মানুষ হয়ে জন্ম নিয়ে আমি সুখী;– বেশ লাগে আমার; অন্য কোনো প্রাণী, এমন কি বস্তু, রঙিন প্রজাপতি বা সুন্দরবনের বাঘ বা শান্ত গরু বা নির্বিকার মোষ বা মাছ বা সাপ বা ছোট্ট পিঁপড়ে বা আমগাছ বা শিমুল বা ঘাস বা পাথরও যদি হতাম, তাহলেও খারাপ লাগতো না, বেশ লাগতো। আর যদি কখনোই জন্ম না নিতাম, কিছুই না হতাম, তাহলেও খারাপ লাগতো না। তখন আমি জানতামই না জন্ম আর পৃথিবী কাকে বলে, যেমন এসব আমি জানবো না যখন ম’রে যাবো। ম’রে যাওয়ার পর কখনোই জানবো না যে আমি জন্ম নিয়েছিলাম, পৃথিবীতে ছিলাম, আমার ভালো লাগতো ভোরের আকাশ, শ্রাবণের মেঘ, হেমন্ত, নদী বা নারী; কখনোই জানবো না আমি কবিতা পড়েছিলাম, এমনকি লিখেছিলামও, কেঁপে উঠেছিলাম কামনায়, অজস্র বার তৃপ্ত করেছিলাম আমার কামনা, এবং বহুবার পরিতৃপ্ত করতে পারি নি। জন্মের আগে যেমন শূন্য ছিলাম, ম’রে যাওয়ার পর আমার কাছে আমি সম্পূর্ণ শূন্য হয়ে যাবো। আমার সূচনার আগের অধ্যায় অন্ধকার, সমাপ্তির পরের পরিচ্ছদও অন্ধকার। দুই অন্ধকারের মধ্যে ক্ষণিক আলোর ঝিলিক আমি, এই ঝিলিকটুকু আমার ভালো লাগে। আমার আগের ও পরের অন্ধকার সম্পর্কে যে আমি জানি না, তা নয়; ওই অন্ধকারকে রহস্যময় ব’লে ভেবে আমি বিভোর নই, আমি জানি আমার আগে কী ছিলো, আমার পরে কী হবে। আমি জানি আমি কোনো মহাপরিকল্পনা নই, কোনো মহাপরিকল্পনার অংশ নই, আমাকে কেউ তার মহাপরিকল্পনা অনুসারে সৃষ্টি করে নি; একরাশ প্রাকৃতিক ক্রিয়ার ফলে আমি জন্মেছি, অন্য একরাশ প্রাকৃতিক ক্রিয়াকলাপের ফলে আমি ম’রে যাবো, থাকবো না; যেমন কেউ থাকবে না, কিছু থাকবে না। এ-সম্পর্কে সন্দেহ পোষণের কোনো কারণ আমি দেখি না।
বেঁচে আমি সুখ পাই; আমার ইন্দ্রিয়গুলো দিয়ে সুখ ঢোকে, আমাকে ভ’রে তোলে। সুখ আমার কাছে সামাজিক নয়, যদিও আমার সামাজিক অবস্থান আমাকে সহযোগিতা করে সুখী হতে, তবু সুখ আমার কাছে একান্তই ব্যক্তিগত; তার সাথে সমাজরাষ্ট্রসভ্যতার সম্পর্ক নেই; আমি আমার সুখগুলো প্রকৃতি ও প্রতিবেশ থেকে পুরোপুরি ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগ করি। আমার মাত্র পাঁচটি ইন্দ্রিয়, আমার মনে হয় আরো অনেকগুলো ইন্দ্রিয় থাকা উচিত ছিলো আমার; আমার ইন্দ্রিয়গুলোর থাকা উচিত ছিলো আরো শক্তি, আরো নিপুণতা; তাহলে আমি আরো নানা ধরনের সুখ আরো প্রবলভাবে পেতে পারতাম। আমি দেখতে পাই, যদিও দিন দিন আমার দেখার শক্তি কমছে; দেখতে পাওয়া আমার জন্যে একটি বড়ো সুখ। এক ভোরবেলা চারদিকে এমন ঘন কুয়াশা ছড়ানো দেখলাম, কুয়াশা এমনভাবে ঢেকে ফেললো আমাকে, আরেক ভোরে এমন অমল আলো দেখলাম, রোদ এমনভাবে রঞ্জিত করলো আমাকে যে সুখে শরীর ভ’রে গেলো; মনে হলো মাংসে কুয়াশা ঢুকছে, রক্তে রোদ ঢুকছে, আমি সুখী হচ্ছি। যা কিছু দেখি আমি, তাই আমার জন্যে সুখ। ছেলেবেলায় পুকুরে ঢেউ উঠতে দেখে, স্থির জলে কচুরি ফুল দেখে সুখ পেতাম, আজো পাই; আজ পৌষের শিশির দেখে সুখ পেলাম, শিশিরভেজা ঘাসের সবুজ দেখে সুখ পেলাম, কোমল রোদ দেখে সুখ পেলাম; আজ এতোগুলো বিস্ময়কে দেখলাম যে সুখে দেহ ভ’রে উঠলো। বলবো কি যে মন সুখে ভ’রে উঠলো? সামাজিক অনেক কিছুর দিকেই আমি চোখ দিই না, ওসব দেখে সুখ পাই না, নোংরা লাগে, চোখ অসুস্থ বোধ করে। আমার মগজ সামাজিক অধিকাংশ ব্যাপার দেখতে ঘেন্না বোধ করে, তাই ওগুলো পীড়া দেয় আমাকে; যেমন মন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতি দেখে আমি সুখ পাই না, সাধারণত ওসব দেখতে চাই না, ওঁরা যেখানে থাকেন আমি সাধারণত সেখানে যাই না, ক্ষমতা আমার কাছে অসুন্দর, এমনকি অশ্লীল; দোয়েলচড়ুই দেখে সুখ পাই, রাষ্ট্রপতির মুখের থেকে চড়ুইর মুখ অনেক সুন্দর; উলঙ্গ শিশুরা, ওদের পরার কিছু নেই, মাঘের শীতে পাতার আগুনের উম নিচ্ছে দেখে সুখ পাই; সুখ পেয়ে নিজেকে অপরাধী বোধ করি। আমার ইন্দ্রিয়গুলোর মধ্যে চোখ দুটিই শ্রেষ্ঠ; এ-দুটি দিয়ে আমি দূর থেকে ভেতরে টেনে আনি দৃশ্যের পর দৃশ্য, সৌন্দর্যের পর সৌন্দর্য। অন্য কোনো ইন্দ্রিয় দিয়ে এভাবে টানতে পারি না বাইরকে। ছেলেবেলায় পদ্মার পারে, সূর্যাস্তের আগে, দাঁড়িয়ে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। পদ্মার পশ্চিম প্রান্তে যে-লাল গলতে দেখেছিলাম, তার ঢেউ আজো দেখতে পাই; ওই লাল আমার চোখে লেগে আছে, যে-লাল আমি পরে মুহূর্তের জন্যে দেখেছিলাম মেরেলিন মনরোর ঠোঁটে, ওই ঠোঁটও আমি দেখতে পাই।
গন্ধ আমাকে সুখী করে, এলোমেলো করে, কখনো ভারী, কখনো হাল্কা করে; দৃশ্যের থেকেও, অনেক সময়, গন্ধ আমাকে বেশি আলোড়িত করে। গন্ধ অনেক বেশি গভীরে ঢোকে দৃশ্যের থেকে, এবং দেয় সংস্পর্শের বোধ। চোখ দূরকে ভেতরে টেনে আনলেও দূরত্ব ঘোচাতে পারে না; নাক দূরকে টেনে আনতে পারে না ভেতরে, টেনে আনে যা কিছু আমাদের সংলগ্ন; তাই নাক দিয়ে নিই সংলগ্নতার স্বাদ। শুধু সুগন্ধ নয়, যেসব গন্ধ খুব ভদ্র নয়, সাধারণত আমরা পেতে চাই না, সেগুলোতেও আমি সুখ পাই। অজানা ফুলের গন্ধে, সাথে কেউ না থাকলে, যেমন হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ি, তাকাই, তেমনি দাঁড়িয়ে পড়ি, তাকাই, পচানো পাটের অবর্ণনীয় অভদ্র গন্ধে, আমার ভেতরে একটা প্রচণ্ড এলোমেলো অবস্থা ঘটে, ভেতরটি ভারী হয়ে ওঠে, আমি সুখ পাই। বেশি সুগন্ধ বা দুর্গন্ধ আমি সহ্য করতে পারি না; বেশি সুগন্ধে ও দুর্গন্ধে অসুস্থ হয়ে পড়ি। আমার জগত গন্ধেরও জগত, সেটি যেমন ভ’রে আছে শিউলির সুগন্ধে, তেমনি ধানের, বা ঘাসের, বা কারো শরীরের গন্ধে, এবং কোনো কোনো কবিতা থেকে ছড়িয়ে পড়া গন্ধে। দৃশ্যের জগতের মতো বিশাল নয় গন্ধের জগত, এ-ইন্দ্রিয়টি বেশি দূরকে আমার ভেতরে টেনে আনতে পারে না; কিন্তু আমি বেঁচে থেকে যে-সুখ পেয়েছি, তার অনেকটা সংগ্রহ করেছে এ-ইন্দ্রিয়টি। ..
কান সুখী করেছে আমাকে বিপুলভাবে; এটি পৃথিবীকে ধ্বনিরূপে ঢুকিয়েছে আমার ভেতরে, আমার অভ্যন্তরকে ক’রে তুলেছে ধ্বনিময়, ভেতরে সব সময়ই ধ্বনির গুঞ্জন চলছে। নিঃশব্দতাই আমি বেশি পছন্দ করি আজকাল, সুখ পাই স্বরকোলাহল থেকে দূরে থাকতে পারলে, যদিও তা অসম্ভব হয়ে উঠেছে, কেননা পৃথিবী আজকাল উচ্চ কৃত্রিম ধ্বনি দ্বারা বড়ো বেশি আক্রান্ত; কিন্তু স্বরমালা যে বাল্যকাল থেকে সুখী করে আসছে আমাকে, কোনো কোনো স্বরে আমি আজো সুখে কেঁপে উঠি, তা অস্বীকার করতে পারি না। সুখ পাই আমি প্রাকৃতিক শব্দে, দোয়েলের নিম্নস্বর বা বজ্রের প্রচণ্ড গর্জনে, গাভীর ডাকে, বৃষ্টির শব্দে, জলের প্রবাহে; বাঁশি বা বেহালার হাহাকারও সুখী করে আমাকে। একটি জলপ্রবাহের শব্দ আমি আজো শুনতে পাই। ঘুম থেকে জেগে এক বন্ধু আর আমি দেখতে পাই বর্ষা এসে গেছে, থইথই চারদিক, প্রচণ্ড শব্দে সরু নালা দিয়ে জল ঢুকছে পশ্চিম পুকুরে; আমরা দুজন ওই জলপ্রবাহে সারা সকাল ভ’রে ঝাঁপিয়ে পড়তে আর ভেসে যেতে থাকি, আবার ঝাঁপিয়ে পড়তে থাকি। ওই শব্দ আজো আমাকে সুখ দেয়। মানুষের স্বর দিন দিন আবেদন হারিয়ে ফেলছে আমার কাছে, মানুষের বাচালতা এতো পীড়া দিচ্ছে যে মানুষ দেখলে আমি বধির হয়ে যেতে চাই; তবু ভুলতে পারি না যে আমার জন্যে সুখকর কিছু ধ্বনি উঠে এসেছিলো মানুষের কণ্ঠ থেকেই, হয়তো ভবিষ্যতেও আসবে।
শিশুর প্রধান ইন্দ্রিয় জিভ, পৃথিবীকে সে পরখ করতে চায় সম্ভবত জিভ দিয়ে, তাই মুঠোর কাছে যা পায় তাই মুখে দিয়ে দেখে, স্বাদ নেয় পৃথিবীর; তার কাছে সমান সুস্বাদু আবর্জনা আর আগুন। যখন শিশু ছিলাম, কিশোর হয়ে উঠেছি যখন, তখনও আমি সব কিছু চুষে দেখতে চেয়েছি; আজো অনেক কিছু চুষে আর চেখে দেখতে ইচ্ছে করে। ছেলেবেলা ভ’রে ইচ্ছে হতো চুলোর লাল আগুনের টুকরোগুলোকে চুষে দেখতে, ওগুলো লাল গোলাপের থেকেও লাল হয়ে জ্বলজ্বল করতো, সূর্যাস্তকেও চুষে স্বাদ নিতে ইচ্ছে হতো; কয়েক বছর আগে সারা সন্ধ্যা চুষতে চিবুতে ইচ্ছে হয়েছিলো চুয়িংগামের মতো এক তরুণীকে। চারপাশে ছড়িয়ে আছে যে-জগত, তার স্বাদ আছে, টক মিষ্টি ঝাল তেতো বিষাক্ত স্বাদ; আমি তার স্বাদ নিয়ে সুখী হয়েছি। শুধু মিষ্টি স্বাদ নয়, সব স্বাদই সুখকর, যদিও সব স্বাদ সমানভাবে সহ্য করতে পারি না; কিন্তু স্বাদের জগত আমাকে সুখী করে।
ছোঁয়া সবচেয়ে অন্তরঙ্গ অনুভূতি; আমাদের শরীর ছোঁয়া চায়, আমরা ছুঁতে চাই; আমিও ছুঁতে চেয়েছি, ছোঁয়া চেয়েছি, এবং ছোঁয়া পেয়ে ও ছুঁয়ে সুখী হয়েছি। আমার ত্বক সুখী হয়েছে অজস্র ধরনের ছোঁয়ায়; আমি যতো ছুঁতে চেয়েছি, তার চেয়ে বেশি ছোঁয়া চেয়েছি; ছোঁয়া অনেকটা শান্ত পুকুরে ছোঁড়া ঢিলের মতো, ছোঁয়া পেলে আমার ত্বক জলের মতো কেঁপে ওঠে, চারদিকে ঢেউ খেলে যায়, ঢেউ কেঁপে কেঁপে দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে। আমি সাধারণত ছুঁয়েছি হাত দিয়ে, কিন্তু আমি ছোঁয়া চেয়েছি সারা শরীরে; এবং দুটি বস্তুই সম্ভবত আমাকে ছুঁয়েছে সারা শরীরে– একটি জল, আরেকটি বায়ু। জলের ছোঁয়ার তুলনা হয় না। ছেলেবেলায় পুকুরে নেমে যে উঠতে চাই নি, মাঘের ভোরেও লাফিয়ে পড়েছি জলে, কেননা জলই শুধু আমাকে সারা শরীরে নিবিড়ভাবে ছুঁয়েছে। বাতাসের সাথে জলের পার্থক্য হচ্ছে বাতাস তার ছোঁয়া বুঝতে দেয় না, ত্বকে হাল্কা ছোঁয়া দিয়েই চ’লে যায় বা স্থির থাকে, কিন্তু জল নিবিড়ভাবে আবৃত ক’রে রাখে। জল কামনাময়। আমি ছুঁয়ে সুখ পেয়েছি। আকাশ আর আগুন ছুঁয়ে ফেলেছি কতোবার; ঘাস দেখলে এখনো ছুঁতে ইচ্ছে করে, পশু দেখলে ছুঁতে ইচ্ছে করে, কোনো কোনো নারী দেখলে ছুঁতে ইচ্ছে করে, কিন্তু ছুঁই না; সব কিছু ছোঁয়া অনুমোদিত নয়। ওষ্ঠ দিয়ে ছোঁয়া নিবিড়তম ছোঁয়া, আমি যা কিছু ওষ্ঠ দিয়ে ছুঁয়েছি, তারাই আমাকে সুখী করেছে সবচেয়ে বেশি। আমাদের সমাজে ছোঁয়া খুবই নিষিদ্ধ ব্যাপার; আমরা খুব কম মানুষকেই ছুঁতে পারি, খুব কম মানুষকেই ছোঁয়ার অধিকার আছে আমাদের। ছোঁয়া এখানে পাপ; কোনো নারী যদি কোনো পুরুষকে ছোঁয়, কোনো পুরুষ যদি কোনো নারীকে ছোঁয়, তাতে সূর্য খ’সে পড়ে না, আকাশে হুলস্থুল শুরু হয়ে যায় না; কিন্তু আমরা মনে করি মহাজগত তাতে খেপে উঠছে। শরীর খুবই আপত্তিকর আমাদের কাছে, একে অজস্র পাপের উৎস ভেবে আমরা ভয় পাই; পবিত্র বইগুলো সব সময় মনে করিয়ে দেয় যে আমরা পাপী, তাই আমাদের সুখ নয়, শাস্তি প্রাপ্য। কিন্তু আমি ছুঁয়েছি, ছোঁয়া পেয়েছি, তাতে চাঁদতারা খ’সে পড়ে নি। ছুঁয়ে ও ছোঁয়া পেয়ে আমি যে-সুখ পেয়েছি, তা আর কিছুতে পাই নি।
ইন্দ্রিয়গুলো, আমার মোহন ইন্দ্রিয়গুলো, সুখী করে আমাকে; কিন্তু আমি শুধু এগুলোর সুখেই সীমাবদ্ধ থাকি নি। আমি পাঁচ ইন্দ্রিয়ের সুখ থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখতে পারি, সরিয়ে রেখে সুখ পাই, খুবই ভিন্ন রকমের সুখ; পাঁচ ইন্দ্রিয়ের টসটসে সুখের থেকে খুবই ভিন্ন ধরনের সুখ পাই আমি আরেক জগতে, নিরিন্দ্রিয় ওই জগতকে, অন্য কোনো ভালো নামের অভাবে, বলতে পারি কল্পনা ও চিন্তার জগত। ইচ্ছে করলে আমি বাস্তব কাজ করতে পারি, এটা কঠিন নয় আমার জন্যে; কতো তুচ্ছ মানুষ পৃথিবীতে, বিশেষ ক’রে বাঙলাদেশে, কতো উচ্চ উচ্চ বাস্তব কাজ করছে, সমাজরাষ্ট্র ভাঙছে, গড়ছে, রাষ্ট্রকে চিৎ করছে, সমাজকে উপুড় করছে, কাৎ করছে, গর্ভবতী করছে, প্রচণ্ড বাস্তব কাজ ক’রে অমর হচ্ছে, আমি তার দু-একটি করতে পারতাম না তা নয়; তবে আমার মনে হয় সব কাজের মধ্যে সহজ হচ্ছে বাস্তব কাজ, আর কঠিন অবাস্তব কাজ। বছরের পর বছর ধ’রে আমরা যুদ্ধ করতে পারি, কিন্তু কারো পক্ষে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধ’রে স্বপ্ন দেখা সম্ভব নয়। আজ দল বেঁধে নেমে সারা শহর পুড়িয়ে দিতে পারি, অতোটা নিষ্ঠুর না হয়ে শহরকে সারাদিন ধ’রে বিকল ক’রে রাখতে পারি, কিন্তু আমরা দল বেঁধে এক হাজার উৎকৃষ্ট কবিতা লিখে উঠতে পারি না। কবিতার কথা ছেড়েই দিই, রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীকে গরু সম্পর্কে একটি রচনা লিখতে দিলে তাঁরা হয়তো তা লিখে উঠতে পারবেন না, কিন্তু হেলিকপ্টারে সারা দেশ ঘুরে দশখানা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করতে পারবেন।
রাষ্ট্রের কাছে কবিতার কোনো মূল্য নেই- রাষ্ট্র কোথাও কবির জন্যে কোনো পদ রাখে না, কিন্তু দশতলা দালান খুবই মূল্যবান; তবে একটি দশতলা দালানের মালিক হওয়ার থেকে অনেক কঠিন ‘অবসরের গান’ লেখা। জীবনানন্দ অবশ্য ওই কবিতাটির বদলে একটি একতলা দালান বানাতে পারলে ট্রামলাইনের পাশে একটু সাবধানে হাঁটতেন। তবে জীবনানন্দ ছাড়া কেউ ওই কবিতাটি লিখতে পারতেন না; দশতলার মালিক অনেকেই হ’তে পারেন, যাঁদের ঠিক যোগাযোগটি আছে, কিন্তু কোনো যোগাযোগের ফলেই ওটি লেখা সম্ভব নয়। কে মূল্যবান– জীবনানন্দ না রাষ্ট্রপতি? আমি আনন্দ পাই কল্পনায় এবং চিন্তায়; কল্পনা ও চিন্তায় আমি জীবনের বড়ো অংশ ব্যয় করেছি- আনন্দে। আমি দশতলা আর পাজেরো করতে পারতাম, ফুলের মালায় নিজের গলদেশও ভ’রে তুলে অমর হ’তে পারতাম; আমি কি পারতাম না?- কিন্তু ওইসব আমাকে আনন্দ দেয় না, আনন্দ পাই আমি কল্পনা ও চিন্তায়, যাতে সমাজরাষ্ট্রের কোনো দরকার নেই। এই আনন্দ ইন্দ্রিয়ের সুখের থেকে অনেক ভিন্ন, উৎকৃষ্টও হয়তো, কিন্তু তা আমি বলতে চাই না, আমার ইন্দ্রিয়গুলোকে আমি কখনোই নিন্দিত করতে চাই না। ইন্দ্রিয়গুলোকে আমি ভালোবাসি, যেমন ভালোবাসি আমার মগজকে, যা আমি দেখি নি, যার ক্রিয়াকলাপ বুঝি না আমি, যা আমার কাছে কিংবদন্তির মতো।
তবে সব কিছুই নিরর্থক, জগত পরিপূর্ণ নিরর্থকতায়; রবীন্দ্রনাথও নিরর্থক, আইস্টাইনও নিরর্থক; ওই গোলাপও নিরর্থক, ভোরের শিশিরও নিরর্থক; তরুণীর চুম্বন ও নিরর্থক, দীর্ঘ সুখকর সঙ্গমও নিরর্থক, রাষ্ট্রপতিও নিরর্থক। কেননা সব কিছুরই পরিণতি বিনাশ। বিস্ময়কর বিশ্ব, রঙিন ফুল বা মানুষ বা বন্যশুয়োর, সূর্য বা নক্ষত্র, গ্রহউপগ্রহ সব কিছুর জন্যেই অপেক্ষা ক’রে আছে তাদের পরিণতি- বিনাশ, যার থেকে কোনো উদ্ধার নেই। এ-মহানিরর্থকতায় ভয় পেয়ে কতোগুলো শিশুতোষ রূপকথা তৈরি করতে পারি আমরা, যেমন তৈরি করেছি ধর্মের রূপকথা, তৈরি করেছি স্রষ্টা, পাপ, পুণ্য, স্বর্গ আর নরক। এ হচ্ছে তাৎপর্যহীন জীবনকে তাৎপর্যপূর্ণ করার স্থূলতম প্রয়াস। জীবনের তাৎপর্যহীনতা ভাবুক মানুষকে পাগল ক’রে তুলতে পারে, তাই বিচিত্র ধরনের ভাবুক চেষ্টা করেছে একে বিচিত্ররূপে তাৎপর্যপূর্ণ ক’রে তুলতে; ধর্ম একে তাৎপর্যপূর্ণ করতে চেয়েছে সবচেয়ে নিকৃষ্টরূপে, এবং একে আরো নিরর্থক ক’রে তুলেছে। এই যে আমি বেঁচে আছি, বেঁচে থেকে সুখ পাচ্ছি, আমি ম’রে যাবো, এই হাস্যকর নিরর্থকতাকে কীভাবে অর্থপূর্ণ ক’রে তুলতে পারি আমি? আমার জীবনকে অর্থপূর্ণ ক’রে তোলার কোনো পূর্বনির্ধারিত উপায় নেই, কোনো পবিত্র বা অপবিত্র বই বা কোনো মহাপুরুষ বা প্রবর্তক আমাকে পথ দেখাতে পারেন না। তাঁরা খুঁজেছেন নিজেদের পথ, নিজেদের জীবনকে তাৎপর্যপূর্ণ করার পথ; আমি তাঁদের পথে চলতে পারি না, আমি খুঁজতে চাই আমার পথ, নিজের জীবনকে তাৎপর্যপূর্ণ করার দায়িত্ব সম্পূর্ণরূপে আমার নিজের। বেশ আগে একটি কবিতা লিখেছিলাম, নাম ‘ব্যাধিকে রূপান্তরিত করছি মুক্তোয়’। কবিতাটির কথা আমার মনে পড়ে; কবিতাটি একবার পড়তে চাই :
একপাশে শূন্যতার খোলা, অন্য পাশে মৃত্যুর ঢাকনা,
প’ড়ে আছে কালো জলে নিরর্থ ঝিনুক।
অন্ধ ঝিনুকের মধ্যে অনিচ্ছায় ঢুকে গেছি রক্তমাংসময়
আপাদমস্তক বন্দী ব্যাধিবীজ। তাৎপর্য নেই কোনো দিকে-
না জলে না দেয়ালে- তাৎপর্যহীন অভ্যন্তরে ক্রমশ উঠছি বেড়ে
শোণিতপ্লাবিত ব্যাধি। কখনো হল্লা ক’রে হাঙ্গরকুমিরসহ
ঠেলে আসে হলদে পুঁজ, ছুটে আসে মরা রক্তের তুফান।
আকস্মিক অগ্নি ঢেলে ধেয়ে আসে কালো বজ্ৰপাত।
যেহেতু কিছুই নেই করণীয় ব্যাধিরূপে বেড়ে ওঠা ছাড়া,
নিজেকে– ব্যাধিকে– যাদুরসায়নে রূপান্তরিত করছি শিল্পে-
একরত্তি নিটোল মুক্তোয়!
ঝিনুক ও মুক্তোর রূপকে জীবনের তাৎপর্যশূন্যতার মর্মান্তিক সৌন্দর্য উপস্থাপন করতে চেয়েছিলাম কবিতাটিতে। মুক্তো সুন্দর, প্রিয়, মূল্যবান; কিন্তু ঝিনুকের জন্যে তা ব্যাধি, ঝিনুক তার ব্যাধিকে এমন রূপ দেয় যা মানুষের কাছে মুক্তো। এই মহাজগত এক বিশাল ঝিনুক, যার দুটি ঢাকনার একটি শূন্যতা, অন্যটি মৃত্যু; কোথাও কোনো তাৎপর্য নেই; ওই ঝিনুকের মধ্যে রোগবীজাণুর মতো ঢুকে গেছি আমি। আমরা সবাই। আমি কী করতে পারি ওই নিরর্থক শূন্যতায়? পারি শুধু ব্যাধিরূপে বেড়ে উঠতে, ব্যাধিতে বিশ্ব ভ’রে দিতে; কিন্তু আমি তা করছি না, ব্যাধিকে ঝিনুকের ব্যাধির মতো রূপান্তরিত করছি শিল্পকলায়। এ হচ্ছে চূড়ান্ত অর্থহীনতাকে অর্থপূর্ণ করার এক সুন্দর ব্যর্থ করুণ প্রয়াস।
এ-প্রয়াস সুন্দর, কিন্তু ব্যর্থ; এতে কি তাৎপর্যমণ্ডিত হয়ে ওঠে জীবন? মনে পড়ে আলবেয়ার কামু ও তাঁর অ্যাবসার্ড বা নিরর্থকতাকে। আমি পুরাণ থেকে অনেক দূরে, পৌরাণিক উপাখ্যান ও চরিত্রগুলো আমার ভেতর ঢোকে না, পুরাণ আমার কাছে আদিম বিশ্বাস মনে হয় ব’লেই হয়তো, কিন্তু কামু বেছে নিয়েছিলেন গ্রিসীয় পুরাণের সিসিফাসকে। রাজা সিসিফাস মানুষ, নিয়তিদণ্ডিত, কিন্তু সে নিয়তিকে মানতে রাজি হয় নি, দাঁড়াতে চেয়েছে মূর্খ বর্বর অন্ধ অসুন্দর নিয়তির মুখোমুখি। স্বৈরাচারী দেবতাদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে সে চায় নি; কিন্তু দেবতারা নিষ্ঠুর শক্তিধর প্রতিশোধস্পৃহ, তারা সিসিফাসকে বাধ্য করে একটি বিশাল পাথরখণ্ডকে ঠেলে ঠেলে পাহাড়ের চুড়োয় উঠোতে, কিন্তু উঠোনোর পরেই ওই পাথর গড়িয়ে পড়ে পাহাড়ের পাদদেশে, আবার সেটি ঠেলে ঠেলে উঠোতে হয় সিসিফাসকে। অনন্তকাল ধ’রে সে এই নিরর্থক পীড়াদায়ক দণ্ডে দণ্ডিত। একই ক্লান্তিকর কাজ সে ক’রে চলে চিরকাল, তার জীবন একই নিরর্থক পুনরাবৃত্তির সমষ্টি। আমরা এই নিরর্থক পুনরাবৃত্তি থেকে একটুও এগোই নি, কামু বলেছেন, আমাদের জীবন একই রোববারের পর সোমবার, সোমবারের পর মঙ্গলবার, মঙ্গলবারের পর বুধবারের, একই নিরর্থকতার পুনরাবৃত্তি। এই নিরর্থকতার মুখোমুখি কীভাবে দাঁড়াতে পারি? কামুর মতে একটিই সত্যিকার দার্শনিক সমস্যা রয়েছে, তা হচ্ছে আত্মহত্যা। জীবনের এই মহানিরর্থকতায় মানুষ একটি কাজই করতে পারে, তা হচ্ছে আত্মহত্যা। জীবন কি যাপন করার উপযুক্ত? বেঁচে থাকার কি কোনো মানে হয়? কোনো অর্থ কি আছে ‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’ লেখার, ঝ মহাকাশে নভোযান পাঠানোর, বা নারীর নগ্ন স্তনে চুম্বনের, বা জন্মদানের?
বহু মানুষ বিশ্বাস করে বিধাতায়, পোষণ করে ধর্মীয় বিশ্বাস; তবে বিধাতা বা ধর্মীয় বিশ্বাস, যা মানুষের আদিম কল্পনার ফল, তা কোনো সাহায্য করতে পারে না, তাৎপর্যপূর্ণ ক’রে তুলতে পারে না জীবনকে; বরং জীবনকে ক’রে তোলে মিথ্যায় পূর্ণ। নির্বোধ/অন্ধ/ লোভী/কপট/ভীতরাই শুধু তাতে শান্তি পেতে পারে, ভাবতে পারে নিজেদের জীবনকে অর্থপূর্ণ ব’লে, কেননা পরলোকে তাদের জন্যে অপেক্ষা করছে একটি দুর্দান্ত কামনাঘন বিলাসপূর্ণ জীবন; কিন্তু তা হাস্যকর। বিধাতা বা ধর্মের কাছে হাত পাততে পারি না আমরা, যদিও এগুলো প্রচণ্ডভাবে চলছে, তবে ওগুলোর প্রতারণার সময় শেষ হয়ে গেছে; ওগুলো মানুষকে কিছু দেয় নি, কিছু দিতে পারে না, বরং তার জীবনকে ক’রে তুলেছে আরো নিরর্থক। কামুর ধারণা আমরা বাস করি অ্যাবসার্ড বা নিরর্থকতার কালে; ওই নিরর্থকতা আমাদের আক্রমণ করতে পারে যে-কোনো মুহূর্তে, রাস্তার যে-কোনো মোড়ে, যে-কোনো গলিতে; তখন নিজের কাছে নিজেকেই মনে হয় অচেনা, বহিরস্থিত। মানুষের প্রশ্নের শেষ নেই, হাজার হাজার প্রশ্ন তার, সেগুলোর কোনো উত্তর নেই; মানুষ চায় সমাধান, কিন্তু সমাধান চাইতে গিয়েই মানুষ জাগিয়ে তোলে নিরর্থকতা। মানুষ যখন জীবনের অর্থ খুঁজতে চায়, বুঝতে চায় জীবনের অর্থ কী, তখন সে মুখোমুখি হয় নিরর্থকতার। জীবনের কোনো অর্থ নেই, কোনো মহৎ উদ্দেশ্য নেই; সুধীন্দ্রনাথ যেমন বলেছেন, তার সারকথা পিশাচের উপজীব্য হওয়া।
মানুষ অভিনয় ক’রে যেতে থাকে, কিন্তু একদিন মঞ্চ ভেঙে পড়ে। জীবনের ক্লান্তিকর পুনরাবৃত্তির চমৎকার বর্ণনা দিয়েছেন কামু এভাবে : ‘জাগরণ, গাড়ি, চার ঘণ্টা কাজ, আহার, নিদ্রা, এবং সোমবার, মঙ্গলবার, বুধবার, বৃহস্পতিবার, শুক্রবার, এবং শনিবার একই তালে পুনরাবৃত্ত– এই পথেই চলা অধিকাংশ সময়। কিন্তু একদিন দেখা দেয় ‘কেনো’।’ তখন সব কিছু মনে হ’তে থাকে অ্যাবসার্ড, নিরর্থক। এই নিরর্থকতার উদ্ভব ঘটে আমাদের চৈতন্য ও বিশ্বের মধ্যে যখন ঘটে সংঘর্ষ। মানুষ, কামু মনে করেন, এই নিরর্থকতাকে এড়াতে পারে না যতোদিন সে বেঁচে থাকে; তাই, তাঁর মতে, অস্তিত্ব হচ্ছে ‘চূড়ান্ত আশাহীনতা’। মানুষ এই নিরর্থকতাকে অতিক্রম করার কোনো উপায় দেখে না, কেননা বেঁচে থাকাই হচ্ছে নিরর্থকতা। সুধীন্দ্রনাথ এ-পরিস্থিতির কথাই বলেছিলেন ‘মৃত্যু কেবল মৃত্যুই ধ্রুবসখা/যাতনা কেবল যাতনা সুচির সাথী’র হাহাকারে। এই নিরর্থকতা থেকে মুক্তির এক উপায় মৃত্যু; মৃত্যু পারে নিরর্থকতার সমাপ্তি ঘটাতে। তাই আত্মহত্যা একটি উপায় নিরর্থকতা থেকে মুক্তির। তাহলে কি আমরা আত্মহত্যা করবো? কামু, এবং সবাই, বলবেন, না; আত্মহত্যা কোনো সমাধান নয়, আত্মহত্যা ক’রে নিরর্থক জীবনকে তাৎপর্যপূর্ণ করা সম্ভব নয়। তবে প্রত্যেক মানুষের জীবনেই কোনো কোনো মুহূর্ত আসে, যা তাকে আত্মহত্যা করার প্ররোচনা দেয়; কিন্তু সবাই আত্মহত্যা করে না, শুধু তারাই আত্মহত্যা করে বা সফল হয় আত্মহত্যায়, যারা হঠাৎ জেগে ওঠা নিরর্থকতার প্ররোচনা কাটাতে পারে না, যেমন পারে নি জীবনানন্দের ‘আট বছর আগের একদিন’-এর তরুণ, যার জানালার পাশে দাঁড়িয়েছিলো উটের গ্রীবার মতো এক নিস্তব্ধতা। আমি কয়েকবার আত্মহত্যাকে সমাধান হিশেবে বিবেচনা করেছি, এবং বাতিল করেছি; একবার একটি কবিতা লিখেছি ‘ছাদআরোহীর কাসিদা’ নামে। রবীন্দ্রনাথ কি কখনো আত্মহত্যার কথা ভেবেছেন? অবশ্যই ভেবেছেন; তাঁর প্রথম দিকের কাব্যগুলোতে এর নানা দাগ দেখতে পাই। আত্মহত্যা কোনো সমাধান নয়, এটা একটি আস্তিত্বিক পাপ। মানুষ তার নিজের ইচ্ছায় মরবে না, বেছে নেবে না স্বেচ্ছামৃত্যু; মানুষকে মরতে হবে মিটমাট না ক’রে। জীবন, আমাদের সুন্দর জীবন, তার কোনো অর্থ নেই, অর্থের দরকার নেই; জীবনের অর্থ হচ্ছে জীবন, জীবনের অন্য অর্থ নেই ব’লেই জীবন সুন্দর। কোনো পূর্বনির্ধারিত পথ নেই মানুষের জন্যে; কোনো গ্রন্থ পথ দেখাতে পারে না তাকে, কোনো মহাপুরুষ বা প্রবর্তক তার জন্যে পথ প্রস্তুত করতে পারেন না; ওই মহাপুরুষেরা তৈরি করেছেন নিজেদের পথ, অন্যদের নয়। প্রত্যেককে খুঁজে বের করতে হয় নিজের পথ, তৈরি করতে হয় নিজের রাস্তা। অনেকের পথ আমাকে আলোড়িত করেছে, অনেক গ্রন্থ আমাকে আলো দিয়েছে; কিন্তু আমি ওইসব পথে চলি নি, ওই আলোতে পথ দেখি নি।
আশা। আমরা কি আশা করবো? আশা খুব প্রশংসিত, আশার প্রশংসায় পৃথিবী পঞ্চমুখ, কিন্তু আশার কিছু নেই পৃথিবীতে, আশা করার স্থান নয় জীবন। স্থূল জীবন যাপনের জন্যে স্থূল ছোটো ছোটো আশা আমরা ক’রে থাকি, ভুলে থাকি জীবনের বিশাল আশাহীনতাকে; কিন্তু যদি আশা করি যে জীবনের নিরর্থকতাকে অতিক্রম করতে পারবো, তাহলে জীবনকে অর্থপূর্ণ ক’রে তুলি না, বরং আত্মহত্যা করি দার্শনিকভাবে। আশার প্রলোভনে ভুললে কারো পক্ষে সৎ থাকা সম্ভব নয়, তখন সে পরিবৃত হয় মিথ্যে দিয়ে। কামুর অ্যাবসার্ড নায়ক সিসিফাসের মতো আমরাও ঘেন্না করি মৃত্যুকে, ভালোবাসি জীবনকে; এবং তার মতো আমরাও দণ্ডিত। তবে যতোই ঘেন্না করি মৃত্যুকে আর ভালোবাসি জীবনকে, মৃত্যুকেই বরণ করতে হবে অবশেষে, তার কাছেই আত্মসমর্পণ করতেই হবে। মৃত্যু ছাড়া আর কিছু সম্পর্কেই আমরা নিশ্চিত নই। আমরা ভয় পাই ওই চরম অন্ধকারকে; রবীন্দ্রনাথকে মনে পড়ে, যখন রোম্যান্টিকের চোখে দেখেছেন তখন প্রেমে পড়েছেন মৃত্যুর, কিন্তু বুড়ো বয়সে যখন সত্যিই মৃত্যু হানা দিতে থাকে তিনি ভয় পেতে থাকেন, তাঁর কবিতা মৃত্যুর ভয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ে। সিসিফাস নিয়তিকে মেনে নেয় শুধু নিয়তিকে অস্বীকার করার জন্যে, সে কখনো অসৎ নয়; সততা দিয়ে সে একরকমে তাৎপর্যপূর্ণ ক’রে তোলে তার জীবনকে। ওই তাৎপর্য নিরর্থকতাকে লুপ্ত করতে পারে না, তবে অস্বীকার করে তার কাছে আত্মসমর্পণ করতে। আমরা নিরর্থকতার মধ্যে বন্দী হয়ে আছি, কিন্তু তা মেনে না নিয়ে, আপন পথ খুঁজে, পথ তৈরি ক’রে সার্থক করতে পারি নিজেদের। কোনো সার্থকতাই অবশ্য সার্থকতা নয়, সব কিছুই পরিশেষে নিরর্থক; অর্থপূর্ণ শুধু দুই অন্ধকারের মাঝখানের হঠাৎ ঝলকানিটুকু।
“নির্বাচিত প্রবন্ধ” উপন্যাস বা প্রবন্ধ সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ
♦ মধ্যাহ্নের অলস গায়কঃ রোম্যান্টিক বহিরস্থিত রবীন্দ্রনাথ
♦ পাকিস্থানবাদী সাহিত্যতত্ত্বঃ প্রতিক্রিয়াশীলতার বিষবৃক্ষ
♦ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রধান কবিতাঃ অবতরণিকা
♦ বাংলা গদ্যচর্চা ও বিদ্যাসাগর
♦ মেরিওলস্টোনক্র্যাফটঃ অগ্নিশিখা ও অশ্রুবিন্দু
♦ নামপরিচয়হীন যে-কোন একজন নিহত মুক্তিযোদ্ধার কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা
♦ শহীদ মিনারঃ কাফনে মোড়া অশ্রুবিন্দু
♦ নারীবাদী সাহিত্যতত্ত্ব ও সমালোচনা
♦ নারীদের নারীরাঃ নারীদের উপন্যাসে নারীভাবমূর্তি
♦ বাঙ্গালীঃ একটি রূগ্ন জনগোষ্ঠি
♦ মাইকেল মধুসূদনঃ প্রথম বিশ্বভিখারি ও ত্রাতা