প্রাচীন বস্তুবাদী দর্শনটির নামটা নিয়ে একটু আলোচনা স্বল্প পরিসরে সেরে নিলে বোধহয় অনেকের কিছুটা কৌতূহলও মেটানো যাবে এবং আত্মা প্রসঙ্গে যে দর্শনের মতামতের সঙ্গে পরিচিত করাতে চাইছি, তার বিষয়েও কিছু বলা হবে।
‘চার্বাক’ কথাটি কোথা থেকে এলো? অনেক দার্শনিকের মতে ‘চারু-বাক’, থেকে চার্বাক কথাটা এসেছে। মানুষের স্বাভাবিক ভোগ প্রবৃত্তির কথা মাথায় রেখে যে দর্শন ‘চারু’ বা সুন্দর কথার জাল বুনে ‘ইহ জগতেই সব কিছুর শেষ, মৃত্যুর পরে অন্য কোন জগৎ বলে কিছুই নেই’, বলে মানুষের চিত্ত আকর্ষণ করেছে, সেই দর্শনী চারু-বাক বা চার্বাক দর্শন।
অন্য মতে ‘চর্ব’ (অর্থাৎ চর্বণ) করে যে – এই অর্থে চার্বাক শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। এই ধরণের ব্যাখ্যা তারা বলতে চান – চর্ব-চোষ্য খানা-পিনার মধ্যেই জীবনের চরমতম সার্থকতা যে দর্শন খুঁজে পায় সেই দর্শনই চার্বাক দর্শন।
ব্যাকরণ মানতে গেলে দুটো মতকেই বাতিল করতে হয়। ‘চারু-বাক’, থেকে ‘চারুবাক’, অথবা ‘চারবাক’ বা ‘চার্বাক-এর ‘ক’ –এ হসন্ত বাত দেওয়া হয়েছে।
আবার ‘চর্বণ করে যে’ সে ‘চার্বাক’ –নয় ‘চার্বাক’, অর্থাৎ ‘র্ব’ –এ আ-কার হবে না।
পালি সাহিত্যে বিষয়ে সুপণ্ডিত রসি ডেভিন্ডস (Rhys Dabinds)-এর ধারণায় – মহাভারতের এক কুচরিত্র রাক্ষস চার্বাক। এই নাম থেকেই পরবর্তী সময়ে ভাববাদীরা বস্তুবাদী দর্শনটির নাম রাখেন চার্বাক দর্শন। মহাভারত আছে –চার্বাক ছিল দুরাত্মা দুর্যোধনের বন্ধু আর এক দুরাত্মা। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ-বিজয়ী ধর্মরাজ যুধিষ্ঠীরকে ব্রাক্ষ্মণ ছদ্মবেশধারী চার্বাক জ্ঞাতিঘাতী হিসেবে ধিক্কার জানিয়ে আত্মঘাতী হতে প্ররোচিত করেছিল। কিন্তু উপস্থিত ব্রাক্ষ্মগণ তাঁদের অতীন্দ্রিয় ক্ষমতায় চার্বাক –এর আসল পরিচয় জেনে ফেলে যুধিষ্ঠিরকে রক্ষা করেন।
প্রাচীন ভাববাদীরা বস্তুবাদী দর্শনটির প্রতি সাধারণ মানুষের অশ্রদ্ধা ও ঘৃণা সৃষ্টির জন্যই এমন এক ঘৃণ্য রাক্ষস চরিত্রের নামে দর্শনটির নাম রেখেছিলেন।
সে যুগের কিছু ভাববাদীরা চার্বাক বা লোকায়ত দর্শনকে দেবগুরু বৃহস্পতি প্রণীত বলে উল্লেখ করেছেন। পুরাণে আছে – অসুরদের পরাক্রমে বিধ্বস্ত দেবকুলকে রক্ষা করতে এক কৌশল অবলম্বন করলেন বৃহস্পতি। অসুরদের ধ্বংসের জন্য, অধঃপাতে নিয়ে যাঔয়ার জন্য এই ভ্রান্ত-দর্শন রচনা করলেন। তারপর অসুরের ছদ্মবেশে অসুরদের মধ্যে বস্তুবাদী দর্শনটি প্রচার করলেন। ফলে নীতিভ্রষ্ট, ভ্রান্ত অসুররা দেবতাদের কাছে পরাজিত হল।
এখানেও দেখতে পাই – বস্তুবাদী দর্শনই অসুরদের ধ্বংসের কারণ হয়েছিল, প্রচারের মধ্য দিয়ে বস্তুবাদী দর্শনের প্রতি আতঙ্ক এবং বিদ্বেষ সৃষ্টির স্পষ্ট চেষ্টা।
শঙ্করাচার্য প্রমুখ ভাববাদী দার্শনিকেরা বস্তুবাদী দর্শনটিকে ‘লোকায়ত’ নামে অবহিত করার কারণ হিসাবে জানিয়েছেন – দর্শনটি ইতর লোকের দর্শন, তাই ‘লোকায়ত’ দর্শন।
এখানে ভাববাদী দার্শনিকদের লোকায়ত দর্শনের প্রতি অশ্রদ্ধা স্পষ্ট।
অনেক পাঠক-পাঠিকাদের মনেই এ-চিন্তা নিশ্চয়ই উঁকি-ঝুঁকি দিচ্ছে – চার্বাক বা লোকায়ত দর্শনে কি এমন কথা বলা হয়েছে, যা অবহেলায় পাশে সরিয়ে দেওয়ার সাধ্য সে যুগের রথী-মহারথী দার্শনিকদের ছিল না। ফলে ভাববাদী রথী-মহারথীরা বস্তুবাদী দর্শনটিকে লক্ষ্য করে তীক্ষ্ম আক্রমণ হেনেছেন,। এবং সাধারণ মানুষদের দর্শনটি থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে নানাভাবে আতঙ্ক সৃষ্টির চেষ্টা করেছেন।
চার্বাক বা লোকায়ত দর্শনে আত্মার বিষয়ে এমন কিছু যুক্তির অবতারণা করা হয়েছিল যেগুলি ইতরজন বা সাধারণের কাছেও গ্রহণীয় হয়ে উঠেছিল। যুক্তিবাদী এই দর্শনে আত্মা বা চৈতন্যকে দেহধর্ম বলে বর্ণনা করা হয়েছে। আর এইউ বক্তব্যই ভাববাদী দার্শনিকদের কাছে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বস্তুবাদী চার্বাক দর্শনের সুদীর্ঘ লড়াই চলেছিল শুধুমাত্র আত্মা ‘অমর’ কি ‘মরণশীল’ –এই নিয়ে।
লোকায়ত দর্শন মতে – কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর জন্য প্রমাণের প্রয়োজন। একান্ত বিশ্বাস-নির্ভর অনুমানের সাহায্যে সিদ্ধান্ত পৌঁছানো সম্ভব নয়/ অনুমান-নির্ভর, একান্ত বিশ্বাস-নির্ভর অমর আত্মা, ইহলোক, পরলোক ইত্যাদি ধারণাগুলো লোক ঠকানোর জন্য একদল ধূর্ত লোকের সৃষ্টি।
প্রমাণের মধ্যে প্রত্যক্ষ প্রামণই শ্রেষ্ঠ বলে চার্বাক দর্শন মনে করলেও তাঁরা প্রত্যক্ষ-অনুগামী জ্ঞানকেও মর্যাদা দিয়েছিলেন। অর্থাৎ অপ্রত্যক্ষ প্রমাণের ক্ষেত্রে প্রতিটি অনুমানের মূল শর্ত অবশ্যই হবে ‘পূর্ব প্রত্যক্ষ’ অর্থাৎ প্রত্যক্ষের ওপর নির্ভর করে অনুমান। যেমন ধোঁয়া দেখলে আগুনের অনুমান, গর্ভ দেখে অতীত মৈথুনের অনুমান ইত্যাদি। অপ্রত্যক্ষ বিষয়ে অনুমান কখনোই হতে পারে না।
ভাববাদীদের চোখে প্রত্যক্ষ ও প্রত্যক্ষ-অনুগামী জ্ঞানের গুরুত্ব ছিল সামান্য অথবা অবাস্তব। তাঁরা অনেক বেশি গুরুত্ব দিতেন, ‘ঋষি’ নামধারী ধর্মগুরুদের মুখের কথাকে, ধর্মগুরুদের অন্ধ-বিশ্বাসকে – যার ওপর নির্ভর করেই গড়ে উঠেছিল আধ্যাত্মবিদ্যা।
আজও যারা বলেন, “বিজ্ঞানের সঙ্গে ধর্ম এবং অধ্যাত্মবাদের কোন দ্বন্দ্ব নেই, বরং অধ্যাত্মতত্ত্বই ‘পরম বিজ্ঞান’, তাঁরা এটা ভুলে যান – প্রত্যক্ষলব্ধ জ্ঞান ছাড়া প্রকৃত বিজ্ঞানের প্রথম ধাপটিতে পা রাখাই সম্ভব নয়।
লোকায়ত দর্শন প্রত্যক্ষ ও প্রত্যক্ষ-অনুগামী জ্ঞানের ওপর নির্ভর করে দ্বিধাহীন ভাষায় ঘোষণা করেছিলেন – চৈতন্য দেহেরই গুণ বা দেহেরই ধর্ম। দেহ ধ্বংস হওয়ার পর চৈতন্যস্বরূপ আত্মার অস্তিত্ব অজ্ঞান ও ধূর্তদের কল্পনা মাত্র।
লোকায়ত দর্শনের এই বক্তব্যের বিরুদ্ধে শঙ্করাচার্য যে যুক্তি রেখেছিলেন তা হল – লোকায়ত দর্শনের মতে দেহের মূল উপাদান জল, মাটি, আগুন, বায়ু ইত্যাদি ভূত-পদার্থ। এই প্রতিটিভূত-পদার্থই জড় বা অচেতন পদার্থ। তাহলে এই অচেতন পদার্থে গড়া মানুষের মধ্যে চেতনা আসছে কোথা থেকে? আসছে নিশ্চয়ই এই সব অচেতন পদার্থের বাইরে থেকেই। অতএব স্বীকার করে নেওয়া উচিৎ – চৈতন্য বা আত্মা দেহের অতিরিক্ত একটা কিছু। আত্মা বিষয়ে অন্যান্য বহু ভাববাদী দার্শনিকেরা যে-সব তর্কের ঝড় তুলেছেন, তাঁদের অনেকের বক্তব্যেই শঙ্করাচার্যের এই যুক্তির সুর লক্ষ্য করা যায়। তাঁরাও ঘুরিয়ে ফিরিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন – জড় বা অচেতন পদার্থের গড়া দেহ তো সরল যুক্তিতে অচেতনই হবার কথা। তবে মানুষের চৈতন্য আসছে কোথা থেকে?
লোকায়ত দর্শন এই যুক্তির বিরুদ্ধে পাল্টা যুক্তিও হাজির করেছেন – মদ তৈরির উপকরণগুলোকে আলাদা করে বা মিলিত অবস্থায় কোন মদশক্তি নেই। কিন্তু সেই উপকরণগুলোকেই এক ধরনের বিশেষ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মিলন ঘটানোর পর সম্পূর্ণ নতুন এক গুণ পাওয়া যাচ্ছে, যাকে বলছি মন্দ। আত্মা বা চৈতন্যও একই জাতীয় ঘটনা।
লোকায়তিকদের চৈতন্যের সঙ্গে মদশক্তির তুলনা নিয়ে কোন বিপক্ষ দার্শনিকই কুটতর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করেননি। তবে, তাঁরা দৃষ্টান্ত হিসেবে এনেছেন মৃতদেহের তুলনা। চৈতন্য থাকার কথা, থাকে না কেন? মৃতদেহও দেহ।
লোকায়ত দর্শনের আত্মা বা অচৈতন্যতত্ত্বের বিরুদ্ধে ভাববাদীদের এটাই সবচেয়ে জোরালতম যুক্তি।
চার্বাক বা লোকায়ত দর্শন-এর বিপক্ষে জোরাল কোন যুক্তির হাজির করতে পারেনি। প্রাচীনকালের পটভূমিতে শারীরবিদ্যার অনগ্রসরতার যুগে এই ধরনের যুক্তির কোন উত্তর দেওয়া সম্ভব ছিল না। আজ বিজ্ঞানের তথা শরীর বিজ্ঞানের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে আমরা অনেক কিছু জেনেছি, পরবর্তীকালে নিশ্চয়ই আরও অনেক কিছুই জানব। যেটুকু জেনেছি, তারই ভিত্তিতে আমরা বলতে পারি দেহ ও মৃতদেহের ধর্ম সমান নয়। চিন্তা, চেতনা বা চৈতন্য মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষের ক্রিয়া।
মৃতদেহের ক্ষেত্রে মৃতদেহেরই অংশ মস্তিষ্ক-স্নায়ুকোষেরও যেহেতু মৃত্যু ঘটে, তাই স্নায়ুকোণে ক্রিয়াও ঘটে না, ফলে মৃতদেহের ক্ষেত্রে চৈতন্য বা চিন্তা থাকে অনুপস্থিত।
লোকায়ত দর্শনে আত্মা, পরলোক এবং পারলৌকিক ক্রিয়াকর্ম নিয়ে এমন অনেক কথা বলা হয়েছে, যেগুলর তীক্ষ্মতা এ যুগের যুক্তিবাদীদেরও ঈর্ষা জাগাবার মতো। দু-একটা উদাহরণ হিসেবে তুলে দেওয়ার লোভ সামলাতে পারলাম না। যদিও নিশ্চিতভাবে জানি আমার অক্ষম বাংলা তর্জমায় মূল শ্লোকগুলোর রস অনেকটাই শুকিয়ে যাবে।
উদাহরণ ১: ব্রাক্ষ্মণ জীবিকা হেতু করেছেন শ্রাদ্ধাদি বিহিত
এ-ছাড়া কিছুই নয় জেনো গো নিশ্চিত।।
উদাহরণ ২: যদি, শ্রাদ্ধকর্মে হয় মৃতের তৃপ্তির কারণ।
তবে, নেভা প্রদীপে দিলে তেল উচিৎ জ্বলন।।
উদাহরণ ৩: পৃথিবী ছেড়ে যে পঞ্চভূতে
তার পাথেয় (খাদ্যবস্তু) ঘরে দেওয়া বৃথা।।
যেমন ঘর ছেড়ে যে গ্রামান্তরে
তার পাথেয় ঘরে দেওয়া বৃথা।।
উদাহরণ ৪: চৈতন্যরূপ আত্মার পাকযন্ত্র কোথা?
তবে তো পিন্ডদান নেহাতই বৃথা।।
উদাহরণ ৫: যদি, জ্যোতিষ্টোম যজ্ঞে
বলি দিলে পশু যায় স্বর্গে।
তবে, পিতাকে পাঠাতে স্বর্গে
ধরে-বেঁধে বলি দাও যজ্ঞে।।
উদাহরণ ৬: ভণ্ডরা পশুর মাংস খেতে চান।
তাই তাঁরা দিয়েছেন বলির বিধান।।
আত্মা, পরলোক ইত্যাদি নিয়ে ভাববাদীদের সঙ্গে বস্তুবাদীদের চিন্তারও মতের এই যে পার্থক্য, এটা নিছক দুটি মতের পার্থক্য নয়। এটা মতাদর্শগত পার্থক্য, মতাদর্শগত সংগ্রাম, সাংস্কৃতিক সংগ্রাম।