দক্ষিণেশ্বরের কাছে আদ্যাপীঠের মন্দির ভারতীয় এবং হিন্দুদের কাছে এক পবিত্র মন্দির। বহু বাড়িতেই আদ্যামারূপী কালীমূর্তির ছবি যথেষ্ট ভক্তি ও বিশ্বাসের সঙ্গে পূজিত হয়। কথিত আছে, আদ্যামায়ের স্তব পাঠ করলে অনেক মুশকিলের অবসান হয়। আদ্যাস্তবেই বলা হয়েছে, তিন পক্ষকাল আদ্যাস্তব শ্রবণ করলে অপুত্রার পুত্র হয়। দু’মাস শুনলে বন্ধন মুক্তি ঘটে (জেল থেকে খালাস পেতে অপরাধীরা পরীক্ষা করে দেখতে পারেন)। মৃতবৎসা দু’মাস স্তব শ্রবণে জীববৎসা হয়। ঘরে লিখিত স্তব রেখে দিলে অগ্নি এবং চোরের দ্বারা কোন ক্ষতি হবে না (সরকারি উদ্যোগে কয়েক কোটি স্তব ছাপিয়ে প্রতিটি পরিবারপিছু একটা করে বিলি করলে আর অহেতুক ফায়ার ব্রিগ্রেড পুষতে হয় না, পুলিশের ওপরেও চাপ কমে। অন্ততঃ ব্যংকগুলো চোর-ডাকাতের হাত থেকে বাঁচতে আদ্যাস্তবের কার্যকারিতা পরীক্ষা করে দেখতে পারেন)।
আদ্যামায়ের এই কালীমূর্তি মাটি ফুঁড়ে উঠেছিলেন কলকাতার ইডেন গার্ডেনে। সালটা সম্ভবত ১৯২৮। শ্রীঅন্নদা ঠাকুর নাকি স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন যে, আদ্যাকালী গঙ্গার তীরে ইডেন গার্ডেনে হাজার হাজার বছর ধরে মাটির তলায় বন্দিনী হয়ে রয়েছেন। এবার মা তাঁর বন্দীদশা কাটিয়ে মেদিনী ভেদ করে উঠবেন। স্বপ্নাদেশ পেয়ে শ্রীঅন্নদা ঠাকুর ইডেনে গেলেন, সেখানেই পেলেন মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে আসা আদ্যাকালীকে। সেই মূর্তি প্রতিষ্ঠা করা হল দক্ষিণেশ্বরের কাছে আদ্যাপীঠের মন্দিরে। এরই মধ্যে কিছু লোক সন্দেহ প্রকাশ করলেন যে, মূর্তিটি আদৌ হাজার হাজার বছর ধরে ইডেনে ছিল না। দু-এক দিন আগে মাটিতে পোঁতা হয়েছিল। মূর্তির তলায় ঢালা হয়েছিল বস্তাখানেক শুকনো ছোলা। ছোলাতে জল ঢেলে মাটি বুজিয়ে দেওয়া হয়েছিল। শুকনো ছোলা জল পেয়ে ফুলতে শুরু করে। প্রচুর ছোলা ফুলছে, আয়তন বাড়ছে, অতএব আশেপাশে চাপও বাড়ছে, গর্তের চারপাশে চাপ বাড়লেও শক্ত মাটিতে কিছুই করারও উপায় নেই। স্বাভাবিক কারণেই ছোলার ওপর চাপানো মূর্তিটিকে ঠেলে ছোলাগুলো নিজেদের জায়গা বাড়িয়েছে। তাই মূর্তিও একটু একটু করে মাটি ঠেলে ওপরে উঠেছে। অন্য মতে মূর্তিটি পাওয়া গিয়েছিল ইডেন গার্ডেনের জলাশয়ে।
আদ্যামায়ের ভক্তেরা এসব শুনে যথেষ্ট ক্ষুব্ধ হলেন। তাঁরা ঘোষণা করলেন, কয়েক হাজার বছরের প্রাচীন কালীমূর্তিটি ওঠার পেছনে কোন চাতুরী নেই, এসবই মায়ের অলৌকিক লীলা মাত্র।
এগিয়ে এলেন বিশ্ববিখ্যাত প্রত্নতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক শ্রীরাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি আদ্যাপীঠের কালীবিগ্রহ দেখে ও পরীক্ষা করে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানালেন, এই মূর্তি সম্প্রতি তৈরি করা হয়েছে। এঁকে কয়েক হাজার বছরের প্রাচীন বলাটা নিছক মূর্খতা।
খবরটা ছড়িয়ে পড়াতে বহু সাধারণ মানুষ এই ধরণের ছলনায় ও চতুরতায় ক্ষিপ্ত হলেন। সম্ভবত সাধারণের রোষ থেকে বাঁচতে মায়ের প্রধান ভক্তেরা আদ্যামূর্তি বিসর্জন দিলেন গঙ্গায়। রটালেন, মা স্বপ্নে বিসর্জন দিতে আদেশ করেছেন।
এরপর বেশ কিছু বছর আদ্যামায়ের মন্দির বিগ্রহ-শূন্য থাকার পর বর্তমানের আদ্যামূর্তিটি তৈরি করিয়ে প্রতিষ্ঠা করা হয়।
আমাদের দেশে এই ধরনের ঘটনা অবশ্য বহুবার বহু জায়গায় ঘটেছে। কেউ স্বপ্ন দেখে মাঠে গিয়ে খুঁজে পান স্বপ্নের দেবমূর্তিকে, কেউ দেবমূর্তিকে আবিষ্কার করেন গরু খুঁজতে গিয়ে। দেখেন গরু একটি মূর্তির কাছে দাঁড়িয়ে আছে, গরুর বাঁট থেকে আপনা-আপনি দুধ ঝরে পড়ছে; কেউ নতুন কাটা পুকুরে আবিষ্কার করেন দেবমূর্তি। দেবমূর্তি আবিষ্কারের সঙ্গে-সঙ্গেই শুরু হয়ে যায় প্রচার। স্বপ্নে পাওয়া দেবতার সঙ্গে দু-একটা অলৌকিক ঘটনা জুড়ে দিতে পারলে তো কথাই নেই। অর্থ, সম্মান, প্রতিপত্তি সবই একে একে পড়বে পূজারীর হাতে।
মানুষের দুঃখকষ্ট, অসহায়তা ও মানসিক দুর্বলতার পরিণতিতে এসেছে ঈশ্বর-বিশ্বাস। ঈশ্বর মানষ সৃষ্টি করেনি, মানুষই সৃষ্টি করেছে ঈশ্বর।