আল্লাহ্ পাক বলেনঃ
خُذِ الْعَفْوَ وَامْرُ بِالْعُرْفِ وَأَعْرِضْ عَنِ الْجَاهِلِينَ – وَإِمَّا يَنْزَغَنَّكَ مِنَ الشَّيْطَانِ نَزْغٌ فَاسْتَعِذْ بِالله – انَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ .
‘ক্ষমাশীলতা অবলম্বন কর, সৎকার্যের নির্দেশ দাও এবং অজ্ঞদের পরিহার কর। এক্ষেত্রে যদি কখনও শয়তানের প্ররোচনা আসে, তখন আল্লাহ্র কাছে পানাহ চাও। নিশ্চয় তিনি সব শোনেন, সবই জানেন।
অন্যত্র তিনি বলেনঃ
اِدْفَعْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ السَّيِّئَةَ – نَحْنُ أَعْلَمُ بِمَا يَصِفُونَ – وَقُل رَّبِّ أَعُوذُبِكَ
مِنْ هَمَزَاتِ الشَّيَاطِينِ وَأَعُوذُبِكَ رَبِّ أَنْ يُحْضُرُونَ .
‘উত্তম ব্যবহার দ্বারা নিকৃষ্ট ব্যবহারকে প্রতিরোধ কর। তাহারা যাহা (মিথ্যা) আরোপ করে তাহা আমি ভালভাবেই জানি। তাই তুমি বল, প্রভু হে, শয়তানের প্ররোচনা হইতে আমি
তোমার নিকট আশ্রয় চাহিতেছি। এবং হে পরোয়ারদিগার, আমার নিকট তাহাদের উপস্থিতি হইতে আমি তোমার কাছে আশ্রয় লইতেছি।
তিনি আরও বলেনঃ
اِدْفَعْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ – فَإِذَا الَّذِي بَيْنَكَ وَبَيْنَهُ عَدَاوَةٌ كَأَنَّهُ وَلِيُّ حَمِيمٌ – وَمَا يُلَقَّاهَا إِلَّا الَّذِينَ صَبَرُوا ج وَمَا يُلَقَّاهَا إِلَّا ذُو حَظِّ عَظِيمٍ – وَإِمَّا يَنْزَغَنَّكَ مِنَ الشَّيْطَانِ نَزْغٌ فَاسْتَعذ بالله – انَّهُ هُوَ السَّمِيع العليم .
‘উত্তম ব্যবহার দ্বারা (নিকৃষ্ট ব্যবহারের) জবাব দাও। দেখিবে তোমার চরম শত্রু পরম বন্ধুতে পরিণত হইয়াছে। উহা শুধু সহিষ্ণু ব্যক্তিরাই পারে এবং বিরাট সৌভাগ্যবান ব্যক্তিরা ছাড়া উহা কেহ পারে না। তারপর যদি শয়তানের কুমন্ত্রণা আসে, তাহা হইলে আল্লাহর কাছে পানাহ চাও। নিশ্চয় তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ।’
উপরোক্ত আয়াতত্রয়ের সমার্থক অন্য কোন আয়াত নাই। উক্ত আয়াতসমূহে আল্লাহ্ তা’আলা মানব-শত্রুর সহিত ক্ষমাশীল, সহনশীল ও উদার ব্যবহার করিতে বলিয়াছেন। এরূপ ব্যবহারে শত্রুর অন্তর্নিহিত স্বাভাবিক সুপ্ত সদগুণাবলী জাগ্রত হইবে এবং নিজে নিকৃষ্ট স্বভাব ও আচরণের জন্য লজ্জিত হইবে। পরন্তু সৎ ও ভদ্র ব্যবহার করিতে উদ্বুদ্ধ হইবে। পক্ষান্তরে শয়তান-শত্রুর আক্রমণ হইতে আত্মরক্ষার জন্য উক্ত আয়াতসমূহে আল্লাহ্ তা’আলা শুধু তাঁহার নিকট আশ্রয় চাহিতে উপদেশ দিয়াছেন। কারণ, শয়তান মানুষের মহৎ, উদার ও ক্ষমাশীল ব্যবহারের কোন মূল্য দেয় না। সে মানব জাতির জনক আদম ও তাহার মধ্যকার তীব্র শত্রুতার কারণে মানুষের ধ্বংস ভিন্ন অন্য কিছুতে সন্তুষ্ট ও তৃপ্ত নহে।
যেমন আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ
يبد دم لأيَفْتَِتكُمٌ الشَيْطَانُ كَمَا آخْرَج أبْوَيْكُمْ مِنَ الجئة
‘হে আদম সন্তান ! শয়তান যেভাবে তোমাদের পিতা মাতাকে জান্নাত হইতে বাহির করিয়াছে, তদ্রূপ সে তোমাদিগকেও যেন বিপথগামী না করে।’
তিনি আরও বলেনঃ
إِنَّ الشَّيْطَانَ لَكُمْ عَدُوٌّ فَاتَّخِذُوهُ عَدُوا – إِنَّمَا يَدْعُوا حِزْبَهُ لِيَكُونُوا مِنْأصْحَابِ السَّعِيرِ –
“নিশ্চয় শয়তান তোমাদের শত্রু। অতএব তাহাকে শত্রুই বিবেচনা করিও। সে তাহার দলে যোগদানকারীদিগকে দোযখের বাসিন্দা হইবার জন্য আহবান জানায়।
অন্যত্র তিনি বলেনঃ
افتتخذونه وذريته اولياء من دونى وهم لكم عدو ط بنّس للظالمين بدلا
শয়তান ও তাহার মানসপুত্রগণ তোমাদের শত্রু হওয়া সত্ত্বেও আমাকে ছাড়িয়া তোমরা তাহাদিগকে বন্ধু বানাইবে? দূরাচারদের পরিণাম বড়ই খারাপ।
শয়তান হযরত আদম (আঃ)-কে শপথ করিয়া বলিয়াছিল, নিশ্চয়ই সে তাহার কল্যাণ চাহে। ইহা হইতে সহজেই অনুমেয় যে, সে আমাদের সহিত কিরূপ আচরণ করিবে । শয়তান তো বলিয়াই রাখিয়াছেঃ
فبعزتك لأعْوَيتُهم أَجَمَعيُّنَ الا عبادك منْهُم المُخلّصين তোমার মহা মর্যাদার শপথ ! তাহাদের সকলকে আমি বিভ্রান্ত করিব। বাদ থাকিবে শুধু তোমার নিবেদিত বান্দারা।’ শয়তানের কুমন্ত্রণা ও প্ররোচনা হইতে বাঁচার পন্থা নির্দেশ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ
فَإِذا قرأت الْقُرْآنَ فَاسْتَعِذْ بِالله مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّحِيمِ- إِنَّهُ لَيْسَ لَهُ سُلْطَانُ عَلَى الَّذِينَ آمَنُوا وَعَلى رَبِّهِمْ يَتَوَكَّلُونَ- إِنَّمَا سُلْطَانُهُ عَلَى الَّذِينَ يَتَوَلَّوْنَهُ : وَالَّذِينَ هُمْ بِهِ مُشْرِكُونَ –
“যখন তুমি কুরআন তিলাওয়াত কর, তখন বিতাড়িত শয়তান হইতে আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা কর। যাহারা ঈমান আনিয়া স্বীয় প্রতিপালকের উপর নির্ভরশীল হইয়াছে, তাহাদের উপর শয়তানের আধিপত্য নাই। শয়তানের কর্তৃত্ব চলে তাহাদের উপর যাহারা তাহাকে বন্ধু ভাবিয়াছে এবং আল্লাহর সহিত শিরকে লিপ্ত হইয়াছে।”
একদল ফকীহ্ ও কারী বলেন, কুরআন মজীদ তিলাওয়াত শেষে তিলাওয়াতকারী শয়তান হইতে আল্লাহ্র নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করিবে। তাঁহারা উপরোক্ত আয়াতের এইরূপ অর্থই করেন। তাঁহারা বলেন, আয়াতে আল্লাহ্ তা’আলা তিলাওয়াত শেষে তাঁহার নিকট শয়তান হইতে পানাহ চাহিতে নির্দেশ দিয়াছেন। তাঁহারা আরও বলেন, তিলাওয়াত রূপ ইবাদত সম্পন্ন করিবার পর তিলাওয়াতকারীর মনে ইবাদতের অহংকার আসিতে পারে। তাহা দূর করাও শয়তান হইতে আল্লাহ্র কাছে পানাহ্ চাওয়ার অন্যতম উদ্দেশ্য। সুতরাং উহা তিলাওয়াতের পরে হওয়াই সমীচীন ও যুক্তিযুক্ত।
আবূল কাসিম ইউসুফ ইব্ন আলী ইব্ন জুনাদাহ আল্ হাযলী আল্ মাগরেবী স্বীয় গ্রন্থ ‘আল ইবাদাতুল কামিল’ এ উল্লেখ করেন যে, ইব্ন ফাফুফা ও আবূ হাতিম সাজিস্তানী বর্ণনা করিয়াছেন, হযরত হামযা উপরোল্লেখিত মতের সমর্থক ছিলেন। হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ) হইতেও অনুরূপ একটি অভিমত বর্ণিত হইয়াছে। তবে তাঁহার বরাত দিয়া বর্ণিত উক্ত বর্ণনার কোন সমর্থন মিলে না। মুহাম্মদ ইবন উমর রাযী স্বীয় তাফসীর গ্রন্থে ইবন সীরীন হইতে অনুরূপ একটি অভিমত উদ্ধৃত করিয়াছেন। তিনি আরও বলেন, ইবরাহীম নাখঈ, দাউদ যাহেরী এবং ইবন আলী আল ইস্পাহানীও উক্ত অভিমত পোষণ করিতেন।
মাজমূআহ হইতে ধারাবাহিকভাবে আবূ বকর ইবনুল আরাবী ও ইমাম কুরতুবী বর্ণনা করেন যে, ইমাম মালিক (রঃ) বলিয়াছেন, তিলাওয়াতকারী তিলাওয়াত শেষে শয়তান হইতে আল্লাহর কাছে পানাহ চাইবে। ইবনুল ‘আরাবী অবশ্য উক্ত অভিমতকে সমর্থনের অযোগ্য বলিয়াছেন।
ইমাম কুরতুবী আরেকটি অভিমত উদ্ধৃত করিয়াছেন। তাহা এই যে, তিলাওয়াতকারী তিলাওয়াতের পূর্বে ও পরে উভয় সময় শয়তান হইতে আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করিবে। ইমাম রাযীও উপরোক্ত অভিমত উদ্ধৃত করিয়াছেন।
উক্ত অভিমতের প্রবক্তাগণ বলেন, এই অভিমত তিলাওয়াতের পূর্ব আর পরের ঝগড়ার অবসান ঘটায় এবং উভয় মতের ভিতর সমন্বয় সাধন করে।
অধিকাংশ ফকীর অভিমত এই যে, তিলাওয়াতকারী তিলাওয়াতের পূর্বে শয়তান হইতে আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করিবে যাহাতে শয়তান প্ররোচনা দিয়া তিলাওয়াতকারীকে তিলাওয়াত হইতে বিরত রাখিতে না পারে। এই মতটিই সর্বত্র খ্যাত ও সার্বজনীনভাবে স্বীকৃত।
এই মতের প্রবক্তারা বলেন, اذا قرت القُران অর্থ হইতেছে, ‘যখন তুমি কুরআন তিলাওয়াত করিতে ইচ্ছা কর।’ দৃষ্টান্তস্বরূপ তাহারা বলেনঃ
إذَا قُمْتُمْ إِلَى الصَّلوة আয়াতে یا اَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِذَا قُمْتُمْ إِلَى الصَّلوة الخ
অর্থ হইতেছে ‘যখন তোমরা সালাতে দণ্ডায়মান হইতে ইচ্ছা কর। اذا قرات القرأن -এর শেষোক্ত অর্থই সঠিক বলিয়া প্রমাণিত হয়।
হযরত আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে আবুল মুতাওয়াক্কিল আত্তাজী, আলী ইব্ন আলী আর রিফাঈ আল্ য়াশকারী, জা’ফর ইব্ন সুলায়মান; মুহাম্মদ ইব্ন হাসান ইবন আনাস এবং ইমাম আহমদ বর্ণনা করেনঃ
নবী করীম (সাঃ) রাত্রে নামাযে দাঁড়াইয়া তাকবীরে তাহরীমার পর বলিতেনঃ
سُبْحَانَكَ اللَّهُمَّ وَبِحَمْدِكَ وَتَبَارَكَ اسْمُكَ وَتَعَالَى جَدُّكَ وَلَا إِلَهَ غَيْرُكَ –
অতঃপর বলিতেনঃ لا اله الا الله
অতঃপর বলিতেনঃ أعُوذُ بالله السميع العليم من الشَّيْطَانِ الرَّحِيمِ مِنْ هَمْزهِ وَنَفْخِهِ وَنَفْته
(বলাবাহুল্য ইহা কিরাআতের পূর্বের ব্যাপার)।
ইমাম নাসাঈ, ইমাম আবূ দাউদ, ইমাম তিরমিযী ও ইমাম ইব্ন মাজাহ উপরোক্ত হাদীসটি. উহার অন্যতম রাবী জা’ফর ইবন সুলায়মান হইতে ঊর্ধ্বতন সনদাংশ সহ বিভিন্ন অধস্তন বর্ণনাকারীর মাধ্যমে বর্ণনা করিয়াছেন। ইমাম তিরমিযী বলিয়াছেন, এতদসম্পর্কিত হাদীসসমূহের মধ্যে উপরোক্ত হাদীসই অধিকতর খ্যাত।
কেহ কেহ الهمن النفخ النفث শব্দত্রয়ের অর্থ করিয়াছেন যথাক্রমে গলা টিপিয়া হত্যা করা, অহংকার ও কবিতা।
হযরত যুবায়র আল মুতইম (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে নাফে’ ইবন যুবায়র আল মুতইম, আসিম আল গুযী, আমর ইব্ন মুররা, শু’বা প্রমুখ রাবীর বরাত দিয়া ইমাম আবূ দাউদ ও ইমাম ইব্ন মাজাহ বর্ণনা করেনঃ
“হযরত যুবায়র আল মুতইম (রাঃ) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-কে দেখিয়াছি, তিনি নামাযের প্রারম্ভে তিনবার বলিতেনঃ أللهُ أكْبّر كَبِيْر
অতঃপর তিনি বলিতেনঃ أ لْحَمَدُ لله كَمْيْأ
অতঃপর তিনবার বলিতেনঃ سَيُحان الله ُكْرَةٌ وأصيلاٌ
অতঃপর বলিতেনঃ أللَّهُم انى أعوذيك من الشيطان من هَمْرْهٍ وَنَّقْثْمِ
আমর ইবন মুররা (রাবী) বলেন, الهمز অর্থ গলা টিপিয়া হত্যা করা النفخ অর্থ অহংকার ও النفث অর্থ কবিতা।
হযরত ইবন মাসউদ (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে আবূ আব্দুর রহমান সালমী, আতা ইব্ন সায়েব, ইবন ফুযায়েল, আলী ইব্ন মুনযির ও ইমাম ইবন মাজাহ বর্ণনা করেন যে, নবী করীম (সাঃ) বলিতেনঃ
اللهم انى أعُوذُبِكَ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّحِيمِ وَهمزه ونفع ونقته
রাবী বলেন— الهمز অর্থ গলা টিপিয়া হত্যা করা النفخ অর্থ অহংকার ও النفث অর্থ কবিতা ।
হযরত আবূ উমামা বাহেলী (রাঃ) হইতে জনৈক ব্যক্তি, তাহার নিকট হইতে ইয়ালা ইব্ন আতা, তাহার নিকট হইতে শরীক, তাহার নিকট হইতে ইসহাক ইব্ন ইউসুফ ও তাহার নিকট হইতে ইমাম আহমদ বর্ণনা করেনঃ
‘নবী করীম (সাঃ) নামাযে দাঁড়াইয়া তিনবার الله اكبر বলিতেন, তিনবার لا اله الاالله বলিতেন, তিনবার سبحان اللّه وبحمد বলিতেন। অতঃপর বলিতেনঃ
أعُوذُ بِاللَّهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ مِنْ هَمْزِهِ وَنَفْخِهِ وَنَفْتِه .
হযরত উবাই ইবন কা’ব (রাঃ) হইতে ক্রমাগত আবদুর রহমান ইব্ন আবূ লায়লা, আবদুল মালিক ইবন উমায়র, ইয়াযীদ ইবন যিয়াদ, আলী ইব্ন হিশাম, ইব্ন বারীদ, আবদুল্লাহ ইব্ন উমর ইবন ইবন কূফী ও হাফিজ আবূ ইয়ালা আহমদ ইব্ন আলী ইব্ন মুছান্না মওসেলী বর্ণনা করেনঃ
একদা দুইটি লোক রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর সামনে ঝগড়া করিতেছিল। ক্রোধে তাহাদের একজনের নাসিকা স্ফীত হইয়া উঠিল। রাসূল (সাঃ) বলিলেন, ‘আমি একটি বাক্য জানি। এই ব্যক্তি তাহা উচ্চারণ করিলে সে যাহা দ্বারা আক্রান্ত হইয়াছে তাহা দূর হইয়া যাইবে। বাক্যটি হইতেছেঃ أعودُ باللّه من الشَيْطان الرجِيْم “বিতাড়িত শয়তান হইতে আমি আল্লাহর নিকট আশ্রয় লইতেছি।’
ইমাম নাসাঈও اليوم والليلة গ্রন্থে উপরোক্ত হাদীস উহার অন্যতম রাবী ইয়াযীদ ইব্ন যিয়াদ হইতে উর্ধ্বতন সনদ সহ পরবর্তী ফযল ইব্ন মূসা ও ইউসুফ ইব্ন মূসা আল মারূযীর মাধ্যমে বর্ণনা করিয়াছেন।
হযরত মু’আয ইব্ন জারাল (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে আবদুর রহমান ইব্ন আবূ লায়লা, আব্দুল মালিক ইবন উমায়র, যায়দাহ ইব্ন কুদামা প্রমুখ রাবীর মাধ্যমেও ইমাম নাসাঈ উক্ত হাদীস বর্ণনা করেন। উক্ত হাদীসের অন্যতম রাবী আবদুল মালিক ইবন উমায়র হইতে ক্রমাগত সুফিয়ান ছাওরী, ইব্ন মাহদী ও বিন্দারের সনদে ইমাম নাসাঈ উহা اليوموالليلة গ্রন্থে উদ্ধৃত করেন। ইমাম তিরমিযীও উক্ত সনদে হাদীসটি বর্ণনা করেন। উপরোক্ত রাবী আবদুল মালিক ইবন উমায়র হইতে ক্রমাগত জারীর ইবন আবদুল হামীদ, ইউসুফ ইব্ন মূসা ও যায়দার বরাতে ইমাম আবূ দাউদ উহা বর্ণনা করেন। ইমাম আহমদও উপরোক্ত রাবী আবদুল মালিক ইব্ন উমায়র হইতে আবূ সাঈদের বরাতে বর্ণনাটি উদ্ধৃত করেন। মোটকথা, ইমাম নাসাঈ, ইমাম তিরমিযী, ইমাম আবূ দাউদ ও ইমাম আহমদ ভিন্ন ভিন্ন সনদে একই বর্ণনা উদ্ধৃত করেন। বর্ণনাটি এইঃ
“একদিন দুই ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর সামনে ঝগড়া করিতেছিল। তাহাদের একজন ভীষণ উত্তেজিত হইল । আমার (মু’আয ইব্ন জাবাল) মনে হইল ক্রোধে তাহার নাসিকা স্ফীত হইল। রাসূল (সাঃ) বলিলেন, ‘আমি একটি বাক্য জানি। এই ব্যক্তি তাহা উচ্চারণ করিলে সে যেই রোগ দ্বারা আক্রান্ত হইয়াছে, নিশ্চয় তাহা দূর হইবে।’ আমি বলিলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ্! উহা কি? তিনি বলিলেন, সে পড়িবেঃ
أللَهُم انَى أعوذبك من الشيطان الرّجيّم “আয় আল্লাহ্, আমি বিতাড়িত শয়তান হইতে তোমার নিকট আশ্রয় লইতেছি।’ হযরত মু’আয (রাঃ) তাহাকে উহা পড়িতে বলিলেন। কিন্তু সে তাহা পড়িল না এবং তাহার ক্রোধ বৃদ্ধি পাইতে লাগিল।”
ইমাম তিরমিযী বলিয়াছেন, হাদীসটি مرسل (বিচ্ছিন্ন)। কারণ, আবদুর রহমান ইব্ন আবূ লায়লা হযরত মু’আয ইব্ন জাবাল (রাঃ)-এর সাক্ষাত পান নাই। কারণ, তিনি বিশ হিজ্রীর পূর্বেই ইন্তেকাল করেন।
আমি (ইব্ন কাছীর) বলিতেছি, আবদুর রহমান ইব্ন আবূ লায়লা সম্ভবত হাদীসটি হযরত উবাই ইব্ন কা’ব (রাঃ) হইতে সরাসরি এবং হযরত মু’আয ইবন জাবাল (রাঃ) হইতে পরোক্ষভাবে শুনিয়াছেন। কারণ, উক্ত ঘটনা একাধিক সাহাবা প্রত্যক্ষ করিয়াছেন।
হযরত সুলায়মান ইব্ন সা’দ (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে ‘আদী ইব্ন ছাবিত, আ’মাশ, জারীর, উসমান ইব্ন আবূ শায়বা ও ইমাম বুখারী (রঃ) বর্ণনা করেনঃ
“একদিন দুই ব্যক্তি নবী করীম (সাঃ)-এর সামনে ঝগড়া করিতেছিল। আমরা তাঁহার খেদমতে উপবিষ্ট ছিলাম। তাহাদের একজন ক্রোধান্বিত হইয়া অন্যজনকে গালি দিতেছিল। তাহার মুখমণ্ডল রক্তিম হইয়া উঠিল। নবী করীম (সাঃ) বলিলেন, ‘আমি একটি বাক্য জানি। এই ব্যক্তি উহা পাঠ করিলে যাহা দ্বারা সে আক্রান্ত হইয়াছে, নিশ্চয় তাহা দূর হইয়া যাইবে। সে শুধু বলিবেঃ
أَعَوْدُ باللّه من الشَيْطان الرَجِيّم উপস্থিত লোকগণ তাহাকে বলিল, আল্লাহ্র রাসূল কি বলিতেছেন তাহা শুনিতেছ না? সে বলিল, আমি পাগল নহি।”
ইমাম বুখারী, ইমাম মুসলিম, ইমাম আবূ দাউদ এবং ইমাম নাসাঈ উক্ত হাদীসটি অন্যতম রাবী আ’মাশ হইতে পূর্ববর্তী সনদে ও পরবর্তী স্তরে ভিন্ন ভিন্ন সনদে বর্ণনা করেন ৷
الاستعاذه (শয়তান হইতে আল্লাহ্র নিকট আশ্রয় প্রার্থনা) সম্পর্কে বহু হাদীস রহিয়াছে। সকল হাদীস উল্লেখের স্থান ইহা নহে। আল্লাহ্ চাহেন তো আমার ‘কিতাবুল আযকার’ ও ‘ফাযায়েলুল আ’মাল’ গ্রন্থদ্বয়ে উহা বিশদভাবে আলোচিত হইবে। আল্লাহ্ই শ্রেষ্ঠতম জ্ঞানী। হাদীসে বর্ণিত হইয়াছে, হযরত জিবরাঈল (আঃ) কুরআন মজীদ লইয়া নবী করীম (সাঃ)-এর নিকট প্রথমবার আসিয়া তাঁহাকে الاستعاذه পাঠ করার জন্য বলেন।
হযরত ইব্ন আব্বাস (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে যিহাক, আবূ রাওক, বাশার ইন আম্মারাহ, উসমান ইব্ন সাঈদ, আবূ কুরায়ব ও ইমাম জা’ফর ইব্ন জারীর বর্ণনা করেনঃ ‘হযরত জিবরাঈল (আঃ) প্রথমবার কুরআনের বাণী লইয়া নবী করীম (সাঃ)-এর সমীপে উপস্থিত হইয়া তাঁহাকে বলিলেন, ‘হে মুহাম্মদ ! ‘ইস্তিআযাহ্’ পাঠ করুন। নবী করীম (সাঃ) পড়িলেনঃ أَسَتْعيْدُ بالله من الشيْطَان الرُجِيّْم
অতঃপর হযরত জিবরাঈল (আঃ) বলিলেন, আপনি বলুনঃ بسم اللّه الرحمن الرحيم
অতঃপর বলিলেনঃ افرأ باسم ربك الّذِى خَلَقَ الخ
হযরত ইব্ন আব্বাস (রাঃ) বলেন, ‘এই সূরাই হযরত জিবরাঈল (আঃ)-এর মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর নিকট অবতীর্ণ প্রথম সূরা।’
অবশ্য উক্ত হাদীস সমর্থিত নহে। শুধু জানাইবার জন্যই উহা উল্লেখ করিলাম । উহার সনদ দুর্বল । তাহা ছাড়া উহা حديث منقطع (ছিন্ন সূত্রের হাদীস)। আল্লাহ্ই অধিকতম জ্ঞানের অধিকারী।
অধিকাংশ ফকীহর মতে الاستعازه ফরয বা অপরিহার্য নহে; বরং উহা মুস্তাহাব। ইমাম রাযী বলেন, ‘আতা ইব্ন আবূ রিবাহ্র মতে, নামাযের ভিতরে ও বাহিরে কুরআন মজীদ তিলাওয়াতের পূর্বে ইস্তি’আযাহ ওয়াজিব । ইব্ন সীরীন বলিয়াছেন, জীবনে একবার ইস্তি‘আযাহ করিলেই ওয়াজিব আদায় হইয়া যাইবে। ‘আতা ইব্ন আবূ বিরার পক্ষে ইমাম রাযী নিম্নোক্ত দলীল পেশ করেনঃ
فَإِذَا قَرَاءتَ الْقُرْآنَ فَاسْتَعذ بالله من الشَّيْطَانِ الرَّحِيمِ
উক্ত আয়াতে আল্লাহ্ তা’আলা কুরআন পাঠের সময়ে ইস্তিআযাহ্ করার আদেশ করিয়াছেন। আদিষ্ট কাজ স্পষ্টতই ওয়াজিব। ইহার সপক্ষে তিনি নবী করীম (সাঃ)-এর কার্যধারাও প্রমাণ হিসাবে পেশ করিয়াছেন। নবী করীম (সাঃ) তিলাওয়াতের পূর্বে সর্বদা ইস্তি‘আযাহ্ করিতেন। অধিকন্তু উহা দ্বারা শয়তানের কুমন্ত্রণা ও প্ররোচনা প্রতিহত হয় । মূলত যে কার্যের সহায়তা ব্যতীত ওয়াজিব কার্য সম্পন্ন হইতে পারে না, তাহাও ওয়াজিব হয। সুতরাং ইস্তি’আযাহ্ ওয়াজিব। উহা ওয়াজিব হইবার ইহাও একটি পূর্বশর্ত।
কেহ কেহ বলেন, ইস্তিআযাহ শুধু নবী করীম (সাঃ)-এর জন্য ওয়াজিব ছিল। তাঁহার উম্মতের উপর ওয়াজিব নহে। ইমাম মালিক (রঃ) সম্পর্কে বর্ণিত হইয়াছে যে, তিনি ফরয নামাযে ইস্তিআযাহ্ করিতেন না। তিনি শুধু রমযানের প্রথ রজনীতে সুন্নাত (তারাবীহর) নামাযে ইস্তিআযাহ্ করিতেন।
ইমাম শাফেঈ (রঃ) তাঁহার الاملاء গ্রন্থে লিখিয়াছেনঃ মুসল্লীরা সরবে ইস্তিআযাহ্ পড়িবে। তবে নীরবে পড়িলে ক্ষতি নাই । তিনি তাঁহার الام গ্রন্থে বলেন, উহা উচ্চ কি অনুচ্চ যে কোন স্বরে পড়িলেই চলিবে। কারণ, হযরত উমর (রাঃ) অনুচ্চ স্বরে ও হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ) উচ্চ স্বরে পড়িতেন।
ইমাম শাফেঈ (রঃ) প্রথম রাক’আত ভিন্ন অন্যান্য রাক’আতে ইস্তিআযাহ্ পাঠ করাকে মুস্তাহাব বলেন কিনা তাহা লইয়া মতভেদ রহিয়াছে। একদলের মতে তিনি মুস্তাহাব বলেন। অন্যদলের মতে তিনি মুস্তাহাব বলেন না। শেষোক্ত মতই সবল। আল্লাহ্ই ভাল জানেন। ইমাম শাফেঈ (রঃ) ও ইমাম আবূ হানীফা (রঃ) বলেন, ইস্তি’আযাহ্ পাঠেঃ أعوذبك منالشيطان الرجيم বলিলেই চলিবে।
কেহ কেহ বলেন, উহাতে أعُوذُ باللهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ إِنَّ الله هُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ পড়িতে হইবে।
কেহ আবার أعوذ بالله من الشيتطان الرجيم ان الله هو السميع الْعليُم পড়িতে বলেন। সুফিয়ান ছাওরী, ইমাম আওযাঈ (রঃ) প্রমুখ বলেনঃ
‘পূর্ববর্ণিত আয়াত ও হযরত ইব্ন আব্বাস (রাঃ) হইতে যিহাক বর্ণিত হাদীসের ভিত্তিতে ইস্তিআযাহ্ নিম্নরূপঃ اَسْتَعِيذُ باللهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّحِيمِ
তবে উপরোক্ত হাদীস অধিকতর অনুসরণযোগ্য। আল্লাহ্ই সর্বজ্ঞ।
ইমাম আবূ হানীফা (রঃ) ও ইমাম মুহাম্মদ (রঃ) বলেন, নামাযে যে ইস্তিআযাহ্ পড়ার বিধান রয়েছে, উহা কুরআন মজীদের তিলাওয়াতের কারণে প্রদত্ত হইয়াছে। পক্ষান্তরে ইমাম আবূ ইউসুফ (রঃ) বলেন, উক্ত বিধান নামাযের কারণে প্রদত্ত হইয়াছে। তাই ইমাম আবূ ইউসূফ বলেন, মুক্তাদী নামাযে কিরাআত পড়িবে না বটে, তা‘আউয পড়িবে। তেমনি ঈদের নামাযে তাকবীরে তাহরীমার পরও অতিরিক্ত তাকবীরের পূর্বে ইস্তিআযাহ পড়িবে। পক্ষান্তরে অধিকাংশ ফকীহ বলেন, ঈদের নামাযে অতিরিক্ত তাকবীরের পর ইস্তিআযাহ্ পড়িতে হইবে।
ইস্তিআযার বিস্ময়কর উপকার এই যে, অন্যায় অশ্রাব্য বাক্য উচ্চারণের ফলে মুখে যে অপবিত্রতা লাগিয়া যায়, ইস্তিআযার ফলে তাহা ধৌত হয়। প্রকৃতপক্ষে মুখ হইতেছে পবিত্ৰ কালাম তিলাওয়াতের অঙ্গ। ইস্তিআযার বদৌলতে উহা পাক কালাম তিলাওয়াতের যোগ্যতা অর্জন করে। ইস্তিআযাহ্ দ্বারা শয়তানের মোকাবেলার জন্য আল্লাহ্ সাহায্য প্রার্থনা করা হয় ৷ ফলে আল্লাহ্ তা’আলার কাছে বান্দার নির্ভরতা ও অসহায়তা প্ৰকাশ পায়।
শয়তান মানুষের অদৃশ্য নিশ্চিত শত্রু। সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ্ তা’আলার সাহায্য ব্যতীত মানুষ তাহার অকল্যাণ হইতে বাঁচিতে পারে না। মানুষ মানুষের শত্রুতাকে উদারতা ও মহানুভবতা দিয়া বশ করিতে পারে, কিন্তু শয়তান উহাতে বশ হয় না। ইস্তিআযাহ্ সম্পর্কিত শুরুর তিন আয়াত ও নিম্নোক্ত আয়াত দ্বারাও প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ্ তা’আলার সাহায্য ছাড়া শয়তানের আক্রমণ প্রতিহত করার ক্ষমতা মানুষের নাই। আল্লাহ্ পাক বলেনঃ
ان عبّادئ لَيْس لَك عَلَيْهِمْ سلْطان وَكْفَى بِرَبّكَ وَكيّْلاً “নিশ্চয় আমার নেক বান্দার উপর তোমার কোন ক্ষমতা থাকিবে না। তোমার প্রতিপালকই অভিভাবক হিসাবে যথেষ্ট।”
এই সবের পরিপ্রেক্ষিতে ইস্তিআযাহ্ মানুষের জন্য অপরিহার্য। মানুষের আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য ফিরিশতা অবতীর্ণ হইয়াছিলেন। (অথচ শয়তানের আক্রমণ তো আরও মারাত্মক ) এই প্রেক্ষিতেও ইস্তিআযার গুরুত্ব অপরিসীম।
মানুষের আক্রমণে নিহত হইলে শহীদের মর্যাদা পায়। অথচ শয়তানের আক্রমণে পর্যুদস্ত হইলে আল্লাহ্র রহমত হইতে বঞ্চিত হয়। মানুষের হাতে পরাজয় বরণ করিলে আল্লাহ্র কাছে পুরস্কার পায়। পক্ষান্তরে শয়তানের কাছে পরাজিত হইলে পথভ্রষ্ট ও অভিশপ্ত হয়। তাই ইস্তিআযার গুরুত্ব অনস্বীকার্য।
শয়তান মানুষকে দেখে, কিন্তু মানুষ শয়তানকে দেখে না। তাই যে আল্লাহ্ শয়তানকে দেখেন, কিন্তু শয়তান তাঁহাকে দেখে না, সেই মহান শক্তির আশ্রয় ছাড়া শয়তানের হামলা হইতে বাঁচার বিকল্প পথ নাই। ইস্তিআযার গুরুত্ব এখানেই।