কার্ল মার্কস পৃথিবীর সর্বকালের শ্রেষ্ঠ সমাজবিজ্ঞানীদের অন্যতম। জন্ম ১৮১৫ সালের ৫ মে, জার্মানির ট্রায়ার শহরে।

প্রথম যৌবনে জার্মানির অত্যন্ত নামী দার্শনিক জর্জ হেগেল-এর মতবাদে অনুপ্রাণিত হন। সমাজ বিষয়ে মার্কস যে নিজস্ব মতবাদ গড়ে তুলেছিলেন, তাতে স্পষ্টতই হেগেলের প্রভাব ছিল। দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ, ঐতিহাসিক বস্তুবাদ, রাষ্ট্র, আমলাতন্ত্র ইত্যাদি বিষয়ে সংজ্ঞা ও ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে মার্কস হেগেলের চিন্তার ছায়ায় বিচরণ করেছেন।

হেগেলের চিন্তাতেই সর্বপ্রথম গোটা মানব সমাজের পরিবর্তনের একটা বিস্তৃত রূপ ফুটে ওঠে। কিন্তু একই সঙ্গে হেগেল ছিলেন একজন ভাববাদী। তাঁর মতামত ‘Hegel’s Absolute Idealism’ নামে বিখ্যাত ।

আক্ষরিক অনুবাদের পরিবর্তে ভাবানুবাদ করে আমরা বলতে পারি ‘হেগেলীয় পরম ভাববাদ’। হেগেল তাঁর মতবাদে বলেছিলেন, মন (mind) ও জড় পদার্থ (matter) পরস্পর বিরোধী মনে হলেও আসলে দু’য়ের মধ্যেই পরমচৈতন্যের (absolute consciousness) প্রকাশ ঘটে। এই যে বিরোধ বা দ্বন্দ্ব, তা আসলে দুয়ের সমন্বয়েরই প্রকাশ ।

একটা সময় এলো যখন হেগেলের ভাববাদী মতবাদকে ভুল বলে মার্কস খণ্ডন করলেন। এই সময়ে জার্মানির অন্যতম দার্শনিক ছিলেন লুডউইগ ফায়ারবাখ। ফায়ারবাখের মতামতের প্রতি মার্কস আকৃষ্ট হলেন।

ফায়ারবাখের মতামত ছিল বড় বেশিরকমের বস্তু (matter) নির্ভর। মানুষের চিন্তা-ভাবনা-যুক্তি তাঁর কাছে ছিল একেবারেই মূল্যহীন। মানুষের কর্মময় জীবন নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে চিন্তা-ভাবনার সামান্যতম অবদান আছে বলে তিনি মনে করতেন না। মনে করতেন সময়ের প্রয়োজনে বিভিন্ন চরিত্রের জন্ম। সময়ের প্রয়োজনেই বিভিন্ন প্রতিভার আবির্ভাব। আলেকজান্ডার থেকে শেক্সপিয়ার সবারই আবির্ভাব সময়ের প্রয়োজন মেটাতে। যেন, যা ঘটে চলেছে, তা ঘটতোই। সব-ই অনিবার্য। এও এক নিয়তিবাদ। সবই বড় বেশি রকমের যান্ত্রিক।

এক সময় ফায়ারবাখের মতবাদকে মার্কস ‘যান্ত্রিক বস্তুবাদ’ হিসেবে চিহ্নিত করেন। মানব সমাজকে চিনতে-জানতে মার্কস বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গভীর ভাবে পড়াশুনো শুরু করেন। তারই পরিণতিতে পৃথিবী পেলো মার্কসের প্রয়োগ দর্শন Philosophy of Practice’, যা সত্যই অমূল্য।

মার্কস তাঁর সমাজতত্ত্বে নানা ভাবে ব্যাখ্যা করে আদিম মানব সমাজ থেকে আগামী কালের আর্থ-সামাজিক বিন্যাস ও বিবর্তনের কথা বললেন। মানুষের দ্বারা মানুষকে শোষণ করার যে প্রক্রিয়া চলছে, তার অবসান ঘটানোর দিশা দেখাতে চাইলেন। মানুষের চিন্তা-বুদ্ধি-যুক্তির ওপর গুরুত্ব দিলেন। তিনি বললেন, মানুষ যখন যুক্তির প্রয়োগ করে তখন একটা বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই করে। যুক্তি মেনে চললে বস্তুবাদী হতেই হয়।

মার্কসের মতবাদ নিরীশ্বরবাদী, নিয়তিবাদ বিরোধী, আত্মার অমরত্ব তত্ত্বের বিরোধী। বস্তুবাদী মার্কসের মতামতে অলৌকিত্বের কোনও জায়গা নেই।

মার্কস ছিলেন সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মানবতাবাদী। তিনিই প্রথম

স্বপ্ন দেখিয়ে ছিলেন শোষণহীন সমাজের। মার্কস মনে-প্রাণে

বিশ্বাস করতেন, মার্কসবাদ সমাজ বিজ্ঞান,

মার্কসবাদ কোনও সামগ্রিক

দর্শন নয় ।

১৮৮৩ সালে মার্কসের মৃত্যু ‘দাস ক্যাপিটেল’ গ্রন্থের কাজ শেষ না করেই। শেষ করলেন মার্কসের সহযোদ্ধা এ্যঙ্গেলস। ১৯১৭ সালে লেনিনের নেতৃত্বে ঘটলো রুশ বিপ্লব। মার্কসবাদকে দেশোপযোগী, কালোপযোগী করতে লেনিন লিখলেন চৌত্রিশ খণ্ডের গ্রন্থ। এই গ্রন্থে উৎসারিত মতবাদই ‘লেনিনবাদ’ নামে খ্যাত।

এখনকার কিছু ‘অতি বিপ্লবী’ লেনিনকে ‘শোধনবাদী’ বলেন। মার্কসবাদে গতিশীল করতে গিয়ে সেইসব বালখিল্যের খোঁচা লেনিনকে সহ্য করতে হয়েছিল, যারা স্থবিরপন্থী। কিন্তু এরপরও ‘মার্কসবাদ-লেনিনবাদ’ শব্দটি একই সঙ্গে উচ্চারিত হয় প্রায় সর্বত্র। মার্কসবাদ-লেনিনবাদকে দেশোপযোগী ও কালোপযোগী করে চিন ও ভিয়েতনামে সার্থক প্রয়োগ করেছিলেন মাও জে দং এবং হো চি মিন।

‘বস্তুবাদ’ বা ‘মার্কসবাদ-লেনিনবাদ’ এতই বিশাল এক তাত্ত্বিক মতবাদ যে, তার থেকে অতি সংক্ষেপে কিছু জরুরি মতামত তুলে দেওয়াটা আমার পক্ষে হয়তো বড় রকমের ধৃষ্টতা হয়ে যাচ্ছে। প্রয়োজনের তাগিদে এমন একটা ধৃষ্ট কাজে বাধ্য হচ্ছি বলে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। লেখার এই অংশটা একটু বেশি অ্যাকাডেমিক । কারও কারও কাছে বিরক্তিকর মনে হতে পারে জেনেও লেখার প্রয়োজন অনুভব করছি।

 

নির্যাসে বস্তুবাদ, মার্কসবাদ-লেনিনবাদ

মার্কসবাদে বিশ্বাসীরা বস্তুবাদী। বস্তুবাদীদের চিন্তায়—বস্তুময় পৃথিবীর সৃষ্টি চৈতন্যময় মানুষের আগে। তারপর পরিবেশগত নানা বিবর্তনের মধ্য দিয়ে এক সময় এমন একটা অনুকূল অবস্থা এসেছে, যখন প্রাণের সৃষ্টি হয়েছে। এক কোষী প্রাণী থেকে উদ্ভিদ ও প্রাণীর সৃষ্টি হয়েছে দীর্ঘ বিবর্তনের মধ্য দিয়ে। বিবর্তনের মধ্য দিয়েই আধুনিক মানুষের উৎপত্তি।

  • বস্তুর সৃষ্টি নেই, ধ্বংস নেই। চিরন্তন। মানুষের দেহ বস্তু দিয়েই তৈরি। বস্তুই মুখ্য। চৈতন্য বস্তুরই পরিবর্তিত রূপ।

(What is Philosophy ? by G. Kirilenko, L. Korshunova, Progress Publishers, Moscow, 1985-এর নির্যাস)।

মার্কসবাদ চায় শ্রেণীহীন একটা সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করতে। এই সমাজ ‘শোষক’ ও ‘শোষিত’ এই দুটি শ্রেণী থাকবে না। থাকবে না কোনও শোষণ ব্যবস্থা। প্রতিষ্ঠিত হবে শ্রমিকশ্রেণীর একনায়কত্ব।

মার্কসীয় চিন্তায় ‘রাষ্ট্র’ হল শ্রেণীবিভক্ত সমাজে রাজনৈতিক ক্ষমতার হাতিয়ার। রাষ্ট্রের মূল নীতি হল, অর্থনৈতিক ক্ষমতার অধিকারীদের একনায়কত্ব।

  • ‘প্রলেতারিয়েত’ শব্দের অর্থ হল শ্রমিক শ্রেণী। শ্রমিকরা পুঁজিপতিদের কাছে শ্রম বিক্রি করে পুঁজিপতি দ্বারা শোষিত হয়। শোষিত এই শ্রমিক শ্রেণীই জনগণের সংগ্রামকে পরিচালনা করে এবং শেষ পর্যন্ত শ্রমিক শ্রেণীর একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা করে। অবসান ঘটে শোষণের ।
  • মার্কসবাদের মতে, বস্তুবাদ নির্ভর করে যুক্তি, বিজ্ঞান ও কাণ্ডজ্ঞানের উপরে। একজন বস্তুবাদীর মধ্যে থাকবে জিজ্ঞাসা। এই জিজ্ঞাসাই তাকে পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসন্ধান ও যাচাই করতে উদ্দীপ্ত করবে। যুক্তির প্রয়োগ করবে বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে। এগুলোই হল দৃষ্টিভঙ্গির বৈশিষ্ট্য।

 

‘মার্কসবাদ-লেনিনবাদ’ সমাজবিদ্যার বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য হলঃ
  • সমাজে এই তত্ত্ব প্রয়োগের আগে যে অঞ্চলে প্রয়োগ করা হবে সেই অঞ্চলের মানুষদের বিষয়ে নানা রকমের তথ্য সংগ্রহ জরুরি। তথ্য সংগ্রহ করতে হবে সরাসরি মানুষের কাছে গিয়ে প্রশ্নমালার ভিত্তিতে। প্রশ্নমালা এমন হবে যাতে এর সাহায্যে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর, গোষ্ঠীর ও পেশার মানুষদের আর্থিক অবস্থা, শ্ৰমিক-মালিক সম্পর্ক, শ্রমিক সংগঠনের সঙ্গে সম্পর্ক, তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস, কুসংস্কার, শিক্ষা, সাধারণ জ্ঞান, দক্ষতা ইত্যাদি সম্পর্কে বিস্তৃতভাবে জানা যায়।”
  • এই সমীক্ষার ওপর ভিত্তি করে আমরা সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারি, কীভাবে এই জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক চেতনা বৃদ্ধি করবো।
    • দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের ওপর নির্ভর করে মার্কস মানুষের বিবর্তনের যে বিশ্লেষণ করেছেন, তাকে বলা হয় ঐতিহাসিক বস্তুবাদ।

    মানব সমাজের বিবর্তন বা পরিবর্তনের ক্রমপর্যায়গুলো হল— আদিম গোষ্ঠীতান্ত্রিক, দাসপ্রথাধীন, সামন্ততান্ত্রিক, পুঁজিতান্ত্রিক, সমাজতন্ত্র, কমিউনিজম।

    • প্রত্যেক দেশের সামাজিক ও প্রাকৃতিক কিছু নিজস্বতা ও বৈশিষ্ট্য রয়েছে। তাই এক দেশের বিপ্লবের প্রয়োগ কৌশল আর এক দেশে যান্ত্রিক ভাবে প্রয়োগ করলে ব্যর্থ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। (হো চি মিন বলতেন, একজন সাচ্চা কমিউনিস্টকে প্রাথমিকভাবে একজন জাতীয়বাদী হতে হবে। তারপর নিজেকে একজন আন্তর্জাতিকতাবাদী হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। নিজের দেশের মানুষ, দেশের প্রকৃতিকে ঠিক-ঠাক মতো চিনে না নিতে পারলে, বিপ্লব পরিস্থিতি গড়ে তোলা সম্ভব নয়)।
    • ‘উৎপাদন সম্পর্ক’ মার্কসবাদ-লেনিনবাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ শব্দ। উৎপাদন, বণ্টন, বিনিময় ও ভোগের প্রক্রিয়ার সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক-ই হল উৎপাদন সম্পর্ক । • উৎপাদন সম্পর্কের পরিবর্তনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের সমাজ পরিবর্তনের ইতিহাস।
    • ‘সমাজ’ হল একটা ব্যবস্থা এবং জনগণ তার মূল উপাদান।
    • সমাজের ‘বনিয়াদ’ বা কাঠামো হল উৎপাদন সম্পর্কের প্রণালী। ‘উপরিকাঠামো’ হল রাজনীতি অর্থনীতি থেকে নন্দনতত্ত্ব, কুসংস্কার, উপাসনা-ধর্ম ইত্যাদি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সমস্ত কিছু।
    • ‘বনিয়াদ’ ‘উপরিকাঠামো’কে প্রভাবিত করে। আবার উপরিকাঠামো বনিয়াদকে প্রভাবিত করে।
    • পুঁজিতন্ত্র থেকে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন সমাজ জীবনের সমগ্র পরিমণ্ডলের মৌলিক গুণগত পরিবর্তন। কী মালিকানা সম্পর্কের, কী সাংস্কৃতিক জগতের—সর্বত্রই এই গুণগত পরিবর্তন জরুরি।

    সমাজতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য হল—ব্যক্তিমালিকানার পরিবর্তে সমাজের সকলের মালিকানার প্রতিষ্ঠা। তারপর যা সব চেয়ে জরুরি তা হল, পরিকল্পিত অর্থনীতি গ্রহণ করে শোষণের অবসান ঘটানো।

    • সমাজতন্ত্রের নীতি প্রত্যেকের কাছ থেকে তার সামর্থ অনুসারে কাজ নেওয়া ও প্রত্যেককে তার কাজ অনুসারে পারিশ্রমিক দেওয়া। একজন ডাক্তার ও একজন অদক্ষ কর্মী একই সুযোগ-সুবিধে ও পারিশ্রমিক পাবে না। সবার সন্তানের শিক্ষার দায়িত্ব নেওয়া হবে। কেউ সামর্থ থাকা সত্ত্বেও শ্রম দিতে না চাইলে তাকে নির্বাসনে পাঠানো হবে। কেউ অক্ষম হয়ে পড়লে তার দায়িত্ব দেশ নেবে ।

    জাতিভেদ প্রথা ও কুসংস্কার উৎখাত করা ছাড়া সমাজবিকাশ অসম্ভব। (What Is Historical Materialism? Progress Publihers, Mowcow 1985., Page 96)

    লেনিন অত্যন্ত জোর দিয়ে বলেছিলেন—কোনও পার্টি ঠিক পথে চলছে কি না—সেটা বিচার করতে হবে সেই পার্টির কাজ-কর্ম বিশ্লেষণ করে। পার্টির গাল ভরা বিপ্লবী নাম ও কর্মসূচীর ঘোষণা দেখে নয়। (V.L.Lenin ‘The Grand Total”, Collected Works, Vol 17, Page 294 )

    বুর্জোয়া গণতন্ত্র (যে গণতন্ত্র ভারত সহ বহু দেশে প্রচলিত) আসলে শ্রমজীবী ও শোষিত মানুষদের ওপর সংখ্যালঘু ধনী শোষকদের একনায়কত্ব।

    মার্কসবাদ একটি নিরীশ্বরবাদী মতবাদ। এই মতবাদে আত্মার অমরতা, নিয়তিবাদ, অলৌকিক বিশ্বাসকে অস্বীকার করা হয়েছে। মার্কসবাদী হওয়ার আবশ্যিক শর্তের মধ্যে পড়ে—তাকে নিরীশ্বরবাদী হতে হবে, আত্মাকে অবিনশ্বর মনে করা ও নিয়তিবাদে বিশ্বাস করা ছাড়তে হবে।

    • আদিম মানুষ প্রাকৃতিক শক্তিতে ভয় থেকে পুজো করতো। আধুনিক যুগের অজ্ঞ মানুষও নিজের অসহায় শোষিত অবস্থা থেকে মুক্তির কামনায় উপাসনা-ধর্মে ও ঈশ্বরে বিশ্বাস করে। ধর্ম (religion) শোষণ ব্যবস্থাকে আড়াল করতে সাহায্য করে। এ’ভাবেই ধর্ম শোষণ ব্যবস্থাকে টিকে থাকতে সাহায্য করে। ধর্ম শেষিতদের শিক্ষা দেয় সহনশীলতা ।

    এই হল খুব সংক্ষেপে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ, যা একই সঙ্গে নিরীশ্বরবাদী ও শোষণহীন সমাজ তৈরি করতে প্রত্যয়ী একটি সমাজ বিজ্ঞান।

 

মার্কসবাদের সেই সময়, এই সময়

কার্ল মার্কস পৃথিবীর প্রথম চিন্তাবিদ, দার্শনিক, যিনি শোষণহীন এক সমাজ ব্যবস্থার কথা বলেছিলেন। তাঁর আগে শোষণকে মানুষ স্বাভাবিক সামাজিক নিয়ম বলেই মনে করতো। পৃথিবীতে রাজা-প্রজা থাকবে, ধনী-গরিব থাকবে, কেউ খাটবে কেউ খাটাবে—এমনটাই তো নিয়ম। শোষিত মানুষদের মধ্যে নতুন ভাবনা এনে দিলেন মার্কস। মার্কসকে শুধু সমাজবিজ্ঞানী ভাবলে ভুল হবে। তিনি বিভিন্ন বিষয়ে গভীর পাণ্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন।

একশো বছরের বেশি সময় আগে মার্কস যা লিখে গিয়েছিলেন, তা হয়তো সেই সময়ে প্রয়োগ করার অবস্থায় ছিল। মার্কস তাঁর জীবনকালে ধনতন্ত্রের যে রূপ, কাঠামো ও বৈশিষ্ট্য দেখেছিলেন তা ছিল ধনতন্ত্রের ‘হাটি হাটি পা-পা’ অবস্থা। ধনতন্ত্র এখন যে চূড়ান্ত পর্যায়ে উঠেছে, তাতে ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্র শক্তির সমস্ত রকম ক্ষমতাই বিশালতা পেয়েছে। ধনতান্ত্রিক রাষ্টগুলোর অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ আজ বহুজাতিক সংস্থাগুলোর হাতে। বহুজাতিক সংস্থাই ঠিক করে দিচ্ছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের অর্থনীতি, বিদেশনীতি, দেশের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন বিষয় থেকে কৃষিনীতি পর্যন্ত ।

কোন সরকারকে ফেলতে হবে, কোথায় সেনা অভ্যুত্থান ঘটাতে হবে,

কোন রাষ্ট্র নায়ককে হত্যা করতে হবে—সবই ঠিক-ঠাক মতো করে

চলেছে ধনতান্ত্রিক শক্তি। ‘পেপসি-কোকাকোলা’ নিজেদের

স্পনসরকারী ক্রিকেট টিমকে জেতাতে ‘ম্যাচ ফিক্স’

করতে নেমে পড়েছে।

বিশ্বকাপ ফুটবলেও কালো ছায়া পড়েছে ক্রীড়া সরঞ্জাম প্রস্তুতকারক কোম্পানি ‘নাইক’, ‘রিবক’-এর। এ’হল দুই ধনী সংস্থার নিজেদের মধ্যেকার লড়াইকে খেলার জগতে নিয়ে আসার পরিণতি।

ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ইনফরমার ছড়িয়ে রয়েছে রাজনীতিক, বুদ্ধিজীবী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক জগতের বিভিন্ন স্তরে। এ’ছাড়াও নজরদারি করার জন্য অর্থ সাহায্যের নামে এক ধরনের দালাল তৈরি করা হয়েছে, যাদের বলা হয় এন. জি. ও বা বে-সরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। দেশের কোনও প্রান্তে শোষিতদের চেতনার জাগরণের কোনও প্রয়াস হলেই ধনতন্ত্রের তান্ত্রিকদের কাছে সে খবর মুহূর্তে পৌঁছে দিচ্ছে দালালরা। শত্রুকে অঙ্কুরে বিনাশ করাই ধনতন্ত্রের বর্তমান নীতি। যে দেশে এমন ‘ধনতন্ত্র বিরোধী ষড়যন্ত্র’ হচ্ছে, সে দেশের সরকারকে এ’বিষয়ে ওয়াকিবহাল করা হচ্ছে। সরকার তার সেনা-পুলিশ-প্রশাসন নিয়ে এমন সন্ত্রাস তৈরি করছে, যাতে শোষিতদের চেতনাকে জাগাবার কথা চিন্তা করতে গেলে ভয়ে শরীর হিম হয়ে যায়, দক্ষিণ আমেরিকা থেকে এশিয়া, পাকিস্তান থেকে ভারত—সর্বত্র একই অবস্থা ।

এই পরিবর্তিত অবস্থাতেও মার্কসবাদকে অপরিবর্তিত রেখে প্রয়োগ সম্ভব বলে অনেক মার্কসভক্তরাই মনে করেন। এইসব গোঁড়া মার্কসভক্তরা তাঁদের সীমাবদ্ধ জ্ঞান নিয়ে, সমাজ থেকে মুখ ফিরিয়ে রেখে যেমনটা ভাবেন, সমাজের বাস্তব চিত্র আদৌ তেমনটা নয়।

মার্কসের পর মার্কসবাদকে বিকশিত করার জন্য কোনও

ইতিবাচক চেষ্টা না হলে মার্কসবাদ শুধু

ইতিহাস হয়েই থেকে যাবে।

মার্কস মনে করেছিলেন শ্রমিক শ্রেণীই সবচেয়ে শোষিত শ্রেণী। সুতরাং ধনতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিপ্লবে নেতৃত্ব দেবে এই সর্বহারা শ্রমিকরা। মার্কস যখন এই উপলব্ধিতে গিয়েছিলেন, তখন হয় তো শ্রমিকদের অবস্থাটা তেমনই ছিল। কিন্তু আজকের শ্রমিকশ্রেণীকে সবচেয়ে শোষিত, সর্বহারা শ্রেণী বলে চিহ্নিত করলে ভুল হবে। এখন শ্রমিকদের আর্থিক অবস্থা অনেক পাল্টেছে। আজ বড় শিল্পপতিদের অধীন শ্রমিকদের ফ্রিজ, টিভি, টু-হুইলার বা কার থাকাটা সাধারণ ব্যাপার। তুলনায় ক্ষেতমজুরদের শোষণ এ’দেশে অনেক বেশি। ক্ষেত মজুরদের হাতে নগদ টাকা নেই, যা দিয়ে লজ্জা ঢাকতে কাপড় কিনতে পারে, রোগ হলে ওষুধ কিনতে পারে। দু-বেলা খাবার খাওয়াটাই যেন বিলাসিতা।

ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শ্রমিকরা নিশ্চিত জীবনের যে স্বাদ পাচ্ছে, তাতে

তারা ধনতন্ত্রের উচ্ছেদে নেতৃত্ব দেবে—ভাবনাটার মধ্যে একটা বড়

রকমের ভুল রয়েছে। বরং সর্বহারা শ্রেণী বলতে আমরা শোষিত,

বঞ্চনার শিকার অসংগঠিত ক্ষেত মজুরদের চিহ্নিত করতে

পারি। মার্কসবাদকে এগিয়ে নিয়ে

যাওয়ার স্বার্থেই পারি।

মার্কসবাদ বলে, উৎপাদন সম্পর্কের উপর শ্রেণীগত অবস্থান গড়ে ওঠে। পুঁজির মালিক-ই উৎপাদন ব্যবস্থার অধিকারী বা বুর্জোয়া। পারিশ্রমিক দিয়ে শ্রমিকের শ্রম কেনে। শ্রম থেকে উৎপাদিত জিনিস বিক্রি করে সে অর্থের পাহাড় গড়ে। শ্রমিককে ঠকিয়েই মালিক মুনাফা করে। এই সর্বহারা শ্রমিকরা হল ‘প্রোলিতারিয়েত’। বুর্জোয়া ও প্রলেতারিয়েতদের মাঝখানে রয়েছে মধ্যবিত্ত শ্রেণী বা ‘পেটি-বুর্জোয়া’। বিপ্লবের প্রক্রিয়ায় পেটি-বুর্জোয়ার অবস্থান প্রায় শূন্য। অর্থাৎ মধ্যবিত্তদের সমাজে অবস্থানও প্রায় শূন্য ।

মার্কস তাঁর ‘ক্যাপিটাল’ গ্রন্থে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে ফেলেছিলেন কৃষক, হস্তশিল্পী, ক্ষুদ্র উৎপাদক, সরকারি কর্মচারী, শিক্ষক, সুপারভাইজার ইত্যাদি পেশার মানুষদের মার্কস এই মধ্যবিত্তদের রক্ষণশীল শ্রেণীর মানুষ বলে চিহ্নিত করেছিলেন। বর্তমানে মধ্যবিত্তরা আর মার্কসের জমানায় নেই। বলতে কী, মার্কসীয় যুগের শ্রেণী-কাঠামোর চেহারা অনেকটাই পাল্টে গেছে। এখন আর বংশ পরম্পরায় কোম্পানির মালিকানা বর্তাচ্ছে না। মধ্যবিত্তশ্রেণী থেকে উঠে আসা পেশাদার কোম্পানি পরিচালকদের হাতে কোম্পানি পরিচালনার ভার চলে যাচ্ছে। এই পেশাদার পরিচালকরা অনেকেই পাচ্ছেন মাইনের সঙ্গে মালিকানারও অংশ ৷

ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থাও আমূল পাল্টে গেছে। এখন কোনও ব্যক্তি মালিকের খামখেয়ালিপনায় ব্যাঙ্ক চলে না। ব্যাঙ্কের কাজ-কর্ম দেখ-ভালের দায়িত্ব এখন মোটা মাইনের ডিরেকটর, ম্যানেজিং-ডিরেক্টর ও প্রফেশনাল ম্যানেজমেন্টের হাতে। এই কর্মচারীদের মার্কসীয় ধারণার মধ্যবিত্তশ্রেণীতে ফেলা যায় না।

ভারতের সর্বহারাদের রাজনৈতিক পার্টিগুলোর দিকে তাকালে দেখতে পাবেন, সেখানে সর্বহারাদের হারিয়ে মধ্যবিত্তদেরই রমরমা। সাহিত্যিক, চিন্তাবিদ, থেকে বিজ্ঞানী—সর্বত্রই একই চিত্র। মধ্যবিত্ত শ্রেণী থেকেই সবচেয়ে বেশি করে এঁরা উঠে আসছেন।

ধনতন্ত্রের বিরুদ্ধে সর্বহারাদের লড়াইতে এই নতুন গড়ে ওঠা মধ্যবিত্তশ্রেণী যে সর্বহারাদের হয়ে সর্বস্বপণ করে লড়াইতে নামবে না—এই বাস্তব অবস্থাকে বুঝতে হবে। অথচ ১৮৪৮-এর

‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’-তে বলা হয়েছে—পৃথিবীর এ’যাবৎকালের ইতিহাস

হল শ্রেণীসংগ্রামের ইতিহাস। এই শ্রেণীসংগ্রাম সমাজের পুঁজিপতি

বিত্তবানদের সঙ্গে সর্বহারা শ্রমিকশ্রেণীর মধ্যেকার সংগ্রাম।

সমাজের এই দুই শ্রেণী হল প্রধান দুই প্রতিপক্ষ।

এই দুই শ্রেণীর বাইরে বা এর মধ্যবর্তী স্তরে

যে সব শ্রেণী রয়েছে, তারা বিপ্লবী পরিস্থতি

সৃষ্টি হলেই সর্বহারা শ্রেণীর সঙ্গে

মিশে যেতে বাধ্য হবে।

হয়তো সে’সময়কার মধ্যবিত্তদের শ্রেণী অবস্থান এমনই ছিল। কিন্তু আজ মধ্যবিত্তদের মূলস্রোত-ই ধনতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াইতে নামার মতো মানসিক অবস্থাতেই নেই। তারা বরং বর্তমানের স্থিতাবস্থায় সুখী।

 

চিন ও মাওবাদ

মার্কসের মূল লক্ষ—মানুষের ওপর মানুষের শোষণের অবসান। এই লক্ষকে সামনে রেখে মাও মার্কসবাদকে সময়োপযোগী, স্থানোপযোগী করে চিনে প্রয়োগের মধ্য দিয়ে অসাধারণ সাফল্য আনলেন। চিন কৃষিপ্রধান দেশ। শতকরা ৮০ ভাগ মানুষ কৃষিনির্ভর। শিল্প নেই। শ্রমিকের সংখ্যা অতি নগণ্য। মার্কস যদিও শ্রমিকদের বিপ্লবী শ্রেণীর ও কৃষকদের ‘গ্রামীণ জড়বুদ্ধি মানুষ’ (Village idiot) বলে মনে করতেন, কিন্তু মাও তাঁর দেশের কৃষকদের শোষিত ও সংগ্রামী বলে বিশ্বাস করতেন। তিনি ‘জনগণতান্ত্রিক’ বিপ্লবের ডাক দিলেন। কৃষকদের নেতৃত্বে শুরু হল লড়াই। এই লড়াই ছিল জমিদার-জোতদার-সামন্তপ্রভু এবং ঔপনিবেশিক ও আধা- ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে। বিপ্লবের মস্তিষ্ক মাও এই লড়াইতে ধনী কৃষকদেরও সঙ্গে নিয়েছিলেন। জমিদার ও সামন্তপ্রভুদের সঙ্গে ধনী কৃষকদের একটা বিরোধ ছিল। তাই তিনি এদের মিত্রশক্তি হিসেবে সঙ্গে নিয়েছিলেন। একই সঙ্গে সহযোগী ব্যক্তি হিসাবে লড়াইতে শামিল করেছিলেন শ্রমিক, মধ্যবিত্ত, বুদ্ধিজীবী থেকে জাতীয়তাবাদী বুর্জোয়াদের পর্যন্ত। তবে মূল বিপ্লবী শক্তি হিসেবে কৃষকশ্রেণীর সন্দেহাতীত প্রাধান্য ছিল। মাও পৃথিবীর প্রথম কৃষি সাম্যবাদের রূপকার। তিনি নিজের দেশের উপযুক্ত করে বিপ্লবের পরিকল্পনা গ্রহণ করলেন, নেতৃত্ব দিলেন এবং সফল হলেন।

ভারত ও চিনে কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠা হয় প্রায় একই সময়ে। চিনা

কমিউনিস্ট পার্টি পঁচিশ বছরের মধ্যে দেশে বিপ্লব ঘটিয়ে দিল।

আমাদের দেশের কমিউনিস্ট পার্টি পঁচাত্তর বছর ধরে শুধু

কৌশল, মিছিল, বন্ধ আর নির্বাচনের

গোলকধাঁধাতেই ঘুরপাক খাচ্ছে।

 

ভারতে মাও চিন্তার প্রভাব

‘নকশালবাড়ি’ উত্তরবঙ্গের নেপাল সীমান্তে ছোট একটা গ্রাম। গ্রামবাসীদের মধ্যে আদিবাসীর সংখ্যাই বেশি। ছ’এর দশকের মাঝামাঝি। জঙ্গল সাঁওতাল ওই সময় নকশালবাড়ির কৃষক নেতা। সি.পি.আই (এম) করেন। দার্জিলিং জেলার সি.পি.আই (এম) নেতা বলতে তখন চারু মজুমদার, কানু সান্যাল, সৌরেন বসু।

১৯৬৭-র এপ্রিলের শেষ দিকে দার্জিলিং জেলা ও শিলিগুড়ি মহকুমার কৃষক সভার নেতা ও কর্মীরা ‘সিলিং’ বহির্ভূত অর্থাৎ আইন মাফিক বেঁধে দেওয়া জমি রাখার সর্বোচ্য-সীমা বহির্ভূত বে-আইনি জমি উদ্ধারের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। ২০ থেকে ২২ মে নকশালবাড়ির প্রসাদ জোতের বেনামী জমি স্থানীয় কৃষকরা দখলে রাখে। ২২ থেকে ২৫ মে চলে সংগ্রাম ও কৃষকদের সঙ্গে যুক্তফ্রন্ট পুলিশ বাহিনীর লড়াই। ১০ জন আদিবাসী কৃষকের মৃত্যু হয় ।

এই ঘটনার খবর সারা ভারতে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। সি. পি. আই. (এম) রাজ্য নেতৃত্ব চারু মজুমদার, কানু সান্যাল, সৌরেন বসু ও জঙ্গল সাঁওতালকে পার্টি থেকে বের করে দেয়। ‘৬৭-র শেষ দিকে সি.পি.আই (এম) পার্টিতে ভাঙন প্রক্রিয়া শুরু হয়। ১৯৬৯ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত নকশালবাড়ির সংগ্রাম ব্যাপকতা লাভ করে।

১৯৭১-এ বাংলাদেশকে যুদ্ধে সাহায্য করতে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধি সেনা নামালেন। সেনা নামলো দুই বাংলাতেই। এ’পার বাংলায় আতঙ্ক, অত্যাচার ও গণহত্যার মধ্য দিয়ে নকশাল আন্দোলনের একটা অধ্যায়কে শেষ করা হয়েছিল।

১৯৬৫ থেকে ১৯৬৭ পর্যন্ত চারু মজুমদার তাঁর রাজনৈতিক বক্তব্য আটটি প্রবন্ধে ব্যক্ত করেছিলেন। পরবর্তীকালে এই আটটি প্রবন্ধ আটটি দলিল হিসেবে পরিচিত হয়। প্রথম দলিলেই চারু মজুমদার জানিয়েছিলেন—ভারতীয় বিপ্লবের প্রধান স্তম্ভ কৃষি বিপ্লব।

১৯৬৭-র মে’তে যে ‘কৃষি সাম্যবাদ’ প্রতিষ্ঠার লক্ষে সংগ্রামের শুরু হয়েছিল এবং দ্রুত ব্যাপকতা পেয়েছিল—তাকে পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছিলেন মাও। ‘৬৭- র ২৬ জুলাই, ২ ও ১৭ আগস্ট এবং ১৬ ডিসেম্বর চিন থেকে প্রকাশিত ‘শিনহুয়া নিউজ এজেন্সি’-র প্রতিবেদনে নকশালবাড়ির আন্দোলন সম্পর্কে মাও-এর বক্তব্য প্রকাশিত হল। মাও এই লড়াইকে নিপীড়িত শোষিত মানুষদের যথার্থ লড়াই বলে ঘোষণা করলেন।

নকশালবাড়ির ঐতিহাসিক ঘটনা ভারতের রাজনীতি, অর্থনীতি ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে যথেষ্ট আলোড়ন তুলেছিল। বহু শিল্পী-সাহিত্যিক-গীতিকার-চিন্তাবিদ তাঁদের সৃষ্টির মধ্যে এই সংগ্রামের কথা তুলে ধরেছিলেন। এঁদের সংঘবদ্ধ করে একটা শক্তিশালী সাংস্কৃতিক বাহিনী গড়ে তোলার জরুরি প্রয়োজন ছিল।

প্রয়োজন ছিল বিপ্লবের আগে একটা সাংস্কৃতিক বাহিনীর সাহায্যে

নিয়ে জনসাধারণের সমর্থন আদায়ের। মিত্রশক্তি হিসেবে

চিন্তাবিদদের সঙ্গে পাওয়ার প্রয়োজনীয়তার যে কথা

ইয়েনানে মাও বলেছিলেন। নকশাল নেতৃত্ব

সে’কথায় তেমন আমল দিলেন না।

বিপ্লবের আগে, বিপ্লবের সময়, বিপ্লবের পরে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের যে কোনও বিকল্প নেই—তাই প্রমাণিত হয়েছে। পৃথিবী জুড়ে সমাজতান্ত্রিক দেশের নেতারা সাংস্কৃতিক আন্দোলনের বে-হাজিরায় নিজেদের দুর্নীতি ও স্বজনপোষণে এতই ব্যস্ত রেখেছেন যে, বুর্জোয়া নেতার সঙ্গে কমিউনিস্ট নেতার পার্থক্য গিয়েছিল মুছে। অনিবার্য ফল— দেশের মানুষের সমাজতন্ত্রের উপরে বিতৃষ্ণা ও ঘৃণা প্রবল হয়েছে। তারপর শুরু হয়েছিল পতনের কাউন্ট ডাউন।

নকশালবাড়ি আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ের সমাপ্তির পর বিশ্লেষণে নেমেছেন অনেকেই। কী কী কারণে সংগ্রামের বিকাশ না ঘটে এমন একটা অবস্থায় এসে দাঁড়ালো? কেন এই ব্যর্থতা?

ব্যর্থতার কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হল সাংস্কৃতিক আন্দোলন, কুসংস্কারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের অনুপস্থিতি। জনচেতনাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টার অনুপস্থিতি ।

আশির দশকে বিপ্লবের অগ্রবাহিনী হিসেবে উঠে এল সমকালীন যুক্তিবাদী আন্দোলন। যে যুক্তিবাদ সময়ের সঙ্গে তাল রেখে চির আধুনিক যুক্তিবাদ এবং একই সঙ্গে একটি সম্পূর্ণ দর্শন এবং একটি সার্বিক সাংস্কৃতিক আন্দোলন। সে আর এক ইতিহাস ।

error: Content is protected !!