বছর কয়েক আগের কথা। কলকাতার এক বিখ্যাত কলেজের বিজ্ঞান বিষয়ের এক অধ্যাপক বন্ধু একদিন কথায় কথায় বললেন, তিনি নিজেই কয়েকবার প্ল্যানচেটের সাহায্যে বিদেহী আত্মাকে এনেছেন। তাঁর বাড়িতে এ-রকম একটি প্ল্যানচেট-চক্রে উপস্থিত থাকার জন্য আমাকে আমন্ত্রণ জানালেন। বন্ধুর আমন্ত্রণ উপেক্ষা না করে তাঁর এক প্ল্যানচেট-চক্রে হাজির হলাম।

সেদিনের ওই চক্রে অধ্যাপক বন্ধু সমেত আমরা পাঁচজন হাজির ছিলাম। খাওয়ার টেবিল ঘিরে পাঁচটা চেয়ারে বসলাম আমরা পাঁচজন। টেবিলের  মাঝখানে রাখা হল একটা বড় সাদা কাগজ। কাগজটার ওপর বসানো হল ছোট্ট তিনকোনা প্ল্যানচেট-টেবিলটার তিনটে পায়ার বদলে দু’দিনে লাগানো রয়েছে দু’টো লোহার গুলি বা বল-বেয়ারিং, একদিকে একটা বোর্ড-পিন, লোহার গুলি লাগানোর কারণ, টেবিলটা যাতে সামান্য ঠেলায় যে কোনও দিকে সাবলীল গতিতে যেতে পারে। সম্ভবত এককালে বোর্ড-পিনের জায়গাতেও একটা লোহার গুলিই ঢাকনা সমেত বসানো ছিল, গুলিটা কোনও কারণে খসে পড়ায় বোর্ড-পিনটা তার প্রক্সি দিচ্ছে। যেদিকে বোর্ড-পিনের পায়া, সেদিকের টেবিলের কোণে রয়েছে একটা ছোট ফুটো। ওই ফুটোর ভেতরে গুঁজে দেওয়া হল একটা পেন্সিল। পেন্সিলের ডগাটা রইল কাগজ স্পর্শ করে।

ঘরে ধূপ জ্বালা হল। আমাকে দর্শক হিসেবে রেখে চারজনে বসলেন বিদেহী আত্মার আহ্বানে। আমি আবেগপর্ব নই বলেই আমাকে মিডিয়ামের অনুপযুক্ত বলে রাখা হয়েছিল দর্শক হিসেবে।

আশ্চর্য জগদীশচন্দ্র বসুর একটা ছবি এনে রাখা হল মিডিয়ামদের সামনে। মিডিয়ামরা ছবিটার দিকে তাকিয়ে একমনে চিন্তা করতে লাগলেন, সেইসঙ্গে প্রত্যেকের ডান হাতের তর্জনী ছুঁয়ে রইল, প্ল্যানচেটের টেবিল।

কিছুক্ষণ পরে প্ল্যানচেটের টেবিলে নড়ে-চড়ে উঠল। অধ্যাপক বন্ধু জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি কে?”

উত্তরে বাংলায় লেখা হল – জগদীশচন্দ্র বসু।

প্রশ্ন – পরলোকে উদ্ভিদের আত্মা আছে কি?

উত্তর – না।

প্রশ্ন – কেন যাননি? উৎসাহ নেই?

উত্তর – আমি চলি।

এবার যে ছবিটা হাজির করলাম, সেটা আমার মায়ের। ছবিটা টেবিলে রাখতে আমার অধ্যাপক বন্ধু বললেন, “ইনি কে?”

-“আমার মা।“

-“নাম?”

-“সুহাসিনী ঘোষ।“

আবার প্ল্যানচেট-চক্র বসল। কিছুক্ষণ কেটে যেতেই পেন্সিলটা গতি পেল। আমি প্রশ্ন করলাম, “আপনি কে?”

-“তোর মা।“

“নাম?”

“সুহাসিনী ঘোষ।“

“এখন কেমন আছ? ওখানে কষ্ট হয়?”

“না। এ দুঃখ-কষ্টের ঊর্ধ্বে এক জগৎ।“

“আমি দেহাতীত আত্মার অস্তিত্বে এতদিন অবিশ্বাস করে এসেছি। তুমি যে সত্যিই আমার মা, তার প্রমাণ কি?”

-“এখনি প্রমাণ করতে পারিস, তুই আমার ছেলে? আমি যাই।“

চক্র ভাঙতেই অধ্যাপক বন্ধুটি বললেন, “আমরা কোনও চাতুরীর আশ্রয় নিয়েছিলাম বলে কি তোমার ধারণা?”

“না, লোক ঠকানোর চেষ্টা তোমরা করনি ঠিক, কিন্তু, তোমাদের মধ্যে কারও একজনের চিন্তাশক্তির তীব্রতা তারই অজ্ঞাতে পেন্সিলটাকে ঠেলে লেখাচ্ছিল,” বললাম, আমি।

বন্ধুটি কিছুটা উত্তেজিত হলেন, বললেন, “তুমি তো নিজেকে একজন র‍্যাশানালিস্ট বল। কোন যুক্তিতে এই লেখাগুলোকে আমাদেরই কারও অবচেতন মনের প্রতিফলন বলে স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছতে চাও তা একটু বলবে?”

আমি এবার মিহি সুরে আসল সত্যটি প্রকাশ করলাম, “ওই যে ছবিটা দেখছ, ওটি আমার মায়ের, নাম সুহাসিনী। কিন্তু তাঁর বিদেহী আত্মাকে টেনে আনতেই আমি নিশ্চিত হলাম, এই প্ল্যানচেটের পেছনে লোক ঠকানোর কোনও ব্যাপার না থাকলে, গোটাটাই ঘটছে অবচেতন মন থেকে। কারণ আমার মা জীবিত।“

আপনাদের অবগতির জন্য জানাই সেদিনের প্রেত-চক্রে উপস্থিত সকলেই প্ল্যানচেটের অস্তিত্বে বিশ্বাস হারিয়েছেন।

কয়েক মাস আগে আমার পরিচিত মিস্টার সিনহার (নামটা ঠিক মনে নেই) আহ্বানে তাঁরই এক বন্ধুর ভবানীপুরের বাড়িতে প্ল্যানচেটের আসরে গিয়েছিলাম। বরেণ্য সাহিত্যিক সন্তোষকুমার ঘোষের একটি ছবি মিডিয়ামদের সামনে রেখেছিলাম। আমি ছিলাম দর্শক। মিডিয়াম ছিলেন সিনহা ও তাঁর দুই বন্ধু। এখানেও একটা তিনকোনা প্ল্যানচেট-টেবিলকে একটা সাদা কাগজের ওপর চাপানো হয়েছিল। টেবিলের ফুটোয় গুঁজে দেওয়া হয়েছিল পেন্সিল।

কিছুক্ষণের মধ্যে পেন্সিলটিকে চলতে দেখে প্রশ্ন করলাম, “আপনি কে?”

উত্তরে লেখা হল, “সন্তোষ ঘোষ।“

আমি বললাম, “আপনি নিজের নাম ভুল লিখলেন কেন? আপনি কি সন্তোষ ঘোষ লিখতেন? যেমনভাবে নিজের নামের বানান লিখতেন, তেমনভাবে লিখুন।“

এবার লেখা হল, “সন্তোষকুমার ঘোষ।“

শ্রীসিনহাকে বললাম, “এই লেখাটা কিন্তু সন্তোষকুমার ঘোষের লেখা নয়। আপনারা গভীর বিশ্বাসের সঙ্গে জোর দিয়ে যা ভাবছেন, সেই ভাবনাকে রূপ দিতেই আপনারা নিজেদের অজ্ঞাতে প্ল্যানচেট-টেবিলের পেন্সিলকে দিয়ে তা লিখিয়ে নিচ্ছেন। সন্তোষদা তাঁর নামের বানান লিখতেন সন্তোষকুমার ঘোষ, অর্থাৎ সন্তোষ ও কুমার থাকত একসঙ্গে। আপনারা কিন্তু লিখেছেন আলাদা আলাদাভাবে দুটি পৃথক শব্দ হিসেবে, সন্তোষ, কুমার। ওঁর বানান লেখার পদ্ধতি জানতেন না বলেই আপনারা ভুল করছেন।

আমার এক বন্ধু তপন চৌধুরী থাকেন যাদবপুরে। একদিন খবর দিলেন, তাঁর কয়েকজন বন্ধু প্ল্যানচেট করে বিদেহী আত্মাদের নিয়ে আসছেন বলে দাবি করছেন। তপন তাঁর বন্ধুদের প্ল্যানচেটের ব্যাপারে আমার অবিশ্বাসের কথা বলায় ওই বন্ধুরা নাকি আমার দিকে প্ল্যানচেটকে মিথ্যে বা জালিয়াতি প্রমাণ করার চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছেন।

আমি চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছিলাম। বসেছিলাম, আমার পকেটে একটি কাগুজে টাকা থাকবে। সর্বত্রগামী, সূক্ষ্মদেহী, বিদেহী আত্মাদের সহায়তায় মিডিয়ামরা যদি আমার নোটটির নম্বর লিখে দিতে পারেন, তবে পচিশ হাজার টাকা ওদের দেব। হেরে গেলে পাঁচ হাজার টাকা ওদের দিতে হবে, রাজি আছেন কি?”

শেষ পর্যন্ত ওরা রাজি হননি। জানি, রাজি না হওয়াটাই স্বাভাবিক, কারণ পাঁচ হাজার টাকা তো কম নয়!

এক মার্কসবাদী খুদে নেতা তাঁর বাড়িতে এক প্ল্যানচেট-চক্রে আমাকে ও আমার বন্ধু শম্ভুনাথ চক্রবর্তীকে উপস্থিত থাকার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। খুদে নেতাটির দাদা সেই সময় ছিলেন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রভাবশালী সচিব। ঠিক হল চক্রে উপস্থিত থাকব আমি, শম্ভু এবং নেতা একটি বামপন্থী ইউনিয়নের কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত হলেও সাহিত্য ও সাহিত্য সৃষ্টিতে যথেষ্ট আগ্রহী।

চক্রে বসার দিন সময়ও ঠিক করে ফেললাম নেতা, আমি ও শম্ভু। শম্ভু সর্বজনশ্রদ্ধেয় এক সাহিত্যিকের নাম করে বললেন, “ওঁর আত্মাকে সেদিন নিয়ে আসতে হবে।“

নেতাটি তাঁর স্বভাবসিদ্ধ হাসিটি মুখের চারপাশে ছড়িয়ে বললেন, “ওকে অনেকবার আমরা এনেছি। কোনও প্রব্লেম নেই।“

শম্ভু এবার বললেন, ওঁর এক অবৈধ সন্তান ছিল। সন্তানটির নাম গবেষক ছাড়া কারওরই খুব একটা জানার কথা নয়। লেখকের আত্মা নিজের অবৈধ সন্তানটির নাম লিখে দিলেই আমি চুড়ান্তভাবে প্ল্যানচেটকে স্বীকার করে নেব।“

আমাদের সেই প্ল্যানচেটের আসর আজ পর্যন্ত বসেনি। সম্ভবত নেতাটি এখনও সাহিত্যিকের অবৈধ সন্তানটির নাম জেনে উঠতে পারেননি।

মাঝে মধ্যে প্ল্যানচেট-চক্র বসত প্রতিষ্ঠিত এক সঙ্গীতশিল্পীর বাড়িতে। শিল্পীর নামটি তাঁরই অনুরোধে এখানে উল্লেখ করলাম না। আমার বোঝাবার সুবিধের জন্যে ধরে নিলাম তাঁর নাম ‘সত্যবাবু’। ’৮৩-র মার্চের একদিন সত্যবাবুকে আমিই

বৃত্ত এঁকে প্ল্যানচেট করা হচ্ছে

ফোন করে জানালাম তাদের পরবর্তী চক্রে দর্শক হিসেবে উপস্থিত থাকতে চাই। তিনি সঙ্গে সঙ্গেই পরবর্তী চক্রের তারিখ ও সময় জানিয়ে দিলেন।

চক্র বসল রাত দশটা নাগাদ। উপস্থিত ছিলেন দু’জন মহিলা সমেত সাতজন, এঁদের মধ্যে চারজনেরই প্ল্যানচেট মিডিয়াম হওয়ার পূর্ব অভিজ্ঞতা আছে।

কার্পেট গুটিয়ে মেঝেতে ঘড়ির বৃত্ত আঁকা হল। বৃত্তের ভিতরে লেখা হল 1 2 3 4 5 6 7 8 9 0। বৃত্তের বাইরে লেখা A থেকে Z পর্যন্ত। নিয়ন নিভিয়ে জ্বেলে দেওয়া হল একটা মোটা মোম। বৃত্তের মাঝখানে বসানো হল একটা ধূপদানি। ধূপদানিতে তিনটে চন্দন ধূপ গুঁজে জ্বেলে দেওয়া হল। তিনজন মিডিয়াম বৃত্তের বাইরে বসে ডানহাতের তর্জনী দিয়ে ছুঁয়ে রইলেন ধূপদানিটা। একজন বসলেন একটা খাতা ও কলম নিয়ে, ধূপদানি যেই যেই অক্ষরে বা সংখ্যায় যাবে সেগুলো লিখে রাখবেন।

প্রথমেই ওরা যার ছবি সামনে রেখে আত্মাকে আহ্বান করেছিলেন, তিনি একজন সঙ্গীতজগতেরই খ্যাতিমান পুরুষ। আত্মা এলো, ধূপদানিটাও তৎপরতার সঙ্গে এক-একটি অক্ষরে ঘুরতে লাগল। একসময় আমাকে প্রশ্ন করতে অনুরোধ করলেন সঙ্গীতশিল্পী। বিদেহী আত্মাকে আমার পরিচয় দিলেন, আত্মার অস্তিত্বে অবিশ্বাসী হিসেবে।

বিদেহী আত্মা বললেন, “YOUR QU.”

অর্থাৎ, আমার প্রশ্ন কি?

বললাম, “আমার বুকপকেটে একটা এক টাকার নোট আছে, নোটটার নম্বর কত?”

ধূপদানিটা বার কয়েক এদিক ওদিক ঘুরে লিখল, “NONSENCE”।

পরবর্তী বিদেহী আত্মা হিসেবে আমি আমার মায়ের ছবি পেশ করেছিলাম, সঙ্গে নাম।

মায়ের বিদেহী আত্মাও কিন্তু উত্তর দিয়েছিলেন। মা জীবিত শোনার পর সেদিনের মতো প্ল্যানচেট-চক্রের বৈঠক ভেঙ্গে গিয়েছিল। আমি যতদূর জানি, সঙ্গীতশিল্পীর ঘরে আর কোনও দিন প্ল্যানচেট-চক্র বসেনি। ভুল করাটা বড় কথা নয়। ভুলটা বুঝতে পেরে নিজেকে সংশোধন করে নেওয়াটাই বড় কথা।

যুগে যুগে ধাপ্পাবাজেরা তাদের প্রচারের ও সাফল্যের চাবিকাঠি হিসেবে বিখ্যাত ব্যক্তিদেরই বেছে নিয়েছে। ওরা জানে মওকা বুঝে ঠিকমতো কৌশল অবলম্বন করতে পারলে মোটা বুদ্ধির চেয়ে সূক্ষ্মবুদ্ধির লোকেদের কব্জা করা অনেক বেশি সহজ।

প্রতিটি পাঠক-পাঠিকার কাছে একটি বিনীত অনুরোধ – যে ঘটনা আপনার অলৌকিক বলে মনে হচ্ছে, তার পেছনে রয়েছে আপনার অজানা কোনও কারণ, এই বিশ্বাস অনুসন্ধান করুন। প্রয়োজনে অপরের সাহায্য নিন। নিশ্চয়ই আপনার নেতৃত্বে অলৌকিকত্বের রহস্য উন্মোচিত হবে।

আপনার অনুসন্ধানে আমার কোনও সহযোগিতার প্রয়োজন হলে নির্দ্বিধায় আমার অথবা এই বইটির প্রকাশকের ঠিকানায় আমাকে জবাবী খামসহ চিঠি দিন বা যোগাযোগ করুন। নিশ্চয়ই সাধ্যমতো সব রকম সহযোগিতা করব।

error: Content is protected !!
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x