ক্ষমতায় বসানো হল আওয়ামী লীগকে
যদিও দেশ স্বাধীনতা লাভ করে ১৬ই ডিসেম্বরর ১৯৭১ কিন্তু সৈয়দ নজরুল ইসলামের প্রবাসী সরকার এবং মন্ত্রিসভার আগমন ঘটে ২২শে ডিসেম্বর ১৯৭১-এ।
ঢাকায় এসেই তাজুদ্দিন সরকার ঘোষণা করে, “তাদের সরকার বিপ্লবী সরকার। বাংলাদেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করাই তাদের লক্ষ্য।” যদিও ১৯৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে সমাজতন্ত্রের কোন অঙ্গীকার ছিল না। সমাজতন্ত্রের শৃঙ্খলে বাংলাদেশের জনগণ কখনোই নিজেদের বন্দী করতে আগ্রহী ছিল না। তাদের সর্বকালের দাবি ছিল অর্থনৈতিক স্বাধীনতা এবং সামাজিক ন্যায় বিচার। জনাব প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণাকে চ্যালেঞ্জ করেছিল তৎকালীন প্রগতিশীল, দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দলগুলো। ১৯৭২ সালের ১৭ই জানুয়ারী বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক সমাজবাদী দল অন্যান্যদের সাথে প্রশ্ন তোলে। তারা বলে, “আওয়ামী লীগ সরকার বিপ্লবী সরকার হতে পারে না। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম যদি বিপ্লবই হয়ে থাকে তবে সে বিপ্লব শুধু আওয়ামী লীগই করেনি, করেছে এ দেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ। আর তাই সকল দলের প্রতিনিধি নিয়েই গঠন করতে হবে স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সরকার।” তাদের এ দাবি যুক্তিসঙ্গত হওয়া সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ ভারতীয় সাহায্যে প্রবাসকালের একলা চলো নীতিই ধরে রাখে। মস্কোপন্থী মোজাফফর ও মনিসিং গং ক্ষমতার অংশ না পেয়েও যুদ্ধকালীন সময় থেকেই তাদের বিদেশী মুরুব্বীদের ইচ্ছানুসারে আওয়ামী লীগ সরকারের লেজুড়বৃত্তি করতে থাকে নির্লজ্জভাবে। ভারতীয় রাজনীতিতে সিপিআই যেভাবে কংগ্রেসের লেজুড়ে পরিণত হয় ঠিক সে স অবস্থাই হয়েছিল মোজাফফর ন্যাপ এবং মনিসিং এর কম্যুনিষ্ট পার্টির বাংলাদেশের রাজনীতিতে।
কিন্তু সার্বিক আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির দ্রুত অবনতির ফলে প্রফেসর মোজাফফর আহমদ (মোজাফফর ন্যাপের প্রেসিডেন্ট) আওয়ামী লীগের লেজুড়বৃত্তি করেও অবস্থার চাপে ১০ই মে চট্টগ্রামে জাতীয় সরকার কায়েমের দাবি তুলতে বাধ্য হয়েছিলেন।
আওয়ামী লীগের তাত্ত্বিক দেউলিয়াপনা
জনাব তাজুদ্দিন আহমদ এবং মুজিববাদীদের মধ্যে ক্ষমতার লড়াই।
শ্রেণীগতভাবে আওয়ামী লীগ ছিল বুর্জুয়া এবং পাতি বুর্জুয়া শ্রেণীর প্রতিনিধিত্বকারি দল৷ কিন্ত এই দলে জাতীয়তাবাদী, প্রগতিশীল এবং সমাজতন্ত্রীরাও ছিল। এ কারণে বিপরীতমুখী চিন্তা-ভাবনা দলে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, অসন্তুষ্টি এবং সংঘর্ষের সৃষ্টি করে।
প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজুদ্দিন আহমদ প্রচার করেছেন বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র তথা খাঁটি সমাজতন্ত্রই বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হবে অন্য কিছু নয়। তার এসব বক্তব্য ও প্রচারণাকে কেন্দ্র করে ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরের ক্ষমতার অর্ন্ত-দ্বন্দ্বগুলো ক্রমান্বয়ে উম্মোচিত হতে থাকে। ক্রমবর্ধমান সমস্যার মোকাবেলার জন্য ১৯৭২ সালের ১০ইমে চট্টগ্রামে এক জনসভায় আওয়ামী লীগের লেজুড় দল ন্যাপের সভাপতি জনাব মোজাফফর আহমদ সর্বদলীয় সরকার গঠনের আহ্বান জানাতে বাধ্য হন।
আগেই বর্ণিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের উপর অনাস্থা ও যুদ্ধত্তোর বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতি যে কোন হুমকির মোকাবেলা করার জন্য তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর বিশেষ উপদেষ্টা ভারতের অন্যতম কূটনীতিবিদ জনাব ডিপি ধরের পরামর্শে এবং বাংলাদেশ প্রবাসী সরকারের একাংশের বিশ্বাসঘাতকতায় মুক্তি বাহিনীর পাশাপাশি ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে গড়ে তোলা হয়েছিল বিএলএফ পরবর্তিকালে মুজিব বাহিনী।
বাংলাদেশের চারজন ছাত্রনেতা ভারতীয় সরকারের এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করার বিষয়ে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। এই চতুরঙ্গ তোফায়েল, রাজ্জাক, শেখ মনি ও আব্দুর রাজ্জাক পরবর্তিকালে বাংলাদেশের ‘চার খলিফা’ নামে প্রসিদ্ধ লাভ করেন। তাদেরই একজন জনাব তোফায়েলকে দিয়ে ১৭ই ফেব্রুয়ারী ১৯৭২ এ ঘোষণা করা হল, “মুজিববাদ কায়েম করব। মুজিববাদের চার স্তম্ভঃ গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ এবং ধর্মনিরপেক্ষতা।” তিনি মুজিববাদের একটি ব্যাখ্যাও দিলেন। তিনি বললেন, “মহান মার্কিন নেতা আব্রাহাম লিংকন আমেরিকার জনগণকে গণতন্ত্র ও স্বাধীনতা দিয়েছিলেন কিন্তু সমাজতন্ত্র দিতে পারেননি। কার্ল মার্কস সমাজতন্ত্রের স্থপতি কিন্তু তার দর্শনে ছিল না গণতন্ত্র এবং স্বাধীনতা৷ মুজিববাদে রয়েছে দু’টোই গণতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্র। সুতরাং মুজিববাদ বিশ্বের তৃতীয় মতবাদ কিংবা রাজনৈতিক দর্শন।” তিনি আরো বলেন, “পুজিঁবাদ ও কম্যুনিজমের মধ্যে একটি দৃষ্টান্ত হিসাবে মুজিববাদ কায়েম করে সোনার বাংলা গড়ে তোলা হবে।” তিনি বাংলাদেশের জনগণকে মুজিববাদ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে ‘জাতীয় বিপ্লব’ আখ্যা দিয়ে তাতে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য উদাত্ত আহ্বান জানান। জনাব তাজুদ্দিনকে চ্যালেঞ্জ করার জন্যই জনাব তোফায়েলের মাধ্যমে মুজিববাদ নামক এক উদ্ভট এবং অদ্ভূত রাজনৈতিক দর্শনের উপস্থাপনা করা হয়। ৩রা জানুয়ারী ১৯৭২ সালে পাকিস্তান সরকার এক ঘোষণার মাধ্যমে শেখ মুজিবকে মুক্তি দেয়া হবে বলে খবর প্রচার করে।
যুব নেতৃবৃন্দ বাংলাদেশে ফিরেই মুজিব পরিবারের অনুকম্পা ও সহানুভূতি লাভের আশায় জনাব তাজুদ্দিন আহমদ সম্পর্কে কদর্য্য প্রচারণা নতুন করে শুরু করেন। তারা বলেন, “শেখ মুজিবের প্রতি তাজুদ্দিনের কোন আনুগত্য ও শ্রদ্ধাবোধ নেই। স্বাধীনতা সংগ্রামের কৃতিত্বের দাবিদার তিনি একাই হতে চান।” তারা আরো বলেন, “শেখ মুজিব স্বাধীনতার ঘোষক সেটাও জনাব তাজুদ্দিন স্বীকার করেন না। তাছাড়া শেখ মুজিবকে উপেক্ষা করার আর একটি নজির এই যে, তিনি তাকে অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী না করে ক্ষমতার অভিলাষে নিজেকেই প্রধানমন্ত্রী বানান এবং শেখ মুজিবকে শুধুমাত্র সাংবিধানিক ক্ষমতাহীন রাষ্ট্রপতি করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তার উদ্দেশ্য সৎ হলে তিনি শেখ মুজিবকে প্রধানমন্ত্রী বানিয়ে নিজে উপ-প্রধানমন্ত্রী হিসেবে স্বাধীনতা সংগ্রাম ও প্রবাসী সরকার পরিচালনা করতে পারতেন।’
এমনিভাবে তাজুদ্দিনের প্রতি শেখ মুজিব ও তার পরিবারের সদস্যদের প্রত্যেকের মন বিষিয়ে তুলেছিলেন তারা। শেখ মনির এতে মুখ্য ভূমিকা ছিল। শেখ মুজিব বাংলাদেশে ফেরার পর উল্লেখিত নেতৃবৃন্দ শেখ ফজলুল হক মনির নেতৃত্বে তাজুদ্দিনের বিরুদ্ধে আরো সক্রিয় হয়ে উঠেন। শেখ মুজিব যেহেতু স্বাধীনতা সংগ্রাম কালের নয় মাস নির্বাসিত ছিলেন পাকিস্তানের কারাগারে সেই অনুপস্থিতির পুর্ণ সুযোগ গ্রহণ করেছিলেন তারা। তার সামনে কেঁদে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ার নাটক করে এদের অনেকেই বলেছিলেন, “আপনার ভাবমুর্তি ও নেতৃত্ব রক্ষা করার যথাসাধ্য চেষ্টা করে তাজুদ্দিনের বিরাগভাজন হয়েছি আমরা। তিনি ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলাবার হুমকি পর্যন্ত দিয়েছেন। শেখ কামালকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠাবার হুকুম দিয়েছিলেন তিনি। শুধু আমাদের বিরোধিতায়ই সেটা সম্ভব হয়নি। আমরা আমরা জোর করে তাকে মুজিবনগর হেডকোয়াটার্স এ কর্নেল ওসমানীর এডিসি হিসাবে রেখেছিলাম।” আরো অনেক কিছু বলে তার কান ভারী করতে সক্ষম হয়েছিলেন কুচক্রী ক্ষমতালিপ্সু যুব নেতৃবৃন্দ। শেখ মুজিব তাদের কথার সত্যতা যাচাই করার সুযোগ পেলেন না। কেননা, তার পরিবারের সদস্যগণ আরো রুঢ় ভাষায় তাজুদ্দিনের বিরুদ্ধে তাদের মনের খেদ প্রকাশ করেন শেখ মুজিবের কাছে। এর ফলেই দেশে ফেরার মাত্র একদিন পরই ১১ই জানুয়ারী ১৯৭২ শেখ মুজিব তার দীর্ঘ দিনের পরীক্ষিত সহকর্মী জনাব তাজুদ্দিনকে অপসারন করে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী হয়ে বসলেন। জনাব তাজুদ্দিনকে মন্ত্রী পরিষদ থেকে বাদ না দিলেও তাকে সব ব্যাপারে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে চলতে লাগলেন শেখ মুজিব। প্রশাসনিক ব্যাপারে আবার তিনি যুব নেতৃবৃন্দের উপরই সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়লেন। ফলে যুব নেতৃবৃন্দ জাতীয় পরিসরে সর্বময় ক্ষমতা প্রদর্শনের সুযোগ পেয়ে গেলেন। তাদের মনোবাঞ্ছনা পূর্ণ হল। কিন্তু শেখ মুজিবের এ ধরণের আচরণে মনোক্ষুন্ন হলেন দলের বর্ষিয়ান নেতারা।
ছাত্রলীগের বিভক্তি আওয়ামী লীগেও টানাপোড়নের সৃষ্টি করে। রাজনৈতিক দ্বিধা-দ্বন্দ্বে জাতি হয় বিভক্ত।
সদ্য প্রতিষ্ঠিত একটি দেশের জন্য এ ধরনের বিরোধ ছিল মারাত্মক ক্ষতিকর।
১৯৭২ সালের প্রায় গোড়া থেকেই মুজিববাদ নিয়ে ছাত্রলীগের মাঝে দেখা দেয় সংকট। সৃষ্টি করে অনৈক্য। ‘৭২ সালের ১২ই মে ছাত্রলীগের চার নেতা খোলাখুলিভাবে দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে পরেন। জনাব রব ও শাহজাহান সিরাজ বললেন, “মুজিববাদে তারা বিশ্বাসী নন। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের মাধ্যমেই আসিবে জনমুক্তি।” অপরদিকে আব্দুল কুদ্দুস মাখন ও নূরে আলম সিদ্দিকী ঘোষণা দিলেন, “যে কোন মূল্যে মুজিববাদ প্রতিষ্ঠা করতে হবে।” অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই সংকট দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি হলে মুজিববাদী ও মুজিববাদ বিরোধী ছাত্রদের মধ্যে সশস্ত্র সংঘর্ষ ঘটে। বিরোধ চূড়ান্ত রূপ ধারণ করে যখন দুই গ্রুপই আলাদাভাবে মহাসম্মেলনের আয়োজন করে। শেখ মুজিব অবশ্য মাখনদের সম্মেলনই নিজে উদ্বোধন করেন।
ছাত্রলীগের ভাঙ্গনের পরিপ্রেক্ষিতে শ্রমিক লীগেও কোন্দল ঘনীভূত হয়। ফলে শ্রমিক লীগও দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যায়। মুজিববাদ বিরোধী ছাত্রলীগ এবং তাদের সমর্থক শ্রমিক লীগ তৎকালীন গণপরিষদ ভেঙ্গে দিয়ে বিপ্লবী সরকার গঠনের আহ্বান জানান। তখন থেকেই দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন উত্তপ্ত হয়ে উঠতে থাকে। একদিকে মুজিববাদ অপরদিকে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র। আসম রব ১৯৭২ সালের ৩রা মার্চ এক ভাষণে বলেন, “জীবনে সকল ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তনের জন্য জাতি যখন আর একটি বিপ্লবের প্রস্তুতি নিচ্ছিল ঠিক সে মুহুর্তে বেশ কিছু সংখ্যক সরকারি আমলা, শিল্পপতি, আওয়ামী লীগসহ কিছু রাজনৈতিক লোকজন জাতীয় বিপ্লবের নামে আমাদের এই প্রস্তুতির বিরুদ্ধে চক্রান্ত করে চলেছে এবং গণবিরোধী প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে চলেছে। ৮ই মার্চ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বক্তৃতায় তিনি আরো বলেন, “পতাকা বদল হলেই জনগণের মুক্তি আসে না, তার জন্য দরকার সমাজতান্ত্রিক কর্মসূচী।” এর জবাবে ‘৭২ সালের ৫ই মে ছাত্রলীগ (মুজিববাদী) নেতা নূরে আলম সিদ্দিকী বলেন, “মুজিববাদের প্রতি হুমকি বিপ্লবীদের সমাজতন্ত্রের প্রতিই হুমকি স্বরূপ। ২৩শে মে ‘৭২ তৎকালীন আওয়ামী সেচ্ছাসেবক বাহিনী প্রধান এবং পার্টির সাংগঠনিক সম্পাদক জনাব আব্দুর রাজ্জাক দিন তারিখ দিয়ে ঘোষণা করেন, “৭ই জুন থেকে মুজিববাদ প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম দেশব্যাপী আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হবে।” ১৩ই জুন গৃহিত এক প্রস্তাবে মাখন সিদ্দিকী গ্রুপ দাবি করে, “মুজিববাদের চার নীতির উপর ভিত্তি করে দেশের শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করতে হবে।” ৬ই জুলাই তোফায়েল আহমদ কুমিল্লার এক জনসভায় ঘোষণা করলেন, “যারা বিদেশী মতবাদ প্রচার করছেন তারা দেশের জনগণের বন্ধু নয়, তারা জাতীয় শত্রু। মুজিববাদ প্রতিষ্ঠার মধ্যেই নিহিত রয়েছে সব সমস্যার সমাধান এবং মুজিববাদ দেশে সমৃদ্ধির এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবে।” একই জনসভায় জনাব আবদুর রাজ্জাক বলেন, “আমরা বিশ্বকে দেখিয়ে দেবো কিভাবে গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র একসঙ্গে চলতে পারে।” ১৬ই জুলাই নেতা জিল্লুর রহমান বললেন, “মুজিববাদ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শোষণমুক্ত সমাজ গঠন করা সম্ভব। মুজিববাদ বাংলাদেশের জনগণের আশা-আকঙ্খার প্রতীক। এর বাস্তবায়নের মধ্যেই মানুষের সর্বাঙ্গীন মুক্তি নিহিত।” একই দিনে ঢাকায় মাখন সিদ্দিকী গ্রুপ ছাত্রলীগের এক সভায় গৃহিত প্রস্তাবে বলা হয়, “মাওবাদী বিভ্রান্ত নেতৃত্ব, সিআইএ-র এজেন্ট দল ও ছাত্রলীগ নামধারী বহিস্কৃত নেতৃত্ব, পলাতক আলবদর, আলশামস, রাজাকার, শান্তি কমিটির মেম্বার, মুসলিম লীগারস, জামায়াত, নেজাম, জমিয়তে ওলামা, পিডিপি সহ প্রতিক্রিয়াশীল সংগঠনগুলো ঐক্যবদ্ধভাবে মুজিববাদ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে বানচাল করতে চায়।
২৪শে জুলাই ‘৭২ ছাত্রলীগের প্রতিদ্বন্দী উভয় গ্রুপের মধ্যে বায়তুল মোকাররমে গোলাগুলি হল। ২১শে জুলাই ছাত্রলীগ মুজিববাদী অংশের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সম্মেলনে শেখ মুজিবের উপস্থিতিতেই মুজিববাদ প্রতিষ্ঠার শপথ গ্রহণ করা হয়। একই দিন বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী ছাত্রলীগ রব গ্রুপের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় পল্টন ময়দানে। সেই সম্মেলনে জনাব আসম রব ঘোষণা করেন, “কার্ল মার্কসের পর সমাজতন্ত্রের কোন নতুন সংজ্ঞা কেউ দিতে পারে না। সমাজতন্ত্র সম্পর্কে তার রূপরেখাই চূড়ান্ত এবং আমাদের এই বাংলাদেশে সেই সমাজতন্ত্রই কায়েম করা হবে।” জনাব রব দৃঢ়ভাবে বললেন, “মুজিববাদের ককটেল কোন সমাজতান্ত্রিক রূপরেখা নয়।” ২৪শে জুলাই ৭২ মুজিববাদী ছাত্রলীগের একটি মিছিল অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত হয়ে পল্টন ময়দানে রব গ্রুপ ছাত্রলীগের একটি সভার উপর চড়াও হয়। তাদের হামলায় জনাব রবসহ শতাধিক ছাত্র আহত হন। পরে আহতদের একজন ছাত্র হাসপাতালে মারা যায়।
১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সরকারকে সোভিয়েত ইউনিয়ন সরকার পড়াশুনার জন্য একশতটি বৃত্তি দেয়। মেধা অনুসারে একশত জন ছাত্র নির্বাচিত হয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে। ৮ই জুলাই নির্বাচিত তালিকা থেকে হঠাৎ করে অন্যায়ভাবে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ৪১ জনকে বাদ দিয়ে নতুন করে তাদের জায়গায় অন্য ৪১ জনকে নির্বাচিত করা হয়। মুজিববাদে বিশ্বাসী ছিল না বলেই প্রথম নির্বাচিত ৪১ জনকে বাদ দেয়া হয়। ইতিমধ্যে সরকারের উচ্চ পর্যায়েও মুজিববাদকে কেন্দ্ৰ করে মতবিরোধ সৃষ্টি হয়। নেতাদের বিবৃতি বক্তব্যে এ বিরোধ ক্রমে স্পষ্ট হয়ে উঠে।
১৯৭২ সালের ১৮ই জুলাই তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী চট্টগ্রামে ঘোষণা করলেন, “গণতন্ত্রের নীতি ও আদর্শেই দেশ পরিচালিত হবে।” তার একদিন আগে ঠাকুরগাঁয়ে এক জনসভায় লীগ নেতা জহুর আহমদ চৌধুরী বললেন, “মুজিববাদের চার নীতি দ্বারাই দেশ চালিত হবে।” তার কয়েকদিন পর ৩১শে জুলাই আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কমিটিতে সকল ষড়যন্ত্ৰ নস্যাৎ করে মুজিববাদ কায়েমের শপথ আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করা হয়। ১২ই আগষ্ট অর্থমন্ত্রী ও প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজুদ্দিন আহমদ ভাওয়ালের তাজুদ্দিন আহমদ ভাওয়ালের এক জনসভায় বললেন, “সমাজতন্ত্রের প্রতি বাধা আসলে গণতন্ত্র ত্যাগ করব।” ২০শে আগষ্ট আওয়ামী লীগের নেতা আব্দুর রাজ্জাক বললেন, “বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র ধার করা আদর্শ এবং মাওবাদী চক্রান্ত।” রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বলেন, “গণতন্ত্র কায়েম হবে!” মন্ত্রী বলেন, “সমাজতন্ত্রের জন্য প্রয়োজনে গণতন্ত্র ত্যাগ করব!!” শীর্ষ নেতা শেখ মুজিব বলেন, “দু’টাকে মিলিয়ে মুজিববাদ কায়েম করা হবে!!! ” এভাবেই দেশে সৃষ্টি করা হল আদর্শগত বিভ্রান্তিকর এক চরম অবস্থা। আর এ বিভ্রান্তির ফলে শুধুমাত্র ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগই নয় সমস্ত জাতি হল দ্বিধা-বিভক্ত।
জনগণ পরিণত হয় শত্রুতে
পাকিস্তান এখন নেই। কিন্তু শত্রুর প্রয়োজন। শত্রু হল জনগণ।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ায় অস্থানীয়দের স্থলে বাংলাদেশী বুর্জুয়াদের শাসন প্রতিষ্ঠিত হল। তারা তাদের নিজেদের স্বার্থ দেখা শুরু করলেন। ঠিক যেভাবে পাকিস্তানীরা দেখতো তাদের আপন স্বার্থ। পাকিস্তান শেষ হয়ে গেছে। তা যাক, কিন্তু শত্রুতো থাকতে হবে। শত্রু এখন কে? শত্রু এখন জনগণ। জনসাধারনের পক্ষের শক্তিকে উৎখাত করার তৎপরতা চালানো হল সরাসরিভাবে। তেমনি চললো তাদেরকে নিজেদের লেজুড়ে পরিণত করার চক্রান্ত। জনগণ যুদ্ধ করেছে। যুদ্ধ করে দেশকে স্বাধীন করেছে। তারা তাদের রাজনৈতিক অধিকার এবং নিজেদের বাচাঁর অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চাইবে। তাই তাদেরকে শুধু ধোকা দেবার জন্যই সমাজতন্ত্রকে আওয়ামী লীগ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্রীয় নীতি হিসাবে গ্রহণ করে নিয়েছিল নিজেদের স্বার্থেই।
বাংলাদেশ নামে একটি জাতীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হল। কিন্তু শাসক বুর্জুয়াদের মধ্যে জাতীয় চেতনার উম্মেষ ঘটল না। তাদের চরিত্রে রয়ে গেল মুৎসুদ্দী ধামাধরার প্রবণতা। আমেরিকা আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল। কোন অবস্থাতেই ভবিষ্যতে মার্কিন সাহায্য বাংলাদেশ গ্রহণ করবে না এই সাহসী সরকারি ঘোষণা মুজিবনগরে পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু শেখ মুজিব ঢাকায় ফিরে তার প্রথম সাংবাদিক সম্মেলনেই বলতে বাধ্য হলেন যে তিনি মার্কিন সাহয্য গ্রহণ করবেন। যুদ্ধের সময় ভারত বিরোধী ছিলেন ছিলেন যেসব বিত্তবানেরা তাদের বেশিরভাগই ভারতপ্রেমিক হয়ে দাড়ালেন রাতারাতি। প্রতিযোগিতার দৌড় শুরু হল ভারতীয় মারোয়াড়ী ব্যবসায়ী গোষ্ঠির সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে অল্প সময়ে চোরাকারবারের মাধ্যমে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হবার। যে আওয়ামী লীগ চিরকাল ছিল মার্কিন ঘেষা, আমেরিকার প্রশ্নে যেখানে সোহরাওয়ার্দী ও শেখ মুজিব মজলুম নেতা মাওলানা ভাসানীর থেকে পৃথক হয়ে গিয়েছিলেন ঐতিহাসিক কাগমারী সম্মেলনে, সেই আওয়ামী লীগ এর এতটুকু কষ্ট হল না সোভিয়েত ইউনিয়নের অনুরাগী হয়ে পড়ে ভারতের সাথে চুক্তির দাসখত লিখে দিতে। মুলকথা মুরুব্বী চাই। ‘স্বাধীন হয়েও স্বাধীন নয়, স্থানীয় বটে তবে জাতীয় নয়’ প্রকৃতির আওয়ামী লীগ সমাজতন্ত্রের নীতি গ্রহণ করেছিল জাতীয় অর্থনীতিকে তাদের দলীয় নিয়ন্ত্রণে নেবার জন্যই। রাষ্ট্রীয়করণের মাধ্যমে পাকিস্তানী বণিক সম্প্রদায় এবং শিল্পপতিদের পরিত্যক্ত ব্যবসা কেন্দ্র এবং শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোতে তাদের পার্টির সদস্য ও সহযোগীদের পরিচালনার দায়িত্বে নিযুক্ত করা হয়। ব্যবসা-বানিজ্যের লাইসেন্স পারমিটও দেয়া হয় অব্যবসায়ী অনভিজ্ঞ পার্টি টাউটদের। অর্থনীতিকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখে দলীয় সদস্যদের নব্য পুঁজিপতি হবার সুযোগ করে দেয়া হল সেই আদিম পদ্ধতিতে। এভাবেই একাত্তরের আগের অধ্যায়ে পাকিস্তানীরা লুট করেছে বাংলাদেশকে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সমাজতন্ত্রের ধর্মজাল সৃষ্টি করে শুরু হল বাঙ্গালী নব্য পুজিঁপতিদের লুন্ঠন। গরীব দেশবাসী আরো গরীব হল। জাতীয় অথনৈতিক মেরুদন্ড গেল ভেঙ্গে। রুশ-ভারতের চাপে সমাজতন্ত্রকে রাষ্ট্রীয় অর্থনীতি হিসেবে গ্রহণ করে সমাজতন্ত্রের অসাড়তাই প্রমাণ করেছিল আওয়ামী লীগ।
সোভিয়েত নৌ বাহিনীর বহর চট্টগ্রাম বন্দর দখল করে নেয়
যুদ্ধের সময় তাজুদ্দিন পুরোপুরিভাবে রুশ-ভারতের প্রভাবাধীন ছিল, পাকিস্তান থেকে প্রত্যাবর্তনের পর শেখ মুজিব ও সেই বলয়েরই প্রভাবাধীন হয়ে পড়ে।
যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরপরই দেশে ফিরে এসে শেখ মুজিব বাংলাদেশকে পূর্বের সুইজ্যারল্যান্ড বানাবার ঘোষণা দিয়ে মূলতঃ ভারতের একটি করদ রাজ্যেই পরিণত করলেন সদ্যমুক্ত বাংলাদেশকে। তিনি চালনা এবং চট্টগ্রামের বন্দর পরিষ্কারের অজুহাতে সোভিয়েত ও ভারতীয় নৌ বাহিনীকেও আমন্ত্রন জানান। সোভিয়েত ও ভারতীয় নৌ বাহিনী বন্দর ও সমুদ্র সীমার বিশাল অংশ তাদের দখলে নিয়ে নেয় এবং ঐ অঞ্চল অন্যদের এমনকি বাংলাদেশ প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যদের জন্যও “নিষিদ্ধ এলাকা” বলে ঘোষণা দেয়। সোভিয়েত এবং ভারতীয় নৌ বহর দীর্ঘ দুই বৎসরকাল চট্টগ্রামে অবস্থান করে। ক্রমান্বয়ে খবর বের হতে থাকে এই দুই নৌ বাহিনীর সদস্যরা বন্দরের খাড়ি পরিষ্কারের নামে সন্দেহজনক বিভিন্ন তৎপরতায় লিপ্ত রয়েছে। এভাবেই বাংলাদেশকে ইন্দো-সোভিয়েত বলয়ের মধ্যে ঠেলে দিয়েছিলেন শেখ মুজিব।
বিরোধী পক্ষের উপর নির্যাতন শুরু
বিরোধী পক্ষের প্রতি হুশিয়ারী উচ্চারণ করে গর্বের সাথে শেখ মুজিব বললেন, “রাষ্ট্র বিরোধী দুঃস্কৃতিকারীদের হুশিয়ার করে দিচ্ছি, প্রয়োজনে আমি লাল ঘোড়া দাবড়াইয়া দিব।” সরকার ও সরকারি দলের প্রভাবশালী নেতাদের ব্যক্তিগত বিভিন্ন বাহিনীগুলোর প্রতিই ছিল তার এই ইঙ্গিত।
১৯৭২ সালের মাঝামাঝি সময় থেকেই বিরোধী রাজনৈতিক দলসমূহের উপর বর্বর নির্যাতন শুরু হয়। এ নির্যাতনে শুধু রাষ্ট্রীয় প্রশাসন যন্ত্রের বিভিন্ন বাহিনীই অংশগ্রহণ করেনি, তাতে অংশ নেয় আওয়ামী লীগ সমর্থিত বিভিন্ন লাঠিয়াল ও বেআইনী সশস্ত্র পেটোয়া বাহিনী। রাজনৈতিক নির্যাতন ও হয়রানির অভিযোগ তোলেন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির চেয়ারম্যান মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, কাজী জাফর আহমদ, ছাত্রলীগের রব-সিরাজ গ্রুপ৷ তারা আওয়ামী সরকারের জুলুমের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে রুখে দাড়াবার জন্য জনগণের কাছে আবেদন জানান। তারা বিবৃতি সমাবেশের মাধ্যমে বলেন, “বাংলাদেশের রাজনীতিতে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার ও সংগ্রামী ছাত্র-জনতার প্রতিরোধ শক্তিকে শেষ করে দেবার জন্য মাত্র ৯মাস আগে নির্যাতন এবং পুলিশ ও সেনা বাহিনীর বেপরোয়া গুলি চালানোর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মুখর হয়ে উঠতেন যারা; ক্ষমতায় আসীন হয়ে গত মাসেই প্রায় ডজনখানেক জায়গায় ছাত্র-জনতার সমাবেশে ও মিছিলে গুলি চালিয়েছেন তারা। শুধু তাই নয়, ক্ষমতাসীন দল দখলদার বাহিনীর দালালদের সহায়তায় প্রশাসন যন্ত্রকে প্রভাবিত করে ছাত্র, বিরোধী দলীয় কর্মী ও প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে মিথ্যে মামলা দায়ের করে তাদের গ্রেফতার করছেন। রাজনৈতিক নেতারা রাজধানী থেকে সরকারি ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের কর্মী, ছাত্র, যুবকদের শায়েস্তা করার জন্য গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি করে তাদের অযথা হয়রানি করছেন।
৯ই সেপ্টেম্বর ১৯৭২ সালে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রধান আব্দুর রাজ্জাক বলেন, “বাংলাদেশের প্রতিটি বাড়ির দোর গোড়ায় মুজিববাদের বাণী পৌছে দেয়ার জন্য আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাবে। আঞ্চলিক, জেলা এবং মহকুমা পর্যায়ের নেতাদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এই বাহিনীর প্রশিক্ষণ এবং কর্মকান্ডের সমন্বয় সাধন করা হবে। প্রতিটি ইউনিয়নে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সদস্যদের বাশের লাঠির মাধ্যমে জঙ্গি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে।” এরপর ট্রেনিং শুরু হয়। ইতিমধ্যে আওয়ামী-লীগের নেতা জনাব আব্দুল মান্নান এক লক্ষ লোকের এক সমাবেশের আয়োজন করেন ১লা মে ১৯৭২-এ এবং ঐ সমাবেশে তিনি ঘোষণা দেন, “আগামী ৯ই জুন থেকে তার অনুসারীরা জাতীয় শত্রুদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করবে।” তিনি সরকারের কাছে দাবি জানান যাতে করে তার বাহিনীর সদস্যদের এ্যারেষ্ট, সার্চ, ইন্টারোগেশন এবং শাস্তি দেবার ক্ষমতা দেয়া হয়। এভাবে মুজিব ভক্তরা সবাই আইনকে নিজেদের হাতে নেবার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেন। এক সভায় স্বয়ং শেখ মুজিবর রহমান অতি দম্ভের সাথে তার সমালোচকদের উদ্দেশ্যে বলেন, “আমি আমার লাল ঘোড়া দাবড়াইয়া দেব৷” ইঙ্গিতটি ছিল আওয়ামী লীগের বেসরকারি বাহিনীগুলোর প্রতি। শ্রমিকলীগের নেতার ঐ অভিযান শুরু হওয়ার ৭দিনের মাথায় খুলনায় পুলিশ ও লালবাহিনীর সদস্যদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও ঐ ধরণের সংঘর্ষের খবর পাওয়া যায়। সার্বিক আইন-শৃংখলা পরিসি’তির আরো অবনতি ঘটে। ঐ সমস্ত ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের বাহিনীর হাতে নাজেহাল হতে থাকে সাধারণ নিরীহ মানুষ।
অবস্থার এতই অবনতি ঘটে যে, আওয়ামী লীগের ‘বি’ টিম হিসেবে পরিচিত মোজাফফর ন্যাপ ও ঐ ধরণের ঔদ্বত্ত বন্ধ করার জন্য সংবাদপত্রে বিবৃতি প্রদান করতে বাধ্য হয়৷ জনাব মোজাফফর আহমদ এক বিবৃতিতে বলেন, “স্বেচ্ছাসেবক এবং একটি রাজনৈতিক দলের অন্যান্য বাহিনীর সদস্যরা অন্যায়ভাবে নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে। সংগঠনের দায়রার বাইরে গিয়ে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র এবং শ্রমিক সংগঠনগুলো ঐ ধরণের বর্বরতা করে চলেছে অবিরাম। তারা ইচ্ছানুযায়ী কারফিউ জারি করে স্থানীয় প্রশাসনকে অবজ্ঞা করে লোকজনকে ধরে তথাকথিত আদালতে তাদের বিচারের নামে অমানুষিক জুলুম করছে। প্রশাসন এবং পুলিশ রহস্যজনকভাবে ঐ ধরণের কার্যকলাপের ব্যাপারে নিরব দর্শকের ভূমিকা গ্রহণ করে নিশ্চুপ হয়ে রয়েছে।” তিনি জনগণের প্রতি আবেদন জানান যাতে করে ঐক্যবদ্ধভাবে তারা ঐ সমস্ত অন্যায় ও অসহনীয় নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে তুলেন।
মেজর জলিল (বীর উত্তম) বন্দী হলেন
মেজর জলিল ছিলেন একজন সাহসী মুক্তিযোদ্ধা, ভারতীয় বাহিনীর লুটপাটে তিনি বাধা দিয়েছিলেন।
পাকিস্তান আর্মির সারেন্ডারের পর ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশ থেকে হাতিয়ার, গোলাবারুদ, যুদ্ধ সরঞ্জাম, কলকারখানার মেশিনপত্র সবকিছুই লুট করে ভারতে পাচাঁর করতে থাকে। মেজর জলিল এ সমস্ত লুটপাটের বিরোধিতা করেন। তার সাহসিকতা অন্যান্য সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদেরও “মিত্র বাহিনীর” লুটপাটে বাধা প্রদানে উৎসাহিত করে তোলে। ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে তার ঐ ধরণের কর্মকান্ডের জন্য সরকার তাকে বন্দী করে। ষড়যন্ত্রের জাল ফেলে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। সমগ্র জাতি সরকারের ঐ ধরণের আচরণের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ১১ই মার্চ বরিশালে মুক্তিযোদ্ধা ও জনগণের এক বিশাল সমাবেশে তাকে অবিলম্বে মুক্তি দেবার জোর দাবি উত্থাপন করা হয়। প্রধানমন্ত্রীর কাছে জোরালো দাবি উত্থাপিত হয়েছিল সেনা বাহিনীর তরফ থেকেও। এর প্রতিক্রিয়ায় সরকার এক বিজ্ঞপ্তিতে ঘোষণা করে, “তার বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ রয়েছে এবং আর্মি রুলস এর অধিনেই তার বিচার করা হবে।” সরকারের ঐ ঘোষণার পর বিক্ষোভ আরো বৃদ্ধি পায়। আর্মি, মুক্তিযোদ্ধা এবং জনগণ ক্ষেপে উঠে। প্রচন্ড গণচাপের মুখে সরকার বাধ্য হয় মেজর জলিলকে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে।
১লা জানুয়ারী ১৯৭৩, ঢাকার রাজপথ আবার রক্তে রঞ্জিত হলো
প্রতিবাদ মিছিলে পুলিশের গুলিতে দু’জন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রকে প্রাণ দিতে হয়।
১৯৭৩ সালের ১লা জানুয়ারী স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ দিন। ঐ দিন ভিয়েতনামে মার্কিন হামলার বিরুদ্ধে মস্কোপন্থী বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন “ভিয়েতনাম দিবস” পালনের ডাক দেয়। এ উপলক্ষে ঐ দিন ছাত্র ইউনিয়ন এক বিক্ষোভ মিছিল বের করে। মিছিলটি প্রেসক্লাবের বিপরীত দিকে অবস্থিত তৎকালীন মার্কিন তথ্য সার্ভিস ইউএসআইএস (ইউসিস) দফতরের সামনে এসে ভীষণ বিক্ষুদ্ধ হয়ে উঠে। সঙ্গে সঙ্গে কার্টুনে গ্যাস বা লাঠিচার্জ ছাড়াই নিয়োজিত পুলিশ বাহিনী বিনা উস্কানিতে ছাত্র মিছিলের উপর বর্বরোচিতভাবে গুলি চালায়। গুলিতে নিহত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষ দর্শনের (অনার্স) ছাত্র মতিউল ইসলাম ও মীর্জা কাদেরুল ইসলাম নামক অপর আর একজন ছাত্র। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রকাশ্যে রাজপথে পুলিশের গুলিতে ছাত্র হত্যার এই বিবরণ লিপিবদ্ধ হয়ে আসে পরের দিনের সংবাদপত্রগুলিতে। নূরুল আমিন, আইয়ূব খান, মোনেম খান, ইয়াহিয়া খান পাকিস্তান আমলে তাদের নির্যাতনমূলক গণবিরোধী স্বৈরশাসনের জন্য ধিকৃত হয়েছিল জনগণের কাছে। একই ন্যাক্কারজনক বর্বরতার জন্য এদেশের মানুষ ধিক্কার দিল আওয়ামী লীগ সরকারকে।
স্বাধীনতার মাত্র এক বছরের পরই আওয়ামী লীগ সরকারের এহেন প্রকাশ্যে ছাত্র হত্যা হতবাক করে দিয়েছিল দেশবাসীকে। উৎকন্ঠায় আতংকিত হয়ে পড়ে তারা। প্রেসক্লাবের বারান্দায় দাড়িয়ে থাকা সাংবাদিকরা স্তব্ধ হয়ে অবলোকন করেন পুলিশের বর্বরোচিত প্রাণহানিকর আচরণ। সেদিন পুলিশী নির্যাতনের হাত থেকে সাংবাদিক, ফটোগ্রাফাররাও রেহাই পাননি। মুজিব সরকারের পুলিশ বাহিনী উপস্থিত প্রেস ফটোগ্রাফারদের হাত থেকে ক্যামেরা ছিনিয়ে নিয়ে ভেঙ্গে ফেলে নির্মমভাবে সরকারের তদানীন্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী টাঙ্গাইলের আব্দুল মান্নান এই পুলিশী সন্ত্রাসের ব্যাপারে কোন বিবৃতি দেবারই প্রয়োজন বোধ করেননি সেদিন। গুলি চালনার খবর মুহুর্তে ছড়িয়ে পড়ে পুরো শহরে। ব্যবসা-বাণিজ্য, দোকানপাট, যানবাহন সব কিছুই বন্ধ হয়ে যায় সারা শহরে। স্বতঃস্ফুর্তভাবে হাজার হাজার লোক ছুটে আসে ইট দিয়ে ঘেরা রক্তে রঞ্জিত রাজপথের অংশ দেখার জন্য। শহরের অলিতে-গলিতে মানুষ পুলিশের পাশবিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী মৌন মিছিল নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। পরদিন ২রা জানুয়ারী এই হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে সারাদেশে পূর্ণ হরতাল পালিত হয়। ঐদিন প্রফেসর মোজফফর আহমদ ঘোষণা করলেন, “আওয়ামী লীগের ছাত্র হত্যা ইয়াহিয়া-মোনেম স্বৈরাচারী সরকারের কার্যকলাপেরই নামান্তর। আমরা দেশবাসীর দাবির সঙ্গে একাত্ম হয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের আশু পদত্যাগ দাবি করছি।” তিনি আরো বলেন, “নূরুল আমিন সরকারের ভাগ্যে যে পরিণতি ঘটেছিল, শেখ মুজিবের ভাগ্যেও সেই একই পরিণতি অনিবার্য।
শেখ মুজিবকে দেয়া “বঙ্গবন্ধু” খেতাব উঠিয়ে নেয়া হয় এবং একই সাথে তার “ডাকসুর আজীবন সদস্যপদ” ও বাতিল করা হয়।
৩রা জানুয়ারী পল্টন ময়দানে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন আয়োজিত এক সভায় ইউনিয়নের নেতা মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ঘোষণা করেন, “দরকার হলে আরো রক্ত দেব। তবুও সাম্রাজ্যবাদের লেজুড় সরকারকে উৎখাত করে সমাজতন্ত্র কায়েম করবই।” ঐ সভায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রিয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সহ-সভাপতি সেলিম ডাকসুর আজীবন সদস্যপদ থেকে শেখ মুজিবর রহমানকে বহিষ্কারের কথা ঘোষণা করেন। এবং সদস্যপদ বই থেকে সংশ্লিষ্ট পাতাটি জনসভায় ছিঁড়ে কুটি কুটি করে ফেলেন।
রাজনীতির পরিহাস, ১৯৭২ সালের ৬ই মে এই ছাত্রনেতাই শেখ মুজিবর রহমানকে ডাকসুর আজীবন সদস্যপদ দেবার গৌরব অর্জন করেছিলেন। জনাব সেলিম ডাকসুর পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবর রহমানকে প্রদত্ত “বঙ্গবন্ধু” উপাধিও প্রত্যাহার করে সাবধান বাণী উচ্চারণ করেন, “সংবাদপত্র, টিভি ও বেতারে শেখ মুজিবের ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি ব্যবহার করা চলবে না।” তিনি বাড়িতে, অফিস-আদালতে ও দোকানে টানানো শেখ মুজিবর রহমানের ছবি নামিয়ে ফেলারও আহ্বান জানান।
১৯৭২ সালের নির্বাচন
৭ই মার্চ ১৯৭৩, প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন এক পাতানো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
নির্বাচন সম্পর্কে দৈনিক সংবাদ ও দৈনিক গণকন্ঠের প্রতিবেদনে সন্ত্রাস, গুন্ডামি, নির্যাতন, ব্যালট বাক্স ছিনতাই, পোলিং এজেন্ট প্রহৃত, খুন প্রভৃতির খবর ছাপা হয়। ৮ই মার্চের দৈনিক সংবাদের প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত কয়েকটি খবরের শিরোনাম ছিলঃ
“সিলেট-১ কেন্দ্রে ব্যালট বাক্স ছিনতাই,
“পটুয়াখালীতে ব্যালট পেপার ছিনতাই”,
“চট্টগ্রামে ৩১টি ব্যালট পেপারসহ ২ব্যক্তি গ্রেফতার”,
“ধামরাইতে রক্ষীবাহিনীর সন্ত্রাস”,
“ঢাকা শহরসহ বিভিন্ন ভোট কেন্দ্রে বিচিত্র ঘটনা ঘটেছে,
“নির্বাচন দারুন অবাধ হয়েছে”,
“একজন একাধিকবার অবাধে ভোট দিতে পেরেছে”,
“জাসদের দু’জন কর্মী হাইজ্যাক”,
“ঢাকার একটি কেন্দ্রে সন্ত্রাস ও গুলি”,
“পটিয়ায় ভোট সন্ত্রাসী-মাস্তানরাই দিয়েছে”
“কুমিল্লা শহরে ব্যাপক সন্ত্রাস”,
“নির্বাচন প্রহসনে পরিণত”,
“কালিগঞ্জে সন্ত্রাস”,
“রাজশাহী ভোট কেন্দ্রে সন্ত্রাস”,
“ভোট নাট্যের দু’ দৃশ্য” প্রভৃতি।
৯ই মার্চ ন্যাপের সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ ও সাধারণ সম্পাদক পংকজ ভট্টাচাৰ্য্য এক যুক্ত বিবৃতিতে বলেন, “কমপক্ষে ৭০টি আসনে ন্যাপ ও অন্যান্য বিরোধী রাজনৈতিক দলের প্রার্থীদের সুনিশ্চিত বিজয়কে শাসকদল ক্ষমতার চরম অপব্যবহার, ভুয়া ভোট, পোলিং বুথ দখল, পোলিং এজেন্ট অপহরণ, বিদেশী সাহায্য সংস্থা, জাতিসংঘ, সরকারি গাড়ি ও রেডক্রসের গাড়ির অপব্যবহার প্রভৃতি চরম অগণতান্ত্রিক কার্যকলাপের মাধ্যমে উক্ত নির্বাচন ক্ষেত্রসমূহে নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করেছে এবং বিরোধী দলের প্রার্থীদের জোর পূর্বক পরাজিত করেছে।
৯ই মার্চ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের এক সাংবাদিক সম্মেলনে জাসদ সভাপতি মেজর (অবঃ) জলিল বলেন, “প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব যেভাবে নির্বাচনের সময় প্রচলিত কোন ন্যায়নীতির তোয়াক্কা না করে সমস্ত গণতান্ত্রিক রীতিনীতি বিসর্জন দিয়ে বাংলাদেশে একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠায় মরিয়া হয়ে উঠেছেন এতে আমি তাকে জাতির পিতা বলতে ঘৃনাবোধ করি।”
তিনি আরো বলেন, “নির্বাচনের দিন গণভবনেই নির্বাচনী কন্ট্রোলরুম স্থাপিত হয়েছিল এবং স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের ফলাফল নিয়ন্ত্রণ করেছেন। বিরোধী দলের প্রার্থীরা যখন ভোট গননায় এগিয়ে যাচ্ছিলেন তখন প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশেই অকস্মাৎ বেতার টেলিভিশনে এই সকল কেন্দ্রের ফলাফল প্রচার বন্ধ করে দেয়া হয় এবং সন্দেহজনকভাবে দীর্ঘ সময় পর নিজেদের পছন্দসই ভোটের সংখ্যা প্রকাশ করে আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের বিজয়ী ঘোষণা করা হয়।” জাসদ সভাপতি আওয়ামী লীগের নবনির্বাচিত সরকারকে সাম্রাজ্যবাদ ও নয়া-উপনিবেশবাদের তাবেদার বলে অভিহিত করে তাদের নির্বাচনী বিজয়কে হিটলার, মুসোলিনী, চিয়াংকাই সেকের বিজয়ের সঙ্গে তুলনা করেন।
৯ই জুলাই প্রেসক্লাবে ভাসানী ন্যাপের তৎকালীন সহ-সভাপতি ডাঃ আলিম আল রাজি বলেন, “ক্ষমতাসীন সরকার এক দলীয় স্বৈরাচার ও একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য বিগত নির্বাচনে ক্ষমতার প্রকাশ্য অপব্যবহার, সন্ত্রাস সৃষ্টি, শক্তি প্রয়োগ করে ভুয়া ভোটদান, বিপুল অর্থ ব্যায়, বেতার, টেলিভিশন ও সংবাদপত্রসহ সকল প্রচার মাধ্যমের ব্যবহার করে নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করেছে।” বিরোধী দলগুলো যাতে জনগণের কাছে তাদের বক্তব্য প্রকাশ করতে না পারে সেজন্য ক্ষমতাসীন দল তাদের নিজস্ব রক্ষীবাহিনী, লালবাহিনী, নীলবাহিনীর হাতে বিপুল অস্ত্র দিয়ে গ্রামে গ্রামে পাঠিয়ে সন্ত্রাস সৃষ্টির মাধ্যমে জনসাধারণকে ভোটাদানে বিরতই শুধু করেনি; হয়রানির এক নজীরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। তিনি সকল প্রচার মাধ্যম সরকারি দলের দলীয় স্বার্থে যদেচ্ছা ব্যবহারের উল্লেখ করে প্রচার মাধ্যমকে এক “ব্যাবিলিয়ন ক্যাপটিভ প্রেস” বলে অভিহিত করেন। জানুয়ারীতে প্রকাশ্যে রাজপথে দু’জন ছাত্র হত্যার কথা উল্লেখ করে ডাঃ রাজি বলেন, “ঐ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ক্ষমতাসীন মুজিব সরকার যেভাবে সন্ত্রাস সৃষ্টি করেছিল, দু’শ বছরের ইতিহাসে তার নজির নেই।” তিনি হুশিয়ারীও উচ্চারণ করে বলেন, “বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্রের ভবিষ্যত অন্ধকার।” নীল নকশার আওতায় ” নীল নকশার আওতায় সুপরিকল্পিত উপায়ে জনগণের সকল মৌলিক অধিকার ও গণতন্ত্র ছিনিয়ে নেবার উক্ত প্রচেষ্টা পরবর্তী পর্যায়ে ক্রমান্বয়ে সত্য হয়ে উঠে।
একতরফা পাতানো খেলার নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে ২৯১টিতে আওয়ামী লীগকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। চট্টগ্রামের একটি কেন্দ্র থেকে প্রথমে ন্যাপের মোশতাক আহমদ চৌধুরীকে বিজয়ী ঘোষণা করা হলেও পরে তাকে পরাজিত ঘোষণা করা হয়। সবকয়টি বিরোধী দল এই ঘটনার প্রতিবাদ করে। মোশতাক আহমদ চৌধুরী এই নির্বাচনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে একটি রীট আবেদন করেন। সম্পূর্ণ আইন বিভাগ তখন পুরোপুরিভাবে দলীয় স্বার্থের অনুগত বিধায় মোশতাক চৌধুরীর রীটের পরিপ্রেক্ষিতে কোন সুবিচার পাওয়া সম্ভব হয়নি।
১০ই মার্চ এক সাংবাদিক সম্মেলনে জাতীয় লীগের প্রবীণ নেতা জনাব আতাউর রহমান খান নির্বাচন প্রচারাভিযানের সময়, নির্বাচনের দিন ও ফলাফল ঘোষণার পর তার নির্বাচনী এলাকা ধামরাইতে সংগঠিত আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ নেতা কর্মী ও রক্ষীবাহিনীর সার্বিক সন্ত্রাসকে “দুঃস্বপ্নের কালোরাত্রি” বলে আখ্যায়িত করেন।
১১ই মার্চ যুবলীগের নূরে আলম সিদ্দিকী বলেন, “৭ই মার্চের নির্বাচনে যারা আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছে, তারা রাজাকার, আল বদর, স্বাধীনতার শত্রু। এইসব বিদেশী চচরদের মুজিববাদের নিড়ানী দিয়ে উৎখাত করা হবে।” পরদিন বায়তুল মোকাররমে শেখ ফজলুল হক মনি মুজিববাদ বিরোধীদের উৎখাত করার জন্য যুদ্ধ পরিচালনার কথা ঘোষণা করেন। এই যুদ্ধে ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগষ্ট পর্যন- শাহাদাত বরণ করতে হয়েছিল ৩০ হাজারেরও বেশি লোককে। দেশপ্রেমিক বিরোধী দলীয় রাজনৈতিক কর্মী, বুদ্ধিজীবি, সাংবাদিক, শ্রমিক নেতা, ছাত্রসমাজ, আইন- শৃঙ্খলা প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যবর্গও এই শ্বেতসন্ত্রাসের হাত থেকে রেহাই পাননি৷ জাতীয় পরিসরে যেখানেই কেউ স্বৈরশাসনের বিরোধিতা করেছেন অথবা অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন তাকেই নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়েছে নতুবা তাকে হতে হয়েছে অকথ্য নির্যাতনের শিকার।
যারাই প্রতিবাদ করেছিল, মৃত্যু অথবা অমানুষিক নির্যাতনের শিকারে পরিণত হতে হয়েছিল তাদের।
১৯৭৩ সালের মধ্যেই যারা স্বৈরাচার এবং আওয়ামী অপশাসনের বিরোধিতায় সোচ্চার হয়েছিল তাদের কে মৃত্যু কিংবা অকথ্য নির্যাতনের মুখোমুখি হতে হয়।
১৯৭৩ সালে ঐ সময়ের উপমহাদেশের বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ, সাহিত্যিক সাংবাদিক জনাব আবুল মনসুর আহমদ দৈনিক ইত্তেফাকে বিভিন্ন বিষয়ে কতগুলি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ লিখে অসীম সাহসের পরিচয় দেন।
‘আজ আর একচেঞ্জ অব হার্ট নয়, চাই চেক অব হার্ট’ শীর্ষক উপ-সম্পাদকীয় নিবন্ধে তিনি বলেন, “মানুষের হৃদয়ের চার চেম্বারের মতই আমাদের বাংলাদেশের রাজনীতির সকল ক্ষেত্রেই চারটি করিয়া চেম্বার আছে। প্রথমত: আমাদের সংবিধান দাড়াইয়া আছে চারটি স্বতন্ত্ৰ মজবুত মূল নৈতিক খুঁটির উপর। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ (জাতীয়তা তন্ত্রই বেশি শুদ্ধ হইত ) ও ধর্মনিরপেক্ষতা (এখানেও তন্ত্রযোগ করিলে ভাল হইত)। এই চারটি নৈতিক খুটিকে “স্বতন্ত্র” বলিলাম এই দন্ডে যে, সংবিধান রচয়িতাদের মধ্যে কেউ কেউ বলেন, ওই চারটি খুঁটি এক ঘরের খুঁটি হইতে পারে না। খুঁটিগুলির উচ্চতা সমান নয় বলিয়াই তারা এক ঘরের খুঁটি হইতে পারে না। নীতি ও পন্থা হিসাবে এই চার বস্তুর মিল নাই একথাই বোধ করি সমালোচকরা বলিতে চান। তার মানে হৃদপিন্ডের চারটি চেম্বারের মধ্যে যেমন সহযোজক দরজা (কানেকটিং ভালব) আছে, আমাদের চার নীতির মধ্যে তেমন কোন কানেকটিং ভালব নাই। তারপর সংবিধানের বেলাতেও আমরা প্রচলিত শাসনতান্ত্রিক কাঠামোকে টানিয়া বুনিয়া চারি চক্রে আনিবার চেষ্টা করিয়াছি এবং যথাসম্ভব সফলও হইয়াছি। অন্যান্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে প্রচলিত এক্সিকিউটিভ, লেজিসলেটিভ ও জুডিশিয়ারী এই তিনটি ইন্সটিটিউশনকে ‘নির্বাহী বিভাগ’, ‘আইন বিভাগ’ ও ‘বিচার বিভাগ’ নামে সংবিধানে গুঞ্জায়েস করিয়াছি সত্য; কিন্তু সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে যা অত্যাবশ্যক অথচ সংবিধানের কর্মবিভাগ বা দেশরক্ষা বিভাগে যার বিধান করা সম্ভব ছিল না; সেই রূপ একটি স্বতন্ত্র ও স্বয়ংসম্পূর্ণ প্যারামিলিটারী বাহিনী গঠন করিয়া আমরা রাষ্ট্রকে চারটি শক্তি স্তম্ভের উপর দাড় করাইয়াছি। এই চারটি শক্তি স্তম্ভের সাথে পাঠকগণ চারটি মূলনীতি স্তম্ভের সাথে তালগোল পাকাইয়া ফেলিবেন না।”
তার ঐ দীর্ঘ প্রবন্ধে শিল্পকারখানা সর্ম্পকে জনাব আবুল মনসুর আহমদ লেখেন, “হৃদয়ের চার চেম্বারের অনুকরণে আমরা শুধু আমাদের জাতীয় জীবনে, রাষ্ট্রীয় জীবনে, পার্টি জীবনে ও সামাজিক জীবনে চার-বর্ণের প্রবর্তন করিয়াই ক্ষান্ত হই নাই। অর্থনৈতিক জীবনেও উহার সম্প্রসারন করিয়াছি। ‘মিনস অফ প্রডাকশন’ অর্থাৎ উৎপাদন যন্ত্রের মালিকানাকে সংবিধানেই তিন শ্রেণীতে বিভক্ত করিয়াছি। যথা: রাষ্ট্রীয় মালিকানা, সমবায় মালিকানা ও ব্যক্তিগত মালিকানা। এই তিন শ্রেণীর মালিকানা ছাড়া আর সব সম্পত্তি যা প্রডাকটিভ নয়, সেগুলি অটোম্যেটিক্যালী ব্যক্তিগত মালিকানায় থাকার ব্যবস্থা করিয়া গোটা সম্পত্তি জগতকে চার শ্রেণীতে বিভক্ত করিয়া হৃদয়ের চার চেম্বারের সামাঞ্জস্য বিধান করিয়াছি। যাতে মিল কারখানাদির ‘মিনস্ অফ প্রডাকশনকে’ হরতাল স্ট্রাইকারদের দ্বারা আনপ্রডাকটিভ করিয়া অন্য প্রকার মালিকানার সৃষ্টি করিতে কেউ না পারে এবং ঐ পন্থায় চার প্রকার মূলনীতিতে যাতে কেউ বত্যয় ঘটাইতে না পারে সেই উদ্দেশ্যে আমরা হরতাল-স্ট্রাইককে ন্যাশনালাইজ করিয়া ফেলিয়াছি। সরকারি দল ছাড়া অপর সকলের হরতাল স্ট্রাইক নিষিদ্ধ করিয়াছি।”
প্রশাসনের সঙ্গে জনগণের সম্পর্ক প্রশ্নে একই প্রবন্ধে জনাব আবুল মনসুর আহমদ বলেন, “হৃদয়ের চার চেম্বারের প্রতি আমাদের এই সামগ্রিক ও সার্বজনীন আকর্ষণ দেখিয়া বিদেশী বন্ধুরা বিস্মিত হইতে পারেন। কিন্তু তাদের সেই বিস্ময় সেই মুহুর্তেই কাটিয়া যাইবে যখন তারা জানতে পারিবেন যে, জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় নেতার নেতৃত্ব কেবলমাত্র আমাদের হৃদয়ের উপরই নির্ভরশীল। আমাদের নেতা প্রেমিক; তিনি দেশবাসীকে ভালোবাসেন; দেশবাসী তাকে ভালোবাসে। এ দেশে নেতা আর জনতার মধ্যে ভালোবাসা-বাসি ছাড়া আর কোন বৈষয়িক স্বার্থের সম্পর্ক নাই। পুরোটাই হৃদয়ের ব্যাপার। তাই হৃদয়ের চার চেম্বারের সাথে মিল রাখিয়াই আমাদের সামগ্রিক জীবনকে চার ভাগে বিভক্ত করিয়াছি। হৃদয়ের অনুকরণেই আমাদের রাষ্ট্রীয় আর্থিক জীবনকে উপরের তলা নীচের তলা এই দুই তলা বিশিষ্ট করিয়াছি। হৃদয়ের অনুকরণেই আমরা উভয় তলাতেই অর্থাৎ অবিকল ভেনট্রিকস উভয়টাতেই লেফট রাইট রাখিয়াছি। সাধারণত: নেতার ভালোবাসা- বাসির ব্যাপারই হৃদয়ের চার চেম্বারের প্রতি আমাদের আসক্ত করিয়াছে ঠিকই। কিন্তু চারের প্রতি আকৃষ্ট হইবার আমাদের আরও কারণ আছে। আমাদের রাষ্ট্র সেক্যিউলার হইলেও আমরা নিজেরা আজও ধর্মবিরোধী হই নাই। ধর্মনিরপেক্ষ হইয়াছি মাত্র। আমাদের মধ্যে বিপুল মেজরিটি লোকই মুসলমান। আমরা মুসলমানেরা এখনও ধর্ম ছাড়ি নাই। তাই চারের মায়াও ছাড়িতে পারি নাই। আমাদের চার কিতাব, চার কলেমা, চার ফেরেশতা, চার মাযহাব, চার খলিফা, চার ইমাম এ অবস্থায় রাষ্ট্রের চার মূলনীতি, সমাজের চার মালিকানা নীতি, পলিটিকস এ চার পার্টি নীতি। এসবে আমাদের আকর্ষণ সহজাত। শুধু মুসলমানরা হইবে কেন? আমাদের দেশের হিন্দুদের ধর্মেও চারের প্রাধান্য রহিয়াছে। তাদের চার বেদ, চার বর্ন, চার যুগ এমনই চার যোগও আছে। এইভাবে আমরা চারের গোলকধাধাঁয় ঢুকিয়াছি। সরকারি দফতরে চার তাসের কর্মচারী বহাল হওয়ায় বাজারে আমরা চার কায়দায় ব্যবসা চালু করিয়াছি। কালোবাজারী, মুনাফাখোরী, মজুতদারী ও চোরাচালানী আমরা ছাড়তে পারি না এই চারের মায়াতেই।
হার্টের চার চেম্বারের সবচেয়ে বড় ত্রুটি দেখা দিয়াছে ‘জাতির পিতা’ ও তার সন্তানদের সম্পর্কের মধ্যে। জাতির পিতা তার সন্তানদের ভালোবাসেন, সন্তানরাও পিতাকে ভালোবাসে। সবাই পিতাকে অন্তর দিয়া ভালোবাসে বলিয়াই তাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা-প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও পরিণামে খুন-খারাবী। জাতির পিতা খুন-খারাবী বন্ধ করিতে সন্তানদের প্রথমে অনুরোধ পরে নির্দেশ অবশেষে ধমক দিয়েছেন। কিন্তু সন্তানেরা পিতার কথা শুনিতেছে না। পিতা ও কঠোর হইয়া সন্তানদের শাস্তি দিতে পারিতেছেন না। এটা ঘটিতেছে হৃদয়ের জন্যই। বিশেষত: হৃদয়ের চারটি চেম্বারের দোষেই। জাতির পিতা সকলের কল্যাণের জন্য যতই চেঞ্জ অফ হার্টের কথা বলিতেছেন সন্তানেরা ততই স্টেনগানের সাহায্যে এক্সচেঞ্জ অফ হার্ট করিতেছে। এটা অধিক দিন চলিতে দিলে সকলেরই হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হইয়া যাইবে।” এই প্রবন্ধ প্রকাশিত হইবার পর জনাব মনসুরের উদ্দেশ্যে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন মহল থেকে নানারকমের কটুক্তি শুরু হয়।
♦ পাকিস্তানের রাজনীতির পরিণাম – স্বাধীনতার সংগ্রাম এবং আমাদের সিদ্ধান্ত
♦ কোলকাতায় অবস্থিত প্রবাসী সরকার এবং মুক্তিযুদ্ধ
♦ ভারতীয় নীলনকশা এবং মুজিব নগর সরকার
♦ আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসানো হল ; আদর্শিক দেউলিয়াপনা, কোন্দল ও ভাঙ্গন
♦ ৭১ এর চেতনার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা আওয়ামী কুশাসন এবং প্রতিরোধ
♦ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ বাংলাদেশ সামরিক বাহিনী এবং মুজিব সরকার
♦ আওয়ামী দুঃশাসন এবং দুর্নীতির মুখোমুখি সামরিক বাহিনী
♦ বহুদলীয় গণতন্ত্রকে কবর দিয়ে বাকশালী স্বৈরশাসন কায়েম
♦ শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা থেকে জাতিকে মুক্ত করতে ১৫ই আগষ্টের মহান বৈপ্লবিক অভ্যুত্থান
♦ প্রতিবিপ্লবী চক্রান্ত, মোশতাক সরকার এবং সেনা পরিষদ
♦ ৩রা নভেম্বরের ব্যর্থ ক্যু’দাতা এবং ৭ই নভেম্বরের সিপাহী জনতার সফল বিপ্লব
“আমি মেজর ডালিম বলছি” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ