১৯৮৬ সালে ‘উদ্বোধন কার্যালয়’ একটি বই প্রকাশ করে – মন ও তার নিয়ন্ত্রণ। লেখক- স্বামী বুধানন্দ, অনুবাদ স্বামী ঈশাত্মনন্দ। বইটিতে বেদান্ত মতে মন কি সে বিষয়ে কিছু আলোচনা রয়েছে। ১৩ পৃষ্ঠা রয়েছে, “মনের পিছনেই থাকে আত্মা, যা মানুষের যথার্থ স্বরূপ। শরীর এবং মন দুই জড়, আত্মাই অচতন্যস্বরূপ।“
স্বামী বুধানন্দের শরীর-বিজ্ঞান সম্বন্ধে অজ্ঞতারই ফলশ্রুতি এ ধরনের অবৈজ্ঞানিক অন্ধ বিশ্বাসজড়িত বক্তব্য। ‘মন’ যে জড় বস্তু নয় এবং মন ও চৈতন্য যে কোন পৃথক কিছু নয়, এ বিষয়ে নতুন করে আর আলোচনায় গেলাম না, কারণ আগেই এ নিয়ে বিজ্ঞান কি বলে, আলোচনা করেছি।
এ’বার যে বইটি নিয়ে আলোচনা করব, তার নাম ‘সত্য দর্শন’, প্রকাশক বারাণসীর ‘কলিকানন্দ বেদান্ত আশ্রম’। লেখক পরমহংস পরিব্রাজকচার্য শ্রীমৎ কালিকানন্দ স্বামী ১০৯ পৃষ্ঠায় ‘মনস্তত্ব’ শিরোনামের বলেছেন, “তোমরা যে চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা ও ত্বক এই পঞ্চেন্দ্রিয় যোগে জগৎকে প্রত্যক্ষ কর, বাস্তবপক্ষে কিন্তু কেবল শরীরের এই বহিস্থ পঞ্চেন্দ্রিয়ের দ্বারাই তোমাদের বহির্জগৎ প্রত্যক্ষ করার কার্য শেষ হয় না। এই বাহিরের পঞ্চেন্দ্রিয় ইন্দ্রিয় নহে, উহা কেবল বাহিরের বিষয়কে ভিতরে লইয়া যাইবার যন্ত্রবিশেষ মাত্র; প্রকৃত ইন্দ্রিয় মস্তিষ্কস্থ স্নায়ুকেন্দ্রেই বিদ্যমান। মনে কর আমি একটি শব্দ শুনিতেছি; এখানে বাহিরের কর্ণ শব্দটিকে গ্রহণ করিয়া মস্তিষ্কই ইন্দ্রিয়ে পৌঁছাইল। এই মনও কেবল বাহক মাত্র, মন ঐ শব্দকে আরও ভিতরে বহন করিয়া লইয়া গিয়া বুদ্ধির নিকট পৌঁছাইল। তখন বুদ্ধি উহার সম্বন্ধে নিশ্চয় করে যে, উহা কিসের শব্দ এবং উহা ভাল কি মন্দ। এই বুদ্ধির আবার আরও ভিতরে লইয়া গিয়া সর্বসাক্ষীস্বরূপ, সকলের প্রভু আত্মার নিকট উহাকে সমর্পণ করিল। তখন পুনরায় যে যে ক্রমে উহা ভিতরে গিয়াছিল, সে সেই ক্রমে আবার বহির্যন্ত্রে আসিল, -প্রথম বুদ্ধিতে, তারপর মনে, তারপর মস্তিষ্ক-কেন্দ্রে তৎপর বহির্যন্ত্র কর্ণে।“
১১০ পৃষ্ঠায় কালিকানন্দ স্বামী বলছেন, আত্মাই চিত্ত।
অর্থাৎ মোদ্দা কথায় কালিকানন্দ স্বামীর মনে হয়েছে মন, বুদ্ধি, চিত্ত বা চেতনা সবই ভিন্ন ভিন্ন বস্তু এবং চিত্ত বা চেতনাই আত্মা। মন ও বুদ্ধির সূক্ষ্ম শরীরও রয়েছে। স্বামীজির এই অদ্ভুত বিশ্বাসের সঙ্গে বিজ্ঞানের সত্যের কোনও সম্পর্ক নেই।
শঙ্করাচার্যও চৈতন্য নামের লক্ষণটি দেহাতিরিক্ত আত্মা বলে ঘোষণা করেছিলেন।
আত্মার শান্তিতে শ্রাদ্ধ
প্রাণীর জীবন্ত শরীরে অসংখ্য জটিল রাসায়নিক করিয়া-বিক্রিয়ার ফলে যে শক্তির সৃষ্টি হয় সেই শক্তিই শরীরের প্রাণ-শক্তি, শরীরকে কর্মচঞ্চল রাখার শক্তি।
মৃত্যু ঘটলে শরীরের রাসায়নিক ক্রিয়া-বিক্রিয়াগুলো বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধ হয় শক্তির সরবরাহ। মৃত্যু পুরোপুরি একটি জৈবিক প্রক্রিয়া, মৃত্যুর পর আত্মাকে ধরে নিয়ে যেতে যমদূতেরা হাজির হয় না। যদিও অনেক হিন্দুর মধ্যেই এই ধারণা রয়েছে যে –
যম আত্মার পূর্বজন্মের কর্মফল বিচার করে স্বর্গে বা নরকে পাঠায়। সেখানে আত্মা সুখ বা শান্তি ভোগ করে। শাস্তির মধ্যে আছে গরম তেলে ভাজা, দিয়ে কাটা ইত্যাদি। তাহলে, আত্মাকে ভাজা যায় না কাটা যায় না – হিন্দু বিশ্বাসের কি হবে?
বহু প্রাচীন যুগ থেকে একধরনের সুবিধাভোগীরা তাদের স্বার্থরক্ষার জন্য প্রচার করেছিল – তুমি এই জন্মে ত্যাগ স্বীকার কর, রাজাকে মান্য কর, পুরোহিতকে শ্রদ্ধা কর – মৃত্যুর পর তোমার আত্মার স্থান হবে স্বর্গে। এর অন্যথায় পতিত হবে নরকে। নরক ভোগের পরে তোমার আত্মা পৃথিবীতে ফিরে এসে আবার জন্ম নেবে, ভোগ করবে পূর্বজন্মের কর্মফল, স্বর্গ নরক এইসব নিয়ে যে ধারণার সৃষ্টি হয়েছে তা একান্তভাবেই বিশ্বাসের ব্যাপার মাত্র। বাস্তবে স্বর্গ, নরক এবং আত্মা কোনওটারই অস্তিত্ব প্রমাণিত হয়নি কারণ অস্তিত্ব নেই।
বিভিন্ন ধর্মে মানুষের মৃত্যুর পর তার অস্তিত্বহীন আত্মার তৃপ্তি, মুক্তি, পরলোকযাত্রার পাথেয় দেওয়ার জন্যে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের নিয়ম-কানুন ও সংস্কার। বিভিন্ন ধর্মীয় বিশ্বাস অনুসারে মৃতদেহকে জ্বালানো হয়, কফিনে শুইয়ে কবর দেওয়া হয়, মৃতদেহকে বসিয়ে কবর দেওয়া হয়, খাল, নদী বা সমুদ্রের জলে ভাসিয়ে সলিল সমাধি দেওয়া হয়, এমনকি মৃতদেহকে গাছে ঝুলিয়েও রাখা হয়।
পরলোকের পাথেয় হিসেবে অনেক সময় মৃতের সঙ্গে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রও কবর বা সমাধিতে দিয়ে দেওয়া হয়। মিশর, চীন, গ্রীস ও ভারতের কবরের সঙ্গে পাথেয় হিসেবে বহু নিত্য-প্রয়োজনীয় জিনিস ও মূল্যবান অলংকার রত্ন প্রভৃতি দেওয়ার প্রচলন বিভিন্ন ধর্মসম্প্রদায়ের মধ্যে ছিল এবং আছে, মিশরের ফারাও পরিবারের মৃতের সঙ্গে কবর দেওয়া হতো জীবন্ত দাস-দাসীদের। বৈষ্ণবরা মৃতের সমাধির সঙ্গে ভিক্ষের ঝলিও দিয়ে দেন।
হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে রয়েছে অশৌচ পালনের আচরণবিধি। হিন্দু পরিবারে কেউ মারা গেলে, জ্ঞাতি-আত্মীয়দের অশৌচ পালন করার বিধি রয়েছে, এই সময় নিরামিষ খেতে হয়, বাড়িতে পূজো, বইয়ে বা ওই জাতীয় কোনও শুভকাজ করা যায় না, চামড়ার জুতো পরা, চুল-দাড়ি-গোঁফ কাটাও নিষিদ্ধ বলে মানা হয়। এই নিয়ম মানা হয় শ্রাদ্ধের দিন পর্যন্ত। ব্রাক্ষ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্রদের বর্ণাশ্রম অনুযায়ী মৃত্যুর কতদিন পর শ্রাদ্ধের কাজ কর্ম, আত্মাকে পিন্ডিদান ইত্যাদি হবে, তা ঠিক করা আছে। মৃতের শ্রাদ্ধের কাজ যে করবে (ছেলে থাকলে অবশ্যই ছেলে) তাকে আরও অনেক নিয়ম-কানুন মানতে হয়। অশৌচ চলাকালীন সেলাইহীন এককাপড়ে থাকতে হয়। নিজে হাতে মাটির মালসায় ভাতে-ভাত রান্না করে খেতে হয়, যাকে বলা হয় হবিষ্যান্ন। জুতো পরা চলবে না। রোদ-বৃষ্টি যাই হোক ছাতা নেওয়া চলবে না। চুল-দাড়ি-গোঁফ চলবে না। গায়ে মাথায় তেল-দেওয়া বা সাবান দেওয়া অবশ্যই চলবে না। যৌনসঙ্গম নিষিদ্ধ। তারপর তো রয়েছে আত্মার শ্রাদ্ধ-শান্তির নাম করে পুরোহিতকে মৃতব্যক্তির প্রিয় জিনিসপত্র দান, ব্রাক্ষ্মণ ও আত্মীয়-বন্ধুদের ভূরিভোজে আপ্যায়ন ইত্যাদি।
শ্রাদ্ধের কাজ যিনি করবেন তিনি বেচারা তেল, সাবানহীন রুক্ষ চুল ও এক মুখ অপরিচ্ছন্ন গোঁফ-দাড়ি নিয়ে, খালি গায়ে একটা নোংড়া কাপড় পরে, খালি পায়ে এবং নিজের রান্না নিজে করে প্রায়শই অফিসের কাজে যোগ দিতে পারেন না। ফলে নষ্ট হয় বেশ কিছু প্রয়োজনীয় শ্রমদিবস। গরিবদের অনেক সময় ভিটে-মাটি বেচে শ্রাদ্ধ-শান্তির খরচ যোগাতে হয়। অস্তিত্বহীন আত্মার নামে এই যে জঘন্য কুসংস্কার ও অর্থহীন খরচ যুগযুগ ধরে চলে আসছে আজও আমাদের সমাজ কিন্তু তার বাইরে বেরিয়ে আসতে পারছে না। ‘পাছে লোকে কিছু বলে’ এই তাড়নায় আত্মার অস্তিত্বে অবিশ্বাসী অনেকেও এই কুসংস্কারের কাছে মাথা নোয়াচ্ছেন। যারা এই সব কুসংস্কারের বিরুদ্ধে দৃঢ়তার সঙ্গে রুখে দাঁড়ান, তাঁদের বিরুদ্ধে একদল লোক-কুবাক্য প্রয়োগ করতে পারেন বটে, কিন্তু, একই সঙ্গে আর একদল লোকের চোখে শ্রদ্ধার আসনও পাতা হয়ে যায়। কারণ, কথায় ও কাজে যারা এক, তাঁদের শ্রদ্ধা জানাবার মতো লোক আজও আছেন।
আমার বাবা মারা যান ১৯৮৫-র ২৬ মে। আমিই বাবার একমাত্র ছেলে। আমার বোন-চার। একমাত্র ছেলে হওয়ার সুবাদে হিন্দুধর্মের বিধিমতো বাবার পরলোকগত আত্মার (?) সদগতি ও শান্তির জন্য পারলৌকিক কাজকর্মের পূর্ণ দায়িত্ব আমারই ওপর বর্তানোর কথা।
যেহেতু আত্মার কোনও বাস্তব অস্তিত্ব নেই, আত্মা শুধু অবাস্তব কল্পনা মাত্র, তাই লোকাচার, প্রচলিত সংস্কার ও চক্ষুলজ্জার কাছে নতজানু হবার কোনও ইচ্ছেই আমার ছিল না। বিনিময়ে মর্মান্তিক মূল্য দিতে হবে জেনেও মনে মনে উচ্চারণ করেছিলাম বীরসিংহের দুঃসাহসী বীর সন্তান বিদ্যাসাগরের কথা, “আমি দেশাচারের নিতান্ত দাস নহি, নিজের বা সমাজের মঙ্গলের নিমিত্ত যাহা উচিৎ বা আবশ্যক বোধ হইবে তাহা করিব; লোকের বা কুটুম্বের ভয়ে কদাচ সংকুচিত হইব না।“
মা, বোন, কিছু আত্মীয় ও কিছু প্রতিবেশীর মতামতকে, কুসংস্কারকে মূল্য না দেওয়ায়, দেখেছি তাঁরা কেমনভাবে আমাকে ত্যাগ করেছেন, দেখেছি কুসংস্কারগ্রস্থদের শত্রুতা কত মিথ্যাচারে নামতে পারে, সেই সঙ্গে দেখেছি সমাজের বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে কেমনভাবে বর্ষিত হয় সমর্থন, অভিনন্দন ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার অজস্র কুসুম। এতগুলো মানুষের ভালোবাসা, এইতো আমার জীবনের পাথেয়।