আর ছাড় দেওয়া যায় না, এই সুযোগ। এই সুযোগেই জাহানারা ইমামকে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে হবে। এক ঢিলে দুই পাখি। সার্ক সম্মেলন পণ্ড, জাহানারা ইমাম সাইজ। তুমি রায়ট লাগাও। হিন্দুদের উপর হামলা কর। এদেশের সকল হিন্দুরাই এখন জাহানারা ইমামের পিছনে চলে গেছে।

ঢাকায় রায়ট বা হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা লাগানোর দায়িত্ব দেওয়া হলো মটর সাইকেল আরোহীকে এবং সিদ্ধান্ত হল ২৯ মিন্টু রোড বিরোধী দলের নেত্রীর বাসার এবং ধানমণ্ডি বত্রিশ নম্বরে বঙ্গবন্ধু ভবনের টেলিফোন ব্যবহার না করে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার চাচাতো চাচা বঙ্গবন্ধু ট্রাস্টের মহাসচিব শেখ হাফিজুর রহমানের বাসার টেলিফোন থেকে ঢাকার বাইরের জেলাগুলোকে হিন্দু-মুসলমান রায়ট লাগানোর নির্দেশ দেওয়া হবে। খালেদা জিয়া সরকার যাতে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা কর্তৃক রায়ট লাগানোর পরিকল্পনা টের না পায় সে জন্য এই সতকর্তা।

বিরোধী দলীয় নেত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দ্রুতগতিতে হিন্দু-মুসলমান রায়ট লাগানের জন্য সারা ঢাকা শহরের সকল গুণ্ডা-বদমাইশ এবং সন্ত্রাসীরা হাতে নগদ পাঁচ (৫) লক্ষ টাকা তুলে দেওয়া হলো। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার কর্মসূচী বাস্তবায়িত করার জন্য প্রথমেই যাওয়া হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের পূর্ব পাশে অবস্থিত শিববাড়ী মন্দিরে। সেখানে দেখা গেল লুটেরা আর সুযোগ সন্ধানীদের জটলা। এই জটলাকারী লুটেরা সুযোগ সন্ধানীদের হাতে সঙ্গোপনে একাধিক একশ’ (১০০) টাকার কড়কড়ে নোট গুঁজে দিয়েই বলা হলো, ভারতে মুসলমানদের খুন করা হচ্ছে, মুসলমান নারীদের ইজ্জত আর ধন-সম্পদ লুট করে নেওয়া হচ্ছে। আর আমরা বাংলাদেশের মুসলমানরা চুপচাপ চেয়ে চেয়ে দেখছি, শুনছি। যান, শুরু করেন, নেন, লুট করে নেন।

বলার সঙ্গে সঙ্গেই সুযোগ সন্ধানী লুটেরা হই হই করে মহা উৎসবে শিববাড়ী মন্দিরে লুটপাট শুরু করে দিল। সেখান থেকে চলে আসা হলো ঢাকেশ্বরী মন্দিরে। এখানেও উৎসুক সুযোগ সন্ধানী লুটেরার জটলা। এখানেও নগদ টাকা আর একই কায়দায় বক্তৃতা এবং ঢাকেশ্বরী মন্দির লুট। এরপর এল রামকৃষ্ণ মিশন। নগদ অর্থ আর বক্তৃতায় কাজ হলো। রামকৃষ্ণ মিশনে লুটপাট শুরু হলো। তারপর যাওয়া হলো পুরান ঢাকার তাতি বাজার, শাখারি পট্টি, বাংলাবাজার, মালাকাটোলা, মিলব্যারাক, গুশাই বাড়ী, নারিন্দা, টিকাটুলি, ইসলামপুর ইত্যাদি জায়গায়। কিন্তু না, এটা পুরানো ঢাকা, এখানে সবাই পরিচিত। এখানে বক্তৃতা করা যাবে না। এখানে শুধু টাকার উপর দিয়ে কাজ চালিয়ে যেতে হবে। বিভিন্ন মস্তান, সন্ত্রাসী ও নেশাখোর গ্রুপকে প্রচুর টাকা দেওয়া হলো। টাকায় কথা বললো। পুরাতন ঢাকায় হিন্দুদের দোকান, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বাড়ীঘরে লুটপাট আরম্ভ হলো।

ঘন্টা তিন-চারেক পরে ধানমণ্ডি বত্রিশ নম্বর বঙ্গবন্ধু ভবনে বিরোধী দলীয় নেত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে সারা ঢাকা শহরে হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বা রায়ট লাগিয়ে দেওয়ার সফল সংবাদ দিলে তিনি বেজায় খুশিতে আপ্লুত হয়ে বলে ওঠেন, এই তো কাজের ছেলে। তুমি না হলে কি হয়? তাই তো আমি তোমাকে খুঁজি। সামনের নির্বাচনে তোমাকে আমি মোকসেদপুর থেকে (গোপালগঞ্জের মোকসেদপুর-কাশিয়ানী আসন) এমপি বানাব। সারা দেশে হিন্দু-মুসলমান রায়ট শুরু হলো। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরসীমা রাও ঢাকা এলেন না। সার্ক সম্মেলন পণ্ড হলো।

১০ ই ডিসেম্বর ১৯৯২ সাল, বৃহস্পতিবার, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নেত্রী শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ডাকে গণআদালত কর্তৃক ঘোষিত যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের ফাঁসির রায় কার্যকর করার দাবীতে মানব-বন্ধন কর্মসূচীতে হিন্দু সম্প্রদায় যোগদান করলো না। মাত্র কয়েকদিন আগে ঘটে যাওয়া হিন্দু-মুসলমান রায়টের কারণে যুদ্ধাপরাধী ঘাতক গোলাম আযমের ফাঁসির দাবিতে মানব-বন্ধন কর্মসূচীতে হিন্দু সম্প্রদায় যোগদান করবে না, এটা প্রায় নিশ্চিত ছিল। আর সেই কারণেই ঘাতক দালাল নির্মূল ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন কমিটির নেত্রী শহীদ জননী জাহানারা ইমাম আগে থেকেই আমরা যারা মুক্তিযোদ্ধা আমাদের সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ করে বন্ধু-বান্ধব, পরিবার-পরিজন নিয়ে ১০ই ডিসেম্বর-এর মানব বন্ধন কর্মসূচীতে যোগদান করার আহ্বান জানান, একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে শহীদ জননীর আহ্বানে সাড়া না দিয়ে পারিনি।

তাছাড়া হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টি আমাকে মর্মে মর্মে আঘাত করছিল। এ জন্যই বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে না জানিয়ে আমার একমাত্র শিশুকন্যা স্বর্ণলতা ও প্রিয়তমা স্ত্রী ময়নাকে সঙ্গে নিয়ে মানব-বন্ধন কর্মসূচীতে অংশগ্রহণ করি। মানব-বন্ধন কর্মসূচীর পরের দিন ১১ই ডিসেম্বর ১৯৯২ সাল শুক্রবার দৈনিক ভোরের কাগজ ও দৈনিক আজকের কাগজ-এর প্রথম পাতায় বড় করে আমাদের (আমি, আমার কন্যা এবং আমার স্ত্রী) ছবি ছেপে লিড নিউজ করে। ভোরের কাগজ ও আজকের কাগজের এই ছবি দেখে জননেত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ভীষণ রেগে যান এবং টেলিফোনের মাধ্যমে আমাকে জরুরী তলব করেন।

সকাল দশটা নাগাদ ২৯ মিন্টু রোডে বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার বাসভবনে পৌঁছে কাঠের সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় ব্যালকনিতে উঠে দেখি বঙ্গবন্ধু কন্যা গম্ভীর হয়ে বেতের চেয়ারে বসে আছেন। আমাকে দেখেই ভোরের কাগজ ও আজকের কাগজ পত্রিকা দু’টি আমার দিকে ছুঁড়ে মেরে উত্তেজিত হয়ে বললেন, এই তোমাদের বিশ্বাস ! মুখে এক কথা আর কাজে আর এক।

১৯৯২ সালের ১১ ডিসেম্বর ভোরের কাগজের প্রথম পাতায় প্রকাশিত এই ছবিতে মুক্তিযোদ্ধা মতিয়ুর রহমান রেন্টু তাঁর স্ত্রী ময়না রহমান এবং কন্যা স্বর্ণলতাকে দেখে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ভীষণ ক্ষেপে যান।

পত্রিকা দু’টি হাতে নিলাম এবং এই প্রথম সপরিবারে পত্রিকায় নিজেদের ছবি দেখে বুঝে ফেললাম ঘটনা অনেক খারাপ। আজ কপালে অনেক খারাপি আছে।

বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা বলতে লাগলেন,নেতৃত্বের প্রতি এই তোমাদের আস্থা, এই বিশ্বাস, আই আনুগত্য। যেখানে আমি নিজে জাহানারা ইমামের কর্মসূচিতে তোমাদের অংশ গ্রহণ করতে নিষেধ করেছি এবং অন্য কর্মীরা যাতে অংশগ্রহণ করতে না পারে তার দায়িত্ব তোমাকে দিয়েছি। সেখানে তুমি নিজেই কোন আক্কেলে বউ-বাচ্চা নিয়ে হাজির হলে? একদিকে থাক। জাহানারা ইমাম পছন্দ হয়, জাহানারা ইমামকে নিয়েই থাক। আমার দিকে আর এসো না।

আমি চুপ করে ভাবছি এখন কি বলা যায়, মাথায় একটা বুদ্ধি এলো। ধীরে ধীরে বললাম, নেত্রী আমি কিছু বলতে চাই। তুমি আবার কি বলবা, তোমার আবার কি বলার আছে? বল।

নেত্রী, আমরা তো আসলে মেয়ের (স্বর্ণলতার) জুতা কেনার জন্য এলিফেন্ট রোড যাচ্ছিলাম। কিন্তু আপনার নির্দেশ পালন করার জন্য একটু আগে ভাগেই বেরিয়েছিলাম এবং প্রেসক্লাব এসে অন্তত তিনশ কর্মীকে কানে কানে জাহানারা ইমামের এই কর্মসূচীতে যোগ না দেওয়ার আপনার নির্দেশ জানিয়ে বিদায় করেছি। কিন্তু ফটো সাংবাদিকদের খপ্পর থেকে বাঁচতে. পারলাম না। তারা নাছোড়বান্দা, ফটো না তুলে ছাড়লোই না। আসলে এটা মানব-বন্ধন কর্মসূচীর ফটো না। কৃত্রিমভাবে তোলা এই ছবি। মাত্র কয়েক দিন আগে রায়ট হয়ে গেল। মৌলবাদীরাও সক্রিয়, দেশের এই উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে-আমি বউ-বাচ্চা নিয়ে জাহানারা ইমামের মানব-বন্ধন কর্মসূচীতে যাব? আমার কি মাথা খারাপ হয়েছে? আমরা শুধু আপনার নির্দেশ পালন করার জন্যই এই ঝুঁকি নিয়ে সেখানে গিয়েছি।

তোমরা তো এই রকমই কাজ করবা, হিতে বিপরীত করবা, তোমাদের নিয়ে যদি একটুও নিশ্চিন্ত থাকা যায়! বোঝা এইবার ঠেলা, সবাই পত্রিকার ছবিতে দেখবে শেখ হাসিনার নিজস্ব লোকেই জাহানারা ইমামের কর্মসূচীতে। এখন আর কাকে নিষেধ করবা না যাওয়ার জন্য। তোমাদের নিয়ে আমার যত জ্বালা।

 

শেখ হাসিনা ও গোলাম আযমের ২য় বৈঠক

৩০শে জানুয়ারী ১৯৯৪ ঢাকা সিটি করপোরেশন-এর মেয়র ও কমিশনার নির্বাচন। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ও তার দল আওয়ামী লীগ ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি মোহাম্মদ হানিফকে ঢাকার মেয়র পদে মনোনয়ন দিয়েছে।

তোড়জোড়ে নির্বাচনী প্রচার-প্রপাগান্ডা এগিয়ে চলছে। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা থেকে শুরু করে দলের সকল নেতা-কর্মীই বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটারদের কাছে মেয়র পদে মাছ মার্কায় হানিফের জন্য ভোট চাইছে। অধিক রাত পর্যন্ত চলছে মিছিল এবং নির্বাচনী জনসভা। প্রতিটি পাড়া-মহল্লা, অলি-গলিতে চলছে মেয়র কমিশনার নির্বাচনের কাজ। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামাত, কমিউনিস্ট পার্টিসহ সকল রাজনৈতিক দল নির্বাচনী কাজে ভীষণ ব্যস্ত। ঢাকায় টানটান নির্বাচনী উত্তেজনা। নির্বাচনের আর মাত্র কয়েক দিন বাকি। ২৫শে জানুয়ারী সন্ধ্যা বেলায় ধানমন্ডি ৮/এ রোডে বঙ্গবন্ধুর চাচাতো ভাই শেখ হাফিজুর রহমান টোকনের বাসায় (শেখ হাফিজুর রহমান টোকন বর্তমানে বঙ্গবন্ধু যাদুঘরের মহাসচিব) ‘৭১-এর যুদ্ধাপরাধী জামাত নেতা ঘাতক গোলাম আযমের সাথে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার দ্বিতীয় বৈঠক হয়। এই বৈঠকে ঘাতক গোলাম আযম মেয়র নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থীকে সমর্থন না দেওয়ার আশ্বাস দিলে শেখ হাসিনাও রাজনীতিতে জামাতকে আক্রমণ না করার আশ্বাস দেন।

 

নির্বাচন বাতিলের দাবী

আজ ৩০শে জানুয়ারী ১৯৯৪। ঢাকায় প্রথমবারের মতো সরাসরি জনগণের ভোটে মেয়র নির্বাচন চলছে। সকাল আটটা থেকে বিরতিহীনভাবে বিকাল চারটা পর্যন্ত একটানা ভোট গ্রহণ করা হবে। গত রাতেই জননেত্রী শেখ হাসিনা নির্দেশ দিয়েছেন, আজ ৩০শে জানুয়ারী সকাল ছ’টায় ২৯ মিন্টু রোডে তার বাসায় হাজির হওয়ার জন্য। নির্দেশ মোতাবেক নেত্রীর বাসায় সকাল পৌনে ছ’টায় হাজির হয়েছি। বঙ্গবন্ধু কন্যা ঘুম থেকে উঠলেন, একসঙ্গে নাস্তা করলেন। তারপর সকাল পৌনে সাতটায় তার (শেখ হাসিনার) লাল রঙের নিশান পেট্রোল জীপ গাড়িতে করে আমাদের সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রথমে গেলেন শেরে বাংলা নগরের রাজধানী হাই স্কুলে। তারপর গেলেন ধানমণ্ডি বয়েজ হাই স্কুলে, এরপর গেলেন ধানমণ্ডি বত্রিশে তার (শেখ হাসিনার) পিতার বাড়ি বঙ্গবন্ধু ভবনে। সেখানে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে চা খেয়ে নিজের ভোটার স্লিপ নিয়ে চলে এলেন সিটি কলেজে ভোট দিতে। সিটি কলেজে ভোট দেওয়া শেষ করে আরো কিছু ভোটকেন্দ্র ঘুরে বেলা এগারোটা নাগাদ ফিরে এলেন ২৯ মিন্টু রোডে তার সরকারী বাসভবনে। জননেত্রী শেখ হাসিনা মিন্টু রোডের বাসভবনে ফিরে আসার দশ-পনের মিনিটের মধ্যে এসে উপস্থিত হলেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক (বর্তমানে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য) নওগাঁর আব্দুল জলিল। সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে আব্দুল জলিল বললেন, নেত্রী আমাদের অবস্থা ভাল না। আমরা নির্বাচনে জিততে পারব না। আমাদের লোককে ভোটকেন্দ্র থেকে বের করে দিচ্ছে। আপনাকে তো আগেই বলেছি আওয়ামী লীগ হলো হরতাল আর আন্দোলনের দল, নির্বাচনের দল না। আপনি খামাকা নির্বাচনে যান।

আব্দুল জলিলের কথা শেষ না হতেই এসে হাজির হলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক (বর্তমানে এলজিআরডি মন্ত্রী) জিল্লুর রহমান। জিল্লুর রহমানের পেছনে পেছনে এলেন প্রেসিডিয়াম সদস্য (বর্তমানে পানি সম্পদ মন্ত্রী) আব্দুর রাজ্জাকসহ অন্যান্য নেত্রীবৃন্দ।

একমাত্র আব্দুর রাজ্জাক ছাড়া সকল নেত্রীবৃন্দেরই এক কথা, মেয়র নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি হচ্ছে। আমাদের কর্মীদের ভোটকেন্দ্র থেকে বের করে দিচ্ছে। নির্বাচন বাতিলের দাবী করা হোক, আন্দোলন করা হোক ইত্যাদি। প্রেসিডিয়াম সদস্য আব্দুর রাজ্জাক বললেন, নির্বাচনে কারচুপি হচ্ছে, আমাদের কর্মীদের বের করে দেওয়া হচ্ছে, এটা কি আপনারা কেউ ভোটকেন্দ্রে গিয়ে দেখেছেন?

নেতারা কেউ কোন উত্তর দিলেন না, কোন কথাও কেউ বললেন না, সবাই চুপ।

জননেত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা বললেন, এটা আবার ভোটকেন্দ্রে গিয়ে দেখতে হয় নাকি? ওরা তো ভোট কারচুপি করবেই। এখন না করলে একটু পরে করবে। কাজেই আমাদের নির্বাচন বাতিলের দাবী করতে হবে এবং এই ইস্যু নিয়ে বিএনপি সরকার পতন আন্দোলন করতে হবে। খালেদা জিয়া সরকারের পতন ঘটাতে হবে।

সঙ্গে সঙ্গে টেবিল টেলিফোন সেট (যে সেট দিয়ে উপস্থিত সকলে শুনতে পারে) দিয়ে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা স্বয়ং প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে ফোন করলেন। প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে না পেয়ে, অন্য একজন নির্বাচন কশিনারকে নির্বাচন বাতিল করার কথা বললে, নির্বাচন কমিশনার বিস্ময়ের সাথে বললেন, ম্যাডাম, নির্বাচন বাতিল করা তো দূরের কথা, কোন ভোটকেন্দ্রের নির্বাচন স্থগিত করার মতো কোন ইনফরমেশন এখন পর্যন্ত আমাদের কাছে আসেনি।

জবাবে জননেত্রী শেখ হাসিনা বললেন, আমার কাছে ইনফরমেশন আচে নির্বাচন কারচুপি হচ্ছে। আমি বলছি-নির্বাচন বাতিল করেন।

নির্বাচন কমিশনার বললেন, ম্যাডাম আপনি কাইন্ডলি বলেন, কোন-কেন্দ্রে কারচুপি হচ্ছে আমরা অবশ্যই তার ব্যবস্থা নেব।

বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা চীফ ইলেকশন কমিশনারকে বলবেন আমাকে ফোন করতে এ কথা বলে ফোন রেখে দিলেন। এরপর প্রায় প্রতি ঘন্টায় ঘন্টায় নির্বাচন কমিশনে নির্বাচন বাতিল করার দাবী জানিয়ে ফোন করা শুরু হলো। বিকেল চারটা নাগাদ একবার প্রধান নির্বাচন কমিশনার জননেত্রী শেখ হাসিনার নির্বাচন বাতিলের দাবীর জবাবে বললেন, ম্যাডাম আমি ইতোমধ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েছি। সামান্য গোলযোগের কারণে আমি কয়েকটি ভোটকেন্দ্রের ভোট স্থগিতও করেছি।

শেখ হাসিনা পুনরায় নির্বাচন বাতিলের দাবী করলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেন, ম্যাডাম আমি নির্বাচন কমিশনে বসে নেই। আমি সরাসরি ভোটকেন্দ্রে গিয়ে নিজেই নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করছি। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, যে কোন প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নিতে আমি মোটেই পিছপা হবো না। হ্যাঁ, আপনি নির্বাচন বাতিলের সিদ্ধান্ত নিন। আমি পরে আবার ফোন করবো বলেই জননেত্রী শেখ হাসিনা ফোন রেখে দিলেন। এরপর প্রায় পনের বার ফোন করেও নির্বাচন কমিশনারকে পাওয়া গেলো না। কিন্তু রাত দশটার সময় প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে পাওয়া গেল। প্রধান নির্বাচন কমিশনার ফোন ধরতেই বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা উচ্চস্বরে বললেন, নির্বাচন বাতিলের ঘোষণা দিলেন না? প্রধান নির্বাচন কমিশনার বললেন, ম্যাডাম আমাদের কাছে যে ফলাফল এসেছে তাতে মেয়র পদে মাছ মার্কায় মোহাম্মদ হানিফ বিপুল ভোটে এগিয়ে রয়েছে। এখন আমরা কি নির্বাচন বাতিল ঘোষণা করবো?

শেখ হাসিনা বললেন, জ্বী জ্বী কি বললেন? হ্যাঁ ম্যাডাম, এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত ফলাফল অনুযায়ী মেয়র পদে মাছ মার্কায় মোহাম্মদ হানিফ বিপুল ভোটে এগিয়ে রয়েছে এবং মোহাম্মদ হানিফের মেয়র হওয়া প্রায় নিশ্চিত। আমরা কি এই নির্বাচনী ফলাফল বাতিল করবো?

তাই নাকি, তাই নাকি, না না বাতিল করবেন কেন? আপনি খেয়াল রাখবেন যাতে এই ফলাফল উল্টে না যায়। আমি পরে আবার আপনার সাথে যোগাযোগ করব।

এরপর জননেত্রী শেখ হাসিনা টেবিল টেলিফোন সেট বন্ধ করে উপস্থিত সকলকে উদ্দেশ্য করে বললেন, শুনলেন তো হানিফ নাকি মেয়র হয়ে যাচ্ছে। এখন তো আমাদের নির্বাচন বাতিলের দাবী করা ঠিক হবে না; কি বলেন?

জিল্লুর রহমান বললেন, দেখেন এটা আবার কোন চাল !

আব্দুর রাজ্জাক বললেন, নেত্রী নির্বাচন কমিশনে আমার একজন ঘনিষ্ঠ লোক আছে, আমি তার কাছে যেয়ে সঠিক খবর নিয়ে আসি।

সভানেত্রী শেখ হাসিনা বললেন, তাই যান। আপনারা সকলেই যান, যার যেখানে লোক আছে সেখান থেকেই সঠিক খবরটা সংগ্রহ করেন।

রাত তখন বারোটা, সবাই চলে গেল। একমাত্র আব্দুর রাজ্জাক ছাড়া আর কোন নেতাই রাতে আর ফিরে এলেন না। রাত দেড়টার দিকে আব্দুর রাজ্জাক মিন্টু রোডে এসে বললেন, সভানেত্রী হানিফ তো মেয়র হয়ে গেছে। নির্বাচন কমিশন দেশী-বিদেশী সমস্ত নিউজ মিডিয়াতে হানিফের মেয়র হওয়ার ফলাফল পাঠিয়ে দিয়েছে। এখন হানিফ বেসরকারীভাবে ঢাকার মেয়র। সভানেত্রীকে সংবাদটা দিতে হয়।

আপনি বসেন বলে উপরে গেলাম। সভানেত্রী শেখ হাসিনা ডিশ এন্টিনায় হিন্দি ফিল্ম দেখছিলেন, তাকে আব্দুর রাজ্জাকের আসার সংবাদ এবং হানিফের বেসরকারী ভাবে মেয়র হওয়ার সংবাদ দিলে তিনি বলেন, হানিফের কপাল ভাল। আব্দুর রাজ্জাক দেখা করতে চায় জানালে শেখ হাসিনা বলেন, দূর ছবিটা জমে উঠেছে এই সময় দেখাটেখা হবে না । তুমি বলে দাও আমি (শেখ হাসিনা) ঘুমিয়ে পড়েছি।

তথাস্ত নেত্রী, বলে নিচে এসে আব্দুর রাজ্জাককে বলা হলো আপনি চলে যান, নেত্ৰী ঘুমিয়ে পড়েছেন। আজ আর উঠবেন না।

আব্দুর রাজ্জাক চলে গেলে এরপর ফোন এলো প্রেসিডিয়াম সদস্য (বর্তমান পররাষ্ট্র মন্ত্রী) আব্দুস সামাদ আজাদ-এর, সভানেত্রীকে সামাদ আজাদের ফোনের কথা বলা হলে, তিনি ঐ একই কথা বলেন, দূর সিনেমাটা জমে উঠেছে। বলে দাও ঘুমিয়ে গেছি। এরপর থেকে যে-ই ফোন করুক বলে দেবে ঘুমিয়ে গেছি।

এরপর থেকে বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা যে রুমে বসে ডিশ এন্টিনায় হিন্দী ফিল্ম দেখছেন সেই রুম থেকেই হ্যান্ডসেট দিয়ে যে-ই ফোন করেছে তাকেই বলে দেওয়া হচ্ছে নেত্রী ঘুমাচ্ছেন। এই নিয়ে আবার জননেত্রী শেখ হাসিনা এবং উপস্থিত হিন্দি ফিল্ম দর্শকদের মাঝে হাসির রোল পড়ে গেল।

 

শেখ হাসিনা এবং হানিফ

পরদিন বিকেল বেলা বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা বললেন, কিরে, এত লোক আসে যায়, এত ফুলের তোড়া, ফুলের মালা, কিন্তু হানিফকে (সদ্য নবনির্বাচিত মেয়র মোহাম্মদ হানিফ) দেখছি না ! এখন পর্যন্ত একটা ফোনও করলো না। ব্যাপারটা কি? ঠিক আছে তো, না ভাইগা টাইগা গেল । এই মেয়র হওয়ার লোভেই কিন্তু হানিফ স্বৈরাচারী জেনারেল এরশাদের জাতীয় পার্টিতে যোগ দিয়েছিল। এরশাদের কাছে চান্স না পেয়ে হানিফ মেয়র হওয়ার জন্য আবার আমার কাছে ফিরে এসেছে। আমি এক কোটি সাতত্রিশ লক্ষ টাকা খরচ করে হানিফকে মেয়র করেছি। তাড়াতাড়ি খোঁজ খবর নাও। ফোন কর এবং একজন হানিফের বাড়ি গিয়ে দেখ আসল ব্যাপার কি?

সদ্য নির্বাচিত মেয়র মোহাম্মদ হানিফের বাসায় ফোন করে বলা হলো, জননেত্রী বিরোধী দলীয় নেত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা হানিফ ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলবেন।

জবাবে মিসেস হানিফ বললেন, তিনি অসুস্থ এখন কথা বলতে পারবেন না। বললেন, শীঘ্রই হানিফের বাসায় যাও, দেখ গিয়ে ঘটনা খারাপ।

তখন সন্ধ্যা হয়ে আসছে, মেয়র হানিফের বাড়ি ছুটে যাওয়া হলো। মেয়র হানিফ তখন দশ- বারো জন লোকের সঙ্গে বসে কথা বলছেন। সেখানেই শোনা গেল বিকেলে লালবাগে বিএনপির পরাজিত কমিশনার প্রার্থী আব্দুল আজিজ গুলি করে সাতজন লোককে হত্যা করেছে। জননেত্রী শেখ হাসিনা কথা বলতে চেয়েছেন বলায় মেয়র হানিফ বললেন, নেত্রীকে আমার সালাম দিও, বলো আমার শরীরটা খুব খারাপ, আমি কথা বলতে পারছি না। শুধু লালবাগের খুনের জন্য আমি ওনাদের সাথে কথা বলছি।

মেয়র হানিফের বাসা থেকে সোজা মিন্টু রোডে এসে বঙ্গবন্ধু কন্যাকে লালবাগের বিএনপি কমিশনার প্রার্থী আজিজ কর্তৃক সাত জনকে খুন করার সংবাদ দিলে বঙ্গবন্ধু কন্যা খুশিতে জিন্দেগি জিন্দেগি গান গাইতে থাকেন আর নাচতে থাকেন।

 

রুমালে গ্লিসারিন

পরদিন সকালে লালবাগে নিহত সাত জনের লাশ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গে দেখতে যাওয়ার আগে বঙ্গবন্ধু কন্যা হাসিনা বলতে থাকেন, আমার (শেখ হাসিনা) রুমালে একটু গ্লিসারিন মেখে দাও, ঐ যে, নায়িকারা অভিনয়ের সময় গ্লিসারিন দিয়ে চোখের পানি বের করে কান্নার অভিনয় করে । আমার রুমালে ঐ রকমের গ্লিসারিন লাগিয়ে দাও, যাতে আমি লাশ দেখে রুমাল ধরতেই চোখে পানি এসে যায়।

একজন বলল, গ্লিসারিনের দরকার নেই, শুধু চোখে রুমাল ধরে রাখবেন তাতেই মনে হবে আপনি কাঁদছেন । আর আমরা ফটো সাংবাদিক (ফটো সাংবাদিক) ভাইদের বলে দেখ ছবির নীচে আপনি কাঁদছেন ক্যাপশন লাগিয়ে দিতে।

হাসপাতালের মর্গে নিহত সাত জনের লাশ দেখে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা চোখে রুমাল ধরলে সঙ্গে সঙ্গে সাংবাদিকগণ অসংখ্য ছবি তুলতো। ছবি তোলা শেষে বঙ্গবন্ধু কন্যা গাড়িতে উঠলেন। গাড়ি চলতে শুরু করলো। তখনও বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার চোখে রুমাল। গাড়ির চালক ড্রাইভার জালাল বলল, আপা (শেখ হাসিনা) এখন রুমাল নামান ফটো সাংবাদিক নেই।

গাড়ির সকল আরোহী হেসে উঠলো। জননেত্রী শেখ হাসিনা বললেন, ঠিক মতো দেখেছ তো, কোন ফটো সাংবাদিক নেই তো?

না, নেই।

তাহলে আমি (শেখ হাসিনা) এবার রুমাল নামাই।

 

আজ আমি বেশি খাব

২৯ নং মিন্টু রোডের বাসায় এসে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা বললেন, ময়না (মিসেস মতিয়ুর রহমান রেন্টু) খাওয়া-দাওয়া বেশি করে এনেছ তো? লাশ দেখে এসেছি, লাশ। আজ আমি বেশি করে খাব।

তারপর তিনি জিন্দেগী জিন্দেগী গাইতে গাইতে, নাচতে লাগলেন। সত্যি সত্যিই তিনি (শেখ হাসিনা) অস্বাভাবিক রকমের বেশি খেলেন। এমনিতেই তিনি (শেখ হাসিনা). বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে নিহতদের লাশ দেখে এসে স্বাভাবিকের চাইতে অনেক বেশি খেতেন। কিন্তু আজ খেলেনত অস্বাভাবিকের চাইতেও অনেক বেশি।

 

টাকার ভাগ দিতে হবে

টুঙ্গিপাড়ায় শেখ হাসিনার পিতা আওয়ামী লীগের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের কবরে গিয়ে মেয়র মোহাম্মদ হানিফের আনুষ্ঠানিক শপথ নেওয়ার দিনক্ষণ চূড়ান্ত করা হলো। ঢাকা থেকে বঙ্গবন্ধু কন্যা বিরোধী দলীয় নেত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা ঢাকার মেয়র মোহাম্মদ হানিফকে সঙ্গে নিয়ে টুঙ্গিপাড়ায় যাবেন এবং সেখানে বেসরকারীভাবে হানিফ মেয়র হিসেবে শপথ নেবেন। নির্দিষ্ট দিনে সকালবেলা সকলেই টুঙ্গিপাড়ায় যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। কিন্তু মেয়র হানিফ এলেন না। টুঙ্গিপাড়ায় যাওয়া হলো না।

মেয়র হানিফের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বললেন, তিনি অসুস্থ। এরপর আর মেয়র হানিফ শেখ হাসিনার বাসা, আওয়ামী লীগ অফিস কোথাও এলেন না। আনুষ্ঠানিকভাবে মেয়র পদে মোহাম্মদ হানিফ শপথ নিলেন। ঢাকার মেয়রের দায়িত্বভার নিলেন। হটলাইনের রেড টেলিফোনে প্রতিদিন দুই একবার প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে কথা বলেন। প্রতিদিন না হলেও প্রায়ই প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করেন এবং যুক্তি-পরামর্শ করে সিটি করপোরেশন পরিচালনা করেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী ও আওয়ামী লীগ অফিসের ত্রিসীমানায়ও আসেন না। বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী বিরোধী নেত্রী শেখ হাসিনা কপাল চাপড়ান আর বলতে থাকেন, নিমকহারাম, বেঈমান, ওরে আমি এক কোটি সাত ত্রিশ লক্ষ টাকা খরচ করে মেয়র করেছি। বেঈমান, নিমকহারাম। যে আসে, যাকে পান তার কাছেই তিনি (শেখ হাসিনা) এই কথা বলতে লাগলেন। একজন বললো, ঠিক আছে হানিফ ভাই মেয়র হয়েছে, টাকা কামাবে, টাকা খাবে, থাক, আমরা তো আর ভাগ চাই না ! কিন্তু দলের কাজ করবে না কেন?

জবাবে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা বললেন, কেন? একা টাকা খাবে কেন? আমাদের ভাগ দিতে হবে। ওকে এক কোটি সাতত্রিশ লাখ টাকা খরচ করে মেয়র বানিয়েছি। তোমাদের হাত দিয়েই তো ঐ টাকা খরচ করেছি। হানিফ তো এক পয়সাও খরচ করে নি। সব আমি করেছি। এখন হানিফ একা খাবে কেন? আমাদেরও ভাগ দিতে হবে। নইলে আমি শেখ হাসিনা একদিন না একদিন এর উসুল করে ছাড়ব।

বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা কথা বলবেন, কত শতবার ফোন করা হয়, মেয়র হানিফ ফোন ধরে না। আসতে বলা হয়, দেখা করতে বলা হয়, হানিফ আসে না, দেখা করে না। লোক পাঠালে মেয়র হানিফ বলে, যা যা, যেই জায়গায় আছিস সে জায়গায় যা। ক্ষমতায় যাওয়া লাগবো না। যে পর্যন্ত আগাইছস ঐ বিরোধী দল পর্যন্তই থাক, আর ক্ষমতায় যাওয়া লাগবো না। আমি তোগে লগে নাই।

 

জাহানারা ইমাম মরেছে, আপদ গেছে

১৯৯৪ সালের ২৬শে অথবা ২৭শে জুন সন্ধ্যাবেলায় যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের সভাপতি টেলিফোন করে ২৬শে জুন ‘৯৪ শহীদ জননী জাহানারা ইমামের মৃত্যু হয়েছে বলে সংবাদ দিলে, জননেত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা আনন্দে নাচতে থাকেন আর বলতে থাকেন মিষ্টি খাও, মিষ্টি। আমার একটা প্রতিদ্বন্দ্বী দুনিয়া থেকে বিদায় হয়েছে। আল্লাহ বাঁচাইছে। নেত্রী হতে চেয়েছিল। আমার জায়গা দখল করতে চেয়েছিল। জাহানারা ইমাম মরেছে আপদ গেছে। বাঁচা গেছে। আমার জায়গা দখল করতে চেয়েছিল। তোমরা জান না, ইন্ডিয়ান গোয়েন্দা এজেন্সি ‘র’ (ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার নাম ‘র’) আমার পরিবর্তে জাহানারা ইমামকে নেতৃত্বে বসাতে চেয়েছিল। বেটি মরছে, মিষ্টি খাও। ফকিরকে পয়সা দেও।

এর কয়েকদিন পরে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের লাশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে জিয়া আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর এলে, জননেত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা বলেন, চল, এয়ারপোর্টে যাই, আপদের লাশটা এনে কবরে ফেলি।

এরপর জননেত্রী শেখ হাসিনা তার লাল রঙের নিশান পেট্রোল জীপে করে বিমান বন্দর-এর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন। যেতে যেতে বলতে লাগলেন, বেটি (জাহানারা ইমাম) আমারে অসম্ভব জ্বালাইছে (জ্বালিয়েছে)। ওর মরা মুখও দেখতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু না যেয়ে তো উপায় নেই। পলিটিক্স-এর (রাজনীতির) ব্যবসায় ইচ্ছে না থাকলেও করতে হয়।

বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা বিমান বন্দরের রানওয়ে পর্যন্ত গেলেন ঠিকই, কিন্তু শহীদ জননী জাহানারা ইমামের লাশের ধারে-কাছেও গেলেন না।

 

শেখ হাসিনার ট্রেনে গুলি

১৯৯৪ সালের ২২ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার জননেত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা বিমানযোগে যশোর হয়ে খুলনা এলেন এবং বিকেলে শহীদ হাদিস পার্কের জনসভায় ভাষণ দিলেন। রাত্রে নেত্রীর চাচাতো ভাই শেখ নাসেরের বড় ছেলে শেখ হেলালের বাড়িতে খেলেন এবং থাকলেন। পরদিন ২৩শে সেপ্টেম্বর শুক্রবার সকাল নয়টার সময় উত্তর- বঙ্গের উদ্দেশ্যে ট্রেন যাত্রা শুরু করলেন। বেশ লম্বা ট্রেন। অনেক সাধারণ যাত্রী আছে ট্রেনে, সাধারণ যাত্রীরা জানে না বা বুঝতে পারছে না, শেখ হাসিনার রেলপথে সভা করতে করতে যাওয়া এই ট্রেন কবে, কখন গন্তব্যে পৌঁছবে।

ঠিক সকাল নয়টায় ট্রেন ছাড়লো। প্রতিটি রেলস্টেশনেই ট্রেন থামিয়ে সভা করা শুরু হলো। ট্রেন থেকে নেমে জনসভা আয়োজনের নির্দিষ্ট জায়গায় যেয়ে বক্তৃতা দিয়ে আবার ট্রেনে ফিরে আসতে পৌনে এক ঘন্টা সময়ে লাগতে লাগলো। এভাবে প্রতিটা রেলস্টেশনে গড়ে প্রায় একঘন্টা সময় ব্যয় হতে থাকলো। দিন পেরিয়ে রাত হয়ে গেল। শেখ হাসিনার সঙ্গে ঢাকা থেকে নিয়ে আসা প্রায় ডজনখানেকেরও বেশি সাংবাদিক (বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার ভাষায় সাংঘাতিক) এই ট্রেনে রয়েছে। ট্রেনের শেষের দিকে একটি ভি ভি আই পি স্পেশাল কামরায় বা কম্পার্টমেন্টে (বগীতে) জননেত্রী বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা। ঐ কম্পার্টমেন্ট-এর সামনে এবং পেছনে ঢাকা থেকে নিয়ে আসা শেখ হাসিনার নিরাপত্তায় নিয়োজিত স্পেশাল (এসবি) ব্রাঞ্চ পুলিশের বারো জন সদস্য। তার পরের কম্পার্টমেন্টে সাংবাদিকগণ। এরপর সবগুলো কম্পার্টমেন্ট বা বগিগুলোতে সাধারণ যাত্রী। ট্রেনের এই অপ্রত্যাশিত দীর্ঘ বিলম্বে সাধারণ যাত্রী নারী-পুরুষ আর শিশুদের ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা। ছয় ঘন্টার যাত্রাপথ চব্বিশ ঘন্টায়ও না ফুরানোর ফলে অনেক আগেই পানিসহ ট্রেনের সকল খাবার ফুরিয়ে নিঃশেষ হয়ে গেলে সাধারণ যাত্রীদের কষ্ট আর দুর্ভোগ সীমাহীন পর্যায়ে পৌঁছে।

তৃষ্ণার্ত-ক্ষুধার্ত শিশুদের কান্না আর আহাজারিতে অনেক সাধারণ যাত্রীই পরিবার-পরিজন নিয়ে গন্তব্যের আগেই ট্রেন থেকে নেমে পালিয়ে যায়। জননেত্রী শেখ হাসিনা তার সফরসঙ্গী এবং সাংবাদিকদের জন্য প্রায় প্রতিটি রেলষ্ট্রেশন থেকেই অফুরন্ত খাবার এবং বিশুদ্ধ পানির (মিনারেল ওয়াটার) পর্যাপ্ত বোতল সরবরাহ করা হতে থাকে।

সারাদিন জননেত্রী শেখ হাসিনা প্রায় কুড়িটির মতো রেলস্টেশনে জনসভায় ভাষণ দেন। কোথায় কোথায় রেলস্টেশন ছাড়াই উৎসুক জনতা ট্রেন থামালে সেখানেও তিনি বক্তৃতা করেন। প্রতিটি জনসভাতেই ঢাকা থেকে আসা সাংবাদিকরা উপস্থিত হয়ে বঙ্গবন্ধু কন্যা হাসিনার বক্তৃতা লিপিবদ্ধ করতে থাকেন এবং শেখ হাসিনাও সাংবাদিকদের নজরে রাখেন। কিন্তু রাতের অন্ধকারে শেখ হাসিনা সাংবাদিকদের আর নজরে রাখতে পারেননি। ওদিকে শেখ হাসিনা বারবার একই বক্তৃতা দেওয়ায় সাংবাদিকদের তা মুখস্ত যাওয়াতে অনেক সাংবাদিকই রাতের অন্ধকারে ট্রেন থেকে নেমে শেখ হাসিনার বক্তৃতা লিপিবদ্ধ করতে যায়নি।

রাত তখন এগারোটা সতর মিনিট। শেখ হাসিনাকে বহনকারী ট্রেন ঈশ্বরদি রেলস্টেশন পৌঁছার কিছু সময় বাকি রয়েছে। এমন সময় বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা বললেন, এত টাকা- পয়সা খরচ করে জামাই আদর করে ঢাকা থেকে যে সাংঘাতিকদের (সাংবাদিক) এনেছি তারা কি সব ঘুমাচ্ছে ? জনসভায় এতো লোক হচ্ছে, আমি এতো বক্তৃতা করছি, সাংঘাতিকদের (সাংবাদিক) নজরে পড়ছে না তো ! তোমরা একটু সাংঘাতিকদের (সাংবাদিক) ঘুম ভাঙ্গিয়ে আমার (শেখ হাসিনার) জনসভায় পাঠাও যাতে পত্র-পত্রিকায় ভাল নিউজ হয়।

বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার বেতনভুক ব্যাগ বহনকারী মদন মোহন দাস (যার নামে শেখ হাসিনার লাল রঙের নিশান পেট্রোল জীপ গাড়িটি রেজিস্ট্রেশন করা) বলল, ডাইকা ঘুম ভাঙ্গান লাগব না। পিস্তল দিয়া রাউন্ড গুলি কইরা দিলেই সাংঘাতিকগো ঘুম কই যাইব, লাফাইয়া ট্রেন থাইকা নিচে পইড়া যাইব।

আলাউদ্দিনের প্রদীপ পাওয়ার মত সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা তার বাবার ফুফাতো ভাইয়ের ছেলে বাহাউদ্দিন নাসিমকে (বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এ পি এস) বললেন, দে দুই রাউন্ড গুলি করে।

আর উপস্থিত অন্যদের বললেন, তোমরা আমাকে (শেখ হাসিনাকে) হত্যার জন্য ট্রেনে গুলি করা হয়েছে বলে সাংঘাতিকদের (সাংবাদিক) মাঝে প্রচার করে দেবে। ট্রেন ঈশ্বরদি প্ল্যাটফর্মে ঢোকার কয়েক মিনিট আগে বাহাউদ্দিন নাসিম ট্রেনের জানালা দিয়ে সাংবাদিকদের কম্পার্টমেন্ট লক্ষ্য করে পিস্তল দিয়ে তিন (৩) রাউন্ড গুলি ছুঁড়লো। গুলির শব্দ শুনে শেখ হাসিনার নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত স্পেশাল ব্রাঞ্চের পুলিশেরাও পাঁচ-ছয় রাউন্ড গুলি করে। এই সমস্ত গুলির আওয়াজ শুনে পাশের কম্পার্টমেন্টে থাকা সাংবাদিকরা ভয়ে ট্রেনের ভেতরে গড়াগড়ি শুরু করে এবং আমরা পরিকল্পনামতো সাংবাদিকদের কম্পার্টমেন্টে এসে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য ট্রেনে গুলি করা হয়েছে বলে প্রচার করতে থাকি। ট্রেন ঈশ্বরদি প্ল্যাটফর্মে থামলে, ঈশ্বরদি রেলস্টেশনের জনসভার মঞ্চ থেকেও মাইকে আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়াম সদস্য আমির হোসেন আমু বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য ট্রেনে গুলি করা হয়েছে বলে প্রচার চালাতে থাকেন। পরের দিন ২৪শে সেপ্টেম্বর শনিবার ট্রেনে বঙ্গবন্ধু কন্যার প্রতি গুলি করা হয়েছে বলে জাতীয় পত্র-পত্রিকায় সংবাদ বের হলে, বগুড়া সরকারী সার্কিট হাউসের ভি ভি আই পি রুমে বসে জননেত্রী শেখ হাসিনাসহ তার সফর সঙ্গীরা (যারা প্রকৃত ঘটনা জানে) হাসাহাসি করতে থাকে এবং হাসাহাসির এক পর্যায়ে গুলির এই ঘটনা নিয়ে হরতাল ডাকার সিদ্ধান্ত হয়।

 

স্বামী স্ত্রী-রাত ও কাটায়নি

১৯৯৪ সালের ২৮শে ডিসেম্বর শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদ সদস্যপদ থেকে পদত্যাগ করলেন। ২৯ নং মিন্টু রোডে সরকারী বাসা ত্যাগ করে ধানমণ্ডি পাঁচ নম্বর রোডের চুয়ান্ন নম্বর বাড়িতে উঠলেন। ধানমণ্ডির বাড়িটি প্রথম ও দ্বিতীয় তলা শেখ হাসিনার পরিত্যক্ত স্বামী ডঃ ওয়াজেদ মিয়ার নামে। আর তৃতীয় তলা শেখ হাসিনার নিজের নামে। শেখ হাসিনার অবহেলিত ও পরিত্যক্ত স্বামী বৈজ্ঞানিক ডঃ ওয়াজেদ মিয়া এই বাড়িটি করার সময় দ্বিতীয় তলা করার পর টাকা ফুরিয়ে গেলে শেখ হাসিনার কাছে ধার চায়। তখন শেখ হাসিনা তৃতীয় তলা তার নিজের নামে লিখে নিয়ে তারপর ডঃ ওয়াজেদকে টাকা দেন। অবশ্য এই বাড়িতে ডঃ ওয়াজেদ মিয়া আর শেখ হাসিনা এক সঙ্গে একটি রাতও কাটাননি।

শুধু এই বাড়িতে কেন, ১৯৮১ সালের ১৭ই মে শেখ হাসিনা বাংলাদেশে আসার পর থেকেই ১৯৯৭ সালের ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত (এর পরের অবস্থা জানা নেই যদিও, তথাপি বোঝা যায়, পাঠক যে দিন পড়বেন, সে দিন পর্যন্ত ধরে নিতে পারেন) এই ১৬/১৭ বছর এক সঙ্গে স্বামী- স্ত্রী হিসেবে রাত কাটানো তো দূরের কথা, এক বাড়িতেই কখনো থাকেননি। ১৯৮১ সালে ১৭ই মে বাংলাদেশে আসার পর মাত্র কিছুদিন শেখ হাসিনা ডঃ ওয়াজেদ মিয়ার মহাখালীস্থ সরকারী কোয়ার্টারে ছিলেন। শেখ হাসিনা যতদিন ডঃ ওয়াজেদ মিয়ার সরকারী কোয়ার্টারে থেকেছেন, ততদিন ডঃ ওয়াজেদ মিয়া তাঁর কোয়ার্টারে না থেকে সরকারী রেস্ট হাউসে থাকতেন। এরপর শেখ হাসিনা ধানমণ্ডিস্থ তাঁর পিত্রালয় বঙ্গবন্ধু ভবনে চলে আসেন। বঙ্গবন্ধু ভবন থেকে যান বিরোধী দলীয় নেত্রীর ২৯ মিন্টু রোডের সরকারী বাসভবনে। তখন শেখ হাসিনা এবং তার স্বামী ডঃ ওয়াজেদ মিয়ার ধানমণ্ডি ৫ নম্বর রোডের ৫৪ নম্বর বাড়িটি ভাড়া দেওয়া ছিল। ১৯৯৪ সালে ডিসেম্বর মাসে ধানমণ্ডি ৫ নম্বর রোডের ৫৪ নং বাড়িটির ভাড়াটিয়াদের এক প্রকার জোর করে তাড়িয়ে দিয়ে খালি করা হয় এবং তারপর বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা এই বাড়িতে আসেন। এই বাড়িতে থেকেই নানা আন্দোলন সংগ্রাম এবং নির্বাচনের পর জননেত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হয়ে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন করতোয়া, বর্তমানে গণভবনে গিয়ে ওঠেন। শেখ হাসিনার এই দীর্ঘ ১৬/১৭ বছরের জীবনে ডঃ ওয়াজেদ মিয়া একটি রাতও শেখ হাসিনার সাথে কাটাননি। এমন কি এই ১৬/১৭ বছরের জীবনে শেখ হাসিনা আর ডঃ ওয়াজেদ মিয়ার ১৬/১৭ বারও দেখা পর্যন্ত হয়নি। তবে হঠাৎ হঠাৎ মাঝে মধ্যে কদাচিৎ উদ্ভ্রান্তের মত ডঃ ওয়াজেদ মিয়া এসে হাজির হতেন। কিন্তু তিনি (ডঃ ওয়াজেদ মিয়া) শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে কোন প্রকার আদর-আপ্যায়ন পেতেন না। এমন কি সাধারণ সৌজন্যটুকুও শেখ হাসিনা ডঃ ওয়াজেদ মিয়াকে দেখাতেন না।

শেখ হাসিনা যখন বিরোধী দলীয় নেত্রী হিসেবে ২৯ মিন্টু রোডের সরকারী বাসায় থাকতেন, তখন এক ঈদের দিনে সাধারণ দর্শনার্থীদের মাঝে সাধারণ মানুষের মতোই ডঃ ওয়াজেদ মিয়া শেখ হাসিনার সঙ্গে ঈদ মোবারক জানাতে এলেন। কিন্তু শেখ হাসিনা আগত সকলের কুশলাদি বিনিময় করলেও তার স্বামী ডঃ ওয়াজেদের সাথে কোন প্রকার কুশলাদি বিনিময় দূরে থাক, ভ্রুক্ষেপই করলেন না। এমন কি তাকে (ডঃ ওয়াজেদ মিয়াকে) বসতে পর্যন্ত কেউ বললেন না। ডঃ ওয়াজেদ মিয়া কিছুক্ষণ করুণভাবে ফ্যালফ্যাল করে শেখ হাসিনার দিকে তাকিয়ে থেকে ধীরে ধীরে ঘর থেকে বেরিয়ে লনে, লন থেকে অসহায়ের মতো হাঁটতে হাঁটতে গেটের বাইরে চলে গেলেন। একমাত্র শেখ হাসিনা আর তার খুবই ঘনিষ্ঠ কয়েকজন ছাড়া কেউ জানলো না, বুঝলো না এই ব্যক্তিটি কে !

অনেকবার অসুস্থ হয়ে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতালে মাসাধিক কাল পড়ে থাকলেও শেখ হাসিনা একটি বারের জন্যও তার স্বামী ডঃ ওয়াজেদ মিয়াকে দেখতে যেতেন না।

 

অদ্ভুত চরিত্র, কর্ম ও ভাগ্য

শেখ হাসিনার স্বামী ডঃ ওয়াজেদ মিয়া শেখ হাসিনাকে দৈহিক নির্যাতন করতেন, মারধর করতেন, এ কথা শেখ হাসিনা অসংখ্য বার কেঁদে কেঁদে বলেছেন। শেখ হাসিনার কান্নায় ময়নার চোখেও পানি ঝরেছে। কিন্তু কেন স্বামী তাকে মারতেন, দৈহিক নির্যাতন করতেন, এই কথা শেখ হাসিনা কখনই বলেন নি। এ এক অদ্ভুত চরিত্র, কর্ম ও ভাগ্যের অধিকারী শেখ হাসিনা। বিদেশ থেকে একমাত্র কন্যা পুতুল এসে মা শেখ হাসিনাকে ডাকে ‘এই যে বহুরূপী’ তোমার তো রূপের শেষ নেই। এবার কি রূপ দেখাবে তুমি।

শেখ হাসিনা কোন কথা বললে সঙ্গে সঙ্গে মেয়ে পুতুল আত্মীয়-স্বজন সকলের সামনে বলে ওঠে, এটা তোমার কত নম্বর রূপ ! শেখ হাসিনার ছোট বোন শেখ রেহানাকে পুতুল বলে, খালা এটা তোমার বোনের কত নম্বর রূপ? তোমার বোন তো বহুরূপী। রূপের শেষ নাই তার। বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা তৎক্ষণাৎ চুপ মেরে যান। কোন কথা বলেন না, শেখ হাসিনা মেয়ে পুতুলকে তার (পুতুলের) নিজের বিয়ের প্রস্তাব দিলে কোন রকম টালবাহানা না করে বিনা বাক্যে মুহূর্তের মধ্যে সটান এক পায়ে দাঁড়িয়ে রাজি হয়ে যায়। মনে হয় যেন কারো হাত ধরে মুক্তি পেতে চায় পুতুল। শেখ হাসিনাও যেনতেন পাত্রের কাছে পুতুলকে বিয়ে দিতে যুক্ত হতে চান।

বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা বিদেশে বসবাসরত একমাত্র পুত্র জয়কে ফোন করে দেশে এসে বেড়িয়ে যেতে বলেন এবং আসার সময় তার (শেখ হাসিনার) জন্য একটা শাড়ি নিয়ে আসতে বললে, পুত্র জয় সরাসরি অস্বীকার করে বলে, “ও সব শাড়িটাড়ি আমি আনতে পারবো না।” শেখ হাসিনা আবার উপস্থিত সকলকে বলে, দেখ, আমার সন্তান দেখ, আমার জন্য একটা শাড়ি আনতে বললাম। ছেলে আমার সরাসরি না করে দিল।

মা হিসেবে পুত্র-কন্যার প্রতি শেখ হাসিনার আচার-আচরণে কোনদিন কোন ত্রুটি চোখে পড়েনি। বরং মনে হয়েছে মা হিসেবে শেখ হাসিনার তুলনা নেই। তারপরও আশ্চর্যের বিষয় ! শেখ হাসিনার প্রতি তার পুত্র-কন্যার কেন এ রকম আচরণ?

 

রাজাকারের ছেলের সাথে বিয়ে দেব না

শেখ হাসিনা তার কন্যা পুতুলের বিয়ে ঠিক করলে ধানমণ্ডিস্থ বাড়িতে শেখ হাসিনার স্বামী ডঃ ওয়াজেদ মিয়া এসে ক্ষিপ্ত হয়ে শেখ হাসিনাকে বলতে লাগলেন, মেয়ে কি তোমার একার? মেয়ে কি আমার না? তুমি রাজাকারের ছেলের কাছে আমার মেয়ের বিয়ে ঠিক করেছ? রাইফেল হাতে নিয়ে যে রাজাকারগিরি করেছে, মুক্তিযোদ্ধা মেরেছে, তার ছেলের সঙ্গে আমি কিছুতেই আমার মেয়ে বিয়ে দেব না। তুমি আমার মেয়েকে ঐ রাজাকারের ছেলের সাথে কিছুতেই বিয়ে দিতে পারবে না।

জননেত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা বললেন, আমি মেয়ে বিয়ে দেব। পারলে তুমি ঠেকাও। ডঃ ওয়াজেদ বললেন, তাই বলে তুমি রাজাকারের ছেলের সাথে মেয়ে বিয়ে দেবে? বঙ্গবন্ধু কন্যা বললেন, কিসের আবার রাজাকার ফাজাকার? আমার আত্মীয় এটাই বড় কথা। সাথে মরলে আত্মীয়রাই মরে। দেখনি ঐ মুক্তিযোদ্ধা ফুক্তিযোদ্ধারাই আমার বাপ-মা ভাইদের কিভাবে মেরেছে, আমি আমার মেয়েকে এখানেই বিয়ে দেব। পারলে তুমি ঠেকাও ৷ ডঃ ওয়াজেদ মিয়া বললেন, তোমাদের সাথে তো আমি ঠেকাঠেকিতে পারব না। তবে আমি বলে দিচ্ছি আমার মেয়েকে যদি রাজাকারের ছেলের সাথে বিয়ে দেও তবে আমি এই বিয়ের সাথে নেই । বিয়েতে আমি আসবো না। আমি তোমাকে অনুরোধ করছি, ঐ রাজাকারের ছেলে ছাড়া যেখানে খুশি সেখানে তুমি মেয়ে বিয়ে দাও, আমি তোমার সাথে থাকবো। কিন্তু রাজাকারের বংশের কাছে মেয়ে বিয়ে দিলে আমি থাকবো না।

বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা তার স্বামী ডঃ ওয়াজেদের কথা রাখলেন না। তিনি তার ইচ্ছেমতো রাজাকারের ছেলের সঙ্গেই মেয়ে বিয়ে দিলেন। সত্যি সত্যিই ডঃ ওয়াজেদ কথা পাকাপাকি পান চিনি, গায়ে হলুদ এবং বিয়ে কোথায়ও আসলেন না। শুধু বিয়ের অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে মিনিট ৩/৪-এর জন্য এসে আবার খালেদা জিয়ার সঙ্গেই চলে গেলেন। তিনি কারো সাথে কোন কথা বললেন না। কেউ তাঁর সঙ্গে কোন কথা বললো না। বিয়ের খুঁটিনাটি থেকে শুরু করে যাবতীয় যা আয়োজন তার সিংহভাগই করতে হয়েছে আমাদের (প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক অবাঞ্ছিত ঘোষিত এক নম্বর মতিয়ুর রহমান রেন্টু, দুই নম্বর মিসেস মতিয়ুর রহমান রেন্টু, ময়না) এর উপর বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার বাবার ফুফাতো ভাইয়ের ছেলে বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এ পি এস বাহাউদ্দিন নাসিমের বায়না তো ছিলই। ডেকোরেটরের বিল, বাবুর্চির বিল, খানসামার বকশিস ইত্যাদি যখন যা প্রয়োজন হয়েছে, বাহাউদ্দিন নাসিম তার সব কিছুই আমাদের কাছ থেকেই নিয়েছে।

 

সব যান বের হন

বিয়ের অনুষ্ঠানে বিয়ে পড়ানোর জন্য কাজীর সামনে একটি মাইক লাগানো হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা হঠাৎ সেই মাইক দিয়ে বিয়ের অনুষ্ঠানে আগতদের ঢালাওভাবে ধমকের সুরে বলতে লাগলেন, সব যান বের হন, কি পেয়েছেন? তামাশা পেয়েছেন? এখনই এই জায়গা থেকে চলে যান। নইলে অসুবিধা হবে।

বঙ্গবন্ধু কন্যার মুখে মাইকে এই কথা শুনে উপস্থিত সকলে হতবিহ্বল, কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যায় এবং অনেকেই আগা-মাথা না বুঝে অনুষ্ঠান থেকে চলে যেতে শুরু করলে, ময়না তাড়াতাড়ি জননেত্রীর কাছে এই কথার অর্থ কি জানতে চাইলে শেখ হাসিনা বলেন, দাওয়াত ছাড়াই অনেকে এসেছে, তাদের জন্য আমি এই কথা বলেছি। এরপর ময়না নিমন্ত্রিত অতিথিদের অনেককে বোঝাবার চেষ্টা করেছে, কিন্তু তাতে ফল হয়নি। অধিকাংশ নিমন্ত্রিত অতিথিই না খেয়ে চলে যায়।

বিয়ের সকল অনুষ্ঠান শেষ। সকলেই চলে গেছে। শুধু বর (জামাই) আর বরের আত্মীয়- স্বজনরা রয়েছে। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা তার কন্যা পুতুলকে বরের গাড়িতে তুলে দিয়ে ময়নাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। তারপর জননেত্রী শেখ হাসিনা ময়নাকে বললেন, ময়না আজ আর তুমি আমাকে ছেড়ে যেও না।

বিয়ের অনুষ্ঠানস্থল সংসদ ভবন চত্বর থেকে শেখ হাসিনার সঙ্গে আমাদের একমাত্র সন্তান পাঁচ বৎসরের স্বর্ণলতাকে সাথে নিয়ে ধানমণ্ডি ৫ নম্বর রোডে শেখ হাসিনার ৫৪ নম্বর বাড়িতে চলে এলাম। বাড়িতে এসে বাইরের কাপড় পাল্টে সবাইকে নিয়ে মাটিতে গোল হয়ে বসে জননেত্রী শেখ হাসিনা ময়নাকে বললেন, ময়না তোমরা যা করলে, তোমাদের ঋণ জীবনে শোধ করা যাবে না। কোনদিন তোমাদের ভোলা যাবে না। কোনদিন তোমাদের ভুলব না। আমাদের মেয়ে স্বর্ণলতাকে দেখিয়ে বললেন, ও তো পেটে থেকেই আমাকে ভালবাসে।

অবশ্য এসব কথা শেখ হাসিনা আজ নতুন বলছেন না, এর আগেও অনেক বার এসব কথা তিনি বলেছেন।

 

এক কোটি সাতত্রিশ লাখ টাকা

১৯৯৫ সাল। ১০ই জানুয়ারী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস। ধানমণ্ডি বঙ্গবন্ধু ভবনে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে রাম মোহন দাসের নামে রেজিস্ট্রি করা লাল রঙের নিশান পেট্রোল জীপে করে ফিরে আসছেন শেখ হাসিনা। তার সঙ্গে পাশে বসে আছে তার একজন মাত্র সঙ্গী। ড্রাইভার জালাল গাড়ি চালাচ্ছে। ড্রাইভার জালাল বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে জিজ্ঞেস করল, আপা মেয়র হানিফ এল না ফুল দিতে? শেখ হাসিনা জবাব দিলেন, কে জানে। বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে ফুল দেওয়ার জন্য ওকে কম ফোন করি নি। ওর কাছে কম লোক পাঠাইনি। তারপর বেঈমানটা আসে নি। শয়তানটা পাত্তাই দেয় নি। এক কোটি সাত্রতিশ লাখ টাকা খরচ করে নিমকহারামটাকে আমি মেয়র বানিয়েছি। তোমরা তো সব জান, সবই দেখেছ, সবই করেছ। কত কষ্ট করেছি আমি। আসলে যে দল থেকে একবার চলে যায় তাকে আর দলেই নেওয়া উচিত না। ও মেয়র হওয়ার জন্য আমার সাথে বেঈমানী করে স্বৈরাচারী এরশাদকে বাপ ডেকে এরশাদের পার্টিতে চলে গেছিল। সেখানে ছেক খেয়ে আবার আমার কাছে ফিরে যখন আসলো তখনই বেঈমানটারে নেওয়া উচিত ছিল না। কিন্তু কি যে হলো ! কি মনে করে যে আবার নিলাম। শয়তানটা আমার সাথে এত বড় বেঈমানী করবে বুঝতে পারি নি। বুঝলে কি আর এই কাম করি।

 

নেত্রী এখন নামাজ পড়ছেন

বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ১৯৯৪ সালের শেষ মুহূর্তে ধানমণ্ডি বাড়িতে উঠেই, ‘৯৫ সালের জানুয়ারীর প্রথম থেকেই জোেরশোরে লাগাতার আন্দোলন, সংগ্রাম, হরতাল, পদযাত্রা ইত্যাদি শুরু করলেন। দুপুর দু’টায় টঙ্গি থেকে মহাখালী পর্যন্ত পদযাত্রা শুরু হলো। অর্থাৎ টঙ্গি থেকে সবাই পায়ে হেঁটে মহাখালী যাবেন। মহাখালীতে মঞ্চ তৈরি করা আছে, পদযাত্রা শেষে এই মঞ্চ থেকে শেখ হাসিনা ভাষণ দেবেন। শেখ হাসিনা তার বেতনভুক ব্যাগ বহনকারী রাম মোহন দাসের নামে রেজিস্ট্রেশন করা লাল রঙের নিশান পেট্রোল জীপে করে, বাকি সব নেতা- কর্মী পায়ে হেঁটে, টঙ্গি থেকে মহাখালীর দিকে রওয়ানা হল। প্রায় পাঁচ-সাত হাজার লোকের পদযাত্রা। হাজার লোকের ঠিক মাঝখানে শেখ হাসিনা জীপে করে পদযাত্রার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলছেন। পদযাত্রার মাঝে মাঝে গোটা বিশেক রিক্সায় মাইক বেঁধে নানা ধরনের শ্লোগান দেওয়া হচ্ছে। জানুয়ারী মাস, শীতের বেলা। হাঁটতে খুব একটা খারাপ লাগছে না । দুপুর গড়িয়ে বিকেল হবে হবে। হঠাৎ একটি মাইকে বলা হল জননেত্রী শেখ হাসিনা এখন আসর নামাজ পড়ছেন।

সঙ্গে সঙ্গে সবগুলো মাইক থেকে বলা শুরু হল জননেত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা এখন আসর নামাজ পড়ছেন। ঘড়িতে তখন সোয়া তিনটা বাজে।

প্রেসিডিয়াম সদস্য তোফায়েল আহমেদ (বর্তমানে শেখ হাসিনার শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রী) বললেন, আরে থামো থামো এখনও আসর ওয়াক্তই হয় নি। একটু পরে বল।

এই কথা শুনে সব নেতারা হাসাহাসি শুরু করল। এদিকে বঙ্গবন্ধু কন্যা নিশান পেট্রোল জীপের বড় বড় জানালার গ্লাস খুলে নামাজ পড়তে শুরু করলেন। আর পদযাত্রার হাজার হাজার পুরুষ জীপ গাড়ি ঘিরে শেখ হাসিনার নামাজ পড়া দেখতে লাগল। নামাজ শেষ হয়ে গেল কিন্তু মাইকে নামাজ পড়ার প্রচার শেষ হলো না। প্রায় এক ঘন্টারও বেশি সময় গোটা বিশেক মাইকে শেখ হাসিনা নামাজ পড়ছেন প্রচার করা হল।

অন্য আর একদিন মোহাম্মদপুর থেকে পদযাত্রা শুরু হয়ে গুলশান আমেরিকান এম্বেসির সামনে দিয়ে বাড্ডায় যেয়ে শেষ হবে। পদযাত্রা শুরু হলে শেখ হাসিনা ডেকে বললেন, নামাজের ওয়াক্ত হওয়ার পরে যেন মাইকে বলা শুরু করে। ওয়াক্তের আগে যেন বলা শুরু না করে। এবার মাইক ম্যানদের আগে ভাগেই জননেত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশ জানিয়ে দেওয়া হল এবং আজ নামাজের ওয়াক্ত শুরু হওয়ার পরই মাইকে প্রচার শুরু হল। নেত্রীও যথারীতি নিশান পেট্রোল জীপের জানালা খুলেই নামাজ আদায় করলেন। হাজার হাজার পুরুষ মানুষ ও জীপ ঘিরে শেখ হাসিনার নামাজ আদায় দেখল। পদযাত্রা শেষে বঙ্গবন্ধু কন্যা তার ধানমণ্ডিস্থ বাসায় গেলে তার এক সঙ্গী বলল, আপা (শেখ হাসিনা) আপনি নামাজ পড়তে থাকলে মানুষ ভিড় করে আপনাকে দেখতে থাকে, এতে নামাজ নষ্ট হয়। আপনি নিশান পেট্রোল জীপে পর্দা লাগিয়ে নেন।

উত্তরে শেখ হাসিনা বললেন, না পর্দা লাগালে জীপের ডিসেন্সি থাকে না।

তখন ঐ সঙ্গী বলল, তাইলে আপা, আপনি জীপে বড় একটা চাদর রাখবেন, যখন নামাজ পড়বেন আমরা তখন ঐ চাদর দিয়ে জীপটা ঘিরে রাখব। যাতে আপনার নামাজ পড়া কেউ দেখতে না পারে।

জননেত্রী বললেন, না তোমরা তো সব ভাইয়ের মতো, চাদর লাগবে না।

 

আমার সাথে বেঈমানী করেছে

এর তিন দিন পড়ে কাঁচপুর থেকে গুলিস্তান পর্যন্ত পদযাত্রা। এই পদযাত্রায়ও ঐ একই মাইক, একই নামাজ, একই পুরুষ মানুষের ঘিরে রাখা। এই পদযাত্রার যোগ দিয়েছিল নোয়াখালি জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোঃ হানিফ। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নিশান পেট্রোল জীপের পাশে হাঁটতে হাঁটতে মোঃ হানিফ বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে জিজ্ঞেস করলেন, নেত্রী আমার মিতাকে দেখছি না?

নেত্রী বললেন, কোন মিতা?

জেলা সভাপতি বললেন, নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ঢাকার মেয়র মোঃ হানিফকে দেখছি না?

সভানেত্রী রেগে বলে উঠলেন, জানেন না, কুত্তার বাচ্চাটা আমার সাথে বেঈমানী করেছে। নিমকহারামী করেছে। ওরে আমি এক কোটি সাত্রতিশ লাখ টাকা খরচ করে মেয়র বানিয়েছি। আর কুত্তার বাচ্চাটা আমার সাথেই বেঈমানী করেছে। ও (ঢাকার মেয়র হানিফ) এখন প্রতিদিন খালেদা জিয়ার সাথে দেখা করে । দিনে তিন-চার বার খালেদা জিয়ার সাথে ফোনে কথা বলে । আর আমি খবর দিলেও আসে না। ফোন করলেও ধরে না। সময় আসলে এই বেঈমানদেরও শিক্ষা দিতে হবে। বুঝলেন, এই বেঈমানদের উচিত শিক্ষা দিতে হবে। আপনারা প্রস্তুত হন।

 

আওয়ামী লীগ সিদ্ধান্তের গুরুত্ব

১৯৯৫ সালে চাঁদপুর পৌরসভার নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত চেয়ারম্যান প্রার্থীর বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে আওয়ামী যুবলীগের এক কর্মী চেয়ারম্যান প্রার্থী হয় এবং যুবলীগের এই কর্মী আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে পরাজিত করে চাঁদপুর পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে যায়। আওয়ামী লীগের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে আওয়ামী লীগ মনো; প্রার্থীর বিরুদ্ধে যুবলীগ কর্মীর নির্বাচনে প্রার্থী হওয়াকে কেন্দ্র করে ধানমণ্ডি ৮ নম্বরে আওয়ামী ফাউন্ডেশন অফিসে আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠক বসে।

আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই বৈঠকে দলীয় শৃঙ্খলা রক্ষার বিষয়কে গুরুত্ব দেওয়া হয় এবং বিস্তারিত আলোচনা করা হয়। আলোচনায় বিশেষ গুরুত্ব সহকারে বলা হয়, আওয়ামী লীগের সিদ্ধান্তের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে যুবলীগ কর্মীর নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া দলীয় শৃঙ্খলা রক্ষার প্রয়োজনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। যদিও যুবলীগ প্রার্থী নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে পৌরসভার চেয়ারম্যান হয়েছে, তবুও তাকে শাস্তি দেওয়া অত্যন্ত জরুরী, কেননা সামনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। যুবলীগ কর্মী ও বর্তমানে চাঁদপুর পৌরসভার চেয়ারম্যানকে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অপরাধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না দিলে সংসদ নির্বাচনেও অনেকেই আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে প্রার্থী হয়ে যাবে। এসব বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার পর শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটি সর্বসম্মতিক্রমে যুবলীগ কর্মী চাঁদপুর পৌরসভার নব নির্বাচিত চেয়ারম্যানকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করার সিদ্ধান্ত নেয়।

পরদিন সকালে শেখ হাসিনার চাচাতো ভাই শেখ নাসেরের চতুর্থ ছেলে শেখ হেলালের চতুর্থ ভাই ২০/২২ বৎসরের যুবক শেখ রুবেল ধানমণ্ডি শেখ হাসিনার বাসায় এসে বঙ্গবন্ধু কন্যা আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে বলল, আপা তুমি চাঁদপুর পৌরসভার চেয়ারম্যানকে মালা দিয়ে বরণ করে নাও।

শেখ হাসিনা বললেন না, ওকে বহিষ্কার করব। শেখ রুবেল বলল, ও সবাইরে হারাইয়া (পরাজিত করে) চেয়ারম্যন হইছে ওরে মালা না দিয়া বহিষ্কার করবা এইটা তুমি (শেখ হাসিনা) কও কি? জলদি ওরে ডাইকা আইনা গলায় মালা দিয়া মিষ্টি খাওয়াও।

আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা বললেন, দূর গত রাতেই তো আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় ওয়ার্কিং কমিটি সিদ্ধান্ত নিছে ওকে বহিষ্কার করার।

শেখ রুবেল বলল, রাখ তোমার ওয়ার্কিং ফুয়ার্কিং কমিটি। ওয়ার্কিং কমিটি ফমিটির কথা তুমি শুইনো না। ওরা জানে কি? বেচারা জিতা আইছে কোথায় বাহ্বা দিবা। তানা এখন উল্টা কথা। বড় আপা তুমি চেয়ারম্যান হিসেবে অভিনন্দন পাঠাও। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা বললেন, তাইলে এক কাম করি, আগে বহিষ্কার করি পরে বহিষ্কার প্রত্যাহার করি।

শেখ রুবেল বলল দেখ, আমি তোমারে কইতেছি, এখনই চেয়ারম্যান হিসেবে অভিনন্দন জানাও আর ঢাকা আইনা মিষ্টি খাওয়াইয়া গলায় মালা দেও।

সভানেত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা বললেন, তাইলে তো এখনই জিল্লুর রহমান (আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক) কে বলতে হয়, নইলে আবার বহিষ্কারের চিঠি পাঠিয়ে দেবে। এতক্ষণে পাঠিয়ে দিয়েছে কিনা কে জানে।

বলেই সঙ্গে সঙ্গে ফোন করে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জিল্লুর রহমানকে বললেন, শুনেন, গতকাল রাতে ওয়ার্কিং কমিটি চাঁদপুর পৌরসভার চেয়ারম্যানকে বহিষ্কার করার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে ঐ চিঠিটা পাঠায়েন না। চেপে যান।

এরপর শেখ রুবেল চলে যাওয়ার জন্য সিঁড়িতে নেমে এলে বঙ্গবন্ধু কন্যা রুবেলের পথ আগলে দাঁড়িয়ে বলে, এই রুবেল-চাঁদপুরের চেয়ারম্যান-এর কাছ থেকে কত টাকা নিয়েছিস? আমার ভাগ দে।

শেখ রুবেল বলে, দূর সরো, যাইতে দাও।

নজিব বলে, আমার ভাগ দে নইলে যাইতে দিমু না। বড় আপারে কইয়া দিমু। শেখ রুবেল বলে, পরে নিও, পরে নিও। এখনও হাতে পাই নি। নজিব বলে, ঠিক আছে আমারে দিবি তো হ্যাঁ, দিমু।

 

জনতাকে শান্ত থাকার বক্তৃতা

১৯৯৫ সালের ২৪শে আগস্ট পুলিশ নিরাপদে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার নাম করে ইয়াসমিন নামে ১৪ বছরের এক কিশোরীকে দিনাজপুর যাওয়ার পথে ধর্ষণ ও হত্যা করে। এই খবর জানাজানি হয়ে গেলে পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ হলে, দিনাজপুরের মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে এবং দিনাজপুরের মানুষ পুলিশের বিরুদ্ধে মিছিল-মিটিং শুরু করলে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা দিনাজপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এডভোকেট আব্দুর রহিমসহ কয়েকজন জেলা নেতাকে অনতিবিলম্বে জরুরী ভিত্তিতে ঢাকায় তলব করেন। এডভোকেট আব্দুর রহিমসহ দিনাজপুরের পাঁচ নেতা ঢাকা এসে ধানমন্ডি বঙ্গবন্ধু ভবনের লাইব্রেরী রুমে বিকেল প্রায় পাঁচটায় বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন। বঙ্গবন্ধু ভবনের এই বৈঠকে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা আপনা-আপনি শুরু হওয়া দিনাজপুরবাসীর এই আন্দোলনকে যে কোন কিছুর বিনিময়ে প্রচণ্ড বিক্ষোভে রূপ দিয়ে বিস্ফোরণ ঘটানোর পরামর্শ ও নির্দেশ দেন। জননেত্রী শেখ হাসিনা বলেন, দিনাজপুরবাসীর এই বিক্ষোভকে নির্দলীয় খোলসে (আবরণে) রেখে খালেদা জিয়া সরকারের বিরুদ্ধে এই গণবিক্ষোভ আরো বেগবান, আরো চাঙ্গা করে গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টি করে খালেদা সরকারের পতন ঘটাতে হবে। এখন আর ঢাকার দিকে চেয়ে থাকলে চলবে না। এখন দিনাজপুর থেকেই শুরু করতে হবে এবং ঢাকায় এসে শেষ করতে হবে। প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে পুলিশের সাথে সংঘর্ষ করতে হবে। লাশের পর লাশ ফেলতে হবে। পুলিশের লাশও ফেলতে হবে। যত টাকা-পয়সা লাগে নিয়ে যান। তবু এই কর্মসূচী বাস্তবায়িত করতে হবে। ঐ পুলিশের মাঝেই লোক আছে, যাদের টাকা-পয়সা দিলে গুলি করে মানুষ মেরে লাশের স্তূপ লাগিয়ে দেবে। পুলিশের সাথেও কন্ট্রাক্ট করবেন, টাকা-পয়সা দেবেন। মনে রাখবেন যদি এগুলো সফল করতে পারেন তাহলেই কেবলমাত্র ক্ষমতার মুখ দেখতে পারবেন। নইলে জীবনে আর আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় নিতে পারবেন না। সারা দেশে যদি এসব দাঙ্গা-হাঙ্গামা, লুটতরাজ, খুন-খারাবি ছড়িয়ে দিতে পারেন, তবেই একমাত্র যদি ক্ষমতার মুখ দেখেন। ইয়াসমিন মইরা এসব ঘটানোর একটা সুযোগ করে দিছে, এখন এটাকে কাজে লাগান। মনে রাখবেন এসব অবশ্যই হতে হবে নির্দলীয় ব্যানারে। আওয়ামী লীগ নামের বিন্দু-বিসর্গও যেন না আসে । ফাল দিয়ে কেউ মঞ্চে যাবেন না । সব করবেন পিছন থেকে। পারতপক্ষে কোন ব্যাপারেই মুখ খুলবেন না। যদি মুখ খুলতেই হয় তাহলে দুনিয়ার যত ভাল ভাল কথা আছে তাই বলবেন । কাজে যাই হোক, মুখে রাখবেন শুধু ভাল কথা । আর সত্যিই যদি একটা লঙ্কাকান্ড ঘটিয়ে দিতে পারেন, তাহলে আমিও দিনাজপুরে আসবো। কিন্তু ওখানে আপনাদের সাথে আমার কোন কথা হবে না। আমি শুধু বক্তৃতায় বলে আসবো, ধৈর্য ধরুন, শান্ত থাকুন ইত্যাদি জাতীয় কথা। কিন্তু আপনারা আপনাদের কাজ পুরোপুরি চালিয়ে যাবেন। এখন ২০ লাখ টাকা নিয়ে যান। পরিস্থিতি বুঝে বাকি যা লাগবে ওখানেই পৌঁছে দেব। আমি শুধু কাজ চাই। টাকা নিয়ে যাওয়ার জন্য আপনাদের গাড়িটাড়ির ব্যবস্থা আছে? নইলে আমি টাকা নিয়ে যাওয়ার জন্য গাড়ির ব্যবস্থা করে দেই।

এডভোকেট আব্দুর রহিমসহ অন্যান্য নেতারা বঙ্গবন্ধু কন্যার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বন্ধবন্ধু ভবন ত্যাগ করে চলে গেল রাত তখন আটটা। ওদিকে দিনাজপুরে অপরাধী পুলিশ ইয়াসমীন হত্যাকাণ্ড ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করলে দিনাজপুরের জনতা আরো বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। বঙ্গবন্ধু ভবন থেকে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যাওয়ার ঠিক দুই দিন পরে, এডভোকেট আব্দুর রহিম ৫ নম্বর ধানমণ্ডির বাসায় ফোন করে জননেত্রী শেখ হাসিনাকে না পেয়ে, এই ম্যাসেজ বা সংবাদ দেন যে, নেত্রীকে বলবেন এখন পর্যন্ত পুলিশের কোন লাশ পাওয়ার সংবাদ পাওয়া যায় নি। তবে এখন পর্যন্ত পুলিশের গুলিতে নিহত সাত (৭) জন দিনাজপুরবাসীর লাশ পাওয়া গেছে। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা বাসায় ফিরলে তাকে এই ম্যাসেজ বা সংবাদ দেওয়া হলে তিনি সঙ্গে সঙ্গে তার নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত স্পেশাল ব্রাঞ্চের পুলিশদের আজ আর কোন কাজ নেই বলে বিদায় করে দিয়ে, ধানমণ্ডি ৮ নম্বর রোডে তার চাচাতো চাচা শেখ হাফিজুর রহমান টোকন-এর বাসায় গিয়ে দিনাজপুরে এডভোকেট আব্দুর রহিমের সঙ্গে কথা বলেন। বঙ্গবন্ধু কন্যা বলেন, ঠিক আছে চালিয়ে যান। আরো জোরে চালিয়ে যান। টাকা-পয়সা যা দরকার আপনি পেয়ে যাবেন। আর একটু জোরদার করেন। আমি আসছি।

অতঃপর বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা দিনাজপুর গেলেন । জনতাকে শান্ত থাকা ও ধৈর্য ধরার বক্তৃতা দিয়ে আবার ঢাকায় ফিরে এলেন এবং ফিরে এসে বললেন, না যত গুড় তত মিঠা হয়নি। অর্থাৎ যত টাকা খরচ করা হয়েছে তত ফল আসেনি।

 

খাতা-কলম গোলাবারুদ ও দিগম্বর কাহিনী

১২ ডিসেম্বর ১৯৯৪ সাল। বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ মতিঝিল শাপলা চত্বরে ছাত্রদের মহা সমাবেশের আয়োজন করেছে। মাত্র কয়েক দিন আগে প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া এই মতিঝিল শাপলা চত্বরেই বিএনপির ছাত্র সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলকে দিয়ে ছাত্রদের মহাসমাবেশ করেছেন। ছাত্রদলের এই মহাসমাবেশে প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া বক্তৃতায় বলেছেন, বিরোধীদলের মোকাবেলা করার জন্য ছাত্রদলই যথেষ্ট। ছাত্রদলের ঐ মহাসমাবেশের পাল্টা মহাসমাবেশ হিসেবেই বঙ্গবন্ধু কন্যা আজকের এই ছাত্রলীগের মহাসমাবেশের আয়োজন করেছেন এবং বেগম খালেদা জিয়ার ঐ বক্তৃতার পাল্টা জবাব হিসেবে শেখ হাসিনা আজ বক্তৃতা করবেন। বঙ্গবন্ধু কন্যা বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা বিকাল ৪টা ১৫ মিনিটে মঞ্চে উঠলেন। আজকের এই ছাত্রলীগের মহাসমাবেশের মঞ্চের একটা বিশেষ এবং উল্লেখযোগ্য দিক হলো কেবল ছাত্রলীগের নেতারা ও একমাত্র শেখ হাসিনা ছাড়া অন্য কোন আওয়ামী লীগ নেতাকে মঞ্চে উঠতে দেওয়া হলো না। মঞ্চের নিচে উত্তর দিকে আওয়ামী লীগ নেতাদের বসার ব্যবস্থা হলো। শেখ হাসিনা ছাত্রলীগের দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে মঞ্চে বসলেন। আওয়ামী লীগের নেতারা মঞ্চের নিচ থেকে মঞ্চে উঠে বক্তৃতা দিয়ে আবার মঞ্চের নিচে চলে গেলেন। বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা তার বক্তৃতায় ছাত্রদের লেখাপড়ায় বিশেষ মনোযোগ দেওয়ার উদার আহ্বান জানালেন এবং মঞ্চে উপস্থিত ছাত্রলীগের নেতাদের হাতেখাতা-কলম তুলে দিলেন। খাতা-কলম তুলে দেওয়ার মুহূর্তে ফটো সাংবাদিকদের ক্যামেরা বার বার ঝলসে উঠলো তার পরের দিন দেশের প্রায় সবগুলো জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় খাতা-কলম তুলে দেওয়ার ছবি ছাপা হল এবং ছাত্রদের লেখাপড়ায় মনোযোগ দেওয়ার শেখ হাসিনার আহ্বানকে পত্রিকার শিরোনাম করা হল। কিন্তু তার আগে ৯ই ডিসেম্বর শুক্রবার ১৯৯৪ বিকেল ৩টায় ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু ভবনের লাইব্রেরী কক্ষে শেখ হাসিনা ছাত্রলীগ নেতা অজয় কর, পঙ্কজ, হিমাংসু দেবনাথ, জ্যোতির্ময় সাহা, ত্রিবেদী ভৌমিক এবং আলমসহ মোট ৯ জনকে ডেকে এনে সামনের আন্দোলনে প্রয়োজন হবে বলে গোলাবারুদ ও অস্ত্রশস্ত্র কেনার জন্য নগদ এক লক্ষ টাকা দিয়ে বলেন, আগামী ২৮শে ডিসেম্বর জাতীয় সংসদ থেকে পদত্যাগ করার পর তোমরা ঢাকা শহরসহ সারা দেশে নজিরবিহীন ত্রাসের সৃষ্টি করবে। খালেদা জিয়ার পতন না পর্যন্ত প্রতিদিন ৫/১০টা লাশ অবশ্যই ফেলতে হবে। নইলে জিয়ার পতন হবে না। এর জন্য যত টাকা লাগবে তোমরা পাবে। টাকার কোন অভাব হবে না। তোমরা গোলাবারুদ ও অস্ত্রশস্ত্রের বিশাল মজুদ গড়ে তুলবে। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এই গুলি রাখবে না। কারণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশ রেড করলে এই সকল অস্ত্রশস্ত্র ও বোমা আমাদের হাত ছাড়া হয়ে যাবে। এসব জিনিষপত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে নিরাপদ জায়গায় রাখবে।

আর একটা দায়িত্ব তোমরা সিরিয়াসলি পালন করবে। সেটা হলো, এই যে, ইস্কাটন গার্ডেন রোড এবং ইডেন কলেজের পশ্চিম পার্শ্বে যে কোয়ার্টারগুলো আছে, সেগুলো সব সচিব- উপসচিবদের, আমি (শেখ হাসিনা) হরতাল দিলেও এই সচিব উপ-সচিবরা পায়ে হেঁটে ঠিকই সচিবালয়ে যায়। এরপর যখন আমি হরতাল দেব, তোমরা এদের বাসার কাছে ওঁত পেতে থাকবে, সেক্রেটারিরা (সচিবরা) হেঁটে সেক্রেটারিয়েট যেতে থাকবে, পথিমধ্যে তোমরা ওদের কাপড়-চোপড় খুলে ন্যাংটা করে ফেলবে।

ছাত্রলীগ নেতারা বলল, আমাদের দুই গ্রুপে ভাগ করে দেন। এক গ্রুপ গোলাবারুদ, অস্ত্রশস্ত্রের দায়িত্বে থাকি। আর অন্য গ্রুপ সচিবদের উলঙ্গ করার দায়িত্বে থাকুক। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা তখন আলমকে সচিবদের নেংটা করার দায়িত্ব দিলেন। এরপর অনেক হরতাল যায়। কিন্তু সচিবদের নেংটা করা হয় না। বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা তার পক্ষ থেকে সচিবদের কাপড় খুলে উলঙ্গ করার দায়িত্বপ্রাপ্ত আলমকে রোববার তাগিদ দেওয়া সত্ত্বেও যখন সচিবরা উলঙ্গ হচ্ছে না, তখন তিনি (শেখ হাসিনা) ঢালাওভাবে যাকে কাছে পান তাকেই সচিবদের নেংটা করার দায়িত্ব দিতে থাকেন। কিন্তু তারপরও সচিবরা উলঙ্গ হচ্ছে না দেখে শেখ হাসিনা ভয়ানক রেগে গেলেন এবং সচিবদের উলঙ্গ করার মূল দায়িত্বপ্রাপ্ত আলমকে নগদ বিশ হাজার টাকা দিয়ে বললেন, এই বিশ হাজার টাকা এখন দিলাম। বাকি আরো ত্রিশ হাজার টাকা সচিবদের নেংটা করার পর দেব এবং পরের হরতালেই নেংটা করতে হবে। নইলে পুরা টাকা ফেরত দিতে হবে।

ঠিকই পরের হরতালেই আলম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দোয়েল চত্বরের সামনে একজনকে উলঙ্গ করে ফেলল। ধানমণ্ডি ৫ নম্বর রোডের ৫৪ নম্বর বাড়িতে বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার কাছে এই উলঙ্গ করার সফলতার সংবাদ পৌঁছলে তিনি খুশিতে মিষ্টি খাওয়ানোর জন্য আলমকে ডেকে আনতে লোক পাঠান। কিন্তু আলম ততক্ষণে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে যায়। তার পরের দিন দেশের সকল সংবাদপত্রে দিগম্বর শিরোনামে ছবিসহ খবর ছাপা হল। জানা যায়, এই উলঙ্গ দিগম্বরের শিকার হওয়া ব্যক্তি একজন সচিব (সেক্রেটারি) নন। তিনি বাংলাদেশের একজন অতি সাধারণ নাগরিক। গো-বেচারা পাবলিক।

 

সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল নাসিমকে ক্ষমতা দখলের প্রস্তাব

কোন আন্দোলন, কোন সংগ্রামেই কাজ হচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া একতরফাভাবে আগামী ১৫ই ফেব্রুয়ারী সপ্তম পার্লামেন্টের নেত্রী হচ্ছেন এবং ২য় বারের মতো সংবিধান অনুযায়ী সরকার গঠন করতে যাচ্ছেন।

সপ্তম পার্লামেন্ট নির্বাচন, বিএনপির পুনরায় সরকার গঠন এবং খালেদা জিয়ার পুনরায় প্রধানমন্ত্রী হওয়া কিছুকেই যখন ঠেকানো যাচ্ছে না তখন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ১৭ই জানুয়ারী ১৯৯৬ সন্ধ্যায় শেখ রেহানার ননদের গুলশানের বাড়িতে কর্নেল তারেক সিদ্দিকী (শেখ রেহানার ভাসুর, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসেই সর্বপ্রথম তারেক সিদ্দিকীকে কর্নেল থেকে ব্রিগেডিয়ার পদে পদোন্নতি দেন এবং তার নিজস্ব সামরিক স্টাফ নিয়োগ করেন।) এর সাথে গোপনে আলোচনা করেন এবং তারেক সিদ্দিকীর মাধ্যমে সেনাবাহিনী প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল আবু সালেহ মোহাম্মদ নাসিম বীর বিক্রমকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করার প্রস্তাব দেন। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল নাসিমকে সামরিক অভ্যুত্থান করে বেগম খালেদা জিয়া সরকারকে উৎখাত করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করার প্রস্তাব দেন।

শেখ হাসিনা তার নিজের তরফ থেকে এবং তার দল আওয়ামী লীগের তরফ থেকে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল নাসিমকে ক্যু করার ব্যাপারে সার্বিক নিঃশর্ত সমর্থন ও সর্বপ্রকার সাহায্য-সহযোগিতা করার পূর্ণ আশ্বাস দেন। ১৯৮২ সালে বিএনপি সরকার উৎখাত করার জন্য জননেত্রী শেখ হাসিনা তখনকার সেনাবাহিনী প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুসাইন মোহাম্মদ এরশাদকে যেভাবে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন এবং সাহায্য-সহযোগিতা ও সমর্থনের আশ্বাস দিয়েছিলেন, ঠিক একইভাবে ১৯৯৬-এর মধ্য জানুয়ারীতে শেখ হাসিনা সেনাপ্রধান জেনারেল নাসিম বীর বিক্রমকে ক্ষমতা দখল করার জন্য সাহায্য-সহযোগিতা ও সমর্থনের আশ্বাস দিলেন। কিন্তু এবার সেনাবাহিনী প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল আবু সালেহ মোহাম্মদ নাসিম বীর বিক্রম বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার প্রস্তাবে সায় না দিয়ে উপরন্তু বলে পাঠালেন, আমি পেশাদার সৈনিক। পেশাদার সৈনিককে পেশাদার সৈনিকই থাকা উচিত এবং দেশে বর্তমানে যা চলছে তা রাজনৈতিক সংকট। রাজনীতিবিদদেরই এই রাজনৈতিক সংকট রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা ও নিরসন করতে হবে। সেনাবাহিনী এই সংকটে জড়িত হয়ে নতুন সংকট সৃষ্টি করবে না।

এরপরে জননেত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা প্রচণ্ড হতাশ হয়ে এই দেশে আর থাকা যাবে না বলে মন্তব্য করেন ৷

 

পুলিশের লাশ চাই, মিলিটারীর লাশ চাই

আজ ১০ই ফেব্রুয়ারী ১৯৯৬। সকাল ৯টা। জননেত্রী শেখ হাসিনা ধানমণ্ডিস্থ তাঁর নিজ বাসভবনের দ্বিতীয় তলায় ভি ভি আই পি ড্রয়িংরুমে ছাত্রলীগ সভাপতি এনামুল হক শামীম, সাধারণ সম্পাদক ইসাহাক আলী খান পান্না, নারায়ণগঞ্জের শামীম ওসমান (বর্তমানে আওয়ামী লীগ এম পি) অজয় কর, পঙ্কজ, নিরঞ্জন সাহা, দিপঙ্কর, অসিম, সাধন দাসসহ মোট এগার (১১) জনকে নিয়ে খুবই গুরুত্বপূর্ণ জরুরী এবং খুবই গোপন বৈঠকে বসেছেন। আসছে আগামী ১৫ই ফেব্রুয়ারী প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া এককভাবে জাতীয় সংসদ নির্বাচন করতে যাচ্ছেন। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা এই নির্বাচন বানচাল করার জন্য সর্বশক্তি দিয়ে মাঠে নেমেছেন। জীবন-মরণ লড়াই।

আজ বিকাল ৩টায় পান্থপথে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার সমাবেশ এবং এই সমাবেশ শেষে প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বাসভবন অভিমুখে মিছিল হবে। এই সমাবেশ ও মিছিলের বিষয়েই শেখ হাসিনা বৈঠকে বসেছেন। জননেত্রী শেখ হাসিনা অত্যন্ত জরুরী, গোপনীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশ ও কর্মসূচী দেওয়ার জন্যই এই বৈঠকে বসেছেন। জননেত্রী আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে ভীষণ চিন্তিত ও মলিন দেখাচ্ছে। কেউ কোন কথা বলছে না। তিনিও কোন কথা বলছেন না। সবাই চুপ করে বসে আছে। মনে হচ্ছে যেন, যুদ্ধে পরাজিত রাজ্যহারা রাণী আর তার সৈনিকেরা বসে আছে। হঠাৎ কান্না বিজড়িত বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে শেখ হাসিনা বললেন, আজ আমার একটি ভাইও বেঁচে নেই। যদি একটি ভাইও বেঁচে থাকত তাহলে আমি যে নির্দেশ দিতাম, যে কর্মসূচী দিতাম তা অবশ্যই পালন হত ৷ তোমরা কি আমার ভাই হতে পার না? অমি তো তোমাদের ভাই-ই মনে করি। তোমাদের মাঝেই আমার হারিয়ে যাওয়া ভাইদের খুঁজে পেতে চাই। কিন্তু তোমরা কি আমাকে বোন মনে কর? যদি তোমরা আমাকে বোন মনে কর, আর যদি সত্যি সত্যিই তোমরা আমার হারিয়ে যাওয়া ভাই হও। তাহলে এই কঠিন দিনে কঠিন কর্মসূচী পালন করার জন্য প্রস্তুত হও।

সকলেই আমার সাথে শপথ নাও, বলেই উপস্থিত সকলকে বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা শপথ বাক্য উচ্চারণ করালেন-“আমরা শপথ নিতেছি যে, যে কোন ধরনের কর্মসূচী বাস্তবায়ন করার জন্য আমরা জীবন উৎসর্গ করলাম এবং আমরা আরো শপথ করিতেছি যে, আমাদের নেত্রী শেখ হাসিনার যে কোন ধরনের নির্দেশ তা যত কঠিনই হোক না কেন জীবন দিয়ে পালন করবো।”

শপথ বাক্য পাঠ শেষ হলে, বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা বললেন, আজ আমি দশ (১০) টা পুলিশের লাশ চাই। ৫ (পাঁচ) টা মিলিটারির লাশ চাই।

পুলিশের লাশ চাওয়া বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নতুন কিছু নয়। অতীতে বহুবার তিনি পুলিশের লাশ চেয়েছেন। কিন্তু আজকের মতো এত আনুষ্ঠানিকতা, এতো নাটকীয়তা করে অতীতে কখনও তিনি পুলিশের লাশ চাননি। অতীতে তিনি (শেখ হাসিনা) মাঝে মধ্যেই বলতেন, পুলিশের লাশ চাই। পুলিশের লাশ চাই। কিন্তু কাউকে নির্দিষ্ট করে বলতেন না। খুব কড়া করেও বলতেন ন । হঠাৎ বিড়বিড় করে কথাগুলো বলতে থাকতেন। বঙ্গবন্ধু শেখ হাসিনা বিড়বিড় করে পুলিশের লাশ চাই, পুলিশের লাশ চাই বলতে থাকলেও কেউ তা শুনত না তা নয়। উপস্থিত সকলেই তা শুনত। কিন্তু কেউই তা গুরুত্ব দিত না এবং পালন করত না। জননেত্রী শেখ হাসিনা ‘পুলিশের লাশ চাই, পুলিশের লাশ চাই’ কথাগুলো হাওয়ার উপর ছেড়ে দিতেন। আর উপস্থিত সকলেই তার (শেখ হাসিনার) ন্যায় হাওয়াতেই কথাগুলো মিলিয়ে যেতে দিত। কিন্তু শেখ হাসিনা মন থেকেই এমন কিছু ঘটানোর জন্যই কথাগুলো বলতেন। অথচ কেউই শেখ হাসিনার কথা পালন করত না। পুলিশের লাশ ফেলত না। আর সেই জন্যই অ’জ ১০ই ফেব্রুয়ারী ১৯৯৬ এত আনুষ্ঠানিকতা, আর এত ভাবগম্ভীর পরিবেশে শপথের মাধ্যমে জননেত্রী শেখ হাসিনা ১০টা পুলিশের, ৫টা মিলিটারীর (সেনাবাহিনীর) লাশ চাইলেন। একটা ব্রিফকেস হাতে রুমে প্রবেশ করলো শেখ হাসিনার ফুফাতো ভাই (আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের ছেলে) আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহ (বর্তমানে জাতীয় সংসদের সরকারী দলের চীফ হুইপ)। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ব্রিফকেস খুলে ৫০০ (পাঁচশত) টাকার নগদ ১০টা বান্ডিল মানে ৫ লক্ষ টাকা ঢেলে দিয়ে বললেন, এই নাও, যাও কর্মসূচী বাস্তবায়িত কর। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ধানমণ্ডির বাসা থেকে রওয়ানা হয়ে বিকেল ৩-৩০ মিনিটে পান্থপথের সমাবেশের মঞ্চে উঠলেন। সমাবেশে হাজার তিনেক লোক জমায়েত হয়েছে। তিন-চার জন নেতার বক্তৃতাশেষে শেখ হাসিনা বক্তৃতা দিতে উঠলেন। বক্তৃতার শুরুতেই তিনি বললেন, আমরা প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বাসভবনে মিছিল নিয়ে যাব। আপনারা সকলেই মিছিলে অংশ নেবেন।

বঙ্গবন্ধু কন্যা যেই একথা বললেন আর অমনিই চতুর্দিকে থেকে বোমা পটকা, গুলি শুরু হল। মুহূর্তের মধ্যে সমবেত জনতা দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে কে কোথায় গেল তার হদিস পাওয়া গেল না। সমাবেশস্থল ফাঁকা, শূন্য হয়ে গেল। মঞ্চের নেতারা পড়ি কি মরি করে মঞ্চ থেকে লাফিয়ে পড়ে পালাতে লাগল। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে অতি কষ্টে মঞ্চ থেকে নামিয়ে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু ভবনে নিয়ে যাওয়া হল। পালানোর প্রতিযোগিতায় নেতারা কেউ কারো চেয়ে কম গেলেন না। এমন কি বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার মঞ্চের সিঁড়ি দিয়ে নামতে দেরী হচ্ছিল এই অবস্থায় পিছনে পড়ে যাওয়া এক নেতা (বর্তমানে মন্ত্রী) তাকে (শেখ হাসিনাকে) ধাক্কা মেরে নিচে ফেলে দিয়ে পালিয়ে যায়।

সমাবেশ ও প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বাসভবন অভিমুখে মিছিল কর্মসূচী ব্যর্থ হয়। পরে গোলযোগের কারণে পুলিশ সোনারগাঁ রোড, পান্থপথ গ্রীনরোড ইত্যাদি রোডে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দিলে, কলাবাগান রোডে যানজটে আটকে পাড়া বি আর টি সির দু’টি দোতলা বাস, তিনটি ট্রাক, তিনটি পিকঅ্যাপ গাড়ি, পাঁচটি প্রাইভেট কার, চারটি বেবী টেক্সী (স্কুটার) এবং ধানমন্ডি বত্রিশের সামনে শুক্রাবাদ পেট্রোল পাম্পে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নির্দেশে বঙ্গবন্ধু ভবনের স্টাফ (কর্মচারী) দিয়ে আগুন লাগিয়ে প্রতিশোধ হিসেবে জ্বালিয়ে দেওয়া হল। শেখ হাসিনা ধানমন্ডি বত্রিশের সামনে নিজ হাতে একটা স্কুটারে (বেবী ট্যাক্সি) আগুন লাগিয়ে দিলেন।

 

বেঈমানটা আসতেছে

বেগম খালেদা জিয়ার দল বিএনপি ১৫ই ফেব্রুয়ারী নির্বাচনের দিন ভোট কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিত করতে না পারায় এতদিন পর্যন্ত বিএনপির পক্ষে থাকা রাজনৈতিক মহল, প্রশাসন ও অন্যান্যরা এখন প্রকাশ্যে বিএনপির বিরোধিতা শুরু করে।

১৭ই ফেব্রুয়ারী শনিবার ১৯৯৬। দুপুর প্রায় ৩টা। ধানমন্ডি ৫ নম্বর রোডের বঙ্গবন্ধু শেখ হাসিনার ৫৪ নম্বরের বাড়ির উপরের তলায় ৮৬৮৭৭৯ টেলিফোন বেজে ওঠে। ফোনটি রিসিভ করে হ্যালো বলতেই, ফোনের অপর প্রান্ত থেকে ভেসে এল হ্যালো, আমি হানিফ, হানিফ ! কোন হানিফ?

আমি নগরের সভাপতি হানিফ, ঢাকার মেয়র।

আস্সালামু আলাইকুম হানিফ ভাই, আপনি?

হ্যাঁ আমি।

আপনি কে?

আমি……।

ও ভাল আছো ভাই? জ্বি ভাল। আমি একটু নেত্রীর সাথে কথা বলতে চাইছিলাম। অনেকদিন অসুস্থ ছিলাম। কথাবার্তা বলতে পারি নি, তাই এখন একটু বলতে চাই। নেত্রীকে একটু দেওয়া যায়?

জ্বী ধরেন, দেখছি নেত্রী কোথায় !

বঙ্গবন্ধু কন্যা ভাত খেয়ে বেসিনে হাত ধুচ্ছিলেন। বলা হলো আপা মেয়র ফোন করেছে ৷ নেত্রী হাত মুছতে মুছতে ফোনের দিকে হেঁটে আসতে আসতে বললেন, মহিউদ্দিন ভাই তো (চট্টগ্রামে সিটি করপোরেশনের মেয়র?

না, ঢাকার মেয়র।

শুনেই বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা থমকে গিয়ে আপন মনেই বলে উঠলেন, বেঈমানটা ! কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলেন। গভীর ভাবে কিছু একটা ভাবলেন। মনে হয় ফোন ধরবেন কি ধরবেন না চিন্তা করলেন। তারপর ধীর পায়ে এগিয়ে এলেন। ফোনটা ধরলেন, হ্যালো। না না এখানে না, এখানে না। বত্রিশে আসেন (বত্রিশ মানে ধানমণ্ডি বত্রিশ নম্বরে বঙ্গবন্ধু ভবনে) পবিত্র জায়গায় আসেন। পবিত্র জায়গায় বসেই আলোচনা করি।

হ্যাঁ, এক্ষুণি আসেন, হ্যাঁ, আপনি না আসা পর্যন্ত আমি আছি।

বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা টেলিফোনটি রেখে দিয়ে বললেন, চল চল বত্রিশে যাই। বেঈমানটা আসতেছে। চল বত্ৰিশ যাই।

সবাই মিলে ধানমণ্ডি বত্রিশ বঙ্গবন্ধু ভবনে যাওয়া হল। শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধু ভবনের গেটের বাইরে রাস্তায় পায়চারী করতে লাগলেন আর ঢাকার মেয়র মোহাম্মদ হানিফের অপেক্ষা করতে লাগলেন। মিনিট বিশেক পরেই বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা লাগানো জীপ গাড়িতে করে ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়র হানিফ বত্রিশে বঙ্গবন্ধু ভবনের সামনে এসে পৌঁছল। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা এগিয়ে গিয়ে নিজ হাতে মেয়র হানিফের জীপের দরজা খুললেন, আর বলতে লাগলেন, এই যে আগামী দিনের এল জি আর ডি মিনিস্টার। এল জি আর মিনিস্টার ছাড়া কি ঢাকার মেয়র চলতে পারে? এল জি আর ডি মিনিস্ট্রি তো আপনার। আপনিই তো এল জি আর ডি মিনিস্টার।

এই কথা বলতে বলতে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা মেয়র হানিফকে জীপ গাড়ি থেকে নামিয়ে এনে উপস্থিত সকলের সাথে মেয়র হানিফকে দেখিয়ে এই যে আগামী দিনের এল জি আর ডি মিনিস্টার বলে পরিচয় করিয়ে দিলেন। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার মুখে এই কথা শুনে মেয়র মোহাম্মদ হানিফ খুশিতে ডগমগ হয়ে বলল, নেত্রী যা বলেন, নেত্রী যা বলেন।

 

নায়ক, মন্ত্রী ও জনতার মঞ্চ

তারপর মেয়র হানিফকে বঙ্গবন্ধু ভবনের অফিস কক্ষে এনে শেখ হাসিনা বললেন, এই মিষ্টি আনো, মিষ্টি আনো, হানিফ ভাইকে মিষ্টি খাওয়াও।

মিষ্টি খেতে খেতে বঙ্গবন্ধু কন্যা বললেন, বঙ্গবন্ধু ছিলেন মহানায়ক, আর আপনি হলেন নায়ক। নায়ক না হলে কি চলে? সারা দেশ, জাতি এখন তাকিয়ে আছে নায়কের দিকে। মানে আপনার দিকে। নগরবাসী তাকিয়ে আছে আপনার দিকে। আমি এই পর্যন্ত এনে দিয়েছি, এখন আপনি ফিনিশিং দেন। এখন আপনার পালা। আপনি নায়ক, আপনার হাতেই সব। আমার হাতে আর কিছু নেই। আমার যা ছিল সব আমি করেছি। আপনি মেয়র, আপনিই নায়ক, এখন আপনি ফিনিশিং গোল করেন। আপনি ছাড়া ফিনিশিং হবে না। আপনার হাতেই ফিনিশিং হবে বলেই খেলা এখনও বাকি আছে।

আপনারাই তো বঙ্গবন্ধুকে শেখ মুজিব থেকে বঙ্গবন্ধু বানিয়েছেন। আপনারা যদি সেদিন আমার পিতাকে আশ্রয় না দিতেন, সাহায্য-সহযোগিতা না করতেন তাহলে কি আমার পিতা শেখ মুজিব থেকে জাতির পিতা হতে পারতেন? এই আপনারা ঢাকার মানুষেরা বানিয়েছেন। আজ আমি তার মেয়ে, আমাকে যদি আপনি সাহায্য না করেন আমি কি করে বড় হবো? আমার ভাইয়েরা কেউ বেঁচে নেই। আপনিই আমার ভাই। আমি আপনার বোন। আমাকে আপনি সহযোগিতা করেন। আমি কখনোই আপনার কথা ভুলব না। আপনাকে ছাড়া চলব না। ঢাকার মেয়র মোহাম্মদ হানিফ বলল, হ্যাঁ নেত্রী, আমাকে এক মাস সময় দেন, আমি খালেদা জিয়াকে ফেলে দেব।

বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা বললেন, না, না, একমাস সময় দেওয়া যাবে না। আপনি পনের দিনের মধ্যেই ফেলে দেন।

এই বৈঠকেই ঠিক হল প্রেসক্লাবের সামনে স্থায়ী মঞ্চ তৈরী করে এখান থেকেই যতক্ষণ বেগম খালেদা জিয়ার পতন না হয়, দিন-রাত ২৪ ঘন্টা স্থায়ী ভাবে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার পরবর্তী সময়ে নাট্যশিল্পী ও টিভির খবর পাঠক রামেন্দু মজুমদার ও নাট্যশিল্পী পিযুষ বন্দোপাধ্যায় এই মঞ্চের নাম দেন জনতার মঞ্চ।

প্রেসক্লাবের সামনের এবং সচিবালয়ের উত্তরের তোপখানা রোডের পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত অর্থাৎ পল্টনের মোড় থেকে হাইকোর্ট পর্যন্ত রাস্তা সম্পূর্ণ বন্ধ করে রাস্তার মাঝখানে বিশাল মঞ্চ তৈরী করে প্রতিদিন চলতে থাকলো গান-বাজনা, বক্তৃতা, আবৃত্তি ইত্যাদি। এক পর্যায়ে এই মঞ্চে এসে যোগ দিল সচিবালয়ের কিছুসংখ্যক কর্মকর্তা ও কর্মচারী। এ সবই চলতে লাগল ঢাকার মেয়র শেখ হাসিনার ভাষায় নায়ক ও আগামী দিনের এল জি আর ডি মন্ত্রী মোহাম্মদ হানিফের নেতৃত্বে।

 

শেখ হাসিনা জেনারেল নাসিমের মুখোমুখি বৈঠক

বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে, সপ্তম সংসদ একদিনের অধিবেশনে মিলিত হয়ে সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিধান করে সপ্তম সংসদ বিলুপ্ত বা বাতিল ঘোষণা করল এবং আগামী ১২ই জুন ১৯৯৬ ইংরেজিতে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এর তারিখ ঘোষণা করল এবং সুপ্রীমকোর্টের সাবেক প্রধান বিচারপতি মোহাম্মদ হাবিবুর রহমানকে প্রধান করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা হল।

সাবেক সেনাবাহিনী প্রধান (এরশাদ আমলের) অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল নূরুদ্দিন খান (বর্তমানে শেখ হাসিনার মন্ত্রী) এবং অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল সালাম (বর্তমানে আওয়ামী লীগ এমপি ও রেড ক্রিসেন্টের চেয়ারম্যান) এর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা সেনাবাহিনী প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল আবু সালেহ মোহাম্মদ নাসিম বীর বিক্রম-এর সাথে আলোচনার প্রস্তাব পাঠান। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার ঐ প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে নাট্যশিল্পী লুৎফুর নাহার লতা (বর্তমানে আমেরিকা নিবাসী) ও তার স্বামী অবসরপ্রাপ্ত মেজর নাসির সেনাপ্রধান জেনারেল নাসিমের সাথে শেখ হাসিনার বৈঠকের আয়োজন করে।

নাট্যশিল্পী লতা ও তার স্বামী মেজর (অবঃ) নাসির বনানীর কুলসুম ভিলা, ১১৭ বনানী ব্লক- ই, রোড-৪ এর ছায়াঘেরা সিরামিকের ৪ তলা ভবনের ৩য় তলার বাসায় শেখ হাসিনা এবং সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল নাসিমের মুখোমুখি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এই বৈঠকে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা আগামী ১২ই জুনের নির্বাচনে সেনাপ্রধান জেনারেল নাসিম এবং তার সৈনিকদের সাহায্য প্রার্থনা করেন। জবাবে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল নাসিম শেখ হাসিনাকে সার্বিক সাহায্য-সহযোগিতার পূর্ণ আশ্বাস দিয়ে বলেন, আপনি (শেখ হাসিনা) চাইলে এখন থেকে সেনাবাহিনী আপনার নির্দেশেই চলবে।

এর জবাবে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা বলেন, এটা যদি সত্যি হয় তবে ভবিষ্যতে আমিও আপনার নির্দেশেই চলব।

এই বৈঠকের পর থেকে সেনাবাহিনী প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল আবু সালেহ মোহাম্মদ নাসিম বীর বিক্রম বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার পরামর্শ ও নির্দেশেই সেনাবাহিনী পরিচালনা করতে থাকেন।

 

নৌকাঃ দুর্গা দেবীর বাহন

১৯৯৬-এর ১২ই জুন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক দল প্রার্থী মনোনয়ন দিল। আওয়ামী লীগও মনোনয়ন দিল। গোপালগঞ্জের তিনটি আসন এবং বাগেরহাটে দু’টি আসনের মোট ভোটারের প্রায় পঁয়ষট্টি শতাংশ ভোটার হিন্দু সম্প্রদায় হওয়ায় স্বাভাবিক কারণেই এই পাঁচটি আসনে আওয়ামী লীগ-এর নৌকামার্কা প্রার্থী ছাড়া অন্য কোন দলের অন্য কোন মার্কার প্রার্থী নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার কোনই সম্ভাবনা নেই এবং কোনকালেই বিজয়ী হয়নি এবং হবেও না। (১) মোকসেদপুর ও কাশিয়ানী, (২) গোপালগঞ্জ ও কাশিয়ানী (৩) টুঙ্গিপাড়া ও কোটালিপাড়া (৪) মোল্লার হাট ও ফকিরের হাট (৫) বইঠাঘাটা ও দাকোপ এই ৫টি (পাঁচ) আসনে যতদিন পর্যন্ত পঁয়ষট্টি শতাংশ হিন্দু সম্প্রদায় থাকবে ততদিন পর্যন্ত আওয়ামী লীগ প্রার্থী নৌকা মার্কায় একচেটিয়াভাবে বিজয়ী হতে থাকবে। এই পাঁচটি আসনের প্রার্থীদের এলাকায় কোন কাজ করতে হয় না। যে কোন প্রকারেই হোক বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগের নৌকা মার্কা টিকিট নিলেই সে যে কেউই হোক ৭৫% ভোটে বিজয়ী হবে। এই ৫টি আসনকে বলা হয় ভিক্ষার আসন। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা দয়া করে যাকে এই অঞ্চলের আসন ভিক্ষা দেবেন, তিনিই এই অঞ্চলের জনপ্রতিনিধি বা জাতীয় সংসদ সদস্য অর্থাৎ এমপি। এই অঞ্চলের লেখাপড়া প্রায় অজানা একজন প্রবীণ বৃদ্ধ হিন্দু লোককে কেন আওয়ামী লীগকে ভোট দেন জানতে চাইলে, ঐ প্রবীণ বৃদ্ধ হিন্দু লোকটি বলেন, আমরা আওয়ামী লীগ টিগ বুঝি না। আওয়ামী লীগকে ভোটও দেই না। আমরা ভোট দেই নৌকায় অর্থাৎ নৌকা মার্কায় ভোট দেই।

নৌকা মার্কায় কেন ভোট দেন জানতে চাইলে তিনি বলেন বারে, নৌকায় ভোট দেব না? নৌকা যে দেবীর বাহন। মা দুর্গা দেবী এই বাহনে (নৌকা) চড়েই স্বর্গ থেকে ধরায় এসেছিলেন, অসুর (পাপিষ্ঠ) কে দমন করার জন্য। আর আমরা যদি মা দুর্গার বাহন নৌকায় ভোট না দেই, তাইলে দেবীর বাহনের অমর্যাদা হবে। মা দুর্গা অভিসম্পাত দেবে। এ জন্য দেখেন না, ভোটের সময় আমরা সকলেই গিয়ে, মা দুর্গা দেবীকে খুশি করার জন্য মা দুর্গা, মা দুর্গা বলে নৌকা মার্কায় ভোট দিয়ে আসি। একজনও বাদ যাই না। সকলে গিয়ে নৌকা মার্কায় ভোট না দিলে মা দুর্গা অসন্তুষ্ট হবে। আমাদের অমঙ্গল হবে। তাই যত কাম থাকুক, যত ঝামেলাই থাকুক, কোন রকমে শুধু ভোটকেন্দ্রে যেতে পারলেই হলো। আমরা সকলেই গিয়া নৌকা মার্কায় ভোট দিয়ে আসবো।

 

রাজাকারের কাছে আসন বিক্রি

এই অঞ্চলের ৫টি আসনের ৩টি আসনে দাঁড়ালেন শেখ হাসিনা স্বয়ং। আর ১টি আসনে শেখ হাসিনার ফুফাতো ভাই শেখ সেলিম এবং মোকসেদপুর-কাশিয়ানীর অপর আসনটিতে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার বহুবার কথা দিয়েছেন। নিজের থেকেই যেচে পড়ে কথা দিয়েছেন। মতিয়ুর রহমান রেন্টুকে নানা ধরনের কাজ দিয়েছে, আর কাজ শেষে প্রতিবারই বলেছেন, তোমাকেই আমি (শেখ হাসিনা) মোকসেদপুর- কাশিয়ানীর এমপি বানাব। মতিয়ুর রহমান রেন্টুর স্ত্রী ময়নাকেও বহুবার বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা বলেছেন, তোমরা আমাদের জন্য যা করলে এবং যা করছো, তার ঋণ আমি কোনদিন শোধ করতে পারবো না। তোমাদের কথা কোন দিন ভোলা যাবে না। তবে রেন্টুকে (মতিয়ুর রহমান রেন্টু) আমি মোকসেদপুর- কাশিয়ানীর এমপি বানাব।

কিন্তু না, বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা কথা রাখলেন না। ওয়াদা রাখলেন না। কথা দিয়েও তিনি (বঙ্গবন্ধু কন্যা) কথা রক্ষা করলেন না। ওয়াদা করে ওয়াদার বরখেলাফ করলেন। ওয়াদা ভঙ্গ করলেন। যদিও বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা বক্তৃতায় অসংখ্যবার বেগম জিয়ার উদ্দেশ্যে বলেছেন, ওয়াদা ভঙ্গকারীকে আল্লাহ পছন্দ করে না। শুধু মতিয়ুর রহমান রেন্টু কেন? বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা মনোনয়ন দিলেন না সাবেক ছাত্রনেতা, ত্যাগী এবং সৎ নেতা ইসমত কাদির গামা, আবুল হাসান, মুকুল বোস এদের কাউকেই তিনি মোকসেদপুর-কাশিয়ানী থেকে মনোনয়ন দিলেন না। তিনি মনোনয়ন দিলেন এমন একজনকে যার বিরুদ্ধে সশস্ত্র রাজাকারীর অভিযোগ আছে।

কথিত আছে, লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফারুক ১৯৭১ সালে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক হানাদার বাহিনীর যোগসাজশে সশস্ত্র রাজাকার হয়েছিল। তাদের বাড়ীতে রাজাকারের ক্যাম্প বানিয়েছিল এবং ঐ অঞ্চলে পাকিস্তান সেনাবাহিনী নিয়ে অনেক বাড়ীঘর জ্বালিয়েছিল। তিনি (লেঃ কর্নেল ফারুক) প্রখ্যাত মুসলিম লীগ নেতা সালাম খানের দুরসম্পর্কের ভাতিজা । বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি রাজাকারীর অভিযোগে বাড়ীঘর ছেড়ে পালিয়ে যান। পরবর্তী কোন এক সময়ে সম্ভবত ‘৭২/৭৩ সালে যশোর থেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে ভর্তি হন। ২৫ বছর সেনাবাহিনীতে চাকুরী করে জেনারেল এরশাদের সাথে লাইন করে সাপ্লাই কোরে পোস্টিং নিয়ে প্রচুর টাকা-পয়সা কামান। মতিয়ুর রহমান রেন্টু, ইসমত কাদির গামা, আবুল হাসান, মুকুল বোস এরা সকলেই মুক্তিযোদ্ধা। এই মুক্তিযোদ্ধা ও ত্যাগী নেতাদের বাদ দিয়ে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা মোকসেদপুর-কাশিয়ানী থেকে মনোনয়ন দিলেন ‘৭১-এর রাজাকার এলপিআর-এ আসা লেঃ কর্নেল ফারুক খানকে। কিন্তু কেন? সেনাবাহিনীতে চাকরীরত অবস্থায় অসৎ পথে উপার্জিত অর্থ থেকে লেঃ কর্নেল ফারুক খান বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে এক কোটি টাকা দেন এবং এই নগদ টাকার বিনিময়ে শেখ হাসিনা মোকসেদপুর- কাশিয়ানী আসনটি এলপিআর-এ যাওয়া লেঃ কর্নেল রাজাকার ফারুক খানের কাছে বিক্রি করেন।

error: Content is protected !!