খবরটা বিশালভাবেই ছড়িয়েছিল—আগরপাড়ার একটা বাড়িতে রহস্যজনকভাবে যেখানে-সেখানে আগুন জ্বলে উঠছে যখন-তখন। আগুন প্রথম জ্বলেছিল গত ২৪ এপ্রিল ১৯৯৩। শনিবার সকাল ৯টায়। তারপর থেকে আগুন তাড়া করে ফিরেছে বিভিন্ন ঘরে বিভিন্ন সময়ে। আগুন ধরেছে বিছানার গদিতে, চাদরে, শাড়ির কোনায়, খাতায়, বই-পত্তরে এমনকি কাঠের ইঁদুর-কলে। রহস্যময় এমন আগুনের যখন-তখন আক্রমণে বাড়ির সকলের নাওয়া-খাওয়া-শোওয়া শিকেয় উঠেছে। বাড়ির প্রবীণতম সদস্য সদানন্দ দাস। সংসারে আছেন তাঁর স্ত্রী, তিন ছেলে, বয়স চল্লিশ থেকে পঞ্চাশের মধ্যে, তিন পুত্রবধূর বয়স তিরিশ থেকে চল্লিশের মধ্যে ও পাঁচ নাতি-নাতনি। সবচেয়ে বড় নাতি বাবাই পড়ে ক্লাস সেভেন-এ।

ও বাড়িতে আর থাকতেন চার ঘর ভাড়াটে, যাঁদের এক ঘর বাড়ি ছেড়ে উঠে গেছেন ভূতুড়ে আগুনের আক্রমণে সবে গত মঙ্গলবার।

আগুন-হানার রহস্য উন্মোচনে যাঁরা সবচেয়ে আগে এগিয়ে এসেছিলেন, তাঁরা হলেন সপ্তর্ষি ক্লাবের টগবগে তরুণা। তাঁদের সঙ্গে সহযোগিতা করেছিলেন স্থানীয় দমকল বাহিনী ও স্থানীয় পুলিশ। পাশের পুরনো কুয়ো থেকে কোনও গ্যাস বেরিয়ে এমন অঘটন ঘটিয়েছে কি না—পরীক্ষা করতে দমকল বাহিনী দড়ি বেঁধে হ্যারিকেন নামিয়েছে। হ্যারিকেন নিভে যেতে কুয়োকে গ্যাস মুক্ত করতে জল এনে কুয়ো ভর্তি করে কুয়োকে গ্যাসমুক্ত করেছেন, কিন্তু তাতেও বাড়িকে আগুন-মুক্ত করতে পারেননি। অগত্যা বাড়ির বিদ্যুতের মেইন সুইচ বন্ধ করে দিয়েছেন। কিন্তু তাতেও আগুন-রহস্য পিছু ছাড়েনি। বাড়ির ছেলেরা ওঝা নানুবুড়োকে এনেছেন গত বৃহস্পতিবার সকালে। প্রণামী দুশো একান্ন টাকা। নানুবুড়ো জলপড়া ছেটাবার সময়ই আগুন জ্বলেছে একটা খবরের কাগজে। খড়দার এক ভর-এ পড়া মানুষের দ্বারস্থ হয়েছিলেন বাড়ির লোকেরা। তিনি ভরগ্রস্ত অবস্থায় জানিয়েছিলেন, ‘ব্রহ্মভূত এমনটা ঘটাচ্ছে।’ জলপড়া দিয়ে দিয়েছিলেন। ঘরের চারপাশে জলপড়া ছেটানো হয়েছে। কিন্তু আগুন ঠেকানো যায়নি তাতেও।

পরের সপ্তাহের বৃহস্পতিবার রাতে যুক্তিবাদী সমিতির সদস্য দেবাশিস চ্যাটার্জি গিয়েছিলেন সমিতির তরফ থেকে সরেজমিনে তদন্ত করতে। ঘরের প্রত্যেক সদস্যকে একঘরে কথায় কথায় আটকে রেখেছিলেন রাত সাড়ে ন’টা থেকে শুক্রবার সকাল পাঁচটা পর্যন্ত। এই প্রথম ওই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে কোনও আগুন জ্বলল না। দেবাশিস জানিয়ে এলেন শুক্রবার প্রবীর ঘোষ আসবেন।

শুক্রবার দুপুর দুটো তিরিশে নিজে গিয়ে হাজির হলাম ওই বাড়িতে। শুনলাম এখন পর্যন্ত আর একবারের জন্যেও আগুন ধরেনি। আমি যাব খবর পেয়ে ‘দ্য টেলিগ্রাফ’ ও ‘সংবাদ প্রতিদিন’ পত্রিকার সাংবাদিক ও চিত্র সাংবাদিকরা হাজির হয়েছিলেন আমারও আগে।

আগরপাড়ায় সদানন্দ দাসের বাড়িতে যুক্তিবাদী সমিতির সদস্যরা। শুক্রবার, ছবিঃ অভিজিৎ মুখার্জি, ১ মে, ১৯৯৩ আজকাল

ঘরে বসেছিলেন এক মাজারের পীর। পীরকে এনেছেন বাড়ির বড় ছেলে সমীর দাসের শ্যালক সনৎকুমার। পীরসাহেব ঘণ্টা দেড়েক ‘ভর হওয়া’ মানুষের মত মাথা দুলিয়ে জানিয়েছেন—জিনের কাণ্ড। পীর চার দেওয়ালে চারটে গজাল পুঁতে দিয়ে বাড়ি বেঁধে দিয়েছেন জিনের কারসাজি বন্ধ করতে।

সমস্যা হল ভিড়। যে ঘরে ঢুকি আমার সঙ্গে ঢুকে পড়েন এক ঝাঁক উৎসাহী জনতা, সপ্তর্ষির সদস্যরা ও সাংবাদিক, চিত্র-সাংবাদিকরা। আমি গিয়েছি ‘আজকাল’ পত্রিকার তরফ থেকে। চিত্র-সাংবাদিক হিসেবে সঙ্গে এসেছেন অভিজিৎ মুখার্জি। ভূতুড়ে পোড়ার কিছু স্যাম্পেল দেখা দরকার। বাড়ির সম্প্রতি পোড়া কিছু জামা-কাপড় বা কাগজ এনে দিতে বলতে মেজছেলে প্রবীর ও সনৎবাবু একটা শো-কেসের ওপরে পাতা আধ-পোড়া খবরের কাগজ থেকে কিছুটা ছিঁড়ে দিলেন, গন্ধ শুঁকলাম। কোনও তীব্র বিশেষ গন্ধ পেলাম না, যেটা মেটালিক সোডিয়ামের সাহায্যে জ্বালালে হত। সবার সামনে কাগজে কিছুটা জল ঢেলে দিতেই খবরের কাগজের রঙ মুহূর্তে হয়ে গেল হালকা বেগুনি। যেমনটা পটাসিয়াম পারমাঙ্গানেটে জল পড়লে হওয়া উচিত। ঘরে তখন অনেক দর্শক। আগুনের ক্ষেত্রে যে পটাসিয়াম পারমাঙ্গানেটের একটা প্রবল ভূমিকা ছিল এটা বুঝিয়ে দিয়ে বললাম, এর সঙ্গে গ্লিসারিন মিশলেই বিক্রিয়ায় আগুন জ্বলে, আর এ ভাবেই প্রতিটি ক্ষেত্রে আগুন জ্বালানো হয়েছে। পটাসিয়াম মেশানো জল জিভে চেটে দেখলেন আজকাল-এর চিত্র সাংবাদিক অভিজিৎ মুখার্জি, চাখলেন সনৎবাবু। দুজনেই একমত, পটাসিয়াম পারম্যাঙ্গানেটই।

পরিবারের সকলের সঙ্গেই আলাদাভাবে কথা বললাম। বাইরের কারও পক্ষে এই ঘরে বিভিন্ন সময়ে ঢুকে পটাসিয়াম পারমাঙ্গানেট ও গ্লিসারিন আগুন জ্বলে ওঠার মত করে গুছিয়ে রেখে যাওয়া অসম্ভব। সুতরাং এটা ভাড়াটে বা কোনও প্রমোটারের পরিকল্পনার অঙ্গ হতে পারে না । তবে যে জ্বালাচ্ছে, সে এই দুটির ব্যবহার বিষয়ে ওয়াকিবহাল। আমাদের সমিতির ‘অলৌকিক, নয়, লৌকিক’ বইটি পড়ে এই রসায়ন দুটির প্রয়োগ শিখেছে, এমনও হতে পারে। খুবই ক্যাজুয়েল ভঙ্গিতে অথচ আসলে সতর্কতার সঙ্গে বাড়ির সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হলাম। জানালাম এই পরিবারেরই একজন ঘটনাটা ঘটাচ্ছে। এই পরিবারেরই একজন এমনটা ঘটাচ্ছে বলায় বাড়ির কেউই তেমন সন্তুষ্ট হতে পারছিলেন না। এমন কি ওই দুটি রসায়নে আগুন জ্বলে—এটা মানতেই চাইলেন না। আবার ‘সপ্তর্ষির কেউ কেউ যদিও বা মানলেন, তবু তাঁদের জিজ্ঞাসা-আগুন জ্বলার সময় ধারে-কাছে কাউকে দেখা যাচ্ছে না কেন? হাতে-কলমে আমাকে পরীক্ষা করে দেখাবার জন্য রীতিমত চ্যালেঞ্জ জানালেন দু-একজন অতি উৎসাহী দর্শক। সপ্তর্ষির এক তরুণ দৌড়ে কিনে আনলেন গ্লিসারিন ও পটাসিয়াম পারম্যাঙ্গানেট। বাড়ির বড় বউ দিলেন এক টুকরো কাপড়। কাপড়ের ভাঁজে পটাসিয়াম ছড়িয়ে দিয়ে ঝুলিয়ে দিলাম কাপড়টা। কাপড়ে গ্লিসারিন ঢেলে দিলাম। এক সময় গ্লিসারিন গা বেয়ে নেমে এল, পটাসিয়ামের সঙ্গে বিক্রিয়া শুরু করল, ধোঁয়া-পোড়া গন্ধই হচ্ছিল।’ পোড়া কাপড়ে এক গ্লাস জল ঢেলে দিতেই কাপড়টা হালকা বেগুনি হয়ে গেল—খবরের কাগজটার মতই ।

সমীরবাবু বললেন, ‘আপনি তো বললেন আমাদের পরিবারেরই কেউ এমনটা ঘটাচ্ছিল। আপনার কথা যদিও মেনে নিই, তবুও একটা প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে, যে ঘরে যখন আগুন জ্বলছে তখন দেখা গেছে ঘর ফাঁকা, কেউ নেই ।”

‘তেমনটাই তো হওয়ার কথা। যে আগুন জ্বালাচ্ছিল, সে যথেষ্ট চালাক। গ্লিসারিন ঢালছে কাপড়ে বা চাদরে। যেখানে ঢালছে তার কিছুটা নীচে রাখছে পটাসিয়াম। গ্লিসারিন ধীরে ধীরে নামছে। ততক্ষণে ভিলেন অনেক দূরে। তাই প্রতিবারই ঘটনাস্থলে ঘটনার সময় ভিলেনের দেখা মেলেনি।’

সপ্তর্ষির অনেকেই জানতে চাইলেন ভিলেনের নাম। সম্ভবত তাতেই উদ্দীপ্ত হয়ে বাড়িরই এক বউ প্রায় সমস্বরে বললেন, ‘নামটা যদি জানেনই তো জানান না।’

বললাম, ‘দেখুন যে এমনটা করেছে, সে আমাকে কথা দিয়েছে আর করবে না। তার কথা ক্যাসেটবন্দি করা আছে। তাকে আমিও কথা দিয়েছি, আর এমনটা না করলে তার নাম কাউকে জানাব না। আপনাদের প্রত্যেকের কাছে অনুরোধ তাকে ভালো হওয়ার একটা সুযোগ দিন । এরপরও সে যদি আবার এমন ঘটনা ঘটায় আমি নিজে এসে তার স্বীকারোক্তি আপনাদের শুনিয়ে দিয়ে যাব।’

আমার এই কথা শোনার পর কেউ আর নাম জানাতে পীড়াপীড়ি করেননি।

এ ভাবেই আগুন ভূতের টগবগে রহস্যে জল ঢেলে দিয়ে আগরপাড়ায় বিজ্ঞানমনস্কতার জয়কেই আবারও ঘোষণা করে এলাম।

১মে ৯৩ এ বহু পত্রিকাতেই ছবিসহ এই রহস্যভেদের খবর প্রকাশিত হয়েছিল।

♦ কিছু কথা

প্রথম খন্ড

♦ কিছু কথা

অধ্যায়ঃ এক

♦ মার্কিন গডম্যান মরিস সেরুলোঃ একটি ইতিহাস

অধ্যায়ঃ দুই

♦ যোগী-জ্যোতিষী হরেকৃষ্ণবাবা !

অধ্যায়ঃ তিন

♦ পঞ্চাশ বছর আগের বালক ব্রহ্মচারী এবং…

অধ্যায়ঃ চার

♦ মেঠাইবাবার রহস্যভেদ

অধ্যায়ঃ পাঁচ

♦ হাড় ভাঙ্গার দৈব-চিকিৎসা

অধ্যায়ঃ ছয়

♦ কাকদ্বীপের দৈব-পুকুর

অধ্যায়ঃ সাত

♦ আগরপাড়ায় ‘ভূতুরে’ আগুন

অধ্যায়ঃ আট

♦ প্রদীপ আগরওয়ালের সম্মোহনে ‘পূর্বজন্মে’ যাত্রা

অধ্যায়ঃ নয়

♦ কামধেনু নিয়ে ধর্মব্যবসা

অধ্যায়ঃ দশ

♦ বরানগরের হানাবাড়িঃ গ্রেপ্তার মানুষ- ভূত

অধ্যায়ঃ এগারো

♦ এফিডেভিট করে ডাক্তারের প্রশংসাপত্র নিয়ে ওঝাগিরি !

অধ্যায়ঃ বারো

♦ ‘গ্যারান্টি চিকিৎসা’র নামে হত্যাকারীর ভূমিকায় সর্পবিদ হীরেন রায়

অধ্যায়ঃ তেরো

♦ চলো যাই ফকিরবাড়ি

অধ্যায়ঃ চোদ্দ

♦ সাঁইবাবার চ্যালেঞ্জঃ পেটে হবে মোহর !

অধ্যায়ঃ পনেরো

♦ হুজুর সাইদাবাদীঃ মন্তরে সন্তান লাভ !

অধ্যায়ঃ ষোলো

♦ জলাতঙ্ক ও দৈব-চিকিৎসা

অধ্যায়ঃ সতেরো

♦ বিশ্বাসের ব্যবসায়ীরা ও নপুংসক আইন

দ্বিতীয় খন্ড

♦ কিছু কথা

অধ্যায়ঃ এক

♦ খেজুর তলার মাটি সারায় সব রোগ

অধ্যায়ঃ দুই

♦ পক্ষিতীর্থমের অমর পাখি

অধ্যায়ঃ তিন

♦ স্বামী রামদেবঃ সন্ন্যাসী, সর্বযোগসিদ্ধ যোগী, যোগচিকিৎসক !

অধ্যায়ঃ চার

♦ নাকালের দৈব-পুকুরঃ হুজুগের সুনামী

অধ্যায়ঃ পাঁচ

♦ সায়েব যখন রেইকি করে রাঘব বোয়াল চামচা ঘোরে

অধ্যায়ঃ ছয়

♦ লক্ষ্মীমূর্তি কালি হলেন আপন খেয়ালে

অধ্যায়ঃ সাত

♦ পাথর যখন কথা বলে

অধ্যায়ঃ আট

♦ ফাঁদে পড়ে জ্যোতিষী শ্রীঘরে

অধ্যায়ঃ নয়

♦ বিশ্বের বিস্ময় অলৌকিক মাতা জয়া গাংগুলী’র বিস্ময়কর পরাজয় এবং…

অধ্যায়ঃ দশ

♦ আই আই টিতে টেলিপ্যাথি দেখালেন দীপক রাও

অধ্যায়ঃ এগারো

♦ জন্ডিস সারাবার পীঠস্থান ইছাপুর

অধ্যায়ঃ বারো

♦ মালপাড়ার পেশা দাঁতের পোকা বের করা

অধ্যায়ঃ তেরো

♦ নিমপীঠের গুগি মা

তৃতীয় খন্ড

♦ কিছু কথা

অধ্যায়ঃ এক

♦ ওঝার ঝাড়ফুঁক আর টেরিজার লকেটে মণিহার রোগমুক্তিঃ কুসংস্কারের দু’পিঠ

অধ্যায়ঃ দুই

♦ ‘মেমারিম্যান’ বিশ্বরূপ-এর একটি বিশুদ্ধ প্রতারণা

অধ্যায়ঃ তিন

♦ কোটিপতি জ্যোতিষী গ্রেপ্তার হলেন

চতুর্থ খন্ড

অধ্যায়ঃ এক

♦ কিস্যা অক্টোপাস পল বিশ্বকাপ ফুটবলের ভবিষ্যৎ বক্তা

অধ্যায়ঃ দুই

♦ কিস্যা জ্যোতিষী বেজান দারওয়ালা

অধ্যায়ঃ তিন

♦ সাধারণ নির্বাচন ২০০৯ নিয়ে সব জ্যোতিষী ফেল

অধ্যায়ঃ চার

♦ মা শীতলার পায়ের ছাপ পুকুরঘাটেঃ রহস্যভেদ

অধ্যায়ঃ পাঁচ

♦ যিশুর মূর্তি থেকে রক্তপাত

অধ্যায়ঃ ছয়

♦ সত্য সাঁই-এর সত্যি-মিথ্যে

অধ্যায়ঃ সাত

♦ অলৌকিক উপায়ে সন্তান দেন ডা. বারসি

অধ্যায়ঃ আট

♦ জ্যোতিষীর বাড়িতে অলৌকিক আগুন

অধ্যায়ঃ নয়

♦ সম্মিলিত দুর্নীতির ফসল ‘মোবাইলবাবা’

অধ্যায়ঃ দশ

♦ জাতিস্মরঃ রাজেশ কুমার

♦ অলৌকিক শক্তিধরদের প্রতি চ্যালেঞ্জ

“যুক্তিবাদীর চ্যালেঞ্জাররা” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ

⇒ মন্তব্য করুন⇐

error: Content is protected !!