২৯শে আগষ্ট ১৯৭১ । বর্ষণমুখরিত রাত। পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আজাদদের বাসায় সে রাতে অবস্থান করছে আজাদ, কাজি কামালউদ্দিন এবং জুয়েল। আজাদদের দু’তিন জন আত্মীয় এসেছে গ্রামের বাড়ি থেকে। তারাও সে রাতে সেই বাড়িতেই থাকবে।

আজাদের মা অনেকদিন পর ওদের পেয়ে ভালো খাওয়া-দাওয়ার বন্দোবস্ত করেছেন। ওরা সবাই মুক্তিযোদ্ধা। ধুমকেতুর মত এসে উপস্থিত হয় মাঝে মাঝে আবার হঠাৎ করেই চলে যায়। ঢাকার বিভিন্ন স্থানে গোপনে লুকিয়ে থেকে ঢাকার বুকে দুর্ধর্ষ অপারেশন চালিয়ে যাচ্ছে ওরা জীবন বাজি রেখে। খাওয়া থেকে আরম্ভ করে কত রকমের কষ্টই না সহ্য করতে হচ্ছে ওদের। হাজার হলেও মায়ের প্রাণ । তাই অনেকদির পর ছেলেদের কাছে পেয়ে তাদের কিছু ভালোমন্দ খাওয়ানোর আয়োজন করেছেন তিনি। খাওয়া সেরে মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন গল্প শুনতে শুনতে অনেক রাত করে সবাই শুতে গেল ৷

ড্রইং রুমে ঢালা বিছানা পেতে শুয়ে পড়েছে আজাদ, কাজি, জুয়েল ও গ্রাম থেকে আসা আজাদের আত্মীয়রা। হঠাৎ করে দরজা ভেঙ্গে ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ল বেশ কয়েকজন অস্ত্রধারী খানসেনা। ঘটনার আকস্মিকতায় সবাই অপ্রস্তুত। ঘরে ঢুকেই লাথি মেরে ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলা হল সবাইকে। জুয়েল কয়েকদিন আগে যাত্রাবাড়ি অপারেশনে আহত হয়েছে। ডঃ আজিজের ক্লিনিকে গোপনে তার হাতের অপারেশন করা হয়েছে। হাতে তখনও ব্যান্ডেজ বাধাঁ। অল্পক্ষণেই সবাই বুঝতে পারলো বাড়ি রেইড করা হয়েছে । সাক্ষাত জমদূতের আগমন, মৃত্যু অবধারিত।

খানসেনারা ওদের সবাইকে সঙ্গিনের গুতো দিয়ে দেয়ালের কাছে সারিবদ্ধভাবে দাড় করাল। “কাজি কউন হ্যায়?” প্রশ্ন করল একজন। কেউ মুখ খুলল না। অন্য দু’জন সারা ঘর তল্লাশী করছে। হঠাৎ একজন একটা চাইনিজ ৭.৬২ পিস্তল একটা বালিশের নিচ থেকে উদ্ধার করল। প্রমাদ গুনল সবাই। পিস্তলটা কাজির। আবার প্রশ্ন, “কাজি কউন হ্যায়?” কেউ কোন জবাব দিচ্ছে না দেখে একজন সুবেদার এগিয়ে এসে জুয়েলের ব্যান্ডেজ বাধাঁ হাতটা অমানুষিকভাবে মুচড়ে ধরল। অসহ্য ব্যাথায় চিৎকার করে জুয়েল কিছু কথা কিছু ব্যথা বেহুশ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে গোঙ্গাতে থাকল। জুয়েলের আর্তনাদে আজাদের মা পাগলীনির মত ভেতরের ঘর থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করলেন। একজন খানসেনা রাইফেলের বাঁট দিয়ে তাঁর মাথায় আঘাত হানল। তিনি সংজ্ঞা হারিয়ে দরজার মুখেই মুখ থুবড়ে পড়ে গেলেন। বেদম মারধর শুরু হল সবার উপর। কিল-ঘুষি, বাঁটের গুতো, লাথি কিছুই বাদ পড়ছে না। সব অত্যাচার সহ্য করে সবাই নিশ্চুপ দাড়িয়ে আছে।

কাজি ভাবছে কি করা যায় ? তাকে যেখানে দাড় করানো হয়েছে তার বিপরীতেই খোলা দরজা, পাশে একটা ছোট্ট ডিভান। হঠাৎ একজন তরুণ ক্যাপ্টেন ঢুকল খোলা দরজা দিয়ে পিস্তল হাতে। তাকে দেখেই সুবেদার সাহেব খুঁজে পাওয়া চাইনিজ পিস্তলটা তার হাতে তুলে দিয়ে কি যেন বলছিল। সেই ক্ষণিকের অসতর্ক মুহুর্তে কাজি একলাফে ছিনিয়ে নিল সুবেদারের হাতের চাইনিজ ষ্টেনগান। সেটা নিয়েই কাজি উঠে দাড়াল ডিভানের উপর। কেউ ভাবতে পারেনি এ ধরণের একটা দুঃসাহসিক পদক্ষেপ নেবে কাজি।

-Don’t move. Hands up. গর্জে উঠল কাজি। তার ষ্টেনগান তখন ক্যাপ্টেন ও সুবেদারের দিকে তাক করা। অপ্রত্যাশিত ঘটনায় বিহ্বল হয়ে সুবেদার ও ক্যাপ্টেন দু’জনেই হাত তুলে দাড়াল নিরুপায় হয়ে। কাজি আবার গর্জে উঠল,

-Tell your man to drop their guns. Quick.

ক্যাপ্টেন আদেশ দিল অন্যদের। সবাই হাতিয়ার ফেলে হাত উঁচু করে দাড়িয়ে রইল হতবম্ব হয়ে। হঠাৎ কাজি দেখতে পেল আরেকজন খানসেনা খোলা দরজা দিয়ে ঢোকার জন্য এগিয়ে আসছে। মুহুর্তে সিদ্ধান্ত নিল কাজি ফায়ার ওপেন করার। তার ষ্টেনগান গর্জে উঠল। ঘরের সব কয়জন খানসেনা এবং দরজার দিকে এগিয়ে আসা খানসেনাটি লুটিয়ে পড়ল গুলি খেয়ে। কাজি চিৎকার করে মুক্তিযোদ্ধাদের বলল,

– Run, Run for life. পালাও। বলেই সে নিজেও খোলা দরজা দিয়ে ফায়ার করতে করতে বেরিয়ে গেল বাইরের অন্ধকারে।

কয়েক মুহুর্তের ঘটনা। বাইরে পাহারারত খানসেনাদের কিছু বোঝার আগেই অন্ধকারে মিলিয়ে গেল কাজি। তার পরনের লুঙ্গি কখন খুলে পড়ে গেছে টেরও পায়নি কাজি। প্রাণপণে পার্চিলের পর পার্চিল টপকে ছুটে চলেছে কাজি সম্পূর্ণ দিগম্বর আবস্থায়। কিছু কথা কিছু ব্যাখা অনেকদূর চলে এসেছে কাজি। তখনও শোনা যাচ্ছে গোলাগুলির অবিশ্রান্ত আওয়াজ। আজাদদের বাসার সীমানা থেকে কাজি তখন অনেকদূরে চলে এসেছে।

হঠাৎ তার খেয়াল হল সে সম্পূর্ণরুপে উলঙ্গ। এ অবস্থায় কি করা যায়? উলঙ্গ হয়ে রাস্তায় চলাও বিপদজনক। হঠাৎ ওর মনে হল দিলু রোডে মুক্তিযোদ্ধা আলমদের বাড়ি । সেখান থেকেই কাপড় সংগ্রহ করে পালাতে হবে। ছুটে গিয়ে দরজায় কড়া নাড়তেই জানালা দিয়ে মুখ বের করল আলমের ছোট বোন। কাজিকে সম্পূর্ণ উলঙ্গ অবস্থায় দেখে ও ভরকে গেল। সংক্ষেপে কাজি সব ঘটনা খুলে বলে তাকে অনুরোধ করল কিছু কাপড়ের বন্দোবস্ত করার জন্য। তড়িৎ গতিতে আলমের বোন আলমেরই এক গ্রন্থ কাপড় এনে দিল কাজিকে। কাজি সেগুলো পরে নিয়ে ছুটে পালিয়ে গেল রাতের অন্ধকারে। আলম তখন গেছে মেলাঘরে, অস্ত্রের অন্বেষায়। তীক্ষ্ণ উপস্থিত বুদ্ধি এবং অসীম সাহসের বদৌলতে কাজি প্রাণ নিয়ে পালাতে সক্ষম হয়েছিল সে রাতে। দলের অন্য কেউই আজাদদের বাড়ি থেকে সে রাতে পালাতে পারেনি। সবাই ধরা পড়েছিল খানসেনাদের হাতে। পরে তাদের বন্দি অবস্থায় ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ক্যান্টনমেন্টে। দেশ স্বাধীন হবার পর ওদের কারো কোন হদিস পাওয়া যায়নি। আজাদের মা আজো আজাদের অপেক্ষায় রয়েছেন। তার ধারণা তার ছেলে নিশ্চয়ই বেঁচে আছে এবং ফিরে আসবে একদিন।

error: Content is protected !!