অহী অবতরণ পরিক্রমা
প্রথম হাদীসঃ ‘কিভাবে ওহী নাযিল হইল ও কোন্ আয়াত প্রথম নাযিল হইল’ শীর্ষক অধ্যায়ে ইমাম বুখারী (রঃ) বুখারী শরীফে হযরত ইব্ন আব্বাস (রাঃ) হইতে একটি হাদীস বর্ণনা করেন। উহাতে তিনি বলেনঃ
المهيمن অর্থাৎ الامين (সংরক্ষক)। আল-কুরআন যেহেতু অতীতের সকল আসমানী গ্রন্থের সংরক্ষক, তাই উহাকে ‘আল মুহায়মিন’ বলা হইয়াছে।’
হযরত আবূ সালমা (রাঃ) হইতে পর্যায়ক্রমে ইয়াহিয়া, শায়বান ও আব্দুল্লাহ্ ইব্ন মূসা (রঃ) বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেনঃ
‘আমাকে হযরত আয়েশা (রাঃ) ও হযরত ইব্ন আব্বাস (রাঃ) বলিয়াছেন- নবী করীম (সা)-এর মক্কী জীবনের দশ বছর ও মাদানী জীবনের দশ বছরে কুরআন অবতরণ সম্পন্ন হইয়াছে।’
হযরত ইব্ন আব্বাস (রাঃ) হইতে ইমাম বুখারী (রাঃ) যে ‘আল মুহায়মিন’ শব্দের ব্যাখ্যা বর্ণনা করিয়াছেন উহা দ্বারা তিনি সূরা মায়িদার তাওরাত ও ইঞ্জীল সম্পর্কিত আলোচনা প্রসঙ্গে আল্লাহ্ তা’আলার অবতীর্ণ এই আয়াতের প্রতি ইঙ্গিত প্রদান করিয়াছেনঃ
وَأَنْزَلْنَا إِلَيْكَ الْكِتُبَ بِالْحَقِّ مُصَدِّقًا لِمَا بَيْنَ يَدَيْهِ مِنَ الْكِتُبِ وَمُهَيْمِنًا عَلَيْهِ
‘আর আমি তোমার নিকট সত্যসহ আল-কিতাব নাযিল করিয়াছি যাহা পূর্ব প্রচলিত আসমানী গ্রন্থের সত্যায়ক ও উহার সংরক্ষক ৷’
হযরত ইব্ন আব্বাস (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে আলী ইব্ন তালহা, মুআবিয়া, আব্দুল্লাহ্ ইব্ন সালেহ, আল মুছান্না ও ইমাম আবূ জা’ফর ইব্ন জারীর (রঃ) বর্ণনা করেনঃ
مُهَيْمِنًا عَلَيْهِ আয়াতাংশের المهيمن অর্থ الامين (সংরক্ষক)। অর্থাৎ আল-কুরআন উহার পূর্ববর্তী সকল আসমানী গ্রন্থের সংরক্ষক।
অপর এক বর্ণনায় বলা হইয়াছেঃ مُهَيْمِنًا عَلَيْهِ অর্থ شهيداعَلَيْه অর্থাৎ পূর্ববর্তী সকল কিতাবের সত্যতা সম্পর্কে ও উহার অনুসারীদের বিকৃতি সাধনের ব্যাপারে আল-কুরআন সাক্ষ্য প্রদানকারী।
ইব্ন আব্বাস (রা) হইতে পর্যায়ক্রমে ইমাম আবূ ইসহাক সাবীঈ, সুফিয়ান ছাওরী ও একাধিক অন্যান্য ইমাম বর্ণনা করেনঃ مُهَيْمِنًا عَلَيْهِ অর্থাৎ موتمئا عليه (উহার আমানতদার)। মুজাহিদ, আস-সুদ্দী, কাতাদাহ, ইব্ন জুরায়জ, হাসান বসরীসহ পূর্বসূরী বহু ইমাম অনুরূপ ব্যাখ্যা দান করেন।
المهيمن -এর মর্মার্থ হইল الحفظ والارتقاب (সংরক্ষণ ও পর্যবেক্ষণ)। যখন কেহ কোন কিছু দেখাশোনা ও রক্ষণাবেক্ষণ করে, তখন বলা হয় قد هيمن عليه উহা দেখাশোনা করিয়াছে। তাই তাহাকে বলা হয়, مهيمن অর্থাৎ পর্যবেক্ষণকারী। আল্লাহ্ তা’আলার এক নাম المهيمن অর্থাৎ তিনি সকল কিছুরই পরিদর্শক, পর্যবেক্ষক ও সংরক্ষক।
যে হাদীসে বর্ণিত হইয়াছে যে, ‘নবী করীম (সাঃ) কুরআন নাযিলের দশ বছর মক্কায় ও দশ বছর মদীনায় ছিলেন, উহা ইমাম বুখারী (রঃ) তাঁহার বুখারী শরীফে একাই উদ্ধৃত করেন । মুসলিম শরীফে উহা উদ্ধৃত হয় নাই। অবশ্য নাসায়ী শরীফে ইব্ন আব্বাস (রাঃ) ও হযরত আয়েশা (রাঃ) হইতে উহা পর্যায়ক্রমে আবূ সালমা, ইয়াহিয়া ইব্ন কাছীর ও শায়বান ইব্ন আব্দুর রহমানের মাধ্যমে বর্ণিত হইয়াছে ।
ইব্ন আব্বাস (রাঃ) হইতে ক্রমাগত ইকরামা, দাউদ ইব্ন আবূ হিন্দ ইয়াযীদ ও আবূ উবায়দ আল-কাসিম বর্ণনা করেনঃ
“কদরের রাত্রিতে পৃথিবীর আকাশে কুরআন একই সঙ্গে অবতীর্ণ হইয়াছে। তারপর বিশ বছর ধরিয়া উহা (পৃথিবীতে) অবতীর্ণ হইয়াছে।” অতঃপর তিনি এই আয়াত পড়েনঃ
আর কুরআনকে আমি পৃথক পৃথক করিয়া নাযিল করিয়াছি যেন মানুষের কাছে তুমি উহা বিরতি সহকারে পাঠ কর এবং উহা আমি যথাযথভাবেই নাযিল করিয়াছি।” এই বর্ণনাটি বিশুদ্ধ।
‘নবী করীম (সাঃ)-এর মদীনার দশ বৎসর কুরআন নাযিল হওয়ার ব্যাপারে কোন দ্বিমত নাই। কিন্তু নবূওত লাভের পর তাঁহার মক্কায় দশ বৎসর অবস্থানের ব্যাপারটি প্রশ্ন সাপেক্ষ।
কারণ, মশহুর বর্ণনামতে উহা তের বৎসর। কারণ, তিনি চল্লিশ বৎসর বয়সে নবৃত্তত ও ওহী লাভ করেন এবং বিশুদ্ধ বর্ণনামতে তেষট্টি বৎসর বয়সে তিনি ইন্তিকাল করেন। সম্ভবত সংক্ষেপণের জন্য ইমাম বুখারী (রঃ) দশোর্ধ বৎসর কয়টি উল্লেখ করেন নাই। কারণ, আরবরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দশকের পরবর্তী ভগ্ন সংখ্যা অনুল্লেখ বা উহ্য রাখে। ইহাও হইতে পারে যে, ওহী লইয়া জিবরাঈল (আঃ)-এর আগমনের পরবর্তী কালটুকুই হিসাব করা হইয়াছে ও উহার পূর্ববর্তী কালটুকু ধরা হয় নাই। কারণ, ইমাম আহমদ (রঃ) বর্ণনা করেন- প্রারম্ভে মীকাঈল (আঃ) নবী করীম (সাঃ)-এর নিকট আসেন। তিনি নবী করীম (সাঃ)-এর প্রতি কোন আয়াত বা অন্য কিছু ‘ইলকা’ করিতেন। নবূওত ও ওহী নাযিলের ইহাই প্রথম স্তর। অতঃপর তাঁহার নিকট জিবরাঈল (আ) আসেন।
ফাযায়েলুল কুরআনের অধ্যায়ে উক্ত হাদীসটি উদ্ধৃত করার কারণ এই যে, কুরআনের অবতরণ শুরু হইয়াছে হারাম শরীফের মত সম্মানিত স্থানে ও রমযান শরীফের মত সম্মানিত মাসে। তাই মহাসম্মানিত কুরআনের সহিত সম্মানিত স্থান-কালের যে সংযোগ ঘটিয়াছে, উক্ত হাদীস হইতে তাহা জানা গেল।
এই কারণেই রমযান মাসে বেশী বেশী কুরআন তিলাওয়াত করা অভিপ্রেত বা মুস্তাহাব। যেহেতু রমযান মাসেই উহার অবতরণ শুরু হইয়াছে। তাই জিবরাঈল (আঃ)-ও রমযান মাসে আসিয়া রাসূল (সাঃ)-এর কুরআনের শুনানী নিতেন। তাঁহার ইন্তিকালের বৎসর জিবরাঈল (আঃ) দুইবার আসিয়া তাঁহার তিলাওয়াত শুনেন যাহাতে কুরআন তাঁহার স্মৃতিতে স্থায়ী হইয়া যায়।
উক্ত হাদীসে ইহাও জানা গেল যে, কুরআন মক্কা ও মদীনা উভয় স্থানে নাযিল হইয়াছে । উহার হিজরত পূর্ব আয়াতগুলি মক্কী ও হিজরত পরবর্তী আয়াতগুলি মাদানী-উহা মদীনা, মক্কা, আরাফাতসহ যে কোন শহরেই নাযিল হউক না কেন।
কুরআনের সূরাগুলিকে মক্কী ও মাদানী হিসাবে বিন্যাস করা হইয়াছে। মাদানী সূরাগুলির ব্যাপারে মদভেদ রহিয়াছে। একদল বলেন- প্রারম্ভে মুকাত্তাআত হরফ সংযুক্ত সূরাগুলি মক্কী শুধু বাকারা ও আলে-ইমরান বাদ যাইবে। তেমনি যেই সকল সূরায় মু’মিনগণকে সম্বোধন করা হইয়াছে তাহা মাদানী। পক্ষান্তরে যাহাতে মানব জাতিকে সম্বোধন করা হইয়াছে, তাহা মক্কী ও মাদানী উভয়ই হইতে পারে। তবে মক্কী হওয়ার সম্ভাবনাই বেশী। তবে কোন কোন মাদানী সূরায়ও উহা বিদ্যমান। যেমন সূরা বাকারায় ‘ইয়া আইউহান নাসু’বুদূ রব্বাকুমুল্লাযী খালাকাকুম’ ও ‘ইয়া আইউহান্নাসু কুলু মিম্মা ফিল আরদে হালালান তাইয়িবা।’ একদল অবশ্য এইরূপ সুনির্দিষ্টভাবে ভাগ করা দুরূহ ও অসম্ভব বলেন।
আবূ উবায়দ (রঃ) বলেনঃ আমাদিগকে আবূ মুআবিয়া, তাহাদিগকে একব্যক্তি আ’মাশ হইতে, তিনি ইবরাহীম হইতে ও তিনি আলকামা হইতে বর্ণনা করেনঃ কুরআনে যাহাই “ইয়া আইউহাল্লাযীনা আমানূ’ দ্বারা শুরু হইয়াছে, উহা মাদীনায় অবতীর্ণ হইয়াছে। পক্ষান্তরে যাহা “ইয়া আইউহান্নাসু’ দ্বারা শুরু হইয়াছে উহা মক্কায় অবতীর্ণ হইয়াছে। অতঃপর আলকামা বলেন- আমাদিগকে আলী ইব্ন মুআব্বাদ আবুল মালীহ হইতে ও তিনি মায়মূন ইব্ন মিহরা হইতে বর্ণনা করেনঃ
‘কুরআনে যাহা ‘ইয়া আইউহান্নাস’ ও ‘ইয়া বনী আদামা’ দ্বারা শুরু হইয়াছে তাহা মক্কী এবং যাহা ‘ইয়া আইউহাল্লাযীনা আমানূ’ দ্বারা শুরু হইয়াছে তাহা মাদানী।’
তাঁহাদের একদল বলেনঃ কোন কোন সূরা দুইবার নাযিল হইয়াছে। একবার মক্কায় ও একবার মদীনায়। আল্লাহ্ই ভাল জানেন। অপর একদল মক্কী সূরার কিছু আয়াত মাদানী বলিয়া আলাদা করেন। যেমন সূরা হজ্জ ইত্যাদির কিছু আয়াত। মূলত বিশুদ্ধ দলীল দ্বারা যাহা প্রমাণিত হয় শুধু তাহাই সত্য। আল্লাহই সর্বজ্ঞ।
আবূ উবায়দ (র) বলেনঃ আমাদিগকে আবদুল্লাহ্ ইব্ন সালেহ মুআবিয়া ইব্ন সালেহ, হইতে ও তিনি আলী ইব্ন আবূ তালহা হইতে বর্ণনা করেনঃ
“সূরা বাকারা, আলে ইমরান, নিসা, মায়িদা, আনফাল, তাওবা, হজ্জ, নূর, আহযাব, আল্লাযীনা কাফারূ, ফাতহ্, হাদীদ, মুজাদালা, হাশর, মুমতাহিনা, সাফ, তাগাবুন, ইয়া আইউহান্নাবীয় ইযা তাল্লাকতুমুন্ নিসা, ইয়া আইউহান্নাবীয্য লিমা তুহারিমু, (প্রথম দশ আয়াত) ওয়াল ফাজর, ওরাল্লাইলে ইযা ইয়াগশা, ইন্না আনযালনা, লাম ইয়া কুনিল্লাযীনা, ইযা যুলযিলাত ও ইযা জাআ নাসরুল্লাহ মদীনায় অবতীর্ণ হইয়াছে। ইহা ছাড়া আর সবই মক্কায় অবতীর্ণ হইয়াছে।(১)
‘ আবূ তালহার বর্ণনাটিই বিশুদ্ধ ও প্রসিদ্ধ ! তিনি ইব্ন আব্বাস (রাঃ)-এর সহচরগণের অন্যতম। তাঁহাদের নিকট হইতেই তাফসীর বর্ণিত হইয়া থাকে।
অবশ্য মাদানী বলিয়া আরও যে সকল সূরা চিহ্নিত করা হইয়াছে তাহার ভিতর কোন কোন সূরার মাদানী হওয়ার ব্যাপারে প্রশ্ন রহিয়াছে ৷ যেমন সূরা হুজুরাত ও মুআব্বিযাত।
দ্বিতীয় হাদীসঃ ইমাম বুখারী (রঃ) বলেনঃ আমাদিগকে মূসা ইব্ন ইসমাঈল ও তাঁহাদিগকে মু’তামার তাঁহার পিতা হইতে ও তিনি আবূ উসমান হইতে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন— আমি খবর পাইয়াছি যে, হযরত উম্মে সালামা (রাঃ)-এর সামনে হযরত জিবরাঈল (আঃ) আসিয়া রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর সঙ্গে কথা বলেন। তখন নবী করীম (সাঃ) হযরত উম্মে সালামা (রাঃ)-কে প্ৰশ্ন করেন- বল তো, এই লোকটি কে? তদুত্তরে তিনি বলিলেন- দাহিয়াতুল কালবী। তারপর যখন রাসূল (সা) মসজিদে গিয়া খুতবায় হযরত জিবরাঈলের আগমনের কথা বলিলেন, তাহা শুনিয়া হযরত উম্মে সালামা (রাঃ) বলিলেন- আল্লাহর কসম ! আমি তো দাহিয়া কালবী ছাড়া অন্য কেহ বলিয়া ভাবিতেই পারি নাই।
বর্ণনাকারী মু’তামার দ্বিধান্বিত হইয়া বলেনঃ আমার পিতা বলিয়াছেন, আমি আবূ উসমানকে প্রশ্ন করিলাম- আপনি কাহার নিকট এই বর্ণনা শুনিয়াছেন? তিনি বলিলেন- ‘উসামা ইবন যায়দের (রাঃ) নিকট।’ আব্বাস ইবন ওয়ালিদ আন নুরসী হইতে ‘আলামাতে নবূওত’ অধ্যায়ে অনুরূপ বর্ণনা উদ্ধৃত হইয়াছে। মুসলিম শরীফে ‘ফী ফাযায়েলে উম্মে সালামা’ অধ্যায়ে আবদুল আলা ইব্ন হাম্মাদ ও মুহাম্মদ ইব্ন আব্দুল আ’লার মাধ্যমে মু’তামার ইব্ন সুলায়মানের সূত্রে উহা উদ্ধৃত হয়। এখানে উক্ত হাদীস উদ্ধৃত করার উদ্দেশ্য ইহাই প্রতিপন্ন করা যে, আল্লাহ্ ও রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর মধ্যে হযরত জিবরাঈল (আঃ) দূতের দায়িত্ব পালন করেন । তিনি অত্যন্ত সম্মানিত ফেরেশতা। পদমর্যাদা ও প্রভাব প্রতিপত্তির বিচারে অত্যন্ত উঁচু স্তরের ফেরেশতা। যেমন আল্লাহ্ তা’আলা বলেঃ
تزل به الرأاخ الأصين على قليك لتكن من المثذريت বিশ্বস্ত আত্মার মাধ্যমেই উহা তোমার অন্তরে অবতীর্ণ হইয়াছে যেন তুমি সতর্ককারীদের অন্তর্ভুক্ত হও।’ তিনি অন্যত্র বলেনঃ
اته لقول دسول كريم ذئ قوة. عثة ذى الغذشر مكين مطاع تم آمين وماصاحبكم بحجْتن
“অবশ্যই এই কথা এক সম্মানিত দূতের; আরশে অবস্থানকারীর সকাশে প্রাপ্ত মর্যাদার বলে বলীয়ান; তথাকার সর্বজনমান্য বিশ্বস্ত সত্তা। আর তোমাদের সহচরও উন্মাদ নহে।
আল্লাহ্ তা’আলা এই সব আয়াতে তাঁহার বান্দা ও দূত জিবরাঈল (আঃ) ও মুহাম্মদ (সাঃ)-এর প্রশংসা করিয়াছেন। ইনশাআল্লাহ্ শীঘ্রই এই ব্যাপারে তাফসীরের যথাস্থানে সবিস্তারে আলোচনা করিব।
আলোচ্য হাদীসে হযরত উম্মে সালামা (রাঃ) -এর বিরাট ফযীলতের ব্যাপারটি প্রকাশ পাইয়াছে। ইমাম মুসলিম (রঃ)-এর বর্ণিত হাদীসে দেখা যায়, তিনি শ্রেষ্ঠতম ফেরেশতা জিবরাঈল (আঃ)-কে দেখিয়াছেন ও কথোপকথন শুনিয়াছেন। এই হাদীসে দাহিয়া কালবীরও মর্যাদা প্রকাশ পাইয়াছে। কারণ, জিবরাঈল (আঃ) অধিকাংশ সময়ে দাহিয়া কালবীর রূপ ধারণ করিয়া রাসূল (সাঃ)-এর কাছে আসিতেন। তিনি অত্যন্ত সুন্দর চেহারার লোক ছিলেন। উসামা ইবন যায়দ ইব্ন হারিছা কালবী তাঁহারই গোত্রের লোক ছিলেন। তাঁহারা উভয়ই কালব ইব্ন ওবেরার বংশধর এবং কুযাআ গোত্রের লোক। একদল বলেন- তাহারা আদনান সম্প্রদায়ের লোক । অপর দল বলেন- তাহারা কাহতান গোত্র হইতে আসিয়াছে। আবার কেহ কেহ বলেন- তাহারা স্বতন্ত্র এক গোত্র। আল্লাহ্ই সর্বজ্ঞ।
তৃতীয় হাদীসঃ আমাকে আব্দুল্লাহ্ ইব্ন ইউনুস, তাঁহাকে আল-লায়ছ, তাঁহাকে সাঈদ ইবনুল মাকবারী তাঁহার পিতা হইতে ও তিনি আবূ হুরায়রা (রাঃ) হইতে বর্ণনা করেনঃ
“নবী করীম (সাঃ) বলেন- প্রত্যেক নবীকে তাঁহার উপর যেই পরিমাণ লোক ঈমান আনিয়াছে সেই পরিমাণ দায়িত্ব ও ক্ষমতা দান করা হইয়াছে। সেমতে আমার উপর যে পরিমাণ ওহী আসিয়াছে তাহাতে আমি আশা করিতে পারি যে, কিয়ামতের দিন আমার অনুসারী সর্বাধিক হইবে।”
আব্দুল আযীয ইব্ন আব্দুল্লাহ্র ‘আল ইতিলাম’ গ্রন্থেও উক্ত হাদীস উদ্ধৃত হইয়াছে। মুসলিম ও নাসাঈ কুতায়বা হইতে এবং তাহারা সকলেই লায়ছ ইব্ন সা’দ হইতে, তিনি সাঈদ ইব্ন আবূ সাঈদ হইতে এবং তিনি তাঁহার পিতা কায়সানুল মাকবারী হইতে উহা বৰ্ণনা করেন।
এই হাদীসে কুরআনের শ্রেষ্ঠতম মর্যাদার প্রতি ইঙ্গিত দান করা হইয়াছে। অন্যান্য নবীর কাছে যত ওহী বা কিতাব নাযিল হইয়াছে, কুরআন তাহা হইতে সর্বদিক দিয়া শ্রেষ্ঠ ও কুরআনের মু’জিযা সকল গ্রন্থের মু’জিযাকে ডিঙাইয়া গিয়াছে। উক্ত হাদীসের তাৎপর্য ইহাই। উহাতে বলা হইয়াছে— এমন কোন নবী নাই যাঁহাকে মু’জিযা দেওয়া হয় নাই। অতঃপর তাঁহার সেই মু’জিযা অনুপাতেই তাঁহার উপর মানুষ ঈমান আনিয়াছে। অর্থাৎ তাঁহাকে সত্য বলিয়া মানিয়া লওয়ার জন্য যে দলীল প্রমাণ দেওয়া হইয়াছে তাহা যত বেশী শক্তিশালী, তত বেশী লোক তাঁহার উপর ঈমান আনিয়াছে। আম্বিয়ায়ে কিরামের ইন্তিকালের পর তাঁহাদের মু’জিযা ও শেষ হইয়া গিয়াছে। শুধু অবশিষ্ট রহিয়াছে তাঁহাদের প্রাপ্ত বাণী ও অনুসারীবৃন্দ। উহাই যুগ যুগ ধরিয়া তাঁহাদের মু’জিযার সাক্ষীরূপে বিরাজ করে। কিন্তু তাঁহাদের সেইসব আজ নিছক কাহিনী হিসাবে বিদ্যমান।
পক্ষান্তরে সর্বশেষ রাসূল মুহাম্মদ (সাঃ) -কে আল্লাহ্ তা’আলা ওহীর মাধ্যমে যে বিরাট ও মহান কিতাব দান করিয়াছেন তাহা ক্রমাগত যথাযথভাবে মানুষের কাছে পৌঁছিতেছে। প্ৰত্যেক যুগে ও প্রতি মুহূর্তে উহা যেইভাবে অবতীর্ণ হইয়াছিল সেইভাবে বিরাজ করিতেছে। এই কারণে রাসূল (সাঃ) বলিয়া গিয়াছেন- আমি আশা করি, কিয়ামতে আমার অনুসারীর সংখ্যা সর্বাধিক হইবে। ঘটিয়াছেও তাহাই। তাঁহার রিসালাতের ব্যাপ্তি ও সার্বজনীনতার কারণে অন্যান্য নবীর অনুসারী হইতে তাঁহার অনুসারীর সংখ্যা বেশী। বিশেষত কিয়ামত পর্যন্ত এই রিসালাতই অব্যাহত থাকিবে এবং তাঁহার মু’জিযাও ততদিন স্থায়ী থাকিবে। এই কারণেই আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ
تبرك اذئ تزل الرقان على عبدم ليكون للكلمين تذيرا মুবারক সেই মহান সত্তা যিনি তাঁহার বান্দার উপর আল-ফুরকান নাযিল করিয়াছেন যেন সে নিখিল সৃষ্টির জন্য সতর্ককারী হয়।
তিনি আরও বলেনঃ
قُلْ لَّئِنِ اجْتَمَعَتِ الْإِنْسَ وَالْجِنُّ عَلَى أَنْ يَأْتُوا بِمِثْلِ هَذَا الْقُرْآنِ لَا يَأْتُونَ بِمِثْلِهِ – وَلَوْ كَانَ بَعْضُهُمْ لِبَعْض ظهيراً
“বলিয়া দাও, যদি জ্বিন ও ইনসান সকলে মিলিয়া এই কুরআনের অনুরূপ কিছু উপস্থিত করিতে চায়, তাহা তাহারা আদৌ করিতে পারিবে না, যদিও তাহারা পরস্পরের সহায়তায় আগাইয়া আসে।”
অতঃপর আল্লাহ্ তা’আলা সমগ্র কুরআনের স্থলে মাত্র দশটি সূরা সৃষ্টির জন্য তাহাদিগকে আহ্বান জানান ৷ যেমনঃ
أَمْ يَقُولُونَ افْتَرَاهُ ، قُلْ فَأْتُوا بِعَشْرِ سُوَرٍ مِثْلِهِ مُفْتَرَيْتِ وَادْعُوا مَنِ اسْتَطَعْتُمْ مَنْ دُونِ اللَّهِ إِنْ كُنْتُمْ صَدِقِينَ
“তবে তাহারা কি উহাকে মিথ্যা বলিয়াছে? বলিয়া দাও, উহার মত দশটি সূরা আনয়ন কর ! আর আল্লাহকে বাদ দিয়া তোমাদের যাহারা উহা পারে তাহাদিগকেও ডাকিয়া লও- যদি তোমরা সত্যবাদী হও।”
অতঃপর তাহাদিগকে একটি মাত্র সূরার সমতুল্য সূরা সৃষ্টির সীমা নির্ধারণ করা হয়। তথাপি তাহারা ব্যর্থ হওয়ায় তিনি বলেনঃ
أَمْ يَقُولُونَ افْتَرَاهُ ، قُلْ فَأْتُوا بِعَشْرِ سُوَرٍ مِثْلِهِ مُفْتَرَيْتِ وَادْعُوا مَنِ ط اسْتَطَعْتُمْ مَنْ دُونِ اللَّهِ إِنْ كُنْتُمْ صَدِقِينَ
“অথবা তাহারা কি উহাকে মিথ্যা বলিতেছে? তুমি বল, তাহা হইলে উহার যে কোন সূরার মত একটি সূরা আন। আর আল্লাহ্ ছাড়া যাহারা তোমাদের ভিতরে উহা করিতে সাহায্য করিতে পারে তাহাদিগকে ডাকিয়া লও- যদি তোমরা সত্যবাদী হও।”
এই চ্যালেঞ্জগুলি মক্কী সূরার জন্য ছিল। অতঃপর মাদানী সূরার ব্যাপারে মদীনায় এই চ্যালেঞ্জ দেওয়া হয়। সূরা বাকারায় বলা হইয়াছেঃ
وَإِنْ كُنْتُمْ فِي رَيْبٍ مِّمَّا نَزَّلْنَا عَلَى عَبْدِنَا فَأْتُوا بِسُورَةٍ مِّنْ مِثْلِهِ وَادْعُوا شُهَدَاءَكُمْ مِنْ دُونِ اللَّهِ إِن كُنتُمْ صدقينَ – فَإِن لَّمْ تَفْعَلُوا وَلَنْ تَفْعَلُوا فَاتَّقُوا النَّارَ الَّتِي وَقُودُهَا النَّاسُ وَالْحِجَارَةُ لَا أُعِدَّتْ لِلْكَفِرِينَ
“আর যদি তোমরা আমার বান্দার উপর আমি যাহা অবতীর্ণ করিয়াছি তাহাতে সন্দিহান হও, তাহা হইলে উহার মত একটি সূরা আনয়ন কর। আর আল্লাহ্ ছাড়া তোমাদের যত সহায়ক রহিয়াছে তাহাদিগকে ডাকিয়া লও, যদি তোমরা সত্যবাদী হইয়া থাক। অতঃপর তোমরা উহা করিতে পার নাই এবং কখনও পারিবে না। অনন্তর সেই আগুনকে ভয় কর যাহার ইন্ধন হইবে মানুষ ও পাথর। উহা কাফিরগণের জন্য তৈরি করা হইয়াছে।”
আল্লাহ্ তা’আলা জানাইলেন যে, তাহারা অনুরূপ একটি সূরা সৃষ্টি করার চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করিতে ব্যর্থ হইয়াছে। আর ভবিষ্যতেও তাহারা কখনও তাহা পারিবে না। অথচ তাহারা তখনকার সেরা ভাষাবিদ, ভাষালংকারিক, কবি ও সাহিত্যিক ছিল। কিন্তু আল্লাহর তরফ হইতে তাহাদের সামনে এমন গ্রন্থ উপস্থিত হইল যাহারা সমকক্ষতা কি ভাষা, কি বিষয়বস্তু, কি ভাষালংকার, কি বাক্য-বিন্যাস, কি ছন্দ-স্পন্দন, কি ভাব-গভীরতা, কি উপমা-উৎপ্রেক্ষা, কি ব্যঞ্জনার ব্যাপ্তি ও সুদূর প্রসারতা, এক কথায় কোন ক্ষেত্রেই কোন মানুষের পক্ষে অতীতেও সম্ভব হয় নাই, ভবিষ্যতেও সম্ভব হইবে না। তেমনি উহার বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ, অজ্ঞাত-অতীত ও অজানা ভবিষ্যতের ইতিবৃত্ত এবং প্রজ্ঞাময় ইনসাফের বিধি-বিধান সর্বকালের জন্য অপ্রতিদ্বন্দ্বী থাকিবে।
যেমন আল্লাহ্ বলেনঃ
وتمت كلمة ربك صدقا وعدلا “আর তোমরা প্রভুর বাণী সততা ও ইনসাফে পূর্ণতায় পৌঁছিয়া শেষ হইল ।”
ইমাম আহমদ ইব্ন হাম্বল (রঃ) বলেনঃ আমাদিগকে ইয়াকূব ইবন ইবরাহীম, তাহাদিগকে তাঁহার পিতা, তাঁহাদিগকে মুহাম্মদ ইব্ন ইসহাক, মুহাম্মদ ইব্ন কা’ব হইতে এবং তিনি হারিছ ইব্ন আবদুল্লাহ্ আল-আওয়ার (রঃ) হইতে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেনঃ আমি একদিন সন্ধ্যাবেলা আমিরুল মু’মিনীনের (আলী কঃ) নিকট একটি ব্যাপারে জানার জন্য প্রশ্ন করিলাম। তিনি আমাকে ইশার পরে আসিতে বলিলেন। অতঃপর আমি যখন সেখানে গেলাম, তখন তিনি একটি হাদীস বর্ণনা করিলেন। তিনি বলিলেনঃ
“আমি রাসূল (সাঃ)-কে এইরূপ বলিতে শুনিয়াছি- আমার কাছে জিবরাঈল (আঃ) আসিয়া বলিলেন, হে মুহাম্মদ ! আপনার পরে আপনার উম্মতগণ বিভিন্ন দল-উপদলে বিভক্ত ও ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হইয়া যাইবে। আমি তখন তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম- হে জিবরাঈল ! উহা হইতে বাঁচার উপায় কি? তিনি বলিলেন- আল্লাহর কিতাবে উহার উপায় নিহিত রহিয়াছে। উহা দাম্ভিকগণকে চূর্ণ করিবে। যে ব্যক্তি উহা মজবুতভাবে আঁকড়াইয়া থাকিল, সে মুক্তি পাইল । আর যে উহা বর্জন করিল, সে ধ্বংস হইল। তিনি দুইবার ইহা বলিলেন। অতঃপর বলেনঃ উহা চূড়ান্ত বাণী এবং উহার বিলুপ্তি নাই। ভাষার বিভিন্নতা উহাকে বিকৃত ও বিভিন্ন করিতে পারিবে না এবং উহার বিস্ময়কারীতারও ক্ষতি সাধন করিতে পারিবে না। উহা তোমাদের অতীতের সংবাদবাহক, বর্তমানের চূড়ান্ত বিধায়ক ও পরবর্তীদের জন্য ভবিষ্যদ্বক্তা।” ইমাম আহমদের বর্ণনাও এইরূপ ৷
আবূ ঈসা তিরমিযী (রঃ) বলেনঃ আমাদিগকে আদ্ ইব্ন হুমায়দ, তাহাদিগকে হুসায়ন ইব্ন আলী আল জা’ফী, তাহাদিগকে হামযাহ আয্ যায়্যাত, আবুল মুখতার আত্ তায়ী হইতে, তিনি হারিছুল আওয়ারের ভাতিজা হইতে এবং তিনি হারিছুল আওয়ার (রঃ) হইতে বর্ণনা করেনঃ
إَّناَسِمْعَناقْرآًناعَجًباُيْهِديإَلىالُّرْشِدفَأَمَّنابه অর্থাৎ ‘নিশ্চয় আমরা আশ্চর্য এক কুরআন শ্রবণ করিয়াছি। উহা সঠিক পথের নির্দেশ দেয়। তাই আমরা ঈমান আনিয়াছি।’ তাই যে উহার আলোকে কথা বলে; সত্য বলে আর যে উহা আমল করে সে পুণ্য লাভ করে । উহার ভিত্তিতে যে রায় দেয় সে ইনসাফ করে; আর যে উহার দিকে ডাকে সে সিরাতুল মুস্তাকীমের দিকেই ডাকে । হে আওয়ার ! উহা মজবুত করিয়া ধারণ কর।
অতঃপর ইমাম তিরমিযী (রঃ) বলেন- হাদীসটি ‘গরিব’। শুধু হামযাহ আয্ যিয়াত ছাড়া আর কেহ এই হাদীস বর্ণনা করিয়াছে বলিয়া আমাদের জানা নাই। আর তাহার সূত্র অপরিজ্ঞাত। তাহা ছাড়া হারিছের হাদীসে ত্রুটি থাকে।
আমি বলি- হামযা ইব্ন হাবীব আয যিয়াত এই হাদীস একা বর্ণনা করেন নাই। উহা মুহাম্মদ ইব্ন ইসহাকও মুহাম্মদ ইব্ন কা’ব আল করযী হইতে এবং তিনি হারিছ আল আওয়ার হইতে বর্ণনা করিয়াছেন। সুতরাং হামযার এই বর্ণনায় নিঃসঙ্গতার প্রশ্ন আর থাকিল না। যদি তাহাকে হাদীস বর্ণনায় দুর্বল বলা হয়, তাহা হইলেও তাহাকে কিরাআতের ইমাম বলিয়া মান্য করা হয়। তবে হাদীসটি হারিছুল আওয়ারের সূত্রে বর্ণিত একটি মশহুর হাদীস। অবশ্য তাঁহার ব্যাপারে সমালোচনা রহিয়াছে। সমালোচকদের একদল তাঁহার মতামত ও ধ্যান-ধারণা সম্পর্কে প্রশ্ন তুলিয়াছেন। তথাপি তিনি জ্ঞাতসারে হাদীসের ব্যাপারে মিথ্যার আশ্রয় নিয়াছেন এমনটি হইতে পারে না। আল্লাহ্ই সর্বজ্ঞ ।
ইহাও সম্ভব যে, হাদীসটি মুলত হযরত আলী (রাঃ)-এর উক্তি। অবশ্য কেহ কেহ ইহাকে মারফূ’ মনে করিয়াছেন। তবে হাদীসের বক্তব্যকে ‘হাসান সহীহ’ বলা যায়। কারণ, উহার সমর্থনে হযরত আব্দুল্লাহ্ ইব্ন মাসউদ (রাঃ)-এর নবী করীম (সাঃ) হইতে বর্ণিত হাদীস রহিয়াছে। জ্ঞান জগতের ইমাম আবূ উবায়দ আল কাসিম ইব্ন সাল্লাম (রাঃ) তাঁহার ‘ফাযায়েলুল কুরআন’ গ্রন্থে বলেনঃ আমাদিগকে আবুল য়্যাকজান, তাহাদিগকে আম্মার ইবন মুহাম্মদ আছ ছাওরী কিংবা অন্য কেহ ইসহাক আল হিজরী হইতে, তিনি আবুল আহওয়াস হইতে, তিনি আব্দুল্লাহ্ ইব্ন মাসউদ (রাঃ) হইতে এবং তিনি নবী করীম (সাঃ) হইতে বর্ণনা করেন- ‘নিশ্চয় এই কুরআন আল্লাহর উপহার। তাই তাহার উপহার হইতে যত পার আহরণ কর। নিশ্চয় এই কুরআন আল্লাহ্র রজ্জু। উহা সুস্পষ্ট আলো ও কল্যাণপ্রদ দাওয়াই। যে উহা শক্ত হাতে ধারণ করিল, সে সুরক্ষিত হইল। যে উহা অনুসরণ করিল, সে মুক্তি পাইল। উহাতে কোন জটিলতা নাই যে, সরল করিতে হইবে। তেমনি উহাতে কোন কূটিলতা নাই যাহার জন্য নুতপ্ত হইবে। উহার অনুপমত্বে কোন ত্রুটি নাই। যতই উহার বিরোধিতা হউক, উহা সৃষ্টি করা যাইবে না। তাই উহা তিলাওয়াত কর। আল্লাহ্ তা’আলা উহার প্রতি হরফে দশ দশ নেকী দিবেন। আমি নিশ্চয় ইহা বলি না যে, আলিফ লাম মীম মিলিয়া এক হরফের পুণ্য হইবে; বরং আলিফে দশ, লামে দশ ও মীমে দশ নেকী পাইবে।’
এই সূত্রে অবশ্য হাদীসটি ‘গরিব’। তবে আবূ ইসহাক আল হিজরী হইতে উহা মুহাম্মদ ইব্ন ফুযায়েল বর্ণনা করিয়াছেন। তাঁহার আসল নাম ইবরাহীম ইব্ন মুসলিম। তিনি একজন তাবেঈ। কিন্তু তাঁহার ব্যাপারে অনেক কথা আছে। আবূ হাতিম আর রাযী বলেন- তিনি মজবুত বর্ণনাকারী নহেন। আবুল ফাতাহ ইযদী বলেন- তাহার মারফূ’ বর্ণনায় সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ থাকে। আল্লাহ্ই ভাল জানেন। আমি বলিঃ হয়ত হাদীসটি মূলত হযরত ইব্ন মাসউদ (রাঃ)-এর নিজস্ব উক্তি। সুতরাং উহাকে মারফূ’ করায় সংশয় সৃষ্টি হইয়াছে। তাহা হইলেও অন্য সূত্রে ইহার সমর্থন মিলে।
আবূ উবায়দ (রঃ) আরও বলেনঃ আমাদিগকে হাজ্জাজ- ইসরাঈল হইতে, তিনি আবূ ইসহাক হইতে, তিনি আব্দুল্লাহ্ ইব্ন ইয়াযীদ হইতে এবং তিনি আব্দুল্লাহ্ ইব্ন মাসউদ (রাঃ) হইতে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেনঃ
“কোন বান্দাকেই কুরআন সম্পর্কিত ব্যাপার ছাড়া অন্য কোন ব্যাপারে প্রশ্ন করা হইবে না। যদি সে কুরআনকে ভালবাসিয়া থাকে, তাহা হইলে অবশ্যই সে আল্লাহ্ ও আল্লাহর রাসূলকে ও ভালবাসে।”
চতুর্থ হাদীসঃ ইমাম বুখারী (রঃ) বলেন- আমাকে আমর ইব্ন মুহাম্মদ, তাঁহাকে ইয়াকুব ইব্ন ইবরাহীম, তাঁহাকে তাঁহার পিতা, সালেহ ইব্ন কায়সান হইতে এবং তিনি ইব্ন শিহাব হইতে একটি হাদীস বর্ণনা করেন। ইবন শিহাব বলেন- আমাকে আনাস ইবন মালিক (রাঃ) এই খবর পৌঁছাইয়াছেন যে, ‘আল্লাহ্ তা’আলা রাসূল (সাঃ)-এর উপর তাঁহার ইন্তিকাল পর্যন্ত ক্রমাগত ওহী পাঠাইতে থাকেন। তাঁহার মৃত্যুর প্রাক্কালে অধিকাংশ ওহী অবতীর্ণ হয়। অতঃপর তিনি ইন্তেকাল করেন।’
ইমাম মুসলিম (র)-ও উক্ত হাদীস আমর ইব্ন মুহাম্মদ (র) হইতে বর্ণনা করেন। তিনি একজন সমালোচকও। তাহা ছাড়া হাসান আল হালওয়ানী, আব্দ ইব্ন হামীদ ও ইমাম নাসায়ী, ইসহাক ইব্ন মানসূর আল-কাউসাজ হইতে উহা বর্ণনা করেন। তাহাদের চতুর্থ বর্ণনাকারী উহা ইয়াকূব ইব্ন ইবরাহীম ইব্ন সা’দ আয্ যুহরী (রঃ) হইতে বর্ণনা করেন।
হাদীসটির তাৎপর্য এই যে, আল্লাহ্ তা’আলা রাসূল (সাঃ)-এর উপর এক এক বিষয়ে প্রয়োজনীয় প্রতিটি ক্ষেত্রে ক্রমাগত ওহী নাযিল করিতে থাকেন । উহাতে কোন বিরতি ছিল না। শুধু জিবরাঈল ফেরেশতা ‘ইকরা বিসমি রাব্বিকা’ ওহী লইয়া আসার পর প্রায় দুই বছর কিংবা কিছু বেশী সময় বিরতি ঘটে। অতঃপর আবার ওহী চালু হয় ও উহা ক্রমাগত চলিতে থাকে। উক্ত বিরতির পর প্রথম নাযিল হইল ‘ইয়া আইউহাল মুদ্দাছছির, কুম ফাআনযির।”
পঞ্চম হাদীসঃ আমাকে আবূ নাঈম ও তাঁহাকে সুফিয়ান, আসওয়াদ ইব্ন কয়স হইতে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেনঃ আমি জুন্দুবকে বলিতে শুনিয়াছি যে, রাসূল (সাঃ) একরাত্রি কি দুইরাত্রি অসুস্থতার কারণে রাত জাগা ইবাদত করিতে পারেন নাই। তখন এক মহিলা আসিয়া তাঁহাকে বলিল- আমার মনে হয় তোমার ভূতটি তোমাকে ছাড়িয়া গিয়াছে। তখন আল্লাহ্ তা’আলা এই সূরা নাযিল করেনঃ
والُّضحى – والليل إذا سجى – ما ودعكربكوماقلى ‘উজ্জ্বল দিবস ও অন্ধকার রাত্রির শপথ ! তোমার প্রভু তোমাকে ত্যাগ করেন নাই এবং তোমরা উপর নারায ও হন নাই।’
ইমাম বুখারী (রঃ) এই হাদীসটি ইহা ছাড়াও অন্যত্র বর্ণনা করিয়াছেন। ইমাম মুসলিম, ইমাম তিরমিযী ও ইমাম নাসাঈ (রঃ) অন্য সূত্রে সুফিয়ান ছাওরী ও কু’বা ইবনুল হাজ্জাজ হইতে এবং তাহারা উভয়ই আসওয়াদ ইব্ন কয়স আল আব্দী হইতে ও তিনি জুনদুব ইব্ন আব্দুল্লাহ্ আল বাযালী (রঃ) হইতে উহা বর্ণনা করেন। সূরা আয্হার তাফসীর প্রসঙ্গে এই হাদীসটি পর্যালোচিত হইয়াছে।
ফাযায়েলুল কুরআনের সঙ্গে এই হাদীস ও পূর্ববর্তী হাদীসের সঙ্গতি এই যে, আল্লাহ্ তা’আলা তাঁহার রাসূলকে শ্রেষ্ঠতম অবদানে ধন্য করিয়াছেন এবং অত্যধিক ভালবাসার নিদর্শন স্বরূপ তাঁহার উপর ক্রমাগত ওহী অবতীর্ণ করিয়াছেন এবং তাঁহার ইন্তিকাল পর্যন্ত তাহা অব্যাহত ছিল। আল্লাহ্ তা’আলা তাঁহার উপর কুরআন ক্রমাগত পৃথক পৃথক করিয়া নাযিল করার ভিতর অবদানের পূর্ণত্ব ও মর্যাদা প্রকাশ পায়।
ইমাম বুখারী (রঃ) বলেনঃ কুরআন আরবের কুরায়েশের ভাষায় অবতীর্ণ হইয়াছে। আরবী কুরআন বিশুদ্ধতম আরবীতে নাযিল হইয়াছে। আমাকে আবুল ইয়ামান, তাঁহাকে শুআয়ব, যুহরী হইতে এবং তিনি আনাস ইবন মালিক (রাঃ) হইতে বর্ণণা করেনঃ
‘হযরত উসমান ইব্ন আফ্ফান (রাঃ) যায়দ ইব্ন ছাবিত, সাঈদ ইবনুল আস, আব্দুল্লাহ্ ইব্ন যুবায়র ও আব্দুল্লাহ্ ইব্ন হারিছ ইব্ন হিশামকে নির্দেশ দিলেন- কুরআন গ্রন্থাকারে লিপিবদ্ধ কর এবং যেখানে তোমাদের ভিতর ভাষার ক্ষেত্রে মতভেদ দেখা দিবে, সেখানে তোমরা কুরায়েশের ভাষায় উহার সমাধান খুঁজিও। কারণ, কুরআন তাহাদের ভাষায় অবতীর্ণ হইয়াছে। অতঃপর তাহারা তাহাই করিল।’
এই হাদীসটি মূলত অপর এক হাদীসের অংশমাত্র। শীঘ্রই সেই হাদীস নিয়া পর্যালোচনা করিব। ইমাম বুখারীর উদ্দেশ্য সুস্পষ্ট। তাহা এই যে, কুরআন কুরায়শদের ব্যবহৃত ভাষায় অবতীর্ণ হইয়াছে এবং কুরায়শগণ আরব জাতির প্রাণসত্তা। তাই আবূ বকর ইব্ন দাউদ (রঃ) বলেনঃ আমাকে আবদুল্লাহ্ ইব্ন মুহাম্মদ ইব্ন খাল্লাদ ও তাহাকে ইয়াযীদ ইব্ন শায়বান ইব্ন আবদুল মালিক ইবন উমায়র ইবন জাবির ইব্ন মায়সারাহ্ বলেনঃ
“আমি উমর ফারূক (রাঃ)-কে বলিতে শুনিয়াছি যে, আমাদের কুরআনের বর্তমান গ্রন্থনার পিছনে রহিয়াছে দুইজন কুরায়শ ও দুইজন বনূ ছকীফের তরুণের ভাষা নির্দেশনা।” এই সনদটি বিশুদ্ধ। আবূ বকর ইব্ন দাউদ আরও বলেন; আমাকে ইসমাঈল ইব্ন আসাদ, তাহাকে হাজ্জাজ, তাহাকে আওফ ইব্ন আব্দুল্লাহ্ ইব্ন ফুলা (রঃ) বর্ণনা করেন- হযরত উমর ফারূক (রাঃ) যখন ইচ্ছা করিলেন কুরআনের লিপিবদ্ধকরণ, তখন তাঁহার একদল সহচরকে বসাইয়া দিলেন এবং বলিলেন- তোমরা যখন ভাষার ব্যাপারে মতানৈক্যে জড়াইবে, তখন মুযর গোত্রের ভাষা অনুসরণ করিবে। কারণ, কুরআন মুযর গোত্রের এক ব্যক্তির ভাষায় অবতীর্ণ হইয়াছে । স্বয়ং আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ
قْرآَناعَرِبًّياغْيَرذيموجلَعَّلُهْميَّتُقوَن “কুরআন সরল আরবী ভাষায় বক্রতামুক্ত (অবতীর্ণ হইয়াছে) যেন তাহারা সতর্ক হয়।” আল্লাহ্ তা’আলা আরও বলেনঃ
وِإَّنُه لَتْنِزيُل رِّباْلَعَلِميَننَزَلبِهالُّروُحاْلآِميُن عَلىقْلِبَكلَتُكوَنمَناْلُمْنِذِريَن بلسانعَرِبيُّمِبين
“আর নিশ্চয় উহা (কুরআন) অবশ্যই নিখিল সৃষ্টির প্রতিপালকের তরফ হইতে অবতীর্ণ। তিনি বিশ্বস্ত আত্মার মাধ্যমে উহা তোমার অন্তরে অবতীর্ণ করিয়াছেন। যেন তুমি সতর্ককারীগণের অন্যতম হও। সুস্পষ্ট আরবীতে (উহা অবতীর্ণ হইয়াছে)। “
তিনি আরও বলেনঃ
وُهَذالَساُنعَرِبيُمِبيٌن “আর ইহা (কুরআন) সুস্পষ্ট আরবী ভাষা।”
অন্যত্র তিনি বলেনঃ
وَلْوجَعْلَنُهقْرآًناأْعَجِمًيالَقاُلواَلْولافِصَلْتاْيَتُهأْعَجِمٌّيوَعَرِبُّي “যদি আমি আজমী ভাষায় উহা (কুরআন) রচনা করিতাম, অবশ্যই তাহারা বলিত, কেন উহা আজমী ও আরবী ভাষায় রচিত হইল না?”
মোটকথা, ইত্যাকার আরও বহু আয়াত প্রমাণ করে যে, কুরআন বিশুদ্ধ ও নির্ভেজাল আরবী ভাষায় অবতীর্ণ হইয়াছে ৷
অতঃপর ইমাম বুখারী (রঃ) ইয়ালী ইবন উমাইয়া (রাঃ)-এর হাদীসটি উদ্ধৃত করেন। তিনি বলিতেন- হায়, আবার যদি রাসূল (সাঃ)-এর উপর ওহী নাযিল হওয়া দেখিতে পাইতাম ! অতঃপর তিনি সেই হাদীসটি বর্ণনা করেন যাহাতে এক মুহরিম উমরাহ্ সময় ইহরামের অবস্থায় সুগন্ধী লাগানো সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করিল। তাহার গায়ে জুব্বা ছিল। বর্ণনাকারী বলেন- রাসূল (সাঃ) তাহার দিকে কিছুক্ষণ তাকাইলেন। ইত্যবসরে ওহী আসিল। তখন উমর (রাঃ) ইয়ালী (রাঃ) -কে কাছে আসার জন্য ইশারা করিলেন। ইয়ালী (রাঃ) আসিয়া মাথা ঢুকাইয়া ওহী নাযিলের অবস্থা দেখার প্রয়াস পাইলেন। তিনি দেখিলেন- রাসূল (সাঃ)-এর চেহারা মুবারক লাল হইয়া গিয়াছে এবং কিছুক্ষণ তিনি ধ্যানমগ্ন রহিলেন। অতঃপর স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়া আসিলেন। তখন তিনি বলিলেন- উমরাহ্ সময় ইহরামের অবস্থায় সুগন্ধী লাগানো সম্পর্কে প্রশ্নকারী ব্যক্তি কোথায়? সে উপস্থিত হইলে রাসূল (সাঃ) তাহাকে সুগন্ধী লাগানো জুব্বা খুলিয়া ফেলিতে ও দেহে লাগানো সুগন্ধী ধুইয়া ফেলিতে বলিলেন।
উক্ত হাদীসটি একদল বর্ণনাকারী বিভিন্ন সনদে বর্ণনা করিয়াছেন। কিতাবুল হজ্জে উহা পর্যালোচনাযোগ্য। বর্তমান অধ্যায়ের সহিত উহার সঙ্গতি সুস্পষ্ট নহে, বরং হজ্জের অধ্যায়ের সহিতই উহার সঙ্গতি সুস্পষ্ট। আল্লাহ্ই সর্বজ্ঞ।