৬৯-এর গণ আন্দোলন, ৭০-এর নির্বাচন, স্বাধীনতা ঘোষণা, মুক্তিযুদ্ধ, সিরাজ সিকদার হত্যা, একদলীয় শাসন, শেখ মুজিব হত্যা, মুশতাক রাষ্ট্রপতি, জেল হত্যা, ৩রা নভেম্বর অভ্যুত্থান, ৭ই নভেম্বরের সিপাহী বিপ্লব।
১৯৬৯ সাল, বাঙালি বীরোচিত এক সংগ্রামের মাধ্যমে কারাগারে থেকে বের করে আনলো বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবর রহমানকে। তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অভিযোগে পাকিস্তান সরকার এক প্রহসনমূলক বিচার করছিল শেখ মুজিবর রহমানসহ সামরিক-বেসামরিক-বাঙালি কিছু লোকের। কিন্তু বাংলার মানুষ এই মামলা এবং বিচার গ্রহণ করেনি। শুধু তাই নয়, এই মামলা ও বিচারের বিরুদ্ধে তীব্র গণ আন্দোলন করে বাঙালিরা পাকিস্তান সরকারকে বাধ্য করলো এই মামলা প্রত্যাহার করতে এবং শেখ মুজিবসহ সকল অভিযুক্ত ব্যক্তিকে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে। তখন বাংলাদেশ ছিল পাকিস্তানের উপনিবেশ । আমাদের এই দেশের নাম ছিল পূর্ব পাকিস্তান।
স্বাধীনতার পরে এই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তিদের সাথে মিলেমিশে যতটুকু জানা যায় তা হলো, পাকিস্তান যে আমাদের উপনিবেশ বানিয়ে রেখেছিল এবং ধর্মের নামে বাঙালিদের শোষণ করছে এটা তারা স্পষ্ট বুঝতে পেরেছিল। ঔপনিবেশিক শোষণ ও বাঙালিদের বিশেষ করে বাঙালি সৈনিকদের বঞ্চিত করার বিষয়গুলো নিয়ে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত বাঙালিদের মধ্যে কানাঘুষা চলছিল। পাকিস্তান সেনা- বাহিনীর বাঙালি সৈনিকরা তাদের প্রাপ্য পাওনা নিয়ে ভাবতে আরম্ভ করেছিল। ঠিক এমনি মুহূর্তে পাকিস্তান সরকার শেখ মুজিবসহ সামরিক-বেসামরিক বাঙ্গালিদের গ্রেপ্তার করে ও আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা সাজায়।
এই মামলায় অভিযুক্তরা পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন করবে এই রকম কোন কঠিন সিদ্ধান্ত সে সময় নেয়নি। তবে ক্রমশ নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়ে পড়ছিল। এ মামলায় এমন অভিযুক্তও ছিলেন যিনি কিছুই জানতেন না। শুধু বাঙালি হওয়র কারণেই মূলত অভিযুক্ত হয়েছিলেন। পাকিস্তান আমাদের অধিকার সচেতনাকে অঙ্কুরেই ধ্বংস করে দেওয়ার জন্যই এই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সূত্রপাত করেছিল। এমন অনেক অভিযুক্ত ছিলেন যারা ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়ানো ছাড়া শেখ মুজিবকে আর কখনও দেখেননি এক প্রত্যুষে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশকে স্বাধীন করে ফেলার এমন কোন স্পষ্ট পরিকল্পনা বা সিদ্ধান্ত অভিযুক্তদের কারোই কখনো ছিল না বলে আগরতলা মামলার প্রায় অভিযুক্তদের কাছ থেকে জানা যায়। অভিযুক্তদের প্রায় সকলেই বলেন, বাঙালিদের অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখা এবং নির্যাতনের জন্যই মূলত পাকিস্তান সরকার তিলকে তাল বানিয়ে এই আগরতলা মামলা দায়ের করেন।
পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা পাকিস্তানের নির্যাতনের বিরুদ্ধে বীরোচিত গণ আন্দোলনের মাধ্যমে শেখ মুজিবসহ অভিযুক্ত সকলকে মুক্ত করে আনে।
১৯৬৯ সালেই ছাত্র নেতা তোফায়েল আহমেদ-এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক ছাত্র-জনতার বিশাল সভায় শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধু উপাধি দেওয়া হয়। ১৯৭০ সালে পাকিস্তান সরকার জাতীয় পরিষদ (এমএনএ)-এর এবং প্রাদেশিক পরিষদের (এম পিএ) নির্বাচন ঘোষণা করে। মজলুম জননেতা মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে কিছু সংখ্যক বামপন্থী রাজনৈতিক নেতা নির্বাচন বর্জনের জোরালো আহ্বান জানান। মজলুম জননেতা মাওলানা ভাসানীর বক্তব্য ছিল, পাকিস্তানী সরকারের নির্বাচনী ফাঁদে পা না দিয়ে পূর্ববাংলাকে স্বাধীন করার সংগ্রাম শুরু করা উচিত। তাদের শ্লোগান ছিল, নির্বাচনে লাথি মার পূর্ববাংলা স্বাধীন কর । অপর দিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান নির্বাচনে অংশগ্রহণের পক্ষে ছিলেন এবং তিনি জনগণকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানান। জনগণ বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে অভূতপূর্ব সাড়া দিলো। গোটা পূর্ব পাকিস্তানে বঙ্গবন্ধু এবং তার দল আওয়ামী লীগের পক্ষে নির্বাচনী জোয়ার বয়ে গেল। নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ও তার দল আওয়ামী লীগকে বাঙালিরা পূর্ব পাকিস্তানের ১৬৯টি আসনের মধ্যে মাত্র ২টি আসন ছাড়া বাকি ১৬৭টি আসনে বিজয়ী করলো। মোট ভোটের শতকরা ৯০টি ভোট বঙ্গবন্ধু এবং তার দল পেলেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান সারা পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতা হলেন। পাকিস্তানের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জেনারেল ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে পাকিস্তানের ভাবী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অভিহিতও করলেন। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো এবং পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধুকে প্রধানমন্ত্রীত্ব এবং তার দল আওয়ামী লীগকে পাকিস্তানের ক্ষমতা না দেওয়ার নানা চক্রান্ত শুরু করলেন। পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি হলো আগ্নেয়গিরির মতো, বাঙালিরা চরম উৎকণ্ঠিত, উত্তেজিত। রাজপথ মিছিলে, মিটিং-এ প্রকম্পিত। ঘরে ঘরে মানুষে মানুষে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা।
সমগ্র বাঙালি কেবল তাকিয়ে আছে জাতির অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবর রহমানের দিকে । তিনি যা বলছেন চোখের পলকে বাঙালি তাই করছে। ইতিহাসের পাতায় অনেক ইতিহাস দ্রুত গড়িয়ে যাচ্ছে। যে কোন ধরনের কর্মসূচিতে শুধু শেখ মুজিবের ঘোষণা করতে যতটুকু দেরী- তিনি যে কোন কর্মসূচী ঘোষণা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুৎ গতিতে বাঙালি তা বাস্তবায়িত করছে। উত্তাল জাতির মুখে শুধু একটি শ্লোগান গর্জন করে ফিরছে, বাংলাদেশ স্বাধীন কর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর।
৭ই মার্চের ভাষণ
এরই মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) জনসভা ডাকলেন । ভোর না হতেই লক্ষ লক্ষ বাঙালি রেসকোর্স ময়দানে সমবেত হলো স্বাধীনতা প্রশ্নে নেতার রায় শোনার জন্য। লক্ষ লক্ষ জনতার সামনে এসে দাঁড়ালেন জনতার নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণা করেও স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন না। পাকিস্তান সরকারের কাছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান মূলত ৪টি কন্ডিশন বা দাবি দিয়ে তার ভাষণ শেষ করলেন।
বঙ্গবন্ধু বললেন, আমার দাবি মানতে হবে প্রথম, তারপর তিনি বিবেচনরা করে দেখবেন এসেম্বলীতে যাবেন, কি যাবেন না। যদিও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান বললেন, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।
তারপরও বলা যায় না বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ‘৭১-এর ৭ই মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা করেননি। ৭ই মার্চ ‘৭১ তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করেও স্বাধীনতা ঘোষণা করেননি। অজ্ঞাত কারণে তিনি ‘৭১-এর ৭ই মার্চ পরিষ্কারভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা না করে, স্বাধীনতা ঘোষণা করতে একটুখানি বাকি রাখলেন এবং পাকিস্তান সরকারের উদ্দেশ্যে ৪টি দাবি করলেন। আবার তার এই দাবি মেনে নেওয়ার জন্য পাকিস্তান সরকারকে সুনির্দিষ্ট কোন সময়সীমাও বেঁধে দিলেন না। তবে তাঁর নির্দেশে যে অসহযোগ আন্দোলন তখন চলছিল তা বজায় রাখার নির্দেশ তিনি দেন এবং সেই সাথে নতুন করে যোগ করলেন খাজনা-ট্যাক্স সব বন্ধ করে দেওয়ার নির্দেশ। হরতাল প্রত্যাহার করলেন। স্কুল, কলেজ, অফিস, আদালত, কলকারখানা সব বন্ধ ঘোষণা করলেন। মাস শেষে কর্মচারীদের বেতন নিয়ে আসতে বললেন। শিল্পের মালিককে শ্রমিকের বেতন পৌঁছে দিতে বললেন। রেডিও, টেলিভিশন তাঁর সংবাদ পরিবেশন না করলে বাঙালিদের রেডিও টেলিভিশনে যেতে নিষেধ করলেন।
আন্দোলন নতুন মোড় নিল। বাঙালি বুঝতে পারলো স্বাধীনতা ছাড়া আর কোন গত্যন্তর নেই। কিন্তু ঠিক কবে থেকে স্বাধীনতার যুদ্ধ বা মুক্তিযুদ্ধ শুরু হবে এবং কিভাবে হবে তা নিয়ে ছিল অস্পষ্টতা ও সংশয়। কারোরই সঠিক কোন পরিষ্কার ধারণা ছিল না।
কোন এক অজ্ঞাত কারণে ৭১-এর ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান একক ভাবে সুস্পষ্ট করে স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন না কেন, তা কখনো কোন দিন পাক্কার জানা যায়নি । বিশ্লেষণ এবং সামরিক পরিসংখ্যানে জানা যায়, ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান যদি পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে বাংলাদেশকে স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে ঘোষণা করতেন এবং সুদূর ১২ হাজার মাইল দূর থেকে আসা পাকিস্তানী সৈন্যদের বন্দী করতে বলতেন, তাহলে পাকিস্তানী সৈন্যদের সাথে বাঙালি সৈন্য, ইপিআর, পুলিশ ও জনতার যে লড়াই বা যুদ্ধ হতো, সেই যুদ্ধে মাত্র কয়েক দিনের মধ্যেই সামান্য রক্তপাতের বিনিময়েই আমাদের দেশ মুক্ত বা স্বাধীন হতো।
১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ পযন্ত বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) পাকিস্তানী সৈন্য সংখ্যা এতই নগণ্য ছিল যে, পাকিস্তানী পাঞ্জাবী, সিন্ধি, বেলুচ সৈন্য, বাঙালী সৈন্যদের কাছে অসহায় এবং মুখাপেক্ষী ছিল। অ’বার এই পাকিস্তানী পাঞ্জাবী, সিন্ধি, বেলুচ সৈন্যদের অধিকাংশই ছিল অফিসার। যারা যুদ্ধ পরিচালনা করে কিন্তু নিজেরা সরাসরি যুদ্ধ করে না । এই নগণ্য সংখ্যক পাকিস্তানী সৈন্যকে ধরাশায়ী বা পরাস্ত করতে বাঙালি সৈন্য, ই, পি, আর (আজকের বি, ডি, আর) পুলিশ এবং সাড়ে সাত কোটি জনতার কোন ক্রমেই সপ্তাহের বেশি সময় লাগতো না । কিন্তু অজ্ঞাত কারণে ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু মুজিবর রহমান স্পষ্টভাবে সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা না করায় এবং অনির্দিষ্ট সময় দিয়ে পাকিস্তানের কাছে ৪টি দাবী বা শর্ত দেওয়ার সুযোগে পাকিস্তান দিবা-রাত্রি তাদের সৈন্য এবং অস্ত্র বাংলাদেশে এনেছে। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশে পাকিস্তানের যত নন বেঙ্গলি সৈন্য ছিল, ৭ই মার্চ শেখ মুজিবর রহমানের ভাষণের পর (৭ই মার্চ থেকে ২৫ শে মার্চ পর্যন্ত) পাকিস্তান বাংলাদেশে তার সৈন্য ও অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ বহুগুণ বেশি বৃদ্ধি করে এবং পাকিস্তানী নন বেঙ্গলি সৈন্যের সংখ্যা যখন বাঙালি সৈন্য সংখ্যার চাইতে বহুগুণ বেশি বৃদ্ধি হয় কেবল তখনই পাকিস্তানীরা বাঙালিদের আক্রমণ শুরু করে। বঙ্গবন্ধু ৭ই মার্চের ভাষণে পাকিস্তানীদের আক্রমণ প্রতিহত করতে রাস্তাঘাট বন্ধ করে দেওয়ার কথা বলেছেন। যার যা আছে তাই নিয়ে মোকাবেলা করার কথা বলেছেন । খাজনা-ট্যাক্স বন্ধ করে দেয়ার কথা বলেছেন। বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানে টাকা-পয়সা পাঠানো বন্ধ করেছেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান বলেছেন, বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানে আর এক পয়সাও পাচার হতে পারবে না। কিন্তু বাংলাদেশে আর একজনও পাকিস্তানী সৈন্য আনা যাবে না একথা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান কখনও বলেননি।
ফলে পাকিস্তান ৭ই মার্চ থেকে তৎকালীন ঢাকা তেজগাঁও বিমান বন্দর দিন- রাত ২৪ ঘন্টা শুধু সৈন্য আনার কাজে ব্যবহার করেছে।
পাকিস্তান আমাদের দেশ থেকে ১২ হাজার মাইল দূরবর্তী একটি দেশ। শুধু দূরত্বটাই মুখ্য নয়। আমাদের বাংলাদেশ আর পাকিস্তানের ঠিক পুরোপুরি মাঝখানে রয়েছে পাকিস্তানের চির শত্রুদেশ ভারত। এই মাঝখানের শত্রু ভাবাপন্ন বিশাল ভারত টপকে পাকিস্তানীদের বাংলাদেশে আসা কিছুতেই সম্ভব ছিল না। প্রশ্নই ওঠে না। ভৌগোলিক কারণেই অতি সহজে স্বল্পসময়ে স্বল্প প্রাণহানিতে আমাদের দেশ স্বাধীন হওয়া খুবই সম্ভব ছিল। উচিত ছিল। এমন হওয়াও বৈচিত্র্য ছিল না যে, বিনা যুদ্ধে, বিনা রক্তপাতেই আমাদের দেশ স্বাধীন হতো। কিন্তু আমাদের স্বাধীনতার জন্য কার্যকরী ব্যবস্থা না নিয়ে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান কর্তৃক পাকিস্তানীদের দীর্ঘ সময় দেওয়ার কারণেই আমাদের স্বাধীনতার জন্য ত্রিশ লক্ষ মানুষকে প্রাণ দিতে হলো (ত্রিশ লক্ষ শহীদ এর এই সংখ্যা নিয়েও প্রশ্ন আছে)। দুই লক্ষ মা-বোনদের ইজ্জতও দিতে হলো (এই দুই লক্ষ বীরাঙ্গনাদের সংখ্যা নিয়েও প্রশ্ন আছে)। আসলে শেখ মুজিবর রহমান মানসিকভাবে স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। অথবা পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্র তিনি চাননি। পাকিস্তানীরা আমাদের উপর স্বাধীনতা যুদ্ধ বা মুক্তিযুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছিল এবং তাদের আক্রমণ ও হত্যাযজ্ঞের ফলেই আমরা মুক্তিযুদ্ধ করতে বাধ্য হই । অর্থাৎ পাকিস্তানীরাই আমাদের স্বাধীন হতে বাধ্য করেছে।
‘৭১ সালের ৭ই মার্চের ভাষণে শেখ মুজিবর রহমান পাকিস্তানীদের কাছে যে ৪টি দাবি করেছিলেন-(১) সামরিক আইন মার্শাল ‘ল’ তুলে নিতে হবে। (২) সমস্ত সেনাবাহিনীর লোকদের ব্যারাকে ফিরিয়ে নিতে হবে। (৩) যেভাবে হত্যা করা হয়েছে তার তদন্ত করতে হবে। (৪) আর জন- প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী করতে হবে।
এই দাবিগুলো যদি পাকিস্তানীরা মেনে নিত তাহলে কি আমাদের মুক্তিযুদ্ধ করতে হতো? পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আমাদের আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ হতো? কবি নির্মলেন্দু গুণের মতে শেখ মুজিবর রহমানের ৭ই মার্চের দাবি পাকিস্তান যদি মেনে নিত তাহলে আর যাই হোক, এই যাত্রায় বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ছিলেন পাকিস্তানের নির্বাচিত জন প্রতিনিধিদের নেতা। পাকিস্তানীরা যদি শেখ মুজিবকে নির্বাচিত নেতা হিসেবে ক্ষমতা দিতো, যদি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতেন, তাহলে তো আমরা নিশ্চয়ই পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্র হতাম না বা বঙ্গবন্ধুও তা চাইতেন না। জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত বাঙালি জনপ্রতিনিধিদের কাছে পাকিস্তানী সামরিক শাসকরা ক্ষমতা হস্তান্তর করবে এবং বাঙালি জনপ্রতিনিধিরা পাকিস্তান সরকার পরিচালনা করবেন এই তো ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের প্রকৃত কথা। পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল বাঙালি। এই সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালিরা পাকিস্তান শাসন করবে এটাই ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের মূলমন্ত্র। ঘটনা প্রবাহের ঐতিহাসিক বিশ্লেষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ছিলেন পাকিস্তানের শেষ ব্যক্তি, যিনি পাকিস্তানের অখণ্ডতায় দৃঢ়ভাবে বিশ্বাসী ছিলেন।
ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানের প্রতি শেখ মুজিবর রহমানের ছিল পূর্ণ আনুগত্য। পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন হয়ে যাক, পাকিস্তান টুকরো হয়ে যাক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান কখনই তা চাননি। আর চাননি বলেই প্রয়োজনীয় সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তিনি পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্র তৈরীর জন্য কোন বাস্তব কার্যকর ভূমিকা নেননি।
শেখ মুজিবর রহমানের ৭ই মার্চের ভাষণ হলো ট্রিমেনডাস কন্ডিশন্যাল স্পিস। যে ভাষণে পাকিস্তান রক্ষার শেষ চেষ্টা হিসেবে শেখ মুজিবর রহমানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের শর্ত দেওয়া হয়েছিল। আবার ক্ষমতা না দেওয়া হলে পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার সতর্ক হুঁশিয়ারী দেওয়া হয়েছে।
৭ই মার্চের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান-এর ভাষণ ছিল, বিশ্ব ইতিহাসে অদ্বিতীয় এক অনন্য ঐতিহাসিক ভাষণ । যে ভাষণে তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করেও স্বাধীনতা ঘোষণা করেননি। সে কারণেই আমাদের স্বাধীনতা ঘোষণার তারিখ বা দিন এবং স্বাধীনতার ঘোষক নিয়ে চির বিতর্ক।
আমরা ২৬শে মার্চকে স্বাধীনতা দিবস হিসেবে পালন করি তার মূল কারণ হলো, ২৫ মার্চ দিবাগত রাত বারটার পর পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ঘুমন্ত বাঙালির উপর পৈশাচিক আক্রমণ ও গণহত্যাযজ্ঞ শুরু করে। ২৫শে মার্চ দিবাগত গভীর রাত অর্থাৎ ঘড়ির সময় অনুযায়ী তা ২৬ শে মার্চের প্রথম প্রহর ধরা হয় বলেই ২৬শে মার্চকে আমরা স্বাধীনতা দিবস হিসেবে পালন করি। প্রকৃতপক্ষে পাকিস্তানী সৈনিকদের আক্রমণ আর ঘড়ির সময় হিসেবে নিয়েই ২৬শে মার্চকে স্বাধীনতা দিবস ধরা হয়। এই হিসেবে যদি পাকিস্তানীরা আমাদের ২৬শে মার্চের আগে অথবা পরে যে কোন দিন আক্রমণ করতো তাহলে সেই দিনটিই আমাদের স্বাধীনতা দিবস হিসেবে চিহ্নিত হতো।
সত্যি কথা বলতে কি, কেউই সঠিক সময়ে পূর্ণাঙ্গরূপে আমাদের স্বাধীনতা ঘোষণা করেননি। যদিও বলা হয়ে থাকে ২৫শে মার্চ রাত ১২টায় পর টেলিগ্রামের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন, কিন্তু টেলিগ্রামের ঐ ঘোষণার যথার্থতা খুঁজে পাওয়া যায়নি। টেলিগ্রামের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণাটি তখনকার সময়ের সাড়ে সাত কোটি বাঙালির কেউ পেয়েছে বা শুনেছে আজ পর্যন্ত এমন দাবি কেউ করেননি।
২৩শে মার্চ হলো পাকিস্তান দিবস। এই ২৩শে মার্চে পাকিস্তান দিবসে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) সহ সারা পাকিস্তানের সকল সরকারি-বেসরকারি ভবন এবং শহরের বাড়ীগুলোতে সবুজ-সাদা চাঁনতারা পাকিস্তানী পতাকা তোলা হতো। শহরের রাস্তাগুলো পাকিস্তানী পতাকা দিয়ে সাজান হতো এবং রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক নানা অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে ২৩শে মার্চ পাকিস্তান দিবস পালন করা হতো। কিন্তু ‘৭১-এর ২৩শে মার্চ পাকিস্তান দিবসে পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশের) কোথাও, কোন সরকারি বেসরকারি ভবনে পাকিস্তানী পতাকা তো ওড়ানো হয়ইনি বরং জনগণ স্বেচ্ছায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে এদেশের (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের) প্রতিটি সরকারি-বেসরকারি ভবনে, প্রতিটি বাড়িঘরে, রাস্তাঘাটে, গ্রাম বাংলার গাছে গাছে এমন কি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বাসভবনে সবুজের মাঝে লাল বৃত্তের উপর হলুদ রঙের মানচিত্র খচিত স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়িয়ে দিয়ে পাকিস্তানের যবনিকাপাত ঘটালো । পাকিস্তান দিবসে পাকিস্তানী পতাকা উড়লো না। পাকিস্তানী সৈন্যরা কুচকাওয়াজ করলো না। পাকিস্তানের কোন অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া গেল না। তারপরও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান স্বীকৃত পন্থায় সোজাসুজি স্পষ্ট করে বাংলার স্বাধীনতা ঘোষণা করেননি। কি এক অজ্ঞাত কারণে শেখ মুজিবর রহমান মুখ খোলেননি। নীরব ছিলেন। স্বাধীনতা ঘোষণার বৈধ রাজনৈতিক দায়িত্ব কেবল শেখ মুজিবকে বাঙালি জাতি দিয়েছিলেন, কিন্তু শেখ মুজিবর রহমান জাতি কর্তৃক প্রদত্ত রাজনৈতিক দায়িত্ব পালন করে স্বাধীনতা ঘোষণা করেননি।
ঐ পরিস্থিতিতে অন্য কারো পক্ষে স্বাধীনতা ঘোষণা করা সম্ভব ছিল না। কেননা শেখ মুজিব ছিলেন বাঙালির আশা-আকাঙ্খার মূর্ত প্রতীক। তবে পাকিস্তানীরা ভয়, লোভ কোন কিছুর বিনিময়েই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান স্বাধীনতা চান না এই রকম কোন স্বীকারোক্তি আদায় করতে পারেনি। যদি শেখ মুজিবর রহমান স্বাধীনতার বিপক্ষে কোন কথা বলতেন, তাহলে আমাদের স্বাধীনতা পাওয়া ডিফিক্যান্ট হয়ে যেত।
অপরদিকে ২৭শে মার্চ প্রত্যুষে চট্টগ্রাম কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে মেজর জিয়াউর রহমান দুই রকম স্বাধীনতা ঘোষণা দেন। মেজর জিয়াউর রহমান প্রথম ঘোষণা দেন, “আই এম মেজর প্রেসিডেন্ট পিপলস রিপাবলিক অফ বাংলাদেশ আই ডিক্লিয়ার ইনডিপেন্ডেন্ট অব বাংলাদেশ।
মেজর জিয়াউর রহমান দ্বিতীয়বার ঘোষণা দেন, “আই এম মেজর জিয়া, অই ডিক্লিয়ার ইনডিপেন্ডেন্ট অব বাংলাদেশ, অন বিহব ওয়ার গ্রেট লিডার শেখ মুজিবর রহমান। মেজর জিয়াউর রহমান বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর (ইস্ট পাকিস্তান রাইফেল) পুলিশ এবং জনতাকে পাকিস্তান আর্মির বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পরার আহ্বান জানান। এবং সারা দুনিয়ার কাছে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সাহায্যের আবেদন জানান। যদিও জিয়াউর রহমানের ২৭শে মার্চ সকালে এই ঘোষণা দেওয়ার আগেই ২৫ শে মার্চ দিবাগত গভীর রাতে অর্থাৎ ঘড়ির সময় অনুযায়ী ২৬শে মার্চ প্রথম প্রহরেই ঢাকাতে ই পি আর (ইস্ট পাকিস্তান রাইফেল) এবং পুলিশ পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে দেয়। পাকিস্তানী সৈন্যরা ঢাকার রাজারবাগ পুলিশ হেড কোয়ার্টার এবং ঢাকার পিলখানায় ই,পি,আর হেড কোয়ার্টারে আক্রমণ করলে ইস্ট পাকিস্তান রাইফেল (আজকের বি, ডি আর) এবং পুলিশ পাকিস্তানীদের কাছে আত্মসমর্পণ না করে পাল্টা আক্রমণ করে । এবং আমরা ছাত্রজনতা ঐ রাতেই ঢাকার বিভিন্ন থানা থেকে পুলিশের রাইফেল এনে পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেই। কিন্তু আমাদের রাইফেল চালানোর (ট্রেনিং) প্রশিক্ষণ না থাকায় আমরা পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে ঐ রাতে যুদ্ধ শুরু করতে পারিনি। ই, পি, আর ও পুলিশের ঐ রাতের যুদ্ধটা ছিল মূলত আত্মরক্ষার্থে। কারো কোন প্রকার নির্দেশ বা ঘোষণা ছাড়াই ই, পি আর ও পুলিশ পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে ২৫শে মার্চ দিবাগত গভীর রাতেই যুদ্ধ শুরু করে দিয়েছিল। তারপরও বলা চলে মেজর জিয়াউর রহমানের ২৭শে মার্চের সকালের স্বাধীনতা ঘোষণায় মুক্তিপাগল গোটা বাঙালি জাতি ভীষণভাবে আশান্বিত হয়েছিল, অনুপ্রাণিত হয়েছিল। বিশেষ করে যারা দেশের জন্য যুদ্ধ করতে জন্য মানসিকভাবে চূড়ান্ত প্রস্তুত হয়েছিল তাদের মধ্যে জিয়াউর রহমানের এই স্বাধীনতা ঘোষণা অভূতপূর্ব চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছিল, উৎসাহ উদ্দীপনা ও প্রেরণার সৃষ্টি করেছিল।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেওয়ার কোনরূপ চেষ্টা না করেই পাকিস্তানীদের হাতে গ্রেপ্তার হন। অজ্ঞাত কারণে তিনি কিছুটা ইচ্ছাকৃতভাবেই পাকিস্তানীদের হাতে বন্দী হন বলে অনুমান করা হয়।
২৭শে মার্চ থেকে ঢাকার বাসিন্দারা দিশেহারা হয়ে লক্ষ লক্ষ নর-নারী, আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা পিঁপড়ার সারির মত ঢাকা শহর ছেড়ে পায়ে হেঁটে গ্রামের দিকে চলে যায়। শহর ছেড়ে চলে যাওয়া মানুষের এই কাফেলাকে একমাত্র রোজ কেয়ামতের কাফেলার সাথেই তুলনা করা চলে। সবুজ গ্রাম আর গ্রামের মেঠো পথ ভরে ওঠে শহর ফেলে পালিয়ে যাওয়া লক্ষ লক্ষ মানুষে মানুষে।
শহর থেকে আসা লক্ষ লক্ষ মানুষকে গ্রামের কৃষক-কৃষাণী নিজের সন্তানের মত তাদের বুকে ঠাঁই দেয়। গ্রামের মানুষ রাস্তায়, পথে, মাঠে, ঘাটে চিরা, গুড়, মুড়ি, ডাব, যা কিছু সহায়-সম্বল ছিল তার সবটুকুই উজাড় করে বাড়িয়ে দিয়েছে শহর থেকে আসা মানুষের সাহায্যে। শহর ছেড়ে পালিয়ে আসা মানুষের এতটুকু কষ্ট যেন না হয়, তার সব দায়িত্ব গ্রামবাসীর। গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে দিন-রাত্রি ভাত রান্না হচ্ছে, লক্ষ লক্ষ মানুষ খাচ্ছে। কে খাচ্ছে, কার বাড়িতে খাচ্ছে, কার ভাত খাচ্ছে কেউ তা জানে না। যারা খাচ্ছে তারা জানে না কে খাওয়াচ্ছে। আর যারা খাওয়াচ্ছে তারাও জানে না কাদের খাওয়াচ্ছে। মানুষে মানুষে এ এক মহা মিলন, এক মহা ভ্রাতৃত্ব। কখনো পৃথিবীতে এমন হয়েছে কিনা কিম্বা আর হবে কিনা জানি না। মানুষ মানুষের এত আপন। নিজের চাইতে মূল্যবান অপরজন! এ দৃশ্য যারা দেখেনি তারা কোনদিন বুঝবে না! তাদের কোনদিন বোঝানো যাবে না। পৃথিবীতে এমন কোন ভাষা বা শব্দ নেই, এমন কোন লেখক নেই যে লেখক ঐ সময়ের মানুষে মানুষে ঐক্য, ভ্রাতৃত, সহমর্মিতা আর নিজের চাইতে অপরকে বেশি ভালবাসার চিত্র তুলে ধরতে পারবে। ঢাকা থেকে পায়ে হেঁটে ফরিদপুরের গোপালগঞ্জ-মুকসুদপুর গ্রামের বাড়িতে গিয়েছি। কত নদী পার হয়েছি, পার হয়েছি পদ্মা নদী। পাঁচ দিন-পাঁচ রাত্রি পথ চলেছি, তারপর গ্রামের বাড়ি এসেছি। একটি পয়সাও খরচ হয়নি। কোথাও একটি পয়সা লাগেনি। গ্রামের মানুষ খাইয়েছে। নৌকার মাঝি নদী পার করে দিয়েছেই বিনা পয়সায় খাওয়ানো, থাকতে দেওয়া, নদী পার করে দেওয়া, যেন গ্রামের মানুষের মহা পবিত্র নৈতিক দায়িত্ব ছিল। হাঁটতে হাঁটতে পথিমধ্যে কত গর্ভবতী মা-বোন সন্তান প্রসব করেছে। আর গ্রামের মা-বোনেরা তার সেবার ভার তুলে নিয়েছে আপন করে।
এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ, এবার মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার পালা। কিভাবে মুক্তিযোদ্ধা হওয়া যায়, মুক্তিযুদ্ধ করা যায়? ১৭ই এপ্রিল আকাশবাণী কলকাতা থেকে বার বার ঘোষণা এসেছে, আজ রাত আটটার পর একটি বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করা হবে। রাত আটটার আকাশবাণী কলকাতা বেতারের বাংলা খবরে বলা হলো সংবাদের পর একটি বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করা হবে। দেশাত্মবোধক গান দিয়ে শুরু হল অনুষ্ঠান। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের এবং বাঙালির ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ দিন এবং শ্রেষ্ঠ ঘটনাটির কথা। আজ ১৭ই এপ্রিল, কুষ্টিয়ার মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে জননেতা তাজউদ্দিন আহমেদ-এর নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠনের কথা জানানো হলো। মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার নাম ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষর দিয়ে নতুন করে রাখা হলো মুজিব নগর এবং এই মুজিবনগরেই তাজুদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে শপথ নিল বাংলাদেশের প্রথম এবং বিপ্লবী সরকার। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে করা হলো বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি এবং তার অনুপস্থিতিতে উপ-রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে করা হলো অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি। এবং তাজুদ্দিন আহমেদকে করা হলো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। তাজুদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে একটি মন্ত্রীসভাও গঠিত হলো। জেনারেল ওসমানীকে করা হলো প্রধান সেনাপতি । অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, প্রধান সেনাপতি সকলের শপথ অনুষ্ঠানও হলো এই মুজিব নগরে। এখানেই প্রবাসী সরকারকে গার্ড অফ অনার দেওয়া হলো।
শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধের নতুন যাত্রা। বাঙালির ইতিহাসে সংযোজিত হলো নতুন অধ্যায়ের। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ সুসংগঠিত হলো। আমাদের দেশের প্রায় এক কোটি মানুষ শরণার্থী হয়ে ভারতে আশ্রয় নিল। আমরা যারা মুক্তিপাগল কিশোর, তরুণ, যুবক আমরা ভারতে গিয়ে সামরিক প্রশিক্ষণ (আর্মি ট্রেনিং) নিলাম এবং মুক্তিযোদ্ধা হলাম। মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার আগে শুধু ভাবতাম কবে মুক্তিযোদ্ধা হব? কিভাবে মুক্তিযোদ্ধা হবো ! ভাবতে ভাবতে গ্রামের বাড়ি থেকে আবার ঢাকায় চলে এলাম। এই ঢাকায়ই আমি জন্মেছি। শিশু থেকে কিশোর হয়েছি। এখানেই আমার সব বন্ধু-বান্ধব। গ্রামের বাড়ীতে আমার কোন বন্ধু-বান্ধব নেই। মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার জন্য অন্তত একজন বন্ধু তো খুবই দরকার। কাজেই আবার শত্রুর প্রধান ঘাঁটি ঢাকায় চলে এলাম। প্রতিদিন ভাবি মুক্তিযুদ্ধে যাব। কিন্তু রাতে শুধু মা’র কথা মনে হয়। মনে হয়, আমি যুদ্ধে চলে গেলে মা শুধু কাঁদবেন। আমার জন্য মা অনেক কষ্ট পাবেন, অনেক কাঁদবেন। আমার আর কোন পিছু টান নেই, শুধু মা। আব্বার কথা আমি মোটেও ভাবি না। মা’র জন্যই মনটা আমার কেমন হয়ে যায়। কেমন জানি সব কিছু এলোমেলো হয়ে যায়। এভাবে ভাবতে ভাবতে কয়েক দিন চলে যায়। মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার জন্য মনটা আমার অস্থির হয়ে আছে। কিন্তু মাকেও ছাড়তে পারি না, মুক্তিযুদ্ধেও যাওয়া হয় না।
একদিন আমার মনে হলো, সব ছেলেরই তো মা আছে। ছেলে যুদ্ধে গেলে মা তো কাঁদবেই। মা’র কান্নার কথা ভেবে ছেলে যদি মুক্তিযুদ্ধে না যায়, তাহলে তো মুক্তিযুদ্ধ হবে না, দেশও স্বাধীন হবে না। না, মা কাঁদে কাঁদুক, আমাকে মুক্তিযুদ্ধে যেতে হবে। দেশ স্বাধীন করতে হবে। পরের দিনই পাশের বাড়ীর আমার এক বন্ধু বয়সে আমার চেয়ে সামান্য বড়, নাম তার বাবুল আজাদ-তাকে মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার কথা বলে ফেললাম। সঙ্গে সঙ্গেই বাবুল আজাদ খুশিতে রাজি হয়ে গেল। বললো, আমি তো এই রকমই ভাবছিলাম এবং এই রকম একজন বন্ধুই খুঁজছিলাম।
তারপর প্ল্যান প্রোগ্রাম করে একদিন খুব ভোরে দু’জনে ভারতের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। আমরা দু’বন্ধু গ্রামের পথ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে নদীর পারে একটি বাড়িতে এসে পৌঁছলাম। তখন প্রায় সন্ধ্যা। শ’খানেক পুরুষ-মহিলা-শিশু আগে থেকেই নদী পার হওয়ার জন্য এই বাড়িতে ঘাপটি মেরে অপেক্ষা করছে। বাড়ির নদী-ঘাটে ছোট একটি ডিঙ্গি নৌকা বাধা আছে। এই ছোট নৌকাটিতে আট- দশজনের বেশি লোক একসঙ্গে পার হওয়া যাবে না। এই বাড়ির কোন মানুষ এখানে নেই। শুধু কয়েকটি লাশ পচে গলে পড়ে আছে। আর এই যে শ’খানেক মানুষ, এর সবাই শরণার্থী হয়ে ভারতে চলে যাওয়ার জন্য এখানে জড়ো হয়ে আছে। সন্ধ্যার পর নৌকার মাঝি এসে নদী পার করে দেবে সেই অপেক্ষায় আছে। নদীতে পাক সেনারা গানবোট নিয়ে ঘাঁটি করেছে। দিনের বেলায় নদী পার হতে গেলে দেখা যাবে এবং আর্মিরা গুলি করে মেরে ফেলবে। তাই রাতের অপেক্ষায় আছে সবাই। রাতের অন্ধকারে নদী পার হতে হবে। অন্ধকার ঘনিয়ে এলো। বেশ গাঢ় অন্ধকার, হঠাৎ নদীতে পাকিস্তানী আর্মির গানবোটের সার্চলাইটের আলো দেখা গেল। এই দিকেই আসছে গানবোটটা। চাপা কান্না শুরু হয়ে গেল। কেউ কেউ বলছে কাইন্দেন না ভাই, কাইন্দেন না, আল্লাহরে ডাকেন।
গানবোটটা দ্রুত এই দিকে ছুটে আসছে। সবাই মৃত্যুর ভয়ে চুপসে গেল, কারো কোন সাড়াশব্দ নেই। শুধু গানবোটের আওয়াজ আর সার্চলাইটের আলো। আমরা সবাই মাটিতে শুয়ে পড়লাম যাতে গানবোটের সার্চলাইটের আলোতে দেখা না যায়। বুকের ভেতর ভয় । তার উপর মানুষের পচা লাশের গন্ধে দম বন্ধ হয়ে আসছে।
দিন চারেক আগে পাকিস্তানী হানাদাররা এই বাড়িতে হানা দিয়ে এই মানুষগুলোকে হত্যা করেছে। আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা কারো মুখেই কোন শব্দ নেই। অন্তরে শুধু আল্লাহ, রসূল (সঃ) আর ভগবানের নাম। গানবোট যতই এগিয়ে আসছে মনে হচ্ছে মৃত্যু ততই এগিয়ে আসছে।
মৃত্যু এখন শুধু কয়েক মিনিটের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি একটা গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে সবাইকে বললাম, কেউ শোয়া থেকে উঠবেন না, নড়াচড়াও করবেন না, কোন কথা বলবেন না। সবাই মাটিতে যেভাবে শুয়ে আছেন ঠিক এভাবেই থাকবেন। কোন প্রকার চিৎকার বা ছোটাছুটি মানেই নিশ্চিত মৃত্যু। আল্লাহ পাক যদি সহায় হোন তাহলে আমরা এভাবেই বেঁচে যাব। এ ছাড়া আমাদের আর বাঁচার কোনই পথ নেই। সবাই সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করেন। গানবোট একেবারে বাড়ির পাশে এসে পড়লো। সার্চলাইটের তীব্র আলোয় আলোকিত হলো সারা বাড়ি। বাড়ির আঙ্গিনায় কাপড় শুকানোর যে দড়ি বাঁধা ছিল তাও স্পষ্ট দেখা গেল। গানবোটটি যত দ্রুত এসেছিল তত দ্রুতই চলে গেল। থামলো না। এক সময় অদৃশ্য হয়ে গেল। সবাই যেন নতুন জীবন নিয়ে বেঁচে উঠলো। কিছুক্ষণ পর নৌকার মাঝি এলে কার আগে কে যাবে, এক সঙ্গে লাফিয়ে নৌকায় উঠে পড়লো। যা হবার তাই হলো। তীরেই নৌকা ডুবে গেল। নৌকা তুলে পানি ফেলে মাত্র ভাসানো হলো, সঙ্গে সঙ্গে আবারও সবাই নৌকায় লাফিয়ে উঠলো। পানি সেচে নৌকা আবার ভাসানো হলো। আবারও সবাই এক সঙ্গে উঠতে গিয়ে ডুবিয়ে দিল নৌকা। শিশু আর মহিলারা কাঁদতে শুরু করলো। আমি আর আমার বন্ধু বাবুল আজাদ উচ্চ কণ্ঠে ধমকের সুরে বললাম, আমরা দু’জন সবার শেষে যাব। একজনও বাকি থাকতে আমরা যাব না। সবাই নদী পার হওয়ার পর আমরা পার হবো, কে কে আমাদের সঙ্গে নদী পার হবেন?
কেউই কোন কথা বলল না। সকলেই চুপ।
আমরা কথা দিলাম সবাই আগে যাবেন-আমাদের আগে যাবেন। আমরা যাকে বলবো সেই নৌকায় উঠবেন। নইলে নৌকা আর তুলবো না, সবাই একসঙ্গে মারা পড়বো। জনাকয়েক বলে উঠলো, ঠিক আছে, আপনারাই ঠিক করে দেবেন কে কখন উঠবে। কেউ কেউ বলে উঠলো আবার নিজেরাই আমাদের ফেলে চলে যেয়েন না।
বললাম, দেখতেই তো পাবেন যাই কিনা। কাউকেই ফেলে আমরা যাব না। আমাদের কথা শুনেন, সবাই নদী পার হতে পারবেন এবং আমাদের আগে পার হবেন।
আবার নৌকা তুলে পানি ফেলে নৌকা ভাসালাম। ডান দিক থেকে এক এক করে নয়জন করে নৌকায় তুললাম। নৌকা ছেড়ে গেল। নামিয়ে দিয়ে আবার নৌকা ফিরে এলো। শেষ ট্রিপ-এ আমরা দু’জনসহ পাঁচজন নৌকায় উঠে নদী পার হলাম।
সীমান্তের কাছাকাছি বাতেন ভাই নামে এক ভদ্রলোকের বাড়িতে রাত্রি কাটানোর পর সকাল বেলায় আমার বন্ধু বাবুল আজাদ কান্না জুড়ে দিল। সে ঢাকায় ফিরে আসবে। আবার আমাকে সঙ্গে নিয়ে ফিরে আসবে। বাবুল আজাদ কাঁদতে কাঁদতে বলতে থাকলো, রাত্রে মাকে স্বপ্ন দেখেছি, মা বলছে ফিরে আয়। রিম্মিকে স্বপ্ন দেখেছি। রিম্মি হলো বাবুল আজাদ আর আমার বাসায় ঠিক উল্টো দিকের বাসার মস্ত বড় এক ধনী লোকের মেয়ে। বাবুল আজাদের প্রেমিকা, খুবই ভাল মেয়ে। সব দিক দিয়েই ভাল। আচার- ব্যবহার অমায়িক, দেখতে সুন্দরী, ভাল ছাত্রী, সবার প্রিয়। (বেচারা রিম্মির অকাল মৃত্যু হয়েছে। আল্লাহর কাছে দোয়া করি রিম্মি যেন বেহেস্তে যান) বাবুল আজাদ বললো, স্বপ্নের ভিতর রিম্মি আমাকে বলছে, বাবুল তুমি যুদ্ধে যেও না। তুমি মরে গেলে আমি কাকে ভালবাসবো? তুমি ছাড়া আমি কাউকে ভালবাসতে পারব না। তুমি ফিরে এসো নইলে আমাকেও নিয়ে যাও। ইত্যাদি ইত্যাদি বলতে বলতে সে কি কান্না বাবুল আজাদের। আমার কাছে বাবুলের দাবী, চল আমরা ঘরে ফিরে যাই।
কান্না যখন কিছুতেই থামাতে পারলাম না, তখন বললাম, তুই ফিরে যা। আমি ফিরে যাব না।
আমি যুদ্ধে যাব।
বাবুলের উত্তর আমি তোকে ফেলে একা ফিরে যাব না। চল দু’জনেই ফিরে যাই। না, আমি ফিরে যাব না, তুই ফিরে যা।
না, আমি তোকে ছাড়া ফিরে যাব না।
বাবুল আমাকে সঙ্গে নিয়ে ঘরে ফিরে আসবে, আমি ফিরে আসব না। বাবুলের কান্না থামে না। এক পর্যায়ে বললাম, সীমান্তের কাছেই তো চলে এসেছি, চল আর একটু সামনে গিয়ে দেখি কি হচ্ছে। তারপর ফিরে আসব।
এবার বাবুল আজাদ রাজি হলো। কান্না থামাল। আমরা এবার সীমান্ত লক্ষ্য করে চলতে শুরু করলাম। যতই সীমান্তের কাছে যাচ্ছি ততই বেশি করে গোলাগুলির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে ৷ অনেক চড়াই-উৎরাই পার হয়ে দু’বন্ধু মিলে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলায় গিয়ে পৌঁছলাম। পথের অনেক কাহিনী, সব লিখলে ফুরাবে না। ভারতের যে জায়গায় আমরা গিয়ে উঠলাম। জায়গাটা বেশ উঁচু পাহাড়ের মত, তবে পাহাড় না। এই জায়গায় উঠেই দেখি খাকি পোষাক পড়া চার-পাঁচ জন আর্মি একটি বাংকারে দাঁড়িয়ে আছে এবং আরো সাত-আট জন আর্মি দাঁড়িয়ে মানুষের সঙ্গে কথা বলছে। দেখেই তো আমার আত্মারাম খাঁচা হয়ে গেল। এ আমি কোথায় এলাম, যে আর্মির ভয়ে সারা পথ কত কষ্ট করে এলাম আর এখানে এসে সেই আর্মির একেবারে মুখের সামনে দাঁড়িয়ে পড়লাম! ভয়ে আমি হিম হয়ে গেলাম। কিছু সময় জ্ঞান শূন্য থাকলাম। তারপর ধীরে ধীরে তাকিয়ে দেখলাম জনগণের মাঝে কোন প্রতিক্রিয়া নেই; সবাই যার যার কাজে ব্যস্ত। আমি ভীষণ অবাক হলাম-স্বপ্ন দেখছি না তো? পরে বুঝলাম, ও এইটা তো ভারত ! এরা ভারতীয় আর্মি। পৃথিবীর সব দেশের আর্মির পোষাকই যে এক এটা আমার জানা ছিল না।
আমরা শরণার্থী ক্যাম্প বা শিবিরে না গিয়ে, সোজা কলেজ টিলায় চলে গেলাম। কলেজ টিলা মানে আগরতলা এম, বি, বি, কলেজ ক্যাম্পাস। এই কলেজ টিলাতেই বাংলাদেশের প্রাক্তন ও বর্তমান ছাত্র নেতারা থাকেন। এখানেই ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের অফিস। শেখ ফজলুল হক মনির নেতৃত্বে (পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক, আওয়ামী যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, দৈনিক বাংলার বাণী ও দৈনিক টাইমস পত্রিকার সম্পাদক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ভাগনে। ‘৭৫-এর ১৫ই আগস্টে শেখ মনিকেও হত্যা করা হয়) আ, স, ম, রব (ডাকসুর ভিপি, জাসদ-এর সাধারণ সম্পাদক, হোসেন মোহাম্মদ এরশাদ-এর ‘৮৮ সালের পার্লামেন্টের গৃহপালিত বিরোধী দলীয় নেতা। সম্মিলিত ওয়াচ ডগ, শেখ হাসিনার ঐকমত্যের সরকারের মন্ত্রী।)
আব্দুল কুদ্দুস মাখন (‘৭০-‘৭১-এর ডাকসুর ছাত্র সংসদের জি, এস, ‘৯০ দশকে মারা যান এবং মীরপুর বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে মুক্তিযোদ্ধা কবর স্থানে দাফন হয়) এম, এ, রশিদ (পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের দপ্তর সম্পাদক, স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠকারী, স্বাধীনের পর বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক, বর্তমানে ব্যবসায়ী)। শেখ ফজলুল করিম সেলিম (প্রাক্তন ছাত্রনেতা, শেখ মনির সহোদর, বর্তমানে দৈনিক বাংলার বাণীর সম্পাদক, যুবলীগের চেয়ারম্যান, জাতীয় সংসদ সদস্য)। মিজানুর রহমান মিজান (প্রাক্তন ছাত্রনেতা, আব্দুল কুদ্দুস মাখন-এর ভগ্নিপতি, বর্তমানে ঢাকা জেলার এ, ডি, সি ল্যান্ড) প্রমুখ এর তত্ত্বাবধানে কলেজটিলা থেকে বাংলাদেশের ছাত্রদের তালিকাভুক্ত (রিক্রুট) করে সামরিক প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য ভারতের বিভিন্ন ট্রেনিং ক্যাম্পে পাঠানো হতো।
এই কলেজ টিলাতে গিয়ে আমরা মনি ভাই, মাখন ভাই, রশিদ ভাই এবং মিজান ভাইয়ের সাথে দেখা করলাম। নেতারা বললেন, যতদিন ট্রেনিং-এ যাওয়া না হয় এখানে থাক। আমরা সারাদিন আগরতলায় ঘুরে বেড়াই, রাতে কলেজ টিলায় ঘুমাই। এমনি করে প্রায় মাসখানেক চলে গেল। আমরা সঙ্গে করে বাড়ি থেকে যে টাকা-পয়সা এনেছিলাম তা শেষ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হলো। এদিকে ট্রেনিং-এ যেতে আরো বেশ কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। এই অবস্থায় বন্ধু বাবুল আজাদ একদিন বললো, দোস্ত তুমি থাক, আমি ঢাকায় যাই, যেয়ে বাড়ি থেকে টাকা নিয়ে আসি।
আমি সঙ্গে সঙ্গে বাবুলের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলাম। বললাম, না ট্রেনিং এ যতদিন না যাই ততদিন খেয়ে না খেয়ে কষ্ট করতে থাকি।
খাওয়ার দারুণ কষ্টে পড়ে গেলাম। দিনে একমুঠো ভাত পাইতো পাই না অবস্থা। আর বাবুলের প্রতিদিন একই কথা—তুই থাক আমি ঢাকায় যাই টাকা-পয়সা নিয়ে আসি।
আমি বলি, না তুই ঢাকা ফিরে গেলে আর আসবি না।
বাবুল আমাকে বোঝায়, দেখ দোস্ত, আমি যদি এখান থেকে চলে যেতে চাই, তাহলে কি চলে যেতে পারি না? তুই কি আমাকে আটকিয়ে রেখেছিস? আমি চলে যেতে চাইলে তো যে কোন সময় চলে যেতে পারি, তোকে বলে যাওয়ার দরকার কি? আমি এই জন্যই তোকে বলে যেতে চাই যাতে তুই মন খারাপ না করিস। তুই বিশ্বাস কর, আমি কথা দিলাম, ঠিকই ঢাকায় যেয়ে মা’র কাছ থেকে টাকা নিয়ে আবার তোর কাছে ফিরে আসবো।
আমি বাবুলের কথা বিশ্বাস করলাম না।
যে ছেলে বাংলাদেশে থাকতেই রাস্তা থেকে বাড়ি ফিরে যাওয়ার জন্য কান্নাকাটি জুড়ে দিয়েছিল, সেই ছেলে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ঢাকার বাড়িতে ফিরে গিয়ে টাকা নিয়ে আবার আগরতলায় আমার কাছে ফিরে আসবে ! এটা কিছুতেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। তবে চিন্তা করলাম বাবুল যে কোন মুহূর্তেই সত্যিই আমাকে না জানিয়ে বাংলাদেশে চলে যেতে পারে। ওকে ধরে রাখার কোন উপায় তো আমার নেই। না বলে পালিয়ে যাবে তার চাইতে আমিই বাবুলকে বাংলাদেশে যাওয়ার অনুমতি দিয়ে দেই। সেই ভাল। আমি বাবুল আজাদকে চলে যাওয়ার অনুমতি দিলাম। দু’বন্ধু সীমান্তে এলাম, একজন আর একজনকে জড়িয়ে ধরলাম।
অশ্রুসজল চোখে আমি বাবুল আজাদকে বিদায় দিলাম। মনে হলো যেন আর দেখা হবে না। এ দেখাই শেষ দেখা। বিদায়ের বেলায় শুধু বললাম, আমার মাকে সান্ত্বনা দিস। আমি টিলার উপর দাঁড়িয়ে রইলাম। সামনে সমতলভূমি, বাংলাদেশ। বাবুল ধীরে ধীরে বাংলাদেশে নেমে গেল। পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম বাবুলের যাওয়ার দিকে। দৃষ্টিতে যতদূর দেখা যায় বাবুল আস্তে আস্তে ছোট হয়ে যাচ্ছে। এক সময় দৃষ্টির বাইরে মিলিয়ে গেল বাবুল আজাদ। টিলার উপর ঐ একই স্থানে কতক্ষণ নির্বাক, পলকহীন, ভারাক্রান্ত হৃদয়ে আনমনা হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম জানি না। ভারতীয় এক শিখ সৈন্যের স্পর্শে সংজ্ঞা ফিরে পেলাম। একাকী বিষন্ন মনে কলেজ টিলায় ফিরে এলাম। নিজেকে ভীষণ নিঃসঙ্গ মনে হলো। সারারাত ঘুম হলো না। রাতভর শুধু মনকে শক্ত করলাম। দেখতে দেখতে সপ্তাহখানেক পার হয়ে গেল। শুনলাম কলেজ টিলায় আমরা যারা আছি তাদের খুব তাড়াতাড়ি ট্রেনিং-এ পাঠিয়ে দেওয়া হবে । শুনে মনটা ভাল লাগলো। মুক্তিযোদ্ধা হব। দেশের মুক্তির জন্য যুদ্ধ করব। বাবুল আজাদের কথা মনে হলো। বাবুল আজাদ আর আসবে না জানি। তবুও যদি আসে, আমাকে পাবে না। এসে দেখবে আমি ট্রেনিং-এ চলে গেছি। আমার সাথে বাবুল আজাদের আর দেখা হবে না। যদি বেঁচে থাকি, বাবুলও যদি বেঁচে থাকে, দেশ স্বাধীন হলে হয়তো দেখা হবে। মিজানুর রহমান মিজান ভাই খুব অমায়িক লোক। আমাকে ডেকে বললেন, রেন্টু তৈরি হও, দুই চার দিনের মধ্যেই ট্রেনিং-এ যাবে। তুমি ছোট তো তাই একটু ঝামেলা হবে। তোমাকে ছোট বলে ট্রেনি-এ নিতে চাবে না। তুমি চিন্তা করো না। আমি সব ঠিক করে দেব। মিজান ভাই-ই ট্রেনিং-এর লিস্টটা লিখে। তাই খুব একটা ঘাবড়ালাম না। বাবুল চলে গেছে বেশ কয়েক দিন হয়ে গেল । মনের গভীরে নিজের অজান্তেই ক্ষীণ আশা। এখনো বাবুল এলো না? আগামী পরশু দিন সকাল সাতটায় আমি ট্রেনিং-এ চলে যাব। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। মাগরিবের নামাজের সালাম ফেরাতেই দেখি, বাবুল আজাদ বলছে, রেন্টু আমি আইসা পরছি । আমি স্বপ্ন দেখছি না, ঠিক ঠিক দেখছি, কিছুক্ষণ বুঝে উঠতে পারলাম না। সত্যি সত্যিই বাবুল আাদ এসেছে (ব্রিগেডিয়ার আমীন আহাম্মেদ চৌধুরী ১৯৮৮ সালে ভারত সরকার-এর কাছ থেকে ‘৭১-এর মুক্তিযোদ্ধাদের যে তালিকা সংগ্রহ করে এবং পরবর্তী পর্যায়ে সেনানিবাস (ক্যান্টনমেন্ট) ও মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টে এবং তার পরবর্তী পর্যায়ে ১৯৯৮/৯৯ সালে প্রধাণমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার দপ্তরে (প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে) মুক্তিযোদ্ধাদের যে তালিকা সংরক্ষিত হয়, ভারতীয় সেই তালিকার ১নং ভলিউম-এর ৪৬১ নং “মোঃ আবুল হোসেন, পিতা-এ, কে আজাদ ৬৪ বি, কে, দাস রোড ফরাশগঞ্জ, ঢাকা।” মোঃ আবুল হোসেন-এর ডাকনাম হলো বাবুল আজাদ)। শুধু একা বাবুল আজাদ আসেনি। সঙ্গে আবার মনির নামে একজনকে নিয়ে এসেছে (ব্রিগেডিয়ার আমীন আহাম্মেদ চৌধুরী ১৯৮৮ সালে ভারত সরকার- এর কাছ থেকে ‘৭১-এর মুক্তিযোদ্ধাদেরও তালিকা সংগ্রহ করে এবং পরবর্তী পর্যায়ে সেনানিবাস (ক্যান্টনমেন্ট) ও মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টে এবং তার পরবর্তী পর্যায়ে ১৯৯৮/৯৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার দপ্তরে (প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে) মুক্তিযোদ্ধাদের যে তালিকা সংরক্ষিত হয়, ভারতীয় সেই তালিকার ১নং ভলিউম-এর ৪৬৬ নং “মোঃ আব্দুল হালিম সিদ্দিক পিতা-মোঃ সুবেদ আলী ৫৩ নং বি, কে দাস রোড ফরাশগঞ্জ ঢাকা।” মোঃ আব্দুল হালিম সিদ্দিক-এর ডাকনাম হলো মনির। বর্তমানে মনির সপরিবারে আমেরিকায় বসবাস করে)। মনির আমাদেরই পাড়ার ছেলে। আমি অবশ্য মনিরকে এর আগে চিনতাম না। এই প্রথম দেখলাম মনিরকে । মিজান ভাইয়ের কাছে গিয়ে বললাম। আমার দু’বন্ধু ছাড়া আমি ট্রেনিং-এ যাব না। যে করেই হোক বাবুল আজাদ ও মনিরকে আমার সাথে ট্রেনিং-এ পাঠাতেই হবে । পরের দিন সকালে মনির বললো, ওর বড় ভাই মন্টু ভাই আগরতলাতেই কোথাও আছে। ছুটলাম মনিরের বড় ভাই মন্টু ভাইয়ের সন্ধানে। খুঁজে বের করলাম মন্টু ভাইকে। মন্টু ভাই ট্রেনিং শেষ করে অস্ত্র নিয়ে বাংলাদেশের ভিতরে যুদ্ধে যাওয়ার অপেক্ষায় আছেন। মন্টু ভাইয়ের কাছেই শুনলাম আমার সেজো ভাই ঢাকা কায়েদে আজম (বর্তমান শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ) ছাত্র সংসদের জি, এস, মজিবুর রহমান মন্টু ট্রেনিং শেষ করে অনেক আগেই ঢাকায় অপারেশনে চলে গেছে। কলেজ টিলায় ফিরে এসে দেখা হলো শহীদ ভাইয়ের সাথে। শহীদ ভাই আমার সেজো ভাই মজিবুর রহমান মন্টুর বন্ধু এবং কায়েদে আজম কলেজ ছাত্র সংসদের এ, জি এস।
শহীদ ভাই আমাদের পরে যাবে টেন্ডুয়া ট্রেনিং ক্যাম্পে সামরিক প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য। মিজান ভাইয়ের বদৌলতে পরের দিন সকালে আমরা তিন বন্ধু এটা মিলিটারী লরিতে উঠে বসলাম অন্যান্যদের সাথে। মিলিটারী লরিতে ওঠার আগে তিন-চার জায়গায় আমাদের নাম লেখা হলো এবং আমাদের স্বাক্ষর নেওয়া হলো। সামরিক লরি আমাদের নিয়ে চলতে শুরু করল, সন্ধ্যা নাগাদ লেম্বু চোরা নামক ট্রেনিং ক্যাম্পে পৌঁছে গেলাম। এই লেম্বু চোরা ট্রেনিং ক্যাম্পে ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেজর কে, বি, সিং এবং মেজর আর, পি, শর্মার অধীনে এক মাস সামরিক প্রশিক্ষণশেষে ২নং সেক্টরের সদর দপ্তর মেলাঘর থেকে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বাংলাদেশের ভেতরে ঢুকে পড়লাম। ২নং সেক্টরের প্রথম সেক্টর কমান্ডার ছিলেন মেজর খালেদ মুশাররফ। ২নং সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মুশাররফকে লেঃ কর্নেল পদে পদোন্নতি দিয়ে তাঁর নামের ইংরেজি প্রথম অক্ষর K অনুসারে গড়ে তোলা হয় ফোর্স। এবং এই K ফোর্সের অধিনায়ক হন খালেদ মুশাররফ। তখন ২নং সেক্টরের কমান্ডারের দায়িত্ব নেন ক্যাপ্টেন থেকে সদ্য পদোন্নতি পাওয়ার মেজর হায়দার। খুব সম্ভবত খালেদ মুশাররফ যখন ২নং সেক্টর কমান্ডার তখন হায়দার ২নং সেক্টরের টু আই সি ছিলেন।
আমরা যারা ভারতে সামরিক প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা হয়েছি, আমাদের প্রশিক্ষণকালে অসংখ্যবার বহু জায়গায় আমাদের নাম, পিতার নাম, বর্তমান ও স্থায়ী ঠিকানা কতজন ভাই, কতজন বোন, তাদের নাম ইত্যাদি বিশদ লিপিবদ্ধ করা হয় এবং স্বাক্ষর নেওয়া হয়। এই জাতীয় বায়োডাটা দিতে গিয়ে আমরা বিরক্ত হয়ে পড়েছিলাম। ভারত সরকার যদি প্রয়োজন মনে করে ঐ তালিকা ধরে এখনও আমাদের খুঁজে বের করে ফেলতে পারবে। একমাত্র কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম-এর কাদেরিয়া বাহিনী ছাড়া, আমরা যারা ভারতে গিয়ে ট্রেনিং নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা হয়েছি এই মুক্তিযোদ্ধারাই মূল মুক্তিযোদ্ধা বা প্রথম মুক্তিযোদ্ধা। এই মুক্তিযোদ্ধারাই দেশে এসে ছাত্র যুবকদের ট্রেনিং দিয়ে আরো মুক্তিযোদ্ধা তৈরি করে। অর্থাৎ ভারতীয় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের থেকেই জন্ম নেয় দেশীয় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা। এই হলো ইন্ডিয়ান ট্রেইন্ড এবং লোকাল ট্রেইন্ড মুক্তিযোদ্ধা। এই মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে এদেশের আপামর জনতা যোগ হয়ে হলো মুক্তিবাহিনী। যদি মুক্তিবাহিনী বলা হয় বা ধরা হয়, তাহলে কেবল রাজাকার, আলবদর, আলশামস ব্যতীত সকল (সাড়ে সাত কোটি) বাঙালির মুক্তিবাহিনী। যেমন সেনাবাহিনী, সেনাবাহিনীর সকল সদস্যই যুদ্ধ করে না। সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের লোকদের দায়িত্ব হচ্ছে, ব্রীজ, কালভার্ট, পুল ইত্যাদি তৈরি করা। যুদ্ধ করা নয়। আবার সেনাবাহিনীর মেডিকেল কোর বা সিগন্যাল কোর-এর সদস্যরা যুদ্ধ করে না। মেডিকেল কোরের দায়িত্ব হচ্ছে আহত সৈনিকের চিকিৎসা করা, যুদ্ধ করা নয়।
সিগন্যাল কোরের দায়িত্ব হচ্ছে সিগন্যাল দেওয়া, যুদ্ধ করা নয়। সেনাবাহিনীর সাপ্লাই কোরের লোকেরা যুদ্ধ করে না, কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে রসদ, গোলাবারুদ, খাবার ইত্যাদি সকল কিছু সাপ্লাই করার বা পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব হচ্ছে সাপ্লাই কোরের। সেনাবাহিনীর পদাতিক (ইনফিন্ট্রি), গোলন্দাজ (আর্টিলারি) ইত্যাদি কোরের কাজ হচ্ছে যুদ্ধ করা।
সেনাবাহিনীর পদাতিক (ইনফিন্টি), গোলন্দাজ (আর্টিলারি) ইত্যাদি কোরের কাজ হচ্ছে শত্রুকে আক্রমণ করা বা শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করা অর্থাৎ সাধারণ ভাষায় যুদ্ধ করা। ইঞ্জিনিয়ারিং কোর, সিগন্যাল কোর, মেডিক্যাল কোর, সাপ্লাই কোর ইত্যাদি সকল কোর মিলেই হয় সেনাবাহিনী।
এখন যদি ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের লোকেরা ব্রীজ বা পোল না বানিয়ে দেয়। তাহলে সৈনিকেরা নদী পার হতে পারবে না। মেডিক্যাল কোর চিকিৎসা না করলে আহত সৈনিক সুস্থ হতে পারবে না। সিগন্যাল কোর সিগন্যাল না দিলে সৈনিকেরা বুঝতে পারবে না। সাপ্লাই কোর সাপ্লাই না দিলে সৈনিকেরা গোলাবারুদ পাবে না, খাবার পাবে না।
এখন যদি ইঞ্জিনিয়ারিং কোর ব্রীজ না তৈরি করে, মেডিক্যাল কোর চিকিৎসা না দেয়, সিগন্যাল কোর সিগন্যাল না দেয়, সাপ্লাই কোর সাপ্লাই না দেয়। তাহলে কি পদাতিক বা গোলন্দাজ কোর যুদ্ধ করতে পারবে? না, পারবে না। যুদ্ধ করতে হলে উল্লেখিত সকল কিছু চাই। এই সকল কিছু মিলেই হয় যুদ্ধ । আমাদের মুক্তিযুদ্ধও সকল কিছু মিলেই হয়েছে। যেমন নৌকার মাঝি মুক্তিযোদ্ধাদের নদী পার করে দিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের দায়িত্ব পালন করেছেন। গ্রাম্য ডাক্তার বা ঔষধের দোকানদার মুক্তিযোদ্ধাকে চিকিৎসা করে মেডিকেল কোরের কাজ করেছেন। গ্রামের কৃষক পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর গতিবিধির খবর মুক্তিযোদ্ধাকে জানিয়ে সিগন্যাল কোরের ভূমিকা নিয়েছেন। গ্রামের মা ভাত রেঁধে খাইয়েছেন এবং সাধারণ মানুষ অস্ত্র ও গুলির বোঝা মাথায় করে মুক্তিযোদ্ধাদের পৌঁছে দিয়ে সাপ্লাই কোরের কাজ করেছেন। তবেই না কেবল আমরা মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ করেছি। আমরা মুক্তিযোদ্ধারা পদাতিক বা গোলন্দাজ কোরের কাজ করেছি। গোটা সাড়ে সাত কোটি বাঙালি ইঞ্জিনিয়ারিং, মেডিক্যাল, সিগন্যাল, সাপ্লাই ইত্যাদি কোরের কাজ করেছেন। এবং এই সকল কোরের সমন্বয়ে অর্থাৎ মুক্তিযোদ্ধা জনতার সমন্বয়ে সৃষ্টি হয়েছে মুক্তিবাহিনী।
কেবল রাজাকার, আলবদর ব্যতীত সকল বাঙালি মুক্তিবাহিনী। পাকিস্তানীরা অবশ্য এই সংজ্ঞাই বিশ্বাস করতো, আর এই জন্যই তারা নির্বিচারে বাঙালি হত্যা করেছে। নির্বিচারে বাঙালি হত্যা করা ছাড়া পাকিস্তানী সৈনিকদের আর যা করার ছিল তা হলো আত্মসমর্পণ। পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর অবস্থা ছিল দীপান্তরে বা নির্বাসনে আসা মানুষের মত ৷ নির্বাসনে বা দীপান্তরে আসা মানুষের সাথে পাক-সেনাদের পার্থক্য ছিল শুধু নিরস্ত্র আর সশস্ত্র । নির্বাসনে পাঠানো মানুষ থাকে নিরস্ত্র। কিন্তু পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সৈনিকদের আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে নিজ ভূখণ্ড পাকিস্তান থেকে ১২শ’ মাইল দূরে বাংলাদেশে নির্বাসনে পাঠানো হয়েছিল। পাকিস্তানী সমরবিদ ও রাজনীতিবিদরা মনে করেছিল তারা শুধু অস্ত্রের জোরে মানুষ খুন করেই বাংলাদেশ দীর্ঘ দিন দখল করে রাখতে পারবে। কিন্তু যেই মাত্র নিরস্ত্র বাঙালি সংক্ষিপ্ত সামরিক ট্রেনিং নিয়ে অস্ত্র হাতে তুলে নিল, সঙ্গে সঙ্গে শুধু শহর অঞ্চল ছাড়া গোটা বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণ চলে গেল মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিবাহিনীর কাছে।
বাংলাদেশে আসা পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর কাছে যে ধরনের অস্ত্র এবং যে পরিমাণ অস্ত্র ছিল তা দিয়ে কেবল নিরস্ত্র মানুষকে দীর্ঘদিন দাবিয়ে রাখা যেতো ঠিকই, কিন্তু সশস্ত্র মানুষকে বেশিদিন দাবিয়ে রাখা কিছুতেই যেতো না। এবং ভারতের মত একটি রাষ্ট্রের আক্রমণ মোকাবেলা করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশে অবস্থানরত পাকিস্তানীদের অস্ত্র ছিল সম্পূর্ণ অকার্যকর। মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই মুক্তিযোদ্ধা এবং এদেশের আপামর জনতা অর্থাৎ মুক্তিবাহিনীর দাপটে পাক হানাদাররা রাতের বেলায় চলাফেরা বন্ধ করে দিল । তবে পাক হানাদাররা ঠাণ্ডা মাথায়, একটা পরিকল্পনা দ্রুত চালিয়ে যেতে থাকলো তা হলো এদেশের নারীদের ধর্ষণ করা। পাকিস্তানীদের নীল নক্সাই ছিল এদেশের কিশোরী, যুবতী, রমণী নির্বিচারে ধর্ষণ করে তাদের পেটে পাকিস্তানীদের জারজ সন্তান তৈরি করা। বাঙালি নারীর গর্ভে পাকিস্তানী জারজ বংশধর বৃদ্ধি করা এবং পাকিস্তানী এই জারজদের দিয়ে বাংলাদেশকে চিরকাল দখল করে রাখা। পাকিস্তানীরা তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করার জন্য গোলাম আযম, মতিউর রহামন নিজামীদের মত মুষ্টিমেয় হাতে গোনা কতিপয় ঘৃণিত ব্যক্তিকে তাদের দোসর হিসেবে পেল ঠিকই। কিন্তু গোটা বাঙালি জাতি পাকিস্তানীদের চিরদিনের জন্য উপড়ে ফেলার জন্য ছিল বদ্ধপরিকর।
অপরদিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সরকার এবং ভারতের জনগণ বাঙালি জন্য, বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য তাদের সকল ধরনের সাহায্যের দুয়ার খুলে দিল অকৃপণভাবে।
মুক্তিযুদ্ধের মাত্র নয় মাসের মাথায় ভারতের সাথে পাকিস্তানের যুদ্ধ বেঁধে গেল। একদিকে মুক্তিযোদ্ধা-জনগণ মিলে সাড়ে সাত কোটি মুক্তিবাহিনী, তার সাথে যোগ হলো ভারতীয় সেনাবাহিনী। মুক্তিবাহিনী আর ভারতীয় বাহিনী মিলেমিশে হলো মিত্রবাহিনী। ৬ই ডিসেম্বর মিত্রবাহিনী সাঁড়াশি আক্রমণ শুরু করল নির্বাসনে আসা দিশেহারা পাক হানাদার বাহিনী মাত্র দশ দিনের মাথায় ১৬ই ডিসেম্বরে অসহায়ে মত পরাজয় বরণ করলো। ছিয়ানব্বই হাজার পাকিস্তানী সৈন্য জেনারেল নিয়াজির নেতৃত্বে ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ সাল রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) আত্মসমর্পণ করলো। এই আত্মসমর্পণের ঐতিহাসিক দলিলে, আত্মসমর্পণকারীদের পক্ষে পাকিস্তানীদের জেনারেল নিয়াজি স্বাক্ষর করেন এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা বিজয়ীদের পক্ষে স্বাক্ষর করেন । বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠিত হলো স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। মুক্তিপাগল মানুষ মুক্তিযোদ্ধা এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের মাধ্যমে ছিনিয়ে আনলো স্বাধীনতার লাল সূর্য।
বাঙালী জাতি সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন করে ১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে স্বাধীন দেশে ফিরিয়ে আনলো।
স্বাধীন দেশে ফিরে এসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, যার সফল নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে বিপ্লবী সরকারের প্রধানমন্ত্রী বা মুজিব নগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজুদ্দিন আহমেদকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে নিজে প্রধানমন্ত্রী হলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে অস্ত্র জমা নিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় যে বাঙালিরা পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর অধীনে চাকরী করেছে ও পরাজিত হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে সেই পরাজিত প্রশাসনকে, পুনর্জীবিত করলেন ও দেশ পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত করলেন। আর মুক্তিযোদ্ধারা কে কোথায় গেল তার কোন খবর রাখলেন না। শুধু তাই নয়, ভারত সরকারের কাছে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পূর্ণ সঠিক তালিকা থাকা সত্ত্বেও সেই তালিকা না এনে নানানজনকে দিয়ে নানা রকমের মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট বিতরণ করলেন। আমার জানামতে, ঐ মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট কোন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা তো নেনইনি, বরং যারা রাজাকার ছিল, চরম সুবিধাবাদী ছিল, যারা মুক্তিযুদ্ধের ধারকাছ দিয়েও হাঁটেনি তারাই ঐ সকল মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভুক্ত হয়েছে এবং সার্টিফিকেট নিয়েছে।
একজন মুক্তিযোদ্ধার জাতির কাছ থেকে কেবল সম্মান ব্যতীত আর কিছু পাওয়ার থাকতে পারে না। মুক্তিযোদ্ধারা জাতির গৌরব। ভারত সরকারের কাছ থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা নিয়ে আসার সহজ পন্থা গ্রহণ না করে, কেন শেখ মুজিবর রহমান নানানজনকে দিয়ে (অনেক বিতর্কিত ব্যক্তিও এর মধ্যে আছে) নানান রকমের তালিকা আর মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট দিয়ে লেজে গোবরে বেহাল অবস্থা করলেন, তা বোধগম্য নয়।
মুক্তিযোদ্ধারা থাকবে না, থাকবে দেশ। থাকতে হবে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা। কিন্তু শেখ মুজিব অতি সামান্য ও অতি সহজ কাজ ভারত থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রকৃত তালিকা নিয়ে আসতে কেন ব্যর্থ হলেন! এই ব্যর্থতার জন্য একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে কখনই ক্ষমা করবো না।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের প্রতি জাতির ভালবাসা, শ্রদ্ধা, সর্বোপরি বিশ্বাস আকাশছোঁয়া, তিনি সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। জাতির আশা ছিল মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলগুলো নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব একটি জাতীয় সরকার গঠন করবেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান তা করলেন না। তিনি সরকার গঠন করলেন মুক্তিযুদ্ধের কঠিন ত্যাগের পরীক্ষায় পিছিয়ে পড়া, দেশ ও জাতির প্রতি দায়িত্ব পালনে চরমভাবে ব্যর্থ, সুবিধাভোগী আওয়ামী লীগের সেই সব ব্যক্তিদের নিয়ে। মুক্তিযুদ্ধের সফল নেতা তাজুদ্দিন আহমেদসহ সকল মুক্তিযোদ্ধাদের দূরে ঠেলে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান পরাজিত প্রশাসন ও লোকদের দিয়ে সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে বিজয়ী একটি জাতি ও একটি দেশকে পরিচালনা করতে যেয়ে, আসলে বিজয়ী জাতিকে পরাজয়ের গহ্বরে ঠেলে দিলেন।
একজন জাতীয় নেতার জ্ঞান গরিমা আর অভিজ্ঞতায় পূর্ণাঙ্গ সফল হতে যদি একশ’ মার্কের দরকার হয়, তবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের ছিল পঞ্চাশ মার্ক। পাকিস্তানের তেইশ- চব্বিশ বছরের আন্দোলন আর সংগ্রামের মধ্য দিয়ে শেখ মুজিবর রহমান পঞ্চাশ মার্ক অর্জন করেছিলেন। আর বাকী পঞ্চাশ মার্ক অর্জন হতো, যদি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ‘৭১-এ মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের কাছে বন্দী না হয়ে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিতেন তাহলে তিনি প্রত্যক্ষভাবে বুঝতেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কি, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ কি। মুক্তিযোদ্ধা কারা হয় এবং কিভাবে মুক্তিযোদ্ধা হয়। একটা জাতির জীবনে মুক্তিযুদ্ধ বারবার আসে না। জাতির জীবনে মুক্তিযুদ্ধ আসা বিরল ভাগ্যের ব্যাপার। একমাত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমেই একটি জাতি দেহ-মনে মাথা তুলে দাঁড়ায় এবং পুরনো ধ্যান-ধারণা, পুরনো সকল ব্যবস্থা, সংকীর্ণ সকল চিন্তা ঝেড়ে ফেলে জাতি নতুন করে জন্ম নেয়।
একমাত্র মুক্তিযুদ্ধের জীবনপণ কঠিন পরীক্ষার মাধ্যমেই দেশ ও জাতির সেবায় এগিয়ে আসে জাতির বীর সন্তানেরা। আর পিছনে পড়ে যায়, পালিয়ে যায় সুবিধাবাদী ভীরু কাপুরুষের দল। কেবল মুক্তিযুদ্ধের সময়ই পরিষ্কার চেনা যায় কারা সুবিধাভোগী ভীরু কাপুরুষ আর কারা ত্যাগী সাহসী পুরুষ। কিন্তু জাতির দুর্ভাগ্য, দুর্ভাগ্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান চিনলেন না, জানলেন না জাতির সাহসী, ত্যাগী পুরুষদের। এখানেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের পঞ্চাশ মার্ক ঘাটতি থেকে গেল। শুধু পঞ্চাশ মার্ক নিয়ে তিনি দেশ চালাতে গেলেন। পাকিস্তানীরা যুদ্ধে পরাজিত হলো। বন্দী হলো। কিন্তু তাদের পরাজিত তাঁবেদারি বাঙালি প্রশাসনটা রয়েগেল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান এই পরাজিত পাকিস্তানী প্রশাসনটা শুধু অক্ষতই রাখলেন না বরং বিজয়ী বাঙালি জাতির মাথার উপর পুনরায় চাপিয়ে দিলেন। তিনি দল ও প্রশাসনে মুক্তিযোদ্ধাদের তেমন স্থান দিলেন না। এক সময়ে যারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের দল ছিল, সমর্থক ছিল তারা বিভক্ত হলো, জাতি বিভক্ত হলো। বাড়তে থাকলো নিরাশার সংখ্যা। হতাশা আর নিরাশার ভিতর দিয়ে সময় বয়ে যেতে থাকলো। এদেশের কৃষক-শ্রমিক ছাত্র জনতা এবং সাধারণ মানুষ জীবনপণ করে যুদ্ধ করেছে। জীবনপণ করা সকল যোদ্ধাদের তথা গোটা জাতির শুধু একটি স্বপ্ন ছিল। একটিই আশা ছিল। আর সে স্বপ্ন ও আশা হলো সুখে থাকার স্বপ্ন, সুখে থাকার আশা। সুখ বলতে যা বোঝায় তাহলো, থাকার জন্য ঘর। ক্ষুধার জন্য অন্ন। রোগশোকের জন্য চিকিৎসা ও শিক্ষার নিশ্চয়তাই হলো সুখে থাকা। আর এই সুখে থাকার জন্যই এদেশের মানুষ লড়াই করেছে, যুদ্ধ করেছে। অস্পষ্ট হলেও জনগণের আকাঙ্খা ছিল সমাজ বিপ্লবের। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে সমাজতান্ত্রিক উপাদান ছিল, মুক্তিযুদ্ধে সমাজতন্ত্রীরাও ছিলো। কিন্তু সমাজতন্ত্রীরা নেতৃত্ব দিয়ে জাতীয়তাবাদীদের উপরে ওঠার আগেই আমাদের দেশ স্বাধীন হয়ে যায়। মুক্তিযুদ্ধ বিকাশ লাভ না করে অসমাপ্ত থেকে যায়। ফলে সামাজিক বিপ্লবও অসমাপ্ত থেকে যায়। স্বাধীনতার অর্থ হচ্ছে জনগণের মুক্তি। দেশ স্বাধীন হলো, কিন্তু জনগণ মুক্তি পেল না। জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি হলো না। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের পুরাতন সমাজ কাঠামো ভেঙ্গে নতুন সমাজ গড়ার মধ্য দিয়ে সকল মানুষের জন্য অধিকার ও সুযোগের সাম্য প্রতিষ্ঠা না করে বরং প্রতিহত করেছে সামাজিক বিপ্লবকে। অক্ষুন্ন রেখেছে অসম বিকাশের পুরাতন ধারাকে। তারা লুণ্ঠন করেছে দু’হাতে। আমলা, কালো ব্যবসায়ী অসৎ রাজনীতিক এরাই ক্রমাগত ধনী হয়েছে স্বাধীনভাবে। জনগণের অগ্রগতি হবে কি? তারা আরো নিঃস্ব, আরো দরিদ্র হতে থাকলো। নেতৃত্ব সমগ্র জনগণের স্বার্থ না দেখে, শ্রেণীস্বার্থ দেখেছে। তাৎপর্যের বিষয়, নেতৃত্ব যে কেবল শ্রেণীতে সীমাবদ্ধ ছিল তা নয়, আটক ছিল দল এবং সর্বোপরি পরিবারের কাছে। দেশে দুর্ভিক্ষ শুরু হলো। হাজার হাজার মানুষ না খেতে পেয়ে ক্ষুধায় মারা গেল। বৃদ্ধি পেলো লুণ্ঠন ও দুর্নীতি। শেখ মুজিবের নেতৃত্ব বিশ্বাসযোগ্যতা হারাতে লাগলো। অপর দিকে অসমাপ্ত সামাজিক বিপ্লবের বিপ্লবীরা পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টির মহান নেতা কমরেড সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বে তাদের সশস্ত্র বিপ্লবী তৎপরতা তীব্রতর করে তোলে । যুবকরা পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টি জিন্দাবাদ, কমরেড সিরাজ সিকদার জিন্দাবাদ ধ্বনি দিয়ে দেশে ব্যাপক এক নতুন সংগ্রাম শুরু করে। এই সংগ্রামের নাম দেয় শ্রেণী সংগ্রাম। দলে দলে যুবকরা সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বে এই সশস্ত্র সংগ্রামে যোগ দিতে থাকে।
আদিকাল থেকে শিক্ষিত ও ধনী পরিবারে সিরাজ সিকদার জন্মগ্রহণ করেন। সিরাজ সিকদার খুবই মেধাবী ছাত্র ছিলেন এবং নিজে বি, এস, সি, (সিভিল) ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। ছাত্র জীবনে তিনি বামপন্থী ছাত্র সংগঠন করতেন। শ্রেণী সংগ্রাম ও সমাজ বিপ্লবের প্রয়োজনে কমরেড সিরাজ সিকদারের সশস্ত্র সংগ্রাম এতই ব্যাপক ও তীব্র হলো যে, শেখ মুজিবর রহমানের প্রশাসন দিনকে দিন অচল হয়ে যেতে শুরু করলো। নির্যাতিত নিপীড়িত শোষিত বাঙালির হৃদয়ে কমরেড সিরাজ সিকদারকে ঘিরে নতুন স্বপ্ন দানা বাঁধতে লাগলো।
১৯৭৪ সালের ২রা জানুয়ারী সিরাজ সিকদার গ্রেপ্তার, পলায়নকালে পুলিশের গুলিতে নিহত, এই শিরোনামে দেশের সকল পত্রিকায় সংবাদ পরিবেশিত হলো। পুলিশের প্রেসনোটে বলা হলো সিরাজ সিকদারকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল এবং সাভার রোড দিয়ে নিয়ে আসার সময় সিরাজ সিকদার পুলিশের ভ্যান থেকে লাফিয়ে পড়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল। তখন পুলিশ গুলি করে, সেই গুলিতে সিরাজ সিকদার নিহত হয়।
কিন্তু অনুসন্ধান করে জানা যায় পুলিশের প্রেসনোট বানোয়াট। সিরাজ সিকদারকে গ্রেপ্তার করা হয় ঠিকই এবং গ্রেপ্তারের পর বিনা বিচারে বন্দী অবস্থায় গুলি করে হত্যা করা হয়। সিরাজ সিকদারের বুকে মোট পাঁচটি গুলির চিহ্ন ছিল যা সামনে থেকে করা হয়েছে। কেউ যদি পালাতে থাকে এবং পলায়নপর ব্যক্তিকে যদি পিছনে থেকে গুলি করা হয়, তাহলে সেই গুলি পিঠে বিদ্ধ হবে। কিন্তু সিরাজ সিকদারের বুকে বুলেট বিদ্ধ হয়েছিল । তিনি মেহনতী মানুষের মুক্তির জন্য, শোষকের শোষণ থেকে মানুষের মুক্তির জন্য ব্যক্তিগত সকল ভোগবিলাস, সুযোগ-সুবিধা বিসর্জন দিয়ে সর্বহারা শ্রেণীতে মিশে গেলেন। নিপীড়িত-নির্যাতিত,সর্বহারা মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ঘর সংসার, আত্মীয়-পরিজন, আরাম-আয়াস ত্যাগ করে সমাজ বিপ্লবে নিজেকে সম্পূর্ণ উৎসর্গ করেছিলেন। মানুষের জন্য এমন উৎসর্গীকৃতপ্ৰাণ কমরেড সিরাজ সিকদারকে বিনা বিচারে বন্দী অবস্থায় নির্মম-নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করার পর শেখ মুজিবর রহমান পবিত্র পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে দম্ভের সাথে বললেন, আজ কোথায় সিরাজ সিকদার? এই ঘটনার পর শেখ মুজিবের দেশপ্রেম, মহানুভবতা এবং আইন ও বিচারের প্রতি শ্রদ্ধা প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে পড়লো। মানুষ ভাবতে লাগলো শেখ মুজিব যদি একজন দেশপ্রেমিক হন, একজন বীর হন, একজন মহান নেতা হন, তাহলে কি করে আর একজন দেশপ্রেমিককে, আর একজন বীরকে, আর একজন সর্বস্বত্যাগী মহান নেতাকে বিনা বিচারে বন্দীদশায় গুলি করে হত্যা করতে পারলেন? আবার এই জঘন্য অন্যায় ও কলঙ্কের কথা পবিত্র পার্লামেন্টে দম্ভের সাথে শেখ মুজিব কি করে বলতে পারলেন?
১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবর রহমান প্রধানমন্ত্রী থেকে রাষ্ট্রপতি হলেন। দেশের সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেন। এবং প্রতিষ্ঠিত করলেন একদলীয় বাকশালি শাসন ব্যবস্থা। শেখ মুজিবের বাকশাল ছাড়া কেউ অন্য কোন দল করতে পারবে না। সরকার নিয়ন্ত্রিত চারটি সংবাদপত্র ছাড়া দেশের অন্য সকল সংবাদপত্র নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলো। জাতির বিভক্তি গেল না। আশা-নিরাশার মিশ্র প্রতিক্রিয়া বইতে লাগলো। ১৯৭৫ সালের ৭ই জুন বহু মানুষ, বহু পেশাজীবী সংগঠন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে বাকশাল করার জন্য প্রবল বর্ষণ উপেক্ষা করে অভিবাদন জানালো।
সরকারী মালিকানায় নেওয়া দৈনিক ইত্তেফাকসহ চারটি পত্রিকা ছাড়া বাকি সকল সংবাদপত্র নিষিদ্ধ। শেখ মুজিবের নেওয়া নতুন একদলীয় রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক ব্যবস্থা সম্পর্কে রাজনীতিবিদ, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, সামরিক-বেসামরিক ব্যক্তিসহ দেশের সকল নাগরিকের কিছুই বলার সুযোগ থাকলো না। সর্বত্র নিস্তব্ধতা ।
১৫ই আগস্ট ১৯৭৫ সাল। ফজরের আজানের পর কাক ডাকা ভোরে রেডিওতে মেজর ডালিমের কণ্ঠ, আমি মেজর ডালিম বলছি, স্বৈরাচারী শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে। সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করেছে। অনির্দিষ্ট কালের জন্য কার্য ঘোষণা করা হয়েছে। এরপর দ্বিতীয়বার ঘোষণা করা হলো, শেখ মুজিব ও তার স্বৈরাচারী সরকারকে উৎখাত করে খন্দকার মোশতাক আহমেদের নেতৃত্বে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করেছে এবং কার্ফু জারি করা হয়েছে।
সহকর্মী হিসেবে শেখ মুজিব যাদের দীর্ঘদিন কাছে এবং পাশে রেখেছেন সেই সকল আওয়ামী লীগের নেতা নীরব এবং নিশ্চুপ থেকেছেন। ছাত্রলীগের সামান্য সংখ্যক তরুণ নেতৃস্থানীয় কর্মীরা আওয়ামী লীগের নেতাদের সাথে যোগাযোগ করলে তারা সবাই চুপচাপ থাকার, অপেক্ষা করার এবং দেখার পরামর্শ ও নির্দেশ দেন। নেতাদের ইংরেজিতে একটা কমন ডায়লগ ছিল, যা কোন কোন ক্ষেত্রে নির্দেশ হিসেবেও মান্য হয়েছে, এই ডায়ালগ বা নির্দেশটি হলো ‘ওয়েট এন্ড সি’। ‘৭৫-এর ১৫ই আগস্ট শেখ মুজিব হত্যার পর আওয়ামী নেতাদের ‘ওয়েট এন্ড সি’-এর রাজনীতি শুরু হয়। ছাত্রনেতা-কর্মীদের খুবই সামান্য একটা অংশ ‘ওয়েট এন্ড সি’ রাজনীতি প্রত্যাখ্যান করে অনুল্লেখযোগ্য কর্মতৎপরতা শুরু করে এবং এই তৎপরতা মূলত শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই সীমাবদ্ধ থাকে। এই কর্মতৎপরতায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন বর্তমান কম্যুনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম।
১৫ই আগস্টে শেখ মুজিবর রহমানকে হত্যার পর হত্যার সমর্থনে আনন্দ উল্লাস করে রাজপথে কোন মিছিল হয়নি। আবার হত্যার বিপক্ষেও কোন শোক সভা, শোক মিছিল এবং প্রতিবাদ মিছিলও হয়নি।
বলা যায় শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডের পিছনে প্রায় সকল সামরিক এবং বেসামরিক নেতৃত্ব সমর্থন জুগিয়েছিল। অন্তত একথা সহজেই বলা যাবে যে, সকলেই নীরবে এ হত্যা মেনে নিয়েছিল কেবল ব্যতিক্রম কাদের সিদ্দিকী ছাড়া।
মুক্তিযুদ্ধের কিংবদন্তী কাদের সিদ্দিকী শেখ মুজিব হত্যার প্রতিবাদে ‘৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের ন্যায় আবারো সশস্ত্র যুদ্ধ শুরু করে। শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডের পর আওয়ামী লীগের নেতারা এবং শেখ মুজিবের মন্ত্রী সভার সদস্যরাই খন্দকার মোশতাক আহমেদ-এর নেতৃত্বে মন্ত্রীসভা গঠন করে। খন্দকার মোশতাক আহমেদ শেখ মুজিবের স্থলাভিষিক্ত হন। খন্দকার মোশতাক আহমেদ ছিলেন শেখ মুজিবর রহমানের মন্ত্রীসভার বাণিজ্যমন্ত্রী। বাণিজ্যমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদের রাষ্ট্রপতি হওয়ার সাংবিধানিক কোন বৈধতা ছিল না। খন্দকার মোশতাকের রাষ্ট্রপতি হওয়া সাংবিধানিকভাবে সম্পূর্ণ অবৈধ ছিল। তবুও দেশের নতুন রাষ্ট্রপতি হন খন্দকার মোশতাক আহমেদ এবং খন্দকার মোশতাক আহমেদের নেতৃত্বে মন্ত্রী সভায় যোগদান করেন বর্তমানে শেখ হাসিনার মন্ত্রী সভার সদস্য আবুল হাসান চৌধুরীর পিতা সাবেক রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সভাপতি মন্ডলির সদস্য এবং এমপি আব্দুল মান্নানসহ শেখ মুজিবের মন্ত্রী সভার অনেক মন্ত্রী।
খন্দকার মোশতাক আহম্মেদের রাষ্ট্রপতি হওয়া, সাংবিধানিকভাবে কোন বৈধতা না থাকা সত্ত্বেও অবৈধভাবে খন্দকার মোশতাক আহামদকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ বাক্য পাঠ করান সুপ্রীম কোর্টের অস্থায়ী প্রধান বিচারপতি এ, বি মাহামুদ হোসেন।
এছাড়া মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনানী বঙ্গবীর জেনারেল এম, এ, জি ওসমানী খন্দকার মোশতাকের সামরিক উপদেষ্টা হন। ১৫ই আগস্ট সকাল ৯টায় তৎকালীন সেনাবাহিনী প্রধান শেখ হাসিনার দলের বর্তমান এম. পি মেজর জেনারেল শফিউল্লাহ সেনাবাহিনী প্রধান হিসেবে খন্দকার মোশতাক আহম্মেদের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে রেডিওতে ভাষণ দেন। এরপর আনুগত্য প্রকাশ করে রেডিওতে ভাষণ দেন বিমান বাহিনী প্রধান শেখ হাসিনার বর্তমান বিতর্কিত এম. পি এ. কে. খন্দকার, নৌ বাহিনী প্রধান এডমিরাল এম. এইচ. খান ও বি. ডি. আর এবং পুলিশ প্রধানগণ।
নতুন রাষ্ট্রপতি হিসেবে খন্দকার মোশতাক আহমেদ পার্লামেন্ট মেম্বারদের সভা ডাকেন। এই সভায় যোগদান করা থেকে বিরত রাখার জন্য ছাত্রনেতা নিহত সৈয়দ নুরুল ইসলাম নুরুর নেতৃত্বে ছাত্রলীগের হাতে গোনা কয়েক জন কর্মী জোর চেষ্টা ও তদবীর চালালেও আওয়ামী লীগের প্রায় সকল এম, পি উক্ত সভায় যোগদান করেন।
অপর দিকে বিখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম তার জনাপঞ্চাশেক সাথীসহ সীমান্ত এলাকায় অবস্থান নিয়ে খন্দকার মোশতাক আহমেদ-এর সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ শুরু করলে, ছাত্রনেতা সৈয়দ নুরুল ইসলাম নুরু তার কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে বৃহত্তর ময়মনসিংহ এবং বৃহত্তম সিলেট জেলার সীমান্ত অঞ্চলে কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্ব গড়ে ওঠা সংগঠন জাতীয় মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেন।
ডাকসুর সাবেক ভি. পি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম (বর্তমানে কমিউনিস্ট (সিপিবি) পার্টির সাধারণ সম্পাদক), ইসমত কাদির গামা, রবিউল আলম চৌধুরী (বর্তমানে সরকারী আমলা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পিএস মোক্তাদির চৌধুরী) দের নেতৃত্বেমাত্র শ’খানেক ছাত্রনেতা ও কর্মী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনৈতিক কর্মতৎপরতা শুরু করলে, এই কর্মতৎপরতা প্রতিহত করার জন্য জাসদ ছাত্রলীগ (গণবাহিনী) প্রবলভাবে সক্রিয় হয়ে ওঠে।
‘৭৫ সালের অক্টোবর মাসের শেষের দিকে ছাত্রলীগের এই মুষ্টিমেয় নেতা- কর্মী মিলে সিদ্ধান্ত নিল ৪ঠা নভেম্বর ‘৭৫-এ ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের বাসভবনে মৌন মিছিল করে যাওয়া হবে ৷
৪ঠা নভেম্বরের মৌন মিছিল সফল করে তোলার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকা শহরে গোপন বৈঠক চলতে লাগলো। ২রা নভেম্বর দিবাগত গভীর রাতে অর্থাৎ ৩রা নভেম্বর প্রত্যূষে দেশে ২য় সামরিক অভ্যুত্থান ঘটলো। ৩রা নভেম্বর সকালে সোভিয়েত রাশিয়ায় নির্মিত বোমারু বিমান মিগ ২১ আকাশে উড়লো এবং খুবই নীচ দিয়ে ঘন ঘন মহড়া দিতে লাগলো। বাংলাদেশ বেতার বা রেডিও বাংলাদশ এবং টেলিভিশন সম্প্রচার সারাদিন বন্ধ রইল। বোমারু বিমানের নীচ দিয়ে ঘন ঘন মহড়া দেওয়া এবং রেডিও বন্ধ থাকায় দেশে যে ২য় বার সামরিক অভ্যুত্থান হয়েছে এটা স্পষ্ট বোঝা গেল এবং এটাও সুস্পষ্ট বুঝা গেল যে, এই ২য় সামরিক অভ্যুত্থানের জয়-পরাজয়ের কোন নিশ্চিত ফলাফল এখনও হয়নি। কোন পক্ষই এখনও নিশ্চিত বিজয়ী হয়নি। আর এই জন্যই বোমারু বিমান মিগ-২১ বারবার নীচে ড্রাইভ দিয়ে প্রতিপক্ষকে বোমা মারার হুমকি দিচ্ছে এবং বেতার বা রেডিও বন্ধ রয়েছে। বোমারু বিমান বোমা মারার হুমকি দিচ্ছে কিন্তু বোমা মারছে না, এ থেকে বোঝা যাচ্ছে দুই পক্ষের সাথেমালোচনা চলছে। আর সেই জন্যই যুদ্ধ বিমান আক্রমণের মহড়া দিচ্ছে, কিন্তু আক্রমণ করছে না।
রাতে হঠাৎ টেলিভিশন সম্প্রচার শুরু করলো কিন্তু অভ্যুত্থান সম্পর্কে কোন কিছুই বলা হলো না। ৪ঠা নভেম্বর সকাল বেলা পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচী অনুযায়ী মৌন মিছিলের প্রস্তুতি নিয়ে শ’পাঁচেক ছাত্র-জনতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় সমবেত হলো। সমবেত ছাত্র, জনতা বিচ্ছিন্নভাবে সামরিক অভ্যুত্থান নিয়ে আলোচনা করলো।
এদের অধিকাংশেরই ধারণা সেনাবাহিনীর নতুন প্রধান মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণাদানকারী মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান অভ্যুত্থান করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের ঘোষক হিসেবে সাধারণ মানুষের কাছে জেনারেল জিয়ার একটা পরিচিতি ছিল এবং গ্রহণযোগ্যতা ছিল। তাই অনেকেই মনে করেছে জেনারেল জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বেই সামরিক অভ্যুত্থান হয়েছে। অবশ্য কেউ কেউ বলল ব্রিগেডিয়ার খালেদ মুশাররফ অভ্যুত্থান করেছেন। অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব কে দিয়েছেন তা পুরোপুরি নিশ্চিত না হওয়া গেলেও, একটা বিষয় নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, ১৫ই আগস্টে অভ্যুত্থান করে শেখ মুজিবকে যারা হত্যা করেছে; তারা এখন আর ক্ষমতায় নেই এবং তারা দেশ ত্যাগ করেছে। ইতোমধ্যে আরো কয়েকশ’ লোক সমাবেশে যোগ দিয়েছে। সাত আটশ’ লোক নিয়ে মৌন মিছিল শুরু হলো। মৌন মিছিল ধানমন্ডি ৩২নং সড়কে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান এর বাসভবন অভিমুখে যাত্রা করলো। পলাশীর মোড়ে পুলিশ প্রথম বাধা দিল । পুলিশ বলছে, মিছিল নিষিদ্ধ আপনারা মিছিল করবেন না। কে মিছিল নিষিদ্ধ করেছে জিজ্ঞেস করলে পুলিশ কোন উত্তর দিতে পারেনি। পুলিশ বলেছে, আপনারা একটু অপেক্ষা করুন আমরা উধ্বর্তন কর্তৃপক্ষের কাছে জেনে নেই। কিন্তু মিছিল থামলো না। মিছিল চলতে থাকলো। পুলিশও নামকাওয়াস্তে হালকা-পাতলা বাধা দিতে লাগলো। কিন্তু প্রকৃত অর্থে পুলিশী বাধা বলতে যা বোঝায় তা পুলিশ মোটেও দেয়নি। আসলে পুলিশও জানতো না কারা এখন দেশের ক্ষমতায় আছে, দেশে কি হচ্ছে, পুলিশের কি করণীয়। পুলিশ অনেকটা কিংকর্তব্যবিমূঢ় ছিল। নিঃশব্দ মৌন মিছিল সাইন্স ল্যাবরেটরীর মোড় পার হয়ে কলাবাগানের দিকে যেতে থাকলে এদিকে পাহারায় থাকা সেনাবাহিনীর দশ-বার জন্য সৈন্য মিছিলের দিকে এগিয়ে এলো। সৈন্যদের মিছিলের দিকে এগিয়ে আসতে দেখে বেশ কিছু মিছিলকারী মিছিল ত্যাগ করে আশেপাশে সরে পড়ল।
সৈন্যরা মিছিলের দিকে এগিয়ে এলো ঠিকই, কিন্তু মিছিলে বাধা দান বা সমর্থন কোন কিছুই করলো না। শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগলো। তবে সৈন্যদের তাকানোর ভঙ্গিটা বিরূপ ছিল। তারা বাঁকা চোখেই মিছিলটাকে দেখেছে এবং মনে হয়েছে দ্বিতীয় সামরিক অভ্যুত্থান ও সৈন্যদের করণীয় সম্পর্কে তারাও নিশ্চিত হন। মিছিল কলাবাগান অতিক্রম করার সমগ্র ব্রিগেডিয়ার খালেদ মুশাররফ-এর মা এবং ছোট ভাই রাশেদ মুশাররফ (বর্তমানে শেখ হাসিনার ভূমি প্রতিমন্ত্রী) মিছিলে অংশ নিলে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মুশাররফ-এর নেতৃত্বে অভ্যুত্থানের বিষয়ে বিস্তারিত জানা যায়। এখানেই জানা গেল নতুন সেনাবাহিনী প্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মুশাররফ-এর অনুগত বাহিনী বন্দী করেছে এবং অনতিবিলম্বে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মুশাররফ মেজর জেনারেল পদোন্নতি নিয়ে সেনাবাহিনী প্রধান হচ্ছেন। মিছিল ৩২নং ধানমন্ডি বঙ্গবন্ধু ভবনের গেটে গিয়ে বিকেল তিনটায় বিশ্ববিদ্যালয়ের জমায়েত ও বিক্ষোভ মিছিলের কর্মসূচি দিয়ে শেষ হয়।
দুপুর ১টার দিকে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান-এর ভবনের সামনে থেকে যে যার স্থানে ফিরে যাই। মাত্র আধা ঘন্টা সময়ের মধ্যে দুপুরের আহার শেষ করে পুরান ঢাকা থেকে আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রওয়ানা হই। বিকেল তিনটার আগেই আমরা ডাকসু ভবনের সামনে উপস্থিত হয়ে দেখি প্রায় হাজার খানেক ছাত্র-জনতা ইতোমধ্যেই সমবেত হয়েছে। আনুষ্ঠানিকভাবে সমাবেশ শুরু হয়নি, কিন্তু বিক্ষিপ্তভাবে সবাই আলোচনা করছিল, এই আলাপ- আলোচনার মূল বিষয় ছিল জেলখানায় জাতীয় চার নেতা হত্যা। গতকাল ৩রা নভেম্বর শেখ মুজিব হত্যাকারীরা জেলখানার অভ্যন্তরে বন্দী অবস্থায় বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী মুক্তিযুদ্ধের সফল নেতৃত্ব দানকারী জনাব তাজুদ্দিন আহম্মেদ, প্রথম রাষ্ট্রপতি (অস্থায়ী) সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী ক্যাপ্টেন (অবঃ) মুনসুর আলী এবং শিল্পমন্ত্রী কামরুজ্জামানকে গুলি করে হত্যা করে এবং তারপর দেশ ত্যাগ করে।
ডাকসুর সাবেক ভি. পি. বর্তমানে কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, ইসমত কাদির গামা সংক্ষিপ্ত ও বিক্ষিপ্ত বক্তৃতার পর মিছিল শুরু হলো। জেলখানায় জাতীয় চার নেতা ও হত্যার খবরে মিছিলের মানুষগুলো কেমন যেন বিমর্ষ হয়ে গেল। মিছিলটা পুরনো ঢাকার দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো। কিন্তু মিছিলের গতি-প্রকৃতিটা এমনই হলো যেএটা না হলো বিক্ষোভ মিছিল, না হলো মৌন মিছিল। মিছিলটা পুরাতন শহর দিয়ে নাজিমুদ্দিন রোডের সেন্ট্রাল জেলের (কেন্দ্রীয় কারাগার) সামনে দিয়ে সন্ধ্যার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জহিরুল হক হলের মাঠে এসে শেষ হলো। এখানে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম আগামী ৫ই নভেম্বর শোকসভার কর্মসূচী ঘোষণা করে পাড়ায়-মহল্লায় মিছিল ও পথসভা করার নির্দেশ দিলেন। এর আগে বিকেল ৩টার দিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের দক্ষিণ পশ্চিম কোণে তিন নেতার মাজারের সামনে জাতীয় চার নেতাকে দাফন দেওয়ার জন্য কবর খোড়া হলো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পুলিশের বাধার জন্য জাতীয় চার নেতাকে এখানে কবর দেওয়া গেল না। আমরা দশ এগারোজন মিছিল করতে করতে পুরাতন শহরে আমাদের মহল্লায় ফিরে এলাম। তখন রাত ৮টা হবে। মহল্লায় এসে পরিচিত মাইকের দোকান থেকে মাইক এবং গ্যারেজ থেকে রিক্সা নিয়ে মাইক বেঁধে মিছিল এবং পথসভা করতে লাগলাম। পথসভা ও মিছিলে জাতীয় চার নেতা হত্যার প্রতিবাদে আগামীকাল শোকসভার ঘোষণা দিতে থাকলাম ৷ পথসভা এবং মিছিলে জনতা তো অংশ গ্রহণ করলই না, এমন কি আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও অংশগ্রহণ করলই না এমন কি আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীরাই ও অংশগ্রহণ করল না। আমরা দশ-এগারোজন ছাত্রনেতা-কর্মীই সারাটা পুরাতন শহরের যতটা এলাকা সম্ভব মিছিল আর পথ সভা করতে থাকলাম। রাত ১১টার দিকে শ্যামবাজার এলাকায় মিছিল নিয়ে এলে সূত্রাপুর থানার পুলিশ রাস্তার দু’দিকে থেকে ঘেরাও করে আমাদের বেধড়ক লাঠি পেটা করে রিক্সা এবং মাইক ছিনিয়ে নিয়ে যায়। পুলিশের এই হামলায় গুরুতর আহত হয় ছাত্র ইউনিয়ন নেতা বর্তমান সরকারী আমলা খন্দকার শওকত হোসেন (জুলিয়াস) এবং কবি নজরুল সরকারী কলেজের তুখোড় ছাত্রনেতা সৎ ও প্রতিবাদী ব্যক্তিত্ব বিএনপি সরকার কর্তৃক মনোনীত ৭৯ নং ওয়ার্ড চেয়ারম্যান বর্তমান জাতীয়তাবাদী দল ৭৯নং ওয়ার্ড সভাপতি জননেতা মোঃ ফরিদ .উদ্দিন। আমরা সবাই পালিয়ে গেলাম। রাতে কেউই বাসায় থাকলাম না।
কিন্তু রিক্সাওয়ালা, রিক্সার মালিক, মাইকওয়ালা এরা সবাই আমার বাসায় এসে রিক্সা আর মাইক দাবী করে বসে রইল। পরদিন সকালে টাকা-পয়সা দিয়ে থানায় লোক পাঠানো হলো রিক্সা আর মাইক ছাড়ানোর জন্য, কিন্তু থানা পুলিশ কিছুতেই মাইক আর রিক্সা ছাড়লো না। ৩রা নভেম্বর ব্রিগেডিয়ার খালেদ মুশাররফের নেতৃত্বে সংগঠিত দ্বিতীয় সামরিক অভ্যুত্থানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের হত্যাকারীরা দেশ থেকে পালিয়ে গেলেও যার নেতৃত্বে শেখ মুজিবর রহমানকে হত্যা করা হলো এবং যিনি সংবিধান বহির্ভূতভাবে অবৈধ পন্থায় দেশের রাষ্ট্রপতি হয়ে বসলেন সেই খন্দকার মোশতাক আহমেদ ঠিকই রাষ্ট্রপতি পদে বহাল থাকলেন। ১৫ই আগস্ট সকালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে হত্যা করে সংবিধান বহির্ভূত পন্থায় সম্পূর্ণ অবৈধভাবে রাষ্ট্রপতি হয়ে বসা খন্দকার মোশতাক আহমেদকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ বাক্য পাঠ করান বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের তৎকালীন অস্থায়ী প্রধান বিচার এ বি মাহমুদ হোসেন। সংবিধান বহির্ভূত পন্থায় রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত খন্দকার মোশতাক আহমেদ-এর কাছ থেকে ৫ই নভেম্বর ‘৭৫-এ ব্রিগেডিয়ার খালেদ মুশাররফ পদোন্নতি নিয়ে মেজর জেনারেল হন এবং সেই সাথে মুক্তিযুদ্ধের ঘোষক মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে সেনাবাহিনী প্রধানের পদ থেকে সরিয়ে দিয়ে নিজেই সেনাবাহিনী প্রধান পদে অধিষ্ঠিত হন। বিমান বাহিনী প্রধান ও নৌ বাহিনী প্রধানগণ খালেদ মুশাররফকে মেজর জেনারেল ও সেনাবাহিনী প্রধান-এর ব্যাচ পরিয়ে দিচ্ছেন এই ছবি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ৫ই নভেম্বর বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় শ’ পাঁচেক ছাত্র-জনতা সমবেত হলেও নেতৃত্বের অভাবে এবং জাসদ ছাত্রলীগের দাপটের কারণে ৪ঠা নভেম্বর ঘোষিত ৫ই নভেম্বরের শোকসভা অনুষ্ঠিত হয়নি। দেশের সর্বশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে অস্পষ্টতা এবং আতঙ্ক নিয়ে বিক্ষিপ্ত কথাবার্তা আর মিছিলের চেষ্টার মধ্যে দিয়ে ৫ই নভেম্বরের দিন শেষ হয়ে গেলে সন্ধ্যায় আমরা পুরাতন ঢাকায় ফিরে আসি এবং সরকারী কবি নজরুল কলেজের শহীদ সামসুল আলম ছাত্রাবাসের ছাত্রদের নিয়ে ছাত্রসভা করি। পরদিন ৬ই নভেম্বর সকালে পুরাতন ঢাকা থেকে যথারীতি আমরা দশ-এগারোজন মিছিল নিয়ে আবারও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমবেত হলে খন্দকার মোশতাক আহমেদকে রাষ্ট্রপতির পদ থেকে সরিয়ে সুপ্রীম কোর্টের প্রধান বিচারপতি আবু সাহাদাত মোঃ সায়েমকে রাষ্ট্রপতি করা, (আওয়ামী লীগের) পার্লামেন্ট ভেঙ্গে দেওয়া, সামরিক আইন জারি করা এবং সেনাবাহিনী প্রধান হিসেবে মেজর জেনারেল খালেদ মুশাররফের প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হওয়াসহ ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে বিস্তারিত শোনা যায় এবং এই দিনেও আমাদের মিছিল ও আলোচনার কোন আনুষ্ঠানিকতা ছিল না। সবাই ছিল বিক্ষিপ্ত এবং বিচ্ছিন্ন। সন্ধ্যানাগাদ আমরা পুরাতন শহরে ফিরে আসি। নেতৃত্বের কোথাও কেউ নেই। সব কেমন যেন শূন্য ও ফাঁকা । দেশে আরো সাংঘাতিক ধরনের কি যেন হতে যাচ্ছে তা অনুভব করা যায়। উপলব্ধি করা যায়। কিন্তু পরিষ্কার বোঝা যায় না। আওয়ামী বাকশালী নেতারা সব কে যে কি করছে বা কোথায় পালিয়ে গেছে তাও বোঝা যায় না। ছাত্রনেতাদের মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ভাগনে শেখ শহীদ অনেকটা পাতানো গৃহবন্দী বলেই মনে হচ্ছে। ইসমত কাদির গামার ততটা বুদ্ধিশুদ্ধি নেই, তবে কিছু করার চেষ্টায় আছেন। রবিউল আলম চৌধুরী (বর্তমানে আমলা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পিএস মোক্তাদির চৌধুরী) আছেন, সব সময়ই আছেন। বলতে গেলে সেই এখন সব চাইতে বড় নেতা। ডাকসুর সাবেক ভিপি ছাত্র ইউনিয়ন নেতা মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম হলেন কিছু একটা করার চেষ্টাকারীদের মূল নেতা। ছাত্রনেতা সৈয়দ নুরু কাদের সিদ্দিকীর সাথে যোগ দিয়েছেন।
আগামীকাল যথারীতি বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া ছাড়া আমাদের কোন কর্মসূচী নেই। রাত যখন গভীর হলো, দেড়টা দু’টা বাজে, ঘড়ির সময় অনুযায়ী ৭ই নভেম্বর গভীর রাতে হঠাৎ গুলির আওয়াজ শোনা যেতে লাগলো। রাত যতই বাড়তে লাগলো গুলির আওয়াজও ততই বাড়তে লাগলো । গুলির আওয়াজে মনে হতে লাগলো এ যেন পঁচিশে মার্চ ‘৭৫-এর মতোই এক কালো রাত। পঁচিশে মার্চ ‘৭১-এ পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র ঘুমন্ত বাঙালিকে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করেছে। কিন্তু আজকের গুলি কারা করছে, কেন করছে, কার বিরুদ্ধে করছে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।
৭ই নভেম্বর ভোর হতে না হতেই দেখা গেল সেনাবাহিনীর সিপাহীরা (জোয়ান) আকাশপানে গুলি করতে করতে রাস্তা গিয়ে পায়ে হেঁটে, গাড়িতে চড়ে যে যেভাবে খুশি ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর এই সেনা সিপাহীদের সঙ্গে স্বতঃস্ফূর্তভাবে জনগণের একটা অংশ যোগ দিয়েছে। সিপাহী জনতা, রাজপথে মিছিল করছে আর আকাশের দিকে গুলি ছুঁড়ছে, শ্লোগান দিচ্ছে। সিপাহী- জনতার এই মিছিল থেকে নানা ধরনের শ্লোগান দিতে শোনা গেল। কোন মিছিল থেকে শ্লোগান আসলো মোশতাক-জিয়া জিন্দাবাদ, মুসলিম বাংলা জিন্দাবাদ। কোন মিছিল থেকে শ্লোগান উঠলো কর্নেল তাহের জিন্দাবাদ, তাহের-জিয়া ভাই ভাই। গণবাহিনী জিন্দাবাদ, সিপাহী জনতা-ভাই ভাই ইত্যাদি নানা ধরনের শ্লোগান দিতে শোনা গেল সিপাহী জনতার- মিছিল থেকে। এই সিপাহী-জনতার সামনে কোন সুস্পষ্ট লক্ষ্য বা পরিষ্কার কোন ধারণা যে ছিল না তা বোঝা যাচ্ছিল এবং এই সিপাহী-জনতার বিদ্রোহে কোন একক নেতৃত্ব বা নিয়ন্ত্রণ যে ছিল না তাও বোঝা যাচ্ছিল। তবে এই সিপাহী-জনতার বিদ্রোহ যে আওয়ামী বাকশালী এবং শেখ মুজিব-এর অনুসারীদের বিরুদ্ধে তা নিশ্চিত ছিল।
ঐ মিছিলকারী সিপাহী-জনতা আওয়ামী বাকশালী বা শেখ মুজিব-এর অনুসারীদের দেখামাত্র যে মেরে ফেলত তাতে কোনই সন্দেহ ছিল না।
“আমার ফাঁসি চাই” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ