আঞ্জুমান আরা বেগম (ভোলাহাট)

মুক্তিযোদ্ধা মেহেরুন্নাহারের কাছ থেকে আমি আঞ্জুমান আরা বেগমের কথা জানতে পাই। বিকালে তাঁর বাড়ির উদ্দেশে রওনা হয়ে যাই ভোলাহাট থানার ঝাউবন গ্রানে। মুক্তিযোদ্ধা আঞ্জুমান আরার গ্রামটি আমবাগানে শোভিত। পড়ন্ত বেলায় দেখা হয় তাঁর সাথে। দেখতে গম্ভীর প্রকৃতির মনে হলেও অত্যন্ত মিশুক ও আন্তরিক তিনি।

তাঁর জন্ম ১৯৫০ সালের ১ সেপ্টেম্বর চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার মসজিদপাড়া এলাকায়। তাঁর বাবা মৌলভী মোঃ আইনউদ্দিন মিঞা ছিলেন একজন প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক এবং মা হামিদা বেগম গৃহিণী। তিন ভাই ও দুইবোনের মধ্যে আঞ্জুমান আরা দ্বিতীয়।

একাত্তরের এপ্রিল মাসের শেষদিকে পাকবাহিনীর অত্যাচার ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। তারা শকুনের মতো ঘিরে ফেলে বাংলার গ্রাম-গ্রামান্তর। জ্বালিয়ে দেয় গ্রামের পর গ্রাম। নারী নির্যাতন ও লুটের রাজত্ব কায়েম করে পাকবাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকারেরা। সারা দেশের মানুষ তাদের অত্যাচার ও নির্যাতনে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। গ্রামবাসীরা পালাক্রমে তাদের গ্রাম পাহারা দেয়। এসব দেখে প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন আঞ্জুমান আরা।

পাকবাহিনী ভোলাহাটে স্থায়ীভাবে ঘাঁটি স্থাপন করতে পারে নি, কারণ ভোলাহাট থানার তিন দিকে ভারত এবং পূর্বদিক মহানন্দার শাখানদী দ্বারা বেষ্টিত। ভোলাহাটের পূর্বপাশে গোমস্তাপুর থানা। মে মাসের প্রথম দিকে এখানে পাকবাহিনী স্থায়ীভাবে ঘাঁটি স্থাপন করে। পাকবাহিনী গোমস্তাপুর থেকে মাঝেমধ্যেই ভোলাহাটের বিভিন্ন গ্রামে আক্রমণ চালায় এবং নির্বিচারে গুলি করে, জ্বালিয়ে দেয় ঘরবাড়ি। পাকবাহিনীর এরকম অত্যাচার ও নির্যাতনে অতিষ্ঠ হন আঞ্জুমান আরা। তিনি নানাভাবে সুযোগ খুঁজতে থাকেন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য।

ভোলাহাট থানার গিলাবাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প ও অস্থায়ী হাসপাতাল ছিল। আগস্ট মাসের দিকে এই অস্থায়ী হাসপাতালে আসতে থাকে আহত মুক্তিযোদ্ধারা। হাসপাতালে চাহিদার তুলনায় ডাক্তার, নার্স ও চিকিৎসা ব্যবস্থা ছিল অপ্রতুল। সীমিত সংখ্যক ডাক্তার ও নার্সের পক্ষে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের যথাযথ সেবা দেয়া সম্ভব হচ্ছিল না। ওই সময় হাসপাতালে চিকিৎসা কাজে সহযোগিতার জন্য এলাকায় শিক্ষিত মেয়েদের খোঁজ করা হচ্ছিল।

আঞ্জুমান আরা তাঁর বান্ধবী মুক্তিযোদ্ধা মেহেরুন্নাহার ও সামসুন্নাহারের সহযোগিতায় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার নিজামউদ্দিন ও হাফিজুর রহমান হাসনুর নিকট যান এবং মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেন। হাফিজুর রহমান আঞ্জুমানের আগ্রহ দেখে মুগ্ধ হন এবং অস্থায়ী হাসপাতালে নার্স হিসেবে যোগদানের জন্য অনুমতি দেন।

নভেম্বর মাসের প্রথম দিকে নার্স হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন আঞ্জুমান আরা। তিন সপ্তাহের নার্সিং প্রশিক্ষণ হয় তাঁর। নার্সিং প্রশিক্ষণ দেন ডাক্তার জসি ও ডাক্তার বিপেন। মূলত তাঁদের নার্সিং প্রশিক্ষণ হয় হাতে-কলমে। নার্সিং প্রশিক্ষণের পাশাপাশি আগ্নেয়াস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণও গ্রহণ করেন তিনি। আগ্নেয়াস্ত্রের মধ্যে ছিল গ্রেনেড ও রাইফেল অন্যতম। কমান্ডার হাফিজউদ্দিন হাসনু তাঁদের আগ্নেয়াস্ত্রের প্রশিক্ষণ দেন।

নার্স হিসেবে তিনি যে ডাক্তারদের সাথে কাজ করেন তাদের মধ্যে ডাক্তার বিপেন, ডাক্তার জসি ও ডাক্তার ইয়াসিন অন্যতম। আহত মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষতস্থান পরিষ্কার করা, ব্যান্ডেজ করা, ইনজেকশন পুশ করা, ঠিকমতো ঔষধ খাওয়ানো ছিল তাঁর নিয়মিত কাজ। এছাড়া ছোট ছোট অপারেশনের সময় তিনি ডাক্তাদের সহযোগিতা করতেন। আহতদের অবস্থা বেশি খারাপ হলে ডাক্তারদের তত্ত্বাবধানে তাঁদেরকে দ্রুত মালদহ সরকারি হাসপাতালে পাঠানো হতো। দেশ স্বাধীনের আগে পর্যন্ত তিনি অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে তাঁর দায়িত্ব পালন করেন এবং প্রশংসিত হন।

পাকসেনাদের অমানবিক নির্যাতনের একটা স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘গোমস্তাপুর থানা স্বাধীন হওয়ার পরের দিন আমরা কয়েকজন নার্স, ডাক্তার ও সশস্ত্রযোদ্ধা একসাথে গোমস্তাপুর থানার রহনপুরে পাকিস্তানিদের ক্যাম্পে যাই। ক্যাম্পের সাথেই পাকিস্তানিদের বাংকার ছিল। ওই বাংকারের ভেতরে এক করুণ দৃশ্য দেখতে পাই আমরা। আমার বুকের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যায়। বাংকারের মধ্যে এখানে সেখানে ছড়িয়ে আছে মেয়েদের চুলের বেণি, চুলের গোছা, ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন পেটিকোট ব্লাউজ। আমাদের বুঝতে কষ্ট হয় নি নরপশুরা মেয়েদের বাংকারের ভেতরেও নির্যাতন চালিয়েছে। আজও সে দৃশ্য মনে হলে আঁতকে উঠি আমি। হয়তো, আজও কান পাতলে ওই মেয়েদের আর্তনাদ শুনতে পাই, শুনতে পাই নিজেদের প্রাণ ভিক্ষার আকুতি। কিন্তু পশুরদলের হাত থেকে রক্ষা পায় নি মেয়েরা।’

স্বাধীনতার পরে ১ আগস্ট ১৯৭৯ সালে ভোলাহাট থানার ঝাউবন গ্রামের আলহাজ্ব মুজিবুর রহমানের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন আঞ্জুমান আরা। তার স্বামী প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা করেন। এক ছেলে ও তিন মেয়ের জননী তিনি।

আঞ্জুমান আরা আবেগে আপ্লুত হয়ে আরো বলেন, ‘যাদের জীবনের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা পেলাম, তাঁদের ত্যাগের কী মূল্যায়ন হলো ? আমরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই।

হাজারো স্মৃতি এবং বুকের ভেতর চাপা আর্তনাদ নিয়ে বেঁচে আছেন আঞ্জুমান আরা। তিনি মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস এ প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের জানানোর অনুরোধ জানিয়েছেন।

error: Content is protected !!