ভারতে পালায়ন

৭ই নভেম্বরের সিপাহী জনতার বিপ্লব ছিল শেখ মুজিবর রহমান, আওয়ামী বাকশালী ও ভারতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। সাধারণ সিপাহী-জনতা এই বিপ্লবে স্বাধীনতার ঘোষক জিয়াউর রহমানকেই নেতা মনে করেছে। ‘৭৫ সালের আগস্টে শেখ মুজিবের হত্রাকাণ্ডের পর আওয়ামী বাকশালীরা বা শেখ মুজিবের অনুসারীরা কে যে কোথায় লাপাত্তা হয়ে গেল তার কোন হদিস পাওয়া গেল না । অবশ্য শেখ মুজিবের সহপার্টি বা আওয়ামী বাকশালী নেতাদের একটা বিরাট অংশ মুজিব হত্যাকারীদের সাথে হাত মিলালো এবং হত্যাকারীদের নেতা খন্দকার মোশতাক আহমেদের নেতৃত্বে সরকার গঠন করল। আর আমরা গুটিকয়েক ছাত্র-নেতাকর্মী রাজনৈতিক তৎপরতা চালাবার বা মুজিব হত্যার প্রতিবাদ করার চেষ্টা করছিলাম, তারা ‘৭৫-এর ৭ই নভেম্বরের বিক্ষুদ্ধ সিপাহী জনতার বিদ্রোহ দেখে ভয়ে পালিয়ে ভারত চলে গেলাম।

যুদ্ধে পরাজয়

১৯৭৭ সালের নির্বাচনে ইন্দিরা গান্ধী পরাজিত হলে মোরারজি দেশাই ভারতের প্রধানমন্ত্রী হন। ইন্দিরা গান্ধীর পরাজয় এবং মোরারজি দেশাই-ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ায় আমরা শংকিত হই। এমনিতেই সারা বিশ্বের আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি আমাদের সম্পূর্ণ বিপক্ষে। একমাত্র ইন্দিরা গান্ধী ছাড়া গোটা ভারতের রাজনীতিও ছিল আমাদের বিপক্ষে। আমাদের একমাত্র সমর্থক এবং সাহায্যকারী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী এখন ক্ষমতাচ্যুত। সামনের দিন আমাদের ভাল হওয়ার কোনই সম্ভাবনা নেই। ভারতের নতুন প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাই প্রথমে আমাদের সকল সাহায্য বন্ধ করে দিলেন। বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়াউর রহমান এবং ভারতের নতুন প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাই উভয়ই ছিলেন আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে মার্কিন লবির লোক। ফলে সম্ভবত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের পরামর্শে ভারত এবং বাংলাদেশ যৌথভাবে আক্রমণ করে আমাদের পরাস্ত করার চুক্তিবদ্ধ হয়।

সীমান্ত অঞ্চলে আমাদের দখলে থাকা মুক্তাঞ্চল এবং আমাদের ঘাঁটিগুলোতে বরাবর ভারত ব্যাপক সৈন্য সমাবেশ করে। অপরদিকে বাংলাদেশেও অনুরূপভাবে ব্যাপক সৈন্য সমাবেশ করে। আমরা সামনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও বি ডি আর এবং পিছনে ভারতীয় সেনাবাহিনী ও বি এস এফ দ্বারা সাঁড়াশি কায়দায় চতুর্দিক থেকে ঘেরাও হয়ে পড়ি। আমাদেরকে বাংলাদেশ ও ভারতের সৈন্যরা চতুর্দিক থেকে ঘেরাও করার ফলে আমরা এক কোম্পানি থেকে আরেক কোম্পানি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি। বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি হেডকোয়ার্টার থেকেও। আমাদের এক ঘাঁটি থেকে আর এক ঘাঁটির যোগাযোগ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। আমাদের সর্বাধিনায়ক সিদ্দিকীর সাথেও সকল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়।

আমরা এক ঘাঁটির সাথীরা অন্য ঘাঁটির সাথীরা কি করছে, কি অবস্থায় আছে কিছুই বুঝতে পারছি না। শুধু বাংলাদেশের আর ভারতীয় আর্মিদের মাইকের আওয়াজ। একদিকে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর মাইকে বলছে আটচল্লিশ (৪৮) ঘন্টার মধ্যে আত্মসমর্পণ (সারেন্ডার) কর। নইলে আক্রমণ করা হবে। অন্যদিকে পিছনের দিক থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনী মাইকে বলছে, আটচল্লিশ ঘন্টাকা আন্দার হাতিয়ার ডালদো।

আমার ঘাঁটি ছিল ময়মনসিংহ জেলার দুর্গাপুর থানার ভবানীপুর। আমার ঘাঁটির সামনে ছিল বেশ বড় সমেশ্বর নদী। নদীর অপর পারে ছিল জেনারেল মাহামুদুল হাসান, মেজর সামাদ, মেজর মঈন-এর নেতৃত্বে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এবং পিছনে ছিল ভারতীয় সেনাবাহিনী আমরা উভয় দেশের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ করতে প্রস্তুত। আমাদের অস্ত্রের ভাণ্ডার মোটামুটি খারাপ না, যদিও গোলাগুলির পরিমাণ কম। পেছন থেকে ভারতীয় বাহিনী আমাদের সহজে কাবু করতে পারলেও সামনে নদী থাকায় কৌশলগত কারণেই বাংলাদেশ বাহিনী আমাদের সহজে কাবু করতে পারবে না। আমার ধারণা ছিল ভারতীয় সেনাবাহিনী আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করলেও এডভান্স হয়ে আমাদের ঘাঁটি দখল করতে আসবে না । ভারতীয় বাহিনী তাদের অবস্থান থেকে প্রচণ্ড আক্রমণ করে আমাদের ঘায়েল করতে চাইবে। কিন্তু এডভান্স করে আমাদের ঘাঁটি দখল করার রিক্সা বা ঝুঁকি নেবে না । আর আমাদের ঘাঁটির সামনে নদী থাকায় কৌশলগত কারণে আমরা অনেক সুবিধা ও সুদৃঢ় অবস্থানে আছি। বাংলাদেশ বাহিনীর পক্ষে নদী অতিক্রম করে আমাদের ঘাঁটি দখল করা এক দুরূহ ব্যাপার । এই অবস্থায় একমাত্র বিমান হামলা করা ছাড়া আমাদের পরাস্ত করা কঠিন। আমরা সম্ভাব্য বিমান হামলা মোকাবেলা করার জন্য আগে থেকেই মাটি কেটে শালবনের বিশাল বিশাল শাল গাছ দিয়ে তার উপর সমেশ্বর, নদীর পাথর, বালি আর মাটি দিয়ে দুর্বোধ্য মজবুত বিশালাকার বাঙ্কার ও ট্রেঞ্চ তৈরি করেছি। আমরা মাটির উপর না উঠে মাটির নিচ দিয়ে বাঙ্কার ও ট্রেঞ্চের ভিতর দিয়ে অনায়াসে এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় যেতে পারি এবং যুদ্ধ করতে পারি।

আমাদের আত্মসমর্পণের (সারেন্ডারের) জন্য বেঁধে দেওয়া আটচল্লিশ ঘন্টা সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পর, জেনারেল মাহামুদুল হাসান নিজে নেতৃত্ব দিয়ে আমাদের ঘাঁটির উপর বারো ঘন্টাব্যাপী মর্টারের প্রায় শতাধিক শেল নিক্ষেপ করে। সেই সময়ে পিছন দিক থেকে ভারতীয় বাহিনীও আমাদের উপর অবিরাম গোলা ও গুলি নিক্ষেপ করে।

ভারতীয় বাহিনীর গোলাগুলি ও বাংলাদেশ বাহিনীর মর্টারের শেলিং চলাকালে আমরা বাঙ্কার ও ট্রেঞ্চে বসে বাংলাদেশ বাহিনীর দিকে সজাগ ও তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখা ছাড়া এক রাউন্ড গুলিও করিনি। তখনও ভোর হয়নি, অন্ধকার কাটেনি, আবছা অন্ধকারে হঠাৎ দেখা গেল বিশ-ত্রিশ নৌকা বোঝাই হয়ে জেনারেল মাহামুদুল হাসানের বাহিনী নদী অতিক্রম করছে। সঙ্গে সঙ্গে আমরা আক্রমণ করলে তারাও মরিয়া হয়ে পাল্টা আক্রমণ করে। তাদের সমর্থনে সেনাবাহিনীর একটি দল কভারেজ এটাক্ট করে। আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণের মধ্যে দিয়ে প্রচন্ড যুদ্ধ বেধে যায়। ঘন্টাতিনেক তীব্র সংঘর্ষের পর জেনারেল মাহামুদুল হাসানের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ বাহিনী প্রচণ্ড মার খেয়ে পিছু হটে যায়। এভাবে সপ্তাহখানেক জেনারেল মাহামুদুল হাসানের আক্রমণ প্রতিহত করতেই আমাদের গোলাবারুদ ফুরিয়ে যায়। আমাদের অস্ত্রের যে মজুদ আছে তা দিয়ে বাংলাদেশ বাহিনীর আক্রমণ বছরের পর বছর প্রতিহত করা যাবে। কিন্তু গোলাবারুদের ভাণ্ডার প্রায় ফুরিয়ে এসেছে। তার চাইতেও মারাত্মক আকার ধারণ করেছে খাদ্য সংকট। তিন দিন থেকে আমাদের কাছে কোন খাদ্য নেই। ক্যাম্পে তিন-চারটি গরু জবাই করে পুড়িয়ে পুড়িয়ে আমরা খেয়েছি। আজ তাও নেই। আমরা যারা একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা, আমরা একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা শুধু অস্ত্রের সংকটে পড়েছি। কিন্তু খাদ্য সংকটে কখনও পড়িনি। গোটা বাঙালী জাতিই আমাদের খাদ্য সরবরাহ করেছে। প্রয়োজনে বাঙালী নিজে না খেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের খাইয়েছে। কোন মুক্তিযোদ্ধাই খাদ্যে কষ্ট করেনি। এদেশের মানুষ আগে মুক্তিযোদ্ধার খাওয়া জুগিয়েছে, তারপর নিজের খাওয়া জুগিয়েছে। একাত্তরের যুদ্ধে আমি খাদ্য সংকটেও পড়িনি এবং যুদ্ধে অস্ত্রে ও গোলাবারুদের মতো খাদ্যও যে একটা বিরাট ভাইটাল ফ্যাকটর তাও বুঝিনি।

এখন অস্ত্র আছে, কিন্তু গোলাবারুদের সংকটে পড়েছি। তার চাইতেও বেশি সংকটে পড়েছি খাদ্যের। আমাদের অস্ত্রপ্রতি পাঁচ-সাত রাউন্ড গুলি ও গোলা রয়েছে মাত্র। যা পাঁচ-দশ মিনিটও টিকবে না। আমার মনে এখনো আশা শেষ মুহূর্তে ভারত হয়তো সদয় হতে পারে। আবার সর্বাধিনায়ক কাদের সিদ্দিকীর সাথে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হবে।

আমাদের কয়েকজন বন্ধু পালিয়ে যেতে গিয়ে ভারতীয় বাহিনী ও বাংলাদেশ বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে মাইকে আমাদের নাম ধরে ডাকতে লাগলো। আর বলতে লাগলো, কোন অসুবিধা নেই, সবাই চলে আসেন ইত্যাদি ইত্যাদি।

দু’দিন কোন পক্ষেরই কোন যুদ্ধ নেই, গোলাগুলি নেই। চতুর্দিকে নীরব। আমাদের কেউ বাঙ্কারে, কেউ উপরে। কেউ বসে, কেউ দাঁড়িয়ে। আমাদের কোনই খাদ্য নেই। অস্ত্র আছে, কিন্তু নেই যুদ্ধ করার গুলি। সর্বোপরি নেই যুদ্ধ করার মতো বিন্দুমাত্র মানসিক শক্তি। আমি একটি ছোট কাঁঠাল গাছের নিচে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছি জেনারেল মাহামুদুল হাসান তার বিরাট সৈন্যবাহিনী নিয়ে নৌকা করে আমাদের তীরে এসে নামলো। পাশে থাকা আমার অস্ত্রটা একবার তাকিয়ে দেখলাম। হয়তো মনের ভুলেই দেখলাম। কিন্তু হাতে তুলে নিলাম না। জেনারেল মাহামুদুল হাসান তার বাহিনীকে নদীর পারে দাঁড় করিয়ে রেখে মেজর মঈন, মেজর সামাদসহ কয়েক জন অফিসার সঙ্গে নিয়ে ধীরে ধীরে আমাদের ঘাঁটিতে উঠে এসে আমার সামনে দাঁড়িয়ে অত্যন্ত মোলায়েম এবং ভদ্রকণ্ঠে আমাকে বললেন, দিন, আপনার অস্ত্রটা আমার হাতে দিন।

আমি শেষ বারের মত আমার অস্ত্রটা দেখলাম। তারপর আলতো হাতে জেনারেল হাসানের হাতে তুলে দিতে দিতে মনে মনে বললাম, বিদায় হে বন্ধু, বিদায়।

এরপর জেনারেল হাসান বললেন, চলেন আপনাদের ঘাঁটিটা একটু ঘুরে দেখি।

তিনি ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলেন। আমাদের সাথীরা যে যেখানে ছিল সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল। কারো অস্ত্র হাতে, কারো অস্ত্র মাটিতে। মেজর মঈনকে অস্ত্রগুলো কালেকশন করতে বলে, আমাদের সবাইকে এক জায়গায় দাঁড় করালেন। এরপর নিয়ে গেলেন দুর্গাপুরে সেনাবাহিনীর একটি ঘাঁটিতে। সেখানে নিয়ে জেনারেল মাহামুদুল হাসান আমাদের উদ্দেশ্যে বললেন, আপনাদের চিন্তার বা ঘাবড়াবার কোনই কারণ নেই। আমার সাথে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান-এর কথা হয়েছে। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান কথা দিয়েছেন আপনাদের সকলকেই ছেড়ে দেওয়া হবে। শুধুমাত্র ‘৭৫-এর ১৫ই আগস্টের আগে যদি কারো বিরুদ্ধে বাংলাদেশ দণ্ডবিধির আওতায় মামলা থেকে থাকে তাহলে তাকে বিচারের জন্য সোপার্দ করা হবে। দুর্গাপুরে কয়েক দিন রাখার পর আমাদের নিয়ে যাওয়া হয় নুরুদ্দিন কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে। এরপর সেখান থেকে নিয়ে যাওয়া হলো ময়মনসিংহ রেসিডেন্সিয়াল মডেল গার্লস স্কুলের কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে।

এই ক্যাম্পে আমাদের ইন্টারোগেশন শুরু হয়। প্রতিদিন আমাদের আলাদা আলাদাভাবে বিভিন্ন ধরনের প্রশ্নের উত্তর লিখিত ও মৌখিকভাবে নেওয়া হতো। আমাদের মাঝ থেকে আমাদের সাথী চট্টগ্রামের জননেতা মৌলভী সৈয়দ আহম্মেদকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে টর্চার (নির্যাতন) করে মেরে ফেলা হয়। এই সংবাদসহ আমাদের প্রতি ভারতের মোরারজি দেশাই সরকারের বর্বরোচিত অমানবিক আচরণের সংবাদ ভারতীয় সংবাদপত্রে প্রকাশিত হলে কংগ্রেস বিরোধী মোর্চার প্রতিষ্ঠাতা, ইন্দিরা গান্ধীর পতনের মূল নায়ক, যার বদৌলতে মোরারজি দেশাই ভারতের প্রধানমন্ত্রী, ভারতের সেই প্রবীণ সর্বদলীয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ বিক্ষুব্ধ হয়ে সঙ্গে সঙ্গে মোরারজি দেশাইয়ের পদত্যাগ দাবী করেন।

জয় প্রকাশ নারায়ণের বক্তব্য হলো, প্রতিবেশী রাষ্ট্রের বিদ্রোহীদের আশ্রয় দেওয়া ভারতের নৈতিক দায়িত্ব এবং চিরকালের ঐতিহ্য। প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাই এই নৈতিক দায়িত্ব পালন না করে এবং চির ঐতিহ্য রক্ষা না করে বাংলাদেশের বিদ্রোহীদের মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়ে অমার্জনীয় অপরাধ করেছেন এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী থাকার নৈতিক দায়িত্ব ও অধিকার হারিয়েছেন। সুতরাং আর এক মুহূর্ত দেরি না করে তাকে পদত্যাগ করতে হবে। নইলে ক্ষমতাচ্যুত করা হবে।

সর্বদলীয় নেতা জয় প্রকাশ নারায়ণ প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাইয়ের পতনের কার্যক্রম শুরু করলে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাই সরকার আমাদের সর্বাধিনায়ক বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীসহ ভারতে থাকা কয়েকজনকে ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় দেন। অন্যদিকে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান তার দেওয়া কথানুযায়ী ভবিষ্যতে রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক কাজে জড়িত হবে না এই মর্মে মুচলেকা (বন্ড) নিয়ে আমাদের নিঃশর্ত মুক্তি দেন।

মূলত আমাদের প্রতি ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাই সরকারের অমানবিক ও অনৈতিক আচরণের ফলে শেষ পর্যন্ত ভারতের সর্বদলীয় নেতা জয় প্রকাশ নারায়ণ জনতার মোর্চা ভেঙ্গে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাইয়ের পতন ঘটান।

 

হারিয়ে যাওয়া শেখ মুজিবের জনপ্রিয়তা ফিরিয়ে আনা

কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প থেকে ছাড়া পেয়েই হারিয়ে যাওয়া শেখ মুজিবর রহমানের জনপ্রিয়তা পুনরায় উদ্ধারের এবং সংগঠন গড়ে তোলার কাজে নতুন করে ঝাঁপিয়ে পড়ি। একমাত্র কাদের সিদ্দিকী ও তার কয়েকজন সাথী ছাড়া অন্য কেউ ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় না পাওয়ায় এস এম ইউসুফ, মোজাহিদুল ইসলাম সেলিম, শাহ মোহাম্মদ আবু জাফর (বর্তমানে জাতীয় পার্টি নেতা) মোস্তফা মোহসীন মন্টু (বর্তমানে গণফোরাম নেতা), রবিউল আলম চৌধুরী (বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পি, এস মোক্তাদীর চৌধুরী), ফরিদপুরের রুমি (শেখ মুজিবের মন্ত্রী মোল্লা জালাল উদ্দিনের ছেলে), আবু সাঈদ (বর্তমানে শেখ হাসিনার তথ্য প্রতিমন্ত্রী) ডাঃ এস এ মালেক (বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক উপদেষ্টা) সহ শেখ মুজিব নিহত হওয়ার পর যে সকল নেতা-কর্মী ভারতে গিয়েছিল তারা সকলেই একে একে দেশে ফিরে আসেন। হেদায়েতুল ইসলাম কাজল (শেখ মুজিব ও এরশাদের মন্ত্রী কোরবান আলীর ভাগ্নে ১৯৯৬-এর সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত) গোলাম মোস্তাফা খান মিরাজ, আব্দুস সামাদ পিন্টু, মোবারক হোসেন সেলিম (বর্তমানে অগ্রণী ব্যাংক কর্মকর্তা ও নেতা), শামীম আফজাল (বর্তমানে বিচারপতি), রাজশাহীর বজলুর রহমান ছানা (বর্তমানে সহকারী এটর্নী জেনারেল) এবং রানাসহ আরো কিছু সাথী বন্ধু মিলে সারা দেশের সব ক’টি বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ এবং অঞ্চলে নতুন করে দ্রুত সংগঠন গড়ে তুলতে থাকি। বিশেষ দায়িত্ব হিসেবে আমি ঢাকা শহরের সব কয়টি কলেজ এবং মহল্লায় সংগঠন গড়ে তুলি। আমরা শুধু ছাত্র সংগঠন গড়ে তুলেই ক্ষান্ত হতাম না। যুবলীগ, কৃষক লীগ এমন কি মূল সংগঠন আওয়ামী লীগও আমরা গঠন করে দিতাম। আমাদের কর্মী সৃষ্টি এবং কর্মী সংগ্রহ অভিযান দ্রুতগতিতে চলতে থাকে এবং আমরা দারুণভাবে সংগঠিত ও শক্তিশালী হতে থাকি।

আব্দুর রাজ্জাক, এস এম ইউসুফ, শাহ মোহাম্মদ আবু জাফর, রবিউল আলম চৌধুরী ও শফিকুল আজিজ মুকুল (আওয়ামী লীগের সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা, নামকরা তাত্ত্বিক, দৈনিক বাংলার বাণীর সহ-সম্পাদক-সাহিত্যিক সাংবাদিক নিবেদিতপ্রাণ, চিরকুমার) এবং আমাদের মধ্যে একটা অঘোষিত চেইন অফ কমান্ড তৈরি হয়। অন্যদিকে কিশোরগঞ্জ থেকে আসা মঞ্চ কাঁপানো ও ব্যাপক সাড়া জাগানো বক্তা ও সবচাইতে জনপ্রিয় ছাত্রনেতা ফজলুর রহমান (ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা, প্রাক্তন এম পি, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ থেকে শেখ হাসিনা কর্তৃক বহিষ্কৃত)-এর জ্বালাময়ী বক্তৃতা এবং সেই সাথে অভিজ্ঞ ও তুখোড় সংগঠক খ, ম, জাহাঙ্গির এম পি, শেখ হাসিনার মন্ত্রীসভার প্রতিমন্ত্রী) এর সাংগঠনিক দক্ষতা এই সব মিলে ১৫ই আগস্টে শেখ মুজিবের সাথে নিহত হয়ে যাওয়া শেখ মুজিবের জনপ্রিয়তা এবং সংগঠন নতুন প্রাণ পেতে থাকে। প্রকাশ্যে ফজলু জাহাঙ্গিরদের বক্তৃতা-বিবৃতি এবং আমাদের নীতি ও আদর্শের রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ এবং কর্মী সৃষ্টি এই দুয়ে মিলে রাজনীতিতে এবং দেশে নতুন পোলারাইজেশন বা মেরুকরণ শুরু হয়। জহুরা তাজুদ্দিন আওয়ামী লীগের আহ্বায়িকা। আব্দুর রাজ্জাক আওয়ামী লীগের চালিকাশক্তি। ‘৭১-এ আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা যা পেয়েছিলাম এবং স্বাধীনতার পর আমরা যা হারিয়েছি, সেই ন্যায়-নীতি, আদর্শ, ত্যাগ সর্বোপরি মানুষের জন্য মানুষের ভালাবাসা, ভোগে নয় ত্যাগেই সুখ। দেশ ও মানুষের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার হারিয়ে যাওয়া চেতনা আবার ফিরে আসতে লাগলো।

হোটেল ইডেনে শেখ মুজিবের মৃত্যুর পর আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় সম্মেলন হলো। প্রথম সম্মেলনে জহুরা তাজুদ্দীনকে আহ্বায়িকা করে আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কমিটি গঠিত হলো। দ্বিতীয় সম্মেলনে কর্মীদের আপত্তি ও ঘোরতর বিরোধিতা সত্ত্বেও সৈয়দা জহুরা তাজুদ্দীনকে বাদ দিয়ে আব্দুল মালেক উকিলকে আওয়ামী লীগের সভাপতি ও আব্দুর রাজ্জাককে সাধারণ সম্পাদক করা হলে আমরা কিছুটা চিন্তিত হই এই ভেবে যে, মালেক উকিল আদর্শবান ব্যক্তিত্ব নন। মালেক উকিল প্রেসিডেন্ট হলেও পার্টির চালিকা শক্তি থেকে যায় সেক্রেটারী আব্দুর রাজ্জাকের হাতেই। এই পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের সঙ্গে অঙ্গ সংগঠন এবং মূল শক্তি ছাত্রলীগের সম্মেলন হয়। সম্মেলনে সারা দেশের ছাত্র প্রতিনিধিদের ফজলু-জাহাঙ্গির প্যানেলের একক দাবি থাকলেও অজ্ঞাত কারণে কাদের-চুন্নু প্যানেল করা হয়। ওবায়দুল কাদের (শেখ হাসিনার যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী) কে সভাপতি ও বাহালুল মজনুন চুন্নুকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়। পরে জানা যায়, মালেক-রাজ্জাক নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে কাদের-চুন্নু প্যানেল করে। এতে আমরা যারা আদর্শের জন্য নিবেদিতপ্রাণ তারা খুবই মর্মাহত হই।

বাহালুল মজনুন চুন্নু নিজ শ্রম, ও ব্যক্তিগত আচার-ব্যবহার-এর মাধ্যমে নিজেকে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে মানিয়ে নিতে পারলেও সভাপতি হিসেবে ওবায়দুল কাদের কখনই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারা তো দূরের কথা একজন সাধারণ ছাত্রনেতা হিসেবেও দাঁড়াতে পারেনি । ডাকসুর নির্বাচনে তিন তিনবার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে প্রতিবারই ভোট পেয়েছে জামানত বাজেয়াপ্ত হওয়ার সামান্য কিছু উপরে। কিন্তু বাহালুল মজনুন চুন্নু সাধারণ ছাত্র সমাজের কাছে একজন বিনয়ী, কর্মঠ ছাত্রনেতা হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করতে পেরেছেন।

১৯৭৯ সালে মুক্তিযোদ্ধা রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি নির্বাচন দিলে, আওয়ামী লীগ সরাসরি নিজ দলের প্রার্থী না দিয়ে গণতান্ত্রিক ঐক্যজোট (গজ)-এর নামে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল আতাউল গনি ওসমানীকে মুক্তিযোদ্ধা রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়াউর রহমানের বিপরীতে রাষ্ট্রপতি প্রার্থী করে। ঐ নির্বাচনে মুক্তিযোদ্ধা জেনারেল জিয়াউর রহমান মূলত আওয়ামী লীগের প্রার্থী জেনারেল এম এ জি ওসমানীকে বিপুল ভোটে পরাজিত করে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। নির্বাচনের পরে জানা যায়, আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব ঐ রাষ্ট্রপতি নির্বাচনকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গুরুত্ব, অর্থবহ ও বৈধতা দেওয়ার জন্য মুক্তিযোদ্ধা রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সাথে গোপন শলাপরামর্শ ও যোগসাজশের ভিত্তিতে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল আতাউল গনি ওসমানিকে রাষ্ট্রপতি প্রার্থী করেছিল।

 

রাজনীতিতে শেখ হাসিনা

আওয়ামী লীগে মালেক উকিল এবং ছাত্রলীগে ওবায়দুল কাদের এর মতো স্থুল, আপোষকামী ও অযোগ্য লোকের নেতৃত্বে আসায় নিবেদিত কর্মীদের মাঝে হতাশা ও তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। এই হতাশা ও ক্ষোভের মধ্যে আব্দুর রাজ্জাকের চরিত্র ও ভূমিকা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে থাকে। এরই মধ্যে আসে ‘৭৫ পরবর্তী আওয়ামী লীগের তৃতীয় সম্মেলন। এই সম্মেলনকে সামনে রেখে রাজ্জাক এবং তোফায়েল উভয় গ্রুপ আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দখলের অর্থাৎ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদ দখলের তীব্র প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। এই প্রতিযোগিতায় মালেক উকিল রাজ্জাকের সঙ্গে থাকলেও তোফায়েল গ্রুপ নেতৃত্ব দখলের প্রশ্নে কোন প্রকার ছাড় না দেওয়ার সিদ্ধান্তে অটল থাকে। এতে আওয়ামী লীগ ভাঙ্গনের সম্মুখীন হয়। এমনিতেই মিজানুর রহমান চৌধুরীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের একটি ক্ষুদ্র অংশ আগেই দল থেকে বেরিয়ে বিচ্ছিন্ন আওয়ামী লীগ তৈরী করেছে । নেতৃত্ব দখলের লড়াইয়ের মাঝেই আওয়ামী লীগ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। অবস্থা বেগতিক দেখে দলের ভিতরের বিরুদ্ধবাদীদের মোকাবেলা করার জন্য আব্দুর রাজ্জাক আওয়ামী লীগের সভাপতি পদে শেখ মুজিবের মেয়ে শেখ হাসিনাকে এই ভেবে নিয়ে আসেন যে, শেখ মুজিব পরিবারের এই অরাজনৈতিক মহিলা সব সময়ই তার (আব্দুর রাজ্জাকের) মুখাপেক্ষী হয়ে থাকবে।

শেখ মুজিবের জীবদ্দশায় তাঁর ছেলে শেখ কামাল, ভাগ্নে শেখ মনি, শেখ সেলিম এবং কখনো কখনো শেখ জামাল রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ বা নাক গলালেও শেখ হাসিনা কখনই রাজনীতির ধারে-কাছেও ঘেঁষেনি। যদিও সাম্প্রতিককালে এক সময়ে শেখ হাসিনা ইডেন মহিলা মহাবিদ্যালয়ের ভি পি ছিলেন বলে প্রচার চালানো হলেও শেখ হাসিনা নিজে কখনই এমন দাবি করেননি। শেখ হাসিনার ভি পি থাকার প্রচারণা চালানো হলেও কবে, কখন বা কোন সালে ভি পি ছিলেন তা প্রচার করা হয় না। বরং শেখ হাসিনা ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যও ছিলেন না-এটা তিনি (শেখ হাসিনা) ছাত্রলীগের প্রায় অনুষ্ঠানেই বলেন।

তাছাড়া শেখ হাসিনা মহিলা, আবার দেশের বাইরে রয়েছেন। কখনও দেশে এলেও রাজনৈতিক অনভিজ্ঞ ও অরাজনৈতিক মহিলা হওয়ার কারণেই আব্দুর রাজ্জাক যেভাবে চালাবেন, শেখ হাসিনা সেভাবেই চলবেন। এই ধারণা থেকেই আব্দুর রাজ্জাক গং শেখ হাসিনাকে আওয়ামী লীগের সভাপতি করেন।

অতীতে মালেক উকিলকে আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং ওবায়দুল কাদেরকে ছাত্রলীগের সভাপতি করায় সংগঠনের নীতি ও আদর্শবান, ত্যাগী নেতা-কর্মী বাহিনীর আব্দুর রাজ্জাকের নেতৃত্বের প্রতি আস্থা কমে যায় এবং শেখ মুজিবের মেয়ে শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের সভাপতি হওয়ায় স্বস্তিবোধ করে।

সেনাবাহিনী এবং জেনারেলরা রাজনীতিতে বেআইনী ও অবৈধ হস্তক্ষেপ করতে থাকে এবং জনগণের উপর প্রভুত্ব ফলাতে থাকলে আমরা ‘৭১ ও ‘৭৫-এর যোদ্ধারা সেনাবাহিনীর বিকল্প শক্তি তৈরীর চিন্তা করতে থাকি। ছাত্রদের রাজনৈতিক প্রশিক্ষণকালে ছাত্ররা সেনাবাহিনীর চাইতেও শক্তিশালী বাহিনী বলে ধারণা দেওয়া হতো। ছাত্রদের বোঝানো হতো, সশস্ত্র কিন্তু অশিক্ষিত বাহিনী হচ্ছে সেনাবাহিনী। নিরস্ত্র কিন্তু শিক্ষিত বাহিনী হচ্ছে ছাত্রবাহিনী। সেনাবাহিনী বাস করে ক্যান্টনমেন্টের ব্যারাকে এবং ছাত্ররা বাস করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রাবাসে।

সেনাবাহিনী জনগণের বিরুদ্ধাচরণ করে এবং জনতার স্বার্থের পরিপন্থী কাজ করে। ছাত্ররা জনগণের পক্ষাবলম্বন করে এবং জনতার জন্য জীবন দান করে। আগামী দিনে লড়াই হবে, সেই লড়াইয়ে শিক্ষিত ছাত্রবাহিনীর কাছে অশিক্ষিত সেনাবাহিনী পরাজিত হবে। সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল খলিলুর রহমান এবং অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল শওকত আলী এই দুই ব্যক্তি আওয়ামী লীগে যোগদান করলে, রেজাউল বাকি, গোলাম মোস্তাফা খান মিরাজ, আব্দুস সামাদ পিন্টু, মরহুম হেদায়েতুল ইসলাম কাজল, মোবারক হোসেন সেলিম এবং আরো কয়েকজন ‘৭১ ও ‘৭৫ এর যোদ্ধা মিলে আলাপ-আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিলাম কর্নেল শওকত আলীকে সাথে নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি সংগঠন করার। সিদ্ধান্ত মোতাবেক কর্নেল শওকত আলীকে আহ্বায়ক করে মুক্তিযোদ্ধা সংহতি পরিষদ নামে ‘৭১ ও ‘৭৫-এর যোদ্ধাদের একটি নতুন সংগঠন গড়ে তোলা হলো। আমাদের দৃষ্টি ক্যান্টনমেন্টের দিকে।

লক্ষ্য ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট দখল। এই লক্ষ্য বাস্তবায়নে আমাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম ও রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করা হলো। আমরা ছাত্র-যুবকদের আসন্ন সমাজ বিপ্লবে অংশগ্রহণের ও সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারের দীক্ষা দিতে থাকলাম। ছাত্র-যুবকদের বলে-কয়ে জীবন দেওয়ার জন্য প্রস্তুত করতে লাগলাম। বিপ্লব করতে হলে ব্যক্তি জীবনের ভয়াবহ ক্ষতি হতে পারে। কিন্তু সেই ক্ষতির হিসেব রাখা যাবে না। কেননা, বিপ্লব ব্যক্তিগত ক্ষয়-ক্ষতির হিসেব রাখে না। বিপ্লব ব্যক্তিগত ক্ষয়-ক্ষতির মধ্যে দিয়ে সামগ্রিক ফসল এনে দেয়, যা মূলত ভবিষ্যৎ বংশধরদের নিশ্চিত সুন্দর জীবন এনে দেয়। কার্যক্রমের এই পর্যায়ে আমাদের সাথে যোগ দেয়, ‘৭৫ সালের ৩রা নভেম্বর জেনারেল খালেদ মুশাররফ-এর নেতৃত্বে সংগঠিত ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের কতিপয় মুক্তিযোদ্ধা সামরিক অফিসার। যোগদানকারী সামরিক অফিসারদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন লেঃ কর্নেল এ এইচ এম গাফফার বীর বিক্রম (‘৭৫- এর ৩রা নভেম্বরের ব্যর্থ অভ্যুত্থানের দায়ে সামরিক বাহিনী থেকে বরখাস্ত এবং পরবর্তী পর্যায়ে রাষ্ট্রপতি হোসেইন মোহাম্মদ এরশাদের বাণিজ্য মন্ত্রী), মেজর নাসির (পত্রিকার কলাম লেখক এবং বিশিষ্ট নাট্যশিল্পী লুৎফর নাহার লতার স্বামী) এবং ক্যাপ্টেন হাফিজুল্লা। কর্নেল গাফফার সব সময় ইংরেজি রাজনৈতিক ক্লাস নিতেন। এক ক্লাসে তিনি শিখিয়েছিলেন ভোগে শুধু সুখ আছে, কিন্তু তৃপ্তি নেই। ত্যাগে সুখ এবং তৃপ্তি দুটোই আছে। ‘৮১ সালের ১৭ই মে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের অরাজনৈতিক কন্যা শেখ হাসিনা কর্মী এবং জনতা বিমান বন্দরে শেখ হাসিনাকে নজিরবিহীন সংবর্ধনা দেয়।

 

এই জিয়া সেই জিয়া নয়

শেখ হাসিনার দেশে ফিরে আসার তিন-চারদিন পরই তাঁর সাথে আমাদের প্রথম বৈঠক হয়। এই বৈঠকে আলোচনার শুরুতেই শেখ হাসিনা ছাত্রনেতা ও মুক্তিযোদ্ধাদের বলেন, আজ থেকে প্রচার চালাতে হবে যে, এই জিয়া সেই জিয়া নয়।

অর্থাৎ বর্তমান মুক্তিযোদ্ধা রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষক মেজর জিয়াউর রহমান নয়। শেখ হাসিনা হিটলারের তথ্য উপদেষ্টা গোয়েবলস-এর থিউরি অনুসারে বলেন, তোমরা যদি ভালভাবে প্রচার করতে পারো, এই জিয়া স্বাধীনতার ঘোষক জিয়া নয়, তাহলে দেখবে একদিন মানুষ এটাই বিশ্বাস করবে।

আমাদের মাঝ থেকে একজন প্রশ্ন করলো, তাহলে এই জিয়াকে কোন জিয়া বলবো?

শেখ হাসিনা বললেন, অত কথার দরকার নেই; শুধু বলবে এই জিয়া সেই জিয়া নয় !

এই কথা শুনে আমরা সবাই বিস্তৃত হলাম এবং নিজেদের মধ্যে ফিসফাস ও হাসাহাসি করলাম। কিন্তু আমরা কেউ কোন দিন শেখ হাসিনার এ শিক্ষা “এই জিয়া সেই জিয়া নয়” প্রচার করলাম না।

 

রাষ্ট্রপতি জিয়া হত্যা

‘৮১ সালের ২৩মে এবং ২৪মে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টি এস সির তিন তলায় সেমিনার কক্ষে ‘৭১ ও ৭৫-এর যোদ্ধাদের এবং সেনাবাহিনীর প্রাক্তন সদস্যদের গোপন ও জরুরী বৈঠক বসে । এই বৈঠকে কর্নেল শওকত আলী (বর্তমানে আওয়ামী লীগের এম পি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় আসামী) মুক্তিযোদ্ধা রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়াউর রহমান বীর উত্তমকে হত্যার পরিকল্পনা এবং হত্যাকালীন ও হত্যা পরবর্তী সময়ে করণীয় সম্পর্কে অবহিত করেন। কর্নেল শওকত আলী বলেন, জিয়াউর রহমান চট্টগ্রাম গেলে চট্টগ্রামের জি ও সি মেজর জেনারেল মঞ্জুর বীর উত্তম-এর নেতৃত্বে জিয়াকে হত্যা করা হবে এবং এই হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে সভানেত্রী শেখ হাসিনা অবহিত আছেন। সভানেত্রী আমাদেরকে এই হত্যাকাণ্ডে সহায়তা ও ভূমিকা রাখার নির্দেশ দিয়েছেন।

আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা মাত্র কয়েক দিন হলো দেশে এসেছেন, এর মধ্যেই তিনি এমন একটি নির্দেশ কিভাবে দিতে পারেন? প্রশ্ন করা হলে কর্নেল শওকত আলী বলেন, শেখ হাসিনা দেশের বাইরে (ভারত) থাকতেই এ বিষয়ে অবহিত আছেন। কর্নেল শওকত আলী জিয়া হত্যাকাণ্ডে ও হত্যা পরবর্তী সময়ে আমাদের করণীয় সম্পর্কে বলেন যে, হত্যাকাণ্ডের সময় আমাদের চট্টগ্রাম ও ঢাকায় থাকতে হবে। আমাদের যারা চট্টগ্রামে থাকবে তাদের দায়িত্ব হবে জেনারেল মঞ্জুর-এর কাছে থেকে অস্ত্র নিয়ে ঢাকায় চলে আসা এবং ঢাকায় যারা থাকবে তাদের দায়িত্ব হবে চট্টগ্রাম থেকে আসা অস্ত্র নিয়ে ঢাকায় রেডিও-টেলিভিশসনসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থানে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা। আমাদের মধ্যে একজন কবে নাগাদ এই হত্যাকাণ্ড হতে পারে প্রশ্ন করায় কর্নেল শওকত বলেন, এখন থেকে যে কোন সময় হতে পারে। যখনই জিয়াউর রহমান চট্টগ্রামে যাবেন তখনই তাকে হত্যা করা হবে। কর্নেল শওকত আরো বলেন, জিয়া হত্যা সংগঠন পর্যন্ত সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল এইচ এম এরশাদসহ অন্যান্য জেনারেলগণ এবং রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান-এর গার্ড রেজিমেন্টের কর্নেল মাহফুজুর রহমান অভ্যুত্থানের নেতা জেনারেল মঞ্জুরের সাথে থাকবেন। কিন্তু যে মুহূর্তে জিয়া হত্যা সংঘটিত হয়ে যাবে সেই মুহূর্তে থেকে এরা বিভক্ত হয়ে পড়বে এবং দ্বন্দ্ব শুরু হবে। সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল এরশাদের নেতৃত্বে থাকবে পাকিস্তান প্রত্যাগত (রিপেট্রিয়ট) অফিসার ও জোয়ানসহ ঢাকার জেনারেলগণ। অন্যদিকে জেনারেল মঞ্জুরের নেতৃত্বে থাকবে চট্টগ্রামের মুক্তিযোদ্ধা সামরিক অফিসার ও জোয়ানরা। জিয়া হত্যার পর জেনারেল এরশাদের আনুগত্যশীল সেনাবাহিনী এবং জেনারেল মঞ্জুরের আনুগত্যশীল সেনাবাহিনীর লড়াই হবে, যুদ্ধ হবে। এই যুদ্ধে উভয় গ্রুপেরই ক্ষতি হবে এবং একটি গ্রুপকে পরাজিত ও ধ্বংস করে অপর গ্রুপটি বিজয়ী হলেও খুবই দুর্বল থাকবে, ঠিক সেই মুহূর্তে আমরা ঐ বিজয়ী দুর্বল গ্রুপকে আক্রমণ করে পরাজিত করবো। এই হচ্ছে আমাদের হত্যা ও হত্যা পরবর্তী করণীয়।

এই জরুরী গোপন বৈঠকে ৩রা নভেম্বর ‘৭৫-এ সামরিক অভ্যুত্থানকারী কর্নেল গাফফার, মেজর নাসির, ক্যাপ্টেন হাফিজ এবং আরো কয়েকজন সদস্যসহ প্রায় সত্তর পঁচাত্তর জন যোদ্ধা উপস্থিত ছিল। বৈঠকে আমাদেরকে প্রধানত ৩টি গ্রুপে ভাগ করা হয়। একটি গ্রুপকে চট্টগ্রাম যেয়ে জেনারেল মঞ্জুরের কাছ থেকে অস্ত্র নিয়ে আসার দায়িত্ব দেওয়া হয়। ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ সদস্যের দ্বিতীয় গ্রুপকে সারা দেশ সফর করে জিয়া বিরোধী মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে এই সংবাদ পৌঁছানো ও যে কোন মুহূর্তে যে কোন ধরনের একশনে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত করতে দায়িত্ব দেওয়া হয়। বাকি সবাইকে তৃতীয় গ্রুপ হিসেবে চব্বিশ ঘন্টা প্রস্তুত করে ঢাকায় রাখা হয়। মুক্তিযোদ্ধা রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান চট্টগ্রামে পৌঁছলে, জেনারেল মঞ্জুরের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টের কিছুসংখ্যক সেনা অফিসার অভ্যুত্থান করে ৩০শে মে প্রত্যুষে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে অতি সহজে, বলা যায় বিনা বাধায় মুক্তিযোদ্ধা রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে হত্যা করতে পারলেও সেনাবাহিনীর সাধারণ জোয়ান ও জনগণ এই হত্যাকাণ্ড প্রত্যাখ্যান করে। জেনারেল মঞ্জুর বীর উত্তম-এর আনুগত্যশীল অফিসারগণ চট্টগ্রাম বেতার ও টেলিভিশন দখলে ও নিয়ন্ত্রণে রাখে। এদিকে ঢাকায় সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল এইচ এম এরশাদ, জেনারেল মীর শওকত বীর উত্তম, জেনারেল রহমানসহ সকল অফিসার ও জোয়ানরা জেনারেল মঞ্জুরের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়।

জেনারেল মঞ্জুরকে মোকাবেলা করার জন্য কুমিল্লা ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টের জি ও সি ব্রিগেডিয়ার মাহামুদুল হাসানকে এক ব্রিগেড সৈন্যসহ চট্টগ্রামের দিকে পাঠান হয়। ব্রিগেডিয়ার মাহামুদুল হাসান চট্টগ্রাম সড়কের শুভপুর ব্রিজের ঢাকা পারে অবস্থান নেয় এবং শুভপুর ব্রিজের চট্টগ্রাম পারে ব্রিগেডিয়ার মাহামুদুল হাসানকে মোকাবেলা করার জন্য জেনারেল মঞ্জুরের প্রতি আনুগত্যশীল ক্যাপ্টেন দোস্ত মোহাম্মদ তার সৈন্যসহ অবস্থান নেয়। অন্যদিকে ঢাকায় মুক্তিযোদ্ধা রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান হত্যার প্রতিবাদে এবং জেনারেল মঞ্জুরের বিরুদ্ধে জনগণ ব্যাপক বিক্ষোভ, মিছিল, মিটিং সমাবেশ করলেও উপ-রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আব্দুস সাত্তার জিয়া হত্যার সংবাদ শোনামাত্র প্রাণভয়ে ঢাকা সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সি এম এইচ)- এ “রোগী সিরিয়াস কারো সাথে দেখা হবে না” বোর্ড লাগিয়ে ভর্তি হন। পরে জিয়াউর রহমানের প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান এবং যোগাযোগ মন্ত্রী আব্দুল আলীম সি এম এইচ- এ গিয়ে উপ-রাষ্ট্রপতি সাত্তারকে বলেন, সেনাবাহিনী প্রধান এরশাদ বলেছেন, আপনি এখন রাষ্ট্রপতি।

প্রত্যুত্তরে উপ-রাষ্ট্রপতি সাত্তার বলেন, আগে সেনাবাহিনী প্রধান এরশাদকে আনেন।

তারপর সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল এরশাদের পৃষ্ঠপোষকতায় উপ-রাষ্ট্রপতি সাত্তার অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হন। দৃশ্যত সেনাবাহিনী দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে শুভপুর ব্রিজে পরস্পর পরস্পরের মুখোমুখি অবস্থান নিলেও এবং ভাইয়ে ভাইয়ে রক্তপাতের ও জীবননাশের অবস্থা সৃষ্টি হলেও কার্যত জেনারেল মঞ্জুর চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টের প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন। ফলে আমাদেরকে অস্ত্র সরবরাহ দেওয়ার কোন প্রশ্নই ওঠে না। সেনাবাহিনীর সাধারণ সৈনিক জোয়ানেরা মুক্তিযোদ্ধা রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান হত্যা সমর্থন করে না, এবং জিওসি জেনারেল মঞ্জুরের প্রতি আনুগত্য পরোক্ষভাবে অস্বীকার করে। জেনারেল মঞ্জুরের পক্ষে শুভপুর ব্রীজে আসা ক্যাপ্টেন দোস্ত মোহাম্মদ-এর সৈন্যরা, ব্রীজের অপর পারে ব্রিগেডিয়ার মাহামুদুল হাসানের সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে অস্বীকার করে। ননকমিশন অফিসার এবং সিপাহীরা ক্যাপ্টেন দোস্ত মোহাম্মদকে সরাসরি পরিষ্কার বলে দেয়, জেনারেল মঞ্জুর প্রেসিডেন্ট জিয়াকে হত্যা করেছে। এখন জেনারেল মঞ্জুর নিজে প্রেসিডেন্ট হবে। আমরা সুবেদার, হাবিলদার, সিপাহীরা যা আছি তাই থাকবো। আমরা নিজেরা নিজেদের জীবন নেব না। আপনারা অফিসারেরা যুদ্ধ করেন। আমরা যুদ্ধ করবো না।

তখন ক্যাপ্টেন দোস্ত মোহাম্মদ অবস্থা বেগতিক দেখে ব্রিগেডিয়ার মাহামুদুল হাসানের কাছে আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নেয় এবং আত্মসমর্পণ করে। জেনারেল মঞ্জুর বীর উত্তম চট্টগ্রাম বেতার ও টেলিভিশনে ভাষণ দিতে এবং সাংবাদিক, গণ্যমান্য ব্যক্তি ও মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে আলোচনা করতে ক্যান্টনমেন্টের বাইরে এলে চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট তার সম্পূর্ণ হাতছাড়া হয়ে যায়। সেনাবাহিনীর বিশেষত নন কমিশনড্ এবং জোয়ানেরা মুক্তিযোদ্ধা রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের প্রতি এতই আনুগত্যশীল ছিল যে, সুযোগ পাওয়া মাত্র মুহূর্তের মধ্যেই তারা জেনারেল মঞ্জুর বীর উত্তম-এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। ফলে জেনারেল মঞ্জুর ও তার প্রতি আনুগত্যশীল অফিসারেরা আর ক্যান্টনমেন্টে ফিরে যেতে তো পারেইনি বরং পালিয়ে যেতেও পারেনি। পালিয়ে যাওয়ার সময় দৃশ্যত অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি আব্দুস সাত্তার সরকারের প্রতি আনুগত্যশীল, কিন্তু প্রকৃত অর্থে মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমানের প্রতি আনুগত্যশীল সৈন্যদের আক্রমণে মঞ্জুর সমর্থিত কয়েকজন অফিসার হতাহত হলেও মেজর খালেদ ও মেজর মুজাফফর পালিয়ে ভারত সীমান্তের দিকে না গিয়ে ঢাকা আসতে সমর্থ হয় এবং কর্নেল শওকত আলীর সেলটারে (আশ্রয়) থাকে। অন্যদিকে জেনারেল মঞ্জুর বীর উত্তমসহ তার আরো কয়েকজন অনুগামী অফিসার জিয়া সৈনিকদের হাতে গ্রেপ্তার হলে, জিয়াউর রহমান হত্যায় নিরাপদ দূরত্ব থেকে জড়িত তৎকালীন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল এইচ এম এরশাদ গ্রেপ্তারকৃত জেনারেল মঞ্জুরকে সঙ্গে সঙ্গে হত্যা করান। জেনারেল এরশাদ জিয়া হত্যায় তার সংশ্লিষ্টতা যাতে প্ৰকাশ না হয়ে পড়ে সেই জন্য জেনারেল মঞ্জুর বীর উত্তমকে গ্রেপ্তার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হত্যা করা। জেনারেল মঞ্জুর আমাদের অস্ত্র দিতে ব্যর্থ হলে এবং গ্রেপ্তার ও নিহত হলে আমাদের সাথীরা ঢাকা ফিরে এসে মেজর খালেদ ও মেজর মুজাফফরকে রাজশাহী সীমান্ত দিয়ে ভারতের মুর্শিদাবাদ পৌঁছে দেয়। মুক্তিযোদ্ধা রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান হত্যায় জড়িত গ্রেপ্তারকৃত জেনারেল মঞ্জুরের সাথী বারজন মুক্তিযোদ্ধা সামরিক অফিসারের গোপন সামরিক আদালত (কোর্ট মার্শাল)-এ বিচার শুরু হলে কর্নেল শওকতের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধা সংহতি পরিষদ মেজর জিয়াউদ্দিনের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধা সংগ্রাম পরিষদ এবং মুক্তিযুদ্ধের ডেপুটি সেক্টর কমান্ডার লেঃ কর্নেল কাজী নুরুজ্জামানের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ এই তিনটি মুক্তিযোদ্ধা সংগঠন ঐ বিচারের বিরুদ্ধে এবং গ্রেপ্তারকৃত মুক্তিযোদ্ধা সামরিক অফিসারদের মুক্তির দাবীতে আন্দোলনের ডাক দেয়।

উল্লেখিত তিনটি মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠন ঢাকায় বিক্ষোভ মিছিল, সমাবেশ ইত্যাদি কর্মসূচি চালিয়ে যেতে থাকে এবং এই সকল কর্মসূচীতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনৈতিক দলসমূহের সমর্থন ও অংশগ্রহণের জন্য জোর প্রচেষ্টা চালাতে থাকে। কিন্তু একমাত্র আব্দুর রাজ্জাক ছাড়া অন্য কোন রাজনৈতিক নেতাকে ঐ সময় পাওয়া যায়নি। মুক্তিযোদ্ধা সামরিক অফিসারদের মুক্তির জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের আন্দোলন সত্ত্বেও মুক্তিযোদ্ধা রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান হত্যার অভিযোগে সামরিক আদালতের গোপন বিচারে বারজন মুক্তিযোদ্ধা সামরিক অফিসারের ফাঁসিতে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হলো। এদিকে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল এইচ এম এরশাদের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রতিষ্ঠিত অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি আব্দুস সাত্তার নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ঘোষণা করেন এবং তিনি নিজে প্রার্থী হন।

আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শেখ হাসিনা অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আব্দুস সাত্তারের বিপরীতে ডঃ কামাল হোসেনকে রাষ্ট্রপতি প্রার্থী করে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেও নির্বাচনের তারিখ পিছানোর দাবী করতে থাকেন। কিন্তু সেনাবাহিনী প্রধান এরশাদ সমর্থিত বিচারপতি সাত্তার সরকার আওয়ামী লীগের নির্বাচন পিছানোর দাবী অগ্রাহ্য করে। ‘৮১ সালের ঐ রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচাইতে বেশি সংখ্যক ব্যক্তি রাষ্ট্রপতি প্রার্থী হলে সরকারী গোয়েন্দা সংস্থা এন এস আই (ন্যাশনাল সিকিউরিটি ইনটিলিজেন্স বা জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা)-এর কর্মকর্তারা রাষ্ট্রপতি প্রার্থীদের মোটা অংকের ঘুষ দিয়ে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করায়। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা যে কোন একজন রাষ্ট্রপতি প্রার্থীকে হত্যা করে তাদের নির্বাচন পিছানোর দাবী বাস্তবায়িত করার গোপন নির্দেশ দেন। উল্লেখ্য, এক প্রার্থী খুন হলে নির্বাচনী আইন অনুযায়ী ঐ নির্বাচন তিন মাসের জন্য স্থগিত হয়ে যাবে। প্রার্থী হত্যায় শেখ হাসিনার গোপন নির্দেশ বাস্তবায়িত না হওয়ায় এবং সাত্তার সরকার আওয়ামী লীগের নির্বাচন পিছানোর দাবি মেনে না নেওয়ায় নির্দিষ্ট সময়ে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন হয় এবং সেই নির্বাচনে সেনাবাহিনী সমর্থিত বি এন পি প্রার্থী বৃদ্ধ বিচারপতি আব্দুস সাত্তার বিপুল ভোটের ব্যবধানে আওয়ামী লীগ প্রার্থী ডঃ কামাল হোসেনকে পরাজিত করে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন।

বিচারপতি সাত্তার রাষ্ট্রপতি হলেও মূলত ক্ষমতা থেকে যায় সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল এরশাদের হাতে। জেনারেল এরশাদ যখন যেভাবে খুশি সেভাবেই রাষ্ট্রপতি সাত্তারকে পরিচালনা করতে থাকেন। প্রকৃত অর্থে জনগণের ভোটে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আব্দুস সাত্তার হয়ে যান সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল এরশাদের নাচের পুতুল।

 

লেবানন ট্রেনিং

১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে হত্যা করার পর যারা কাদের সিদ্দিকী (বাঘা সিদ্দিকী)-এর সঙ্গে মিলে ঐ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে যুদ্ধ করেছিল, তাদের কয়েকজন ১৯৮২ ইং সালের জানুয়ারী মাসের প্রথম সপ্তাহে ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কন্যা শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট (ঢাকা সেনানিবাস) দখল করার একটা প্রস্তাব ও পরিকল্পনা জানালে শেখ হাসিনা উক্ত প্রস্তাব ও পরিকল্পনা সানন্দে গ্রহণ করেন। পরিকল্পনাটা থাকে এই রকম যে, রাজনৈতিক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এবং কমিটেড় পঁচিশ- তিরিশ হাজার যুবককে সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়ে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত করে, নির্দিষ্ট একটি দিনে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে কমান্ডো হামলা করে দখলে নিয়ে নেওয়া। আর ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট দখল করে নেওয়া মানেই বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে ফেলা। শেখ হাসিনা সর্বশক্তি দিয়ে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করার নির্দেশ দিলেন এবং তার নিজের (শেখ হাসিনার) পক্ষ থেকে সর্বপ্রকার সাহায্য-সহযোগিতা এবং নেতৃত্ব দেওয়ার কথা ঘোষণা করলেন।

শুরু হলো ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট দখল করার জন্য রাজনৈতিক কর্মী তৈরি করা এবং সাথে সাথে এই কর্মীদের কোথায় সামরিক প্রশিক্ষণ দেওয়া যায় সেই স্থান খুঁজে বের করা। কর্মী সংগ্রহের জন্য সারা দেশে গোপনে রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ শুরু হলো। এই কর্মীদের মন-মানসিকতা ও ধ্যান-ধারণা এবং ব্যক্তিগত গুণাবলীর প্রতি বিশেষ নজর দেওয়া হলো। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই বড় ধরনের একটা কর্মী বাহিনী তৈরি করা গেল। এই কর্মী বাহিনীর মধ্যে থেকে রাজনৈতিক শিক্ষা দিয়ে বাছাই করে একটা ব্যাচ তৈরি করা হলো সামরিক শিক্ষার জন্য। অর্থাৎ মিলিটারী (আর্মি) ট্রেনিং-এর জন্য প্রথম ব্যাচ তৈরি করা হলো। কিন্তু সমস্যা হলো সামরিক শিক্ষা দেওয়ার জায়গা এবং অস্ত্র কোথায় পাওয়া যাবে? রাজনৈতিক শিক্ষা দেওয়া যত সহজ সামরিক প্রশিক্ষণ দেওয়া অত সহজ নয়। সামরিক প্রশিক্ষণ দিতে হলে প্রথমেই প্রয়োজন একটা নিরাপদ, মুক্ত এলাকা। যে এলাকায় প্রশিক্ষণার্থীরা নিরাপদে অস্ত্র চালনার মাধ্যমে অস্ত্র শিক্ষা গ্রহণ করবে।

‘৭১ সালে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা ভারতীয় এলাকা নিরাপদে প্রশিক্ষণের ব্যবহার করেছিলাম। কিন্তু এখন তা সম্ভব নয়। মাত্র বৎসর কয়েক আগে ভারত তার মাটি থেকে কাদের সিদ্দিকীর বাহিনীকে তাড়িয়ে দিয়েছে। সামরিক প্রশিক্ষণের জন্য ভারতের মাটি ব্যবহারের কোনই সম্ভাবনা নেই। বাংলাদেশের সুন্দরবন এবং হিলট্রক্টও সামরিক শিক্ষার জন্য মোটেই নিরাপদ নয়। আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় আমাদের কোন বন্ধু নেই। আফগানিস্তান কট্টর মৌলবাদীদের নিয়ন্ত্রণে। সেখানেও আমাদের কোন জায়গা নেই। সোভিয়েত ইউনিয়ন (রাশিয়া) এর কোনই সাড়া-শব্দ নেই। এমতাবস্থায় চিন্তা করতে করতে লেবানন এবং পি এল ও (প্যালেস্টাইন লিবারেশন অরগানাইজেশন) এর কথা বিবেচনায় এসে গেল। গোপন যোগাযোগ করা হলো পি এল ও’র ঢাকাস্থ প্রতিনিধি আহমেদ এ রাজেক-এর সাথে। পি এল ও’র ঢাকাস্থ গুলশান এম্বাসিতে পি এল ও প্রতিনিধি আহমেদ এ, রাজেকের সাথে গোপনে কয়েক দফা বৈঠক হলো। আহমেদ এ, রাজেককে খোলাখুলি বলা হলো আমরা সামরিক প্রশিক্ষণ চাই, বিনিময়ে তোমরা যা চাও আমরা দেব। আহমেদ এ, রাজেক মাসখানেক সময় চাইলো।

মাসখানেক পর আহমেদ এ রাজেক-এর সাথে আবার বৈঠক হলো। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হলো পি এল ও আমাদেরকে লেবাননের মাটিতে সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়ে দেবে। বিনিময়ে আমাদেরকে পি এল ওর পক্ষে ইসরাইলীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে। আমরা রাজি হলাম। আমাদের প্রথম ব্যাচ লেবাননে গেলে তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে ইসরাইলের বিপক্ষে পি এল ও’র পক্ষে যুদ্ধ করার জন্য সরাসরি রণাঙ্গনে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। প্রথম ব্যাচ যুদ্ধ করতে থাকবে, দ্বিতীয় ব্যাচ লেবানন যাবে। দ্বিতীয় ব্যাচের প্রশিক্ষণ শেষে রণাঙ্গনে গিয়ে যুদ্ধ করতে শুরু করলে প্রথম ব্যাচ বাংলাদেশে ফেরত দেবে। অর্থাৎ আমাদের একটা ব্যাচকে সব সময়ই পি এল ওর হয়ে যুদ্ধ করতে হবে।

আমাদের বিমানে করে লেবাননে নিয়ে যাওয়া এবং ঢাকায় নিয়ে আসার ব্যয় পি এল ও বহন করবে। আমাদের যারা যুদ্ধ করবে তাদের পি এল ও বেতন দেবে।

সময়ে সময়ে সকল বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনাকে জানানো হলো এবং তার পরামর্শ নেওয়া হলো। পি এল ওর সাথে বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রথম ব্যাচকে ‘৮২ সালের মে মাসের শেষ সপ্তাহে লেবানন পাঠিয়ে দেওয়া হলো।

প্রথম ব্যাচ সামরিক প্রশিক্ষণশেষে ইসরাইল সীমান্তে গিয়ে পি এল ওর পক্ষে যুদ্ধ করতে লাগলো। এদিকে দ্বিতীয় ব্যাচ লেবানন যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলো। এমন সময় ইসরাইল আক্রমণ করে লেবাননই দখল করে নিল। আমাদের সকল যোদ্ধা ইসরাইলীদের হাতে বন্দী হলো। আমাদের সব পরিকল্পনা ও কর্মসূচী ভেস্তে গেল। আমাদের যোদ্ধাদের মা-বাবা, আত্মীয়-স্বজন সবাই কান্নাকাটি শুরু করলো। মুজিব কন্যা শেখ হাসিনা বেমালুম সব ভুলে গেলেন। নিঃশব্দ নীরব থাকলেন। আমাদের ছেলেদের ব্যাপারে কোনদিন আর কোন কথা বললেন না। অতঃপর অতি কষ্টে পাকিস্তান রেডক্রস-এর মাধ্যমে ইসরাইলের হাতে বন্দী আমাদের যোদ্ধাদের দেশে ফিরিয়ে আনা হলো।

 

এরশাদকে ক্ষমতা গ্রহণের আমন্ত্রণ

এদিকে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল এইচ এম, এরশাদকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের পূর্ণাঙ্গ আমন্ত্রণ জানাতে থাকেন।

জননেত্রী শেখ হাসিনা জনগণের পক্ষ থেকে জেনারেল এরশাদকে ক্ষমতা দখলের ব্যাপারে সর্বপ্রকার সাহায্য সহযোগিতার আশ্বাস দিতে থাকেন। নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি ও সরকার উৎখাত করে সামরিক বাহিনীর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করার ব্যাপারে জেনারেল এরশাদ এবং বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার চার-পাঁচ দফা গোপন বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।

অতঃপর জেনারেল এরশাদ সামরিক অভ্যুত্থানের ইতিহাসে নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করে ক্ষমতা দখলের অনেক আগেই ঢাকা সেনানিবাসে সংবাদপত্রের সম্পাদক বৈঠক ডেকে সামরিক অভ্যুত্থানের ঘোষণা দেন।

‘৮২ সালের মার্চের ২৪ তারিখ জেনারেল এরশাদ বিনা বাধায় বিনা বাক্যে জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আব্দুস সাত্তারকে রাষ্ট্রপতি ভবন বঙ্গভবন থেকে গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দেন এবং পরের দিন আবার কলার ধরে নিয়ে এসে রেডিও-টেলিভিশনে নিজের অযোগ্যতা ও তার সরকারের দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতি ইত্যাদি কারণে স্বেচ্ছায় সেনাবাহিনী প্রধান এরশাদের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করে তিনি (রাষ্ট্রপতি সাত্তার) বিদায় নিলেন এ মর্মে ভাষণ দিতে বাধ্য করে। অশীতিপর বৃদ্ধ অথর্ব রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আব্দুস সাত্তার প্রাণভয়ে কাপুরুষের মতো নিরবে-নিঃশব্দে প্রাণ নিয়ে বিদায় নিলেন। সেনাবাহিনী প্রধান লেঃ জেঃ হোঃ মোঃ এরশাদ দেশে সামরিক আইন জারি করলেন এবং তিনি স্বয়ং হলেন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও বিচারপতি এ এফ এম আহসানউল্লা চৌধুরীকে করলেন ক্ষমতাবিহীন নামমাত্র রাষ্ট্রপতি। শেখ হাসিনার গোপন আমন্ত্রণে ও সহযোগিতায় জেনারেল এরশাদ সর্বময় ক্ষমতার মালিক হয়ে জগদ্দল পাথরের ন্যায় জনগণের বুকে চেপে বসলো।

 

‘৮৩-র মধ্য ফেব্রুয়ারী ছাত্র হত্যা

বছর না ঘুরতেই প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল এরশাদ আর বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার গোপন আঁতাতের মাঝে গোপন বিরোধ সৃষ্টি হলো ১৯৮৩ সালের জানুয়ারীর শেষ সপ্তাহে শেখ হাসিনার স্বামী ডঃ ওয়াজেদ আলী মিয়ার মহাখালিস্থ আণবিক শক্তি কমিশনের সরকারী বাসভবনে শেখ হাসিনা বলেন, লেঃ জেঃ এরশাদ হাতের মুঠোয় আর থাকতে চাচ্ছে না। আমার হাতের মুঠো থেকে খাটাশটা ক্রমশ বেরিয়ে যাচ্ছে। ওকে হাতের মুঠোয় পোক্ত করে আটকে রাখা দরকার।

প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এরশাদকে হাতের মুঠোয় রাখার জন্য শেখ হাসিনা নামকা ওয়াস্তে ভুয়া এক ছাত্র আন্দোলনের পরিকল্পনা হাজির করে বলেন, এই ছাত্র আন্দোলনের অবশ্যই ছাত্র নিহত হতে হবে। যে করেই হোক ছাত্র আন্দোলনে নামে ছাত্র হত্যা হতেই হবে। ছাত্র হত্যা হলে ছাত্র আন্দোলন চাঙ্গা হবে। আর ছাত্র আন্দোলন চাঙ্গা থাকলেই কেবল সি এম এল এ জেনারেল এরশাদকে হাতের মুঠোয় শক্ত ভাবে রাখা যাবে। শেখ হাসিনা ছাত্র আন্দোলনের নামে ছাত্র হত্যার কঠিন নির্দেশ ও পরিকল্পনা দিলেন। কোন আততায়ী বা অজ্ঞাত ঘাতকের হাতে ছাত্র হত্যা হলে কাজ হবে না । ছাত্র হত্যা হতে হবে সামরিক শাসক এরশাদের মিলিটারী অথবা পুলিশের হাতে।

বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা বললেন, টাকা যা-ই লাগুক, এটা করতেই হবে। কিভাবে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করা যায় সবাই এ নিয়ে খুব ব্যস্ত ও চিন্তিত।

যোগাযোগ হলো প্যারা মিলিটারী ট্রুপস আর্মড পুলিশের কোম্পানী কমান্ডার (সিনিয়র এস পি) হাফিজুর রহমান লস্করের সঙ্গে। এই হাফিজুর রহমান লস্কর পুলিশের অফিসার হয়েও দীর্ঘদিন যাবত এন এস আই (ন্যাশনাল সিকিউরিটি ইন্টিলেজেন্ট বা রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা) এর ডেপুটি ডাইরেক্টর পদে ঘাপটি মেরে বসে ছিলেন। এরশাদ ক্ষমতায় এসেই হাফিজুর রহমান লস্করকে এই বলে এন এস আই থেকে ঝেটিয়ে বিদায় করেছেন যে, তুমি পুলিশের লোক হয়ে এখানে কি কর? যাও, পুলিশের পোষাক পরে রাস্তায় চোর ধর। বলেই এন এস আই-এর ডেপুটি ডাইরেক্টরের পদ থেকে হাফিজুর রহমান লস্করকে সোজা আর্মড পুলিশের তৎকালীন হেডকোয়ার্টার ১৪নং কোম্পানী কমান্ডার পদে বদলী করে পাঠিয়ে দেয়। এই কারণে আমড় পুলিশের কোম্পানী কমান্ডার (পুলিশের সিনিয়র এস পি) হাফিজুর রহমান লস্কর জেনারেল এরশাদ ও তার সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে খুবই চটা ও বৈরী ছিলেন। এর উপর ছিল নগদ অর্থের টোপ ৷

এরশাদের প্রতি ভয়ানক ক্ষেপা ও বিরাগভাজন এবং নগদ অর্থের টোপ দু’য়ে মিলে, ছাত্র আন্দোলনের নামে ছাত্র হত্যার প্রস্তাব আসা মাত্র সঙ্গে সঙ্গে হাফিজুর রহমান লস্কর প্রস্তাব গ্রহণ করলেন। এন এস আই এর মূলত কাজ হচ্ছে কারা সরকারের বিরুদ্ধাচরণ করে তাদের লিস্ট বা তালিকা তৈরি করে সরকারকে সরবরাহ করা এবং সরকারের পতন হলে সঙ্গে সঙ্গে পতন হয়ে যাওয়া সরকারের আমলে তৈরি করা সমস্ত নথিপত্র পুড়িয়ে ধ্বংস করে ফেলে নতুন সাদা ফাইল নিয়ে নতুন সরকারের কাছে হাজির হওয়া।

৩০শে মে ‘৮১ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান নিহত হলে এন এস আই-এর কর্মকর্তাগণ জিয়া বা বিএনপি সরকারের আমলে তৈরি করা সমস্ত নথিপত্র পুড়িয়ে ফেলতে যায়। কিন্তু যে মুহূর্তে নথিপত্রে অগ্নিসংযোগ করতে যাবে ঠিক সেই মুহূর্তে উপ-রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাত্তার অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত হন। অর্থাৎ বিএনপি সরকারই টিকে যায়। ফলে এন এস আই কর্মকর্তাগণ নথিপত্র পুড়িয়ে না ফেলে আবার তা সংগ্রহশালায় যত্ন করে তুলে রাখেন। উপ- রাষ্ট্রপতি সাত্তার অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হলেও মূলত ক্ষমতা চলে যায় সেনাবাহিনী প্রধান হোসেন মোহাম্মদ এরশাদের হাতে। সেই সুবাদে জেনারেল এরশাদ বিচারপতি সাত্তারকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি পদ রেখে এন এস আই নতিপত্রগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। এনএসআই-এর নথিপত্রে জিয়াউর রহমান বা বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধাচরণকারীদের তালিকায় জেনারেল এরশাদ-এর নামও ছিল । ফলে জেনারেল এরশাদ ক্ষমতায় এসে প্রথমেই এন এস আই থেকে হাফিজুর রহমান লস্করকে ঝেটিয়ে বিদায় করে। আর সেই কারণেই এবং নগদ অর্থের বিনিময়ে হাফিজুর রহমান লস্কর গং জেনারেল এরশাদ ও তার সামরিক শাসনের পতনের যে কোন প্রস্তাব বা প্রক্রিয়ায় শামিল হন।

আর্মড পুলিশের কোম্পানী কমান্ডার হাফিজুর রহমান লস্করের সঙ্গে ছাত্র আন্দোলনের নামে ছাত্র হত্যার নীলনক্সা চূড়ান্ত হয়। নীলনক্সা অনুযায়ী যে কোন প্রকারে ছাত্রদের একটি মিছিল বাংলা একাডেমির দক্ষিণে, কার্জন হলের উত্তরে, শিশু একাডেমির পশ্চিমে দোয়েল চত্বর পর্যন্ত নিয়ে আসলেই হবে। বাকি কাজ আর্মড পুলিশ সেরে ফেলবে। অর্থাৎ আমাদের দায়িত্ব ছাত্রদের একটা মিছিল দোয়েল চত্বর পর্যন্ত নিয়ে আসা, তারপর সেই মিছিলের উপর গুলি চালিয়ে ছাত্র হত্যার দায়িত্ব আর্মড পুলিশের কোম্পানী কমান্ডার হাফিজুর রহমান লস্করের। এই নীলনক্সা অনুযায়ী মিছিল নিয়ে আসার প্রাথমিক দায়িত্ব পড়ে জগন্নাথ হল ছাত্র সংসদের জি-এস কাদেরিয়া বাহিনীর সদস্য নিরঞ্জন সরকার বাচ্চু, সাধন সরকার, যাদব, বিদ্যুৎ, শ্যামল, প্রমুখ-এর উপর। জেনারেল এরশাদের বিরুদ্ধে একটা মিছিল করার প্রস্তাব নিয়ে ছাত্রনেতা ফজলুর রহমান, বাহালুল মজনুন চন্নু, ডাঃ মোস্তফা মহিউদ্দিন জালাল, খ, ম জাহাঙ্গির, ডাকসুর ভিপি আক্তারুজ্জামান, জি এস জিয়াউদ্দিন বাবলু, ফারুক, আনোয়ার, মিলন, জালাল প্রমুখ ছাত্রনেতাদের সাথে আলোচনা করা হলে সকলেই মিছিলের পক্ষে মত দেন।

ফেব্রুয়ারী মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের প্রথমেই মিছিলের তারিখ নির্ধারণ হলো এবং মিছিল শিক্ষা ভবন পর্যন্ত যাওয়ার সিদ্ধান্ত হলো। সিদ্ধান্ত মোতাবেক কলা ভবন থেকে ছাত্র মিছিল শুরু হলো। এদিকে শিশু একাডেমির কাছে আর্মড পুলিশ নিয়ে মিছিলে গুলি করে ছাত্র হত্যার জন্য পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে হাফিজুর রহমান লস্কর চাতক পাখির ন্যায় অপেক্ষা করতে থাকলো। কিন্তু কিছুতেই মিছিলকে কলা ভবনের আশপাশের বাইরে নেওয়া গেল না। অধিকাংশ ছাত্রনেতা মিছিল নিয়ে এগিয়ে যেতে মুখে অস্বীকার না করলেও, কার্যত মিছিল নিয়ে কেউ কলা ভবনের বাইরে গেল না। ফলে নীলনক্সা ভেস্তে যাওয়ায় আমরা উত্তেজিত হয়ে ছাত্রনেতাদের লাঞ্ছিত করলাম এবং কোন কোন ছাত্রনেতাকে শারীরিকভাবে আঘাতও করলাম। আবার ছাত্র মিছিলের নতুন তারিখ নির্ধারিত হলো।

আগামী ১৪ই ফেব্রুয়ারী ১৯৮৩, ১লা ফাল্গুন ছাত্র মিছিল হবে এবং মিছিল শিক্ষা ভবন অভিমুখে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হলো।

১২ই ফেব্রুয়ারী ‘৮৩ সকাল ৮টায় ১৪নং মীরপুর আর্মড পুলিশের হেড কোয়ার্টারে এন এস আই-এর সাবেক কর্মকর্তা পুলিশের সিনিয়র এস পি আর্মড পুলিশের কোম্পানী কমান্ডার হাফিজুর রহমান লস্করকে আগামী ১৪ই ফেব্রুয়ারী ছাত্র মিছিলের চূড়ান্ত কর্মসূচী অবহিত করা হলো এবং ১৩ই ফেব্রুয়ারী রাত আটটায় হাফিজুর রহমান লঙ্কর-এর মীরপুর দুই নম্বরের বাসায় আগামীকাল ১৪ই ফেব্রুয়ারী সকাল দশটায় যে কোন কিছুর বিনিময়ে ছাত্র মিছিল শিশু একাডেমী পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার কর্মসূচী নিশ্চিত করা হলো এবং নগদ অর্থ প্রদান করা হলে তিনিও (হাফিজুর রহমান লস্কর) ছাত্র হত্যার জন্য প্রস্তুত বলে চূড়ান্তভাবে জানান। রাত এগারোটায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের এসেম্বলী বিল্ডিং-এ জগন্নাথ হল ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক ‘৭৫-এর কাদেরিয়া বাহিনীর সদস্য ছাত্রনেতা নিরঞ্জন সরকার বাচ্চুর রুমে সর্বশেষ গোপন বৈঠক হয়। বৈঠকে উপস্থিত ছাত্রনেতা নিরঞ্জন সরকার বাচ্চু, মোবারক হোসেন সেলিম, ডাকসুর মহিলা সম্পাদিকা নাহিদ আমিন খান, সাধন সরকার, যাদব, বিদ্যুৎ প্রমুখকে আগামীকাল ১লা ফাল্গুন মোতাবেক ১৪ই ফেব্রুয়ারী ১৯৮৩ সকালের ছাত্র মিছিল ও ছাত্র হত্যা সম্পর্কে বিস্তারিত জানানো ও আলোচনা শেষে সিদ্ধান্ত হয় যে, ছাত্রনেতা ফজলুল রহমান, বাহালুল মজনুন চুন্নসহ প্রগতিশীল ছাত্রনেতা ও নেতৃস্থানীয় কর্মীরা কোন অবস্থাতেই আণবিক শক্তি কমিশনের পরে যাতে মিছিলে না থাকে সেই ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে হবে।

আজ ১লা ফাল্গুন, ১৪ই ফেব্রুয়ারী ১৯৮৩। ফুল ফুটুক আর নাই ফুটুক আজ বসন্ত। ঋতুর রাজা বসন্তের এই সমীরণে আজ সবাই উদ্বেলিত। বাঙালি রমণীরা লাল পেড়ে হলুদ শাড়ি পরে ভোর হতে না হতেই ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে বসন্তকে অবগাহন করতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া ও সামসুন্নাহার হলের ছাত্রীরা খুব ভোর থেকেই লাল পেড়ে বাসন্তি রঙয়ের শাড়ি পরে বসন্ত উৎসবে মেতে উঠেছে। বসন্ত উৎসব মুখর বিশ্ববিদ্যালয়। লাল পাড় হলুদ বর্ণের শাড়ি পরে কোন কোন ছাত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস ছেড়ে মনের মানুষের সাথে বসন্ত উৎসব করতে দূর-দূরান্তে চলে যাচ্ছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় লাল পেড়ে হলুদ শাড়ির সমারোহ। আজি এ বসন্ত … সবাই বসন্তের দোলায় দুলছে । কেউ জানে না একটু পরে কি ঘটতে যাচ্ছে। কে নিহত হতে যাচ্ছে । কোন্ স্নেহময়ী মাতার বুক খালি হচ্ছে। কোন পিতা সন্তানহারা হচ্ছে। বেলা দশটার দিকে কলাভবনের সামনে অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে মিছিলের উদ্দেশ্যে ছাত্ররা জমায়েত হতে শুরু করে। একটি মটর সাইকেল ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে শেখ হাসিনা, বিশ্ববিদ্যালয় এবং আমড় পুলিশের হাফিজুর রহমান লস্কর-এর সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করে যাচ্ছে। মটর সাইকেলটি দ্রুত গতিতে ৩২ নম্বরে শেখ হাসিনা ও শিশু একাডেমীর পূর্ব পাশে অবস্থানরত আর্মড পুলিশের কোম্পানী কমান্ডার হাফিজুর রহমান লস্করের কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বশেষ পরিস্থিতি জানিয়ে যাচ্ছে। বেলা এগারোটা নাগাদ ছাত্র মিছিল শুরু হলো।

যেসব ছাত্রনেতা ও কর্মীদের আণবিক শক্তি কমিশনের পরে মিছিলে আর না থাকতে জানিয়ে দেওয়ার কথা তাদেরকে তা জানিয়ে দেওয়া হলো।

সিদ্ধান্ত ও পরিকল্পনামতো মিছিলসহ এগিয়ে গেলে কিছু ছাত্রনেতা ও কর্মীরা মিছিলের পিছন থেকে সরে পড়লো। মিছিল এগিয়ে গেল বাংলা একাডেমী ছেড়ে আরো সামনে দক্ষিণের দোয়েল চত্বরের দিকে। একেবারে দোয়েল চত্বরের কাছে এবং মিছিল যেই দোয়েল চত্বর পিছনে ফেলে পূর্ব দিকে ঘুরে দাঁড়ালো সঙ্গে সঙ্গে আগে থেকে ওঁৎ পেতে থাকা হাফিজুর রহমান লস্করের আর্মড পুলিশের গুলি, গুরুম গুরুম, টাস টাস ! মুহূর্তের মধ্যে লুটিয়ে পড়লো কয়েকজন ছাত্র।

মটর সাইকেলটি দ্রুত ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে গিয়ে শেখ হাসিনাকে গুলির সংবাদ দিয়ে আবার ছুটে চললো ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। ইতোমধ্যে ছাত্ররা হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে গুলিবিদ্ধ ছাত্রদের নিয়ে এসেছে, গুলিবিদ্ধ ছাত্রদের মধ্যে জয়নাল ও জাফর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে পৃথিবী ছেড়ে পরকালে চলে গেছে। জয়নাল ও জাফরের মায়ের কোল খালি হয়েছে। শূন্য হয়েছে পিতার বুক। নীল-নক্সা বাস্তবায়িত হওয়ার চূড়ান্ত সংবাদটি নিয়ে মটর সাইকেলটি চলে গেল ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে। দুজন ছাত্র হত্যার সফলতার সংবাদটি শেখ হাসিনাকে দিয়ে মটর সাইকেলটি ফিরে এলো বিশ্ববিদ্যালয়ে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। থেমে গেছে ১লা ফাল্গুনের বসন্তের উৎসব। ছাত্ররা তাদের নিহত সাথী জাফর ও জয়নালের লাশ কলা ভবনের অপরাজেয় বাংলার পাদদেশ ঐতিহাসিক বটতলায় নিয়ে এসেছে। বিকেল তিনটায় জানাজা ও শোকসভার কর্মসূচীটা ৩২ নম্বরে দিলে, দুপুর ২টা নাগাদ বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলা আসেন এবং তার (শেখ হাসিনার) দীর্ঘ প্রতীক্ষিত নিহত ছাত্রদের লাশ দেখে রুমাল দিয়ে চক্ষু মোছার ভান করতে করতে কোন কর্মসূচী না দিয়েই বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ত্যাগ করেন। শোকে ম্রিয়মাণ ছাত্র-ছাত্রীরা বটতলায় সমবেত হতে থাকে এবং ১লা ফাল্গুনে বসন্তের পোষাক লাল পেড়ে বাসন্তি রঙ-এর শাড়ি পরে প্রত্যুষে ক্যাম্পাসের বাইরে যাওয়া রোকেয়া ও শামসুন্নাহার হলের ছাত্রীরা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ফিরে এসে ছাত্র হত্যার ঘটনায় শোকে বিহ্বল হয়ে বটতলার শোকসভায় সমবেত হয়।

শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ত্যাগ করে যেয়েই সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল হোসাইন মোহাম্মদ এরশাদের সাথে যোগাযোগ করেন এবং ছাত্রহত্যার প্রতিবাদে কোনরূপ আন্দোলনের কর্মসূচী না দেওয়ার বিনিময়ে এরশাদের কাছ থেকে কতগুলো গোপন দাবী আদায় করে নেন । ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে আন্দোলনের কর্মসূচী দেওয়া হবে না এই মর্মে শেখ হাসিনার কাছ থেকে নিশ্চয়তা ও আশ্বাস পাওয়ার পর জেনারেল এরশাদ সমগ্র বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় চতুর্দিকে থেকে নজিরবিহীন পুলিশী ও মিলিটারী হামলা চালায়। পুলিশের সাঁড়াশি হামলার মুখে ছাত্রহত্যার প্রতিবাদে বটতলায় অনুষ্ঠিত জানাজা ও শোকসভায় সমবেত ছাত্র- ছাত্রীরা দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে দৌড়াতে থাকে। কিন্তু যেদিকেই দৌড়ায় সেদিকেই পুলিশ ও আর্মির বেধড়ক মার। নিমেষের মধ্যেই বটতলায় হাজার হাজার স্যান্ডেল-জুতা পড়ে থাকা ছাড়া কোন মানুষের চিহ্ন থাকে না।

জাফর ও জয়নালের লাশ দু’টি অতি কষ্টে ছাত্ররা ধরাধরি করে সূর্যসেন হলে নিয়ে যায় এবং সূর্যসেন হলের গেটের ভেতর থেকে তালা লাগিয়ে বন্ধ করে দেয়। হলের রুমের ভেতরে ছাত্র, শিক্ষক, কর্মচারী, আর হলের আঙ্গিনায়সহ সারা বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু পুলিশ আর সেনাবাহিনী। মুহূর্তের মধ্যে পুলিশ আর আর্মি হলের কেচি গেট ভেঙ্গে রুমের মধ্যে প্রবেশ করবে। অবস্থা বেগতিক দেখে মটর সাইকেল আরোহী সূর্যসেন হলের দোতলা থেকে এক লাফ দিয়ে পড়লো হলের আঙ্গিনায়। আর অমনি শকুনের দল যেমনি মরা গরু ঘিরে ধরে খায় তেমনি পুলিশের দল মটর সাইকেল আরোহীকে ঘিরে পেটাতে লাগলো। এরই মধ্যে মটর সাইকেল আরোহী প্রাণপণে ছুটে চললো সূর্যসেন হলের বাউন্ডারী প্রাচীরের দিকে। মটর সাইকেল আরোহী দৌড়াচ্ছে আগে আগে, পিছনে পিছনে শকুনের ঝাঁকের ন্যায় দৌড়াচ্ছে আর পিটাচ্ছে পুলিশ ও আর্মি। পড়ি কি মরি করে এক লাফে সূর্যসেন হলের প্রাচীর টপকে কাঁটাবন আর পলাশির রাস্তায় গিয়ে পড়লো মটর সাইকেল আরোহী। সেখান থেকে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে গিয়ে শেখ হাসিনাকে না পেয়ে আণবিক শক্তি কমিশনের পরিচালক শেখ হাসিনার স্বামী ডঃ ওয়াজেদ মিয়ার মহাখালি সরকারী বাসভবনে গিয়ে শেখ হাসিনার পাজেরো জীপ পাওয়া গেলেও শেখ হাসিনাকে পাওয়া গেল না। শেখ হাসিনার প্রিয় এবং বিশ্বাসী বাবুর্চি রমাকান্তর কাছ থেকে জানা গেল তিনি (শেখ হাসিনা) কাউকে সাথে না নিয়ে অপরিচিত একটি প্রাইভেট কারে করে অপরিচিত একমাত্র চালক আরোহীর সাথে বোরকা পরে অজ্ঞাত স্থানে গিয়েছেন। এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সবগুলো হলের গেট ও দরজা ভেঙ্গে পুলিশ এবং মিলিটারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মচারী এবং ছাত্রদের বেধড়ক মারপিট ও গ্রেপ্তার করে সারারাত খোলা আকাশের নিচে বসিয়ে রাখে এবং নিহত ছাত্র জাফর ও জয়নালের লাশ নিয়ে যায়। বলাবাহুল্য, ঐ সময় (১৯৮৩ সালে) বেগম খালেদা জিয়া এবং তার দল বিএনপি-র সাংগঠনিক কোন অস্তিত্ব ছিল না। ফলে বেগম খালেদা জিয়া ছাত্র হত্যার পর বিশ্ববিদ্যালয়েও আসেননি। সামরিক স্বৈরাচার জেনারেল এরশাদ এবং তার সামরিক আইনের বিরুদ্ধে চির সংগ্রামের ঐতিহ্যবাহী সহজ সরল প্রাণ এদেশের ছাত্র সমাজের প্রথম আন্দোলন, প্রথম বিদ্রোহ এবং আত্মদান। রাজনৈতিক নেতৃত্বের ব্যর্থতা এবং শেখ হাসিনার পাতানো আপোষহীনতার কারণে সম্পূর্ণ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। বৃথা হয়ে যায় জাফর ও জয়নালের আত্মদান। সামরিক স্বৈরাচার জেনারেল হুসাইন মোহাম্মদ এরশাদ নিশ্চিন্তে, নির্বিঘ্নে, নির্ভাবনায় ক্ষমতায় বসে থাকে। রাজনৈতিক নেতৃত্বের অভাবে ছাত্র সমাজ দিশেহারা হয়ে নেতিয়ে যায়। এদেশের আন্দোলন-সংগ্রাম-এর মূল চালিকা- শক্তি আওয়ামী লীগ এবং তার নেত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে ম্যানেজ করে দোর্দণ্ড প্রতাপে চলতে থাকে এরশাদের সামরিক শাসন।

সেলিম ও দেলোয়ার হত্যা

বছর ঘুরে এলো ১৯৮৪ সাল। আবার ফিরে এলো ভাষা আন্দোলনের শহীদের মাস, ফেব্রুয়ারী মাস। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী, বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নতুন বছরের নির্দেশ- এরশাদের বিরুদ্ধে আবারো ছাত্র আন্দোলন করতে হবে।

৩রা ফেব্রুয়ারী ১৯৮৪ সাল। ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু ভবনে বিকেল ৪টায় বসলো এক রুদ্ধদ্বার বৈঠক। বৈঠকে নেত্রী যে কোন প্রকারেই হোক ছাত্র আন্দোলন করার কঠোর নির্দেশ দিলেন। শুরু হলো আবার ছাত্র হত্যার নতুন পরিকল্পনা। একদিকে চলতে লাগলো ছাত্র হত্যাকারী পুলিশ অফিসার হাফিজুর রহমান লস্করদের ভাড়া করার কাজ। অন্যদিকে চলতে লাগলো সাধারণ ছাত্রদের ক্ষেপিয়ে তুলে ছাত্র আন্দোলন সংগঠিত করার কাজ।

শেখ হাসিনার প্রত্যক্ষ নির্দেশ ও তত্ত্বাবধানে খুবই দ্রুত ছাত্র হত্যাকারী পুলিশ অফিসারদের ভাড়া করার কাজ সম্পূর্ণ হলো। কিন্তু আন্দোলন করার নানাভাবে বহু রকম চেষ্টা-তদবির করেও ছাত্রদের আন্দোলনে শরীক করা গেল না।

গোটা ছাত্রসমাজই এরশাদের বিরোধী। কিন্তু আন্দোলনের প্রশ্নে, আন্দোলনের নেতৃত্বের প্রশ্নে ছাত্র সমাজ শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগকে বিশ্বাস করলো না। বেগম জিয়া এবং বিএনপি-র তখনো তেমন কোন অস্তিত্ব অনুভব করা যায়নি। দিন গড়িয়ে যায়, কিন্তু ছাত্র আন্দোলনের তেমন কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এদিকে ছাত্র হত্যাকারী আর্মড পুলিশেরা ‘৮৩র মধ্য ফেব্রুয়ারীতে সংঘটিত ছাত্র হত্যার অনুরূপ পরিকল্পনা ও কর্মসূচী হাতে নিয়ে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে এবং গত মধ্য ফেব্রুয়ারীর ন্যায় একটা ছাত্র মিছিল নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে আসার জন্য বারবার তাগাদা দিচ্ছে। তাগাদা দিচ্ছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা। দিন যায় কিন্তু আন্দোলনের কোন খবর নেই। এক পর্যায়ে জননেত্রী শেখ হাসিনা অধৈর্য হয়ে ‘তোমাদের দ্বারা কিছুই হবে না’ বলে ক্ষোভ প্রকাশ করলেন। অনেক চেষ্টা করেও শ’পাচেক ছাত্রের একটা মিছিল নিয়ে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে আসতে পারলাম না। ফলে গত ‘৮৩র মধ্য ফেব্রুয়ারীর ন্যায় ছাত্র হত্যা সম্ভব না হওয়ায় হত্যার ধরন পাল্টানো হলো।

আর্মড পুলিশের কোম্পানী কমান্ডার পুলিশের সিনিয়র এস পি হাফিজুর রহমান লস্কর ছাত্রহত্যার পরিকল্পনায় আর্মড পুলিশের পরিবর্তে রায়ট পুলিশকে সম্পৃক্ত করে এবং নতুন পরিকল্পনা অনুযায়ী ঠিক হয় যে, ২০/৫০ জনের একটি মিছিল কোন রকমে যে কোন দিন বিশ্ববিদ্যালয়ের যে কোন দিক দিয়ে বাইরে নিয়ে এলেই রায়ট পুলিশ (যে পুলিশ ২৪ ঘন্টা বিশ্ববিদ্যালয়েই থাকে) ছাত্র হত্যা পরিকল্পনা সফল করে দেবে। সাধারণ ছাত্র তো দূরের কথা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরাই মিছিলে আসতে চায় না।

এদিকে নেত্রীর কড়া নির্দেশ ছাত্রলীগের একটা খণ্ড মিছিল নিয়ে হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে যেতে হবে, নইলে তোমাদের দায়িত্ব থেকে বিদায় নিতে হবে। ২৮শে ফেব্রুয়ারী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস-এর বাইরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হলো এবং যথারীতি এই সিদ্ধান্ত জননেত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে জানান হলো শেখ হাসিনার মাধ্যমে এই সংবাদ হাফিজুর রহমান লস্করের মারফত রায়ট পুলিশের ঘাতকদের জানানো হলো।

২৮শে ফেব্রুয়ারী ১৯৮৪, হঠাৎ ৩০/৪০ জন ছাত্রের একটা মিছিল বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ত্যাগ করে চানখাঁরপুল হয়ে ফুলবাড়িয়া বাস স্ট্যান্ড এর দিকে দ্রুত যেতে থাকলো। এই মিছিলের পেছনে পেছনে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী রায়ট পুলিশের একটি লরি আসতে লাগলো। বোঝা গেল এবার সামনে থেকে ছাত্র হত্যা করা হবে না, হত্যা করা হবে মিছিলের পেছন থেকে। যারা এই পরিকল্পনা অবহিত তারা যতটা সম্ভব মিছিলের সামনে থাকতে লাগলো। মোটামুটি মিছিলের অনেকেই জানে পেছন থেকে মিছিলে আক্রমণ করা হবে। রায়ট পুলিশের লরি থেকেই এই আক্রমণ করা হবে তবে রায়ট পুলিশের লরি থেকে গুলি করা হবে, না অন্য কোন ভাবে আক্রমণ করা হবে এটা কেউ জানতো না। তখন বিকেল পাঁচটা, ক্ষুদ্র ছাত্র মিছিলটি নিমতলী পার হয়ে ফুলবাড়িয়া বাসস্ট্যান্ডে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই রায়ট পুলিশ তাদের লরিটি বিদ্যুৎ গতিতে মিছিলের উপর তুলে দিল। মিছিলের পিছন দিকে থাকা সেলিম মুহূর্তের মধ্যে পুলিশের লরির চাকায় পিষ্ট হয়ে গেল। বাকি সবাই রাস্তার দু’দিকে ছিটকে পড়ে প্রাণে বাঁচলেও দেলোয়ার সোজা দৌঁড়াতে লাগলো। প্রাণভয়ে দেলোয়ার দৌড়ায় আগে, দেলোয়ারের প্রাণবধ করতে পেছনে দ্রুত ছুটছে রায়ট পুলিশের লরি।

মিনিট দু’য়েক-এর মধ্যেই দেলোয়ারের দেহ চাকায় পিষে রাস্তার সাথে মিশিয়ে দেয় পুলিশের লরি। দেলোয়ারের দেহ এমন ভাবে রাস্তার সাথে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, এটা যে দেলোয়ারের দেহ তা বোঝাতো দূরের কথা, এটা যে একটা মানুষের দেহ তাই বোঝা যাচ্ছে না। আর পেছনে পিচ ঢালা রাস্তার সাথে থেতলে মিশে আছে সেলিমের দেহ।

ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু ভবনে সংবাদের জন্য অধীর আগ্রহে উৎসুক হয়ে বসে থাকা বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী, সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে রায়ট পুলিশের চাকায় পিষ্ট হয়ে সেলিম ও দেলোয়ারের নিহত হওয়ার সংবাদটি পৌঁছাল মটর সাইকেল আরোহী।

ছাত্রলীগের দু’জন নেতার নিহত হওয়ার সংবাদটি শুনে শেখ হাসিনা পুলকিত ও আনন্দিত হয়ে বলে উঠলেন, সাবাস।

তারপর গাড়ির ড্রাইভার জালালকে বললেন, জালাল গাড়ি লাগাও আমি বাইরে যাবো। মটর সাইকেল আরোহী সঙ্গে যেতে চাইলে নেত্রী বললেন, তোমরা এক কাজ করো, আগামীকাল ৩২শে সবাই আসো। আজ সবাই চলে যাও।

পরদিন সকালে বত্রিশে গিয়ে নেত্রীকে না পেয়ে মটর সাইকেল আরোহী সোজা মহাখালী চলে গিয়ে ড্রাইভার জালাল এবং পাজেরো জীপ দেখতে পেয়ে নিশ্চিত হলো, নেত্রী এখানেই আছেন। কিন্তু ঘরে গিয়ে নেত্রীকে না পেয়ে বাবুর্চি রমাকান্তের কাছে জানতে পারলো, নেত্রী অজ্ঞাত গাড়ী আর চালকের সঙ্গে অজ্ঞাত স্থানে গিয়েছেন অনেক ভোরে।

দুপুর ১টার দিকে ফিরে এসে নেত্রী খাওয়া-দাওয়া করে সোজা চলে এলেন ধানমন্ডি ৩২শে ভবনে। ছাত্রলীগের বেশ কিছু নেতা বিকেল তিনটায় ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু ভবনে এসে সভানেত্রী শেখ হাসিনার কাছে ছাত্রলীগ নেতা সেলিম ও দেলোয়ারকে পুলিশের লরির চাকায় পিষ্ট করে নির্মম ও নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করার প্রতিবাদে সামরিক একনায়ক স্বৈরাচারী এরশাদের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন করার কর্মসূচী চাইলে সভানেত্রী শেখ হাসিনা এই বলে ছাত্রনেতাদের সান্ত্বনা দেন যে, আমাদের মূল শত্রু জিয়াউর রহমান এবং তার দল বিএনপি। জিয়া তো শেষ। জেঃ এরশাদ বিএনপির কাছ থেকে মাত্র কিছুদিন হলো ক্ষমতা দখল করেছে। আমাদের এখন প্রধান কাজ, বিএনপিকে চিরতরে শেষ করে দেওয়া। এই মুহূর্তে আমরা জেনারেল এরশাদের বিরুদ্ধে সরাসরি যাব না। আমাদের মূল শত্রু বিএনপি এটা মনে রাখতে হবে। ছাত্রনেতারা সেলিম ও দেলোয়ারের হত্যার জন্য আবেগাপ্লুত হলে শেখ হাসিনা বলেন, আবেগপ্রবণ হয়ে লাভ নেই। সময় হলেই এদের পরিবারকে পুষিয়ে দেওয়া হবে।

ছাত্রনেতারা কোন রকম কর্মসূচী ছাড়াই ভগ্ন হৃদয়ে বঙ্গবন্ধু ভবন ত্যাগ করলো।

 

দেশদ্রোহী অসভ্য বাহিনী

৩রা মে ১৯৮৪ এর এক পড়ন্ত বিকেলে ধানমণ্ডি বঙ্গবন্ধু ভবনে বসে গল্প করছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনাসহ কয়েক জন। গল্পে গল্পে ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ ও পাকিস্তানী সেনাবাহিনী প্রসঙ্গ উঠলো। প্রসঙ্গ উঠলো ‘৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে গড়ে ওঠা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কথা।

জননেত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সম্পর্কে বললেন, এটা একটা সেনাবাহিনী হলো? এটা একটা বর্বর, নরপিশাচ, উচ্ছৃঙ্খল, লোভী, বেয়াদব বাহিনী। এই বাহিনীর আনুগত্য নেই, শৃঙ্খলা নেই, মানবিকতা নেই, মান্যগণ্য নেই, নেই দেশপ্রেম। এটা একটা দেশদ্রোহী অসভ্য হায়েনার বাহিনী। তোমরা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কথা বল। সারা বিশ্বে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মতো এত ভদ্র, নম্র, সভ্য, বিনয়ী এবং আনুগত্যশীল বাহিনী খুঁজে পাওয়া যাবে না। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মানবিকতা বোধের কোন তুলনাই চলে না। কি অসম্ভব সভ্য আর নম্র তারা !

পঁচিশে মার্চ রাতে তারা (পাকিস্তান আর্মি) এলো, এসে আব্বাকে (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব) সেলুট করলো, মাকে সেলুট করলো, আমাকেও সেলুট করলো। সেলুট করে তারা বলল, স্যার আমরা এসেছি শুধু আপনাদের নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য। অন্য কোন কিছুর জন্য নয়। আপনারা যখন খুশি, যেখানে খুশি যেতে পারবেন। যে কেউ আপনার এখানে আসতে পারবে। আমরা শুধু আপনাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবো। আপনারা বাইরে গেলে আপনাদের নিরাপত্তার জন্য আমরা আপনাদের সঙ্গে যাবো। কেউ আপনাদের এখানে এলে আমরা তাকে ভালভাবে তল্লাশি করে তারপর ঢুকতে দিব। এসবই করা হবে আপনাদের নিরাপত্তার জন্য। সত্যিই পাকিস্তানী সেনাবাহিনী যা করেছে তা সম্পূর্ণ আমাদের নিরাপত্তার জন্যই করেছে।

২৬শে মার্চ দুপুরে আব্বাকে (শেখ মুজিব) যখন পাকিস্তানী আর্মিরা নিয়ে যায়, তখন জেনারেল টিক্কা খান নিজে এসে আব্বাকে ও মাকে সেলুট দিয়ে, আদবের সাথে দাঁড়িয়ে বিনয়ের সাথে (শেখ মুজিবকে) বলে, স্যার আপনাকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান আলোচনার জন্য নিয়ে যেতে বলেছেন। আমি আপনাকে নিয়ে যেতে এসেছি। আপনাকে নেওয়ার জন্য বিশেষ বিমান তৈরি (স্পেশাল ফ্লাইট রেডি) আপনি তৈরি হয়ে নেন এবং আপনি ইচ্ছে করলে ম্যাডাম (বেগম মুজিব) সহ যে কাউকে সঙ্গে নিতে পারেন। আব্বা-মা’র সঙ্গে আলোচনা করে একাই গেলেন। পাকিস্তান আর্মি যতদিন ডিউটি করেছে এসেই প্রথমে সেলুট দিয়েছে।

শুধু তাই নয়, আমার দাদীর সামান্য জ্বর হলে পাকিস্তানীরা হেলিকপ্টার করে টুঙ্গিপাড়া থেকে দাদীকে ঢাকা এনে পি জি হাসপাতালে চিকিৎসা করিয়েছে। জয় (শেখ হাসিনার ছেলে) তখন পেটে, আমাকে প্রতি সপ্তাহে সি এম এইচ (সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে) নিয়ে চেকআপ করাতো। জয় হওয়ার একমাস আগে আমাকে সি এম এইচ-এ ভর্তি করিয়েছে। ‘৭১ সালে জ’ জন্ম হওয়ার পর পাকিস্তান আর্মিরা খুশিতে মিষ্টি বাঁটোয়ারা করেছে এবং জয় হওয়ার সমস্ত খরচ পাকিস্তানীরাই বহন করেছে। আমরা যেখানে খুশি যেতাম। পাকিস্তানীরা দু’টি জীপ করে আমাদের সাথে যেতো। নিরাপত্তার জন্য পাহারা দিত।

আর বাংলাদেশের আর্মিরা! জানোয়ারের দল, অমানুষের দল এই অমানুষ জানোয়ারেরা আমার বাবা-মা, ভাই সবাইকে মেরেছ-এদের যেন ধ্বংস হয়।

 

‘৮৬ নির্বাচন

১৯৮৪ সালের ২৮শে ফেব্রুয়ারী ছাত্রলীগ নেতা সেলিম ও দেলোয়ার নিহত হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা যারপরনাই চেষ্টা করেও আর ছাত্র আন্দোলন করতে পারলেন না। ইত্যবসরে সামরিক স্বৈরাচার জেনারেল হোসাইন মোহাম্মদ এরশাদ পাকাপোক্তভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে নিজের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে যায় । যদিও এরই মাঝে নিরবে-নিঃশব্দে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্ব বিএনপি উল্লেখযোগ্য একক রাজনৈতিক শক্তিতে প্রতিষ্ঠিত হলো। এরশাদ তার ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করেই ১৯৮৬ তে সংসদ নির্বাচনের ঘোষণা ও প্রস্তাব দেন। এরশাদের প্রস্তাবিত সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা, না করার বিষয় নিয়ে দেশের রাজনৈতিক মহল ও নেতাদের মধ্যে ব্যাপক আলাপ-আলোচনা শুরু হলে বেগম খালেদা জিয়া এবং তার দল বিএনপির পক্ষ থেকে এরশাদের নির্বাচনী ফাঁদে পা না দিয়ে এরশাদ হটাও আন্দোলন করার প্রস্তাব দেয়।

তখন জননেত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার সাথে গুলশানের জনৈক ব্যবসায়ী এস আই চৌধুরীর (সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী) গুলশানের বাসায় তৎকালীন ডিজিডি এফ আই (ডাইরেক্টর জেনারেল অব ডিফেন্স ফোর্স ইন্টিলিজেন্ট) ব্রিগেডিয়ার মাহামুদুল হাসানের সাথে গোপন বৈঠক হয়। ব্রিগেডিয়ার মাহামুদুল হাসান জেনারেল এরশাদের পক্ষ থেকে ব্যক্তিগতভাবে শেখ হাসিনাকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার অনুরোধ করেন এবং নির্বাচনী সকল ব্যয়ভার বহন করার প্রতিশ্রুতি দিলে শেখ হাসিনা আন্দোলনের অংশ হিসেবে নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করার পক্ষে মত দেন। এই পরিস্থিতিতে দেশের বামপন্থী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ বিশেষত কমিউনিস্ট পার্টির প্রয়াত সাধারণ সম্পাদক কমরেড ফরহাদ-এর প্রচেষ্টায় খালেদা জিয়া এবং শেখ হাসিনার মতপার্থক্য এই কৌশলে কমিয়ে আনা হয় যে, নির্বাচনে শুধুমাত্র দুইনেত্রী (খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা) ছাড়া আর কেউ দাঁড়াবে না। অর্থাৎ বামপন্থী নেত্রীবৃন্দ বেগম জিয়াকে এটা বোঝাতে সমর্থ হয় যে, বেগম জিয়া এবং শেখ হাসিনা দু’জনে দেড়’শ দেড় শ তিন’শ আসনে নির্বাচনে দাঁড়াবেন, আর বাকি সবাই মিলে দুই নেত্রীকে তিনশ’ আসনে জিতিয়ে দেবেন। তাহলে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচনের মাধ্যমে সামরিক স্বৈরাচার জেনারেল এরশাদকে ক্ষমতাচ্যুত করা যাবে। এবং তাতে করে রাজনৈতিক দলসমূহের মধ্যে বিভেদ এবং অনৈক্য সৃষ্টি হবে না।

বেগম খালেদা জিয়া এরশাদকে ক্ষমতাচ্যুত করার প্রয়াসে দুই নেত্রী ১৫০+১৫০=৩০০ আসন নির্বাচনের প্রস্তাবে সায় দেন এবং শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া মুখোমুখি সংক্ষিপ্ত বৈঠক করেন। কিন্তু গুলশানের ব্যবসায়ী এস আই চৌধুরীর মাধ্যমে দুই নেত্রীর এই গোপন নির্বাচনী কৌশলের কথা এরশাদের কাছে পৌঁছে যায় এবং এরশাদ রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ জারি করে যে, এক ব্যক্তি পাঁচের অধিক বা বেশি আসনে নির্বাচনে দাঁড়াতে পারবে না।

ফলে দুই নেত্রীর দেড়’শ দেড়’শ তিন’শ আসনে নির্বাচনী করার কৌশল ভন্ডুল হয়ে যায়। তখন বেগম জিয়া এরশাদের নির্বাচনী ফাঁদে পা না দিয়ে এরশাদ পতনের আন্দোলনের পুরানা অবস্থানে চলে যান। এদিকে গুলশানের এস আই চৌধুরীর বাড়িতে ডিজিডি এফ আই ব্রিগেডিয়ার মাহামুদুল হাসানের সাথে শেখ হাসিনার আবার বৈঠক হয় এবং সেই বৈঠকে দাবি করা হয় নির্বাচনী ব্যয় হিসেবে আগে যে পরিমাণ অর্থ ধরা হয়েছে, এখন তার তিনগুণ অর্থ দিতে হবে। ডি জি ডি এফ আই, ব্রিগেডিয়ার মাহামুদুল হাসান এক ঘন্টার সময় চেয়ে চলে যান এবং বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বঙ্গবন্ধু ভবনে চলে আসেন। ঘন্টা দুই পর সন্ধ্যার দিকে ব্যবসায়ী এস আই, চৌধুরী দু’টি মাইক্রোবাস সঙ্গে নিয়ে ৩২ নম্বরে এসে হাজির। এস আই চৌধুরী আর শেখ হাসিনার মধ্যে এক-দেড় মিনিট কথা, তারপরই হুকুম হলো তাড়াতাড়ি মাইক্রোবাস থেকে বস্তাগুলো নামিয়ে আনো। সঙ্গে সঙ্গে মাইক্রোবাস থেকে মুখ সেলাই করা মোট নয়টি নতুন বস্তা নামিয়ে বঙ্গবন্ধু ভবনের নিচতলায় লাইব্রেরী আর বেডরুমের মাঝে যে মাস্টার বাথরুম সেই বাথরুমে রাখা হলো।

এরপর শেখ হাসিনা আদেশ করলেন সাংবাদিক সম্মেলন-এর আয়োজন করতে এবং ডঃ কামাল হোসেনসহ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু ভবনে জরুরী ভিত্তিতে আসতে বলার জন্য।

ডঃ কামাল হোসেনসহ যে সকল নেতাদের টেলিফোনে পাওয়া গেল তাদের অনতিবিলম্বে বঙ্গবন্ধু ভবনে আসতে বলা হলো। বিভিন্ন পত্রিকা অফিসে টেলিফোনের মাধ্যমে ও সশরীরে গিয়ে জরুরী সাংবাদিক সম্মেলনের সংবাদ জানান হলো। সাংবাদিক সম্মেলনের বিষয়বস্তু সম্পর্কে সাংবাদিকদের কিছু জানানো সম্ভব হলো না। শুধু বলা হলো জরুরী ও খুবই গুরুত্বপূর্ণ সাংবাদিক সম্মেলন। আসলে সত্যি কথা বলতে কি, সাংবাদিক সম্মেলনের বিষয়বস্তু সম্পর্কে ডঃ কামাল হোসেনসহ কোন নেতা কিছু জানেন না। মূল বিষয়বস্তু সম্পর্কে জানেন মূলত চার ব্যক্তি (১) শেখ হাসিনা (২) ব্যবসায়ী এস আই চৌধুরী (৩) ডি জি ডি এফ আই ব্রিগেডিয়ার মাহামুদুল হাসান এবং (৪) প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক সেনাবাহিনী প্রধান রাষ্ট্রপতি জেনারেল হুসাইন মোহাম্মদ এরশাদ।

অধিক রাত হওয়া সত্ত্বেও বহুসংখ্যক সাংবাদিক এসে উপস্থিত হলো ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু ভবনে।

শেখ হাসিনা ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগ নেতাদের এরশাদের নির্বাচনে যাওয়ার (অংশ গ্রহণ করার) সিদ্ধান্ত জানালেন। নেতারা বললেন, নির্বাচনে যাব ঠিক আছে, কিন্তু একদিন আমরা বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করি; তারপর সিদ্ধান্ত নেই।

শেখ হাসিনা বললেন, আমাদের সময় নেই, তাড়াতাড়ি করতে হবে। খালেদা জিয়া এবং তার দল বিএনপিকে ল্যাং মেরে নির্বাচনে যেতে হবে। কাজেই এটা নিয়ে এত আলোচনার দরকার নেই। বাইরে সাংবাদিকরা বসে আছে, এখনই নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দিতে হবে। বলেই সরাসরি সাংবাদিকদের মাঝে এসে উপস্থিত হলেন এবং নির্বাচনে যাওয়ার (অংশগ্রহণ করার ঘোষণা দিলেন। তার পরদিন ছয় ফুট লম্বা তিন ফুট চওড়া পাঁচ তলা (পাঁচ তাক) একটি স্টিলের ওয়াড্রব আনা হলো এবং যে বাথরুমে সেলাই করা বস্তাগুলো আছে সেখানে রাখা হলো। তারপর একে একে বস্তা খোলা হলো। আর বস্তার ভিতরে থাকা পাঁচশ’ টাকার নতুন বান্ডিলগুলো ঐ স্টিলের ওয়াড্রব (আলমারী)-এ সাজিয়ে রাখা হলো। সব টাকা ওয়াড্রবে না ধরায় বাকি টাকা অন্যত্র সরিয়ে ফেলা হলো।

শুরু হলো ১৯৮৬-এর সংসদ নির্বাচনী প্রক্রিয়া। দেশ দুই ভাগে বিভক্ত হলো। এক ভাগ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে জেঃ এরশাদের পাতানো নির্বাচনে জড়িয়ে পড়লো। আরেক ভাগ বেগম খালেদা জিয়ার আহবানে এরশাদ পতন ও পাতানো নির্বাচন বর্জন এবং ঠেকানের চেষ্টায় রত হলো। শেখ হাসিনা সর্বশক্তি দিয়ে আওয়ামী লীগ কর্মীদের নির্বাচনে ঝাঁপিয়ে পড়ার জোরদার আহ্বান জানালেন। তিনি বললেন, এই নির্বাচনের মাধ্যমেই আওয়ামী লীগকে পুর্নরায় ক্ষমতায় আসতে হবে এবং সামরিক শাসক এরশাদকে বিদায় করতে হবে।

শেখ হাসিনার আহ্বানে জনগণ এগিয়ে না এলেও আওয়ামী লীগের কর্মী ও সমর্থকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে এলো।

আওয়ামী লীগের কর্মী ও সমর্থকরা সারা দেশেই একটা নির্বাচনী পরিবেশ সৃষ্টি করে তুললো। ঐ সময়ই ফিলিপাইনে সামরিক একনায়ক জেনারেল মার্কোস-এর বিরুদ্ধে নিহত জননেতা মিঃ একুইনোর বিধবা স্ত্রী মিসেস কোরাজন একুইনো প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। সারা বিশ্ব ফিলিপাইনের দিকে তাকিয়ে আছে। ঠিক এমনি মুহূর্তে বাংলাদেশেও সামরিক শাসকের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক নির্বাচন ফিলিপাইনের মতোই প্রায় দৃষ্টি আকর্ষণ করে আছে। শেরে বাংলা নগরে মানিক মিয়া এভিনিউতে আওয়ামী লীগের শেষ বিশাল নির্বাচনী জনসভা। এর মাত্র দু’দিন আগে ফিলিপাইনে নির্বাচন হয়ে গেছে। সামরিক একনায়ক জেনারেল মার্কোস নির্বাচনের ফলাফল পাল্টে দিয়ে নিজেকে বিজয়ী ঘোষণা করেছে। অপর দিকে মিসেস কোরাজন একুইনো ঐ ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে নিজেকে বিজয়ী ঘোষণা করেছেন। মিসেস কোরাজন একুইনোর পক্ষে ফিলিপাইনের জনগণ রাস্তায় নেমেছে। আর সেই জনগণকে দমিয়ে দেওয়ার জন্য একনায়ক মার্কোস-এর পক্ষে সেনাবাহিনী ট্যাঙ্ক নিয়ে রাস্তার বেরিয়ে এসেছে। একদিকে জনগণের বিক্ষোভ অপরদিকে সামরিক বাহিনীর ট্যাঙ্ক। ফিলিপাইনের অবস্থা গত দু’দিন থেকে খুবই উত্তপ্ত। জনগণও বিক্ষোভে শামিল হওয়ার জন্য জেনারেল মার্কোসের কার্য ভেঙ্গে রাস্তায় বেরিয়ে এসেছে। আর সেই জনগণের দিকে তাক করে ট্যাঙ্ক নিয়ে ধেয়ে আসছে সেনাবাহিনী। ফিলিপাইনের দিকে সারা পৃথিবীর দৃষ্টি যতখানি গভীর বাংলাদেশের জনগণের দৃষ্টি তার চাইতে অনেক বেশি গভীর।

ফিলিপাইনের মতো বাংলাদেশেও প্রায় একই ঘটনা, একই অবস্থা। জনগণ বনাম সামরিক বাহিনী। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি বনাম সামরিক একনায়ক।

বাংলাদেশের জনগণ সজাগ ও তীক্ষ্ণদৃষ্টি রেখেছে ফিলিপাইনের শেষ পরিণতির দিকে। ফিলিপাইনের উত্তাপ বাংলাদেশের জনগণের অনুভূতিতে লাগছে। এমনি মুহূর্তে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগের শেষ নির্বাচনী বিশাল জনসভা চলছে। হঠাৎ মঞ্চের নেতার বক্তৃতা বন্ধ করে মাইকে ঘোষণা করা হলো ফিলিপাইনের একনায়ক জেনারেল মার্কোস দেশ (ফিলিপাইন) থেকে পালিয়ে গিয়েছে। ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুৎ গতিতে জনতা উল্লাসে ফেটে পড়লো।

মনে হলো যেন বাংলাদেশ থেকে জেনারেল এরশাদ পালিয়ে গেছে এবং শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসেছেন। মঞ্চের নেতারা একে অপরকে বুকে জড়িয়ে ধরে কোলাকুলি করলেন। এ যেন পথের দিশা পাওয়া গেল। বাংলাদেশেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে যাচ্ছে। দু’দিন পর বাংলাদেশে নির্বাচন হলো। জেনারেল এরশাদ জেনারেল মার্কোসের ন্যায় মিডিয়া ক্যু করে ফলাফল পাল্টিয়ে দিয়ে নিজের দল জাতীয় পার্টিকে বিজয়ী ঘোষণা করলো। অপর দিকে শেখ হাসিনা ঐ ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে ফিলিপাইনের মিসেস কোরাজন একুইনোর মতো নিজেকে বিজয়ী ঘোষণা করলেন। জেনারেল এরশাদ পার্লামেন্ট অধিবেশন ডাকলো শেখ হাসিনাও পাল্টা পার্লামেন্ট অধিবেশন ডাকলেন। জেনারেল এরশাদের পার্লামেন্ট অধিবেশন শুরু হলো পার্লামেন্ট হাউজে। শেখ হাসিনার পার্লামেন্ট অধিবেশন শুরু হলো পার্লামেন্টের সিঁড়িতে। এভাবে কয়েক দিন চলতে লাগলো। একদিন সন্ধ্যার পর গুলশানের ব্যবসায়ী এস আই চৌধুরী ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু ভবনে তিনটি মাইক্রোবাস নিয়ে এলেন। আগে থেকে অপেক্ষায় থাকা বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা দৌড়ে এলেন এবং এস আই চৌধুরীকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু ভবনের লাইব্রেরীতে বসিয়ে সঙ্গে সঙ্গে তিনি বেরিয়ে এসে মাইক্রোবাস থেকে দ্রুত ছালার বস্তা গুলো আগের জায়গায় নামিয়ে রাখতে বললেন। যথারীতি বস্তাগুলো নামিয়ে নির্দিষ্ট জায়গায় রাখা হলো । এবার বস্তা হলো তেরটি। নেত্রীকে বস্তা নামানো শেষ হয়েছে জানানো হলো। নেত্রী মাইক্রোবাসের সঙ্গে আসা বঙ্গবন্ধু ভবনের বাইরে থাকা সাদা পোষাকের অস্ত্রধারী ব্যক্তিদের চা খাওয়ানোর কথা বললে এস আই চৌধুরী আপত্তি করে এখনই চলে যেতে হবে বলে বিদায় নিলেন। নেত্রী তাকে মাইক্রোবাসে তুলে দিয়ে ফিরে এলেন।

অনুমান করা গেল নির্বাচনে যাওয়ার আগে নয় বস্তায় দশ কোটি টাকা ছিল। আর এখন তের বস্তায় পনর কোটি টাকা। বাংলাদেশের জনগণের আশা, আকাঙ্খা ছিল জননেত্রী শেখ হাসিনা ফিলিপাইনের মিসেস কোরাজন একুইনোর মতো আপোষহীন থাকবেন, জনগণকে রাস্তায় বেরিয়ে আসার আহ্বান জানাবেন। জনগণ রাস্তায় বেরিয়ে আসবে, সামরিক একনায়ক এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করবে। এরশাদ জনগণ-এর বিপক্ষে সেনাবাহিনী এবং ট্যাঙ্ক নামাবে। জনতার প্রতিরোধের মুখে সেনাবাহিনী এবং ট্যাঙ্ক অকার্যকর হবে, সামরিক স্বৈরাচার এরশাদ দেশ থেকে পালিয়ে যাবে। কিন্তু না, বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা জনতার সমস্ত আশা- আকাঙ্খা জলাঞ্জলি দিয়ে নীরবে নিঃশব্দে চুপিসারে স্বৈরাচারী জেনারেল এরশাদের পার্লামেন্টে যোগ দিলেন এবং এরশাদের পার্লামেন্টের বিরোধী দলের নেত্রী হলেন। দেশ থেকে সামরিক শাসন এবং সমর নায়ক স্বৈরাচারী এরশাদ তো গেলই না বরং ‘৮৬-এর নির্বাচনের পাতানো খেলায় সামরিক একনায়ক জেনারেল এরশাদ পূর্বের চাইতে আরো শক্তিশালী রূপে জগদ্দল পাথরের ন্যায় জনগণের ঘাড়ে চেপে বসলো।

 

আন্দোলন আন্দোলন খেলা

স্বৈরাচারী জেনারেল এরশাদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনাকে রেখে, বেগম খালেদা জিয়া একক আন্দোলন করলে কাঙ্খিত ফল আসবে না ভেবে, মটর সাইকেল আরোহী আন্দোলনের আন্তরিকতার বিষয়ে প্রশ্ন করলে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা জবাব দেন, “আমি (শেখ হাসিনা) আছি ম্যাডামের (খালেদা জিয়া) পিছনে পিছনে। ম্যাডাম (খালেদা জিয়া) যে কর্মসূচী দেবে, আমিও (শেখ হাসিনা) সেই কর্মসূচী দেব। যাতে মনে হয় আমি (শেখ হাসিনা) ও আন্দোলনে আছি। আন্দোলন সফল করে তোলার প্রশ্নে আওয়ামী লীগ কর্মীদের বলিষ্ঠ ভূমিকা বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে জননেত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আওয়ামী লীগ কর্মীদের বলে দেবে তারা যেন আন্দোলন আন্দোলন খেলা করে, কিন্তু আন্দোলন যেন না করে। অর্থাৎ আন্দোলনের সাথে থেকে আন্দোলনের পিঠে ছুরি মারতে হবে। ম্যাডামকে (খালেদা জিয়া) ব্যর্থ করে করে ঘরে বসিয়ে দিতে হবে, আর যাতে রাজনীতির নাম না নেয়। জনগণ এবং আওয়ামী লীগের মাঠকর্মীরা এরশাদ পতনের আন্দোলনের জন্য এতই উদগ্রীব যে, আন্দোলন প্রশ্নে বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার স্পষ্ট নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও তারা (আওয়ামী লীগ কর্মীরা) আন্দোলনে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করতে থাকে। যখন আওয়ামী লীগের কর্মীদের কাছে জননেত্রী শেখ হাসিনার আন্দোলন না করার গোপন নির্দেশ পৌঁছানো হলো, তখন আওয়ামী লীগ কর্মীরা সভানেত্রী শেখ হাসিনার মুখ থেকে সরাসরি এই নির্দেশ শুনতে চাইলো। কিন্তু বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার পক্ষে সরাসরি এই নির্দেশ দেওয়া সম্ভব হলো না। ফলে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে থাকলেন বেগম খালেদা জিয়া আর জীবন দিতে থাকলো নূর হোসেনসহ আওয়ামী লীগ কর্মীরা।

 

ছিয়াশির পার্লামেন্ট ভেঙ্গে দেওয়া

১৯৮৭ সালের ১০ই নভেম্বর ঢাকায় আওয়ামী যুবলীগ কর্মী নূর হোসেন বুকে “স্বৈরাচার নিপাত যাক, আর পিঠে গণতন্ত্র মুক্তি পাক” লিখে বিক্ষোভ মিছিল করার সময় পুলিশের গুলিতে নিহত হলে দেশী এবং বিদেশী বিশেষ করে বহির্বিশ্বের প্রচার মাধ্যমে তা ফলাও করে প্রচার করে। ফলে সামরিক একনায়ক হোসাইন মোহাম্মদ এরশাদ খুবই অসন্তুষ্ট এবং রাগান্বিত হন। আওয়ামী লীগের কর্মীদের আন্দোলনে বলিষ্ঠ ভূমিকা থাকায় এরশাদ মনে করেন (ভুল বোঝেন) যে, শেখ হাসিনা তলে তলে কর্মীদের তার (এরশাদ) বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়েছেন। তিনি (এরশাদ) এই বলে মন্তব্য করেন যে. আমার খাবে আমার পরবে, আবার আমার সাথে গাদ্দারী। শেখ হাসিনা গাদ্দারী করবে, আমার সাথে বেঈমানী করবে নাফরমানী করবে! আমিই (এরশাদ) শেখ হাসিনাকে বিরোধী দলীয় নেত্রী বানিয়ে মন্ত্রীর মর্যাদা দিয়েছি; মন্ত্রীর চাইতে বেশি সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছি। দেশ চালনা থেকে শুরু করে সব কিছুতেই ভাগাভাগি করছি। আর তলে তলে আমার (এরশাদ) সাথে গাদ্দারী, নাফরমানী। আমি (এরশাদ) আর শেখ হাসিনাকে কোন ভাগ দেব না, বিরোধী দলের নেত্রীও রাখবো না। জননেত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা ব্যবসায়ী এস আই চৌধুরী এবং ডি জি ডি এফ আই মাহামুদুল হাসানের মাধ্যমে এরশাদকে আন্দোলনে তার (শেখ হাসিনার) অনাগ্রহ, অনিচ্ছা এবং আন্দোলনের নামে আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত থেকে পিছন থেকে ছুরি মেরে আন্দোলনকে ভন্ডুল করে দেওয়ার বিষয়টা অনেক বোঝাবার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু এরশাদ নাছোড়বান্দা। তার এক কথা, আন্দোলনের নামে পিছন থেকে আন্দোলনকে ছুরি মারতে হবে না। আন্দোলনের বিরুদ্ধে আমাকে (এরশাদকে) প্রকাশ্যে সরাসরি সমর্থন দিতে হবে। নইলে আমি (এরশাদ) পার্লামেন্টও রাখব না, শেখ হাসিনাকেও বিরোধী দলীয় নেত্রী রাখবো না। বিরোধী দলীয় নেত্ৰী থাকতে হলে এবং মন্ত্রীর মর্যাদাসহ অন্যান্য সকল প্রকার সুযোগ-সুবিধা পেতে হলে আমাকে (এরশাদ) কোন প্রকার রাখঢাক না করে ঢালাওভাবে সমর্থন করতে হবে।

শেখ হাসিনা কৌশলগত কারণে প্রকাশ্যে সরাসরি ঢালাওভাবে জেনারেল এরশাদকে সমর্থন করতে অক্ষমতা প্রকাশ করলে অবশেষে এরশাদ ১৯৮৮ সালে মাত্র দুই বছর আগে গড়া তার (এরশাদের) নীলনক্সার পার্লামেন্ট ভেঙ্গে দেয় এবং নতুন করে দ্বিতীয়বার তার (এরশাদ) নীলনক্সার পার্লামেন্ট নির্বাচন দিয়ে জাসদের আ স ম রব (বর্তমানে শেখ হাসিনার মন্ত্রী) কে পার্লামেন্টে বিরোধী দলের নেতা বানান।

 

এরশাদ পতন ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার

জনতা স্বৈরাচারী এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত হয় এবং বেগম জিয়া ভেতরে ভেতরে জনতার মাঝে আপোষহীন নেত্রী রূপে প্রতিষ্ঠিত হন। অবস্থা বেগতিক দেখে শেখ হাসিনার বেগম খালেদা জিয়ার আন্দোলনের সাথে পুরোপুরি সম্পৃক্ত হওয়া ছাড়া কোন গত্যায়ন্তর থাকে না। আগে থেকেই আওয়ামী লীগের মাঠকর্মীরা এরশাদ হঠাও আন্দোলনে তাদের বলিষ্ঠ ভূমিকা বজায় রেখেছে। এখন শেখ হাসিনা বাধ্য হয়ে আন্দোলনে আসায় আন্দোলন আরো বেগবান হয়েছে।

জননেত্রী শেখ হাসিনা এবং দেশনেত্রী খালেদা জিয়া দুই নেত্রীর আন্দোলন প্রসঙ্গে বৈঠক হলো। আন্দোলন আরো তুঙ্গে উঠলো। দুর্বার গণ আন্দোলন চলতে থাকলো। স্বৈরাচার সামরিক একনায়ক জেনারেল এরশাদ কার্ফু জারি করলো, সেনাবাহিনীকে জনগণের বিপক্ষে রাস্তায় নামালো। কিন্তু জনগণকে দমানো গেল না। জনগণ ইস্পাতদৃঢ় ঐক্য গড়ে জেনারেল এরশাদের কার্ফু ভাঙ্গলো, সেনাবাহিনীর সাথে সংঘর্ষ শুরু করলো। সারা দেশে স্ফুলিঙ্গের মতো আন্দোলনের আগুন ছড়িয়ে পড়লো-ছাত্র যুবক আর জনতার আন্দোলনের মুখে বিশ্ব বেহায়া স্বৈরাচারী এরশাদের সকল কূটকৌশল আর শক্তি পরাস্ত হতে থাকলো।

জেনারেল এরশাদ ছাত্রনেতাদের ক্রয় করার জন্য শত কোটি টাকা খরচ করলো এবং জেলখানা থেকে দাগী অপরাধীদের ছাড়িয়ে এনে কোটি কোটি টাকা আর অস্ত্র দিয়ে আন্দোলন দমানোর ব্যবস্থা করলো। এই দাগী অপরাধীরাই ১৯৯০ সালের ২৭শে নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরীর পূর্ব দক্ষিণ কোণায় দূর থেকে গুলি করে ডাঃ মিলনকে হত্যা করলো। ডাঃ মিলন নিহত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ছাত্র-জনতার আন্দোলন দাবানলের রূপ নিল। আন্দোলন নতুন মোড় নিল। ঠিক যেমন ১৯৬৯-এ আসাদ হত্যার পর হয়েছিল। অনির্দিষ্টকালের হরতাল ও কার্ফুতে দেশের সমস্ত কিছু অচল। চলছিল শুধু পিকেটিং, মিছিল, টিয়ার গ্যাস আর গুলি।

 

এরশাদ পতন সেনাবাহিনীর ভূমিকা

সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ অফিসারগণ সেনাবাহিনী প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল নূরুদ্দিন খানকে (বর্তমানে শেখ হাসিনার সরকারের মন্ত্রী) সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ অফিসারদের একটি গোপন বৈঠক করতে বাধ্য করলো এবং সেই বৈঠকে প্রেসিডেন্ট জেনারেল এরশাদকে আর সমর্থন না করার সিদ্ধান্ত হয়। সেনাবাহিনী প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল নূরুদ্দিন খানকে বৈঠকের এই সিদ্ধান্ত প্রেসিডেন্ট এরশাদকে জানিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব দিলে তিনি (সেনাপ্রধান নূরুদ্দিন খান) এই দায়িত্ব পালনে অপারগতা প্রকাশ করলে নবম ডিভিশনের (সাভার ক্যান্টনমেন্টের) জি ও সি মেজর জেনারেল আব্দুল সালাম (বর্তমানে আওয়ামী লীগের এম পি রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির চেয়ারম্যান) বৈঠকের এই সিদ্ধান্ত প্রেসিডেন্ট এরশাদকে জানিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব নেন এবং বৈঠক থেকে সোজা ঢাকা সেনাভবনে গিয়ে প্রেসিডেন্ট এরশাদকে সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ অফিসারদের বৈঠকে তাকে (এরশাদকে) আর সমর্থন না করার সিদ্ধান্তের কথা স্পষ্ট জানিয়ে দেন। তখন স্বৈরাচারী হোসেন মোহাম্মদ এরশাদ সম্পূর্ণ হতবিহ্বল হয়ে পড়ে এবং তারপরই পদত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেয়। এই পদত্যাগের সিদ্ধান্ত কার্যকরী করার জন্য প্রথম উপ-রাষ্ট্রপতি মওদুদ আহমেদ পদত্যাগ করেন এবং সুপ্রীমকোর্টের প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহম্মেদ উপ-রাষ্ট্রপতি হন। তারপর রাষ্ট্রপতি জেনারেল এরশাদ উপ-রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহম্মেদের কাছে পদত্যাগ করলে উপ-রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন আহম্মেদ অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হন এবং তাঁর নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করে ১৯৯১ সালের ২৭শে ফেব্রুয়ারী জাতীয় সংসদের নির্বাচন দেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম দেশের সবক’টি রাজনৈতিক দল স্বাধীন, মুক্ত এবং স্বেচ্ছায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমেদ-এর নেতৃত্বে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করে। নির্বাচনী প্রক্রিয়া দ্রুত এবং জোরদারভাবে এগিয়ে চলছে। নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সকল দল প্রার্থী মনোনয়ন চূড়ান্ত করেছে। দেশের জনগণও এই প্রথম মুক্ত স্বাধীন এবং নিরপেক্ষভাবে আমার ভোট আমি দেব যাকে খুশি তাকে দেয়ার দৃঢ় মনোভাব নিয়ে আগামী ২৭শে ফেব্রুয়ারী ১৯৯১ সাল ভোট দেবার স্বতঃস্ফূর্ত সিদ্ধান্ত নেয়। সারা দেশে চলে ব্যাপক নির্বাচনী প্রচারাভিযান। পোস্টার আর দেয়াল লিখনে ভরে গেছে সমস্ত জায়গা। দিবা-রাত্রি চলছে মিছিল-মিটিং। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি মূলত এই দু’টি দলের মধ্যে তীব্র নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে। বিএনপি ও আওয়ামী লীগ এই দু’টি দলের কোথায় কে জেতে কে হারে বলা কঠিন। এরই মধ্যে এক সাংবাদিক সম্মেলনে জননেত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বললেন, বিএনপি দশটির বেশি সিট পাবে না। অর্থাৎ বিএনপি তিনশ’ (৩০০) আসনের মধ্যে দশটি (১০) আসনে বিজয়ী হবে এবং দুশ’ নব্বই (২৯০) আসনে পরাজিত হবে।

স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত, ঘরে-বাইরে, মাঠে-ঘাটে সর্বত্র নির্বাচনী আলোচনা আর প্রচারণা। এক কথায় নির্বাচনী প্রচারণা এখন তুঙ্গে। আজ ১০ই ফেব্রুয়ারী। ধানমণ্ডি বঙ্গবন্ধু ভবনের একটি কক্ষে রুদ্ধদ্বার বৈঠক বসলো। সামনের ২৭শে ফেব্রুয়ারী নির্বাচন। এই নির্বাচন উপলক্ষেই আজকের বৈঠক। এই বৈঠকের আলোচনায় মটর সাইকেল আরোহী যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে বলল, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাবে না । আগামী ২৭শে ফেব্রুয়ারীর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পরাজিত হবে এবং জননেত্রী বঙ্গবন্ধু কন্য শেখ হাসিনা ঢাকার দু’টি আসনেই পরাজিত হবেন।

বৈঠকে উপস্থিত রবিউল আলম চৌধুরী (বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পি এস মোক্তাদির চৌধুরী) ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন, মিয়া আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাবে না মানে কি? আওয়ামী লীগ তো ক্ষমতায় যেয়েই আছে। ঐ যে পাশের ঘরে বসে আছে হোম সেক্রেটারী, সংস্থাপন সচিব, পররাষ্ট্র সচিব। অন্য পাশের ঘরে বসে আছে পুলিশের আই জি। একটু আগে এসেছিল সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল নূরুদ্দিন খান। তারপরও বলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাবে না ! শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হবে না।

মটর সাইকেল আরোহী বলে সেক্রেটারীরা (সচিবগণ) যতই বসে থাকুক, পুলিশ প্রধান, সেনাপ্রধান যতই সালাম দিয়ে যাক ২৭শে ফেব্রুয়ারী নির্বাচনে জিতে আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় যাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।

এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে বৈঠকে উপস্থিত জননেত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ক্রুদ্ধস্বরে বলেন, তুমি এখনই বের হয়ে যাও, আর আসবে না।

বের হয়ে যেতে যেতে মটর সাইকেল আরোহী বলে নেত্রী, আপনি বের করে দিলে আমি বেরিয়ে যেতে বাধ্য, তবে যা বললাম আর ক’দিন পরেই তা আপনি বুঝবেন। ১৯৯১-এর ২৭শে ফেব্রুয়ারী শুধু বাংলাদেশের নির্বাচনী ইতিহাসে নয়, উপ-মহাদেশের নির্বাচনী ইতিহাসে এক নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করে নর-নারী নির্বিশেষে জনগণ হাসতে হাসতে নিজেদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করলো। ভোট গণনায় দেখা গেল আওয়ামী লীগ পরাজিত হলো। ঢাকার দুই আসনেই জননেত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা বিপুল ভোটে ব্যক্তিগতভাবে পরাজিত হলেন। বেগম খালেদা জিয়া ও তার বিএনপি নির্বাচনে বিজয়ী হলেন। জননেত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা নির্বাচনী ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে বললেন, ভোটে সূক্ষ্ম কারচুপি হয়েছে, আর সূক্ষ্ম কারচুপির মাধ্যমেই আমাকে পরাজিত করা হয়েছে। আমি এই ফলাফল মানি না এবং বেগম জিয়া সরকার গঠন করলে আমি এক মিনিটও খালেদা জিয়াকে সুস্থ থাকতে দেব না।

error: Content is protected !!