আমরা কোথায় আছি
আমাদের মতো সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে পিছিয়ে পড়া সংস্কারবদ্ধ দেশে পদে পদে যেখানে অনিশ্চয়তা সেখানে বেশির ভাগ সাধারণ মানুষ দুঃখ-কষ্টের হাত থেকে পরিত্রাণ পেতে প্রতিকারের একমাত্র ধব্জাধারী জ্যোতিষী বা অবতারদের দ্বারস্থ হবেন, এটাই স্বাভাবিক।
বিজ্ঞানের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে ধর্মীয় ভ্রান্ত ধারণাগুলোকে একে একে পচা-গলা অঙ্গের মতোই খসে খসে পড়ছে। শিক্ষা ও বিজ্ঞানের সঙ্গে সঙ্গে বিজ্ঞান-মনস্ক মানসিকতাও একটু একটু করে গড়ে উঠছে। তবুও এ-কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, অনুন্নত দেশের তুলনায় অনেক কম হলেও উন্নতর দেশেও অবৈজ্ঞানিক, যুক্তিহীন, ভ্রান্ত ধর্মীয় ধারণাগুলো এখনো বর্তমান।
শ্রদ্ধেয় বিজ্ঞানী সাহার বক্তব্য থেকে আমরা জানতে পারি তাঁর সংগৃহীত তথ্য অনুসারে সে সময়ে আমাদের দেশের শতকরা ৯৯ ভাগ পুরুষ ও শতকরা ১০০ ভাগ মহিলা ফলিত জ্যোতিষে বিশ্বাসী। ইউরোপে ফলিত জ্যোতিষে পূর্ণ আস্থাবান পুরুষের সংখ্যা ৫ এবং মহিলার সংখ্যা শতকরা ৩৩ জন।
এই পরিসংখ্যান থেকে অনুমান করতে অসুবিধা হয় না যে, যুক্তিহীন কুসংস্কার ভারতীয় সমাজে কেমনভাবে জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসে রয়েছে। অতি দুঃখের কথা এই যে, প্রতিটি দেশ যখন বিভিন্ন বিষয়ে উন্নতিকে দ্রুততর করতে চাইছে, তখন আমরা অতীত সংস্কৃতির দোহাই দিয়ে সনাতন সংস্কারের আবর্তে থাকতে চাইছি।
এ-যুগের অনেকেই বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশুনো করলেও বা বিজ্ঞানের কোন বিভাগকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করলেও মনে-প্রাণে বিজ্ঞানী হতে পারেননি, পারেননি বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিকে গ্রহণ করতে।
এঁরা প্রায়শই একদিকে যুক্তিহীন ধর্মীয় ধ্যান-ধারণাগুলোকে আঁকড়ে ধরে রেখেছেন, আর একদিকে লেখাপড়ায় সুপুত্র হয়ে ডাক্তারি বা ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে ছাত্র-জীবনে ছেদ টেনেছেন, অথবা বিজ্ঞানের অন্য কোনও বিভাগে সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে কর্মজীবনে আর্থিক সফলতা পেয়েছেন।
আমার এক পরিচিত এক ডাক্তারকে দেখেছি, একটা স্ট্রোক হওয়ার পর তাঁর হাতে ও গলায় একাধিক মাদুলী শোভা পাচ্ছে।
আমার এক পরিচিত বিজ্ঞান পেশার প্রতিবেশীকে জানি, যার পালিয়ে যাওয়া কিশোরী কন্যাটিকে ফেরত পাওয়ার জন্য ঈশ্বরের কাছে মানত করেছিলেন।
এক কেমিস্ট্রির অধ্যাপককে জানি, যিনি বিশ্বাস করেন, তাঁর গুরুদেব মাধ্যাকর্ষণ শক্তিকে উপেক্ষা করে ধ্যানে শূন্যে ভেসে থাকতে পারেন।
বর্তমানের নামী দামী অবতারদের জীবনী পড়লে বিজ্ঞান শিক্ষায় শিক্ষিত অনেকেরই নাম পাবেন, যারা এইসব অবতারদের অলীক অলৌকিক ক্ষমতার পক্ষে মত প্রকাশ করেছেন। তাঁরা এই সব মত প্রকাশ করেছেন কখনো অন্ধ-বিশ্বাসে, কখনো বা অলৌকিক (?) ঘটনাটির পেছনে লুকোনো বাস্তব কারণ বুঝতে না পারার দরুন। অহংবোধের ফলে এইসব শিক্ষিত মানুষ একবারও ভাবতে পারেন না, তাঁদের বোধশক্তির বাইরেও যুক্তিগ্রাহ্য কারণ থাকতে পারে। বিশ শতকের শেষ মাথায় এসেও ভারতবর্ষের শিক্ষিত, বিজ্ঞান-শিক্ষিত, মার্কসবাদে-দীক্ষিত অনেকেই যুক্তিহীন, অবৈজ্ঞানিক চিন্তাধারা বহন করে চলেছেন।
সমাজে প্রতিষ্ঠিত শিক্ষিত অথচ যুক্তিহীন মানুষের তালিকা দিতে গেলে একটা ছোট-খাটো বই হয়ে যাবে।
কিছু কিছু বিজ্ঞান পেশার ব্যক্তি আছেন, যারা তাঁদের আজন্ম লালিত ধর্মীয় ধারণাগুলোকে বিজ্ঞানের কাছে নতজানু হতে দেখে ধর্মতত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত এবং অতিন্দ্রীয়তার অস্তিত্ব প্রমাণের জন্য মিথ্যা ও শঠতার আশ্রয় নিতে পিছ-পা নন। ধর্মতত্ত্ব ও অতীনন্দ্রিয়তাকে বিজ্ঞান সম্মত বলে প্রচার করার অক্লান্ত চেষ্টা করে চলেছেন পরামনোবিজ্ঞানী (Para-psychologist) নামের অ-মনোবিজ্ঞানীরা। আজ পর্যন্ত তাঁদের এই চেষ্টা প্রচারের স্তরেই রয়ে গেছে, পরামনোবিদ্যা প্রকৃতি বিজ্ঞানের (মেথডলজি) অনুসরণ করে বিজ্ঞানের দরবারে অতীন্দ্রিয় ক্ষমতা, প্ল্যানচেট, জাতিস্মর মানুষের অস্তিত্ব প্রমাণের জন্য নানাধরনের কুটকৌশলের আশ্রয় নিয়েছেন। যদিও সেই সব কৌশলের একটিও বিজ্ঞানের দরবারে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। গ্রহণযোগ্য হয়নি কোনো যুক্তিবাদী মানুষের কাছে। কারণ, পরামনোবিজ্ঞানীদের দেওয়া প্রতিটি পরীক্ষার ক্ষেত্রেই ছিল কৌশল গ্রহণের সুযোগ।
ভারতীয় সমাজকে কুসংস্কারের অন্ধকার থেকে বিজ্ঞানের আলোতে আনার জন্য যখন বুদ্ধিজীবী ও যুক্তিবাদীদের প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি, তখন এক শ্রেণীর কুসংস্কারাচ্ছন্ন ‘বুদ্ধিজীবী’ মানুষই অতিন্দ্রীয়তাকে, অবতারবাদকে, জন্মান্তরকে, জ্যোতিষশাস্ত্রকে প্রতিষ্ঠিত করে প্রগতির চাকাকে উল্টো দিকে ঘোরাতে চাইছেন।
শিক্ষার ডিগ্রীধারী সংস্কারবদ্ধ মানুষ, অবতারদের কৌশলকে ব্যাখ্যা করতে না পারা সমাজে প্রতিষ্ঠা পাওয়া আত্মগর্বী মানুষ, কৌশলে অতীন্দ্রিয়তাকে প্রতিষ্ঠা করতে চাওয়া বিজ্ঞান শাখার মিথ্যাচারী মানুষগুলোই আজকের সমাজে যুক্তিবাদী ও বিজ্ঞান-মনস্ক মানুষগড়ার কাজে সবচেয়ে বড় বাধা।
আমাদের দেশে স্বল্প-শিক্ষিত, ডিগ্রিহীন, সংস্কারমুক্ত, যুক্তিবাদী স্বচ্ছ বৈজ্ঞানিক মানসিকতার মানুষ আমি দেখেছি। আবার একই সঙ্গে দেখেছি ‘যুক্তিবাদী’, ‘বিজ্ঞামনস্ক’, এবং সংগ্রামী বলে স্ব-বিজ্ঞাপিত কিছু সমাজশীর্ষ মানুষের ঈর্ষার নানা রূপ। ঈর্ষা তাঁদের কখনো নিয়োজিত করছে যুক্তিবাদী মানুষের সংস্কারমুক্তির সংগ্রামের বিরুদ্ধে, কখনো বাধ্য করছে যুক্তিহীনতাকে আশ্রয় করতে।
জানি, প্রতিটি ক্ষেত্রেই শেষ পর্যন্ত অনিবার্যরূপে যুক্তিবাদী মানসিকতা যুক্তিহীনতার বিরুদ্ধে ঝী হবেই। বিরোধীরা এই জয়কে বিলম্বিত করতে পারে মাত্র, আজ পর্যন্ত স্তব্ধ করতে পারেনি এবং পারবেও না। ইতিহাস অন্তত এই শিক্ষাই দিয়েছে।
১. অধ্যায়ঃ এক
১.৩ যুক্তিবাদী, মুক্তচিন্তার সেইসব মানুষ
২. অধ্যায়ঃ দুই
২.১ কুসংস্কারের বিরুদ্ধে বিজ্ঞান
২.২ শাসক শ্রেণির স্বার্থে কুসংস্কার পুষ্ট হচ্ছে
৩. অধ্যায়ঃ তিন
৩.২ বিখ্যাত মহারাজের শূন্যে ভাসা
৩.৩ ব্ল্যাক আর্ট ছাড়া সাধিকার শূন্যে ভাসা
৩.৪ লাঠিতে হাতকে বিশ্রাম দিয়ে শূন্যে ভাসা
৩.৫ বেদে-বেদেনীদের শূন্যে ভাসা
৩.৭ সাঁই বাবাঃ সাঁইবাবার অলৌকিক ঘড়ি-রহস্য
৩.১১ শূন্য থেকে হার আনলেন ও হার মানলেন সাঁই
৩.১২ সাঁইবাবার চ্যালেঞ্জঃ পেটে হবে মোহর!
৩.১৬ যে সাধকরা একই সময়ে একাধিক স্থানে হাজির ছিলেন
৩.১৭ অতিন্দ্রীয় ক্ষমতার তান্ত্রিক ও সন্ন্যাসীরা
৩.২০ অবতারদের নিজদেহে রোগ গ্রহণ
৩.২৬ বকনা গরুর অলৌকিক দুধ ও মেহবেব আলি
৩.২৭ বাবা তারক ভোলার মন্দির ও শ্রীশ্রীবাসুদেব
৩.২৮ যোগে বৃষ্টি আনলেন শিববাল যোগী
৩.২৯ চন্দননগরে সাধুর মৃতকে প্রাণ-দান
৩.৩০ ভগবান শ্রীসদানন্দ দেবঠাকুর
৪. অধ্যায়ঃ চার
৫. অধ্যায় পাঁচ
৬. অধ্যায়ঃ ছয়
৬.১ হিস্টিরিয়া, গণ-হিস্টিরিয়া, আত্ম-সম্মোহন, নির্দেশ
৭. অধ্যায়ঃ সাত
৭.২ সম্মোহনে আত্মা এলো ‘সানন্দা’য়
৭.৩ সম্মোহন নিয়ে নানা ভুল ধারণা
৮. অধ্যায়ঃ আট
৮.১ Illusion (ভ্রান্ত অনুভূতি)
৮.২ Hallucination (অলীক বিশ্বাস)
৮.৩ Delusion মোহ, অন্ধ ভ্রান্ত ধারণা
৯. অধ্যায়ঃ নয়
৯.২ ধর্মের নামে লোক ঠকাবার উপদেশ কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে
৯.৩ সোমনাথ মন্দিরের অলৌকিক রহস্য
৯.৪ প্রাচীন মিশরের ধর্মস্থান রহস্য
৯.৫ কলকাতায় জীবন্ত শীতলাদেবী ও মা দুর্গা
৯.৭ খেজুরতলার মাটি সারায় যত রোগ
৯.১৩ বার্মুডা ট্র্যাঙ্গেল রহস্য
১০. অধ্যায়ঃ দশ
১১. অধ্যায়ঃ এগারো
১১.২ ডুবোজাহাজে টেলিপ্যাথির পরীক্ষা
১১.৩ টেলিপ্যাথির সাহায্যে নোটের নম্বর বলা
১১.৪ টেলিফোনে টেলিপ্যাথিঃ আয়োজক লন্ডনের ‘সানডে মিরর’
১১.৭ টেলিফোন টেলিপ্যাথির আর এক আকর্ষণীয় ঘটনা
১১.৮ এমিল উদ্যা ও রবেয়ার উদ্যা’র টেলিপ্যাথি
১১.৯ অতীন্দ্রিয় ইউরি গেলারকে নিয়ে ‘নেচার’ (Nature)-এর রিপোর্ট
১১.১০ আই আই টি-তে টেলিপ্যাথি দেখালেন দীপক রাও
১১.১১ তবু প্রমাণ করা যায় তেলিপ্যাথি আছে
১২. অধ্যায়ঃ বার
১২.২ নায়াগ্রা জলপ্রপাত ভেঙ্গে পড়ার ভবিষ্যদ্বাণী
১৩. অধ্যায়ঃ তের
১৩.২ সাধু-সন্ন্যাসীদের অতীন্দ্রিয় দৃষ্টি
১৩.৩ ইউরি গেলারের অতীন্দ্রিয় দৃষ্টি
১৪. অধ্যায়ঃ চোদ্দ
১৪.২ মানসিক শক্তিতে রেলগাড়ি থামানো
১৪.৪ স্টীমার বন্ধ করেছিলেন পি.সি. সরকার
১৪.৬ লিফট ও কেবল-কার দাঁড় করিয়েছিলেন ইউরি গেলার
১৪.৭ মানসিক শক্তি দিয়ে গেলারের চামচ বাঁকানো
১৪.৯ ‘নিউ সায়েন্টিস্ট’ –এর পরীক্ষায় ইউরি এলেন না
১৫. অধ্যায়ঃ পনের
১৬. অধ্যায়ঃ ষোল
১৬.১ অধ্যায়ঃ ভাববাদ বনাম যুক্তিবাদ বা বস্তুবাদ
১৬.২ মুক্ত চিন্তার বিরোধী ‘মনু সংহিতা’
১৬.৩ আধ্যাত্মবাদ ও যুক্তিবাদের চোখের আত্মা
১৬.৪ আত্মা, পরলোক ও জন্মান্তর বিষয়ে স্বামী অভেদানন্দ
১৬.৫ স্বামী বিবেকানন্দের চোখে আত্মা
১৬.৬ আত্মা নিয়ে আরও কিছু বিশিষ্ট ভাববাদীর মত
১৬.৭ আত্মা প্রসঙ্গে চার্বাক বা লোকায়ত দর্শন
১৭. অধ্যায়ঃ সতের
১৭.১ জাতিস্মররা হয় মানসিক রোগী, নয় প্রতারক
১৮. অধ্যায়ঃ আঠারো
১৮.১ জাতিস্মর তদন্ত-১: দোলনচাঁপা
১৮.২ জাতিস্মর তদন্ত ২: জ্ঞানতিলক
১৮.৩ জাতিস্মর তদন্ত ৩: ফ্রান্সিস পুনর্জন্ম
১৮.৪ জাতিস্মর তদন্ত ৪: সুনীল দত্ত সাক্সেনা
১৮.৬ জাতিস্মর তদন্ত ৬: কলকাতায় জাতিস্মর
১৯. অধ্যায়ঃ ঊনিশ
১৯.২ উনিশ শতকের দুই সেরা মিডিয়া ও দুই জাদুকর
১৯.৩ প্ল্যানচেটের ওপর আঘাত হেনেছিল যে বই
১৯.৪ স্বামী অভেদানন্দ ও প্রেত-বৈঠক
১৯.৫ বন্ধনমুক্তির খেলায় ভারতীয় জাদুকর
১৯.৬ রবীন্দ্রনাথের প্ল্যানচেট-চর্চা
২০. অধ্যায়ঃ বিশ
“অলৌকিক নয়,লৌকিক- ১ম খন্ড ” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ