সাঁওতাল সমাজের পরম্পরাগত নেতাকে বলা হয় ‘মাঝি’ সামাজিক কোন কামকর্ম বা পূজো মাঝির অনুমতি ছাড়া হতে পারে না। বলতে গেলে মাঝি গ্রামের পুরোহিতের চেয়ে কিছু বেশি। বিয়ে দিতে মাঝির প্রণামী দেন। গ্রামে বর বিয়ে করতে ঢুকলে বরযাত্রীরা বউয়ের গ্রামের মাঝির বাড়িতে আগে যাবেন, সেখানে মাঝিকে সম্মান জানিয়ে তারপর যাবে বিয়ের আসরে। ‘পরবে’ (উৎসবে) নাচ শুরু হবে মাঝির বাড়ি থেকে। শিকার উৎসবে নিহত পশুদের ভাগ দেওয়া হয় মাঝিকে। সমাজের কেউ কোনও সমস্যা নিয়ে হাজির হলে বা সম্পত্তি বন্টনের জন্য পরামর্শ চাইলে মাঝি প্রয়োজন মনে করলে ‘কুলহই দুরুপ’ ডাকবেন। ‘কুলহই দুরুপ’ হল পূর্ণবয়স্ক পুরুষদের নিয়ে সভা। এই সভায় সকলেই আলোচনায় অংশ নিতে পারবেন। কিন্তু শেষ কথা বলবেন মাঝি। মাঝিকে সাহায্য করবেন সমাজের পাঁচজন, যাঁদের বলা হয় ‘মোরে হড়’ (মোরে=পাঁচ, হড়=মানুষ)। মাঝির অনুমতি পেলে সমাজের কেউ পুলিশের কাছে যান বা আদালতে যান। গ্রামে কোনও অপরাধমূলক ঘটনা ঘটলে সাধারণত মাঝিই থানায় খবর দেন। থানা থেকে কেউ গ্রামে এলে প্রথমে মাঝির সঙ্গেই দেখা করেন।

গ্রাম পত্তনের সময় আদিবাসী সমাজের প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষরা মাঝি সহ আরও কিছু সমাজ নেতা নির্বাচন করেন। পদটি সাধারণত বংশানুক্রমিক হলেও ‘মাঝি’ বড় ধরনের কোনও অপরাধ করলে গ্রামবাসী পুরুষেরা মিলিত হয়ে নতুন কাউকে মাঝি নির্বাচিত করেন।

গ্রামের কেউ দীর্ঘদিন ধরে অসুখে ভুগলে গ্রামের মানুষ আধারণত মাঝির কাছে ‘ডাইনির নজর’ –এর সন্দেহের কথা জানান। মাঝির নেতৃত্বে গ্রামবাসীরা ওঝা বা জানগুরুর কাছে হাজির হন। জানগুরু কাউকে ডাইনি বলে ঘোষণা করলে ঘোষিত ডাইনির বিরুদ্ধে শাস্তিদানও মাঝির নির্দেশেই হয়।

জগমাঝিকে এসব প্রতিটি কাজে সাহায্যকারীরূপে যিনি সাহায্য করেন, তাঁকে বলা হয় পারানিক।

‘নাইকে’ সাঁওতাল সমাজের পুরোহিত। পদটি বংশানুক্রমিক। সাঁওতাল সমাজের বোঙ্গারা (দেবতারা) দুধরনের বলে সামজের বিশ্বাস। শুভকারী বোঙ্গা ও অশুভকারী বোঙ্গা। শুভকারী বোঙ্গার পুজো নাইকের প্রধান কাজ। পুজোয় বলি দেওয়া পশুর মাথা নাইকে দেওয়া হয়। শিকার উৎসবে যোগদানের আগে গ্রামবাসীরা বোঙ্গার পুজো দেন এবং নাইকেকে এজন্য দেওয়া হয় পাঁচটা মোরগ।

কুজম নাইকে হলেন নাইকের সহকারী। অর্থাৎ সহকারী পুরোহিত। কুজম নাইকে অশুভকারী বোঙ্গাদের পুজোর অধিকারী। সামজের বিশ্বাস ও অশুভকারী বোঙ্গারা গ্রামে মানুষদের ক্ষতি করার ক্ষমতা রাখে। তাই তাদের তুষ্ট করতে পুজো দেন।

সমাজের বয়জ্যেষ্ঠদের পাঁচজনকে নিয়ে ‘মোরে হড়’ তৈরি হয়। ‘মোড়ে হর’ -এর প্রতিপত্তি সমাজে যথেষ্ট। সামাজিক অপরাধ, বিবাহ-বিচ্ছেদের বিচার করেন মোরে হড়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিচারে দোষীদের জরিমানা হয়। অভিযোগকারী পান জরিমানার অর্ধেক। বাঁকি অর্ধেক মাঝির হাতে তুলে দেওয়া হয়। মাঝি তার থেকে সামান্য রেখে বাঁকি টাকায় হাঁড়িয়া কিনে সমাজের সকলে একসঙ্গে পান করেন।

‘গোড়েৎ’ -এর কাজ মাঝির ডাকা সভার খবর গ্রামে বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেওয়া।

সমাজের ধর্মীয় জীবনে জানগুরুর কোন স্থান নেই। আদিবাসী সমাজে পুজো-পার্বণের ভার কখনই জানগুরুকে দেওয়া হয় না। ওঝা বা জানগুরু অথবা আর যে নামেই পরিচিত হোন না কেন এরা সমাজের মানুষের ভয়-মিশ্রিত শ্রদ্ধা আদায় করে। নানা কারণে মানুষ ওদের পরামর্শ নিতে হাজির হয়। রোগের কারণ ও রোগমুক্তির জন্য, বন্ধ্যা রমণী মা হওয়ার বাসনা নিয়ে, চুরি যাওয়া জিনিসের খোঁজে, গৃহপালিত পশুর অসুখের সমস্যা নিয়ে, সন্তান-সম্ভবার সন্তান যেন ভালভাবে হয় এই প্রার্থনা নিয়ে, ডাইনি ধরেছে সন্দেহ করলে, ডাইনির নজর পড়েছে সন্দেহ করলে অথবা ডাইনিকে খুঁজে বের করার আবেদন নিয়ে সমাজের বিভিন্ন মানুষ উদ্ধার পেতে জানগুরুর শরণাপন্ন হন।

সমাজের বিশ্বাস, জানগুরু একধরনের বিশেষ বোঙ্গার মাধ্যমে অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী। এইসব বোঙ্গাদের সাহায্যে জানগুরু ডাইনিদের এবং অনিষ্টকারী আত্মাদের প্রভাব নষ্ট করতে সক্ষম। জানগুরুরা বিভিন্ন প্রয়োজনে বিভিন্ন বোঙ্গাদের কাজে লাগিয়ে অনিষ্টকারী বোঙ্গা, আত্মা, ডাইনিদের নিয়ন্ত্রণ করেন। দু একটি উদাহরণ বরং দিই। প্রসূতির হিতার্থে ভালুয়াবিজয় বোঙ্গা, উলুমপাইকে বোঙ্গা, জুলুমপাইকে বোঙ্গা, খোস-পাঁচড়ায় গোসাঞী-এরা বোঙ্গা, পাগল ভাল করতে নাশনচন্ডী বোঙ্গা, দুরিয়া বারদো বোঙ্গা, গৃহপালিত পশুদের অসুখে জাহের এরা বোঙ্গাও নাগ-নাগিন বোঙ্গাদের তুষ্ট করে কাজে লাগান হয়। জানগুরুদের বোঙ্গাদের মধ্যে কিছু হিন্দু দেব-দেবীও আছেন। যেমন, গঙ্গা, কালি, দিবি (দুর্গা)।

আদিবাসী সমাজের বিশ্বাস, জাদু দুরকমের – হিতকারী ও অনিষ্টকারী। জানগুরুরা হিতকারী জাদু ক্ষমতার অধিকারী এবং ডাইনি বা ডাইনরা অনিষ্টকারী জাদু ক্ষমতার অধিকারী। সমাজ বিশ্বাস করেন একমাত্র জানগুরুরাই ডাইনির মন্ত্রশক্তির বিরুদ্ধে লড়ার ক্ষমতা রাখেন। যদি কোন ডাইনির শক্তির কাছে একজন জানগুরু পরাজিত হন অন্য জানগুরু আসবেন। জানগুরুরা সমাজের কল্যাণে নিবেদিতপ্রাণ।

ডাইন প্রসঙ্গে বহু জানগুরুদের সঙ্গে কথা বলেছি। তাদের অনেকের মত- ডাইনি যার উপর নজর দিয়েছে, তার গু ডাইনিকে খাওয়ালে ডাইনির ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়। আবার অনেকের মতে ডাইনি যতক্ষণ জীবিত থাকে, ততক্ষণ তাদের ক্ষমতাও কাজ করে।

দ্বিতীয় মতটি সমাজের মানুষদের প্রভাবিত করে বলেই ভীত মানুষগুলো রোগ থেকে নিজে বাঁচতে  বা আত্মীয়কে বাঁচাতে জানগুরু যাকে ডাইনি বলে ঘোষনা করে তাকে অতি নিষ্ঠুরতার সঙ্গে হত্যা করতে সামান্যতম কুন্ঠিত হন না। বরং অনেক সময় হত্যাকারীরা মনে করেন, ডাইনি হত্যা করে সমাজের উপকারই করেছেন, ভবিষ্যতে কাউকে ডাইনির নিষ্ঠুরতার বলি হতে হবে না। এ ধরনের ঘটনাও বহু ঘটছে, ডাইনি হত্যাকারী নিজেই বীরের মত থানায় গিয়ে আত্মসমর্পণ করেছেন।

সমাজ অবশ্য সাধারণভাবে বিশ্বাস করে, ডাইনি ইচ্ছে করলে তার মন্ত্র ফিরিয়ে নিতে পারে।

error: Content is protected !!