আমাদের ওপরে আকাশ- নীল হয়ে ছড়িয়ে আছে আকাশে আকাশে; আবার কখনো মেঘে ঢাকা, কখনো সেখানে জ্বলে সোনার ঝিলিক, কখনো রুপোর; ভোরে সূর্য ওঠে, সন্ধ্যায় ওঠে চাঁদ, আর আকাশে ঝিকমিক করে আলোর ফোঁটার মতো রুপোর ফুলের মতো তারা। আকাশের দিকে তাকিয়ে মানুষ বিস্মিত হয়েছে, আজো বিস্মিত হই আমরা। আকাশকে আমাদের কখনো মনে হয়েছে ছাদের মতো, কখনো মনে হয়েছে উল্টোনো নীল পেয়ালার মতো, কখনো মনে হয়েছে গম্বুজ। আকাশকে আমরা বুঝে উঠি নি হাজার হাজার বছর। আকাশের দিকে তাকালে মনে হয় একটি বিশাল গোল ঢাকনা ঘিরে আছে পৃথিবীকে, ঢাকনাটি ধীরেধীরে ঘুরছে পুব থেকে পশ্চিমে; আর প্লাতো আরিস্ততলের মতো জ্ঞানীরাও আকাশকে মনে করেছেন সত্যিকারেরই ঢাকনা – স্বচ্ছ স্ফটিকে গঠিত, তার গায়ে চুমকির মতো লাগানো আছে তারাগুলো। আকাশ মানুষকে বিভ্রান্ত করেছে বহু কাল। আকাশ এক রহস্যপূর্ণ এলাকা, কেননা তাকে যেমন দেখি আসলে সে তেমন নয়; আকাশ আমাদের চোখে সৃষ্টি ক’রে চলছে চমৎকার সুন্দর বিভ্রম। দেখতে পাই ভোরে সূর্য উঠছে, ধীরেধীরে উঠছে মাথার ওপর, সন্ধ্যায় অস্ত যাচ্ছে পশ্চিমে, ছড়িয়ে পড়ছে অন্ধকার; দেখি চাঁদ ওঠে, আবার অস্ত যায়, তার কলা বাড়ে দিনে দিনে, কমে, পূর্ণিমা হয়, অমাবস্যার অন্ধকারে রাত ঢেকে যায়; একটু খেয়াল করলে দেখি পুব দিকে আকাশে উঠছে নক্ষত্ররা, তারারা, ভোরে ডুবে যাচ্ছে পশ্চিমে। যা-সব দেখি আমরা মহাশূন্যে, সবই আছে শূন্যে; তবে দেখি আমরা একটু ভুলভাবে, যেনো আকাশ এক যাদুকরের মতো ধাঁধা দেখিয়ে চলছে আমাদের। মনে হয় আমাদের ঘিরে পুব দিক থেকে পশ্চিম দিকে ঘুরছে আকাশ, কিন্তু আকাশ ঘোরে না, ঘুরি আমরাই, ঘোরে আমাদের পৃথিবী।

আকাশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিলো এক সময়, যখন শহর গ’ড়ে ওঠে নি, বিদ্যুতের আলোয় ভূভাগ আলোকিত হয় নি, ধুঁয়োয় ঢেকে যায় নি আকাশ। তখন আকাশের দিকে তাকিয়ে তারা দেখে চাষীকে ঠিক করতে হতো ফসল বোনার ঋতু, নাবিককে চালাতে হতো নৌকো, আকাশে খুঁজতো তারা শুভ আর অশুভ সংকেত। পুরোনো কালের মানুষেরা আর জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা মাসের পর মাস শতাব্দীর পর শতাব্দী রাতের পর রাত আকাশের দিকে তাকিয়ে বের করেছেন এলোমেলো সুন্দর আকাশের শৃঙ্খলা; তাদের অনেক ধারণাই আজ ভুল ব’লে প্রমাণিত হয়েছে, কিন্তু সে-সব আমাদের সাহায্য করেছে আকাশকে চিনতে। এখন অনেক জ্ঞান জড়ো হয়েছে আকাশ সম্পর্কে, বৈজ্ঞানিকভাবে আমরা এখন জানি আকাশের বাস্তবতা, এবং আমরা ভুলে যাচ্ছি আকাশকে। আজ অধিকাংশ মানুষের কোনো আকাশ‍ই নেই, তারা আকাশহীন জীবন যাপন করে, যদিও তাদের অনেকে আকাশে উড়ে যায় দেশ থেকে দেশে। অধিকাংশ মানুষ আজ জানে না কোন মাসে পুব দিকে ওঠে কোন তারার মণ্ডল, কিশোরকিশোরী ও প্রাপ্তবয়স্করা জানে কীভাবে বাড়ে চন্দ্রকলা, আকাশের কোন প্রান্তে ওঠে পূর্ণিমার চাঁদ। অনেক বয়স্ক মানুষ, অনেক কবি, কখনো দেখেন নি পূর্ণিমার চাঁদ উঠতে; তাঁরা ধারণা ক’রে নেন পূর্ণিমার চাঁদ ওঠে মধ্যরাতে, কিন্তু পূর্ণিমার চাঁদ ওঠে পুব দিকে সন্ধ্যাবেলা। এককালে রাতের আকাশ দেখে দেখে রাখাল আর মাঝি হয়ে উঠেছিলো জ্যোতির্বিজ্ঞানী, এখন আকাশ অধিকাংশ মানুষেরই অচেনা। কিন্তু চেনা দরকার আকাশকে, জানা দরকার কী ঘটে সেখানে; এই চেনাজানা শুধু জ্ঞান দেয় না, দেয় বিশুদ্ধ আনন্দ।

তারামণ্ডলঃ নক্ষত্রমণ্ডল

নির্মল চাঁদহীন মেঘহীন কোনো রাতে আকাশের দিকে তাকালে মন ভ’রে যায়’ তারার ঝিকিমিকিতে, দেখা যায় আকাশে ছড়িয়ে আছে হাজার হাজার তারা। তারাগুলো কি গুচ্ছে গুচ্ছে ছড়ানো? প্রথম মনে হয় এলোমেলো ছড়িয়ে আছে তারারা, কিন্তু আমরা যেমন কল্পনা ক’রে মেঘে মুখ দেখতে পাই, জলের ঢেউয়ে দেখতে পাই ছবি, তেমনি তারাগুলোতেও খুঁজে পেতে পারি বিন্যাস। সেগুলোকে সাজাতে পারি বিভিন্ন গুচ্ছে। পুরোনো কালের জ্যোতির্বিদেরা এলোমেলো ছড়ানো তারার ভেতরে খুঁজে পেয়েছিলেন নানা গুচ্ছ, নানা বিন্যাস, নানা রূপ বা আকৃতি ৷ তারার এই গুচ্ছগুলোকে বলা হয় ‘তারামণ্ডল’ : কন্‌স্টলেশন। তাঁরা কয়েকটি তারামণ্ডলের চমৎকার নামও রেখেছিলেন। পুরোনো কালের জ্যোতির্বিদেরা চিহ্নিত করেছিলেন যে-সব তারামণ্ডল, সেগুলোর সীমা তাঁরা স্পষ্টভাবে নির্দেশ করেন নি; তারামণ্ডলগুলোর রূপরেখায় তাঁরা দেখেছেন কোনো পৌরাণিক পুরুষ বা নারী বা দেব বা দেবীর আকার। ওগুলোর সাথে জড়িয়ে দিয়েছিলেন তাঁরা নানা সুন্দর চমকপ্রদ গল্প, যেগুলো আজো ভালো লাগে। তারামণ্ডল প্রথম চিহ্নিত করেছিলেন মেসোপটেমিয়ার জ্যোতির্বিদেরা থ্রি ৩০০০ অব্দের দিকে। তারামণ্ডলের তারাগুলোকে পৃথিবী থেকে গুচ্ছে সাজানো দেখা গেলেও, একটিকে আরেকটির কাছে দেখা গেলেও, সেগুলো আসলে আছে খুবই দূরে দূরে, হয়তো অজস্র আলোক-বর্ষ দূরে, এবং বিভিন্ন দিকে ছুটে চলছে তীব্র গতিতে। ওগুলোর মধ্যে এটুকুই মিল যে ওগুলো আছে পৃথিবী থেকে একই দিকে। পুরোনো কালের জ্যোতির্বিদেরা শনাক্ত করেছিলেন ৪৮টি তারামণ্ডল; তারপর আধুনিক কালে আরো ৪০টি তারামণ্ডল শনাক্ত করা হয়েছে; তাই মোট তারামণ্ডল ৮৮টি।

অরিয়ন বা অরাইয়ন বা মহাশিকারী তারামণ্ডল। অরিয়ন গ্রিক পুরাণের এক চরিত্র। এটির ভারতীয় নাম কালপুরুষ। ছবিটি এঁকেছিলেন ডুরার, ছাপা হয়েছিলো ১৬০৩ অব্দে প্রকাশিত ইয়োহান ব্যায়ারের ইউরানোমেট্রিয়া নামের তারাচিত্রাবলিতে।

সবচেয়ে পুরোনো তারামণ্ডলগুলোর দুটি হচ্ছে লিও (সিংহ) ও টৌরাস (বৃষ); পাঁচ হাজার বছর আগে এ-মণ্ডল দুটি শনাক্ত করা হয়েছিলো মেসোপটেমিয়ায়; তারপর নতুন নতুন তারামণ্ডল চিহ্নিত করেন ব্যাবিলন, মিশর, ও গ্রিসের জ্যোতির্বিদেরা। এগুলো চিহ্নিত করার পেছনে ছিলো তাঁদের ধর্মবোধ, আকাশে তাঁরা দেখতে চেয়েছিলেন তাঁদের দেবতা ও আরাধ্যদের; তবে এগুলোর বাস্তব প্রয়োগও ছিলো;- চাষীরা এগুলো দেখে প্রস্তুত হতো চাষের জন্যে, নাবিকেরা নৌকো চালাতো এগুলো দেখে। হাজার হাজার বছর কেটে গেছে এগুলো শনাক্ত করার পর, মহাশূন্যে তীব্র বেগে ছুটছে তারাগুলো, কিন্তু এতো বছরেও এগুলোর রূপ বিশেষ বদলায় নি, নিজ নিজ জায়গায় আছে মণ্ডলের তারাগুলো । পুরোনো কালের জ্যোতির্বিদেরা কাছাকাছি কয়েকটি তারার গুচ্ছে কল্পনা করেছিলেন একেকটি তারামণ্ডল, আর সেগুলোতে আরোপ করেছিলেন বিভিন্ন দেবদেবী, পশু, বা পুরুষের আকৃতি । তাঁরা তারামণ্ডলগুলোর সীমা স্পষ্টভাবে নির্দেশ করেন নি; তাই কোনো কোনো তারা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে একাধিক তারামণ্ডলে। আলফেরাটজ (উত্তরভাদ্রপদ) তারাটিকে তাঁরা অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন দুটি মণ্ডলে- অ্যান্ড্রোমিডা (ধ্রুবমাতামণ্ডল) ও পেগাসাস তারামণ্ডলে। আধুনিক কালে তারামণ্ডল আর শুধু একগুচ্ছ তারার বিন্যাস নয়; সুস্পষ্টভাবে নির্দিষ্ট করা হয়েছে একেকটি তারামণ্ডলের সীমা- বিশেষ একটি তারামণ্ডল এখন আকাশের একটি সুনির্দিষ্ট এলাকা। তাই আলফেরাটজ এখন অ্যান্ড্রোমিডা মণ্ডলের তারা, পেগাসাস মণ্ডলের নয়।

পুরোনো কালের জ্যোতির্বিদেরা সম্পূর্ণ আকাশের কথা ভাবেন নি, তাঁদের সম্পূর্ণ আকাশ ছিলো না; তাঁরা ভেবেছেন শুধু উত্তর গোলার্ধের আকাশের কথা, কেননা তাঁরা ছিলেন উত্তর গোলার্ধের মানুষ। উত্তর আকাশেও যেখানে উজ্জ্বল তারা কম, তাঁরা সেখানে কোনো তারামণ্ডল নির্দেশ করেন নি; দক্ষিণ আকাশ তো ছিলো অজানা। আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা উত্তর ও দক্ষিণ দু-গোলার্ধের আকাশই দেখেন, শনাক্ত করেন আরো ৪০টি তারামণ্ডল । তাঁরা দেখেন আকাশের অনেক জায়গায় কোনো তারাই নেই; তবে সেখানেও তাঁরা কল্পনা করেছেন তারামণ্ডল, সীমা নির্দেশ করেছেন তারামণ্ডলের; এবং রেখেছেন নানা আধুনিক নাম । পুরোনো মানুষের ছিলো দেবতা, ঋষি, শিকারী, পশু, তাদের নামে তাঁরা নাম রেখেছিলেন তারামণ্ডলের; আর এখন আছে যন্ত্র, তাই আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা দূরবিনমণ্ডল (টেলিস্কোপিয়াম), অণুবীক্ষণমণ্ডল (মাইক্রোস্কোপিয়াম) ধরনের নামও রেখেছেন । তারামণ্ডল ও তারাগুলোর পুরোনো নাম আজো ব্যবহৃত হয়, কিন্তু ওই পুরোনো নামে কোনো মণ্ডলে কোনো একটি তারাকে খুঁজে পাওয়া সহজ নয় । তাই আধুনিক কালে নতুনভাবে নামকরণ করা হয়েছে তারাগুলোর, যাতে সহজেই খুঁজে পাওয়া যায় আকাশভরা তারার মাঝে নিজের তারাটি।

তারামণ্ডল আর তারাগুলোর পুরোনো নামগুলো সুন্দর। তারামণ্ডলগুলোর ইউরোপীয় নামগুলো রাখা হয়েছে লাতিন ভাষায়, তবে অধিকাংশ তারার নাম এসেছে পুরোনো আরবি থেকে; আর ভারতের জ্যোতির্বিদেরা সংস্কৃতে রেখেছিলেন অপূর্ব সুন্দর নাম বিভিন্ন তারামণ্ডল ও তারার। তারামণ্ডল-এর একটি প্রতিশব্দ হচ্ছে ‘রাশি’; তবে সব তারামণ্ডলকে রাশি বলা হয় না, রাশি বলা হয় বারোটি তারামণ্ডলকে, যেগুলোর ভেতর দিয়ে সূর্য ভ্রমণ করে বলে বিশ্বাস করা হতো ৷ ইউরোপীয় তারামণ্ডলগুলোর নামের সাথে অর্থের দিক দিয়ে মিলে যায় ভারতীয় তারামণ্ডলগুলোর, বিশেষ ক’রে রাশিগুলোর, নাম । যেমন- এরিজঃ মেষরাশি, টৌরাসঃ বৃষরাশি, জেমিনিঃ মিথুনরাশি, ক্যান্সারঃ কর্কটরাশি (কাঁকড়া), লিও সিংহরাশি, ভিরগোঃ কন্যারাশি, লিব্রাঃ তুলারাশি (দাঁড়িপাল্লা), স্কোরপিয়াসঃ বৃশ্চিকরাশি, স্যাজিটারিয়াসঃ ধনুরাশি, ক্যাপরিকর্নাসঃ মকররাশি (ক্যাপরিকর্নাস- এর অর্থ ‘সামুদ্রিক ছাগল’, আর ‘মকর’-এর অর্থ ‘কুমির’), আকোয়েরিয়াসঃ কুম্ভরাশি, এবং পাইসিজঃ মীনরাশি (মাছ)। কারা নিয়েছিলো কাদের থেকে গ্রিকরা ঋণ করেছিলো ভারত থেকে, না কি ভারত ঋণ করেছিলো গ্রিকদের থেকে? মনে হয় ঋণ করেছিলো পুরোনো ভারতই; পুরোনো ভারতের জ্যোতির্বিদেরা হয়তো টলেমির আলমাজেস্ত পেয়েছিলেন, সেখান থেকে নিয়েছিলেন তারামণ্ডল ও তারার নাম। তবে তাঁরা নামগুলোকে ভারতীয় ক’রে নিয়েছিলেন; রেখেছিলেন সুন্দর সুন্দর নাম । তাঁরা আকাশে তারামণ্ডলে অনেক সময় দেখেছেন সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিশ; যেমন- পশ্চিমে যে-তারামণ্ডলটির নাম ‘উরসা মেজর’ অর্থাৎ ‘বড়ো ভালুক’, সেটি ভারতীয় জ্যোতির্বিদদের কল্পনায় হয়েছে ‘সপ্তর্ষি’; তাঁরা তারা দিয়ে আঁকা ছবিতে ভালুক না দেখে সাতটি তারায় দেখেছেন সাতজন ঋষিকে – ক্রতু, পুলহ, পুলস্ত্য, অত্রি, অঙ্গিরা, মরীচি, বশিষ্টকে।

আকাশে ছড়িয়ে আছে কোটি কোটি তারা, সবগুলো তাঁরা দেখতে পান নি, যেগুলো দেখেছেন সেগুলোর প্রত্যেকটিরও নাম রাখেন নি; তবে পুরোনো জ্যোতির্বিদেরা নাম রেখেছেন বহু তারার। তারাদের গুচ্ছগুচ্ছ তারার মতোই নাঃ অশ্বিনী, ভরণী, কৃত্তিকা, রোহিণী, মৃগশিরা, আর্দ্রা, পুনর্বসু, পুষ্যা, অশ্লেষা, মঘা, পূর্বফল্গুনী, উত্তরফল্গুনী, চিত্রা, স্বাতী, বিশাখা, অনুরাধা, শতভিষা, রেবর্তী – এমন অজস্র নাম । তারাদের ইউরোপীয় নামগুলোর অনেকগুলো এসেছে পুরোনো আরবি থেকে; যেমন- সিরিয়াস (অর্থ ‘পোড়াটি’), আলডেবরন (অর্থ ‘প্লেইডেসের অনুসারী’), বেটেলগিউস (অর্থ ‘মধ্যেরটির বগল’)। সবচেয়ে বিখ্যাত তারাটির নাম ধ্রুবতারা; এটিকে বলা হয় ‘পোলারিস’, নাম থেকেই বোঝা যায় এটি মেরুতারা। তবে এটি যে চিরকাল ধ্রুবতারা ছিলো ও থাকবে, তা নয় ৷ একে ‘উত্তর আকাশের তারা’ও বলা হয় । কয়েকটি তারার ইউরোপীয় ও ভারতীয় নাম এমনঃ সিরিয়াসঃ লুব্ধক, ক্যানোপাসঃ অগস্ত্য, ভেগাঃ অভিজিৎ, কাপেলাঃ ব্রহ্মহৃদয়, আর্কটরাসঃ স্বাতী, রিগেলঃ বাণরাজা, আলতাইরঃ শ্রাবণা, স্পাইকাঃ চিত্রা, বেটেলগিউসঃ আর্দ্রা, আলডেবরনঃ রোহিণী (হলদিবরণ), পুনর্বসুঃ পোলাক্স, ডেনেবঃ মীনপুচ্ছ, রেগুলাসঃ মঘা, আলনাথঃ অগ্নি, আলগলঃ মায়াবতী, ওয়াসার্টঃ অনিল, আলনিলামঃ অনিরুদ্ধ, আলনিটকঃ ঊষা, ডেনেবোলাঃ উত্তরফল্গুনী, জোসমাঃ পূর্বফল্গুনী, আলকোরঃ অরুন্ধতী, পোলারিসঃ ধ্রুবতারা, এটামিনঃ সর্পমণি, আলফেরাটজঃ উত্তরভাদ্রপদ।

অজস্র তারা, অজস্র সুন্দর আলোর ফুলের মতো নাম; কিন্তু নাম জানলেই আকাশে তাদের চেনা যায় না। কোনটি কোথায় আছে, কোন তারামণ্ডলে? ১৬০৩ অব্দে ইয়োহান ব্যায়ার ইউরানোমেট্রিয়া নামের তারাচিত্রাবলিতে তারাগুলোকে সহজে চেনার জন্যে একটি পদ্ধতি বের করেন। তাঁর পদ্ধতিই এখন ব্যবহৃত হয়। তিনি গ্রিক বর্ণমালার ক্রম দিয়ে নির্দেশ করেন তারামণ্ডলের উজ্জ্বলতম থেকে ক্রমশ ম্লান তারাগুলো; সবচেয়ে উজ্জ্বল তারাটি আলফা, তার পরেরটি বিটা, তার পরেরটি গামা, এভাবে ডেল্টা, এপসাইলন, জিটা, ইটা, থিটা, আওয়াটা, কাপ্পা, লামডা, মিউ, নিউ, জাই ইত্যাদি । মনে করা যাক মণ্ডলটির নাম সপ্তর্ষি; তাহলে এর উজ্জ্বলতম তারাটিকে চিহ্নিত করা হবে, অর্থাৎ হয়েছে, সপ্তর্ষির আলফা নামে, তারচেয়ে কম উজ্জ্বলটি সপ্তর্ষির বিটা নামে, পরেরটি সপ্তর্ষির গামা নামে । এভাবে তারাগুলো হারিয়ে ফেলে তাদের ঝলমলে ঝিকিমিকি নামগুলো, কিন্তু তাদের চেনা সহজ হয়ে ওঠে; এ-রীতিতে আমরা জানি তারামণ্ডলের নাম, আর জানি তারাটির উজ্জ্বলতার মাত্রা । যেমন, যদি বলি লুব্ধক, তাহলে তারার একটি সুন্দর নাম শুনি, তার বেশি নয়; কিন্তু যদি বলি ক্যানিস মেজরিস বা বড়ো কুকুরমণ্ডলের আলফা, তাহলে সহজেই খুঁজে বের করতে পারি তারাটিকে। তবে উজ্জ্বলতা নির্দেশ করতে করতে এক সময় ফুরিয়ে যায় গ্রিক বর্ণমালা; কিন্তু আমাদের ছায়াপথেই আছে ১০০ বিলিয়ন তারা।

স্বচ্ছ অন্ধকার আকাশে আলোর অলঙ্কারের মতো তারামণ্ডল দেখা আর চেনা আনন্দের ব্যাপার, কিন্তু ওগুলো চেনা সহজ নয়; আকাশের মানচিত্র বদলে যায় ঋতুতে ঋতুতে, আর রাতের এক যাম থেকে আরেক যামে । তারামণ্ডলগুলো এক সাথে আকাশে উঠে স্থির হয়ে থাকে না। তারামণ্ডল চেনার জন্যে পাওয়া যায় রাতের আকাশের মানচিত্র, ওই মানচিত্রের সাথে মিলিয়ে আকাশে চেনা যায় বিভিন্ন তারামণ্ডল আর তারা। মনে করা যাক গ্রীষ্মের আকাশ দেখছি; তখন খুঁজতে হবে মাথার প্রায় ওপরে একটি উজ্জ্বল তারা। তারাটির নাম ভেগা বা অভিজিৎ। এটি লায়রা বা বীণা তারামণ্ডলের আলফা। তারার মানচিত্রের সাথে মিলিয়ে মিলিয়ে দেখলে পাওয়া যাবে সাইগনাস (রাজহাঁস), ড্রাকো (ড্রাগন), উরসা মেজর (সপ্তর্ষি) বিভিন্ন তারামণ্ডল, আর ডেনেব (মীনপুচ্ছ), পোলারিস (ধ্রুবতারা), স্পাইকা (চিত্রা) প্রভৃতি তারা। তালিকা ও আকাশ দেখে দেখে চিনে নিতে হবে তারা ও তারামণ্ডল।

মানচিত্রটিকে প্রথম ভুল মনে হতে পারে; কেননা সামনের দিকে যদি উত্তর দিক থাকে, তাহলে ডান দিকে পুব দিক থাকার কথা, কিন্তু এটিতে ডানে আছে পশ্চিম দিক। এটি উপুড় করে মাথার ওপর তুলে তারপর লম্বভাবে নিচে নামিয়ে পড়তে হবে। মানচিত্রটিতে বিশেষ তারামণ্ডলের পাশে আছে তারামণ্ডলের নাম, আর বিশেষ তারার পাশে আছে তারার নাম।

এখন তারামণ্ডল আছে ৮৮টি। তারামণ্ডলগুলোঃ অ্যান্ড্রোমিডা (রাজকন্যা, ধ্রুবমাতা), অ্যান্টিলা (বায়ুনিষ্কাশনযন্ত্র), আপুস (স্বর্গের পাখি), আকোয়েরিয়াস (কুম্ভ), অ্যাকুইলা (ইগল, গরুড়), আরা (বেদি), এরিজ (ছাগ, মেষ), অরিগা (সারথি, ব্রহ্মমণ্ডল), বুওটেস (ভালুক তাড়নাকারী, ভূতেশ), ক্যালাম (ভাস্করের বাটালি), ক্যামেলোপাস (জিরাফ), ক্যান্সার (কর্কট), কানেস ভেনাটিকি (শিকারি কুকুর, সারমেয়যুগল), কানিস মেজর (বড়ো কুকুর, মৃগব্যাধ), কানিস মাইনর (ছোটো কুকুর, শূনী), ক্যাপরিকর্নাস (সামুদ্রিক ছাগল, মকর), ক্যারিনা ( জাহাজের তলি), ক্যাসিওপিয়া (ইথিওপিয়ার রানী, কাশ্যপেয়), সেন্টোরাস (অশ্বনর, মহিষাসুর), কেফিউস (রাজা), সেটুস (তিমি), ক্যামেলিওন ( গিরগিটি), সার্মিনাস (দিকনির্ণয়যন্ত্র, কম্পাস), কলুম্বা (ঘুঘু), কোমা বেরেনিসেস (বেরেনিসেসের চুল), করোনা অস্ট্রালিস (দক্ষিণের মুকুট, দক্ষিণ কিরীট), করোনা বোরেআলিস (উত্তরের মুকুট, উত্তরকিরীট), কোর্ভাস (কাক, করতল), ক্রেটার (পেয়ালা), কাক্স (দক্ষিণের ক্রুশ, ত্রিশঙ্কু), সাইগনাস (রাজহাঁস, বক), ডেলফিনাস (গুগুক, শ্রবিষ্ঠা), ডোরাডো (তলোয়ার মাছ, সুবর্ণাশ্রম), ড্র্যাকো (ড্রাগন, তক্ষক), ইকিউলিউস (অশ্বশাবক), এরিডানুস (নদী), ফোরন্যাক্স (গবেষণাগারের চুল্লি), জেমিনি (মিথুন), গ্রুস (ক্রেন), হারকিউলিস, হোরোলোগিয়াম (ঘড়ি), হাইড্রা (জলসৰ্প, হ্রদসর্প), হাইড্রস (জলসাপ), ইন্ডাস (আমেরিকি ইন্ডিয়ান), লাসেটা (টিকটিকি), লিও (সিংহ), লিও মাইনর (সিংহশাবক), লেপাস (খরগোশ), দিব্রা (তুলা, দাঁড়িপাল্লা), লুপুস (নেকড়ে), লাইংঙ্ক (বনবিড়াল), লায়রা (বীণা), মেনসা (টেবিল পর্বত), মাইক্রোস্কোপিয়াম (অণুবীক্ষণযন্ত্র), মোনোসেরোস (ইউনিকর্ন, একশিংঅশ্ব), মুস্কা (মাছি), নরমা (মিস্ত্রির স্কোয়ার), ওক্টেন্স (ওক্টেন্ট), ওফিউকাস (সপঝুড়ি), অরিয়ন বা অরাইয়ন (মহাশিকারি, কালপুরুষ), পাড়ো (ময়ুর), পেগাসাস (ডানাঅলা অশ্ব), পার্সিয়ুস (গ্রিক পুরাণের নায়ক, পরশু), ফিনিক্স (পৌরাণিক পাখি), পিক্টর (চিত্রকরের ইজেল), পাইসিজ (মীন), পাইসিজ অস্ট্রেনাস (দক্ষিণের মাছ), পাপিস (জাহাজের পেছনভাগ), পাইক্সিস (কম্পাসবাক্স), রেটিকুলাম (জাল), সাজিটা (তীর), স্যাজিটারিয়াস (তীরন্দাজ, ধনু), স্করপিয়াস (বৃশ্চিক), স্কাল্পটর (ভাস্কর), স্কুটাম (ঢাল), সেরপেন্স (সাপ), সেক্সটান্স (সেক্সট্যান্ট), টৌরস (বৃষ), টেলিস্কোপিয়াম (দূরবিন), ট্রাইঅ্যাঙ্গুলাম (ত্রিভুজ), ট্রাইঅ্যাঙ্গুলাম অস্ট্রালে (দক্ষিণের ত্রিভুজ), টুকানা (টৌকান), উরসা মেজর (বড়ো ভালুক, সপ্তর্ষি), উরসা মাইনর (ছোটো ভালুক), ভেলা (পাল), ভিগো (কন্যা), ভোলান্স (উড়াল মাছ), ভুলপেকিউলা (শেয়াল)।

রাতের আকাশে আলোর বিন্দুর মতো মিটিমিটি করে তারাগুলো। ওগুলো কি অনেক দূরের মোমবাতি? দীপের স্থির শিখা? স্ফুলিঙ্গ? না, তা নয়; তারাগুলো একেকটি সূর্য। তারাগুলোর দিকে তাকিয়ে ওগুলোকে যতোটা উজ্জ্বল যতোটা প্রভাময় মনে হয়, ওগুলো আসলে তেমন নয়; গুগুলো বিশাল বিশাল সূর্য, অনেক দূর থেকে দেখি ব’লেই গুগুলোকে স্থির জোনাকি ব’লে মনে হয় । জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা নির্দেশ করেন তারাগুলোর দু-রকম উজ্জ্বলতা; তারাদের এক রকম উজ্জ্বলতাকে বলা হয় ‘আপাতপ্রভা’, আরেক রকম উজ্জ্বলতাকে বলা হয় ‘ধ্রুবপ্রভা’ । পৃথিবী থেকে কোনো তারাকে যতোটুকু উজ্জ্বল দেখায়, তাই হচ্ছে তারাটির আপাতপ্রভা বা দৃশ্যমান প্রভা; আর তারাগুলোকে যদি এক সারিতে বসানো যেতো, তাহলে একেকটির উজ্জ্বলতা যেমন দেখাতো, তা হচ্ছে তাদের ধ্রুবপ্রভা। গ্রিক জ্যোতির্বিদ হিপ্পারকাস খ্রিপূ ১৩০ অব্দে ১০০০ তারার একটি তালিকা তৈরি করেছিলেন; এবং তিনি তারাগুলোকে তাদের আপাতপ্রভা অনুসারে ভাগ করেছিলেন ছ-ভাগে ৷ প্ৰথম প্রভার তারাগুলো সবচেয়ে উজ্জ্বল, দ্বিতীয় প্রভার তারাগুলো তারচেয়ে কম উজ্জ্বল, এভাবে ষষ্ঠ প্রভার তারাগুলো সবচেয়ে কম উজ্জ্বল । তবে তারা শুধু ছ-রকম প্রভার নয়; আরো নানা প্রভার তারা আছে, যা খালি চোখে দেখতে পান নি হিপ্পারকাস । উনিশ ও বিশ শতকের জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা আরো সুচারুরূপে মেপেছেন তারার প্রভা; দেখেছেন প্রথম প্রভার তারার থেকেও বেশি প্রভাময় তারা রয়েছে, এবং আছে ষষ্ঠ প্রভার তারার থেকেও ম্লান প্রভার তারা । হিপ্পারকাসের প্রথম প্রভার তারা ষষ্ঠ প্রভার তারার থেকে প্রায় ১০০ গুণ উজ্জ্বল; আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এ-মাত্রা হিশেব ক’রে দেখেছেন কোনো একটি তারা তার থেকে একটু ম্লান তারাটির থেকে আড়াই গুণ উজ্জ্বল । আধুনিক কালে তারার প্রভা মাপার জন্যে ঋণাত্মক এবং ভগ্নাংশের মাত্রাও ব্যবহৃত হয়; যেমন, সিংহমণ্ডলের থিটা তারাটি হিপ্পারকাসের রীতিতে তৃতীয় প্রভার তারা, আর এখন স্পষ্টভাবে বলা যায় এর প্রভা ৩.৩৪; আর সূর্যের আপাতপ্রভা হচ্ছে -২৬.৫ (বিয়োগ ছাব্বিশ দশমিক পাঁচ)। এভাবে পূর্ণিমার চাঁদের আপাতপ্রভা -১২.৫, শুক্রের আপাতপ্রভা -৪.৪, ভেগার (অভিজিৎ) আপাতপ্রভা ০.০, স্পাইকার (চিত্রা) আপাতপ্রভা ১.০ । তবে তারার আপাতপ্রভা তারার আসল প্রভা নয়, এটা হচ্ছে পৃথিবী থেকে দেখা প্রভা। এটা ঘটে তারাদের দূরত্বের জন্যে, তাই এর সাহায্যে কোন তারার কতোটা শক্তি, তা বোঝা সম্ভব নয় । তারার প্রকৃত শক্তি নির্দেশ করা হয় তারার ধ্রুবপ্রভার মাত্রার সাহায্যে।

আকাশগোলক

আকাশ আমাদের বিভ্রান্ত করে, আকাশের ঘটনাগুলো আমাদের চোখে আর মনে বিভ্রম সৃষ্টি করে । পুরোনো কালের জ্যোতির্বিদেরা মনে করেছিলেন আকাশ একটি স্ফটিকে গঠিত গোলক, যা ঘিরে আছে পৃথিবীকে; আর তার গায়ে চুমকির মতো লাগানো আছে তারাগুলো। তাঁরা মনে করতেন গোলকটি সূর্য, চাঁদ, গ্রহ, তারা নিয়ে দিনে একবার পুব থেকে ঘোরে পশ্চিমে। আমরা এখন জানি আকাশ স্ফটিকে গড়া গোলক নয়, তারাগুলো ছড়িয়ে আছে মহাশূন্যে বহু বহু দূরে; আর আকাশ পৃথিবী ঘিরে ঘোরে না, পৃথিবীই ঘোরে তার অক্ষের ওপর। আমরা জানি পৃথিবীকে ঘিরে কোনো গোলক নেই, কোনো গোলকের ভেতর বন্দী নয় পৃথিবী; কিন্তু এমন একটা গোলক কল্পনা ক’রে নিলে আকাশের জিনিশগুলো কীভাবে চলছে, তা ব্যাখ্যা করা যায় সহজে। আকাশের গোলকটির অর্ধেক আমরা দেখতে পাই, বাকি অর্ধেক থাকে দিগন্তের নিচে; সবটা মিলে কল্পনা করতে পারি এই আকাশগোলকটি, যেমন কল্পনা করেছিলেন প্রাচীন গ্রিকরা। মনে ক’রে নিচ্ছি পৃথিবীকে ঘিরে আছে একটি বিশাল গোলক, যার ব্যাসার্ধ বিশাল, যার গায়ে লাগানো আছে তারাগুলো। বাঙলায় একে সাধারণত বলা হয় ‘খগোল’; আমার কাছে ওই শব্দটি নিরর্থক মনে হয়, ভালো লাগে না; তাই এই কল্পিত আকাশের – গোলকটিকে আমি বলছি ‘আকাশগোলক’। এটি একটি বিপুল বিশাল গোলক, যার কেন্দস্থলে আছে পৃথিবী; পৃথিবীর যেখান থেকেই এর দিকে তাকাই, দেখতে পাই এটি ঘিরে আছে আমাদের। যদি আমরা আকাশের দিকে তাকাই, তাহলে দেখতে পাই আকাশগোলকটি তার সব কিছু নিয়ে পুব থেকে ঘুরছে পশ্চিম দিকে । পৃথিবী যেহেতু পশ্চিম থেকে পুব দিকে ঘোরে, তাই দেখতে পাই দিনে সূর্য পুবে উঠে ডোবে পশ্চিমে; আর সন্ধ্যার পর দেখি পুরে ওঠে রাশিরাশি তারা, আকাশে ধীরেধীরে চলে অস্ত যায় পশ্চিম দিগন্তের নিচে।

আকাশগোলক। এটি ভূকেন্দ্রিক। তারাখচিত বিশাল আকাশগোলকের পৃথিবীর পৃথিবীর বিষুবরেখা কেন্দ্রে অবস্থিত পৃথিবী । পৃথিবীর যেমন উত্তর ও দক্ষিণ মেরু আছে, এরও আছে উত্তর ও দক্ষিণ মেরু; পৃথিবীর মতো এরও আছে বিষুবরেখা বা নিরক্ষবৃত্ত। এর মেরু ঠিক পৃথিবীর মেরুর ওপরে, এর বিষুবরেখা ঠিক পৃথিবীর বিষুবরেখার ওপরে।

আকাশগোলক তার সব কিছু নিয়ে ঘোরে পুব থেকে পশ্চিমে; যে-দুটি বিন্দুকে কেন্দ্র ক’রে ঘোরে, সে-দুটি আকাশগোলকের মেরু। এর উত্তর মেরু পৃথিবীর উত্তর মেরুর ঠিক ওপরে, আর দক্ষিণ মেরু ঠিক দক্ষিণ মেরুর ওপরে। পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধে দাঁড়িয়ে যদি উত্তরের তারাগুলোর দিকে তাকাই, আর দক্ষিণ গোলার্ধে দাঁড়িয়ে তাকাই দক্ষিণের তারাগুলোর দিকে, তাহলে দেখতে পাবো কিছু তারা কখনোই দিগন্তের নিচে অস্তমিত হয় না; তারাগুলো ওখানে ঘোরে বৃত্তাকারে । এগুলো মেরুপরিবৃত্ত তারা বা অনস্তগ তারাঃ সারকামপোলার স্টার। এ-তারাগুলো ঘুরে ঘুরে তৈরি করে যে-বৃত্ত, তার কেন্দ্রটিই আকাশগোলকের মেরু। ধ্রুবতারাটি এখন আছে আকাশগোলকের উত্তর মেরুর কাছাকাছি, এটি সারারাত অনেকটা স্থির হয়েই থাকে; এজন্যে একে উত্তর আকাশের তারাও বলা হয়। ১০০০ বছর ধরে ধ্রুবতারা আছে উত্তর মেরুর কয়েক ডিগ্রির মধ্যে; আগে অন্য তারা ছিলো উত্তর মেরুর কাছাকাছি। আকাশগোলকের দক্ষিণ মেরুর কাছাকাছি কোনো তারা নেই। পৃথিবীর বিষুবরেখার ওপরে কল্পনা করা হয়েছে আকাশগোলকের বিষুবরেখা; এটি দুই সমান ভাগে বিভক্ত করে আকাশগোলককে আকাশকে এভাবে ভাগাভাগি করা, তাতে নানা চিহ্ন দেয়ার কারণ হচ্ছে এগুলোর সাহায্যে সূর্য ও চাঁদের গতি, ঋতুবদল, গ্রহণ প্রভৃতি ব্যাপার সহজে বোঝা যায় ৷

আকাশ অনন্ত এলাকা; এখানে রয়েছে নানা জিনিশ, সেগুলোর দূরত্ব মাপতে হয় জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের। তাই তাঁরা কোণ আবিষ্কার করেছেন আকাশে; তাঁরা কোণ দিয়ে মাপেন দূরত্ব । যদি বলি কোনো একটি তারা থেকে চাঁদটি ১০ ডিগ্রি উত্তরে, তাহলে বুঝতে হবে যদি একটি হাত বাড়াই চাঁদের দিকে এবং আরেকটি বাড়াই তারাটির দিকে, তাহলে দু-হাতের মধ্যে উৎপন্ন কোণটি হবে ১০ ডিগ্রির । এটা চাঁদ ও তারাটির মধ্যে কৌণিক দূরত্ব। এ-রীতিতে আকাশের কোনো বস্তুর দূরত্ব ও অবস্থান নির্দেশ করা যায়। কোণ মাপা হয় ডিগ্রিতে, চাপের মিনিটে, ও চাপের সেকেন্ডে । এ-পদ্ধতি বের করেছিলেন ব্যাবিলনীয়রা, তাঁরা কোণ মেপেছিলেন ৬০-ভিত্তিক পদ্ধতিতে । একটি বৃত্তের পরিমাণ ৩৬০ ডিগ্রি, ৬০ মিনিটে ১ ডিগ্রি, আর ৬০ সেকেন্ডে ১ মিনিট । সময়ও মাপা হয় এ-রীতিতেই। সময়ের মিনিট ও সেকেন্ড থেকে কোণের মিনিট-সেকেন্ডের পার্থক্য বোঝানো হয় ‘চাপের মিনিট’ ও ‘চাপের সেকেন্ড’ কথার সাহায্যে। কোণের সাহায্যে নির্ণয় করা যায় আকাশের বস্তুদের আকৃতি ও তাদের দূরত্ব। যেমন, চাঁদ ও সূর্যের ব্যাস মোটামুটি ০.৫ ডিগ্রি; বিগ ডিপার (উরসা মেজর) মণ্ডলের তর্জনি তারাগুলো ৫ ডিগ্রি দূরে দূরে অবস্থিত, আর আছে আকাশগোলকের উত্তর মেরু থেকে ৩০ ডিগ্রি দূরে।

সূর্যাবর্ত

আকাশের উজ্জ্বলতম বস্তু সূর্য, একটি তারা, যাকে ঘিরে ঘুরছে পৃথিবী । কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় সূর্য প্রদক্ষিণ করছে পৃথিবীকে; প্রতিদিন ভোরে পুব দিগন্তে উঠছে, ধনুকের মতো বাঁকানো পথে আকাশে চ’লে সন্ধ্যায় ডুবছে পশ্চিম দিগন্তে । আরেকটি আপাতগতি কল্পনা করা যায় সূর্যের; পেছনের তারাগুলোর সাথে মিলিয়ে দেখলে মনে হবে যেনো সূর্য পশ্চিম থেকে পুব দিকে আকাশ পরিভ্রমণ ক’রে চলছে। এটা মনে হয়, এটা প্রতিভাস মাত্র, এটা সত্য নয়; তবে এককালে মানুষ এটা বিশ্বাস করতো যে সূর্য ভ্রমণ করছে তারামণ্ডলের বা রাশিচক্রের ভেতর দিয়ে।

কেনো এমন মনে হয় যে তারাগুলোর ভেতর দিয়ে সূর্য পশ্চিম থেকে যাচ্ছে পুবে? এটা ঘটে পৃথিবীর কক্ষপথে বার্ষিক গতির জন্যে। চাঁদ পৃথিবীকে একবার প্রদক্ষিণ করে ২৭.৩ দিনে; পেছনের তারাগুলোর সাথে মিলিয়ে দেখলে মনে হবে চাঁদও সূর্যের মতো একই পথে পশ্চিম থেকে যাচ্ছে পুব দিকে। এ ছাড়া পাচটি গ্রহ- বুধ, শুক্র, মঙ্গল, বৃহস্পতি, শনি বেশ উজ্জ্বল, সহজেই তাদের দেখা যায়; তারাও কক্ষপথে পুব দিকে যায় সূর্যের পথের থেকে সামান্য ভিন্ন পথে। আকাশের সব কিছুই নিরন্তর পরিভ্রমণরত; সূর্য, চাঁদ, গ্রহ, ও তারাগুলো ঘুরছে তাদের পথে। তারাগুলো এতো দূরে আছে যে তাদের চলাচল অজস্র বছরেও চোখে পড়ে না; তাই মনে করতে পারি যে গুগুলো স্থির হয়ে আছে আকাশগোলকে । কিন্তু সূর্য, চাঁদ, আর গ্রহগুলো আছে কাছে: আর পেছনের তারারাশির পটভূমিতে তারা যে ভ্রমণ করছে, এটা লক্ষ্য করতে পারি।

সূর্যপথ। তারামণ্ডলের ভেতর দিয়ে পশ্চিম থেকে পুব দিকে ভ্রমণ করছে সূর্য। নির্মল সন্ধ্যার আকাশের দিকে দিনের পর দিন তাকালে দেখা যাবে পেছনের তারাদের পটভূমিতে দিনে দিনে স্থান বদল করছে সূর্য। সূর্যের পথটির নাম সূর্যপথ বা ক্রান্তিবৃত্ত। এটি আকাশে একটি বিশাল বৃত্ত, তবে এ-ছবিতে পথটি একটি বক্ররেখা। ছবিটিতে দেখানো হয়েছে প্রধান তারামণ্ডলগুলো, আর রাশিচক্রের তারাগুলো দেখানো হয়েছে মোটা রেখার। সূর্যপথ একটি দৃষ্টিবিভ্রম, সূর্য আসলে এভাবে ভ্রমণ করে না । আমরা সূর্য পেরিয়ে তারামণ্ডলগুলো দেখি, তাতে আমাদের চোখে বিভ্রম জাগে যেনো সূর্য ভ্রমণ করে চলছে তারামণ্ডলগুলোর ভেতর দিয়ে।

সূর্যপথ বা ক্রান্তিবৃত্তঃ সূর্যকে প্রতিদিন পুর্বে উঠতে আর ডুবতে দেখি পশ্চিমে। সূর্য ওঠেও না ডোবেও না; পৃথিবী নিজের অক্ষের ওপর পশ্চিম থেকে পুবে ঘোরে ব’লেই এমন দেখি আমরা । পৃথিবী সূর্যকে ঘিরে নিজের কক্ষপথে ঘোরে বছর ভ’রে; এর ফলেও চোখে পড়ে সূর্যের একটি আপাতগতি । সূর্য যে এভাবে সত্যিই ঘোরে, তা নয়; কিন্তু আমরা পৃথিবী থেকে দেখি ব’লে মনে হয় সূর্য চলছে এমন একটি পথে। জানুয়ারি মাসে সূর্যকে দেখা যায় স্যাজিটারিয়াস বা ধনু তারামণ্ডলের দিকে; দিনের বেলা দেখা সম্ভব নয়, কিন্তু সন্ধ্যায় সূর্য ডোবার সময় তাকালে এটা দেখা যায় । দিন যায়, পৃথিবী চলতে থাকে তার কক্ষে; আমরা সূর্যকে দেখতে থাকি পৃথিবীর কক্ষপথের ভিন্ন ভিন্ন স্থান থেকে। ফেব্রুয়ারি মাসে দেখা যায় সূর্য আছে ক্যাপরিকর্নাস বা মকর তারামণ্ডলে। মার্চে দেখা যায় সূর্য আছে আকোয়েরিয়াস বা কুম্ভ তারামণ্ডলে। পৃথিবী ঘুরতে থাকে, আমাদের মনে হ’তে থাকে যেনো সূর্য তারামণ্ডলগুলোর ভেতর দিয়ে পুব দিকে চলছে; এবং এক বছরে ঘুরে আসছে সম্পূর্ণ আকাশ।

সূর্য আসলে এভাবে ঘোরে না, পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে ব’লেই আমাদের এমন মনে হয়- যেনো তারামণ্ডলগুলোর ভেতর দিয়ে পশ্চিম থেকে পুবে পরিভ্রমণ করছে সূর্য। সূর্যের এই কল্পিত পথকে বলা হয় ক্রান্তিবৃত্তঃ একলিপটিক। তবে আমি বলবো সূর্যপথ; কেননা সূর্যপথ বললে সূর্যের পথটি যেনো চোখে দেখা যায়। সুর্যের এই আপাতভ্রমণের মূলে আছে কক্ষপথে পৃথিবীর পরিক্রমা; তাই সূর্যপথটি হচ্ছে আকাশে পৃথিবীর কক্ষপথের প্রতিচ্ছায়া। যদি আকাশগোলকটি হতো একটি বড়ো গোলাকার পর্দা, যার মাঝখানে আছে সূর্য; তাহলে কক্ষপথে পরিক্রমার সময় ওই পর্দার ওপর যে-ছায়া পড়তো পৃথিবীর কক্ষপথের, তাই হতো সূর্যপথ। সূর্য এই পথে, স্থির তারাদের পটভূমিতে রেখে, দিনে ১ ডিগ্রি ক’রে এগোয় পুব দিকে, বছরে সম্পূর্ণ করে ভ্রমণ। সম্পূর্ণ বৃত্ত বা ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরে আসতে সূর্যের লাগে ৩৬৫.২৬ দিন বা এক বছর।

পৃথিবী প্রতিমুহূর্তে ঘুরছে, আবর্তিত হচ্ছে তার অক্ষের ওপর; আবর্তন করতে করতে তার কক্ষপথে পৃথিবী প্রদক্ষিণ করে সূর্যকে। পৃথিবী তার কক্ষপথের ওপর সোজা বা লম্বভাবে দাঁড়িয়ে পরিভ্রমণ করে না, থাকে একটুখানি হেলে। পৃথিবীর এই হেলে থাকার পরিমাণ 23½ ডিগ্রি। পৃথিবী তার কক্ষপথের ওপর 23½ ডিগ্রি হেলে থাকে ব’লে সূর্যপথও 23½ ডিগ্রি হেলে থাকে আকাশগোলকের বিষুবরেখার ওপর ৷ যখন সূর্যপথকে স্থাপন করা হয় আকাশগোলকের বিষুবরেখার ওপর, তখন তারাও সৃষ্টি করে একটি 23½ ডিগ্রি কোণ। আকাশগোলকের বিষুবরেখা আর সূর্যপথ আকাশে দু-স্থানে ভেদ করে পরস্পরকে; এ-দুটি স্থানকে বলা হয় ‘বিষুব’ ইকুইনোক্স (লাতিনে এর অর্থ ‘সমান রাত’)। সূর্য যে-স্থানে আকাশগোলকের বিষুবরেখাকে অতিক্রম ক’রে উত্তরের দিকে এগোয়, সে-স্থানটিকে বলা হয় মহাবিষুব বা বসন্তবিষুব : ভারনাল ইকুইনোক্স; আর সূর্য যে-স্থানে আকাশ- গোলকের বিষুবরেখাকে অতিক্রম ক’রে দক্ষিণের দিকে এগোয়, তাকে বলা হয় জলবিষুব বা শারদবিষুবঃ অটামনাল ইকুইনোক্স।

সূর্য বসন্তবিষুব অতিক্রম করে ২১ মার্চ বা তার কাছাকাছি সময়ে, আর শারদবিষুব অতিক্রম করে ২২ সেপ্টেম্বর বা তার কাছাকাছি সময়ে। বসন্তবিষুব পেরিয়ে সূর্য যখন উত্তরে যাত্রা করে তখন উত্তর গোলার্ধে শুরু হয় বসন্তকাল; আর গ্রীষ্ম শুরু হয় যখন সূর্য পৌঁছে উত্তরায়ণে। শরৎ শুরু হয় যখন সূর্য শারদবিষুব পেরিয়ে দক্ষিণে যেতে শুরু করে, আর সূর্য যখন সবচেয়ে দক্ষিণে পৌঁছে, উপস্থিত হয় দক্ষিণায়নে, তখন শুরু হয় উত্তর গোলার্ধে শীতকাল। সূর্যপথের আরো দুটি বিন্দু চিহ্নিত করতে পারি; খুঁজে দেখতে পারি আকাশগোলকের বিষুবরেখা থেকে সূর্য সবচেয়ে দূরে থাকে কোন কোন স্থানে। ২২ জুনের কাছাকাছি সময়ে সূর্য চ’লে যায় দূরতম উত্তরে, ওই বিন্দুটিকে বলা হয় উত্তরায়ণ বা গ্রীষ্মায়নঃ সামার সোলন্টিস (লাতিনে সোলস্টিসের অর্থ ‘স্থিরসূর্য’); আর ২২ ডিসেম্বরের কাছাকাছি সময়ে সূর্য চ’লে যায় দূরতম দক্ষিণে, ওই বিন্দুটিকে বলা হয় দক্ষিণায়ন বা শীতায়নঃ উইন্টার সোলস্টিস। সূর্যপথের এ-চিহ্নগুলো নির্দেশ করে বিভিন্ন ঋতুর সূচনা। পৃথিবী থেকে সূর্যের গড়দূরত্ব ৯ কোটি ৩০ লক্ষ মাইল; তবে পৃথিবীর কক্ষপথ উপবৃত্তাকার ব’লে দূরত্ব কখনো বাড়ে কখনো কমে । ৩ জানুয়ারিতে পৃথিবী পৌঁছে সূর্যের নিকটতম স্থানে, এ-স্থানটিকে বলা হয় অনুসূরঃ পেরিহেলিয়ন; ৬ জুলাই পৌছে সূর্যের থেকে দূরতম স্থানে, একে বলা হয় অপসূরঃ আপহেলিয়ন।

অয়নচলন বা অভিমুখবদলঃ পৃথিবী নিজের অক্ষরেখার ওপর ঘুরছে লাটিমের মতো, তার মাথাটি সব সময় একই অবস্থানে থাকে না, কেননা পৃথিবী ঘুরতে ঘুরতে খুব ধীরেধীরে তার মাথাটি সরিয়ে নিচ্ছে। এই ধীর লাটিমের মতো গতিকে বলা হয় অয়নচলন বা অভিমুখবদলঃ প্রিসেশন। সুমেরীয় কালে বসন্তবিষুবের সময় সূর্য উঠতো বৃষরাশিতে; এখন বসন্তের শুরুতে সূর্যকে উঠতে দেখা যায় মীনরাশিতে । ৫০০০ বছরে বসন্তবিষুব বৃষরাশি থেকে মেষরাশি হয়ে পশ্চিমে স’রে গেছে মীনরাশিতে। এভাবে ২৬০০০ বছরে একবার ঘোরে পৃথিবীর অভিমুখ । অভিমুখবদল যেহেতু ঘটে দীর্ঘ সময়ে, তাই দু-এক শতকে তার কোনো প্রভাব দেখা যায় না । অভিমুখ বদলের ফলে বদল ঘটে মেরুতারার। এখন আকাশগোলকের উত্তর মেরু আছে ধ্রুবতারার কাছে, ৩০০০ বছর আগে ছিলো ড্র্যাকোমণ্ডলের থুবান তারার কাছে; ১২০০০ বছর পর উত্তর মেরুর কাছে থাকবে বীণামণ্ডলের অভিজিৎ বা ভেগা তারাটি । তাই ধ্রুবতারাও ধ্রুব নয়। অভিমুখবদলের মূলে আছে সূর্য ও চাঁদের অভিকর্ষ। পৃথিবী গোলাকার, তবে বিশুদ্ধরূপে গোল নয়; তার বিষুবাঞ্চলে রয়েছে কিছুটা স্ফীতি, সূর্য ও চাঁদ এটাকে টেনে পৃথিবীকে তার কক্ষপথে খাড়াভাবে ঘোরাতে চায় । এর ফলে নড়ে পৃথিবীর অক্ষ, অভিমুখবদল ঘটে পৃথিবীর মেরুমুখের।

চন্দ্ৰাবৰ্ত্ত

চাঁদ পৃথিবীর একমাত্র উপগ্রহ, এটি কোনো পবিত্র স্বর্গীয় বস্তু নয়; একটি কর্কশ প্রাণহীন মহাশূন্যের শূন্যবস্তু । চাঁদ পশ্চিম থেকে পুবে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে ২৭.৩২ দিনে। এ-সময়টিকে বলা হয় নাক্ষত্রিক কালঃ সিডেরিয়েল পিরিয়ড। চাঁদ খুব তাড়াতাড়ি চলে আকাশে, ২৪ ঘণ্টায় চাঁদ এগিয়ে চলে ১৩ ডিগ্রি; তার আপাতব্যাসের থেকে প্রায় ২৬ গুণ। পেছনের তারার পটভূমির সাথে যদি মিলিয়ে দেখি চাঁদের অবস্থান, তাহলে দেখতে পাই চাঁদ এক ঘণ্টায় চলে তার ব্যাসের (০.৫ ডিগ্রি) থেকে কিছুটা বেশি। পৃথিবীর কক্ষপথের ওপর চাঁদের কক্ষপথ হেলে থাকে ৫ ডিগ্রি, তাই চাঁদ কখনো সূর্যপথ থেকে ৫ ডিগ্রির বেশি স’রে যায় না । চাঁদের নিজের আলো নেই, এর ওপর সূর্যের আলো পড়ে ব’লেই চাঁদকে দেখতে পাই আমরা। সবটা দেখতে পাই না, শুধু যে-অংশের ওপর সূর্যের আলো পড়ে, আর তার যতোটুকু পৃথিবী থেকে দেখা যায়, ততোটুকুই দেখতে পাই। চাঁদ আকাশ পথে চলতে থাকে, আর চাঁদের যে-পিঠ পৃথিবীর দিকে, তার বিভিন্ন এলাকার ওপর পড়তে থাকে সূর্যের আলো, তাই আমরা দেখি চাঁদের বিভিন্ন কলা । চাঁদ পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে, কিন্তু তার একটি দিকই স্থির হয়ে থাকে পৃথিবীর দিকে, তাই চাঁদের বিপরীত দিকটি আমরা দেখতে পাই না।

পূর্ণিমার চাঁদ। তার সন্নিকট ছবি। একে দেখে আর মন জ্যোৎস্নায় ভরে না, পবিত্র মনে হয় না, কবিতার মতো মনে হয় না।

চাঁদের অমাবস্যা হয়, নতুন চাঁদ ওঠে, তার কলা বাড়ে, পূর্ণিমা হয়; তারপর কলা কমতে থাকে, আবার অমাবস্যা হয়। কিন্তু এসব সময়ে কী ঘটে আকাশে, কী ঘটে চাঁদের? অমাবস্যায় কি চাঁদ হারিয়ে যায় আকাশ থেকে? ম’রে যায়? কোনো প্রচণ্ড দেবতাকে প্রণাম করতে গিয়ে লুকিয়ে থাকে তার পায়ের আড়ালে? না, এসব পৌরাণিক কোনো কাণ্ড ঘটে না। আকাশে সব সময়ই আছে সূর্য, পৃথিবী, আর চাঁদ; এবং পৃথিবী ঘুরছে সূর্যকে ঘিরে, চাঁদ ঘুরছে পৃথিবীকে ঘিরে। এই ঘিরে ঘিরে ঘোরাঘুরির ফলেই চাঁদকে আমরা দেখি বিভিন্ন রূপে। চাঁদের বিভিন্ন আলোকিত রূপকে বলা হয় চাঁদের কলা বা চন্দ্ৰকলা।

চাঁদের অমাবস্যা থেকেই শুরু করতে পারি চাঁদবর্ণনা। চাঁদ ঘুরতে ঘুরতে যখন মোটামুটিভাবে সূর্য ও পৃথিবীর মাঝখানে থাকে, তখন চাঁদের যে-পিঠটি থাকে আমাদের দিকে, সেটির ওপর কোনো আলো পড়ে না । এ-পিঠ থাকে অন্ধকার, আমরা তাই চাঁদ দেখতে পাই না। চাঁদের অপর পিঠে আলো পড়ে, অত্যন্ত তীব্র আলো পড়ে, কেননা চাঁদ তখন সূর্যের খুব কাছে, ওই আলোতে হারিয়ে যায় চাঁদ । চাঁদের এই অদৃশ্য অবস্থাকে বলা হয় অমাবস্যা; এ-দিনের চাঁদকেই বলা হয় ‘নতুন চাঁদ’ । নতুন চাঁদ দেখা যায় না। নতুন চাঁদ ধারণাটি এসেছে পৌরাণিক বিশ্বাস থেকে যে চাঁদের কলা বেড়ে বেড়ে আর ক্ষয় হয়ে হয়ে ম’রে যায় চাঁদ, তারপর আবার জন্ম নেয়। এর পর দিন দুয়েক চাঁদকে দেখা যায় না; এ-সময়ে চাঁদ স’রে যেতে থাকে সূর্যের কাছে থেকে, পশ্চিম দিগন্তে দেখা দেয় দিন দুয়েক পর। এ-সময়ে চাঁদের একটি আলোকিত বাঁকা অংশ দেখতে পাই আমরা, তবে সূর্যের আলো শুধু ওটুকুর ওপরই পড়ে না, পরে অর্ধেকের ওপর; কিন্তু পৃথিবী থেকে আমরা একটু বাঁকা আলো দেখি। এ-চাঁদকে বলি বাঁকা চাঁদঃ ক্রিসেন্ট। এ-সময়ে চাঁদ আকাশে উঠে অল্প পরেই অস্ত যায়। এ-সময় চাঁদের শিং দুটিকে দেখা যায় ওপরমুখো। এর পর রাতে রাতে বাড়তে থাকে চাঁদ, বাড়তে থাকে চাঁদের কলা, পৃথিবী প্লাবিত হয়ে যেতে থাকে চাঁদের জ্যোৎস্নায়; চাঁদ ক্রমশ যেতে থাকে আকাশের পুব দিকে; এবং সাত দিন পর আকাশে দেখা যায় অর্ধেক আলোকিত চাঁদ। এ-সময়ে দিনের বেলাও সূর্যাস্তের আগে চাঁদ দেখা যায় আকাশে। রাতে রাতে বেড়ে বেড়ে চাঁদ পুব দিকে স’রে যেতে থাকে সূর্য থেকে, এবং দু-সপ্তাহ পর চাঁদ চ’লে যায় সূর্যের বিপরীত দিকে। তখন সূর্যের আলোতে যে-অর্ধেক আলোকিত হয় চাঁদের, তা আমরা দেখতে পাই পৃথিবী থেকে; মনে হয় সারাটি চাঁদ আলোকিত হয়ে আছে। একে বলা হয় পূর্ণিমা বা পূর্ণচাঁদ। পূর্ণিমায় চাঁদ হয়ে ওঠে একটি আলোর বৃত্ত; আকাশে ওঠে সন্ধ্যারাতে। অনেকেরই ভুল ধারণা আছে যে পূর্ণিমার চাঁদ ওঠে মধ্যরাতে; খুব ভুল ধারণা এটি, পূর্ণিমার চাঁদ ওঠে সন্ধ্যায়, যখন চাঁদ আর সূর্য থাকে বিপরীত দিকে; মাঝে থাকে পৃথিবী। চাঁদ ওঠা থেকে পূর্ণিমা পর্যন্ত সময়টিকে আমরা বলি শুক্লপক্ষ।

পূর্ণিমার পর আর সন্ধ্যায় চাঁদ দেখা যায় না, এ-সময়ের পর চাঁদ উঠতে থাকে সন্ধ্যার পর। শুরু হয় চাঁদের কৃষ্ণপক্ষ, রাতে রাতে কমতে থাকে চাঁদের কলা । এ-পক্ষে চাঁদ দেখা যাবে সূর্যোদয়ের আগে। পুব দিকে যখন সূর্য উঠতে থাকে, পূর্ণচাঁদ ডুবতে থাকে পশ্চিমে। এ-সময়ে চাঁদ সূর্যের থেকে পুব দিকে এগোতে এগোতে কাছে আসতে থাকে সূর্যের, হ্রাস পেতে থাকে তার আলোর আকার; অমাবস্যার তিন সপ্তাহ বা পূর্ণিমার এক সপ্তাহ পরে দেখা যায় আকাশে উঠেছে অর্ধবৃত্তের মতো চাঁদ। তবে এই অর্ধেক চাঁদ দেখতে শুক্লপক্ষের অর্ধেক চাঁদের বিপরীত; শুক্লপক্ষে দেখা যায় ডান দিকের অর্ধেক, কৃষ্ণপক্ষে বাঁ দিকের অর্ধেক। এর পর দেখা যায় চাঁদ ক্রমশ কাছে আসছে সূর্যের, পরিণত হচ্ছে বাঁকা চাঁদে; তবে এবার বাঁকা চাঁদের শিং দুটি বিপরীত দিকে ফেরানো।

চাঁদ ২৭.৩২ দিনে একবার প্রদক্ষিণ করে পৃথিবীকে; তবে তার কলার এক চক্র পূর্ণ করতে চাঁদ কিছুটা বেশি সময় নেয়। চাঁদ যখন ২৭.৩২ দিনে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করতে থাকে, তখন সূর্য দিনে ১ ডিগ্রি ক’রে এগোতে থাকে পুব দিকে । ২৭.৩২ দিনে চাঁদ এর আগের বার নতুন চাঁদের অবস্থায় যেখানে ছিলো, আকাশের সেখানে ফিরে আসে; কিন্তু এ-সময়ে সূর্য এগিয়ে যায় ২৭ ডিগ্রি পুবে। তাই চাঁদ আরো ২ দিনের কিছুটা বেশি সময় নেয় সূর্যের কাছাকাছি নতুন চাঁদের অবস্থায় যেতে। তাই চাঁদের কলার এক চক্র পূরণ করতে চাঁদের সময় লাগে ২৯.৫৩ দিন। এ-সময়টিকে বলা হয় চান্দ্র কালঃ সাইনোডিক পিরিয়ড। তাই ২৯.৫৩ দিন পরে চাঁদ আবার পৌছে সূর্যের কাছাকাছি, এবং অমাবস্যায় হারিয়ে যায় নতুন চাঁদ চাঁদ এ-সময়ে হারিয়ে যায় না, ম’রে যায় না; ছোটো হয় না বড়ো হয় না, পবিত্র হয় না অপবিত্র হয় না; আগে যেমন ছিলো থাকে তেমনই। এ-সময়ে চাঁদ আকাশে সূর্যের থেকে ৫ ডিগ্রির মধ্যে থাকে, কিন্তু দেখা যায় না। কিন্তু কখনো কখনো ঘটে দুর্লভ ঘটনা; নতুন চাঁদের সময় চাঁদ উপস্থিত হয় সূর্যের ঠিক মুখোমুখি; আর তখন যে-অসামান্য ঘটনা ঘটে, তাকে বলা হয় সূর্যগ্রহণ। সূর্য আর চাঁদকে স্থির তারার মতো দেখায় না, স্থির তারার মতো আচরণও করে না চাঁদসূর্য; তারা ভ্রমণ করে স্থির তারারাশির ভেতর দিয়ে। কিন্তু লক্ষ্য করলে দেখা যায় তারার মতো পাঁচটি বস্তু আছে আকাশে, এগুলোকে তারাই মনে করা হয় সাধারণভাবে, কিন্তু এগুলো ভ্রমণ ক’রে চলে তারারাশির ভেতর দিয়ে। এরা তারা নয়, গ্রহ : বুধ, শুক্র, মঙ্গল, বৃহস্পতি, শনি। গ্রিক ভাষায় প্ল্যানেট শব্দের অর্থ ‘ভ্রমণকারী’। আরো কয়েকটি গ্রহ আছে, যেগুলো খালি চোখে দেখা যায় না, আবিষ্কৃত হয়েছে দূরবিন দিয়ে, সেগুলো কথা এখানে বলছি না।

যে-পাঁচটি গ্রহ খালি চোখে দেখা যায়, সেগুলোকে দুটি ভাগে ফেলা হয় । এক ভাগে রয়েছে সূর্যের সন্নিকট গ্রহ দুটিঃ বুধ ও শুক্র; আরেক ভাগে রয়েছে সূর্য থেকে দূরবর্তী গ্রহ তিনটিঃ মঙ্গল, বৃহস্পতি, ও শনি। পৃথিবীর কথা বলছি না । সন্নিকট গ্রহ দুটি সূর্যের নিয়ত সঙ্গী; বুধ ও শুক্রকে আকাশে সব সময়ই দেখা যায় সূর্যের কাছাকাছি। তারা সূর্যের একপাশ থেকে আরেক পাশে যায়, কিন্তু কখনো সূর্যের সঙ্গ ছেড়ে যায় না । এ-দুটিকে সূর্যোদয়ের আগে দেখা যায় পুব আকাশে, সূর্যাস্তের পর দেখা যায় পশ্চিম দিগন্তে । শুক্রকে দেখাই বেশি সহজ, কেননা এর কক্ষপথ বুধের কক্ষপথের থেকে বড়ো, এবং এটি ওঠে দিগন্তের বেশ ওপরে । বুধের কক্ষপথ ছোটো ব’লে সূর্যের আলোতে লুপ্ত হয়ে থাকে। সূর্যোদয়ের আগে আকাশে যে-গ্রহকেই দেখা যায়, তাকেই বলা হয় শুকতারা; আর সূর্যাস্তের পর যে-গ্রহকেই দেখা যায় আকাশে, তাকে বলা সন্ধ্যাতারা। তবে শুক্রকেই সাধারণত দেখা যায় সন্ধ্যাতারা আর শুকতারারূপে; কেননা শুক্র খুবই উজ্জ্বল, সূর্য ও চাঁদের পরেই এটিই আকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বল বস্তু।

আকাশের বস্তুদের দূরত্ব মাপা হয় কৌণিক বিচ্ছিন্নতা বা দূরত্ব (অ্যাঙ্গুলার সেপারেশন) মেপে। সূর্য থেকে কোনো গ্রহের কৌণিক দূরত্বকে বলা হয় ‘প্রসারণ’: ইলঙ্গেশন । শুক্রগ্রহটি সূর্যের পুব দিকে চলতে চলতে এক সময় সূর্য থেকে এর কৌণিক দূরত্ব বা প্রসারণ হয় প্রায় ৪৮ ডিগ্রি; এর এই অবস্থানকে বলা হয় শুক্রের সর্বোচ্চ পূর্বপ্রসারণ; তারপর এটি দ্রুত চ’লে যায় পশ্চিমে, অবশেষে পৌঁছে ৪৮ ডিগ্রি প্রসারণে, একে বলা হয় শুক্রের সর্বোচ্চ পশ্চিমপ্রসারণ। বুধও এভাবে দৌড়োদৌড়ি করে, তবে এটি কখনোই ২৮ ডিগ্রির বেশি প্রসারণে যায় না। যখন কোনো গ্রহ এমন অবস্থায় থাকে যে সূর্যের সাথে তার কৌণিক দূরত্ব হয় সবচেয়ে কম, তখন ওই অবস্থাকে বলা হয় সংযোগঃ কনজাংশন। এ-অবস্থায় গ্রহটি সূর্যের সাথে থাকে একই পংক্তিতে। সংযোগের সময় গ্রহটিকে খালি চোখে দেখা যায় না কেননা এটি হারিয়ে যায় সূর্যের তীব্র আলোর ঝলকানির অন্ধকারে।

যদি আমরা গ্রহগুলোকে স্থির তারার পটভূমিতে দিনের পর দিন দেখি, তাহলে দেখতে পাবো যে গ্রহগুলো তারারাশির ভেতর দিয়ে সাধারণত পশ্চিম থেকে পুবে যায়। দিনের পর দিন পুব দিকে যেতে যেতে তারা এক সময়ে পরিক্রমা ক’রে আসে সম্পূর্ণ আকাশগোলক । এভাবে পরিক্রমা করতে বুধের লাগে ১১৬ দিন, শুক্রের ৫৮৪ দিন, মঙ্গলের ৭৮০ দিন, বৃহস্পতির ৩৯৯ দিন, আর শনির লাগে ৩৭৮ দিন।

গ্রহগুলো আকাশ পরিক্রমার সময় এক বিস্ময়কর, বিভ্রমজাগানো ধাঁধার মতো, কাজ করে ব’লে মনে হয়; এই ধাঁধা বেশ পাগল ক’রে তুলেছিলো পুরোনো কালের জ্যোতির্বিদদের। তাঁরা দেখেন আকাশে তারার মতো একটি উজ্জ্বল বস্তু তারাদের ভেতর দিয়ে পশ্চিম থেকে যাচ্ছে পুবে, কয়েক মাস যাচ্ছে এভাবে; এ-গতিকে তাঁরা বলেন সম্মুখগতি । তাঁরা মনে করেন গ্রহটি এভাবেই চলতে থাকবে পুবে, কিন্তু একরাতে দেখেন বস্তুটি থেমে আছে স্থির তারাগুলোর মধ্যে। খুবই বিস্ময়কর ব্যাপার। তাহলে এটি কি হয়ে গেছে স্থির তারা? না, পুরোনো জ্যোতির্বিদেরা আরো বিস্মিত হয়ে দেখেন বস্তুটি এবার পেছনের দিকে চলতে শুরু করেছে, পুব থেকে যেতে শুরু করেছে পশ্চিমে। তাঁরা এই গতিকে বলেন পশ্চাৎগতি । গ্রহটি পেছনের দিকে যেতে থাকে কিছু রাত ধ’রে, তারপর থামে; তারপর আবার তারাদের ভেতর দিয়ে পশ্চিম থেকে যেতে শুরু করে পুব দিকে। এটা খুব বিস্মিত বিব্রত করেছিলো পুরোনো জ্যোতির্বিদদের; এটা বর্ণনার জন্যে তাঁরা আকাশে তৈরি করেছিলেন চাকার পর চাকা- ছোটো ছোটো বৃত্ত । পৃথিবী থেকে সবগুলো গ্রহকেই এভাবে সম্মুখগতিতে আর পশ্চাৎগতিতে ভ্রমণ করতে দেখা যায়। তবে গ্রহরা আসলে এমন এগিয়ে পিছিয়ে পাগলের মতো চলে না; এটা আমাদের দেখার ভুল । পৃথিবী ও বিভিন্ন গ্রহ প্রদক্ষিণ ক’রে চলছে সূর্যকে; গ্রহদের প্রদক্ষিণের গতি সম্মান নয়, তাই পৃথিবীর গতির সাথে অন্যান্য গ্রহের গতির অমিলের ফলেই এমন প্রতিভাস তৈরি হয় যেনো গ্রহগুলো পুব দিকে চলতে চলতে এক সময় থামছে, তারপর পেছনের দিকে যাচ্ছে, আবার থেমে যাচ্ছে পুবের দিকে।

গ্রহণ

গ্রহণ, সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণ, আজো শিউরে দেয় মানুষকে। আদিম মানুষ গ্রহণ সম্পর্কে তৈরি করেছিলো নানা পুরাণ, এবং বাস করতো গ্রহণের ভীতির মধ্যে। পূর্ণসূর্যগ্রহণের সময় আকাশে কয়েক মুহূর্তের মধ্যে নেমে আসে অন্ধকার, দিনের বেলাও ঝিকিমিকি ক’রে ওঠে তারা, পশুপাখিরা অদ্ভুত আচরণ করতে থাকে, শিউরে দেয়ার মতো স্তব্ধতা নেমে আসে চরাচরে। পূর্ণচন্দ্রগ্রহণের সময় চাঁদ হয়ে ওঠে রক্তাভ । গ্রিকরা গ্রহণকে বলেছে একলিপসিস বা বর্জন, ভারতীয়রা কল্পনা করেছে রাহু আর কেতু গ্রাস করে সূর্য ও চাঁদকে, চিনদেশের মানুষ মনে করেছে ড্রাগন খেয়ে ফেলছে সূর্যকে। আদিমানুষ ভীষণ ভয় পেয়েছে গ্রহণকে; বিধাতার পাঠানোপুরুষেরা একে ক’রে তুলেছে খুবই ভীতিকর। হেরোদোতুস জানিয়েছেন খ্রিপূ ৫৮০ অব্দে হঠাৎ সূর্যগ্রহণ দেখে ভয় পেয়ে যুদ্ধ থামিয়ে সন্ধি পাতিয়েছিলো লাইডীয় ও মেডীয় বাহিনী।

পূর্ণসূর্যগ্রহণ। ছবিটি তোলা হয়েছিলো ১২ নভেম্বর ১৯৬৬। চাঁদের ছায়ার নিচ থেকে সূর্যের আলো বিচ্ছুরিত হয়ে হীরের আংটির মতো দেখাচ্ছে সূর্যকে। বাঁ দিকে দেখা যাচ্ছে শুক্রকে।

পৃথিবী থেকে দু-রকম গ্রহণ দেখতে পাইঃ সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণ। সূর্যগ্রহণ ঘটে যখন চাঁদ পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করতে করতে সূর্য ও পৃথিবীর মাঝখানে এসে পড়ে; এবং পূর্ণসূর্যগ্রহণ ঘটে যখন চাঁদের ছায়া সম্পূর্ণ ঢেকে ফেলে সূর্যকে, আর আংশিক সূর্যগ্রহণ ঘটে যদি চাঁদ কেন্দ্র থেকে একটু স’রে থেকে ঢাকে সূর্যের অংশবিশেষ । চাঁদের থেকে অনেক বড়ো সূর্য, কিন্তু পৃথিবী থেকে তাদের কৌণিক আকার সমান, উভয়েরই আকার প্রায় ০.৫ ডিগ্রি। তাই চাঁদের ছায়া ঠিকঠাক আবৃত করে সূর্যকে, তবে চাঁদ যদি তার কক্ষপথের দূরতম স্থানে থাকে, তখন তার কৌণিক আকার ছোটো হয় ব’লে সূর্যকে পুরোপুরি আবৃত করতে পারে না। এর ফলে যে-সূর্যগ্রহণ হয়, তাকে বলে বলয়গ্রাস গ্রহণ; এতে চাঁদের ছায়া ঘিরে দেখা যায় আলোর চক্র। সূর্যগ্রহণ ঘটে নতুন চাঁদে অর্থাৎ অমাবস্যায়।

চন্দ্রগ্রহণ ঘটে তখন, যখন চাঁদ পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করতে করতে পৌছে সূর্য থেকে পৃথিবীর সম্পূর্ণ বিপরীত ধারে। তাই চন্দ্রগ্রহণ হয় সব সময়ই পূর্ণিমায়, পৃথিবীর ছায়া প’ড়ে ঢেকে যায় চাঁদের ধবধবে বৃত্ত। পৃথিবীর ছায়া পেরোতে চাঁদের সময় লাগে কয়েক ঘণ্টা; এ-সময়ে চাঁদ হয়ে ওঠে রক্তাভ, কেননা তখন চাঁদে সূর্যের আলো গিয়ে পৌঁছে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের ভেতর দিয়ে। সৌরজগতের অন্যান্য স্থানেও ঘটে গ্রহণ; যেমন চাঁদ থেকে দেখা যায় পৃথিবীর ছায়ায় আবৃত সূর্যগ্রহণ, মঙ্গলগ্রহ গ্রহণের কবলে পড়ে যখন তার ওপর গিয়ে পড়ে মঙ্গলের চাঁদ ফোবোসের ছায়া । গ্রহণ মহাজাগতিক ব্যাপার, একের ছায়া অপরের ওপরে পড়ার ব্যাপার।

চাঁদ ঘোরে, পৃথিবী ঘোরে, তাহলে প্রতি মাসে কেনো সূর্যগ্রহণ চন্দ্রগ্রহণ হয় না? স্থির তারাদের পটভূমিতে চান্দ্রপথ ও সূর্যপথ কিছুটা ভিন্ন; চান্দ্রপথ সূর্যপথের ওপর ৫ ডিগ্রি কোণ তৈরি ক’রে হেলে থাকে। শুধু দু-জায়গায় সূর্যপথ ও চান্দ্রপথ ছেদ করে পরস্পরকে; ওখানেই শুধু চাঁদ ও সূর্য এতোটা কাছাকাছি দিয়ে যায় যে ঘটতে পারে সূর্যগ্রহণ। দুটি পথের ছেদবিন্দুকে বলা হয় ‘পাত’ নোড। চাঁদ ও সূর্যের প্রত্যেকের কৌণিক ব্যাস ০.৫ ডিগ্রি; তাই সূর্যকে ঢাকতে হ’লে চাঁদ ও সূর্যকে আসতে হয় একে অন্যের ০.৫ ডিগ্রির মধ্যে। চাঁদ পৃথিবী থেকে যতোটা দূরে আছে তাতে তার ছায়া কোনো রকমে এসে পৌঁছে পৃথিবীতে। পূর্ণসূর্যগ্রহণের সময় পৃথিবীতে চাঁদের ছায়ার সর্বোচ্চ প্রস্থ হয় ৩০০ কিলোমিটার । পৃথিবীতে শুধু ওই ছায়ার এলাকায় বাস করে যারা, তারাই দেখতে পায় পূর্ণসূর্যগ্রহণ; অন্যরা দেখতে পায় আংশিক সূর্যগ্রহণ। পৃথিবীকে ঘিরে চাঁদের কক্ষপথ ও সূর্যকে ঘিরে পৃথিবীর কক্ষপথ যদি একই সমতলে হতো, তাহলে প্রতিমাসেই চাঁদ আসতে পারতো সূর্য ও পৃথিবীর ঠিক সোজাসুজি, তাহলে প্রতিমাসেই ঘটতে পারতো সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণ । চাঁদের কক্ষপথ পৃথিবীর কক্ষপথের থেকে ৫ ডিগ্রি হেলে আছে; তাই চাঁদ সাধারণত পৃথিবী ও সূর্যের রেখা ও পৃথিবীর ছায়ার কিছুটা ‘ওপর’ বা ‘নিচ’ দিয়ে চ’লে যায়। সূর্যপথ ও চাঁদের পথ মিলতে পারে শুধু দু-জায়গায়, দুটি ছেদবিন্দুতে বা ‘পাতে’; তাই শুধু তখনই হ’তে পারে গ্রহণ। পুরোনো গ্রিকরা সূর্যপথের নাম দিয়েছিলেন ‘একলিপটিক’, আর গ্রহণ হচ্ছে ‘একলিপ্স’। সূৰ্যপথকে তাঁরা ‘একলিপটিক’ বলেছিলেন, কেননা শুধু তখনই গ্রহণ বা ‘একলিপ্স’ ঘটতে পারে যখন চাঁদ অতিক্রম করে ‘একলিপটিক’। গ্রহণের জন্যে চাঁদকে অবশ্যই থাকতে হবে একটি পাতের কাছে, তারপরও গ্রহণ নাও ঘটতে পারে; শুধু তখনই গ্রহণ ঘটে যখন ওই পাত বা ছেদবিন্দু দুটির রেখা থাকে সূর্যের সোজাসুজি।

পূর্ণচন্দ্রগ্রহণের কয়েকটি স্তরের সময় পরম্পরার ছবি (জুলাই ১৯৮২)। বাঁ থেকে ডান দিকে পৃথিবীর ছায়া থেকে বেরিয়ে আসছে পূর্ণিমার চাঁদ।

কখন সূর্যপথ আর চান্দ্রপথের ছেদবিন্দুর রেখা থাকে সূর্যের সোজাসুজি? যদি চাঁদের কক্ষের ওপর কোনো বাইরের শক্তি কাজ না করতো, তাহলে বছরে দু-বার ছেদবিন্দুর রেখা সোজাসুজি হতো সূর্যের, আর গ্রহণ ঘটতে পারতো। তবে তারার পটভূমিতে চাঁদের পথ স্থির নয়; নানা শক্তির চাপে চাঁদের পথ বিচলিত হয়। এর ফলে চাঁদের কক্ষপথে ঘটে ছেদবিন্দুর অভিমুখবদল। তারাদের পটভূমিতে ছেদবিন্দুর পংক্তি বা রেখা ধীরেধীরে ঘোরে, এবং একবার ঘুরতে সময় নেয় ১৮.৬১ বছর। তাই গ্রহণ ঘটার জন্যে এক সাথে কাজ করে কয়েকটি ব্যাপার : সূর্যকে ঘিরে ২৯.৫ দিনে একবার চাঁদের পরিক্রমা, পৃথিবীর ১ বছরের বার্ষিক গতি, ও ১৮.৬ বছরে চাঁদের একবার সম্পূর্ণ অভিমুখবদল। এসব একসাথে মিলে নিয়ন্ত্রণ করে গ্রহণ । বেশ জটিল ব্যাপার, কিন্তু পুরোনো জ্যোতির্বিদেরাই এসব হিশেব ক’রে ভবিষ্যদ্বাণী করতে পেরেছিলেন কখন ঘটবে গ্রহণ।

চাঁদ ২৯.৫ দিনে (মাস) একবার সূর্যের অভিমুখের সবচেয়ে নিকট দিয়ে যায়, আর সূর্যপথ ও চান্দ্রপথের ছেদবিন্দু সূর্যের সাথে একই রেখায় বা পংক্তিতে আসে ৩৪৬.৬ দিনে (গ্রহণবছর) একবার। চন্দ্র বা সূর্যগ্রহণ ঘটতে পারে, যদি এ-দুটি সময়চক্র পরস্পরের সাথে মেলে। এ-মিলন ঘটে কখন কখন? এ-দুটি চক্রের মিলন ঘটে ৬৫৮৫ দিনে বা ১৮ বছর ১১ দিনে একবার। এ-সময়টিকে বলা হয় সারোসচক্র। পুরোনো জ্যোতির্বিদেরা আবিষ্কার করেন যে যদি কোনো বছর চন্দ্রগ্রহণ ও সূর্যগ্রহণ হয়, তবে আবার ওই পরম্পরায় গ্রহণ ঘটবে এক সারোস পর। চাঁদের ছায়া যেহেতু ছোটো, তাই পৃথিবীর অল্প এলাকা থেকেই শুধু দেখা যায় সূর্যগ্রহণ; আর যেহেতু পৃথিবীর ছায়া বড়ো, এবং চাঁদ দেখা যেতে পারে সম্পূর্ণ রাত্রির গোলার্ধ থেকে, তাই পৃথিবীর অর্ধেক থেকে দেখা যায় প্রতিটি চন্দ্রগ্রহণ। চন্দ্রগ্রহণ দেখতে পায় অধিকাংশ মানুষ, তাই প্রাচীন জ্যোতির্বিদদের পক্ষে চন্দ্রগ্রহণ সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা ছিলো কিছুটা সহজ। আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা সব গ্রহণ নির্ভুল ও যথাযথভাবে আগে থেকেই নির্দেশ করতে পারেন; কেননা তাঁরা চক্রের বদলে ব্যবহার করেন কম্পিউটার ও কক্ষপথতত্ত্ব। গড়ে প্রায় প্রতিবছরই একবার চন্দ্রগ্রহণ হয়, আর সূর্যগ্রহণ হয় এক বছর পর পর; তবে পূর্ণসূর্যগ্রহণ হয় ৪০০ বছরে একবার।

error: Content is protected !!