আদিম উপজাতি গোষ্ঠীর সঙ্গে এযুগের উপজাতিদের উপাসনা-ধর্ম, চেতনার, জাদু বিশ্বাসের তেমন কোনও পার্থক্য নেই। পার্থক্য যতটা বহিরঙ্গের ততটা ধর্মবিশ্বাস, জাদু বিশ্বাসের নয়। আজও কৃষিজীবী আদিবাসীরা ভাল ফসল কামনায় কাম-মূলক তুক্-তাক্ করে থাকে। শস্য কামনায় ও রোগ-অশুভ শক্তি ইত্যাদিকে দূরে রাখতে বলি দেয়। সেটা নরবলি হলে আরও ভালো। নরবলি বে-আইনি হয়ে যাওয়ার পরও নাগাল্যান্ড, মিজোরাম, মণিপুর, ওড়িশা, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশে এখনও গোপনে নরবলি হয়। এ অনেকটা রূপ কানোয়ারের সতী হওয়ার মত। হাজার লোকের সামনে ঘটনা ঘটলো, কিন্তু একটিও প্রত্যক্ষদর্শী মিললো না। স্থানীয় মানুষরা নরবলির খবর জানে। বলি উৎসবের কয়েকদিন আগে থেকেই মানুষ খুব সাবধানে থাকে। বাচ্চাদের আগলে রাখে। তবু বলি আটকায় না। ভক্তরা কাউকে না কাউকে বলির জন্য ঠিক পাকড়াও করে নেয়।
নিজেরাই হাঁড়িকাঠে মাথা দিতে চায়, এমন লোকও ছিল, আছে। তারা ভাবে এতে বিশাল পুণ্য হয়। সরাসরি মায়ের চরণে স্থায়ী জায়গা মেলে। আবার কাউকে নানা ধরনের ভোগের লোভ দেখিয়ে, ভোগের সুযোগ দিয়ে বলি দেওয়া হত । অসম ও মেঘালয়ে এক সময় এমন মানুষ প্রচুর মিলতো, যারা নিজেরাই ঘোষণা করতো, মা ‘কা-মে-খা’ বা কামাখ্যা তাদের রক্ত চেয়েছেন। এইসব ঘোষণাকারীদের বলা হতো ‘ভোগী’। তাদের সমস্ত রকমের সুখভোগের ব্যবস্থা করা হতো। তার মধ্যে অপরিমিত মদ্যপান ও নিত্যমৈথুনের ব্যবস্থা অবশ্যই থাকতো। তারপর তাদের সাধারণত অম্বুবাচীতে বলি দেওয়া হতো।
খাসি উপজাতিদের দেবী ছিলেন ‘কা-মে-খা’। ‘কা-মে-খা’ হলেন দেবীর যোনি। শিবের লিঙ্গ যেমন বহু মন্দিরে পূজিত হয়, তেমনই কামরূপে যোনি পুজো হয় । কামরূপের এই যোনি দেবী ভারতের অবিতর্কিত (তন্ত্র-বিশ্বাসীদের কাছে) এক নম্বর তান্ত্রিক দেবী। এই ‘কা-মে-খা’-ই পরবর্তীতে কামাখ্যা হয়েছেন। তিনি যে নতুন মন্দিরে পূজিত হন, সেই মন্দিরের উদ্বোধন উপলক্ষে ১৪০টি নরবলি দেওয়া হয়। একবিংশ শতকে দাঁড়িয়ে এখনও ভারতের কোটি কোটি মানুষ বিশ্বাস করে যে অম্বুবাচিতে যোনিটি রজস্বলা হয়। ভক্তরা রজঃতে কাপড় ভিজিয়ে মাদুলি বা তাবিজ করে ধারণ করে। বিশ্বাস করে কামাখ্যার রজঃ সমস্ত বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা করবে। অনেক অপরাধিরাই রজঃ থেকে তৈরি ‘মহামৃত্যুঞ্জয়ী কবচ’ ধারণ করে। বিশ্বাস করে, পুলিশ বা বিরোধী সমাজবিরোধীদের গুলিও হার মানবে এই কবচের সামনে। এ’সবই জাদু-বিশ্বাস।
কেরলের ভগবতী ও উত্তর ভারতের দেবী পার্বতী রজস্বলা হন বলে ভক্তরা বিশ্বাস করেন। এইসব জাদু বিশ্বাসের হাত ধরে হিন্দু উপাসনা-ধর্মের বিবর্তন ঘটেছে। জাদু বিশ্বাসের ভিতের উপর গড়ে উঠেছে তন্ত্র।
জাদু বিশ্বাসের পক্ষে যারা নানা ধরনের আচার-আচরণের
বিধান দিত, সেই জাদুকররাই বর্তমান
হিন্দু পুরোহিতদের পূর্বসূরি।
“অলৌকিক নয়,লৌকিক- ৫ম খন্ড ” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ
অধ্যায়ঃ এক
ধর্মঃ সংজ্ঞায় গোলমাল
অধ্যায়ঃ দুই
উপাসনা ধর্মঃ প্রাচীন মত
♦ উপাসনা- ধর্মের (religion) উৎপত্তি
♦ একঃ দৈব-প্রত্যাদেশ বা অপৌরুষেয় প্রত্যাদেশ
♦ দুইঃ ঈশ্বরে বিশ্বাস; সহজাত প্রবৃত্তি
♦ তিনঃ ধর্মীয় আচরণ বাদে ঈশ্বর বিশ্বাস
♦ আধুনিক নাস্তিক্যবাদ ‘মার্কসবাদ’
অধ্যায়ঃ তিন
‘সমকালীন যুক্তিবাদ’ নাস্তিক্যবাদের সঙ্গে বাড়তি কিছু
♦ ‘সমকালীন যুক্তিবাদ’ চির নতুন
♦ তোমার আমার দুই চেতনার ভালো-খারাপ
♦ মারাদোনার পায়ের জাদু ও যুক্তিবাদ
♦ প্রেমের রহস্যময়তা ও যুক্তিবাদ
♦ ‘ঈশ্বরে বিশ্বাস’, ‘বিজ্ঞানের বিশ্বাস’ : আকাশ-পাতাল
অধ্যায়ঃ চার
উপাসনা ধর্মঃ আধুনিক মত
♦ উপাসনা-ধর্ম : নৃতত্ত্ব ও সমাজতত্ত্বের দৃষ্টিতে
অধ্যায়ঃ পাঁচ
ভারতবর্ষের জাদু সংস্কৃতি
♦ আদিম উপজাতি, আধুনিক উপজাতিঃ একই কথা
♦ ধর্মীয় জাদু বিশ্বাস ও ম্যাজিক শোঃ দুই পৃথিবী
অধ্যায়ঃ ছয়
তন্ত্রের প্রথম ধাপ যোগ, তারপর…
অধ্যায়ঃ সাত
বৈদিক সাহিত্য, জাদু-বিশ্বাস, যজ্ঞে যৌনাচার
♦ সত্য খোঁজে মুক্তমন, হিসেব কষে ভন্ড
♦ বৈদিক সাহিত্যের গপ্পো ও দুই ডাক্তার
♦ বৈদিক সাহিত্যে জাদু-বিশ্বাস, যজ্ঞের নামে যৌনাচার
অধ্যায়ঃ আট
হিন্দু উপাসনা-ধর্মে তন্ত্র
অধ্যায়ঃ নয়
শক্তিধর্মে তন্ত্র
অধ্যায়ঃ দশ
রেইকি গ্রাণ্ডমাষ্টার, ফেং শুই ক্ষমতার দাবিদার, জ্যোতিষী ও অলৌকিক ক্ষমতার দাবিদারদের প্রতি