মাসের প্রথম শুক্রবারে মীরার বাবা আফতাব নিজে বাজার করেন। তিনি চলে যান। ধূপখোলার বাজারে। সেখানে বিক্রমপুরের তাজা মাছ আসে। পর মাছ। তার স্বাদই অন্যরকম। বড় মাছের দাম এখন সংগতির বাইরে চলে গেছে। তারপরও লোভে পড়ে হঠাৎ হঠাৎ বড় মাছও কিনে ফেলেন। গত মাসে নিউমার্কেট কাঁচাবাজার থেকে মাঝারি সাইজের একটা চিতল মাছ কিনেছিলেন, তার স্বাদ এখনো মুখে লেগে আছে।
আজ মাসের প্রথম শুক্রবার। আফতাব নাশতা শেষ করে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছেন, তখন মীরা তার সামনে এসে দাঁড়াল। মীরার বয়স একুশ। সে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ইকনমিক্স পড়ছে। থার্ড ইয়ার।
আফতাব বললেন, মা, কিছু বলবি?
মীরা বলল, আজ মাছ কিনতে যাবে না?
যাব। কেন?
এম্নি জিজ্ঞেস করছি। বাবা, আমার খুব ইচ্ছা করে দেখি কীভাবে তুমি মাছ কেন?
মাছওয়ালার সঙ্গে দরদাম করি, চেঁচামেচি করি, তোর দেখতে ভালো লাগবে না।
মীরা বলল, তোমার সঙ্গে যেতে ইচ্ছা করছে। বাবা, আমাকে সঙ্গে নাও না প্লিজ।
আফতাব কিছুক্ষণ মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। মেয়ে বড় হয়েছে কিন্তু ছেলেমানুষী এখনো যায় নি। তিনি গম্ভীর গলায় বললেন, উদ্ভট চিন্তাভাবনা। যাই হোক, রেডি ই।
বাবা! আরেক কাপ চা খাবে? আমি নিজে বানাব।
তোকে বানাতে হবে না। হাত পুড়বি। তোর মাকে বল। চা খেয়েই রওনা হব। দেরি করে গেলে ভালো মাছ কিছুই পাওয়া যাবে না।
মীরা চা বানাতে গেল। আফতাব টেলিফোন করলেন তার ছোটবেলার বন্ধু শামসুদ্দিনকে। সংসারের অতি খুঁটিনাটি বিষয়ও তিনি তার বন্ধুকে না জানিয়ে পারেন না।
হ্যালো শামসু! এমন বিপদে পড়েছি।
কী বিপদ?
মীরাকে নিয়ে বিপদ। সে আমার সঙ্গে ধূপখোলা মাছের বাজারে যাবে।
ভালো হতো, নিয়ে যাও।
ছোটবেলায়ও এরকম যন্ত্রণা করত। অফিসে যাব–গলা ছেড়ে কান্না। সঙ্গে যাবে।
বাপসোহাগী মেয়ে পেয়েছ। আমার বদমাইশটা কালও গাজা খেয়ে বাসায় ফিরেছে। তোমার ভাবি পালংকের কাঠ খুলে পিটিয়েছে। রক্তারক্তি কাণ্ড ছেলে ছেলে করে জীবন দিয়ে দিয়েছিল। আজমীর শরীফে গিয়ে সুতা বেঁধে এসেছে ছেলের জন্যে। এখন ছেলের মজা বুঝছে। গাঁজা, ফেনসিডিল কোনোটাই বাদ নাই। আচ্ছা রাখি।
আফতাব প্রশান্ত মনে মেয়েকে নিয়ে রিকশায় করে বের হলেন। মাছ প্রসঙ্গে মেয়েকে নানান ধরনের জ্ঞান দিলেন। মীরা বাবার ডানহাত শক্ত করে ধরে আছে।
আফতাব মনের আনন্দে গল্প করে যাচ্ছেন।
একেক সিজনের একেক মাছ। বোয়াল, চিতল খেতে হয় শীতে। তখন তাদের গায়ে চর্বি হয়। বর্ষার কই সবচেয়ে ভালো। কই তখন সাইজে ছোট থাকে, তবে মাংস থাকে মাখনের মতো নরম। রীঠা সবচেয়ে স্বাদু মাছ। একবার খেলে মুখে স্বাদ লেগে থাকে একমাস। তবে সমস্যা আছে।
কী সমস্যা?
রীঠা মাছ কিনতে হয় জীবন্ত। মরা মাছ বিস্বাদ।
মীরা বলল, আজ কী মাছ কিনবে বাবা?
আজ তুই যাচ্ছিস। তোর পছন্দে কিনব। তোর পছন্দ কী?
বড় চিংড়ি মাছ পাওয়া যাবে?
অবশ্যই পাওয়া যাবে। চিংড়ি কিনতে হয় কালার দেখে। চিংড়ির গা হতে হবে সবুজ।
বড় পাবদা মাছ কি পাওয়া যাবে বাবা?
পদ্মার ফ্রেস পাবদা মাঝে মাঝে পাওয়া যায়। তবে সিলেটের হাওরের পাবদা অসাধারণ। দেখি তোর ভাগ্যে কী আছে। তোর যা যা পছন্দ সবই কিনব।
মীরা বলল, থ্যাংক য়্যু বাবা।
চিংড়ি পাওয়া গেল না, তবে টাটকা পাবদা পাওয়া গেল। কানকো নড়ছে এমন একটা আইড় মাছ পাওয়া গেল। বড় বড় কই পাওয়া গেল। চাষের কই না, দেশী কই। শেষটায় মাঝারি সাইজের একটা ইলিশ মাছও কেনা হলো। আফতাব টাকার দিকে তাকালেন না। মেয়ে প্রথমবার শখ করে মাছ কিনতে এসেছে। দুদিন পর মেয়ের বিয়ে হয়ে যাবে। কার না কার হাতে পড়বে কে জানে! হয়তো জীবন পার করবে মলা মাছ আর কুচো চিংড়ি খেয়ে।
মীরার মা শাহানা চোখ কপালে তুলে বললেন, এত মাছ?
মীরা বলল, হ্যাঁ, এত মাছ। সব রাঁধবে। ফ্রিজে তুলে রাখবে না।
কে খাবে?
মীরা বলল, আমার এক বন্ধুকে আজ দুপুরে খেতে বলেছি মা।
বন্ধুটা কে? অতসী?
না, অতসী না।
তার নাম কী?
নামের দরকার আছে মা? সে অনেকদিন ভালোমন্দ কিছু খায় না। মেসে থাকে। একবেলা মেসে খায় একবেলা বাইরে খায়। মেসের খাবার কী জানো মা? এক পিস ফার্মের মুরগি আর ডাল। সে ফার্মের মুরগি খায় না বলে শুধু ঝোল দিয়ে ভাত খায়।
ছেলে না মেয়ে?
ছেলে। নাম শওকত।
শাহানা হতভম্ব গলায় বললেন, একটা ছেলেকে দুই দুপুরে খেতে বলেছিস?
মীরা মার চোখ থেকে চোখ নামিয়ে মেঝের দিকে তাকিয়ে হা-সূচক মাথা নাড়ল।
শাহানা বললেন, তোর সঙ্গে পড়ে?
না।
কী করে?
প্রাইভেট টিউশনি করে। অনেকদিন ধরে চাকরি খুঁজছে। পাচ্ছে না।
এরকম একটা ছেলের সঙ্গে তোর পরিচয় কীভাবে হলো?
মীরা জবাব দিল না।
সত্যি তাকে দুপুরে খেতে বলেছিস?
হুঁ।
কবে বলেছিস?
গতকাল। তার মেসে গিয়ে তাকে বলে এসেছি। সে খুব খুশি। তার মেনে যেতে হলো কেন?
ওর মোবাইল ফোন নেই মা। স্কলারশিপের টাকা পেয়ে আমি একটা কিনে দিয়েছিলাম। হারিয়ে ফেলেছে।
তুই তাকে মোবাইল ফোন কিনে দিয়েছিস?
হুঁ।
তুই কি প্রায়ই তার মেসে যাস?
হুঁ। মা, তোমার জেরা শেষ হয়েছে? জেরা শেষ হলে রান্না শুরু কর। আমি ওকে ঠিক দুটার সময় আসতে বলেছি।
হতভম্ব শাহানা বলল, ঐ ছেলেকে দেখে তোর বাবা কী বলবে এই নিয়ে ভেবেছিস?
না।
তোর বাবার রাগ তুই জানিস। জানিস না?
জানি।
সে ছেলের ঘাড়ে ধাক্কা দিয়ে তাকে রাস্তায় ফেলে দিতে পারে। পারে না?
পারে।
সেটা কি ছেলের জন্যে সম্মানের ব্যাপার হবে? না-কি তোর জন্যে সম্মানের হবে? আমার তো ধারণা পুরো ঘটনা জানার পর সে তোকে সুদ্ধ ঘাড় ধাক্কা দিয়ে রাস্তায় ফেলবে। তখন কী করবি? তার মেসে গিয়ে উঠবি? ফার্মের মুরগির ঝোল দিয়ে ভাত খাবি?
মীরা চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখ ছলছল করছে। চোখ থেকে একফোঁটা পানি টপ করে মেঝেতে পড়ল। শাহানা চোখের পানি পড়ার দৃশ্যটা দেখলেন। তাঁর মন মোটেই নরম হলো না। তিনি কঠিন গলায় বললেন, ছেলের বাবা কী করে?
বাবা মারা গেছেন।
যখন জীবিত ছিলেন তখন কী করতেন?
মুদির দোকান চালাতেন।
ছেলের বাবা তাহলে বিজনেস ম্যাগনেট?
মীরার চোখ থেকে আরেক ফোঁটা পানি পড়ল। তার বাঁ চোখ থেকে আরেক ফোটা পানি পড়ল। বাঁ চোখ থেকেই পানি পড়ছে। ডান চোখ শুকনো।
শাহানা বললেন, এত বড় সাহস কীভাবে করলি?
মীরা ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, ভুল হয়ে গেছে মা। আজ ওর জন্মদিন। আমাকে বলছিল প্রাইভেট টিউশনি থেকে আজ কিছু টাকা পাবে, তখন আমাকে নিয়ে করি নামের একটা দোকানে রুই মাছের পেটি খাবে। ওর কথা শুনে মনটা এত খারাপ হয়েছে, দাওয়াত দিয়ে ফেলেছি।
এখন আসতে নিষেধ কর। টেলিফোন কর। বল Some other time.
ওর মোবাইল নেই মা।
যা, মেসে গিয়ে বলে আয়।
মেসে গেলে পাওয়া যাবে না। শুক্রবারে তার সারাদিন টিউশনি। একটা টিউশনি থেকে সরাসরি বাসায় আসবে।
কত বড় গজব যে হবে বুঝতে পারছিস?
পারছি।
শাহানা কঠিন গলায় বললেন, যদি সাহস থাকে তোর বাবাকে গিয়ে বল। পাজি মেয়ে। খর্বদার আমার সামনে চোখের পানি ফেলবি না। গাধি।
মীরা বসার ঘরে গেল। বাবার সামনে দাঁড়াল। আফতাব খবরের কাগজ পড়ছিলেন। ছুটির দিনে একই কাগজ তিনি দুবার পড়েন। সকালে চা খেতে খেতে একবার। বাজার শেষ করে আরেকবার। আফতাব মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, চোখ লাল কেন রে মা!
মীরা বলল, জানি না।
আফতাব বললেন, শখ করে বাজার করেছিস, যা আজ একটা আইটেম তুই রান্না কর কেমন।
বাবা, আমি রাঁধতে জানি না।
তোর মাকে বল দেখিয়ে দেবে। চিংড়ি রান্না খুব সহজ। প্রতিভা ছাড়া এই মাছ খারাপ রান্না করা যায় না।
মীরা রান্নাঘরে ফিরে এল। মায়ের সামনে বসে ফুপিয়ে কাঁদতে লাগল।
শাহানা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন, কান্না বন্ধ কর। টেবিলের ওপর থেকে পাঁচশ টাকা নে। ওর আসার সময় হলে বাসার সামনে দাড়িয়ে থাকবি। ওর হাতে পাঁচশ টাকা ধরিয়ে দিয়ে বলবি রুই মাছের পেটি খেয়ে নিতে। পরে এই নিয়ে তোর সঙ্গে জরুরি বৈঠক করব। গাধা মেয়ে।
মীরা মার সামনে থেকে সরে গেল। আফতাব সাহেব হাসিমুখে ঢুকলেন। স্ত্রীকে বললেন, এখনো রান্না শুরু কর নি! মাছ নরম হয়ে যাচ্ছে।
শাহানা বললেন, মাছ নরম হবে না। যথাসময়ে রান্না শেষ হবে।
আফতাব বললেন, সুজিতকে দুপুরে খেতে বললে কেমন হয়? বেচারা একা থাকে, বাবুর্চি কী রান্না করে না করে তার নাই ঠিক। ও গাড়ি কিনেছে, শুনেছ তো?
শুনেছি।
গাড়ি নিয়ে চলে আসুক। কী গাড়ি কিনল দেখলাম। তুমি কী বলো?
শাহানা জবাব দিলেন না। সুজিতের সঙ্গে মীরার বিয়ের কথাবার্তা হয়ে আছে। সে ডাক্তার। লন্ডন থেকে FBcs ডিগ্রি নিয়ে এসেছে। তার বাবা-মা মীরাকে পছন্দ করে আংটি পরিয়ে গেছেন। মীরা সেই আংটি পরছে না। মাকে বলেছে, আংটিটা বড় হয়েছিল আঙুল থেকে কোথায় যেন খুলে পড়ে গেছে। শাহানা মেয়ের কথা বিশ্বাস করেছিলেন। এখন বুঝতে পারছেন ঘটনা কী।
আফতাব বললেন, কী, কথা বলছ না কেন?
শাহানা বললেন, আজ পিতা কন্যা বাজার করে এনেছ। তোমরাই খাওয়াদাওয়া কর। বাইরের কাউকে ডাকলে ফর্মাল ব্যাপার চলে আসবে।
তাও ঠিক। মীরাকে চিংড়ি মাছ কীভাবে রাঁধতে হয় শিখিয়ে দাও। দেখি তোমার মেয়ের হাতের রান্নার কী অবস্থা।
শাহানা বললেন, তোমার সঙ্গে আমার বিশেষ কিছু কথা আছে। এখন বলব, না পরে বলব বুঝতে পারছি না।
গলির মোড়ে শওকতকে দেখা গেল। সে আজ ইস্ত্রি করা পাঞ্জাবি পরেছে। পায়ে নতুন স্যান্ডেল। আজই চুল কেটেছে বলে অদ্ভুত দেখাচ্ছে। তার হাতে দোলনচাঁপা ফুলের তোড়া। মীরা এগিয়ে গেল।
শওকত বলল, দেরি করে ফেললাম?
মীরা বলল, না।
শওকত বলল, টিউশনির টাকাটার জন্যে অপেক্ষা করতে করতে দেরি হলো।
পেয়েছ?
পেয়েছি। এই টাকাতেই তো নতুন স্যান্ডেল কিনলাম। ভয়ঙ্কর খিদে লেগেছে। মীরা, তোমাদের বাসায় রান্না কী? ভালো কথা, তোমার বাবা-মা আমাকে দেখে আপসেট হবেন না তো?
মীরা বলল, আজ বাসায় একটা সমস্যা হয়েছে। অনেক লোকজন চলে এসেছে। আজ বাসায় তোমাকে নেব না।
ও আচ্ছা।
আস, এই রেস্টুরেন্টে ঢুকি। কিছু খেয়ে নাও। রুই মাছের পেটি পাওয়া যায় কি-না দেখ। আমি বাসায় চলে যাচ্ছি। এই টাকাটা রাখ।
টাকা লাগবে না। টাকা আছে।
প্লিজ টাকাটা রাখ তো। আজ আমার নিমন্ত্রণ।
রেস্টুরেন্টে আছে শুধু তেহারি। মুরগির ঝালফ্রাই ছিল। শেষ হয়ে গেছে।
শওকত তেহারি অর্ডার দিয়েছে। বয়কে বিনীত গলায় বলল, ঝালাইয়ের ঝোল যদি থাকে আলাদা করে একটু ঝোল দেবেন।
তেহারি চলে এসেছে। মুরগির ঝালাইয়ের ঝোল এসেছে। পেঁয়াজ কাঁচামরিচের সালাদ এসেছে। শওকত খাওয়া শুরু করবে, তখনি আফতাব ঢুকলেন। এদিক ওদিক তাকিয়ে এগিয়ে গেলেন শওকতের দিকে। গম্ভীর গলায় বললেন, তোমার নাম শওকত?
শওকত থতমত খেয়ে উঠে দাঁড়াল। আফতাব বললেন, আমার মেয়ে তোমাকে দুপুরে খাবার নিমন্ত্রণ করেছে?
জি স্যার!
টেবিলে খাবার দেয়া হয়েছে, খেতে আস। আমার মেয়ে তোমার জন্যে অপেক্ষা করছে।
আফতাব সাহেব ছেলের পিঠে হাত রাখতে রাখতে বললেন, আমার মেয়েটা খুব কাঁদছে। এত কান্নার কী আছে বুঝলাম না। সে আজ জীবনের প্রথম চিংড়ি মাছ রান্না করেছে। খেয়ে দেখ তো কেমন।
“আজ দুপুরে তোমার নিমন্ত্রণ” সমগ্র সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ