প্রায় এক শতাব্দীকাল পর্যন্ত জীববিজ্ঞানীগণ চেষ্টা করিয়া আসিতেছেন মানুষের পূর্বপুরুষের নিদর্শন পাওয়ার জন্য এবং এ ব্যাপারে তাহারা কতক সাফল্যও লাভ করিয়াছেন। বিভিন্ন অঞ্চলের মাটি খুঁড়িয়া বিভিন্ন সময়ে যে সকল বিক্ষিপ্ত হাড়গোড় এবং আস্ত কঙ্কাল পাওয়া গিয়াছে, তাহা সুসংবদ্ধভাবে সাজাইয়া মানুষের বিবর্তনের একটি পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস বিজ্ঞানীরা পাইয়াছেন। উহাতে দেখা যায় যে, হাল আমল হইতে যতই অতীতের দিকে যাওয়া যায়, মানুষের চেহারা ততই বুনো হইয়া দাঁড়ায় এবং যতই বর্তমানের দিকে আসা যায়, ততই বুনো হয় আধুনিক। দৃষ্টান্তস্বরূপ দেখানো যাইতে পারে –অস্ট্রালোপিথেকাস মানুষ, জাভা ও পিকিং মানুষ, নেয়ানডার্থাল মানুষ, ক্রোমাঞ মানুষ ইত্যাদি।
অস্ট্রালোপিথেকাস মানুষ— আফ্রিকার দক্ষিণ-পশ্চিম ট্রান্সভাল অঞ্চলে ১৯২৪ সালে একটি মাটির ঢিবিকে ডিনামাইট দিয়া উড়াইয়া দেওয়া হইয়াছিল। উহার নিচে আরও কিছু মাটি খুঁড়িয়া পাওয়া গিয়াছিল ছয় বৎসর বয়সের একটি ছেলের মাথার খুলি। উহার গড়ন ছিল বানর ও মানুষের মাঝামাঝি। খুলিটির বয়স ছিল এক লক্ষ বৎসরের কিছু বেশি। ইহাকে বলা হয় অস্ট্রালোপিথেকাস মানুষ।
১৯৩৬ সালে জোহানেসবার্গ-এর নিকটবর্তী স্থান হইতে মাটি খুঁড়িয়া আর একটি মাথার খুলি ও কিছু হাড়গোড় পাওয়া গিয়াছিল। এইগুলি ছিল একটি পূর্ণবয়স্ক মানুষের। এইটিও ছিল না। মানুষ, না বানর গোছের এবং অস্ট্রালোপিথেকাসের সমবয়সী ও সমগোত্রীয়।
১৯৩৮ সালে ঐ অঞ্চল হইতে আরও একটি মাথার খুলি ও কয়েকটি দাঁত এবং ১৯৪৭ সালে ঐ রকম আরও নিদর্শন পাওয়া গিয়াছিল। সবগুলিই ছিল মানুষ ও বানরের মাঝামাঝি চেহারার এবং প্রত্যেকের বয়সই ছিল লক্ষাধিক বৎসর।
জাভা ও পিকিং মানুষ –হল্যাণ্ডবাসী ইউজেন দুবোয়া নামক একজন ডাক্তার ১৮৯০-৯২ সালে জাভা দ্বীপের পূর্বার্ধে মাটি খুঁড়িয়া বিক্ষিপ্তভাবে পাইয়াছিলেন মানুষের একটি দাঁত সহ নিচের চোয়ালের একটি হাড়, উপরের চোয়ালের ডান দিকের একটি পেষণ দাঁত, মাথার খুলি ও উরুর একটি হাড়।
প্রোক্ত কঙ্কালগুলি পর্যবেক্ষণ করিয়া জীববিজ্ঞানীরা জানিয়াছেন যে, ব্রহ্মতালুটি বানরের মতো ও উরুর হাড় অবিকল মানুষের মতো। অর্থাৎ উহা আধা বানর ও আধা মানুষ। মাটির যে স্তরে ঐ কঙ্কালসমূহ পাওয়া গিয়াছে, তাহার পুরাতনত্বের হিসাবে ঐ কঙ্কালের বয়স এক লক্ষ হইতে তিন লক্ষ বৎসরের মধ্যে।
পিকিং শহরের নিকটবর্তী স্থান হইতে একজন জার্মান ডাক্তার ১৯০২ সালে আবিষ্কার করেন একটি দাঁত, ১৯১৬ সালে একজন জীববিজ্ঞানী ঐ অঞ্চলের মাটি খুঁড়িয়া প্রাপ্ত হন কতগুলি হাড়গোড়, ১৯২৭ সালে কানাডার একজন জীববিজ্ঞানী প্রাপ্ত হন একটি দাঁত এবং ঐ একই অঞ্চল হইতে একজন চীনা, একজন ফরাসী এবং একজন আমেরিকান জীববিজ্ঞানী খুঁজিয়া পান মাথার খুলি, চোয়ালের হাড় ও দাঁত ইত্যাদি। চেহারায় ঐ পিকিং মানুষগুলি জাভা মানুষের সমগোত্রীয় ও সমবয়সী। ইহারা না মানুষ, না বানর। অর্থাৎ মানুষ ও বানরের মাঝামাঝি চেহারা।
নেয়ানডার্থাল মানুষ –জার্মানীর ডুসেলডর্ফ ও এনবেরফেণ্ড-এর মাঝখানে নেয়ানডার্থাল নামক স্থানে ১৮৫৬ সালে মৃত্তিকা খনন করিয়া পাওয়া গিয়াছিল একটি মাথার খুলি। জীববিজ্ঞানীদের মতে খুলিটি মানুষের পূর্বপুরুষের। মাটির যে স্তরে ঐটি পাওয়া যায়, তাহার প্রাচীনত্বের হিসাবে ঐ খুলিটির বয়স ৭৫ হাজার বৎসর।
১৯০৮ সালের ৩ আগস্ট তারিখে ফ্রান্সের শাপেন ও-স্যা নামক গ্রামের কাছে একটি গুহা হইতে পাওয়া গিয়াছিল একটি আস্ত কঙ্কাল। এইটি পরীক্ষা করিয়া নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হইয়াছে যে, এই কঙ্কালটি মানুষের। বিশেষত নেয়ানডার্থাল মানুষের সমবয়সী ও সমগোত্রীয়।
ঐ আস্ত ককালটি হইতে মানুষের একটি নিখুঁত ছবি পাওয়া গিয়াছে। মানুষটির মুণ্ড প্রকাণ্ড, ধড় ছোট, লম্বায় পাঁচ ফুট এক ইঞ্চি হইতে তিন ইঞ্চির মধ্যে। দুই পায়ে ভর দিয়া খাড়া হইয়া দাঁড়াইতে পারে, কিন্তু শরীর ও মাথা সামনের দিকে নুইয়া পড়ে, হাঁটু বাকিয়া যায়। শরীরের তুলনায় মুখ বড়, মাথার খুলি চ্যাটালো। অর্থাৎ মানুষ নহে, পুরাপুরি বানরও নহে। তবে মানুষের আদলটিই বেশি।
ক্রো-মাঞঁ মানুষ –১৮৬৮ সালে ফ্রান্সের দোর্দোন অঞ্চলে পাঁচটি পূর্ণাবয়ব কঙ্কাল পাওয়া যায়। উহাকে বলা হয় ক্রোমাঞ (Cro-Magnon) মানুষ। লম্বায় ৫ ফিট ১১ ইঞ্চি হইতে ৬ ফিট ১ ইঞ্চির মধ্যে। ইহাদের লম্বাটে মাথা, থ্যাবড়া মুখ, পেশীবহুল প্রত্যঙ্গ, উঁচু চোয়াল। চেহারার দিক দিয়া পুরাপুরি আধুনিক মানুষ। কালগুলির বয়স মাত্র ৩০ হাজার বৎসর।[২৬]
জীববিজ্ঞানীগণ বলেন যে, পৃথিবীতে জীবের আবির্ভাব হইয়াছে প্রায় দেড়শত কোটি বৎসর আগে। কিন্তু মানুষ বর্তমান মানুষের রূপ পাইয়াছে মাত্র ত্রিশ হাজার বৎসর আগে।
মানুষ ও পশুতে সাদৃশ্য
ধর্মাচার্যগণ বলিয়া থাকেন যে, যাবতীয় জীবের মধ্যে মানুষ ঈশ্বরের শখের সৃষ্ট জীব এবং উহা পবিত্র মাটির তৈয়ারী। আকৃতি-প্রকৃতি ও জ্ঞানে-গুণে মানুষের সমতুল্য কোনো জীবই নাই। অর্থাৎ জীবজগতে মানুষ অতুলনীয় জীব। কিন্তু বিজ্ঞানীগণ বলেন যে, জীবজগতে মানুষের তেমন কোনো বৈশিষ্ট নাই। আপাতদৃষ্টিতে যে সমস্ত বৈশিষ্ট দেখিতে পাওয়া যায়, তাহা হইল ক্রমবিবর্তনের ফল। মৌলিক বৈশিষ্ট বিশেষ কিছুই নাই এবং যাবতীয় জীবদেহের মৌলিক উপাদান একই।
মানুষের রক্তের প্রধান উপাদান শ্বেত কণিকা, লোহিত কণিকা, জল ও লবণ জাতীয় পদার্থ এবং দেহ বিশ্লেষণ করিলে পাওয়া যায় লৌহ, কার্বন, ফসফরাস ও গন্ধকাদি কতিপয় মৌলিক পদার্থ। দেখা যায় যে, অন্যান্য প্রাণীর দেহের উপাদানও উহাই।
জীবগণ আহার করে দেহের স্বাভাবিক ক্ষয় পুরণের জন্য। ইহাতে জানা যায় যে, শরীরের যে বস্তুটি ক্ষয় হইতেছে, তাহা পূরণ করিবার জন্যই আহাবের প্রয়োজন। জীবজগতে যখন খাদ্য-খাদক সম্পর্ক বর্তমান আছে, তখন উহাদের দেহগঠনের উপাদানও হইবে বহুল পরিমাণে এক। যেমন– বাঘ মানুষ ভক্ষণ করে, মানুষ মাছ আহার করে, আবার মাছেরা পোকা-মাকড় খাইয়া বঁচিয়া থাকে ইত্যাদি। ইহাতে বুঝা যায় যে, একের শরীরের ক্ষয়মান পদার্থ অপরের শরীরে বিদ্যমান আছে। মাতৃহীন শিশু যখন গোদুগ্ধ পানে জীবন ধাবণ করিতে পারে, তখন গাভী ও প্রসূতির দেহের উপাদান বহুলাংশে এক।
প্লেগ, জলাতঙ্ক প্রভৃতি রোগসমূহ ইতর প্রাণী হইতে মানবদেহে এবং মানবদেহ হইতে ইতর প্রাণীতে সংক্রমিত হইতে পারে। ইহাতে উহাদের টিস্যু (tissue) ও রক্তের সাদৃশ্য প্রমাণিত হয়।
চা, কফি ও মাদক জাতীয় দ্রব্যাদি গ্রহণে ও কতক বিষাক্ত দ্রব্য প্রয়োগে মানুষ ও পশুর একই লক্ষণ প্রকাশ পায়, ইহাতে উভয়ের পেশী (muscle) ও স্নায়ুর (nerve) সাদৃশ্য প্রমাণিত হয়।
গো-মহিষাদি পশুরা লোমশ প্রাণী, মানুষও তাহাই এবং পশুদের দেহে যেরূপ পরজীবী বাস করে, মানুষের শরীরেও তদ্রূপ উকুনাদি বাস করে। প্রজননকার্যে মানুষ ও অন্যান্য স্তন্যপায়ী জীবদের বিশেষ কোনো পার্থক্য নাই। পূর্বরাগ, যৌনমিলন, সূণোৎপাদন, সন্তান প্রসব ও প্রতিপালন সকলই প্রায় একরূপ।
স্তন্যপায়ী সকল জীবকেই রজঃশীলা হইতে দেখা যায়। তবে বিভিন্ন জীবের যৌবনে পৌঁছিবার বয়স, রজঃ-এর লক্ষণ ও স্থিতিকাল এবং গর্ভকাল এক নহে। তথাপি একজন মানবীর রজঃ বা ঋতুর অন্তর এক মাস (সাধারণত ২৮ দিন) এবং একটি বানরীরও এক মাস, আর একজন মানবীর গর্ভধারণকাল দশ মাস (সাধারণত নয় মাস) এবং একটি গাভীরও গর্ভধারণকাল ঐরূপ।
মানুষের ন্যায় পশু-পাখিরও সন্তানবাৎসল্য এবং সামাজিকতা আছে। মানুষ যেরূপ আহ, উহ, ইশ ইত্যাদি অনেক প্রকার শব্দ দ্বারা হর্ষ, বিষাদ, ভয়, ক্রোধ ইত্যাদি মানসিক ভাব ব্যক্ত করে, তদ্রূপ অনেক ইতর প্রাণীও কতক সাঙ্কেতিক শব্দ দ্বারা মনোভাব ব্যক্ত করিয়া থাকে। গৃহপালিত কুকুরের ঘেউ ঘেউ শব্দের পাঁচটি রকমভেদ আছে। ইহাতে শত্রুর আগমনের বার্তা, হর্ষের শব্দ, বেদনার শব্দ ইত্যাদি লক্ষিত হয়। গৃহপালিত মোরগ প্রায় বারোটি শব্দ ব্যবহার করে। গাভীর হাম্বা রবে তিন-চারি প্রকার মনোভাব প্রকাশিত হয়। ইতর প্রাণী কথা যে একেবারেই বলিতে পারে না, এমন নহে। ময়না, টিয়া, কাকাতুয়া ইত্যাদি পাখিরা মানুষের মতোই কথা বলিতে শেখে।
গরু, ঘোড়া, হাতি, বাঘ, শিয়াল, বিড়াল ইত্যাদি পশুরা পঞ্চ-ইন্দ্রিয়-বিশিষ্ট জীব, মানুষও তাহাই। ঐসকল পশুর এবং মানুষের রক্ত, মাংস, মেদ, মজ্জা, অস্থি ইত্যাদিতে কোনো পার্থক্য তো নাই-ই, উহাদের অভ্যন্তরীণ দেহযন্ত্র যথা –হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস, প্লীহা, যকৃত, মূত্রযন্ত্র, পাকস্থলী ইত্যাদির গঠন, ক্রিয়া, সংযোজন ও অবস্থিতি তুলনা করিলেও বিশেষ কোনো পার্থক্য লক্ষিত হয় না। বিশেষত শিম্পাঞ্জি, গরিলা ও বানরের সহিত মানুষের আকৃতি ও প্রকৃতির সাদৃশ্য যথেষ্ট।
জীববিজ্ঞানীগণ স্তন্যপায়ী শ্রেণীর জীবসমূহকে কতগুলি দল বা বর্গ-এ বিভক্ত করিয়াছেন। উহার বিশেষ একটি বর্গের সমস্ত প্রাণীকে একত্রে বলা হয় প্রাইমেট (Primate)। যাহারা হাত দিয়া জড়াইয়া ধরিয়া গাছে উঠিতে পারে, যাহাদের হাতে পাঁচটি করিয়া আঙ্গুল আছে, যাহাদের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ অন্যান্য আঙ্গুলগুলির উপর ন্যস্ত করা যাইতে পারে, যাহাদের আঙ্গুলে নখ থাকে, যাহাদের অক্ষিগোলক চতুর্দিকে অস্থি দ্বারা পরিবৃত, যাহাদের স্তনগ্ল্যাণ্ড বক্ষদেশে নিবদ্ধ এবং যাহাদের পাকস্থলী সাধারণভাবে গঠিত –তাহারাই প্রাইমেট বর্গের অন্তর্গত। দেখা যায় যে, মানুষের মধ্যে উহার প্রত্যেকটি চিহ্নই বিদ্যমান। সুতরাং মানুষ যে প্রাইমেট, সেই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই।
তাহা হইলে মানুষের বৈশিষ্ট কোথায়?
মানুষের বৈশিষ্ট
মানুষের সহিত অন্যান্য জীবদের তথা পশুদের শত শত রকম সামঞ্জস্য বিদ্যমান। কাজেই যাবতীয় জীব বিশেষত পশুরা মানুষের আত্মীয়, এ কথাটি অস্বীকার করিবার উপায় নাই। তথাপি মানুষ মানুষই, পশু নহে। এখন দেখা যাক যে, অন্যান্য প্রাণীর সঙ্গে মানুষের তফাত কি।
জীবজগতে মানুষের প্রধান বৈশিষ্ট তিনটি। যথা –হাত, মগজ ও ভাষা।
বিবর্তনের নিয়ম-কানুনে বিজ্ঞানীদের মধ্যে কোনো কোনো বিষয়ে দ্বিমত থাকিলেও একটি বিষয়ে প্রায় সকল বিজ্ঞানীই একমত যে, মানুষের পূর্বপুরুষেরা এককালে পুরাপুরি বৃক্ষচারী জীব ছিল। কালক্রমে যখন তাহারা গাছের বাসা ছাড়িয়া মাটিতে নামিয়া আসিল, তখন অন্যান্য অনেক জানোয়ারের তুলনায় নানা দিক দিয়াই তাহারা ছিল অসহায়। জীবন সংগ্রামের জন্য ছিল তাহাদের প্রধানত দুইটি সম্বল। প্রথমত অন্যদের তুলনায় ভালো মস্তিষ্ক, দ্বিতীয়ত চলাফেরার কাজ হইতে মুক্তি পাওয়া’ দুইখানি হাত। ইহারই সাহায্যে মানুষ বাঁচিবার চেষ্টা করিয়াছে। ফলে উন্নত হইয়াছে মানুষের মস্তিষ্ক এবং হাত দুইই। মস্তিষ্কের উন্নতি হাতকে উন্নত করিয়াছে, আবার হাতের উন্নতি মস্তিষ্ককে উন্নত করিয়াছে। অধিকন্তু মস্তিষ্ক এবং হাত, এই দুইয়ের উপর নির্ভর করিয়া মানুষ কথা বলিতে শিখিয়াছে, ভাষা পাইয়াছে। এই ভাষা কাহারও একার সম্পত্তি নহে, পুরা সমাজের সম্পত্তি। তাই ভাষাভাষী হিসাবে মানুষ একান্তই সামাজিক জীব। উন্নত মস্তিষ্ক, কর্মক্ষম হাত এবং সুসমঞ্জস ভাষা সহায়ক হইল এক রকম জীবের — তাহারই নাম মানুষ। কিন্তু হাত, মগজ ও ভাষা জীবজগতের সর্বত্র দুর্লভ নহে। অনুন্নত জীবজগতের সর্বত্র দুর্লভ– মানুষের হাসি।
বিবর্তনের কয়েকটি ধাপ
ক্রমবিবর্তনের বিষয়ে এযাবত যে সমস্ত আলোচনা করা হইল এবং তাহাতে যে সমস্ত জীবের নামোল্লেখ করা হইল, তাহা বিবর্তনের প্রধান প্রধান ধাপ মাত্র। এক জাতীয় জীবের আর এক জাতীয় জীবে রূপান্তরিত হইতে সময় লাগে লক্ষ লক্ষ বা কোটি কোটি বৎসর এবং ইহারই মধ্যে ঐ জীবটি রূপান্তরিত হয় আরও শত শত জীবে। কিন্তু এই মধ্যবর্তী জীবগুলি প্রকৃতি ও পরিবেশের সাথে নিজেকে খাপ খাওয়াইতে পারার দরুন অথবা অন্য কোনো কারণে অধিকাংশই পৃথিবীর বুকে টিকিয়া থাকিতে পারে না, কৃচিৎ অনুন্নত অবস্থায় বাঁচিয়া থাকে। যেমন –আফ্রিকার কোয়েলাকান্থ ও ফুসফুসওয়ালা মাছ; ইহারা মৎস্য ও সরীসৃপের মাঝামাঝি জীব। যেমন– গরিলা; ইহারা পশু ও মানুষের মাঝামাঝি জীব। যেমন –আর্কিওপটেরিক; ইহারা পাখি ও সরীসৃপের মাঝামাঝি জীব ইত্যাদি। যাহা হউক, বিবর্তনের আলোচ্য প্রধান প্রধান ধাপগুলি সম্বন্ধে আর একবার সংক্ষেপে আলোচনা করিতেছি।
অ্যামিবা- ইহারা এককোষী জীব। ইহার বিবর্তনে অর্থাৎ কোষ সমবায়ে গঠিত হইয়াছে বহুকোষী জীব।
বহুকোষী জীব- ইহারা দুই দলে বিভক্ত হইয়া এক দল হইতে অচল উদ্ভিদ এবং অপর দল হইতে জন্মিয়াছে সচল জীব।
সচল জীব- ইহাদের এক শ্রেণীর জীবের নাম ট্রাইলোবাইট।
ট্রাইলোবাইট- ইহারা পোকা জাতীয় জলজীব। কালক্রমে ইহাদের এক শ্রেণীর দেহে মেরুদণ্ড জন্মে, তাহাদের বলা হয় মাছ।
মাছ- ইহাদের বংশ হইতে জন্মে জলচর, উভচর, বিহঙ্গম ও স্থলচর সরীসৃপ।
সরীসৃপ- ইহাদের এক শাখা হইতে জন্মে উষ্ণ রক্ত বিশিষ্ট স্তন্যপায়ী জীব।
স্তন্যপায়ী জীব- ইহাদের এক শাখা হয় বৃক্ষচারী জীব, তাহাদের বলা হয় প্রাইমেট।
প্রাইমেট- ইহাদের মধ্যে জন্মে দ্বিপদ জীব, যাহাদের বলা হয় প্যারাপিথেকাস।
প্যারাপিথেকাস- ইহাদের মধ্য হইতে একদল জন্মে পুরাপুরি সমতলভূমিবাসী দ্বিপদ জীব। ইহাদের বলা হয় এ্যানথ্রোপয়েড এপ বা বনমানুষ।
বনমানুষ- ইহাদের ক্রমোন্নতির ফলে জন্মিয়াছে অসভ্য ও আধুনিক সভ্য মানুষ।
[২৬. পৃথিবীর ঠিকানা, অমল দাসগুপ্ত, পৃ. ২৬১।]
“আরজ আলী মাতুব্বর” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ