অবাধ চোরাচালান এবং চরম দুর্নীতির ফলেই ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ হয়
১৯৭২ সালের যে কোন খবরের কাগজ খুললে দেখা যাবে প্রায় সব খবরই হচ্ছে খুন, রাহাজানি এবং ছিনতাই সংক্রান্ত।
১৯৭২ সালের যে কোন জাতীয় সংবাদপত্র খুললে প্রথমেই চোখে পড়বে খুন, ডাকাতি, ছিনতাই, রাহাজানী, আর দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির খবর। প্রতিদিন দেশের শহরগুলোতে ঘটছিল প্রকাশ্য খুন, ডাকাতি ও রাহাজানীর ঘটনা৷ গ্রামে-গঞ্জেও চলছিল ত্রাসের রাজত্ব। ক্রমবর্ধমান এ ত্রাসের নাগপাশে জনগণ এক শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় কাল অতিবাহিত করছিল। যখন জনগণের পরনে কাপড় নেই তখনই ঘটেছিল সুতা নিয়ে কেলেংকারী। পেটে যখন ভাত নেই তখন লাখ লাখ টন বিদেশী সাহায্যে প্রাপ্ত খাদ্য নির্বিবাদে পাচাঁর হয়ে গিয়েছিল সীমান্তের ওপারে।
মজলুম নেতা ভাসানী অবাধে চোরাচালানের প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে উঠেন। তিনি আওয়াজ তোলেন সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ ও ভারতীয় সম্প্রসারনবাদের বিরুদ্ধে। জবাবে আওয়ামী লীগ সরকার তাকে চীন ও পাকিস্তানের দালাল, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের তল্পিবাহক প্রভৃতি বলে আখ্যায়িত করে। অথচ ইতিহাস সাক্ষ্য দেবে ১৯৬৮-১৯৬৯ এর সাড়া জাগানো আন্দোলনকালে বরফের উপর আঘাত করেছিলেন সর্বপ্রথম যে ব্যক্তি তার নাম মাওলানা ভাসানী। মাওলানার সার্বজনীন আবানের পরিপ্রেক্ষিতেই ছাত্ররা দিলেন ১১ দফা। তারই নির্দেশে ন্যাপ তার নিজস্ব ১৪ দফা বাদ দিয়ে ১১ দফাকেই তাদের দাবি হিসাবে গ্রহণ করে। ঊনসত্তোরের কারাবন্দী মুজিবর রহমানকে মুক্ত করার দুর্বার গণ আন্দোলনও গড়ে তুলেছিলেন এই মাওলানা ভাসানীই। ১৬ই ফেব্রুয়ারী পল্টনের বিশাল জনসভায় তিনি বজ্রকন্ঠে হুশিয়ারী উচ্চারণ করেন, “প্রয়োজন হলে ফরাসী বিপ্লবের মত জেলখানা ভেঙ্গে মুজিবকে বের করে আনব।” তার মতো একজন অভিজ্ঞ প্রবীণ রাজনৈতিক উদারপন্থী নেতাকে সাম্প্রদায়িক উস্কানিদাতা বলে গালাগালি দিতেও কুন্ঠাবোধ করেনি শাসক দল। এই গালাগাল পর্ব শুরু করেন তরুণ নেতারা। পরে প্রবীণরাও ক্রমে তাদের সাথে যোগদান করেন। মার্চের শুরু থেকেই খবর আসতে থাকে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে- মানুষ মরছে অনাহারে, না খেয়ে। বগুড়া, রংপুর, দিনাজপুর, টাঙ্গাইলে বিরাজ করছে দুর্ভিক্ষ অবস্থা। আকাশচুম্বী দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল বের হতে থাকে স্থানে স্থানে। এ অবস্থায় ভারতীয় দূতাবাসের মুখপাত্রও স্বীকার করেন যে, চোরাচালান হচ্ছে ব্যাপক হারে। তারা বলেন, “সীমান্ত বাণিজ্য চুক্তি হয়ে গেলেই এই চোরাচালান বন্ধ হবে।” এ বক্তব্য দূতাবাস থেকে দেয়া হয় ২৩-৩-১৯৭২ তারিখে। দুর্নীতি ছড়িয়ে পরে দেশের সব জায়গায়, সর্বস্তরে।
১৯৭২ সালের ২৭শে ফেব্রুয়ারী শেখ মুজিব তার সংসদ সদস্যদের প্রতি এক নির্দেশ জারি করে বলেন, “চাকুরি, নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতির জন্য কেউ সুপারিশ করবেন না। প্রশাসনকে চলতে দিন।” ১১ই মার্চ দৈনিক বাংলায় এক খবর বের হয় সিগারেটের পারমিট নিয়ে, “বাংলাদেশ ট্যোবাকো কোম্পানীর ২৫জন ডিষ্ট্রিবিউটর নিয়োগের জন্য কর্তৃপক্ষ তিন হাজার সুপারিশপত্র পেয়েছেন। সুপারিশকারীরা প্রত্যেকেই এমন প্রভাবশালী যে, কোম্পানী কাকে ছেড়ে কাকে ডিলারশীপ দেবেন সে সম্পর্কে কোন সিদ্ধান্তই নিতে পারছেন না।” ৬ই জুন চোরাচালানের স্বর্গ সিলেট থেকে দৈনিক বাংলার প্রতিনিধি খবর পাঠান যে, গ্রেফতারকৃত চোরাচালানীরা প্রভাবশালী ক্ষমতাসীন নেতাদের চাপে ছাড়া পাচ্ছে। একইভাবে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে চরম নৈরাজ্য নেমে আসে সরকারের পারমিটবাজী নীতির সূচনায়। সুতার পারমিট যে পাচ্ছে তার তাঁত নেই, কেরসিনের পারমিট যে পেল সে কোন ডিলার নয়। পারমিট দেয়া হল অব্যবসায়ী রাজনৈতিক টাউটবাজদের খুশি করার জন্য। ফলে ফলে দুর্ভোগ গিয়ে বর্তাল জনগণের উপর। পারমিট হাত বদল প্রথায় জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেল কয়েকগুন। কাপড়ের অভাবে মা-বোনেরা দিনের বেলায় ঘর থেকে বেরুতে পারতেন না। মেয়ে-মা একখানি কাপড় গোসল করে পালা বদলিয়ে পরছে। এ সমস্ত খবরও প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক পত্রিকায়। ঠিক সেই সময় সরকার টিসিবি’র মাধ্যমে ভারত থেকে আনল ‘সুন্দরী শাড়ী’। যে শাড়ীতে হাঁটু ঢাকে না, পর্দাও হয় না। ভারতীয় দূতাবাস বলল টিসিবি দেখেই এনেছে এই শাড়ী। টিসিবি কোন জবাব দিতে পারল না।
আগষ্ট মাসে দেশে বন্যা শুরু হয়। আসে বিস্তর রিলিফ। রিলিফ নিয়ে লুটপাটের কাহিনী পাওয়া যাবে ১৯৭৪ সালের আগষ্ট, সেপ্টেম্বর, অক্টোবর, নভেম্বর, ডিসেম্বর মাসের সংবাদপত্রসমূহে। অবাধ লুটপাট চলে বাশঁ, টিন, খাদ্যসামগ্রী, রিলিফের ঔষধপত্র এবং কম্বল নিয়ে। প্রতিদিনের সংবাদপত্রে ছাপা হয় ক্ষুধাতুর মানুষের ছবি। অন্ন নেই, বস্ত্র নেই, মাথা গোজাঁর ঠাই নেই। কোটি কোটি লোক হয় ক্ষতিগ্রস্ত ও বাস্তুহারা। ৩রা আগষ্ট ইত্তেফাকে ছাপা হয় এসব ছবি। দৈনিক বাংলায় খবর বের হয়, বমি খাচ্ছে মানুষ। বাংলাদেশ রেডক্রস সম্পর্কে প্রকাশিত হয় চুরি, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির অসংখ্য অভিযোগ। গ্রামে-গঞ্জে রেডক্রস প্রধান গাজী গোলাম মোস্তফার নামে ছড়া বের হয়। আতাউর রহমান খান রেডক্রসের অসাধু তৎপরতার প্রতিবাদ করেন। দুর্নীতির অভিযোগ করেন। ১০ই আগষ্টের ইত্তেফাকে সে বিবৃতি ছাপা হয়। ১৩ তারিখ সংবাদপত্রের রিপোর্টে দেখা যায় যে, সারাদেশের মানুষ কচু-ঘেচু খেয়ে জীবনধারণ করছে। আতাউর রহমান খান অভিযোগ করেন যে, বিরোধী দলীয় সদস্যদের ত্রান সাহায্য সংগ্রহের চেষ্টায় পুলিশ বাধা দিচ্ছে। তাদের গ্রেফতার করছে। জনাব খান ১১ই আগষ্ট কাগজে বিবৃতি দেন যে, দুনিয়ায় এমন কোন নজির নেই যে রেডক্রস সমিতির চেয়ারম্যান কোন দলীয় লোক হয়। তিনি একজন বিচারপতি অথবা বিশিষ্ট শিক্ষাবিদকে এ সমিতির দায়িত্ব দেয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
গ্রাম থেকে, উপদ্রুত এলাকা থেকে হাজার হাজার মানুষ শহরে আসতে থাকে। ঢাকা শহরে ১৩৫টি রিলিফ ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। ১২ই আগষ্ট যাত্রাবাড়ির রিলিফ ক্যাম্পে আশ্রয় গ্রহণকারীরা বলেন যে, তিনদিনে তাদের জন্য একমুঠো জন্য একমুঠো খাবার ও বরাদ্দ করা হয়নি। ১৬ই আগষ্ট আইসিআরসির সদস্য মিঃ এলভিন কাজ পরিদর্শনের জন্য আদমজী রিলিফ ক্যাম্পে গেলে লোকেরা কমিটির চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে চুরি ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ করে। এলভিন চলে এলে কমিটির চেয়ারম্যান তার গুন্ডা বাহিনী দ্বারা অভিযোগকারীদের উপর হামলা চালায়। এতে ছুরিকাহত দুই ব্যক্তিকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। খাওয়ার অনুপযুক্ত পচাঁ বিস্কুট সরবরাহ করা হয়। তা থেকে ক্যাম্পগুলোতে কলেরা মহামারী আকারে দেখা দেয়। মরতে থাকে মানুষ।
মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা চলে। সে সময়কার পত্রিকার পাতা উল্টালে গা শিউরে উঠে। মানুষের সৃষ্ট দুর্ভিক্ষ কেড়ে নেয় লাখ লাখ মানুষের প্রাণ। হাজার হাজার চাষী যারা একদা কষে ধরতো লাঙ্গল, মাঠ ভরে তুলত সবুজ শস্যের সমারোহে, তারা ভিক্ষার জন্য শহরের মানুষের কাছে হাত পাতে। ফিরে যায় ভিক্ষা না পেয়ে। তারপর বেওয়ারিশ লাশ হয়ে পড়ে থাকে। আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলাম প্রতিদিন ঢাকা শহর থেকেই তিরিশ থেকে চল্লিশটি বেওয়ারিশ লাশ দাফন করছিল। সে কাহিনী ও ছবি আছে সেই সময়কার দৈনিক সংবাদপত্রগুলোর পাতায় পাতায়। ঢাকায় প্রতি ঘন্টায় ৩-৪ জন লোক মারা যেতে থাকে অনাহারে। এর এক পর্যায়ে আঞ্জুমানের লাশ দাফনের কথা খবরের কাগজে প্রকাশ করা বন্ধ করে দেয়া হয় সরকারি আদেশে। আগষ্ট থেকে ডিসেম্বর মাস অব্দি প্রতিটি জেলা থেকে খবর আসতে থাকে যে, শত শত লোক অনাহারে মারা যাচ্ছে। ভাত নেই, কাপড় নেই, বাসস্থান নেই। ১০ই সেপ্টেম্বর ইত্তেফাক ছবি ছাপে- মাছ ধরার জাল পরে লজ্জা ঢাকার চেষ্টা করছে গ্রামের কোন কুল বধু। চট পরে ভিক্ষার আশায় সন্তান কোলে ঘুরে ফিরছে অসহায় জননী। গৃহবধুরা ক্ষুধার জালায় হচ্ছে প্রমোদবালা। রিলিফের কেলেঙ্কারীর খবর ছাপা হচ্ছিল খবরের কাগজে। কিন্তু অপরাধী ব্যক্তিদের একজনের ও বিচার হয়েছে এমন কথা শোনা যায়নি কখনো৷ কেন হয়নি সে খবরও সংবাদপত্রের পাতায় আসেনি। উত্তরাঞ্চলে পানির দামে বিক্রি হতে থাকে জমি। অসংখ্য সম্ভ্রান্ত কৃষক ভিক্ষুকে পরিণত হন। সে সময়ের ২২শে সেপ্টেম্বর বায়তুল মোকাররমে দুই শতাধিক উলঙ্গ, অর্ধউলঙ্গ নারী পুরুষ অন্নবস্ত্রের দাবিতে মিছিল করে। গ্রাম থেকে আসা অসহায় মানুষের আর্তনাদ একটুও কম্পিত করতে পারেনি আওয়ামী লীগের শাসককুলের হৃদয়। আর সেই সময়েই শেখ মুজিবের ৫৫তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে ৫৫ পাউন্ড ওজনের কেক কাটেন শেখ মুজিব নিজেই !!!
২৩শে সেপ্টেম্বর সারাদেশে ৪৩০০ লঙ্গরখানা খোলার কথা ঘোষণা করা হয়৷ সে সমস্ত লঙ্গরখানার ইতিহাস আর এক করুণ কেলেঙ্কারীর ইতিহাস। নওগাঁর আওয়ামী লীগ সংসদ সদস্য ২৪শে সেপ্টেম্বর এক বিবৃতি দিয়ে জানান যে, সারা জেলার মানুষ গত ৩-৪ দিন ধরে না খেয়ে আছে। চালের সের সাত টাকা। তার ক’দিন পরেই ৬ই অক্টেবর ইত্তেফাক খবর দেয় যে, ২১ লাখ টাকার বিদেশী মদ ও সিগারেট আমদানি করা হয়েছে সরকারি টাকায়। ঐ দিনই খাদ্যমন্ত্রী বললেন, “তখন পর্যন্ত অনাহারে কতলোক মরেছে সরকারের তা জানা নেই৷ জানা নেই। প্রকাশিত পত্রিকাগুলোর খবর অতিরঞ্জিত।” তবে তিনি স্বীকার করেন চোরাচালান কিছুটা হয়েছে।
৮ই অক্টোবর অধ্যাপক আবুল ফজলসহ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮৪ জন শিক্ষক এক বিবৃতিতে বলেন, “জাতির জীবনে দুর্যোগ মোকাবেলার প্রতি এত অনাসক্তি, এত অবজ্ঞা, এত অদ্ভুত রকম ঔদাসীন্য কখনও দেখা গেছে বলে মনে হয় না। নিজের প্রতি আস্থাহীন জাতি যে কী রকম জড় পদার্থে পরিণত হতে পারে বর্তমান বাংলাদেশ তার জ্বলন্ত উদাহরণ। স্বাধীনতা সংগ্রামের সেই একাত্মতা, ত্যাগের মহৎ শক্তির সেই প্রচন্ডতা পরবর্তিকালে সিদ্ধান্তহীনতায়, ভুল সিদ্ধান্তে, প্রশাসনিক নিষ্ক্রিয়তায় আর গুটিকতক লোকের লাগামহীন দুর্নীতির সয়লাবে সব ধুয়ে গেছে। দেশের নেতৃত্বের প্রতি এই জাতীয় দুর্দিনে আমাদের আকুল প্রার্থনা, জাতি হিসেবে আমাদের শক্তিতে আস্থাবান হওয়ার পরিবেশ ফিরিয়ে দিন।”
৮ই অক্টোবর ১৯৭৪ শ্রমিক লীগের আব্দুল মান্নান এমপি জানান, “লবনের দুঃপ্রাপ্যতা সম্পর্কে সম্ভাব্য সকল প্রকার খোঁজখবর নিয়ে জানা গেছে যে, মজুতদার উৎপাদনকারীদের কাছ থেকে ২টাকা মন দরে লবন কিনে থাকে। সরকারিভাবে মজুতদারদের জন্য অশোধিত লবনের দাম ১৫ টাকা আর শোধিত লবনের দাম ৫৫ টাকা নির্ধারিত করা হয়েছে।” তিনি আরো বলেন, “অশোধিত লবনের দাম ৪০ টাকা করা হলে বাজারে প্রচুর লবন পাওয়া যাবে। প্রকাশ, າ ব্যাপারে নাকি আমাদের দলীয় কোন কোন সংসদ সদস্য জড়িত রয়েছেন বলে অনুমান করা হচ্ছে।’
১৩ই অক্টোবর ঢাকার সংবাদপত্র সূত্রে জানা যায় যে, প্রতিদিন গড়ে ৮৪টি বেওয়ারিশ লাশ দাফন হচ্ছে। ২৭শে অক্টোবর খবর আসে জামালপুরে প্রতিদিন অনাহারে শতাধিক লোক মারা যাচ্ছে। সরকার এই মৃত্যুকে পুষ্টিহীনতা বলে অভিহিত করে। অনাহারে মানুষ মরছে সরকার সেটা অস্বীকার করে। ২৫শে অক্টোবর ঢাকার সংবাদপত্রে বের হয় ট্রাক বোঝাই ধানচাল ভারতে পাচাঁর হচ্ছে। দিনাজপুরে চালের সের ৮ টাকা। ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্য মানিকগঞ্জের এক পরিবারের ৭জন আত্মহত্যা করেছে। এসময়ে ২৫শে অক্টোবর আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি জনাব কামরুজ্জামান দাবি করেন, “দেশের প্রচলিত আইনে চোরাচালানীদের দমন করা হচ্ছে না। কয়েক মাস আগে সংসদে চোরাচালানীদের গুলি করে হত্যা করার বিধান পাশ হয়। কিন্তু কাউকে কোন দিন ঐ বিধানে হত্যা করা হয়নি।” একই সঙ্গে কামরুজ্জামান অবশ্য বলেন, “দলের ভেতর থেকে দলের সমালোচনা চলবে না।” তখন থেকে আওয়ামী লীগের ভেতরেও কোন্দল দানা বেঁধে উঠে। সেই ক্রান্তিলগ্নে ২৬শে অক্টোবর ‘৭৪ স্বাধীনতা সংগ্রামকালের প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজুদ্দিন আহমদ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবের নির্দেশে মন্ত্রীত্ব হারান। জনাব তাজুদ্দিন এক বিবৃতিতে বলেন, “জাতির বৃহত্তর স্বার্থে তিনি কোন বিতর্ক সৃষ্টি করতে চান না।” ঢাকার এবং বিদেশী সাংবাদিকদের মতে স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করায় জনাব তাজুদ্দিন আহমদের যে ইমেজ গড়ে উঠে তা পাকিস্তানে আটক শেখ মুজিবর রহমান সহ্য করতে পারছিলেন না। তাছাড়া মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানে আটক শেখ মুজিবের চেয়ে স্বাধীনতার প্রশ্নকে বড় করে দেখার জন্য বেগম মুজিবও তাজুদ্দিনকে সহ্য করতে পারতেন না বলে জানা যায়। তাজুদ্দিন সম্পর্কে সরকার পক্ষ থেকে প্রচার চালানো হয় যে, তিনি অর্থমন্ত্রী থাকাকালে দেশের অর্থনীতি ধ্বংসের পথে চলে যায়। তাজুদ্দিন আহমদ বাকশালের কেন্দ্রিয় কমিটি থেকেও পরবর্তিতে বাদ পড়েন।
২৯শে অক্টোবর সারাদেশে ধর্মঘট নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। একই দিন মজুতদারী আর কালোবাজারীর দায়ে আওয়ামী লীগের আর একজন সংসদ সদস্য গ্রেফতার হন। ৩০ তারিখে লবন মজুতের জন্য আওয়ামী লীগের এমপি ডঃ শামসুদ্দিন আহমদকে গ্রেফতার করা হয়।
এ অবস্থায় মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ ও আইন সাহায্য কমিটির উদ্যোগে ১লা নভেম্বর ১৯৭৪ বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গনে শিক্ষক, আইনজীবি, চিকিৎসক, লেখক, সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক কর্মী, চিত্রশিল্পী ও ছাত্রসহ বিভিন্ন পেশায় নিযুক্ত ব্যক্তিরা বাংলাদেশের বর্তমান মন্বন্তর প্রতিরোধের জন্য আন্দোলন গঠনের উদ্দেশ্যে এক বিরাট সমাবেশে যোগদান করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর বুদ্ধিজীবিদের এত বিরাট সমাবেশ ইতিপূর্বে আর অনুষ্ঠিত হয়নি। ‘মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ ও আইন সাহায্য কমিটির’ সভাপতি সিকান্দার আবু জাফরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত দুই ঘন্টার উপর এ অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন এডভোকেট মির্জা গোলাম হাফিজ, ডঃ আহমদ শরীফ, মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির সম্পাদক জয়নাল আবেদীন, ব্যারিষ্টার মওদুদ আহমেদ, এনায়েত উল্লাহ খান, কামরুন্নাহার লাইলী, নিজামুদ্দিন আহমদ, মহিউদ্দিন আলমগীর, মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির মুহাম্মদ জাকারিয়া এবং বদরুদ্দিন উমর। সমাবেশে বিদ্যমান মন্বন্তর পরিস্থিতি ও মৌলিক আধিকার সম্পর্কে ১৭টি প্রস্তাব গৃহিত হয়। সমাবেশের পর বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গন থেকে একটি মিছিল বের হয়ে শহীদ মিনার পর্যন্ত যায় এবং সেখানেই সমাবেশের কর্মসূচী শেষ হয়। সমাবেশে গৃহিত প্রস্তাববলীর বিবরণঃ-
১৯৭৪ সালের ১লা নভেম্বর বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গনে অনুষ্ঠিত মন্বন্তরের গৃহিত প্রস্তাবে বলা হয় যে, এই মন্বন্তরের ব্যাপকতা ও ভয়াবহতা ১৯৪৩ সালের মন্বন্তরের ব্যাপকতা ও ভয়াবহতাকেও অতিক্রম করেছে এবং এই মম্বন্তর, বন্যা বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে সৃষ্টি হয়নি বরং শাসকশ্রেণী ও তাদের সহযোগীদের গণবিরোধী নীতি ও কর্মকান্ডেরই প্রত্যক্ষ পরিণতি। সমাবেশের প্রস্তাবে এই মন্বন্তরকে ‘প্রায় দুর্ভিক্ষাবস্থা’ বলে বর্ণনা না করে একে মন্বন্তর বলে ঘোষণার জোর দাবি জানানো হয়। প্রস্তাবে বৈদেশিক সাহায্যের একটি শ্বেতপত্র ও চোরাচালানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানানো হয়।
সমাবেশের প্রস্তাবে সর্বদলীয় রিলিফ কমিটি গঠনে সরকারের বিরোধিতার নিন্দা করে অবিলম্বে একটি সর্বদলীয় রিলিফ কমিটি গঠন করার দাবি জানানো হয় এবং এ ব্যাপারে বিরোধী দলসমূহের প্রতি উদ্যোগী ভূমিকা গ্রহণের আহ্বান জানানো হয়। এছাড়াও রেশনিং এলাকা সম্প্রসারন ও টেষ্ট রিলিফ চালু করার দাবি জানানো হয়। সমাবেশের প্রস্তাবে লঙ্গরখানার সংখ্যা বৃদ্ধি এবং সেখানে নির্যাতন বন্ধ করার দাবি জানানো হয়। মন্বন্তর প্রতিরোধ আন্দোলন সমাবেশে রেডক্রসের চেয়ারম্যান হিসাবে সুপ্রীম কোর্টের একজন বিচারপতিকে নিয়োগ করার দাবি জানানো হয়। রাজনৈতিক নির্যাতন বন্ধ ও মিথ্যা মামলায় আটক ও বিনা বিচারে আটক রাজনৈতিক বন্দীসহ সকল রাজবন্দীর মুক্তির দাবি জানানো হয়।
পরবর্তিকালে বেগম খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের সময় আওয়ামী লীগ সরকার ও সরকারি দলের নেতা-সদস্যদের রিলিফ চুরির ও চোরাচালানের বিবরণ দিতে গিয়ে ১৩ই আগষ্ট ১৯৯২ সালে সংসদে বলেছিলেন, “রিলিফ চুরি ও চোরাচালানের মাত্রা এতটা বৃদ্ধি পেয়েছিল আওয়ামী শাসনামলে যে তদানীন্তন রাষ্ট্রপ্রধানকে বলতে হয়েছিল, ‘আমার কম্বলটা কোথায়??” ”(২১শে আগষ্ট ১৯৯২ বিচিত্রায় প্রকাশিত)।
সেই সময় বিরোধী দলীয় নেত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা সংসদে উপস্থিত ছিলেন কিন্তু ঐ বক্তব্যের বিরোধিতা করা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। তিক্ত সত্যকে গলঃধরণ করে তাকে নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকতে হয়েছিল বাধ্য হয়ে অসহায়ের মত।
শেখ কামাল নিজেকে ভবিষ্যত প্রধানমন্ত্রী বলে দাবি করলো !
বেসামরিক প্রশাসনের সাহায্যে আমরা তখনও ব্যস্ত। একরাতে হঠাৎ করে শেখ কামাল, সাহান এবং তারেক এসে উপস্থিত আমার কুমিল্লা সেনানিবাসের বাসায়। সাহান ও তারেক ছিল কামালের বিশেষ ঘনিষ্ট বন্ধু।
কিছুদিন পর হঠাৎ একদিন বেশ রাত করেই শেখ কামাল, সাহান এবং তারেক কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে আমার বাসায় এসে হাজির। রাত তখন প্রায় ১১টা বাজে। এতরাতে কোন খবর না দিয়ে ওদের আগমণে কিছুটা আশ্চর্য হয়েছিলাম।
– কি ব্যাপার কামাল। তোমরা এত রাতে এখানে ? প্রশ্ন করলাম।
– বস সরি ! কিন্তু উপায় নাই। রাতটা আপনার বাসায় নিরাপদে কাটাবো বলেই এলাম। সকালে এসেছি পার্টির কাজে। সারাদিন ব্যস্ত ছিলাম শহরে। খবর দেবার সময়ও পাইনি। কিছুক্ষণ আগে কাজ শেষ হল। দিনকাল খারাপ তাই ভাবলাম শহরে না থেকে আপনার কাছে চলে আসি।
– তা বেশ করেছো। শহরেতো আজ গোলাগুলিও হয়েছে শুনলাম।
– না বস। গোলাগুলি না; এই একটু রংবাজী আর কি! জানাল কামাল। এরি মধ্যে নিম্মী
খাবারের বন্দোবস্ত করে এসে বলল,
– সবার মুখ দেখে বোঝাই যাচ্ছে কারোই খাওয়া হয়নি, এসো খেয়ে নাও; তারপর কথা বলার জন্য সারারাত পড়ে আছে।
– নিম্মী You are really great বলল কামাল। সবাই হাতমুখ ধুয়ে খেতে বসে গেল। এরা তিনজনেই বিশেষভাবে পরিচিত এবং আপনজন। খাওয়ার মাঝেই সাহান বলে উঠল,
– ডালিম ভাই কামাল বিয়ে করছে।
– তাই নাকি ! তা হঠাৎ করে বিয়ে কি বিষয়?
– না মানে, সবাই ধরছে; না করে আর উপায় কি বস ? রাজি হতেই হল।
– এত খুবই সুখবর। তা তোমার স্কলারশীপের কি হল? সস্ত্রীক যাচ্ছ নাকি? জানতে চাইলাম আমি।
– যাওন যাইবো না বস। পড়ালেখা করার সময় নাই। এরপর কামাল শার্টের কলারের একপ্রান্ত আঙ্গুল দিয়ে নাড়িয়ে বেশ একটু গর্বের সাথেই বলল,
– Future Prime Minister বুঝতেইতো পারেন কত কাম। একদম সময় নাই।
– সেটাতো বুঝতেই পারছি; কিন্ত There is no short cut to knowledge. মাত্রতো ২-৪ বছরের ব্যাপার ছিল। লেখাপড়াটা সেরে আসলে ভবিষ্যতে একজন Educated Prime Minister পেতাম। This is my only interest nothing else. তাই বলা আর কি। তাছাড়া আগামী দু’চার বছরেতো চাচা রিটায়ার করছেন না; সেক্ষেত্রে স্কলারশীপটা avail করলেই পারতে। দেখ কামাল, চাচা বলেন তিনি প্রায় সর্বমোট ১৭ বছর জেল খেটেছেন পাক আমলে। জেলে থাকাকালীন অবস্থায় পৃথিবীর প্রায় সব নামি-দামী নেতারা বিস্তর লেখাপড়া করেছেন। আমাদের ঢাকা সেন্ট্রাল জেলের লাইব্রেরীটাও শুনেছি খুবই rich. জেলে থাকাকালীন সময়টার যথাযধ সদব্যবহার করে চাচা কিন্তু তেমন একটা লেখাপড়া করেননি। সময়টাকে কাজে লাগালে আজ তারই অনেক সুবিধা হত রাষ্ট্র পরিচালনা করতে। কি কথাটা ঠিক বললাম কি না? ওরা সবাই আমার কথা শুনছিল আর খাচ্ছিল। কামাল কিংবা অন্যদের কেউ কোন উত্তর দিল না। আমার কথাগুলো সম্ভবত ওদের মনঃপুত হয়নি। খাওয়ার পর কিছুক্ষণ হালকা আলাপ করে সবাই শুয়ে পড়েছিলাম। পরদিন নাস্তার পর ওরা ঢাকায় ফেরার জন্য রওনা হয়ে গেল।
জেনারেল জিয়াকে সেনাবাহিনী থেকে সরিয়ে দেবার পরিকল্পনা
সরকার জেনারেল জিয়াকে বার্মায় ‘ডিফেন্স এ্যটাসী’ করে পাঠাবার সিদ্ধান্ত নেয়।
আমরা তখনো সারাদেশে ডিপ্লয়েড। একদিন নূর ফোন করে জানাল- জেনারেল জিয়া অতি জরুরী প্রয়োজনে আমার সাথে দেখা করতে চান। ফোন পেয়েই এলাম ঢাকায়। নূর জানাল বস আমাকে বাসায় দেখা করতে বলেছেন। বুঝলাম বিশেষ জরুরী বিষয়ে আলাপ করতে ডেকে পাঠিয়েছেন তিনি। জরুরী এবং গোপন বিষয়ে আলাপ-আলোচনা সাধারণতঃ তার বাসাতেই হত। বাসায় গিয়েই দেখা করলাম। সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে অনেক আলোচনার পর তিনি আসল কথাটা বললেন,
– I hear that I am going to be sent out from the army as Defense Attaché to Burma soon, do you know anything about it?
– আকাশ থেকে পড়লাম! কি বলছেন জেনারেল জিয়া? শেখ মুজিবতো কথা দিয়েছিলেন কিছুদিনের মধ্যেই তিনি তাকে চীফ বানাবেন; তাহলে? জবাব দিলাম,
– আমি কিছুই জানি না স্যার। তবে আপনার যাওয়া চলবে না। আপনাকে হারাতে চাই না
আমরা।
– Well then try to do something.. তার ইঙ্গিত স্পষ্ট। তিনি চাচ্ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর সাথে এ বিষয়ে আমি আলাপ করি। অবশ্যই আমার সাধ্যমত যা করার সেটা আমি করব। প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করব আজই। বললাম আমি।
– I shall appreciate that. Do let me know the outcome of your meeting. I shall be waiting for your return.
– ঠিক আছে স্যার। বলে বেরিয়ে এসেছিলাম তার বাসা থেকে।
সেদিন রাতেই গিয়ে উপস্থিত হলাম ৩২নং ধানমন্ডিতে। নেতা তখনো বাড়ি ফেরেননি। রেহানা 3 জামালের সাথে বসে গল্প-গুজব করছিলাম। জামাল জানাল সে স্যান্ডহার্টস না হয় যুগোস্লাভিয়ায় যাচ্ছে Army officer’s course করার জন্য। শুনে বললাম, “ ভালইতো; ক্যারিয়ার হিসাবে আর্মিকে যদি তোমার পছন্দ হয় তবে তো তোমার যাওয়াই উচিত।” আমরা যখন কথা বলছিলাম কামাল যেন কোথা থেকে বাসায় ফিরে এল। আমাকে দেখে জিজ্ঞেস করল,
– বস কি ব্যাপার ?
– কোন ব্যাপার ছাড়া ৩২নং এ বুঝি কেউ আসে না? আমার পাল্টা প্রশ্নে ও একটু লজ্জা পেলো। তাড়াতাড়ি পরিবেশ হালকা করার জন্য বলল,
– না না তা ঠিক নয়। তবে বেশিরভাগ লোকজনদেরই কিছু না কিছু ব্যাপার থাকে; তবে ব্যতিক্রমও আছে যেমন আপনি। আপনি আসেন শুধু আব্বার সাথে ঝগড়া করতে।
– ঝগড়া করার অধিকার তার, ভালবাসার অধিকার যার। জবাবে বলেছিলাম আমি।
– তাতো অবশ্যই, সেটা কি আমরা বুঝি না। বাদ দেন এসব। একটা পরামর্শ দেনতো বস। বলল কামাল।
– কি বিষয়ে? জিজ্ঞেস করলাম।
– একটা স্কলারশীপ পাইছি ক্যানাডায় ল’ পড়ার জন্য। ঠিক করতে পারতাছি না যামু কি যামু না।
– এটাতো অত্যন্ত সুখবর! যাবে না মানে? নিশ্চয়ই যাওয়া উচিত। জ্ঞান অর্জন করার জন্যতো চীন পর্যন্ত যেতে বলেছেন আমাদের প্রিয় নবী। মাত্র ৩-৪ বছরের ব্যাপার। সময় দেখতে দেখতে কেটে যাবে। আমি যদি এমন একটা সুযোগ পেতাম তবে খুশী হয়ে চলে যেতাম। আমার জবাব শুনে কামাল বলল,
– তাহলে যাওয়াই উচিত আপনার মতে?
– অবশ্যই যাওয়া উচিত। এরই মধ্যে বাড়ির কাজের ছেলেটা এসে জানাল কেউ এসেছে কামালের সাথে দেখা করতে তাই বিদায় নিয়ে কামাল চলে গেল। নেতা ফিরলেন বেশ রাতে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার ডাক পড়ল।
– কি খবর অনেকদিন পর আইলি যে? শেখ সাহেব বললেন।
– ঢাকায় কাজে এসেছি ভাবলাম আপনাকে সালাম জানিয়ে যাই। তিনি বেশ খোশমেজাজেই ছিলেন। কথার সাথে সাথে পাইপ টানছিলেন।
– চাচা, আপনি নাকি জেনারেল জিয়াকে বার্মায় Defense Attaché করে পাঠবেন ঠিক করেছেন? তার ভাল মুড এর সুযোগ নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
– ঠিক করি নাই; তবে বার্মায় একজনরে পাঠাইতে হইবো৷ শফিউল্লাহ কইলো জিয়ার নাকি ইন্টিলিজেন্সের ট্রেনিং আছে তাই ওর ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করা হইতাছে।
তার কথার খেই ধরে আমি বললাম,
– ইন্টিলিজেন্স কোর্স করা আর্মিতে আরো অনেক অফিসারই আছে। তাদের থেকে কাউকে পাঠান। General Zia is too senior for that post anyway. তাছাড়া এই মুহুর্তে তাকে বাইরে পাঠালে সবাই ভাববে আপনি আপনার কথার খেলাপ করে তাকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে আর্মি থেকে সরিয়ে দিচ্ছেন। এটা আপনার জন্য ভাল হবে কি? তাছাড়া বেশকিছু কারণে আর্মির ভেতরে একটা সুপ্ত ক্ষোভ বিরাজ করছে। এ অবস্থায় এ ধরণের একটা ইস্যুকে কেন্দ্র করে যদি কোন Out burst ঘটে; সেটা সরকার এবং সরকার প্রধান হিসাবে আপনার জন্য বিব্রতকরও হতে পারে। বেয়াদবী নেবেন না চাচা, আমার মনে হয় এই সিদ্ধান্ত নেয়াটা ঠিক হবে না। চুপ করে আমার কথাগুলো শুনে গেলেন শেখ সাহেব পাইপ মুখে নিয়ে।
– তুই কেমন আছস? কথার মোড় ঘুরিয়ে দিলেন তিনি৷
– যেমন রাখছেন। জবাব দিলাম।
– তোরাতো একটা কথা বুঝস না। পার্টির রাজনীতি করতে গেলে সবকিছুতে যুক্তি চলে না। নিজের ইচ্ছামতও সবকিছু করন যায় না। আমার অবস্থাটা বুঝিস। দেশও চালাইতে হয় আবার পার্টির স্বার্থও দেখতে হয়।
– চাচা আমি রাজনীতি করি না। প্রত্যক্ষ রাজনীতি সম্পর্কে আপনার অভিজ্ঞতা অনেক। সেই তুলনায় আমার কোন জ্ঞান নাই বললেই চলে। তবু কেন জানি মনে হয় প্রচলিত প্রবাদটা একটা গভীর মানে আছে, একটা ঈঙ্গিত বলা চলে।
– কোন প্রবাদের কথা কছ তুই? জানতে চাইলেন জনাব শেখ মুজিব
– ঐ যে, ‘ব্যক্তির চেয়ে দল বড়; দলের চেয়ে দেশ বড়।’ হালকাভাবে কথাটা বলেই ফেললাম। পূর্ব প্রসঙ্গে ফিরে গেলেন শেখ সাহেব।
– জিয়া তোরে পাঠাইছে? প্রশ্ন করলেন তিনি।
– জিয়া পাঠাবে কেন? আপনিই আমাকে কথা দিয়েছিলেন উপযুক্ত সময় তাকে আপনি চীফ বানাবেন; তাই খবরটা জানার পর আমি নিজেই এসেছি স্বেচ্ছায় আপনার কাছ থেকে এ ব্যাপারে জানতে। বেয়াদবী হয়ে থাকলে মাফ করে দেবেন।
– ঠিক আছে বুঝলাম। তুই যা এখন, কিছু লোকজন আইবো।
আমি সালাম জানিয়ে বেরিয়ে এলাম। পরদিন জেনারেল জিয়াকে সবকিছু জানিয়ে কুমিল্লায় ফিরে এলাম। আমাদের সেদিনের আলোচনার ফলেই হোক কিংবা অন্য কোন কারণেই হোক জেনারেল জিয়াকে আর বার্মায় যেতে হয়নি। তার জায়গায় পাঠানো হয়েছিল কর্নেল নূরুল ইসলাম শিশুকে। তিনি অত্যন্ত খুশী হয়ে চলে গেলেন বার্মায়। তার খুশী হওয়ার কারণ ছিল। যুদ্ধের সময় হার্টের পালপিটেশনের অযুহাতে রণাঙ্গন ছেড়ে কোলকাতার মুজিবনগর হেডকোয়াটার্স চলে এসেছিলেন তিনি। দেশ স্বাধীন হবার কিছুদিন পর তিনি হঠাৎ করে একদিন ২৭নং মিন্টু রোডের হেডকোয়াটার্স থেকে লাপাত্তা হয়ে যান। বেশ কিছুদিন হয়ে গেল তবুও তিনি ফিরলেন না। এতে জেনারেল ওসমানী ভীষণ ক্ষেপে গেলেন। তৎকালীন সামরিক গোয়েন্দা বাহিনীর প্রধান ক্যাপ্টেন সালাহ্উদ্দিনকে ডেকে হুকুম দিলেন যেকরেই হোক না কেন deserter শিশুকে খুঁজে বের করে ধরে নিয়ে আসতে। আমরা সবাই জানতাম আর্মিতে আর চাকুরি করতে চাচ্ছেন না শিশু ভাই।
কিন্তু জেনারেল ওসমানীও ছাড়বেন না তাকে। সে এক উভয় সংকট অবস্থা। এ কারণেই লাপাত্তা হয়েছিলেন তিনি। যাই হোক অনেক কষ্টে তাকে সবাই মিলে বুঝিয়ে কোনরকমে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল। সেই শিশু ভাই পরবর্তিকালে জেনারেল জিয়াউর রহমানের শাসনামলে মেজর জেনারেল ইসলাম “The Rasputin of Bangladesh” হয়ে উঠেন। একেই বলে ‘কপালের নাম গোপাল’। বাংলাদেশের রাজপুটিন শিশুর কর্মতৎপরতার পরিণাম কি হয়েছিল সে এক করুণ ইতিহাস। সেক্সপিয়রীয় বিয়োগান্তর নাটকের জুলিয়াস সিজারে পরিণত হয়েছিলেন জেনারেল জিয়াউর রহমান। যাই হোক, জেনারেল জিয়াকে বাইরে পাঠিয়ে দেবার প্রচেষ্টায় আমরা চিন্তিত হয়ে পড়লাম। যাত্রায় তিনি রক্ষা পেলেও পরিষ্কার বোঝা গেল সেনাবাহিনীর দেশপ্ৰেমিক জাতীয়তাবাদী চেতনার অধিকারী অংশকে দুর্বল করে তোলার জন্য সরকার ক্ষেপে উঠেছেন। মেজর জলিল, কর্নেল জিয়াউদ্দিন এবং কর্নেল তাহেরকে ইতিমধ্যেই হারিয়েছি এবং আরো অনেককেই হয়তো বা বের করে দেয়া হবে সেনাবাহিনী থেকে কোন না কোন অজুহাতে। বিষয়টি নিয়ে নিজেদের মধ্যে, রাজনৈতিক মহল এবং অন্যান্য ক্ষেত্রের সমমনা লোকদের সাথে আলোচনা হল। প্রায় সবাই একই মত পোষণ করলেন যে, সেনাবাহিনীতে স্বাধীনচেতা দেশপ্রেমিকদের ক্রমান্বয়ে বের করে দিয়ে শুধুমাত্র খয়ের খাঁ, জী হুজুর টাইপের সদস্যদেরকেই রাখা হবে সেনাবাহিনীতে। এরপর এক সময় রক্ষীবাহিনীকে তাদের সাথে একত্রীভূত করে গড়ে তোলা হবে সম্পূর্ণভাবে সরকারের তাবেদার এক সেনাবাহিনী। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম- এখন থেকে যতটুকু সম্ভব এ বিষয়ে খোঁজ-খবর রাখব।
সেনাবাহিনীকে পুনরায় আইন-শৃংখলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং বেআইনী অস্ত্র উদ্ধারের জন্য বেসামরিক প্রশাসনের সাহায্যে তলব করা হয়।
১৯৭৩ সালের এপ্রিল মাসে এক নাজুক পরিস্থিতিতে দিকহীন আওয়ামী লীগ সরকার আইন শৃংখলা পুনঃপ্রতিষ্ঠার এবং বেআইনী অস্ত্র উদ্ধারের জন্য বেসামরিক প্রশাসনের সাহায্যে সেনাবাহিনীকে তলব করতে বাধ্য হন শেখ মুজিব ও তার সরকার।
১৯৭৩ সালের এপ্রিল মাসে দেশের এক নাজুক পরিস্থিতিতে দিশেহারা মুজিব সরকার নেহায়েত অনোন্যপায় হয়ে আবার সেনাবাহিনীকে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার এবং দুস্কৃতিকারী দমন করে দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি সাধনের জন্য তলব করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কুমিল্লা সেনানিবাসের ব্রিগেড কমান্ডার তখন কর্নেল নাজমুল হুদা। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় জড়িত ছিলেন কর্নেল হুদা। সেই সুবাদে কিংবা অন্য যেকোন কারণেই হোক শেখ মুজিবের প্রতি অন্ধ ভক্তি ছিল তার। তবে এ বিষয়ে সুশিক্ষিত কর্নেল হুদার মনে দ্বন্দ্বও ছিল যথেষ্ট। একই সাথে যুদ্ধ করেছি আমরা। অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি আমাকে ভীষণ আপন করে নিয়েছিলেন। আমাদের সম্পর্ক এত নিবিড় হয়ে উঠেছিল যে আমরা রাজনীতি নিয়ে অবাধে খোলামেলা আলাপ-আলোচনা করতাম। আমার স্পষ্টবাদিতায় অনেক সময় তিনি আতঙ্কিত হয়ে পড়তেন। অনেক সময় বড় ভাইয়ের মত উপদেশ দিতেন বেফাঁস কথাবার্তা বলে আমি যাতে নিজেকে বিপদে না ফেলি। তার আন্তরিকতায় আমি তাকে বিশেষভাবে শ্রদ্ধা করতাম। অপারেশন অর্ডার আসার পর আমি হুদা ভাইকে একদিন বলেছিলাম ‘৭২ সালের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা৷ তিনি নিজেও সে বিষয়ে ওয়াকিফহাল ছিলেন। ঠিক করা হল চীফ অফ স্টাফকে অনুরোধ জানানো হবে যাতে তিনি সশরীরে কুমিল্লায় এসে অপারেশন সম্পর্কে সবকিছুই বিস্তারিত খুলে বলেন। এতে করে আমরাও জানার সুযোগ পাবো এবার সরকারের উদ্দেশ্য কি? প্রধনমন্ত্রী কি এবার সত্যিই তার ‘চাটার দল’ ছেড়ে জনগণের কল্যাণ চান? এর জন্যই কি তিনি আমাদের সাহায্য চাইছেন? সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জেনারেল শফিউল্লাহকে কর্নেল হুদা কুমিল্লায় আসার অনুরোধ জানালেন। এলেন জেনারেল শফিউল্লাহ। কনফারেন্সে তাকে জিজ্ঞাসা করা হল, “৭২ সালের মত সেনাবাহিনীকে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হবে নাতো এবারও?” তিনি জবাব দিয়েছিলেন, “This time ‘Bangabandhu’ means business. If even his dead father is found to be implicated in any crime then his body could be exhumed for trial. No exception this time whatsoever. This is what he told me personally and I have no reason to disbelieve him.” খুবই ভালো কথা। শেখ মুজিব এবার সত্যিই চিনতে পেরেছেন তার সরকার ও দলকে। তিনি তাদের অন্যায়ের প্রতিকার চান। এদের খপ্পর থেকে বেরিয়ে এসে প্রকৃত অর্থে জননেতা হবার জন্য দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর সাহায্য চাইছেন তিনি। তার এই প্রচেষ্টায় অবশ্যই আমরা আমাদের সর্বশক্তি দিয়ে তাকে সাহায্য করব সব ঝুঁকি হাসিমুখে বরণ করে নিয়ে; সে কথাই দেয়া হয়েছিল জেনারেল শফিউল্লাকে। অপারেশনকে যেকোন মূল্যে সফল করে তুলবো আমরা। খুশি মনেই ফিরে গিয়েছিলেন তিনি। কুমিল্লা ব্রিগেডকে দায়িত্ব দেয়া হল কুমিল্লা, নোয়াখালী এবং সিলেটে অপারেশন পরিচালনার। আমাকে কর্নেল হুদা (হুদা ভাই) কুমিল্লা অপারেশনের দায়িত্ব দিলেন। সিলেট এবং নোয়াখালীর দায়িত্ব দেয়া হল মেজর হায়দার এবং মেজর রশিদকে। Combing Operation শুরু হল। সরকারি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর রিপোর্ট থেকে জানা গেল সব সেক্টরে আওয়ামী লীগ এবং দলের অঙ্গ সংগঠনগুলোর কাছেই রয়েছে বেশিরভাগ অবৈধ অস্ত্ৰ৷ প্রভাবশালী নেতাদের ছত্রছায়াতেই নিরাপদে রয়েছে ঐসব অস্ত্র এবং অস্ত্রধারীরা। তাতে কি? এবার মুজিব তার মরা বাপকেও ছাড়তে রাজি নন। আমরা যার যার এলাকায় সব প্রস্তুতি শেষে অপারেশন শুরু করলাম। সব জায়গায়ই খবর পাওয়া যাচ্ছিল এলাকার যত দাগী লোক, অবৈধ অস্ত্রধারী, সন্ত্রাসী, খুনী, লুটেরাদের মাথা হল আওয়ামী লীগের নেতারা কিংবা নেতাদের পোষ্য মাস্তানরা। সব জায়গাতেই আবার আমাদের সরকারি দলের নেতারাও তাদের তৈরি সন্ত্রাসীদের নামের তালিকা দিয়েছিলেন। কিন্তু তদন্তের ফলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে তাদের দেওয়া তালিকাভুক্ত লোকেরা প্রায়ই এলাকায় সৎ এবং নীতিবান বলে পরিচিত। অবশ্য তাদের মধ্যে অনেকেই সরকার বিরোধী রাজনীতির সাথে জড়িত কিংবা সমর্থক ছিলেন। আমাদের দায়িত্ব হল দুঃস্কৃতিকারীদের ধরা সে যেই হোক না কেন। দল বিশেষের প্রতি আমাদের কোন পক্ষপাতিত্ব নেই। আমাদের কাজ হচ্ছে নিরপেক্ষ থেকে আমাদের দায়িত্ব পালন করে যাওয়া। ধর-পাকড করা হল অপরাধীদের স্থানীয় বেসামরিক আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলো এবং প্রশাসনের সহায়তায়। যারা ধরা পড়েছিল তাদের বেশিরভাগই হোমরা-চোমরা চাঁই এবং নেতা-নেত্রীরা৷ সংসদ সদস্যা মমতাজ বেগম থেকে কুমিল্লার জহিরুল কাইউম কেউই বাদ পড়লেন না। সিলেট, নোয়াখালী, খুলনা, বরিশাল এবং দেশের অন্যান্য জায়গাতে আর্মির হাতে ধরা পড়ল শেখ নাছের, হাসনাত প্রমুখ অনেক নামী-দামী নেতারা। সব জায়গায় একই একই উপাখ্যান। এলাকার দুস্কৃতিকারীদের বেশিরভাগই সরকার ও সরকারি দলের লোকজন সরকারি দলের লোকজন। এই অপারেশনের সময় সেনাবাহিনীর সদস্যরা সরাসরিভাবে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা-পাতি নেতাদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংঘাতে জড়িয়ে পড়েন। আর্মি অপারেশনের ফলে সারাদেশে চমক সৃষ্টি হল। লোকজন ভাবল শেখ মুজিব আর্মির সাহায্যে ‘চাটার দল’ এর সন্ত্রাস ও দুর্নীতির হাত থেকে দেশ ও জাতিকে বাঁচাবার চেষ্টা করছেন। ফলে সবখানেই জনগণ স্বতঃস্ফুর্তভাবে এগিয়ে এসেছিলেন আমি অপারেশনে সাহায্য করতে। কয়েকদিনের দেশব্যাপী অভিযানের ফলে সন্ত্রাস কমে গেল অস্বাভাবিকভাবে। জনগণের মনে আশা ফিরে এল। দুঃশাসনের ফলে নির্জীব হয়ে পড়া জাতির মধ্যে নতুন করে প্রাণের সঞ্চার হল। ধরা পড়া সবার বিরুদ্ধেই আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হল। কারো ব্যাপারেই কোন ব্যতিক্রম করা হল না। যদিও বিভিন্ন প্রভাবশালী মহল থেকে এমনকি প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় থেকেও অনেকের ব্যাপারে চাপ সৃষ্টি করার চেষ্টা করা হচ্ছিল অনবরত। কিন্তু আমরা আমাদের নীতিতে সবাই অটল। কারো ব্যাপারে কোন বাছ-বিচার করা হবে না। আইন সবার জন্যই সমান। হঠাৎ সেনা সদর থেকে কয়েকজন আটক অপরাধীকে ছেড়ে দেবার জন্য নির্দেশ পাঠালেন জেনারেল শফিউল্লাহ। কর্নেল হুদা পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন কাউকে ছেড়ে দেওয়া তার পক্ষে কিছুতেই সম্ভব নয়। কারণ শুধুমাত্র আইনই এখন তাদের ভাগ্য নির্ধারন করতে পারে। আইনকে নিজের হাতে নেবার কোন অধিকার তার নেই। ব্রিগেড কমান্ডারের এই জবাব জেনারেল শফিউল্লাহ প্রধানমন্ত্রীকে জানালেন। কর্নেল হুদার কাছে ফোন এল প্রধানমন্ত্রীর। কর্নেল হুদা বিনীতভাবে প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করলেন প্রধানমন্ত্রী যেন তার রাজনৈতিক সচিব জনাব তোফায়েলকে পাঠিয়ে দেন চীফের সাথে সরেজমিনে অবস্থার তদন্ত করার জন্য। তদন্তে যদি প্রমাণিত হয় যে আর্মি কারো প্রতি কোন অবিচার কিংবা অন্যায় আচরণ করেছে সেক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর যেকোন শাস্তিই তিনি মাথা পেতে নিতে প্রস্তুত আছেন এরিয়া কমান্ডার হিসাবে। প্রধানমন্ত্রীর টেলিফোন যখন আসে তখন দৈবক্রমে আমিও কন্ট্রোল রুমে এ উপস্থিত ছিলাম। প্রধানমন্ত্রীর ফোন তাই আমি রুম থেকে বের হয়ে যেতে চেয়েছিলাম কিন্তু কর্নেল হুদার নির্দেশেই রুমে থেকে যেতে হয়েছিল আমাকে। কর্নেল হুদার চারিত্রিক দৃঢ়তা সেদিন আমাকে মুগ্ধ করেছিল। নেতার প্রতি তার অন্ধ আনুগত্য এবং শেখ মুজিবের অতি বিশ্বাসভাজনদের একজন হয়েও কর্নেল হুদা (গুডু ভাই) এ ধরণের জবাব প্রধানমন্ত্রীকে দেবেন সেটা সত্যিই আমি ভাবতে পারিনি। প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন অতিসত্বর তিনি লোক পাঠাচ্ছেন তদন্তের জন্য। সেদিনই হেলিকপ্টারে করে এসে পৌঁছালেন জেনারেল জিয়াউর রহমান। জনাব তোফায়েলকে কিছুতেই তিনি সঙ্গে আনতে রাজি করাতে পারেননি। সেটাই স্বাভাবিক। কারণ জনাব তোফায়েল কুমিল্লায় এলে সবকিছু বিস্তারিত জানার পর মাথা হেট করে ফিরে যাওয়া ছাড়া অন্য কোন গত্যান্তর থাকত না তার। জেনারেল জিয়ার আগমণের পর কুমিল্লাসহ অন্য সব জেলার শীর্ষ নেতাদের যারা তখনও বাইরে ছিলেন তাদের সবাইকে সেনানিবাসে আমন্ত্রণ জানানো হল এক মধ্যাহ্ন ভোজে। ভোজপর্ব শেষে একে একে সব ধৃত ব্যক্তিদের কেন এবং কোন চার্জে ধরা হয়েছে; প্রমাণাদিসহ তার বিশদ বিবরণ দিলেন অপারেশন কমান্ডাররা। কেউ কোনকিছুর প্রতিবাদ করতে পারলেন না। জেনারেল জিয়া কর্নেল হুদা এবং আমাকে সঙ্গে করে একই হেলিকপ্টারে করে ঢাকায় সেনা সদরে ফিরে এলেন। সেখান থেকে জেনারেল শফিউল্লাহকে সঙ্গে করে আমরা গেলাম ৩২নং ধানমন্ডিতে শেখ সাহেবের সাথে দেখা করতে। সেখানে পৌঁছে দেখি প্রধানমন্ত্রী এবং জনাব তোফায়েল আহমদ আমাদের জন্য উদ্গ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছেন। ঘরে ঢুকতেই কর্নেল হুদা এবং আমাকে দেখা মাত্র শেখ মুজিব গর্জে উঠলেন,
– কি পাইছস তোরা? আওয়ামী লীগ ছাড়া দেশে আর কোন দুস্কৃতিকারী নাই? জাসদ, সর্বহারা পার্টির লোকজন তোদের চোখে পড়ে না? অবাক হয়ে গেলাম। কি বলছেন প্রধানমন্ত্ৰী ! কর্নেল হুদা জবাব দিলেন,
– স্যার আমরা আপনার নির্দেশে অপারেশন করছি প্রকৃত দুস্কৃতিকারীদের ধরার জন্য। আমরা নির্দলীয়। আমাদের কাছে সবাই সমান। বিভিন্ন এজেন্সীর দেয়া রির্পোটের ভিত্তিতে এবং আমাদের নিজস্ব এজেন্সী দিয়ে ঐ সমস্ত রিপোর্ট ভেরিফাই করার পরই আমরা এ্যাকশন নিয়েছি। ধৃত ব্যক্তিদের বেশিরভাগই যদি আওয়ামী লীগার হয় তাতে আমাদের দোষ কোথায়? কথা বাড়তে না দিয়ে জনাব তোফায়েল কয়েকজনের নাম করে তাদের অবিলম্বে ছেড়ে দিতে বললেন। তাকে সমর্থন করে আমাকে উদ্দেশ্য করে প্রধানমন্ত্রী বললেন,
– যা হবার তা হইছে। এখন এদের ছাড়ার বন্দোবস্ত কর। জবাবে আমি বললাম, -ধরার বা ছাড়ার মালিক আমরা নই স্যার। চীফের মাধ্যমে আপনার নির্দেশই কার্যকরী করেছি আমরা। ধরার হুকুম দিয়েছিলেন আপনি; ছাড়ার মালিকও আপনি; তবে এ বিষয়ে আইন কি বলে সেটা আমার জানা নেই। ছেড়ে দেয়াটা যদি আইনসম্মত মনে করেন তবে হুকুম জারি করে আইন সংস্থাকে বলেন তাদের ছেড়ে দিতে। আমরা তাদের ছাড়বো কিভাবে? তারাতো এখন আমাদের অধিন নয়। সবাই এখন রয়েছে আইনের অধিনে। আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে প্রত্যেকের বিরুদ্ধে। আমার জবাব শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে জেনারেল শফিউল্লাকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলে উঠলেন,
– বাজান ! কিছু একটা কর নাইলে দেশে আওয়ামী লীগ একদম শ্যেষ হইয়া যাইবো। জেনারেল শফিউল্লাহ প্রধানমন্ত্রীর ‘বাজান’ সম্বোধনে বিগলিত হয়ে দাড়িয়ে পড়ে প্রায় হাতজোড় করে বললেন,
– স্যার। আপনি অস্থির হবেন না। আমি অবশ্যই একটা কিছু করব। আপনি আমার উপর ভরসা রাখতে পারেন। কথাগুলো শেষ করে বসতেও ভুলে গিয়েছিলেন সেনা প্রধান। প্রধানমন্ত্রীর ইশারায় আবার নিজের আসনে বসলেন জেনারেল শফিউল্লাহ। আমরা সবাই নিশ্চুপ বসে থেকে তার মোসাহেবীপনার কৌতুক উপভোগ করছিলাম কিছুটা বিব্রত হয়ে। After all he is our Chief! ইতিমধ্যে জনাব তোফায়েল শেখ সাহেবের কানে কানে নীচুস্বরে কিছু বললেন। তার কান পড়ায় হঠাৎ ক্ষিপ্ত হয়ে প্রধানমন্ত্রী বলে উঠলেন,
– কুমিল্লার ক্যাপ্টেন হাই, ক্যাপ্টেন হুদা, লেফটেন্যান্ট তৈয়ব, সিলেটের লেফটেন্যান্ট জহির এর বিরুদ্ধে এ্যাকশন নিতে হইবো। তারা বন্দীদের উপর অকথ্য অত্যাচার করছে। হুদা ভাইকে উদ্দেশ্য করেই ক্ষোভ প্রকাশ করলেন শেখ মুজিব।
– স্যার ওরা সব জুনিয়র Subordinate officer. ওরা যা করেছে সেটা আমার হুকুমেই করেছে। অত্যাচারের অভিযোগ সত্যি নয়। এই অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যে এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। তার পরেও যদি ওদের শাস্তি দিতে চান তবে সেটা সবার আগে আমারই প্রাপ্য। আমাকে ডিঙ্গিয়ে জুনিয়র অফিসারদের শাস্তি দিলে সেটা আমার জন্য অপমানকর হবে সেক্ষেত্রে কমান্ডার হিসাবে অধিনস্থ সব অফিসার এবং সৈনিকদের কাছে আমি আর ফিরে যেতে পারব না। কর্নেল হুদার জবাবে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। ত্রস্তে উঠে দাড়ালেন তিনি এবং বললেন,
– ঠিক আছে। আইজ তোরা যা, ডালিম তুই রাইতে খাইয়া যাইস। আমাকে রেখে বাকি সবাই চলে গেলেন। শেখ সাহেব ও আমি বাড়ির অন্দর মহলে ঢুকলাম। রাত তখন প্রায় ১১টা৷ যথাযথ নিয়মে বারান্দায় খাওয়া পরিবেশন করা হল। খেতে খেতে শেখ সাহেব বললেন, –তুই থাকতে কুমিল্লায় আওয়ামী লীগের এই দশা অইলো ক্যান?
– চাচা বিশ্বাস করেন; আমরা কোন দল দেখে অপারেশন করিনি। চীফ কুমিল্লায় এসে আমাদের বলেছিলেন এবার নাকি আপনি আপনার মরা বাপকেও ছাড়বেন না। আমরা সে অনুযায়ী কাজ করেছি। আপনি একবার কুমিল্লায় গিয়ে দেখেন লোকজন কি খুশী। সবাই মনে করছে এবার আপনি সত্যিই চাটার দল এবং টাউট বাটপারদের শায়েস্তা করতে চাচ্ছেন। এই পরিস্থিতিতে নেতা হিসাবে জনগণের মনোভাবকেই তো আপনার প্রাধান্য দেয়া উচিত। আমিতো মনে করি আমাদের এই অপারেশনের পর আপনার জনপ্রিয়তা অনেক বেড়ে গেছে। এখন যেকোন কারণেই আপনি যদি এদের ছেড়ে দেন তবে কি আপনার লাভ হবে? আমারতো মনে হয় ক্ষতিই হবে আপনার। আপনার পরামর্শদাতারা যে যাই বলুক না কেন আমার মনে হয় বিনা বিচারে কাউকেই ছাড়া আপনার উচিত হবে না। এতে ব্যক্তিগতভাবে আপনিই ক্ষতিগ্রস্থ হবেন সবচেয়ে বেশি।
– কিন্তু পার্টি ছাড়া আমি চলমু কেমনে ? প্রশ্ন করলেন শেখ সাহেব।
– পার্টি আপনার অবশ্যই প্রয়োজন। মনে করেন না কেন এটা একটা শুদ্ধি অভিযান। খারাপদের বাদ দিয়ে সৎ এবং ভালো মানুষদের নিয়েওতো পার্টি চালানো যায়। কিছু মনে করবেন না চাচা; চোর, বদমাইশ, সন্ত্রাসী, লুটেরা, টাউট-বাটপারদের নেতা হিসাবে পরিচিত হওয়াটাকি আপনার শোভা পায়? যারাই ধরা পড়ছে তাদের বেশিরভাগই আওয়ামী লীগার। তার মানে বর্তমানে আপনার দলে ভালো লোকের চেয়ে খারাপ লোকজনই বেশি। এদের বাদ দেন। দেখেন লোকজন কিভাবে আপনাকে সমর্থন জানায়। চুপ করে শুনছিলেন আমার কথা। মুখটা ছিল থমথমে। খাওয়ার পর পাইপ টানার অভ্যাস তার, পাইপটা টেবিলের উপর পরে থাকলেও আজ তিনি সেটা ধরাননি। চিন্তিত অবস্থায় হঠাৎ করে বলে উঠলেন,
– বাঙ্গালী জনগণরে খুব ভালো কইরা চিনি আমি।
বুঝলাম না তিনি এই উক্তিতে কি বোঝাতে চাইলেন। কিছুক্ষণ পর শোবার ঘরে উঠে চলে গেলেন শেখ সাহেব। ওখানে তার কোন আত্মীয় অপেক্ষা করছিলেন। আমিও উঠতে যাচ্ছিলাম হঠাৎ কামাল এসে উপস্থিত।
– বস দিলেনতো আওয়ামী লীগ শেষ কইরা। কাজটা ভালো করেন নাই। উত্তর দিলাম,
– সব criminals and badelements যদি আওয়ামী লীগার হয় তার জন্য আমরা দায়ী না৷ সারা দিনের ধকলে ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম তাই কথা না বাড়িয়ে চলে এসেছিলাম ৩২ নম্বর থেকে। বাসায় ফিরে দেখি আব্বা আমার ফেরার অপেক্ষায় তখনও জেগে বসে আছেন। বুঝতে পারলাম কুমিল্লা থেকে নিম্মী ফোন করে আমার ঢাকায় আসার খবর বাসায় জানিয়েছে।
আব্বা জিজ্ঞেস করলেন কি হল? সবকিছুই খুলে বললাম তাকে। সব শুনে তিনি বললেন, “তোরা কি ভেবেছিলি? শেখ মুজিব সত্যিই অপরাধীদের ধরার জন্য তোদের মাঠে নামিয়েছে? আমি ওকে ভালো করে চিনি। যখন এসএম হলে জিএস ছিলাম তখন একসাথে মুসলীম লীগের রাজনীতিও করেছি। ওর নীতি বলে কিছু নেই। সারাজীবন ক্লিকবাজী আর লাঠিবাজীর মাধ্যমে নিজের সুবিধা আদায় করে নিয়েছে সে। চরম সুবিধাবাদী চরিত্রের ধুরন্দর শেখ মুজিব। তোদের মাঠে নামিয়ে এক ঢিলে দুই পাখি শিকার করতে চেয়েছিল শেখ মুজিব। একদিকে বর্তমানের তীব্র সরকার বিরোধী তৎপরতায় লিপ্ত রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিশেষ করে জাসদ, সর্বহারা পার্টির সদস্যদের খতম করা অন্যদিকে সেনাবাহিনী এবং জনগণের দেশপ্রেমিক ও জাতীয়তাবাদী অংশের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি করে সেনাবাহিনীকে তার দলের লাঠিয়াল বাহিনীতে পরিণত করার জন্যই সে এই পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু তার চালকে বানচাল করে দিয়েছিস তোরা। দেখ এখন সে কি করে। তাদের নিয়েই আমার চিন্তা। I hope you and your other colleauges don’t get victimised. আব্বার কথাগুলো শুনে জবাবে আমার কিছু বলার ছিল না। তার বক্তব্যের সত্যতা ভবিষ্যতেই প্রমাণ হতে পারে। আব্বা বুঝতে পেরেছিলেন আমি ভীষণ ক্লান্ত। তাই কথা না বাড়িয়ে বললেন, “কুমিল্লাতে একটা ফোন করে শুয়ে পড়। Don’t over estimate Mujib, he is just an average man. আব্বার কথায় কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়েছিলাম। পরদিন সকালে জেনারেল শফিউল্লাহ সেনা সদরে আমাকে ডেকে পাঠালেন। সেখানে গিয়ে দেখি কর্নেল হুদাকেও ডেকে পাঠানো হয়েছে। হুদা ভাই আমাকে বললেন, “Chief will go with us to Comilla to release all those people.” ভীষণভাবে দমে গিয়েছিলাম এই সিদ্ধান্তের কথা শুনে। হুদা ভাই ও ভীষণ আপসেট. ক্যাপ্টেন নূর জেনারেল জিয়ার এডিসি. তার কামরায় গিয়ে বললাম, বসের সাথে দেখা করতে চাই। নূরের মাধ্যমে খবরটা পেয়েই তিনি আমাকে ডেকে পাঠালেন। ঘরে ঢুকে দেখলাম তিনিও গম্ভীর। আমাকে বসতে ইঙ্গিত করে বললেন, “Well I know every thing. Don’t loose heart. Allah is there. You have done your duty sincerely so forget about the rest and be at ease.” চীফের সাথে একই হেলিকপ্টারে ফিরে এলাম কুমিল্লায়। চীফ নিজে গিয়ে বন্দীদের মুক্তি দিলেন। আমাদের সামনেই ফুলের মালা গলায় পরিয়ে সমবেত আওয়ামী লীগাররা সদর্পে মিছিল করে চলে গেল শেখ মুজিবের জয়ধ্বনি করতে করতে। বিব্রতকর অবস্থায় intolerable humiliation সহ্য করে নিতে হয়েছিল আমাদের সকলকে। ঢাকায় ফেরার আগে জেনারেল শফিউল্লাহ আমাদের সারমন দিলেন, “Prime minister’s desire is an order.” এ ঘটনার ফলে সারাদেশে ডেপ্লয়েড আর্মির মনোবল একদম ভেঙ্গে পড়েছিল। গুজব ছড়িয়ে পড়ল শেখ মুজিব শীঘ্রই আর্মি অপারেশন বন্ধ করে দিচ্ছেন। এরপর আমরা নামে মাত্র অপারেশনে ডেপ্লয়েড ছিলাম। আরোপিত দায়িত্ব পালনে কোন উৎসাহ ছিল না কারোই। কোনরকমে সময় কাটাচ্ছিলাম আমরা।
আমার স্ত্রী এবং আমি গাজী গোলাম মোস্তফা কর্তৃক অপহরিত হই
রেডক্রস চেয়ারম্যান এবং তদানীন্তন ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ প্রধান গাজী গোলাম মোস্তফা নিম্মী এবং আমাকে বন্দুকের মুখে লেডিস ক্লাব থেকে অপহরণ করে নিয়ে যায়।
১৯৭৪ সালের মাঝামাঝি ঘটে এক বর্বরোচিত অকল্পনীয় ঘটনা। দুস্কৃতিকারী দমন অভিযানে সেনাবাহিনী তখনও সারাদেশে নিয়োজিত। আমার খালাতো বোন তাহমিনার বিয়ে ঠিক হল কর্নেল রেজার সাথে। দু’পক্ষই আমার বিশেষ ঘনিষ্ট। তাই সব ব্যাপারে মধ্যস্থতা করতে হচ্ছিল আমাকে এবং নিম্মীকেই। বিয়ের দু’দিন আগে ঢাকায় এলাম কুমিল্লা থেকে। ঢাকা লেডিস ক্লাবে বিয়ের বন্দোবস্ত করা হয়েছে। সেই বিয়েতে অনেক গন্যমান্য সামরিক এবং বেসামরিক লোকজন বিশেষ করে হোমরা-চোমরারা এসেছিলেন অতিথি হিসেবে। পুরো অনুষ্ঠানটাই তদারক করতে হচ্ছিল নিম্মী এবং আমাকেই। আমার শ্যালক বাপ্পি ছুটিতে এসেছে ক্যানাডা থেকে। বিয়েতে সেও উপস্থিত। বিয়ের কাজ সুষ্ঠভাবেই এগিয়ে চলেছে। রেডক্রস চেয়ারম্যান গাজী গোলাম মোস্তফার পরিবারও উপস্থিত রয়েছেন অভ্যাগতদের মধ্যে। বাইরের হলে পুরুষদের বসার জায়গায় বাপ্পি বসেছিল। তার ঠিক পেছনের সারিতে বসেছিল গাজীর ছেলেরা। বয়সে ওরা সবাই কমবয়সী ছেলে-ছোকরা। বাপ্পি প্রায় আমার সমবয়সী। হঠাৎ করে গাজীর ছেলেরা পেছন থেকে কৌতুকচ্ছলে বাপ্পির মাথার চুল টানে, বাপ্পি পেছনে তাকালে ওরা নির্বাক বসে থাকে। এভাবে দু’/তিনবার চুলে টান পড়ার পর বাপ্পি রাগান্বিত হয়ে ওদের জিজ্ঞেস করে, -চুল টানছে কে?
– আমরা পরখ করে দেখছিলাম আপনার চুল আসল না পরচুলা। জবাব দিল একজন। পুচঁকে ছেলেদের রসিকতায় বাপ্পি যুক্তিসঙ্গত কারণেই ভীষণ ক্ষেপে যায়; কিন্তু কিছুই বলে না৷ মাথা ঘুরিয়ে নিতেই আবার চুলে টান পরে। এবার বাপ্পি যে ছেলেটি চুলে টান দিয়েছিল তাকে ধরে ঘর থেকে বের করে দিয়ে বলে,
– বেয়াদপ ছেলে মশকারী করার জায়গা পাওনি? খবরদার তুমি আর ঐ জায়গায় বসতে পারবে না। এ কথার পর বাপ্পি আবার তার জায়গায় ফিরে আসে। এ ঘটনার কিছুই আমি জানতাম না৷ কারণ তখন আমি বিয়ের তদারকি এবং অতিথিদের নিয়ে ভীষণভাবে ব্যস্ত। বিয়ের আনুষ্ঠিকতার প্রায় সবকিছুই সুষ্ঠভাবেই হয়ে যায়। খাওয়া-দাওয়ার পর্বও শেষ। অতিথিরা সব ফিরে যাচ্ছেন। সেদিন আবার টেলিভিশনে সত্যজিৎ রায়ের পুরষ্কার প্রাপ্ত ছবি ‘মহানগর’ ছবিটি দেখানোর কথা; তাই অনেকেই তাড়াতাড়ি ফিরে যাচ্ছেন ছবিটি দেখার জন্য। অল্প সময়ের মধ্যেই লেডিস ক্লাব প্রায় ফাঁকা হয়ে গেল। মাহবুবের আসার কথা৷ মানে এসপি মাহবুব। আমাদের বিশেষ ঘনিষ্ট বন্ধুদের একজন। আমরা সব একইসাথে যুদ্ধ করেছি স্বাধীনতা সংগ্রামে। কি এক কাজে মানিকগঞ্জ যেতে হয়েছিল তাকে। ওখান থেকে খবর পাঠিয়েছে তার ফিরতে একটু দেরী হবে। ঘনিষ্ট আত্মীয়-স্বজনরা সবেমাত্র তখন খেতে বসেছি। হঠাৎ দু’টো মাইক্রোবাস এবং একটা কার এসে ঢুকল লেডিস ক্লাবে। কার থেকে নামলেন স্বয়ং গাজী গোলাম মোস্তফা আর মাইক্রোবাস দু’টো থেকে নামল প্রায় ১০-১২ জন অস্ত্রধারী বেসামরিক ব্যক্তি। গাড়ি থেকেই প্রায় চিৎকার করতে করতে বেরুলেন গাজী গোলাম মোস্তফা।
– কোথায় মেজর ডালিম? বেশি বার বেড়েছে। তাকে আজ আমি শায়েস্তা করব। কোথায় সে? আমি তখন ভেতরে সবার সাথে খাচ্ছিলাম। কে যেন এসে বলল গাজী এসেছে। আমাকে তিনি খুঁজছেন। হঠাৎ করে গাজী এসেছেন কি ব্যাপার? ভাবলাম বোধ হয় তার পরিবারকে নিয়ে যেতে এসেছেন তিনি। আমি তাকে অভ্যর্থনা করার জন্য বাইরে এলাম। বারান্দায় আসতেই ৬-৭ জন স্টেনগানধারী আমার বুকে-পিঠে-মাথায় তাদের অস্ত্র ঠেকিয়ে ঘিরে দাড়াল। ঘটনার আকস্মিকতায় আমিতো হতবাক! কিছুটা অপ্রস্তুতও বটে। সামনে এসে দাড়ালেন স্বয়ং গাজী। আমি অত্যন্ত ভদ্রভাবে তাকে জিজ্ঞেস করলাম,
– ব্যাপার কি? এ সমস্ত কিছুর মানেই বা কি?
তিনি তখন ভীষণভাবে ক্ষীপ্ত। একনাগাড়ে শুধু বলে চলেছেন,
– গাজীরে চেন না। আমি বঙ্গবন্ধু না। চল্ শালারে লইয়া চল্। আইজ আমি তোরে মজা দেখামু। তুই নিজেরে কি মনে করছস?
অশালীনভাবে কথা বলছিলেন তিনি। আমি প্রশ্ন করলাম,
– কোথায় কেন নিয়ে যাবেন আমাকে?
আমার প্রশ্নের কোন জবাব না দিয়ে তিনি নির্দেশ দিলেন তার অস্ত্রধারী অনুচরদের। তার ইশারায় অস্ত্রধারীরা সবাই তখন আমাকে টানা-হেচড়া করে মাইক্রোবাসের দিকে নিয়ে যাবার চেষ্টা করছে। বিয়ের উপলক্ষ্যে নিরাপত্তার জন্য পুলিশের বন্দোবস্ত করা হয়েছে; গাড়িতে আমার এস্কট সিপাইরাও রয়েছে। ঠিক বুঝতে পারছিলাম না কি করা উচিত। একটা বিয়ের অনুষ্ঠান। কন্যা দান তখনও করা হয়নি। কি কারণে যে এমন অদ্ভুত একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি হল সেটাই বুঝতে পারছিলাম না। হঠাৎ দেখলাম বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা আলম এবং চুল্লুকে মারতে মারতে একটা মাইক্রোবাসে উঠালো ৩-৪ জন অস্ত্রধারী। ইতিমধ্যে বাইরে হৈ চৈ শুনে নিম্মী এবং খালাম্মা মানে তাহমিনার আম্মা বেরিয়ে এসেছেন অন্দরমহল থেকে। খালাম্মা ছুটে এসে গাজীকে বললেন,
– ভাই সাহেব একি করছেন আপনি? ওকে কেন অপদস্ত করছেন? কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন ওকে? কি দোষ করেছে ও?
গাজী তার কোন কথারই জবাব দিলেন না। তার হুকুমের তামিল হল। আমাকে জোর করে ঠেলে উঠান হল মাইক্রোবাসে। বাসে উঠে দেখি আলম ও চুল্লু দু’জনেই গুরুতরভাবে আহত। ওদের মাথা এবং মুখ থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছিল। আমাকে গাড়িতে তুলতেই খালাম্মা এবং নিম্মী দু’জনেই গাজীকে বলল,
– ওদের সাথে আমাদেরকেও নিতে হবে আপনাকে। ওদের একা নিয়ে যেতে দেব না আমরা৷ -ঠিক আছে; তবে তাই হবে। বললেন গাজী।
গাজীর ইশারায় ওদেরকেও ধাক্কা দিয়ে উঠান হল মাইক্রোবাসে। বেচারী খালাম্মা! বয়স্কা মহিলা, আচমকা ধাক্কায় হুমড়ি খেয়ে পড়লেন মাইক্রোবাসের ভিতরে। আমার দিকে অস্ত্র তাক করে দাড়িয়ে থাকলো পাঁচজন অস্ত্রধারী; গাজীর সন্ত্রাস বাহিনীর মাস্তান। গাজী গিয়ে উঠল তার কারে। বাকি মাস্তানদের নিয়ে দ্বিতীয় মাইক্রোবাসটা কোথায় যেন চলে গেল। মাইক্রোবাস দুইটি ছিল সাদা রং এর এবং তাদের গায়ে ছিল রেডক্রসের চিহ্ন আঁকা। গাজীর গাড়ি চললো আগে আগে আর আমাদের বহনকারী মাইক্রোবাসটি চললো তার পেছনে। এসমস্ত ঘটনা যখন ঘটছিল তখন আমার ছোট ভাই মুক্তিযোদ্ধা কামরুল হক স্বপন বীর বিক্রম ও বাপ্পি লেডিস ক্লাবে উপস্থিত ছিল না। তারা গিয়েছিল কোন এক অতিথিকে ড্রপ করতে। আমাদের কাফেলা লেডিস কালব থেকে বেরিয়ে যাবার পর ওরা ফিরে এসে সমস্ত ঘটনা জানতে পারে লিটুর মুখে। সবকিছু জানার পরমুহুর্তেই ওরা যোগাযোগ করল রেসকোর্সে আর্মি কন্ট্রোল রুমে তারপর ক্যান্টনমেন্টের এমপি ইউনিটে। ঢাকা ব্রিগেড মেসেও খবরটা পৌঁছে দিল স্বপন। তারপর সে বেরিয়ে গেল ঢাকা শহরের মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যোগাযোগ করে আমাদের খুঁজে বের করার জন্য। আবুল খায়ের লিটু আমার ছোট বোন মহুয়ার স্বামী এবং আমার বন্ধু। ও ছুটে গেল এসপি মাহবুবের বাসায় বেইলী রোডে। উদ্দেশ্য মাহবুবের সাহায্যে গাজীকে খুঁজে বের করা।
এদিকে আমাদের কাফেলা গিয়ে থামল রমনা থানায়। গাজী তার গাড়ি থেকে নেমে চলে গেল থানার ভিতরে। অল্প কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে নিজের গাড়িতে উঠে বসলেন গাজী। কাফেলা আবার চলতে শুরু করল। কাফেলা এবার চলছে সেকেন্ড ক্যাপিটালের দিকে। ইতিমধ্যে নিম্মী তার শাড়ী ছিড়ে চুল্লু ও আলমের রক্তক্ষরণ বন্ধ করার জন্য ব্যান্ডেজ বেধে দিয়েছে। সেকেন্ড ক্যাপিটালের দিকে আমাদের নিয়ে যাচ্ছে দেখে আমি চিন্তিত হয়ে পড়লাম। গাজীর মনে কোন দুরভিসন্ধি নেইতো? রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে হত্যা করবে নাতো? ওর পক্ষে সবকিছুই করা সম্ভব। কিছু একটা করা উচিত। হঠাৎ আমি বলে উঠলাম,
– গাড়ি থামাও !
আমার বলার ধরণে ড্রাইভার গাড়ি থামিয়ে দিল। আমাদের গাড়িটা থেমে পড়ায় সামনের গাজীর গাড়িটাও থেমে পড়ল। আমি তখন অস্ত্রধারী একজনকে লক্ষ্য করে বললাম গাজী সাহেবকে ডেকে আনতে। সে আমার কথার পর গাড়ি থেকে নেমে গিয়ে গাজীকে গিয়ে কিছু বলল। দেখলাম গাজী নেমে আসছে। কাছে এলে আমি তাকে বললাম,
– গাজী সাহেব আপনি আমাদের নিয়ে যাই চিন্তা করে থাকেন না কেন; লেডিস ক্লাব থেকে আমাদের উঠিয়ে আনতে কিন্তু সবাই আপনাকে দেখেছে। তাই কোন কিছু করে সেটাকে বেমালুম হজম করে যাওয়া আপনার পক্ষে কিছুতেই সম্ভব হবে না৷
আমার কথা শুনে কি যেন ভেবে নিয়ে তিনি আবার তার গাড়িতে গিয়ে উঠলেন। কাফেলা আবার চলা শুরু করল। তবে এবার রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্পের দিকে নয়, গাড়ি ঘুরিয়ে তিনি চললেন ৩২নং ধানমন্ডি প্রধানমন্ত্রীর বাসার দিকে। আমরা হাফ ছেড়ে বাচলাম। কলাবাগান দিয়ে ৩২নং রোডে ঢুকে আমাদের মাইক্রোবাসটা শেখ সাহেবের বাসার গেট থেকে একটু দূরে এলকটা গাছের ছায়ায় থামতে ইশারা করে জনাব গাজী তার গাড়ি নিয়ে সোজা গেট দিয়ে ঢুকে গেলেন ৩২নং এর ভিতরে। সেকেন্ড ফিল্ড রেজিমেন্ট তখন শেখ সাহেবের বাড়ি পাহারা দিচ্ছে। একবার ভাবলাম ওদের ডাকি, আবার ভাবলাম এর ফলে যদি গোলাগুলি শুরু হয়ে যায় তবে ক্রস- ফায়ারে বিপদের ঝুঁকি বেশি। এ সমস্তই চিন্তা করছিলাম হঠাৎ দেখি লিটুর ঢাকা ক-৩১৫ সাদা টয়োটা কারটা পাশ দিয়ে হুস্ করে এগিয়ে গিয়ে শেখ সাহেবের বাসার গেটে গিয়ে থামল। লিটুই চালাচ্ছিল গাড়ি। গাড়ি থেকে নামল এসপি মাহবুব। নেমেই প্রায় দৌড়ে ভিতরে চলে গেল সে৷ লিটু একটু এগিয়ে গিয়ে রাস্তার পাশে গাড়ি থামিয়ে অপেক্ষায় রইলো সম্ভবত মাঙ্গুবের ফিরে আসার প্রতীক্ষায়। লিটু এবং মাহ্রুবকে দেখে আমরা সবাই আস্বস্ত হলাম। নির্ঘাত বিপদের হাত থেকে পরম করুণাময় আল্লাহ্ তায়ালা আমাদের বাচিঁয়ে দিলেন।
লিটু যখন মাহ্বুবের বাসায় গিয়ে পৌঁছে মাহবুব তখন মানিকগঞ্জ থেকে সবেমাত্র ফিরে বিয়েতে আসার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল। হঠাৎ লিটুকে হন্তদন্ত হয়ে উপরে আসতে দেখে তার দিকে চাইতেই লিটু বলে উঠল,
– মাহবুব ভাই সর্বনাশ হয়ে গেছে। বিয়ে বাড়ি থেকে গাজী বিনা কারণে ডালিম-নিম্মীকে জবরদস্তি গান পয়েন্টে উঠিয়ে নিয়ে গেছে।
একথা শুনে মাহবুব স্তম্ভিত হয়ে যায়। প্রধানমন্ত্রীকেই খবরটা সবচেয়ে আগে দেওয়া দরকার কোন অঘটন ঘটে যাবার আগে। গাজীর কোন বিশ্বাস নাই; ওর দ্বারা সবকিছুই সম্ভব। মাহবুব টেলিফোনের দিকে এগিয়ে যায়। হঠাৎ টেলিফোনটাই বেজে উঠে। রেড টেলিফোন। মাহবুব এস্তে উঠিয়ে নেয় রিসিভার। প্রধানমন্ত্রী অপর প্রান্তে,
– মাহবুব তুই জলদি চলে আয় আমার বাসায়। গাজী এক মেজর আর তার সাঙ্গ-পাঙ্গদের ধইরা আনছে এক বিয়ার অনুষ্ঠান থ্যাইকা৷ ঐ মেজর গাজীর বউ-এর সাথে ইয়ার্কি মারার চেষ্টা করছিল। উপযুক্ত শিক্ষা দিতে হবে। বেশি বাড় বাড়ছে সেনাবাহিনীর অফিসারগুলির।
সব শুনে মাহবুব জানতে চাইলো,
– স্যার গাজী সাহেবকে জিজ্ঞেস করুন মেজর ও তার সাঙ্গ-পাঙ্গদের কোথায় রেখেছেন তিনি? —ওদের সাথে কইরা লইয়া আইছে গাজী। গেইটের বাইরেই গাড়িতে রাখা হইছে বদমাইশগুলারে। জানালেন প্রধানমন্ত্রী।
– স্যার গাজী সাহেব ডালিম আর নিম্মীকেই তুলে এনেছে লেডিস ক্লাব থেকে। ওখানে ডালিমের খালাতো বোনের বিয়ে হচ্ছিল আজ। জজানাল মাহবুব।
– কছ কি তুই ! প্রধানমন্ত্রী অবাক হলেন।
– আমি সত্যিই বলছি স্যার। আপনি ওদের খবর নেন আমি এক্ষুণি আসছি।
এই কথোপকথনের পরই মাহবুব লিটুকে সঙ্গে করে চলে আসে ৩২নং ধানমন্ডিতে। মাহ্বুবের ভিতরে যাওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যেই রেহানা, কামাল ছুটে বাইরে এসে আমাদের ভিতরে নিয়ে যায়। আলম ও চুল্লুর রক্তক্ষরণ দেখে শেখ সাহেব ও অন্যান্য সবাই শংকিত হয়ে উঠেন।
– হারামজাদা, এইডা কি করছস তুই?
গাজীকে উদ্দেশ্য করে গর্জে উঠলেন শেখ মুজিব। চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে নিম্মী এবং আমাকে জড়িয়ে ধরলেন তিনি। খালাম্মা ঠিকমত হাটতে পারছিলেন না। কামাল, রেহানা ওরা সবাই ধরাধরি করে ওদের উপরে নিয়ে গেল। শেখ সাহেবের কামরায় তখন আমি, নিম্মী আর গাজী ছাড়া অন্য কেউ ছিল না। নিম্মী দুঃখে-গ্ল্যানিতে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। শেখ সাহেব ওকে জড়িয়ে ধরে সান্তনা দিতে চেষ্টা করছিলেন। অদূরে গাজী ভেজা বেড়ালের মত কুকড়ে দাড়িয়ে কাঁপছিল। হঠাৎ ফোন বেজে উঠল। রেড ফোন। শেখ সাহেব নিজেই তুলে নিলেন রিসিভার। গাজীর বাসা থেকে ফোন এসেছে। বাসা থেকে খবর দিল আর্মি গাজীর বাসা রেইড করে সবাইকে ধরে নিয়ে গেছে। শুধু তাই নয় সমস্ত শহরে আর্মি চেকপোষ্ট বসিয়ে প্রতিটি গাড়ি চেক করছে। ক্যান্টনমেন্ট থেকে কিডন্যাপিং এর খবর পাওয়ার পরপরই ইয়ং-অফিসাররা যে যেখনেই ছিল সবাই বেরিয়ে পড়েছে এবং খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে মেজর ডালিম ও তার স্ত্রী নিম্মীকে। সমস্ত শহরে হৈচৈ পড়ে গেছে। গাজীরও কোন খবর নেই। গাজীকে এবং তার অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদেরও খুঁজছে আর্মি তন্নতন্ন করে সম্ভাব্য সব জায়গায়। টেলিফোন পাওয়ার পর শেখ সাহেবের মুখটা কালো হয়ে গেল। ফোন পেয়েই তিনি আমাদের সামনেই আর্মি চীফ শফিউল্লাহকে হটলাইনে বললেন, -ডালিম, নিম্মী, গাজী সবাই আমার এখানে আছে, তুমি জলদি চলে আসো আমার এখানে। ফোন রেখে শেখ সাহেব গাজীকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
– মাফ চা নিম্মীর কাছে।
গাজী শেখ সাহেবের হুকুমে নিম্মীর দিকে এক পা এগুতেই সিংহীর মত গর্জে উঠল নিম্মী, -খবরদার! তোর মত ইতর লোকের মাফ চাইবার কোন অধিকার নাই; বদমাইশ। এরপর শেখ মুজিবের দিকে ফিরে বলল নিম্মী,
– কাদের রক্তের বদলে আজ আপনি প্রধানমন্ত্রী? আমি জানতে চাই। আপনি নিজেকে জাতির পিতা বলে দাবি করেন। আমি আজ আপনার কাছে বিচার চাই। আজ আমার জায়গায় শেখ হাসিনা কিংবা রেহানার যদি এমন অসম্মান হত তবে যে বিচার আপনি করতেন আমি ঠিক সেই বিচারই চাই। যাদের রক্তের বিনিময়ে আজ আপনারা জাতির কর্ণধার হয়ে ক্ষমতা ভোগ করছেন সেইসব মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান ভুলুন্ঠিত করে তাদের গায়ে হাত দেয়ার মত সাহস কম্বলচোর গাজী পায় কি করে? এর উপযুক্ত জবাব আমি আজ চাই আপনার কাছ থেকে। আজ পর্যন্ত আপনি বলতে পারবেন না ব্যক্তিগতভাবে কোন কিছু চেয়েছি আপনার কাছে কিন্তু আজ দাবি করছি ন্যায্য বিচার। আপনি যদি এর বিচার না করেন তবে আমি আল্লাহর কাছে এই অন্যায়ের বিচার দিয়ে রাখলাম। তিনি নিশ্চয়ই এর বিচার করবেন।
আমি অনেক চেষ্টা করেও সেদিন নিম্মীকে শান্ত করতে পারিনি। ঠান্ডা মেজাজের কোমল প্রকৃতির নিম্মীর মধ্যেও যে এধরণের আগুন লুকিয়ে থাকতে পারে সেটা আমার কাছেও আশ্চর্য লেগেছিল সেদিন। শেখ সাহেব নিম্মীর কথা শুনে ওকে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে বলেছিলেন,
– মা তুই শান্ত ‘হ। হাসিনা-রেহানার মত তুইও আমার মেয়েই। আমি নিশ্চয়ই এর উপযুক্ত বিচার করব। অন্যায় ! ভীষণ অন্যায় করছে গাজী কিন্তু তুই মা শান্ত ‘হ। বলেই রেহানাকে ডেকে তিনি নিম্মীকে উপরে নিয়ে যেতে বললেন।
রেহানা এসে নিম্মীকে উপরে নিয়ে গেল। ইতিমধ্যে জেনারেল শফিউল্লাহ এবং ঢাকা ব্রিগেড কমান্ডার সাফায়াত জামিল এসে পৌঁছেছে। শেখ সাহেব তাদের সবকিছু খুলে বলে জেনারেল শফিউল্লাকে অনুরোধ করলেন গাজীর পরিবারের সদস্যদের ছেড়ে দেবার বন্দোবস্ত করতে। জেনারেল শফিউল্লাহ রেসকোর্স কন্ট্রোল রুমে অপারেশন কমান্ডার মেজর মোমেনের সাথে কথা বলার জন্য টেলিফোন তুলে নিলেন,
– হ্যালো মোমেন, আমি শফিউল্লাহ বলছি প্রাইম মিনিষ্টারের বাসা থেকে। ডালিম, নিম্মী, গাজী ও রা সবাই এখানেই আছে। প্রাইম মিনিষ্টারও এখানেই উপস্থিত আছেন। Everything is going to be all right. Order your troops to stand down এবং গাজী সাহেবের পরিবারের সদস্যদের ছেড়ে দাও। অপরপ্রান্ত থেকে মেজর মোমেন জেনারেল শফিউল্লাকে পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিলেন কিডন্যাপ করে নিয়ে যাওয়া অফিসার এবং তার স্ত্রীকে না দেখা পর্যন্ত এবং গাজী ও তার ১৭জন অবৈধ অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের তার হাতে সমর্পন না করা পর্যন্ত তার পক্ষে গাজীর পরিবারের কাউকেই ছাড়া সম্ভব নয়। শফিউল্লাহ তাকে অনেক বোঝাতে চেষ্টা করলেন কিন্ত মেজর মোমেন তার অবস্থানে অটল থাকলেন শফিউল্লাহর সব যুক্তিকে অসাড় প্রমাণিত করে। অবশেষে শফিউল্লাহ ইচ্ছার বিরুদ্ধে অনেকটা বাধ্য হয়েই প্রধানমন্ত্রীকে অপারেশন কমান্ডার এর শর্তগুলো জানালেন। শেখ সাহেবের মুখ শুকিয়ে গেল। তিনি আমাকে অনুরোধ করলেন মেজর মোমেনের সাথে কথা বলতে। আমি অগত্যা টেলিফোন হাতে তুলে নিলাম,
– হ্যালো স্যার। মেজর ডালিম বলছি। Things are under control প্রধানমন্ত্রী কথা দিয়েছেন তিনি ন্যায় বিচার করবেন।
Well Dalim it’s nice to hear from you. But as the Operation Commander I must have my demands met. I got to be loyal to my duty as long as the army is deployed for anti-miscreant’s drive. The identified armed miscreants cannot be allowed to go escort free. As far as I am concerned the law is equal for everyone so there can’t be any exception. Chief has got to understand this. বললেন মেজর মোমেন।
Please Sir, why don’t you comeover and judge the situation yourself. অনুরোধ জানিয়েছিলাম আমি।
There is no need for me to come. However, I am sending Capt. Feroz. বলে ফোন ছেড়ে দিলেন মেজর মোমেন। অল্পক্ষণের মধ্যেই ক্যাপ্টেন ফিরোজ এসে পড়ল। ফিরোজ আমার বাল্যবন্ধু। এসেই আমাকে জড়িয়ে ধরল।
– তুই গাজীরে মাফ কইরা দে। আর গাজী তুই নিজে খোদ উপস্থিত থাকবি কন্যা সম্প্রদানের অনুষ্ঠান শেষ না হওয়া পর্যন্ত। অনেকটা মোড়লী কায়দায় একটা আপোষরফা করার চেষ্টা করলেন প্রধানমন্ত্রী।
– আমার বোনের সম্প্রদানের জন্য গাজীর বিয়ের অনুষ্ঠানে যাবার কোন প্রয়োজন নেই। ওকে মাফ করাও আমার পক্ষে সম্ভব নয়। সেটা হবে আমার জন্য নীতি বিরোধিতা। আমরা দেশ স্বাধীন করেছি রক্তের বিনিময়ে। আমাদের গা থেকে রক্ত ঝরাটা কোন বড় ব্যাপার নয়। ইউনিফর্মের চাকুরি করি টাকা-পয়সার লোভেও নয়। একজন সৈনিক হিসাবে আমার আত্মমর্যাদা এবং গৌরবকে অপমান করেছেন গাজী নেহায়েত অন্যায়ভাবে। আপনিই আমাদের দায়িত্ব দিয়েছেন জনগণের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য। অবৈধ অস্ত্রধারীদের খুঁজে বের করে আইনানুযায়ী তাদের শাস্তির ব্যবস্থা করতে। সেখানে আজ আমাদেরই ইজ্জত হারাতে হল অবৈধ অস্ত্রধারীদের হাতে! আপনি প্রধানমন্ত্রী হয়ে কথা দিয়েছেন এর উচিত বিচার করবেন। আমরা আপনি কি বিচার করেন সেই অপেক্ষায় থাকব৷
ক্যাপ্টেন ফিরোজকে উদ্দেশ্য করে সবার সামনেই বলেছিলাম, দেশের প্রধানমন্ত্রী যখন বিচারের ওয়াদা করেছেন সেক্ষেত্রে গাজীর পরিবারের সদস্যদের আর আটকে রাখার প্রয়োজন কি? কর্নেল মোমেনকে বুঝিয়ে তাদের ছেড়ে দেবার বন্দোবস্ত করিস।
সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে আসছিলাম ঠিক সেই সময় শেখ সাহেব বললেন,
– আমার গাড়ি তোদের পৌঁছে দেবে।
– তার প্রয়োজন হবে না চাচা। বাইরে লিটু-স্বপনরা রয়েছে তাদের সাথেই চলে যেতে পারব। বাইরে বেরিয়ে দেখি ৩২নং এর সামনের রাস্তায় গাড়ির ভীড়ে তিল ধারণের ঠাই নেই। পুলিশ অবস্থা সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে। বন্ধু-বান্ধবরা যারাই জানতে পেরেছে আমাদের কিডন্যাপিং এর ব্যাপারটা; তাদের অনেকেই এসে জমা হয়েছে স্বতঃস্ফুর্তভাবে। আমাদের দেখে সবাই ঘিরে ধরল। সবাই জানতে চায় কি প্রতিকার করবেন প্রধানমন্ত্রী এই জঘণ্য অপরাধের। সংক্ষেপে যতটুকু বলার ততটুকু বলে ফিরে এলাম লেডিস ক্লাবে। মাহবুবও এল সাথে। মাহবুবের উছিলায় সেদিন রক্ষা পেয়েছিলাম চরম এক বিপদের হাত থেকে আল্লাহ্পাকের অসীম করুণায়। বিয়ের আসরে আমরা ফিরে আসায় পরিবেশ আবার আনন্দ-উচ্ছাসে ভরে উঠল। সবাই আবার হাসি- ঠাট্টার মাধ্যমে বিয়ের বাকি আনুষ্ঠিকতা সম্পন্ন করে কন্যা সম্প্রদান করা হল। তাহমিনার বিয়ের রাতটা আওয়ামী দুঃশাসনের একটা ঐতিহাসিক সাক্ষী হয়ে থাকলো। জ্বলন্ত উদাহরণ হয়ে থাকলো আওয়ামী নেতাদের এবং তাদের ব্যক্তিগত বাহিনীর ন্যাক্কারজনক স্বেচ্ছাচার নিপীড়নের। কী করে এমন একটা জঘণ্য ঘটনার সাথে গাজী সরাসরি নিজেকে জড়িয়ে ফেলতে পেরেছিল তার কোন যুক্তিই খুঁজে পাচ্ছিলাম না। অনেক পরে বিভিন্ন সূত্র থেকে জানতে পেরেছিলাম আমাদের কুমিল্লা অপারেশনের পর পার্টির তরফ থেকে শেখ মুজিবের উপর প্রচন্ড চাপ সৃষ্টি করা হয়েছিল আমাদের বিশেষ করে আমার ঔদ্ধত্বের উপযুক্ত শিক্ষা দেবার জন্য। কিন্তু শেখ মুজিব ঐ চাপের পরিপ্রেক্ষিতে বলেছিলেন, “আর্মি কোন কাঁচা কাজ করে নাই। তারা আইন অনুযায়ী সবকিছু করছে, প্রত্যেককে ধরেছে হাতেনাতে প্রমাণসহ সে ক্ষেত্রে আমি কি করতে পারি?” তার ঐ কথায় সন্তুষ্ট হতে পারেনি ক্ষমতার দম্ভে অন্ধ আওয়ামী নেতাদের একাংশ। আইনের মাধ্যমে যদি কোন কিছু করা না যায় তবে অন্য কোনভাবে হলেও শিক্ষা তাদের দিতেই হবে এবং সেই দায়িত্বটাই গ্রহণ করেছিলেন সেই সময়ের Top terror and most powerful leader বলে পরিচিত গাজী গোলাম মোস্তফা। তখন থেকেই নাকি সুযোগ খুঁজছিলেন তিনি জিঘাংসা মিটাতে। বিয়ে বাড়িতে বাপ্পি এবং তার ছেলেদের মাঝে যে সামান্য ঘটনা ঘটে সেটাকেই সুযোগ হিসাবে গ্রহণ করে গাজী চেয়েছিল আমাকে উচিত শিক্ষা দিতে। এ বিষয়ে মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি তার বই ‘বাংলাদেশ! সামরিক শাসন এবং গণতন্ত্রের সংকট’ এ লিখেছেন, “গাজী সমর্থক লোকদের সম্ভবতঃ মেজর ডালিম ও তার স্ত্রীকে হত্যা করার পরিকল্পনা ছিল।’
অপহরণের ঘটনা সেনাবাহিনীতে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে
সেই কালোরাত্রির পরদিন আমাকে সেনা সদরে তলব করে পাঠানো হয়।
আর্মি হেডকোয়াটার্সে উপস্থিত হয়েই জানতে পারলাম চীফ আমাকে ডেকেছেন। কিন্তু তার আগেই ডাক পড়ল জেনারেল জিয়ার অফিসে। মেজর হাফিজ তখন PS-Cord to DCAS. সেই আমাকে খবর দিল জেনারেল জিয়া আমার সাথে কথা বলতে চান। তিনি আমার অপেক্ষায় আছেন। অনুমতি নিয়ে গিয়ে ঢুকলাম তার অফিসে। গতরাতে কি ঘটেছে তিনি জানতে চাইলেন। সবকিছুই বিস্তারিত খুলে বললাম তাকে। সব শুনে তিনি বেশ উত্তেজিতভাবেই বললেন,
– This is incredible and ridiculous. This is simply not acceptable. ঠিক আছে দেখ চীফ কি বলে।
তার অফিস থেকে বেরিয়ে আসতেই হাফিজ তার ঘরে নিয়ে গেল। নূরও ছিল সেখানে৷ হাফিজ বলল, “দ্যাখো ডালিম; গতরাতের বিষয়টা শুধুমাত্র তোমার আর ভাবীর ব্যাপারই নয়; সমস্ত আর্মির Dignity, pride and honour are at stake মানে আমরা সবাই এর সাথে জড়িত। You got to understand this clearly ok? অন্যান্য সব ব্রিগেডের সাথে আলাপ হয়েছে তারাও এ ব্যাপারে সবাই একমত। This has got to be sorted out right and proper. শেখ মুজিব কি বিচার করবে? আমরা শফিউল্লাহর মাধ্যমে দাবি জানাবো আর্মির তরফ থেকে। প্রধানমন্ত্রীকে সে দাবি অবশ্যই মানতে হবে। দাবিগুলোও আমরা ঠিক করে ফেলেছি। তুমি শফিউল্লাহ কি বলে সেটা শুনে আস তারপর যা করবার সেটা আমরা করব।”
আর্মি হেডকোয়াটার্স এ সমস্ত তরুণ অফিসারদের মধ্যে চরম উত্তেজনা বিরাজ করছিল। হাফিজের অফিস থেকেই চীফের ADC -কে ইন্টারকমে জানালাম,
– I am through with DCAS so I am free now to see the Chief.
Right Sir. বলে রিসিভার নামিয়ে রাখলো ADC. কিছুক্ষণ পরই ADC হাফিজের কামরায় এসে জানাল চীফ আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। চীফের অফিসে ঢুকতেই তিনি আমাকে বসতে বললেন। চেয়ার টেনে বসলাম মুখোমুখি।
– How are you?
– Fine Sir.
– How is Nimmi?
– She is ok Sir, but terribly upset.
– Quite natural. But she is a brave girl I must say. The way she talked to the Prime minister was really commendable. এ সমস্ত কথার পর আসল বিষয়ের অবতারনা করলেন জেনারেল শফিউল্লাহ,
– দেখ ডালিম, গতরাতের ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী নিজেই দুঃখ এবং অনুতাপ প্রকাশ করেছেন । I am also very sorry about the whole affair. শেখ সাহেবতো তোমাদেরও আপনজন। অত্যন্ত স্নেহ করেন তোমাদের দু’জনকেই। তিনি যখন চাইছেন তুমি গাজীকে মাফ করে দাও, তার সে ইচ্ছা তুমি পূরণ করবে সেটাইতো তিনি আশা করছেন। তুমি যদি গাজীকে মাফ কর তবে তিনি খুশী হবেন তাই নয় কি?
– স্যার, তিনি আমাদের বিশেষ শ্রদ্ধার পাত্র। পারিবারিকভাবে আমাদের ঘনিষ্ঠতাও আছে; সেটাও সত্য। তিনি ও তার পরিবার আমাদের ভালোবাসেন। কিন্তু নীতির ব্যাপারে আপোষ আমি করতে পারব না সেটা আপনার সামনেই তাকে আমি বলে এসেছি। And I shall stick to that till the end.
– Well that’s up to you then. I have nothing more to tell you.
– Thank you Sir. বলে বেরিয়ে এসে দেখি চীফের অফিসের সামনে AHQ -র প্রায় সব অফিসার একত্রিত হয়ে দাড়িয়ে আছে। তারা আমার কাছ থেকে জানতে চাইলো চীফ কি বললেন। আমি আমাদের কথোপকথনের সবটাই তাদের হুবহু খুলে বললাম। ক্ষুব্ধ হয়ে উঠল সবাই। একজন
ADC কে বলল, “Go and call him out here, we want to talk to him. “
ADC-র মাধ্যমে অফিসারদের অভিপ্রায় জানতে পেরে বেরিয়ে এলেন জেনারেল শফিউল্লাহ। সবাই তাকে ঘিরে দাড়াল। চীফ বললেন,
– বলো তোমাদের কি বলার আছে ?
– স্যার, গতরাতের ঘটনা শুধুমাত্র মেজর ডালিম এবং তার স্ত্রীর ব্যক্তিগত ব্যাপার নয়। আমরা আজ যেখানে দুস্কৃতিকারী দমনের জন্য সারাদেশে ডেপ্লয়েড সেই পরিস্থিতিতে বিনা কারণে গাজী ও তার সন্ত্রাসীরা অস্ত্রের মুখে আমাদেরই একজন অফিসার এবং তার স্ত্রীকে কিডন্যাপ করে নিয়ে গিয়ে হত্যা করার চেষ্টা করেছে। এটা সম্পূর্ণ বেআইনীই নয়; It has compromised the honour and the dignity of the whole armed forces particularly army. We can’t take it lying. It has got to be sorted out right and proper. কথাগুলো বলল একজন। জেনারেল শফিউল্লাহ জবাবে বলার চেষ্টা করলেন,
– Well, the Prime minister is personaly very sorry about the whole affair.
– That’s not enough ! শফিউল্লাহকে থামিয়ে দিল একজন।
Now Sir, you being our Chief and the leader have to shoulder your responsibility to uphold the honour and the dignity of this army. সমগ্র সেনাবাহিনীর তরফ থেকে আমাদের ৩টি দাবি আপনাকে জানাচ্ছি।
১। গাজীকে তার সংসদপদ এবং অন্যান্য সমস্ত সরকারি পদ থেকে এই মুহুর্তে অব্যাহতি দিয়ে তাকে এবং তার অবৈধ অস্ত্রধারীদের অবিলম্বে আর্মির হাতে সোপর্দ করতে হবে প্রধানমন্ত্রীকে; যাতে করে আইনানুযায়ী তাদের সাজা হয়।
২। গতরাতের সমস্ত ঘটনা সব প্রচার মাধ্যমগুলোর মাধ্যমে দেশের জনগণকে অবগত করার অনুমতি দিতে হবে প্রধানমন্ত্রীকে।
৩। যেহেতু গাজী আওয়ামী লীগের সদস্য সেই পরিপ্রেক্ষিতে পার্টি প্রধান হিসাবে প্রধানমন্ত্রীকে ব্যক্তিগতভাবে মেজর ডালিম এবং তার স্ত্রীর কাছে ক্ষমা চাইতে হবে।
আপনাকে আমাদের এই ৩টি দাবি নিয়ে যেতে হবে প্রধানমন্ত্রীর কাছে এবং আগামী ২৪ ঘন্টার মধ্যে প্রধানমন্ত্রীকে এ দাবিগুলো মেনে নিতে হবে। এই দাবিগুলি আপনি যদি আদায় করতে অপারগ হন তবেYou have got no right to sit on your chair. You will be considered not fit enough to lead this army.
ঘাবড়ে গিয়ে ঢোক গিলতে লাগলেন জেনারেল শফিউল্লাহ। থতমত খেয়ে বেসামাল অবস্থায় কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন তিনি কিন্তু তার আগেই লেফটেন্যান্ট সামশের মুবিন চৌধুরী বীর বিক্রম তার কোমরের বেল্ট খুলে ছুঁড়ে ফেলে দিল জেনারেল শফিউল্লার পায়ের কাছে,
– We serve the army for our pride, honour and dignity. If that is not there then I hate to serve that army any longer.
উত্তেজিতভাবে উপস্থিত সবাই একই সাথে বলে উঠল,
– Sir, you got to restore our lost honour and dignity. We have had enough humiliation but no more. Sir, please don’t be afraid. We all are with you. Just try to understand the gravity of the problem and be one of us.
বাইরের শোরগোল শুনে জেনারেল জিয়া কখন বেরিয়ে এসেছিলেন আমরা খেয়ালই করিনি। হঠাৎ তিনি তার গুরুগম্ভীর গলায় বলে উঠলেন,
– Boys be quite and listen to me, I have heared everything and I appreciate your sentiment. I have also understood the problem. Your demands are just and fair. Shafiullah you must go with their demands to the Prime minister and make him understand the gravity of the situation and suggest him to accept the demands for the greater interest of the nation and the armed forces. জেনারেল শফিউল্লাহ যেন ধরে প্রাণ ফিরে পেলেন। বললেন,
– আমি এখনই যাচ্ছি প্রধানমন্ত্রীর কাছে। তক্ষুণি তিনি বেরিয়ে গেলেন গণভবনের উদ্দেশ্যে। তখন দুপুর পেরিয়ে গেছে। শফিউল্লাহ চলে যাবার পর আমরাও মেসে চলে এলাম লাঞ্চের জন্য। এখানে একটা বিষয় প্রাণিধানযোগ্য। শফিউল্লাহকে যখন ঘেরাও করা হয়েছিল তখন সেখানে কর্নেল এরশাদও উপস্থিত ছিলেন অন্যান্য PSO -দের সাথে। তিনি তখন AC ( Adjutant General ) হিসাবে হেডকোয়াটার্স-এ পোষ্টেড ছিলেন। এক সময় জেনারেল শফিউল্লাহ তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন,
– এরশাদ তোমার অভিমত কি ?
– Sir, I think their demands are quite legitimate. এ ধরণের ঘটনা আপনার কিংবা আমার সাথেও ঘটতে পারত। যেখানে Army is deployed to maintain law and order and engaged in anti-miscreant drive সেখানে এ ধরণের একটা ঘটনাকে শুধুমাত্র ডালিম- নিম্মীর ব্যক্তিগত ব্যাপার বলে কানসিডার করা উচিত হবে না। It is definitely a question of honour and prestige of the entire army and you being the Chief must make this point clear to the Prime minister and advise the PM correctly to restore the lost honour by accepting the demands.
তার জবাব শুনে আমরা বেশ কিছুটা আশ্চর্যই হয়েছিলাম। কারণ, তিনি ছিলেন একজন Repatriated officer তিনি সাহস করে ঐ ধরণের স্পষ্ট বক্তব্য রাখবেন সেটা আমাদের কাছে ছিল অপ্রত্যাশিত। এতেই প্রমাণিত হয় পাকিস্তান প্রত্যাগতদের মাঝে অনেকেই ছিলেন ন্যায়পরায়ণ। সন্ধ্যার দিকে চীফ ফিরলেন গণভবন থেকে; সারাদিন দরবার করে। রাত ৮টার দিকে তিনি আমাদের কয়েকজনকে ডেকে পাঠালেন সেনা ভবনে। সেখানে গিয়ে দেখি কর্নেল সাফায়াত এবং ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফও উপস্থিত রয়েছেন। আমরা কুশলাদী বিনিময় করে সবাই বসলাম। চীফ শুরু করলেন,
– আমি প্রধানমন্ত্রীকে তোমাদের দাবিগুলো জানিয়েছি। তিনি সময় চেয়েছেন। প্রাইম মিনিষ্টার যখন সময় চেয়েছেন তখন তাকে সময় আমাদের দিতে হবেই। চীফের কথার মাঝে ফোঁড়ন কাটছিলেন কর্নেল সাফায়াত। ব্রিগেডিয়ার খালেদ নিশ্চুপ বসেছিলেন।
– স্যার ‘তোমাদের দাবিগুলো’ বলে আপনিকি এটাই বোঝাতে চাচ্ছেন যে আপনার ও আমাদের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে? দাবিগুলো ছিল entire army-র তরফ থেকে। তবে কি আমাদের বুঝতে হবে আপনি বা আপনারা মানে the senior lots are not with us? জানতে চাওয়া হল জেনারেল শফিউল্লাহর কাছ থেকে। তিনি এ ধরণের কথায় একটু ঘাবড়ে গেলেন। চালাক প্রকৃতির ব্রিগেডিয়ার খালেদ অবস্থা আঁচ করতে পেরে শফিউল্লাহর হয়ে জবাব দিলেন,
– Boys don’t have wrong impression. Offcourse we all are together. How could we be different on this issue?
– কিন্তু স্যার মনে হয় প্রধানমন্ত্রী আমাদের দাবি মানবেন না। সময় চেয়ে নিয়ে তিনি প্রথমত: ব্যাপারটাকে এড়িয়ে যেতে চাচ্ছেন। দ্বিতীয়ত: তার অবস্থানকে পোক্ত করার জন্যই সময় চেয়েছেন তিনি। যদি শেষ পর্যন্ত তিনি আমাদের দাবি মানতে রাজি না হন তবে কি করা হবে সে সম্পর্কে পরিষ্কারভাবে জানতে চাই আমরা।
তিনজনই এ কথার কোন জবাব না দিয়ে চুপ করে বসে থাকলেন।
– Well Sir, if you don’t have any idea what to do next then we shall think what needs to be done. বলে চলে এসেছিলাম আমরা। আজিজ পল্লীর এক বাসায় বৈঠকে বসলাম আমরা। বিষয়বস্তু: দাবি মানা না হলে আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপ কি হবে। অন্যান্য ব্রিগেডের সাথে যোগাযোগ করে মতামত বিনিময় করা হচ্ছিল সবসময়। রাত প্রায় ১১টার দিকে খবর পেলাম জেনারেল শফিউল্লাহর সাদা ডাটসন কারে দু’জন লোক সিভিল ড্রেসে চাদর মুড়ি অবস্থায় ২নং গেইট দিয়ে বেরিয়ে ৩২নং ধানমন্ডির দিকে যাচ্ছে। একজন young officer -কে মোটর সাইকেল নিয়ে গাড়িকে ফলো করতে বলা হল। রাত প্রায় ১১:৩০ মিনিটে ঐ অফিসার ফিরে এসে জানাল গাড়িতে ছিলেন জেনারেল শফিউল্লাহ এবং কর্নেল সাফায়াত। তারা গিয়ে ঢুকেছিলেন শেখ সাহেবের বাসায়। রাত প্রায় ১২:৩০ মিনিটের দিকে খবর আসতে লাগল শহরে রক্ষীবাহিনীর মুভমেন্ট শুরু হয়ে গেছে। দুইএ দুইএ চার; মিলে গেল হিসাব। শফিউল্লাহ এবং সাফায়াত শেখ সাহেবের একান্ত বিশ্বাসভাজন বিধায় ৩২নম্বরে গিয়ে আমাদের সন্ধ্যার আলোচনার সবকিছুই জানিয়ে এসেছেন তারই পরিপ্রেক্ষিতে শহরে রক্ষীবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে; আর্মির তরফ থেকে যেকোন move এর মোকাবেলা করার জন্য। নিজেদের প্রতি তার অনুকম্পা আরো বাড়াবার জন্যই ব্যক্তি পূঁজার এক ঘৃণ্য উদাহরণ! রাত আড়াইটার দিকে বিভিন্ন বর্ডার এলাকা থেকে খবর আসতে লাগল মধ্যরাত্রির পর থেকে ভারতীয় বাহিনীর অস্বাভাবিকভাবে তৎপরতা শুরু হয়েছে। তার মানে নিজের নিরাপত্তার জন্য শেখ মুজিব শুধুমাত্র তার অনুগত রক্ষীবাহিনী এবং সেনাবাহিনীর তার তল্পিবাহক নেতৃত্বের উপর আস্থা রেখে স্বস্তি পাচ্ছেন না; তাই বন্ধু রাষ্ট্রের সাহায্যও চেয়ে বসেছেন মৈত্রী চুক্তির আওতায়। আমরা কয়েকজন শহর ঘুরে দেখলাম খবরগুলো সত্যি। দুঃখ হল, পেশাগত নিজ যোগ্যতায় নয় শেখ মুজিবের বদন্যতায় যারা একলাফে মেজর থেকে জেনারেল বনে গেছেন তারা নিজেদের চামড়া পর্যন্ত বিকিয়ে দিয়ে বসে আছেন শেখ সাহেব এবং তার দলের স্বার্থ রক্ষা করার জন্য। ব্যতিক্রম অবশ্য ছিল; জেনারেল জিয়াউর রহমান ছিলেন তেমনি একজন। কিন্তু কথায় আছে Exception is never an example. ধিক্কার এসে গিয়েছিল আমাদের মনে এসমস্ত মেরুদন্ডহীন মতলববাজ সিনিয়র অফিসারদের চারিত্রিক দুর্বলতা জানার পর। পরদিন শফিউল্লাহর ডাক পড়ল গণভবনে। ফিরে এসেই আমাকে ডেকে পাঠালেন তিনি। গত দু’দিনের তুলনায় আজ তাকে বেশি confident দেখাচ্ছিল,
– Well Dalim, the Prime minister has asked for time as you have been already told. Meanwhile, I am ordering a court of inquiry about the whole matter that has happened so far just for an official record. Once the court of inquiry is finished you will go back to Comilla
– Right Sir. বলে সেল্যুট করে বেরিয়ে এসেছিলাম তার অফিস কক্ষ থেকে। কি অদ্ভুত যুক্তি! দোষ করল গাজী গোলাম মোস্তফা আর court of inquiry হবে আমার! বর্তমান অবস্থায় চীফের হুকুম মেনে নিয়ে court of inquiry -র পরিণাম পর্যন্ত চুপচাপ থাকতে হবে সিদ্ধান্ত হল। court of inquiry শেষ করে কয়েকদিন পর কুমিল্লায় ফিরে এলাম।
রাষ্ট্রপতি আমাদের চাকুরী থেকে অবসর দিয়ে আমাদের প্রতি তার ন্যায় বিচার করলেন।
রাষ্ট্রপতি ৯নং আদেশ বলে ৮জন সামরিক অফিসারকে চাকুরীচ্যুত করা হয়। নূর ও আমিও ছিলাম তাদের মধ্যে ৷
মাসখানেক পর জুলাই মাসের শেষাধে এক সন্ধ্যায় আমার বাসায় একটা পাটি ছিল। নিমন্ত্রিত অতিথিরা প্রায় সবাই এসে গেছে। বাইরে ইলশেগুড়ির বৃষ্টি হচ্ছে। হুদা ভাবীও এসে গেছেন কিন্তু হুদা ভাইয়ের পাত্তা নেই। বেশ একটু দেরি করেই এলেন কর্নেল হুদা। ভীষণ শুকনো তার মুখ। অস্বাভাবিক গম্ভীর তিনি। এসে সবার সাথে কুশল বিনিময় করে এককোনায় গিয়ে বসলেন তিনি। বোঝা যাচ্ছিল, কারো সাথে কথাবার্তা বলার তেমন একটা ইচ্ছে নেই তার। সদা উচ্ছল হুদা ভাই এত নিরব কেন? ব্যাপারটা খুবই অস্বাভাবিক ঠেকলো। এক ফাঁকে কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, -কি হয়েছে হুদা ভাই? কোন অঘটন ঘটেনিতো?
– না কিছু না।
নিজেকে কিছুটা হালকা করে নেবার জন্য ড্রিংকসের গ্লাসটা হাতে তুলে নিলেন তিনি৷ নিম্মী অতিথিদের আপ্যায়নে ব্যস্ত। হঠাৎ হুদা ভাই নিম্মীকে ডেকে পাশে বসালেন। প্রশ্ন করলেন, -আচ্ছা নিম্মী ধর এমন একটা খবর তুমি পেলে যার ফলে তোমার এই সুন্দর সাজানো সংসারটা ওলট-পালট হয়ে গেল, তোমাদের এই সুখ কেউ কেড়ে নিল তখন কি করবে? নিম্মী অবাক বিস্ময়ে হুদা ভাইকে ভালো করে দেখে নিয়ে বলল,
– আজ আপনার কি হয়েছে হুদা ভাই? কী সব এলমেলো বলছেন কিছুই বুঝতে পারছি না৷ বলেন না কি হয়েছে? আমিও এরি মধ্যে তাদের সাথে যোগ দিয়েছি।
– ডালিম ঢাকা থেকে কোন খবর পেয়েছ? জিজ্ঞেস করলেন কর্নেল হুদা।
– নাতো। তেমন কিছু হলে নিশ্চয়ই পেতাম। প্লিজ হুদা ভাই রহস্য বাদ দিয়ে বলেন না কি হয়েছে? ব্যাপার কি?
– যা হবার নয় তাই হয়েছে। Presidential Order No – 9 ( PO-9) প্রয়োগ করে আর্মি থেকে ৮জন অফিসারকে চাকুরি থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। তুমি এবং নূরও রয়েছো এই ৮ জনের মাঝে। খবরটা অপ্রত্যাশিত; তাই হজম করতে কিছুটা সময় লাগল। নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়ে নিম্মীকে ডেকে বললাম,
– জান, take it easy. নিজেকে সামলে নাও। Don’t get upset and spoil the party. Let this be over then we shall think about it. Now be brave as you have allways been and act like a good host ok? মেয়ে মানুষ তার উপর ভীষণ স্পর্শকাতর এবং কোমল প্রকৃতি নিম্মীর। তবুও সেদিন অতিকষ্টে সব কিছুই সামলে নিয়েছিল সে। অতিথিদের কেউই কিছু বুঝতে পারেনি কি অঘটন ঘটে গেছে ইতিমধ্যে। খবরটা তখন পর্যন্ত কেউ জানত না। পার্টি শেষে একে একে অভ্যাগতদের সবাই বিদায় নিয়ে চলে গেল। থেকে গেলেন শুধু হুদা ভাই ও ভাবী। ভাবীকে খবরটা দেয়া হল। খবরটা জেনে ভাবী ভেঙ্গে পড়লেন। আমাদের অত্যন্ত স্নেহ করতেন তিনি। নিম্মীও আর নিজেকে সামলে রাখতে পারলো না; ক্ষোভে-কান্নায় জড়িয়ে ধরল ভাবীকে। আমি ও হুদা ভাই দু’জনে তাদের শান্ত করার চেষ্টা করছিলাম৷ হুদা ভাই বললেন,
– Come on now both of you hold yourselves, this is not the end of the world. Allah is there and He is great. Please stop crying and think what should be done. নীলু ভাবী কাঁদছেন আর হুদা ভাইকে বলে চলেছেন,
– Gudu you must do something about this injustice. You have to do whatever nessesary. This is simply outrageous you must not take this lying noway get this very clear.নিলু ভাবীর আন্তরিকতায় মন ভরে গেল।
– I got it Nilu I got it, please comedown. I promise you I shall go out of myway to redress this. Nimmi you too please stop crying, don’t you have faith on your Huda Bhai? আমাকে বললেন,
– কাল তোমাকে নিয়ে আমি ঢাকায় যাব এবং প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করব। নিম্মী তুমিও যাবে আমাদের সাথে। ঠিক সেই মুহুর্তে ঢাকা থেকে ফোন এল। নূর বলল,
– Sir. we have been sacked under PO-9. We need your presence here as soon as possible. জবাব দিলাম,
– আমি এবং হুদা ভাই কালই আসছি। টেলিফোন রেখে দিলাম। পরদিন ব্রিগেডের সবাই খবরটা জেনে গেল। কর্নেল হুদা সকালেই CO’s conference call করলেন। সেখানে তিনি বললেন, -ডালিম এবং আমি ঢাকায় যাচ্ছি। I can assure you all that I personally shall do everything to redress this shocking injustice. এ ব্যাপারে তোমাদের চেয়ে আমার অসন্তোষও কম নয়।
ঢাকায় এলাম আমরা। আর্মি হেডকোয়াটার্স এ চরম উত্তেজনা। শফিউল্লাহ অফিসে নেই। তিনি নাকি অসুস্থ। জেনারেল জিয়া আমি এসেছি জানতে পেরে ডেকে পাঠালেন। গিয়ে ঢুকলাম তার অফিসে। তিনি সিট থেকে উঠে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। স্বল্পভাষী লোক। বললেন,
– Have faith in Allah. He does everything for the better. This is just the beginning and I am sure manymore heads will roll.
– দোয়া করবেন স্যার। ঠিকই বলেছেন সবকিছুই আল্লাহর ইচ্ছাতেই ঘটে। বললাম আমি।
– We must keep-in touch and you can count on me for everything just as before. For any personal need my doors are always open to you.
– Thank you very much Sir, You are most kind. But you must remain alert as you are our last hope. Future will say what is there in our common destiny.
MS branch থেকে PO-9 এর লিখিত অর্ডারটা নিয়ে বেরিয়ে এসেছিলাম আমি ও নূর সেনা সদর থেকে। Retirement order টা যখন হাতে নিচ্ছিলাম তখন মনে পড়েছিল শেখ সাহেব স্বস্নেহে নিম্মীকে বুকে জড়িয়ে ধরে কথা দিয়েছিলেন সুবিচার করবেন তিনি। সেই সুবিচারের ফলেই আজ আমি চাকুরিচ্যুত হলাম বিনা কারণে !
সেদিনই সন্ধ্যায় আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে কর্নেল হুদা গিয়ে হাজির হলেন ৩২নং ধানমন্ডিতে। অতি পরিচিত সবকিছুই। কিন্তু এবারের আসাটা কিছুটা ভিন্ন প্রকৃতির তাই পরিবেশটা কিছুটা অস্বস্তিকর। রেহানা, কামাল সবাই কেমন যেন বিব্রত! পরিবেশটাকে হালকা করার জন্য বললাম, -কি কামাল বিয়ের দাওয়াত পাবোতো? আমার প্রশ্নে লজ্জা পেয়ে কামাল উত্তর দিল,
-কি যে বলেন বস! আমি নিজে গিয়ে আপনাকে ও নিম্মীকে দাওয়াত করে আসব। আপনাদের ছাড়া বিয়েই হবে না৷ রেহানা চা-নাস্তা নিয়ে এল। হুদা ভাই চুপ করে বসে সবকিছু দেখছিলেন। বাসায় ফিরে এলেন শেখ সাহেব। ডাক পড়ল আমাদের তিন তলার অতিপরিচিত ঘরেই। একাই বসে ছিলেন শেখ সাহেব। ঘরে ঢুকে অভিবাদন জানাবার পর কর্নেল হুদা বললেন, -এতবড় অন্যায়কে মেনে নিয়ে চাকুরি করার ইচ্ছে আমারও নেই স্যার। বলেই পকেট থেকে একটা পদত্যাগপত্র বের করে সামনের টেবিলের উপর রেখে তিনি বললেন,
– আমার এই পদত্যাগপত্রের Official copy through proper channel শীঘ্রই আপনার কাছে পৌঁছাবে। তার এধরণের আকস্মিক উপস্থাপনায় কিছুটা বিব্রত হয়েই শেখ সাহেব বললেন, -তোমরা সবকিছুই একতরফাভাবে দেখ। আমার দিকটা একটুও চিন্তা কর না। একদিকে আমার পার্টি আর অন্যদিকে ওরা৷ আমি কি করুম? পার্টির কাছে আমি বানধা। পার্টি ছাড়াতো আমার চলব না। তারপর আমার দিকে ফিরে বললেন,
– তুই আর নূর কাইল আমার সাথে রাইতে বাসায় দেখা করবি।
শেখ সাহেবের সাথে কথা বলার সময় হুদা ভাইয়ের চোখে পানি এসে গিয়েছিল। পরদিন জেনারেল শফিউল্লাহর অফিসে আমার ডাক পড়ল। চীফ আমাকে নির্দেশ দিলেন কুমিল্লায় আমার আর ফিরে যাওয়া চলবে না। নিম্মীকে পাঠিয়ে জিনিষপত্র সব নিয়ে আসার বন্দোবস্ত করতে হবে। কর্নেল হুদা এই নির্দেশের জোর প্রতিবাদ করলেন। কিন্তু শফিউল্লাহ তার সিদ্ধান্ত বদলালেন না। কোন ঝুঁকি নিতে চাচ্ছেন না তিনি। কুমিল্লায় ফিরে আমি যদি আবার কোন অঘটন ঘটিয়ে বসি! এভাবেই মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে স্বাধীনতার পর যে আর্মি গঠন প্রক্রিয়ায় অক্লান্ত পরিশ্রম করেছিলাম রাতদিন; সেই আর্মি থেকে স্বাভাবিক নিয়মানুযায়ী বিদায় নেয়ার সৌভাগ্য থেকেও বঞ্চিত করা হয়েছিল আমাকে। একজন সৈনিকের জন্য এই অবমাননা সহ্য করা খুবই কষ্টকর। আমি ঢাকায় রয়ে গেলাম। হুদা ভাই নিম্মী ও খালাম্মাকে নিয়ে ফিরে গেলেন কুমিল্লায়।
আমাকে কুমিল্লায় ফিরতে না দেয়ায় অফিসার এবং সৈনিকরা অসন্তোষ ক্ষোভে ফেটে পড়ল। একদিন দুই ট্রাক সৈনিক কুমিল্লা থেকে আমাদের মালিবাগের বাসায় এসে হাজির। আমাকে ওরা নিয়ে যেতে এসেছে। সরকার অন্যায়ভাবে ক্ষমতাবলে আমাকে চাকুরিচ্যুত করেছে; তার উপর যে রেজিমেন্ট আমি শুরু থেকে তিলে তিলে গড়ে তুলেছি সেই ইউনিটের তরফ থেকে আমাকে বিদায় সম্বর্ধনাও জানাতে পারবে না ইউনিটের সদস্যরা; সেটা কিছুতেই হতে দেবে না তারা। সব বাধা উপেক্ষা করে তারা আমাকে নিয়েই যাবে। পরিণামে যা কিছুই ঘটুক না কেন; তার মোকাবেলা করা হবে একত্রিতভাবে; সে সিদ্ধান্তই নেয়া হয়েছে ইউনিটে। Emotionally charged অবস্থায় পরিণামের বিষয়টি উপেক্ষা করে যে পদক্ষেপ তারা নিতে প্রস্তুত হয়েছে তার ফল তাদের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর হতে পারে সেটা তারা ঠিক বুঝতে না পারলেও আমি বুঝতে পারছিলাম। তাই অনেক কষ্টে সবাইকে বুঝিয়ে ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। আমার যুক্তিগুলো মেনে নিয়ে অনেক ব্যাথা বুকে নিয়ে ফিরে গিয়েছিল তারা। ফিরে যাবার আগে আমার প্রিয় সহযোদ্ধারা বলেছিল, “স্যার আপনি যেখানেই থাকেন না কেন আমরা সবসময় আপনার সাথে আছি; একথাটা ভুলবেন না কখনো। প্রয়োজনে ডাক দিয়ে দেখবেন আমরা সব বাধা পেরিয়ে আপনার পাশে এসে দাড়াব।” একজন কমান্ডার হিসাবে অধিনস্ত সৈনিকদের কাছ থেকে এ ধরণের দুর্লভ সম্মান পাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। এর বেশি আর কি লাভ করা সম্ভব হত চাকুরিতে থাকলেও। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে পদভারে অনেক জেনারেল এবং কমান্ডার রয়েছেন ঠিকই কিন্তু তাদের কতজনের ভাগ্যে এধরণের শ্রদ্ধা এবং বিশ্বাস জুটেছে? আবেগ এবং আত্মতৃপ্তির অনাবিল আনন্দে সেদিন নিজেকে সামলে রাখতে পারিনি; খুশীর জোয়ার নেমে এসেছিল দু’চোখ বেয়ে। মনে হয়েছিল আমার সৈনিক জীবনের যবনিকাপাত অতি আকস্মিকভাবে ঘটানো হলেও স্বল্প পরিসরের এ জীবন আমার সার্থক হয়েছে। শুধু কুমিল্লা থেকেই নয়; দেশের বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্ট থেকেও অফিস – সৈনিকরা সুযোগ-সুবিধামত আসতে থাকলো সমবেদনা জানাবার জন্য। সবার একই আক্ষেপ,কেন এমন অবিচার; এতবড় অন্যায়??? জবাবে সবাইকে বলেছি, “স্বৈরাচারী সরকারের পক্ষে সবকিছুই সম্ভব। তারা ক্ষমতার দম্ভে ভুলে যায় ক্ষমতা চিরস্থায়ী নয়; প্রকৃতপক্ষে মানুষের নিজের হাতে কোন ক্ষমতাই নেই। আল্লাহতা’য়ালাই সব ক্ষমতার অধিকারী। তার ইচ্ছাতেই যেকোন ব্যক্তি বিশেষ ক্ষমতা লাভ করে থাকে কিন্তু তার দেয়া ক্ষমতার অপব্যবহার করলে তিনিই আবার শাস্তিস্বরূপ সে ক্ষমতা কেড়ে নেন। সব অত্যাচারীর ক্ষেত্রে তেমনটিই ঘটেছে। আল্লাহ যা করেন তা ভালোর জন্যই করেন; এ ঈমানের জোর আমার আছে। আমি তোমাদের দোয়া চাই আর কিছুই নয়।”
ছোট দেশ আমাদের। সেনাবাহিনী আরো ছোট। এ সংগঠনে সবাই সবার খবর রাখে। প্রত্যেকটি অফিসার কে কি চরিত্রের; কার কতটুকু যোগ্যতা এসমস্ত খবরা-খবর সৈনিকরা রাখে। পদাধিকারে প্রাপ্য মর্য্যাদা তারা সবাইকেই দিয়ে থাকে নিয়মাফিক। কিন্তু তাদের মন জয় করা শ্রদ্ধা ও আন্তরিকতা লাভ করতে পেরেছে শুধুমাত্র পরীক্ষিত সৌভাগ্যবানরাই। নীতিগতভাবে পদাধিকার বলে যে সম্মান লাভ করা যায় তার চেয়ে অর্জিত সম্মানই আমার কাছে বেশি মূল্যবান; তাই চাকুরি জীবনে অধিনস্থ সবাইকে সে ধরণের সম্মানই অর্জন করার জন্য অনুপ্রানিত করার চেষ্টা করেছি সবসময়। আমার সে প্রচেষ্টা সার্থক হয়েছে।
হালে আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা লন্ডন সফরকালে সেখানে রেডিওতে আমিনুল হক বাদশাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “আমার বাবা সেনাবাহিনী গড়েছিলেন বলেই মেজর’রা জেনারেল হতে পেরেছিলেন।” একটা গুরত্বপূর্ণ কথা বলেছেন তিনি। এটা অতি সত্য কথা যে, মেজর থেকে যাদের জেনারেল বানানো হয়েছিল তাদের অনেকেরই জেনারেল হবার যোগ্যতা ছিল না। কিন্তু তবুও তাদের জেনারেল বানানো হয়েছিল। এর কারণ ছিল শেখ মুজিব চেয়েছিলেন অযোগ্য নেতৃত্বের অধিনে সেনাবাহিনীকে দুর্বল করে রাখতে এবং ঐ সমস্ত অযোগ্য ‘খয়ের খাঁ টাইপের জেনারেলদের মাধ্যমে সেনাবাহিনীকে তার ঠেঙ্গারে বাহিনীতে পরিণত করতে। কিন্তু সেটা ছিল তার দিবাস্বপ্ন মাত্র। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর দেশপ্রেমিক অংশের উপর ঐ সমস্ত ‘জী হুজুর!’ জেনারেলরা কোন প্রভাবই বিস্তার করতে সক্ষম হয়নি।
নিম্মী ও খালাম্মা গিয়েছিলেন কুমিল্লায়; সংসার গুটিয়ে আনতে। বাসার সব জিনিষপত্র ট্রাকে করে বাই রোড পাঠাবার বন্দোবস্ত করে তারা বাই এয়ার ঢাকায় ফিরবেন। হঠাৎ করেই ব্রিগেড গোয়েন্দা ইউনিট খবর পেলো কুমিল্লা বিমান বন্দর থেকে আওয়ামী লীগের গুন্ডারা নিম্মীকে কিডন্যাপ করার প্ল্যান করেছে। খবরটা পেয়েই কর্নেল হুদা কঠোর নিরাপত্তার ব্যবস্থা করলেন। নিরাপত্তার সব দায়িত্ব দেয়া হল ফার্স্ট ফিল্ড রেজিমেন্টের মেজর বজলুল হুদা এবং ক্যাপ্টেন হাইকে। কর্নেল হুদা নিজে তার ফ্ল্যাগ কারে নিম্মী এবং খালাম্মাকে সঙ্গে করে এয়ারর্পোটে এসে তাদের প্লেনে তুলে দিয়েছিলেন। প্লেন টেক অফ না করা পর্যন্ত তিনি এয়ারপোর্টে উপস্থিত ছিলেন। এভাবেই আমার আর্মি ক্যারিয়ারের পরিসমাপ্তি ঘটেছিল।
ইউনির্ফম ত্যাগে বাধ্য হবার পর জীবিকা অর্জনে তেমন কোন অসুবিধা হয়নি
মেজর নূর এবং আমি আমার কনিষ্ঠ ভ্রাতা স্বপনের সাথে ব্যবসায় যোগদান করি।
আমার ছোট ভাই স্বপনের সাথেই ব্যবসা করব ঠিক করলাম। সে ব্যবসাতে অভিজ্ঞ। এমবিএ- তে ভালো রেজাল্ট করার পর থেকেই ব্যবসা করছে স্বপন। কর্নেল আকবর ও মেজর শাহরিয়ার ইতিমধ্যেই স্বেচ্ছায় চাকুরি ছেড়ে দিয়েছে আমরা চাকুরিচ্যুত হওয়ার পর। মেজর শাহরিয়ার ‘শ্যেরী এন্টারপ্রাইজ’ নামে কোম্পানী খুলে ব্যবসা শুরু করল। কর্নেল আকবর আমাদের সাথে যোগ দিবেন ঠিক করলেন। স্বপন, কর্নেল আকবর, মেজর নূর এবং আমার নামের প্রথম অক্ষর দিয়ে গঠন করা হল ‘SANS INTERNATIONAL’. চাকুরিচ্যুত হওয়ায় বাধ্যবাধকতার ঝামেলা অনেক কমে গেল। অবাধে সব জায়গায় ইচ্ছামত যোগাযোগের সুযোগ পেলাম আমরা। সরকার ও সরকারি দল আমাদের প্রতি বিরূপ থাকলেও অনেক হিতৈষী এবং সুজন ব্যবসায় আমাদের বিভিন্নভাবে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছিলেন। ক্ষেত্র বিশেষে ঝুঁকি নিয়েও অনেকে আমাদের সাহায্য করেছেন। তাদের সেই সাহায্য ও আন্তরিক সহযোগিতার ঋণ কখনোই শোধ করার নয়। পরিচয় নেই এমন অনেকেও সেই দুর্দিনে নাম শুনেই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন সহানুভূতির সাথে। ছোটখাটো ইম্পোর্ট এবং সাপ্লাই এর ব্যবসা আমাদের অল্প সময়ের মধ্যেই বেশ জমে উঠল। টাকা-পয়সার আমদানি হচ্ছিল ভালোই। আইআরডিপিতে সাপ্লাই কন্ট্রাকটার হিসাবে দেশের প্রায় সব থানাতেই কাজ করার সুযোগ হয়েছিল আমাদের। এতে করে সব মহলের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করার বিশেষ সুবিধা হয়েছিল আমাদের। শহর-বন্দরে, গ্রামে-গঞ্জে ঘুরে সর্বস্তরের লোকজনদের সাথে মিশে বিভিন্ন বিষয়ে তাদের মনোভাব বোঝার সুযোগ হয়েছিল আমাদের। বুঝতে পারছিলাম সরকারের অপশাসন আর অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে উঠেছে দেশের সাধারণ মানুষ। যেখানেই গেছি পরিচয় জেনে লোকজন সম্মান দেখিয়েছেন; শ্রদ্ধার সাথে নিঃস্বার্থভাবে যতটুকু সম্ভব সাহায্য করেছেন আমাদের কাজে। এভাবেই কাটছিল আমাদের সময়।
আমাদের অন্তিম বৈঠক
শেখ সাহেব নূর এবং আমাকে দেখা করতে বলেছিলেন কিন্তু বিভিন্ন ব্যস্ততায় সেটা সম্ভব হয়নি। আমাদেরকে মনে করিয়ে দেয়া হলো। আমরা গেলাম তার সাথে দেখা করতে।
গেলাম আমি ও নূর ৩২নম্বরেই দেখা করতে। সালাম দোয়া বিনিময়ের পর শেখ সাহেবই শুরু
করলেন,
– দেখ আমার কিছুই করার ছিল না। নেহায়েত অপারগ হয়েই তোদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে আমাকে। জানি আমার এই সিদ্ধান্তে মনঃক্ষুন্ন হইছস তোরা; হওয়াটাই স্বাভাবিক৷ আমি তোদের জন্য কিছু একটা করতে চাই। বিদেশে দূতাবাসে চাকরি করতে চাইলে সেই ব্যবস্থা কইরা দিতে পারি। ব্যবসা করতে চাইলে নাসেররে কইয়া সে ব্যবস্থাও কইরা দিতে পারি; ওর অনেক ধরণের ব্যবসা আছে। তার সাথেও তোরা যোগ দিতে পারছ।
– চাচা আমরা সৈনিক মানুষ। সেনাবাহিনীর চাকরি স্বেচ্ছায় নিয়েছিলাম টাকা-পয়সার লোভে নয়; সম্মান এবং দেশের সেবা করার জন্যই। সেটাই যখন আপনার বিচারে হারাতে হয়েছে তখন আপনার কাছে আমাদের আর অন্য কিছুই চাওয়ার নাই। এরপরও আপনি আমাদের জন্য যদি কিছু করতে চান সেটা আপনার মহানুভবতা। আপনি আমাদের জন্য দোয়া করবেন সেটাই যথেষ্ট। রিজিকের মালিক আল্লাহ। খেয়ে পড়ে বাচাঁর মত কিছু একটা করতে পারব আপনাদের দোয়ায় ইনশাল্লাহ। জানি না আর দেখা হওয়ার সুযোগ হবে কিনা? বেয়াদবী নেবেন না চাচা, একটা কথা আপনাকে বলে যাই। আপনার আশেপাশে যারাই সর্বক্ষণ আপনাকে ঘিরে রাখছে তাদের বেশিরভাগই মতলববাজ। দেশের অবস্থা এবং জনগণ সম্পর্কে তারা আপনাকে সঠিক কথা বলে না। যা শুনলে আপনি খুশী হবেন চাটুকাররা সেটাই বলে থাকে মতলব হাসিল করার জন্য। খোদা না করুক তেমন দুর্দিন যদি কখনো আসে তবে এদের কেউই আপনার সাথে থাকবে না; চলে যাবে নতুন আশ্রয়ের সন্ধানে। তখন সেই অবস্থার জন্য সব দায়দায়িত্ব আপনার উপরই আরোপ করা হবে এবং অবস্থার মোকাবেলাও করতে হবে আপনাকেই। আপনি সবসময় বলে থাকেন যে দেশের জনগণকে আপনি ভালো করে চেনেন; কিন্তু আজ আমি বলে যাচ্ছি জনগণ থেকে বর্তমানে আপনি সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন কিংবা আপনাকে করা হচ্ছে। আপনি আমাদের স্নেহ করেন। আমাদের চাকুরিচ্যুত করে আপনার কতটুকু লাভ হয়েছে সেটা আপনিই ভালো বোঝেন; তবে আমরা কিন্তু বরাবরই আন্তরিকভাবে আপনার ভালোই চেয়েছি। আল্লাহপাক আপনাকে অনেক দিয়েছেন। আপনারতো আর চাওয়া-পাওয়ার কিছুই থাকতে পারে না। ‘চাটার দল’ ছেড়ে দেশ ও জাতির নেতা হওয়ার চেষ্টা করা উচিত আপনার। তারই মধ্যে রয়েছে আপনার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের ত্যাগ ও পরিশ্রমের সার্থকতা।
শেখ সাহেব আমার কথাগুলো চুপচাপ শুনছিলেন আর পাইপে মৃদু টান দিচ্ছিলেন। তিনি কিছু বলছেন না দেখে আমি বললাম,
– আমরা তাহলে এবার আসি? তিনি অনুমতি দিলেন। আমরা বেরিয়ে এলাম ৩২ নম্বর থেকে। অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথেই কথাগুলি বলেছিলাম তাকে; ব্যক্তিগতভাবে শ্রদ্ধা করি বলেই। এর কতটুকু তিনি বুঝেছিলেন জানি না।
আর্মি এবং রক্ষীবাহিনীর প্রতি শেখ মুজিবের মনোভাব
জেনারেল শফিউল্লাহর ১৯৮৭ সালে ২৮শে আগষ্ট লন্ডনের বাংলা সাপ্তাহিক জনমত-কে দেয়া সাক্ষাৎকার যেটা পরে ৩রা সেপ্টেম্বর ১৯৮৭ সালে স্থানীয় দৈনিকগুলিতে প্রকাশিত হয়েছিল তাতে শেখ মুজিবের সেনাবাহিনী এবং রক্ষীবাহিনীর প্রতি তার মনোভাবের বিশদ প্রতিফলন ঘটে।
প্রশ্নঃ আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে সামরিক বাহিনীর সম্পর্ক নাকি ততটা ভালো ছিল না। কথাটা কি সত্য বলে আপনি মনে করেন?
উত্তরঃ আওয়ামী লীগ সরকারের ব্যক্তিগতভাবে আমার উপর আস্থা ছিল। কিন্তু পুরো সামরিক বাহিনীর উপর তাদের আস্থা ছিল কিনা তাতে সন্দেহ আছে।
প্রশ্নঃ স্বাধীনতার পর আপনাকে কেন চীফ অব স্টাফ নিযুক্ত করা হল?
উত্তরঃ এটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। ওসমানী সাহেবের কোন সিদ্ধান্ত নয়।
প্রশ্নঃ রক্ষীবাহিনী গঠন করার আগে আওয়ামী লীগ সরকার এ ব্যাপারে কি আপনার সঙ্গে কোন আলাপ-আলোচনা করেছিল?
উত্তরঃ না। তবে গঠন করার পর আমাকে বলা হয়েছিল রক্ষীবাহিনী গঠন করা হয়েছে পুলিশ বাহিনীর সহযোগী শক্তি হিসাবে। তবে লোকমুখে আমি শুনেছি যে, রক্ষীবাহিনী গঠন করা হচ্ছে আর্মড ফোর্সের জায়গা পূরণের জন্য।
প্রশ্নঃ সামরিক বাহিনীর সাথে রক্ষীবাহিনীর সম্পর্ক কেমন ছিল?
উত্তরঃ সম্পর্ক ভালো ছিল না। তার কতগুলো কারণ ছিল। তখন গুজব ছড়িয়েছিল যে, রক্ষীবাহিনীকে আর্মির জায়গায় বসানো হবে। নতুন বাহিনী হিসাবে রক্ষীবাহিনীকে তখন সবকিছুই নতুন জিনিষপত্র দিয়ে সাজানো হচ্ছিল। এদিকে আর্মি দেখছে তাদের সেই পুরাতন অবস্থা। এগুলো দেখে আর্মড ফোর্সের অনেকের মনে আঘাত লাগে। যার ফলে সম্পর্কটা খারাপ রূপ নেয়। তবে এ ব্যাপারে সরকার একটা ভুল করেছিলেন, তা হল রক্ষীবাহিনীকে ‘power of arrest and search’ দেওয়া। এতে সামরিক বাহিনীর অনেকেই ক্ষুব্ধ এবং চিন্তিত হন। শুধু তাই নয়; রক্ষীবাহিনী এই সময় সেনাবাহিনীর অনেক অফিসারকে লাঞ্ছনা পর্যন্ত করে। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছিল রক্ষীবাহিনীর ক্ষমতা সেনাবাহিনীর চেয়েও বেশি।
প্রশ্নঃ শেখ মুজিবর রহমান সামরিক বাহিনীর উন্নতির পক্ষে ছিলেন না, এ কথা কি সত্য?
উত্তরঃ হ্যাঁ। আমি বলবো একথা সত্য।
প্রশ্নঃ গাজী গোলাম মোস্তফার সাথে লেডিস ক্লাবে মেজর ডালিমের অপ্রীতিকর ঘটনার পর সেনাবাহিনীর চীফ অব স্টাফ হিসাবে কি কোন কিছু করার চেষ্টা করেছিলেন?
উত্তরঃ যখন গোলমালের খবর আমি জানতে পারি তখন ডালিমের পক্ষ হয়ে বঙ্গবন্ধুর কাছে যাই এর একটা বিচারের জন্য। বঙ্গবন্ধু আমার উপর রেগে গেলেন। তখন আমি বললাম, ‘বঙ্গবন্ধু আমি যদি আমার অফিসারদের জন্য না বলি তাহলে কে বলবে? গাজী গোলাম মোস্তফার এই ঘটনা আপনি তদন্ত করে দেখুন। আপনি যদি এ ব্যাপারে সাহায্য চান তাহলে আমি আপনাকে সাহায্য করতে প্রস্তুত আছি। যেহেতু ওরা গাজীর বিরুদ্ধে এবং আমিও তাদের পক্ষে, তাই গাজীর বিরুদ্ধেই বলেছি। তাই তিনি খুব খুশী হননি । তিনি শুধু বললেন, ‘শফিউল্লাহ, আপনি জানেন কি যে আপনি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা বলছেন? (ইংরেজি ভাষায়) আমি বললাম, ‘আমি জানি স্যার। আমি আমার জন্য কথা বলছি না; আমি কথা বলছি আপনার জন্য স্যার। মানুষ আপনাকে সত্য বলেনি। ঐ সময় জিয়া ও সাফায়াত জামিলও সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
প্রশ্নঃ তারপর কি হল?
উত্তরঃতারপর আমরা ওখান থেকে কোন বিচার না পেয়ে মনঃক্ষুন্ন হয়ে চলে আসি ৷ পরে দেখা গেল সরকার মেজর ডালিমকে সেনাবাহিনী থেকে বরখাস্ত করলেন।
♦ পাকিস্তানের রাজনীতির পরিণাম – স্বাধীনতার সংগ্রাম এবং আমাদের সিদ্ধান্ত
♦ কোলকাতায় অবস্থিত প্রবাসী সরকার এবং মুক্তিযুদ্ধ
♦ ভারতীয় নীলনকশা এবং মুজিব নগর সরকার
♦ আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসানো হল ; আদর্শিক দেউলিয়াপনা, কোন্দল ও ভাঙ্গন
♦ ৭১ এর চেতনার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা আওয়ামী কুশাসন এবং প্রতিরোধ
♦ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ বাংলাদেশ সামরিক বাহিনী এবং মুজিব সরকার
♦ আওয়ামী দুঃশাসন এবং দুর্নীতির মুখোমুখি সামরিক বাহিনী
♦ বহুদলীয় গণতন্ত্রকে কবর দিয়ে বাকশালী স্বৈরশাসন কায়েম
♦ শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা থেকে জাতিকে মুক্ত করতে ১৫ই আগষ্টের মহান বৈপ্লবিক অভ্যুত্থান
♦ প্রতিবিপ্লবী চক্রান্ত, মোশতাক সরকার এবং সেনা পরিষদ
♦ ৩রা নভেম্বরের ব্যর্থ ক্যু’দাতা এবং ৭ই নভেম্বরের সিপাহী জনতার সফল বিপ্লব
“আমি মেজর ডালিম বলছি” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ